ফেরাউন মারনেপতাহর মমি
এ পর্যন্ত যেসব প্রমাণপঞ্জি তুলে ধরা হল, তা থেকে একটা বিষয় সাব্যস্ত হয়ে যায়, মিসররাজ দ্বিতীয় রামেসিসের সন্তান মারনেপতা-ই ছিলেন সেই ফেরাউন, যিনি হযরত মুসার নেতৃত্বে ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন এবং মারা পড়েছিলেন সমুদ্রে ডুবে। এই ফেরাউন মারনেপোহর মমিকৃত দেহটি আবিষ্কার করেন মিঃ লরেট ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে থেবেসের রাজকীয় উপত্যকা থেকে। সেখান থেকে মমিটিকে কায়রো নিয়ে আসা হয়। ১৯০৭ সালের ৮ই জুলাই এলিয়ট স্মীথ এই মমিটির আবরণ উন্মোচন করেন : তিনি তাঁর ‘রয়্যাল মামিজ’ পুস্তকে (১৯১২) এই আবরণ উনোচন এবং মমিটির দেহ পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই বিবরণ থেকে জানা যায়, কয়েকটি জায়গায় কিছু কিছু বিকৃতি ঘটলেও মোটের উপর লাশটি সন্তোষ জনকভাবে সংরক্ষিত ছিল। সেই থেকে কায়রোর যাদুঘরে পর্যটকদের দর্শনের জন্য মমিটিকে রেখে দেয়া হয়েছে। মমিটির মাথা ও ঘাড়টি ভোলা, বাদবাকি দেহটা কাপড়ে ঢাকা। প্রদর্শনের এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও মমিটিকে এমন কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যে, কাউকে ওই মমিটির ফটো পর্যন্ত তুলতে দেয়া হয় না। সেই ১৯১২ সালে স্মথের তোলা ফটোগুলো ছাড়া আর কোনো ফটো যাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিকটও যায়নি।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ মেহেরবানী করে ডা. মরিস বুকাইলিকে মমিটির শরীরের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে দেখার অনুমতি দেন। এতদিন যাবত মমিটির দেহের এসব অংশ কাপড়েই ঢাকা পড়ে ছিল। কর্তৃপক্ষ আমাকে মমিটির শরীরের বিভিন্ন অংশের ফটো তোলারও অনুমতি দিয়েছিলেন। ষাট বছরের উপর হয়ে গেছে, মমিটি প্রথম আবিস্কৃত হয়। তখনকার অবস্থার সাথে মমিটির বর্তমান অবস্থার তুলনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, মমিটির অবস্থার অনেক অবনতি ঘটেছে, এবং দেহের বিভিন্ন অংশের বেশকিছু টুকরা খসে পড়েছে বা হারিয়ে গেছে। মমিকৃত লাশটির টিসুগুলোর অবস্থাও নাজুক। এরকমটি হয়েছে কতকটা মানুষের হাতের নাড়াচাড়ায়, আর বাদবাকিটা হয়েছে। কালের নির্মম স্বাক্ষরে।
প্রাকৃতিক কারণেই যে মমিটির এই দুরবস্থা তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই মমিটি আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকে এর সংরক্ষণ-ব্যবস্থারও ঘটেছে পরিবর্তন। আগেই বলেছি, মমিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল থেবেসের নেক্রোপলিস কবরখানায়। সেখানে মমিটি শায়িত ছিল তিন হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে। অধুনা, মমিটিকে এখন সাধারণ একটি কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছে যা বাইরের বাতাসের অনুপ্রবেশ ও আবহাওয়ার প্রতিক্রিয়া ঠেকাবার মোটেও উপযোগী নয়। তাছাড়া, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীবাণুকণার আক্রমণ প্রতিহত করাও এই কাঁচের বাক্সের পক্ষে অসম্ভব। এদিকে, তাপমাত্রা ওঠানামা,–আর্দ্র আবহাওয়ার ঋতু পরিবর্তনের ধকল। তিন হাজার বছর আগেকার মমিকৃত কোনো লাশের পক্ষে পরিস্থিতির এই ধকল সামলানো মুশকিল : মমির অবস্থার অবনতিই বরং স্বাভাবিক। এতকাল যাবত মমিটি যে আচ্ছাদনে জড়ানো ছিল–সে আচ্ছাদনও এতদিনে তার সংরক্ষণ-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া, এরআগে মমিটি কবরের বদ্ধ কুঠুরিতে এমন অবস্থায় ছিল যেখানে তাপমাত্রা ছিল বরাবর প্রায় একরকম; তথাকার বায়ুর আর্দ্রতা কায়রোর সময়বিশেষের আর্দ্রতার চেয়ে কম। অবশ্য, একথাও সত্য যে, নেক্রোপলিসে থাকাকালে মমিটিকে প্রায়ই কবর-ডাকাতদের হামলা সহ্য করতে হত (প্রথমদিকে সম্ভবত তাই হয়ে থাকবে)। এছাড়াও, ছিল ইঁদুরসহ বিভিন্ন পোকামাকড়ের উপদ্রব। এসব কারণেই মমিটির অনেক ক্ষতি ইতিমধ্যেই সাধিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, তবুও (মনে হয়। বর্তমানে মমিটি যে পরিস্থিতিতে পড়ে রয়েছে, তারচেয়ে অতীতের পরিস্থিতিই যেন সংরক্ষণের ব্যাপারে বেশি অনুকূল ছিল।
যাহোক, আমার পরামর্শক্রমে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে মমিটিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি বিশেষ টীম গঠন করা হয়। ডক্টর এল, মেলিগাই ও ডক্টর র্যামসিয়ীস-এর দ্বারা মমিটির উপর চমৎকারভাবে রেডিওগ্রাফিক স্টাডি পরিচালিত হয়। ডক্টর মুস্তফা মানিয়ালভী মমিটির বুকের একটি ফাঁকা জায়গা দিয়ে বুকের ভেতরটাও ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। এছাড়াও, মমিটির পেটেও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালানো হয়। কোনো মমির উদরের অভ্যন্তরে এ ধরনের পরীক্ষা ও তদন্ত পরিচালনা এটাই প্রথম।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড. মরিস বুকাইলি মমিটির অভ্যন্তরভাগের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিস্তারিতভাবে জানার এবং সেসবের ফটো তোলার সুযোগ পান। অধ্যাপক সেসালডির দ্বারা মমিটির উপরে পরিচালিত হয়েছিল মেডিকো লিগ্যাল স্টাডি। মমিটির দেহ থেকে খসে পড়া একটি টুকরো অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই চূড়ান্ত পরীক্ষা ও গবেষণা পরিচালিত হয়।
এইসব পরীক্ষা ও তদন্তের ফলে উপস্থিত যা জানা গেছে, তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেখা গেছে, মমিটির হাড়ে একাধিক ক্ষত বিদ্যমান। সেগুলোতে ফাঁকও রয়েছে বড় বড়। তাদের কোনো-কোনোটা সম্ভবত ক্ষয়ে গিয়ে থাকতে পারে। তবে যাই হোক, সেগুলো ফেরাউনের মৃত্যুর আগে হয়েছে না পরে হয়েছে এখন তা নির্ণয় অসম্ভব। মমিটি পরীক্ষা করে আরো যা পাওয়া গেছে তাতে বলা যেতে পারে যে, এই ফেরাউনের মৃত্যু ঘটেছে–ধর্মগ্রন্থে যেমনটি বলা হয়েছে–পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে কিংবা পানিতে ডুবে যাওয়ার প্রাক্কালে নিদারুণ কোনো ‘শকের’ দরুন। আবার এইসঙ্গে সংঘটিত এই দু’টি কারণেও তাঁর মৃত্যু ঘটা বিচিত্র নয়।
উপরে মমিটির দেহে ও অস্থিতে ক্ষতের যে কথা বলা হয়েছে এবং সেই সাথে গোটা মমির অবস্থার অবনতির যে চিত্র তুলে ধরা হল, তাতে ফেরাউনের এই মমিকৃত লাশটি সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য অতিসত্ত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। কেননা, যতই দিন যাবে, সমস্যাটা প্রকট হতে প্রকটতর হবে। এখনো মমিটির যে অবস্থা অবশিষ্ট রয়েছে এবং এখনো যা-কিছু কালের প্রবাহে লুপ্ত হয়নি তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সত্যিই অপরিসীম। কেননা, একমাত্র এই উপায়ে ইহুদীদের মিসরত্যাগের সাথে সংশ্লিষ্ট এই ফেরাউনের মৃত্যু সত্যি কিভাবে ঘটেছিল, এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তার মরদেহই বা কিভাবে উদ্ধার পেয়েছিল, তার বাস্তব প্রমাণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব।
ইতিহাসের নিদর্শনাবলীর সংরক্ষণ সবারই কাম্য। কিন্তু এখানে যে মমিটির সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, তা শুধু নিছক কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়; এ মমিটির গুরুত্ব তারচেয়েও অনেক বেশি। এটি এমন একজন মানুষের মরদেহ, হযরত মুসার সাথে যার পরিচয় হয়েছিল, যে মানুষটি হযরত মুসার ধর্মীয়-প্রচার প্রতিহত করতে চেয়েছিল, এবং হযরত মুসা যখন ইহুদীদের নিয়ে মিসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই লোকটিই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছিল; আর ধাওয়া করতে গিয়েই মারা পড়েছিল সমুদ্রের পানিতে ডুবে। আল্লাহর ইচ্ছাতেই তার মরদেহ ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছে এবং কোরআনের বাণী অনুসারেই ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য তা নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে সংরক্ষিত।
এ যুগের অনেকেই আধুনিক তথ্য-প্রমাণের আলোকে ধর্মীয় গ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে চান। তাঁদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন মেহেরবানী করে কায়রো যান এবং তথাকার মিসরীয় যাদুঘরে রয়্যাল মামিজ উল্লেখ্য, (রামেসিসের মমিটির উপরও ফেরাউন মারনেপতাহহর মমির মতই পরীক্ষা ও তদন্তকার্য পরিচালিত হয়েছে)। এই মমিটির জন্যও অনুরূপ সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন।
১৯৭৫ সালে কায়রোতে ফেরাউনের মমির উপরে যে মেডিক্যাল তদন্ত পরিচালিত হয়, তার লিখিত ফলাফল ১৯৭৬ সালের প্রথমদিকে ডঃ মরিস বুকাইলি (ফরাসী উচ্চারণ, মরিস বুকাই) নিজেই তা একাধিক সুধি-সমাবেশে পেশ করেন। উল্লিখিত সুধি-সমাবেশের মধ্যে যেমন একাধিক বিদগ্ধ সমিতির নানা অধিবেশনের কথা বলতে হয়, তেমনি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ফ্রান্স ন্যাশনাল একাডেমীর অধিবেশনের কথাও। যাহোক, তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় রামেসিস-এর মমিটি চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে মোতাবেক, ১৯৭৬ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর মমিটি প্যারিসে পৌঁছে। যাদের পক্ষে সম্ভব তাঁরা সংরক্ষিত ফেরাউনের এই মমিটি দর্শন করে আসবেন। আর তা হলেই তারা বুঝতে পারবেন, কোরআনের আয়াতে ফেরাউনের মরদেহ সংরক্ষণ সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে, তার বাস্তব উদাহরণ কত জাজ্বল্যমান।