ফেউ
এক
আমি বিরাট বিপদের মধ্যে পড়েছি।
হাতে মাত্র সাতদিন সময়। এর মধ্যে আমাকে রিপোর্ট তৈরি করে কলকাতার অফিসে পাঠাতে হবে। রিপোর্ট তৈরির জন্য গত পাঁচ বছরের হিসেব ঘাঁটতে হচ্ছে। সেখানে বড় ধরনের গোলমালের ইঙ্গিত পেয়েছি। আমার কি কোথাও ভুল হচ্ছে?
মাত্র তিনমাস হল এখানে এসেছি। তাও পুরো তিন মাস হয়নি। চার-পাঁচ দিন এখনও বাকি। এই গোলমেলে কাজ আমি একা সামলাব কী করে? একেই তো একটা অজ পাড়াগাঁয়ে বদলি করছে, তার ওপর ভালো করে দায়িত্ব বুঝতে না বুঝতে একটা কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট ঘাড়ে চাপল!
টেনশনে সেই সকালে অফিসে চলে এসেছি। তখনও কেউ আসেনি। আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি রয়েছে। এখানে অফিসারের কাছে একটা চাবি থাকে। আমাদের অফিস ছোট, স্টাফও কম। মাধব পাল হেড ক্লার্ক। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করেন। এই অফিসের নাড়িনক্ষত্র ওঁর জানা। বয়েসে আমার থেকে অনেকটাই বড়। আমার ছত্রিশ, ওর পঞ্চাশের ওপর। এখানে আছেনও দীর্ঘদিন। আমাদের চাকরিতে এতদিন এক জায়গায় এতদিন থাকা যায় না। বদলি হয়। তবে কোনও কোনও সময়ে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। মাধব পালের বেলাতেও তাই হয়েছে। অফিসের ঘাঁতঘোঁত উনি এতটাই বেশি জানেন যে চট করে সরানো যায় না। ওর অ্যাসিস্টেন্ট পরিমল সামন্ত বসেন পাশের টেবিলে। এছাড়াও আছেন মেকানিক মাখন দত্ত আর দু’জন ‘পাম্পবাবু’। তাদের আউটডোর ডিউটি। ফিল্ডে ঘুরে বেড়ান। কিছুদিন পর পর এসে রিপোর্ট করেন। সেই অনুযায়ী মালপত্র কেনা হয়। লোক কম হলেও, আমাদের এই অফিসের দায়িত্বে বেশ কয়েকটা ব্লক পড়ে। সেখানকার ক্ষেতে সেচের পাম্প চালু রাখতে হয়। অফিসে মোটে দুটো ঘর। ছোটটা আমার। আলাদা করে দরজা নেই, পর্দা ঝোলে। বাইরের বড় ঘর মাধববাবু আর বাকি স্টাফেদের। অফিসের পিছনে একটা গোডাউন মতো রয়েছে। সেখানে জলের নানারকম পাম্প থাকে। তার সঙ্গে পাইপ, মেশিন, মোটোর তো আছেই।
আমি অফিসে ঢোকবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজু এসে হাজির হল। ‘স্যার, আপনি এত সকালে!’
‘কাজ আছে।’
‘চা এনে দিই?’
‘দাও। তবে তোমাদের ওই মধুকে গাদাখানেক চিনি দিতে বারণ করবে। আমার গ্লাসটা নিয়ে যাও।’
বিজু চা এনে জানলা খুলে, টেবিল চেয়ার ঝেড়ে পুঁছে দিল। ও আমাদের অফিসের স্টাফ নয়। চারপাশে আরও অনেকের ফাইফরমাস খাটে। আমাদের অফিসের পাশে পঞ্চায়েতের অফিস, একটু এগোলে স্কুল। আরও কিছুটা গেলে মধুর দোকান। তার পাশে সাইকেল, ভ্যান মেরামতির ঝুপড়ি। বিজু সব জায়গাতেই ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যেমন লাগে। শিলাটি বাজারের দিকেও কাজ করে। সব মিলিয়ে কিছু পয়সাকড়ি পায়। তাতেই চালায়। মধু পয়সা দেয় না, দু’বেলা খেতে দেয়।
রোগা চেহারা বিজুর। গায়ের রং কালো। চোয়াড়ে মুখে লম্বা নাক, চোখদুটো বড় বড়। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, কাজল মেখে রয়েছে। ঘন ভুরু। বয়স ষাট, বাষট্টি, তেষট্টি যা খুশি হতে পারে। ঢোলা প্যান্টের ওপর ততোধিক ঢোলা জামা। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো। পোশাকে দৈন্যের ছাপ। তবে হাঁটে পিঠ সোজা করে। মনে হয়, পয়সাকড়ি না থাক, বেটার মেরুদণ্ড সোজা রয়েছে। এই লোকের পূর্বপুরুষ নাকি একসময়ে এখানকার বাসিন্দা ছিল। এখন দূরে চলে গেছে। বিজুর ভ্যানিস হওয়ার অভ্যেস রয়েছে। এবারও হয়েছিল। ছ’মাসের লম্বা ডুব। আমি জয়েন করবার দিন কয়েক আগে নাকি এসেছে।
‘স্যার, কচুরি খাবেন?’
আমি মুখ না তুলে বললাম, ‘না, ভাজাভুজি খাই না।’
‘খান, অসুবিধে নাই। মধু ভালো করে। গরম গরম চারটা এনে দিই।’ এবার আমি হালকা বিরক্ত হলাম। বললাম ‘ভালো করুক, মন্দ করুক, আমি খাব না।’
‘তাহলে ঘুগনি রুটি বলি? এক প্লেটে দুই পিস রুটি দেয়। সকালবেলা খালি পেট ভালো নয় স্যার। কথায় আছে সকালবেলায় খালি পেট, সারাদিন মাথা হেঁট।’
এ তো আচ্ছা, বিপদ। এই লোক দেখছি আমাকে খাইয়ে ছাড়বে। তবে খিদে পেয়েছে এটা ঠিক। হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলাম, ন’টা বাজে। বললাম, ‘আচ্ছা, একটা অমলেট আর টোস্ট নিয়ে এসো।’
বিজু খুশি হয়ে রওনা হল। এত ঝামেলার মধ্যেও আমি একটু হাসলাম। এই পাড়া গাঁয়ে একজন যত্নআত্তির লোক হয়েছে। শ্রীনয়ন্তীকে আজ ফোনে বলতে হবে। ও একটু স্বস্তি পাবে। আমার স্ত্রী সুন্দরী এবং আহ্লাদি প্রকৃতির বদলির খবর নিয়ে যেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম, বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’ কী মুশকিল! আমাদের ছেলে ছোট। সবে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কলকাতার নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ভর্তি করতে কালঘাম ছুটে গেছে। সেই স্কুল ছাড়িয়ে ছেলেকে একটা ধ্যাড়ধ্যাড়ে গ্রামে নিয়ে আসব? এটা হয়? শ্রীনয়ন্তী নাছোড়বান্দা। সে আবার বোঝে কম। বাড়াবাড়ি শুরু করল। মাথা ঠান্ডা রেখে তার সঙ্গে কথা বললাম।
শ্রী, তুমি ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা কর। পিন্টুর স্কুলের কী হবে? ‘কেন বোর্ডিঙে দিয়ে দেব। কত ছেলেমেয়ে তো বোর্ডিং—এ থেকে লেখাপড়া করছে। করছে না? এখন বোর্ডিং এ রাখাটাই স্টাইল। কালিম্পঙ বা মুসৌরিতে কত বড় বড় স্কুল আছে।’
আমি বললাম, ‘তুমি খেপেছ? এসব জায়গায় ছেলেমেয়ে পড়াতে কত টাকা লাগে জান? আমি একটা সামান্য চাকরি করি। ক’ টাকা মাইনে? এতদিন বাদে প্রোমোশন পেলাম। তাও এই বদলিটা না নিলে প্রোমোশন হত না। নইলে কি আর গ্রামে যেতে রাজি হতাম? তুমি ওখানে থাকতে পারবে না শ্রী। শুনেছি, বেশিরভাগ সময়ে ইলেকট্রিসিটি থাকে না, টিউবয়েলের জলে স্নান করতে হয়। বাথরুমও নাকি বাইরে।’
বাথরুমের কথা শুনে শ্রীনয়ন্তী থমকে গেল।
‘আমি একা থাকব?’
আমি বললাম, ‘চিন্তা করো না। কোনোরকমে কটাদিন থাকি, তারপর ঠিক বদলি নিয়ে আবার কলকাতায় চলে আসব। ভেবেছিলাম, বদলিটা নেব না। তাহলে প্রোমোশনও হত না।’
এরপর একদিন আমি দেবদীপ বসুর কাছে শ্রীনয়ন্তীকে নিয়ে গেলাম। উনি আমার অফিসের একজন বস। বললেন, ‘চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। একটা বছর যেতে দিন। তারপর আপনার বরকে ফেরত আনবার বিষয়টা দেখব। তবে মন দিয়ে কাজ করতে হবে।’
বাড়ি ফিরে শ্রীনয়ন্তী ছলছল চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উনি কি সত্যি কিছু করবেন?’
আমি ওকে কাছে টেনে হেসে বললাম, ‘তোমার কি মনে হল উনি মিথ্যে বলতে পারেন? প্রথমদিন দেখেই স্যারের তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। চোখ সরাচ্ছিলেন না।’
শ্রীনয়ন্তী আমাকে সরিয়ে কাঁধে ঘুষি মেরে কান্না কান্না গলায় বলল, ধুস, পাজি একটা। আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে।’
বিজুর এনে দেওয়া টোস্ট অমলেট খেয়ে আবার কাগজপত্রের মধ্যে ডুব দিলাম। খানিক পরে বুঝতে পারলাম, গোলমাল সহজ নয়, গোলমাল ভংয়কর। খাতায় গত বছরের কিছু পাতা পাওয়া যাচ্ছে না। পাতা কোথায় গেল?
এই জায়গার নাম শিলাইহাটি। লোকে বলে শিলাই। আমাদের অফিসটা লোকালয় থেকে খানিকটা সরে এসে। লোকালয় বলতে ছোটখাটো একটা গঞ্জের মতো। বাস রাস্তা ছেড়ে দেড় কিলোমিটার মতো ঢুকতে হয় এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে। জায়গাটা প্রাচীন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে গঞ্জ তৈরি হয়েছিল। পরে এখান দিয়ে নাকি ব্রিটিশ সেনারা যাতায়াত করত। এখনও পাকা বাড়ি হাতে গোনা। বাকি সব মাটি আর খড়ের। ইলেকট্রিক আর মোবাইল কানেকশন আছে বটে তবে তারা থাকে নিজের মর্জি মতো। বেশিরভাগ সময়েই বেপাত্তা। অফিসের সামনে রাস্তাটা মাটির হলেও খানিকটা চওড়া। গোরুর গাড়ি, সাইকেল যেমন যায়, ভটভট আওয়াজ করে মোটোর লাগানো ভ্যান রিকশও চলে। ক্ষেতের কাজ করে ভ্যানে চেপে লোকজন গ্রামে ফেরে। রাস্তার পাশে মধুর দোকান। মধু চায়ে সঙ্গে কচুরি, ঘুগনি, মুড়ি তেলেভাজা রাখে। বাড়ি ফেরবার পথে অনেকে খায়। এই পথ ধরে মিনিট সতেরো আঠেরো এগোলে আমার কোয়ার্টার। আমার কোয়ার্টারটা ভালো না, তবে কোয়ার্টারে যাবার পথটা চমৎকার। দু’পাশে গাছ নুয়ে থাকে। ছায়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে অফিসে আসি। শুনেছি, বর্ষায় খুব সমস্যা। পথে কাদা হয়। সে আর কী করা যাবে? বদলি হয়ে যখন গ্রামে এসে পড়েছি তখন তো কাদা, অন্ধকার, সাপখোপ মেনে নিতেই হবে।
ভেবেছিলাম একসময়ে কোয়ার্টারে গিয়ে স্নান করে খেয়ে আসব। তা আর হল না। খানিক আগে একটা মারাত্মক জিনিস আবিষ্কার করেছি। তারপর আর স্নান করতে যাওয়া যায় না। হিসেবের খাতার যে পাতাগুলো নেই, সেগুলো আসলে ছেঁড়া। ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। কে ছিঁড়ল! এই পাতায় খরচের হিসেব ছিল। এটা তো মাধববাবুকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। ডাকবার আগেই গলা খাঁকারি দিয়ে মাধব পাল পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাতে ফাইল।
‘স্যার, এই যে গত বছরের হিসেব। ছ’মাসের রয়েছে, বাকিটা পরে দিচ্ছি। স্যার, একটা কথা বলব?’
আমি বললাম, ‘বলুন।’
মাধববাবু নিচু গলায় বললেন, ‘এখানে ভালো করে জমিয়ে বসার আগেই এতো খাতাপত্র ঘাঁটাঘাটি শুরু করলেন… কারণটা জানতে পারি?’
আমি একটু ভেবে, হেসে বললাম, ‘পুরোনো খাতা না দেখলে নতুন কাজ করব কী করে?’
মাধববাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক…। এটা ভালো। নিজে সব জেনেবুঝে নেওয়ার মতো ভালো জিনিস কিছু নেই। আগের স্যারেরা তো কেউ এত খাটাখাটনি করতেন না, কিছু লাগলেই এই অধমের ডাক পড়ত।’
মনে মনে ভেবে নিলাম, এখনই নয়, আর একটু দেখার পর পাতা ছেঁড়ার কথা জিজ্ঞেস করব। হেসে বললাম, ‘আমিও আপনাকে ডাকব। এই অফিসে আপনাকে না ডেকে উপায় আছে?’
মাধববাবু গদগদ গলায় বললেন, ‘অবশ্যই ডাকবেন স্যার। আপনার অর্ডার পালনই আমার ডিউটি। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘স্যার, আপনি নাকি ওই লোককে রাতে বাড়িতে রেখেছিলেন?’
আমি মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কোন লোককে রেখেছি? কার কথা বলছেন?’
মাধববাবু একটু ঝুঁকে পড়ে, নিচু গলায় বললেন, ‘বিজুকে। শুনলাম, বিজু একদিন রাতে আপনার ওখানে ছিল।’
মাধববাবু এখনও আগেরকার দিনের মতো ধুতি আর কলার দেওয়া সাদা শার্ট পরে অফিসে আসেন। শার্টের হাতা গোটানো। সাইকেলের হ্যান্ডেলে একদিকে লম্বা ছাতা, আরেকদিকে তিন-চার বাটিঅলা টিফিন কেরিয়ার ঝোলে। আসেন সেই পাহাড়পুর থেকে। পৌনে এক ঘণ্টার পথ। টিফিন টাইমে বাটি সাজিয়ে তরিবত করে খান। তবে শুধু খাওয়া নয়, মানুষটার কাজকর্মও গোছানো। এই যে কাল ফাইল চেয়েছিলাম, আজ ঠিক বের করে দিলেন। দু’বার বলতে হয়নি। আমি ফাইলের ফিতে খুলতে খুলতে বললাম, ‘বিজুকে রেখেছি কোথায়? শুধু শুক্রবার রাতে ছিল। খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল তাই। ও অবশ্য থাকতে চাইছিল না। আমিই জোর করলাম। খিচুড়ি রান্না করল, রান্নার হাতটা ভালো। কোয়ার্টারের বাইরের ঘরে মেঝেতে চাদর পেতে শুল। তবে বড্ড নাক ডাকে।’ কথা শেষ করে আমি হাসলাম।
মাধববাবু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘এটা কেমন কথা স্যার? ঝড়বৃষ্টি বলে একটা ফেউ আপনার মতো অফিসারের বাড়ি থেকে যাবে? মধুর দোকানে থাকতে পারত, স্কুলের বারান্দায় থাকতে পারত।
আমি মুখ তুলে বললাম, ‘ফেউ! ফেউ আবার কী?’
মাধববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ওকে এখানে সবাই ফেউ বলে জানে। ও শুধু ফেউ নয়, ওর বাপ চোদ্দো পুরুষও ফেউ ছিল।’
আমি আরও অবাক হলাম। বললাম, ‘পূর্বপুরুষ ফেউ ছিল! কী বলছেন মাধববাবু? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।’
মাধববাবু গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন, ‘ঢুকবে স্যার, কদিন বাদেই ঢুকবে। আমি জানলে এবার আর অফিসে ঢুকতে দিতাম না। আপনি আসার কয়েকদিন আগে, এসে হাতে পায়ে ধরল…এক সময়ে ওর বাবাও এখানে কাজ করে গেছে। মায়া হয়। আর মায়া নয়। আমিই ভুল করেছি।
রিপোর্ট তৈরির এতো ঝামেলার মধ্যেও আমার কৌতূহল হল। মাধববাবু বিজুর ওপর এত রেগে আছেন কেন?
‘বিজুকে সবাই ফেউ ডাকে কেন?’
মাধববাবু নিজেকে শান্ত করে বললেন, ‘এখন আপনি ব্যস্ত আছেন স্যার, পরে বলব। তাছাড়া ঘটনা সত্যি না বানানো কেউ জানে না। গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।’
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম, ‘এখনই বলুন।’
মাধববাবু সংক্ষেপে যা বললেন তা সত্যি হোক আর বানানো গল্প হোক, খুবই ইন্টরেস্টিং।
কথায় আছে, বাঘের আগে ফেউ চলে। ডাক দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় ‘বিপদ আসছে’। বংশপরম্পরায় বিজুরা নাকি এই কাজ করেছে। বিপদ আসবার আগে খবর দিয়ে বেড়ায়। জমিদার আমলে লেঠেল বাহিনী গ্রামে আসবার আগেই খবর রটিয়ে দিত। যে যেমন পারত ধান, গম লুকিয়ে ফেলত। ব্রিটিশ আমলেও তাই। সেনারা কুচকাওয়াজ করে ঢোকবার আগেই বিজুর কোনো পূর্বপুরুষ শিলাইহাটি আর আশপাশের পাঁচ-সাতটা গ্রামের মানুষদের সাবধান করে যেত, শয়তানরা আসছে কিন্তু।’ গ্রামের মানুষ জঙ্গলে বউ বাচ্চাকে লুকিয়ে রেখে আসত। পরে যারা স্বাধীনতার লড়াই করেছে, তাদের হয়েও গুপ্তচরের কাজ করছে। আরও পরে, স্বাধীন দেশেও যখন পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে আর তাড়া খেয়ে বনেবাদাড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে কম বয়সি ছেলেরা, তাদের জন্যও নাকি একই সার্ভিস দিয়েছে বিজুর বাপ ঠাকুর্দা। পুলিশের গাড়ি আসবার আগেই বলে যেত, ‘বিপদ আসছে’। ওই পরিবারের লোকদের নাম হয়েছিল ‘ফেউ’। ওদের কাউকে দেখলেই গ্রামের লোকে বুঝত, পিছনে ‘বিপদ’ আছে। কেমন করে ‘বিপদ’–এর খবর তারা আগে পেত কেউ জানে না। আদৌ কি পেত? এখন আর এসব নেই, তবে বিজু ‘ফেউ’ নাম থেকে মুক্তি পায়নি।
আমি হেসে বললাম, ‘মাধববাবু, এই গল্প কি আপনার বিশ্বাস হয়?’
মাধববাবু বললেন, ‘না, হয় না।’
আমি বললাম, ‘আমারও হয় না। হয়তো দশটার মধ্যে একটা আধটা কাকতালীয় ভাবে মিলে যেত।’
মাধববাবু গজগজ করে বলত, ‘তাও মিলত না। ভাঁওতা দিত। পাড়াগাঁয়ের মানুষ ভাঁওতা বিশ্বাস করতে ভালোবাসে।’
আমি বললাম, ‘পাড়াগাঁয়ের দোষ দিচ্ছেন কেন? শহরও গুজব ছড়ানোয় পিছিয়ে নেই। আপনারও বিজুর ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়। ঝড়বৃষ্টির সময়ে দরকার হলে আপনিও আমার কোয়ার্টারে থেকে যেতে পারেন। ওটা অফিসারের বাড়ি নয়, অফিসের কোয়ার্টার। বিজু নামের লোকটা আমাদের স্টাফ না হলেও, সার্ভিস তো দেয়।’ একটু চুপ করে থেকে বললাম, আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি দরকার আছে মাধববাবু। কাল কথা বলব।’
মাধববাবু আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কালকেও কি সকালে আসবেন স্যার?’
আমি বললাম, ‘দেখি।’
‘যদি বলেন, আমি চলে আসতে পারি।’
আমি নরম গলায় বললাম, ‘দরকার নেই। দরজা-টরজা বিজুই খুলে দেবে।’
মাধববাবু আবার আমার দিকে স্থির চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে চলে গেলেন। উনি কি আমার ওপর বিরক্ত হলেন? হতে পারেন। এই লোক সম্পর্কে আমি কলকাতা থেকেই খবর নিয়ে এসেছি। শিলাইহাটির এই অফিস উনি চালান। আগে যারা এখানে অফিসার হয়ে আসতেন, এই লোকের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে কলকাতায় পালাতেন। পরে পুরোনো তারিখে সই করা হত। মাধব পাল ছাড়া আর কেউ জানত না। তবে এ সুযোগ আমার নেওয়া হয়নি। তিন মাস হল এখনও কলকাতায় যেতে পারিনি। যদিও মাধববাবু আমাকে প্রায়ই বলেন, ‘স্যার বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসুন। অনেকদিন হয়ে গেল, বৌমার সঙ্গে দেখা করে আসুন। চিন্তা করবেন না, এদিকটা আমি সামলে নেব।’
বাড়ি যাওয়ার জন্য তিনবার প্ল্যান করেও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি। এখানকার কাজের ব্যাপারে কলকাতা থেকে ঘন ঘন যোগাযোগ করা হচ্ছে। নানা বিষয়ে জানতে চাইছে। আমাদের ঝামেলা প্রচুর। কোন ক্ষেতে জল যাচ্ছে না, কোথায় পাম্প নেই, কোথায় মোটোর খারাপ হয়েছে, কোথায় পাম্পের ভাড়া ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় পাম্পের তেল বেশি লাগছে সব খবর রাখতে হয়। সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হয়। মালপত্র কেনাকাটা আছে। তবে কলকাতার এতো খোঁজখবরে মাধববাবু পর্যন্ত অবাক হচ্ছে। এমনটা নাকি আগে কখনও হয়নি। পাড়াগাঁয়ের এই ছোট একটা অফিস নিয়ে হেড কোয়ার্টার কখনও মাথা ঘামাত না। হলটা কী! এর মধ্যে ঘাড়ে এসে পড়েছে রিপোর্টের ফ্যাকড়া। দেবদীপ বসু নিজে ফোন করছেন, ‘রিপোর্টগুলো তুমি লিখে পাঠাবে। কাউকে দেখাবে না। ওই ডিভিশন নিয়ে আমাদের কাছে নানারকম গোলমালের খবর আসছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘স্যার, এখানে আসবার আগে তো কিছু বলেননি!’
দেবদীপ বললেন, ‘ইচ্ছে করেই বলিনি। তুমি ঘাবড়ে গিয়ে যদি পিছিয়ে যাও। অনেকেই পালিয়ে এসেছে।’
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমি স্যার পালাব না।’
দেবদীপ বললেন, ‘ভেরি গুড। আমি জানতাম।’
এরপর মাধববাবুর হাতে দায়িত্ব ছেড়ে কলকাতায় যাই কী করে? একটাই
ভালো খবর শ্রীনয়ন্তী আমার কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। সে আমাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য আর তাগাদা দেয় না।
‘ডার্লিং, তুমি যে একবারে বদলে গেলে!
শ্রীনয়ন্তী বলে, ‘বাঃ তুমিই তো বলেছ ভালো কাজ করলে আবার বদলি হয়ে চলে আসবে। বলনি?’
আমি গাঢ় স্বরে বলি, ‘একটা চুমু দাও।’
শ্রীনয়ন্তী মোবাইলে মুখ ঠেকিয়ে চুমু খায়। তবে পুরোটা পারে না। তার আগে কানেকশন কেটে যায়। এই এক ঠেলা। ফোন যে কখন কেটে যাবে কেউ বলতে পারে না।
দুই
কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে দাড়ি কামাচ্ছি। আয়না রেখেছি টুলের ওপর। এখানে দাড়ি কামানোর এটাই উপায়। আজ অফিসে গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করব। যদি হারিয়ে যাওয়া হিসেব অন্য কোথাও পেলাম তো ভালো, নয়তো মাধব পালের শরণাপন্ন হব।
বাগানের গেট খুলে বিজু ঢুকল। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মলিন জামাকাপড়েও সকালের রোদে তাকে দেখাচ্ছে ঝলমলে। সকালের আলোর এটাই গুণ। সে গরিব বড়লোকের পার্থক্য করে না।
‘স্যার, আজও কি তাড়াতাড়ি যাবেন?’
আমি বললাম, ‘না, যাব না। কাল স্নান খাওয়া হয়নি। রোজ অনিয়ম চলবে না।’
বিজু বলল, ‘ভালো করেছেন। স্যার, একটু চা করে দিই?’ আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘কর। তুমিও নিও।’
বিজু রান্নাঘর থেকে চা করে আনল। আমাকে কাপ দিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে বসল। আমি দাড়ি কামানো শেষ করে বেতের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসলাম। কাপে চুমুক দিয়ে হালকা গলায় বললাম, ‘বিজু, তোমরা নাকি একসময়ে লোককে সাবধান করার কাজ করতে।’
বিজু বলল, ‘মাধববাবু বলেছে?’
আমি বললাম, ‘যেই বলুক। ঘটনা ঠিক?’
বিজু হেসে বলল, ‘কী বলেছে আমাকে? ফেউ? বাঘের আগে আসে?’
আমি এবার জোরে হেসে বললাম, ‘সত্যি কিনা বল। আমি কাল রাতে আমার বউকে ফোনে গল্পটা করেছি। সে তোমাকে দেখতে চেয়েছে।’
বিজু দু’হাতে গ্লাস ধরে চুমুক দিয়ে বলল, ‘সত্যি কিনা জানি না, তবে শুনেছি আমার বাপ ঠাকুর্দা লেঠেল বাহিনী, পুলিশ, মিলিটারির খবর আগে পেয়ে যেত।’
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম,’কী করে পেত?’
‘জানি না স্যার। হয়তো কোনও ক্ষমতা ছিল। সত্যি হতে পারে, আবার মিথ্যেও হতে পারে।’
আমি বললাম, ‘তুমি এরকম কিছু পাও?’
বিজু একটু চুপ করে থেকে অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘লোকে আমায় মিছিমিছি ফেউ ডাকে। বাপ্ ঠাকুর্দার বদনাম হয়। লজ্জা করে।’
আমি নরম গলায় বললাম, ‘এতে বদনামের কী আছে? তাঁরা তো বিপদের খবর দিয়ে ভালো করতেন। সবাই সাবধান হত।’
বিজু চায়ের গ্লাস নামিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি ভালো মানুষ তাই এতো কথা বললাম। হাবিজাবি সব কথা। আমায় মাপ করবেন।’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘দূর বোকা। যাই এবার অফিসের জন্য তৈরি হব।’
বিজুও উঠে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, ‘স্যার, আজ আমি চলে যাচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘চলে যাচ্ছ! মানে?’
‘অনেকদিন শিলাইতে রয়ে গেলাম। আর ভালো লাগছে না।’
আমি বললাম, দূর, কোথায় যাবে? আমার এখানেই পাকাপাকি থেকে যাও। কাজকম্ম করবে, রান্নাবান্না করবে। তোমার বৌদি আসবে, সে তোমাকে ভালো ভালো রান্না শিখিয়ে দিয়ে যাবে।’
বিজু শুকনো হেসে বলল, আমায় মাপ করবেন স্যার। তিনমাস একটানা আছি, এখন আর নয়। পরে ফের আসব। তাছাড়া ওই মাধব পাল আমাকে পছন্দ করছে না। উনি ভুল করলেন।’
আমি ভুরু কুঁচকে কড়া গলায় বললাম, ‘মাধববাবু কিছু বলেছেন নাকি?’
বিজু একথার উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে দুঃখ পাওয়া গলায় বলল, ‘স্যার, আমি চাই না, তারপরেও কিছু বিপদ আপদের খবর আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। বোধহয় আমি ফেউ বলেই ঘোরে।’
আমি এগিয়ে বিজুর কাঁধে হাত রাখি। বলি, ‘কীসব পাগলের মতো বলছ বিজু? মানুষ কখনও ফেউ হতে পারে না। সে কি পশু? তার কি বিপদ বোঝবার ঘ্রাণশক্তি থাকে? তুমি কেন বিপদের খবর নিয়ে ঘুরবে? তোমাকে নিশ্চয় মাধববাবু চলে যেতে বলেছেন।
বিজু কথা না বলে ঠোঁটের ফাঁকে হাসল।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত
আমি অফিসে বোরোনোর ঠিক মুখে আরও একজন এসে হাজির হলেন। আমাদের অফিসের পরিমল সামন্ত। মাধববাবুর সহকারী। বিরক্ত হলাম। ইনি আবার কী চান? কোয়ার্টারে কেন? উনিও কি বিজুর নামে বলবেন? পরিমল সামন্ত কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে পড়লেন এবং আমাকে না বলেই দরজায় ছিটকিনি দিলেন তুলে। তারপর হড়বড় করে বলতে শুরু করলেন। কীভাবে বছরের পর বছর ধরে মাধববাবু অফিসের টাকা চুরি করছেন, কীভাবে চাষিদের ঠকাচ্ছেন, কীভাবে হিসেবের খাতায় গোলমাল করছেন, কীভাবে সবাইকে লোভ আর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছেন, সব বলে গেলেন এক নিঃশ্বাসে।
একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘এসব আমাকে বলতে এসেছেন কেন?’
‘আপনি শুনবেন বলে। এতদিন বাকিদেরও বলবার চেষ্টা করেছি, কেউ শোনেননি। মাধববাবুর কাছ থেকে তাঁরা নানারকম সুবিধে নিতেন।’
আমি বললাম, ‘আপনি নেননি?’
পরিমল সামন্ত চোখ নামিয়ে বললেন, ‘সবাই ঘুষ নেন না স্যার। যেমন আপনি।’
আমি বললাম,’আপনার কথা কেন বিশ্বাস করব?’
পরিমল সামন্ত বড় করে শ্বাস টেনে বললেন, ‘স্যার, যেদিন থেকে আপনি পুরোনো হিসেবের খাতা দেখা শুরু করছেন, মাধববাবু গোলমাল করা হিসেবের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। সম্ভবত আজও নেবেন।’
আমি অস্ফুটে বললাম, ‘সেকী! পাতা ছিঁড়ে ব্যাগে ভরে নেন?’
‘না স্যার, ব্যাগে নয়, উনি কাগজগুলো টিফিন কেরিয়ারের বাটিতে ভাঁজ করে নেন। কোনওদিন তল্লাশি হলেও যাতে কেউ ধরতে না পারে।’
আমি চেয়ারে বসে পড়লাম ধপ করে। বিড়বিড় করে বললাম, ‘ও মাই গড। এখানে থানাটা কোথায় পরিমলবাবু?’
তিন
ভেবেছিলাম, ফেউ বিজুর সঙ্গে আর দেখা হবে না। দেখা হল।
মাধব পালকে সেদিনই হাতেনাতে ধরা গেছে। ওর টিফিন কেরিয়ারের দুটো বাটি থেকে পুলিশ অফিসের খাতা ছেঁড়া কাগজ পেয়েছে। সত্যি ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা। ওর চুরির হিসেব। হেড অফিসের চাপ এবং আমার রিপোর্ট তৈরির ব্যস্ততা দেখে তিনি এই ভয়ংকর কাণ্ড করছিলেন। খাতা ছিঁড়ে লোপাট। গ্রেপ্তার, সাস্পেনশন, আদালত সামলাতে সাতটা দিন কেটে গেল। আপাতত অফিসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পরিমল সামন্তকে। আমার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেল। তবে ভালো খবর আছে। আমার কাজে অফিসের কর্তৃপক্ষ দারুণ খুশি। খবরের কাগজে টিফিন কেরিয়ারে তথ্য পাচারের খবর ফলাও করে বেরিয়েছে। বসেরা সবাই দেখেছে। দেবদীপ বসু রাজি না হলেও, আরও উঁচু পোস্টে যারা রয়েছেন তাঁরাই আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আরও বড় দায়িত্ব নিতে হবে। তিনমাসে দু-দু’বার প্রোমোশন! আমি খুব খুশি।
বাড়ি যাচ্ছি। স্টেশনে যাব বলে ব্যাগ নিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি বড় রাস্তায়। পাশে এসে দাঁড়াল বিজু। মাটি ফুঁড়ে উঠল যেন।
‘আরে বিজু! কেমন আছ?’
‘ভালো আছি স্যার। আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এলাম। শিলাইহাটির কোয়ার্টারে গিয়ে শুনলাম, রওনা দিয়েছেন।’
আমি ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, ‘খবর শুনেছ তো?’
বিজু লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘শুনেছি স্যার। মাধববাবু দেরি করে বুঝলেন।’
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কী বুঝলেন?’
বিজু সামান্য হেসে বলল, ‘ছ’মাস পরে আমি কেন আবার হাজির হয়েছিলাম সেটা বুঝতে পারেননি। স্যার, ফেউ তো বিপদের খবর নিয়েই যায়। বিপদ যে ওর নিজেরও হতে পারে, আমাকে দেখে ভাবা উচিত ছিল।’
আমি অবাক গলায় বললাম, ‘বিজু তুমিও এসব বিশ্বাস কর! সত্যি তুমি…।’
বিজু আমাকে প্রণাম করল। তারপর ফিসফিস করে বলল, স্যার, আপনি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন এটা খুব ভালো। দেরি করবেন না, রাতের গাড়ি ধরবেন।’
ঝকঝকে দিনের আলোতেও আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বিজু কী বলতে চাইছে? ‘দেরি করবেন না’ মানে কী? জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বাস এসে গেল। আমি হড়বড়িয়ে ভিড় ঠেলে উঠে পড়লাম। আমাকে রাতের গাড়ি ধরতেই হবে।
চার
আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে শ্রীনয়ন্তী।
সে এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে ফেউ বিজু গল্প শুনেছে। এবার আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘তুমি একজন ভালো মানুষের গল্প বললে, এখন আমি তোমাকে একজন খারাপ মানুষের গল্প বলব। এই কদিন আমাকে খুব জ্বালাতন করেছে।’
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসে বললাম, ‘তোমাকে! কে জ্বালাতন করেছে?’
শ্রীনয়ন্তী আমাকে ওর নগ্ন গায়ের ওপর টেনে নিল। হেসে বলল, ‘তোমার বদলির কথা ভেবে এতদিন কিছু বলতে পারিনি। এবার ফোন করলে বুঝতে পারবে ঠেলা।’
আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম, ‘কে? দেবদীপ বসু?’
শ্রীনয়ন্তী আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। আমি চোখ বুজলাম। বিজুর মুখ ভেসে উঠল। সে কি আমার বিপদেরও খবর এনেছিল?