বরযাত্রীর দল বিবাহের পর-দিবস আহারান্তে ফিরোজা বেগমকে রোহিলাদের দিকে রওয়ানা হইলেন সফদরজঙ্গে বন্ধুবর্গ, বাদশাহ্ শাহ আরম, মারাঠী সেনাপতি সদাশিব রাও এবং দিল্লীর অন্যান্য আমীর রইসগণ যে-সমস্ত বহুমূল্য উপঢৌকন দান করিয়াছিলেন, তৎসমস্ত এবং তদ্ব্যতীত সফদরজঙ্গের নিজ প্রদত্ত অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র, যথা-হস্তিদন্তনির্মিত ৪ খানি কুর্সী, সুবর্ণনির্মিত আতরদান, গোলাবপাশ, স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত নান শ্রেণীর রেকাব, পেয়ালা, জাম, তশ্তরী, পানদান, আবলুস কাষ্ঠের বাক্স, চন্দন কাষ্ঠের পালঙ্ক, কাশ্মীরে নির্মিত জরীজড়োয়া পাগড়ী, বোখারায় নির্মিত সুবৃহৎ দর্পণ, বৃহৎ মুক্তার হার, লাহোরে নির্মিত সুবর্ণখচিত কার্পেট, দামেস্কে নিমিত হীরকের বাঁটবিশিষ্ট তরবারি এবং একটি বিচিত্র কৌশলময় বৃহৎ ঘটিকাযন্ত্র প্রভৃতি মূল্যবান উপহার এবং তাহার হেফাজতের জন্য একদল সৈন্যসহ নজীব-উদ্দৌলা আনন্দ উৎফুল্লচিত্তে স্বদেশাভিমুখে চলিলেন।
সদাশিব রাও প্রত্যুদ্গনের জন্য নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গে সঙ্গেই গমন করিলেন। সন্ধ্যার পর বরযাত্রীর মিছির আরামপুর অতিক্রম করিয়া একটি বিশাল প্রান্তরের মধ্যে দিয়া চলিতে লাগিল। কিয়দ্দূর মাঠ অতিক্রম করিবার পরই নিবিড় বন। শুক্লপক্ষের তৃতীয়ার ক্ষীণ জোৎস্না বনের অন্ধকার দূর করিতে সমর্থ নহে দেখিয়া, মশালচীরা বৃহৎ বৃহৎ মশার প্রজ্জ্বলিত করিয়া বনভূমি আলোকিত করিয়া ফেলিল। সাবধানে সকলেই সেই বনভূমি অতিক্রম করল। বন অতিক্রম করিয়া সকলেই হর্ষোৎফুল্ল মনে গমন করিতে লাগিল।
জঙ্গল অতিক্রম করিয়াই একটি প্রকাণ্ড দীঘি। দীঘির পাড়ে নীচ দিয়াই শাহী রাস্তা। দীঘির ধারে উপস্থিত হওয়া মাত্রই একদল অশ্বারোহী জাঠ দস্যু ভীষণবেগে অতর্কিত অবস্থায় বরযাত্রীদলের উপরে যাইয়া মার মার করিতে পতিত হইল। সহস্রাধিক দস্যুর সহিত একশত সৈন্য ভীষন বিক্রমে যুদ্ধ করিতে লাগিল।
বরযাত্রীর দল গাফেল ছিল বলিয়া অনেকেই বিত্রস্ত এবং হতভম্ব হইয়া পড়িল। সর্দারগণ অস্ত্রপাণি ছিলেন বলিয়া বেগমের পাল্কী রক্ষার জন্য দ্রুতবেগে তথায় ধাবিত হইলেন।
নজীব-উদ্দৌলা হস্তিপৃষ্ঠে থাকিয়া তরবারিযোগে যুদ্ধ করা অসম্ভব বলিয়া লম্ফ প্রদানপূর্বক একটি দস্যুর উপরে পতিত হইয়া মুর্হর্তমধ্যে তাহার শিরচ্ছেদন করতঃ তাহার অশ্বে আরোহণ করিয়া দস্যুদলকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিলেন। নজীব-উদ্দৌলা এবং তাঁহার সঙ্গীয় কয়েকটি যুবক ভীষন পরাক্রম প্রদর্শন করিয়া দস্যুদিগকে নিহত করিতে লাগিলেন।
নজীব-উদ্দৌলা এবং তার সঙ্গিগণ কেহই বর্মমণ্ডিত ছিলেন না, সুতরাং সকলেই গুরুতররূপে আহত হইলেন। অনেকে বিপাকে বিঘোরে পড়িয়া নিহত হইলেন। জিনিসপত্র সমস্তই লুণ্ঠিত হইল। দস্যুদিগের মধ্যে প্রায় ৩০ জন নিহিত হইয়া লুণ্ঠনক্ষেত্রেই পতিত হইল। নজীব-উদ্দৌলা গুরুতররূপে আঘাত প্রাপ্ত ইয়াছিলেন। আঘাত পাইয়া তিনি মূর্ছিত হইয়া পড়েন।
দস্যুগণ চলিয়া যাইবার পরে যাহারা জীবিত এবং সচেতন ছিল, তাহারা মশাল জ্বালাইয়া সকলের অনুসনন্ধান করিতে লাগিল। সকলকেই মৃত বা জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু হায়! ফিরোজা বেগমের কোনই সন্ধান হইল না। তাঁহাকে পাল্কীরবাহকেরা বলিল যে, দস্যুরা তাহাকে পাল্কীসহ বহনকরিয়া লইয়া গিয়াছে। অল্প সময় মধ্যেই এ সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। দিল্লী এবং রোহিলাখণ্ডে হাহাকার পড়িয়া গেল। নজীব- উদ্দৌলা পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন! হিন্দুস্থানের মুসলমানদিগের মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক ও উত্তেজনার সঞ্চার হইল।
ফিরোজা বেগম তৎকালে সৌন্দর্যের জন্য সর্বত্রই বিখ্যাত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি যেমন রূপবতী, তেমনি বিদূষী ছিলেন। পারস্য ভাষায় তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে সকলেই ‘মুনশী ফাজেলা‘ বলিয়া অভিহিত করিতেন। শাহ আলম তাঁহাকে নিজের কণ্যার মত ভালোবাসিতেন। তাঁহার মধুর চরিত্র, নিমৃল রুপ, অপুর্ব গঠনভঙ্গিমা, প্রগাঢ় ধর্মভাব এবং তাঁহার সরস কবিতা পাঠে দিল্লীর সকলেই মুগ্ধ ছিলেন।
চতুর্দিক ফিরোজা বিগমের অনুসন্ধান হইতে লাগিল। অনেকেই সিদ্ধান্ত করিল যে, এই লূণ্ঠন ও হরণ ব্যাপারটা মারাঠীদিগের দ্বারাই সম্পাদিত হইয়াভে। কিন্তু সকলেই বলিলেন যে আক্রমণকারীরা জাঠ ছিল। সদাশিব রাও যে কয়েকটি দস্যুকে দন্দী করিয়াছিল, তাহারা জাঠ ছিল। তাহাদিগকে মুক্তি দিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাহারা প্রকাশ করিল যে, ভরতপুরের রাজাই এই লুণ্ঠনের কারণ। তাঁহার আদেশেই তাঁহার সৈনিকেরা রাতহানা দিয়া অতর্কিত অবস্থায় ফিরোজা বেগমই লুঠিয়া লইয়াছে।
ইতিপূর্বে যখন মারাঠীরা ভরতপুর আক্রমণ করিয়াছিল, তখন ভরতপুরের রাজা ছত্রসিংহ রোহিলাদিগের নিকট এবং বাদশাহ শাহ আলমের নিকট সাহায্য করিয়াছিলেন না সেই রাগেই ছত্রসিংহ রোহিলাদিগকে জব্দ করিবার জন্য ফিরোজা বেগমকে হরণ করিয়া লইয়াছে। সদাশিব রাও বিশেষ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিলেন, ইহা নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। মারাঠীরা কখনও রোহিলা সর্দারের পুত্রবধূ হরণ করিবেন না। মারাঠীদিগের কোনও দলই সেদিন কোথাও লুণ্ঠনে বহির্গত হয় নাই।
সফদরজঙ্গ, নজীব- উদ্দৌলা এবং বাদশাহ স্বয়ং নানা স্থানে সুদ সন্ধানীদিগকে প্রেরণ করিলেন। কিন্তুকোথায়ও কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। ভরতপুরেও অনেক গুপ্তচর পাঠান হইল। কিন্তু হায়! কেহই কোনও খবর আনিতে পারিল না। ভরতপুররাজ লোকমুখে এবং জনশ্রুতি- পরস্পরা হাঁহার সন্বন্ধে ফিরোজা বেগমের হরণের কলঙ্কারোপ শুনিয়া দিল্লীশ্বরকে এক পত্র লিখিলেন।
[[ পত্র ]]
মহামহিমান্বিত দিল্লীশ্বর!
সহস্র সহস্র সালাম এবং কুর্ণিশ পর কৃতাজ্ঞলিপুটে বিনীত নিবেদন এই যে, অকারণে আমার প্রতি ফিরোজা বেগমের হরণের কথা বিশ্বাস করিতেছেন। আমার শক্ররাই এই অলীক কলঙ্ককালিমা আমার মস্তকে নিক্ষেপ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এ অধীন দ্বারা এমন পাপকার্য কদাপি অনুষ্ঠিত হইতে পারে না। আমি এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত অবগত নহি। অধুনা লোকমুখে শুনিতে পাইয়া মর্মান্তিক কেশ ভোগা করিতেছি। দাসকে আর বৃথা সন্দেহ করিবেন না। দাস এখনও দিল্লীপতিকেই ভরতপতি বলিয়াই মনে করে পত্রের অপরাধ মার্জনা করিতে মর্জি হয়।
শাহানশাহের কৃপাভিখারী
ছত্রসিংহ
ভরতপুর।
এই পত্র পাইয়া নজীব- উদ্দৌলা এবং শাহ্ আলম বলিলেন, ”ইহা কদাপি ভরতপুরের কার্য নহে। ছত্রসিংহ চরিত্রবান এবং ধার্মিক। ইহা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মারাহীদলেরই কার্য। তাহারা ব্যতীত এমন কার্য কাহারও দ্বারা সম্ভব না।
কিন্তু সদাশিব রাও বলিলেন, ”ইহা নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। তাহা না হইলে” মাচার উপরে কে রে? তার উত্তর আমি কলা খাই না। এরূপ ঘটনা ঘটিবার কোনও কারণ নাই। ভরতপুরপতি ছত্রসিংহ গায়ে পড়িয়া নিজেই নিজের দোষ ক্ষালন করিয়াছেন। আমরা ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই যে, তিনি পত্র লিখিয়া নিজের সাফাই গাহিবেন। অযাচিতভাবে এই পত্র লেখাতেই তাঁহার অপরাধ প্রতিপন্ন হইতেছে।”
অতঃপর সফদরজঙ্গ এবং বাদশাহের প্রেরিত কয়েকজন গুপ্ত-সন্ধানীকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করিয়া, সদাশিব রাও সন্ধান দেওয়াইলেন যে, ফিরোজা বেগম ভরতপুর-প্রাসাদেই আছে। এইরূপ ষড়যন্ত্রের ফলে বাদশাহ্ এবং সফদরজঙ্গ ক্রমশঃ বিশ্বাস করিলেন যে, ইহা ভরতপুর-রাজেরই কার্য। কিন্তু নজীব-উদ্দৌলা কিছুতেই তাহা বিশ্বাস করিলেন না। তবে কঠোরভাবে প্রতিবাদও করিলেন না।
পরামর্শ ঠিক হইল যে, ভরতপুর আক্রমণ করিয়া ফিরোজাকে উদ্ধার করিতে এবং ছত্রসিংহকে কঠোর শাস্তি প্রদান করিতে হইবে সদাশিব রাও সর্বপ্রকারে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। সুতরাং ভরতপুর আক্রমণে ”সাজ সাজ” রব পড়িয়া গেল।
খুব ভাল।