৪
পরদিন কাজে এল না ফুলমণি।
চন্দনদার দুশো টাকা বাসন্তীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সাঁওতালদের অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাসন্তী টাকাটা দিয়ে দিয়েছে, ফুলমণি নিতেও আপত্তি করেনি জানা গেল। চন্দনদার হাত থেকে নিতে ও লজ্জা পেয়েছিল। ওর এত লজ্জা আমি কখনো দেখিনি।
এরা পয়সা জমাতে জানে না। হাতে পয়সা থাকলে কাজ করতেও চায় না। ফুলমণির রোজ ছিল বাইশ টাকা, একসঙ্গে দুশো টাকা পেয়েছে, এখন কতদিন কাজে আসবে না কে জানে! পর পর তিনদিন পাত্তা পাওয়া গেল না তার।
চন্দনদা অন্যরকম একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। এখানে অনেক ট্রেসিং পেপার লাগে, সেগুলো পাঠানো হয় শক্ত কাগজে মোড়া প্যাকেটে। সেই শক্ত কাগজগুলো কেটে কেটে ঠিক মতন সাইজের করা হলো। দু’তিন রকম রংও জোগাড় করেছে চন্দনদা। সেগুলো আমায় দিয়ে বলেছিল, তুই ফুলমণিকে এই কাগজের ওপর রং দিয়ে ছবি আঁকতে বলবি। আঙুল দিয়ে হোক বা যেভাবেই আঁকুক। দেয়ালে চুন দিয়ে আঁকা ছবি কিংবা তার ফটোগ্রাফেরও বিশেষ কোনো মূল্য নেই। কাগজের ওপর আঁকা কয়েকখানা ছবি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নাম করা দু’একজন শিল্পীকে দেখানো যেতে পারে। তার মতামত শুনে বোঝা যাবে, সত্যিই মেয়েটার ছবি আঁকার ক্ষমতা কতখানি।
কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। কোথায় ফুলমণি? সে নিজে থেকে না এলে তো তাকে জোর করে ধরে আনা যায় না।
আমার ঘরে এসে সন্ধেবেলা চন্দনদা খাটে শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা আজও, আসেনি?
আমি বললুম, নাঃ। ওর গ্রামের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে পারে না। আদিবাসীরা কোনো প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দেয় না। হয় হাসে, অথবা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে। আমি বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি কেন আসছে না। তার উত্তরে ও প্রথমে খিলখিল করে হাসল। তারপর বলল, আমি যদি এক রোজ না আসি, তুই আমার কথা জিগাস কি, ছোটবাবু? বোলো? এরপর কি ফুলমণি সম্পর্কে আর কৌতূহল দেখানো যায়?
চন্দনদা বলল, দ্যাখ নীলু, আমি ছবি আঁকা কনটিনিউ করিনি বটে, কিন্তু ছবি আমি মোটামুটি বুঝি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও মেয়েটা একটা জিনিয়াস। আজকাল ছবির বাজার দারুণ ভালো। একটু নাম করা শিল্পীদের ছবি পনেরো, কুড়ি, তিরিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। হুসেনের এক এক খানা ছবির দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগে একটা গ্যালারিতে একজন প্রায় নতুন শিল্পীর একজিবিশান দেখতে গেসলাম। এক একটা ওয়াটার কালার ছবির দাম ধরেছে পাঁচ হাজার টাকা। আমার ধারণা, এই মেয়েটাও ছবি এঁকে যথেষ্ট রোজগার করতে পারে। একটা গ্রামের অশিক্ষিত গরিব মেয়ে বলে সুযোগ পাবে না, তার গুণের কদর হবে না, কেন?
—একটা কথা জিজ্ঞেস করি, চন্দনদা। এইটাই আমার কাছে ধাঁধার মতন লাগে। সাধারণ গরিব মানুষ, যাদের খাওয়া পরার চিন্তাতেই সারাদিন কেটে যায়, তাদের প্রায় কেউই ছবি-টবির ব্যাপার জানেই না, তবু হঠাৎ দু’একজন ছবি আঁকতে চায় কেন?
–তুই আদিম গুহামানবদের আঁকা ছবি দেখিসনি? তারা কি ছবির বিষয় কিছু জানত? তাদেরও শুধু খাবার জোগাড়ের চিন্তায় দিন কাটত। তখন স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স ছিল সাঙ্ঘতিক। তবু তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছবি এঁকেছে।
—অনেকে যে বলে, খুব বৃষ্টির মধ্যে যখন ওরা গুহা থেকে বেরুতে পারত না, তখনই ওরা সময় কাটাবার জন্য দেয়ালের গায়ে ছবি এঁকেছে।
—সময় কাটাবার জন্য অধিকাংশ মানুষই পড়ে পড়ে ঘুমোয়। কিংবা অন্যের সঙ্গে খুনশুটি করে কিংবা সেক্সের তালে থাকে। মাত্র দু’একজনেই ছবি আঁকে। এটাই একটা রহস্য। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হঠাৎ দু’একজন গানের গলা পায়। দু’একজন কিছু না শিখেও ছবি আঁকতে পারে, দু’একজন করি হয়। শিল্পের লাইনে উন্নতি করতে গেলে সবাইকেই শেষ পর্যন্ত শিখতে হয়, সাধনা করতে হয়। কিন্তু ভেতরে কিছু জিনিস না থাকলে তো হাজার ট্রেইনিং-এও শিল্পী হওয়া যায় না। এক একজনের আবার এই ভেতরের জিনিসটা থাকলেও সুযোগের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশে এখনো শহরের লোকেরা যত সুযোগ পায়, গ্রামের লোকেরা তার কিছুই পায় না।
—শহরের লোকেরা…ইদানীং সব বড়লোকের ছেলেমেয়েরাই ছবি আঁকা শিখতে যায়, যেখানে সেখানে গানের ইস্কুল, আর কবি, কবিদের তো ইস্কুলও লাগে না, হাজার হাজার কবি, সবাই ভাবে কবিতা লেখাটা খুব সহজ! রিটায়ার্ড জজ, ডকের মজুর, যাবতীয় স্কুল মাস্টার, যাবতীয় প্রেমিক দু’চারলাইন লিখেই ভাবে, এই তো কবিতা হয়ে গেল। আজকাল তো আবার ছন্দ মিলেরও ব্যাপার নেই! তুইও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিস নাকি কখনো, নীলু?
—রক্ষে করো! দেখছ না আমার হাতের আঙুল, এই আঙুলে কখনো কবিতা বেরুতে পারে? আমি ভুলেও কখনো সে চেষ্টা করিনি!
চন্দনদা উঠে বসে খানিকক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই রকম মুখের ভাব দেখলেই বুঝতে পারি, চন্দনদার মাথায় আবার নতুন কোনো প্ল্যান ঘুরছে।
চন্দনদা গাঢ় গলায় বলল, দ্যাখ নীলু, ঐ ফুলমণি মেয়েটার সত্যিকারের প্রতিভা আছে। সেটাকে নষ্ট হতে দেওয়াটা অন্যায়। আমাদের কিছু দায়িত্ব নেই? তা হলে আমরা কিসের মানুষ?
আমি আমতা আমতা করে বললুম, কিন্তু মেয়েটা যদি নিজে না চায়
—ওকে বোঝাতে হবে! ওকে দিয়ে আরও আঁকাতে হবে। আমি ওকে গোল্লায় যেতে দিতে কিছুতেই রাজি নই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মুশকিল এই, আমি নিজে কিছু করতে পারব না ওর জন্য। আমি কোনো দায়িত্ব নিতে পারব না।
—কেন?
–তার কারণ, ও একটা মেয়ে।
—তাতে কী হয়েছে?
–আরে মেয়ে বলেই তো ঝামেলা। ওর কোনো উপকার করতে গেলেই তোর বউদি খেপে যাবে। সেবারে রোহিণীকে নিয়ে কী কাণ্ড হলো মনে নেই? নীপার ধারণা, কোনো মেয়েকে আমি যদি কিছু সাহায্য করতে যাই, তার মানেই আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি।
—যাঃ, কী বলছ, চন্দনদা! ফুলমণি সম্পর্কে এ প্রশ্নই ওঠে না। একটা রোগা হাড় জিরজিরে মেয়ে, সাত চড়ে রা কাড়ে না, কোনো কথাই বলে না, তার সঙ্গে আবার প্রেম হতে পারে নাকি!
—তুই বুঝবি না, মেয়েদের যে কিসে কখন ঈর্ষা হয়! তুই আর মেয়েদের সম্পর্কে কতটুকু জানিস! ঐ ফুলমণিটা যদি একটা ছেলে হতো, আমি নিজের টাকা খরচ করে ওকে কোনো আর্টিস্টের কাছে কিছুদিন রেখে দিতাম, ওর ছবির প্রদর্শনী নিয়ে সারাভারতে ঘুরতাম! কিন্তু ওর বেলায় তা পারব না, তোকেই ভার নিতে হবে। তোকে তো আর কেউ প্রেমে পড়ার বদনাম দেবে না, আর বদনাম দিলেই বা তোর কী আসে যায়?
এই সময় হরিলাল হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে এসে খবর দিল, কলকাতা থেকে একটা গাড়ি এসেছে, গাড়ি ভর্তি লোক, তারা চন্দনদাকে খুঁজছে।
আমরা ওপর থেকেই উঁকি মেরে দেখলুম, লালুদার লাল রঙের মারুতি গাড়ি। ভেতরে নীপা বউদি, মুমু আর ওদের বাড়ির রান্নার লোকটি।
লালুদার ঐটুকু গাড়ি থেকে এত জিনিস বেরুতে লাগল যে মনে হলো যেন ম্যাজিক। দু’তিন হাঁড়ি মিষ্টি, অনেক রকমের ফল, বাক্স বাক্স চীজ, বিস্কিট, মাখনের টিন, সার্ডিন মাছের টিন, পাঁউরুটি, জ্যাম, জেলি, আচার…।
এসেই লালুদা ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে দিল।
দারুণ ভাবে শুরু হলো রান্নাবান্নার তোড়জোড়। রাত আটটা বেজে গেছে, এ সময় এখানে কোনো দোকান খোলা থাকে না, গ্রামে লোক পাঠিয়ে আনা হলো মুরগি। লালুদা নিজে মদ খায় না, সিগারেট খায় না। অথচ সঙ্গে এনেছে হুইস্কি—ব্র্যান্ডির বোতল, দামি দামি সিগারেটের প্যাকেট। চন্দনদার বাংলোয় আড্ডা চলল রাত পৌনে তিনটে পর্যন্ত।
পরদিন সকাল থেকেই আবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। লালুদা যেখানে থাকে, সেখানে অন্যদের কথাও বলতে দেয় না, পয়সাও খরচ করতে দেয় না। গ্যাস বিক্রির টাকা যেন অফুরন্ত।
আমাকে ন’টার সময় ঠিক কাজে যেতে হয়। লালুদা সেখানেও উপস্থিত। বাড়ির কনস্ট্রাকশান বিষয়ে আমাকে কত না উপদেশ দিল তার ঠিক নেই। ওটা যে আমার কাজ নয়, তা বলারও সুযোগ পেলুম না। লালুদাকে মহিমবাবুর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারলে হতো। মহিমবাবু এদিকে আসেননি।
পাঁচদিন হয়ে গেল, ফুলমণিরও দেখা নেই।
সন্ধেবেলা চন্দনদা আমায় চুপি চুপি খানিকটা ভর্ৎসনা করে বলল, নীলু, তুই মেয়েটার একটা খবর নিলি না? যদি অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে? ঐ তো রোগা চেহারা, যদি মরে যায়। কাল রবিবার, কাল তুই ওদের গ্রামে যেতে পারিস না?
আমি চুপ করে রইলুম।
ঐ রকম একটা ইচ্ছে আমার হয়েছিল, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আদিবাসীদের গ্রামে এখন আর চট করে যাওয়া যায় না, ওরা সন্দেহ করে। অবস্থা অনেক বদলে গেছে। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’-ফাত্রি এখন আর চলে না। আমার মতন একটা ছোকরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে একটা মেয়ের খোঁজ করলে ওর স্বামীটাই হয়তো আমাকে ধরে পেঁদিয়ে দেবে। আর যদি তীর ধনুক দিয়ে…
মাথায় অন্য একটা মতলব এসে গেল।
রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে, তখন আমি ফস করে বলে উঠলুন, মুমু, কাল সকালে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি? একটা মস্ত বনতুলসীর ঝোপ আছে, সেটা পেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ের পাশে ঝরনা।
মুমু বলল, হ্যাঁ যাব, হ্যাঁ যাব!
লালুদা অমনি বলল, কোথায় যাবে নীলমণি? আমি গাড়ি করে নিয়ে যাব। সবাই মিলে যাব।
আমি বললুম, না গাড়িতে গেলে হবে না। সবাই মিলে গেলেও হবে না। একবার শুধু মুমু আর আমি এই ছোটপাহাড়ীতে এসেছিলুম। তখন যেসব জায়গায় ঘুরেছি এখন আমরা দু’জনে সেই সব জায়গা আর একবার দেখব!
লালুদা বলল, ও, সেই যেবার তুমি মুমুকে নিয়ে ইলোপ করেছিলে, নীলকণ্ঠ? নীপা বউদি হেসে ফেলল।
আমি বললুম, দু’বছর আগে মুমু আরও ছোট ছিল। ওর বয়স তখন এগারো। এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে কেউ কখনো ইলোপ করে?
মুমুটা অতি দুষ্টু। মিচকি হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই তো। এই নীলকাকা, তুমি সেবার কী সব মিথ্যে কথা বলে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে তো! লালুদা বলল, তারপর তুমি মুমুকে অযোধ্যা পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে। নীলকমল, আমার সব মনে আছে!
চন্দনদা আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনের হাসি দিল।
মুমু আমার পাসপোর্ট। মুমুর মতন একটি কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কোনো আদিবাসীদের গ্রামে গেলে কেউ ভাববে না, আমি কোনো কুমতলবে এসেছি। ফুলমণির গ্রামের কয়েকজন আমাকে চেনে, ওরা আমার কাছে কাজ করে, ওদের মোটেই উগ্র-হিংস্র বলে মনে হয় না, তবু সাবধানের মার নেই। মুমুর মুখখানায় সদ্য কৈশোরের লাবণ্য মাখা, ওকে দেখলেই পছন্দ করে সবাই। পরদিন ভোরবেলা, লালুদা জাগবার আগেই বেরিয়ে পড়লুম আমি আর মুমু। রাত্তিরে বেশ জোর কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোরের বাতাস রীতিমতো শিরশিরে। বৃষ্টির জলে এখানে কাদা হয় না, মাটিতে সোঁদা সোঁদা ভাব। গাছপালাগুলো সব যেন স্নান করে ফিটফাট সেজে আছে।
মুমু বলল, আগেরবার তো আমরা পাহাড়ের দিকে যাইনি!
আমি বললুম, তুই তো চন্দনদার ওপর রাগ করে, অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়লি এক সময়। তারপর তো সন্ধেবেলায় আমরা ফিরে গেলুম কলকাতায়। দুপুরটাতে আমি একা একা এদিকে ঘুরে গেছি। একটা খুব সুন্দর ছোট্ট নদী আছে।
মুমু বলল, অ্যাই ব্লু, আমার যখন আঠেরো বছর বয়স হবে, তখন তুমি আমায় নিয়ে সত্যি ইলোপ করবে? বেশ মজা হবে তা হলে!
আমি বললুম, তুই যা সুন্দর হচ্ছিস দিন দিন, আঠেরো বছরে তোর এত বন্ধু জুটে যাবে যে তখন আমায় প্রায় পাত্তাই দিবি না!
—আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে বুঝি অনেক বন্ধু হয়?
—হ্যাঁ, তখনই তো জীবনের শুরু।
—ইস, কবে যে আঠেরো বছর আসবে!
—আর পাঁচ বছর বাদেই।
—এই শোনো ব্লু, আঠেরো বছর বয়েসে যখন আমার অনেক বন্ধু হয়ে যাবে, তখন আমি যদি তোমাকে পাত্তা না দিই, তুমি কিন্তু তখনো আসবে আমার কাছে। তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।
—আহা-হা-হা, তুই অন্য বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবি, তবু আমি তোর কাছে আসব কেন রে?
—হ্যাঁ তোমাকে আসতেই হবে। আসতেই হবে। বলো আসবে।
–সে আমি এখন কিছু বলতে পারছি না।
–না, তুমি আসবে। প্রমিজ করো। এক্ষুনি প্রমিজ করো। না হলে আমি যাব না! মুমু একটা সোনাঝুরি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
হালকা সোনালি রঙের শালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে আজ, রংটার সঙ্গে ভোরের রোদ্দুরের মিল আছে। মাথার চুল উড়ছে একটু একটু। চোখের কোণে এখনো যেন ঘুম লেগে আছে একটু একটু। ছেলেমানুষীতে ভরা মুখখানাতে রাগ রাগ ভাব।
মেয়েটা সত্যিই খুব রূপসী হবে। এর মধ্যেই লম্বা হয়েছে অনেকটা!
কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললুম, পাগলী একটা! পাঁচ বছর আগেকার প্রতিজ্ঞার কি কোনো দাম আছে? পাঁচ বছরে কত কী বদলে যেতে পারে! পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমি ঠিক এক বছরের ফিলজফি নিয়ে বেঁচে থাকি। মুমু আমার হাত ছাড়িয়ে সরে গিয়ে বলল, এক বছরের ফিলজফি? মানে কী আগে বলো!
আমি বললুম, সেই গল্পটা জানিস না! একজন বিদেশীকে এক রাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল।
—মৃত্যুদণ্ড…মানে ডেথ সেনটেন্স?
-হ্যাঁ। মৃত্যুদণ্ড মানে ডেথ সেনটেন্স। আজকাল অনেক বাংলা কথার ইংরিজিতে মানে বলে দিতে হয়।…রাজা মৃত্যুদণ্ড দেবার পর সেই বিদেশী বলল,
মহারাজ, আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখেন, তা হলে আপনার সবচেয়ে যে প্রিয় ঘোড়াটা, সেটাকে আমি আকাশ দিয়ে ওড়া শিখিয়ে দিতে পারি, আপনি সেটায় চেপে আকাশে ঘুরবেন। মহারাজ শুনে হকচকিয়ে গিয়েও বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে আমি এক বছর সময় দিলাম! লোকটাকে জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পর অন্য একজন কয়েদি বলল, তুমি কি পাগল নাকি? ঐ কথা বললে—ঘোড়া কখনো আকাশে উড়তে পারে? বিদেশীটি বলল, শোনো, এই এক বছরের মধ্যে রাজা মরে যেতে পারেন, ঘোড়াটা মরে যেতে পারে, কিংবা এমন কিছু আবিষ্কার হতে পারে যাতে সত্যি সত্যি ঘোড়াকে আকাশে ওড়ানো যায়। এই সব কথা ভেবে ভেবে আরও অন্তত একটা বছর তো বেশ মজায় কাটানো যাবে। মুমু খিলখিল করে হেসে বলল, আমি এর নাম দিলুম, নীললোহিত-ফিলজফি! এই রাগ, এই হাসি–এর নাম কৈশোর!
বনতুলসীর জঙ্গলটা পার হয়ে আমরা পৌঁছোলুম নদীটার ধারে। এখন মোষেরা পার হচ্ছে না, বকেরাও নেই, তবু নদীটি ফুলমণির আঁকা ছবি হয়ে আছে। আমি বললুম, তুই সাঁতার শিখেছিস, এখন তো জলে ভয় পাস না। মুমু ঠোঁট উল্টে বলল, মোটে একটুখানি জল, এর মধ্যে সাঁতার কাটা যাবে নাকি?
—হেঁটেই পার হতে হবে, তবে এক এক জায়গায় গভীর আছে। মোষ ডুবে যায়। কিন্তু তোর শালোয়ার-কামিজ যে ভিজে যাবে!
—তুমি আগে বললে না কেন? এর তলায় সুইমিং সুট পরে আসতুম!
—এক কাজ করা যেতে পারে। আমি হবো সিন্দবাদ নাবিক আর তুই হবি বুড়ো, শক্ত করে আমার গলাটা ধরে থাকবি, আমি তোকে পিঠে নিয়ে পার কর দেব।
–আমার বুড়ো হতে বয়ে গেছে। ভিজুক গে শালোয়ার!
যে কোনো নদী পার হতে গেলেই আমার দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়ে। সেখানকার নদী অবশ্য বেশ বড়, খানিকটা সাঁতার দিতেই হয়। সেখানকার বালি সোনার দানার মতন। এ নদীতে বালি নেই, শুধু পাথর।
অল্প জল হলেও স্রোতের টান আছে বেশ।
ছুটির দিনে আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছি। পাজামা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে নিতে অসুবিধে নেই। চটিগুলো আস্তে ছুঁড়ে দিলুম অন্য পারে। জল বেশ ঠাণ্ডা। মুমু আমার হাত ধরে এগোতে লাগল।
এই সকালবেলা মুমুর হাত ধরে একসঙ্গে নদী পার হবার মধ্যে যে ভালোলাগা, তা শুধু আজকের জন্য নয়, এক বছরের জন্যও নয়, তা চিরকালের।
মাঝখানটায় বেশ জল, মুমুর কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল, আমি ওকে জোর করে তুলে নিলুম বুকে। মুমু হাত পা ছুঁড়ে আপত্তি জানাতে লাগল, আমি প্ৰায় দৌড়ে চলে এলুম এ পাড়ে।
পোশাকের ওপরের অংশটা না ভিজলেই হলো। তলার দিকটা ভিজলে তেমন ক্ষতি নেই, গায়ে ঠাণ্ডা বসে না।
এতক্ষণ একটাও মানুষজন দেখিনি, এবার দেখা গেল দুটে বাচ্চা ছেলেকে। ওরা কি একটা দুর্বোধ্য গান গাইছে। এক লাইন একজন, আর এক লাইন অন্যজন।
এদের ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, এই, পিঁজরাল গাঁওটা কোন্ দিকে রে?
উত্তর না দিয়ে ছেলে দুটি পাহাড়ের তলা দিয়ে এক দিকে ছুটে গেল অনেকখানি। একটা বড় শিমুল গাছের তলায় থেমে হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকল। কাছে যেতে একজন বলল, এই নীচা দিয়ে চলে যাও। হুই দেখো পিঁজরাল গাঁও।
ওরা আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই নির্দেশ না দিয়ে যে এই পর্যন্ত ছুটে এল, সেটাই এদিককার মানুষের বিশেষত্ব। যদি বলতুম, আমাদের এই গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চল তো, তাও যেত অম্লান বদনে। আমি ছেলেদুটোর মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে আদর করে দিলুম।
মুমু জিজ্ঞেস করল, আমরা পাহাড়টার ওপরে উঠব না?
—আগে চল পিঁজরাল গ্রামটা ঘুরে আসি।
–সেখানে কী আছে?
–সেখানে একটা মেয়ে আছে, ছবি আঁকে, তোর চেয়ে অনেক বড়, বোধহয় আমার বয়সী, তার সঙ্গে একটু দেখা করতে হবে!
–ও, তুমি একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ। সে কথা আগে বলোনি।
চন্দনদা ঠিকই বলেছিল, মেয়েদের যে কখন, কেন ঈর্ষা জেগে ওঠে, তা বোঝা দুঃসাধ্য।
মুমু মুখ গোঁজ করে বলল, আমি এখন এই পাহাড়টার টপে উঠব!
আমি হেসে বললুম, তা হলে তোকে একা উঠতে হবে ভাই। আমি আগে গ্রামটায় যাব।
–তুমি পাহাড়ে যাবে না আমার সঙ্গে?
—তুই আমার সঙ্গে গ্রামে যাবি না! কে কার সঙ্গে কখন কোথায় যাবে সেটা আগে ঠিক করা যাক।
–ব্লু, তুমি একটা অতি পাজী, মিথ্যেবাদী, গুড ফর নাথিং, বেবুন, রিস্টারিং বার্নাল, থাণ্ডারিষং টাইফুনস।
—এই আমাকে গালাগালি দিবি না বলছি, মুমু, এখানে কেউ নেই, মেরে তোকে ঠাণ্ডা করে দেব।
—ইস মারো তো দেখি! দেখি তোমার গায়ে কত জোর। আমিও বুঝি মারতে জানি না?
আমি খপ করে মুমুর একটা হাত চেপে ধরে কটমট করে ওর দিকে তাকালুম। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললুম, চল, আগে গ্রামটা ঘুরে আসি চট করে। বেশি বেলা হলে চড়া রোদ উঠে যাবে। বিকেলে পাহাড়ে উঠব।
মুমু এবার দৌড়তে লাগল আমার সঙ্গে। এ সবই আমাদের খেলা।
পিঁজরাল গ্রামে পৌঁছোতে বেশিক্ষণ লাগল না। এখানকার সব লোকই এর মধ্যে জেগে গেছে। একটা গোয়ালে গরুর দুধ দোয়াবার চ্যাঁ চোঁ শব্দ হচ্ছে। সরু রাস্তা দিয়ে ছোটাছুটি করছে মুরগি।
একজন কালো পাথরের তৈরি মূর্তির মতন লোক একটা ছোট মোষের বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, ও মাঝি, ফুলমণি কোন বাড়িতে থাকে?
লোকটি একটুও অবাক হলো না, কোনো রকম কৌতূহলও প্রকাশ করল না। খানিকটা এগিয়ে একটা মেঠো পথ দেখিয়ে বলল, হুই যে তালগাছ, তার পাশে।
আমার আগের অভিজ্ঞতায় জানি, সাঁওতালরা খুবই অতিথিপরায়ণ হয়, মানুষকে সহজেই বন্ধু ভাবে নেয়। কোনো কারণে ওরা খেপে গেলেই মুশকিল। বাইরের কিছু লোক নানা ধরনের বাঁদরামি করে ওদের খেপে যাবার কারণও ঘটিয়েছে।
তালগাছটা পর্যন্ত যাবার আগেই একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাসন্তী।
সে হাসিমুখে বলল, আরে ছোটাবাবু, ফুলমণির খবর নিতে এসেছ বুঝি?
নিজের ওপর পুরো দায়িত্ব না দিয়ে আমি বললুম, বড়বাবু পাঠালেন। ও আর কাজ করবে কিনা জানা দরকার। না হলে নতুন লোক নিতে হবে।
বাসন্তী মুমুর দিকে চেয়ে বলল, কী সোন্দর বিটিয়া। তোমার মেয়ে বুঝি?
মুমু লাজুক ভাবে আমার দিকে তাকাল।
আমি বললুম, আমাকে এত বুঢ়ঢ়া ভাবিস বুঝি? আমার এত বড় মেয়ে থাকবে কী করে? এ তো বড়বাবুর মেয়ে।
বাসন্তীকে নিয়ে আমরা ঢুকলুম ফুলমণির বাড়ির আঙিনায়।
কোনো সাঁওতালের বাড়িই আমি অপরিচ্ছন্ন দেখিনি। যত গরিবই হোক, ওরা ঘর-দোর-উঠোন ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। মাটির বাড়ির দেয়ালেও একটা ময়লা দাগ থাকে না।
এ বাড়ির উঠোনে একটা খাটিয়ার ওপর বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথার চুল ধপধপে সাদা, চোখে একটা নিকেলের ফ্রেমের চশমা, তার কাচ এত মোটা যে বৃদ্ধটি প্রায় চোখে দেখতে পায়ই না বলা যেতে পারে। বৃদ্ধটির হাতে একটা হুঁকো।
আমাদের পায়ের শব্দ পেতেই বৃদ্ধটি মুখ ফিরিয়ে বললেন, কউন?
আমি বললুম, নমস্কার।
বৃদ্ধটি এবার চোখ কুঁচকে আমাদের দেখার চেষ্টা করে পরিষ্কার বললেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
আমি বললুম, ছোটপাহাড়ী থেকে। এ বাড়ির ফুলমণি সেখানে কাজ করে। অনেকদিন যাচ্ছে না—
বাসন্তী বৃদ্ধের কাছে গিয়ে নিজেদের ভাষায় কী সব বোঝাল।
বৃদ্ধ দুবার মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, হাঁ? বসুন, বসুন, এই বসবার জায়গা দে।
বাসন্তী একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে দুটো মাছিয়া নিয়ে এল। সে দুটোতে আমি আর মুমু বসলুম একটা আতা গাছের নীচে।
বাড়ির পেছন দিক থেকে এবার এল ফুলমণি, তার দু’হাতে মাটি লাগা। আমাদের দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বললুম, কী, ফুলমণি, তুমি আর কাজে যাও না কেন?
ফুলমণি মৃদু গলায় বলল, যাব!
যাক, মেয়েটা তা হলে সত্যিই বোবা নয়। এই প্রথম ও আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলল। ওর গলার আওয়াজটা খসখসে ধরনের, ইংরিজিতে যাকে বলে হাস্কি ভয়েস।
বৃদ্ধ বললেন, ঘরের ছাদটা ফুটো হয়ে গেছে। সেই ছাদটা সারাচ্ছে ক’দিন ধরে। আমি তো কোনো কাজ করতে পারি না—
তারপর ব্যস্ত হয়ে বাসন্তীকে বললেন, আরে বাবুদের জন্য চা নিয়ে আয়। আমি বললুম, না না, আমরা চা খাব না। আমরা এদিকে বেড়াতে এসেছিলুম, এক্ষুনি চলে যাবে।
—তা হলে লাড্ডু খান।
মুমু বলল, আমি এক গেলাস জল খাব।
ফুলমণি জল আনতে ভেতরে চলে গেল।
বাড়িটার মাটির দেয়ালে নানা রকম ছবি আঁকা। রঙিন ছবি। কিন্তু এ ছবিগুলো এমন কিছু দর্শনীয় নয়। বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতা, বজরংবলী। গোদা গোদা ধরনের। একেবারে অপটু হাতের কাজ নয়, তবে ফুলমণির আঁকা যে ছবি দুটো আগে দেখেছি, তার সঙ্গে মেলে না।
আমি বৃদ্ধকে বললুম, ফুলমণি তো ভালো ছবি আঁকে। কোথায় শিখল?
বাসন্তী বলল, এগুলো ফুলমণির শ্বশুর এঁকেছে গো!
বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, আমি ছবি আঁকতাম। আগে মেলায় মেলায় নিয়ে গিয়ে অনেক ছবি বিক্রি করেছি। এখন চক্ষে দেখি না। ভগবান চোখের রোশনি কমিয়ে দিয়েছে!
যাক। তা হলে একটা পটভূমি আছে। ফুলমণি একেবারে আকাশ থেকে পড়ে ছবি আঁকতে বসেনি। বাড়িতে একটা ছবির কালচার আছে। শ্বশুরের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছে, কিছু শিখেছে। ওর ভেতরে ছবি আঁকার বীজ ছিল, সেটা জল-মাটি পেয়েছে। অনেক সময় শিষ্য ছাড়িয়ে যায় গুরুকে। তাই দেয়ালের এই গোদা গোদা ছবির চেয়ে ফুলমণির ছবির অনেক তফাৎ!
বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ওর মরদ কোথায়?
বাসন্তী ডান হাতটা দু’বার ঘোরাল। অর্থাৎ নেই। কিন্তু বিয়ে হয়নি, না মরদ ওকে পরিত্যাগ করেছে, না মরে গেছে, তা ঐ একটা ইঙ্গিত থেকে বুঝব কী করে? তবে শ্বশুর যখন আছে তখন বিয়ে হয়েছিল নিশ্চয়ই।
ফুলমণি দুটো কাঁসার গেলাশ, এক ঘটি জল ও একটা কলাই করা প্লেটে কয়েকটা তিলের নাড়ু নিয়ে এল। এরাও অতিথিকে শুধু জল দেয় না।
মুমু আমার দিকে বিপন্ন ভাবে তাকাল। অর্থাৎ সে নাড়ু খাবে না। লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে তিলের নাড়ু খাবে, তিলের নাড়ুদের অত সৌভাগ্য আজও হয়নি! আমিই একটা মুখে দিলুম। না, খেতে সত্যিই ভালো নয়। একবার একটা বাড়িতে তিলের নাড়ু গোপনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে আমায় খুব জব্দ হতে হয়েছিল। এখানে এসব চলবে না।
জলটা খুব ঠাণ্ডা আর সুস্বাদু।
বৃদ্ধ বললেন, আমার আঁকা আরও ছবি দেখবেন? এই, ভিতর থেকে নিয়ে আয় না। আমি কলকাতাতেও গেছি বাবু। যামিনীবাবু ছিলেন না একজনা, যামিনীবাবু খুব বড় আর্টিস, তিনি আমার ছবি দেখেছিলেন। বাঁকুড়ায় তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন।
ফুলমণি ভেতর থেকে অনেকগুলো বড় বড় কাগজ নিয়ে এল। তাতে রঙিন ছবি আঁকা। তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। একটু মলিন হয়ে গেছে ছবিগুলো।
আমরা মাছিয়া-দুটো এগিয়ে নিয়ে গেলুম বৃদ্ধের খাটিয়ার কাছে।
বৃদ্ধা চশমা খুলে ঝুঁকে পড়ে বলল, এটা কোন্ ছবি রে?
বাসন্তী বলল, রাম-লছমন আর সীতাজী!
বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, এটা ভালো। হনুমানজী সমুদ্র পার হচ্ছে, সেটা দেখা? ডিসেম্বর মাসে এসপ্লানেড অঞ্চলে প্রচুর নতুন ক্যালেন্ডার দেখা যায়, তাতে এই ধরনের ছবি থাকে। কয়েকটা দেখার পরই একঘেয়ে লাগল। কিন্তু ভদ্রতা রক্ষার জন্য সবগুলো দেখতেই হবে। বৃদ্ধ দেখাচ্ছেনও খুব উৎসাহের সঙ্গে।
আমি একবার মুখ তুলে বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণির এ রকম কাগজে আঁকা ছবি নেই?
বাসন্তী ফুলমণিকে বলল, নিয়ে আয় না! আছে তো! ফুলমণি প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল।
বাসন্তী বলল, আমি আনছি।
ফুলমণি তার হাত চেপে ধরল। বাসন্তী তবু জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল ভেতরে। নিয়ে এল পাঁচখানা ছবি।
প্রথম ছবিটাই সাঙ্ঘাতিক। অনেকখানি ফাঁকা মাঠ, তার মাঝখানে একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মাথার ওপর আকাশ। মেয়েটা ছাড়া আর কিছুই নেই বলে মাঠের মধ্যে মেয়েটার একাকিত্ব খুব দারুণ ভাবে ফুটেছে। আকাশের রং লাল, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো লাল, আর মেয়েটার রং মেরুন। রঙের এমন সাহসী ব্যবহার কদাচ দেখা যায় না। ফুলমণি কি গগ্যার ছবি দেখেছে নাকি।
বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন্টা? এটা কোটা?
বাসন্তী বলল, সেই যে একটা ছোট মেয়ে গো। আমরা বলি, বড়কা মাঝির হারিয়ে যাওয়া মেয়ে
বৃদ্ধ বললেন, হাঁ। আমার বহু তার ছবি ফিনিশ করে না। অর্ধেক এঁকে রেখে দেয়। এই ছবিতে চার পাঁচখানা গাছ আঁকা উচিত ছিল কিনা বলুন। বৃষ্টিতে গাছের পাতা খসে পড়ছে, দু-একটা ছাগল-গরু থাকতে পারে, মেয়েটা মাঠে চরাতে নিয়ে গেছে।
আমার কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের একটা অংশ মনে পড়ল।
রাজা দুষ্মন্ত ছবি আঁকতে পরতেন। গর্ভবর্তী শকুন্তলাকে তিনি অন্যায় ভাবে তাড়িয়ে দিয়েছেন রাজসভা থেকে। তারপর ছ’বছর কেটে গেছে, হঠাৎ এক জেলের কাছ থেকে আংটিটা ফেরত পেয়ে রাজার সব মনে পড়ে। তখন রাজা দুষ্মন্ত বিরহে হা-হুতাশ করছেন আর শকুন্তলার ছবি এঁকে সেই ছবির সঙ্গে কথা বলছেন। রাজার বিদূষক মাধব্য রাজাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন। মাধব্য দেখলেন রাজার আঁকা ছবিটি। দুই সখীর মাঝখানে, আমগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে শকুন্তলা। ছবিটার খুব প্রশংসা করতে লাগলেন মাধব্য। তাই শুনে রাজা বললেন, ছবিটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। পেছনে আঁকা হয়নি মালিনী-নদী, দূরে একটা পাহাড়ও থাকা দরকার। ওখানে হরিণের পাল ঘুরে বেড়ায়, একটা বড় গাছের ডালে ঋষিদের পরিধেয় বল্কল ঝোলে, একটা কৃষ্ণ মৃগ আর বাচ্চা হরিণ ওখানে খেলা করে এই সবও ছবিটার মধ্যে দিতে হবে।
মাধব্য তখন মনে মনে বললেন, সর্বনাশ। এর পর লম্বা দাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ো ঋষিদের ভরিয়ে দিয়ে ইনি ছবিটা একেবারে নষ্ট করে ফেলবেন দেখছি। মাধব্যের এই মন্তব্যেই বোঝা যায়, কালিদাস অতি উচ্চাঙ্গের আর্ট ক্রিটিক ছিলেন।
ফুলমণির এই ছবিটায় আর একটা দাগ টানলেই ছবিটি নষ্ট হয়ে যেত। ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাঠের মধ্যে একলা হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির কান্নাও যেন শোনা যায়।
চন্দনদা ঠিকই ধরেছিলেন। ফুলমণি সত্যিকারের শিল্পী। ছাই চাপা আগুন। প্রত্যেকটা ছবিই ভালো, কল্পনা ও রঙের খেলায় অভিনব। পুরোপুরি বাস্তব বা ফটোগ্রাফিক করেও সে আঁকে না, ছবির বিষয়টা প্রধান হয় না, গল্প বলার চেষ্টা নেই। রেখা, রং ও আয়তন মিলে কিছুটা রহস্যময়তা এসে যায়। এ রকম ছবি বোঝার সাধ্য ওর শ্বশুরের নেই। অশিক্ষিত, গ্রাম্য পরিবারের এই বধূটির ক্ষমতা খানিকটা যেন অলৌকিকের পর্যায়ে পড়ে।
আমি ফুলমণির দিকে তাকালুম।
শীর্ণ চেহারার এই অসুন্দর মেয়েটির মুখে এখন এমন একটা তীব্রতা ঝলমল করছে, যাতে একটা আলাদা রূপ ফুটে উঠেছে। অন্যদের থেকে এ মেয়েটি একেবারেই আলাদা।
মুমু ফিসফিস করে বলল, নীলকাকা, এই ছবিগুলো একদিনের জন্য নিয়ে যেতে দেবে? বাবাকে দেখাতুম।
মুমু আমার ঠিক মনের কথাই বলল! আমি বৃদ্ধের উদ্দেশে জোরে বললুম ছবিগুলো আমি নিয়ে যেতে পারি? পরে ফেরত দেব!
বৃদ্ধ বললেন, আগে একজন বাবু এসেছিল। দু’বছর আগে। ক’খানা ছবি নিল। বলল, আবার আসবে। আর এল না।
ও তাহলে ফুলমণির প্রতিভার আমরাই প্রথম আবিষ্কারক নই? আগেও কেউ দেখেছে। এবং সেই আগের কারণটি এদের কাছে অবিশ্বাসের কারণ ঘটিয়েছে। এই সব আগের লোকদের নিয়ে মহা জ্বালা হয়, আগের লোকদের জন্য পরের লোকদের ভুগতে হয়।
বললুম, আমি তো ছোটপাহাড়ীতেই থাকি। ফুলমণি কাজ করতে যাবে, ওকে দিয়ে দেব।
বৃদ্ধ নিজের ছবিগুলো আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, নিয়ে যান। কেউ যদি বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনতে চায় বেচে দেবেন! যা দাম পাওয়া যায়। একশোটা টাকা পেলে একটা বকরি কিনব। বকরির দুধ খেলে আমার তাগৎ হয়।
দু’জনের আঁকা ছবিই গুছিয়ে নিয়ে একটু বাদে আমরা উঠে দাঁড়ালুম।
ফেরার পথে মুমু বলল, এই মেয়েটার যখন খুব মনখারাপ থাকে, তখন ও ছবি আঁকে, তাই না?
আমি চমকে গেলুম। মুমুর কাছ থেকে আমি ওরকম কথা আশা করিনি। মুমু তো ছবির-টবির ধার ধারে না। ফুলমণিদের বাড়িতে ঢোকবার মুখে ও একবার বলেছিল, বড্ড গোবরের গন্ধ! এতক্ষণ ওকে বসিয়ে রেখে শাস্তিই দেওয়া হয়েছে।
আমি বললুম, তাই নাকি। কী করে তুই বুঝলি?
মুমু বলল, আমার মনে হলো।
হয়তো মুমু ঠিকই বুঝেছে। এই মনে হওয়াগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না।