ফিরে এলো ছোটাচ্চু

তবুও টুনটুনি তবুও ছোটাচ্চু

উৎসর্গ

হাসি-খুশি রেবেকা–
যেখানে থাকে, সেখানেই আনন্দ!

.

ভূমিকা

আমি যখন টুনটুনি ও ছোটাচ্চু নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম তখন একবারও ভাবিনি যে এদের নিয়ে দ্বিতীয় একটি বই লেখা হবে। এখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করছি, শুধু দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় নয়, চতুর্থবারও লেখা হয়ে গেছে।

বলা বাহুল্য, আমার এই লেখালেখি করার কারণ হচ্ছে পাঠকদের চাপ। পাঠকেরা যদি কমবয়সী শিশু কিশোর হয়, তাদের চাপ অত্যন্ত কঠিন, সেখান থেকে বের হয়ে আসা সোজা কথা নয়! আরো লিখতে হবে কি না জানি না–যদি লিখেও ফেলি, সেই বইয়ের নাম কীভাবে দেব?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১১.১২.২০১৭

.

ফিরে এলো ছোটাচ্চু

দাদি (কিংবা নানি) বসে টেলিভিশনে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখছেন, কাহিনি খুব জমে উঠেছে, শাশুড়ি বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, ছেলে প্রতিবাদ না করে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। সেই দৃশ্য দেখে দাদি অপদার্থ ছেলেটির উপর খুবই রেগে উঠছেন। কিন্তু তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন না কারণ খুব কাছেই বাচ্চারা হুটোপুটি করে খেলতে খেলতে চিৎকার করছে।

দাদি একটা হুংকার দিয়ে বললেন, “এই! তোরা থামবি? তোদের যন্ত্রণায় এক মিনিট টেলিভিশনটাও ঠিক করে দেখতে পারি না।”

পাশেই বসে ঝুমু খালা দাদির পায়ে গরম তেল মাখিয়ে দিচ্ছিল। গরম তেলে কী দিয়েছে কে জানে, দাদির শরীর থেকে শিক কাবাবের মতো একধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। দাদির হুংকারের পর সেও একটা হুংকার দিল, “তোমরা কি চিল্লাফাল্লা থামাবা নাকি জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া নিয়া আসুম?”

বাচ্চারা চিৎকার থামিয়ে ঝুমু খালার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। জরিনি বেওয়ার নাম তারা আগেও ঝুমু খালার কাছে শুনেছে, তার নানা রকম রহস্যজনক কাজকর্মের কথাও শুনেছে, পানি-পড়া দিয়ে কী হয় সেটা এখনো শুনেনি, তাই একজন জিজ্ঞেস করল, “জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া দিয়ে কী হবে?”

ঝুমু খালা বলল, “খালি তোমাদের শরীরে একটা ছিটা দিমু, ব্যস, কথা বন্ধ। নো চিল্লা নো ফাল্লা।”

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমাগো গ্রামে দবির মিয়া হইল ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত। মার্ডার কেসের আসামি, যখন কোর্টে মামলা উঠছে তখন হে জরিনি বেওয়ার এক শিশি পানি-পড়া নিয়া গেছে। জজ সাহেব ঠিক যখন রায় দিব তখন জজ সাহেবের দিকে পানি-পড়া ছিটায়ে দিছে! ব্যস, জজ সাহেবের জবান বন্ধ। দবির মিয়া বেকসুর খালাস।”

সবচেয়ে ছোটজন রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?

ঝুমু খালা বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমাগো গ্রামে চলো, দবির মিয়ারে দেখামু। এখনো ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত।”

আরেকজন বলল, “আমাকে এক শিশি পানি-পড়া এনে দেবে?”

ঝুমু খালা জানতে চাইল, “কী করবা?”

“আমাদের স্কুলে বিলকিস মিসের গায়ে ছিটা দিব।”

“কেন?”

“ক্লাসে বড় জ্বালায়। ক্যাটক্যাট করে খালি বকা দেয়।”

তখন সবাই একসাথে হই হই করে উঠল, “আমাকে এক শিশি আমাকে এক শিশি–”

শান্ত বলল, “আমাকে এক বালতি।”

সবাই ঘুরে শান্তর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এক বালতি? এক বালতি দিয়ে কী করবে?”

শান্ত হাসি হাসি মুখে বলল, “বিজনেস! ছোট ছোট শিশিতে ভরে বিক্রি করব। এক শিশি একশ’ টাকা!”

শান্ত কীভাবে জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া দিয়ে বিজনেস করবে সেটা শোনার আগেই সবাই দেখল ঘরে ছোট চাচা ঢুকছে। তার মুখ হাসি হাসি এবং হাতে একটা ব্যাগ।

সবাই হই হই করে উঠল, “ছোটাচ্চু, কী এনেছ? কী এনেছ?”

ছোটাচ্চুর মুখের হাসি আরো বড় হলো; বলল, “ফাটাফাটি জিনিস। এই দ্যাখ–” তারপর ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা মোটা বই বের করে আনল। চকোলেটের বাক্সের বদলে একটা বই, তাও সেটা ইংরেজিতে লেখা। দেখেই সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এবং একসাথে সবাই মিলে যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। ছোটাচ্চু সেটা খেয়াল করল বলে মনে হলো, বইটা উপরে তুলে বলল, “এই হচ্ছে সেই বই। মাদার অব অল বুকস।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “ইংরেজি বই?”

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ।”

“তুমি ইংরেজি বই পড়বে?”

ছোটাচ্চু একটু রেগে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ, পড়ব। কোনো সমস্যা আছে?”

শান্ত বলল, “তুমি বাংলাই ভালো করে জানো না, ইংরেজি বই কেমন করে পড়বে?”

ছোটাচ্চু হুংকার দিল, “আমি বাংলা জানি না?”

শান্ত বলল, “মনে নাই, আমি গোসল করব না বললে তুমি বলো আমি গোসলাব–”

“বলি না। আমি কোনোদিন গোসলাব বলি না।”

“বলেছ। দাদি বলেছে।”

শান্ত তখন তার দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, মনে আছে তুমি বলেছিলে ছোটাচ্চু ছোট থাকতে বলত আমি গোসলাব, বলত না দাদি?”

দাদি তার সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। শাশুড়ি এখন বাড়ির বউয়ের চুল ধরে টানাটানি করছে, শান্তর কথা শোনার সময় নাই, তাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলত।”

শান্ত রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে বলল, “দেখেছ?”

“ছোট থাকতে কে কী বলে তার ঠিক আছে?”

শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “কারো যদি সমস্যা থাকে সেটা ছোট থাকতেই বোঝা যায়।”

মুনিয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, ছবি আছে বইয়ে?”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “ছবি? ছবি দিয়ে কী হবে?”

“ছবি নাই?”

“নামানে, এইটা তো পোলাপানের বই না যে ছবি থাকবে। এটা হচ্ছে কাজের বই।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”

“এই তো কীভাবে বিজনেস বড় করতে হয়। ম্যানেজমেন্ট এফিসিয়েন্ট করতে হয়। প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হয়।”

একজন কানে হাত দিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছোটাচ্চু তুমি এই খারাপ খারাপ কথাগুলো বোলো না, শুনলে গা শিরশির করে।”

আরেকজন বলল, “ছোটাচ্চুর কথা শুনে লাভ নাই। চকোলেটের বাক্স আনলে একটা কথা ছিল। আয় খেলি।” বলে সবাই খেলায় ফিরে গেল।

ছোটাচ্চু বইটা উপরে তুলে ধরেছিল; এবারে মনমরা হয়ে বইটা নিচে নামিয়ে বলল, “তোদের হয়েছেটা কী? দিন-রাত খাই খাই করিস। চকোলেট না আনলে কথাই শুনতে চাস না।”

কেউ ছোটাচ্চুর এই কথাটাও শুনল বলে মনে হয় না, সবাই হইচই করে খেলতে থাকল। দাদি একটু পরে আবার হুংকার দিলেন, “এই তোরা থামবি? থামবি একটু?”

ছোটাচ্চু যখন তার ঘরে গিয়ে জুতো খুলে বিছানায় বসেছে তখন টুনি গিয়ে ঢুকল, ছোটাচ্চু তাকে একনজর দেখে বলল, “কী হলো, কিছু বলবি?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“তাহলে?”

“তুমি যেটা বলতে চাইছিলে সেটা শুনতে এসেছি।”

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই নাই। তোদের মতো পোলাপানদের সাথে আমি কী বলব?”

টুনি মাথা নাড়ল; বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মুখ দেখেই সবকিছু বোঝা যায়। আজকে কিছু একটা হয়েছে, সে জন্যে তুমি খুব উত্তেজিত। তুমি কিছু

একটা বলতে চাচ্ছ। কী হয়েছে বলো।”

“কিছু হয় নাই।”

“ছোটাচ্চু তুমি এই রকম মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়ার মানুষ না তোমাকে কেউ একজন কিছু একটা বলেছে। কে বলেছে? কী বলেছে?”

ছোটাচ্চু টুনির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল এবং ধীরে ধীরে তার মুখে আবার হাসি ফিরে এলো, বলল, “আজকে আমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছিল। তার নাম হচ্ছে সরফরাজ কাফি।”

“এটা আবার কী রকম নাম?”

“নাম তো নামই। স্কুলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম ছিল মাগরা মাহিন্দি। যাই হোক সরফরাজ রীতিমতো এপয়ন্টমেন্ট করে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। এসে কি বলল জানিস?”

“কী বলল?”

“বলেছে আমার দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির ভবিষ্যৎ একেবারে ফাটাফাটি এটাকে ঠিকমতো মার্কেটিং করতেপারলে–”

টুনি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মার্কেটিং? মানে বেচা-কেনা?”

“আরে না, আলু-পটল বেচার মতো মার্কেটিং না। অন্য রকম মার্কেটিং। ব্র্যান্ডিং করা। সবাইকে জানানো–”

“সরফরাজ কাফি আর কী বলেছে?”

“বলেছে আমার এজেন্সির সব ঠিক আছে, শুধু ম্যানেজমেন্ট দুর্বল। ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে পারলে ধাই ধাই করে উঠে যাবে।

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তোমাকে গায়ে পড়ে অপমান করে গেল আর তুমি কিছু বললে না?”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “আরে ধুর। গায়ে পড়ে অপমান কেন হবে? নিজ থেকে আমাকে সাহায্য করতে চাইল। এত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।”

“গুরুত্বপূর্ণ? তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ফালতু টাইপ।”

“না, না। কী বলিস, ফালতু কেন হবে? তাদের বিশাল বড় ফার্ম, নূতন নূতন কোম্পানিকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাকে এই বইটা পড়তে দিয়েছে।” ছোটাচ্চু সেই ইংরেজি বইটা আবার দেখাল।

টুনি বইটা দেখার কোনো উৎসাহ দেখাল না। ছোটাচ্চু অবশ্যি উৎসাহ নিয়ে বইটা খুলে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, “সরফরাজ কাফি বলেছে, আমাকে ম্যানেজমেন্টের সবকিছু শিখিয়ে দেবে। আমি কি ভাবছি জানিস?”

“কী ভাবছ?”

“আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি তো বড় হচ্ছে, আমার আরো লোক দরকার। আমি নিজে বড় বড় ডিটেকটিভ কাজগুলো করব। আর অফিসিয়াল কাজের জন্যে একজন লোক নিয়ে নিব। সরফরাজ যদি পার্টটাইম কাজ করতে রাজি থাকে”

টুনি ছোটাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “খবরদার ছোটাচ্চু! তুমি এই লোককে নেবে না।”

ঠিক তখন সবগুলো বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকল। ঢোকার সময় তারা শুধু টুনির কথাটা শুনেছে, আগে-পিছে কিছুই জানে না, কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হলো না, প্রায় সবাই মিলে একসাথে বলল, “না ছোটাচ্চু, তুমি এই লোককে নেবে না।”

শান্ত তারপর গলা নামিয়ে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “কোন লোক টুনি? এই লোক কী করেছে?”

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী চাস? এখানে কেন এসেছিস?”

একজন বলল, “বেশি চেঁচামেচি করছিলাম দেখে দাদি বের করে দিয়েছে। আমরা অবশ্যি এমনিতেই তোমার কাছে আসছিলাম।”

“কী জন্যে আসছিলি?” “সবকিছু শোনার জন্যে। তোমার মাদারী মাদার বইটা দেখার জন্যে।”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “মাদারী মাদার না-বইটা হচ্ছে মাদার অব অল বুকস।”

“একই কথা।” ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “মোটেও একই কথা না।” শান্ত টুনিকে আবার জিজ্ঞেস করল, “টুনি, তুই কোন লোককে নিতে করছিস?”

“একজন মানুষ, তার নাম সরফরাজ কাফি। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢুকতে চাচ্ছে।”

“কী নাম বললি?” “সরফরাজ কাফি।”

“এটা আবার কী রকম নাম? এই নামের লোককে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।” শান্ত ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, টুনি ঠিকই বলেছে, এই লোককে তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢোকানো যাবে না।”

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোরা এখন বিদায় হবি? বিদায় হবি এখন থেকে? একেবারে পাগল-ছাগলের হাতে পড়েছি।”

শান্ত বলল, “আয় যাই। আজকে যেখানেই যাচ্ছি সেখান থেকেই সবাই আমাদের বের করে দিচ্ছে। এই বাসায় মানুষজন কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।”

দুই দিন পর রাত্রিবেলা কলিংবেল বাজল। শান্ত দরজা খুলে দেখল স্যুট-টাই পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে, তাই মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুলগুলো দুই ভাগ করে টাক মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। মানুষটা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব আছেন?”

শান্তর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে শাহরিয়ার মানুষটা কে, তখন তার মনে পড়ল ছোটাচ্চুর ভালো নাম হচ্ছে শাহরিয়ার। সে স্যুট-টাই পরা মানুষটিকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।

ছোটাচ্চু বাইরের ঘরে এসে মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “আরে সরফরাজ সাহেব! আপনি? আমার বাসায়?”

সরফরাজ নামের মানুষটা উঠে ছোটাচ্চুর হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে আঁকাতে বলল, “আমি নিজেই চলে এসেছি। ভাবলাম শুভকাজে দেরি করে কী লাভ? কাগজপত্র নিয়ে এসেছি, আপনার সিগনেচার নিয়ে যাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “আপনার নিজের তো আসার দরকার ছিল না। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন!”

“না, না, আবার কাকে পাঠাব? নিজেই চলে এসেছি। যেহেতু এখন আপনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে তাই ভাবলাম বাসাটা চিনে যাই!”

শান্ত ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে সরফরাজের দিকে তাকিয়ে ছিল। ছোটাচ্চু বলল, “শান্ত, তুই হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? যা, ভিতরে যা।”

শান্ত ভিতরে গেল, তারপর সবাইকে খবর দিল সরফরাজ কাফি নামের মানুষটা তাদের বাসায় চলে এসেছে, বাইরের ঘরে সোফায় বসে আছে। ছোটাচ্চুর কাছ থেকে কীসের জানি সিগনেচার নেবে।

তখন সবাই ছুটে গেল মানুষটাকে দেখার জন্যে, বাইরের ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে টুম্পা ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা ভালো না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”

“দেখছ না স্যুট-টাই পরে আছে। গরমের মাঝে যারা স্যুট-টাই পরে থাকে, তারা মানুষ ভালো না।”

মুনিয়া বলল, “তাছাড়া মোছটাও ভালো না।”

“মোছ ভালো না মানে কী?”

“দেখছ না কত চিকন মোছ! চিকন মোছ মানেই সমস্যা।”

সবাই যখন ভিড় করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরফরাজ কাফিকে দেখছে তখন ঝুমু খালা হেঁটে যাচ্ছিল, সবাইকে জানালার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “কী দেখো তোমরা?”

টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে একটা লোক এসেছে। লোকটা ভালো না খারাপ সেটা দেখছি।”

ঝুমু খালা বলল, “মানুষের চেহারা দেখে ভালো-খারাপ বোঝা যায় না। ফিরেশতার মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ইবলিশ-এইরকম মানুষ আছে। আবার ইবলিশের মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ফিরেশতা-এইরকম মানুষও আছে। মানুষের ভালো-খারাপ বোঝার জন্য অন্য নিয়ম আছে।”

“সেইটা কী?”

“পান-পড়া। পানের উপর খাঁটি সরিষার তেল লাগায়া সেটার উপর তিনবার ফুক দিতে হয়। ফুক দেয়ার সময় বলতে হয় ভালায় ভালা, মন্দে কালা। তারপর সেই পানটা মানুষের কপালে ডলে দিতে হয়। মানুষটা ভালো হলে কিছু হবে না। মন্দ হলে কপাল থেকে কালা রং বের হবে। পানটা হবে কুচকুচা কালা”

শান্ত বলল, “এই টেকনিক খুব ডেঞ্জারাস। মানুষটা মনে হয় তার কপালে পান-পড়া ডলতে দিবে না।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “সোজা নিয়ম নাই ঝুমু খালা?”

ঝুমু খালা চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “আছে একটা সহজ উপায়।”

“কী?”

“চায়ের মাঝে চিনির বদলে লবণ দিয়া দিমু। যদি মানুষটা ভালো হয়, মগজের মাঝে দুই নম্বরি বুদ্ধি না থাকে, তাহলে চা মুখে দিয়েই বলবে, হায়, হায়, চায়ের মাঝে দেখি লবণ! আর মানুষটা যদি দুই নম্বর হয়, যদি বদমতলব থাকে তাহলে টু শব্দ না কইরা চা’টা খায়া ফেলব।”

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি!”

“ঝুমু খালা, তাহলে তাড়াতাড়ি লবণ দেওয়া চা নিয়ে আসো। প্লিজ।”

“ঠিক আছে।”

ঝুমু খালা তখন চা আনতে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই চা আর সাথে গরম গরম ভাজা ডালপুরি নিয়ে ঝুমু খালা বসার ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চুর সামনে চিনি দেওয়া চা, সরফরাজ কাফির সামনে লবণ দেয়া চা আর দুইজনের মাঝখানে ডালপুরির প্লেট রেখে ঝুমু খালা চলে এলো। তারপর ঝুমু খালাও অন্যদের সাথে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল এখন কী হয়।

ছোটাচ্চু কাগজপত্রে সাইন করছিল, ঝুমু খালার তৈরি স্পেশাল ডালপুরি দেখে কাগজপত্র সরিয়ে রেখে ডালপুরি খেতে শুরু করল। সরফরাজ কাফি

অর্ধেকটা ডালপুরি ভেঙে নিয়ে একটুখানি খেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। সবাই দেখল কাপে চুমুক দিতেই তার মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে, কাপটা মুখ থেকে সরিয়ে অবাক হয়ে সে কিছুক্ষণ কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটাচ্চু অবশ্য কিছুই লক্ষ করল না, গভীর মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা ডালপুরি খেয়ে যেতে লাগল। ডালপুরি ছোটাচ্চুর খুবই প্রিয়।

জানালার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে সবাই তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে সরফরাজ কাফি এখন কী করে। প্রথমে মনে হলো বুঝি কাপটা নামিয়ে রাখবে। শেষ পর্যন্ত নামিয়ে রাখল না। একবার আড়চোখে ছোটাচ্চুকে দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বিস্বাদ-লবণাক্ত চা খেতে লাগল।

ঝুমু খালা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাতে কিল দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই লোক দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নম্বুরি। মাথার মাঝে বদমতলব।

গে রগে বদমাইশি। এর থেকে একশ হাত দূরে থাকন দরকার।”

সরফরাজ কাফি কাজ শেষ করে যখন চলে যাচ্ছে ঝুমু খালা তখন ট্রেতে করে খালি কাপ-প্লেট তুলে আনতে আনতে জিজ্ঞেস করল, “চা-নাশতা ঠিক ছিল আঙ্কেল?”

সরফরাজ কাফি এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো ছিল। খুব ভালো ছিল। থ্যাংকু।”

ঝুমু খালা বলল, “পরের বার যখন আসবেন তখন আরো ভালো চা নাশতা দিব।”

সরফরাজ কাফি কোনো কথা না বলে চোখ ছোট ছোট করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

ছোটাচ্চু তার নিজের ঘরে পৌঁছানোর আগেই সবগুলো বাচ্চা তার ঘরে হামলা করল।

একজন বলল, “ছোটাচ্চু কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কোন কাজটা?”

“এই যে একজন দুই নম্বরি মানুষকে তোমার সাথে নিচ্ছ।”

ছোটাচ্চু রেগে বলল, “কী রকম বেয়াদপের মতো কথা বলছিস! একজন সম্মানী মানুষ নিজ থেকে আমাকে সাহায্য করার কথা বলছে আর তোরা ঘ্যানঘ্যান করছিস?”

“তুমি হচ্ছ আমাদের ছোটাচ্চু-তোমাকে আমরা কিছু বলতে পারব না?”

“পারবি না কেন? একশ’বার পারবি। কিন্তু বড়দের ব্যাপারে তোরা নাক গলাচ্ছিস কেন? তোরা এসবের কিছু বুঝিস না জানিস?”

প্রমি মুখ শক্ত করে বলল, “একটা জিনিস জানি আর বুঝি।”

“কী জিনিস?”

মুনিয়া বলল, “এই মানুষটা দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নষুরি।”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললি! কী বললি তুই?”

ঝুমু খালার বাক্যটা দ্বিতীয়বার বলা ঠিক হবে না ভেবে মুনিয়া চুপ করে গেল।

টুম্পা বলল, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি মানুষটা খারাপ।”

“কীভাবে পরীক্ষা করেছিস?”

ঝুমু খালার লবণ-চা পরীক্ষার কথা বললে ঝুমু খালা বিপদে পড়ে যেতে পারে বলে কেউ পরীক্ষার পদ্ধতিটা নিয়ে কথা বলল না। মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা এখন বিদায় হ। আমার এই কাগজগুলো পড়তে হবে।”

সরফরাজ কাফি ছোটাচ্চুকে পড়ার জন্যে বান্ডিল বান্ডিল কাগজ দিয়ে গেছে; ছোটাচ্চু কাগজগুলো সবাইকে দেখাল। তারপর আঙুল দিয়ে দরজাটা দেখিয়ে দিল, ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট-সবাই যেন বের হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো তখন একজন একজন করে বের হয়ে গেল। টুনি বের হলো সবার শেষে, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।

আধা ঘণ্টা পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ছোটাচ্চু কাগজের বান্ডিলের উপর মাথা রেখে মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। ছোট ছোট অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা বান্ডিল বান্ডিল কাগজ ছোটাচ্চুর পক্ষে পড়া সম্ভব না। ঠিক কী কারণ জানা নেই। টুনির ছোটাচ্চুর জন্যে একটু মায়া হলো।

পরদিন সকালে ছোটাচ্চু তার দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে গিয়ে দেখে রঞ্জনা কেমন যেন হতচকিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ছোটাচ্চু বলল, “কী খবর রঞ্জনা?”

রঞ্জনা বলল, “না মানে ইয়ে–” কিন্তু বাক্যটা শেষ করল না, কেমন যেন ভ্যাবাচেকার ভঙ্গি করে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে তার ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। অফিসে তার বড় ডেস্কটার পিছনে তার গদি আঁটা চেয়ারে সরফরাজ কাফি বেশ আয়েশ করে বসে আছে। সামনে একটা ফাইল; সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ছোটাচ্চু যতটুকু বিরক্ত হলো অবাক হলো তার থেকে বেশি। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল, ধরে নিল সরফরাজ কাফি তাকে দেখে চেয়ারটা ছেড়ে দেবে।

সরফরাজ কাফি চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোনো নিশানা দেখাল না, হাসি হাসি মুখে বলল, “এই যে শাহরিয়ার সাহেব। গুড মর্নিং!”

ছোটাচ্চু গুড মর্নিংয়ের উত্তর না দিয়ে বলল, “মানে-আপনি আমার চেয়ারে?”

সরফরাজ কাফি এমনভাবে ছোটাছুর দিকে তাকাল যে দেখে মনে হলো সে ছোটাচ্চুর কথা বুঝতে পারছে না। একটু অবাক হয়ে বলল, “আ আপনার চেয়ার?”

“হ্যাঁ। এইটা আমার অফিস। আমার ডেস্ক। আমার চেয়ার।”

সরফরাজ কাফির হাসি আরো বিস্তৃত হলো, ছোটাচ্চুকে সামনে বসার ইঙ্গিত করে বলল, “কিন্তু আমরা যে কাল রাতে কন্ট্রাক্ট করলাম? আপনি ফিল্ড লেভেলে কাজ করবেন, আমি ম্যানেজমেন্ট দেখব। আপনি যেহেতু ফিল্ডে কাজ করবেন, কোনো অফিসের দরকার নেই, আমি এই অফিসে বসব।”

ছোটাচ্চুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ক-কন্ট্রাক্টে তাই লেখা ছিল?”

“হ্যাঁ। আপনাকে একটা কপি দিয়ে এসেছি, পড়েননি?”

ছোটাচ্চু তার পায়ে জোর পাচ্ছিল না, কোনোভাবে একটা চেয়ারে বসে বিড়বিড় করে বলল, “কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”

সরফরাজ কাফি জোরে জোরে মাথা নাড়ল; বলল, “না, না, গোলমাল হবে কেন? আমি আর আপনি মিলেই তো সবকিছু ঠিক করেছি। এই যে আমি ফাইল নিয়ে বসেছি। ফাইলে লেখা দশটার সময় আপনার একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে পুরান ঢাকায়। এখন বাজে সাড়ে নয়টা, এক্ষুনি বের হয়ে যান, তা না হলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না।” সরফরাজ কাফি তারপর গলা উঁচিয়ে ডাকল, “রঞ্জনা, শাহরিয়ার সাহেবকে একটা স্লিপ দাও। ফিরে আসার পর খরচের ভাউচার নিতে ভুলে যেও না।”

সরফরাজ কাফি আবার হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব, আপনাকে আরো একটা জিনিস বলি। এত দিন আপনি এই এজেন্সিটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালিয়েছেন, এখন যেহেতু আমি দায়িত্ব নিয়েছি, এখন এটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালানো যাবে না। একটা নিয়মের ভিতর আসতে হবে, শৃঙ্খলার ভিতর আসতে হবে। যেমন ধরেন, অফিসের টাইম হচ্ছে নয়টা, আপনি এসেছেন সাড়ে নয়টায়-ভবিষ্যতে এটা হতে পারবে না। তারপর ধরেন আপনার পোশাক-একটা টি-শার্ট পরে চলে এসেছেন, এটাও ঠিক হয় নাই। কমপক্ষে ফুল হাতা শার্ট আর টাই। এখন টাইয়ের ফ্যাশন হচ্ছে চওড়া; চিকন একটা টাই পরে চলে আসবেন না যেন–”

এ রকম সময় ছোটাচ্চু বিকট আঁ আঁ শব্দ করে সরফরাজ কাফির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথম ঘুষিটা লাগাতে পারল না, তবে দ্বিতীয়টা ঠিক ঠিক লাগল এবং সরফরাজ কাফি চেয়ারসহ পিছন দিকে পড়ে গেল। ছোটাচ্চু লাফ দিয়ে সরফরাজ কাফির বুকের উপর বসে তার টাইটা টেনে বলল, “তবে রে দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নম্বুরি–”

সরফরাজ কাফি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, “হেল্প! হেল্প!!”

চিৎকার শুনে রঞ্জনা এসে পিছন থেকে ছোটাচ্চুকে ধরে কোনোমতে টেনে সরিয়ে আনল।

.

রাত্রিবেলা বাসায় খুবই উত্তেজনা। অনেক দিন পর বাসায় এ রকম উত্তেজনা হয়েছে। ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা। বড় চাচা ঘরে পায়চারি করছেন, একটু আগে অনেক কষ্ট করে বড় চাচা ছোটাচ্চুকে হাজত থেকে ছুটিয়ে এনেছেন। ছোটাচ্চুর হাতে মার খেয়ে সরফরাজ কাফি তার কোম্পানিকে ফোন করেছে, কোম্পানি ফোন করেছে পুলিশকে। পুলিশ এসে ছোটাচ্চুকে ধরে হাজতে নিয়ে গেছে। বড় চাচার সাথে পুলিশের বড় অফিসারের পরিচয় আছে, তা হলে কী হতো কে জনে!

দাদি (কিংবা নানি) অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে সতেরো বারের মতো বললেন, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার ছেলে মারপিট করে জেলহাজতে গেছে। আমার ছেলে? যে ছেলেকে আমি পেটে ধবেছি, সে মানুষের সাথে মারপিট করে জেলহাজতে যায়?”

দাদি যেটাই বলে ঝুমু খালা সবসময়ই সেটা বলে, এই প্রথমবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেল। সে গলা উঁচিয়ে বলল, “এইটা আপনি কী বলেন খালা? জেলহাজত কেন-দরকার হলে আপনার ছেলে কালাপানিতে যাবে কিন্তু চোর-ছ্যাচড়-বান্দরের বাচ্চাদের পিটায়া সাইজ করবে না?”

ঝুমু খালা তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইজান, আপনি এই বদমাইশের বাচ্চাকে আচ্ছামতন দুইটা দিছেন তো? ঘুষি মাইরা নাকের হাড্ডিটা ভাইঙা দিছেন তো?”

বড় চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঝুমু। তুমি থামবে? কী সব কথা বলছ? ছিঃ।”

ঝুমু খালা থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না, বলল, “আপনি কী বলেন বড় ভাইজান, আমি যে খালি ঘরে বইসা তড়পাচ্ছি, এইটা ওই বান্দরের বাচ্চার সাত পুরুষের ভাগ্য! ছোট ভাইজানরে সোজা-সরল মানুষ পাইয়া হাজতে দেয়-আমার সাথে তেড়িবেড়ি করতে আসত, আমি গিয়া খাবলা দিয়া চোখ দুইটা তুইলা আনতাম।”

বড় চাচা হাল ছেড়ে দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন কী অবস্থা?”

ছোটাচ্চু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বড় চাচার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বের করে দিয়েছে।”

ঘরের সবাই চমকে উঠল! বড় চাচা বললেন, “কী বলছিস? তোকে তোর কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছে?”

ছোটাচ্চু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “এটা এখন আর আমার কোম্পানি না। ঐ পাজি মানুষটা আমাকে দিয়ে কী সব কাগজ সাইন করিয়ে নিয়েছিল, আমি বুঝি নাই-এখন অফিসিয়ালি আমি ডিটেকটিভ এজেন্সির কেউ না। সবকিছুর মালিক সরফরাজ কাফির কোম্পানি।”

বড় চাচা হুংকার দিয়ে বললেন, “এটা কী মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি যে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলবে?”

বড় চাচা খুবই শান্ত মানুষ, কেউ তাকে কোনোদিন গলা উঁচিয়ে কথা বলতে শুনে নাই। তাই হঠাৎ করে বড় চাচা যখন হুংকার দিলেন, তখন সবাই অবাক হয়ে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে রইল। বড় চাচা কী বলছেন কেউ শুনছে না, কীভাবে বলছেন সেটাই সবাই দেখছে।

বড় চাচা হাত-পা নেড়ে বললেন, “আমার পরিচিত সুপ্রিমকোর্টের ল’য়ার আছে, আমি মামলা করে দেব।

ছোটাচ্চু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না ভাইজান। আমার মামলা করার ইচ্ছা নাই। যা হবার হয়েছে-আমি এর মাঝে আর নাই।”

তারপর কাউকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ছোটাচ্চু নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। বড় মানুষ কেউ তার সাথে গেল না কিন্তু বাচ্চারা সবাই দলবেঁধে তার পিছু পিছু গেল।

ছোটাচ্চু তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল। টুনি নরম গলায় ডাকল, “ছোটাচ্চু”

ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু বলবি?”

“তোমার কি মন খারাপ ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “এখন মনটা কাজ করছে না, থেমে আছে। তাই বুঝতে পারছি না। যখন মনটা কাজ করতে শুরু করবে তখন বুঝতে পারব।”

“তুমি মন খারাপ কোরো না ছোটাচ্চু।”

তখন সবাই একসাথে বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু, মন খারাপ কোরো না। প্লিজ ছোটাচ্চু-প্লিজ। তুমি মন খারাপ করলে আমাদেরও মন। খারাপ হবে।”

ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, মন খারাপ করব না।” একটু থেমে বলল, “আসলে তোরা ঠিকই অনুমান করেছিলি যে সরফরাজ মানুষটা বদ।”

একজন বলল, “বদের লাঠি।”

আরেকজন বলল, “পাজির পা ঝাড়া।” আরেকজন বলল, “খাটাসের বাচ্চা খাটাস।”

তখন সবাই মিলে সরফরাজ কাফিকে গালিগালাজ শুরু করল। সে কী গালিগালাজ! মনে হলো গালিগালাজের তাপে ঘরে বুঝি আগুন ধরে যাবে।

গালাগাল একটু কমে আসার পর টুনি আবার ছোটাচ্চুকে ডাকল, “ছোটাচ্চু।”

“বল।”

“তোমাকে একটা কথা বলি?”

“বল।”

“তোমাকে যদি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিটা ফিরিয়েও দেয় তুমি সেটা নিয়ো না।”

ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “নিব না?”

“না।”

“কেন?”

“বড় অফিস নেওয়ার পর তুমি অন্য রকম হয়ে গেছ। তোমার সাথে আমাদের আর দেখা হয় না। মনে আছে আগে কত মজা হতো? সবসময় তুমি আমাদের সাথে থাকতে!”

অন্য সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “হা হা, তুমি আমাদের সাথে থাকতে আর আমাদের কত মজা হতো।”

একজন বলল, “মনে আছে একবার একটা ছাগলকে রং করে দিয়েছিলে?” আরেকজন বলল, “তারপর আমরা নাটক করলাম?”

আরেকজন বলল, “আর ওই যে একবার রাজাকার টাইপের নানা যখন এসেছিল তখন রাত্রে ভূতের ভয় দেখানো হলো।”

আরেকজন বলল, “তারপর একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করলাম? ভৌতিক সংখ্যা?”

আরেকজন বলল, “শান্ত ভাইয়া যখন স্কুলে ঝামেলায় পড়ল তুমি গার্জিয়ান সেজে গিয়ে শান্ত ভাইয়াকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে।”

আরেকজন বলল, “স্কুলের স্পোর্টসের দিন তুমি আমাকে ডাইনি বুড়ি সাজিয়ে দিলে মনে আছে?”

আরেকজন বলল, “আমার সায়েন্স ফেয়ারের প্রজেক্টের জন্যে তুমি সেঁক ধরে আনলে মনে আছে?”

আরেকজন বলল, “সায়েন্স টিচারকে সেই জোঁক কামড়ে ধরল, আর সায়েন্স টিচার চিৎকার করে সবকিছু উল্টাপাল্টা করে ফেলল?”

মুনিয়া তখন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এখন তুমি কিছু কোরো না।”

ছোটাচ্চু সবার দিকে তাকাল, কিছু বলল না। টুনি বলল, “তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাও।”

“সেটা কী রকম?”

“ওই তো।”

“ওই তো মানে কী?”

“আগের মতোন-পুরোপুরি অপদার্থ।”

ছোটাচ্চু হেসে ফেলল, আর তাকে হাসতে দেখে অন্য সবাই হি হি করে হাসতে থাকল। হাসি আর থামতেই চায় না।

.

ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে শান্ত নিচু গলায় বলল, “সরফরাজ কাফিকে সাইজ করতে হবে।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে সাইজ করবে ভাইয়া?

“এখন বলব না।”

টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তোমার মাথা গরম, কী না কী করে ফেলবে, আরো বড় ঝামেলা হবে।”

শান্ত বলল, “হলে হবে। শুধু সরফরাজ কাফির টেলিফোন নম্বরটা দরকার।”

টুনি বলল, “সর্বনাশ! টেলিফোন করলে আরো বিপদে পড়বে–”

“আমি টেলিফোন করব না।”

“তাহলে?”

“এখন বলব না।” বলে শান্ত আবার ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকে গেল। ছোটাচ্চু বাথরুমে গোসল কতে ঢুকেছে, টেবিলে তার মোবাইল ফোন রেখে গেছে। সেখান থেকে খুব সহজেই সরফরাজ কাফির মোবাইল নম্বর পাওয়া গেল।

একটু পরেই শান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল, যাবার আগে সে ঝুমু খালার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়ে গেল। এই রাত্রিবেলা শান্ত কোথায় গেছে, কী করবে সেগুলো নিয়ে টুনি খুবই দুশ্চিন্তার মাঝে ছিল কিন্তু আধা ঘণ্টার মাঝেই শান্ত ফিরে এলো। কোথায় গিয়ে কী করেছে কিছুই সে বলল না।

.

পরদিন স্কুলে যাবার সময় বাচ্চারা দেখল বড় রাস্তার মোড়ে নূতন একটা বিল্ডিংয়ের ধবধবে সাদা দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা :

“পাঁচশ’ টাকার নোট একশ’ টাকায়–”

তার নিচে একটা টেলিফোন নম্বর।

লেখাটির সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত যখন সবার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল তখন সবাই বুঝে গেল যে এটা শান্তর কাজ, এবং নিচের নম্বরটি সরফরাজ কাফির।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “এটা তুমি লিখেছ?”

“নিজে লিখি নাই। একজনকে পঞ্চাশ টাকায় সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছি। ব্যাটার হাতের লেখা ভালো না।”

শান্তর এই প্রজেক্ট কাজে লেগেছে কি না বোঝা গেল না।

.

ছোটাচ্চু দুই দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটাল। তৃতীয় দিন দরজা খুলে বের হয়ে এলো। বাচ্চারা আশেপাশেই ছিল, তারা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। মুনিয়া ছোটাচ্চুর হাত ধরে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শেভ করো নাই, বিন্দি বিন্দি দাড়ি বের হয়েছে।”

ছোটাচ্চুকে অবশ্য তার বিন্দি বিন্দি দাড়ি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতে দেখা গেল না; ভুরু কুঁচকে বলল, “এই মাত্র আমাকে ডিবি পুলিশ ফোন করেছে।”

বাচ্চারা ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“জানতে চাইছে আমি সরফরাজ কাফিকে কতদিন থেকে চিনি, ওই ব্যাটা জাল নোটের ব্যবসা করে এ রকম কিছু আমি জানি কি না।”

শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

ছোটাচ্চু তার গালের বিন্দি বিন্দি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “পুলিশ ব্যাটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রিমান্ডে নিবে কি না বুঝতে পারছে না।”

এবারে শান্তর সাথে আরো অনেকে হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি পুলিশকে কী বলেছ?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি বলেছি ব্যাটা জাল নোটের ব্যবসা করে কি না জানি না তবে মানুষটা পুরাপুরি দুই নম্বুরি তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমাকে ঠকিয়ে আমার এজেন্সি লিখে নিয়েছে।”

এবারে সবাই হুংকার দিয়ে বলল, “ধ্বংস হোক! ধ্বংস হোক!”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ব্যাটা মনে হয় বিপদে পড়েছে। আমাকে একটু পরে পরে ফোন করছে। আমি ফোন ধরছি না।”

সবাই বলল, “হ্যাঁ, ধরবে না ফোন। কক্ষনো ধরবে না।”

ছোটাচ্চু তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বাথরুমে ঢুকে গেল, মনে হয় বিন্দি বিন্দি দাড়ি শেভ করে ফেলবে।

ঝুমু খালার ধার শোধ করার জন্য শান্ত যখন সবার কাছ থেকে চাঁদা চাইল সবাই তখন উদারভাবে শান্তকে চাঁদা দিল। কিছুক্ষণেই পঞ্চাশ টাকা থেকে বেশি টাকা উঠে গেল, শান্ত ঝুমু খালাকে তার পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাকিটা সার্ভিস চার্জ হিসেবে নিজের পকেটে রেখে দিল।

অন্য যেকোনো সময় এ রকম কিছু হলে বাচ্চারা চেঁচামেচি, হইচই করে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলত-এবারে কেউ সেটা নিয়ে কিছু করল না। এ রকম একটা সফল প্রজেক্টের জন্যে শান্ত কিছু সার্ভিস চার্জ নিতেই পারে।

সন্ধেবেলা বাসার ছাদে ছোটাচ্চু তার মাদার অব অল বুকসটাকে পুড়িয়ে কেতলিতে পানি গরম করে চা বানাল। সবাই সেই চায়ের ভাগ পেল-মুনিয়াকে পর্যন্ত বেশি দুধ-চিনি দিয়ে আধা কাপ চা দেওয়া হলো।

.

মনে হচ্ছে ছোটাচ্চু আবার আগের ছোটাচ্চু হয়ে যাচ্ছে। কাজ নাই, কর্ম নাই এবং পুরোপুরি অপদার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *