ফুলজানি

ফুলজানি । শ্রীশ্রীশচন্দ্র মজুমদার-প্রণীত

শহরে বিচিত্র জটিল ঘটনা, লোকজনের গতিবিধি, গাড়িঘোড়া-কলকারখানায় সমস্ত মানুষ ছোটো হইয়া যায়; শহরে কে বাঁচিল কে মরিল, কে খাইল কে না খাইল তাহার খবর কেহ রাখে না। সেখানে বড়োলাট-ছোটোলাটের কীর্তি, চীনে জাপানে লড়াই, অথবা একটা অসামান্য ঘটনা নহিলে সর্বসাধারণের কানেই উঠিতে পারে না।

কিন্তু পল্লীগ্রামে ছোটোবড়ো সকল মানুষ এবং মনুষ্যজীবনের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠে; এমন-কি, নদীনালা পুষ্করিণী মাঠঘাট পশুপক্ষী রৌদ্রবৃষ্টি সকালবিকাল সমস্তই বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেখানকার লোকালয়ে সুখ-দুঃখের সামান্যতম লহরীলীলা পর্যন্ত গণনার বিষয় হয়, এবং প্রকৃতির মুখশ্রীর সমস্ত ছায়ালোকসম্পাত একটি ক্ষুদ্র দিগন্তসীমার মধ্যে মহৎ প্রাধান্য লাভ করে।

উপন্যাসের মধ্যেও সেইরূপ শহর-পল্লীগ্রামের প্রভেদ আছে। কোনো উপন্যাসে অসাধারণ মানবপ্রকৃতি, জটিল ঘটনাবলী এবং প্রচণ্ড হৃদয়বৃত্তির সংঘর্ষ বর্ণিত হইয়া থাকে– সেখানে সাধারণ মনুষ্যের প্রাত্যহিক সুখদুঃখ অণু আকারে দৃষ্টির অতীত হইয়া যায়; আবার কোনো উপন্যাস উন্মত্ত ঘটনাবর্তের কোলাহল হইতে, উত্তুঙ্গ কীর্তিস্তম্ভমালার দিগন্তপ্রসারিত ছায়া হইতে, ঘনজনতাবন্যার সর্বগ্রাসী প্রলয়বেগ হইতে বহুদূরে ধুলিশূন্য নির্মল নীলাকাশতলে, শস্যপূর্ণ শ্যামল প্রান্তরপ্রান্তে ছায়াময় বিহঙ্গকূজিত নিভৃত গ্রামের মধ্যে আপন রঙ্গভূমি স্থাপন করে, যেখানে মানবসাধারণের সকল কথাই কানে আসিয়া প্রবেশ করে এবং সকল সুখদুঃখই মমতা আকর্ষণ করিয়া আনে।

শ্রীশবাবুর “ফুলজানি’ এই শেষোক্ত শ্রেণীর উপন্যাস। ইহার স্বচ্ছতা, সরলতা, ইহার ঘটনার বিরলতাই ইহার প্রধান সৌন্দর্য। এবং পল্লীর বাগানের উপর প্রভাতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ যেমন করিয়া পড়ে; কোথাও-বা চিকন পাতার উপরে ঝিক্‌ঝিক্‌ করিয়া উঠে, কোথাও-বা পাতার ছিদ্র বাহিয়া অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে চুম্‌কি বসাইয়া দেয়, কোথাও-বা জীর্ণ গোয়ালঘরের প্রাঙ্গণের মধ্যে পড়িয়া মলিনতাকে ভূষিত করিতে চেষ্টা করে, কোথাও-বা ঘনছায়াবেষ্টিত দীর্ঘিকাজলের একটিমাত্র প্রান্তে নিকষের উপর সোনার রেখা কষিয়া দেয়– তেমনি এই উপন্যাসের ইতস্তত যেখানে একটু অবকাশ পাইয়াছে সেইখানেই লেখকের একটি নির্মল স্নিগ্ধহাস্য সকৌতুকে প্রবেশ করিয়া সমস্ত লোকালয়দৃশ্যটিকে উজ্জ্বলতায় অঙ্কিত করিয়াছে।

শ্রীশবাবু আমাদিগকে বাংলাদেশের যে-একটি পল্লীতে লইয়া গিয়াছেন সেখানে আমরা সকলের খবর রাখিতে চাই, সকল লোকের সহিত আলাপ করিতে চাই, বিশ্রদ্ধভাবে সকল স্থানে প্রবেশ করিতে চাই, তদপেক্ষা গুরুতর কিছুই প্রত্যাশা করি না। আমরা অভ্রভেদী এমন একটা-কিছু ব্যাপার চাহি না যাহাতে আর-সকলকেই তুচ্ছ করিয়া দেয়, যাহাতে একটি বিস্তীর্ণ শান্তিময় শ্যামল সমগ্রতাকে বিদীর্ণ ও খর্ব করিয়া ফেলে। এখানে সুশুনির মা এবং নিস্তারিণী, ফনুশেখ এবং নায়েবমহাশয় সকলেই আমাদের প্রতিবেশী– পরস্পরের মধ্যে ছোটোবড়ো ভেদ যতই থাক্‌, তথাপি সকলেরই ঘরের কথা আমাদের জিজ্ঞাস্য, প্রতিদিনের সংবাদ আমাদের আলোচ্য বিষয়। এরূপ উপন্যাস সুপরিচিত স্থানের ন্যায় আমাদের মনের পক্ষে অত্যন্ত বিরামদায়ক; এখানে অপ্রত্যাশিত কিছু নাই, মনকে কিছুতে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয় না, প্রত্যেক পদক্ষেপে এক-একটা দুরূহ সমস্যা জাগ্রত হইয়া উঠে না, সৌন্দর্যরস এত সহজে সম্ভোগ করা যায় যে, তাহার জন্য কোনোরূপ কৃত্রিম মালমসলার আবশ্যক করে না।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রন্থকার নিজের প্রতিভায় নিজে সন্তুষ্ট নহেন; তিনি আপনাকে আপনি অতিক্রম করিতে চেষ্টা করেন। অরসিকদের চক্ষে যাহা সহজ তাহা তুচ্ছ; গ্রন্থকার ক্ষমতাশীল লেখক হইয়াও সেই অরসিকমণ্ডলীর নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভনটুকু কাটাইতে পারেন নাই। তিনি হঠাৎ এক সময় আপন প্রতিভার স্বাভাবিক গতিকে বলপূর্বক প্রতিহত করিয়া তাহাকে অসাধারণ চরিত্র ও রোমহর্ষণ ঘটনাবলীর মধ্যে অসহায়ভাবে নিক্ষেপ করিয়াছেন। পরিচিত সহজ সৌন্দর্যের সহিত সুন্দরভারে সহজে পরিচয় সাধন করাইয়া দেওয়া অসামান্য ক্ষমতার কাজ; বাংলার লেখকসম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীশবাবুর সেই অসামান্য ক্ষমতাটি আছে, কিন্তু তিনি তদপেক্ষা আরো অধিক ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া পাঠককে চমৎকৃত করিতে চাহেন এবং সেই কাজ করিতে গিয়া নিজের প্রতিভার মধ্যে অনর্থক একটা আত্মবিরোধ বাধাইয়া বসেন। প্রতিভাবর্হিগামী এই দুরাশায় তাঁহার প্রথম-চরিত উপন্যাস “শক্তিকাননে’র মাঝখানে দাবানল জ্বালাইয়া ছারখার করিয়া দিয়াছে এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ “ফুলজানি’-রও একটি প্রান্তভাগে তাহার একটি শিখা আপন প্রলয়রসনা বিস্তার করিয়াছে– সৌভাগ্যক্রমে সম্পূর্ণ গ্রাস করিতে পারে নাই।

সার্বভৌম-মহাশয়ের মেয়েটির নাম কালী, তাহার স্বভাবটি যেমন মিষ্ট তেমনি দুষ্ট, তেমনি স্বাভাবিক; গ্রন্থের নায়িকা ফুলকুমারীর প্রতি তাহার যে সুদৃঢ় ভালোবাসা সেও বড়ো স্বাভাবিক; কারণ, ফুল নিতান্ত নিরুপায় ভীরুস্বভাব — এত অধিক নির্জীব যে, পাঠকের হৃদয়াকর্ষণে সে সম্পূর্ণ সক্ষম নহে; কিন্তু এইরূপ নির্ভরপরায়ণ সামর্থ্যহীনেরর জন্যই বলিষ্ঠ তেজস্বী স্বভাব আপনাকে একান্ত বিসর্জন করিয়া থাকে। ফুলকুমারী যদিও গ্রন্থের নায়িকা, কিন্তু তাহাকে একটি শূন্যপটের মতো অবলম্বন করিয়া তাহার উপরে গ্রন্থকার কালীকেই অঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছেন। এই সামান্য পল্লীর কালো মেয়েটি অসাধারণ হয় নাই, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে কখন যে স্থায়িত্ব লাভ করিয়াছে তাহা জানিতেও পারা যায় না। বোসেদের ফুলবাগানের মধ্যে, তালপুকুরের ধারে এই দুটি ক্ষুদ্র বালিকার সখিত্ব আমরা সস্নেহে আনন্দে নিরীক্ষণ করিতেছিলাম; তাহার মধ্যে পাঠশালার ছেলেদের দৌরাত্ম্য-কোলাহল, বালকবিদ্বেষী উত্যক্ত বাগ্‌দিবুড়ির অভিশাপমন্ত্র, মধ্যাহ্নে পক্ষীনীড়লুন্ঠক ছাত্রবৃন্দকর্তৃক আন্দোলিত ঘন আম্রবনের ছায়া এবং নিভৃত দীর্ঘিকার সন্তরণাকুল অগাধশীতল জলের তরঙ্গভঙ্গ মিশ্রিত হইয়া একটি মনোহর সৌন্দর্য সৃষ্টি করিয়াছিল। আমরা পাঠকবর্গ ইহাতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলাম, ইহার অধিক আর কিছুই প্রার্থনা করি নাই, এমন সময় হরিশপুর পল্লীর সেই স্নিগ্ধ আম্রবনচ্ছায়ার মধ্যে একটুখানি অলৌকিকের ছায়া আসিয়া পড়িল। ফুল স্বপ্নে দেখিল যে, তাহার আসন্ন বিবাহ শুভ হইবে না, এবং বাগ্‌দিবুড়ির মুখেও যেন সেই অভিশাপ শুনিতে পাইল, এবং বটবৃক্ষের শাখা হইতেও সেই অভিশাপ ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখনই বুঝিলাম, ফুলকুমারীর বিবাহও সুখের হইবে না, এবং পাঠকের কাব্যরস-সম্ভোগের আনন্দেও অভিশাপ লাগিয়াছে। কিছুকাল পরে ফুলকুমারীও তাহার দুঃস্বপ্ন ভুলিয়া গেল, পাঠকও পুনশ্চ ক্ষুদ্র পল্লীর লোকসমাজে প্রবেশ করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে তাঁহার একটা ফাঁড়া আছে।

সেখানে প্রবেশ করিয়া নায়েব মহেশ্বর ঘোষের সহিত সাক্ষাৎ হইল। শান্তিসৌন্দর্যময় পল্লীটির মধ্যে ইনিই রুদ্ররসের অবতারণা করিয়াছেন। রৌদ্রীশক্তিতে গৃহিণী জগদ্ধাত্রী আবার স্বামীকেও অভিভূত করিয়াছেন। দেখিয়া মনে হয় যে, প্রজাবর্গ অসহায় হস্তীর ন্যায় পড়িয়া আছে; নায়েব সিংহের ন্যায় তাহাদের স্কন্ধের উপর চড়িয়া রুধির শোষণ করিতেছেন এবং গৃহিণী জগদ্ধাত্রী, দেবী জগদ্ধাত্রীর ন্যায় এই প্রচণ্ড সিংহের স্কন্ধে পা রাখিয়া বসিয়া আছেন।

ছেলেটির নাম পুরন্দর। যদিচ তিনিই এই গ্রন্থের নায়ক, তথাপি সাধারণ ছেলের মতো পাঠশালা হইতে পলায়ন করিয়া থাকেন, বটগাছে চড়িয়া কাকের ছানা পাড়িয়া আমোদ অনুভব করেন, গাছের ডাল হইতে ঝুপ করিয়া দিঘির জলের মধ্যে পড়িয়া ফুৎকারে আকাশে জলক্ষেপ করিতে করিতে চিতসাঁতার কাটেন– দেখিয়া আমাদের বড়ো আশা হইয়াছিল পাঠকের কপালগুণে ছেলেটি আর যাহাই হউক অসাধারণ হইবে না। কিন্তু “আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায় তাই ভাবি মনে’। কিন্তু সে কথা পরে হইবে।

শান্ত মধুর অথচ দৃঢ়স্বভাব নিস্তারিণীর চরিত্র সুন্দর অঙ্কিত হইয়াছে। এই নিস্তারিণীর কন্যা ফুলকুমারীর সহিত যথাকালে নায়েবমহাশয়ের পুত্র পুরন্দরের বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল। কিন্তু নায়েবমহাশয় এবং তাঁহার স্ত্রী জগদ্ধাত্রী তাঁহাদের বেহাইনের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। বিবাহের পর উভয় বৈবাহিক পক্ষে ছোটোখাটো পল্লীযুদ্ধ চলিতে লাগিল। নায়েবমহাশয় পুত্র পুরন্দরকে তাঁহার বেহাইনের প্রভাব হইতে দূরে রাখিবার জন্য সঙ্গে করিয়া আপন কর্মস্থানে লইয়া গেলেন।

এইখানে আসিয়া মৌলভির নিকট হাফেজ পড়িয়া এবং পণ্ডিতের নিকট শাস্ত্রাধ্যয়ন করিয়া পুরন্দর একটা নূতনতর মানুষ হইয়া উঠিল। মানুষের পরিবর্তন কিছুই অসম্ভব নহে এবং পুরন্দরের স্বভাবে পরিবর্তনের প্রচুর কারণও ছিল। কিন্তু আমরা যে গ্রামদৃশ্য, যে সরল লোকসমাজ, যে অনতিতরঙ্গিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এতক্ষণ কালযাপন করিতেছিলাম নূতনীকৃত পুরন্দর তাহাকে যেন অত্যন্ত অতিক্রম করিবার উপক্রম করিল। পুরন্দর ভালো ছেলে হউক, সে ভালো; তাহার দানধ্যানে মতি হউক, হরিনামে প্রীতি হউক, শাস্ত্রে বুৎপত্তি এবং হাফেজে অনুরাগ বাড়িতে থাক্‌, আমাদের দেশে সচরাচর যেরূপ ভাবে অনেক লোকের মনে সংসার-বৈরাগ্যের উদয় হইয়া থাকে, পুরন্দরের হৃদয়েও সেইরূপ বৈরাগ্যের সঞ্চার হউক তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু তাহার বেশি কিছু হইতে গেলে তাহাকে আর সহ্য করা যায় না। কারণ, “ফুলজানি’ উপন্যাসকে সম্পূর্ণতা দেওয়াই পুরন্দরচরিত্রের একমাত্র সার্থকতা। অসাধারণ মহত্ত্ব প্রকাশ করিতে গিয়া যদি তিনি উপন্যাস নষ্ট করেন তবে আমরা তাহাকে মার্জনা করিতে পারিব না। প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভ হইতে “ফুলজানি’তে যে-এক স্বচ্ছ সুন্দর সারল্য-স্রোত প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল পুরন্দর হঠাৎ অসাধারণ উচ্চ হইয়া উঠিয়া তাহাকেই প্রতিহত করিয়া দিয়াছে। গ্রন্থকর্তা পুরন্দর সম্বন্ধে লিখিতেছেন–

“বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে যে পরিবর্তন ঘটিতেছিল তাহার গতি এবং প্রকৃতি বিষাদের দিকে। মানুষ সংসারে, যে কারণেই হউক, দুঃখকষ্ট সহিতে আসিয়াছে, এই রকম তাহার মনের ভাব। আত্মজীবনের একটা লক্ষ্য তাহার কখনো স্থির হয় নাই কিন্তু আপনার বিষয়ে ভাবিতে বসিলেই তাহার মনে হইত, অতিঘোর আঁধারে তাহার ভবিষ্যৎ সমাচ্ছন্ন। মনের এই অবস্থায় আনন্দের ভিতরেও সে মনশ্চক্ষে দেখিত, যে কেহ তাহার সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট সকলেরই জীবন অল্পবিস্তর দুঃখযন্ত্রণাময়।’

পুরন্দরের এই অনাসৃষ্টি দুঃখভাবের গূঢ় কারণ অনতিপরেই একটি ঘটনায় প্রকাশ পাইয়াছে। একদা তিনি এবং তাঁহার বন্ধু ব্রজ বেড়াইতে গিয়া দেখিলেন গঙ্গাতীরে এক শালিকের কোটরের নিকট এক বিষধর সাপের সহিত শুকদম্পতির যুদ্ধ চলিতেছে। সেই পক্ষীদের নিরীহ শাবকগুলি এখনই সর্পের কবলস্থ হইবে মনে করিয়া পুরন্দরের চক্ষে এক ফোঁটা জল আসিল। তাহার সঙ্গী ব্রজ অসাধারণ বালক নহে, এইজন্য সে এক ফোঁটা জল না ফেলিয়া একখণ্ড লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিল। তাহাতে অধিক কাজ হইল, আহত সর্পটা জলে পড়িয়া গেল। ব্রজ পুনশ্চ তাহার প্রতি লোষ্ট্রবর্ষণ করাতে পুরন্দর তাহা সহিতে পারিল না, বারণ করিল। —

“সে ভাবিতেছিল খাদ্য-খাদকের অহি নকুলের যে বিষম বিদ্বেষ ভাব, ইহার জন্য কে দায়ী? ভগবানের সংসার প্রেমময় না হইয়া কেন এমন হিংসাদ্বেষসংকুল হইল?

ইত্যাদি ইত্যাদি। এই-সকল বক্তৃতা শুনিয়া —

“ব্রজ সহসা কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার প্রিয় সুহৃদের হৃদয়ে ব্যথা কোন্‌খানে, বুঝিতে পারিল। বুঝিল, পুরনের দুঃখ ব্যক্তিগত নহে।’

টার্পিন তেল মালিশ করিলে যে-সকল ব্যথা সারে, অভাব মোচন হইলে যে-সকল দুঃখ দূর হয়, উপস্থিতক্ষেত্রে সেই-সকল ব্যথা এবং সেই-সকল দুঃখই ভালো। প্রচলিত প্রবাদে গরিবের ছেলের ঘোড়ারোগকে যেরূপ অনর্থের হেতু বলিয়াছে, বাংলাদেশীয় পল্লীর ছেলের এ-সকল বড়ো বড়ো ব্যথা এবং উঁচুদরের দুঃখও সেইরূপ সর্বনাশের কারণ।

পুরন্দরের পিতা পুরন্দরকে লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় পথিমধ্যে অসন্তুষ্ট প্রজাগণ কর্তৃক নিহত হইলেন, তাঁহার স্ত্রী জগদ্ধাত্রী সহমৃতা হইলেন। পুরন্দর এই আঘাতে পীড়িত হইয়া বাড়ি গেলেন, সেখানে তাহার স্ত্রীর শুশ্রূষায় জীবন লাভ করিলেন, এবং তাঁহাদিগকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া বিধবা নিস্তারিণী শ্রীক্ষেত্রে চলিয়া গেলেন।

এইখানে গ্রন্থ শেষ হইল, কিন্তু গ্রন্থকার ক্ষান্ত হইলেন না, তিনি আবার শেষকে নিঃশেষ করিতে বসিলেন। অকস্মাৎ একদল যবন এবং যবনী মিলিয়া কালী এবং ফুলকে চুরি করিয়া লইয়া গেল– কালী জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মরিল– ফুল সিরাজউদ্দৌলার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল, পুরন্দর তাহাকে উদ্ধার করিতে গেল এবং উভয়ে ঘাতকহস্তে বিনষ্ট হইল।

এ-সমস্ত কেন? আগাগোড়া গল্পের সহিত ইহার কী যোগ? প্রথম হইতে এমন কী সকল অনিবার্য কারণ একত্র হইয়াছিল যাহাতে গ্রন্থের এই বিচিত্র পরিণাম অবশ্যম্ভব হইয়া উঠিয়াছিল? গ্রন্থকার যদি বলিতেন “গ্রামে হঠাৎ একটা মড়ক হইল এবং সকলেই মরিয়া গেল’ তবে কাব্য-হিসাবে তাহার সহিত ইহার প্রভেদ কী? ১৬৬ পাতায় বইখানি সমাপ্ত। ১২২ পাতায় নিস্তারিণী তীর্থে গেলেন। তাহার পর ৪৪টি পত্রে গ্রন্থকার হঠাৎ একটা সম্পূর্ণ নূতন কাণ্ড ঘটাইয়া পাঠকগণকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন। পূর্বে ইহার কোনো সূত্রপাত ছিল না, ফুলকুমারীর চরিত্রের সঙ্গেও ইহার কোনো যোগ ছিল না। এতক্ষণ গ্রন্থকার ১২২ পৃষ্ঠায় যে একটি সুন্দর সরল সমগ্র কাব্য গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসবশত শেষের ৪৪ পৃষ্ঠায় অতি সংক্ষেপে একটি আকস্মিক বজ্র নির্মাণ করিয়া তাহার মস্তকে নিক্ষেপ করিলেন ।

অগ্রহায়ণ ১৩০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *