ফিরোজা মুকুট রহস্য

ফিরোজা মুকুট রহস্য

প্রথম পরিচ্ছেদ – ছন্নছাড়া পথিক

জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলুম৷ রাস্তার দিকে মুখ বাড়িয়ে বললুম, ‘জয়ন্ত, পথ দিয়ে একটা পাগল যাচ্ছে৷ ওর আত্মীয়স্বজন কীরকম লোক জানি না, এমন মানুষকেও একলা পথে বেরোতে দেয়!’

জয়ন্ত উঠে এসে পিছন থেকে আমার কাঁধের উপরে মুখ বাড়িয়ে দেখলে৷

বর্ষাকাল৷ উপরি উপরি কয়েক দিন ধরে প্রবল ধারাপাতের পর কাল থেকে বৃষ্টি থেমেছে বটে, কিন্তু আকাশ এখনও মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে৷ হু-হু করে বইছে কনকনে হাওয়া৷ রাজপথের উপরে পুরু কর্দমের প্রলেপ৷ দিনের বেলাতেই সাঁঝের ছায়ার ইঙ্গিত৷ যেকোনো মুহূর্তে আবার বৃষ্টির পালা শুরু হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে রাজপথ জনশূন্য৷ দেখা যাচ্ছে কেবল পাগলের মতো দেখতে একটিমাত্র মানুষকে৷

লোকটির বয়স হবে বোধ হয় বছর পঞ্চাশ৷ হোমরাচোমরা লম্বা-চওড়া চেহারা, সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, মনে জাগায় সম্ভ্রম৷ সাজপোশাকও জমকালো৷ কিন্তু লোকটির চেহারার সঙ্গে তার চালচলন মোটেই খাপ খাচ্ছিল না৷ সে বেগে ছুটতে ছুটতে মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছে৷ থেকে থেকে দুই হাত ছুড়ছে এবং বিকৃত মুখভঙ্গি করছে৷

আমি বললুম, ‘ব্যাপার কী বল দেখি? ও ঘন ঘন মুখ তুলে বাড়িগুলোর নম্বর দেখছে কেন?’

জয়ন্ত বললে, ‘আমার বিশ্বাস ও আমাদেরই বাড়ি খুঁজছে৷’

-‘হ্যাঁ৷ বোধ হয় ও কোনো বিপদে পড়েছে, আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আসছে৷ ওই দেখো, যা ভেবেছি তাই!’

মূর্তিটা আমাদের বাড়ির সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে খুব জোরে জোরে কড়ানাড়া দিতে লাগল৷

আমাদের বেয়ারা মধু যখন তাকে উপরে নিয়ে এল, তখনও সে হাঁপাতে হাঁপাতে বিকৃত মুখভঙ্গি করতে লাগল বটে, কিন্তু তার স্তম্ভিত চোখ দু-টির ভিতরে এমন মর্মস্পর্শী যাতনা ও নিরাশার ভাব দেখলুম যে, আমরা আর হাসতে পারলুম না, মন ভরে উঠল সকরুণ সমবেদনায়৷

খানিকক্ষণ সে কোনো কথাই কইতে পারলে না, পাগলের মতো দুই হাতে মাথার চুল ধরে টানাটানি করতে লাগল, তারপর হঠাৎ দেওয়ালের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এত জোরে মাথা ঠুকলে যে, আমরা দু-জনেই তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ঘরের মাঝখানে টেনে আনলুম৷

জয়ন্ত তাকে একখানা ইজিচেয়ারের উপরে বসিয়ে, নিজেও তার পাশে আসন গ্রহণ করলে৷ তারপর শান্ত, মিষ্ট স্বরে বললে, ‘আপনি আমাদের কাছে নিজের বিপদের কথা বলতে এসেছেন, তাই নয় কি? বেশ, আগে একটু বিশ্রাম করুন, তারপর আমরা আপনার কথা শুনব৷’

লোকটি প্রথমে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগল৷ তারপর নিজেকে কতকটা সামলে নিয়ে রুমাল বার করে কপাল মুছতে মুছতে বললে, ‘আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে পাগল বলে মনে করেছেন?’

জয়ন্ত বললে, ‘বিপদে পড়লে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না৷ আপনার বিপদটা কী, শুনতে পাই না?’

-‘ভগবান জানেন আমার বিপদ কী ভয়ানক! বিনা মেঘে এমন বজ্রপাত কল্পনাতেও আনা যায় না৷ আমার মানসম্ভ্রম সব যেতে বসেছে, তার উপরে সংসারেও দারুণ দুর্ঘটনা উপস্থিত৷ ঘরে-বাইরে আচমকা দুর্ভাগ্যের আক্রমণে আমি যে সত্য সত্যই পাগল হয়ে যাইনি, এইটেই হচ্ছে আশ্চর্য! কেবল আমি নই মশাই, আমার দুর্ভাগ্যের অংশ গ্রহণ করতে হবে আর একজন দেশবিখ্যাত ব্যক্তিকেও৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আপনার মনের কথা ধীরে-সুস্থে খুলে বলুন৷ দেখি, আমরা আপনার কোনো উপায় করতে পারি কি না!’

-‘আমার নাম মহিমচন্দ্র রায়চৌধুরী৷ মহাজনি ব্যবসায়ে আমার কিছু নাম আছে৷’

এ নাম দেশের কে না জানে? বিখ্যাত তাঁর ব্যাঙ্ক-দেশ-বিদেশে তার শাখা৷ তার চেয়ে বড়ো প্রাইভেট ব্যাঙ্ক এদেশে আর নেই৷ মহিমবাবুর মতো ধনকুবের এমন কী বিপদে পড়েছেন, যার জন্যে তাঁকে উদভ্রান্ত অবস্থায় আমাদের কাছে ছুটে আসতে হয়েছে? আমাদের মন ভরে উঠল বিস্ময়ে এবং কৌতূহলে৷

এতক্ষণ পরে যথাসম্ভব প্রকৃতিস্থ হয়ে মহিমবাবু বললেন, ‘মশাই, আমার মামলা এখন পুলিশের হাতে গিয়েছে৷ পুলিশ কী করবে না করবে জানি না, কিন্তু আপনার উপরে বিশ্বাস আমার অটল৷ পথের মাঝখানে আমার মোটরও আবার কল বিগড়ে বাদ সাধলে৷ তাই আমি পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে আপনার কাছে এসেছি৷ এইবার শুনুন আমার বিপদের কথা৷’

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মহিমবাবুর কাহিনি

‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ব্যাঙ্ক কেবল টাকা জমা রাখে না, লেনদেনের কারবারও চালায়৷ অনেক বড়ো বড়ো পরিবার আমাদের কাছে গহনা, মূল্যবান জিনিসপত্র বা জমি বন্ধক রাখেন, বিনিময়ে আমারাও টাকা ধার দিই৷

‘কাল সকালে এমন এক ব্যক্তি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন, যাঁকে দেখে আমি অভাবিত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম৷ কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা ভারতবর্ষের লোক তাঁর নাম জানে৷ এমনকী ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাঁর নাম অপরিচিত নয়৷ তাঁর অন্য কোনো পরিচয় আমি দিতে পারব না, কেবল এইটুকু জেনে রাখুন, তিনি একজন মহামান্য মহারাজা৷

‘আমার বাড়িতে তাঁর পদার্পণে আমি সম্মানিত হয়েছি-তাঁকে এইরকম কোনো অভিনন্দন দিতে উদ্যত হলুম, কিন্তু তার আগেই তিনি একেবারে কাজের কথা পেড়ে বসলেন৷ বললেন, মহিমবাবু, শুনেছি আপনারা টাকা ধার দেন?

‘বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, যদি ভালো সিকিউরিটি থাকে৷

-‘আজকেই আমার ত্রিশ লক্ষ টাকার নিতান্ত দরকার৷ আমার কাছে অবশ্য এই টাকার পরিমাণ তুচ্ছ, আমি অনায়াসেই বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে এই টাকাটা সংগ্রহ করতে পারি, কিন্তু আমি কারুর কাছে বাধ্যবাধকতা স্বীকার করতে প্রস্তুত নই৷

-‘কতদিনের জন্যে আপনি টাকা চান?

-‘এক হপ্তার জন্যে৷ এক সপ্তাহ পরে সমস্ত টাকা নিশ্চয়ই আমি সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেব৷

-‘কিন্তু আমি মহাজন৷ কীসের বিনিময়ে আমি ত্রিশ লক্ষ টাকা দেব, সেটাও আমার জানা দরকার৷

-‘নিশ্চয়ই, সেজন্যে আমি প্রস্তুত হয়ে এসেছি৷

‘মহারাজা সঙ্গে করে এনেছিলেন একটি চৌকো মরক্কো কেস৷ তিনি তার ডালা খুলে আমাকে দেখালেন৷

‘ভিতরে নরম মখমলের বিছানায় বসানো আছে এক অপূর্ব ও বিচিত্র রত্নমুকুট৷ নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি এবং তার উপরে আছে মস্ত মস্ত ফিকে নীল চল্লিশখানা ফিরোজা৷ তার সোনার কাজও অসাধারণ৷ এই রত্নমুকুটের কথা আমিও শুনেছি, মহারাজের নামের মতো তার খ্যাতিও ফেরে লোকের মুখে মুখে৷

‘মহারাজা বললেন, আমি যে টাকা চাই, তার চেয়ে মুকুটের দাম দুই গুণ বেশি৷ এইটেই আমি আপনার কাছে বন্ধক রাখতে চাই৷

‘মুকুট হাতে করে আমি বসে রইলুম কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ়ের মতো৷

‘মহারাজা শুধোলেন, এর মূল্য সম্বন্ধে আপনার কোনো সন্দেহ আছে?

-‘বিন্দুমাত্র না৷ আমি ভাবছি-

-‘এমন অমূল্য জিনিস কেন আমি এখানে রেখে যেতে চাই? হ্যাঁ, আমিও রেখে যেতুম না, যদি এক সপ্তাহ পরে এটা ফিরিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি আমার না থাকত৷ এখন আপনার মত কী?

-‘আমি রাজি৷

-‘কিন্তু দেখবেন, একথা নিয়ে যেন বাজারে আলোচনা না হয়৷ খুব সাবধানে মুকুটটিকে রাখবেন৷ এটি আমার পৈতৃক সম্পত্তি৷ এই দুর্লভ জিনিস হারালে আমার রাজ্যে ঢিঢিকার পড়ে যাবে৷ এতে যে ফিরোজাগুলি আছে, তার মতো আর একখানি পাথর সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাওয়া যাবে না৷

‘সেইদিনই মহারাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিলুম৷ কিন্তু তারপরে পড়ে গেলুম দারুণ দুশ্চিন্তায়৷ বার বার মনে হতে লাগল, এত বড়ো ঝক্কি ঘাড়ে নিয়ে বড়ো ভালো কাজ করা হল না৷ এ লেনদেনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না রাখাই উচিত ছিল৷ ফিরোজা রত্নমুকুট যদি হারায়, তাহলে কেবল আমার সমস্ত সুনাম নষ্ট হবে না, সেই সঙ্গে হবে আমার সর্বনাশও৷

‘মুকুটটিকে আমার আপিসে রাখাও যুক্তিযুক্ত মনে করলুম না৷ ব্যাঙ্কে তো আজকাল আকচার চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, কেউ যদি সন্ধান পায়, আমার উপরেও শনির দৃষ্টি পড়তে কতক্ষণ? মুকুট সঙ্গে নিয়ে আমি ভয়ে ভয়ে আমার বালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে এলাম এবং যতক্ষণ না আমার উপরের ঘরের আলমারির ভিতরে সেটি রেখে দিলুম, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে পারলুম না৷

‘জয়ন্তবাবু, এইবারে আগে আমার সংসারের কথা কিছু শুনুন৷

‘আমার চারকবাকররা শোয় বাড়ির বাইরে৷ ভিতরে থাকে তিন জন দাসী, তারা পুরোনো লোক, সকল সন্দেহের অতীত৷ আর একটি নূতন দাসী এসেছে, নাম তার ননিবালা, বয়স অল্প৷ আজ মাসকয় কাজ করছে৷ কিন্তু তারও আচরণ ভালো৷

‘আমার নিজের পরিবার বড়ো নয়৷ আমি বিপত্নীক৷ আমার একটিমাত্র ছেলে, নাম সুবিমল৷ বয়সে যুবক৷ তার জন্যেই আমার যত দুর্ভাবনা৷ সে হচ্ছে বিলাসী, চঞ্চলমতি, আমোদপ্রিয়, অমিতব্যয়ী৷ সে আমার কারবারের উপযোগী নয়, তার হাতে বেশি টাকা দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি না৷ তার স্বভাবের জন্যে লোকে দায়ী করে আমাকেই৷ বলে, আমিই আদর দিয়ে দিয়ে তার মাথা খেয়েছি৷ হয়তো কথাটা নিতান্ত মিথ্যা নয়৷ একে সে আমার একমাত্র সন্তান, তার উপরে অল্পবয়সেই মাতৃহারা৷ তার মুখ ম্রিয়মাণ দেখলে আমার বুক ফেটে যায়৷

‘সুবিমলের বন্ধুরা সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিষ্কর্মা ছেলে৷ সেও তাদের মতো আমোদপ্রমোদ করতে আর দু-হাতে টাকা ওড়াতে চায়৷ তাদের এক ক্লাব আছে, সেখানে তাসের জুয়া চলে৷ ক্লাবে আর ঘোড়দৌড়ের মাঠে সুবিমল যে কত টাকা নষ্ট করেছে তার কোনো হিসাব নেই৷ আমি তাকে মোটা মাসোহারা দিই, তাতেও তার খরচ কুলোয় না৷ প্রতি মাসেই আমার কাছ থেকে সে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে৷

‘মাঝে মাঝে তার সুবুদ্ধি হয়, ওইসব বিপদজনক বন্ধুর সম্পর্ক ছাড়বার চেষ্টা করে৷ কিন্তু সে চেষ্টা তার সফল হয় না আর একজনের জন্যে৷ নাম তার কুমার মহেন্দ্র নারায়ণ, আমরা কুমার বাহাদুর বলে ডাকি৷ সে রাজবংশের ছেলে, সুবিমলের চেয়ে বয়সে বড়ো৷ অনেক দেশে বেড়িয়েছে, অনেকরকম লোকের সঙ্গে মিশেছে, কথা কয় চমৎকার, দেখতেও পরমসুন্দর৷ সুবিমলের উপরে তার প্রবল প্রভাব, তার কথায় সে ওঠে-বসে৷ কিন্তু তার মতামত স্বাস্থ্যকর নয়, তার ভাবভঙ্গিও আমার ভালো লাগে না৷ সে আমার বাড়িতে যখন-তখন আসে৷ আমাদের অমলাও তাকে পছন্দ করে না৷ অমলার বয়স বেশি না হলেও লোকের চরিত্র বোঝে৷

‘এইবারে অমলার পরিচয়ও দিই৷ সে আমার এক পরলোকগত বাল্যবন্ধুর মেয়ে, আমাদেরই স্বজাতি৷ তার বয়স যখন আট-নয় বৎসর, সেই সময়ে তার পিতা তাকে একান্ত অসহায় অবস্থায় রেখে হঠাৎ মারা পড়েন৷ আমাকেই অমলার ভার গ্রহণ করতে হয়৷ সেই থেকেই এ বাড়িতে সে আমার নিজের মেয়ের মতো লালিতপালিত হয়েছে৷ আমার এই অন্ধকার বাড়িকে সে আলো করে আছে সোনালি রোদের মতো৷ একটি শান্ত, নম্র, স্নেহময়ী তরুণী, সে না থাকলে অচল হয়ে পড়ে আমার জীবন৷

‘অমলা আমার সব কথা রাখে, কেবল একটি ছাড়া৷ সুবিমল দুই-দুই বার তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিল, তাকে সে সত্যসত্যই ভালোবাসে৷ কিন্তু অমলা রাজি হয়নি৷ আমার দৃঢ়বিশ্বাস, একমাত্র সেই-ই সুবিমলকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে, একমাত্র অমলাই পারে তার জীবনকে নূতনভাবে গড়ে তুলতে৷ কিন্তু এখন আমার সকল আশা বিফল হয়েছে-আর তা হবার নয়, হবার নয়৷’

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মহিমবাবুর কাহিনির জের

‘রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সুবিমল ও অমলার সঙ্গে গল্প করছিলুম৷ তাদের ফিরোজা মুকুটের কথা বললুম৷ পানের ডিবে দিয়ে যাবার জন্যে সেই সময়ে ননিবালা একবার ঘরের ভিতরে এসেছিল৷

‘সুবিমল ও অমলা দুই জনেই মুকুটটা দেখবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে৷ কিন্তু আমি রাজি হলুম না৷

‘সুবিমল সুধোলে, মুকুটটা তুমি কোথায় রেখেছ?

-‘আমার শোবার ঘরের আলমারিতে৷

-‘ভগবান করুন আজ রাত্রে বাড়িতে যেন চোর না আসে৷

-‘আলমারি চাবি বন্ধ৷

-‘যেকোনো পুরোনো চাবি দিয়ে ও আলমারি খোলা যায়৷ ছেলেবেলায় আমি নিজেই খুলেছি৷

-‘কিন্তু ঘরের ভিতরে থাকব আমি৷

-‘হ্যাঁ, ঘুমিয়ে৷

‘শয়ন করবার জন্যে উপরে উঠলুম৷ সঙ্গে সঙ্গে এল সুবিমল৷ মুখ তার গম্ভীর৷ আমার শোবার ঘরে ঢুকে বললে, বাবা, আমাকে দু-হাজার টাকা দিতে পারবে?

‘আমি বললুম, অসম্ভব! তোমাকে যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে৷

-‘জানি বাবা, এজন্যে আমার কোনো অভিযোগ নেই৷ কিন্তু দু-হাজার টাকা আদায় আমার নিতান্তই দরকার৷ টাকা না পেলে ক্লাবে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না৷

-‘তোমার পক্ষে সেটা হবে শাপে বর৷

-‘কিন্তু সবাই বলবে আমি জুয়াচোর৷ সে অপমান আমি সইতে পারব না৷ যেমন করে পারি এ ঋণ আমাকে শোধ করতেই হবে৷

‘আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললুম, এই মাসেই আরও দুই বার তুমি আমার কাছ থেকে উপরি টাকা আদায় করেছ৷ আমার কাছ থেকে আর একটা কানাকড়িরও প্রত্যাশা কোরো না৷

‘সে আর কিছু বললে না, মাথা হেঁট করে বাইরে বেরিয়ে গেল৷

‘সে রাত্রে আমি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করলুম৷ নীচেকার সব দরজা ভালো করে বন্ধ আছে কি না দেখবার জন্যে আবার একতলায় নামলুম৷ সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৈঠকখানায় ঢুকতে দেখি, অমলা ওদিককার একটা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে৷

‘সে বললে, কাকাবাবু, আপনি কি আজ রাত্রে ননিবালাকে বাইরে যাবার ছুটি দিয়েছিলেন?

‘বললুম, না৷

-‘এইমাত্র সে বাইরে থেকে ফিরে এল৷ এ সব ভালো কথা নয়৷

-‘বেশ, কাল সকালে আমি নিজেই তাকে সাবধান করে দেব৷ বাড়ির দরজা বন্ধ আছে তো?

-‘হ্যাঁ কাকাবাবু৷

‘আমার ঘুম খুব গাঢ় হয় না৷ বিশেষত কাল রাত্রে আমার মনটা উদ্বিগ্ন ছিল বলে ভালো করে ঘুম হয়নি৷ গভীর রাত্রে হঠাৎ কী একটা শব্দে আমি জেগে উঠলুম৷ কান পেতে শুনতে লাগলুম৷ মনে হল, বাড়ির কোথায় কে যেন একটা দরজা বন্ধ করে দিলে৷ তারপর সভয়ে শুনলুম, পাশের ঘরে কে যেন সন্তর্পণে পা ফেলে চলে বেড়াচ্ছে৷ এইখানে বলে রাখা উচিত, ঘুমোবার আগে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করার অভ্যাস আমার ছিল না৷

‘তখনি খাট থেকে নেমে পড়লুম৷ দরজার পাল্লা একটু ফাঁক করে দেখলুম, পাশের ঘরে আলো জ্বলছে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুবিমল, তার গায়ে গেঞ্জি, পায়ে জুতো নেই, আর হাতে রয়েছে সেই ফিরোজা মুকুট৷ সে মুকুটটা সজোরে মুচড়ে বা নুইয়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল৷

‘একলাফে পাশের ঘরে গিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, সুবিমল! চোর, দুরাত্মা!

‘আমার চিৎকার শুনে সে চমকে উঠল, তার হাত থেকে খসে মুকুটটা মাটির উপরে পড়ে গেল সশব্দে৷ তাড়াতাড়ি আমি সেটাকে তুলে নিয়ে দেখলুম, তিন খণ্ড ফিরোজা অদৃশ্য৷ -তার একটা প্রান্ত ভাঙা৷

‘বিবর্ণ মুখে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুবিমল৷ আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললুম, বদমাইস, তুই এটা ভেঙে ফেলেছিস! আমার মানসম্ভ্রম ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছিস! কোথায় গেল আর তিনখানা পাথর?

‘সে বললে, চুরি গেছে৷

‘তাকে ধাক্কা মেরে বললুম, চুরি করেছিস তুই!

-‘না৷

-‘তুই কেবল চোর নোস, মিথ্যেবাদীও! আমি স্বচক্ষে দেখলুম আরও পাথর চুরি করবার জন্যে তুই মুকুটটা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিস!

‘সে বললে, বাবা তুমি আমাকে যথেষ্ট গালাগাল দিয়েছ৷ এরপরে এ বিষয় নিয়ে আমি আর কোনো কথাই বলব না৷ কাল সকালেই আমি তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করব৷

-‘হ্যাঁ, কাল সকালে তোকে এ বাড়ি থেকে যেতে হবে বটে, কিন্তু যেতে হবে পুলিশের সঙ্গে৷

‘এইবারে ক্রোধারক্ত মুখে সে বললে, উত্তম৷ তবে তাই হোক৷

‘ইতিমধ্যে আমার চিৎকার শুনে গোটা বাড়ি জেগে উঠেছে৷ সর্বপ্রথমে সেখানে ছুটে এল অমলা৷ সুবিমলের মুখ ও আমার হাতের মুকুট দেখে তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না, একটা আর্তনাদ করে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল৷

‘সকালে পুলিশ এল৷ সুবিমল বললে, বাবা তাহলে তুমি আমাকেই চোর সাব্যস্ত করলে?

-‘তা ছাড়া আর উপায় নেই৷ আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি না৷

-‘তাহলে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্যে আমাকে একবার বাড়ির বাইরে যেতে দাও৷

-‘বুঝেছি, তুমি সরে পড়তে চাও? তা হয় না৷ কেবল এক শর্তে তোমাকে আমি ক্ষমা করতে পারি৷ পাথর তিনখানা যদি ফিরিয়ে দাও৷

‘সে বলতে বলতে চলে গেল, তোমার ক্ষমা যে চায়, তাকে তুমি ক্ষমা কোরো৷ আমি ক্ষমাপ্রার্থী নই৷

‘সুবিমলকে আমি পুলিশের হাতে সমর্পণ করেছি৷ পুলিশ কিন্তু তার কাপড়চোপড় খুঁজেও এবং সারা বাড়ি খানাতল্লাস করেও পাথর তিনখানা উদ্ধার করতে পারেনি৷ সুবিমলও স্বীকার করেনি কোনো কথা, একেবারেই যেন বোবা হয়ে গিয়েছে৷

‘এই আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনি৷ ভগবান, আমি এখন কী করব? এক রাত্রেই আমি আমার সম্মান, আমার বন্ধকি রত্ন, আমার সন্তানকে হারালুম৷ আমি এখন কী করব?’

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অমলা দেবী

জয়ন্ত খানিকক্ষণ বসে রইল স্তব্ধভাবে৷ তারপর শুধোলে, ‘মহিমবাবু, আপনার বাড়িতে কি বেশি লোকের আনাগোনা আছে?’

-‘মাঝে মাঝে দু-একজন আত্মীয়কুটুম্ব খবরাখবর নিতে আসেন৷ বাইরের লোকের মধ্যে নিয়মিত আনাগোনা করেন কুমার বাহাদুর৷’

-‘আপনি কি সামাজিকতা রক্ষার জন্যে নানা জায়গায় আসা-যাওয়া করেন?’

-‘সুবিমল করে৷ আমি আর অমলা বাড়িতেই থাকি৷ সামাজিকতার জন্যে আমাদের মাথাব্যথা নেই৷’

-‘এরকম তরুণীর কথা কম শোনা যায়৷ আপনার কথা শুনে বোঝা যায়, মুকুটের ব্যাপারের জন্যে অমলা দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন৷’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার চেয়েও৷’

-‘সুবিমলবাবু যে অপরাধী সে বিষয়ে আপনাদের কোনো সন্দেহ নেই?’

-‘কী করে থাকবে? আমি যে নিজের চোখে দেখেছি!’

-‘যে শব্দ শুনে আপনার ঘুম ভেঙে যায়, সে সম্বন্ধে পুলিশের মত কী?’

-‘তাদের মতে সুবিমল ঘর থেকে বেরিয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল৷’

-‘বাজে কথা৷ চোর কখনো পাড়া জাগিয়ে চুরি করে না৷ শব্দ হয়েছে অন্য কারণে৷ এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷’

-‘কারণটা কী?’

-‘আমি তা জানি না৷ মহিমবাবু, মামলাটা আপনি সহজ মনে করছেন, কিন্তু আমার মতে এটা হচ্ছে জটিল মামলা৷ আপনি অনুমান করেছেন, আপনার ছেলে নিজের ঘরের দরজা সশব্দে ভেজিয়ে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন৷ তাহলে তিনি মুকুটটা কখন চুরি করলেন? আর এই অল্প সময়ের মধ্যে পাথর তিনখানা লুকিয়েই বা রাখলেন কোথায়? না মহিমবাবু, এই ঘটনার মধ্যে আছে অজানা কোনো রহস্য৷’

-‘কী রহস্য?’

-‘সেইটেই এখন আবিষ্কার করতে হবে৷ আপাতত আপনার ঠিকানা রেখে আপনি বাড়ি ফিরে যান৷ একটু পরেই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হব৷’

বড়ো রাস্তা থেকে একটু তফাতে মহিমবাবুর মস্ত বাড়ি৷ সামনে খানিকটা খোলা জমি৷ ডান দিকে একটি ছোটো কাঁচা রাস্তা৷ বাড়ির দুটো ফটক-একটি বড়ো, একটি ছোটো৷ বড়ো ফটকটি বাড়ির সামনের দিকে এবং দ্বিতীয়টিকে বলা চলে খিড়কির ফটক, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলে ব্যবহার করতে হয় কাঁচা রাস্তাটি৷

বড়ো ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং মহিমবাবু৷

জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, তুমি খানিকক্ষণ মহিমবাবুর সঙ্গে আলাপ করো, আমি আগে বাড়ির চারিদিকটা ঘুরে দেখে আসি৷’

মহিমবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বৈঠকখানায়৷ তাঁর মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন, কথাবার্তা বড়ো একটা হল না৷

মিনিট কয়েক পরেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন একটি তরুণী৷ সুদর্শনা, সুগঠনা কিন্তু তাঁর চোখের ভাব আর্ত, মুখ একেবারে পাণ্ডুর৷ দেহখানি দেখলেও বোধ হয়, দুঃখের ভার সইতে না পেরে এখনি তা ভেঙে পড়বে৷ আন্দাজে বুঝলুম, ইনিই হচ্ছেন অমলা দেবী৷

অমলা আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না, একেবারে মহিমবাবুর কাছে গিয়ে তাঁর একখানি হাত ধরে বললেন, ‘কাকাবাবু, সুবিমলদাকে তুমি ছেড়ে দিতে বলেছ তো?’

মহিমবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না মা, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত না দেখলে চলবে না৷’

-‘না কাকাবাবু৷ আমি বলছি তিনি নির্দোষ৷’

-‘তাহলে অপরাধী কে?’

-‘আমি জানি না৷ কিন্তু সুবিমলদা পুলিশের হাতে, একথা যে কল্পনা করা যায় না কাকাবাবু৷’

-‘সুবিমলকে তুমি ভালোবাসো, তাই আমার অবস্থা তুমি বুঝতে পারছ না৷ কেবল পুলিশ নয়, আমি আর এক ভদ্রলোককেও মামলাটা তদারক করবার জন্যে নিয়ে এসেছি৷’

আমার দিকে ফিরে অমলা শুধোলেন, ‘এই ভদ্রলোক?’

-‘না, ওর বন্ধু৷ আমি তাঁকে কাঁচা রাস্তার ভিতরে ঢুকতে দেখেছি৷’

ভুরু কুঁচকে অমলা বললেন, ‘কাঁচা রাস্তায়? সেখানে পাবার কী আছে? . . . ওই যে, আর এক ভদ্রলোক আসছেন৷ কাকাবাবু, উনিই কি তিনি?’

-‘হ্যাঁ মা৷’

জয়ন্ত ঘরে ঢুকে পাপোশের উপরে পা ঘষে জুতোর কাদা তুলে ফেলতে লাগল৷

অমলা তার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমার সুবিমলদা নিশ্চয়ই এ কাজ করেননি, কী বলেন?’

জয়ন্ত হাসিমুখে বললে, ‘আপনার কথা সত্য হলে সুখী হব৷ আপনিই বুঝি অমলা দেবী? আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করব?’

-‘নিশ্চয়ই!’

-‘গেল রাত্রে আপনি কোনো শব্দ শোনেননি?’

-‘কিছু না৷ কাকাবাবুর গলা শুনে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলুম৷’

-‘কাল রাত্রে বাড়ির সব দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘আজ সকালেও কোনো দরজা খোলা ছিল না?’

-‘না৷’

-‘আপনাদের নতুন দাসী রাত্রে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল?’

-‘হ্যাঁ৷ কাকাবাবু আমাদের কাছে যখন মুকুটের কথা বলছিলেন, তখন সে ঘরের ভিতরে পানের ডিবে দিতে এসেছিল৷’

-‘তাহলে আপনার সন্দেহ হচ্ছে, ননিবালা মুকুটের খবর বাইরের আর কারুকে দিতে গিয়েছিল?’

মহিমবাবু অধীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘এসব প্রশ্নের মানে হয় না৷ আমি নিজে দেখেছি মুকুট ছিল সুবিমলের হাতে৷’

-‘একটু অপেক্ষা করুন মহিমবাবু৷ ওসব কথা পরে হবে৷ অমলা দেবী, আপনি ননিবালাকে খিড়কির ফটক দিয়ে ফিরে আসতে দেখেছেন?’

-‘হ্যাঁ৷ ফটকের বাইরে ছায়ার মতো একটা লোককেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷’

-‘সে কে হতে পারে?’

-‘এ পাড়ার মুদির ছেলে৷ নাম কাঙালিচরণ৷ ননিবালাকে বিয়ে করতে চায়৷’

-‘সে বোধ হয় ফটকের বাঁ-পাশে দাঁড়িয়েছিল?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘তার একটা পা কাঠের?’

অমলার মুখে ফুটে উঠল ভয় ও বিস্ময়৷ সে বললে, ‘কী আশ্চর্য, আপনি কি মায়াবী? এ কথা কেমন করে জানলেন?’

অমলাকে কোনো উত্তর না দিয়ে জয়ন্ত ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ‘মহিমবাবু, এইবারে আমি আপনার শোবার ঘরটা দেখতে চাই৷ না, না, আর এক কথা৷ এই বৈঠকখানায় দেখছি তিনটে দরজা রয়েছে৷ যে দরজা দিয়ে আমি ঢুকলুম, ওটা দিয়ে বাইরের লোক এখানে আসে৷ দ্বিতীয় দরজা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়?’

-‘বাড়ির ভিতর-মহলে৷’

-‘আর ওই দরজাটা?’

-‘ওটা দিয়ে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে খিড়কির ফটকের দিকে যাওয়া যায়৷’

জয়ন্ত সেইদিকে এগিয়ে গেল৷ পকেট থেকে আতশিকাচ বার করে দরজার চৌকাঠের তলাটা অল্পক্ষণ পরীক্ষা করে বললে, ‘এইবার উপরে চলুন৷’

মহিমবাবুর শয়নগৃহটি মাঝারি৷ একখানি খাট, একটি ড্রেসিং টেবিল, একটি আলমারি ও খানদুই চেয়ার ছাড়া সেখানে আর কোনো আসবাব নেই৷

জয়ন্ত বললে, ‘মুকুট আছে ওই আলমারিতে?’

-‘হ্যাঁ৷’

মহিমবাবুর কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে জয়ন্ত বললে, ‘খোলবার সময়ে কোনো শব্দ হয় না এইজন্যেই আপনার ঘুম ভাঙেনি৷’

জয়ন্ত মরক্কো কেসের ভিতর থেকে মুকুটটি বার করে বিছানার উপরে স্থাপন করলে৷ সে এক অপরূপ সৌন্দর্যের ঐর্শ্বয, তার দিকে তাকালেও চোখ যেন জুড়িয়ে যায়৷ কেবল অপূর্ব ফিরোজাগুলিই দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে না, যে স্বর্ণকার এই মুকুটটি গড়েছে নিশ্চয়ই সে একজন উঁচুদরের শিল্পী৷

জয়ন্ত বললে, ‘মহিমবাবু, মুকুটের এই প্রান্তটা একটুখানি ভেঙে গেছে৷ আপনি আরও একটু ভেঙে ফেলতে পারেন?’

আতঙ্কে শিউরে মহিমবাবু বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, বলেন কী মশাই? সে আমি প্রাণ থাকতেও পারব না৷’

-‘বেশ, আপনি না পারেন, আমি পারি কি না দেখা যাক,’ বলেই সে মুকুটটা তুলে নিয়ে দুই হাত দিয়ে তার আর একটা প্রান্ত ভাঙবার চেষ্টা করলে৷ তারপর বললে, ‘লোকে বলে আমি নাকি মহা বলবান ব্যক্তি, মুকুটের এই প্রান্তটা আমি একটু দুমড়াতে পেরেছি, প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করলে ভেঙে ফেলতেও পারি৷ কিন্তু কোনো একজন সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা হবে না৷ আর এক কথা৷ মুকুটটা এইভাবে এখনি যদি ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে ঠিক পিস্তল ছোড়ার মতো একটা আওয়াজ হবে৷ মহিমবাবু, পাশের ঘরে আপনি সুবিমলবাবুকে মুকুট নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে দেখেছেন, অথচ এরকম কোনো আওয়াজ শোনেননি, এ বড়ো আশ্চর্য কথা৷’

মহিমবাবু বললেন, ‘কী জানি মশাই, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

-‘আপনারা এখানে বসুন৷ এখন আমি একলা আর একবার বাড়ির বাইরে যেতে চাই৷’ এই বলে জয়ন্ত প্রস্থান করলে৷

এবং প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে ফিরে এসে বললে, ‘মহিমবাবু, এখানে যা-যা দেখবার সব আমি দেখে নিয়েছি৷ এইবারে বাড়ি ফিরতে চাই৷’

-‘কিন্তু আমার রত্ন তিনখানা কোথায়?’

-‘তা আমি বলতে পারব না৷’

হাত কচলাতে কচলাতে মহিমবাবু বললেন, ‘বেশ বুঝতে পারছি, আমার ভাঙা কপাল আর জোড়া লাগবে না৷’

অমলা কাকুতি ভরা কন্ঠে বললে, ‘আমার সুবিমলদাকে রক্ষা করুন৷’

-‘রক্ষাকর্তা ভগবান, আমি নই৷ মহিমবাবু, আমি পেশাদার গোয়েন্দা নই, কাজ করি শখের খাতিরে৷ কিন্তু আমি পারিশ্রমিক নেব না বটে, তবে চোরাই পাথর তিনখানা ফিরে পেতে হলে আপনাকে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে৷’

মহিমবাবু উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘ভগবানকে ধন্যবাদ৷ তাহলে সেগুলো ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে? বলুন বলুন, আমাকে কত টাকা দিতে হবে?’

-‘আন্দাজে তাও আজ বলতে পারছি না৷ কাল সকালে দশটার সময়ে দয়া করে একবার আমার বাড়িতে যাবেন৷ আশা করি সেই সময়ে আপনাকে আলোকিত করতে পারব৷ এসো মানিক৷’

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভবঘুরে

বেশ বুঝলুম, জয়ন্ত একটা কিছু সাব্যস্ত করে ফেলেছে৷ আমি কিন্তু এখনও অন্ধের মতো গোলকধাঁধার মধ্যে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি৷ বাড়িতে ফেরবার মুখে জয়ন্তকে বারকয়েক জাগ্রত করবার চেষ্টা করে দেখলুম, যদি সে পথ নির্দেশ করতে পারে৷ কিন্তু আমার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হল৷ সে শিলামূর্তির মতো মৌন৷

বাড়িতে এসে জয়ন্ত নিজের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে৷ আধ ঘণ্টা পরে সে যখন আবার বেরিয়ে এল তখন একেবারে বদলে গেছে তার চেহারা৷ চুলগুলো উশকোখুশকো, রুক্ষ; বাঁ-গালে একটা আব; কানে গোঁজা একটা বিড়ি; গায়ে আধময়লা মেরজাই; পরনে রঙিন ছিটের লুঙ্গি; পায়ে বাটা কোম্পানির ছেঁড়া ও কাদামাখা রবারের জুতো৷ পয়লা নম্বরের ভবঘুরের মূর্তি! অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম৷

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘এইরকম লোকের মুখে কীরকম গান মানায় বলো তো? এ গানটা কি চলবে?’ বলেই গুনগুন করে প্রথম দুই লাইন গাইলে-

 ‘ও আমার, কমলালেবু প্রাণ!

 সিলেটে জন্ম তোমার,

 বেলেঘাটায় স্থান৷’

শুধোলুম, ‘এই বেশে কোথায় যাচ্ছ হে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

-‘ভবঘুরেরা যেখানে যায়৷ রাস্তায়৷ মধু, ও মধুসূদন!’ ডাক শুনে মধুর আবির্ভাব৷

-‘সারাদিনটাই হয়তো পথে পথে টোটো করে ঘুরে মরতে হবে, কিন্তু উদরদেশ তো ততক্ষণ শূন্য থাকতে রাজি হবে না৷ চটপট খান কয় শসার আর চিকেন স্যান্ডউইচ বানিয়ে কাগজে মুড়ে দিয়ে যাও৷’

জয়ন্ত বেরিয়ে গেল এবং ফিরে এল বেলা পাঁচটার সময়ে-হাতে তার ঝুলছে দড়ি দিয়ে বাঁধা একজোড়া পুরোনো লপেটা জুতো৷ মুখে তার হাসিখুশি৷

আমি তখন চা পান করতে বসেছি৷ জয়ন্তও আমার সঙ্গে যোগ দিলে৷ বললে, ‘আবার বেরিয়ে পড়বার জন্যে এখানে এসেছি৷ এক পেয়ালা চা খেয়েই উঠব৷’

-‘আবার যাবে কোথায়?’

-‘বালিগঞ্জের এখানে-সেখানে৷ আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না৷ ফিরতে রাত হতে পারে৷’

-‘খবর আশাপ্রদ তো?’

-‘মন্দ নয়, মন্দ নয়৷ অভিযোগ করবার কিছুই নেই৷ দুপুরে মহিমবাবুদের পাড়াতেও গিয়েছিলুম, কিন্তু তাঁর বাড়ির ভিতরে ঢুকিনি৷ ভারি মনের মতো মামলা হে, কাজ করে খুশি আছি৷ কিন্তু যাক, এখন আমার গালগল্প করবার সময় নেই৷ এখনি আবার সম্ভ্রান্ত সমাজে প্রবেশ করবার জন্যে বেশ পরিবর্তন করতে হবে৷’

জয়ন্তের হাসিমুখ, নৃত্যশীল চোখ ও স্ফূর্তিভরা হাবভাব দেখে বেশ বোঝা গেল, মামলাটার সুরাহা হতে আর দেরি নেই৷ সে স্নান করে জামাকাপড় বদলে আবার বেরিয়ে গেল ভদ্রবেশে৷ তারপর মধ্যরাত্রি পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন তার কোনো সাড়া পেলুম না, তখন আমি শয়ন করতে গেলুম৷ এমনি তার স্বভাব, কখনো কখনো সে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকে, সুতরাং তার জন্যে আমার কোনোই দুর্ভাবনা হল না৷

কত রাত্রে সে ফিরে এসেছে জানি না, কিন্তু সকাল বেলায় চায়ের আসরে এসে দেখি, টেবিলের সামনে পেয়ালা হাতে করে বসে রয়েছে জয়ন্ত, একেবারে ফিটফাট, তাজা চেহারা৷

জয়ন্ত বললে, ‘এইবারে খবরের কাগজ পড়ে শোনাও৷’

কাগজ পড়তে পড়তে বাজল বেলা দশটা৷

জয়ন্ত বললে, ‘মহিমবাবুর আসবার সময় হয়েছে৷’

বললুম, ‘সদর দরজার সামনে একখানা মোটর দাঁড়ানোর শব্দ হল৷’

অবিলম্বে মহিমবাবুর প্রবেশ৷ এক রাত্রেই তাঁর মূর্তির পরিবর্তন দেখে আমি চমকিত হলুম৷ তাঁর মাথার চুলে যেন আরও বেশি পাক ধরেছে; চোখ, গাল বসা বসা, দেহ একেবারে যেন ভেঙে পড়তে চায়৷ তাড়াতাড়ি তাঁর দিকে একখানা চেয়ার এগিয়ে দিলাম, অমনি পরিশ্রান্তের মতো তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন৷

থেমে থেমে ভগ্নস্বরে তিনি বললেন, ‘কী পাপ করেছি যে এত দায়ে ঠেকছি? দু-দিন আগেও আমার সুখের সীমা ছিল না, আর আজ আমি দুনিয়ায় একা, আমার সম্মান পর্যন্ত নেই৷ এক দুর্ভাগ্যের পর আসছে আর এক দুর্ভাগ্য৷ জানেন জয়ন্তবাবু, অমলা আমাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে?’

-‘চলে গিয়েছে?’

-‘হ্যাঁ৷ আজ সকালে উঠে দেখি, ঘর তার খালি, বিছানাতেও সে শোয়নি৷ টেবিলের উপরে রয়েছে তার হাতে লেখা একখানা চিঠি৷ কাল রাত্রে তাকে বলেছিলুম, সে যদি আমার ছেলেকে বিবাহ করত, তাহলে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না৷ এ কথা রাগ করে বলিনি, মনের দুঃখে বলেছিলুম৷ হয়তো বলা আমার উচিত হয়নি, কিন্তু কথাটা তার প্রাণে গিয়ে বেজেছে৷ কারণ চিঠিতে সে লিখেছে: পূজনীয় কাকাবাবু, আমার মনে হচ্ছে, এই দুর্ঘটনার জন্যে আমিই দায়ী, আপনাদের কথা শুনলে কারুকে আজ দুর্বহ দুর্ভাগ্যের ভার সামলাতে হত না৷ এরপরেও কোন মুখ নিয়ে আর আপনাদের আশ্রয়ে বাস করি? তাই চিরদিনের জন্যে আমি বিদায় গ্রহণ করলুম৷ আমার ভবিষ্যতের জন্যে ভাববেন না, কারণ সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি৷ আর এক নিবেদন৷ আমার জন্যে খোঁজাখুঁজি করবেন না, কেননা সেটা হবে ব্যর্থ৷ কিন্তু মরি আর বাঁচি, আমাকে একান্ত আপনারই বলে জানবেন৷ ইতি প্রণেতা অমলা৷ -এ চিঠির অর্থ কী জয়ন্তবাবু? অমলা কি আত্মহত্যা করতে চায়?’

-‘না, না মহিমবাবু, অমলা দেবী মোটেই আত্মহত্যা করবেন না৷ সমস্যার এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হতে পারে না৷ আমার মনে হচ্ছে, আপনার বিপদের মেঘ এইবারে কেটে যাবে৷’

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – অসম্ভব কথা

জয়ন্তের কথা শুনেই মহিমবাবু চেয়ারের উপরে সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘বিপদের মেঘ কেটে যাবে? আপনি নিশ্চয়ই সব জানতে পেরেছেন? কোথায় মুকুটের সেই ভাঙা অংশ?’

-‘তার জন্যে আপনি কত টাকা ব্যয় করতে পারেন?’

-‘আগে মান, তারপর টাকা৷ তার বিনিময়ে আমার সমস্ত সম্পত্তি দিতে পারি৷’

-‘অতটা বেশি অগ্রসর হবার দরকার নেই মহিমবাবু৷ প্রত্যেকখানা পাথরের জন্য দশ হাজার টাকা দিলেই চলবে৷’

-‘দশ হাজার কেন, আমি বিশ হাজার করে টাকা দিতে প্রস্তুত৷’

-‘বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই৷ আপনার কাছে কলম আর চেক বই আছে? বেশ, তিনখানা পাথরের জন্যে দিন ত্রিশ হাজার টাকা৷’

হতভম্ভের মতো মহিমবাবু কথামতো কাজ করলেন৷ জয়ন্ত দেরাজ খুলে বার করলে একখানা তিনকোণা সোনার উপরে বসানো তিনখানি ফিরোজা৷

বিপুল উল্লাসে চিৎকার করে দুই হাতে জিনিসটাকে চেপে ধরে মহিমবাবু বলে উঠলেন, ‘হারানিধি আপনি খুঁজে পেয়েছেন! আমি বেঁচে গেলুম৷ আমি বেঁচে গেলুম!’

জয়ন্ত গম্ভীর স্বরে বললে, ‘আপনার আরও কিছু কর্তব্য আছে৷’

-‘আরও কিছু কর্তব্য? বুঝেছি, আপনি পুরস্কার চান৷’ পকেট থেকে চেকবই ও কলম বার করে মহিমবাবু বললেন, ‘বলুন কত হাজার টাকা চান? আপনি যা চান তাই দেব!’

-‘এক টাকাও চাই না৷’

-‘তবে কী কর্তব্যের কথা বলছেন?’

-‘আপনার কর্তব্য হচ্ছে, সুবিমলবাবুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা৷’

-‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করব! কেন?’

-‘সুবিমলবাবুর মতো পুত্র যেকোনো পিতার মুখোজ্জ্বল করতে পারে৷’

-‘আপনি কী বলছেন!’

-‘ঠিক কথাই বলছি৷’

-‘তবে কি-তবে কি পাথর তিনখানা সে চুরি করেনি?’

-‘না, তিনি নিরপরাধ৷’

-‘বলেন কী! এ বিষয়ে আপনি কি নিশ্চিত?’

-‘একেবারে নিশ্চিত৷’

-‘তাহলে এখনি আমি থানায় গিয়ে এ সুসংবাদটা তাকে দিয়ে আসছি৷’

-‘এ সংবাদ তাঁর জানতে বাকি নেই৷ কাল আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলুম৷ তিনি যখন কিছুতেই আসল ব্যাপার ভাঙতে রাজি হলেন না, তখন আমি যা অনুমান করেছিলুম, সেটা তাঁকে খুলে বললুম৷ তারপর তাঁকে স্বীকার করতে হল যে, আমার অনুমানই সত্য৷’

-‘সবই যে অদ্ভুত রহস্য বলে মনে হচ্ছে৷ ভগবানের দোহাই, সব কথা খুলে বলুন৷’

-‘হ্যাঁ, বলব বই কী! পায়ে পায়ে কেমন করে আমি অগ্রসর হয়েছি, তাও আপনাকে বলব৷ কিন্তু তার আগে আর একটা কথা শুনুন৷ এই চুরির সঙ্গে অমলা দেবী আর কুমার বাহাদুরের যোগাযোগ আছে৷’

-‘অমন কথা মুখেও আনবেন না৷ আমার অমলা? অসম্ভব!’

-‘দুঃখের বিষয়, অসম্ভবই হয়েছে সম্ভবপর৷ এই কুমার বাহাদুর হচ্ছে এক নিঃস্ব বড়ো ঘরের ছেলে, সর্বহারা জুয়াড়ি, তার না আছে হৃদয়, না আছে বিবেকবুদ্ধি৷ তার চরিত্র যে কতখানি জঘন্য, আপনি বা সুবিমলবাবু কেউই তা জানেন না৷ অমলা দেবী তো সংসারে অনভিজ্ঞ তরুণী, তিনি তার স্বরূপ বুঝবেন কেমন করে? তিনি তার সুন্দর মুখ দেখে ভুলেছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন তার প্রত্যেকটি মিথ্যাকথা৷ সে নিশ্চয়ই তাঁকে বিবাহ করবে বলে, অঙ্গীকার করেছিল৷ দু-জনের মধ্যে দেখাশোনা হত প্রায় প্রত্যহই৷’

মহিমবাবু জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘এসব কথা আমি বিশ্বাস করতে পারব না, পারব না!’

সপ্তম পরিচ্ছেদ – জয়ন্তের কথা

‘শুনুন মহিমবাবু৷ আমি মামলাটাকে যে ভাবে খাড়া করেছি তার মধ্যে যে ভুলচুক কিছু নেই, এমন কথা জোর করে বলতে পারি না৷ খানিক খানিক অস্পষ্টতা থাকবেই৷ অমলা দেবীকে পেলে সে অস্পষ্টতা দূর করা যেত, কিন্তু তিনি এখন যবনিকার অন্তরালে৷

‘ঘটনার দিন রাত্রে আপনি নীচে নেমে দেখেছিলেন, খিড়কির ফটকের দিকে যাবার জন্যে বৈঠকখানায় যে দরজাটা আছে, অমলা সেটা বন্ধ করে দিচ্ছেন৷ আসলে বাইরে সেখানে ছিল কুমার বাহাদুর, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা কইছিলেন অমলা৷ তিনি কথাপ্রসঙ্গে নিশ্চয়ই তাকে বলেছিলেন ফিরোজা মুকুটের কথা৷ শুনেই কুমার বাহাদুরের মনে জাগ্রত হয় দুর্দান্ত লোভ৷ সে ঠিক কী প্রস্তাব করে, বলতে পারব না৷ খুব সম্ভব মুকুটটা সে খালি একবার দেখতে চেয়েছিল৷ অমলা যে আপনাকে ভালোবাসেন, তাতে আর সন্দেহ নেই৷ প্রথমটা নিশ্চয়ই তিনি এই বিপদজনক প্রস্তাবে রাজি হননি৷ কিন্তু কুমার বাহাদুর শেষটা তাঁকে বুঝিয়ে দেয় যে, মুকুটটা কেবল একবার চোখে দেখলে কারুর কোনো ক্ষতিই হবে না৷ সে মুকুটটা দেখবার জন্যে গভীর রাত্রে আবার সেখানে আসবে৷ জেদাজেদিতে পড়ে অমলাকে শেষটা সম্মতি দিতে হয়৷

‘ঠিক সেই সময়ে হয় আপনার আবির্ভাব৷ অমলা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেন৷ আপনার কাছে ননিবালার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন৷ সে অভিযোগ মিথ্যা নয়৷

‘টাকার জন্যে আপনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে সে রাত্রে সুবিমলবাবুর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়৷ তার উপরে ক্লাবের দেনার জন্যেও তাঁর মনে ছিল দুশ্চিন্তা৷ তাঁর ঘুম হয়নি, মধ্য রাত্রেও জেগে ছিলেন৷ হঠাৎ ঘরের বাইরে শুনতে পান কার অস্পষ্ট পায়ের শব্দ৷ কৌতূহলী হয়ে উঠে দরজা একুট ফাঁক করে সবিস্ময়ে দেখতে পান, অমলা চোরের মতো সন্তর্পণে আপনার শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন৷

‘রাত্রেও সেখানে আলো জ্বালা থাকে৷ ব্যাপারটা কী জানবার জন্যে সুবিমলবাবু নিজের ঘরের অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং একটু পরেই স্তম্ভিত নেত্রে দেখলেন, আপনার ঘর থেকে অমলা আবার বেরিয়ে আসছেন-হাতে তাঁর ফিরোজা মুকুট!

‘অমলা নীচে নেমে গেলেন, পিছনে পিছনে নামলেন আতঙ্কগ্রস্ত সুবিমলবাবুও৷ বৈঠকখানার দরজার কাছে পর্দার আড়াল থেকে দেখা গেল, খিড়কির ফটকের দিকে যাবার দরজাটা খুলে অমলা মুকুটটা সমর্পণ করলেন বাইরের কোনো লোকের হাতে৷ সে মুকুটটা হস্তগত করেই সরে পড়ল৷ এর জন্যে অমলা প্রস্তুত ছিলেন না, ভয় পেয়ে উপরে পালিয়ে এলেন৷

‘অমলাকে ভালোবাসেন সুবিমলবাবু৷ তাকে বিবাহ করতে চান৷ পাছে অমলার নামে কলঙ্ক রটে, সেই ভয়ে এতক্ষণ তিনি কোনো গোলমাল করতে পারেননি, কিন্তু এখন তাঁর হুঁশ হল, মুকুটটা যদি খোয়া যায়, তাহলে তাঁর পিতার কত বড়ো বিপদের সম্ভাবনা৷ তিনি তখনি পাগলের মতো ছুটে ওদিককার দরজা খুলে ফেলে বাইরে গিয়ে পড়লেন৷ তারপর খিড়কির ফটক থেকে বেরিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটতে লাগলেন৷

‘চোর তখনও বেশি দূরে যেতে পারেনি৷ গ্যাসের আলোতে সুবিমলবাবু তাকে চিনতে পারলেন৷ তারপর মুকুট নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া আরম্ভ হল-একদিকে সুবিমলবাবু আর একদিকে কুমার বাহাদুর৷ টানাটানি করতে করতে সুবিমলবাবু প্রচণ্ড এক ঘুসি মারেন কুমার বাহাদুরকে-তার চোখের উপরটা কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে থাকে৷ মুকুটটা অত্যন্ত কঠিন, একজনের সাধারণ শক্তি তাকে ভাঙতে পারে না, কিন্তু দুই জনের সম্মিলিত শক্তিতে হঠাৎ সেটা ভেঙে গেল৷

‘মুকুটটা নিয়ে ফিরে এলেন সুবিমলবাবু৷ সে সময়ে তিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন, ওদিককার দরজাটা জোরে বন্ধ করে দেন আর সেই শব্দে আপনার নিদ্রাভঙ্গ হয়৷ শোবার ঘরের কাছে এসে সুবিমলবাবু মুকুটটা দুমড়ে গেছে দেখে যখন আবার সেটা টেনে সোজা করবার চেষ্টায় ছিলেন, সেই সময়ে হয় আপনার আবির্ভাব৷’

অষ্টম পরিচ্ছেদ – পদচিহ্নের ইতিহাস

মহিমবাবু বিস্ফারিত নেত্রে বললেন, ‘এও কি সম্ভব?’

জয়ন্ত বললে, ‘যখন তাঁর প্রাপ্য সাধুবাদ, তখন সুবিমলবাবুকে দিলেন আপনি গালাগালি আর চোর বদনাম৷ তাঁর রাগ আর অভিমান হওয়া স্বাভাবিক৷ তার উপরে তিনি যাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন, সেই অমলাকে না জড়িয়ে তাঁর পক্ষে কোনো কথা বলা ছিল অসম্ভব৷ এই জন্যেই তিনি করেছিলেন মৌনাবলম্বন৷ যেমন করে হোক অমলাকে তিনি কুৎসিত কলঙ্কের কালিমা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন৷’

মহিমবাবু বললেন, ‘ও বুঝেছি৷ তাই সব কথা ফাঁস হয়ে গেছে ভেবে মুকুট দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল৷ কী নির্বোধ আমি! ধরা পড়বার পর সুবিমল পাঁচ মিনিটের জন্যে বাইরে যেতে চেয়েছিল কেন, তাও বুঝতে পারছি৷ তিনখানা পাথর পাওয়া যাচ্ছে না শুনে সে চেয়েছিল সেগুলো খুঁজে আনতে৷ তখন তাকে অবিশ্বাস করে আমি কি অবিচারই করেছি৷’

জয়ন্ত বলতে লাগল, ‘এত সহজে মামলাটার রহস্য ভেদ করতে পারলুম কেন জানেন? মেঘ আর বৃষ্টির জন্যে৷ কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় পাতা কাদার আস্তরণ৷ তারপর পরশু থেকে বৃষ্টি থেমেছে বটে কিন্তু কাল পর্যন্ত আকাশ ছিল মেঘে আচ্ছন্ন৷ রোদ ওঠেনি বলে রাস্তার কাদা শুকোয়নি৷ মানুষের পদচিহ্নগুলো আপনার বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তার উপরে লিখে রেখেছিল বিচিত্র ইতিহাস৷

‘কাল সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি সর্বাগ্রে সেই ইতিহাস পাঠ করবার চেষ্টা করেছি৷ কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে বেশি লোক চলাচল নেই৷ বৃষ্টির ধারায় আগেকার সব পদচিহ্নই ধুয়ে মুছে গিয়েছে৷ সুতরাং ঘটনার রাত্রে ওখানে কারা চলাফেরা করেছিল, সেটা জানতে কিছুই বেগ পেতে হল না৷

‘প্রথমেই দেখলাম, খিড়কির ফটকের সামনে রয়েছে ছোটো ছোটো খালি পায়ের দাগ, কোনো বালক বা নারী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার সামনেই পেলুম একখানা পা ও একটা গোল দাগ-কোনো একঠেঙো লোক কাঠের পা পরে সেখানে এসেছিল৷ পরে জানা গেল, আপনাদের দাসী ননিবালা তার একঠেঙো হবু-বরের সঙ্গে সেইখানে দাঁড়িয়ে বাক্যালাপ করেছিল৷

‘তারপর দেখলাম, কোনো মানুষের দুই সার শৌখিন জুতোর দাগ বাহির থেকে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে৷ সেই সঙ্গে পেলুম আরও দুই সার খালি পায়ের চিহ্ন৷ দাগের গভীরতা ও ব্যবধান দেখে বুঝতে দেরি লাগল না যে, কেউ খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে ছুটতে ছুটতেই৷ মনটা খুশি হয়ে উঠল, কারণ আগেই আপনার মুখে শুনেছিলুম যে, সুবিমলবাবুকে আপনি নগ্নপদে মুকুট নিয়ে টানাটানি করতে দেখেছিলেন৷

‘একজায়গায় দেখলাম, কাদার উপরে বিষম ধস্তাধস্তির চিহ্ন- সেখানেও খালি পায়ের আর শৌখিন জুতোর দাগ৷ সেখানে যে রক্তপাত হয়েছে, তাও বোঝা গেল৷ তারপর জুতোর দাগ চলে গিয়েছে গলির বাইরের দিকে, আর খালি পা ফিরে এসেছে বাড়ির দিকে৷ ধরে নিলাম, সে বাড়িরই লোক৷

‘আপনার মনে আছে, বৈঠকখানায় ঢুকে খিড়কির ফটকের দিকে যাবার দরজার তালাটা আমি পরীক্ষা করেছিলাম? একজন লোক যে কাদামাখা খালি পা নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছে, সেখানে ছিল তার স্পষ্ট চিহ্ন৷

‘তখন আসল ব্যাপারটা কতক কতক আন্দাজ করতে পারলুম৷ কোনো শৌখিন জুতোপরা লোক মুকুট হস্তগত করে প্রস্থান করছিল৷ সুবিমলবাবু দেখতে পেয়ে তার অনুসরণ করেন, তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে মুকুট ছিনিয়ে নিয়ে আবার বাড়ির ভিতরে ফিরে আসেন৷

‘চোরকে নিশ্চয় বাড়ির কোনো লোক সাহায্য করেছিল৷ বাড়ির ভিতরে ছিল কেবল দাসীরা আর অমলা৷ কিন্তু দাসীদের মুখ চেয়ে সুবিমলবাবু নিশ্চয়ই অপরাধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নেবেন না৷ বাকি রইলেন কেবল অমলা৷ সুবিমলবাবু তাঁকে ভালোবাসেন৷ তাঁর মানরক্ষার জন্যে তিনি সব করতে পারেন৷ অতএব, প্রথমে অসম্ভব মনে হলেও আমি সন্দেহ করলুম অমলাকেই৷ তার উপরে রাত্রে আপনি তাঁকে বৈঠকখানায় বাগানে যাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন এবং মুকুট দেখেই তিনি ভয়ে আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন৷ এখন শৌখিন জুতোপরা লোকটা কে হতে পারে? এ বাড়িতে কুমার বাহাদুর হামেশাই আনাগোনা করে৷ তার নাম আগেই শুনেছিলুম, সে হচ্ছে অত্যন্ত কুবিখ্যাত ব্যক্তি৷ ভবঘুরে সেজে তার চাকরের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললুম৷ শুনলুম তার মনিব আগের রাতে আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে৷ নিজের ছেঁড়া জুতো দেখিয়ে, আট আনা পয়সা দাম দিয়ে তার কাছ থেকে কুমার বাহাদুরের একজোড়া পুরোনো ফেলে দেওয়া লপেটা কিনে আনলুম৷ তারপর আপনার বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তায় এসে সেই শৌখিন জুতোর দাগের সঙ্গে লপেটা জোড়া মিলিয়ে দেখলুম৷ অবিকল মিলে গেল৷ আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না৷

‘তারপর পোশাক বদলে কুমার বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করলুম৷ আমি জানি, এই কেলেঙ্কারি আপনি চাপা দিতে চান, তাই পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করলুম না৷

‘সে প্রথমটা সবই উড়িয়ে দিতে চাইলে৷ তারপর আমি যখন তার বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ ছিল, একে একে সেগুলো উল্লেখ করলাম, সে মারমুখো হয়ে লাঠি নিয়ে তেড়ে এল৷ আমিও বার করলুম আমার রিভলভার৷ তখন সে কতকটা শান্ত হল৷

‘আমি বললুম, পাথর তিনখানা ফিরিয়ে দাও৷ আমরা ত্রিশ হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত আছি৷

‘সে বললে, হায় হায়, আমি যে মোটে পাঁচ হাজার টাকায় তিনখানা পাথরই বেচে ফেলেছি!

‘তারপর তার কাছ থেকে সেই চোরাই মালের কারবারির ঠিকানা আদায় করলুম৷ তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে আপনার রত্ন উদ্ধার করে এনেছি৷’

মহিমবাবু উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন, ‘ধন্যবাদ জয়ন্তবাবু, অসংখ্য ধন্যবাদ! আপনার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারব না৷ আপনার ক্ষমতা জাদুকরের মতো৷’

 .

গল্পটি জনৈক সুপ্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য লেখকের আখ্যান অবলম্বনে রচিত৷ ইতি-গ্রন্থকার৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *