সেতারার সুসজ্জিত একটি প্রাসাদে ফিরোজা বেগমের বাসের বন্দোবস্ত হইয়াছে। ফিরোজা বেগমের নাম লক্ষ্মীবাঈ রাখা হইয়াছে। তাহার সেবার জন্য বন্দোনস্ত হইয়াছে। দাসদাসীর বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। সুখ-সুবিধার জন্য কোনও ক্রটি নাই। কিন্তু হায়! বন্দীর মনে আবার সুখ কবে? স্বাধীন বনবিহারী বিহঙ্গকে বহু যত্নে সুবর্ণ পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখিলেন এবং পৃথিবীর নানা দেশের সুরসাল ও সুললিত ফলমূল দান করিলেও, তাহার প্রানে অশান্তি এবং আত্মগ্লানি কখনও বিন্দুমাত্রও দূর হয় না।
আর মানুষ-জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ, তাহার মধ্যে কোমলপ্রাণা রসবতী চরিত্রবতী যুবতী-যাহার জীবনের উচ্ছ্বাসিত প্রেম-প্রবাহ যাহা শুধু উদ্দেশ্য মাত্র সঞ্চিত হইয়াছিল, কিন্তু প্রবাহিত হইবার সময় পায় নাই, তাহার অন্তর্বেদনার কে ইয়াত্ত করিবে? একে বিরহবেদনা, তাহার উপর বন্দীদশায় হীনতার জ্বালা, তদুপরি ধর্মনাশের আশঙ্কা। দারুণ দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে ফিরোজা বেগম বসন্তের কীটদষ্ট নধর লতিকার ন্যায় দিন দিন মলিন হইতে লাগিলেন। কর্দমে পতিত পদ্মের ন্যায়, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায়, ধূমাচ্ছন্ন বহ্নির ন্যায় একান্ত বিমানয়মানচিত্ত হইয়া পড়িলেন।
মুরলা নামক একটি পরিচারিকা নিতান্ত চতুর এবং সুন্দরী ছিল। ফিরোজার সদ্ব্যবহারে সে ক্রমশঃ ফিরোজার প্রতি একান্ত ভক্তিমতী এবং সহানুভূতিসম্পন্না হইয়া পড়িল। মারাঠীরা তাহাকে মালব দেশ হইতে বন্দী করিয়া আনিয়াছিল; আনিবার পরে একটি ভৃত্যের সহিত বিবাহ দিয়াছিল। কিন্তু সে বিবাহের পরেই অল্পদিন মধ্যেই বিধাবা হইয়াছে। ফিরোজার মনোমোহিনী দেবীদুর্লভ পরমা শ্রী, মধুর ভাষা এবং সস্নেহ ব্যবহারে মুরলা এমনি মুগ্ধ হইয়া পড়িল যে ফিরোজার সেবা করিতে পারিলেই পরমানন্দ লাভ করিত। ক্রমে সে প্রাণ ঢালিয়া ভালবাসিতে বাসিতে ফিরোজা-গত-চিত্ত হইয়া পড়িল।
সে আনন্দের সহিত ফিরোজার রক্তকমলনিন্দিত হস্তপদ টিপিয়া দিত। ফিরোজার দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিত। ফিরোজার মুক্তির অনুসন্ধান করিত। সেই যমদূতের ন্যায় প্রহরী-প্রহরিত বাটী হইতে নির্গত হইয়া কিরূপে দিল্লী গমন করিতে পারে, সে-বিষয়ে কত রজনী বিনিদ্র অবস্থায় পরামর্শ করিল। মুক্তির জন্য কতরূপ কল্পনা-জল্পনা করা হইল। কিন্তু কিছুই কুল-কিনারা হইল না। কোনও উপায় উদ্ভাবিত ও নির্দিষ্টি হইল না।
ইহার মধ্যে ঘোষিত হইল যে, সদাশিব রাও আর কয়েক দিনের মধ্যেই দিল্লী হইতে সেতারায় আসিবেন। দালান-কোঠায় চূণকাম হইতে লাগিল। বাগান ও বৃক্ষবাটিকা সকল পরিষ্কৃত হইতে লাগিল। রাজবাটীর সকলেই প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। এ-সংবাদ অবশেষে মুরলা কর্তৃক ফিরোজা বেগমেরও গোচরীভূত হইল। ফিরোজা শিহরিয়া উঠিলেন। ভূমিতে মস্তক লুটাইয়া আল্লাহ্র দরগায় সেজদা করিলেন। তাহার পর অশ্রুপূর্ণ আঁখিতে মোনাজাত করিলেনঃ
“হে আল্লাহ্! হে আমার প্রভু! তুমিই ধর্ম ও ন্যায়ের রক্ষাকর্তা। হে এলাহি! কাফেরের হস্ত হ’তে আমাকে উদ্ধার করা। আমার ধর্ম ও সতীত্ব রক্ষা কর। হে প্রভু! তোমার অসাধ্য কর্ম কিছুই নাই। তুমি হজরত ইউনুসকে মৎস্যের উদর হ’তে, ইব্রাহমিকে অগ্নিকুণ্ড হ’তে, হযরত মুসাকে দরিয়া হ’তে রক্ষা করেছ। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তুমি অনন্ত কোটি জীবজন্তুকে লক্ষ লক্ষ বিপদ, মছিবত এবং লক্ষ প্রকারের অধঃপতন ও পাপ হতে রক্ষা করছ। তোমার মহিমা ও কৌশল অপরিসীম।
“হে মালেক! তোমার এই ক্ষুদ্র ও অধম বান্দীকে বন্দিত্ব হতে মুক্ত কর। তুমি পরমপিতা, পরমবন্ধু এবং পরমহিতৈষী! কীটানুকীট আমি হীনতম দাসী আমি, অধমাদপি অধম আমি, আমি তোমার দয়ার ভিখারী!
“হে বিশ্বপ্রভু! তোমার ইচ্ছায় সকলই সম্ভবপর। তুমি পর্বতকে সমুদ্র ও সমুদ্রকে পর্বতে পরিণত করতে পার। তুমি রাত্রিকে দিবস এবং দিবসকে রাত্রিতে পরিণত করতে পার। তুমি রাত্রিকে দিবস এবং দিবসকে রাত্রিত পরিণত সমর্থ। তোমার ইচ্ছায় মৃত জীবিত এবং জীবিত মৃতে পরিণত হয়। তুমি ইচ্ছা করলে অসম্ভব সম্ভব এবং সম্ভব অসম্ভব হয়। করুণাময় স্বামিন্! এ দাসীকে কাফেরের হস্ত হ’তে মুক্ত কর।”
এইরূপে উদ্বেগ- অশান্তি এবং ধ্যান ও প্রার্থনায় আরও কিয়দ্দিন অতিবাহিত হইয়া গেল্ মুরলা বেগমের মুক্তির জন্য অবশেষে এক কৌশল খেলিল; দ্বারের প্রহরীকে হাত করিবার জন্য ফন্দি আঁটিল। মুরলা প্রহরীর সহিত ক্রমশঃ খুব ভাবের পশার জাঁকাইয়া তুলিল। মুরলার যৌবনের প্রভাব, রঙ্গ-রস ও ভাব- কৌতুকপুর্ণ বাক্য এবং লোলকটাক্ষে প্রহরী হরি ক্রমে ক্রমে দৃঢ় বদ্ধমুল হইল।
ফাল্গুন মাসের ১২ই তারিখ বুধবারে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা উপলক্ষে সদাশিব রাওয়ের বাড়তি মহা মহোৎসব ব্যাপার। সন্ধ্যার পরেও বহু নর-নারী বালক-বালিকা রাজপুরীতে যাতায়াত করিতেছে মুরলা তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া উৎসবের বাসন্তী বেশে সজ্জিত হইয়া অপরাহ্নেই বাহির হইয়া গিয়া সেতারা হইতে পলায়নের সমন্ত উদ্যোগ-আয়োজনে লিপ্ত রহিল। প্রহরী ঘূণাক্ষরেও কিচু টের পাইল না।
এদিকে মুরলাকথিত নির্দিষ্ট সময়ে ফিরোজাবানু মুরলার পরিত্যক্ত আটপৌরে কাপড়খানি মুরলার ভঙ্গীতে পরিয়া জনতার সহিত মিশিয়া ব্যস্তভাবে দ্বারা পার হইয়া নিকটবর্তী উদ্যানের দক্ষিন দিকে যাইতেই দেখিলেন মুরলা তাঁহার জন্য ব্যস্তভাবে অপেক্ষা করিতেছে।