হেঁই হো হুকুমদারি হেই হো!
নোটে শিয়া চুরচুর
হে পরাণি দুরদুর
কেঁদো না নক্কী বউ,
মধু আছে শ্বউর বাড়ি,
হেই হো হুকুমদারি।
পালকি চলেছে। কাঠের গায়ে সবুজ রং করা পালকি। সবুজের উপরে সাদা রং-এর ফুল লতাপাতা আঁকা। পালকির দরজা একটুখানি ফাঁক হয়ে রয়েছে। কিন্তু কিছু দেখা যায় না।
বড় বড় মেঘের চাঁই আকাশটাকে খোঁচা খোঁচা করে তুলেছে। খোঁচা খোঁচা আর মস্ত বড়। দুর্গম সীমাহীন পাহাড়ের মতো, যেন হাতের কাছে, আকাশ প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। মেঘ নীচে নেমে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে নদী-নালা বেতস বন। আষাঢ়ের জলে লকলকিয়ে উঠেছে ছাগলবটি আর গইলে লতা। গাঢ় সবুজ বনানী কালচে হয়ে উঠেছে। খালে বিলে গঙ্গায় নেমেছে ঢল। মেঘের ছায়ায় নদী যেন ভরাট হয়ে উঠেছে আর ভিড় লেগেছে পানকৌড়ি ও গাংচিলের। জ্যৈষ্ঠের ধুলো-পথ জল পড়ে কালো ও কর্দমাক্ত দেখাচ্ছে। আষাঢ়ের মৃদু মৃদু ভারী বাতাসে দুলছে শিলাবৃষ্টির ছাপ ধরা বনস্পতি। বর্ষার উচ্ছ্বাসের মাতন লেগেছে কুরচি দেবদারু শিরীষের ঝাড়ে। গুপ্তিপাড়া থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। গুপ্তিপাড়ার সানাই ডাক দিয়েছে। তালে তালে ডাকছে বৃন্দাবন জীউর নহবতখানা থেকে ঢোলক কাঁসির ধাকুড়কুড়, ট্যাং-ট্যাং শব্দ। আজকে রথযাত্রা, রথের মেলা।
পথে বড় মানুষের ভিড়। ভিড় মেয়ে পুরুষ শিশুর। ডাঙায় ভিড় গোরুর গাড়ির, জলে ভিড় নৌকার। আজ সব পথ, সকলের পথ গুপ্তিপাড়ার দিকে। পালকিও চলেছে সেই দিকে। হেই গো, সামলে। বেহারাদের থ্যাবড়া পায়ের ছাপ পড়ছে ভেজা মাটিতে। হাঁই হাঁই করে চলেছে।
শাউড়ির হাতে মধুর স্বাদ,
শউরের মুখে আশীর্বাদ,
ননদেরা দিবে গো বাক্যি ছড়ার বাড়ি।
হেঁই হো হুকুমদারি, হেঁই হো!
সামলে, পথে বড় ভিড়। গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রার মেলা চলেছে পথে পথে। কে যায়? কী জানি। বড় সাহেব এসল নাকি?না, বড় সাহেব আসেনি। বড় সাহেব আসেনি কিন্তু কুঠিয়ালরাও কেমন যেন থমকে রয়েছে এ বছর। থমথমে ভাব সারা দেশ জুড়ে। কী হয় কী হয় ভাব। যশোহরে খুনোখুনি হয়েছে। গোরা কুঠিয়াল খুন হয়েছে রায়তের হাতে। গুপ্তিপাড়ার কুঠিয়ালরা মাঠে মাঠে রেখেছে লাঠিয়াল। নিজেরা চলে লাঠিয়াল নিয়ে। বলে, রায়তকে বিশ্বাস নেই। আর রায়ত কুঠিয়াল-লাঠিয়াল দেখে ভয়ে পালায়। তবু থমকে রয়েছে। যেন নীলকর বাঘের গরাসটা গলায় আটকে গেছে। ক্ষেপেছে, কিন্তু তাগ করতে পারছে না। কেবলই ছুটোছুটি চলেছে। বাঁশবেড়ের সাহেব আসে গুপ্তিপাড়ায়, গুপ্তিপাড়ায় সাহেব যায় বাঁশবেড়ে। বাঁশবেড়ে থেকে চুঁচুড়া। চুঁচুড়া থেকে কলকাতায়। নীল কমিশন বসার আয়োজন হচ্ছে। সাহেবরা বলে ইন্ডিগো কমিশন। কলকাতায় হুলস্থুল পড়ে গেছে। গুপ্তিপাড়ার ঈশান মিত্তির মশাই সংবাদ প্রভাকর নিয়ে পড়ে শোনাল সবাইকে। বললে, দেখ, দেখ, আমাদের গুপ্তিপাড়ার জামাইয়ের কাগজ কেমন চুটিয়ে লিখেছে সাহেবদের অত্যাচারের কথা। গুপ্তিপাড়ার জামাই ঈশ্বর গুপ্ত। ওদিকে লেফটেনান্ট গভর্নর লর্ড ক্যানিং-এর মতো সাহেবরাও উঠে পড়ে লেগেছেন একটা বিহিত করার জন্য। এক নীল চাষের ব্যাপার নিয়ে যদি বারো মাস রাজ্যের মধ্যে প্রজা বিদ্রোহ-ই লেগে থাকে, তবে তো ভয়ানক বিপদ। অনেক দিন চুপ করে থাকা গেছে। কিন্তু তাদেরই নিমক-খাওয়া এক পোেস্টাল সুপারিন্টেডেন্টবাবু সর্বনাশ করেছেন। তিনি আবার নীলদর্পণ বলে এক নাটক লিখেছেন। কিন্তু আইন তাকে হাতে পায়নি। বইটা অনুবাদ করেছেন মধুসূদন, নাম দেওয়া হয়েছে পাদরি লং-এর। ভদ্রলোকের এক মাস জেল হয়ে গেল। গোদের উপর বিষ ফোঁড়া, হাজার টাকা জরিমানা। টাকা দিয়েছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ৷ দেবেন না! নইলে আর ও হাত দিয়ে হুতোমের নকশা বেরোয়? ওদিকে আবার হরিশ্চন্দ্ৰ মুখুজ্জে বলে এক বাবু কথায় আর কবিতায় আগুন ছিটিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, মাঠে মাঠে নীলের চারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তবু যেন খাপছাড়া। চুঁচুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট জন ড্যালারিমপ এসেছিলেন অবস্থাটা দেখতে, হুকুম পেয়ে আসেননি। কুঠিতে ঢুকবেন, তারপর কৈফিয়ত দিয়ে প্রাণান্ত হত। কিন্তু তার আসায় একটা ফল বোধ হয় হয়েছে। জোর করে দাদন দেওয়া সব মাঠে নীল বুনতে সাহস করেনি কুঠিয়ালরা।
তবুও ধানের পাশে পাশেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে নীল। কিছু কিছু পেঁড়ি। সাহেবরা বলে, পপি কালটিভেশান। দেশের লোক বলে চেঁড়ি, নয় তো পোস্তদানার চাষ। পোস্ত হয় মুণ্ডু, চেঁড়ি গাছের নরম ছাল ছাড়িয়ে রস বের করে নেয়। ওতে আছে আপিম। আপিমের চাষ হয়। তবে সেঁড়ি ফুলের ঝুমকো কানে বড় সুন্দর দেখায়। ওর নাম ওই জন্য ঝুমকো পেঁড়ি। ফুল ফুটলে হয় একবার। ছোট ছোট আইবুড়ো মেয়েদের ভিড় লেগে যায়। কানে ঝুমকো, নাকে ঝুমকো, বনসুন্দরীর সাজে সেজে মেয়েরা দল বেঁধে নেচে বেড়ায়।
মাঠে মাঠে ধান, নীলের বিস্তার যেন তার চেয়েও বেশি, আর কিছু পেঁড়ি।
বর্ধমানের বড় সাহেব আসেননি। লোকাল ইনস্পেকশনের প্রয়োজন হবে না হয়তো শেষ পর্যন্ত। খোদ ঘরে কমিশন বসেছে। কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে শ্যামচাঁদ। শ্যামচাঁদ চাবুক, পাঁচন বাড়ির বাবা। নদের নীলকর লার্মার সাহেব যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছিল।
অনেক রায়তের রক্ত জমে শ্যামচাঁদের চামড়া শক্ত হয়ে উঠত। সেই শ্যামচাঁদ পাঠানো হয়েছে। কমিশনের কাছে। গুপ্তিপাড়ার নীলকর সাহেব বলেছে, রায়ত শুয়োরের পিঠে ভাঙব শ্যামচাঁদ আর কমিশনের মাথায় মারব রূপচাঁদ। রূপচাঁদের মারে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, হাকিম আর লাট, সব। কোটি কোটি চাঁদির জুতো মারব তাদের মাথায়।
রূপচাঁদ হল টাকা। চাঁদির জুতো মেরে তারা বিগড়ে দেবে কমিশন। ঈশান মিত্তির মশাই বলেন, সে দিন আর নেই। দেশের মানুষ চাঁদির জুতোয় বেগড়াবে না। দেশের মানুষ তো কুঠির পেশকার চক্রবর্তী নয়। ও তো দেশের মায়ের দুধ খায়নি। ও সাপ, হাওয়া খেয়ে বিষ পুষেছে অন্তরে।
হেঁই হো হুকুমদারি হেঁই হে।
পালকি আসছে, কিন্তু বড় সাহেব আসেনি। তবে কার পালকি? বউ যাচ্ছে। পালকির দরজা আঁটসাঁট বন্ধ। পথের মানুষ সরে দাঁড়ায়। সরে দাঁড়িয়ে বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকায় পালকির দিকে।
আষাঢ়ের বর্ষা। মাঠে মাঠে কৃষাণেরা কাজে রয়েছে। জল ধরে রাখবার জন্যে বাঁধ দিচ্ছে কেউ, কেউ জল নিকাশের জন্য কাটছে আল। কালো কালো উলঙ্গ ছোট ছোট ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নয়ানজুলিতে। এদিক ওদিকের নালাখন্দ দিয়ে জল এসে পড়ছে, তিরতির করে ছুটছে। এখনও আসেনি শ্রাবণের ধারা। এর মধ্যেই ঘুনি আটোল নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে ন্যাংটো ছেলেরা মৌরলার ঝাঁক ধরতে। এদিকে সবুর সয় না। পালকির হেঁই হো ডাক দিচ্ছে। নহবতখানার সানাইয়ের সুর আসছে ভেসে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। রথ টানের সময় বুঝি হয়ে গেল। রথের দড়ি না টানলে তো জীবনই বৃথা। ঘরের পাশ দিয়ে ফসকে যাবে মস্ত পুণি। বেলা বয়ে যায় মেঘে মেঘে। বৃষ্টি এল। ছত্রাকার মেঘদল লেপটে আসছে গায়ে গায়ে। কোন দুর আকাশ থেকে শব্দ আসছে বুম বুম। থেকে থেকে ফিক্ করে হেসে ওঠার মতো বিদ্যুৎ উঠছে চকিতে।
হেঁই হো
ঘোমটা খোল বউ,
ঘরে নেইকো কেউ।
আমি তোমার বর,
এইটে তোমার ঘর,
হেঁই হো
নতুন বউ যাচ্ছে রথের মেলায়। কার বউ গো! শিব ঠাকুরের, বেউলের শিবনাথ বাচস্পতির নতুন বউ। ভরার মেয়েকে বিয়ে করে রথ দেখাতে নিয়ে চলেছে ঠাকুর।
হ্যাঁ, বাচস্পতি চলেছে সর্বাগ্রে। মোটা থান গুটিয়ে নিয়েছে হাঁটুর উপর। হাঁসের ডিমের মতো মস্ত বড় নস্যাধার খুঁজেছে কোমরে। বয়স বাহান্ন বটে, বুকের ছাতিটি মস্ত বড়। ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে এলিয়ে পড়েছে গরদের চাদর। পৈতায় বাঁধা আংটি, হাতে লাঠি আর গামছা। বাঁ হাতে টোকা। বড় হালকা, সুন্দর টোকা, তমলুক থেকে নিয়ে এসেছিল তার এক ছাত্র। টৌকাটি নিয়েই বেরুতে হয়েছে। বলা তো যায় না যদি বৃষ্টি বাদলা এসে পড়ে।
সকলের আগে আগে শিবনাথ। তার সারা মুখে চাপা হাসির কী ঝিলিক। তার মুখে, তার সারা দেহে এক চাপা আনন্দ যেন গলে গলে পড়ছে। এত বড় শরীরটা তার হালকা লাগছে। চলতে আনন্দ, যেন এমন চলা আর জীবনে কোনওদিন চলেনি শিবনাথ। চলেছে আগে, কান পেছনে। কান মন, সবই পেছনে। মাঝে মাঝে দেখছে ফিরে ফিরে ফিরে ফিরে, বারে বারে, ওই সবুজ পালকির দিকে। যেমন করে চাতক তাকায় মেঘের দিকে। আর নিঃশব্দে, আপনা থেকেই তার মন এলোমেলো আবৃত্তি করে চলেছে মেঘদূত। বলছে,
বক্ৰঃপন্থা যদপি ভবতঃ প্রস্থিতস্যোত্তরাশাং।
সৌধোৎসঙ্গপ্রণয়বিমুখো মাস্ম ভূরুজ্জয়িন্যাঃ ॥
হে মেঘ, যখন যাবে উত্তরে, পথ বাঁকা হলেও উজ্জয়িনীর সৌধে নজর করতে ভুলো না। কেন? শিবনাথের সারা মুখে যেন রক্ত ছুটে আসে। ফিরে তাকাল আবার পিছনে, পালকির দিকে। মেঘ কেন উজ্জয়িনীর বাড়িঘরের দিকে লক্ষ করবে?করতে হবে, কারণ সেখানে মেয়েদের বিদ্যুৎ-চকিত-চঞ্চল চোখে তার চোখ পড়বে। তাতেও যদি তার কামনা না জাগে, তবে মেঘ। ওরে মেঘ, তোর জন্ম বৃথা। বেহারাদের ঘাড়ে ওই শিবিকাই আজ সারা রাঢ়ের উজ্জয়িনী। মেঘ নয়, জন্ম সার্থক করতে চায় পণ্ডিত শিবনাথ বাচস্পতি। মেঘদূতের রতিসাধ তো আজ আর কাব্য নয়, সে যে আজ আবর্তিত রক্তে রক্তে। বেহারাদের তালে তালে বুলি থেকে থেকে মেঘদূতকাব্যের ধারাবাহিকতা দিচ্ছে ভেঙে। সেও আর এক কাব্য বলে,
হেঁই হো
বউ কেন কাঁদে?
আলো কেন চাঁদে?
আমার চাঁদের জেল্লা ঘরে।
বউয়ের মুখে ঝরে
হেঁই হো
বেহারাদের আগে আগে চলেছে বিলোচন। জোত জমির কথা সাময়িকভাবে চাপা পড়েছে তার মনে। চাপা তো কতই পড়ে, কিন্তু আগুন কি চাপা থাকে। থাকে না। এই আনন্দের মাঝেও ওই আকাশের বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে যাচ্ছে। বড় সাহেব আসেনি। তবু, কলকাতার সংবাদ মনে অনেকখানি ভরসা দিয়েছে। কাগজে লেখা হচ্ছে রায়তদের কথা, লাট সাহেব পর্যন্ত মাথা ঘামাচ্ছে। তা ছাড়া কুঠিয়ালদের ভাবখানাও কেমন যেন মাছ-বিবাগী বেড়ালের মতো। বিলোচন ওত পেতে ছিল, চুঁচুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট আসার দিন। এক বার ফাঁক পেলে হয়, নামলে হয় সাহেব এক বার ঘোড়া থেকে। কুঠিয়াল না হয় পরে পিঠে শ্যামচাঁদ ভাঙবে। তবু সে জোড় হাতে সব বলবে, পায়ে ধরে শোনাবে, কিন্তু সাহেব ফাঁক দেয়নি। কাউকেই না।
সে খালি গায়ে কোমরে গামছা বেঁধে চলেছে বেহারাদের আগে আগে। পথে আরও মানুষ চলেছে। তাদের সকলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেছে। চেনা লোকের বাড়ি পথে পড়লে ডাক দিচ্ছে, কই গো, যাবে নাকি? বেহারাদের আগেই নিজে হাঁক দিচ্ছে, পাশ দেও, পাশ দেও।
সে চলেছে, তার ছেলে বউ মেয়ে আসছে পেছন পেছন। মেয়েমানুষ তো আর পালকির সঙ্গে সঙ্গে চলতে পারে না। তার উপরে, ওদের সঙ্গে রয়েছেন আবার বাচস্পতি ঠাকুরের দিদি। তিনি পালকিতে উঠতে পারেন না, কেমন নাকি গা শিরশির করে। শোনো কথা! পালকিতে ঢুকিয়ে তেমন তেমন বাড়ির মেয়েদের গঙ্গায় চুবিয়ে আনে। লোকে দেখতে পাবে না, গঙ্গা স্নানও হবে। আর উনি পালকিতে চড়তেই পারেন না। ওঁর নাকি গা বমি বমি করে। তার উপরে মোটা মানুষ। তা ছাড়া বিধবা, বয়স হয়েছে। হেঁটে গেলে পাঁচ কান হবার ভয় নেই। নইলে নৌকায় করেও যেতে পারতেন। কাঁচা বয়সেই বা এমন আর কী কথা! কজনে আর পালকি জোগাতে পারে। বেশির ভাগই হেঁটে যায়। তবে বাচস্পতি ঠাকুরের নেহাত নতুন বউ, আর কাঁচা। একটুখানি পথ, তা হলই বা।
অবনী চলেছে পালকির ধারে ধারে। গুরুর নির্দেশ, গুরুপত্নীর সঙ্গে সঙ্গে আসবে সে। যদি কোনও দরকার হয়। স্বামীর সঙ্গে তো আর কথা বলতে পারবে না। শিবনাথই বা বলবে কী করে। যদি সঙ্গে সঙ্গে যেতে পারত, যদি ভানুমতীর পালকির দরজা খোলা থাকতে পারত, যদি দেখে দেখে কথা বলে বলে যেতে পারত, তা হলে কি আর সে আগে আগে যেত। সে যে শিবনাথ বাচস্পতি, প্রণাম নিতে নিতে আশীর্বাদ করতে করতে পথ চলতে হচ্ছে তাকে। তবুও চলায় বলায়, হাবে ভাবে মনের ভাব গোপন করতে পারছে না। তাতেই কত লোক টিপে টিপে হাসছে।
তাই অবনী রয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় এবং মেধাবী অবন। আদর্শে, দর্শনে, ধর্মে, যুক্তিতে অবনকেই ভয় অথচ বেশি। হবেই তো। তার হাতে গড়া সেরা ছেলে। আজ পর্যন্ত এক টিপ নস্যি নিতে দেখেনি কেউ। হুঁকো শুঁকেও দেখেনি। নম্র, কিন্তু বক্তব্যে যেন তীক্ষ্ণধার অসি।
অবনী চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। সে বড় বেশি উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। এই বুঝি তাকে ডাকল পালকি থেকে। বারে বারেই দেখছে পালকির দিকে। একবার পালকির এপাশে, আবার ওপাশে। কেবলি মনে হচ্ছে তাকে যেন কেবলি ডেকে চলেছে গুরু-মা। মনোযোগটা একটু বেশি দিয়েছে সে। বিয়ের রাত্রির পর তিন দিন গুরুপত্নীকে দেখতে পায়নি। ওর নাকি অসুখ হয়েছিল। অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল বাসর রাত্রে। তিন দিন পর দেখা হয়েছিল। যখন দেখা হয়েছিল, ভোরবেলা, সেই উজপের শেষে, নির্জন উঠানে গুরুপত্নী তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েছিল বড় বড় চোখ মেলে। অসংকোচে একেবারে শিশুর মতো তাকে তাকিয়ে দেখেছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। যেন এমনটি সে আর কোনওদিন দেখেনি। মাথা নত হয়ে এসেছিল অবনের। না, রাশভারী গুরু-গম্ভীর মতো মোটেই নয়। তবু গুরুপত্নী তো।
বিয়ে হয়েছে আজ ষোলো দিন। এর মধ্যে কত বারই দেখা হয়েছে। প্রতি বারেই ভানুমতী তাকে দেখেছে তেমনি বড় বড় চোখ মেলে। অবন জানে না, মনের মধ্যে কে যেন ওই চোখ দুটিকে অপূর্ব ভেবে লজ্জায় ভয়ে ও আনন্দে শিউরে উঠেছে। রূপসী এক ছোট মেয়ে, সারা গুরুগৃহে যেন কীসের আলো জ্বেলে দিয়েছে। কী রূপ! মনের কোন শক্ত লোহায় যে তাত লেগেছে তার, এই অপরূপের আগুনে, সে জানে না। তার এই কৈশোর-উত্তীর্ণ প্রায় মনে শিক্ষার ধার আছে, অভিজ্ঞতার ভার নেই। কোনও পাপের ছায়াও পড়েনি তার মনে। দুর্বলতা কোনওদিন বাসা বাঁধবার ছিদ্র পায়নি তার হৃদয়ে। এ দুর্বলতা নয়, পাপ নয়, তার নিষ্কলুষ হৃদয়ের আয়নায় রূপের ছায়া পড়েছে। সে ছায়া অন্ধকারে জন্ম দেয় না কীটের। যে ছায়া মুগ্ধ করে, অজান্তে হাসায়, ভাবায়, শ্রদ্ধা দিয়ে ভরে রাখে। শ্রদ্ধাটুকু বুঝি সংস্কার। আঠারোর রক্তে বড় বিচিত্র গুঞ্জন শোনা যায়।
গুরুপত্নী ছোট মেয়ে। তাই অমন তাকিয়ে থাকতে পারে। তাকিয়ে হঠাৎ একটু হাসতেও পারে। হাসে গুরুপত্নী। হাসে না হয়তো, অবনের মনে হয়, আড়ি দেওয়া খেলার সঙ্গিনী একটু ঠোঁট মচকায় শুধু।
মেঘ ডেকে উঠল দুরু দুরু করে। অবন ফিরে তাকাল আকাশের দিকে।
সেই মুহূর্তেই ঠক ঠক শব্দে ফিরে দেখল, পালকির দরজার ফাঁকে গুরুপত্নীর মুখ।
গুরুপত্নী! এই কি ভানুমতী! ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের গৃহিণীরা কস্তাপেড়ে শাড়ি পরেই জীবন কাটায়। যার থাকে অনেক ঐশ্বর্য, তারও বিলাসে বড় কার্পণ্য। বাচস্পতি-পত্নী বিবি সাজতে পারে না।
বিবি সাজানো হয়নি ভানুমতীকে। কিন্তু সাজানো হয়েছে। শান্তিপুরের ঠাস বুনননি তাঁতের নীলাম্বরী পরেছে। গাঢ় নীলে সব ঢাকা পড়ে গেছে অতলে। নীলাম্বরীতে রুপালি রেশমের ঝরনা। শাড়ির পাড়ও রুপালি। জামা নেই গায়ে। রেওয়াজও নেই। গলায় চওড়া বিছে হার, সিঁথিতে টায়রা, নাকে লাল পাথর দেওয়া সোনার নাকছাবি। সবই যেন একটু বড় বড়। দুহাত ভরতি চুড়ি, সোনা দিয়ে পেঁচানো লোহা ও শাঁখা। ভারী ভারী রুলি, নীল ও লাল পাথরের চোখ বসানো সাপের মতো তাগা। আঙুলে আংটি। আলতা পরা পায়ে রুপোর মল। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা৷ সিদুরের চেয়েও লাল তার পান খাওয়া ঠোঁট।
চেনা যায় না ভানুমতীকে। এই কি বিনি জেলেনির মেয়ে গঙ্গা। সত্যি অপরূপ রূপের উপরে রূপ হলে সে অপরূপ হয়। ভারী ভারী বড় বড় গহনা বটে, তবুও শাড়িতে গহনাতে নীল বিদ্যুতের ধারে ধারে যেন লাল আগুনের মতো জ্বলছে। পালকি প্রকোষ্ঠে, এই মেঘলা দিনে, চকিত চমকে ঝলকে উঠছে এক দ্যুতিময় মণি।
ঠকঠক শব্দের ঝুন ঝুন করে বেজে উঠল চুড়ি। অবনী ফিরে তাকাল। প্রথম কয়েক দিনের সংশয় ও ভয়ের সেই ছায়া নেই ভানুর চোখে। তাকে যেন অপহরণ করা হয়নি। সে যেন জেলেনির মেয়ে নয়। তাকে যেন চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। তার চোখে মুখে সতেজ তাজা ভাব। লজ্জা আছে, সংকোচ আছে, কিন্তু ধুকপুকুনির অন্ধকার লেপটে নেই কোথাও। একটু যেন হাঁপিয়ে পড়েছে পালকি চেপে। আর মুখে ঘাম দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু। অসংকোচে বাঁকিয়ে বলল, অই গো, ও সদ্দার পোড়ো, আর কতদূর গো।
গুরুপত্নী জিজ্ঞেস করছে। কেমন যেন নিচু তলার মেয়েদের মতো সুর গলার মধ্যে। জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিটিও। আর কী অদ্ভুত ছেলেমানুষ। তাই বোধ হয় এত সংকোচহীন। কিন্তু চোখগুলি ঈষৎ বাঁকা। পাতাগুলিও যেন একটু ভারী ভারী। দীপ্ত আলোর মাথায় গাঢ়বর্ণের পুরু ঢাকার মতো। আলোর ঝলকে সেই ঢাকনার চেহারা চেনা যায় না। তেমনি বোঝা যায় না কেন তার চোখের পাতা ভারী। লাল ঠোঁট দুটিতে গরমের বিরক্তি অথচ হাসি।
অবনী তাড়াতাড়ি বলল, এই তো সামনেই। সামনের ওই বট গাছের মোড়টা পেরুলেই রথের চুড়ো দেখা যাবে।
ভানু ভ্রূ কুঁচকে, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, বড় যে গরম ছাই। কপাট খুলে রাখব?
বিপদে পড়ল অবনী। সে অনুমতি দেওয়ার অধিকার তো তার নেই। কিন্তু গুরুপত্নীর তাই ইচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে, কী বলবে সে। সামনে তাকিয়ে দেখল, শিবনাথ অনেকখানি আগে রয়েছে। সে ছাত্রের মতোই জবাব দিল, যা ইচ্ছে।
যা ইচ্ছে। কী অফুরন্ত অধিকার তার। অবাক হয়ে যায় ভানুমতী, গম্ভীর হয়ে ওঠে। অবনীকে কেমন একটু বিস্মিত নিবিষ্ট চোখে দেখে খানিকক্ষণ ধরে। মনে মনে ভাবে, ভারী সুন্দর মানুষটা, না? খুব বড়লোক বোধ হয়। কিন্তু কেমন করে কথা বলে আমার সঙ্গে! যেন আমি রানি, মহারানি! ভানুর ঠোঁটে হাসি দেখা দেয়। ফিক করে হেসে ওঠে ভানু! বুকের মধ্যে চিকুর হানে, মাথা নামায় অবনী।
আবার গম্ভীর হয়ে ওঠে ভানু। সে তো নিজে হাসেনি। তার বুকে বসে রঙ্গ করে সেই চিরকালের কিশোরী। আবার গম্ভীর হয়ে নিজের সর্বাঙ্গ দেখে। দেখে, দেখতে দেখতে আবার হাসে। আজ সে
গুপ্তিপাড়ার মেলা দেখতে যাচ্ছে পালকি চড়ে। কত দিনের সাধ। আজন্ম সাধ ছিল এই রথ দেখা। কত কেঁদেছে, বায়না করেছে, দেখা হয়নি। আজ যাচ্ছে, তাও পালকি চড়ে, এক গা গহনা পরে।
বারে বারে হাসি চমকে উঠল ঠোঁটে। কত সাধ ছিল গহনা পরার। সবই পরেছে সে আজ। যা ভাবেনি, তা-ও পরেছে। পরমুহূর্তেই ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে, চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। কী হল, কী হল এ সব, কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল! এই রথ দেখা, পালকি চড়া, গহনা পরা,বহু চিন্তা, অনেক ছবি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল তাকে। এই চিন্তা ও ছবির সহস্রদাঁড়া বিছেটা কোথায় লুকিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই থেকে থেকে দাঁড়া মেলে আঁকড়ে ধরে তাকে। বিছের বিষের এ জ্বালা বড় দারুণ। তাকে অবশ করে দেয়, বিভ্রান্ত করে দেয়, তাকে অচৈতন্য করে ফেলে। এ সবকিছুর মধ্যেই কোথায় যেন লুকিয়ে আছে এক মহা সর্বনাশ, চুপিচুপি ফুঁসছে মরণ! দু চোখ ফেটে তার জল আসে।
পালকি দুলছে, ভানুর সারা শরীর দুলছে। মেঘে মেঘে কালো হয়ে আসছে দিন। সানাইয়ের শব্দ তীব্র হয়ে উঠছে। হাত দিয়ে দু চোখ ঢাকতে গিয়ে থমকে যায় ভানু। হাতের সোনার গহনার রাশি ও আঙুলের পাথরখচিত আংটির দিকে তাকিয়ে সে যেন অবাক হয়ে যায়। দুই গাল বেয়ে তার জল গড়িয়ে যায়। তার চোখ দুটিতে মুগ্ধ দ্যুতি ফোটে ধীরে ধীরে। সেই দ্যুতির মধ্যে ভেসে ওঠে শিবনাথের মুখ। শিবনাথ বাচস্পতি। সেইদিন, সেই বাসর রাত্রির কথা মনে পড়ছে ভানুর।
নিঝুম বাসরঘর। ভানু চিনতেও পারেনি, মনেও ছিল না সে কোথায় আছে। জ্ঞান হলে সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছিল, একটি ইট-বেরকরা ফাটা দেওয়াল। দেওয়ালের একটা খোপে টিমটিম করে প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের সামনে কালো পাথরের একটি ছোট মূর্তি। কীসের মূর্তি চেনা যায়নি। আবার চোখ বুজে, আবার তাকিয়ে দেখেছিল এক জোড়া চোখ, মস্ত একখানি মুখ ঝুঁকে রয়েছে তার দিকে। সামনে প্রদীপ। সেই আলোয় চকচক করে জ্বলছিল একটি সুন্দর পুরুষের মস্ত বড় মুখ, খাঁড়ার মতো নাক। কিন্তু সেই চোখের কোলে জল টলমল করছিল। ছেলেমানুষ ভানু, তবু যে মানুষ ব্যথা পায়, দুঃখ পায়, কাঁদে, তার মুখ দেখে বোঝবার মতো অনুভূতি ছিল তার। সে দেখেছিল, তার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা সেই চোখে জল। ব্যথা ও উৎকণ্ঠায় করুণ সেই মুখ। চোখ তুলে তাকাতে তার মনে হয়েছিল, শৈলর মতো যেন সোহাগ ভরে তাকে কে টেনে নিল কোলের মধ্যে। শক্ত আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল ভানুর শরীর। কোন অতলে লুকিয়ে থাকা এক দুরন্ত শক্তি উঠে এসেছিল সারা দেহে। ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া বিদ্রোহের সঞ্চার হয়েছিল তার হাতে পায়ে।
তখনই তার কানে এসেছিল গভীর ব্যথিত মিষ্টি গলা, ওগো, তোমার কী হয়েছে? কী কষ্ট, আমাকে বলো।
বিদ্রোহের লক্ষণটা তাতে চকিতে এক বার সারা দেহে একটি ঝংকার দিয়ে আবার থেমে গিয়েছিল।
শিবনাথ আবার বলেছিল, কে তোমার দিদিমণি, কাকে তুমি ডাকছিলে? তুমি যে বাবাগো বলে ডুকরে উঠেছিলে, তিনি কোথায়? বলল, বলল, আমি তাঁকে ডেকে নিয়ে আসব।
সব যেন জাদু মনে হয়েছিল ভানুর। এই মানুষ জাদু, তার গলায় জাদু। যে কোলের উপরে তার মাথা ছিল, তাও যেন ব্যথা ও স্নেহের জাদুতে মায়াময় হয়ে উঠেছিল। এই আশ্বাস ও ভালবাসায় তার ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কাঁদতে। চিৎকার করে, পাড়া মাথায় করে, দাপিয়ে ডুকরে হাহাকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নতুন পরিবেশ ও নতুন মানুষ ততখানি ছড়াতে দেয়নি তার মনটাকে। তার ওষ্ঠাগ্রে এক তীব্র হলাহলের স্রোত এসে আবর্তিত হয়ে উঠেছিল। আগুন জ্বলে উঠেছিল চোখে। সে বলে উঠেছিল, আমি…আমি…জেলের..
কিন্তু শোনা যায়নি সে স্বর। গলায় তার স্বর ছিল না। সে উঠে বসতে গিয়েছিল।
শিবনাথ গাঢ় স্বরে মিনতি করেছিল, না না, উঠো না। তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। আমি তো কিছু জানিনে, জানিনে তোমার কী কষ্ট আছে। আমার এত আনন্দ, কিন্তু আমার বড় ভয় হয়েছিল। কী কষ্ট তোমার, বলল আমাকে!
শিবনাথের গাঢ় ভাঙা স্বর। অসহ্য আনন্দের মাঝে আকস্মিক শঙ্কা ও বেদনা তাকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা দিয়েছে। সে যে তার শূন্য হাত ভরে পেয়েছে, সে যে না দেখতে ভালবেসেছে বাহান্ন বছর ধরে। এই মধ্য রাত্রের বাসর ঘরে তার বংশজ শাপমোচন ঘটেছে।
ওষ্ঠাগ্র থেকে বিষ কোথায় অন্তর্হিত হয়েছিল ভানুর। টেপা ঠোঁটের ওপর থেকে সে বিষ যেন স্খলিতফণা কাল-সর্পিনীর মতো ধীরে ধীরে আবার ঢুকেছিল গিয়ে তার হৃদয়ে। বিদ্রোহে আড়ষ্ট তার দেহলতা শিথিল হয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে অনুভূতি ফিরে এসেছিল শরীরে। সে অনুভব করেছিল শিবনাথের স্নেহাচ্ছাদিত কোল। অভিজ্ঞতা সব সময় বয়সকে অতিক্রম করতে পারে না। এত বড় এক পুরুষের চোখে জল দেখে তার কৌতূহল হয়েছিল। কেন জানি না, তার কুঁড়ি-মনে কোত্থেকে মাথা দিয়ে উঠেছিল একটু ব্যথা। ভয়ংকর ও বিচিত্র জীবনের সিঁড়ি দিয়ে চলেছে সে বটে, তবে সে মানুষ। মানুষ, মেয়েমানুষ, কিশোরী মাত্র। অবোধ শিশুও ভালবাসার স্পর্শ বোঝে, ডাইনির টিপুনি বোঝে। ভানু তার চেয়ে বেশি বুঝতে শিখেছিল। তাই ভয়ের চেয়েও বেশি মনটা ঝুঁকেছিল এই মানুষটির প্রতি। এই মানুষটি, যাকে তার মন আপনা থেকে ঠাকুর বলে সম্বোধন করেছিল। চিরকাল ব্রাহ্মণ পুরুষকে ঠাকুর বলে জানে সে। এও সেই ঠাকুর।
ঠাকুরের চোখে জল ও ব্যাকুলতা দেখে মনে তার বেদনা ও কৌতূহলের দ্বার খুলে গিয়েছিল। এই কৌতূহল ও বেদনা প্রেম নয়, অনুরাগও নয়। শিবনাথের সংস্পর্শে, এটুকু তার বিশ্বাস ও অভয়। যা তাকে শৈল দিয়েছিল অনেকদিন ধরে, একটু একটু করে। জীবনের যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মনকে সে কখনও কষ্টিপাথর তৈরি করার প্রয়োজন বোধ করেনি। পঙ্কিলতাকে সে চিনতে শেখেনি। নন্দন আর সর্বেশ্বর সেই সুযোগ নিয়েছিল। আজও মন তার কাঁচা কষ্টিপাথর! তবু, এই ঠাকুরের স্পর্শের মধ্যে সে বিশ্বাস ও ভয়শূন্য আশ্রয় অনুভব করেছিল যেন। সে যেন বুঝেছিল, তার ব্যথায় ব্যথিত ঠাকুর, তার দুঃখে সে উৎকণ্ঠিত, বিগলিত। এত বড় মানুষটা স্নেহ সোহাগ দিয়ে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল তাকে। ঠাকুর তার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দিতে চেয়েছিল।
তাই সে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারেনি। সে কাঁদবে না ভেবেছিল কিন্তু না কেঁদে পারেনি। ভয় যে ছিল না তা নয়। সে যে মেয়ে! আদর সোহাগ সবই ভাল। সেই ছলনায় ভুলিয়ে যদি এই ঠাকুর তাকে আর কিছু করে। সেই আর কিছু অস্পষ্ট দুর্বোধ্য এক ভয়ের বস্তু অথচ অন্ধ ঘরের এক সোনার খেলার পুতুলের মিটিমিটি হাসি সেই বস্তুতে। তীব্র কৌতূহল ও ভয় মিশ্রিত একটি বোবা খুশির শিহরন ছিল তাতে। তবু এখানে ভয়টাই তীব্র।
সে তখন না কেঁদে পারেনি। ঠাকুর দু হাতে তার মুখটি মুঠি করে ধরে টেনে নিয়েছিল বুকে। সে ভয় পেয়েছিল। তবু কৌতূহল ছিল। সে ভয়ের মাঝে অবাক হয়ে শুনেছিল শিবনাথের কথা।
শিবনাথ দুহাতে তার মুখোনি ধরে বলেছিল, জানি, তোমাকে সব ছেড়ে আসতে হয়েছে, যেমন করে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে আসে গাছ থেকে। তোমার কত খেলার সাথী ছিল; কত খেলা ছিল; কত বেড়ানো ছিল, মা বাপ ভাই ছিল। আর আজ আমি…
একটু থেমে আবার সে বলেছিল চাপা ফিসফিসে গলায়, যেন খানিকটা আপন মনে, আমি বড় হয়ে গেছি। বড় বড় হয়ে গেছি। কী করব! সে যে আমার দোষ নয়।…
বলে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিল। তারপরে আবার বলেছিল, কিন্তু তুমি আমাকে ভয় কোরো না। আমি ছোট হব, আমি তোমার খেলার সাথী হব, নাচব, গাইব। ভানু, ভানুমতী, আমাকে ভয় কোরো না তুমি।
এর পরেও না কেঁদে কেন থাকতে পারবে ভানু। তার চোখের জল পড়েছিল ঠাকুরের বুকে। ঠাকুর তাকে শিশুর মতো ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ঘুমোও। আমার তো আর এ জীবনে ঘুম হবে না। আমি তোমাকে শুধু দেখব। কাল সারাদিন, সারারাত তোমাকে আর দেখতে পাবনা। রাত্রিটুকু দেখে নিই। তারপর সারা জীবন ভর দেখব।
কী বিচিত্র! সত্যি, ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল ভানুর চোখে। আর কত বাসর, কত ফুলশয্যার ছবি ভেসে উঠেছিল তার চোখে। হালিশহরে কত বিয়ে দেখেছে। কত বর কনে, হাসি ঠাট্টা, উলু শঙ্খধ্বনি, শুভদৃষ্টি, আলো, ছাদনাতলা, এয়োদের চোখ টেপাটেপি, গায়ে পড়াপড়ি…
আর এই বাসর, বিয়ে, আর শুভদৃষ্টি। হ্যাঁ, শুভদৃষ্টির সময় তাকিয়ে দেখেছিল সে, এখন যেমন করে তাকিয়ে আছে তখনও এমনি করে তাকিয়ে ছিল ঠাকুর।
রাত পোহালে সে দেখেছিল, ঠাকুর নেই, ঠাকুরের দিদি রয়েছেন। একটু পরেই বাইরে থেকে ডাক এসেছিল, দিদি, রায়ঠাকুর এসেছেন।
দিদি তাড়াতাড়ি ভানুর গায়ে একখানি গরদের চাদর জড়িয়ে দিয়ে, ঘোমটা টেনে মুখ আড়াল করে দিয়ে বলেছিলেন। কবরেজ এসেছেন। চেঁচিয়ে বলেছিলেন, আসতে বলল।
শিবনাথ আজ আর এ ঘরে প্রবেশ করবে না। কবিরাজ এসেছিলেন। বিরাটাকার কালো এক পুরুষ। শ্রদ্ধা করেও মহিষতুল্য বলা যায়। দন্তহীন মাড়ি আর চোপসানো ঠোঁটের ফাঁকে অস্পষ্ট আধো আধো কথা।
কিন্তু চোখে যেন বাজপাখির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দিদি নতুন বউয়ের হাত বের করেই রেখেছিলেন। নিজে বেশ খানিকটা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়েছিলেন সরে। রায়ঠাকুর এক বার এদিক ওদিক দেখে বিনা বাক্যব্যয়ে ভানুর হাতটি তুলে নিয়েছিলেন। মুখের নানান ভঙ্গিতে বারকয়েক হুহু করে ঘাড় নেড়েছিলেন, এক বার যেন হেসেও ছিলেন। রুগির নাড়ি নাকি রায়ঠাকুরের কানে কানে সব কথা বলে দেয়! তারপর হঠাৎ হৃ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত ঝুঁকে পড়ে দেখেছিলেন ভানুর হস্তরেখা। এই বিদ্যাটিও কিঞ্চিৎ আয়ত্ত ছিল তাঁর। ভানুর রক্ত-স্পন্দিত নাড়ির অঙ্ক ও তার জীবনের ভবিষ্যৎ ছবি সুস্পষ্ট দেখতে দেখতে রায়ঠাকুরের ঘন ঘন নেচেছিল। গোটা মুখে অনেক গোলাকার রেখা ত্রিভুজ হয়ে উঠেছিল।
শিবনাথ অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিল বাইরে। রায়ঠাকুর বাইরে আসতেই সে নস্যদানটি বাড়িয়ে ধরেছিল। রায়ঠাকুর নস্যি নিয়ে শিবনাথের সঙ্গে গিয়ে বাইরের ঘরে বসে বলেছিলেন, আশ্চর্য! কখনও সে লক্ষ্মীঠাকুরানি, কখনও দেবী চামুণ্ডা, কিন্তু আদতে রাজেশ্বরী। বড় অদ্ভুত হাতের রেখা হে বাচস্পতি, তোমার কিশোরী গৃহিণীর। ইনি ভগবতীতুল্যা! কিন্তু দুজন আছেন। খুশি হলে সুখ ও সমৃদ্ধিদাত্রী লক্ষ্মীরূপিণী, অ-সুখে সর্ববিনাশিনী চণ্ডালিকা, তবে ইনি রাজেশ্বরী, সন্দেহ নেই।
রায়ঠাকুরের মুখে এ কথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছিল শিবনাথ। বলেছিল, আপনি আশীর্বাদ করুন–যেন সে চিরদিন আমার লক্ষ্মী হয়ে থাকে। কিন্তু শরীর ওর কেমন দেখলেন?
উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। মানসিক ক্রিয়া-যন্ত্রটি একটু বিকল হয়েছে, ওটা আঘাতের প্রতিক্রিয়া। বৈকল্যহেতু অচৈতন্য, তা তো হয়েই থাকে। অনিদ্রা, ভয় আর কোষ্ঠকাঠিন্যও দায়ি। ভয় একটু হবেই, স্ত্রী তোমার নাবালিকা, গৌরী। রক্ত প্রবাহে রূপান্তরের লক্ষণ সুস্পষ্ট, ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীব্রতা ও অস্পষ্টতা, উভয়হেতু তা বাধাপ্রাপ্ত। কেটে যাবে, অল্পদিনের মধ্যেই তোমার স্ত্রী নারীত্বের মুখ দেখবেন। তোমার শুভরাত্রি কবে?
রায়ঠাকুরের কথা শুনতে শুনতে শিবনাথের মনটা তীব্র খুশিতে অবশ হয়ে পড়েছিল। খুশির কারণ আশ্বাস ও নতুন লক্ষণের কথা। সর্বেশ্বর তাকে গৌরীদান করেছে। স্থলিত স্বরে বলেছিল, আগামীকাল।
নির্বিকার গলায় বলেছিলেন কবিরাজ রায়ঠাকুর, তা হোক, ভাবনা নেই। সর্বরোগনাশকের সঙ্গে একটি কিশোরী-সখা বটিকা দেব সেবন করতে। তাতেই সব বাধা দূরে যাবে। ওতে একটু মাদকদ্রব্য থাকবে সেইজন্য দুশ্চিন্তা কোরো না।
তবু ভয় পেয়েছিল শিবনাথ। বয়োজ্যষ্ঠ রায়ঠাকুরের কথার অন্তনিহিত ইঙ্গিতে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তার মুখ। বলেছিল, তার কী প্রয়োজন রায়ঠাকুর, অল্পদিনের মধ্যেই যখন–
রায়ঠাকুরের গালে কতকগুলো ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল। বলেছিলেন, প্রয়োজনটা তো বড় কথা নয়, ধর্মটা আগে। তোমার ঠাকুরদা বিশিষ্ট পণ্ডিত হয়েও তান্ত্রিক পুরুষ ছিলেন। তোমাদের বংশের নামও আছে সেদিক থেকে। তুমি ভাগ্যবান, ক্রীতকন্যাকে কুমারীরূপে পেয়েছ। ওঁরও যেরকম লক্ষণাদি রয়েছে, তাতে বুঝলাম বাচস্পতি, এ তো তোমার শুভরাত্রি নয়, তোমার দেবী পূজার লগ্ন এসেছে।
কথা শেষ করতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পরিপূর্ণ নায়িকার লক্ষণ নিয়ে এসেছেন তোমার পত্নী। আমি বলছি বাচস্পতি, শুভরাত্রির ভোগের পথে তুমি যেয়ো না আর দশজনের মতো। নিজের ঘরে তুমি চক্র রচনা করো, উপচার সংগ্রহ করো, শুভরাত্রি তোমার সাধনরাত্রি হোক। এ যেন স্বয়ং মহাভৈরবেরই কৃপা, তিনিই তোমার গৃহে গৌরীর আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। তুমি গৌরী পূজা করো, গৌরী গঠন করো। এই মহা লক্ষণকে বিফলে যেতে দিয়ো না। যাতে কোনওদিক থেকেই অসুবিধা না হয়, আমি সেরকম ভাবেই ওষুধ দেব। তোমার শক্তিপ্রয়োগের প্রয়োজন হবে না; নায়িকা নিজেই অগ্রগামিনী হবেন।
শিবনাথ নিরুত্তর ছিল। তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কে তার যে ঘাঁটাঘাঁটি কম ছিল, তা নয়। সম্ভবত তার বাপ-পিতামহ জীবিত থাকলে আজ রায়ঠাকুরের মতোই নির্দেশ দিতেন। তবুও মতদ্বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও শিবনাথের যেন এ বিষয়ে কোথায় আপত্তি ছিল। সে আপত্তি হৃদয়গত। প্রেম তাকে আজ শাস্ত্র থেকে নিরস্ত করেছে। বন্ধু নারায়ণ অন্তর্যামী হলে ছুটে এসে বিদ্রূপ করত। যে ক্রীত কন্যাকে বিয়ের জন্য সে শাস্ত্রের পান থেকে চুন খসতে দেয়নি। তারই লাঞ্ছনার কথা চিন্তা করে ধর্মকে দুরে রাখতে চাইছে। তন্ত্র-চক্র না হোক, শুভরাত্রির ধর্মই বা বাদ যাবে কেন? হৃদয়, প্রেম, এ সব দিয়ে কী দরকার। ধর্ম, ধর্ম-ই। বিদ্রূপ করত বইকী নারায়ণ, যদি শিবনাথের মনের কথা জানতে পারত।
সে নিরুত্তর ছিল অন্য কারণেও। রায়ঠাকুরকে বেশি ঘাঁটালে তখুনি কলকাতার মেডিকেল কলেজের বিষয় উত্থাপিত হত। হয়তো তখুনি ডাক্তার বলি কিংবা গুডিভের যুক্তি ছিন্ন করতে বসতেন তিনি। ষোলো বছর আগে সূর্যকান্ত চক্রবর্তীদের বিলাত যাত্রা বন্ধ করার জন্য কলকাতা যেতে চেয়েছিলেন রায়ঠাকুর। চিঠি দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরকে–আপনি আর গুডিভ কয়েকটি দেশীয় সন্তানকে ডাক্তারি শিক্ষার জন্য বিলাত পাঠাইয়াছেন শুনিয়া মর্মাহত হইলাম। তাহারা পাপের মধ্যেই জন্ম লইয়াছে, ভবিষ্যতে তাহাদের জবাবদিহি থাকিবে, কিন্তু গুডিভের অন্তরঙ্গ পাপস্রষ্টা বন্ধুরা জবাবদিহি করিবার জন্য কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পর্যন্ত খুঁজিয়া পাইবে না। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে আপনাদের যদি কিছু করিবার থাকে তবে দেশের প্রবঞ্চক বৈদ্যশাস্ত্রকারদিগকে দমন করুন, অনধিকারীর চর্চা বন্ধ করুন, আপনার দেশের লুপ্ত শাস্ত্রকে উদ্ধার করুন, গুডিভের কালা সন্তানদের বিলাত পাঠাইবেন না।
গুডিভের কালা-সন্তান বলার কারণ সূর্যকান্ত চক্রবর্তীকে লোকে আজও গুডিভ চক্রবর্তী বলে আদর করে ডাকে। গুডিভ তাঁকে স্নেহ করতেন খুব। সে চিঠির কোনও জবাব দেননি দ্বারকানাথ ঠাকুর। পরে সূর্যকান্ত যখন বিলাতে মেম বিয়ে করলেন, তখন রায়ঠাকুর কলকাতার সংবাদপত্রে ফের চিঠি দিয়েছিলেন এবং তাঁর সে চিঠি ছাপাও হয়েছিল। লিখেছিলেন, কাল বহিয়া যাইবে, সূর্যকান্তের মেমসাহেব পত্নীর গর্ভজাত পুত্রেরা খাঁটি চক্রবর্তী বলিয়া ভবিষ্যৎ সমাজে চলিয়া যাইবে এবং তৎসময়েও আমরা ভাবিব, সূর্যকান্ত চক্রবর্তী শুধু ম্লেচ্ছ চিকিৎসাশাস্ত্র উদ্ধার করিতে সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়াছিলেন, কালা মানুষটির প্রাণে আর কোনওপ্রকার উদ্দেশ্য ছিল না।…
কিশোরী-সখা বটিকা সম্পর্কে কোনও কথা বলতে গেলেই রায়ঠাকুর চিকিৎসা শাস্ত্রের কথা উত্থাপন করবেন, নানান কথা এসে ভিড় করবে। বিশেষ মেডিকেল কলেজের প্রসঙ্গ তো উঠবেই। কিন্তু সে সব কিছুই যে ভাবতে চায় না সে। তাই শিবনাথ নিরুত্তরই থেকে গিয়েছিল। রায়ঠাকুর বাড়ি গিয়ে ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দুটি বটিকার চেহারাই এক ছিল। ভয়ে শিবনাথ কোনওটাই ভানুকে খেতে দিতে পারেনি। সে যে জানে, তার পরিণতি কী ভয়ংকর হবে। হয়তো ভানু চিৎকার করে হাসবে, নগ্ন উন্মাদিনী হয়ে নাচবে।
কালরাত্রির পর শুভরাত্রি। ভানুকে হাঁড়ি স্পর্শ করতে হয়েছিল। রান্নাবান্নার কাজ করতে হয়েছিল দিদির সঙ্গে সঙ্গে। বিয়ের যাঁরা নিমন্ত্রিত ছিলেন, বউ-ভাতেও তাঁরাই এসেছিলেন। ভানু সকলের পাতে পাতে অন্ন ব্যঞ্জন পরিবেশন করেছিল। লোক কম ছিল না। টোলের পড়ুয়াদের নিয়ে নিমন্ত্রিতের ভিড়ে ভরে গিয়েছিল উঠান।
অত বড় মানুষ শিবনাথ। তার বুকের মধ্যে কেন যেন প্রাণটা থরথর করে কাঁপছিল। তার ছুটোছুটির অন্ত ছিল না। তারই মাঝে বার বার ভানুকে দেখছে সে। অস্থির আনন্দের মধ্যে চকিত ব্যথা ও উৎকণ্ঠায় চমকে উঠেছিল সে। ভানুর যে শরীর খারাপ। এত খাটুনি, ওইটুকুনি মেয়ে কী করে সহ্য করবে! কিন্তু কিছুই বলা যায়নি। নিয়মকে মানতে হবে তো৷ এ যে তার সৌভাগ্য। সৌভাগ্য, তার স্ত্রী আজ সকলের পাতে অন্ন পরিবেশন করছে।
রাত্রে যখন সে পেয়েছিল ভানুকে, তখন ভানুর চোখে জল। একটা ছেলেমানুষি কান্নায় অস্থির করে তুলেছিল তাকে। তার রাগ হয়েছিল এত খাটাখাঁটির জন্য। রাগ ব্যর্থ, তাই কান্না পেয়েছিল। কান্নার আরও কারণ ছিল। সে কারণ আজকের এই রাত্রি–ভয়ংকর, কুৎসিত ও ভয়াবহ। শিশু বয়স থেকেই এ রাত্রির অর্থ পরিষ্কার ছিল তার কাছে। তাই সে কাঁদছিল রাগে, দুঃখে ও ভয়ে। সে কাঁদছিল বিদ্রোহ করার জন্য। সেই বিদ্রোহে যে দারুণ দুর্ঘটনা ঘটবে, তার জন্য।
কিন্তু শিবনাথ, ভানুমতীর ঠাকুর তার ধার দিয়েও যায়নি। সে এসে সান্ত্বনা দিয়েছিল ভানুকে; তাড়াতাড়ি মুছিয়ে দিয়েছিল চোখের জল। দুহাতে তুলে বসিয়ে দিয়েছিল অতি সাধারণ বিছানা পাতা খাটের ওপর। বলেছিল, ভয় কী? কোনও ভয় নেই। আমি তোমাকে আজ সাজাব, তারপর তুমি ঘুমোবে, কেমন?
ঘরে টিমটিম করে জ্বলছিল প্রদীপ। চন্দন-ধূপ ও প্রদীপের রেড়ির তেলের মিশ্রিত গন্ধে ভরে উঠেছিল ঘরের মধ্যে। চারদিকে নিঝুম। বাইরে একটু ঝোড়ো হাওয়ার গুঞ্জন ছিল। ঘরের মধ্যেই, কোনও অন্ধ কোণ থেকে, থেকে থেকে একটা ব্যাঙ উঠছিল ডেকে। ঘরের মধ্যেই, হয়তো খাটের তলা থেকেই তারস্বরে চিৎকার করছিল একটা ঝিঁঝিপোকা। এই শব্দগুলিই যেন একটি বিচিত্র পরিবেশ রচনা করেছিল। একটি বিচিত্র সুর, একটি অভূতপূর্ব তাল যেন ঘরে বাইরের সর্বচরাচরে শিবনাথের হৃৎপিণ্ডের তালে তালে, লয়ে লয়ে ফিরছিল লহর তুলে। প্রদীপ-শিখাটা মাঝে মাঝে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, ঝুঁকে পড়া চাল, দেবোওয়া এই ঘরটাও কাঁপছিল। বুঝি শেষ হচ্ছিল রাতের প্রথম প্রহর। শেয়াল ডাকছিল বোধ হয় খিড়কি পুকুরের ধারে, রাংচিতার ঝাড়ে।
শিবনাথ কুলুঙ্গি থেকে শিবলিঙ্গ সরিয়ে একটি ইট তুলে ফেলেছিল। ইটের তলা থেকে একটি লোহার চাবি বের করে নিঃশব্দে হেসে উঠেছিল ভানুর দিকে তাকিয়ে।
ভানুর কেমন ছমছম করছিল মনটা। সাজাবে বলে কুলুঙ্গির ইট সরাচ্ছে কেন ঠাকুর। ঘরের দক্ষিণে দেওয়ালে গাঁথা কাঠের সিন্দুক। কাঠের সিন্দুকের ভিতরে লোহার সিন্দুক। তার মধ্যে ছিল শিবনাথের মা-ঠাকুমাদের সঞ্চিত গহনা। শুধু গহনা নয়, অল্প হলেও কিছু সোনার আর রুপার মোহর ছিল।
এই সিন্দুক জীবনে কয়েকবার খুলেছে শিবনাথ। আর মায়ের কথা মনে পড়েছে, বাবা, বংশজের ঘরে জন্মেছিলুম, তাই তোর বাবাকে পেয়েছিলুম। কিন্তু তুই যে আমার কুলীনের মেয়ের বাড়া। চোখের সামনে দেখে গেলুম, তোর দুই খুডোর বে হল না মেয়ের অভাবে। তবু তাদের ঘরে এক চিমটি সোনাও আমি বড় সাধ করে তুলে রেখে গেলুম, যদি কোনওদিন আমার বউমা আসে, তাকে দিস। সাবধান! তুই দিনরাত পাঁজিপুথি নিয়ে পড়ে থাকিস। বোনটা বিধবা হয়ে ঘরে পড়ে রয়েছে। মানুষের মন, কখন কী করে বসে বলা তো যায় না। ও যেন জানতে না পারে কোথায় কী রয়েছে। ওকে যা দিয়েছিলুম সবই শ্বশুরবাড়ি থেকে কেড়ে নিয়েছে। তুই বংশরক্ষার জন্যও বিয়ের দিকে একটু মন দিস। দিনকাল আসতে পারে, মেয়ে জুটতেও পারে। কোম্পানির রাজত্বে তো সবই হয়। আমার বউমাকে সব দিস, কাপড় গহনা…
শুভরাত্রির দিন সেই কথাই মনে পড়েছিল শিবনাথের। সে ওই সোনার তাল যখ দিয়ে রেখেছিল। এর আগে কয়েকবার সে সিন্দুক খুলেছে, সন্তর্পণে হাত দিয়ে তুলে তুলে দেখেছে চুড়ি, হাঁর, অনন্ত, টায়রা। আর বুকের মধ্যে একটা আচমকা ফিক ব্যথা নিয়ে সব রেখে পালিয়েছে। না, না, কেউ আসবে না কোনওদিন, কারও হাতে গলায় সে পরাতে পারবে না এই অলংকার।
কিন্তু সেইদিন এসেছিল, সেই শুভরাত্রির দিন। বুঝি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছিল। পৃথিবীর কঠিন মাটি উঠছিল ভিজে, কী এক সুখের স্পর্শে বাতাস হয়ে উঠেছিল ব্যাকুল। কিন্তু তার সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছিল। গহনার বাক্সটি এনে ভানুমতীর কোলের কাছে বসিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমার, সবই তোমার। আমার মা তোমাকে দিয়ে গেছে।
ভানুর ভয় করছিল। মা গো! এত সোনা, এত গহনা। সবটাই ভয়ের। এই আলো-আঁধারিতে কাঁপা কাঁপা ঘর, দেয়ালে দেয়ালে শ্যাওলা ঘাস, ব্যাঙ, ঝিঁঝির ডাক, হাঁ করা ফাটল। তার মধ্যেই হাট করে খোলা ওই সিন্দুকের পাল্লা আর এই গহনার রাশি। যেন কতকগুলি সোনা রং-এর বিষাক্ত সাপ একটা পিতলের বাক্সের মধ্যে জড়াজড়ি করে পড়ে ছিল। মাঝে মাঝে পাথরের ঝিকিমিকি দপ দপ করছিল শাণিত চোখের মতো। আর এই ঠাকুর! দর দর করে ঘামছিল, হাসি মুখটা কী অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।
ভয় হচ্ছিল ভানুর। আর তার ভয়ের গহন বনে একটা জংলি ফুলের কুঁড়ি দল মেলছিল। সেই কুঁড়ির খুশি ফিসফিস করছিল, আমার, এ সবই আমার।
বিনি জেলেনির মেয়ে, কত যে সাধ ছিল তার পালঙ্ক-গহনা শাড়ির। ওমা! এ যে সবই হল তার। হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী তা হলে নিশ্চয় খুব জাগ্রত ভগবতী। সে নিশ্চয় সব শুনেছিল ভানুর কথা। কিন্তু এমনি করে! এইখানে, এই ঠাকুরের বাড়িতে। বড় যে ভয় করে। খুশির সেই ফুলটি যে ফুটতে চায় না।
এই সময়েই চকিতে মনে পড়েছিল তার শৈলর কথা। তার দিদিমণি শৈল, গুপ্তিপাড়ার সেই ঘরে অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিংবা হয়তো, এই ঘরেরই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, কোনও ফাটল দিয়ে দেখছে। সে যে এই বাক্সের জন্যই পথ চেয়ে আছে। যেন সত্যি শৈল এসেছে, এমনিভাবে সে চারিদিকে চোখ বুলিয়েছিল। শিবনাথ বলেছিল, কী দেখছ?
চমকে উঠেছিল ভানু। ভীত অসহায় ভাবে, দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বলেছিল, কই, কিছু নয় তো৷ কিছু দেখছে না ভানু।
শিবনাথ বলেছিল, এসো, আমি তোমাকে সব পরিয়ে দিই।
সব পরিয়ে দিয়েছিল। পায়ে পাঁয়জোর থেকে মাথায় টায়রা পর্যন্ত। ভানুর মনে হয়েছিল, তার সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছে যেন কেউ, আর কী ভারী! শিবনাথ বার করে দিয়েছিল আশমানি রংএর ঢাকাই শাড়ি। বলেছিল, এটা পরো।
একটা দুর্বোধ্য ভয় ও খুশিতে, কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়টি পরেছিল ভানু। শিবনাথ প্রদীপের শিখাঁটি বাড়িয়ে দিয়ে সামনে এসে বলেছিল, এক বার খাটের উপর উঠে দাঁড়াও, আমি দেখব।
ভানুর ভয়ের মধ্যেও ঠোঁটের পাশে একটি হাসির রেখা কাঁপছিল। যেন অবশ হয়ে পড়েছিল হাত-পাগুলি। ঠাকুরের গলায় জাদু ছিল, তাই সে উঠে দাঁড়িয়েছিল। শিবনাথ হাঁটু মুড়ে বসেছিল তার পায়ের কাছে। আনন্দে আত্মহারা তার বাহান্ন বছরের রূপমুগ্ধ অন্তর একেবারে মাতাল হয়ে পড়েছিল। রূপ নয়, দেবী দর্শন করছিল যেন। জামা ছিল না, ঢাকাই শাড়ি বার বার খসে খসে পড়ছিল। শিবনাথ বলেছিল, এসো, আমার কাছে এসো৷
গলায় তার অভয় ছিল, তবু ভয় হয়েছিল। ঠাকুর যেন কী বলছে বিড়বিড় করে। ভয় হয়েছিল, তবু মন্ত্রমুগ্ধার মতো ভানু বসেছিল শিবনাথের কোলের কাছে। বাহান্ন বছরের নিস্তরঙ্গ রক্তে দোলা লেগেছিল। সেই দোলার মধ্যে একটি তীব্র কান্না আবর্তিত হচ্ছিল। রায়ঠাকুর যে পুজোর কথা বলেছিলেন, সেই পুজো নয়, সেই চক্র নয়। এই তো, এই তো পুজো করছে শিবনাথ। সে যে মনে মনে বলছে, দেবেশী, হে দেবেশী, তুমি আমার পরম প্রেয়সী, তুমিই আমার আরাধ্যা। ঘোর অন্ধকার বিশ্বের এক প্রান্ত আজ আমার চোখের সামনে দেখেছি, আমার মধ্যে অজ্ঞতা দুর হচ্ছে।
রক্ত ফেটে পড়েছিল শিবনাথের সারা মুখে। বলেছিল, ভয় করছে?
কেন?
কী বিচিত্র প্রশ্ন ভানুর। ভয়ের কথা যেন ভুলে গেছে সে। ভানুর মনের কথা শুনতে চেয়েছিল শিবনাথ।
ভানু নিরুত্তরে শুধু শিবনাথের সারা গায়ে ও মুখে চোখ বুলিয়েছিল। তার কিশোরী চোখে তীব্র অনুসন্ধিৎসা ও ভয়। শিবনাথ দুহাতে তাকে কাছে টেনে বলেছিল, ভয় কী! কোনও ভয় নেই।
কাছে টেনে নিয়ে, তার আগুনের মতো উত্তপ্ত ঠোঁটে, ভানুর বরফের মতো ঠাণ্ডা মুখে একটি চুমু এঁকে দিয়েছিল। কোনও পরিবর্তন হয়নি ভানুর মুখের। সে চোখ দুটি বড় বড় করে তেমনি তাকিয়ে ছিল। যেন ভয়ের মধ্যে খানিকটা বিস্ময়ের হালকা ঘোর লেগেছিল তার। শৈলবালার চুম্বনে একটা তীব্র জ্বালা ছিল। এখন জ্বালা আনন্দ কিছুই ছিল না। একটা অর্থহীন স্পর্শের মতো মনে হয়েছিল।
অস্থির আনন্দে আবার চুমু এঁকে দিয়েছিল শিবনাথ।
আবার আবার! ভানুর কোনও প্রতিবাদ ছিল না, বাধা ছিল না। কেবল তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছে বলেছিল, আমার ঘুম পেয়েছে।
শিবনাথ বলেছিল, ঘুমোও!
ভানু সেইখানেই শুয়ে পড়েছিল। ঘরের মধ্যে গরম ছিল, ঘামে তার ঢাকাই শাড়ি ভিজে উঠেছিল গায়ে।
আত্মহারা শিবনাথ হাত বুলিয়েছিল আদর করে। আর ভানু চোখ বুজে দেখছিল, নব এসে দাঁড়িয়েছে যেন তার সামনে। অবাক, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ নব হাঁ করে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। ভানুর বারো বছরের একটা নিঃশব্দ কান্না গুমরে উঠছে। সে কান্না শুধু ব্যথার নয়, নবকে ধিক্কার দিচ্ছে, নবর উপর অভিমান করছে।
.
একটা বড় রকমের দোলা দিয়ে পালকি নামাল বেয়ারারা গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবন জীউর মন্দিরের অদুরে বাঁশঝাড়ের তলায়। পালকি থেকে বেরুল ভানু। একটু পরেই সেখানে এসে পড়ল পেছনে পড়া শিবনাথের দিদি আর বিলোচনের ছেলে বউ। পালকি তো আর বেশিদূর এগোতে পারবে না। জাগ্রত বৃন্দাবন জীউর স্থান, মানুষের পালকি চড়ার অধিকার নেই এখানে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, বউ-ঝিয়েরা ঘিরে ফেলল চারদিক থেকে।
দেখি, দেখি, কার বউ! বাঃ, বেশ ফুটফুটে বউটি তো! বেউলের শিবঠাকুরের সুন্দর বউ, তা হোক।
শিবনাথের মুখের স্বাভাবিক রং আর দেখা যায় না, সবসময়েই লাল হয়ে রয়েছে; এখনও যেন নতুন ছোকরাটি, লজ্জায় মুখ তুলতে পারে না। বেউলের শিবু পণ্ডিতেরও এমন হাল হয়–যার পাণ্ডিত্যের ভারে সকলের মাথা নত হয়। শিবনাথ বলল, কই, বিলোচন চলো হে–এখন একবার মন্দিরের দিকে চলো৷ ঠাকুর এতক্ষণে রথে চড়ানো হয়ে গেছে। তবু চলো, একবার শূন্য মন্দিরেই মাথা ঠেকিয়ে আসি। গোবিন্দ আছেন তাঁর মন্দিরে।সকলে চলল। সকলের মধ্যে, ভানুর পায়ের ঝাঁজোর বাজতে লাগল ঝুন ঝুন করে বাজতে লাগল শিবনাথের হৃৎপিণ্ডের তালে তালে। এই হৃৎপিণ্ড দিয়ে সে ভানুর ছোট্ট পাখির মতো হৃৎপিণ্ডের তাল অনুভব করেছে। কিন্তু সেই শুভরাত্রি তার আর আসেনি, ভানু নারীত্বের মুখ দেখেনি আজও। না দেখুক, দেখবেশীঘ্রই দেখবে।
বৃন্দাবন জীউর মন্দির। লোকে বলে গুপ্তিপাড়ার মঠ। মঠের মোহান্ত মন্দিরের পেছনে বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজনের সঙ্গে। ভরাট মূর্তি মোহান্তের। গলায় তাঁর ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের সঙ্গে সোনার হার, হাতে সোনার তাগা। হেসে অভ্যর্থনা করলেন শিবনাথকে। শিবনাথ প্রতিনমস্কার করে বলল, আমরা কিন্তু একটু খড়ি স্পর্শ করব। মোহান্ত বললেন, সে আর বলতে।
বন্দুক হাতে ছুটে এলেন বৃন্দাবন স্টেটের নায়েব। বললেন, গঙ্গোদক কলসি ওঠানো হয়েছে, আমি নিশান আর বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে আছি। সময় আর বেশি নেই। আপনার আসতে আজ্ঞা হোক।
মোহান্ত বললেন, এই যাই–শোনো, চৌকিদারেরা এসেছে?
আজ্ঞে।
তারা চারদিকে বেড়া বেঁধেছে?
বেড়া অর্থাৎ রথের চারপাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে বেড়া তৈরি করে দশ-বিশটা এলাকার চৌকিদারেরা। নইলে রথের চাকার তলায় পড়ে প্রাণ হারাতে পারে কেউ। চৌকিদারদের সঙ্গে থাকে ঝাঁপের মোড়ল দারোগারা, নয়তো রাইটারবাবু।
আমলা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, চৌকিদারেরা বেড়া বেঁধেছে।
শোনো, বেড়ার মধ্যে, আমাদের সঙ্গেই বাচস্পতি মশায়ের ব্যবস্থা করো।
আমলা বললেন, আজ্ঞে, আচ্ছা।
সময় আর বেশি নেই। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। মন্দির দেখা পরে হবে। সকলে আগে রথের দিকেই গেল। আমলা নিয়ে গেলেন শিবনাথকে সপরিবারে। সঙ্গে বিলোচন আর তার ছেলেমেয়েও রয়েছে। চারিদিকে অসম্ভব ভিড়। লোকের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। ভানু অবাক হয়ে ভিড় দেখছে। সামনে যে রথ, সে খেয়ালও নেই, আর তাকে দেখছে কত লোক, তার ইয়ত্তা নেই। তার সৌন্দর্য, তার গহনা দেখছে কত মেয়ে পুরুষ।
অনেক দিনের সাধ ছিল ভানুর, জন্মকালের সাধ-গুপ্তিপাড়ার রথ দেখবে। সেই রথ। সাদা রং-এর কাঠের ঘোড়া, সাদা রং-এর সারথি। তার উপরে নকল মসলিনের ঝলমলে পোশাক পরানো জগন্নাথের মূর্তি। একেবারে উপরে স্বয়ং বৃন্দাবনজি। অপলক চোখ, হাসিমুখ দারুমূর্তি বৃন্দাবনচন্দ্র। আসল রথযাত্রা তত তাঁরই। তিনিই জগন্নাথের প্রতিভূ। কিন্তু ভানুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, রথের প্রথম ধাপের উপর, চার কোণে চারটি দারুমূর্তি দেখে। একটি মূর্তি দেখে, মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। মায়ের মতোই স্বাস্থ্যপুষ্ট ফরসা মেয়েমানুষ। মায়ের মতোই তার সু-উন্নত বুক, শাড়ির আঁচলে ভারী আঁট। আঁশবটি পেতে বসে, মাছ কুটছে সেই মেয়েমানুষের মূর্তি। আর এক কোণে একটি পুরুষ মূর্তি। ঠিক তার বাবার মতো। তেমনি কালো, স্ফীত পেশি কোমরে সামান্য একটু ন্যাকড়া জড়ানো প্রায় ন্যাংটো মূর্তি। মানুষ-পরিমাণ কাঠের পুতুল, কিন্তু ভানুর চোখে পলক পড়ে না। বুকটা টনটন করে উঠল। মনে হল, এখুনি যেন মূর্তিটা চিৎকার করে উঠবে, ওরে গঙ্গা, দ্যাখ মরে এখানে কাঠ হয়ে আছি। তোর কাছে আর যেতে পারলুম না। তুই রাজরানি হয়েছিস, হতে চেয়েছিলি, তবে কেন তোর কান্না কান্না আসছে মা।
হ্যাঁ, কান্না আসছে, মূর্তি দেখে বড় কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এত ভিড়, গণ্ডগোল, ভানুর মন আবার অন্যদিকে চলে যায়। চোখে পড়ল আর একটি মূর্তি। যেন কোম্পানির সেপাই, হাতে বুঝি বন্দুক। আর এক কোণে একটি মূর্তি দেখে, ভানুর লজ্জা করে উঠল। সে নিজে যদি কাপড়-চোপড় সব খুলে দাঁড়ায়, তা হলে যেমনটি দেখতে হবে, ঠিক যেন সেইরকম। ওমা! কেন, এত লোকের চোখের সামনে পুতুলটার লজ্জা করছে না?
চৌকিদারেরা রথের সামনে বিশ হাত জায়গা খালি রেখে দিয়েছে। এলিয়ে পড়ে রয়েছে মোটা শিকলের সঙ্গে মোটা কাছি। যেন দুদিকে দুটো ময়াল সাপ, একটু একটু করে ফুলছে। চৌকিদারেরা লোজন ঠেলে রাখতে পারছে না। সকলেই আগে থেকে দড়ি ধরে রাখবার জন্য ঠেলাঠেলি করছে; চিৎকার করছে–জয় বৃন্দাবনচন্দ্রের জয়।
মোহান্ত এলেন। ইতিমধ্যে পোশাক বদলেছেন! দণ্ডধারণ করেছেন হাতে, ছত্ৰী ধরেছে ছত্র তাঁর মাথার উপরে। উন্মুক্ত কৃপাণ নিয়েছে একজন গায়ে ছাই-ভস্ম মেখে।
বিশ জন ঢাকি ঢাক বাজাতে বাজাতে এসে প্রদক্ষিণ করতে লাগল রথের চারদিকে। একটা ভয়ংকর কিছু হওয়ার আগে যেন হু হু করে উত্তেজনা বাড়ছে। চারদিকে শুধু ঘাম আর শিরা-ফোলা খালি-গা মানুষ।
দুর থেকে একটা বন্দুকের শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে বিশটা ঢাকের পিঠে নাগাড় এক তাল বেজে উঠলডুম-ডু-ডুম… মোহান্ত সপারিষদ দড়ি ধরলেন। শিবনাথকেও ইশারা করলেন। শিবনাথ দাঁড়িয়ে ছিল অবাক ও হতভম্ব ভীত ভানুর কাছেই। তাড়াতাড়ি সে ভানুর হাতটা নিয়ে দড়িতে ধরিয়ে নিজে ধরল। তারপর দিদি, অবন, বিলোচন, সকলেই। আবার বন্দুকের শব্দ হল, দুলে উঠল একবার রথ। অর্থাৎ আসল লোকেদের রথ টানা হয়ে গেল। মোহান্তের সঙ্গে শিবনাথও সপরিবারে সরে দাঁড়াল।
আবার বন্দুক গর্জন করে উঠল। রথের উপরে আমলার হাতের সাদা নিশান উড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘর-ঘর শব্দে এগিয়ে গেল রথ। চিৎকার উঠল-সাবধান! সাবধান! চৌকিদার আর ঢাকিরা চলল আগে আগে।
ভানুর বুকের মধ্যে ধকধক করছিল। সে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে শিবনাথের। রথ তাদের সামনে থেকে এগিয়ে গেল অনেকখানি। শিবনাথ বলল, ভয় কী?
ভানুর ভয় আছে, তবু সাধ মেটেনি। বলল, টানবে না?
শিবনাথ বলল, টানলাম তো।
এইটুকু?
শিবনাথ হাসল। এই ভিড়ের মধ্যে ভানুর স্পর্শটুকুই তার একমাত্র আনন্দ। ভানু দেখছে সামনের জনসমুদ্র আর তার ঢেউয়ের আবর্ত।
হন্যে হয়ে, পাগল হয়ে ছুটেছে সবাই রথের দড়ি ধরে। একটু ধরতে দাও। বুড়োবুড়ি, শিশু, মেয়ে, কেউ বাকি নেই; সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে রথের দড়ির উপরে। হা হা করে ছুটে আসা সর্বগ্রাসী বন্যার মতো এক সুদীর্ঘ উন্মত্ত বন্যা ছুটে চলেছে, জয়ধ্বনি করছে। নেশা না করেও কীসের তীব্র নেশার একটা ভয়ংকর মাতলামিতে সকলে অচৈতন্য হয়ে ছুটে চলেছে। জীবন, যৌবন, ধ্যান, কল্পনা সবকিছু নিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে হাজার হাজার মেয়েপুরুষ। কোনও মেয়ের সোনার হার ছিনিয়ে নিল, শয়তান কোনও মেয়ের গায়ের কাপড় একেবারে খুলে নিয়েছে। ধর ধর, মার মার, তবু টান টান। জয় বৃন্দাবনচন্দ্রের জয়।
.
এই জনারণ্যের ভিড়ে একটি আধ-পাগল মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়েছে, দড়ি টানছে। সে হালিশহরের ভোলা। সঙ্গে তার নব। সেনপাড়ার ঘাটে নৌকা বেঁধে রেখে এসেছে। বুঝি নিশির টানেই এসেছে দুজনে। জলে ভেসে ভেসে আর জাল বাইতে ইচ্ছে করেনি। গুপ্তিপাড়ার দিকে অনেক নৌকা আসতে দেখে ভোলার বুকের মধ্যে একটি সোহাগি মেয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল, বাবা গো, অ বাবা, আমাকে গুপ্তিপাড়ায় রথ দেখাতে নিয়ে যাবে গো?
মনে হতে না হতেই, নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল উত্তরে। নব জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যাবে খুড়ো?
ভোলা বলেছিল, গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা দেখতে যাব।
মনে মনে বলেছিল, তুই থাকতে যাইনি গঙ্গা, এবার যাব, তোর চোখে দেখে আসব তোর রথের মেলা।
নবকে দড়ির ভিড় টেনে নিয়ে চলেছে। সে দেখছে চারদিকে। ব্যাকুল চোখে দেখছে প্রতিটি মানুষ। গঙ্গা! গঙ্গা কি নেই এখানে! এত মেয়ে, এত মুখ। এর মধ্যে কি সেই মুখটি নেই! সেই মুখ, যে এখুনি ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠবে: আরে মলো। হাঁদার মতো দেখছ কী? জগন্নাথ। বৃন্দাবন ঠাকুর! বছর বছর তোমার রথ টানব, এই গুপ্তিপাড়ায় এসে মুখ দিয়ে রক্ত উঠিয়ে টানব। এক বার মনস্কামনা সিদ্ধ করো!…
ফিরে তাকাল সে৷ রথের চূড়া ওই দেখা যায়, বৃন্দাবনচন্দ্রকে দেখা যায়। অনেক দূরে, যেন বৃন্দাবনচন্দ্র খুশিতে থরথর করে কাঁপছে।
ভোলার কোনওদিকে নজর নেই। যেন একটা দুর্বিষহ বোঝা টেনে নিয়ে চলেছে সে। দড়ি টানছে যেন জেদ করে, রাগে দুঃখে জীবন পণ করে যেন সে থামবে না, বললেও না। কোনও দিনও না। বৃন্দাবনচন্দ্র যখন তার মাসির বাড়ি পৌঁছে যাবে, বুঝি তখনও থামবে না। চিরকাল ধরে চলবে, যত দিন না তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়, যত দিন না সেই ছেউটি মেয়েটি বাবাগো বলে সামনে এসে দাঁড়ায়। নইলে,নইলে…? কিন্তু যেন ভাবতে পারলে না ভোলা। শুধু রাগে দুঃখে, একটা অন্ধ পশুশক্তি ভয়ংকর বিধ্বংসী তাণ্ডবে কলরব করতে লাগল তার মস্তিষ্কে। যেন মনে হল, রথে বসে বৃন্দাবনচন্দ্র হাসছে। তার বউ বিনি জেলেনিও যেন হাসছে মিটিমিটি।
তাকে লোকে ধাক্কা দিচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে, একটু সরতে বলছে। কিন্তু রথের মোটা কাছির মতো পাকানো পেশি ফুলিয়ে সে একাই একশো হয়ে চলেছে ছুটে। তার সারা গায়ে ঘাম ঝরছে, মুখের কষে ঝরছে ফেনা। অনেকে নিরুপায় হয়ে তার ঘাড়ে পিঠে চড়তে গিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছে।
কী আশা নিয়ে এসেছিল ভোলা এই রথের মেলায়। গঙ্গার মতো করে রথ দেখবে বলেই তো। কিন্তু কোন নিরাশার গ্লানি তাকে উন্মাদ করে ফেলল একেবারে। চিরকাল ধরে এই বিরাট রথ টেনেও যদি ফিরে পাওয়ার পুণ্যি না হয়, সবাই হাসে যদি অমনি মিটিমিটি করে, তবে এই রথের মুখোমুখি ফিরে দাঁড়ানোই ভাল। শক্তি তার ক্ষয় হবেনা, পুণ্যি ব্যর্থ হবে, সোহাগি মেয়েটি এসে তবু কোনওদিন ডাকবে না বাবাগো বলে।
রথের দড়ি ছেড়ে দিয়ে ফিরে দাঁড়াল সে৷ সেই অন্ধ বিধ্বংসী শক্তিটা একটা ভয়ংকর আক্রোশে ফুঁসে উঠল। শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে জনকল্লোলের পাগলা স্রোতের উজান ঠেলে। তাকে ঠেলে যেতে পারছে না লোকে। গালাগাল দিতে দিতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সামনে তার রথ, রথের মুখোমুখি সে।ঘর ঘর করে রথ এগিয়ে আসছে। সামনের সাদা ঘোড়া দুটো যেন ছুটে আসছে টগবগ করে। আর বৃন্দাবনচন্দ্র হাসির দমকে কাঁপছে থরথর করে।
কে চেঁচিয়ে উঠল, সরে যাও, সরে যা। এই হারামজাদা!
ভোলা আচমকা শুয়ে পড়ল শত শত পায়ের তলায়। অনেকে বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে দলে গেল তাকে।
এদিকে হা হা করে রথের চাকা এগিয়ে আসছে। চারিদিকে একটা শোরগোল উঠল, গেল গেল গেল। থামাও, থামাও। কে একটা লোক রথের তলায় চলে যেতে চায়। টেম্পল সুপারিন্টেনডেন্ট আমলা সাদা নিশান ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। শোরগোল শুনে, রথ থামাবার সংকেত করে উড়িয়ে দিলেন লাল নিশান। কিন্তু আগে যারা দড়ি টানছে তারা শুনতে পেল না, দেখতে পেল না নিশান। তারা ছুটে চলে দড়ি টেনে নিয়ে। হুড়মুড় করে রথ এগিয়ে এল। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল চৌকিদার আর ঢাকিরা। রথের সাদা ঘোড়া যেন জীবন্ত হয়ে ছুটে আসছে। নব টেনে তোলার চেষ্টা করল ভোলাকে। কিন্তু ভোলা মৃত্যুপণ করেই মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো সে মাটিতে মুখ গুঁজে পল গুনছে, কখন রথের চাকা গুঁড়িয়ে দেবে তার সর্বাঙ্গ, তার চেতনা, যে চেতনার মধ্যে পাগলিনীর মতো খিলখিল করে হাসছে তার পলাতকা বউ বিনি জেলেনি, যে মস্তিষ্কের মধ্যে দিবানিশি হাহাকার করে কাঁদছে তার সোহাগি মেয়ে গঙ্গা। পিষ্ট হোক, চূর্ণবিচূর্ণ হোক তার সর্বাঙ্গ; তার বুকের তলায় মাটি কেঁপে উঠল।
রথ রোখা গেল না। শব্দ বেজে উঠল কানের কাছে। আশেপাশে শুধু হায় হায়। ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েকজন চৌকিদার তার বুকের তলা দিয়ে লাঠি চালিয়ে ভারী কাঠের মতো দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল তাকে। রথ এগিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই চৌকিদারদের কয়েকটা ক্ষিপ্ত লাঠি এসে পড়ল ভোলার পিঠে। যেন রথের তলা থেকে বাঁচিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়েই মারা হবে মানুষটাকে।
নব ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক। তবু জ্ঞান হারায়নি। চৌকিদারদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ভোলার কাপড় ধরে টেনে নিয়ে ছুটল সে, আর চিৎকার করে বারবার অনুনয় করতে লাগল, মেরো না, মরার পরে আর খাঁড়ার ঘা দিয়ো না গো বাবুরা। ছেড়ে দেওগো, ছেড়ে দেওছুটতে ছুটতে বাজার পেরিয়ে সেনপাড়ার দিকে এগিয়ে চলল সে উধ্বশ্বাসে। বোধ হয় ভোলার চেয়েও নবর ক্ষমতা এখন বেশি ছিল। কিংবা অসাড় হয়েছিল ভোলার সর্বাঙ্গ। চৌকিদারেরা বহু দূর পর্যন্ত ছুটে গেল তাদের পেছনে পেছনে, শিকারি কুকুরের মতো। সঙ্গে একদল মজাখোর মানুষ।
সময়ে উভয়কেই মাতাল ভেবে ছেড়ে দিল তারা। সেনপাড়ার ঘাটে এসে ভোলাকে বসিয়ে নৌকা খুঁজে বার করল নব। তারপর ভোলাকে টেনে তুলেই নৌকার দড়ি খুলে দিল।
কে এক মাঝি হেসে বলল, দুটিই তাড়ি গিলে এয়েছে রথের মেলা থেকে।
আর একজন বলল, চোর বাটপাড় কি না, তাই বা কে জানে।
ভোলার নাক দিয়ে তখন রক্ত ঝরে পড়ছে। সারা গায়ের পেশিতে পেশিতে ফেটে পড়বার জন্য থমকে আছে রক্ত। নৌকা ভেসে গেল মাঝ গঙ্গায়। মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে আকাশ।
এতক্ষণে নব ফুঁপিয়ে উঠল, খুড়ো, একী করলে তুমি, একী করলে গো!
ভোলা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, লবা, বিনি গেছে, গঙ্গা গেছে, ওরা আমার মরণও লিয়ে গেছে রে, আমার মরণও লিয়ে গেছে।
.
এ ঘটনা যখন ঘটছে, তখন ভানুকে নিয়ে শিবনাথ বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির দেখাচ্ছে। সেখানে বাইরের খবর আসেনি। আসেও না মন্দিরের চারপাশের প্রাচীর ভেদ করে। রথ টানা হয়ে গেল, তারা মেলা দেখতে যাবে। কেবল বিলোচন মেলার মধ্যে ছিল। ঘটনাটি সে দেখার চেয়ে শুনেছে বেশি। চোখে দেখেছে কেবল দুটি লোককে ছুটতে। সেই সংবাদই সে ছুটতে ছুটতে এসে দিল শিবনাথকে।
ভানু, শিবনাথের দিদি, বিলোচনের বউ, ছেলেমেয়ে, অবনী, সবাই শুনল। শুনে সকলেরই চোখগুলি আতঙ্কে বড় বড় হয়ে উঠল। কাঁটা দিয়ে উঠল ভানুর গায়ে।
শিবনাথ জিজ্ঞেস করল, লোকদুটো কোথাকার বিলোচন?
বিলোচন বলল, কী জানি। কেউ বলল কেষ্টনগরের, কেউ বলল উলোরনয়তো শান্তিপুরের। সবাই বলছিল, লোকদুটো মাতাল। ছুটে পালিয়ে গেল কুটিরপাড়ার দিকে।শিবনাথ আশ্বস্ত হয়ে বলল, মাতাল! তাই বলো।
ঘোমটা খসে গেছে ভানুর মাথা থেকে। সে হাঁ করে শুনছে বিলোচনের কথা। সে যে শিবনাথ বাচস্পতির স্ত্রী, আইবুড়ো মেয়ে নয়, নতুন বউ তাও ভুলে গেছে। ঘোমটা খসার দিকে কারও নজর নেই। শিবনাথের নজর পড়েছে। মুখে বলতে পারে না। চোখাচোখি হলে ইশারা করতে পারে। আর সকলের পিছনে দাঁড়িয়ে এই ঘোমটা-খসা মূর্তির দিকে তাকিয়ে ছিল অবনী। ন্যায়ান্বেষী ভাবী নৈয়ায়িকের মনে কী যেন ঘটে যায়। শুধু তার সুকঠিন সূত্রগুলি কিছুতেই ধরা দিতে চায় না। ন্যায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নয়, অজ্ঞ লোকায়তের মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতেই যেন দেখছে গুরুপত্নীকে। টান করে বাঁধা পান-খোঁপার মাঝখানে সোনার চিরুনি গোঁজা রয়েছে তার। ঘাড়ের কাছে কয়েক গাছি বাঁধা-না-পড়া কোঁকড়ানো চুল উড়ছে বাতাসে। উৎসুক চোখে তার ব্যথা ও ঘৃণা।
সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গা, লোকদুটোকে চৌকিদারেরা পিটছেল কেন?
সকলেই অবাক হল নতুন বউয়ের কথা শুনে। তার কথার অর্বাচীন উচ্চারণ ও ভঙ্গি দেখে শিবনাথের মনটা বিমর্ষ ও লজ্জায় তটস্থ হয়ে উঠল।
বিলোচন বলল, লোকদুটো মাতাল যে।
ভানু বলল চোখ পাকিয়ে, হলই বা! চৌকিদার মিনসেগুলান তা বলে মারবে? মাতাল হয়ে যে লোক মরতে যাচ্ছিল, তাকে আবার কেউ মারে বুঝিন?
শিবনাথ তাড়াতাড়ি থাক থাক বলে প্রসঙ্গটা ধামাচাপা দিল। সে নিজে একজন তর্কবিশারদ। কিন্তু এ তর্কের মীমাংসা সম্ভব নয়। ছোট মেয়ের মন। ন্যায়কে সে তার হৃদয় দিয়ে বিচার করে। সে তার দিদিকে চুপিচুপি বলল বউয়ের মাথায় ঘোমটা টেনে দিতে। সত্যি, ছোট মেয়ের মন! মন তার পরিবেশ ও প্রসঙ্গ মানে না। বিচিত্র তার অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল, একজন অদেখা মাতালের প্রতি করুণা হয়েছে তার।
আর যদি সে জানতে পারত, যদি সে দেখতে পেত, সেই মাতালকে, তবে হয়তো বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত চৌকিদারদের উপর।
দল বেঁধে অতঃপর তারা মেলায় গিয়ে ঢুকল। শিবনাথ আগেই বিলোচনকে বলে রেখেছিল–যেন সাবধান থাকে সে। নতুন বউয়ের গায়ে অনেক গহনা। অসাবধানে কী ঘটে, কে বলতে পারে। মেলাতে কী না ঘটে।
সেদিক থেকে বিলোচন একাই একশো। তবু লাঠিগাছটি নিয়ে সে ভানুর পাশে পাশে রইল।
মেলার মধ্যে চারদিকে বাঁশের বাঁশি ও তালপাতার ভেঁপুর শব্দে কান পাতা দায়। খই, মুড়ি, মুড়কি আর আনারসের ছড়াছড়ি, আম কাঁঠালও এসেছে মন্দ নয়। ছেনি, বাটালি, কাস্তে, হাতুড়ি সাজিয়ে বসেছে কামার; কোদাল, কুড়ুল, লাঙ্গলের ফাল, এমনকী রাজমিস্তিরির সরঞ্জামও এসেছে। বিলিতি রুপোর বাসন, পেতলের ডাইস কাটা আংটি, চুড়ি, ঝাঁপটা, দুল ইত্যাদি নিয়ে এসেছে কলকাতার ব্যবসায়ীরা। মাটির পুতুল, হাঁড়ি, কলসি সাজিয়ে বসেছে কুমোর। সিন্দুর, কুমকুম, আলতা ছড়িয়ে বসে বিক্রেতারা মন কাড়ছে মেয়েদের। মন কাড়ছে পুঁতির মালা, মাথা ঘসা। খেলনার তো অন্ত নেই। গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশের দোকান বসেছে সারবন্দি। সন্দেশ, রসগোল্লা, জিভেগজা, রসমণ্ডি রয়েছে। থরে থরে সাজানো। অচ্ছুতেরা নিয়ে বসেছে ধামা, চুপড়ি, দড়ি, বসেছে কুলো, খুচুনি, ঘুনি আর পোলো নিয়ে; সুপুরি, মাদুর, হোগলা আর শুকনো লঙ্কা নিয়ে এসেছে সুদূর পূর্ব বাংলার ব্যবসায়ীরা। সুন্দর বনের পাখি ধরার খাঁচায় পুরে নিয়ে বসেছে টিয়ে ময়না নীলকণ্ঠের ঝাঁক। ব্যবসায়ীরা শিস দিচ্ছে আর বলছে বল তো ময়না হরেকৃষ্ণ। এক জায়গায় দুটো দাড়িওয়ালা সাহেব সাদা আলখাল্লা পরে চেঁচাচ্ছে:
শুন, শুন, ভাইগণ মন দিয়ে শুন–
খ্রিস্ট প্রভু তোমার জন্য কোল পেতেছে কেন?
তুমি যে পাপের বোঝা নিয়ে চলছ নরক পানে,
সেই পাপের বেথা আমার খ্রিস্টের বুকে হানে।
একজন সাহেব বলছে, আর একজন বিনা পয়সায় লাল মলাটের বই বিলোচ্ছে সবাইকে। কেউ নিচ্ছে কেউ নিচ্ছে না। ওদিকে ঢোলকে ডুডুমডুম, কাঁসির কাঁই-নাই। কবি গানের আসর জমছে। চারদিকে গান বাজনা, কথা হাসি, সব মিলে চারদিকে উল্লসিত কলরব। মেলার এই কলরবের ঐকতানে এক বিচিত্র রাগিণী বাজছে, নাগরদোলার ঘূর্ণির বাঁই বাঁই কোঁ কোঁ শব্দে। এরই মাঝে হারিয়ে যাওয়ার কান্না আর ফিরে পাওয়ার হাসি। জুয়ো খেলার ধুম। মেলার রং বাসরেও রোশনাই ঝলকাচ্ছে মন্দ নয়। খুশির ঝড়ে সব যেন উথালি পাথালি।
খুশিতে উথালি পাথালি প্রাণ ভানুর। বয়স যাবে কোথায়। কে বলল সে শিবনাথ বাচস্পতির নবোঢ়া। ডুব দিয়ে ওঠা পাতিহাঁসটি যেন। বিড়ম্বিত জীবনের সব গ্লানি এক ঝটকায় যেন ঝরে গেছে কোথায়। কয়েক মাস পরে আজ সে খাঁটি বিনি জেলেনির মেয়ে হয়েছে। আজ সে হালিশহরের জেলেপাড়ার দজ্জাল গঙ্গা। সে একবার এদিকে ছুটে যায়, একবার ওদিকে। একবার এটায় হাত দেয়, আবার ওটায়। একটা কিনতে কিনতে আর একটা দর করে। বেসামাল দোকানিকে চোখ ঘুরিয়ে ধমকে ওঠে, ওমা! মিনসে কি কানের মাথা খেয়েছে না কি গো!
দোকানি চমকে তাকায়। তার বয়স ও রূপ দেখে থমকায়। গহনার ঘটা দেখে কপালে হাত ঠেকায়। বলে, এই যে রানিমা, কী চাই মা?
কেউ বলে, রানিদিদি রাজরানি। ভানু খিলখিল করে হাসে। অবুঝ রাজেন্দ্রাণীর হাসি। যেন তাকে নিয়েই মেলা। হাসতে হাসতে বলে, ওমা মিনসে বলে কী গো৷হাত ভরে আঁচল ভরে ফেলে ভানু যা প্রাণ চায়। কোথায় ঘোমটা, কোথায় কী। গাল ফুলিয়ে সন্দেশ চিবোয়। ধাক্কা খেলে, কেউ গায়ে পড়লে চোখ পাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, কে রে মুদ্দো, চোখের মাতা খেয়েছে নাকি?
অস্বস্তিতে কুঁকড়ে ওঠে বাচস্পতি। কেউ প্রণাম করে, কুশল জিজ্ঞেস করে গুপ্তিপাড়ার পরিচিত পণ্ডিতেরা। শিবনাথ সবাইকে জবাব দেয়, কিন্তু ঠোঁট কামড়ায় আর ক্রু কুঁচকে হাসে। না জানি কী ভাবছে লোকে। আশ্চর্য! একেবারে শিশু তার স্ত্রী। আর কথাগুলি কেমন যেন খট খট করে কানে লাগছে। বিধছে।
কিন্তু কে সামলাবে। দিদি মেলা দেখছেন ভাবলেশহীন চোখে। তার ফোলা ফোলা ধবধবে ফরসা মুখটায় রাগ বিরাগ খুশি কিছুই বোঝা যায় না। বিলোচনের অস্বস্তি হচ্ছে বাচস্পতি ঠাকুরের অবস্থা দেখে। সে হাসছে তোে হাসি আর গামছাখানি কাঁধ বদল করছে ঘন ঘন। অবাক হয়েছে বিলোচনের পরিবার। কোনও ঠাকুরবাড়ির এমন বউ সে দেখেনি, শোনেনি এমন কথা।
কেবল এ সব কিছুই মনে হচ্ছে না অবনীর। গুরুপত্নীর এ ছড়ানো ভরানো, এলানো মেলানো খেলায় ও লীলায় তার মনটা কোন অন্তস্রোতে ভেসে গেছে। তার রুচিসম্পন্ন শিক্ষিত মার্জিত শুদ্ধাচারী মন। অবাক খুশিতে অপলক চোখ। এই মেলা যেন তারই রক্তে রক্তে উৎসবে মেতেছে। তারই রক্তে রক্তে কলরব গান, তালপাতার বাঁশির ভেঁপু, মেলার যত হাসি আর কান্না। নাগরদোলায় যত ঘূর্ণি, সব তারই অন্তপ্রবাহে উল্লাসে পাক খাচ্ছে।
হাসে, বকে, কেনাকাটা করে ভানু। করতে করতে উদাস হয়ে যায়। আবার হাসে, আবার অন্য মনে এদিক ওদিক দেখে। কে যেন থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে মনের মধ্যে। কেউ আসেনি হালিশহরের। কেউ না? বিমলি-রাধা-টেপি? হয়তো গঙ্গায় এখন ওরা ঝাঁপাই ঝুরছে কিংবা গল্প করছে কোথাও বসে। ভানুর কথা বলছে নাকি? নড়ের মা আসেনি? কাদু পিসি, হেলে খুড়ি…
এদিকে এদিকে।
থমকে আবার দলে ভেড়ে ভানু। হাসে, বকে, দুড়দাড় করে কবিগানের আসরেই ঢুকে যায়? কেউ আসেনি?নব, মুখপোড়া নব? চোখে জল এসে পড়ে। মুখপোড়া নয়? নয় তো তবে মনে পড়ে কেন?
সেই মুহূর্তেই সর্দার পোড়াকে দেখবার জন্যে চোখ তোলে ভানু। বড় যে দেখতে ইচ্ছে করছে। কেন, নবর উপর রাগ হচ্ছে বলে, চোখে জল আসছে বলে? অবনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই, তার কাছ গগলাম হক কাছে এগিয়ে গেল। মেলা থেকে কেনা হাত ভরা সব দ্রব্য সামগ্রী বাড়িয়ে দিল অবনকে। বলল নেও গো সদ্দার পোড় বইতে পারি নে আর।
অবন যেন এক মুহূর্ত থতিয়ে গেল। গুরু শিষ্যে চোখাচোখি হল এক বার। শিবনাথের চোখে প্রেম ও স্নেহ-বিগলিত হাসি। অবন হাত বাড়িয়ে নিল সব। ভানু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, সব তোমাকেই দিয়ে দিলুম, অ্যাঁ? নেবে না?
নেবে বইকী, দুই অঞ্জলি ভরে নেবে অবন। গুরুপত্নী যেন খেলার সঙ্গিনী। এ মেলা আজ তার গুরুপত্নীরই, এই গণ উৎসবের রানি সে।
শরীরটা কেমন ভার বোধ হয় ভানুর। ভারী আর ম্যাজমেজে। যেন জ্বররা তাপে দেহের রক্তধারা দ্রুত অথচ শরীরটা ওপরে অবশ অবশ ভাব বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠেছে সারাটি মুখ। পেটের কোথায় যেন চিনচিন করে একটু ব্যথা, তবু রক্তে তার একটি অনাস্বাদিত তীব্র খুশির চেতনা।
আবার একসময় হেসে উঠল। বায়না ধরল, নাগরদোলায় চাপবার জন্য। চাপা হল না। এক গা গহনা নিয়ে নাগরদোলায় ওঠা ঠিক হবে না।
কে যেন ঢিপ করে একটি প্রণাম করল ভানুকে। লাফ দিয়ে সরে গেল ভানু। হেসে উঠল ভানু খিলখিল করে, ওমা। এইটে কে গো৷
ঘোমটা দেওয়া একটি বউ। ফিসফিস করে বলল, খবোদ্দার, চেনা দিসনি মুখপুড়ি। আমি তোর শৈল দিদিমণি।
বলে সে শিবনাথ ও দিদিকে গড় করল তাড়াতাড়ি। শিবনাথ ভারী খুশি। বলল, কে রে বেটি তুই?
শৈল বলল, আমি এঁজ্ঞে গুপ্তিপাড়ায় থাকি। দাদাঠাকুরের বে-তে আমাদের খাওয়া বাদ গেল।
গলায় আবদার ঢেলে বলল শৈল। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বলতেই পারে। শিবনাথ বাচস্পতি সে। তাকে জাত বেজাত, ছোট বড় চেনে সবাই। সে হেসে উঠে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, বাড়ি যেয়ো তুমি। যত প্রাণ চায়, খেয়ে এসো।
আবার প্রণাম করল শৈল। বলল, আহা, কী সোন্দর বউ হয়েছে! যেন মা দুগগাটি।
ভানু তখন তাকিয়ে ছিল দু চোখ বিস্ফারিত করে। তার চারপাশে আবার ঘিরে এল যন্ত্রণার রুদ্ধশ্বাস স্মৃতি। বাবার স্মৃতি, সর্বেশ্বর নন্দনের স্মৃতি, তার বৃন্তহীন জীবনের স্মৃতি। কিন্তু শৈলকে দেখে তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। যেন নতুন বউ অনেক দিন বাদে পেয়েছে বাপের বাড়ির মানুষ। আপনজন এসেছে, তাই আলিঙ্গন করতে প্রাণ চাইছে। কিন্তু এত লোকের মধ্যেও শৈল তাকে ইশারা করছে শান্ত থাকতে।
বেলা পড়ে আসছে। বৃষ্টি হয়নি। বরং মেঘ-ভারাক্রান্ত আকাশটার কোন ফাঁক দিয়ে রোদ উঠেছে। পশ্চিমের গাছ-গাছালির ফাঁকে ঝিকমিক করছে তামাটে বোদ। বাতাস নেই, দমবন্ধ গুমসোনি।
ফেরবার পথে মন্দিরে গেল সবাই। প্রায় মানুষ সমান উঁচু দাওয়ার উপরে মন্দির। দেখে দেখেও পুরনো হয় না, শুনে শুনেও একঘেয়ে লাগে না এ মন্দিরের মূর্তি ও কাহিনী।
সেই একবার আলিবর্দির আমলে, স্বয়ং বৃন্দাবনচন্দ্রের খাজনা বাকি পড়ে গিয়েছিল নবাব দরবারে। নবাব সাহেব ঠাকুর বোঝেন না, বললেন, কোতল করে নিয়ে এসো বৃন্দাবনচন্দ্রকে আমার দরবারে, হাজত করো ব্যাটাকে বাকি খাজনার দায়ে।
বিলোচন বলে, সবাই শোনে। শিবনাথও শোনে। শোনে আজন্ম শোনা পুরনো কাহিনী। আর যত না দেখে বৃন্দাবনচন্দ্রের বাঁয়ে শ্রীমতী রাধারানিকে, তার চেয়ে বেশি দেখে ভানুমতীকে। ভানুও দেখে তার আজন্ম সাধের গুপ্তিপাড়ার মঠ আর শানে বিলোচনের কাহিনী।
বিলোচন বলে, তা লবাবের হুকুম তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, দেবতাকেও যেতে হয়। মোহান্ত নিয়ে গেল বৃন্দাবনচন্দ্রকে, হাজির করে দিল লবাবের দরবারে। কিন্তু সেটি আসল লয়, বৃন্দাবনচন্দ্রের নকল মূর্তি। ওই যে দেখছ কৃষ্ণচন্দ্রের মূর্তি, উনি হলেন সেই নকল বৃন্দাবনচন্দ্র। আর হুই যে দেখছ গৌর নিতাইয়ের মন্দির, ওটি হল আসল বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। তা বৃন্দাবনের মেলাই টাকা, সোনা-দানা জমি জিরেত আছে, ভোগও অনেক হয়। কলকাতার বাগবাজারের মস্ত বড় লোক তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন এই মন্দির। সে সব শুনতে পাবে মোহান্তের কাছে। তবুও মারামারি কি কম হয়েছে বৃন্দাবনের ভাগের মাটি আর টাকা খাবার জন্যে? রাজা বলল, মোহান্ত বলল, সকলেই খেয়োখেয়ি করেছে, করছে। বেশি বলব না বাপু, কাছের গাঁয়ে বাস করতে হয়। কোথা থেকে কী হয়ে যাবে। বলে এমনিতে নীলের গাদনেই মারা গেলুম।
ঘুরে ফিরে বিলোচনের সেই নীলের কথা। ভানু ততক্ষণ চলে গেছে রামসীতার মন্দিরের কাছে। সারা মন্দিরের গায়ে পোড়া ইটের কত না মূর্তি। তার কাছেই অবনী দাঁড়িয়ে। তারো কি মনে হচ্ছে নাকি, বৃন্দাবনচন্দ্রের সঙ্গিনী স্বয়ং ঘুরে বেড়াচ্ছে তার আশেপাশে।
কিন্তু ভানুর কী হয়েছে। মুখ তার লাল, চোখ দুটি যেন বড় বেশি ঝকঝক করছে। কাকে যেন খুঁজছে ভানু। কাকে, কাকে? কীসের এক তীব্র আনন্দ তার সারা দেহে আবর্তিত হচ্ছে, অথচ ভয় করছে, অস্বস্তিও হচ্ছে শরীরের মধ্যে।
মন্দিরের পিছনে বাগান। গাছগাছালির ছায়ায় এর মধ্যেই অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। ভানু বাগানে নেমে গেল সকলের অগোচরে।
সকলের যখন খেয়াল হল, দেখল ভানু নেই। কোথায় গেল? সর্বনাশ! দ্যাখ দ্যাখ, কোথায় গেল। নতুন বউ, এক গা গহনা, অচেনা জায়গা।
পাঁচিলের ওপাশে মোহান্তের বাড়ির সীমানায় গেল নাকি? কাঁটা দিয়ে উঠল শিবনাথের গায়ে। কী ভয়ংকর দশনামী দণ্ডী, ওরা অবধূত, ধর্মে ওদের ভোগের কোনও বাছবিচার নেই।
শিবনাথ ছুটে গেল মোহান্তের আস্তানায়। নেই সেখানে, মোহান্ত অনুপস্থিত। খাঁ খাঁ করছে বাড়ি।
শিবনাথের বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠল। অবন যেন পাগল হয়ে গেছে। তারপর বাগানের দিকে চোখ পড়ে গেল বিলোচনের বউয়ের। দেখা গেল জঙ্গলের মধ্যে একটা মোটা কাঁঠাল গাছের গোড়া জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ভানু। ঘোমটা খসে গেছে। গায়ের নীলাম্বরীও আলুথালু। ঠোঁট দুটিতে রক্ত ফেটে পড়ছে যেন। কী হল?
শিবনাথ তাড়াতাড়ি ছুটে গেল কাছে। দিদি গেলেন থপ থপ করে। বিলোচনের বউ গেল ছুটে। সে-ই বলল, কী হয়েছে গো ঠাকরুন?
না, গহনা আছে সবই। চকিতে কী-ই বা ঘটল। কী হল? কিন্তু কোনও জবাব নেই ভানুর মুখে। খালি কান্না।
হঠাৎ বিলোচনের বউ ফিক করে হেসে উঠল। কী একটা ইশারা করল শিবনাথের দিদিকে। কিন্তু তার ভাবলেশহীন মুখে কোনও ভাবোদয় হল না। কেবল মুখটা যেন লাল হয়ে উঠল খানিকটা। শিবনাথ তখনও বিমূঢ়। ঘোর অন্ধকার হাতড়ে ফিরছে সে। তারপর হঠাৎ খুশির প্রাবল্যে গলা দিয়ে শব্দ বেরিয়ে গেল তার। চকিতে ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, আ-হা-হা কান্নার কী আছে, অ্যা। আর একটু গেলেই পালকি, চলো চলল।
তবু কান্না বাধা মানে না ভানুর। ফোঁসফোঁস করতে করতে পালকিতে এসে উঠল। বিলোচনের বউ দূরে সরে গেছে। বিলোচনও গেছে। এখন কোনওরকমে আর স্পর্শ করা চলবে না। তারা যে শুদ্র। বাড়ি এসেই ঘরবন্দি হল ভানু। আজ থেকে তিন দিন চন্দ্র সূর্য দেখতে পাবে না তাকে। ঘরের মধ্যে, চারটি বাঁশের কঞ্চি পুঁতে গণ্ডির মধ্যে আলোহীন ঘরে তাকে থাকতে হবে। ব্রাহ্মণ, শুদ্র, কোনও পুরুষ অথবা বিধবা নারীর মুখ দেখবে না সে। দেখতে নেই। এইভাবে, এক বস্ত্রে, লবণহীন ব্যঞ্জন খেয়ে থাকতে হবে তাকে। আশেপাশের জ্ঞাতিদের সধবা বউরা এল। শুরু হল স্ত্রী আচার। শাঁখ বাজল, উলু পড়ল। পণ্ডিতের বাড়িতে এ সব লৌকিক বিষয়ে কড়াকড়ির অন্ত নেই। জ্ঞাতিদের এক সধবা বউ এসে একটি নোড়া দিয়ে গেল ভানুর কোলের কাছে। ভানু তখনও কেঁদে কেটে অস্থির। বিস্ময়, কৌতূহল ও ভয় মিশিয়ে এ কান্না।
জেদি গলায় বলল, কী হবে এ দিয়ে?
বউটি মিষ্টি হেসে বলল, ওটিকে কোলে করো।
ভানু কেঁদে উঠল, কেন?
ভানু যত কাঁদে, বউটি তত হাসে। বলে, তোমার যে দ্বিতীয় বিয়ে হচ্ছে গো। মায়ের জাতে উঠলে যে?
ছাই! তোমার মাথা!
তবু বউটির কী হাসি। ভানুর গাল টিপে দিয়ে, নোড়াটি তার কোলের উপর চেপে বসিয়ে, আঁচল দিয়ে ঢাকা দিয়ে বলল, এবার যে হবে ওই রকম একটি, ওই রকম ভারী পাথরের মতো শক্ত ছেলে। তখন তোমার মাথা কি আমার মাথা, একবার দেখব। আর বাচস্পতি ঠাকুরের মতো যদি মুণ্ডটি হয়, তবে তখন তোমার বেহায়াপনা দেখব।
বলে বউটি সস্নেহে ঠোনা মেরে, ভানুর বুকের আঁচল গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে।
মুখ ঢেকে কাঁদতে বসল ভানু। ডুকরে, ফুঁপিয়ে, বুক চেপে, অন্ধকার ঘরে বন্দিনীর মতো কাঁদতে লাগল। কেঁদে সে হয়রান হল, ঘুমোল কেঁদে কেঁদে। এ কান্না নয়, রূপান্তরের অশ্রু। চারাগাছে আজ বিশাল বৃক্ষের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। আজ সে ফুলবতী, অজস্র কালের সম্ভারে সে পরিপূর্ণ। উৎপীড়নে, লাঞ্ছনায় জীবন বসে থাকে না। জীবনের অন্তস্রোতে দিবানিশি বিচিত্র রূপান্তর। আজ ভানু সেদিনের সেই মেয়েটি নয়, সে কিশোরী নয়, সে ভানু নয়, গঙ্গা নয়, সে আজ নারী, শস্যদায়িনী ধরিত্রী, রক্ত-কোষে তার মাতৃত্বের দ্বার উন্মুক্ত। কেবল এই একশো বছরের পুরনো অন্ধকার বাড়িটাতে, বাহান্ন বছরের শিবনাথ বাচস্পতি নিদ্রাহীন শয্যায় নিঃশব্দে হাসতে লাগল। দেবীপূজার লগ্ন এসেছে তার। রায়ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করতে হবে। সংস্কৃতে কবিতা বাঁধল শিবনাথ, হে বৃন্দাবনচন্দ্র, তোমারই মোহন কটাক্ষে নতুন রিপুদল উন্মীলিত হল।
শুধু অবাক হয়েও বিশ্বে যেন এক নতুন অনুভূতি সঞ্চারিত হতে দেখল অবন। বোঝ না বোঝার মাঝামাঝি, এক বিচিত্র অনুভবের মধ্যে সে গুরুপত্নীর ছবি দেখতে লাগল মনে মনে।– রথের মেলা ভাঙেনি এখনও। উল্টোরথ পর্যন্ত সমানে চলতে লাগল যাত্রা, কবিগান, সঙের মিছিল, ভাঁড়ের দলাদলি, কোঁদল। মেলা থাকবে এক মাস। গুপ্তিপাড়ার গঙ্গার ঘাটে প্রতি দিন একটা করে ঘটনা ঘটতে লাগল।
ঘাটে ঘাটে এখনও ভিড় করে রয়েছে বিদেশিদের বজরা, পিনিষ, কয়টর, ভাউলে। অনেকে এসেছে দুর কলকাতা থেকে। মাহেশের রথযাত্রায়ও অনেকে ভিড় করেছে। কিন্তু যারা ভিড় বাঁচিয়ে বাধা বন্ধনহীন নিরঙ্কুশ মজা লোটবার তালে ছিল, তারাই এসেছে এই দুর অঞ্চলে। সঙ্গে এসেছে উঠতি বয়স থেকে প্রৌঢ়া মেয়েমানুষ পর্যন্ত। সেখানে গান ফুর্তির অন্ত নেই। রাতভর শোনা যায় মাতাল নারী-পুরুষের হল্লা। স্থানীয় অনেকে জুটছে গিয়ে সেই সব জলযানে শব-ভুক শকুনের মতো। আসলে কলকাতার দেহোপজীবিনীরা এসেছে মেলায় ব্যবসা করতে। পুরুষেরা তাদের সঙ্গী দালাল। এ সব অঞ্চলের আশেপাশে নিখোঁজ হয়েছে কয়েকটি মেয়ে। তার মধ্যে আছে দুটি ব্রাহ্মণ কুলীনের যুবতী বউ। এ ঘটনা প্রায় প্রতি বৎসরের। কিছুই আসে না বরং যায়। কলকাতা, চুঁচুড়া, চন্দননগরের জুয়াড়িদের কাছে সর্বস্বান্ত হয় অনেকে।
এদিকে তিন দিন বন্দিজীবনের পর, তীরকাটির বেষ্টনী থেকে চতুর্থ দিনে বাইরে আনা হয়েছে ভানুমতীকে। এর মধ্যেই কয়েকজন যুবতী সধবা এসে জুটেছে ভানুর নারীত্ব দর্শনের উৎসবে। আজকেই আসল উৎসব। জোড় হলে হবে না, বে-জোড় মেয়েমানুষ চাই। অর্থাৎ বে-জোড় এয়োরা আজকের উৎসবে অংশ নিতে এসেছে। পুরুষ নেই, বিধবা নেই, আর নেই আইবুড়ো মেয়ে। শুধু বিবাহিতারা আজ নারী-জীবনের এক আদিম রহস্যকে নানান ভঙ্গিতে ও কথায় প্রকাশ করছে ভানুর কাছে।
আকাশে আষাঢ়ের রীতিমতো ঘনঘটা। মাতঙ্গ কালো মেঘ যেন বিশালকায় পুরুষের মতো পা বাড়িয়েছে পৃথিবীর দিকে। বিদ্যুৎ ঝলকে তার হাসি, বজ্রে তার অট্টধ্বনি। দক্ষিণা বাতাসের মোড় ঘুরে গিয়েছে, পুবে সাওটার আভাস বাতাসে।
শিবনাথও বন্দি। ঘরের মধ্যে বসে সে সবই শুনতে পাচ্ছে। দরজা খুললেই দেখতে পায়। কিন্তু দেখবে না, দেখতে নেই। তাই সে জানলা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে, যক্ষরাজানুচরের মতোই তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। বলছে,
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ
কণ্ঠশ্লেষপ্রণয়িনি জনে কিং পুনদ্রসংস্থে?
সত্যি, এমন মেঘ সমারোহ দেখে কোন রসিক তার প্রণয়িনীর কথা না ভাবে। রায়ঠাকুর হলে আজ আরও খুশি হয়ে বলতেন, এর চেয়ে বড় লগ্ন আর হয় না হে বাচস্পতি। বলতেন,
হরসম্পর্কহীনীয়াঃ লতায়াঃ কামমন্দিরে।
স্বয়ম্ভূকুসুমং দেবি রক্তচন্দনসংজ্ঞিত।
একলা ঘরে বসেও, লজ্জায় বিহ্বল হয়ে পড়ল শিবনাথ। রায়ঠাকুর নয়, তন্ত্রের বিশেষ অভিব্যক্তি তারই ঠোঁটের কূল ছাপিয়ে প্লাবিত হচ্ছে। স্বয়ম্ভূকুসুম। ছি ছি, না না, স্বয়ম্ভূকুসুমের পথ শিবনাথের নয়। সে তান্ত্রিক নয়, ভানুর সে খেলার জুটি।
রাত পোহালেও মেঘের জন্য টোলের ঘরে অন্ধকার রয়েছে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ছাত্ররা বসেছে পুথি নিয়ে। অবনী বসেছে ঋগ্বেদ নিয়ে। ধর্মসভা বসবে আজ নারায়ণ চূড়ামণির বাড়িতে, নব্যধর্মসভা। অবনী যাবে সেখানে। কিন্তু তার কান রয়েছে একটি ছাত্রের গুনগুনানির দিকে। সে তখন সংস্কৃত কবিতা আবৃত্তি করছে, যার মানে নারায়ণের কোলে লক্ষ্মী বসেছে দক্ষিণ জঘন ভাজে, বাম উরু নীচে প্রসারিত…।
আরও কানে এসে বাজছে অন্দরের এয়োদের হাসি ও কথা। ঋগ্বেদের সূক্তগুলি কেবলি যেন জড়িয়ে যেতে চাইছে।
সাত এয়ো যেন সাতটি মাতঙ্গিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ভানুর উপর। তিন দিন ধরে নুনের অভাবে পেট ভরে খেতে পারেনি ভানু। ঘুম হয়নি। শরীরে তার জোর নেই, জেদ মরে গিয়েছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কোথায় নে যাবে?
–ঘাটে গো, ঘাটে। নাইতে যেতে হবে, ওঠো তাড়াতাড়ি।
আরও নানান কথা তারা বলল হেসে গেয়ে। সে সব কথা শুনলেও কানে আঙুল দিতে হয়।
ভানুকে নিয়ে এয়োরা ঘাটে এল। যে-ঘাটে কেউ নামেনি, জল স্পর্শও করেনি। ভানুর হাতে কাটারি দিয়ে একজন এয়ো বলল, জল কাটো।
জল কাটতে হয়। নইলে ভূত-প্রেত শুদ্ধ হয় না। জল শুদ্ধ হলে, ভানুকে জলে নামিয়ে দিল। বলল, ডুব দাও, ডুব দিয়ে যা পাও, হাত দিয়ে তুলে নিয়ে এসো।
ভানু অস্থির হয়ে উঠল। বলল, কী তুলব, মাটি?
–যা পাও।
এক ডুবে যা পেলে, তাই মুঠি ভরে তুলে নিল ভানু।
এয়োরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, দেখি দেখি, কী পেয়েছ?
মুঠি ভরে পেয়েছে শামুক, জীবন্ত শামুক। এয়োরা হেসে, ভানুকে গাল টিপে, ঠোনা মেরে বলে উঠল, ছুঁড়ি বাগিয়েছে ভাল, জ্যান্ত শামুক পেয়েছে গো, এবার আর দেখতে হবে না। সামনের বছরে এমন দিনে ছেলে কোলে থাকবে।
আদিম বিশ্বাস তাদের, জীবন্ত শামুক প্রাপ্তি আজ ভানুর প্রথম জীবন্ত সন্তানেরই প্রতীক। মৃত শামুক উঠলে, উৎসবের হাসির মুখে কালি পড়ত, নিরানন্দে নীরব হত সবাই।
তারপরে আবার একটি বিয়ের মতোই ব্যবস্থা হল প্রায়। হোম-যাগ-যজ্ঞ হল। শিবনাথকেও পাটের কাপড় পরে যোগ দিতে হল পূজায়। এয়োরা রাঁধলে ভাল মন্দ। দশরকম ব্যঞ্জন, আঁশ তরকারি, পায়েস-মিষ্টান্ন।
ইতিমধ্যে একটি কিষাণ এসে গর্ত কেটে দিয়ে গিয়েছে খিড়কি দোরের কাছে। কলসি কলসি জল ঢেলে রেখে গিয়েছে কাদা করে। এ উৎসবের নাম কাদা করা।
তার আগেই পুরুষদের খাইয়ে বিদায় করল মেয়েরা। তারপর ভানুকে আবার টেনে নিয়ে এল ঘরের বাইরে। কিছুতেই আসবে না ভানু। কেঁদে কেটে, ধস্তাধস্তি করে কাণ্ড বাধালে সে। কিন্তু এয়োরা তার চেয়ে জোরালো। এ তো শুধুই ফুর্তি নয়, কাদা করার কাদা না মাখালে বাচস্পতি গৃহিণীর অকল্যাণ হবে যে! হালিশহরে অনেক কাদা খেলা দেখেছে ভানু লুকিয়ে। কিন্তু সে যে এমন ভয়াবহ, তা জানত না।
ভানুকে নিয়ে এসে কাদার গর্তে নামল মেয়েরা। সকলেই এক বিচিত্র ঘোরে প্রায় উন্মাদিনী, কাপড়চোপড়ের ঠিক নেই। তার মধ্যে কেউ গান ধরেছে,
মাতাল ভোলা আসছে ক্ষেপে,
সরে যা গো কামিনীকুল
ভানুর হবে নাকড়া ছকড়া
হাতে যে তার আছে ত্রিশূল ॥
কে একজন কপট ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কোথায় গো মাতাল ভোলা?
-ওই আসছে, এবার এসে ধরবে।
–আসুক, তাকেও কাদা করব।
অমনি হাসির রোল পড়ে গেল। ভানুমতী কাদা মাখামাখি হয়ে কাঁদছে। তাকে একজন জড়িয়ে ধরে সশব্দে চুমু খেয়ে বলল, বাচস্পতির কাছে যখন যাবি, তখন দেখব কত কাঁদিস।
এর পরের প্রসঙ্গে এয়োরা শ্লীল অশ্লীলের আর কোনও সীমা রাখলে না।
কাদা করার পর এল নরসুন্দরী। নরসুন্দরী ভানুর হাত পায়ের নখ কাটলে। সাত এয়োর সঙ্গে মিলে স্নান করালে ভানুমতীকে, তারপর আলতা পরালে। লাল শাড়ি পরানো হল ভানুকে। কপালে সিন্দুরের টিপ দিয়ে, সিথে রাঙিয়ে, সাত এয়ো খেতে বসল তাকে নিয়ে।
এ ভানুমতীকে আর চেনা যায় না। চার দিন আগে যে মেয়েকে দেখা গিয়েছিল রথের মেলায়, এ সে মেয়ে নয়। এ যেন অনেক বড়, অনেক ভারী, গম্ভীর এক বউ। নুড়ি পাথরে অগভীর খাতে, বিচিত্র শব্দবতী স্রোতস্বিনী নয়, এ যেন গভীর গম্ভীর, ভরা টাবুটুকু জলধারা।
শুধু দেহ নয়, মনের মধ্যেও ভানুর ভার। সেখানেও তার চিন্তার ছোঁয়া লেগেছে। বালিকার মধ্যে নারীর মন হচ্ছে উন্মোষিত।