ফুল আর হুল

ফুল আর হুল

সব বাড়িরই একটা পাশের বাড়ি থাকে।

একটা বাড়ি নয়, চারপাশে বাড়ির পর বাড়ি। বাড়ির মৌচাকে এক একটি পরিবার। দিবারাত্র, হল হল গল গল করছে। এ ঢুকছে, ও বেরোচ্ছে। এ চেল্লাচ্ছে, ও গান গাইছে। এ পাশে হরিনাম, ও পাশে রামনাম। বাঁ-দিকে জন্ম, ডান দিকে মৃত্যু। জীবন একেবারে জবজবে।

এর মধ্যে যেকোনো একটা বাড়ি খুব বেশিমাত্রায় পাশের বাড়ি হয়ে ওঠে।

এবাড়ি থেকে দই-ইলিশ গেলে তো, ওবাড়ি থেকে তালের বড়া এল। এবাড়ি থেকে সত্যনারায়ণের সিন্নি গেলে, তো ওবাড়ি থেকে এল গোবরডাঙ্গার কাঁচগোল্লা। দোতলার জানালায় এবাড়ির উঠতি বয়েসের ছেলে বিশ্বসংসার ভুলে দাঁড়িয়ে আছে, ওবাড়ির জানালায় মেয়ে। দু-জনেই মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, কেউ এসে পড়ল কিনা দেখছে। মৃদু মৃদু বাক্যালাপ চলছে। খিলখিল হাসি ঝরছে। সবই প্রায় অপ্রাসঙ্গিক কথা। এমন সব প্রশ্নোত্তর, যে প্রশ্নের কোনও মানে নেই, যে উত্তরেরও কোনও ধারা নেই। প্রশ্ন প্রশ্ন টেনে আনে। উত্তর উত্তর হয়ে ফিরে যায়। প্রেম এইরকমই এক মানসিক অবস্থা! একটা অসংলগ্ন, এলোমেলো সুটকেসের মতো। সব আছে, সমস্যাটাই নেই। পায়রার অকারণ লাট খাওয়ার মতো।

ছেলে : ক’দিন তোমাকে দেখিনি কেন সুতপা?

সুতপা : আপনাকেও তো দেখিনি কানুদা।

কানু : বাজে কথা বোলো না।

সুতপা : আপনিও বাজে কথা বলবেন না।

কানু : বাজে কথা! আমি কাল সাতবার এই জানলায় এসে দাঁড়িয়েছি।

সুতপা : থাক আর বলতে হবে না। আমি তিনবার এসেছি।

কানু : মাইরি বলছি। এই দেখ সময় লিখে রেখেছি। ভোর ছটা, সাতটা। সাতটায় বিবিধভারতীতে সাধের লাউ হচ্ছিল।

সুতপা : ও মা, কী মিথ্যুক, কী মিথ্যুক, সাতটার সময় সাধের লাউ কোনো দিন হবে না। ওটা লোকগীতি, হলে সাতটা পাঁচের পরে হবে। ধরা পড়ে গেছেন।

কানু : বিশ্বাস করো। জ্বরের চার্টের মতো সময় লিখে রেখেছি।

সুতপা : ঘড়িটা ফেলে দিন কানুদা।

কানু : তোমাদের রেডিয়োটা ফেলে দাও সুতপা।

সুতপা : কাল সাতটার সময় হচ্ছিল পাতকী বলিয়া।

কানু : আমি নিজে শুনেছি। তোমাদের ওপাশের দালানে হচ্ছিল। তোমার বোন বায়না করছিল।

সুতপা : ও মা, কি মিথ্যেবাদী। টুসি তো মামারবাড়ি গেছে।

কানু : (উজ্জ্বল মুখে) তোমার মা এখানে নেই?

সুতপা : থাকবে না কেন?

কানু : (চুপসে গিয়ে) তা হলে কার সঙ্গে গেল?

সুতপা : মেজোমামা এসেছিল।

কানু : অতটুকু মেয়েকে একলা ছাড়া উচিত হয়নি। তোমার মায়েরও যাওয়া উচিত ছিল।

সুতপা : ওইটুকু মেয়ে!

কানু : ওইটুকু নয়! ওর কতই বা বয়েস?

সুতপা : কত বয়েস?

কানু : চার কি পাঁচ।

সুতপা : ও মা, কিস্যু জানেন না। পাঁচ ছিল পাঁচ বছর আগে।

কানু : দেখলে মনে হয় না।

সুতপা : তা হয় তো হয় না। ও যে ভীষণ ভোগে।

কানু : তোমার মা যাবেন না!

সুতপা : কোনো দিনও না।

কানু : কেন?

সুতপা : ছোটোমাসির বিয়ের সময় মেজোমাইমা মাকে কী সব বলেছিল!

কানু : খুব অন্যায়?

সুতপা : বড়লোকের মেয়ে বলে খুব গরব।

কানু : এই করেই বাঙালি গেল।

ভেতর থেকে বাঁজখাই ডাক ভেসে এল, সুতপা, সুতপা! আমি যাই, বলে সুতপা সরে পড়ল। কানু ফাঁকা ঘরে খানিকটা নেচে নিয়ে, মনে মনে গুনগুনিয়ে উঠল, আ, ইয়া, ইয়া, করু ম্যায় কেয়া, সুকু সুকু। বড়ো বউদির ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে গেল।

আমার বয়েসে সুতপা নেই। কানু হবার বয়েস তিনকাল আগে চলে গেছে। তখনকার কালের সুতপাদের মুখ দিয়ে কথা বেরোতো না। পরিবারের এমন ট্রেনিং ছিল, ছেলে দেখলেই মনে করত, বাঘ দেখছে। আমার পাশের বাড়ির সঙ্গে রোমানস অন্য ধরনের।

সাত সকালে উঠে স্টিম নিচ্ছি। চা চেপেছে শুনেছি, তিনি কখন কাপে চেপে সামনে আসবেন, তা আমার স্টিমদাত্রীই জানে। রোজ সকালে এই এক সমস্যা। সময় সময় মনে হয় চায়ের জন্ম আর মানুষের জন্ম যেন এক ব্যাপার। ইনি হতে চান না, উনি সহজে বেরোতে চান না।

চায়ের অপেক্ষায় বসে বসে চ্যাটাস চ্যাটাস করে মশা মারছি। দেয়ালের গায়ে লেতকে পড়ে আছে, রাত-জাগা সেপাইয়ের মতো বাজারের ব্যাগ। দুধের বোতল দু-টি যেন যমজ সন্তান। বুকে ওঠার জন্যে ব্যবা ব্যবা করছে। সহধর্মিণী চায়ের জল চাপিয়ে স্নান ঘরে ঢুকেছিলেন। ভিজে কাপড়ে চলেছেন সেক্স ছড়াতে ছড়াতে। যাবার সময় মুখঝামটা দিয়ে গেলেন, জলটা ফুটে ফুটে মরে গেল, একদিন চা-টা একটু করে উপকার করতে পার না! বসে আছ গদাই লস্কর চালে! আজ সাত দিন ধরে বলছি, বাথরুমের নর্দমার মুখটা বুজে গেছে, যা হয় একটা কিছু করো। ঝেঁটিয়ে হাতের নড়া খুলে গেল। বাবু এ কান দিয়ে ঢোকাচ্ছেন, ও কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন!

লোকে চা বিস্কুট খায়, ফলাহার করে। রোজ সকালে এইটাই আমার ব্রেকফাস্ট। চায়ের সঙ্গে চাঁট। ঘোটক-ঘোটকীর সংসার। কোন ঘটকে ভিড়িয়েছিল কে জানে!

আমাদের যখন এই সব প্রেমালাপ চলছে তখন পাশের বাড়িতে বেজে উঠল শ্যামের বাঁশি। শুধু বাঁশি নয়, একসঙ্গে তিন-চার রকমের ব্যাপার। একেবারে বিলিতি অর্কেস্ট্রা। সেজো বউ সাত বছরের ছেলেকে বিদ্যাসাগর বানাতে বসেছেন।

এই প্রক্রিয়াটি কী জিনিস আমি দেখে শিখেছি। রান্নার বইয়ের মতো, এর ওপর আমিও একটা বই লিখতে পারি এইভাবে:

উপকরণ : একটি শিশু (ছ-সাত বছরের কচিপাঁঠা)

একটি টেবল, দুটি চেয়ার।

চশমা চোখে, ফর্সা চেহারার রাগী রাগী একটি মা (এক সন্তানের জননী, সুস্বাদু) একটি স্কেল।

খাতা, পেনসিল, একটি ‘হাসিখুশি’ বা ওই জাতীয় কোনো বই।

লোডশেডিং কলম আর পেনসিল ভর্তি লম্বা একটি বাক্স (নাড়ালেই যেন শব্দ হয়) একটি আয়না।

আয়নার সামনে গালে সাবানমাখা একজন বাবা, হাতে সেফটি রেজার।

ঘরের বাইরে কলতলায় সাংঘাতিক মুখরা এক কাজের মহিলা, চারপাশে ছড়ানো স্টেনলেস স্টিলের থালা, বাটি, গেলাস, চীনামাটির কাপ-ডিস।

জানালার বাইরে একজোড়া কর্কশ-কন্ঠ কাক।

দূরের কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসা বিধ্বস্ত রেকর্ডে সানাইয়ের সুর।

প্রকরণ : ছেলে পেনসিলের বাক্স নাচাচ্ছে, খড়াস খড়াস শব্দে। টান মেরে কেড়ে নেবার চেষ্টা করো। কাড়াকাড়ি চলুক কিছুক্ষণ। তারপর একটা মোক্ষম রাগের টান। বাক্স ছেড়ে দিয়ে ছেলে? উরে বাবারে, উরে বাবারে বলে ক্রন্দন, তুমি আমার হাতে লাগিয়ে দিলে কেন? আবার চিল চিৎকার।

গালে সাবান বুলোতে বুলোতে পিতার উক্তি, মারো এক থাপ্পড়। বাঁদর ছেলে।

মাতা : তুমি দয়া করে চুপ করো।

ছেলের মাথায় হাত বুলোতে, বুলোতে আদো আদো গলায় বলা, তুমি অমন অসভ্যতা করলে কেন বাপি! নাও বই খোলো, লক্ষ্মী ছেলে! দেখি, কী পড়া আছে।

ছেলে ছ্যাড়াক করে একটা বই খুলতে গেল, খুব হতচ্ছেদ্যা করে। মলাটের খানিকটা উড়ে গেল।

সঙ্গেসঙ্গে মাথায় এক উড়োন চাঁটি, বেশ সজোরে।

চিল চিৎকার।

সাবানমাখা

সান্টাক্লজ পিতা : জুতো পেটা করো।

আঃ তুমি চুপ করো (উহ্য : এ এখন আমার পাঁঠা)

(দাঁতে দাঁত চেপে) ভদ্রভাবে বই খোলো। অসভ্যতা করলে মেরে বদনা ঘুরিয়ে দোব।

ছেলে হাতে ঝাপটা মেরে সব বই, খাতামাতা ছত্রাকার করে দেবে।

সঙ্গেসঙ্গে উত্তম মধ্যম গোবেড়েন।

পিতা সাবানমাখা বুরুশ হাতে মত্তমাতঙ্গের মতো তেড়ে এসে, উঁ উঁ করে ছেলের গালে খানিকটা সাবান মাখিয়ে দেবেন, ছেলে গাল থেকে সেই সাবানপুঞ্জকে টেনে চোখে তুলবে। তুলে তারস্বরে চেঁচাতে থাকবে, জ্বলে গেলো, জ্বলে গেলো। হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে কলতলা।

সেখানে দেখা যাবে, ছাই শালপাতা, দীনুর মা, এক চিলতে জল, কাক, দীনুর প্রস্রাব সব মিলিয়ে একটা দক্ষযজ্ঞ চলেছে।

(দীনুর মাকে) একটু আস্তে ঘষো, আস্তে ঘষো, থালার আর কিছু থাকবে দীনুর মা?

দীনুর মার কর্কশ উত্তর, লোকের পেছনে অত লাগেন বলে এ-বাড়িতে কাজের লোক টেঁকে না। সবাই বলে বউটা ভীষণ খিটখিটে।

কে বলেছে? কে বলেছে খিটখিটে?

সবাই বলে। কম লোক তো আর এ-বাড়িতে এলো না গেল না? তিন মাসের বেশি তো কেউ টেঁকে না। এরপর আর লোক পাবে না, আমাদের ইউনিয়ন জেনে গেছে।

আধগালে সাবান, আধগালে কামানো গৃহস্বামীকে তেড়ে আসতে হবে। তিনি এসে বলবেন, দূর করে দাও, দূর করে দাও।

আঃ, তুমি সব ব্যাপারে নাক গলাতে আস কেন? যাও তুমি ভেতরে যাও।

(যেতে যেতে) ছেড়ে দিও না, ছেড়ে দিও না, থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দাও।

(হাত-পা নেড়ে) চলে গেলে কে বাসন মাজবে, তুমি?

(ঘুরে দাঁড়িয়ে) শালপাতা, শালপাতা কলাপাতার ব্যবস্থা হবে। মেঝে থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাব।

হচ্ছে আমার সঙ্গে, তুমি ওপর পড়া হয়ে জলঘোলা করতে আসছ কেন?

আসব না! ইউনাইটেড উই স্ট্যাণ্ড, ডিভাইডেড উই ফল। এদের আজকাল খুব মেজাজ বেড়েছে।

(দীনুর মা) বেশ, রইল তোমাদের কাজ, আমি চললুম। আমাদের কাজের অভাব হবে নি গো!

(গৃহস্বামী) তাই যাও। গ্রীষ্মের আম, শীতের কমলালেবু, পুজোর শাড়ি, শীতের র‌্যাপার, গেট আউট।

(দীনুর মা) অ্যা মা, যেমন মাগী তেমনি মিনসে গো। আয় দীনু, আবার ইনজিরিতে গালাগাল।

আঃ, তুমি ভেতরে যাও না বাপু। (দীনুর মার পায়ে পড়ে) ও দীনুর মা, রাগ কোরো না। পুজোয় এবার কাঞ্জিভরম। জানই তো কর্তার মেজাজ তেমন ভালো নয়। ওই মেজাজের জন্যে সব জায়গায় মার খেয়ে মরে। (উচ্চ গ্রামে) কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এতখানি বয়েস হল শিখলে না। যাই বলো দীনুর মা, মনটা কিন্তু ভীষণ ভালো। একেবারে শিশুর মতো।

এই সময় দুম করে একটা শব্দ, ও মা, আমি পড়ে গেছি।

আ মোলো! ওই পেছলে, কী করতে মরতে গেছ। হতচ্ছাড়া। নে চল, চান করবি চল!

(দোরগোড়ায় আবার কর্তা) ওই গোভাগাড়ে পড়েছে তো! বেশ হয়েছে!

চৌবাচ্চায় একঘণ্টা চুবিয়ে রাখো। কে ফেলে দিলে, দীনু বোধ হয়!

আঃ আবার তুমি! তোমার ছেলেকে ফেলতে হয় না। সে নিজেই হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকে।

এই সময় বাইরে ভিখারির আগমন। ননস্টপ চিৎকার—মাহা, মাহা। দাঁড়াও, দাঁড়াও। আ মোলো, যেন দমকলে দম দিয়ে এসেছে!

মন্তব্য : এই রন্ধন প্রক্রিয়া একান্তই বঙ্গজ। ঠিকমতো মশলাটশলা দিয়ে রাঁধতে পারলে অতি সুস্বাদু। রোজ সকালে খবর-কাগজের সঙ্গে প্রতিবেশীকে গরম গরম পরিবেশন করা চলে। গরম গরম খান, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে নেতিয়ে পড়বে। পদটি ছ্যাঁচড়া-জাতীয়। রাগী স্ত্রীলোকের হাতে খোলে ভালো। নাম, জীবনঘণ্ট ব্র্যাকেটে আধুনিক।

বাক্যবাণের টা সহযোগে চা পান হল। এর পর আবিষ্কারের পালা। বুকপকেটে সতেরো টাকা ছিল, দু-টাকা হাওয়া। সংসারের যে কোনও কিলই গোঁসাইকে হজম করতে হয়। শাস্ত্রের বিধান।

(গৃহিণী কে কেশে গলা পরিষ্কার করে, বিনীত অধস্তনের কন্ঠে)

হ্যাঁ গো, তুমি কী আমার পকেট থেকে দুটো টাকা নিয়েছ?

(ডালে ফোড়ন) তোমার টাকা-ফাকার খবর আমি জানি না। একবার অপমানিত হবার পর, তোমার পকেটে আমি হাত দি না, বেঁচে থাকতে দোব না।

(স্বগতোক্তি : আশ্চর্য। কাল রাত দশটা দশে ছিল। সকালে ছটায় হাওয়া। যা: বাব্বা:।)

বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করে রানি, ঘরের মেয়ের মতই। কম বয়েস, সংসারের ঘোরপ্যাঁচ তেমন বোঝে না। সে বোকার মতো বলে বসল, মামিমা কাল রাত সাড়ে দশটার সময় তুমি যে আমাকে দুটো টাকা দিয়ে বললে, যা বিশুর মাকে দিয়ে আয়, সিনেমার টিকিটের দাম।

তুই চুপ কর, ও তো আমার টাকা!

আমি শুনতে পাইনি।

শুনতে পেলেও আমার ভারি বয়ে গেল। হ্যাঁ, বেরোবার আগে আজ দশটা টাকা দিয়ে যাবে। ও মাস থেকে খুব ঘোরাচ্ছ। সেই ডাবওলা কাল এসেছিল, বলেছি আজ দোব।

দশ টাকার ডাব?

আজ্ঞে হ্যাঁ। খাবার সময় মনে ছিল না! এখন চোক একেবারে চড়কগাছ। পেট গরম, পেট গরম করে তখন তো খুব মাথা গরম করতে!

কিল খেয়ে কিল হজম করার বিধান শাস্ত্রে আছে। সংসারে এই বিধানেই শান্তির শ্বেত পারাবত ওড়ে। থলে আর বোতল নিয়ে হুড়মুড় করে বেরোতে যাব, বাধা।

সুন্দরী বাধা। পাশের বাড়ির সেই ভদ্রমহিলা। ছেলেকে ঠ্যাঙানো স্থগিত রেখে তিনি এসেছেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। আলকাতরার মতো কালো চুল। বেশ লম্বা, ছিপছিপে। আমার বিপরীত। আমার মানে, আমার স্ত্রীর। কি সুন্দর ইনটেলিজেন্ট লুক! দুটো চোখে যেন আগুন জ্বলছে।

তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গিয়ে প্রবেশপথ ছেড়ে দিলুম। আমার কাছে কেন আসবেন! যাঁর কাছে এসেছেন তাঁর কাছেই যান। আমি শুধু আড়চোখে বার কতক তাকিয়ে দেখি। একজন মধ্যবয়সী, কর্তব্যনিষ্ঠ সংসারী মানুষ এর বেশি আর কী করতে পারে! তাকিয়ে দু-চারটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে শাসন করা। মেয়েদের যেমন দোকানে গিয়ে শাড়ি পছন্দ হয় না। একটাকে ছেড়ে আর একটার ওপর হামলে পড়ে। বিবাহিত পুরুষদেরও সেই এক অবস্থা। বিয়ের প্রথম দু’এক বছর মন একেবারে পোষা পাখি। তারপর শুরু হল ছটফটানি, ওড়াউড়ি। উড়ব বললেই কী আর ওড়া যায়। শিকলিতে টান ধরে।

বাড়ির বাইরে সবে পা রেখেছি, পেছু ডাক এলো, শোনো শোনো, একবার শুনে যাও। ফিরে এলুম। দুই গৃহিণী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পাশের বাড়ির বউটির মুখে মৃদু হাসির রেখা। মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি, আ হা হা হা হা!

বলো কী বলছ?

তোমার কাছে চিমটে আছে?

চিমটে? চিমটে তো সাধু আস্তানায় থাকে!

আরে বাবা, সে চিমটে নয়, আচ্ছা মাথামোটা লোক! ছোটো ছোটো চিমটে, সেই আগেকার দিনে বুড়োর মাথার পাকা চুল তোলা হত না! সেই জিনিস।

কী হবে বলো তো?

পাশের বাড়ির স্বর্গীয় কন্ঠে বললেন, আর বলবেন না, এই দেখুন কান্ড!

কান্ড দেখার জন্যে, মড়াখেকো ব্যাগ আর বোতল দুটো মেঝেতে নামিয়ে রেখে হাত দুটো মুক্ত করে নিলুম। মহিলা সবুজ রঙের সরু একটি কলম বের করলেন। সোনালি ক্যাপ। দেখেই মনে হচ্ছে বেশ দামি।

(একটু আদুরে আদুরে নাকি সুরে) দামি কলমটার কী অবস্থা করেছে বাঁদরটা!

(বেশ একটু উৎসাহের গলায়, যেন লটারির রেজাল্ট দেখব) কই দেখি, কই দেখি!

মহিলা এগিয়ে, এলেন। সামনে ঝুঁকে এসে কলমের মুন্ডুটা খুলে ফেললেন, বেরিয়ে এল মুন্ডহীন একটা ধড়।

এই দেখুন মাথাটা ভেঙে নিবসুদ্ধু খাপে ঢুকে গেছে। সামান্য একটু জিভ বেরিয়ে আছে।

কই দেখি, কই দেখি। যেন সপ্তম আশ্চর্য দেখছি। ভাসুরকে দেখে ঘোমটাহীন ভাদ্রবউ যেমন জিভ কাটে, ক্যাপে ঢুকে পড়ে কলমও সেইরকম এতটুকু জিভ বের করে বসে আছে!

বিশেষজ্ঞের গলায় বললুম, অ, এই ব্যাপার। দাঁড়ান। একটু নারকোল তেল আনো তো!

(সন্দেহের গলায় স্ত্রী) তেল কী হবে?

তেল কী হয়! তেল দোব। তেল দিয়ে মারব টান, হড়কে বেরিয়ে আসবে।

আমার বউ পাশের বাড়ির বউকে বললে, কেন ভাই হাতুড়ের হাতে দিচ্ছ! যারা পেন সারাই করে তাদের একবার দেখাও, এক মিনিটে ঠিক করে দেবে।

না দিদি, উনি মনে হয় ঠিকই বলছেন। ওইভাবেই বেরোবে।

তাহলে তুমি ভাই বাড়িতে বসে করে নাও। এর পর গেলে আর দুধ পাবে না।

ও এখনও দুধ আনা হয় নি! ছিছি, আমি দেরি করিয়ে দিলুম। ঠিক আছে আমি ততক্ষণ চেষ্টা করে দেখি। না পারলে আবার আসব।

কী সুন্দর, হালকা পায়ে তিনি চলে গেলেন! ঘরেতে ভ্রমর এসেছিল গুনগুনিয়ে। কথা কইবার আগে আর এক ডাঁশ ভ্রমর ঝাপটা মেরে উড়িয়ে দিলে।

(লাল চোখ, রাগ রাগ গলায় স্ত্রী, সঙ্গে ব্যঙ্গের সুর) হাঁ করে কি দেখছ! যাও! খুব মজা তাই না, তেল দিয়ে জিভ বের করা হচ্ছিল!

যা বাব্বা!

দুধ নিয়ে দুধের বোতল দুটো সমীরের দোকানে রাখলুম। বাজারের ব্যাগ রাখলুম কুন্ডুর দোকানে। একপাক ঘুরে দেখি। যদি একটা চিমটে পেয়ে যাই, জিনিসটা সহজেই বেরিয়ে আসবে। শাস্ত্র বলছেন, দেশের আর দশের জন্যে বাঁচতে শেখো। মানুষ নিজের জন্যে জন্মায় না, মানুষ জন্মায় পরের জন্যে। গোটা ষোলো দোকান ঘুরলুম। ধ্যাৎ মশাই, চিমটে কোথায় পাবেন? ওসব জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না। চিমটে, পেতলের কানখুসকি, কাঁচপোকার টিপ, আলুর পুতুল, নৈনিতাল আলু, সতী সাবিত্রী স্ত্রী। ফুটপাথে দেখুন, ফুটপাথে! নিউমার্কেটের কিউরিয়োর দোকানে কিংবা পার্ক স্ট্রিটের নিলামে।

আজকাল জ্ঞান দেবার জন্যে লোকে যেন মুখিয়ে থাকে। বেড়াল যেমন কুকুর দেখলে ফ্যাঁস করে ওঠে, মানুষও তেমনি মানুষ দেখলেই ভস ভস করে জ্ঞান দিতে থাকে।

ফেরার পথে দোলগোবিন্দের দোকানের ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলুম। একেই বলে খেল খতম করে বাড়ি ফেরা। কাঁটা একেবারে ঝুলে পড়েছে। বেশ বুঝতে পারছি, ঢোকামাত্রই উত্তমমধ্যম শুরু হয়ে যাবে। বাজল প্রায় সাড়ে আট, নটা বাজতে পাঁচেই শুরু হয়ে যাবে আমার নৃত্য, খেতে দাও, খেতে দাও। দেরি হয়ে গেল, দেরি। তখন পাতে দমাদ্দম যা এসে পড়বে সবই যেন ব্লাস্ট ফারনেস থেকে বেরিয়ে এল। আগুন গরম। কোকেন খাওয়া জিভ না হলে সহ্য করা শক্ত।

যাক, একেই বলে, রাখে কেষ্ট মারে কে? সেই মহিলা সশরীরে হাজির। আমাকে ঢুকতে দেখেই, যেন একটু অভিযোগের গলায় বললেন, এত দেরি হল, দিদি ছটফট করছেন।

মনে মনে বললুম, হায় সুন্দরী, যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর!

মধুরভাষিণী বললেন, ওনার বাজার করাই ওইরকম। একবার বেরলেন তো ফেরার আর নাম নেই। কী যে করেন! মনে হয় কাক দেখেন!

অ্যাঁ, সে আবার কী?

প্রকৃতি প্রেমী যে। নেচার নেচার করে নৃত্য করেন। ইলেকট্রিকের তারে কাক ঝুলছে, উনি হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আহা, কী সুন্দর ময়না দোল খাচ্ছে!

ময়না?

কিছুই তো চেনেন না! দোয়েল দেখে বললেন, রবিন রেড ব্রেস্ট। কী গাছ, কী গাছ করে সেবার দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে পাঁচ-শো ফুট খাদের তলায় গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। চুলের মুঠি ধরে…

(আমি বাক্য সম্পূর্ণ করলুম) বৈধব্য বাঁচালে।

গৃহিণী জ্বলন্ত অঙ্গারের দৃষ্টি হানলেন, যার পুরোটাই প্রেমের নীলচে আগুন। ভাষা-অভিজ্ঞেরাই বোঝেন—মরণ আর কী! বিধবা শব্দটা মেয়েরা পছন্দ করে না। চোখের সামনে ভবিষ্যৎ ভেসে ওঠে। কর্তা নেই। পাজামা, চটি, চশমা, চুরুট পড়ে আছে। শেষ ব্যবহার করা জিনিস। সেভিং সেটে ধুলো জমেছে। পেন, রুমাল, ছাতা। সকাল বেলা বাথরুম থেকে সেই হেঁড়ে গলা ভেসে আসছে না। কর্তার সঙ্গেসঙ্গে সেই তামাক তামাক গন্ধও হাওয়া। মনের অবস্থা কেমন হয় আমি জানি (কল্পনাপ্রবণ, রোমান্টিক মানুষ তো!) সার্কাসের যে মেয়েটি তারের খেলা দেখাচ্ছে, সে যদি হঠাৎ নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে, জীবন-রক্ষাকারী দড়ির জালটি নেই, তাহলে যেমন লাগে, বৈধব্যের কথায় বউদের মনের অবস্থাও সেইরকমই হয়।

পাশের বাড়ির রোমান্টিক চেহারার সেই মহিলা বললেন, নেচার, আমিও খুব ভালোবাসি দিদি। মাঝে মাঝে, ও ঠাট্টা করে বলে, বিভূতিভূষণ স্ত্রীং।

(আবার ‘ও’ আসছে কেন? ‘ও’ এখন ‘ফো’, তোমার ফ্রেণ্ড হতে পারে। ও ফো রাখ! আমি তো রয়েছি। লাভার অফ নেচার। ইংরেজিতে কী সাধে বলে, বার্ডস অফ দি সেম ফেদার ফ্লক টোগেদার। আমরা দু-জন এক পালকের পাখি হয়ে পাশাপাশি চালিয়ে যাই বেশ কিছুদিন, কেমন? আমারটা রান্নাঘরেই থাক। ডেঙ্গো, পুঁই, লাউ-চিংড়ি, হরিণঘাটা নিয়ে মশগুল হয়ে। তুমি মানিক রোজ পেনের খাপে মুন্ডু ঢুকিয়ে আমার কাছে ছুটে ছুটে এসো। আমি আজই যেখান থেকে পারি সন্না কিনে আনছি। কোথাও না পাই, বিকেলবেলা কার্জনপার্কে গিয়ে বসে থাকব। তেল মালিশ আসবে, কান সাফাইঅলা আসবে। কানের লোকটাকে ধরব। ওর কাছে সন্না থাকবেই। যা দাম লাগে লাগুক, ওটাকে বাগাতেই হবে। তখন তুমি রোজ একটা করে ঢোকাও, আর আমি টেনে বের করি, এক্সপার্ট মিডওয়াইফের মতো। আর ওই উনি, ওঁর মতিগতি, হে ঈশ্বর অন্যরকম করে দাও। মাঝে মাঝে চা দিয়ে যাক, পাঁপরভাজা দিয়ে যাক, ডালমুট, কাজু। পৃথিবীর নিয়মটা যদি এইরকম হত, বছর চারেক পরেই স্ত্রীদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা মাতৃভাব জেগে উঠবে। স্বামীতে পুত্রদর্শন হবে। স্বামী গোপালচন্দ্রকে মনে হতে থাকবে বালগোপাল। নাড়ুগোপাল মনে হলেও ক্ষতি নেই। কী সুন্দর। আমরা তখন দু-হাত তুলে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলব, মা প্রেম করে ফেলেছি। শিশু যেমন বলে, অ্যা কোয়ে ফেয়েচি।)

রানি আবার কী সংবাদ নিয়ে এল। তার তো এখন ঝোলা থেকে মাল বের করে ধোবার আর কোটাবার কথা!

মেসো, তুমি দুধের বোতল কোথায় রেখে এলে গো! আন নাই!

মরেছে, দুধের বোতল পড়ে আছে সমীরের দোকানে। বেমালুম ভুলে বসে আছি। বুড়ো বয়সে ঘোড়া রোগ ধরলে মানুষের এই হয়।

বাড়ির কাজের লোককে মহিলারা যেভাবে শাসন করে, গৃহিণী সেইরকম গলায় বললে, দুধের বোতল কোথায়! ভেঙে আপদ চুকিয়ে দিয়ে এসেছ! আজকাল নেশাভাঙ করছ নাকি!

বাক্যির ছিরি দোখো! প্রাইভেটলি যা হয় হোক। একজন বাইরের মহিলার সামনে আমার কেস খারাপ করে দেবার জন্যে, ইচ্ছে করে শাসন করা। বোঝাতে চাইচে, দেখো এর কোনো পার্সোন্যালিটি নেই। এরা কেউ ডেমোসথেনিস পড়েনি দেখছি। কোনো জ্ঞানগম্যি নেই। লেখা- পড়া শিখে তবে সংসার করতে আসা উচিত। তিনি আমার মনের কথা বলে গেছেন। সব মানুষেরই একটু এদিক-সেদিক আনন্দ খুঁজে নেবার অধিকার অবশ্যই আছে, থাকবেও। বাইরে একজন থাকবেন, ফর ডেলি ইউস (আজ্ঞে হ্যাঁ ঠিক এই শব্দই তিনি ইউস করেছেন, ডেলি ইউস, শুনলে সব চোখ কপালে তুলে শিবনেত্র হয়ে বসে থাকবেন) আর বাড়িতে থাকবে একজন সুশীলা স্ত্রী। তিনি হবেন বিশ্বাসী, সেবাপরায়ণা, সন্তানসন্ততির মা। সংসারটিকে একেবারে সাজিয়ে রেখে দেবেন। ডেমোসথেনিসের কথা শুনব না, মেগাসথেনিসের কথা শুনব না, তা হলে কার কথা শুনব। আমি মহাপুরুষদের অবাধ্য হতে পারব না। কোনোকালেই অবাধ্য ছেলে বলে আমার দুর্নাম ছিল না। তুমি তা হলে বউ হলে কেন, পাশের বাড়ির বউ হতে পারতে! তাহলে আমিও তোমার ক্যাপ থেকে পেনের মুখ খুলে আনার জন্যে সময় নষ্ট করতুম। আনন্দ সহকারে করতুম। হিংসে মোটেই ভালো জিনিস নয়। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা বাঙালিকে একেবারে শেষ করে দিলে।

শেষ ঝাঁজ মুক্তি পেল, মনটা কোথায় পড়ে থাকে শুনি।

গটগট করে ভেতরে চলে গেলেন। হেঁকে বললুম, ভাঙিনি, সমীরের দোকানে রেখে এসেছি। (তা হলে ওইখানেই থাক। নেপোতেই দুধ মারুক। এতকাল দই মেরে এসেছে।)

ভীষণ অপমানিত হয়েছি। মহিলা হলে বলতুম, ধরণী দ্বিধা হও। অবশ্য আমি মহিলা না পুরুষ আজও ভালোভাবে বুঝে উঠলুম না। নিজেকে জানা অত সহজ নয়। মনের অবস্থা অতি শোচনীয়। মনে হচ্ছে, হেডমাস্টার মশাই ক্লাসের বাইরে কান ধরিয়ে নিলডাউন করিয়ে দিয়ে গেছেন। ভালো করে মুখ তুলে মহিলার দিকে তাকাতে পারছি না।

দিদি খুব রেগে গেছেন। কী বলে দুধের বোতল দুটো ফেলে চলে এলেন। সাতসকালে জ্বাল দিলেও আজকাল দুধ রাখা যাচ্ছে না, এতখানি বেলা হয়ে গেল। দুধ না কেটে যায়।

বলতে ইচ্ছে করছিল, বেশ করেছি, আমার দুধ আমি বুঝব, কাটে আমার কাটবে। এরা দেখি সব এক গোঁফের বেড়াল। ইনি ফ্যাঁস করেন ত উনি ফোঁস। রাগ চেপে বললুম, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়ে থাকে, (ভেতরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলুম তিনি এখন কোথায়, তারপর গলা খাটো করে) তা ছাড়া, আপনার ওইটা বের করার জন্যে সারা বাজার চষে ফেললুম, সন্না কোথাও পেলুম না।

সত্যি! আপনি কী ভালো। (মুক্তোর মত দাঁতে হাসি, মানুষকে একেবারে ম্যাড করে দেয়)

আস্তে আস্তে, চেঁচাচ্ছেন কেন? শুনতে পেয়ে যাবে।

ওমা তাই তো! আচ্ছা শুনুন, কলমটা আপনার কাছে রেখে গেলুম। যেখান থেকে পারেন, যেমন করে পারেন, আজকের মধ্যেই সারিয়ে আনতে হবে। ওর দামি কলম। জানার আগেই ঠিক জায়গায় রেখে দিতে হবে, তা না হলে বাড়ি ফাটিয়ে ফেলবে।

ঠিক আছে দিন। যেমন করে পারি আজই আমি করে আনব।

উঃ আপনি কী ভালো, কী ভালো!

মহিলা ফড়ফড়িয়ে, নাচতে নাচতে চলে গেলেন। মনে যেন চাবুক মেরে গেলেন। আমার যেমন দুর্ভাগ্য, আবার চললুম বাজারে, দুধের বোতল আনতে। অন্যদিন একবারের বেশি দুবার বাজার যেতে হলে মেজাজ চড়ে যায় সপ্তমে, আজ আর তা হল না। মনে যেন বক্রেশ্বরের হট-ওয়াটার স্প্রিং টগবগ টগবগ করে ফুটছে। রাস্তা হাঁটছি টাট্টু ঘোড়ার মতো।

অফিস পৌঁছোলুম দু ঘণ্টা লেট। নিত্য যাঁরা ফোড়ন কাটেন তাঁরা বললেন, কী হে আজকের অফিসে এলে, না কালকের! বার ভুল হয় নি তো!

ধ্যার, ব্যাটা তোরা কি বুঝবি! ছা পোষা, ম্যাদামারার দল! আমার আজ ভুট্টার মত সব কটা দাঁত বের করে হাসতে ইচ্ছে করছে।

আজকাল আবার মানুষ সারাবার মতো পেন সারাবারও হাসপাতাল হয়েছে। মেরামতিতে নানা সাজসরঞ্জাম, কলকব্জার প্রয়োজন হয়। পেনের কিছু হওয়া মানেই একেবারে সার্জিকাল কেস। চোখে ঠুলি সেঁটে কলমটা দেখতে দেখতে পেন-সার্জেন বললেন, কেস সিরিয়াস। এর ঘাড় মটকে দিয়েছে।

সে আবার কী মশাই, ভূতে ধরেছিল নাকি!

সেইরকমই। (চোখ থেকে ঠুলি খুললেন) পেনটা খুব ভালো ছিল। জাপানি পাইলট। গোলড নিব। যান, বাড়ি নিয়ে যান। আচারের বয়ামের মধ্যে রেখে দিন।

সে কি মশাই!

দেখছেন না, ভেতর থেকে ভড় ভড় করে তেল বেরোচ্ছে।

যা হয় একটা করে দিন দাদা।

দিতে যে পারি না, তা নয়, তবে অনেক খরচ পড়ে যাবে।

কত?

গোটাপনেরো পড়ে যাবে।

অ্যাঁ, সে কী?

ওপরের পুরো সেকসানটা পালটাতে হবে। তাও আপনার রঙে রং মেলানো যাবে না। ব্ল্যাক হবে। তা হোক, মানাবে ভালো। গ্রের সঙ্গে ব্ল্যাক!

একটু কমালে হয় না? পনেরো বড়ো বেশি হয়ে যাচ্ছে!

তা হলে পারলুম না। নিয়ে যান। একটা পুরো সেকসান পালটাতে হবে, প্রায় নতুন জীবন দান। স্পেয়ারস কী অত সহজে পাওয়া যায় মশাই। এ কী মানুষ, যে যতবার বউ মরবে ততবার বিয়ে করা যাবে!

ঠিক আছে পনেরোই দোব।

(আমার কলম হলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতুম। পনেরো টাকায় নতুন কলম হয়ে যাবে। এ যে বড়ো দুর্বলতার কলম! সারাই খরচ আমি মহিলার কাছ থেকে চেয়ে নিতে পারব না। নিজের পকেট থেকেই যাবে)

ওস্তাদ চোখে ঠুলি লাগিয়ে কাজ শুরু করলেন। সন্না দিয়ে ক্যাপ থেকে ভগ্নাংশের ‘ফরসেপ ডেলিভারি’ হল। জিভ আর নিব একই রইল, ধড়ও যা ছিল তা রইল, গলা থেকে মুন্ডুর অংশ পুরোটাই পালটে গেল। পনেরো টাকা ধরে দিয়ে, বুকে পেন (একটা নয়, দুটো—পি ই এন পেন, আর পি এ আই এন পেন, টাকা খরচের যন্ত্রণা) নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়িমুখো হলুম।

কত পরিকল্পনা! প্রথমেই নিজের বাড়িতে ঢুকব না। পেনটা যথাস্থানে হাসি হাসি মুখে বীরের ভঙ্গিতে গচ্ছিত করে দেব। চেয়ারে বসে এমন একটা ভাব করব যেন কত ক্লান্ত! তারপর এই ধরনের বাক্যালাপ হবে:

সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে, পায়ের টেংরি খুলে গেল। কোথাও আর হয় না, শেষে একটি- মাত্র বড়ো দোকানে পেয়ে গেলুম।

অনেক খরচ পড়ল?

খরচ কোনো ব্যাপারই নয়। জিনিসটা যে হয়েছে এইটাই সবচেয়ে বড়ো কথা।

না না, সে কী! যা পড়েছে আপনি বলুন। আপনি দিতে যাবেন কেন?

আপনি আমাকে পর ভাবছেন?

ছি ছি, পর ভাবলে অত জোর করে বলতে পারতুম? (কাম টু দি পয়েন্ট)

দেখুন ঠিক হল কি না? রঙে রং মেলাতে পারলুম না, এইটাই দুঃখ। তবে কনট্রাস্টে রূপ খুলেছে।

সুন্দর হয়েছে। বসুন চা করে আনি।

তার আগে এক গেলাস জল।

(একা ঘরে বসে গুন গুন গান, ছলিয়া মেরা নাম, ছলিয়া মেরা কাম)

বাড়িটা অসম্ভব শান্ত মনে হচ্ছে। আমাদের পাশের বাড়ির এ সময় এতো শান্ত থাকার তো কথা নয়। সকাল আর সন্ধ্যেই তো রমরমার সময়। দু-চার জন পাড়া প্রতিবেশী বাড়ির সামনে জটলা করছে। সব ঘরে আলোও জ্বলছে না। কী জানি বাবা, ইনকামট্যাকস রেড হয়ে গেছে নাকি! সে তো শুনি বড়লোকদের বাড়িতে হয়!

সদরে ঢুকেই দেখি সেই শিশুটি, রোজ সকালে যাকে মানুষ করার জন্যে ধোলাই আর পেটাই হয়। আমাকে দেখেই বললে, জেঠু, বাবা মারা গেছে।

(জন্ম মৃত্যু বোঝার বয়েস তো হয়নি, তাই অমন সহজে বলতে পারলে)

এবাড়ির সেজো ভাই হন্তদন্ত হয়ে বেরোচ্ছিল। (আমাকে দেখেও দেখল না। চরিত্রহীন ভেবেছে নাকি।) জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে ভাই?

সেজটা স্কুটার অ্যাকসিডেন্ট করেছে, হাসপাতালে।

আর তার দাঁড়াবার সময় নেই, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। এক পাশে সরে দাঁড়ালুম। কেউই আমাকে আর তেমন লক্ষ করছে না। (বিপদের দিনে মানুষ ওরকম করতেই পারে) জনাকয়েক মহিলা আর পুরুষ বেরিয়ে এলেন। মহিলারা অশ্রুমোচন করছেন নীরবে। সকলের মাঝখানে সেজো বউও রয়েছেন। তিনি প্রায় ভেঙে পড়েছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। চিনলেন বলে মনে হল না। (এই সময় এই নিন আপনার পেন বলা যায় না। সেটুকু বুদ্ধি আমার আছে। মানুষ বড়ো না, মানুষের পেন বড়ো। আমি স্কুটার অ্যাকসিডেন্ট করলে, আমার স্ত্রীও কি এই রকম শোকার্ত হবেন! সন্দেহ হয়। একবার করে দেখব? আমি সাইকেলই জানি না তো স্কুটার। একদিন বাস থেকে পড়ে গিয়ে দেখব! নিজে নিজে পড়া যাবে না। অপেক্ষা করে থাকি যদি কোনোদিন ফেলে দেয়। তখন তোমার অগ্নিপরীক্ষা হবে সুন্দরী। বাসের যা অবস্থা, একদিন আমি পড়বই। আমি কেন সকলকেই পড়তে হবে, যেমন জন্মিলে মরিতে হবে।)

বাড়ি চলে এলুম। প্রতিবেশী হিসেবে আমার আর বিশেষ কী করার আছে! এবাড়ির কারুর সঙ্গে দেখা হলেই, নিষ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করব, কী, কেমন আছে?

একটু ভালো। না, তেমন সুবিধের নয়।

হা, ঈশ্বর করুন যেন ভালো হয়ে ওঠে। কলকাতার রাস্তায় স্কুটার চলে না। না: চলে না। আর যেন চাপতে দিও না। আপদ বিদেয় করো, বিদেয় করো!

শুনলে তো!

শোনাতে হবে।

(না:, আর দাঁড়ানো ঠিক নয়। জিজ্ঞেস করেছি, কর্তব্য শেষ। আরও গভীরে গেলে যদি টাকা পয়সা চেয়ে বসে!)

বাড়ি ঢোকামাত্রই গৃহিণীর সংবর্ধনা বেশ ভালোই হল।

কোথা থেকে আডডা মেরে ফিরলে?

কেন অফিস থেকে!

তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না, বুঝলে! হয় ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরতে হবে, না হয় বেঁধে রাখতে হবে খাটের পায়ায়। বাঁজা লোকেরা বড়ো দায়দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়।

যা ব্বাবা! (যা বলল, সে তো মেয়েদেরই কলঙ্ক! উস মে হামারা কেয়া হায় ডার্লিং!)

যা ব্বাবা নয়, জামাকাপড় আর ছাড়তে হবে না, চলো, ওই অবস্থাতেই।

কোথায় যাব, সিনেমায়!

আজ্ঞে না, হাসপাতালে।

একটু চা খেয়ে যাব না!

সারাদিন ক-কাপ হয়েছে অফিসে! একদিন, একবেলা চা না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

হাসপাতালের এমার্জেন্সীতে অরুণকুমার চিৎ হয়ে পড়ে আছে। শোনা যাচ্ছে প্রায় অচৈতন্য। এখুনি একটা এমার্জেন্সী অপারেশানের প্রয়োজন। ব্যাস দেখা হল কী হয়েছে জানা গেল, কী হতে চলেছে তাও জানা গেছে।

এবার তা হলে বাড়ি চলো।

দাঁড়াও না। এ মানুষটা সবেতেই ব্যতিব্যস্ত! নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। দেখতে পাচ্ছ না পাড়ার ছেলেরা কীরকম করছে।

আরে ধ্যুর। ওরা হল মাস্তান টাইপের ছেলে। ওরা তো করবেই।

আর তুমি কী করবে চাঁদু। ফুলে ফুলে মধু খাবে, তাই না? দাঁড়াও এখানে। যাবার সময় হলে আমি বলব!

(আজকাল মেয়েরা কী ভাষা শিখেছে রে ভাই! ফুল আর নেই, সব হুল। কোথায় বাড়িতে গিয়ে বিছানায় একটু আরাম করে লটকে পড়ব, কাগজ পড়তে পড়তে ভালো মন্দ কিছু চিববো, তা না পাশের বাড়ির এই যুবকটি একটি স্কুটার কিনে এই নির্ঝট শান্তিপ্রিয় মানুষটিকে বাঁশ দিয়ে কাৎ হয়ে পড়লেন। এখানে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে কী লাভ হবে! এই তো এরা সবাই রয়েছে। এরাই তো ম্যানেজ করে দেবে। আসলে তা নয়, মেয়েরা একবার বাইরে বেরোলে সহজে আর ঢুকতে চায় না। অনেকটা টুথপেস্টের মতো, বেরোতে জানে ঢুকতে জানে না। পাড়ার ছেলেরা করবে না কেন! স্যামসন না কে যেন ডেলাইলার জন্যে মাথা মুড়িয়েছিল! নামটা মনে পড়ছে না, হারকিউলিসও হতে পারে। আমিও তো করেছি! এই তো পেন সারিয়ে এনেছি!)

হঠাৎ একটা রব উঠল, রক্ত চাই, রক্ত চাই। রক্ত দিতে হবে।

দু-চার জন বীর হাতা গুটিয়ে এগিয়ে গেলেন। (কত বড় দাতা সব! এক ফোঁটা রক্ত হতে চায় না, সেই রক্ত দিতে ছুটল) আবার শোনা গেল গ্রূপ মিলছে না, গ্রূপ মিলছে না।

আমার স্ত্রীরত্নটি যেখানে থাকবে সেইখানেই একটি গোলমাল পাকিয়ে বসে থাকবে! এমন বিশ্বাসঘাতিকা ইতিহাসে নেই! হঠাৎ ওপরপড়া হয়ে বলে উঠল, এরটা দেখুন তো, এরটা দেখুন তো!

ব্যস কাঙালকে শাকের খেত দেখালে যা হয়, তাই হল। হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল, যমদূতের মতো একজন, বললেন শুয়ে পড়ুন। মনের অবস্থা কী হয়? আমার যেন সতীদাহ হচ্ছে!

মিউ মিউ করে বললুম, আজ্ঞে আমার অ্যানিমিয়া আছে মনে হয়।

ধ্যুৎ মশাই, এই যার লাশ, তার অ্যানিমিয়া। (ডাক্তারের কথার যেমন ছিরি)

আজ্ঞে ব্লাড ক্যানসারও থাকতে পারে।

কেন ঘাবড়াচ্ছেন মশাই!

এমন বরাত। টেস্টে গ্রূপও মিলে গেল!

মিলেছে মিলেছে বলে কী উল্লাস। নিয়ে নাও বোতলখানেক।

একেবারে এক বোতল নেবেন স্যার! (গুঁতোর চোটে লোকে রাম নাম কী বলে, আমি বদখদ একটা লোককে স্যার বলছি)

আরে ঘাবড়াচ্ছেন কেন মশাই! মানুষের শরীরে বালতি বালতি রক্ত, তার থেকে এক বোতল নিলে কি হবে! তা ছাড়া আপনি তো হাই-প্রেসারের রুগি। উপকারই হবে।

কে বলেছে হাইপ্রেসার?

আপনার স্ত্রী।

গুলিয়ে ফেলেছে মশাই। হাই-প্রেসার নয়, হাই মেজাজ।

ওই হল। নে শ্যামু, নে টানতে থাক।

এক বোতল তো এক বোতল! ভদ্রলোকের এক কথা। টলতে টলতে রক্ত-শূন্য বীর ফিরে এল।

রক্ত-শোষক বললেন, বাড়ি গিয়ে এক গেলাস গরম গরম দুধ খাইয়ে দেবেন।

স্ত্রী বললেন, আমার দুধ কেটে গেছে।

পথে অনেক দোকান পড়বে খাইয়ে দেবেন। (কাকে কী বলছেন? স্ত্রী আমাকে দুধ খাওয়াবে! ওয়ান পাইস ফাদার মাদার)

ভীষণ রেগে গেছি।

রাগ করে পাশ ফিরে শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে মনের সঙ্গে একটা সমঝোতা করার চেষ্টা করছি। পাশের বাড়ির সঙ্গে দেয়া-নেয়ার একটা খতিয়ান মেলে ধরেছি। চামচে, কাপডিশ, চিনি, চা, দুধ, বই, টেবিলল্যাম্প, ছাতা। গেছে, এসেছে, আসে নি। শেষ গেল রক্ত। পাল্লার ভার এদিকেই বেশি। তা ছাড়া, এখন মনে হচ্ছে, কত বড়ো একটা তৃপ্তি! যাকে ভালো লাগে, তার সঙ্গে দেহের মিলন না হোক, রক্তের মিলন হবে। সেই যে আজকাল বিজ্ঞাপন দেখি, আপনি কী আপনার স্ত্রীর আরও গভীরে যেতে চান?

গায়ের ওপর একটা হাত এসে পড়ল।

শত্রুর হাত। চুড়ির শব্দ।

শোনো!

বলে ফ্যালো।

রাগ করেছ?

করলেই বা কী হবে?

বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। হঠাৎ আজ এত প্রেম?

শোনো, তোমার আর অরুণ ঠাকুরপোর তো এক গ্রূপের ব্লাড!

হ্যাঁ। এক বোতল তো দিয়ে এলুম।

তাহলে? (মহিলার গলা কেমন যেন ধরে এসেছে। দিনের সেই প্রখরতা আর নেই। কী একটা আবেগ চেপে রাখার চেষ্টা) তা হলে আমাদের কেন হল না?

একটি বন্ধ্যা নারীর চাপা কান্নায় আমাদের সুখ-শয্যা কণ্টক-শয্যা হয়ে গেল। জন্মান্তরে না গেলে এ সমস্যার সমাধান নেই। মন ফিরে গেল সুদূরে। সেই ফুলশয্যার রাত। সেদিনের সানাইয়ের সুর কী আজ কান্নার সুর হয়ে ফিরে এল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *