মারাঠী শিবির
সদাশিবঃ নজীব-উদ্দৌলা বোধ হয় আমাদিগকেই সন্দেহ করছে ?
ভাস্করঃ ভাব-ভঙ্গীতে ত তাই বোধ হয় নজীব বড় ধূর্ত এবং চতুর।
সদাশিবঃ তেজস্বীও খুব। জাতীয় টানও খুব আছে। মারাঠীদিগকে বিষচক্ষে দেখে।
ভাস্করঃ তা ত দেখবেই। আমরা দিল্লী পর্যন্ত দস্তদারাজী করছি, এতে আর কি মুসলমানের চিত্ত স্থির থাকতে পারে?
সদাশিবঃ হিন্দুর চিত্তই বা কোথায় প্রফুল্ল? গুপ্তচরেরাই সবাই বলে যে, হিন্দু-মুসলমান সকলেই দিল্লীপতির মঙ্গল কামনা করেন। দিল্লীর অধঃপতনে সকলেই মর্মান্তিক দুঃখিত।
ভাস্করঃ দিল্লীশ্বরের প্রায় কিছুই নাই কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার, এখনও দিল্লীপতির সম্মান ও প্রতিপত্তি নকি অপরিসীম! দিল্লীপতি এবং তাঁর উজীর ও আমীরগণ তেজস্বী, কর্মঠ এবং উদ্যোগী পুরুষ হলে, এখনও আবার সমগ্র ভারতে দিল্লীর আধিপত্য স্থাপিত হতে পারে।
ভাস্কর পন্ডিতের কথা শুনিয়া সদাশিবের সহাকারী তুলাজী দেশপাণ্ডে বলিলেন, ” তাহার জন্য যে ভিতরে ভিতরে চেষ্টা-হচ্ছে চরিত্র হচ্ছে না, তা কে বলবে? অগ্নি, শত্রু এবং সর্পকে কদপি তুচ্ছ ভাবতে নাই। আমার মতে বাদশাহকে পদচ্যুত করে পেশোয়া স্বয়ং দিল্লীর তখতে বার দিন। দিল্লীর তখতে বসতে না পারলে, পেশোয়াকে কদাপি ভারতের বাদশাহ বা সম্রাট বলে কেউই মান্য করবে না। এখনও ভারতবর্সে মুসলমানের যে শক্তি আছে, তা একত্র হলে মারাঠীদিগকে চূর্ন- বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দিতে পারে।
ভাস্করঃ তা বটে। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। অতি শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলিকে আক্রমণ করে উৎপাটিত করবার বন্দোবস্ত করছি। বাঙ্গলা, অযোধ্যা ও সিন্ধু, আর্যাবর্তের এই তিনটি রাজ্যকে আশু ধ্বংস করা আবশ্যক। দিল্লীর তখতে পেশোয়াকে না বসালে এবং দিল্লীর জামে মসজিদে ভবানী-মূর্তি স্থাপিত করতে না পারলে রাজ্যধিকারের পূর্ণ আনন্দলাভ হচ্ছে না।
তুলাজীঃ কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয়, আমরা হিন্দুদিগের সহানুভুতি পাবার জন্য কোনও চেষ্টা করছি না। আমরা ভারতবর্সে হিন্দুপ্রাধান্য ও রাজত্ব স্থাপনের চেস্টা না করে কেবল হত্যা ও লুণ্ঠন করায় ভারতের প্রত্যেক লোকই আমাদের নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠে। বাঙ্গলা ও হিন্দুস্থানে আমাদের নামে যেসব ছড়া ও কবিতা রচিত হয়েছে তা’তে আমাদের জুলুমের কথাটা লোকের মনে একেবারে মুদ্রিত হয়ে গেছে। আমাদের অত্যাচারে নিরীহ এবং দরিদ্র কৃষক- পল্লীতে পযৃন্ত হাহাকার উঠেছে।
সদাশিবঃ কিন্তু এরূপ অত্যাচার ও কঠোরতা প্রদর্শন না করলে কেউ আমাদের ন্যায় নগণ্য জাতিকে গ্রাহ্য করত কি? আজ যে সমগ্র ভারতে আমাদের নামে আতঙ্ক পড়ে গিয়েছে, ভারতের সমস্ত রাজা, নবাব এবং বাদাশাহ পর্যন্ত যে আমাদের করুণাভিখাররী তা’ এই কঠোরতা এবং নৃশংসতারই সুফল। আমাদিগকে আরও কঠোর ও নৃশংস হতে হবে। রাজপুত এবং জাঠগণ যদি আমাদের সহায় হত, তা হলে ভারতময় একচ্ছত্র হিন্দুরাজত্ব স্থাপন করা সহজসাধ্য হ’ত্। কিন্তু রাজপুতেরা আমাদিগকে প্রানের সহিত ঘৃনা করে থাকে আমরা সমূলে উৎসাদিত হই, এটাই তাদের আন্তরিক কামনা। তাদের ধারনা যে, রাজপুত ব্যতীত ভারতবর্ষে হিন্দুদিগের মধ্যে শাসনদণ্ড পরিচালনা করবার জন্য আর কোনও জাতি উপযুক্ত নয়। রাজপুতের অধিকাংশই এখনও দিল্লী সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানকামী।
তুলাজীঃ ওরা ত বলতে গেলে, অর্ধ-মুসলমান। এমন কোনও রাজপুত নাই, যে মুসলমানকে কন্যাদান করে নাই। শিশোদীষ, গিহ্লোট, রাঠোর ও কনোজ- গোত্রীয় সকল বাজা, রাণা ও সর্দারই মুসলমানের সঙ্গে বৈবাহিক সন্মন্ধে আবদ্ধ। যে উদয়পুরের রানা প্রতাপসিংহ মুসলমানকে কন্যাদি দিবেন না বরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন – যিনি, মানসিংহ আকবরকে ভগ্নীদান করেছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে একত্রে আহার করতেও সম্মত হন বাই, পরে তাঁরই কন্যা অশ্রুমতী যুবরাজ সেলিমের প্রেমের বানে বিদ্ধ হয়ে উম্মাদিনী হয়ে গেল। সত্য কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, রাজপুতেরা মুসলমানের মাতুলকুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং তারা যে দিল্লীর বাদশাহী প্রভাব বৃদ্ধিকল্পে বিশেষ চেষ্টা করবে, তা ত স্বাভাবিক। রাজপুতেরা এই মাতুলত্বের দাবীর জন্যই অন্যান্য সর্বজাতীয় হিন্দু অপেক্ষা বেশী প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিপত্তি লাভ করেছে।
সদাশিবঃ ভরতপুরের রাজা ত রাজপুত নয়; কিন্তু সেও দল্লীর হিতৈষী। এই জাঠ বেটাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে।
ভাস্করঃ ফন্দী ত খুবই খাঠান হয়েছে। যার জন্য সে আমাদের সঙ্গে শক্রতা করতে কুণ্ঠিত নয়, এবার সেই বাদশাহকে দিয়েই সাপ খেলাব।
তুলাজীঃ এই ত যথার্থ রাজনীতি, – যাক শক্র পরে পরে। আমরা মজা করে তামাশা দেখব।
ভাস্করঃ তামাশা আর মজা ক’রে দেখতে হবে না। এ তামাশা দেখতে বহু সহস্র মারাঠীর মুণ্ড ধূলায় লুটবে। জাঠেরা সহজে হারবার পাত্র নয়।
তুলাজীঃ তা ত বটেই। পরিনাম কি হয় বলা কঠিন। ভিতরের কথা যদি ফেঁসে পড়ে, তা হলে সবই প্রশুশ্রম হবে। অধিকন্তু মুসলমানদের সঙ্গে ভীষন বিবাদ ও বিগ্রহ হবে।
সদাশিবঃ যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করা গেছে।
তুলাজীঃ কিন্তু কথা হচ্ছে, পাপ কখনও লুক্কায়িত থাকে না।
সদাশিবঃ আরে! মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধ যখন লেগেই আছে এবং আরও লাগবে, তখন আর ভাবনা-চিন্তা করারবার কি আছে? হায়! যার জন্য এত করলাম, এখনও তার ত মুখকমল দেখা দূরে থাক, পা’খানিও দেখতে পেলাম না। সে অলোকসুন্দর প্রফুল্ল কমলের ঘ্রাণ নেবার ভাগ্য আছে কিনা, কে বলবে!
ভাস্করঃ তা’ হবে, মহারাজ। কলস যখন তোলা গেছে, তখন ঘ্রাণ নেওয়া তা নিজেরই হাত। এদিকের বন্দোবস্ত করে ধাঁ করে সেতারায় চলে যান।
সদাশিবঃ পেশোয়া টের পেলেও যে বিপদ!
ভাস্করঃ পেশোয়া বড় কিছু মনে করবেন না। বরং কথা আছে যে, চোরে চোরে মাসতুত ভাই। তবে চুরির এই অমুল্য রত্মটি পাছে চেয়ে না বসেন।
সদাশিবঃ ওরে বাপরে! তবেই ত গেছি। মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া! এমন অধর্ম কখন করবেন না।
তুলাজীঃ ও সব কথার প্রয়োজন নাই। এখন এ যুদ্ধে আপনি স্বয়ং যাবেন, কি পণ্ডিতবরকে পাঠাবেন, তাই নির্ধারন করে সৈন্যদলকে সজ্জিত হবার আদেশ প্রদান করুন।
সদাশিবঃ নজীব-উদ্দৌলার ত খোঁজ খবর নাই। মাত্র দু’হাজার রোহিলা সৈন্যকে সর্দার আহমদ খান পাঠিয়েছেন।
তুলাজীঃ নজীব-উদ্দৌলা নাকি স্ত্রীর শোকে নিতান্ত উন্মাদ হয়ে পড়েছেন।
সদাশিবঃ বেশ কথা, বড় ভুল হয়ে গেছে। তাকে সে রাত্রে সাবাড় করে ফেলাই উচিত ছিল।
তুলাজীঃ সফদরজঙ্গ যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে ফিরোজা বেগম ভরতপুরেই আছেন।
সদাশিবঃ যথা লাভ। সফদরজঙ্গ ভালো যোদ্ধা। দিল্লীর সেনাপতি শমশেরজঙ্গও ব্যুহ রচনায় বেশ পণ্ডিত। তা’হলে আপনি কাল সকালে ভরতপুরে কুচ করবার জন্য প্রস্তুত হোন। ভাস্করজী আমার পরিবর্তে দিল্লী থাকবেন। আমি দু’চার দিনের মধ্যেই সেতারায় রওয়ানা হব।