উজীর সফদরজঙ্গের বাড়ীখানি আজ নয়নমোহন সাজে সজ্জিত। পত্রেপুষ্পে, আলোকে এবং ধ্বজপতাকায় শ্বেতমর্মরনির্মিত বিরাট প্রাসাদ, প্রাঙ্গণ ও রাস্তা সুশোভিত ও সজ্জিত। ফটকের উপরে নহবতে মধুর শাহানা সুরে রওশনচৌকি বাজিতেছে। সেরূপ মধুর বাজনা দিল্লী ব্যতীত আর কোথায়ও সহজে সম্ভবপর নহে। লাল, নীল, সবুজ হলুদ, বেগুনে, শ্বেত প্রভৃতি নানাবর্ণের অর্ধচন্দ্রখচিত রেশমী পতাকা, সহস্রে সহস্রে উড্ডীয়মান হইয়া চমৎকার শোভার সৃষ্টি করিতেছে।
পথের মধ্যে মধ্রে নানা শ্রেণীর পুষ্প-পত্রেসংবৃত তোরণাবলী রচিত হইয়া পরম শোভা বিস্তার করিতেছে। হাজার নানাবর্ণের ফানুস এবং কন্দিল জ্বালাইয়া বাটী এবং পথ-ঘাট আলো করা হইয়াছে। রাজপথের দুই পার্শ্বে দশ দশটি করিয়া হিন্দু এবং মুসলমানদিগের জন্য সুসজ্জিত সুন্দর রমণীয় আহার-আশ্রম খোলা হইয়াছে। বহুসংখ্যক লোক দিবারাত্র উৎকৃষ্ট পান ও ভোজনে রসনার পরিতৃপ্তি সাধন করিতেছে। আটটি পান ও আতরের আড্ডা বসান হইয়াছে। সপ্তাহ পর্যন্ত যাহার যত ইচ্ছা নানা প্রকারের মিঠাই মণ্ডা, রসকরা, গোল্লা, মোরব্বা, হালুয়া, ক্ষীর, রুটি, কাবাব, কোফ্তা, লাড্ডু, দোকানে বসিয়া বিনামূল্যে খাইতে পারে।
রাজপথগামী যে-কোনও লোককে আদর করিয়া ডাকিয়া বসাইবার জন্য কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। বসিবার জন্য উৎকৃষ্ট মূল্যবান কার্পেট চৌকির উপর বিছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। খাদেমগণ পরম যত্নে আগন্তকদিগকে উৎকৃষ্ট মিষ্টান্ন প্রদানে তাহাদের মুখ মিষ্ট এবং উদরপূর্তি করিতেছেন। পানওয়ালারা রাশি রাশি উৎকৃষ্ট সুগন্ধি পান তৈয়ার করিয়া সোনার তবকে মোড়াইয়া নানা আকারের খাঞ্চায় সাজাইয়া রাখিয়াছে।
‘আত্তার’গণ প্রত্যেক লোকের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুক-শিশিতে উৎকৃষ্ট গোলাবী আতর ভরিয়া হাজার হাজার সাজাইয়া রাখিয়াছে। যাহার ইচ্ছা, সেই এক শিশি তুলিয়া লইয়া যাইতেছে।
যথাসময়ে রোহিলাখন্ডের সর্দার পুত্র তেজিয়ান ও পরম শ্রীমান যুবক নজীবউদ্দৌলা বহু বরযাত্রীসহ হস্তিপৃষ্ঠে সুবর্ণ হাওলায় চড়িয়া আগমন করিলেন। কতিপয় রোহিলা সামন্ত ও যুবক অত্যুৎকৃষ্ট আরবীয় অর্শ্বে আরোহণপূর্বক জাঁকজমকের সাথে আগমন করিলেন। ঘোড়াগুলির গঠনভঙ্গিমা এবং চলনের কায়দা দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
যাহা হউক, নওশাহ এর আগমনে বাদ্যকরগণ মহোৎসাহে বাদ্য বাজাইতে এবং মালাকরগণ সহস্র আতশবাজী পোড়াইতে লাগিল। তোপচিগণ ক্রমাগত একশত একটি তোপধ্বনি করিল।
সফদরজঙ্গ এবং তাঁহার আত্মীয় স্বজন পরম সমাদরে যথানিয়মে বর এবং বরযাত্রিগণকে লইয়া বিবাহসভায় বসাইলেন। অনন্তর নানা প্রকার চর্ব্য, চুষ্য, লেহ্য, পেয় প্রভৃতি লজিজ ও নফিস খানা দ্বারা সকলকে পরিতৃপ্তিপূর্বক ভোজন করাইলেন। ভোজনান্তে যথারীতি ইসলামী কায়দা অনুযায়ী উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন করা হইল। বিবাহান্তে আবার বাদ্যধ্বনির উচ্চ শব্দে এবং অবিরাম তোপ ও বোমের গর্জনে দিগ্বলয় কম্পিত হইতে লাগিল। নানা শ্রেণীর বিচিত্র আতশবাজীর অগ্নিক্রীড়ায় নভোমণ্ডল আলোকিত এবং সমবেত জনমণ্ডলী পরম পুলকিত হইলেন।
বিবাহান্তে দিল্লীর প্রসিদ্ধ বাঈজীদিগের নাচের বন্দোবস্তের উপক্রমেই মওলানা আমিনুর রহমান এবং আরও কয়েকজন ধর্মভীরু বৃদ্ধ লোক উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। কেহই তাঁহাদিগকে উঠিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিরেন না। তখন নজীব-উদ্দৌলা নিজেই তাঁহাদিগকে উঠিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিরৈন। মওলানা বলিলেন, বাবা! দেখছ না বাঈজীরা সব এসে হাজীর। এমন ঘৃণিত ও হারাম দৃশ্য কেমন করে দেখব?
নজীবঃ আপনি একেলা উঠে গেলে আপনি মাত্র পাপ হতে বাঁচলেন, কিন্তু অবিশষ্ট লোকের এই মহাপাপ দৃশ্য দর্শন হতে বাঁচবার কি উপায় করলেন? তাদের পাপের জন্য আপনি কি দায়ী হবে না?
মওলানাঃ আমি আর কি করব?
নজীবঃ কেন, আপনি নিষেধ করুন। সকলকে হেদায়েত করুন। বুঝিয়ে দিন যে, এরূপ নৃত্যগীতেই আমাদিগকে ইহলোকে ধ্বংসের আবর্তে এবং পরলোকে জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছে।
মওলানাঃ আমার কথা কে শুনবে?
নজীবঃ সকলেই শুনবে। এমন কোন পাষণ্ড আছে যে, ধর্মের উপদেশ অন্ততঃ কিছুকালের জন্যও প্রতিপালন করবে না? আপনি এবং আপনার সঙ্গীয় আলেমগণ আল্লাহর প্রতি তওয়াক্কা রেখে একবার তেজস্বিনী রসনায় অনলময়ী বাণীতে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করুন, দেখবেন সকলেই এর অপকারিতা স্বীকার করবেন। আমি আপনার সাহায্য করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি, আপনি মেহেরবানি করে ওয়াজ ফরমাতে আরম্ভ করুন।
নজীব-উদ্দৌলার অনুরোধ এবং প্ররোচনায় শেখুল ইসলাম মওলানা আমিনর রহমান সাহেব সভায় দণ্ডায়মান হইয়া গুরু-গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃবৃন্দ! আমাদের কতদূর অধঃপতন হয়েছে চিন্তা করুন! আল্লাহ্ এবং রসুলের আদেশ এবং উপদেশকে আগ্রহ্য করে অদ্য আমরা পবিত্র উদ্বাহক্রিয়ায় ঘৃণিত-চরিত্রা নর্তকীদিগের অশ্লীল নৃত্য দেখবার নিমিত্ত সোৎসাহে বসে আছি! এই অশ্লীল নৃত্য-গীতে আমাদের যুবকদিগের মনে উত্তেজনা এসে প্রথমতঃ, তাদের মস্তিস্ক বিকৃতি এবং দেহের ক্ষয় সাধন করে। দ্বিতীয়তঃ, তাদের মনে চাঞ্চল্য এবং তারল্য জন্মিয়ে দেয়। তৃতীয়তঃ, যারা পরস্পর একত্র হয়ে এই প্রকার ঘৃণিত গীতবাদ্য শ্রবণ করে, তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভক্তিহীন এবং বেহায়া বা নির্লজ্জ হয়ে ওঠে। চতুর্থতঃ, যারা দেখে তা’দের মধ্যে অল্পবিস্তর এই সমস্ত কুৎসিত সঙ্গীত এবং নৃত্যের অশ্লীর ভঙ্গিমার আলোচনা হয়, তার ফলে অনেকের চরিত্র একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।
“ফলতঃ এই শ্রেণীর গানবাজনা, বিলসিতা ও ব্যসনের প্রধান অঙ্গ। এই শ্রেণীর পাপের পরাক্রমেই আমাদের জাতির ভিতর হতে সহিষ্ণুতা, তেজস্বিতা, বীর্যস্বিতা একেবারে লোপ পেয়েছে। যদি আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই সমস্ত বিষয দেখেতেন, তা’হলে তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের মৃত্যুকামনা করতেন।
“ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনার এখন সাবধান হউন! তওবা করে এই পাপের প্রায়চিশ্চত্ত করুন। এরূপ পাপের ফলে আমাদের আর ধ্বংস এবং অধঃপতন হওয়া স্বাভাবিক। যারা একদিন পৃথিবী হতে এই শ্রেণীর সমস্ত কদাচার, পাপাচার ও অশ্লীলাচারকে নির্মূল করেছিলেন, আজ তাঁদেরই বংশধরদিগের মধ্যে এই রূপ পাপকার্যাদি বর্ষাসমাগমে তৃণের ন্যায় বেড়ে উঠছে। কি শোচনীয় অধঃপতন! কি ভয়াবহ ব্যাপার! কি ঘৃণিত পরিণতি!”
“আওরঙ্গজেবের সময়ে যে দিল্লীতে একটিমাত্র বাঈজী বা রূপজীবিনী ছিল না, আজ তথায় সার্ধ চারশত রূপজীবিনী নগরবাসীদিগের ধর্ম, মনুষ্যত্ব, নীতি একেবারে চর্বণ করছে। আজ এই পবিত্র বিবাহ-সভায় যেখানে বর ও পাত্রীর সম্মুখে অশ্লীলতার কি বিরাট উলঙ্গ অভিনয়!”
মাওলানা সাহেব এই পর্যন্ত বলা মাত্রই অনেকেই তওবা পড়িতে লাগিলেন। অনেকেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। অনেকেই বলিয়া উঠিলেন, “এইরূপ পাপাচারেই ত ধ্বংস হলাম।”
উজীর সফদরজঙ্গ লজ্জায় নতবদন হইলেন। বাঈজীর দল তখন তখনই বিদায় লাভ করিল। স্থির হইল, পর দিবস বিবাহের উৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য সৈন্যদিগের কৃত্রিম যুদ্ধ এবং প্রসিদ্ধ পাহ্লোয়ানদিগের কুস্তি হইবে। আমাদের এই নির্দোষ ব্যবস্থায় মাওলানা সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন। অন্যন্য সম্ভ্রান্তমণ্ডলী এবং রোহিলা প্রধান ও সর্দারবর্গ আনন্দ প্রকাশ করিলেন। রাত্রি প্রভাতেই কৃত্রিম যুদ্ধ এবং মল্লযুদ্ধের বন্দোবস্ত ঠিক হইয়া গেল। তখন নজীবউদ্দৌলা স্মিতহাস্যে মাওলানা সাহেবের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “দেখলেন হজরত! আপনাদের সামান্য উপদেশ এবং সামান্য দৃঢ়তায় কত বড় বড় পাপ এবং কদাচার কত শীঘ্র বিলুপ্ত হতে পারে! চাই একটু মনের বল এবং হেদায়েত করবার ইচ্ছা।”
মওলানা সাহেব বলিলেন, “বাবা! আপনার মঙ্গল হোক! খোদা আপনার ইমান এবং হিম্মতকে মজবুত করুন।”
ami jibone eto nirlojjo lekha porini…. marathira atyachari ar muslim nbabab ra sab sadhu purush chilen! orongojeb mahan chilen!.. ek akbar chara ataychrer kahini karo kom noy ..mikel angelo, hinduder sraswati godess kauke apoman karte writer charen ni..muslim bhider proti amer anurodh porun kintu ermodhey kousole je islamer supreority r anno dhrmor prati apoman kara hoyeche ta niropekho dristite bichar korben.