ফুটবল
‘পরশুরামে’র কেদার চাটুজ্যে মশাই দূর থেকে বিস্তর মেমসাহেব দেখেছিলেন; আমিও দুর থেকে বিস্তর সিনেমা স্টার, পলিটিশিয়ান আর ফুটবল খেলোয়াড় দেখেছি। দেখে ওঁদের প্রতি ভক্তি হয়েছে এবং গদগদ হয়ে মনে মনে ওঁদের পেন্নাম জানিয়েছি।
তাই কি করে যে ইস্টবেঙ্গল’ ক্লাবের কয়েকজন খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার মশায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল তার সঠিক ব্যাখ্যা আমি এখনো সমঝে উঠতে পারি নি। তবে শুনেছি। আমরা যে-রকম খাঁচার ভিতর সিংহ দেখে খুশি হই, সিংহাঁটাও নাকি আমাদের দিকে কৌতূহলের সঙ্গে তাকায়, তার বিশ্বাস মানুষকে নাকি জড়ো করা হয় নিছক তাকে আনন্দ দেবার জন্য, যেদিন লোকের সংখ্যা কম হয় সেদিন নাকি সিংহ রীতিমত মন-মরা হয়ে যায়। (আরো শুনেছি, একটা খাঁচার গোটকয়েক শিক ভেঙে যাওয়াতে গরিলা নাকি দস্তুরমত ভয় পেয়ে গিয়ে পেছন-ফিরে দাঁড়িয়েছিল—তার বিশ্বাস ছিল খাঁচাঁটার উদ্দেশ্য তাকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।)
তাই যখন ইস্টবেঙ্গলে’র গুটিকয়েক রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমার দিকে তাকালেন। তখন আমি খুশি হলুম। বইকি। তারপর তাঁদের মাধ্যমে আর সকলের সঙ্গেও মোলাকত হয়ে গেল। সব কটি চমৎকার ভদ্রসন্তান, বিনয়ী এবং নত্ৰ। আমি বরঞ্চ সদম্ভে তাদের শুনিয়ে দিলুম ছেলেবেলার ‘বী’ টিমের খেলাতে কি রকম কায়দাসে একখানা গোল লাগিয়ে দিয়েছিলুম, অবশ্য সেটা সুইসাইডু গোল ছিল।
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাদের খেলা দেখতে যাবো কি না? বললুম, ফাইনালের দিন নিশ্চয়ই দেখতে যাবো। ম্যানেজার বললেন, তা হলে তো যে-করেই হোক ফাইনাল পর্যন্ত উঠতে হবে-বিবেচনা করুন, একমাত্র নিতান্ত আমাকে খুশি করার জন্যই তাঁদের কি বিপুল আগ্ৰহ!
ফাইনালের দিন ম্যানেজার আমাকে আমার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
***
দিল্লিতে ফুটবলের কদর কম। খেলা আরম্ভ হওয়ার পনেরো মিনিট পূর্বে গিয়েও দিব্য সীট পাওয়া গেল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম আমার এক চ্যালাকে–শিটিফিটি দেওয়ার জন্য। পরে দেখলুম, ও ওসব পারে না, সে জন্মেছে পশ্চিমে। বললুম, ‘আরো বাপু মুখে আঙুল পুরে যদি হুইসিলই না দিতে পারিস তবে ফুটবল খেলা দেখতে এসেছিস কেন? রবিঠাকুরের ‘ডাকঘর’ দেখতে গেলেই পারিস।’
খেলা দেখতে এসেছে বাঙালি-তাদের অধিকাংশ আবার পদ্মার ও-পারের–আর মিলিটারি; এই দুই সম্প্রদায়। মিলিটারি এসেছে গোর্খা টিমকে সাহস দেবার জন্য, আর আমরা কি করতে গিয়েছি সে-কথা তো আর খুলে বলতে হবে না। অবশ্য আমাদের ভিতর যে ‘মোহনবাগান’ কিংবা ‘কালীঘাট’ ফ্যান ছিলেন না, সে-কথা বলব না, তবে কলকাতা থেকে এত দূরে বিদেশে তারা তো আর গোর্থীদের পক্ষ নিতে পারেন না। ‘দোস্ত নীপ্ত, লেকিন দুশমন ই-দুশমন হস্ত’ অর্থাৎ ‘মিত্র নয়।’ তবে শক্রর শত্রু’। এই ফাঁসী প্ৰবাদ সর্বত্র খাটে না।
পিছনে দুই সর্দািরজী বড্ড ভ্যাচর ভ্যাচর করতে লাগল। ইস্টবেঙ্গল নাকি ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছে নিতান্ত লোকসে কপাল জোরে, ওরা নাকি বড্ড রাফ খেলে। সবুট গোখার সঙ্গে রাফ খেলবে ইস্টবেঙ্গল! আর পদে পদে নাকি অফ-সাইডু। ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটাকে ধুঘা বসিয়ে দি কিন্তু তার বপুটা দেখে সাহস হল না।
***
খেলার পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই আমার মনে দৃঢ়প্রত্যয় হল ইস্টবেঙ্গল নিশ্চয় জিতবে। দশ মিনিটের ভিতর গোখরা গোটাচারেক ফাউল করলে আর ইস্টবেঙ্গল গোটাতিনেক গোল দেবার মোক নির্মমভাবে মিস করলে। একবার তো বলটা গোল-বারের ভিতরে লেগে দুম করে পড়ে গেল গোল লাইনের উপর। গোলি সেটা তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেললে। আমি দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বললুম, ‘হে মা কালী, বাবা মৌলা আলী, তোমাদের জোড়া পাঠা দেব, কিন্তু এরকম আস্কারা দিয়ে মস্কোরা কোরো না, মাইরি।’ বলেই মনে পড়ল ‘মাইরি’ কথাটা এসেছে ‘মেরি’ থেকে। থুড়ি থুড়ি বলে দুৰ্গা, দুৰ্গা, দুৰ্গতিনাশিনী’কে স্মরণ করলুম।
হাফ-টাইম হতে চলল গোল আর হয় না—এ কী গৰ্ব্ববাযস্তনা রে, বাবা। ওদিকে অবশ্য ফাউলের সংখ্যা কমে গিয়েছে—রেফারি দেখলুম বেজায় দাঁড় লোক। কেউ পাউল করলে তার কাছে ছুটে গিয়ে বেশ দুকথা শুনিয়েও দেয়। জীত রহো বেটা। ফাউলগুলো সামলাও, তারপর ইস্টবেঙ্গলকে ঠ্যাকাবে কেন্ডা।
নাঃ, হাফ-টাইম হয়ে গেল। খেলা তখনো আঁটকুড়ী–গোল হয় নি।
ওহে চানাচুর-বাদাম-ভাজা, এদিকে এসো তো, বাবা। না, থাক, শরবতই খাই। চোঁচাতে চোঁচাতে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। চ্যালাই পয়সাটা দিলে; তা দেবে না? যখন হুইসিল দিতে জানে না। রেফারি। আর কবার হুইসিল বাজালে? সমস্তক্ষণ তো বাজালুম আমিই।
***
হাফ-টাইমের পর খেলাটা যদি দেখতেন! সপাসপ আরম্ভ হল পোলো দিয়ে রুই মাছ ধরার মত গোল মারা।
আমি তো খেলার রিপোর্টার নই, তাই কে যে কাকে পাস করলে, কে কখন প্যার্টন উইভ করলে, কে কজন দুশমনকে নাচালে লক্ষ্য করি নি, তবে এটা স্পষ্ট দেখলুম, বলাটাই যেন মনস্থির করে ফেলেছে, সবাইকে এড়িয়ে গোখার গোলে ঢুকবেই ঢুকবে। একে পাশ কাটিয়ে, ওর মাথার উপর দিয়ে, কখনো বা তিন কদম পেছিয়ে গিয়ে, কখনো বা কারো দু’পায়ের মধ্যিখানের ফাঁক দিয়ে বলটা হঠাৎ দেখি ধাই করে হাওয়ায় চড়ে গোখা গোলের সামনে! সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎপিণ্ডটা এক লম্ফ দিয়ে টনসিলে এসে আটকে গিয়েছেবিকৃতস্বরে বেরল ‘গো-অ-অ-ল!’ (‘রূপদর্শী’ দ্রষ্টব্য)।
ফুটবল ভাষায় একটি তীব্র ‘সট’–এর (‘Sot’-shot নয়) ফলে গোলটি হল।
পিছনের সর্দারাজী বললেন, ‘ইয়ে গোল বাচানা মুশকিল। নহী থা।’
আমি মনে মনে বললুম, ‘সাহিত্যে একে আমরা বলি, ‘মুখবন্ধ’। এরপর আরো গোটা দুই হলে তোমার মুখ বন্ধ হবে। লোকটা জোরালো না হলে—।’
***
এ সব ভাবাভাবির পূর্বেই আরেকখানা সরেস গোল হয়ে গিয়েছে। কেউ দেখল, কেউ না। একদম বেমালুম। তারই ধকল কাটাতে কাটাতে আরেকখানা, তিসরা অতিশয় মান-মনোহর গোল! সেটি স্পষ্ট দেখতে পেলুম। ও গোল কেউ বঁচাতে পারত না। দশটা গোলি লাগিয়ে দিলেও না।
এবার ম্যানেজারকে অভিনন্দন জানানো যেতে পারে। উঠে গিয়ে তাকে জোর শ্যাকহ্যান্ড করলুম। ভারী খুশি। আমায় বললে, ‘প্ৰত্যেক গোলে আপনার রি-একশন লক্ষ্য করছিলাম। আমরা আমাদের কথা রেখেছি (অর্থাৎ ফাইন্যালে উঠেছি)। আর আপনিও আপনার কথা রেখেছেন (আমি কথা দিয়েছিলুম ওরা ফাইনালে জিতবেই)।’ তার সঙ্গী তো আমার হাতখানা কপালে ঠেকালে।
মোরগ যে রকম গটগট করে গোবরের টিবিতে ওঠে। আমি তেমনি আমার চেয়ারে ফিরে এলুম। ভাবখানা, তিনটে গোলই যেন নিতান্ত আমিই দিয়েছি।
তারপর শাঁ করে আরো একখানা। দশ-বারো মিনিটের ভিতর ধনাধন চারখানা আদি ও অকৃত্রিম, খাঁটি-নিৰ্ভেজাল গোল!
পিছনের সর্দারাজী চুপ।
চ্যালাকে বললুম, চলো বাড়ি যাই। খেলা কি করে জিততে হয়, হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলুম তো!’
রাত্রে সব খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানাতে গেলুম। গিয়ে দেখি এক ঢাউস ট্রফি। সঙ্গে আরেকটা বাচ্চা। বললুম, ‘বাচ্চাটাই ভালো। বড়টা রাখা শক্ত (উভয়ার্থে)।’
ওদেরই বিস্তর নাইন-নাইন্টি পুড়িয়ে বাড়ি ফিরলুম।