ফুটোস্কোপ

ফুটোস্কোপ

(১)

ভোরের দিকে একটা আচমকা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল নির্মলের৷ পাশের ঘরে নির্মলের দশ বছরের ছেলে পার্থ ঘুমাচ্ছে৷ সে ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝেই এমন চাপা চিৎকার করে৷ আশ্চর্যের কিছু না৷ পাশেই তন্দ্রিমা শুয়ে৷ সে এখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে৷ পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল নির্মল, কী একটা মনে পড়তে থেমে গেল; একটু আগে যে আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙেছে সেটা আর্তনাদ নয়৷ একটা মিহি হাসির শব্দ৷ এত রাতে এমন খোনা গলায় কে চিৎকার করবে? পার্থর গলা এরকম নয়, তাহলে কি…

সাতপাঁচ ভেবে উঠে পড়ে নির্মল৷ ঘর থেকে বেরিয়েই একটা লম্বা প্যাসেজ৷ সেটা পেরোলেই দুটো পাশাপাশি ঘর৷ তার একটা পার্থর৷ এতদিন মা-বাবার কাছেই শুত সে৷ আগের বছর এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে৷

হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে সেদিকেই এগিয়ে যায় নির্মল৷ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ৷ অন্যদিন সাধারণত সেটা ভেজানো থাকে৷ একটু খটকা লাগে নির্মলের৷

দরজার দিকে কয়েক’পা এগোতেই ঘরের ভিতর থেকে একটা হিলহিলে গলা শুনতে পায়৷ মৃদু স্বরে ছড়া কেটে একটা পরিচিত কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে কেউ, একটা চাপা হিংসা আর শয়তানি খেলা করছে সে গলায়—

আয় তোর মুন্ডটা দেখি, আয় দেখি ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে

দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে৷

শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে যায় নির্মলের৷ এ গলা পার্থর হতেই পারে না৷ তবে কি বাইরে থেকে কেউ ঢুকেছে ওর ঘরে? ও বাইরে থেকেই হাঁক দেয়, ‘পার্থ, কী করছিস তুই ভিতরে? কে আছে তোর সঙ্গে?’

হালকা গোঙানির আওয়াজ আসছে কি? কবিতাটা এখনও শোনা যাচ্ছে আগের মতোই৷ যেন ভিতরের লোকটা শুনতেই পায়নি সে কথা৷

কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা ;

কতখানি ভস ভস ঘিলু, কতখানি ঠক ঠকে ফাঁপা৷

এবার জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে নির্মল, ‘দরজা খুলুন, নাহলে কিন্তু আমি…’

আয় দেখি বিশ্লেষ ক’রে- চোপ রও ভয় পাস কেন ?

গোঙানির শব্দ বেড়ে ওঠে৷ মুখবাঁধা অবস্থায় কেউ যেন চিৎকার করার চেষ্টা করছে৷ দরজায় সজোরে লাথি মারে নির্মল৷ কানের পাশ গরম হয়ে ওঠে ওর৷ বুকে কান্নার ঢেউ ধাক্কা মেরে যায়, ‘ছেড়ে দিন, আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন…’

কাত হ’য়ে কান ধ’রে দাঁড়া, জিভখানা উলটিয়ে দেখা,

ভালো ক’রে বুঝে শুনে দেখি—বিজ্ঞানে যে রকম লেখা ৷

গলাটা সংকেত দিয়ে যায়, ভিতরে খারাপ কিছু হতে চলেছে৷ কিংবা হয়ে গেছে৷ একটা ধাতব শব্দ শোনা যায় ঘরের ভিতর৷ গোঙানির আওয়াজ চরমে পৌছায়৷ কবিতার ফাঁকে ফাঁকে একটা হাসির আওয়াজ এসে মিশতে শুরু করেছে এতক্ষণে৷ শীতল, শয়তানি হাসি… শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘পার্থ…’

মুন্ডতে ‘ম্যাগনেট’ ফেলে, বাঁশ দিয়ে ‘রিফ্লেক্ট’ করে

ইট দিয়ে ‘ভেলসিটি’ ক’ষে, দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে৷

মড়মড় করে ঘাড় ভাঙার একটা শব্দ আসে ঘরের ভিতর থেকে৷ চিৎকারের আওয়াজ বেড়ে উঠেই আবার থেমে যায়…

(২)

‘বাবা, ও বাবা, শুনছ?’

মাঝরাতে রনির ঠেলাঠেলিতে ঘুম ভেঙে গেল স্বপ্নময়ের৷ ঘুম চোখেই কোনওরকম উঠে বসল৷ রনির মুখটা আতঙ্কে পাংশু হয়ে আছে৷ স্বপ্নময়ের মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে ওকে ক্রমাগত ঠ্যালা দিয়ে চলেছে সে৷

‘ওঠো না, ও বাবা, শুনছ?’

রাত আড়াইটার কাছাকাছি বাজে৷ টিকটিক করে আওয়াজ হয়ে চলেছে টেবিলের পাশে রাখা ঘড়িটায়৷ বাইরে কাচের জানলার পাশে ছাতিম গাছের দুলন্ত পাতার ছায়া এ ঘরের মেঝের উপরে এসে পড়েছে৷

স্বপ্নময় মুখের উপর দু-বার হাত বুলিয়ে নিয়ে একটু বিরক্ত গলাতেই বলল, ‘হ্যাঁ কী হল আবার? টয়েলেটে যাবি?’

বছরখানেক আগে নার্ভের রোগ ধরা পড়ে রনির৷ তখনও বকুলের সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়নি স্বপ্নময়ের৷ নার্ভের রোগ ওদের জিনে আছে, ফলে অতটা গুরুত্ব দেয়নি দু-জনে৷ কিন্তু মাসখানেক পরে একদিন স্কুলে দৌড়াতে গিয়ে আচমকাই পড়ে যায় রনি৷ স্কুল থেকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে তিনি কিছু সন্দেহ করে কয়েকটা টেস্ট করতে দেন৷ ডিজিটি করে দেখা যায় রনির রোগটার নাম জেনেটিক পারকিনসন৷ জটিল নার্ভের রোগ৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা একটা করে রোগীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খেয়ে ফেলে৷ রনির পা দুটো তারপর থেকেই ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে৷ আপাতত হুইলচেয়ারে করে এদিক ওদিক যেতে পারে, কিন্তু রাতে হুট করে হিসি পেয়ে গেলে বাবাই ভরসা৷

‘না যাব না…’

‘তাহলে?’

‘আমার খুব ভয় করছে বাবা…’

স্বপ্নময়ের বিরক্ত ভাবটা আরও বেড়ে ওঠে, ‘তোকে এত রাতে জেগে থাকতেই বা কে বলেছে?’

‘ঘুমিয়েই তো ছিলাম৷ ঘুম ভেঙে গেল তো…’

‘কী করে ভেঙে গেল?’

‘ওই যে দরজার দিক থেকে আওয়াজ হল একটা…’

‘কই আমার তো ঘুম ভাঙেনি…’

রনির গলায় এবার আকুতি ঝরে পড়ে, ‘আমি সত্যি বলছি বাবা, ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে…’

‘সে আবার কী কথা?’ ঘরের দরজাটা বন্ধ৷ জানলা দিয়ে আসা বাইরের আলো সেখানে ভালো করে পৌঁছায় না৷ সেই জমাট অন্ধকারের দিক থেকে একবার মুখ ঘুরিয়ে নেয় স্বপ্নময়, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, ‘কেউ দাঁড়িয়ে নেই… তুই ঘুমা…’

দেখার অবশ্য দরকার ছিল না৷ রনির মাঝরাতে এরকম দরজার পেছনের অন্ধকার দেখে ভয় পাওয়া নতুন কিছু নয়৷ মাসে দু’তিনবার রাতে ঘুম ভেঙে এই একই দাবি জানায় সে৷ কথাটা বলে স্বপ্নময় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে৷

বাবার কথায় মনে একটু ভরসা পায় ছেলেটা৷ আবার বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে, তারপর সিলিঙের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘আচ্ছা বাবা, ফুটোস্কোপ বলে সত্যি কিছু আছে?’

‘ফুটোস্কোপ! সেটা আবার কী?’

‘ওই যে স্কুলে কবিতা পড়াচ্ছিল৷ সবাই হাসছিল, আমার কিন্তু ভয় লাগছিল, জান? আয় তোর মুন্ডুটা দেখি, আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে… ওরকম সত্যি কিছু হয়?’

‘ধুর, ওরকম কিছু…’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় স্বপ্নময়৷ অনেককাল আগে পড়া কোনও একটা খবরের কথা মনে পড়ে যায় ওর৷ কিন্তু ওসব কথা রনিকে বলা কি ঠিক হবে? কিশোর মন… আবার বলতেও ইচ্ছা করছে৷

খানিক ভেবেচিন্তে মনস্থির করে নেয় স্বপ্নময়৷ গল্পের মতো শুনিয়ে দিলে ক্ষতি কী? তাছাড়া ছেলেটার মাথায় যখন ভাবনাটা এসেছে… ওর দিকে ঘুরে শোয় স্বপ্নময়, মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে ওর, ‘আমি ছোটোবেলায় একবার কাগজে একটা খবর পড়েছিলাম, জানিস?’

‘খবর? কী খবর?’

এতক্ষণে ছেলেকে একটু ভয় দেখানোর মওকা পাওয়া গেছে৷ রনির দিকে ফিরে স্বপ্নময় বলল, ‘একবার একটা লোক এই কবিতাটা পড়ে পাগল হয়ে গেছিল৷ নিজের ছেলেকে মাথায় বাড়ি মেরে ঘাড় মটকে খুন করেছিল…’

‘সে কী! কেন?’

‘ওই যে, মাথার ভিতরে কী থাকে, কতটা বুদ্ধি, কতটা বোকামো, কতটা গুণ, কতটা রাগ, দুঃখ, অভিমান… ভেবেছিল মাথা ফাটিয়ে ফেললেই বুঝি সব জানা যাবে৷’

‘সত্যি?’

‘তাই তো মনে পড়ছে৷ কোন কাগজে পড়েছিলাম সেটাও ভুলে গেছি৷ তবে পরে পুলিশ নাকি গ্রেফতার করেছিল লোকটাকে৷ লোকটা অবশ্য বলেছিল খুনটা ও আদৌ করেনি৷ অন্য কেউ ঘরে ঢুকে ওই কবিতাটা আবৃত্তি করতে করতে… পুলিশ বুঝতে পারে লোকটা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছে৷ একটু চাপ দিতেই দোষ স্বীকার করে লোকটা৷ ঘটনাটা ঘটার সময় ওর পাশে ওর স্ত্রী…’

কথাটা বলতে বলতে রনির মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলে স্বপ্নময়৷ গল্প বলতে শুরু করার মিনিটখানেকের মধ্যে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে ছেলেটা৷ ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দেয় স্বপ্নময়৷ কপালে একটা চুমু খায়৷ তারপর সেদিকে ফিরেই শুয়ে পড়ে৷

বালিশের উপরে কান রেখে চোখ বন্ধ করতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়৷ ওর মনে হয় খুব মৃদু স্বরে সেই কবিতাটা এখনও যেন শুনতে পাচ্ছে ও৷ বালিশের ভিতরে লুকানো একটা টেপ রেকর্ডারে সেটা চালিয়েছে কেউ৷ ও চমকে ওঠে৷

উঠে বসতেই আওয়াজটা মিলিয়ে যায়৷ ব্যস্ত হয়ে বালিশটা একবার ঘেঁটে দেখে স্বপ্নময়৷ নাঃ, তুলো ছাড়া আর কিছুই নেই তার ভিতরে৷ তাহলে…

ঘরের আলোটা কমে এসেছে নাকি? বাইরে থেকে… ও বুঝতে পারে এতক্ষণ জানলার দিয়ে যে বাইরের আলো আসছিল ঘরের ভিতরে সেটা আসছে না৷ কেউ কি এসে দাঁড়িয়েছে জানলায়?

কী মনে হতে ঝট করে জানলার দিকে ফিরে তাকায় স্বপ্নময়৷ নাঃ, কেউ নেই সেখানে৷ কেবল আগের মতোই ছাতিম গাছের পাতাগুলো দুলছে৷ আগের থেকে একটু জোরে…

(৩)

সন্ধের দিকে ছাদে বসেছিল রনি৷ রোজ এই সময়ে বাবা ওকে ছাদে বসিয়ে দিয়ে যায়৷ ও চুপ করে তাকিয়ে আকাশ দেখে৷ কখনও একটা একটা করে তারা গোনে৷ কখনও উড়ে যাওয়া বাদুড়ের ডানার দিকে চেয়ে থাকে একটানা৷

মাঝে মাঝে দূর আকাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া জেট প্লেনের দেখা পাওয়া যায়৷ মনে হয় যেন আকাশের বুকে কোনও অভিযানে চলেছে যেন প্লেনটা৷ ছুটে যাচ্ছে তারা থেকে তারায়৷

এখানে বসে থাকতে থাকতে মায়ের কথা মনে পড়ে রনির৷ মাকে শেষ দেখেছিল ছ-মাস আগে৷ মাঝে মাঝে অন্য সব ব্যথার মতো মাকে মনে পড়াটা বেড়ে ওঠে৷ কেবল অন্য ব্যথাগুলো বাবাকে বলা যায়, এই মন কেমনটা লুকিয়ে রাখে রনি৷ ও জানে এ ব্যথাটার কোনও মলম নেই বাবার কাছে৷

বাবা অবশ্য ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয় না৷ ইদানীং তো আরওই চোখের বাইরে করতে চায় না৷ কেবল এই সন্ধের সময়টুকু ওকে একা থাকতে দেয়, ভাবতে দেয়৷ বাবা জানে এইসময় ও মায়ের কথা ভাবে…

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল রনি, হঠাৎ খেয়াল হয় অনেকক্ষণ ধরে একটা শব্দ হচ্ছে পেছনে৷

চমকে আশপাশে তাকায়৷ মনে হয় একটা ভারী ধাতব কিছুকে ছাদের মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ৷ অন্ধকারে ভরে আছে ছাদটা৷

হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় রনি৷ থমথমে গলায় ডেকে ওঠে, ‘কে?’

উলটোদিক থেকে কোনও আওয়াজ আসে না৷ যেন ও ঘুরে তাকাতেই থেমে গেছে আওয়াজটা৷ মনের ভুল ভেবে মুখ ঘুরিয়ে আবার উল্টোদিকে ফিরতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা মৃদু শব্দ কানে আসে৷ খুব নিচু স্বরে একটা সুর ভাঁজছে কেউ৷ মেয়েলি গলা৷ প্রায় হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিশে আছে৷ চারপাশ এত নিস্তব্ধ না হলে হয়তো শোনাই যেত না৷

একটা শিরশিরানি ভয় রনির পা বেয়ে উপর দিকে উঠতে থাকে৷ কেউ একটা আছে ছাদে৷ কেউ অন্ধকার থেকে লক্ষ রাখছে ওর দিকে৷ সে-ই তাহলে ধাতব কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ছাদ দিয়ে?

চিৎকার করতে গিয়েও পারে না রনি৷ বুঝতে পারে ভয়ে আর উত্তেজনায় ওর শরীর কাজ করা বন্ধ করতে শুরু করেছে৷ একটা অস্থির হাওয়া ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে ছাদময়৷ কার যেন গন্ধ মিশে আছে তাতে৷

চোখটা সেদিক থেকে নামিয়ে নিতে যাচ্ছিল রনি৷ মেঝের দিকে তাকাতেই ওর হৃৎপিণ্ড থমকে যায়৷ বাইরের আলো ক্ষীণ হয়ে এসে ছাদের মেঝেতে পড়েছিল এতক্ষণ৷ তাতে ওর নিজের শরীরের আউটলাইন আবছা দেখতে পাচ্ছিল৷ এখন মাটির দিকে তাকাতে বুঝতে পারল সেই ছায়াটা পালটে গেছে৷ সেখানে এখন ওর বদলে একটা পুর্ণাঙ্গ মানুষের ছায়া৷ অর্থাৎ ওর পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে কেউ৷ পেছন ঘুরে তাকালেই তাকে দেখতে পাবে৷

চিৎকার করতে চেয়েও ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না৷

তেমনই ক্ষীণ নিঃশ্বাসের শব্দ৷ সেই সঙ্গে পুরনো সুরটা৷ থেমে থেমে একটা পরিচিত কবিতা আবৃত্তি করছে মানুষটা৷

রনি বুঝতে পারে পায়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা শরীর ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে৷ হুইলচেয়ারের হাতলের উপর ওর হাতটা অবশ হয়ে পড়ে আছে৷ চাইলেও নড়াতে পারবে না৷

ছায়াটার দিকে চেয়ে রনি দেখে এতক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাত ওপরের দিকে উঠে এসেছে৷ হাতে ধরা একটা মোটা ব্যাট জাতীয় কিছু৷ রনির মাথার ঠিক পেছন বরাবর হিংস্র শ্বাপদের মতো অপেক্ষা করছে সেটা৷ ধীরে ধীরে সেটা নেমে আসতে থাকে ওর মাথার উপর… আর কয়েক সেকেন্ড…

‘বাবা…’ শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে কোনওরকমে চিৎকার করে ওঠে রনি৷ ফাঁকা ছাদে প্রতিধ্বনিত হয়ে নিচ অবধি ছুটে যায় সেই ডাক৷

পরমুহূর্তে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়৷ হুড়মুড়িয়ে দিয়ে ছাদে উঠে আসে স্বপ্নময়৷ হন্তদন্ত হয়ে অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে রনির হুইল চেয়ারের কাছে এগিয়ে আসে৷

‘আমার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাবা…’ ওকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ওঠে রনি৷ অস্থির নিঃশ্বাস পড়ছে তার৷

এগিয়ে এসে হুইলচেয়ারের পেছন দিকটা খতিয়ে দেখে স্বপ্নময়৷ ওর মুখে আশ্বাসের হাসি খেলে যায়৷ নরম গলায় বলে, ‘কেউ নেই তোর পেছনে, শুধু শুধু ভয় পেয়েছিস…’

‘না, আমি দেখেছি একটা লোক… একটা মেয়ে…’

‘লোক না মেয়ে?’

‘লোক, কিন্তু গলাটা বুড়িদের মতো… বলছিল…’

‘কী বলছিল?’

‘ওই কবিতাটা… আয় তোর মুন্ডুটা দেখি… ওইটা…’

ছেলের কাঁধে একটা হাত রাখে স্বপ্নময়, ‘কবিতাটা নিয়ে বড্ড ভাবছিস তুই, নারে?’

‘আমি সত্যি বলছি বাবা, লোকটা…’

স্বপ্নময় কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই ওর পকেটে ফোনটা বেজে ওঠে৷ নাম্বারটা দেখে ওর ভুরু কুঁচকে যায়, বকুল ফোন করছে৷ কিন্তু কেন? রনিকে নিয়ে দু-কথা শোনানোর না থাকলে সচরাচর তো সে ফোন করে না৷ কয়েক সেকেন্ড সেদিকে চেয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করে, ‘হ্যাঁ, বলো…’

‘রনিকে তোমার কাছে রেখে আসাই উচিত হয়নি…’

‘মানে?’

‘বাচ্চা-কাচ্চা যখন মানুষ করতে পারবে না তখন দায়িত্ব নিয়েছিলে কেন? তার থেকে আমার কাছে থাকলে অন্তত…’

‘আরে বলতে চাইছটা কী?’

‘উলটোপালটা গল্প বলে ভয় দেখিয়েছ রনিকে৷ দুদিন হল দুঃস্বপ্ন দেখছে৷ ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর উপর নজর রাখছে, ছেলের খবর কতটা রাখ তুমি?’

‘তোমাকে ও বলেছে এসব?’ রনির দিক থেকে একবার মুখ ফিরিয়ে নেয় স্বপ্নময়৷

‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে৷ দেখো, যদি একান্তই ওকে সামলাতে না পারো…’

‘আমরা বাপবেটা সামলে নেব, তোমাকে এত মাথা ঘামাতে হবে না…’

‘এত অ্যারোগেন্স তোমার আসে কী করে৷ নেহাত ও তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিল তাই কাস্টডি ছেড়ে দিয়েছি, নাহলে…’

‘ঠিক আছে, রাখছি এখন…’

‘পারলে একটু ভালো রাখার চেষ্টা কর ওকে, এমনিও তো ছেলেটা আর বেশিদিন…’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে দেয় স্বপ্নময়৷ রনি এখনও অন্ধকারের মধ্যে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছে৷ ওর সামনে গিয়ে ছাদের মেঝেতেই বসে পড়ে সে৷ তারপর মুখ তুলে বলে, ‘হ্যাঁ রে ব্যাটা, আমি বাবা হিসেবে কেমন বল তো?’

‘আমি তো অন্য বাবা দেখিনি, তাই বলতে পারব না…’

‘মাকে তো দেখেছিস, মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছা করে না তোর?’

‘মাঝে মাঝে করে…’ রনি ভেবে বলে৷

‘তখন কী করিস?’

‘আর একটু বেশি করে তোমার কাছে থাকি…’

স্বপ্নময় হেসে ফেলে৷ ছেলের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয়৷ তারপর দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকে দু-জনে৷ হালকা হালকা মেঘের ছেঁড়া চাদরে চাঁদটা অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে৷ শার্সি দেওয়া জানলা দিয়ে যেন উঁকি মেরে ওদের দেখতে চাইছে সে৷

‘আজ খুব ভয় পেয়ে গেছিলি, নারে?’ ছাদের অন্ধকারের দিকে চোখ নামিয়ে স্বপ্নময় জিজ্ঞেস করে৷

রনি এবার নরম করে হাসে, ‘পা দুটো ঠিক থাকলে এত ভয় পেতাম না জানো৷ এক দৌড়ে…’

ওর হাতের উপর স্বপ্নময়ের হাতের চাপ বেড়ে ওঠে, ‘দৌড়াতে পারিস আর না পারিস, বাবা থাকতে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না তোর, সে যেই হোক…’

কথাটা বলে একটু থমকায় স্বপ্নময়৷ সে জানে অন্য যাই থাক না কেন যে বিশেষ আততায়ী এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে রনির দিকে৷ তাকে তার বাবাও আটকাতে পারবে না৷ সময় হলে সামনে থেকেই হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে৷

‘নিচে যাবি? চল…’

‘হ্যাঁ চলো…’

দু-পা এগোতে গিয়েও থেমে যায় স্বপ্নময়৷ ওর পায়ে কিসের একটা স্পর্শ লাগে৷ নিচু হয়ে জিনিসটা দেখতেই ওর বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে৷

‘এটা তুই এনেছিস এখানে?’ জিনিসটা হাতে তুলে ধরে রনিকে জিজ্ঞেস করে স্বপ্নময়৷

একটা পুরনো লোহার খিল৷ আগে নিচের দরজা আটকানো হত এই খিল দিয়ে৷ বছরখানেক হল আর কাজে না লাগায় ছাদের এককোণে পড়ে থাকে নোংরার মধ্যে৷ সেটা ছাদের মাঝামাঝি এল কী করে?

রনিও অবাক হয়েছে, খিলটা ভালো করে দেখে বলে, ‘আমি কেন আনব?’

‘তাহলে?’

খিলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে সেদিকে চেয়ে থাকে স্বপ্নময়৷ চাঁদের হালকা আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তার উপরে৷ ধার বরাবর চকচক করছে৷ এতটা চকচকে থাকার তো কথা নয়…

সেটা ছাদের এককোণে সরিয়ে রেখে ছেলেকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে আসে স্বপ্নময়…

(৪)

কাগজটা ইন্দ্রনীল ঘোষালের সামনে ফেলে একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল স্বপ্নময়, ‘এই দেখ, এইটুকুনি খবর মোটামুটি জানা যাচ্ছে৷ এর থেকে বেশি আর কিছু লেখেনি…’

পুরনো জেরক্স করা কাগজটা মুখের সামনে এনে ভালো করে পড়ে দেখে ইন্দ্রনীল৷ তিরিশ বছর আগের একটা খুনের খবর৷ ব্যাঙ্ক কর্মী নির্মল মুখার্জি নিজের দশ বছরের ছেলেকে প্রথমে ঘাড় ঘুরিয়ে তারপর ভোঁতা কিছু দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে খুন করেন৷ খুনটা যে তিনিই করেছেন সেটা প্রথমে ভদ্রলোক স্বীকার করেননি৷ তার নিজের জবানবন্দি অনুযায়ী দরজার বাইরে থেকে একটা বিড়বিড় করে আবৃত্তির শব্দ শুনতে পান৷ ঘরে ঢুকে দেখেন ছেলে মৃত৷ পরে অবশ্য সত্যি কথা স্বীকার করেন৷ ব্যস, এটুকুই… খবরটা এতই ছোট করে লেখা যে নামধাম ছাড়া তাদের সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায় না৷’

খবরের উপর মোটামুটি একরকম চোখ বুলিয়ে মুখ তোলে ইন্দ্রনীল, ‘সুকুমার রায়ের কবিতার সঙ্গে খুনের ব্লেন্ডিংটা অড সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তার জন্য এত সকালে হঠাৎ আমার কাছে…’

স্বপ্নময় এতক্ষণ থম মেরে বসেছিল৷ এবার বলে, ‘বাবার জবানবন্দিটা ইন্টারেস্টিং না?’

‘নো ডাউট…’

‘পুরো খবরটা পড়ে তোর মনে হল লোকটা খুন করেছে?’

‘না করার তো কারণ দেখছি না…’

‘ধরে নিলাম বাবাই করেছে, কেন করেছে? আই মিন কারণটা গেস কর…’

একটু ভেবে কাঁধ ঝাঁকায় ইন্দ্রনীল, ‘ধর কিছু একটা রাগের মাথায় মেরে ফেলেছে৷ ইন্টেনশনাল মার্ডার নয় হয়তো…’

স্বপ্নময় একটু নড়েচড়ে বসে, ‘বেশ, তাই হল না হয়৷ রাগের মাথায় হিট অফ দ্য মোমেন্ট দুম করে মেরে দিল৷ তারপর কী হওয়ার কথা?’

‘রিয়ালাইজ করবে যে নিজের ছেলেকে খুন করে ফেলেছে…’

‘এক্ষেত্রে সেটা হয়নি৷ প্রথমে ঘাড় ঘোরানো হয়েছে, তারপর মাথায় বেশ কয়েকটা বাড়ি মারা হয়েছে৷ এই খুন হিট অফ দ্য মোমেন্টে আদরের কাউকে মেরে ফেলা নয়৷ প্রতিহিংসামূলক…’

‘বাবার নিজের ছেলের প্রতি কী প্রতিহিংসা থাকতে পারে৷’

স্বপ্নময় কী যেন ভেবে ঘাড় নাড়ায়, ‘আমার জানি না কেন মনে হচ্ছে লোকটা আদৌ ছেলেকে খুন করেনি…’

‘সিরিয়াল কিলার গোছের কিছু? কিন্তু…’ খবরটা আবার হাতড়ায় ইন্দ্রনীল, ‘এই তো লেখা আছে পুলিশ ফোর্সড এন্ট্রির কোনও চিহ্ন পায়নি… সিরিয়াল কিলারের আইডিয়া তারা সবার আগে খারিজ করে দিয়েছে… তাহলে?’

জানালা দিয়ে দুপুরের আলো আসছে৷ ঘরের ভেতরে একটা বড় সাইজের আয়না আছে৷ তাতে দুপুরের রোদ পড়ে ছিটকে যাচ্ছে ঘরময়৷ একদিকে টিভিতে একটা নিউজ চ্যানেল খোলা আছে৷ তাতে কোনও সেলিব্রিটির বাড়িতে চুরির খবর চলছে নিচু স্বরে৷

ইন্দ্রনীলের এই অফিসটা নতুন৷ আগে অফিসের বালাই ছিল না৷ ঘুরে ঘুরেই কাজ করতে হত৷ সাংবাদিকতার কাজ৷ বছরখানেক সেই চক্করে থেকে ঘেন্না ধরে গেছিল৷ খামোখা কর্পোরেট বসের চরণামৃত খাওয়া দু’বেলা৷

তার পয়সাকড়ির অভাব নেই৷ ভেবেছিল নিজের মতো কিছু একটা করবে৷ তাতে পয়সা আসুক না আসুক, অভিজ্ঞতাটা যেন কাজে লাগে৷ সেই ধান্দায় কয়েক বছর শখের থিয়েটার করার চেষ্টা করেছিল৷ তাতে মন বসেনি৷ কিছুদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরিয়ে আবার সাংবাদিকতা শুরু করবে কি না ভাবছে এমন সময় গোয়েন্দাগিরির ভূত চাপে মাথায়৷

সেই থেকে এই ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিটা একরকম শখ করেই খোলা৷ তেমন একটা কেসও আসে না৷ আজ সকালেই ফোন করেছিল স্বপ্নময়৷ ওর কলেজ জীবনের বন্ধু৷ ঠিক কেস নয়, তবে কী একটা দরকারে যেন ওর সঙ্গে দেখা করতে চায়৷

‘সব বুঝলাম, কিন্তু একটা আনরিলেটেড পুরনো খুন নিয়ে তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?’ ইন্দ্রনীল কাগজটা ওর হাতে ফেরত দিয়ে জিজ্ঞেস করে৷

এই আলোয় ভরা ঘরেও স্বপ্নময়ের মুখে ছায়া নামে৷ বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে, ‘সেটার জন্যই তোর কাছে আসা৷ সত্যি কথা বলতে ব্যাপারটা অন্য কাউকে বলতে আমার ভরসা হচ্ছে না…’

‘বেশ, বল…’

‘কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে আমার৷ কেবল মনে হচ্ছে এই কবিতাটা…’

‘কবিতাটা কী?’

‘মনে হচ্ছে এই ঘটনাটা আবার ঘটবে৷ আমার বাড়িতে…’

চমকে ওঠে ইন্দ্রনীল৷ চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসে বলে, ‘মনে হওয়ার কারণ?’

‘কেউ নজর রাখছে আমাদের উপর…’

‘মানে?’

কাঁধ ঝাঁকায় স্বপ্নময়, ‘মানেটা বুঝিয়ে বলা মুশকিল৷ হয়তো আমাদেরই মনের ভুল৷ রনি মাঝে মাঝে বলে জানলা দিয়ে কে যেন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে…’

‘আরে ও বাচ্চা ছেলে, মনে হতেই পারে৷ তার মধ্যে আবার তোর মতো একটা ঘোড়েলের কাছে মানুষ হচ্ছে৷ এর মধ্যে আশ্চর্যের কী আছে?’

‘ব্যাপারটা যদি শুধু ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে আমি এত ঘাবড়াতাম না… কিন্তু…’

‘কিন্তু?’

‘আমারও আজকাল কেমন যেন…’

হাতের পেনটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে ইন্দ্রনীল, ‘দেখ, যদি সত্যি কোনও খারাপ ইনটেনশন নিয়ে কেউ তোদেরকে ফলো করে সেক্ষেত্রে আমি তোকে হেল্প করতে পারি৷ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোর ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল৷ গত ক’মাসে কম ট্রমা তো যায়নি তোদের উপর দিয়ে৷ বকুলের সঙ্গে ডিভোর্সটা, প্লাস রনির অসুখ, সব মিলেমিশে…’

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় স্বপ্নময়৷ খোলা জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে, ধীর গলায় বলে, ‘রনির শরীরের কন্ডিশন ভালো না৷ হাতেও জোর পাচ্ছে না ইদানীং৷ আমি ভাবছি…’

ইন্দ্রনীলও উঠে ওর দিকে এগিয়ে আসে৷ সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ডাক্তার কী বলছে এখন?’

সিগারেট ধরায় স্বপ্নময়৷ লাইটারটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘পরশু একটা টেস্ট আছে৷ পরদিন রিপোর্ট দেবে সেটার৷ ওটা না পেলে কিছু বলা যাচ্ছে না৷’

কথাটা শেষ না করেই ইন্দ্রনীলের দিকে ফিরে তাকায় স্বপ্নময়, ‘ঠিকই বলেছিস৷ হয়তো কিছুই না, শুধু এই স্ট্রেসটা থেকেই বাড়াবাড়ি হয়ে…’

ফোনটা বেজে ওঠে স্বপ্নময়ের৷ সেটা হাতে নিয়ে দেখে বাড়ি থেকে ফোন আসছে৷ রনি করছে নিশ্চয়ই৷ ঘড়ি দেখে স্বপ্নময়৷ ওকে দেখাশোনা করে যে মেয়েটা সে এখনও বাড়িতেই আছে৷ তবে দুপুরের দিকটা মাঝে মাঝেই টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে সে৷

‘হ্যাঁ, বল ব্যাটা…’

ওপাশ থেকে কোনও কথা আসে না৷ ঘড়ঘড় করে একটা আওয়াজ শোনা যায় কেবল৷ স্বপ্নময় জানলার দিকে আর একটু সরে আসে, ‘একটু জোরে বল, ঠিক শুনতে পাচ্ছি না…’

ঘড়ঘড় আওয়াজটা থেমে গিয়ে এবার একটা গলা ভেসে আসে, ‘আয় দেখি বিশ্লেষ ক’রে- চোপ রও ভয় পাস কেন?’

সেই হিলহিলে সরীসৃপের মতো গলা৷ ছন্দ করে যেন গানের সুরে গেয়ে চলেছে কবিতাটা৷

‘রনি…’ গলাটা কেঁপে যায় স্বপ্নময়ের৷ আর কোনও দিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দরজার দিকে দৌড় দেয় সে…

(৫)

বিকেলের দিকটা বাড়ির সামনে পার্কে বেড়াতে আসেন বৃদ্ধ কৌশিকবাবু৷ পার্কের ভিতরে ঢুকেই বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেন৷ তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকেন৷ এই সত্তর বছর বয়সেও পার্কের অন্যান্য কচিকাঁচাদের থেকে জোরে হাঁটতে পারেন তিনি৷ তবে শরীর পাকাপোক্ত থাকলেও বছরখানেক হল স্মৃতিশক্তি কিছুটা ক্ষয়ে আসতে শুরু করেছে৷ সেই নিয়ে খানিক মন খারাপও হয় মাঝে মাঝে৷ আহা এতদিন চাকরির কত বাহারি অভিজ্ঞতা, সব ঝাপসা হয়ে যাবে?

তবে হাঁটা ছাড়াও এ পার্কে ঘুরতে আসার আরও একটা কারণ আছে তার৷ পার্কের লাগোয়া পুলিশ স্টেশন৷ ঘুরতে আসার পথে মাঝেমধ্যেই ছোকরা কিছু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়৷ কৌশিক ব্যানার্জিকে দেখলেই একগাল হেসে মাথা ঝোঁকায় তারা৷ চোখে মুখে একটা সম্ভ্রম খেলে৷ সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে মন্দ লাগে না তাঁর৷ যে চল্লিশ বছর পুলিশে সার্ভিস করেছেন তাতে ওই একটি বস্তুই অফুরান কামিয়েছেন তিনি—সম্ভ্রম৷

‘ইয়ে আপনি কৌশিক ব্যানার্জি তো?’

লাঠি ঠুকঠুক করে একমনে হাঁটছিলেন ভদ্রলোক৷ পেছন থেকে নিজের নাম শুনে ফিরে তাকালেন৷ একটা বছর ত্রিশেকের ছোকরা পিছু ডেকেছে তাঁকে৷ ছিপছিপে চেহারা৷ মুখটা ভারি মোলায়েম৷ রিমলেস চশমা ঝুলছে চোখে৷ আজকালকার খবরের কাগজের ছেলেগুলোকে এরকম বোকাসোকা গোছের দেখতে হয়৷

‘হ্যাঁ বলুন…’ একটা আপাত তাচ্ছিল্যের স্বরেই বললেন কৌশিক ব্যানার্জি৷

‘আমার নাম ইন্দ্রনীল ঘোষাল৷ তিরিশ বছর আগের একটা কেসের ব্যাপারে একটু দরকার ছিল আমার…’

‘আপনি সাংবাদিক?’ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন কৌশিকবাবু৷

‘আজ্ঞে, ওইরকমই কিছু বলতে পারেন…’

‘বলতে পারি কি পারি না সেটা তোমার প্রশ্নেই বোঝা যাবে৷ কেস নম্বর আছে?’

‘আজ্ঞে তা আছে…’

‘তো থানায় গিয়ে খোঁজ করো…’ দৃশ্যতেই বিরক্ত হন ভদ্রলোক৷ আবার হাঁটতে শুরু করেন৷

ছেলেটা তার পিছু নেয়, ‘তার চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু কেসটা এত ছোট করে লেখা আছে যে প্রায় কিছুই জানা যায় না, তাই ভাবলাম…’

‘ভাবলে তিরিশ বছর পরে এই সত্তরের বুড়োর মাথার ভেতর একটু উঁকি মেরে দেখি৷ বুদ্ধি বলিহারি তোমাদের! আমাদের সময়ে এসব ন্যালাখ্যাপা সাংবাদিক হত না৷ যাও, যাও…’

কথাটা বলে হাঁটার জোর বাড়াতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধ৷ ছেলেটার মুখের দিকে চোখ পড়তে থেমে যান৷ খানিকটা মায়া লাগে তার৷ ভারী মিষ্টি মুখটা৷ কে জানে দূর থেকে কত আশা করে এসেছে৷ কতই বা মাইনে হবে এদের? খুব একটা বেশি বলে তো মনে হয় না৷ তাছাড়া এই সুযোগে নিজের স্মৃতিশক্তিটাও একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাবে৷

পার্কেরই একটা বেঞ্চে বসে পড়েন ভদ্রলোক৷ লাঠিটা পাশে রেখে মুখের ঘাম মুছে বলেন, ‘বলো, কোন কেস?’

‘আজ্ঞে আপনি এই কেসে স্পেশাল এসপি ছিলেন৷ নির্মল মুখার্জি বলে এক ভদ্রলোক তাঁর একমাত্র ছেলেকে একটি বিশেষ কায়দায় খুন করেন৷ প্রথমে মাথা ঘুরিয়ে…’

‘নির্মল মুখার্জি…’ ঝাপসা হয়ে যেন নামটা মনে পড়ে বৃদ্ধের, লাঠিটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন, ‘মাথা ঘুরিয়ে ব্যাটের বাড়ি মেরে খুন, তাইতো? ভারী বিশ্রী ব্যাপার৷ আমি আমার পুলিশ জীবনে কোনও বাপকে এমন করে খুন করতে দেখিনি৷’

ইন্দ্রনীল পকেটের ভিতরে রাখা ফোনের রেকর্ডিং বাটনটা অন করে দেয়, ‘এক্স্যাক্টলি, আপনাদের কোনও সিরিয়াল কিলারের কথা মাথায় আসেনি?’

উপরে নিচে মাথা নাড়েন ভদ্রলোক, ‘সেটাই সবার আগে মাথায় এসেছিল৷ ইনভেস্টিগেশন শুরু করার সময় আমরা একরকম নিশ্চিত ছিলাম যে বাইরে থেকে কোন আততায়ী এসে কাজটা করেছে৷ কিন্তু সেটা অসম্ভব৷ বাড়ির দরজা-জানলা, ঘরের ভিতরে কোন ফোর্সড এন্ট্রি ছিল না৷ সে রাতে ওই বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ আসেনি৷ বাবা মা আর ছেলে ছাড়া আর কেউ ছিল না…’

‘কিন্তু নির্মল মুখার্জি নিজের ছেলেকে খুন করবেন কেন?’

ঠোঁট উলটান ভদ্রলোক, ‘সেটা আমরা বের করতে পারিনি৷ তবে ছেলেটা এমনিতেই অসুস্থ ছিল…’

‘অসুস্থ! কীরকম?’

বৃদ্ধ স্মৃতি হাতড়ান, ‘খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার৷ ছোটবেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গেছিল৷ মাথায় চোট লাগে৷ ঘিলুতে আঘাত লেগে কীসব বিগড়ে গেছিল মাথায়৷ তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই পাগলামি করত৷ বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত, ভাঙচুর করত, দিনের পর দিন এসব আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়? তাই হয়তো কোনদিন রাগের মাথায় নির্মলবাবু…’

‘আর ওর মা?’

‘মা…’ ঝাপসা হয়ে আসা স্মৃতির হাঁড়িতে আবার হাতা ডোবান ভদ্রলোক, ‘মায়ের বেশি ন্যাওটা ছিল ছেলেটা৷ মাও ভালোবাসত খুব৷ অবশ্য ভালোবাসবে নাই বা কেন, শান্তশিষ্ট, হাবগোবা ছেলে৷ পড়াশোনায়ও মন ছিল ভীষণ৷ আমি মনে হয়…’

ইন্দ্রনীল বুঝতে পারেন স্মৃতির সমুদ্রে পথ হারিয়েছেন বৃদ্ধ৷ সে প্রসঙ্গটা বদলে ফেলে, ‘আচ্ছা নির্মল মুখার্জি তো জেলে৷ ছেলেটি মৃত৷ ওঁর স্ত্রী কোথায় আপনি জানেন?’

মাথা নাড়ান বৃদ্ধ, ‘উঁহুঁ, তা বলতে পারব না৷ মহিলাকে আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম৷ তেমন কিছুই বলতে পারেননি৷ এতটাই শোকাহত ছিলেন যে মুখ খোলানোই যায়নি৷ জেলে থাকাকালীন স্বামীকে দু’-একবার দেখতে এসেছিলেন৷ তারপর আর কোনও ট্রেস নেই…’

‘ভদ্রলোকের বয়ানে একটা কবিতার উল্লেখ ছিল, মনে আছে আপনার?’ ইন্দ্রনীল ঘোষাল উৎসাহী গলায় জিগেস করে৷

‘ছিল? কী জানি…’ একটা বাঁকা হাসি খেলে বৃদ্ধের মুখে, ‘কী জানো, ফাঁসির দড়ি গলার সামনে ঝুললে অনেক গল্প-কবিতাই বলে অপরাধীরা৷ আমরা ওসব অত মনে রাখি না…’

পরের প্রশ্নটা করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় ইন্দ্রনীল৷ ভেবেচিন্তে শেষে করেই ফেলে প্রশ্নটা, ‘আচ্ছা ধরুন আজ তিরিশ বছর পরে কেউ ওই একই কায়দায় খুন করতে চায় একটা বাচ্চা ছেলেকে৷ এমনকি হতে পারে মিস্টার মুখার্জি কিংবা তার স্ত্রী সিরিয়াল কিলার হয়ে ফিরে এসে…’

‘কোন কাগজের সাংবাদিক বললে যেন?’ ওর প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে কৌশিকবাবু…

‘আজ্ঞে ইয়ে…’ খাবি খায় ইন্দ্রনীল, ‘অনলাইন পোর্টাল৷ ওই চটপটা নিউজ টাইপের…’

‘চটপটা! সেটা আবার কী…’ হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকান ভদ্রলোক, ‘সত্যি করে বলো তো তুমি আদৌ সাংবাদিক না শখের উপন্যাস ফুপন্যাস লিখছ, অ্যাঁ? তিরিশ বছর পরে আবার সিরিয়াল কিলারের পিণ্ডি পাকাতে এসেছ এখানে?’

বিপদ বুঝে উঠে পড়ে ইন্দ্রনীল৷ ওর কাঁচুমাচু মুখটা এখন আগের থেকে কিছুটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷ অপরিচিত কৌতূহলের কয়েকটা রেখা খেলা করছে মুখময়৷

কিছু একটা ফুটে উঠতে গিয়েও উঠছে না৷ পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেকর্ডিংটা বন্ধ করে দেয় সে৷ নাঃ ভালো করে আবার শুনতে হবে পুরোটা…

(৬)

জানলার পাশটায় বসেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল স্বপ্নময়৷ মাঝরাতে ঘুমটা নিজে থেকে ভেঙে গেল৷ বন্ধ কাচের পাল্লা স্পর্শ করে আছে মাথাটা৷ উঠে বসে ও৷

ইদানীং রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয় না স্বপ্নময়ের৷ মাথার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে ওঠে বারবার৷ সারাক্ষণ মনে হয় আশপাশে কে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ এ বাড়ির সর্বত্র দৃষ্টি রেখে চলেছে৷ জানলার পাশে বসে সেসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল এতক্ষণ৷

চোখ মুছে চারদিকে ভালো করে তাকায় সে৷ নীলচে রাতবাতির আলোয় ঘরটা আবছা দেখা যায়৷ একটু দূরে বিছানার উপর উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে রনি৷ অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আর ডাকেনি৷

দেওয়ালে ঝুলন্ত রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে৷ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় স্বপ্নময়৷ তারপর রনির ঠিক পাশটায় এসে শুয়ে পড়ে৷ বড়ো করে নিঃশ্বাস নেয়৷ বাঁদিকে তাকিয়ে একবার হাত রাখে ঘুমন্ত রনির পিঠে৷ হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় রনির৷ সেও হাত বাড়িয়ে বাবার হাতের উপর হাত রাখে৷ খটকা লাগে স্বপ্নময়ের৷

রনির হাতটা ভাঁজ হয়ে ওর হাতের উপর পড়ে আছে৷ যদি ও উলটোদিকে মুখ করে শুয়ে থাকে তাহলে কিছুতেই ভাঁজ করে ওর হাতে হাত রাখা সম্ভব নয়৷

ভালো করে সামনে থাকাতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে স্বপ্নময়৷ রনি ওর উলটোদিকে ফিরে নয়, ওর দিকে ফিরেই শুয়ে আছে৷ কেবল ওর মাথাটা ঘাড় ছেঁড়া পুতুলের মতো সম্পূর্ণ উলটোদিকে ঘোরানো৷ এবং যন্ত্রের মতো একটু একটু করে সেটা ফিরছে স্বপ্নময়ের দিকে৷ ক্রমশ ছেলেটা সামনের দিকে মাথা ঘোরায়৷

কিন্তু মুখ কোথায়? রক্ত, চোখ, মুখ, নাক দলা পাকিয়ে যাওয়া একটা মাংসপিণ্ড৷ সেই ঘেঁটে যাওয়া অদ্ভুত মুখে কেবল কয়েকটা দাঁতের সারি চিনে নেওয়া যায়৷ ভালো করে তাকালে বোঝা যায় সে দাঁতের সারি হাসছে… কাঁপা কাঁপা স্বরে সেই মাংসপিণ্ড উচ্চারণ করে, ‘বাবা, আমার খুব ভয় করছে বাবা…’

চিৎকার করে উঠতে ঘুমটা ভেঙে যায় স্বপ্নময়ের৷

ওর চিৎকারে রনিও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, ‘কী হল বাবা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?’

হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলের মুখের দিকে তাকায় স্বপ্নময়৷ তারপর ছিটকে সরে আসে বিছানা থেকে, ‘তু… তুই…’

‘আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বাবা… তোমার ডাকে…’ একটু করুণ হাসি হাসে রনি৷ বিছানার উপর সোজা হয়ে বসতে বসতে বলে, ‘আমার মতো তুমিও ভীতু হয়ে গেলে বাবা৷ বাপ-ছেলেতে কী মিল বলো?’

একটা হাহাকারের স্রোত বিছানার উপর টেনে আনে স্বপ্নময়কে৷ ছেলেকে সজোরে বুকের মাঝখানে আঁকড়ে ধরে, ‘আসলে আমার মাথাটা…’

‘আমাকে একটু বাইরে ঘুরিয়ে আনবে?’ যেন ওকে সান্ত্বনা দিতেই নরম গলায় বলে রনি৷

দু-হাতে মুখ মোছে স্বপ্নময়, ‘এত রাতে?’

‘ভালোই তো, কেউ দেখতে পাবে না যে আমি হাঁটতে পারি না৷’

জামাটা গায়ে গলিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে অন্য হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাইরে নিয়ে আসে স্বপ্নময়৷

ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা ফাঁকা পড়ে আছে৷ ঝিমঝিম করে একটা হাওয়া বইছে তার উপর দিয়ে৷ রাস্তার দু-দিকে সারবাঁধা ফ্ল্যাটবাড়ি অন্ধকারের চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে৷

রাস্তার একধার দিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে স্বপ্নময় বলে, ‘ভাবছি এই বাড়িতে আর থাকব না…’

‘কেন?’

‘কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে এখানে৷ আমরা দু-জনেই কেমন ভীতু হয়ে গেলাম৷’

রনি কী যেন ভেবে বলে, ‘আমার খালি মনে হয় জানো, ওই দরজাটার পেছনে অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ একটু আগেও মনে হচ্ছিল…’

‘তাই ঘর থেকে চলে এলি?’

‘এই হাওয়াটা ভাল লাগে আমার৷ ভয়টা কমে যায়, তোমার কমে না?’

স্বপ্নময় কিছু উত্তর দেয় না৷ হাতের মৃদু চাপে হুইলচেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে৷

‘আমি আর ভালো হব না, তাই না বাবা?’

‘কে বলেছে তোকে?’ প্রতিবাদ করে স্বপ্নময়, ‘এ সপ্তাহের রিপোর্টটা এখনও আসেনি৷ ওটা এলে তারপর…’

‘মায়ের সঙ্গে এত ঝগড়া কোরো না তুমি৷ আগে তিনজনে কত হাসাহাসি করতাম মনে আছে? কী লাভ বলো তো?’

‘তোকে এত কথা কে ভাবতে কে বলেছে? আর তোর মা-ই থাকতে চায়নি আমাদের সঙ্গে, আমি কাউকে কোথাও যেতে বলিনি৷’

মুখে হাওয়া এসে লাগে রনির, ‘আমি থাকতে দু-জনে একসঙ্গে হাসতে, না থাকলে এক সঙ্গে কেঁদো, তাহলেই হবে…’

থেমে যায় স্বপ্নময়৷ ছেলের সামনে এসে দাঁড়ায়৷ চোখের কোণে জল চিকচিক করছে ওর, ‘মায়ের কাছে যাবি রনি? এক্ষুনি?’

রনি হাসে, ওর দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘চলো ঘরে ফিরে যাই, আর হাওয়া ভালো লাগছে না…’

মাথা নামিয়ে আবার পিছনের দিকে সরে আসতে যাচ্ছিল স্বপ্নময়৷ থেমে যায়৷

দূরে একটা অন্ধকার গলির ঠিক বাইরেটায় একটা মানুষের অবয়ব যেন কখন এসে দাঁড়িয়েছে৷ একপাশে জ্বলতে থাকা স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোটা এসে পড়েছে সেই অবয়বের মুখের উপর৷ লোকটার কপাল থেকে নাক অবধি ঢাকা একটা সাদাটে মুখোশে৷ কেবল ঘন কালো দুটো চোখ ফুটে আছে কোটর থেকে৷

লোকটার হাতে ধরা একটা লম্বাটে গোছের লোহার খিল৷ সেটা মাথার উপর তুলে ধরে যেন হাওয়াতেই চালিয়ে দেয় লোকটা৷ মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে তার৷ তারপর আঙুল তুলে ঠোঁটের সামনে রাখে৷ যেন ইশারায় চুপ করতে বলে স্বপ্নময়কে৷

ভয়ে পা দুটো জমে গেছিল স্বপ্নময়ের৷ মাথার ভিতর সাহস ফিরে আসতেই সেদিক লক্ষ করে ছুটতে শুরু করে সে৷ মুহূর্তে যেন হাওয়াতেই মিলিয়ে যায় মুখোশে ঢাকা অবয়বটা… রাতের কুয়াশা গ্রাস করে নেয় তাকে৷

স্বপ্নময় থমকে দাঁড়ায়৷ কয়েক সেকেন্ড সেইভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে আসে রনির কাছে৷

‘কে ছিল বাবা?’

‘কেউ না…’ হাসার চেষ্টা করে স্বপ্নময়, ‘তোর মতো আমিও অন্ধকারে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি…’

(৭)

দমবন্ধ করা অস্থিরতা চেপে ধরছে ইন্দ্রনীলকে৷ এই ক-দিনে আর তেমন যোগাযোগ করেনি স্বপ্নময়৷ সম্ভবত নিজের সমস্যার কিছু সমাধান যে ওর কাছে আছে, সেটা আর বিশ্বাস করে না সে৷

সেদিন অমন হুট করে বাড়িতে ছুটে যাওয়ার পর ওকে একবার ফোন করেছিল ইন্দ্রনীল৷ বাড়িতে নাকি তেমন কিছুই ঘটেনি৷ আজ রনির টেস্টের রিপোর্ট আসার কথা, সেটার কী খবর হল সেটা জানতে ফোন করেছিল একবার৷ ফোন ধরেনি৷

এই ক-দিনে নির্মল মুখার্জির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা কয়েকবার করেছে ইন্দ্রনীল৷ কিন্তু উপায় করে উঠতে পারেনি৷ দু’-এক জায়গায় চিঠি লিখেছিল৷ তার উত্তর আসার তেমন সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে৷

স্বপ্নময়ের বাড়ির আশেপাশেও কয়েকবার ঘুরঘুর করেছে৷ সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়েনি৷ বাড়ির বেশ কয়েক জায়গায় একটা সারভিলেন্স কোম্পানিকে দিয়ে সিসিটিভি বসিয়েছিল স্বপ্নময়৷ তারাও জানিয়েছে অস্বাভাবিক কিছুই ধরা পড়েনি তাতে৷ সবটাই হয়তো বাপ-ছেলের মনের ভুল৷ কিন্তু তাও কী যেন একটা ধাঁধা লেগে আছে ইন্দ্রনীল ঘোষালের মনে৷ ওর মন বলছে এই কেসের সবটা হ্যালুসিনেশন নয়…

স্টাডিরুমে বসে একগাদা কাগজপত্রের মধ্যে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল ওর৷ শেষে মাথাটা একটু হালকা করতে ল্যাপটপটা খুলে বসল৷ ফেসবুকে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে স্ক্রল করল কয়েকবার৷ করতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলল৷ চটপটা নিউজের কয়েকটা উদ্ভট খবর ভাসছে স্ক্রিনে৷ খবরের নামটা দেখতেই মনে পড়ে গেল বুড়োর কথা৷

মনে পড়তেই একবারের জন্য ভুরু কুঁচকে গেল ইন্দ্রনীল ঘোষালের৷ সেদিন বেঞ্চ থেকে উঠে আসার সময়ে বারবার মনে হচ্ছিল কোথায় একটা যেন গন্ডগোল আছে বুড়োর কথায়৷ তারপর আর ভেবে দেখা হয়নি…

ফোনটা বের করে রেকর্ডিংটা চালিয়ে টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল ইন্দ্রনীল৷ একটানা বলে চলেছেন বুড়ো৷ থেমে থেমে, ধীর অথচ ভরাট গলায়…

মাথায় চোট… পাগলামি, ভাঙচুর… ছেলের উপর রাগ, সেই থেকে…

হঠাৎ… ইন্দ্রনীলের মাথাটা টেবিলের উপরে সোজা হয়ে গেল৷ আবার প্রথম থেকে চালিয়ে শুনল সমস্তটা৷ তারপর আর একবার৷ হ্যাঁ, এতক্ষণে গন্ডগোলটা খেয়াল হয়েছে ওর৷

অদ্ভুত ব্যাপার! বুড়ো একটাই বাচ্চার ব্যাপারে যে ইনফরমেশন দিচ্ছেন সেগুলো একটা আর একটার বিপরীত৷ মায়ের ন্যাওটা শান্তশিষ্ট ছেলে, অথচ ছেলেবেলায় গাছ থেকে পড়ে গেল! মাথায় চোট পেয়ে পাগলামি করা বিকারগ্রস্ত ছেলে, অথচ পড়াশোনায় ভীষণ ভালো৷ ঠিক যেন একই মানুষের দুটো সত্তা৷ অথবা…

অথবা উলটোটা…

এক ঝটকায় উঠে বসল ইন্দ্রনীল৷ ওর চোখের সামনে আলো ফুটতে শুরু করেছে৷ নাঃ৷ মনস্থির করার আগে একবার যাচাই করে দেখতে হবে…

দ্রুত ফোনটা নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল ইন্দ্রনীল৷ কয়েকবার রিং হতে ওপাশ থেকে বৃদ্ধের গলা শোনা গেল, ‘হ্যালো…’

‘ইন্দ্রনীল ঘোষাল বলছি স্যার, সেদিন পার্কে কথা হচ্ছিল আপনার সঙ্গে, মনে আছে…’

‘সেই চটপটা নিউজ? তুমি তো আচ্ছা ত্যাঁদড় ছেলে…’

‘নির্মল মুখার্জির স্ত্রী তার দুই ছেলের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসতেন?’

‘ছোটোটিকে, বললাম তো সেদিন৷ বড়োটি গাছ থেকে পড়ে… সে পাগলাটে ছিল বলেই লোকে টোন-টিটকিরি কেটে…’

‘বড়ো ছেলেটা এখন কোথায় আছে জানেন?’

‘সে মনে হয় একটা অনাথ আশ্রমে ট্রান্সফার হয়েছিল৷ সেটার নাম আমি ভুলে গেছি, তবে যতদূর মনে পড়ছে…’

অনাথ আশ্রমের নামটা লিখে নিয়ে ফোনটা রেখে দেয় ইন্দ্রনীল৷ গুগলে টাইপ করে ফোন নম্বর জোগাড় করা অসুবিধের কিছু হবে না৷

উৎসাহের আতিশয্যে টেবিলের উপরে চাপড় মারে৷ সেদিন মস্ত একটা ভুল করেছিল ও৷ কৌশিক ব্যানার্জির সঙ্গে কথা শুরু হওয়ার সময় ‘একমাত্র ছেলে’ কথাটা অজান্তেই বলে ফেলেছিল৷ বুড়ো বয়সে স্মৃতি কিছুটা থাকলেও সে স্মৃতির উপর বিশ্বাস থাকে না৷ অবচেতনে যেটা সত্যি বলে জানতে পেরেছেন তার বাইরে কিছু ভাবতেই পারেননি বৃদ্ধ৷ তাঁর অবচেতন মন তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে নির্মল মুখার্জি, তাঁর স্ত্রী আর ছোটো ছেলে ছাড়াও সেদিন ও বাড়িতে আরও একজন ছিল…

(৮)

ঘরে ঢুকে হাতের কাগজটা টেবিলের উপরে রাখে স্বপ্নময়৷ একগাল হাসে৷ তারপর এগিয়ে আসে রনির দিকে৷

‘ওটা কী গো? আমার রিপোর্ট?’ উৎসাহী গলায় জিগেস করে রনি৷

‘চিন্তার কিছু নেই৷ ঠিক আছে সব…’

রনির মুখে হাসি ফুটতে গিয়েও ফোটে না, ‘আজ দুপুরেও একটা ফোন এসেছিল, জানো?’

‘ফোন?’ জামাটা ছেড়ে হ্যাঙ্গারে ঝোলাতে ঝোলাতে বলে স্বপ্নময়, ‘কী বলছে?’

‘ওই কবিতাটা, ওটা শুনলে আমার খুব ভয় করে…’

ছেলের চুল ঘেঁটে দেয় স্বপ্নময়, ‘ধুর ওটা একটা মামুলি কবিতা…’

‘আর ওই যন্ত্রটা?’

‘কোন যন্ত্র?’

‘ওই যে ফুটোস্কোপ…’

বিছানার উপরে রনির ঠিক পেছন বসে পড়ে স্বপ্নময়, ‘আমার কী মনে হয় জানিস, ফুটোস্কোপটা না কোনও যন্ত্র নয়৷ একটা মানুষ৷ তাহলেও দেখ, কবিতাটার মানে মিলে যাচ্ছে৷ একটা মানুষ যে অনেকটা ডাক্তারের মতো কাজ করে৷ কেবল তার চিকিৎসার ধরনটা আলাদা…’

‘তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না বাবা…’

‘ডাক্তার বলেছে তুই আর ঠিক হবি না৷ ছ’মাসের মধ্যেই…’

রনি ঘুরে তাকায় ওর বাবার দিকে৷ দু’চোখে সমস্ত অভিব্যক্তি উধাও হয়েছে তার৷ বাবার শরীর বেয়ে ওর দৃষ্টি নেমে আসে হাতের দিকে৷ ও চমকে যায়৷

বাবার হাতের পাশে একটা মোটা লোহার খিল৷ একটা হাত ওর মাথায়; অন্য হাতটা সেই খিলের উপর খুব ধীরে ধীরে বোলাচ্ছে স্বপ্নময়…

(৯)

‘হ্যালো! বকুল বিশ্বাস বলছেন?’

অন্যদিন ফোনটা সাইলেন্ট করেই শোয় বকুল৷ আজ কী যেন কারণে করতে ভুলে গেছিল৷ রাত একটার দিকে সেটা বেজে উঠতেই কেটে দিতে যাচ্ছিল৷ শেষে দোনোমন করে ধরেই ফেলে—

‘হ্যাঁ, কে বলুন তো?’

‘আপনার হাজব্যান্ড এখন…’

বিরক্ত হয়ে একবার মাথার চুল খামচে ধরে বকুল, ‘দেখুন আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে৷ ওনাকে যোগাযোগ করতে চাইলে…’

‘ওনার ফোন বন্ধ…’

‘ঘুমাচ্ছেন হয়তো৷ কাল সকালে করবেন…’

ফোনের ওপাশের লোকটা ওকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়, ‘না সেটা সম্ভব নয় ম্যাম৷ আমার মনে হচ্ছে আজ রাতেই উনি একটা অঘটন ঘটাতে চলেছেন৷ পুলিশকে আমি জানিয়েছি, কিন্তু ওরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে… আর ওদেরকে আপনার থেকে ভালো কেউ চেনে না৷ আপনি প্লিজ নিচে নেমে আসুন৷’

‘মানে? আপনি আমার বাড়ির নিচে?’ বকুলের বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলে৷

‘হ্যাঁ, গাড়িতে আছি৷ আপনি তাড়াতাড়ি আসুন…’

‘ওয়াট দ্য হেল! কে আপনি?’

‘উনি একটা হেল্পের জন্যও আমার কাছে এসেছিলেন৷ আমি সব বলব আপনাকে৷ কিন্তু প্লিজ এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ুন৷ মিস বিশ্বাস আপনার ছেলের ভীষণ বিপদ, যে কোনও মুহূর্তে…’

‘কী হয়েছে ওর?’

আর অপেক্ষা করে না বকুল৷ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গাড়িটা সত্যি দেখতে পায়৷ ওর পায়ের তলায় যেন লাভা ঢেলে দিয়েছে কেউ৷ কোনওরকমে ফ্ল্যাটের তালাটা লাগিয়ে লিফটে নিচে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে এসে বসে ও৷

‘কী হয়েছে রনির?’ ইন্দ্রনীল ঘোষালের গাড়ির ইঞ্জিন গর্জন করে উঠতেই ওর দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় বকুল৷

‘এখনও কিছু হয়েছে কি না জানি না৷ কিন্তু উই ক্যান্ট টেক রিস্ক…’

‘আমি কিছুই…’

‘বলছি…’ গভীর রাতে ফাঁকা বাইপাসের রাস্তার উপর গাড়ি চালাতে চালাতে ইন্দ্রনীল বলতে শুরু করে, ‘আপনার এক্স হাজব্যান্ড স্বপ্নময় ঘোষ যে অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড সেটা আপনি জানতেন?’

‘হ্যাঁ, ও নিজেই বলেছিল আমাকে৷ বারো বছর বয়সে একটা অনাথ আশ্রম থেকে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছিল ওকে…’

‘বারো বছর৷ মানে ততদিনে কিশোর বলাই যায়৷ ওর আগের মা-বাবার কথা আপনার কাছে বলেনি কোনওদিন?’

‘না, ওর নাকি ওসব কথা কিছু মনে ছিল না…’

স্টিয়ারিং-এর উপর একটা চাপড় মারে ইন্দ্রনীল৷ বকুল ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ‘কিন্তু আপনি বলতে কী চাইছেন? ওর মা-বাবার সঙ্গে আমার ছেলের কী সম্পর্ক!’

কথাটায় কান দেয় না ইন্দ্রনীল, ‘মিস্টার ঘোষের বায়োলজিক্যাল ফাদার নির্মল মুখার্জি৷ ভদ্রলোক আপাতত নিজের ছেলেকে মাথা ফাটিয়ে খুন করার দায়ে জেলে আছেন…’

‘নিজের ছেলেকে খুন করার দায়ে… মানে ওরা দুই ভাই?’

‘একজনের ডাক নাম পার্থ, অন্যজনের বাবান…’ সামনে লম্বা রাস্তা পড়ে আছে, গাড়ির স্পিড আরও এক ধাপ বাড়িয়ে ধীর গলায় বলতে শুরু করে ইন্দ্রনীল, ‘আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা৷ পার্থ আর বাবান দুই ভাই৷ বয়সের পার্থক্য বছর খানেকের৷ ছোটোবেলায় বড়ো ভাই বাবান একবার ছাদ থেকে পড়ে গেছিল৷ সেখান থেকে মাথায় চোট৷ কোনও রকমে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে সে ফিরে আসে৷ ডাক্তার বলেছিল অন্য কোনও সমস্যা না থাকলেও থেকে থেকে কিছু পাগলামি জেগে উঠতে পারে তার৷ বাবা-মা অবশ্য কোনওদিন তেমন কিছু লক্ষ করেননি৷ অন্তত যে রাতের কথা বলতে চলেছি তার আগে অবধি৷

এই মাথায় চোটের জন্যই কি না জানি না ছোটো থেকে বাবান একটু বোকাসোকা গোছের৷ কোনও জিনিসই সহজে তার মাথায় ঢোকে না৷ বাড়ি ফেরার রাস্তা ভুলে যায়, নামতা ভুলে যায়, কখনও টাকার বান্ডিল রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে আসে৷ ফলে বাবা-মা এমনকি পাড়ার লোকজনের কাছে পদে-পদে অপমানিত অপদস্থ হয় সে৷ দিনের পর দিন সেই অপমানের যন্ত্রণা তার অসুস্থ মাথার মধ্যে জমা হতে থাকে৷

অপরদিকে তারই ভাই পার্থ শান্তশিষ্ট৷ পড়াশোনায় তার জুড়ি নেই৷ বছর বছর আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট৷ মা-বাবার আদরের ছেলে সে৷ এই সমস্তটা বাবানের মনের ভিতরের অন্ধকারটা আরও বাড়িয়ে তোলে৷ ‘ভাইকে দেখ, কী চমৎকার বুদ্ধি… আর তুই…’ কিংবা ‘ওর মাথা এত পরিষ্কার, তোর মাথায় কী গোবর পোরা? হ্যাঁ?’

দিনের পর দিন এই জমতে থাকা অপমানের বারুদের স্তূপের উপর আগুন পড়ে৷ মানসিক বিকারগ্রস্ত ছেলেটার মাথার ভিতরে কেউ বলে দেয় ভাইয়ের মাথা খুলে দেখতে হবে ওর ভিতরে সত্যি এমন কী আছে যা ওর মাথায় নেই৷ তারপর একদিন রাতে সুযোগ বুঝে…’

‘মানে স্বপ্নময় ওর নিজের ভাইকে…’

‘মাথা ঘুরিয়ে, তারপর ব্যাটের বাড়ি মেরে ফাটিয়ে দেয়৷ বাবা নির্মল মুখার্জি ঘরের ভিতরে ঢুকে সবই দেখতে পান৷ প্রথমে সমস্ত সত্যি বলতে শুরু করলেও শেষে ওইটুকু ছেলেকে বাঁচাতে তিনি দোষ নিজের ঘাড়ে নেন৷ তবে এ ঘটনার মূল দোষী বাবানও নয়৷ আসল দোষ ফুটোস্কোপের…’

‘সেটা কী? কোনও যন্ত্র?’

‘এই সমস্ত ঘটনার পরে একটা অরফ্যানেজে পাঠানো হয় বাবানকে৷ এত মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বলে দীর্ঘদিন তার মাথার চিকিৎসা চলে৷ সেখানকার সাইকিয়াট্রিস্ট কিছুদিন পরেই বুঝতে পারেন সত্যিটা৷ ছোটোবেলার আঘাত, ক্রমাগত অপমান, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা বাবানের মাথার ভিতর একটা নতুন আইডেন্টিটির জন্ম দিয়েছে৷ ছোটবেলায় পড়া একটা ছোটদের কবিতা থেকে নেওয়া একটা শব্দ—ফুটোস্কোপ!’

‘সেটা কী?’

‘কবিতা অনুযায়ী একটা যন্ত্র৷ যেটা দিয়ে মানুষের মাথাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়৷ তবে এক্ষেত্রে সেটা যন্ত্র নয়, মানুষ৷ আপনার এক্স হাজব্যান্ডের দুটো পারসোনালিটির একটা৷ কাজ সেই যন্ত্রটার মতোই৷ সে সময়ে সময় জেগে ওঠে, তার একমাত্র কাজ মানুষের মাথা ফাটিয়ে তার ভিতরটা বিশ্লেষণ করা৷ ডিসঅ্যাসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারের ফলে এই সমস্ত ঘটনা আপনার স্বামী ভুলে যায়৷ কিন্তু ফুটোস্কোপ মনে রাখে৷ এত বছর ধরে…’

‘কিন্তু আপনি হঠাৎ এসব কথা আমায় বলছেন কেন?’

‘কারণ সে আবার জেগে উঠেছে৷ তার এবারের ভিক্টিম আপনার ছেলে রনি, মিস বিশ্বাস…’

‘কিন্তু স্বপ্নময় নিজের ছেলেকে হিংসা করবে কেন? ও তো অসুস্থ…’

‘হিংসা নয়৷ ভেবে দেখুন মিস বিশ্বাস, রনির আসন্ন মৃত্যুটা স্বপ্নময়কে দিনরাত যন্ত্রণা দেয়৷ কিছুতেই সত্যিটা মানিয়ে নিতে পারে না সে৷ এই ইমোশনালি ভালনারেবল স্টেট তার ভিতরে অস্থিরতা জন্ম দেয়৷ পারকিনসনস মূলত সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম, আই মিন মাথার রোগ৷ কী এমন আছে রনির মাথার ভিতরে যা এতটা কষ্ট দিচ্ছে ওকে? মিস্টার ঘোষের অবচেতনে ফুটোস্কোপ আবার জেগে ওঠে, মাথা ফাটিয়ে দেখতেই হবে কীসের এত সমস্যা?

এবার সে জেগে উঠেছে হিংসা থেকে নয়, বরঞ্চ সন্তান স্নেহ থেকে, ভালোবাসা থেকে৷ আর সেই ভালোবাসার উপর চরম আঘাতটা এসেছে আজ৷ ফলে ফুটোস্কোপ আজই আঘাত হানবে…’

‘মানে?’

‘আজ সন্ধ্যায় আপনার ছেলের ডিজিটির রিপোর্ট এসেছে৷ অ্যান্ড হি হ্যাজ ফিউ ডেজ লেফট…’

(১০)

‘ভয়ের কিছু নেই রনি, আমি শুধু তোর মাথার ভিতরটা দেখব, কীসের এত রোগ, আয় আমার কাছে…’

ছেলেটা এখনও চুপ করে চেয়ে আছে ওর দিকে৷ মুখে তেমন কোনও অভিব্যক্তি নেই৷ বাবাকে অনেকক্ষণ থেকেই অচেনা লাগছে ওর৷ ইচ্ছা করে হুইলচেয়ার থেকে নেমে কোথাও একটা ছুটে পালিয়ে যেতে৷ কিন্তু সে উপায় নেই৷ নিজের অক্ষম পা দুটোকে নিয়ে ভীষণ অসহায় লাগে ওর৷

বাবার পাশে পুরনো খিলটা পড়ে আছে এখনও৷ ধীরে ধীরে ওর ঘাড়ের পেছন দিকটায় হাত বুলাচ্ছে বাবা৷

‘আয় দেখি কোন ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তোর কোথা৷’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে চলেছে৷ এমন অদ্ভুত হিলহিলে স্বর বাবার মুখ থেকে বেরোতে পারে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না রনি৷ তার করুণ গলা শোনা যায়, ‘আমার খুব ভয় করছে বাবা… তুমি এরকম করে…’

‘আমারও করে, খুব ভয় করে৷ তোকে নিয়ে, তুই ছাড়া আর কে আছে আমার বল? তুইও যদি মরে যাস…’

কী অদ্ভুত গলায় কথা বলছে বাবা! বয়স্ক মহিলাদের মতো স্বর৷ শুনলেই বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়৷

কোলে করে রনিকে তুলে নিয়ে বিছানার উপরে বসিয়ে দেয় স্বপ্নময়৷ মুচকি হাসি হাসে৷ তারপর কয়েক সেকেন্ড ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে ভাঙা খিলটা হাতে তুলে নেয়৷

‘তুমি আমাকে মারবে বাবা?’ এতক্ষণে কী হতে চলেছে খানিকটা বুঝতে পেরেছে রনি৷

‘উঁহুঁ, আমি না৷ রোগ৷ তোর মাথার ভিতরের রোগটা৷ আমি শুধু ওটাকে…’ খিলটা মাথার উপর তুলে ধরে স্বপ্নময়৷ ওর চোখে একটা শয়তানি হাসি উপচে পড়ছে, ‘চোখ বন্ধ কর৷ তোর সব ব্যথা কমে যাবে রনি…’

এক্ষুনি খিলটা এসে পড়বে ওর মাথার উপরে৷ কিংবা মাথাটা ঘুরে যাবে পেছনের দিকে৷

রনি চোখ বন্ধ করে না৷ হাওয়ায় উত্থিত খিলের দিক থেকে তার দৃষ্টি ঘুরে যায় দরজার দিকে৷ বিড়বিড় করে মৃদু স্বরে বলে, ‘ওখানে কে দাঁড়িয়ে আছে বাবা… দরজার পেছনের অন্ধকারে…’

বিরক্ত হয় স্বপ্নময়, উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে, ‘কেউ দাঁড়িয়ে নেই৷ তুই চোখ বন্ধ কর…’

‘ওই তো দাঁড়িয়ে আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি তো…’

রাগ ওঠে স্বপ্নময়ের, চিৎকার করে ওঠে, ‘কে দাঁড়িয়ে আছে?’

‘আমার বাবা…’ তেমনই ফিসফিসে স্বরে বলে রনি৷ মুখে হাসির রেখা খেলে যায় তার, ‘ভয় দেখাচ্ছে না৷ খেয়াল রাখছে আমার৷ বাবা…’

দুটো হাত সেই অন্ধকারের দিকে বাড়িয়ে দেয় রনি৷ যেন কোলে উঠতে চায়৷ অবাক হয়ে সেই জমাট অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে স্বপ্নময়৷

রনি হাতের উপর ভর দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে৷ তারপর শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় সেই অন্ধকারের দিকে৷ চোখে ভয় নেই ওর৷ ও জানে ওর বাবা কোনও ক্ষতি হতে দেবে না৷ রক্ষা করবে ওকে, সেই বাবা যে এতদিন প্রাণ দিয়ে সাহস দিয়েছে ওকে৷ মায়ের অভাব অনুভব করতে দেয়নি৷ শত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও ছোটো পাখির মতো আগলে রেখেছে৷

অক্ষম পা দুটো ডানাছেঁড়া দেবদুতের মতো মাটির উপরে টানতে টানতে দাতে দাঁত চেপে এগিয়ে যায় রনি৷ স্বপ্নময় খিল হাতে চেয়ে থাকে হামাগুড়ি দিতে থাকা ছেলেটার দিকে৷

অন্ধকারের সামনে গিয়ে মুখ তোলে রনি৷ কাতর চোখে তাকায় সেদিকে৷ কাকে যেন খুঁজছে৷ বিড়বিড় করে ডাকে, ‘বাবা, আমি জানি তুমি আছ৷ আমাকে বাঁচিয়ে নাও বাবা… বাবা…’

রনির ডাক কান্নায় পরিণত হয়৷ অন্ধকারটাও যেন কেঁপে ওঠে সেই কান্নায়৷

সে জানে বাবা ওই অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে৷ লক্ষ রাখছে ওর দিকে৷ ঠিক বাঁচিয়ে নেবে ওকে…

‘বাবা, ও বাবা, শুনছ…’ অসম্ভব বিশ্বাসে ডেকে চলেছে রনি৷

কিছুক্ষণ সেদিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকে স্বপ্নময়৷ খিলের উপরে ওর হাতের জোর আরও শক্ত হয়৷ মুহূর্তে সেটা নেমে আসে নিজের মাথার উপরে৷ গায়ের সমস্ত জোর একত্রে করে নিজের মাথায় খিলটা দিয়ে আঘাত করেছে স্বপ্নময়৷

পেছন ফিরে সেদিকে চেয়ে চিৎকার করে ওঠে রনি৷ স্বপ্নময়ের শরীরটা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে৷ মাথার পেছন থেকে বেরিয়ে আসা সরু রক্তের ধারা গাঢ় হতে থাকে৷

দরজায় ধাক্কা পড়ে পরপর৷ বাইরে থেকে মায়ের গলার চিৎকার শুনতে পায় রনি৷ সঙ্গে পুলিশের হাঁকডাক৷ ক্রমশ সে ডাক ওর কানের ভিতরে হারিয়ে যায়৷ মাথাটা নুয়ে পড়ে ওর বুকের ভিতরে…

(১১)

হাতের ধাক্কায় দরজাটা ভেঙে ফেলার উপক্রম হতে একটা মিহি শব্দ করে ভিতর থেকে খুলে যায় সেটা৷ রক্তের গন্ধ আসে ওদের নাকে৷ একটা দমবন্ধ করা হাওয়া যেন ভয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷

নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে আসেন নির্মল আর তন্দ্রিমা মুখার্জি৷ ঢুকেই আর্ত চিৎকার করে মেঝের উপরে বসে পড়েন৷

একদিকে মেঝের উপরে পড়ে আছে ছোট ছেলে পার্থর দেহটা৷ মাথাটা উলটোদিকে ঘোরানো৷ মাথার পেছনদিকটা থেঁতলানো৷ রক্ত আর ঘিলু বেরিয়ে মাটিতে মিশছে…

দরজার ঠিক পাশেই বসে আছে বাবান৷ হাতে ওর নিজেরই ব্যাটটা৷ তাতেও রক্ত আর গলন্ত ঘিলুর দাগ৷ ধীরে ধীরে ব্যাটটা মাটির উপরে নামিয়ে রাখে সে৷ বাপ-মায়ের দিকে চেয়ে ধীর গলায় বলে, ‘দেখো বাবা, ওর মাথায় ওসব কিচ্ছু নেই, শুধু রক্ত আর… রক্ত…’

আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন দম্পতি৷ বমি করে ফেললেন হড়হড়িয়ে৷ দেওয়ালগুলো যেন এখুনি ফেটে যাবে৷

বাবার দিকে এগিয়ে আসে বাবান, ‘কে করল বলো তো এরকম? ওর মাথাটা এমন করে…’

‘তোকে জন্মের সময়েই মেরে ফেললাম না কেন আমরা?’ সজোরে লাথি খেয়ে ঘরের একদিকে ছিটকে পড়ে বাবান৷ মাথাটা সশব্দে ঠুকে যায় দেওয়ালে৷ গুলিয়ে ওঠে ভিতরটা…

অসহায় চোখে ঘরের ভিতরটা দেখে বাবান৷ কোথাও কেউ নেই যে ওকে উত্তর দেবে৷ যে ওকে বোঝাবে৷ এই লোকগুলো শুধু মারে আর ঠাট্টা করে, অপমান করে, কোথা থেকে কী হয়ে গেল ও নিজেই বুঝতে পারছে না৷ ভাইটাও অমন করে পড়ে আছে…

কোথাও কি কেউ নেই?

অসহায়ের মতো ঘরের ভিতরে তাকায় বাবান৷ দরজার পেছনে অন্ধকার জমে আছে৷ সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কেউ?

অপমান অপদস্থ হয়ে বিছানার উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে খুঁজেছে ওখানে, মাকে, অসহায়ের মতো যাকে পেরেছে খুঁজেছে ওই অন্ধকারে, কাউকে পায়নি…

এখন কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা লোককে দেখতে পেল৷ একটা নাক অবধি মুখোশে ঢাকা লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার পেছনের অন্ধকারে৷ চোখদুটো ঘন কালো৷ হাতে ভারী কী যেন একটা৷ লোকটা ঠোঁটের সামনে আঙুল এনে ইশারায় চুপ করতে বলল ওকে৷ বিড়বিড় করে একটা মজার কবিতা বলছে লোকটা…

হাসি মুখে সেই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল ছেলেটা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *