ফুরসতনামা
কত বললাম যে ফুরসত কোথায় যে ফুরসতনামা লিখব? বাক্স-বিছানা সব বাঁধা হয়ে গেছে, আজ বাদে কাল বাইরে যাচ্ছি—কিন্তু ভবী ভুলবার নয়। ফুরসতনামা লিখতেই হবে যাওয়ার আগে লেখা দিয়ে যেতে হবে।
তখন বললাম যে লঘু ইয়ার্কির চুটিয়ে রসিকতা করার সময় নয় এটা। চারদিকে কেমন থমথম করছে। তা ছাড়া এই ঠান্ডায় বোতলের ঘিয়ের মতো মাথার ঘিলু কেমন জমে গেছে। আগে মাথায় জোরে ঝাঁকি দিলে ছলাত-ছলাত করে শব্দ বেরত, তারপর লিখতে বসলেই ফুরফুর করে ফুরসতনামার মতো তরল লেখা তরতরিয়ে বেরত। এখন তো ঘিলুই জমে গেছে।
এ ওজরও খাটল না। আপত্তি টিঁকল না। এবারের ফুরসতনামা আমাকে নাকি লিখতেই হবে।
ঠিক আছে তাই লিখছি। তবে অন্য একজনের কাঁধে বন্দুক রেখে।
হাতের কাছে একটি বিচিত্র পুরনো বই রয়েছে। বইটির নাম ‘মহর্ষি বলেছেন’ (দ্য মহর্ষি সেইজ)। বইটির লেখকের নাম আল বলিসকা। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে একটি পুষি বেড়ালকে। বইটির প্রকাশক কিন্তু ভুবনবিখ্যাত। নিউইয়র্কের পকেট বুক কোম্পানি। যাদের প্রতীক চিহ্ন হল ক্যাঙারু।
মহর্ষি বলেছেন মানে মহর্ষি রজনীশ বা এখনকার চন্দ্রস্বামীর মতো কোনও ব্যক্তির বচনসুধা বলে মনে হতে পারে, যে কোনও ধরনের গোলমেলে কথাই এদের মুখে বসিয়ে চালানো সম্ভব।
আল বলিসকা সেই কাজটিই করেছেন। যতরকম উলটোপালটা চমকপ্রদ কথা এক প্রকল্পিত স্বামীজির নামে চালিয়ে দিয়েছেন।
এবারের ফুরসতনামা ওই স্বামীজি তথা মহর্ষির বাছাই করা উক্তিসমূহের সংকলন। তবে এই সূত্রে একথা জানিয়ে রাখা ভাল যে এর মধ্যে অল্প কিছু বক্র উক্তি আমি আমার কোনও কোনও কবিতায় কখনও কখনও ব্যবহার করেছি। আমার কবিতার পাঠকদের তাই সেগুলো চেনা মনে হতে পারে।
যেমন ধরা যাক, আমার একটি কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি ছিল—
‘যে লোকটা বলেছিলো
আমার কোনও সমস্যা নেই
সেই লোকটা নিজেই একটা সমস্যা।’
অথবা, কেউ কেউ হয়তো স্মরণ করতে পারেন যে একদা আমি একটা কবিতায় লিখেছিলাম, সেটাও ওই সমস্যা সংক্রান্ত ব্যাপারই।
কোনও সমস্যাই এমন বড় হতে পারে না
কোনও সমস্যাই এমন জটিল হতে পারে
না
যে সমস্যার সামনে থেকে
পালিয়ে যাওয়া যাবে না।’
আর পদ্যচর্চা নয়। এই রচনার পাঠক-পাঠিকাদের সেটা সহ্য হবে না। সমস্যাও মাথায় থাক, এবার আমরা সরাসরি মহর্ষি প্রবচনে যাচ্ছি।
মহর্ষি বলেছেন, ‘তুমি যখন লোকেদের তোমার দুঃখ-কষ্টের কথা বলছ, জেনে রাখবে অর্ধেক লোক তোমার কথা শুনছে না, বাকি অর্ধেক তোমার দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে মনে আনন্দ পাচ্ছে।’
এ রকম, নির্মম সত্য কথা মহর্ষি আরও অনেক বলেছেন।
কিছু লোককে অনেক দিনের জন্যে এবং অনেক লোককে অল্পদিনের জন্যে বোকা বানানো যায় কিন্তু সব লোককে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো সম্ভব নয়। এ রকম একটা কথা স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন বলে আমরা জানি।
মহর্ষি বলেছেন এর চেয়েও বাস্তব কথা। কথাটি হল, ‘তুমি অবশ্যই সব লোককে সবসময় বোকা বানাতে পারবে না তার একটা কারণ হল এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তোমাকেই হয়তো বোকা বানাবে, বোকা বানানোর চেষ্টা করে যাবে।’
ধন্যবাদ মহর্ষি, আপনার এই মহামূল্যবান উপদেশটির জন্যে আপনাকে বহু ধন্যবাদ, সেই সঙ্গে আপনাকে আরও স্মরণ করছি এই দুটি আপ্তবাক্যের জন্যে।
এক, যদি একশো বছর বাঁচতে চাও তা হলে তোমাকে প্রথমে নিরানব্বুই বছর বাঁচতে আর তার পরে আর এক বছর খুব সাবধানে থাকতে হবে।
দুই, গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন তার রূপ ও গন্ধের কোনও তারতম্য হবে না। তবে যদি গোলাপের নাম ক্রিসেনথিমাম, বগেনভেলিয়া কিংবা রডোড্রেনডেন রাখা হয় তবে বানান করতে একটু অসুবিধা হবে বইকী।
মহর্ষি মহিলাদের বিষয়ে কিছু লাগসই উক্তি করেছেন। তার দু’-একটি যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
একজন সত্যবাদী মহিলা কখনওই মিথ্যা কথা বলেন না তিনটি বিষয় ছাড়া। এই তিনটি বিষয় হল তাঁর বয়েস, তাঁর ওজন এবং তাঁর স্বামীর মাইনে।
মহিলাদের বিষয়ে মহর্ষি একটি বিপজ্জনক পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঘণ্টার মতো মহিলাদেরও মাঝে মাঝে পেটাতে হয়।
রমণীরা বিভিন্ন বয়েসে বিভিন্ন মহাদেশের মতো। তেরো থেকে আঠারো, কুমারী পৃথিবী, রহস্যময়ী আফ্রিকা। আঠারো থেকে তিরিশ সে হল উষ্ণ, উত্তপ্ত এশিয়া। তিরিশের পরে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত সে আমেরিকা, উচ্ছল, উজ্জ্বল বর্ণময়ী। পঁয়তাল্লিশের পরে পঞ্চান্ন-ষাট অবধি ফুরিয়ে যাওয়া ইউরোপ, তবে দু’-একটি আকর্ষণ তখনও আছে। আর তার পরে অবশেষে সে হল অস্ট্রেলিয়া—তার কারণ কোথায় সে আছে, সেটা সবাই জানে, কিন্তু তা নিয়ে কারও কোনও কৌতূহল নেই।
টেলিভিশন সম্পর্কে মহর্ষি দু’ জায়গায় বলেছেন, দুটোই যথাযথ।
প্রথম বলেছেন যে দূরদর্শন হল পুরনো সিনেমার গোরস্থান। আর দ্বিতীয় কথা বলেছেন, মাথাধরা দেখতে কী রকম! টিভির বাক্স আবিষ্কার না হলে সেটা কোনওদিন জানাই যেত না।
তবে মহর্ষি একথা বলেছেন যে টিভি কখনওই খবরের কাগজের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে না। সেটা সম্ভব হবে না।
টিভি দিয়ে কখনও ঠোঙা বানানো যাবে না। ঘুড়ি বানানো যাবে না। বই-খাতায় মলাট দেওয়া যাবে না।
তবে টিভি দিয়ে উনুন ধরানো যাবে। খবরের কাগজের চেয়ে অনেক বেশি ভাল জ্বলবে টিভি। কিন্তু গরমের সময় লোডশেডিং হলে খবরের কাগজের মতো টিভি দিয়ে কখনও হাওয়া খাওয়া যাবে না।
অবশেষে এটিকেট।
এটিকেট কাকে বলে? মহর্ষি বলেছেন, এটিকেট হল কঠিন ব্যাপার, এটিকেট বোধ সবার থাকে না। মুখ না খুলে হাই তোলাই হল আসল এটিকেটের উদাহরণ।
পুনশ্চঃ টাকমাথা লোকদের সম্পর্কে মহর্ষির পরামর্শ, নিজেকে টাকওলা না ভেবে অন্যদের চুলওলা ভাবতে শিখুন।