মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

ফিরে দেখা

ফিরে দেখা

আসলে আমার নাম রবি ঘোষদস্তিদার। বয়স ৬০। পিতা ৺দীপেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার, মাতা ৺জ্যোৎস্নারানি ঘোষদস্তিদার। সাকিন কলকাতা। আদি নিবাস বরিশাল। খাস বাঙাল। আমি হতে পারতাম সার্কাসের দলের জিমন্যাস্ট, হতে পারতাম ওয়েট লিফটিং-এ বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন, পুলিশ কোর্টের কেরানিবাবু হয়েও জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম—এর প্রত্যেকটিরই তুমুল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হতে পারলাম না। সেই ছোট্টবেলাতেই ‘থিয়েটার’ আর ‘অ্যাক্টিং’ শব্দ দুটো মাথায় গুবড়ে পোকার মতো বাসা গেড়ে বসেছিল। তাই আর পাঁচজনের মতো জীবনের সহজ সরল গতিতে ভেসে যেতে পারলাম না। জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে, বহু উত্থান আর পতনকে অঙ্গীকার করে আজ আমি অভিনেতা রবি ঘোষ।

আমার জন্ম উত্তর কলকাতায়। বড়ো হয়েছি কালীঘাটে। শিল্পকর্মের দিকে আমার অনুরাগ পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত নয়, এটা আসে আমার মাতুলতরফ থেকে। আমার বাবার দিকের সবাই প্লেয়ার, খেলাধুলা করেন। ফুটবল, ক্রিকেট। বিশেষ করে ফুটবল। তাঁরা সবাই ইস্টবেঙ্গলের লাইফ মেম্বার। বাবাও খেলোয়াড় ছিলেন। আমিও ওই পথেই চলেছিলাম। সাত-আট বছর বয়সে গুরুসদয় দত্ত-র ব্রতচারীর মাঠে আমাকে নিয়ে হইচই পড়ে যেত— এত সুন্দর জিমনাস্টিকের খেলা দেখাতে পারতাম। এমন নাম হয়েছিল আমার যে সার্কাস থেকে আমাকে নিতে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাবা রাজি হলেন না। প্রশ্নই ওঠে না সার্কাসে যাবার। তখন কালীঘাট হাইস্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। লেখাপড়া আর খেলাধুলা ছাড়া অন্য কোনও ভাবনা নাই। কিন্তু ভগবানের বোধহয় অন্য ইচ্ছে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমার জীবনের গতিটাকে পালটে দিল।

সালটা ‘৪১ কি ‘৪২। কলকাতা জাপানি বোমার ভয়ে কাঁপছে। সবাই কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে। বাবাও আমাদের পাঠিয়ে দিলেন কোচবিহার, মামার বাড়ি। অথচ মজার ব্যাপার হল বোমাটা পড়ল যখন আবার আমরা তিনবছর পর কলকাতা ফিরে এলাম। হ্যাঁ, টানা তিনবছর কোচবিহারে ছিলাম। সেই তিনটে বছর আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ। আমার ছেলেবেলাকে ঘিরে যে নস্টালজিক ফিলিং, তা কলকাতা কেন্দ্রিক নয়, তার সবটা কোচবিহারকে ঘিরে।

আমার মামারবাড়ি ছিল সংগীতপ্রিয়। দাদু অধ্যাপক ছিলেন, অবসর সময়ে সেতার বাজাতেন। বড়ো মামা অসাধারণ গান গাইতেন, শচীনদেব বর্মণ-এর ছাত্র ছিলেন, আমার মা-ও অপূর্ব গান করতেন।

কী অসাধারণ সুন্দর শহর ছিল কোচবিহার। রাজার অধীনে এক অপূর্ব নেটিভ স্টেট। কী অসাধারণ প্রকৃতি! তোর্সা নদী, গাছপালা— সব মিলিয়ে আজও আমার কাছে সেদিনের কোচবিহার এক স্বপ্ন। আমি খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতাম। চটি পরার রেওয়াজ ছিল না। গাছে উঠতাম, জাম পেড়ে খেতাম। মানে শহুরে আমি, যতরকম গ্রাম্য রীতিনীতি আছে, সব রপ্ত করলাম।

যখন যাই কলকাতার জন্য একটুও কষ্ট হয়নি। দাদু-দিদিমার কাছে যাচ্ছি, বাবার শাসন থাকবে না। আমার বাবা খুব শাসন করতেন। ৮/৯ বছর বয়সে রেগে গিয়ে দুম করে এমন ঘুঁসি মারলেন যে চোখে রক্ত জমে গেল। আমি অবশ্য প্রচণ্ড দুরন্ত ছিলাম। গ্যাসপোস্টে ওঠা, মারামারি— সবই করতাম। তো সেদিন দাদু উপস্থিত ছিলেন। বাবাকে ডেকে শুধু বলেছিলেন, ২৫ বছর ছাত্র পড়াচ্ছি, কোনওদিন কারও গায়ে হাত তুলিনি। শাসন করো, গায়ে হাত তুলো না। মনে আছে বাবা খুব লজ্জিত হয়েছিলেন। উনি ভাবতেই পারেননি আমার অমন দশাটা হবে।

দাদু ভীষণ গুরুগম্ভীর মানুষ ছিলেন। আর আমার দিদিমা ছিলেন পরমা সুন্দরী। ওঁর মতো সুন্দরী এ জীবনে আর দেখলাম না।

কোচবিহারে আমার আর এক সহপাঠী বন্ধু ছিল মান্টু। ভালো নাম সুনীল দাশগুপ্ত। স্কুলে থাকতেই রাজনীতি করত। আমরা তো রীতিমতো ভয় পেতাম— এ কী রে বাবা। সেই মান্টু বড়ো হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরাট নেতা হয়। বিধায়কও হয়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়েছিল। ২০ বছর পর ওরই ডাকে আবার কোচবিহার যাই।

ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন— কোচবিহারে শেষ করে বাবার নির্দেশে কলকাতায় ফিরলাম। উ: সে কী কষ্ট! শুধু তো দাদু-দিদিমাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট নয়, আরও অনেক কিছু যে ফেলে এলাম। কলকাতায় এসে প্রথমেই বন্ধ হয়ে গেল খালি পায়ে হাঁটা। যখন তখন মাছধরা, পুকুর দাপিয়ে সাঁতার কাটা, বর্ষায় টোকা মাথায় ঘুরে বেড়ানো সব ফেলে এলাম।

কলকাতায় এসে সাউথ সুবারবন স্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাস এইটে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হল। তারপর অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। যতই হোক কলকাতারই ছেলে তো। আবার সব বন্ধু-বান্ধব হয়ে গেল। আমার কপাল ভালো, একটা ভালো গ্রুপ পেয়ে গেলাম। আমি খুব একটা মেধাবী ছিলাম না, কিন্তু মিশতাম ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের সঙ্গে। এই ব্যাপারটা আমার বাবা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন—’সব সময় বেটার ছেলেদের সঙ্গে মিশবে। তাহলে কিছু শিখতে পারবে।’ সেটা আমার এখনও রয়ে গেছে। আমি আমার নিম্নবর্গী কারোর সঙ্গ তো মিশিই না, সমপর্যায়ের বন্ধু-বান্ধবও আমার হল না।

যাই হোক, সাউথ সুবারবনে আমরা গড়ে তুললাম বম্বার্ড অ্যাসোসিয়েশন। আমি, ভোলা দত্ত, অশোক ঘোষাল, কল্যাণ দাশগুপ্ত— অশোক আর কল্যাণ খুব ভালো লিখত। আমি খুব ভালো ছবি আঁকতাম। গল্প হলেও সত্যি! আমাদের হাতে লেখা পত্রিকার নাম ছিল ‘হাতে খড়ি’। এখন তার দু-একটা ভোলার কাছে আছে। ও বলেছে— আমি মরলে ও সেগুলো প্রকাশ করবে। সে অ্যাসোসিয়েশনের মাথায় অভিনয়ের খেয়াল চাপল। এর আগে পর্যন্ত আমাদের মজা ছিল ময়দানে খেলা দেখতে যাওয়া এবং ট্রামে কন্ডাক্টরদের পয়সা না দেওয়া। তা নাটকের ভূত যখন চাপল, তখন আমরা ক্লাস নাইনে পড়ি। কী যে তোড়জোড় আমাদের, কত রিহার্সাল; নাটক অবশ্য শেষ পর্যন্ত হল না। কিন্তু নাটকের পোকাটা মাথায় রয়ে গেল। সেই সময়েই আমরা হলিউডের ভক্ত হয়ে উঠেছি। হাফ প্যান্ট পরি কিন্তু মগজটা পেকে গেছে। রুচিবোধ তৈরি। বাংলা ছবি তো দেখতামই না, হলিউডেরও সব ক্লাসিক ছবি দেখতাম।

আমরা তিন ভাই, দু’বোন। দিদি বড়ো, তারপরে আমি, আমার পরে বাকিরা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বড়োলোকও নয় গরিবও নয়। লাক্সারি করার পয়সা বা সুযোগ কোনওটাই ছিল না। বাবা আলিপুর জজকোর্টের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। অসম্ভব সৎ, অত ঘুষের জায়গায় থেকেও এক পয়সা ঘুষ নিতেন না। উনি বলেছিলেন, ‘মাছভাত, লেখাপড়া, মোটা কাপড় হবে, লাক্সারি হবে না।’ তবে আমার অভিনয়ের ব্যাপারটা বাবা মা কেউই সুনজরে দেখেননি।

স্কুলে পড়াকালীনই অভিনয়ের পাগলামিটা শুরু হল। পুজোর সময় এ পাড়ায় ও পাড়ায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দাদাদের কাছে আমরা মাইক্রোফোন চেয়ে বেড়াতাম—নাটক করব। তা কখনও কখনও ফাঁকাও পেতাম। কী সব নাম ‘ কেদার রায়’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’। কেউ নরেশ মিত্তির-এর গলা করে তো কেউ শিশির ভাদুড়ি-র। আমরা ভাবতাম সকলে শুনছে, আসলে কেউ শুনত না। পরে আমার এক বন্ধু বলেছিল— তোরা নাটক করছিলি, আর সবাই গল্প করছিল। শুনে কী দু:খটাই যে হয়েছিল। আসলে ওটাই ছিল পাগলামি।

‘৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করলাম। আশুতোষ কলেজে ভর্তি হলাম ইন্টারমিডিয়েট পড়তে। তখন থেকেই আমি শরীরচর্চায় মন দিই। আশুতোষ জিমনাশিয়ামে ব্যানটাম লিফটিং করতাম। ওই ডালভাত খেয়েই আমার যে কী দুরন্ত স্বাস্থ্য হল কী বলব। আমার বডিওয়েট যখন ১২০ পাউন্ড, আমি ১৪০ পাউন্ড তুলতে পারতাম। জিমনাশিয়ামের দাদারা বললেন, বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপে নামাবে। কিন্তু হল না। পরবর্তী এক মাসে ১৪০ থেকে ১৪৫ পাউন্ড করতে পারলাম না। ফলে বাদ। পরে আমার গুরু বলেছিলেন, যে পরিমাণ খাদ্য দরকার ছিল তা আমি না পাওয়ায় বডিওয়েট বাড়েনি। অপর্যাপ্ত আহার না হলে এসব হয় না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। গুরু বলতেন, ‘লিফটিং ছেড়ে দে, সাধারণ ব্যায়াম কর।’ সেই শরীরচর্চা আজও আমি করি। সারাদিনে কিছু না করলেও ৫/১০ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করি, গলফ খেলি।

এই কলেজে পড়তে পড়তেই নাটকের পাগলামিটা চূড়ান্ত রূপ নিল। ছুটির পর দারোয়ানকে পয়সা দিয়ে কলেজের ছাতে রিহার্সাল দিতাম। কখনও এর ওর বাড়িতেও মহড়া চলত। নাটক করা হত না। ফোর্থ ইয়ারে উঠে বি কম পরীক্ষাটা আর দিলাম না। নাটকের ভূত তখন মাথায়। এই শুরু হল বাড়িতে আমায় অপছন্দ করা।

প্রেমাশিস সেন বলে আমার এক বন্ধু ছিল। আমার পরম মিত্র। গতবছর সেও চলে গেছে। ওর মৃত্যুটা আমার কাছে বিরাট ধাক্কা। কারণ আজকের রবি ঘোষের পিছনে প্রেমাশিসের অবদান বিরাট। সে-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল উৎপল দত্ত-র কাছে। সেটা ‘৫২ সাল।

একদিন প্রেমাশিস এসে আমাকে আর সত্যকে, মানে অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়-কে বলল, ‘চলো তোমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।’ সব শুনে তো আমার হাত-পা ঠান্ডা। ওয়াইএমসিএ-র বাড়িতে ইংরেজি নাটকের রিহার্সাল চলছে। উৎপল দত্ত পরিচালক। আমাদের অভিনয় করতে হবে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। সত্য তো ধুতি পরে, আমি পাজামা, সে সব না হয় গেল, কিন্তু ইংরিজি? আমরা বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলে, গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারি না। প্রেমাশিস ভরসা দিল—’আরে না না। সবাই বাংলায় কথা বলবে।’ গিয়ে দেখি সবাই তুখোড় ইংরেজিতে কথা বলছে। প্রেমাশিসের ইংরেজি ভোকাবুলারি সাংঘাতিক। সেন্ট জেভিয়ার্সের ছেলে। ওর আর কী। আমাদের উৎপলদা বাংলায় কথা বললেন, আর বললেন, করুণাদি, মানে পথের পাঁচালীর করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়১০। তারপর তো রিহার্সাল শুরু হল। উরিব্বাস, সে যে কী অভিজ্ঞতা। সবাই তোড়ে ইংরেজি বলছে আর আমরা একবর্ণও বুঝতে পারছি না। আমাদের একটা ক্রাউড সিনের জন্য প্রেমাশিস নিয়ে এসেছিল। ভাগ্যিস ক্রাউড সিন, তাই উতরে গেল। আর ওইখান থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের কফি হাউসের আড্ডা, উৎপলদা যার মধ্যমণি।

‘৫৩ থেকে ‘৬০ সাল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তারপর আমি অনেক খ্যাতি পেয়েছি, আমার নাম হয়েছে, অর্থ হয়েছে, কিন্তু ওই অসাধারণ সময়টা আর ফিরে পাইনি। কী সময় ছিল। দিনে কফি হাউজে আড্ডা, মাঝে নাম কা ওয়াস্তে চাকরি, নাটক, রিহার্সাল আর আবার অফুরন্ত আড্ডা। বাড়ি থেকে বাধা এলেও করার কিচ্ছু ছিল না। ১৮ বছর বয়স থেকে পুলিশ কোর্টে চাকরি করি। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ি থেকে হাত খরচ নিতাম না। পরে তো প্রশ্নই ওঠেনি। সুতরাং ভাতের খোঁটা কেউ দিতে পারত না, সে পথ বন্ধ ছিল।

চাকরিটা করতাম পুলিশ কোর্টে। অনেক বছর করেছি। ‘৬০ সাল পর্যন্ত। প্রচণ্ড ঘুষের জায়গা। কিন্তু আমি তো বাবার ছেলে। বাবার ওয়ার্নিং আছে। সুতরাং ঘুষ খাব না। তার উপর কমিউনিজমে দীক্ষিত হয়ে গেছি— অসৎভাবে জীবনযাপন করব না। তা আমি ঠিক করলাম—ঘুষ খাব না, কাজও করব না। ১টার পর কেউ আর আমাকে অফিসে পেত না।

ওই ভরদুপুরে আমি সোজা কফি হাউজে হাজির। তখন কফি হাউজের আড্ডাটা আমার কাছে রীতিমতো লোভনীয়। কতরকম মানুষ আসতেন। লেখক, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, শিল্পী, নাট্য আন্দোলনের ছেলেরা, কমিউনিস্ট পার্টির বড়ো বড়ো সব মাথা। কে না এসেছেন। আমরা তখন নাট্য আন্দোলন নিয়ে মশগুল। তারই মধ্যে আবিষ্কার করি মানিকদাকে, মানে সত্যজিৎ রায়কে। উনি আর কমলদা মানে সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার১১ বসতেন পাশের ঘরে লর্ডসে। দূর থেকে দেখতাম মানিকদাকে। সুকুমার রায়ের ছেলে বলে কৌতূহল ছিল, আলাপ করার সাহস ছিল না।

তখন আমরা এলটিজি থিয়েটার গ্রুপ গড়ে তুলছি। আমরা মানে পাঁচজন। উৎপলদা, আমি, প্রেমাশিস, সত্য আর রবি সেনগুপ্ত। রবিদা আমাদের সম্পাদক ছিলেন। কী অসাধারণ মানুষ। দারুণ নিয়মানুবর্তী , দারুণ কঠোর, অথচ কী সহৃদয়। আজ যে উৎপলদার এত পলিটিক্যাল কানেকশন— তার মূলে কিন্তু রবি সেনগুপ্ত। রিহার্সালের ব্যাপারে সাংঘাতিক কঠোর ছিলেন রবিদা। যদি সাড়ে ছ’টায় রিহার্সাল শুরু হবার কথা থাকত তো আমরা ৬-২৫-এর মধ্যে পৌঁছে যেতাম, ৬-৩১-এ কেউ এলে সে দরজার বাইরেই থাকত। এই রবিদার আমলেই আমাদের মহলা দেখতে আসতেন মুজফফর আহমেদ১২, আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।

আমাদের প্রথম নাটক হল ‘সাংবাদিক’। রাশিয়ান নাটকের অ্যাডাপ্টেশন। আইটিএফ প্যাভিলিয়নে নাটক শুরু। স্টেজটা এখনও আছে। আমি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেজ ম্যানেজার। আমার তো ছোটোখাটো চেহারা, এদিকে সাহেবদের নাটক। কী রোল আর আমাকে দেওয়া যায়? তা আমি একটা হকারের রোল পেলাম। মাত্র ২০ সেকেন্ডের স্টেজ অ্যাপিয়ারেন্স। কিন্তু ওই ২০ সেকেন্ড অভিনয়ের জন্য মৃণালদা মানে মৃণাল সেন—তখন ইউনিট থিয়েটার নামে একটি ইংরজি পত্রিকায় লিখতেন— উনি আমার কথা পুরো এক প্যারা লিখলেন।

এই সময়টায় আমি থিয়েটার করি, পার্টির হয়ে পোস্টারিংও করি, চাকরিও করতে হয়, তাই করি। আর ঠিক এই সময়টা থেকেই বাড়িতে শুরু হয় গেল চূড়ান্ত গণ্ডগোল। বাড়িতে অন্যান্য ভাইয়েরা সব পড়াশোনা করছে, আমার তো কোনও উন্নতি নাই। বাবা আমাকে ‘রিজেক্টেড’ বলে ঘোষণা করলেন। যা হয় আর কি। ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী হবে। সে কী আতঙ্ক তাঁর। নেহরুর ভক্ত ছিলেন, চূড়ান্ত কংগ্রেসি। বামপন্থীদের সহ্য করতে পারতেন না। আর ছেলেটা হয়ে গেল ঘোর কমিউনিস্ট। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হত। মাসে দু’তিন দিন তো ‘স্বাধীনতা’১৩-র শো করে ফিরতে ফিরতে রাত একটা-দেড়টা। বাবা বাড়ি থেকে প্রায়দিনই বার করে দিতেন। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা সেই মাঝরাতেই উঁকি ঝুঁকি মারত। অবশ্য বাবা সামনের দরজা দিয়ে বার করে দিতেন, আমি পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়তাম। মা আর কী বলবেন? স্বামীকেও কিছু বলতে পারতেন না, আর ছেলের তো নাগাল পেতেন না। তবে একটাই ওঁর সান্ত্বনা ছিল যে ছেলে উচ্ছন্নে যায়নি। দেখতেন, ছেলে একগাদা বই নিয়ে বাড়ি ঢোকে, কারা সব আসে, অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে, তর্ক করে। ব্যাস ওইটুকুই। আমার ছোটোভাই তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, খুড়তুতো ভাইরাও দারুণ পড়াশোনা করছে। সবার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, কেবল আমার সামনেটা অন্ধকার। আত্মীয়স্বজনরাও আমার অভিনয়টাকে সুনজরে নিল না। সবাই অবাক হত, প্রতি সন্ধ্যায় ছেলেটা কী এমন রাজকার্য করে, আর আমি ভাবতাম আমাদের মতো রাজকার্য বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ করে না।

বাবা আমার কাজকর্ম পছন্দ করতেন না বটে, তবে মাকে প্রায়ই বলতেন—’হি ইজ আ ব্রান্ডেড কমিউনিস্ট। একটা জিনিস ও কোনও খারাপ সংসর্গে মেশে না, কারণ ওর পয়সার দরকার পড়ে না।’

এমনই একটা সময় ‘পথের পাঁচালী’ এল এবং আমরা সত্যজিৎকে নিজেদের লোক অর্থাৎ ট্রাডিশনের বাইরের লোক ভেবে ফেললাম। রিলিজ করার পর আমি আর সত্য পরপর সাতদিন রোজ একবার করে ছবিটা দেখলাম। ‘বসুশ্রীর’ মালিক মন্টুদা—মন্টু বসু১৪ ব্যাপারটা লক্ষ করলেন। মন্টুদা আমাকে ছোটোবেলা থেকেই চিনতেন আর দারুণ স্নেহ করতেন। সত্যি, জীবনে যে কতজনের কত স্নেহ ভালোবাসা পেলাম, তার হিসেব নেই। তো দেখলাম ছবিটা এখানকার সমালোচকরা কেউ ধরতেই পারলেন না। একজনই মাত্র পেরেছিলেন তিনি পঙ্কজ দত্ত। পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে যখন ‘পথের পাঁচালী’ অসংখ্য পুরস্কার পেল, তখন আবার হোম ক্রিটিকরা নতুন করে সমালোচনা লিখলেন।

এসে গেল ‘৫৭ সাল। এই বছর আমরা প্রথম নাট্যোৎসব করলাম। পরপর তিনদিন রংমহলে১৫ উৎসব হল। ঠিক এই সময়েই বাবার গলব্লাডার অপারেশন হল। বাড়ির বড়ো ছেলে। কর্তব্যকর্ম সবই করতাম। চাকরিও। তবে ওই বেলা একটা পর্যন্ত। আসলে ‘৫৩ সালে অফিসে বৈকুণ্ঠের উইল নাটক হয়। ওখানে একটি দৃশ্যে অভিনয় করে আমি গোল্ড মেডেল পাই। তারপরই অফিসে চিফ মেট্রোপলিটান জাজ খোঁজ নেন আমার সম্বন্ধে। আমি কে, কী করি। তো শুনলেন উৎপল দত্তর দলে নাটক করি। ব্যস, আর অসুবিধে হয়নি। রংমহলে পরপর তিনদিনে আমরা করলাম ‘নীচের মহল’, ‘তপতী’, আর গিরীশ ঘোষের ‘সিরাজউদ্দৌলা’। এই প্রথম একটি ক্লাসিক নাটক উৎপলদা নামালেন। এই নাটকে আমি করেছিলাম দানশা ফকির। বিরাট রোল, দারুণ রোল। ‘নীচের মহল’ তো উচ্চ প্রশংসিত হল। ওটা ছিল বিদেশি নাটকের অনুবাদ— মনা ভট্টাচার্য অনুবাদ করেছিল। মনা ছিল জেলখাটা কমিউনিস্ট, আমাদের বন্ধু, মারা গেছে। ‘নীচের মহল’ তো শহরে সাড়া ফেলে দিল। হল ভিড়ে ঠাসা। সে এক দারুণ কাণ্ড। সেবার আমাদের নাট্যোৎসব এককথায় সফল।

বছর কয়েক পর। ‘৬৪ কি ‘৬৫ সাল। আমি তখন এলটিজি ছেড়েছি, নিজের দল গড়েছি ‘চলাচল’। তা এই সময়ে কোচবিহার থেকে নেমন্তন্ন এল। সেই যে ছেলেবেলার বন্ধু মান্টু— মানে সুনীল দাশগুপ্ত— ওর ডাকে। দল নিয়ে গেলাম। অনুভা১৬ সঙ্গে ছিল। ‘ঠগ’ বলে একটা নাটক করলাম।— জা পল সাঁত্র১৭-র একটা নাটকের বাংলা রূপান্তর। কী বলব দু:খের কথা— যে নাটক নিয়ে কলকাতায় হইহই, কোচবিহারে কোনও প্রতিক্রিয়াই হল না। পরদিন আমি, পাড়ার দু’চারজনকে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন লাগল?’ সরাসরি বললেন— ‘ভালো না।’ আমি তো অবাক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্যান ভালো না?’ বললেন, ‘আর্ট নাই।’ আমি তো আরও অবাক— ‘আর্ট নাই?’ তখন পরিষ্কার করে বললেন— ‘না আর্ট নাই, মানে ঘরে যেমন কথাবার্তা বলি, সেরকমই তো করলেন।’ তখন বুঝলাম নাটকে রিয়ালিজম তাঁরা পছন্দ করেন না। একটু অতি নাটকীয় না হলে, অভিনয় করছি সেটা না বোঝালে তাঁদের কাছে নাটক ‘ভালো’ হয় না। আমি তখন মান্টুকে বললাম, মান্টু তুমি রাজনীতি করছ ঠিকই, কিন্তু পাবলিকের কালচারাল মাইন্ড বোঝো না। ব্যাস, পরিকল্পনা বদলে গেল। সঙ্গে ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’। পাঁচদিনের শেষ তিনদিন হল ‘অলীকবাবু’। কী বলব প্রচণ্ড জনপ্রিয় হল। ফাটাফাটি কাণ্ড।

‘৫৯-এ এসে মিনার্ভা১৮ হল পেলাম। আর এই সময় থেকেই দলে ভাঙন শুরু হল, শুরু হল ঝড়। সতীকান্তবাবু সরে গেলেন। আসলে উনি চাননি আমরা পেশাদারি নাটকে যাই। উনি বললেন— যাও, তবে আমি ট্রাস্টি করে দেব। সেখানে নাটক ঠিক হবে। শিল্পীরা টাকা পয়সাও পাবে। সে হল না। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি সেই সময় কিছু কমিউনিস্ট নেতা সতীকান্তবাবুর সুপ্রিমেসিটা মানতে পারছিলেন না। অন্য নেতৃত্ব এল।

তখন আমরা চূড়ান্ত আর্থিক অনটনে। মিনার্ভায় ‘নীচের মহল’ ফ্লপ করল কারণ সেই গ্রাম্য দর্শক। মাথায় ৮০ হাজার টাকার দেনা। কী করে শোধ হবে? আমি সামান্য চাকরি করি, উৎপলদা কিছু করতেন কি না মনে নেই। কে শোধ করবে? মনে আছে ‘নীচের মহল’-এর শেষ শো। হলে সব মিলিয়ে ৭০/৮০ জন লোক। শো শেষ হলেই আমরা বসব ভবিষ্যৎ ঠিক করতে। মনের অবস্থা খুব খারাপ। সেইদিনই আমাদের শো দেখতে এসেছিলেন রবিশঙ্কর। নাটক শেষে বললেন, ‘এমন নাটক কেউ নিল না? ঠিক আছে। আমার দ্বারা যদি কিছু করার থাকে তো বলবেন।’ সেই শুরু হল পরিকল্পনা। উৎপলদার পরিচালনা, তাপস সেন১৯-এর আলো। নতুন আঙ্গিকে নতুন নাটক ‘অঙ্গার’২০। তারপর তো ইতিহাস। ‘অঙ্গার’ সুপার হিট। চাকা ঘুরে গেল। ‘৫৯-এই আমার জীবনে একটা অঘটন ঘটে গেল। ‘অঙ্গার’ শুরু হবার সাতদিন আগে বাবা মারা গেলেন। বাবা আমার সঙ্গে হয়তো মাসে একটা কথা বলতেন, কিন্তু বাবা তো বাবা-ই। মাথার উপর ছাত। বাবার চলে যাওয়াটা মাথার উপর থেকে ছাতটা সরে যাওয়া। আমরা বরিশাইলা বাঙাল তো! ভীষণ জিদ! আমার আর বাবার মধ্যে একটা চাপা মান-অভিমান চলত। বাবা আমাকে মানে আমার কাজকর্মকে পছন্দ করতে শুরু করলেন, ওঁর এক বসের কথায়। তিনি জাস্টিস এস এন গুহরায়। উনি বাবাকে বলেছিলেন, আমি নাকি ট্যালেন্টেড। সেই কথাটা বাবার মনে ধরেছিল। এর আগে পর্যন্ত আমার অভিনয় নিয়ে বাবা তেমন মাথা ঘামাতেন না। মাকে বলতেন—’ও আবার কী অভিনয় করবে, ওই তো চাকরবাকরের মতো চেহারা। আমি দ্যাখসি দুগ্গা বাঁড়ুজ্যেকে২১।’ সেই বাবাই জাস্টিস গুহরায়ের কথা শোনার পর আমার দু’তিনটে নাটক দেখলেন। ‘অঙ্গার’-এর আগে তো বাবা ১৫টা টিকিট বুক করে রেখেছিলেন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দেখবেন বলে। কিন্তু হল না। আমি কাছা গলায় দিয়ে অভিনয় করেছিলাম। আর সেই অঙ্গারেই আমি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা পেলাম। এই সময় একের পর এক ট্র্যাজেডি আমাদের সংসারটাকে তছনছ করে দিল। বাবা চলে গেলেন ‘অঙ্গার’-এর সাতদিন আগে আর অঙ্গারের ১০০ দিনের মাথায় আমার বড়ো জামাইবাবু মারা গেলেন। দিদি ওর ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরে এল। বাবা মারা যাবার পরপরই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। নাটক আর চাকরি—একসঙ্গে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। প্রয়োজনও কম ছিল। ছোটোভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। ও মাঝে মাঝে মায়ের নামে টাকা পাঠাত। মেজোভাইও কর্মসূত্রে বাইরে থাকত, কিন্তু ওর রোজগার আহামরি ছিল না। যা হোক, আমিও এদিক-ওদিক কিছু করে নিতাম, চলেও যেত। কিন্তু জামাইবাবুর মৃত্যুটা ধাক্কা দিয়ে গেল। বিরাট দায়িত্ব, রোজগার নেই। দল থেকে মাসে ২০ টাকা হাতখরচ পেতাম।

‘অঙ্গার’ তখন চলছে হইহই করে। মনে রাখবেন, পাশাপাশি পেশাদারি মঞ্চে স্টার২২-এ ‘সেতু’২৩, রংমহলে ‘উল্কা’২৪ চলছে। ‘অঙ্গার’-এ আমি করতাম সনাতনের চরিত্র। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় খবর এল সব পেশাদারি মঞ্চকে ছাপিয়ে আমাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। বন্ধু বান্ধবদের সে কী আনন্দ।

সুখটা টিকল না। বাড়িতে অভাব। দলে ভাঙনের সূচনা। চতুর্দিকে বিপর্যয়। ‘অঙ্গার’-এর পরই বুঝতে পারলাম সুর কেটে গেছে। আমি এলটিজি ছাড়লাম।

উৎপলদার সঙ্গে কোনও মনোমালিন্য হয়নি, আজও তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে। দল ছাড়লাম সম্পূর্ণ নীতিগত কারণে। গ্রুপ ছাড়ার মাস ছয়েক আগে থেকেই আমার অর্থনৈতিক অবস্থাটা শোচনীয় হয়ে পড়ে। তবু ভালোবাসার লোকও তো জুটে যায়। আমার এক শুভানুধ্যায়ী দাদা, আপন নন, কিন্তু সত্যিকারের আত্মীয়, এই দুর্বিপাক থেকে আমাকে বাঁচান। আমি ওঁকে বলেছিলাম, আমায় মাসে মাসে কিছু টাকা করে ধার দাও। উনি দীর্ঘ ছ’মাস টাকা দিয়ে গেছেন। হয়তো সামান্য টাকাই, কিন্তু তখন সেটাই ছিল অসামান্য। এই সময় ভেবেছিলাম, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাব। চাকরি করব। বন্ধুরা বড়ো বড়ো পোস্টে বসে আছে। একটা জুটিয়ে নেব। প্রেমাশিস তখন দুর্গাপুরে। ও বলেছিল, তুমি যেরকম কথাবার্তা বলো, তাতে খুব ভালো সেলসম্যান হতে পারবে। আমি ‘অঙ্গার’ নাটক ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বরূপার রাসবিহারী সরকার আমাকে মাসে ৮০০ টাকা মাইনের অফার দিয়ে ডেকে পাঠালেন। গেলাম না। সেই যে নীতিবোধ। আমরা তো পেশাদারি মঞ্চে অভিনয় করতে পারি না। ওই পাঁচভূতের মধ্যে বসে খাওয়া—সে পারব না। মা দোনামনা করেছিলেন, কিন্তু আমি বলেছিলাম—ওরকম অসাংস্কৃতিক জায়গায় থাকতে পারব না। সব যখন ছেড়েছুড়ে দেব ভাবছি, হঠাৎ তপন সিংহ২৫-র ডাক পেলাম।

মনে হল আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। উনি তখন ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ করার কথা ভাবছেন। আমাকে বললেন, আপনাকে পানুর রোল করতে হবে। সেদিন উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার বাড়ির সব কথা শুনলেন। তার দু’দিন পরেই আমার হাতে ৫০০টা টাকা দিলেন। বললেন— আমেরিকা যাচ্ছি, ফিরে এসেই কিন্তু শুটিং। আমি প্রায় লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরে দিদির হাতে টাকাটা দিয়ে বললাম— ‘নে, চালা সংসার।’ দিদিই সংসার চালাত। তারপর আর ভাবতে হয়নি।

একদিন ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’-র শুটিং শুরু হল। আমি নাটকের ছেলে। কেমন করে শট দিতে হয় তা তো জানি না। প্রথম দিনেই তাই সারেন্ডার করলাম, ‘তপনদা আমি যে কিছু জানি না।’ তপনদা বললেন, ‘অ্যাক্টিং জানেন তো।’ বললাম, ‘সেটা বোধহয় কিছুটা জানি।’ বললেন, ‘ওতেই হবে।’ উনি শুধু ক্যামেরাকে কী করে নিতে হয় সেই টেকনিকগুলো শিখিয়ে দিলেন। ‘হাঁসুলি বাঁকের’ প্রায় পুরোটার শুটিংই হয়েছিল আউটডোরে— বীরভূমের লাভপুরে। ওখানেই অনুভার সঙ্গে আলাপ। আমার তখন কী অবস্থা। আমার শট থাকুক বা না থাকুক, অনুভা বা কালীদা যেই শট দিক, আমি হাঁ করে দেখতাম। আবার আমার জীবনে শেখার একটা নতুন অধ্যায় শুরু হল।

তপনদার ইউনিটে একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। খাবার সময়ে সকলে একসঙ্গে বসে খাবে এবং একই খাবার খাবে। সে পরিচালক থেকে শুরু করে নিম্নতম টেকনিশিয়ান পর্যন্ত। ফলে একটা পারিবারিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠত। সারাদিন শুটিং-এর পর তারপর শুরু হত আড্ডা। এই সময় আমি তেমন বেশি টাকা পাইনি। কিন্তু তপনদা বা মানিকদার ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে কখনও কিছু বলতে হয়নি। এই তপনদাই পরের ছবিতে বলেছেন, ‘রবির এখন বাজার দর বেড়েছে, ওকে বেশি টাকা দাও।’

মনে আছে হাঁসুলি বাঁকের কয়েকদিনের শুটিং এনটি টুতেও হয়েছে। এরকম সময় আমি আড্ডা মারতাম বিখ্যাত ডেন্টাল সার্জন গোপাল ব্যানার্জির চেম্বারে। গোপালদা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার চূড়ান্ত দুরবস্থার সময় গোপালদা জিজ্ঞেস করতেন—টাকা দেব? আমি অবশ্য কোনওদিন টাকা নিইনি। এরকমই একদিন গোপালদার আড্ডা থেকে ফিরছি। পথে ভানু ঘোষের সঙ্গে দেখা। ভানু তখন সত্যজিৎ রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভানু আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় থাকিস? মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এক্ষুনি চল।’ ভানু জোর করে ধরে নিয়ে গেল মানিকদার লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। কী অসাধারণ সে রিসেপশন মানিকদার, আজও মনে পড়ে। দেখেই গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘কোথায় থাকো, তোমাকে তো একটা রোল করতে হবে। কী করবে তো?’ না করার তো প্রশ্নই নেই। আমার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। দেখলাম মানিকদা নিমেষে কী আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন আমাকে। বললেন, ‘আগামী সপ্তাহে তোমার আর সৌমিত্র২৬-র স্ক্রিন টেস্ট নেব। সৌমিত্র ড্রাইভার তুমি ক্লিনার। ক্লিনার দেখেছো?’ বললাম, ‘দেখেছি মানে? আমি কালীঘাটের ছেলে। ক্লিনারদের মতো দারুণ সিটিও দিতে পারি। সিটি মেরে কত পায়রা উড়িয়েছি।’ সেই শুরু আমাদের যৌথ যাত্রা। ‘অভিযান’ দিয়ে সেইদিন মানিকদার বাড়িতেই সৌমিত্রর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। মানিকদার বাড়ি থেকে বেরিয়েই সৌমিত্র জিজ্ঞেস করল, ‘বিয়ার খান’, আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ব্যাস, ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চাংওয়া। সেদিনের সব কথাটাই হল অভিযানকে ঘিরে। আমাদের সেদিনের বন্ধুত্ব আজও অটুট। ‘অভিযান’ আমাকে খ্যাতি এনে দিল। ছবির জোয়ার শুরু হয়ে গেল। আমি ঢুকে পড়লাম গোয়ালে। টাকা পেলাম, খ্যাতি পেলাম, মানুষের ভালোবাসাও পেলাম। ‘অভিযান’-এর আগেই ‘হাঁসুলি বাঁক’ রিলিজ করেছিল, খুব ভালো ছবি, কিন্তু বাজার পেল না।

এই সময়টাতেই আমি অনুভাকে (অনুভা গুপ্ত) বিয়ে করব ঠিক করলাম। এই বিয়েটাকে কেন্দ্র করে প্রচুর জল ঘোলা হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির লোকজন তো ভেবেছিল যে কোনওদিন আমি খুন হয়ে যাব। আসলে অনুভার বাড়ির কিছু লোকজন ছিল সাংঘাতিক প্রকৃতির। তারা এ বিয়েটা চায়নি। আমি আইনজ্ঞর পরামর্শ নিলাম। আমার কাকাও বার্ন কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। আইন বুঝতেন। সব শুনে বললেন ‘ইউ ক্যান গো অ্যাহেড’। আমরা বিয়ে করলাম। অনুভা তারপর সাতবছর বেঁচেছিল। সেই সাতবছরের বিবাহিত জীবনে আমি সুখী হয়েছিলাম। অনুভার সঙ্গে আমার মা আর দিদির সম্পর্ক ছিল দারুণ ভালো। আর অনুভারই দারুণ স্নেহের পাত্রী ছিল জয়া, জয়া ভাদুড়ি২৭, পরে জয়া বচ্চন।

জয়ার সঙ্গে দেখা হবার ঘটনাটা বলি। তপনদার ‘নির্জন সৈকতে’-র শুটিং চলছে পুরীতে। দেখলাম তরুণদা২৮ মানে সাহিত্যিক সাংবাদিক তরুণ ভাদুড়ির সঙ্গে একটি ছটফটে মেয়ে হাজির। নাকে চোখে মুখে কথা বলে। বছর চোদ্দো বয়স নাম জয়া। আমাদের ইউনিটে ছিল রিঙ্কু মানে শর্মিলা২৯। রোজ সন্ধেবেলা শুটিং পর্ব সারা হলে আমাদের আড্ডা বসত, সেই আড্ডায় ছোট্ট জয়াও যোগ দিত। ও এসেছিল পুরীতে ছুটি কাটাতে। তা আমাদের আড্ডা ও রীতিমতো মাতিয়ে দিত। তখনই আমার মাথায় একটা মতলব চেপে বসে।

মানিকদা তখন ‘মহানগর’৩০-এর জন্য একটা বছর চোদ্দোর ছটফটে বাঙালি মেয়ে খুঁজছেন। জয়াকে দেখে ভাবলাম এ পারবে। বললাম তরুণদাকে। তরুণদা বললেন, ‘আমি জানি না, ওকেই বরং জিজ্ঞেস করে দেখো।’ জয়া কিন্তু সেই সময়ে ফিল্মকে বেশ অপছন্দ করত। তা বলে কয়ে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে রাজি করালাম। ফিরলাম কলকাতা। মানিকদাকে ফোন করলাম। তবে বলেছিলাম, ‘ঘরে যেন বেশি লোকজন না থাকে। যা খেপচুরিয়াস মেয়ে, বিগড়ে গেলে মুশকিল।’ মানিকদা বললেন, ‘ঠিক আছে, নিয়ে এসো।’

নির্দিষ্ট দিনে নিয়ে গেলাম। ঘরে মানিকদা, বৌদি৩১ ছাড়াও বংশী চন্দ্রগুপ্ত৩২ ছিলেন। মানিকদা সাংঘাতিক হিউম্যান সাইকোলজি বুঝতেন। উনি খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন— ‘কী করো, ছবিটবি দ্যাখো?’ জয়া বলল, ‘হ্যাঁ।’ উনি বললেন, ‘কী রকম?’ যেই না বলা, জয়া অবিশ্বাস্যভাবে তখনকার হিন্দি ছবির যত স্টার নায়িকা— মধুবালা৩৩, নার্গিস৩৪, সুরাইয়া৩৫ সব্বাইকে নকল করে দেখাতে লাগল। একঘণ্টা এরকম চলল। সেদিন ফেরার সময় মানিকদা বললেন, ‘রবি, আমি তাহলে শুটিং-এর তারিখ ঠিক করছি।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘তার মানে সিলেক্টেড?’ মানিকদা মৃদু হাসলেন— ‘সিলেক্টেড।’

শুরু করেছিলাম অনুভার জয়াকে ভালোবাসার কথা দিয়ে। সে ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে কলকাতায় জয়া এলে আমার বাড়িতেই থাকত এবং আমি অনুভাকে বলতাম, ‘ও তোমার কাছেই শুক, আমি অন্যঘরে যাচ্ছি।’

ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পাস করে বহু বছর পর জয়া কলকাতায় এল। ওর চেনাজানা কোন এক পরিচালক ওকে নাকি কথা দিয়েছিলেন ওকে নায়িকা করে ছবি করবেন। কিন্তু এসে দেখল ওকে নিচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই দারুণ ভেঙে পড়ল। ভীষণ মন খারাপ। তখন আমি তরুণদাকে বললাম, ‘আপনি চলে যান, ও আমার কাছে থাকুক।’ তরুণদা আমাকে জয়ার লোকাল গার্জিয়ান নিযুক্ত করে চলে গেলেন।

এরকম একটা সময়ে জানতে পারলাম, ঢুলুদা মানে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৩৬ ‘ধন্যি মেয়ে’ বলে একটা ছবি করছেন। ‘ধন্যি মেয়ে’তে আমি ভজহরির রোল করি। ঢুলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘আপনার হিরোইন হয়েছে?’ বললেন—’না রবি, কত খুঁজছি, কিন্তু মনের মতো পাচ্ছি না!’ আমি বললাম— ‘একটা নতুন মেয়ে দিতে পারি। কত দেবেন? বললেন— ‘কেন? দু’হাজার। নতুনেরা যা পায়।’ বললাম— ‘হবে না। যদি পাঁচ হাজার দেন, তো কাল সকালে প্রাোডিউসারকে সঙ্গে করে আমার বাড়িতে চলে আসুন। বললেন— ‘তা মেয়েটা কে?’ তখন সব বললাম। শুনে তো উনি লাফিয়ে উঠলেন।

প্রথম দিন শুটিং করেই উত্তমদা৩৭ বললেন— ‘উরেব্বাস রবি, এ তো ধানি লঙ্কারে।’ সাবিত্রী৩৮ বলল— ‘বাপরে, কী তৈরি?’ হবে না কেন? তখন তো শিখে গেছে সব। ‘ধন্যি মেয়ে’-তে একেবারে ফাটিয়ে দিল জয়া।

সেই সময় হঠাৎ একদিন বম্বে থেকে হৃষিদা৩৯-র ফোন এল আমার কালীঘাটের বাড়িতে— ‘রবি, জয়া তোর ওখানে?’ বললাম— ‘হ্যাঁ।’ বললেন— ‘আর বলিস না। ওকে আমি পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। একটা ছবি করছি— গুড্ডি। তার নায়িকা করব। ওকে পাঠিয়ে দে।’ জয়ার সে কী অভিমান। বলে— ‘না, যাব না। বাংলা ছবি করব।’ আমি বললাম— ‘শোনো বাবা, তুমি তো বাংলাদেশে মানুষ হওনি। জানো না এখানকার বেদনা, দু:খ আর স্ট্রাগলকে। ও সব আমি সইতে পারব, তুমি পারবে না। তুমি বম্বে যাও। আর এত ভালো হিন্দি জানো তুমি। বম্বে হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে তুমি তোমার প্রতিভাকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে।’ ও বম্বে চলে গেল আমাদের ছেড়ে। সেটা ‘৬৯-৭০। তারপর আবার এল। তখন ও প্রতিষ্ঠিত। হাতে প্রচুর ছবি। সেক্রেটারি রেখেছে। শুটিং-এর চেইন। ‘ধন্যি মেয়ে’ পর্যন্ত ও আমার বাড়িতেই ছিল। এবার আমি প্রাোডিউসারকে বললাম—’ওকে গ্র্যান্ডে রাখুন।’ শুনে জয়া বলে—’না না আমি তোমার ওখানেই থাকব।’ বললাম—’না। যে ইন্ডাস্ট্রির যে রীতি। তুমি সারাদিন আমার বাড়িতে থাকো, খাও, গল্প করো, কিন্তু রাতে গ্র্যান্ডে ফিরতেই হবে। এটা তোমার কেরিয়ারের জন্য দরকার। বম্বের অভিনেত্রীকে গ্র্যান্ড ছাড়া মানায় না।’

এই করতে করতে ‘৭২ সাল এসে গেল। আবার আমার জীবনে ঘনিয়ে এল ঝড়। শোকের ঝড়। জানুয়ারিতে অনুভা চলে গেল। এপ্রিলে মা। সেপ্টেম্বরে দিদি। আমি নি:স্ব হয়ে গেলাম। একা, শুধু একা। ভাই বোনেদের সব বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। শুধু আমি ডিরেইলড হয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে আমায় বাঁচিয়ে দিলেন হৃষিদা। ‘সব সে বড়া সুখ’ করছিলেন, ডেকে পাঠালেন।

‘সব সে বড়া সুখ’ ফ্লপ করল। হৃষিদা বললেন, ‘ছবি ফ্লপ কিন্তু তুই হিট। চলে আয়, এখানে সবাই তোকে খুঁজছে।’ না, আর যাইনি। কারণ হিসেবে বলতে পারি, প্রথমত আমি হচ্ছি টিপিকাল বাঙালি। বম্বেতে আমার পোষাবে না। দ্বিতীয়ত আমার রোজগারটা যাদের জন্য, তারা সব মারা গেছে। আমার একার জন্য কিছু লাগবে না, ও যেমন তেমন করে চলে যাবে। একমাত্র রিঙ্কু বলেছিল, ‘রবিদা কিছুতেই বম্বেতে থাকতে পারবে না।’ রিঙ্কু আমার দারুণ বন্ধু। কালীঘাটের বাসায় আড্ডায় একেবারে মক্ষিরানি হয়ে বসে থাকত। আমার মা, দিদি আর অনুভাকে ও-ও খুব ভালোবাসত। রিঙ্কু ছাড়া মানিকদাও বলেছিলেন, ‘না না, রবি বম্বেতে থাকতে পারবে না।’ পুরো ‘৭৩ সালটা বম্বেতে ছিলাম। তখন অমিতাভ৪০-র সঙ্গে জয়ার প্রেম উত্তুঙ্গে।

অমিতের কথায় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সেটা ‘৮৩ সাল। বিয়ের পর বৈশাখীকে নিয়ে আমি বম্বে গেছি। একদিন জয়াকে ফোন করলাম। ফোন পাওয়ার পর জয়া উচ্ছ্বসিত ‘কোন হোটেলে আছ? দাঁড়াও গাড়ি পাঠাচ্ছি।’ গেলাম জয়া-অমিতাভর ‘প্রতীক্ষা’য়। কী চমৎকার বাড়ির নাম দিয়েছে ওরা—’প্রতীক্ষা’। তারপর তো গল্প আর গল্প। জয়া বৈশাখীকে বলল—কাকিমা, রবিকাকু কিন্তু মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। তারপর ড্রিঙ্কসও সাজিয়ে দিল। একটু পরে অমিতাভ এল। ও তো আবার ড্রিঙ্ক করে না। সুতরাং এ ব্যাপারে আমার সঙ্গী হতে পারল না। তারপর গল্প করতে করতে আর খেতে খেতে রাত প্রায় পৌনে একটা। ওদের ড্রাইভার চলে গেছে। জয়া চিন্তিত। আমি বললাম—কী আছে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে যাব। অমিতাভ হাঁ হাঁ করে উঠল—’তা হয় নাকি? ভাবিজি আছেন না? আমি পৌঁছে আসছি।’ তার আগে দিয়েই ‘কুলি’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে অমিত দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই রাতের বেলায় ড্রাইভ করার ব্যাপারে জয়া চিন্তিত ছিল। অমিত কিন্তু সেই রাতে গাড়ি বার করে নিজে ড্রাইভ করে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিল। বৈশাখী তো কোনওদিন গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড দেখেনি। ও এমনিতেই মুগ্ধ ছিল। আমি শুধু বৈশাখীকে বললাম—কলকাতায় তোমার বন্ধুদের বোলো, সুপার হিরো শুধু ফিল্মের সুপার স্টারই নয়, ভদ্রতাতেও সুপার।

অমিতের ভাগ্যটা খারাপ। অমিত মানে অমিতাভ। বেচারি একটাও ‘এ’ ক্লাস রোল পেল না। পেলেও এখন আর ওকে নেবে না। হৃষিদা ‘আলাপ’ বলে একটা ছবি করেছিল। সেতার নিয়ে ছবি ও সেতারিয়া। অমিত তো একসময় ভালো সেতার বাজাতও। তাই ওর অসুবিধাও হল না। দারুণ ভালো ছবি হল। কিন্তু চলল না। হৃষিদা দু:খ করে বললেন—’এই যদি এক্সাইটিং অমিত সেতারটা তুলে কাউকে মারছে, ছবি হিট হয়ে যেত। দেখানো গেল না বলেই সাত দিনে উঠে গেল!’ কিছুদিন আগে তিনু আনন্দের ‘ম্যায় আজাদ হুঁ’ বেশ ভালো লাগল। কিন্তু দু:খ একটাই, ওর প্রতিভাকে কেউ কাজে লাগাল না। ও একটা চক্করে পড়ে গেছে—জনপ্রিয়তার চক্কর। সেটা থেকে ও আর বেরোতে পারবে না।

আগে একটা সময় খুব আড্ডা হত। অমিত ট্রেন্ড ভাঙবে কি ভাঙবে না, দ্বিধায় ছিল। আসলে ট্রেন্ড ভাঙা যায়, কিন্তু জনগণ না নিলে? তাহলে তো সব শেষ। পাবলিক ওর রাগি যুবকের চেহারাই পছন্দ করে। ও কী করবে? জয়া কিন্তু একদম পছন্দ করে না ওর এই অ্যাংরি ইমেজ। কিন্তু করার কিছু নেই। একমাত্র হৃষিদা ছাড়া অমিতকে আর কেউ ব্যবহার করল না। এটাই যা দু:খ।

অনুভা মারা যাবার পর দশ বছর আমি এক্কেবারে একা ছিলাম। তখন আমার জীবনে কোনও ছন্দ ছিল না। মদ্যপান ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। অবস্থা দেখে আমার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় পরিজন, বিশেষ করে ছোটোবোন বলল, ‘এভাবে চলে না। বেঁচে থাকতে হলে ঠিকভাবে চলতে হবে। বিয়ে করো।’ তখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বন্ধু-বান্ধবরাই ধরে করে সম্বন্ধ করল, বিয়ে করলাম বৈশাখীকে। ‘৮২ সালের নভেম্বরে।

সেই বৈশাখীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম মানিকদার বাড়ি। মানিকদা, বৌদিও আমার এই নতুন জীবনে খুব খুশি হয়েছিলেন। ওঁরাও আমার স্থিতি চাইছিলেন। তা এখানেই আমার সঙ্গে মানিকদার কথোপকথনে বৈশাখী বিস্মিত। বলল, ‘অদ্ভুত তো, মানিকদার মতো লোক চুপ করে শোনেন, আর তুমি বকে যাও?’ বললাম, ‘ওখানেই তো মজা। মানিকদা তো আমাদের মতো মিশতে পারেন না। তাই উনি ভাবেন, শুনি তো রবি কী বলে। ইন্টারেস্টিং।’ কিন্তু ফিল্ম সংক্রান্ত কিছু জানতে চাইলে শুধু ধরিয়ে দিলেই হত—একেবারে অ্যাকাডেমিকভাবে ফিল্মের দর্শন পর্যন্ত বলে যেতেন। প্রতিটি বিষয়ে কী অস্বাভাবিক জ্ঞান—কী সঙ্গীত, কী সাহিত্য, কী চলচ্চিত্র!

মানিকদার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাই আলাদা।

মানিকদার শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ আমি ছিলাম। এ আমার পরম সৌভাগ্য। আমার ভূমিকাটা ছিল এক অভিনেতার। মানিকদাকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘চরিত্রটা কেমন? মানে কী ম্যানারিজম থাকবে?’ বললেন— ‘কী আবার? রবি ঘোষের যা ম্যানারিজম তাই, চরিত্রটা রবি ঘোষেরই শুধু রবি ঘোষ নামটা পালটে দিয়েছি। ব্যাস এক নিমেষে বুঝে ফেললাম। আর কোনও অসুবিধাই হয়নি। মনে আছে, অভিযানের শুটিং হচ্ছে। দৃশ্যটায় আমি, সৌমিত্র আর ওয়াহিদা৪১। আমার একটু ছোটার ব্যাপার ছিল মাঠ পেরিয়ে। দৌড়োলাম। দেখি সামনে একটা ষাঁড়। দিলাম এক লাফ। পরমুহূর্তেই ভয় পেলাম—এই রে গেল বুঝি শটটা। দেবেন মানিকদা বকুনি। মানিকদা বললেন ‘কাট’। ভয় বেড়ে চলল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে শুনলুম মানিকদা বললে—’এক্সেলেন্ট।’ আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

ফ্যানটাস্টিক অভিজ্ঞতা হল ‘গুপি গাইন’-এর সময়। জীবনে অত ঘুরিনি। সেই প্রথম আউটডোর শুটিং করতে কোথায় না ছুটলাম—শান্তিনিকেতন, বোলপুর, রামপুরহাট, নন্দীগ্রাম, রাজস্থানের জয়পুর, যোধপুর, বিকানির, জয়সলমীর, সিমলার থেকেও উঁচুতে উখরিতে। আর যেখানেই গেছি, দেখি এলাকার প্রশাসনের সর্বোচ্চ মাথাটি এসে হাজির। কারণ সত্যজিৎ রায় এসেছেন। রাজত্ব গেলেও রাজার এলাকায় রাজা, অন্য জায়গায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী। আশ্চর্য লাগত! আর মানিকদার কাজের রীতি যে কী অনন্য সাধারণ, আমি বর্ণনা করতে পারব না। আমরা মাঝে মাঝে লজ্জা পেতাম। মানিকদার কী এনার্জি, আমাদের তো অত নেই। সারাদিন শুটিংয়ের পর আমরা হয়তো আড্ডা মারছি, মানিকদাও যে গল্প করতেন না তা নয়, কিন্তু এই দেখলাম গল্প করছেন, পরমুহূর্তেই দরজা ফাঁক করে দেখি কাজে ডুবে গেছেন। সত্যিকার কর্মযোগী। যা করতেন তাতেই ডুবে যেতেন।

গুপি গাইনের শুটিং করতে উখরি গেছি। মানিকদা একটা পাঁচতলা উঁচু স্লোপিং দেখিয়ে বললেন, ‘ওখান থেকে ঝাঁপ দিতে পারবে না তোমরা?’ আমি আর তপেন৪২ বললাম নিশ্চয়ই পারব। স্থানীয় লোক তরতর করে উঠে গেল, ঝাঁপও দিল। ওখানে উঠে তো আমাদের মাথা ঘুরে গেল। উরিব্বাস, কী ঠান্ডা। কী রে বাবা, অকালে প্রাণটা যাবে? তবে উঠেছি যখন নামতে তো হবেই। যা থাকে কপালে। মানিকদা বলে দিয়েছিলেন, উনি ইঙ্গিত করলে তবেই ঝাঁপ। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম—ইঙ্গিত আসছে না। কী ব্যাপার? না, মোক্ষম মুহূর্তে ক্যামেরায় ফাঙ্গাস না কী যেন জমে গেছে ওই ঠান্ডায়। গড়বড় হবার আর সময় পেল না, এদিকে আমরা তো ঠান্ডায় কাঠ। যাই হোক, একসময় বুঝলাম—হাতে পায়ে আর সাড় নেই। মানিকদার তলবও পেলাম, ঝাঁপও দিলাম। সে এক এক্সেটিক ফিলিং। মনে হল তুলোর প্যাঁজার ওপর দিয়ে গড়িয়ে এলাম, কিন্তু হাত পা স্টিফ। মানিকদা বললেন, ‘শিগগির ওদের ভ্যানে তোলো, আর গরম দুধ খাওয়াও।’ সব রেডিই ছিল। গাইড বলল, ‘খবরদার, আগুনের কাছে যাবেন না, পা ফেটে যাবে। শুধু পা ঠুকুন।’ পাক্কা ২৪ ঘণ্টা পর হাতে পায়ে সাড় ফিরে পেলাম।

‘অভিযান’-এর শুটিং-এর সময় একটা ভয়ানক দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচেছি। বীরভূমের সাঁইথিয়ার কাছে জায়গাটা। দৃশ্যটা ছিল, রেললাইনের ওপর দিয়ে আমাদের গাড়িটা যাবে, অন্যদিকে, লাইনের ওপর দিয়ে ইঞ্জিন ছুটে আসবে। ওই ইঞ্জিনে ক্যামেরা নিয়ে মানিকদা ছিলেন। গাড়িতে আমি আর সৌমিত্র। সৌমিত্রর হাতে স্টিয়ারিং। দেখলাম ইঞ্জিন আসছে, এদিকে রেললাইনে আমাদের গাড়ি আটকে গেছে। সে এক সাংঘাতিক পরিস্থিতি। যখন ইঞ্জিনটা ৩০/৪০ গজ দূরে সৌমিত্র গিয়ারে চাপ দিল আর ঝপাং করে লাফ দিয়ে গাড়ি উঠে পড়ল। ক্যামেরায় সেই শটটি ধরা পড়ল। পরে মানিকদা বললেন, ইঞ্জিন থেকে তোমাদের অবস্থা দেখে আমার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

‘অভিযান’-এ আমার টুকরো ইম্প্রোভাইজেশনকে উনি মেনে নিলেও জনঅরণ্যর নটবর মিত্তিরের ক্ষেত্রে যেমন বলেই দিয়েছিলেন—’ইম্প্রোভাইজেশন না করতে পারলেই ভালো। একদম দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ মিলিয়ে সংলাপ বলবে। চরিত্র তাই ডিমান্ড করছে।’ এইভাবেই মানিকদা শিখিয়েছেন।

দিন তো কম কাটল না। কত জনের সঙ্গে কাজ করেছি, কত হাজারো সে সব স্মৃতি। উত্তমদা, ভানুদা৪৩, জহরদা৪৪—কী সব অভিনেতা। উত্তমদা আমার দাদার মতো ছিলেন। আমি ছিলাম বুড়ো, মানে তরুণকুমারের৪৫ ক্লাসমেট। কিন্তু উনি আমাকে ভালোবেসে রবিদা বলে ডাকতেন। বুড়ো আপত্তি জানালে বলতেন, ওকে দাদা ডাকতে আমার মজা লাগে। ওঁর সঙ্গে সব আলাপ আলোচনাই হত অভিনয়কে ঘিরে। উত্তমদা যে ইমেজ তৈরি করে গেছেন, আমার মনে হয় আগামী ২০ বছরে সেখান থেকে কেউ তাঁকে সরাতে পারবে না। যদি কেউ পারে, সেটা হবে মিরাকল। সৌমিত্র দারুণ অভিনেতা। কিন্তু জনপ্রিয়তার বিচারে উত্তমদার অনেক পিছনে। তাঁদের দু’জনের তুলনা করাটা ঠিক নয়। যে যার নিজের জায়গায় বেঁচে থাকবেন। উত্তমকুমার জনগণের কাছে মোস্ট অ্যাকসেপটেড। সবার ভাগ্যে সেটা জোটে না।

জনপ্রিয়তার কথায় একটা জিনিস বলে ফেলি। একবার আমি যাত্রা করেছিলাম। সেই উপলক্ষ্যে সুদূর গ্রামে গিয়ে দেখেছি চারটি লোককে গ্রামের লোকেরাও চেনে—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার৪৬ এবং সন্ধ্যা রায়৪৭—অসম্ভব এঁদের জনপ্রিয়তা অবশ্য উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তার কাছে সবাই ম্লান।

ভানুদা গ্রেট লোক ছিলেন। উনি ছিলেন আমার কাকার বন্ধু। ওঁর সঙ্গে গল্প মানেই ছিল অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। দেখলাম ফিল্মেও উনি টপ ম্যান, থিয়েটারে যখন এলেন, তখনও টপ, যখন যাত্রাতেও গেলেন সেখানেও তাই। সাংঘাতিক পপুলার। জহরদাও তাই।

চিনু অর্থাৎ চিন্ময় রায়৪৮ দারুণ অভিনেতা। কিন্তু ওকে ঠিকমতো ব্যবহার করা হল না। কী দারুণ অভিনয় করত নান্দীকার৪৯-এ।

অভিনেত্রীদের মধ্যে ইদানীং মমতাশঙ্কর ছাড়া আর কাউকে দেখছি না। গ্ল্যামারটা অনেকের আছে, কিন্তু ওই লেভেলের অভিনয়টা কারও নেই। আর আগে? বাঞ্চ অব অ্যাকট্রেস—মাধবী৫০ ছিল, অনুভা ছিল, ছায়াদেবী৫১, মঞ্জু দে৫২, অরুন্ধতী৫৩, সাবিত্রী—কী বিস্ময়কর সব প্রতিভা। ছেলেবেলায় মঞ্চের টাওয়ারিং অ্যাকট্রেস ছিলেন সরযূ দেবী৫৪। পরে নীলিমাদি৫৫কে দেখেছি। ইদানীং শ্রীলা৫৬, অপর্ণা৫৭-র নাম করতে হয়।

ছবি বিশ্বাস৫৮ কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব। আমার সঙ্গে আলাপ ছিল না। আমি যে বছর ফিল্মে এলাম, উনি সে বছরই মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান। মনে আছে, আমি আর মানিকদা অভিযানের সেই গাড়িটা করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মানিকদা বলে উঠলেন—’না:, আর বঙ্কিমচন্দ্র ভাবা যাবে না।’ অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের সেই ব্যক্তিত্ব—ছবি বিশ্বাস ছাড়া অন্য কাউকে ওই চরিত্রে ভাবাই যায় না। ছবিবাবুর কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল, তেমনি চেহারা, তেমনি গলার আওয়াজ।

এবার একটু নিজের কথায় ফিরে আসি। অনুভার মৃত্যুর পর দীর্ঘ দশ বছর আমি একেবারে একা ছিলাম। ‘৮২ সালে বৈশাখীর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডায়ার স্ত্রীর মাধ্যমে এই পরিচয়। তারপর বিয়ে। উত্তর কলকাতার বাদুরবাগানের খুব রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। লেখাপড়া-টড়া সবই করেছেন, এমএ পাস, কিন্তু টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত ভ্যালুজ-এ বিশ্বাসী। ফিল্মের লোকজন সম্বন্ধে ভালো ধারণা ছিল না। বায়োস্কোপের লোক বলে প্রথমে বিয়ে করতে চায়নি। পরে ডায়ার বউ খুকি যখন বলল—আমার দাদার মতো, তখন বিয়েতে রাজি হল, না হলে বিয়ে হত না। আমিও বিয়ে করতাম না। বিয়ে হল রেজিস্ট্রি এবং আনুষ্ঠানিক দু’ভাবেই। আমার স্ত্রী একটা ব্যাপারেই আমাকে কমপ্লিমেন্ট দেন—আমি সংসারে ডিসটার্ব কম করি। একদম নিষ্কর্মা লোক আমি। কোনও কাজ করি না, এ সংসার বৈশাখীর সংসার। মাঝেমধ্যে কথা বলতে গিয়েই বরং ডিসটার্ব করে বসি।

অনেকে আমাকে হাসির রাজা বলে, অনেক বলে বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা। আমি মনে করি এসব কোনও কথাই ঠিক নয়। ইতিহাসে লেখা থাকবে রবি ঘোষ একজন অভিনেতা ছিলেন। অতুল শূরের৫৯ বইতে সে কথা লেখাও হয়ে গেছে। আমি হেমন্তদার একটা কথায় খুব বিশ্বাসী। উনি বলতেন—তুমি আমাকে যত বড়োই কমপ্লিমেন্ট দাও, আমাকে জনগণ যে কমপ্লিমেন্ট দেবে সেটাই সব থেকে বড়ো, তার বড়ো কিছু নেই। আমি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখেছি সেখানে একজন দু:স্থ মানুষও আমাকে চেনেন, আবার গলফ ক্লাবে একদিন দেখি একটা বাচ্চা তার মাকে ডেকে বলছে—’লুক মাম্মি, দিস ম্যান প্লেড লাস্ট নাইট।’ এটাই আনন্দ। আমিই বোধহয় ফিল্মের একমাত্র লোক যে গল্ফ খেলি। গল্ফ এখন আমার একটা নেশা হয়ে গেছে। বিউটিফুল লাগে। কোনও আজেবাজে কথা হয় না, তক্কাতক্কি হয় না। সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ। কাজ না থাকলে আমি বেলা দেড়টা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত গল্ফ খেলি। কলকাতার দুটো গল্ফ ক্লাবেরই মেম্বার আমি। প্রেমাশিস আমাকে গল্ফ ক্লাবের মেম্বার করে দেয়। বলেছিল—জানি না তোমাকে নেবে কিনা, ওরা তো প্রচুর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে। যাই হোক, মেম্বারশিপ পেয়ে গেলাম আর, এই গল্ফই এখন আমার সব থেকে বড়ো নেশা। এক একটা বয়সে এক একটা নেশা থাকে না? গিন্নি রাগ করেন। বলেন এই ঠা ঠা পোড়া রোদ্দুরে কেউ খেলে? আমি খেলি।

আজ এই মুহূর্তে জীবনে ৬০টি বছর পিছনে ফেলে এসে মনে হচ্ছে—এই বেশ। অনেক কিছু চেয়েছি, অনেক কিছু পাইনি, কিন্তু এমন অনেক কিছু পেয়েছি যা চাওয়ার কথা জীবনের সেই ভোরবেলাটায় ভাবতেও পারিনি। কোনওদিন ভাবিনি এত সম্মান, এত যশ, এত নাম, এত অর্থ পাব, কোনওদিন ভাবিনি মানুষের এত অজস্র ভালোবাসা পাব, কোনওদিন ভাবিনি মহিম হালদার স্ট্রিটের এই ছোটোখাটো চেহারার ছেলেটা একদিন অতুল শূরের বইয়ে স্থান পাবে। এসব ঘটেছে। না চাইতেই এত পাওয়া আমাকে ঋণী করেছে। এ ঋণ আপনাদের কাছে। আমার শুধু এখন একটাই চাওয়া, আপনাদের একান্ত রবি ঘোষ হয়ে এ জীবনটা যেন শেষ করে দিতে পারি।

‘শারদীয় বর্তমান’, ১৯৯২

টীকা

১) গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)—ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমান বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার বীরশ্রী গ্রামে জন্ম। আইসিএস ছিলেন। ১৯৩২-এ ব্রতচারীর প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছরেই নিখিল ভারত লোকগীতি ও লোকনৃত্য সমিতি গঠন করেন। স্ত্রীর নামে ‘নারীমঙ্গল সমিতি’ এবং ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ মাসিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এনার লেখা বেশ কয়েকটি বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চাঁদের বুড়ি’, ‘পটুয়া সংগীত’, ‘Indian Folk-dances and Folk-Lore movement’, ‘The Folk dances of Bengal’ ইত্যাদি। বাংলার বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে তো বটেই, লন্ডনেও ব্রতচারী সমিতি স্থাপন করেছিলেন গুরুসদয় দত্ত।

২) শচীন দেব বর্মন (১৯০৬-১৯৭৫)—অবিস্মরণীয় সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান। উস্তাদ বাদল খাঁ, সংগীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ প্রমুখ একাধিক দিকপাল সংগীতগুরুর কাছে তালিম নেন। প্রথম নিজের সুরে গাওয়া গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এর সেপ্টেম্বরে—’ডাকলে কোকিল…’ (হেমেন্দ্রকুমার রায়) ও ‘এই পথে আজ…’ (শৈলেন রায়)। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলা গানের এক জনপ্রিয় সুরকার-গায়ক হিসেবে ৭০ দশক অবধি রাজত্ব করেন। ১৯৪৬-এ মুম্বইয়ে তাঁর সংগীত পরিচালিত প্রথম ছবি ‘শিকারী’ মুক্তি পায়। হিন্দি জগতে সুরকার হিসেবে যুগন্ধর হয়ে ওঠেন। ‘শচীন কর্তা’ নামে পরিচিত। কিংবদন্তী সংগীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মন এনারই পুত্র।

৩) ভোলা দত্ত—১৯৩০-এ জন্ম এই বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্যকারের। রবি ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সর্বক্ষণের সঙ্গী। ১৯৫৩ সালে উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (এল.টি.জি)-এ যোগ দিয়ে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেন। এরপর ‘থিয়েটার ইউনিট’, ‘চলাচল’ ইত্যাদি নাট্যগোষ্ঠীতে অনেক নাটকসহ পেশাদার রঙ্গমঞ্চেও বেশ কিছু প্রযোজনায় অভিনয় করেন। ‘আহত হাঙর’, ‘স্বপ্ন নয়’, ‘কিউবা’ ইত্যাদি কিছু নাটক ও অনেকগুলি কৌতুক নকশা লেখেন। রবি ঘোষের সঙ্গে ভোলা দত্তর অনেকগুলি কৌতুক নকশা রেকর্ডস্থ হয়েছে। পেশাদার মঞ্চের ‘ছায়ানট’ ও ‘সাবাস পেটো পাঁচু’ নাটক দু’টির কয়েকটি গানও লিখেছিলেন। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’, ‘আকালের সন্ধানে’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

৪) কেদার রায়—রমেশ গোস্বামী রচিত জনপ্রিয় নাটক। এটি প্রথমে অভিনয় হয় ১৯৩৬ সালের ৪ এপ্রিল রঙমহলে। এরপর বহু বছর ধরে অনেকবার বিভিন্ন মঞ্চে অভিনীত হয় নাটকটি।

৫) চন্দ্রগুপ্ত—দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত প্রখ্যাত নাটক। প্রথম অভিনয় হয় ২২ জুলাই ১৯১১, মিনার্ভায়। পরবর্তীকালে মূলত নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির পরিচালনা ও অভিনয়ে (‘চাণক্য’) নাটকটি অন্য মাত্রা পায়।

৬) নরেশচন্দ্র মিত্র (১৮৮৮-১৯৬৮)—বাংলা নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ও পরিচালক। নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের অন্তরঙ্গ বন্ধু। ছাত্রাবস্থায় মধ্য কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ‘কুরুক্ষেত্র’ নাটকে নরেশ মিত্র ও শিশির ভাদুড়ি যথাক্রমে ‘দুর্বাসা’ ও ‘অভিমন্যু’-র চরিত্রে অভিনয় করেন। কখনও অভিনেতা-পরিচালক, কখনও শুধু তাঁর অসামান্য অভিনয় নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ হয়েছে ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্যালারামের স্বাদেশীকতা’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘প্রফুল্ল’ ইত্যাদি অজস্র নাটক। নাট্যজগতে তাঁকে ‘নটশেখর’ বলা হত। চলচ্চিত্রজগতে নির্বাক যুগে ‘মানভঞ্জন’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’ এবং সবাক যুগে ‘গোরা’, ‘স্বয়ং সিদ্ধা’, ‘কঙ্কাল’, ‘উল্কা’ ইত্যাদি আরও বেশ কিছু ছবি পরিচালনা করেন। ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। নরেশবাবু শেষ বয়সে প্রেতচর্চা করতেন।

৭) শিশির ভাদুড়ি (১৮৮৯-১৯৫৯)—বাংলা নাট্যজগতের এক যুগের প্রতীক। ‘নাট্যাচার্য’ আখ্যায় ভূষিত। প্রথমে শৌখিন থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই সবার নজর কাড়েন। ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেনের প্রদর্শনীতে এক তরুণ সম্প্রদায়কে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’ নাটক করেন। যা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপরই সিদ্ধান্ত নেন পাকাপাকিভাবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে যোগ দেবার। মঞ্চ-আলো-অভিনয় স্টাইল সব মিলিয়ে বাংলা থিয়েটারে এক নবধারা আনেন। ১৯৩০ সালে আমেরিকায় নাট্যদল নিয়ে ভ্রমণ করেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। উৎপল দত্ত তাঁর ‘সমাজ বিপ্লব গণনাট্য’ প্রবন্ধে শিশির ভাদুড়িকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় অভিনেতা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

৮) সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়—১৯৩৩-এ পাটনায় জন্ম। বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার। উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। জার্মান ভাষা জানতেন। ১৯৫২ সালে উৎপল দত্ত-র ‘এল.টি.জি’ দলের প্রযোজনা ‘সাংবাদিক’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে প্রবেশ। কয়েক দশক জুড়ে উৎপল দত্ত-র নাট্যদলে (প্রথমে ‘এল.টি.জি’ পরে ‘পি.এল.টি’) একের পর এক বিখ্যাত প্রযোজনায় অভিনয় করে গেছেন। এই অসম্ভব গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব সারা জীবন উৎপল দত্তের সঙ্গেই ছিলেন। নাটকও লিখেছেন। যার মধ্যে ‘বাজি’, ‘দাঁতো’, ‘মিছিল’, ‘সেনোরা কারার রাইফেল’ ইত্যাদি আরও কিছু উল্লেখযোগ্য। ‘কলকাতা ৭১’, ‘কোরাস’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘জন অরণ্য’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘সিনেমায় যেমন হয়’, ‘বিদ্রোহ’, ‘মনের মানুষ’ ইত্যাদি প্রায় ৩৮টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বেশ কিছু সম্মান পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।

৯) উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩)—একাধারে নাট্যকার- নাট্যাভিনেতা- চলচ্চিত্র পরিচালক-অভিনেতা-নাট্যপরিচালক-প্রবন্ধকার। বাংলা নাট্য জগতের এক যুগন্ধর। বাংলা ও হিন্দি ছবির জগতে অভিনেতা হিসেবে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে। সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াকালীন ফাদার উইভারের অনুপ্রেরণায় নাট্যচর্চার শুরু। কলেজ পত্রিকায় স্যাটায়ারধর্মী ইংরেজি একাঙ্কিকা ‘বেটি বেলসাজার’ (১৯৪৮) দিয়ে নাটক লেখার শুরু। ১৯৪৯-এ ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (এল.টি.জি) তৈরি করে ‘ওথেলো’, ‘হ্যামলেট’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘জুলিয়াস সীজার’ ইত্যাদি একের পর এক শেক্সপীয়ারের নাটক ইংরেজিতেই উপস্থাপন করে আলোড়ন ফেলে দেন। ১৯৫১-তে বিদেশি নাটকের বাংলা অনুবাদ করা নাটক প্রযোজনা দিয়ে বাংলা নাটক শুরু করেন। প্রথম মৌলিক নাটক লেখেন—’ছায়ানট’ (১৯৫৮)। এল.টি.জি থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৭০-এ গড়ে তোলেন নাট্যদল ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ (পি.এল.টি)। যা এখনও চলমান। এল.টি.জি-র হয়ে বাংলা নাটক ‘অঙ্গার’ (১৯৫৯), ‘ফেরারি ফৌজ’ (১৯৬১), ‘কল্লোল’ (১৯৬৫) এবং পি.এল.টি-র ‘ব্যারিকেড’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ ইত্যাদি আরও অনেক অবিস্মরণীয় নাট্য প্রযোজনা উৎপল দত্ত-র রচনা-পরিচালনা-অভিনয়ে বাংলা থিয়েটারে রাজনৈতিক নাটকের এক ধারার সৃষ্টি করেছে। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় নামভূমিকায় মধু বসু পরিচালিত ‘মাইকেল মধুসূদন’ (১৯৫০)-এ। এরপর কয়েক দশক ধরে বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনেতা হিসেবে রাজত্ব করেন। ‘মেঘ’, ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’ ইত্যাদি আরও কিছু ছবি পরিচালনা করেন। এছাড়া ‘শেক্সপীয়ারের সমাজচেতনা’, ‘গিরিশ মানস’, ‘চায়ের ধোঁয়া’ ইত্যাদি কিছু বইও লিখেছেন।

১০) করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়—১৯১৯ সালে জন্ম এই অভিনেত্রীর। গণনাট্যে যুক্ত ছিলেন। লিটল থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিয়ে ‘গোস্টস’ (১৯৫০) ও ‘ডলস হাউস’ (১৯৫১) নাটক দু’টিতে অভিনয় করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) ছবিতে ‘সর্বজয়া’ চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করে। এরপর সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬), ‘দেবী’ (১৯৬০) ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (১৯৬২) ছবিগুলিতে অভিনয় করেন। বাকি ‘হেডমাস্টার’ (১৯৫৯), ‘শুভ বিবাহ’ (১৯৫৯), ‘উত্তরায়ণ’ (১৯৬৩), ‘নয়া মিছিল’ (১৯৭২), ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০)—সবমিলিয়ে মোট ৯টি ছবিতে অভিনয় করেন।

১১) কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯)—এক বিরল প্রতিভাধর মানুষ। একাধারে সাহিত্যিক-নাট্যকার-নাট্য পরিচালক-চলচ্চিত্র বোদ্ধা-সংগীতবোদ্ধা- অঙ্কনশিল্পী-শিল্পবিশারদ। মূলত পরিচয় সম্পূর্ণ এক নিজস্ব ধারার সাহিত্যিক হিসেবে। রিখিয়ায় থাকাকালীন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। শেষজীবনে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে আর্ট শিক্ষক ছিলেন। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘সুহাসিনীর পমেটম’, ‘অনিলা স্মরণে’ ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস ছাড়াও অনেক প্রবন্ধ, গল্প, নাটক ইত্যাদির রচয়িতা। কমলবাবুর প্রত্যেক কাজ থেকেই বেরিয়ে আসত ব্যতিক্রমী ভাবনা। ‘হরবোলা’ নামে নাট্যদল তৈরি করে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি কিছু অদ্ভুত প্রয়োগে প্রযোজিত নাটক তাঁর অন্য আরেক প্রতিভার দিক খুলে দেয়। অজস্র বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এই মানুষটি শ্রীরামকৃষ্ণের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তাঁর নিজস্ব এক আধ্যাত্মিক দুনিয়া ছিল।

১২) মুজফফর আহমেদ (১৮৮৯-১৯৭৬)—বাংলাদেশের নোয়াখালিতে জন্ম। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কাজী নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯২০ সালে নজরুলের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা। এরপর নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকায় ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে মার্কসবাদী ভাবনাকে আশ্রয় করে কৃষক-শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২৬ সালে এনার সম্পাদনায় পার্টির পত্রিকা যে ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়, সেখানেই ১৯২৯-৩৩-এর সময়ে ইন্টারন্যাশনাল গান ও কমিউনিস্ট ইস্তাহারের প্রথম বঙ্গানুবাদ ছাপা হয়। পরাধীন ও স্বাধীন ভারত মিলিয়ে বহুবার জেল খেটেছেন। ‘কাকাবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৪-তে পার্টি ভাগ হলে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সি.পি.এম)-তে যোগ দেন। ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস’ ইত্যাদি কিছু বইও লিখেছেন।

১৩) ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা—অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন মুজফফর আহমেদ, সোমনাথ লাহিড়ী, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও নৃপেন চক্রবর্তী। মাঝে কাগজ প্রকাশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। আবার নবপর্যায়ে ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। যা চলেছিল ৬-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

১৪) মন্টুদা—মন্টু বসু ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার ‘বসুশ্রী’ সিনেমার মালিক। ওই হলের ওপরে একটি কফি হাউসে তৎকালীন ফিল্ম-গান-খেলার জগতের প্রখ্যাতদের নিয়মিত আড্ডা ছিল। মন্টুবাবু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ওই বসুশ্রীতেই ওপরতলায় এই ক্লাবের কোনও কোনও বাইরে থেকে আসা খেলোয়াড়কে নিজের দায়িত্বে রাখতেন মন্টু বসু। যেমন, প্রখ্যাত ফুটবলার আমেদ খান এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৫) ‘রঙমহল’—উত্তর কলকাতার এক প্রখ্যাত নাট্য প্রেক্ষাগৃহ। সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে ও অভিনেতা রবি রায়ের যৌথ উদ্যোগেই এই প্রেক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালের ৮ অগস্ট এটির উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি আমেরিকা থেকে ফিরে এখানে যোগ দেন। শিশিরবাবুর প্রযোজনা ও অভিনয়ে যোগেশ চৌধুরীর লেখা ‘শ্রীশ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া ‘-ই এই প্রেক্ষাগৃহে প্রথম অভিনীত নাটক। প্রসঙ্গত, সলিসিটর ষষ্ঠীচরণ গাঙ্গুলি, হেমচন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ শুরুর সময় শেয়ার কিনে এই প্রেক্ষাগৃহের ডিরেক্টর হন। এরপর, দীর্ঘদিন বহু স্বনামধন্য নির্মিত অজস্র অসামান্য প্রযোজনা হয়েছে এই মঞ্চে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘রঙমহল’ আজ বিলুপ্ত।

১৬) অনুভা (১৯২৯-১৯৭২)—প্রখ্যাত অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তা। ১৯৪৫ সালে শান্তিনিকেতন থেকে এনট্রান্স পাশ করেন। ভবানীচরণ দাসের কাছে গান শিখেছেন। নাচেরও শিক্ষা ছিল। আসল নাম ‘মৃদুলা’। এই নামেই ‘অশোক’ (১৯৪২) ও ‘সন্ধি’ (১৯৪৪) ছবিতে নেপথ্যে গান করেন। ফুটবল-পাগল ছিলেন। নিয়মিত আসতেন মোহনবাগানের মাঠে। এই ক্লাবেরই প্রখ্যাত ফুটবলার অনিল দে-কে বিয়ে করেন। ১৯৪৬ সালে এই মাঠেই নজরে পড়ে যান শিশির মল্লিক, খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায় (হারুবাবু) ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ের। ছবিতে অভিনয়ের অফার পান। প্রথম চিত্রাভিনয় করলেন ‘সমর্পণ’ (১৯৪৯) ছবিতে। কিন্তু প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি—’বিশ বছর আগে’ (১৯৪৮)। এরপর বহুদিন ধরে ‘কবি’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘পলাতক’, ‘রত্নদীপ’, ‘চাঁপাডাঙার বৌ’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘ছদ্মবেশী’ ইত্যাদি আরও অজস্র ছবিতে এই অভিনেত্রীকে দেখা গেছে। অনুভা দেবী ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রবি ঘোষকে।

১৭) জ্যঁ পল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০)—একজন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক- নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-রাজনৈতিক সচেতককর্মী-সাহিত্যবোদ্ধা। যারা পৃথিবীর মধ্যে ‘এক্সজিসটেনসিয়ালিজম’ ও ‘ফেনোমেনোলজি’ বিষয়ক দর্শনের জগতে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। নারীবাদী প্রখ্যাত তাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভেয়ারের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এনার। সাত্র সমাজতত্ত্ব, জটিল সামাজিক তত্ত্ব ও নয়া উপনিবেশবাদ ইত্যাদি বিষয়েও পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। একজন মার্কসিস্ট হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি। ১৯৬৪-তে নোবেল প্রাইজ পাওয়া সত্ত্বেও, তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৮) মিনার্ভা থিয়েটার—শতাব্দীপ্রাচীন নাট্য প্রেক্ষাগৃহ। বিডন স্ট্রিটের যে জমিতে ছিল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, সেই জমিটা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় লিজ নিয়ে পাকা প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করেন। ম্যানেজার করে নিয়ে আসেন নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষকে। ১৮৯২ সালে এইভাবেই ‘মিনার্ভা’ শুরু হয়। গিরিশচন্দ্রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটক দিয়ে এই থিয়েটার মঞ্চের উদ্বোধন হয় ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৩। এরপর আজ পর্যন্ত বহু হাত বদল ঘটে, এখনও পর্যন্ত এই মঞ্চে হয়ে চলেছে নানা অসামান্য প্রযোজনা।

১৯) তাপস সেন (১৯২৪-২০০৬)—এক যুগন্ধর আলোকশিল্পী। বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারে আলো প্রক্ষেপণে এক নতুন যুগের দিশারী। ‘রক্তকরবী’, ‘সেতু’, ‘কল্লোল’, ‘অঙ্গার’, ‘তখন বিকেল’ ইত্যাদি অনেক প্রখ্যাত নাট্য প্রযোজনা সমৃদ্ধ হয়েছে এই আলোকশিল্পীর আলো প্রক্ষেপণে। ‘অন্তরঙ্গ আলো’ নামে তাপস সেনের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম। পুত্র জয় সেন ও স্ত্রী সীতা সেন যথাক্রমে একজন দক্ষ আলোকশিল্পী ও নাট্যগানের একজন গবেষক।

২০) ‘অঙ্গার’—বিহারের চাষনালা কয়লা খনির ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে উৎপল দত্তের রচনা-পরিচালনা ও অভিনয়ে পি.এল.টি প্রযোজিত একটি বিখ্যাত নাটক। মিনার্ভায় প্রথম অভিনয় হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৯। অচিরেই জনপ্রিয় হয় এবং চারদিকে আলোড়ন ফেলে দেয় এই নাটক।

২১) দুগ্গা বাঁড়ুজ্যে (১৮৮৬-১৯৪৩)—বাংলার অভিনয়জগতের প্রথম স্টার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সোনারপুরে জমিদার বংশে জন্ম। বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল’ থেকে আঁকা শিখে থিয়েটারে সিন আঁকার শুরু। স্টার থিয়েটারে ৩০ জুন ১৯২৩-এ কর্ণার্জুন নাটকে ‘বিকর্ণ’ চরিত্রে প্রথম মঞ্চাবতরণ। এরপর একের পর এক নাটকের মাধ্যমে দর্শকদের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। শেষ নাটক ‘কাঁটা ও কমল’ (১৯৪২)। ১৯২২ সালে নির্বাক ছবি ‘আঁধরে আলো’-তে প্রথম চিত্রাবতরণ। চলচ্চিত্রজগতেও ‘স্টার’ হয়ে উঠলেন। শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ (১৯৪৩)।

২২) স্টার—এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যপূর্ণ নাট্যপ্রেক্ষাগৃহ। ৬৮, বিডন স্ট্রিটে গুর্মুখ রায়ের টাকায় ২১ জুলাই ১৮৮৩ সালে গড়ে ওঠে স্টার থিয়েটার। এর পিছনে মহীয়সী অভিনেত্রী শ্রীমতী বিনোদিনীর এক ত্যাগের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত আছে। ১৮৮৭ অবধি এই থিয়েটার চলে। গিরিশ ঘোষের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে শুরু করে ১৮৮৭-তে ‘বুদ্ধদেব চরিত’ ও ‘বেল্লিক বাজার’ নাটক দু’টি নিয়ে সর্বমোট ২০টি নাটক এই মঞ্চে অভিনীত হয়। এই প্রেক্ষাগৃহেই ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকের সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম পদধূলি পড়ে। গুর্মুখ মাঝপথে স্বত্ব ছেড়ে পাঁচজনের হাতে ছেড়ে দেন। ১৮৮৭-তে গোপাললাল শীল ‘স্টার’-এর জমি কিনে উচ্ছেদের নোটিশ আনেন। স্বত্বাধিকারীরা গুডউইল নিজের কাছে রেখে দেন। এরপর একই নামে ২৫ মে ১৮৮৮ হাতিবাগানের মোড়ে একটি থিয়েটার হল তৈরি করে দ্বারোউৎঘাটন করেন পূর্বোক্ত স্বত্বাধিকারীরা। গিরিশবাবুর ‘নসিরাম’ নাটক দিয়ে শুরু হয়ে ১৯৯০ দশক অবধি বহু প্রথিতযশাদের দ্বারা এই মঞ্চে অভিনীত হয়েছে অনেক নাটক। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরে ‘স্টার’ পুনরুজ্জীবন লাভ করে। কিন্তু পরিণত হয়ে যায় মূলত সিনেমা হলে।

২৩) ‘সেতু’—কিরণ মৈত্রের কাহিনি-নির্ভর বিধায়ক ভট্টাচার্যর নাট্যরূপে ‘বিশ্বরূপা’ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত এক জনপ্রিয় নাটক। প্রথম অভিনয়—৮ অক্টোবর ১৯৫৯। মুখ্য চরিত্রে, অসিতবরণ (পরে অসীমকুমার), তৃপ্তি মিত্র, সন্তোষ সিংহ, মণি শ্রীমানী, জয়শ্রী সেন প্রমুখ অভিনয় করেন। তাপস সেনের আলো প্রক্ষেপণ ছিল অসাধারণ। আলোর সাহায্যে মঞ্চে ট্রেন চলে যাওয়ার দৃশ্যটি কিংবদন্তী হয়ে আছে।

২৪) ‘উল্কা’—নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘রঙমহল’ প্রেক্ষাগৃহে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২ অক্টোবর ১৯৫৪। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন দীপক মুখোপাধ্যায়, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, গীতা দে, হরিধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয়শিল্পীরা। অসম্ভব জনপ্রিয় হয় নাটকটি।

২৫) তপন সিংহ (১৯২৪-২০০৯)—প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক। সাউন্ড বিভাগের সহকারী হিসেবে নিউ থিয়েটার্স-এ যোগ দেন। প্রথম পরিচালনা করেন ‘অঙ্কুশ’ (১৯৫৪)। এরপর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘টনসিল’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘হাটে বাজারে’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘জতুগৃহ’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘আজ কা রবিনহুড’ (হিন্দি), ‘এক ডক্টর কি মওত’ (হিন্দি), ‘হুইল চেয়ার’ ইত্যাদি আরও অনেক ছবি পরিচালনার মাধ্যমে এক উচ্চাসন লাভ করেন তপন সিংহ। ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সহ অনেক দেশি-বিদেশি সম্মান পুরস্কার পেয়েছেন।

২৬) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫)—প্রখ্যাত অভিনেতা। কৃষ্ণনগরে জন্ম। পরে কলকাতায় পড়াশোনা। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিক্ষা। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয়। এরপর এই বিশ্ববন্দিত পরিচালক-সহ আরও অনেক নামী-অনামী পরিচালকের ছবিতে আজ পর্যন্ত কাজ করে চলেছেন। ‘এক্ষণ’ পত্রিকা নির্মল আচার্য-র সঙ্গে যৌথভাবে অনেকদিন সম্পাদনা করেছেন। ‘অভিনেতৃ সংঘ’ ও পরে নিজের প্রযোজনায় ও অন্যান্য ব্যানারে অনেক নাটকে অভিনয়-পরিচালনা করেছেন। নাটকও লিখেছেন বেশ কিছু। কবিতা-প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখেছেন অনেক। কাব্যগ্রন্থ-সহ কিছু গদ্যের বই আছে তাঁর। অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

২৭) জয়া ভাদুড়ি—১৯৪৮-এ জন্ম এই বিশিষ্ট অভিনেত্রীর। মধ্যপ্রদেশের ভূপালে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পুরীতে বেড়াতে গিয়ে ওখানে একটি ছবিতে শুটিংরত রবি ঘোষের নজরে পড়েন জয়া। রবিবাবুর মারফতই সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘মহানগর’ (১৯৬৩)-এ প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। মুম্বই গিয়ে পুণা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অভিনয় নিয়ে পড়েন। প্রথম হিন্দিতে অভিনয় ‘গুড্ডি’ ছবিতে। এরপর ‘অভিমান’, ‘কোশিশ’, ‘জঞ্জীর’ থেকে শুরু করে অনেক পরের ‘কভি খুশি কভি গম’, ‘হাজার চৌরাশি কে মা’ ইত্যাদি বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘জননী’, ‘আটাত্তর দিন পরে’, ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ (রবি ঘোষের পরিচালনা) ইত্যাদি বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেন। প্রখ্যাত অমিতাভ বচ্চনের স্ত্রী এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক-লেখক তরুণকুমার ভাদুড়ির কন্যা এই অভিনেত্রী।

২৮) তরুণদা—বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক তরুণকুমার ভাদুড়ি। মধ্যপ্রদেশের ভূপালনিবাসী। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর লেখা ‘অভিশপ্ত চম্বল’, একটি বিখ্যাত বই। এছাড়া, তাঁর লেখা ‘বেহড় বাগী বন্দুক’ বই থেকেও চম্বলের ডাকাতদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ি এনারই মেয়ে।

২৯) শর্মিলা—ভারত বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে ১৯৪৪-এ জন্ম। ডাক নাম রিঙ্কু। রবি ঘোষের স্নেহধন্য ছিলেন। রবি ঘোষই শর্মিলাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারের কাছে অভিনয় শেখাতে। কমলবাবুর নাট্যদল ‘হরবোলা’-য় কিছুদিন মহড়াও দিয়েছিলেন শর্মিলা। প্রথম ছবিতে অভিনয় সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)-এ নায়িকা হিসেবে। এছাড়া ‘দেবী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘নায়ক’, ‘অমানুষ’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘শেষ অঙ্ক’ ইত্যাদি বেশ কিছু বাংলা ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। মুম্বই গিয়ে ‘কাশ্মীর কি কলি’ (১৯৬৪) ছবিতে অভিনয় দিয়ে প্রথম হিন্দি ছবিতে প্রবেশ। এরপর ‘আরাধনা’, ‘অমর প্রেম’, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’, ‘সফর’, ‘ছোটি বহু’ ইত্যাদি বহু হিন্দি ছবিতে কয়েক দশকজুড়ে অভিনয় করেছেন শর্মিলা ঠাকুর। সেন্সর বোর্ড থেকে থেকে শুরু করে দেশে-বিদেশে ছবি সংক্রান্ত একাধিক জুরিবোর্ড-এ যুক্ত হয়েছেন। প্রখ্যাত ক্রিকেটার মনসুর আলি খান পটৌডিকে বিবাহ করেন।

৩০) ‘মহানগর’—সত্যজিৎ রায় পরিচালিত নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনিনির্ভর ‘মহানগর’ ছবিটি মুক্তি পায় ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, জয়া ভাদুড়ি, হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, শেফালিকা (পুতুল) দেবী প্রমুখ।

৩১) ‘বৌদি’—বৌদি হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়। বিয়ের আগে পদবি ছিল দাশ। ১৯১৮ সালে জন্ম। ডাকনাম মঙ্কু। গান শিখেছিলেন অনাদিকুমার দস্তিদার, সাহানা দেবী প্রমুখ গুণীজনের কাছে। গানের রেকর্ড আছে। নেপথ্যেও গেয়েছেন। অভিনয় করেছেন ‘সন্ধ্যা’ (১৯৪৪) এবং ‘শেষ রক্ষা’ (১৯৪৪) ছবিতে। সুকুমার রায়ের সুর করা নাটকের গানগুলি অনাদিকুমার দস্তিদারের সঙ্গে যৌথভাবে স্বরলিপিবদ্ধ করেছেন বিজয়া রায়। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে গানও শুনিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের পাশে থেকে অনেক ব্যাপারেই তাঁকে সাহায্য করতেন।

৩২) বংশী চন্দ্রগুপ্ত (১৯২৪-১৯৮১)—একজন অসাধারণ শিল্প নির্দেশক। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে কমলকুমার, সত্যজিৎ প্রমুখদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। জ্যঁ রেনোয়ার ছবি ‘দ্য রিভার’ (১৯৫০)-এ সহকারী শিল্পনির্দেশকের কাজ দিয়ে শুরু। প্রথম এককভাবে কাজ করেন ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫)-তে। আমৃত্যু তিনি সত্যজিৎ রায়ের সব ছবিতে কাজ করা ছাড়াও মণি কাউলের ‘ডাউন’, কুমার সাহনির ‘মায়াদর্পণ’ প্রভৃতি ছবিতেও শিল্পনির্দেশকের কাজ করেন। শম্ভু মিত্র নির্দেশিত-অভিনীত ‘বহুরূপী’ প্রযোজিত ‘উলুখাগড়া’ (১৯৫০) নাটকে গণেশচন্দ্র বসুর সঙ্গে যুগ্মভাবে মঞ্চসজ্জার কাজ করেন। পুরো নাম বংশীলাল চন্দ্রগুপ্ত।

৩৩) মধুবালা (১৯৩৩-১৯৬৯)—অসামান্য সুন্দরী এই পাঠান কন্যা হিন্দি ছবির জগতে এক জনপ্রিয় নায়িকা। প্রথম হিন্দি ছবি—’বসন্ত’ (১৯৪২), এরপর ‘মহল’, ‘বাদল’, ‘মুঘল-এ আজম’, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’, এছাড়া আরও অনেক জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৬০-এ বিয়ে করেন কিশোরকুমারকে।

৩৪) নার্গিস (১৯২৯-১৯৮১)—এক অসম্ভব শক্তিশালী অভিনেত্রী। মা প্রখ্যাত অভিনেত্রী জদ্দনবাই। রাজ কাপুর-নার্গিস রসায়ন হিন্দি ছবির জগতে ইতিহাস হয়ে আছে। ‘বরসাত’, ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী ৪২০’, ‘জাগতে রহো’—এই জুটির আরও কিছু ছবি আজও জনপ্রিয়। এই জুটি বাদে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবি, নার্গিসের অনবদ্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রসঙ্গত, শিশু অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৩৫ সালে ‘তালাশ-এ-হক’ ছবিতে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রজীবন শুরু। নায়িকা হিসেবে প্রথম ছবি ‘তামান্না’ (১৯৪২)। জনপ্রিয় অভিনেতা সুনীল দত্তকে বিয়ে করেন এবং সঞ্জয় দত্ত এনাদেরই ছেলে।

৩৫) সুরাইয়া (১৯২৯-২০০৪)—এক অসামান্য সুন্দরী নায়িকা-গায়িকা। মুম্বই রেডিয়োতে একসময় গান করেছেন। লাহোরের একটি মুসলমান পরিবারে জন্ম। কাকা একজন সাধারণ অভিনেতা ছিলেন। কাকার সহায়তায় চিত্রজগতে এসে ৮ বছর বয়সে ‘উজালা’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন সুরাইয়া। ‘বেবি সুরাইয়া’ নামে এই সময় পরিচিত ছিলেন। ‘স্টেশন মাস্টার’, ‘তামান্না’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘পরওয়ানা’, ‘প্যার কি জিত’, ‘খিলাড়ি’, ‘অফসর’, ‘জখমী’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন, যার সবগুলোই সুরাইয়ার নিজ কণ্ঠের গানে ভরে আছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে চলে যান এই অভিনেত্রী।

৩৬) অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়—বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) ছোটোভাই। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শুরু করে বাঁকুড়ায় গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ডাক্তার না হয়ে পড়া অর্ধসমাপ্ত রেখে চলে এলেন চলচ্চিত্রজগতে। প্রথম পরিচালিত ছবি—’কিছুক্ষণ’ (১৯৫৯)। এই ছবিতেই প্রথম অভিনয় মারফত রবি ঘোষের চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ। অরবিন্দবাবু নাটকে রবি ঘোষের অভিনয় দেখে তাঁকে চলচ্চিত্র জগতে আনেন। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবির মধ্যে ‘আহ্বান’, ‘নতুন জীবন’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘অর্পিতা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ছোটোদের জন্য বেশকিছু গল্পও লিখেছেন। যেগুলির সংকলন ‘সোনার মেডেল’ নামে বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

৩৭) উত্তমদা—মহানায়ক উত্তমকুমার (১৯২৬-১৯৮০)। আজও ‘স্টার’ হিসেবে বাঙালির অন্তরে বিরাজিত। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি—’দৃষ্টিদান’ (১৯৪৮)। পরপর সাতটি ছবি ফ্লপ করার পর নির্মল দে-র ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) ছবি থেকে ঘুরে দাঁড়ান এই নায়ক। এরপর যে শীর্ষে ওঠেন, সেখানেই আজও আছেন। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয় করেন। ‘অভিনেতৃ সংঘ’ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হলে উত্তমকুমার তার সভাপতি হন। বাংলায় অবিসংবাদিত নায়ক হিসেবে অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন। ‘আলোছায়া’ প্রোডাকসন তৈরি করে বেশ কিছু ছবি প্রযোজনা করেন। পরিচালক হিসেবেও কিছু ছবিতে কাজ করেছেন। পণ্ডিত নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণীর কাছে গান শিখেছেন উত্তমকুমার। ভালো গান করতেন। এই কারণেই তাঁর গানের সঙ্গে ঠোঁট নাড়া ছিল অতুলনীয়।

৩৮) সাবিত্রী—অবিস্মরণীয় অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৭ (মতান্তরে ১৯৩৯) সালে বাংলাদেশের কুমিল্লায়। ওখানে থাকতেই নাচ শেখেন। অল্প বয়সে কলকাতায় আসেন। অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহচর্যে ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পাশের বাড়ি’ (১৯৫১) ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় একেবারে নায়িকা চরিত্রে। ‘বসু পরিবার’, ‘কাজরী’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘ডাকহরকরা’ ইত্যাদি ছবি আর ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘শ্যামলী’, ‘মল্লিকা’, ‘রাজকুমার’ ইত্যাদি নাটক এই অভিনেত্রীর সীমাহীন অভিনয়-নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। বি.এফ.জে.এ-র পুরস্কার কয়েকবার পাওয়া ছাড়াও ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

৩৯) হৃষিদা—প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় (১৯২২-২০০৬)। কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এসসি পাশ করে দোকান করে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৪০-এ হরিদাস মহলানবীশ ও সুবোধ রায়ের সাহায্যে নিউ থিয়েটার্সে চাকরি পান। প্রখ্যাত চিত্রসম্পাদক সুবোধ মিত্র-র সহকারী হয়ে কয়েকটি বাংলা ছবিতে কাজ করে ‘তথাপি’ (১৯৫০) ছবিতে প্রথম এককভাবে সম্পাদনার কাজ করেন। বিমল রায় মুম্বই গেলে তাঁর ইউনিটে হৃষীবাবু মুম্বই যান। সেখানে গিয়ে অনেকগুলি ছবিতে কাজ করার পর প্রথম এককভাবে পরিচালনা করেন ‘মুসাফির’ (১৯৫৭) ছবিটি। যার গল্পটি ঋত্বিক ঘটকের। এরপর ‘আনন্দ’, ‘অভিমান’, ‘অনুপমা’, ‘গুড্ডি’, ‘সত্যকাম’, ‘নমক হারাম’, ‘চুপকে চুপকে’ ইত্যাদি আরও কিছু অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি পরিচালনা করেন। প্রসঙ্গত, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেনদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত আড্ডা ছিল কলকাতায়। সত্যজিৎ রায়েরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

৪০) অমিতাভ—ভারতবিখ্যাত ম্যাটিনি আইডল। অমিতাভ বচ্চনের জন্ম ১৯৪২ সালে এলাহাবাদে। বাবা হরবন্স রাই বচ্চন ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও মা তেজি বচ্চন ছিলেন সমাজকর্মী। জীবনে নানারকম কাজকর্ম করার পর মুম্বই ফিলমি জগতে এসে ‘সাত হিন্দুস্থানি’ (১৯৬৯) ছবিতে প্রথম সুযোগ পান। প্রকাশ মেহেরার ‘জঞ্জীর’ ছবি তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলল। রাগী যুবকের একটি ইমেজ তৈরি করলেন হিন্দি ছবির দুনিয়ায়। এরপর একটার পর একটা ছবিতে যে জায়গায় পৌঁছলেন তা ধরাছোঁওয়ার বাইরে। যে সম্মানীয় ভাবমূর্তি তাঁর তৈরি হয়েছিল, তা আজও একইরকম বা ক্রমশ আরও উচ্চস্থানে গমন করছে। একবার তিনি সাংসদও হয়েছিলেন।

৪১) ওয়াহিদা রহমান—১৯৩৪ সালে দক্ষিণ ভারতের চিঙ্গলপুরে জন্ম এই নায়িকার। ছোটো থেকে রাজমুণ্ডি নাট্যশালায় নৃত্য, গীত ও অভিনয় শিক্ষা করেছেন। ১৯৫১ সালে তেলুগু ‘রোজুলাম’ ছবিতে প্রথম একটি নাচ-গানের চরিত্র করেন। নায়িকা হিসেবে তেলুগু ছবি ‘জয়সিমহা’ (১৯৫৫)-য় প্রথম অভিনয় করেন। গুরু দত্তের ‘সি.আই.ডি’ (১৯৫৬) ছবি মারফত হিন্দি ছবিতে প্রবেশ। ‘কাগজ কে ফুল’, ‘পিয়াসা’, ‘গাইড’, ‘কালা বাজার’ ইত্যাদি ছাড়াও একাধিক জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে।

৪২) তপেন (১৯৩৯-২০১০)—বিশিষ্ট চিত্রাভিনেতা তপেন চট্টোপাধ্যায়। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিকানীরের জিপসাম মাইনসে চাকরির শুরু। পেশা পালটে বিজ্ঞাপনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। ‘আজকাল’-এর বিজ্ঞাপন বিভাগের দায়িত্বও সামলেছেন। প্রথম ছোটো চরিত্রে ছবিতে অভিনয় করেন সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ (১৯৬৩)-এ। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৮) ছবিতে ‘গুপী’-র চরিত্রে তপেন চট্টোপাধ্যায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। অভিনীত ছবির মধ্যে ‘ননীগোপালের বিয়ে’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ‘থিয়েটার ইউনিট’, ‘চলাচল’ ইত্যাদি নাট্যদলে নিয়মিত থিয়েটারও করেছেন।

৪৩) ভানুদা—প্রখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৩)। ভালো নাম সাম্যময়। ঢাকায় জন্ম। কলকাতায় এসে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে প্রথম অভিনয়। মূলত কমেডি অভিনেতা হিসেবে অদ্বিতীয়। ১৯৪৯ সালে ‘যা হয় না’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। প্রথম পরিচিতি ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) ছবিতে। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘ভানু পেলো লটারী’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ইত্যাদি ভানুবাবু অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবির নাম। নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করেছেন। ‘অভিনেতৃ সংঘ’-র অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন।

৪৪) জহরদা—বাংলা চিত্রজগতের অবিস্মরণীয় অভিনেতা জহর রায় (১৯১৯- ১৯৭৭)। বাবা সতু রায় গুণী অভিনেতা ছিলেন। পাটনায় বেড়ে ওঠা জহর রায়ের। সেখানে চার্লি চ্যাপলিনের নকল করে বিভিন্ন জায়গায় হাস্যকৌতুক পরিবেশন করে এমন জনপ্রিয় হন যে, তাঁর নাম হয়ে যায় ‘চার্লি’। পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র ও মঞ্চে এক যুগন্ধর কমেডিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রথম চিত্রাবতরণ ‘পূর্বরাগ’ (১৯৪৭) ছবিতে। এরপর ‘টনসিল’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘কালামাটি’, ‘পরশপাথর’, ‘পলাতক’, ‘এ জহর সে জহর নয়’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘বাঘিনী’ ইত্যাদি কিছু উল্লেখযোগ্য জহর রায় অভিনীত ছবি। আজীবন মঞ্চে কাজ করেছেন। ‘রঙমহল’ থিয়েটারকে পুনরুজ্জীবিত করার মূলে জহর রায় ও সরযূবালা দেবী। অসম্ভব পড়াশোনা করতেন। বাড়িতে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের একটা ছোটোখাটো লাইব্রেরি ছিল বলা যায়।

৪৫) তরুণকুমার (১৯৩১-২০০৩)—অসামান্য অভিনেতা। মহানায়ক উত্তমকুমারের আপন ছোটোভাই হওয়া সত্ত্বেও স্বকীয় অভিনয়ের গুণে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছিলেন। পাড়ার লুনার ক্লাবে থিয়েটার করতেন। ১৯৫৫ সালে অর্ধেন্দু সেনের ‘হ্রদ’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর ‘ইন্দ্রাণী’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সপ্তপদী’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘ফুলেশ্বরী’ ইত্যাদি আরও অনেক ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। ছবিতে নামার আগে অ্যামেচার থিয়েটারে তুলসী লাহিড়ির পরিচালনায় ‘নতুন প্রভাত’ নাটক দিয়ে অভিনয়ের শুরু। ছবির পাশাপাশি সারাজীবন মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’, ‘নহবত’, ‘চৌরঙ্গী’ ইত্যাদি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। ‘শিল্পী সংসদ’ ও ‘উত্তম স্মৃতি সংসদ’ দায়িত্বের সঙ্গে সামলেছেন। বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তরুণকুমারের।

৪৬) অনুপকুমার (১৯৩০-১৯৯৮)—এক অসামান্য চরিত্রাভিনেতা। পুরো নাম অনুপকুমার দাস। বাবা সংগীত ও অভিনয়জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ধীরেন্দ্রনাথ দাস। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিক্ষা। প্রথম মঞ্চে ওঠেন ১৯৪৪ সালে ‘টিপু সুলতান’ নাটকে। সারাজীবন দেশে-বিদেশে নাটক করেছেন। ডি. জি. পরিচালিত ‘হাল বাংলা’ (১৯৩৮) ছবিতে ৮ বছর বয়সে অভিনয় করেন। ‘সংগ্রাম’ (১৯৪৬) ছবি থেকেই ঠিকঠাক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শুরু। ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘বাঁশের কেল্লা’, ‘জীবন কাহিনি’, ‘পলাতক’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘দাদার কীর্তি, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ইত্যাদি অনুপকুমার অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি।

৪৭) সন্ধ্যা রায়—বিশিষ্ট এই চিত্রাভিনেত্রীর প্রথম ছবি ‘অন্তরীক্ষ’ (১৯৫৭)। তবে নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় ‘বৃন্দাবনলীলা’ (১৯৫৮) ছবিতে। ‘গঙ্গা’, ‘অশনি সংকেত’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, ‘বাঘিনী’, ‘দাদার কীর্তি, ‘বাবা তারকনাথ’ ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন এই অভিনেত্রী। বর্তমানে এই অভিনেত্রী সাংসদ হয়েছেন।

৪৮) চিন্ময় রায়—১৯৪০ সালে জন্ম এই অভিনেতার। মণীন্দ্র কলেজে পড়ার সুবাদে ‘নান্দীকার’ নাট্যগোষ্ঠীর সূচনাপর্ব থেকে যুক্ত হন। বেশ কিছু অসামান্য প্রযোজনায় দক্ষ অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন। ১৯৬৬ সালে তপন সিংহ-র ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে একটি ছোটো চরিত্রে প্রথম সুযোগ পান। এছাড়া, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘হাটে বাজারে’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘ননীগোপালের বিয়ে’, ‘পদিপিসীর বর্মী বাক্স’, ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’, ‘মৌচাক’, ‘নিধিরাম সর্দার’, ‘চারমূর্তি’ ইত্যাদি আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। প্রয়াত অভিনেত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছিলেন।

৪৯) ‘নান্দীকার’—সর্বজনপরিচিত এক নাট্যদল। ২৯ জুন ১৯৬০ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত, চিন্ময় রায় প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত করেন দলটি। প্রথম প্রযোজনা ইবসেনের ‘গোস্টস’ অবলম্বনে ‘বিদেহী’ (১৯৬০)। কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, মায়া ঘোষ, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কলাকুশলীরা অজিতেশের নেতৃত্বে ‘সেতুবন্ধন’, ‘চার অধ্যায়’, ‘ভালমানুষ’, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ ইত্যাদি একের পর এক অসামান্য প্রযোজনা মঞ্চস্থ করেন। এরপর কেয়া চক্রবর্তীর আকস্মিক মৃত্যু, অজিতেশ-সহ অনেকের দল ছেড়ে যাওয়া, নতুন লোকের সংযোজন ইত্যাদি নানাভাবে রূপ পালটে ‘নান্দীকার’ এখনও চলমান। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘শের আফগান’, ‘ফুটবল’, ‘আন্তিগোনে’, ‘মাননীয় বিচারকমণ্ডলী’, ‘শেষ সাক্ষাৎকার’, ‘মাধবী’ ইত্যাদি আরও কিছু নান্দীকারের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা।

৫০) মাধবী—প্রখ্যাত অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪৩ সালে কলকাতায়। খুব বাচ্চা বয়স থেকেই অভিনয়জগতে। শিশিরকুমারের কাছে ৫ বছর বয়সে গিয়ে অভিনয় করেন ‘সীতা’ নাটকে। এরপর আরও প্রযোজনায় তাঁকে দেখা গেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় ‘দুই বেয়াই’ (১৯৫৩) ছবিতে ছন্দা দেবীর ছোটোবেলার চরিত্রে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এমনকি, ‘প্রার্থনা’ (১৯৫২) ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীরও ছোটোবেলার চরিত্রে মাধবীকে দেখা গেছে। প্রসঙ্গত, এনার আসল নাম ‘মাধুরী’। মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) ছবি থেকে নাম হয় ‘মাধবী’। অভিনীত ছবির মধ্যে ‘টনসিল’, ‘চারুলতা’, ‘শঙ্খবেলা’, ‘মহানগর’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘সুবর্ণরেখা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মঞ্চেও নিয়মিত অভিনয় করেছেন। ‘না’, ‘ফেরা’, ‘ঘটক বিদায়’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য মাধবী অভিনীত নাটক। দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।

৫১) ছায়া দেবী (১৯১৪-২০০১)—বিরাট মাপের এই চিত্রাভিনেত্রীর ভাগলপুরের রাজবাড়িতে জন্ম। ভালো নাম কনক। কৃষ্ণচন্দ্র দে, দামোদর মিশ্র প্রমুখের কাছে গান, বেলা অর্ণবের কাছে নাচ শেখেন। ‘সোনার সংসার’ (১৯৩৬)-এ প্রথম চিত্রাবতরণ। তারপর ‘ছিন্নহার’, ‘রিক্তা’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘আপনজন’, ‘হাটে বাজারে’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলিতে গানও গেয়েছেন। ‘মেরা গাঁও’, ‘রামানুজ’, ‘উত্তরা অভিমন্যু’, ‘আলাপ’ ইত্যাদি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন ছায়া দেবী।

৫২) মঞ্জু দে (১৯২৬-১৯৮৯)—এক জনপ্রিয় চিত্রাভিনেত্রী। বহরমপুরে মামার বাড়িতে জন্ম। বহরমপুরে প্রথমের দিকের পড়া শেষ করে আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক। প্রথম অভিনয় হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘৪২’ (১৯৫১) ছবিতে। এরপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ‘জিঘাংসা’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’, ‘লৌহকপাট’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’, ‘অভিশপ্ত চম্বল’, ‘জয়জয়ন্তী’ ইত্যাদি আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেন। বেশ কিছু ছবি যৌথভাবে প্রযোজনা করেন। ‘অভিশপ্ত চম্বল’ (১৯৬৭) ও ‘সজারুর কাঁটা’ (১৯৬৮) ছবি দু’টি পরিচালনা করেন মঞ্জু দে। ১৯৫৪ সালে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন ও ক্যালকাটা মোটর স্পোর্টস ক্লাব আয়োজিত মোটর রেসিং-এ প্রথম হন এবং ১৯৫৯-এ লন্ডনে কমনওয়েলথ মোটরিং কনফারেন্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। নাটকেও অভিনয় করেছেন।

৫৩) অরুন্ধতী দেবী (১৯২৫-১৯৯০)—একাধারে কণ্ঠশিল্পী ও চিত্রাভিনেত্রী। বরিশালের গুহঠাকুরতা পরিবারে জন্ম। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন। কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নিয়মিত গান করেছেন। এছাড়া, শান্তিনিকেতনে ‘ডাকঘর’ ও ‘মায়ার খেলা’ ইত্যাদিতে অভিনয় করেছেন। প্রথম অভিনয় করেন, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ (১৯৫২) ছবিতে। এ বাদে ‘ছেলে কার’, ‘চলাচল’, ‘নবজন্ম’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘জতুগৃহ’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘হারমোনিয়াম’ ইত্যাদি আরও কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। প্রথমবার বিয়ে হয়, কলকাতা বেতারের উচ্চপদাধিকারী ও পরে চিত্রপরিচালক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং দ্বিতীয়বার চিত্রপরিচালক তপন সিংহ-র সঙ্গে বিয়ে হয়। কিছু ছবিতে অরুন্ধতী দেবী স্বকণ্ঠে গান করেছেন।

৫৪) সরযূ দেবী (১৯১৩-১৯৯৪)—পুরো নাম সরযূবালা দেবী। ইনি ছিলেন ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’। ১৯২৮-এ নাট্যদুনিয়ায় আসেন। নাট্যাচার্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সরযূবালা দেবীর অভিনয় ক্ষমতার আসল প্রকাশ ঘটেছিল বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির সংস্পর্শে এসে। মনমোহন থিয়েটারে এক রাত্রিরের জন্য ‘মীরাবাঈ’ নাটকে ‘কৃষ্ণ’ চরিত্রে অভিনয় করলেও, ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে ‘কুন্দনন্দিনী’-র চরিত্রেই প্রথমে নিজেকে মেলে ধরেন। ‘গৈরিক পতাকা’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘শ্যামলী’, ‘আমি মন্ত্রী হব’, ‘অনন্যা’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে তাঁকে দেখা গেলেও ‘সাজাহান’ নাটকে তাঁর ‘জাহানারা’ চরিত্রে অভিনয় অমর হয়ে আছে। নির্বাক ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯২৬)-এ প্রথম চিত্রাবতরণ। এরপর সবাক যুগের ‘ঋষির প্রেম’, ‘শাপমুক্তি’, ‘দাসীপুত্র’, ‘কালিন্দী’, ‘তাপসী’, ‘তমসা’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘ফুলশয্যা’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা জহর রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে স্বত্বাধিকারী দীর্ঘদিন ‘রঙমহল’ প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

৫৫) নীলিমাদি—বরেণ্য অভিনেত্রী নীলিমা দাস (১৯২৯-১৯৯৬)। মা সুহাসিনী দেবী এককালের নামকরা অভিনেত্রী। নীলিমা দাস মণিপুরি নাচ শেখেন রাজকুমার সিং-এর কাছে। সারা ভারত ঘুরে নাচের অনুষ্ঠান করেন। অভিনয়জগতে ১৭-১৮ বছর বয়সে এসে ‘পরভৃর্তিকা’ (১৯৪৭) ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। এছাড়া দীর্ঘসময় ধরে ‘কবি’, ‘শেষের কবিতা’, ‘মরণের পরে’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘গঙ্গা’, ‘ঘুম ভাঙার গান’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ইত্যাদি আরও কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। মঞ্চেও নিয়মিত তাঁকে দেখা গেছে। বোর্ড থিয়েটারে ‘কবি’, ‘নামজীবন’, ‘দাবী’, ‘শর্মিলা’ ইত্যাদির পাশাপাশি উৎপল দত্ত-র দলের হয়ে ‘ওথেলো’, ‘ছায়ানট’, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, ‘অঙ্গার’, ‘দাঁড়াও পথিকবর’ ইত্যাদি অনেক নাটকে অসামান্য অভিনয় করেছেন নীলিমা দাস। গানও গাইতে পারতেন। দূরদর্শনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ নাটকে নীলিমা দাসের গান-নাচ সংবলিত অভিনয় ভোলা যায় না। বেতারেও অনেক নাটক করেছেন।

৫৬) শ্রীলা—শক্তিময়ী অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার। কলকাতায় জন্ম। এক অন্যধারার অভিনেত্রী। প্রথম অভিনয় মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৮০) ছবিতে। এছাড়া ‘পরশুরাম’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘নাগমতী’, ‘চপার’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘পূজা’ ইত্যাদি ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন। অপূর্ব কণ্ঠস্বরের কারণে বেতারের এক অপরিহার্য শিল্পী।

৫৭) অপর্ণা—প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও চিত্রপরিচালক অপর্ণা সেন। বাবা বিখ্যাত চিদানন্দ দাশগুপ্ত। প্রথম অভিনয় সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১) ছবির ‘সমাপ্তি’ অংশে। এরপর ‘বাক্সবদল’, ‘আকাশকুসুম’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘সোনার খাঁচা’, ‘মেমসাহেব’, ‘যদুবংশ’, ‘নিধিরাম সর্দার’, ‘মোহনার দিকে’, ‘পরমা’, ‘শ্বেতপাথরের থালা’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। চিত্রপরিচালক হিসেবে ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’, ‘পরমা’, ‘পারমিতার একদিন’, ‘জাপানীজ ওয়াইফ’ ইত্যাদি ছবিতে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। ‘স্বরলিপি’, ‘পান্নাবাঈ’ ইত্যাদি ছাড়া উৎপল দত্ত-রও কিছু নাটকে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন। আবৃত্তিরও রেকর্ড আছে তাঁর।

৫৮) ছবি বিশ্বাস (১৯০০-১৯৬২)—অভিনয়জগতে এক যুগন্ধর শিল্পী। ভালো নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। ছেলের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মা নাম রেখেছিলেন ‘ছবি’। ছোটো জাগুলিয়ার জমিদার বংশের ছেলে। ‘হাওড়া নাট্যসমাজ’, ‘কাঁকুড়গাছি নাট্যসমাজ’-এর হয়ে ‘নদীয়া বিনোদ’ নাটকে ‘নিমাই’ চরিত্রে অভিনয় করে অনেকের নজর কাড়েন। ১৯৩৬ সালে প্রথম অভিনয় করেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে। এরপর ‘ছদ্মবেশী’, ‘মিলন’, ‘শুভদা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জীবনসঙ্গিনী’, ‘দেবী’, ‘সবার উপরে’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘একদিন রাত্রে’ ইত্যাদি প্রায় ২০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন ‘প্রতিকার’ (১৯৪৪) ও ‘যার যেথা ঘর’ (১৯৪৯) নামে দু’টি ছবি। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ‘ধাত্রীপান্না’, ‘দেবদাস’, ‘পরিণীতা’, ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘সাজাহান’, ‘আলমগীর’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে দীর্ঘ সময়জুড়ে মঞ্চে দাপিয়েছেন। বেতারেও অভিনয় করেছেন নিয়মিত। এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই অবিস্মরণীয় অভিনেতা।

৫৯) অতুল শূর—একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক, স্টক এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি জায়গাতেও কাজ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অ্যানথ্রোপলজি’ ও ‘অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার’ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই মহেঞ্জোদাড়োতে গিয়ে সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক কাজ করেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় সাংবাদিক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। বেশ কিছু বই লিখেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক বই—’শতাব্দীর প্রতিধ্বনি’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *