দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ফাবেডিরু

ফাবেডিরু

রাজার নাম ভঙ্গ। রাজধানীর নাম কালিগোলা। আগে কালিতে ঈ লাগানো হত। নতুন আইনে ধর্ম বিদায় হওয়ার পর কালি হয়েছে কালী। কালি অর্থাৎ কালো রাজধানীর রাজবাড়ির একটি ঘর। সেই ঘরে দশাসই একজন মানুষ বিশাল একটা টেবিল সামনে নিয়ে বসে আছেন চেয়ারে। সে-চেয়ার ঘোরে। সামনে-পেছনে দোল খায়। ডানপাশে হাতের কাছে তিন-চারটে বিভিন্ন রঙের টেলিফোন। সাপে ব্যাং ধরলে যেমন আওয়াজ হয়, কোনও একটি টেলিফোনে সেইরকম আওয়াজ হল। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে টেলিফোন তুললেন। ভদ্রলোক হলেন, রাজ্যের বিদ্যুৎ দপ্তরের সচিব।

সচিব : হ্যালো। পাওয়ার। হ্যা, পাওয়ার সেক্রেটারি। আপনি? অ নিউজপেপার। বলুন কী ভাবে খোঁচাতে চান? আই মিন ঠোকরাতে!

সাংবাদিক : সব তো অচল হয়ে বসে আছে মশাই। ট্রেন, ট্রাম, জল, কোর্ট, কাছারি। আজকের ব্যামোটা কী?

সচিব : আপনাদের কাছে তো একটি লিস্ট দেওয়া আছে। আমার, আপনার দুজনেরই সময় নষ্ট না করে যে-কোনও একটি লাগিয়ে দিন না। পাওয়ায় নিয়ে এখন কে আর মাথা ঘামায় আপনারা ছাড়া। আছে আছে, না আছে না আছে। কাগজের খানিকটা জায়গা ভরতে চান। এই তো!

সাংবাদিক : আজ তো মনে হচ্ছে বেশ বড় রকমের মাইফেল। কারণটা আপনার মুখ থেকে এলে একটা ভ্যারাইটি পাওয়া যেত।

সচিব : লিস্টে যতরকম ভ্যারাইটি হতে পারে সবই দেওয়া আছে। আর কিছু বাকি নেই। কী বললেন, ঠিক ধরতে পারছেন না। এক কাজ করুন, ব্রেইল পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করুন।

সাংবাদিক : সেটা কী?

সচিব : চোখ বুজিয়ে লিস্টে হাত রাখুন আই মিন আঙুল রাখুন। চোখ খুলে দেখুন কোথায় পড়ল, সেইটাই কারণ। আমি ধরে আছি। করে বলুন, কারণটা কী পেলেন! আমারও সাহায্য হবে। প্রেস হ্যান্ডআউটে সেইটাই দিয়ে দেব।

সাংবাদিক : জাস্ট এ মিনিট, লিস্টটা বের করি।

সচিব : (কানে ফোন লাগিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন।) ‘তারা দিয়ে সাজিও না আমার এ রাত, আঁধার কেন ভালো লাগে!’

সাংবাদিক : হ্যালো।

সচিব : কী কারণ!

সাংবাদিক : মাছি।

সচিব : হোয়াট? মাছি! মাছি তো লিস্টে ছিল না। মাছির সঙ্গে তো রসগোল্লার সম্পর্ক! পাওয়ারের সঙ্গে তো মাছির কোনও সম্পর্ক নেই। মাছি ইরিটেট করে গরুকে, মানুষকে। গরু লেজের ঝাপটা মারে, মানুষ হাতের। স্ট্রেঞ্জ!

সাংবাদিক : লিস্টের একটা জায়গায় কী ভাবে মরে চেপ্টে ছিল! আঙুল সেইখানেই গিয়ে পড়ল।

সচিব : ঠিক আছে। পড়েছে যখন, লেট আস অনার দ্যাট মাছি। লিখুন, হাইটেনসান ডিস্ট্রিবিউশান লাইনে মাছি বসায় প্ল্যান্ট ট্রিপ করেছে।

সাংবাদিক : ছোট্ট একটা মাছি এত বড় একটা কাণ্ড করতে পারে? গাঁজাখুরি শোনাবে না?

সচিব : বেশ, মাছিটার সাইজ বাড়িয়ে দিন। লিখুন কাবুলি মাছি।

সাংবাদিক : কাবুলি মাছি? সে আবার কে? মাছির নতুন ভ্যারাইটি!

সচিব : ধ্যার মশাই। আপনাদের সবেতেই প্রশ্ন! ইউ আর অল কোয়েশ্চেনস অ্যান্ড নো অ্যানসারস। প্রশ্নকারী-সাংবাদিক না হয়ে উত্তরদাতা হওয়ার চেষ্টা করুন না। সেল্প-হেল্প ইজ বেস্ট হেল্প, এক নম্বর উপদেশ। দু-নম্বর, গড হেল্প দোজ হু হেল্প দেমসেলভস। নিজের মাথা খাটান। ডোন্ট ডিপেন্ড অন আদারস মাথা।

সাংবাদিক : ধ্যার মশাই! ধ্যারধেড়িয়ে বকেই চলেছেন। কাবুলি মাছিটা কী বলবেন তো!

সচিব : কাবুলি ছোলা যদি হয় কাবলি মাছি কেন হবে না! বড় সাইজের মাছি।

সাংবাদিক : মাছি যত বড়ই হোক, কত বড় হবে? হনুমানের মতো! হিপোপটেমাসের মতো!

সচিব : সাইজ নিয়ে মাথা খারাপ করছেন কেন? এ ফ্লাই ইন এ বটল। এক বালতি দুধে ওয়ান মাছি ইজ এনাফ। পঞ্চতন্ত্রের গল্প পড়া আছে?

সাংবাদিক : না। আমি ইংলিশ মিডিয়াম।

সচিব : ওই জন্যেই এই হাল। নলেজ ব্যাঙ্ক নিল। কপি তৈরি হবে কী করে! ডু ইউ নো, একটা মাছি এক রাজার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। রাজা, রাজত্ব, পাওয়ার প্ল্যান্ট। খোদ রাজাকেই মরতে হল মাছির জন্যে, পাওয়ার প্ল্যান্ট কা কথা। তুচ্ছ একটা জিনিস। রাজা বিশ্রাম নেবেন কুঞ্জে। ক্লান্ত রাজা। বন্ধু বানরকে বললেন, লুক মাই ফ্রেন্ড, এই আমি চিৎপাত হলুম কিছুক্ষণের জন্যে, তুমি পাশে বসে, পাহারা দাও। কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। রাজা স্লিপিং। বাঁদর সিটিং। অ্যান্ড এন্টারড এ মাছি। রাজার মুখের চারপাশে ভনভন করে উড়তে লাগল। বাঁদর প্রথমে চেষ্টা করল ঝাপটা মেরে তাড়াতে। মাছির মতো ন্যাগিং প্রাণী আর দ্বিতীয় আছে! জাস্ট লাইক সাংবাদিকস।

সাংবাদিক : আই প্রাোটেস্ট।

সচিব : পরে, পরে। আগে শুনে নিন। যে গরু দুধ দেয় তার চাঁটও সহ্য করতে হয়। সেটল অন মাছি। মাছি রাজার কপালে বসছে, নাকে বসছে, চোখের পাতায় বসছে। বাঁদর ভীষণ রেগে গেল। পাশেই পড়েছিল রাজার খাপ খোলা তরোয়াল। মাছি রাজার কপালে বসে তিরতির করছে। তরোয়ালের এক কোপ, ব্লাডি মাছি। মাছি উড়ে গেল, রাজার মাথা দুখণ্ড। রাজা চলে গেলেন তাঁর হেভনলি অ্যাবোডে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মাছি ক্ষুদ্র হলেও ভয়ংকর।

সাংবাদিক : সবই বুঝলুম, তবে শুধু মাছি হলে তো হবে না। কেস দাঁড়াতে হলে একটা বাঁদরও চাই।

সচিব : আরে মশাই বাঁদরের অভাব আছে দেশে। একটা জোগান করে নিতে কতক্ষণ। যে-কোনও সাহিত্যিক কেসটাকে কল্পনা দিয়ে সহজেই সাজিয়ে নিতে পারতেন। আপনার ইমেজিনেসন নেই। লিখে দিন, হেলিকপটারে করে বন্যাত্রাণের জন্যে গুড় আর ছাতু যাচ্ছিল। হেলিকপ্টার লিক করে তারের ওপর গুড় পড়ল। সেই গুড়ের লোভে কাবুলি মাছি এল। শর্ট সার্কিট হয়ে ফিউজ উড়ে গেল। রাজ্য তলিয়ে গেল অন্ধকারে। কী? পছন্দ হল স্টোরিটা?

সাংবাদিক : কাবুলি মাছি কি কাবুল থেকে এল?

সচিব : ধুর মশাই। ইউরিয়া সারে এক একটা বেগুনের সাইজ বেলুনের মতো। মুলো যেন মুগুর। এই দিশি মাছিই সার পেয়ে কাবলে মাছি হয়েছে।

সাংবাদিক : এই স্টোরিতে পাবলিক হাসবে।

সচিব : আরে মশাই, এত দু:খেও মানুষকে যদি একটু হাসাতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। এক মহাসাফল্য। অন্ধকারে অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে, এই গানের আর কোনও অর্থই থাকবে না। অন্ধকারে অন্তরেতে হাসি ওঠে গুমরে গুমরে। বাই!

(সচিব ফোন ফেলে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা ফোন ক্যাঁক করে উঠল।)

সচিব : হ্যালো! পাওয়ার!

মন্ত্রী : আর পাওয়ার, পাওয়ার করবেন না। সিকস্টিন আওয়ারস স্টেট পাওয়ারলেস। একটা কিছু না করলে হাতে তো হ্যারিকেন!

সচিব : ইয়েস স্যার।

মন্ত্রী : কোনটায় ইয়েস মারলেন? হ্যারিকেন না পাওয়ারে?

সচিব : ও দুটোর কোনওটাতেই নয় স্যার। এটা আমাদের মুদ্রাদোষ। পাওয়ারকে আমরা ইয়েস স্যার বলি। আপনি সেই পাওয়ার।

মন্ত্রী : ছিছি, লজ্জা! মরি, এ কী দুস্তর লজ্জা। এ পাওয়ারে কল চলে না, আলো জ্বলে না।

সচিব : কেন নিজেকে ছোট করছেন, স্যার! শোনেননি, আপনারে ছোট বলে ছোট সেই নয়। লোকে যারে ছোট বলে ছোট সেই হয়।

মন্ত্রী : কী বলছেন যা তা। ছেলেবেলায় আমরা পড়েছি, আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়…

সচিব : কেন পড়েননি, বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে। তার মানে ছোট হওয়াটাই বড় হওয়া। যেমন ছোটলোক হলে বড়লোক হয়।

মন্ত্রী : চলে আসুন আমার চেম্বারে। ভাগ্য ভালো সি এম আজকাল স্টেটে খুব কমই থাকেন। থাকলে দাবড়াতেন।

সচিব : কখনওই নয়। তিনি দাবড়ান কেন্দ্রকে আর রিপোর্টারদের। পাওয়ারের ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। বেশি পাওয়ার মানে ঔদ্ধত্য। পাওয়ার করাপ্টস এডরিসিং। অন্ধকার হল, ইকোয়ালিটি, ইটানিটি ফ্রেটারনিটি। অন্ধকারে হাতড়ে মরে ধনী, গরিব, হাজার লোকে।

মন্ত্রী : সাহিত্য না করে চলে আসুন।

।। ২ ।।

পাওয়ার মিনিস্টারের ঘর। চেয়ারের পেছনে বিশাল একটা চার্ট। চার্টের তলার মেঝেতে একটা গর্ত। সবাই প্রশ্ন করেন গর্ত কেন? পাওয়ার জেনারেশন কার্ভ ওপরের দিকে না উঠে ক্রমশই নীচে নামছে। তিন তলা থেকে দোতলা। দোতলায় ইন্ড্রাস্ট্রি মিনিস্টার। তাঁর চেয়ারের পেছনে একটা বোর্ড। পাওয়ার কার্ভ সেই বোর্ডের কোণ ছুঁয়ে নামছে। সেখানে আরও একটা লাইন তার সঙ্গী। সেটা হল ক্লোজারের লাইন। দুটো গলা জড়াজড়ি করে একতলায় নেমে গেছে। সেই ঘরটা হল হল্লা হল। স্লোগান ফ্যাকট্রি। সেখানে বোর্ড নেই। একটা ডান্ডা মাথায় একটা ঝান্ডা। রাগি চেহারার কিছু ভদ্রলোক। হাত মুঠো করছেন, হাত খুলছেন। যেন কোনও অদৃশ্য শত্রুর চুলের মুঠি ধরে ছিঁড়ছেন। এই ঘরেই একটা টেবিলে আন্তর্জাতিক ভাবনা দপ্তর। একটা স্টিকারে লেখা আছে দেশকে তুচ্ছ করে বিশ্বের কথা ভাবতে শিখুন। সমাজতন্ত্রের মাথায় ধনতন্ত্রের টুপি চাপান। গরিব কখনও বড়লোক হয় না। বড়লোকই আরও বড়লোক হয়। সোনার পাথরবাটি অবাস্তব ব্যাপার। দেশের মানুষকে বক্তৃতা সেবন করান। বায়ুর মতো পথ্য নেই। দারিদ্র্যের মতো শৃঙ্খল নেই। ভেড়ার গায়ের লোমেই বড়লোকের জামিয়ার হয়। মরার যারা মরবে। বাঁচার যারা বাঁচবে। গরুর দুধ গরু খায় না। দেবতার নৈবেদ্য পুরোহিতের প্রাপ্য। ভালোবেসে ঠেঙাও। ডান্ডাই হল শাসন। ধোলাই একটাই। একমাত্র ধোলাই মগজ-ধোলাই। কাজের চেয়ে কথা বড়। ভালোবাসা হল হোমিওপ্যাথিক গুলি। ভয় হল অ্যান্টিবায়োটিক দাওয়াই। ইত্যাদি বহু কথা নানা অক্ষরে লেখা।

আর একটি টেবিল হল প্রাোগ্রাম টেবিল। সেখানে তৈরি হচ্ছে আন্দোলন পঞ্জিকা। আন্দোলন নির্ঘন্ট। সিদ্ধান্ত হয়েছে ছোট, পকেটসাইজ পঞ্জিকার আকারে ছেপে বিক্রি করা হবে। মলাটে লেখা থাকবে মটো, সচলের উলটো অচল। চললেই ক্লান্তি, অচলেই এনার্জি। সচলের অচল হওয়ার ভয় থাকে। অচলের সে ভয় নেই। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না, বসতে ইচ্ছে করে। বসার পরই শোওয়ার বাসনা জাগে। বন্ধুগণ, শুয়ে পড়ুন। না শুলে শুইয়ে দেওয়া হবে। সে ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয় মটো, কেন কাজ করবেন? কলুর বলদ হয়ে লাভ কী? যা উৎপাদন করবেন তা তো অন্যের ভোগেই যাবে। মালিক মারবে স্কচ, চিকেন, আপনাদের শুকনো রুটি। এই চক্রান্ত চলছে, চলবে। চক্রান্তের চাকায় তেল না ঢেলে, হাত গুটিয়ে উবু হয়ে বসে থাকুন। তাস খেলুন। তাস-পাশা-দাবা তিন বড় নেশা। শিল্প মানেই শিল্পপতি, চাষবাস মানেই জোতদার। অতএব এ-ও নেই ও-ও নেই। পণ্য কিনতে হয় মূল্য দিয়ে। মূল্য মানেই মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যবৃদ্ধি মানেই গণবিক্ষোভ। পণ্য না থাকলে কোনওটাই নেই। ধর্মের যেমন ব্রহ্মবাদ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির ব্রহ্মবাদ আমরা তেমনি খুঁজে পেয়েছি। সেটা হল, কিছুই নেই। সব শূন্য। সব ভোঁভাঁ। শুধু পোঁ-টাই সত্য। পোঁ ধরলে বাঁচবে। অন্য কিছু ধরতে চাইলেই মরবে। লেজই সব। নাড়লে গুঁড়ো পাবে। খাড়া করলেই ডান্ডা পড়বে। চির ঠান্ডা মেরে যাবে।

তৃতীয় নির্দেশ, বাঙালি একসময় মাছ ধরত। প্রবচন, লেখাপড়া করিব মরিব দু:খে, মৎস্য ধরিব খাইব সুখে। আমরা বলছি, মাছ নয় দাদা ধরো। বলো, আমরা সবাই এক-একজন, এক-এক দাদার আশ্রিত। বাবার যুগ শেষ, এখন হল দাদার যুগ।

পঞ্জিকা মানে প্রাোগ্রাম, যেমন ৩০ মার্চ, ইরাকে মার্কিনী আক্রমণের প্রতিবাদে, পদযাত্রা। ট্রেন, ট্রাম, বাস চলতেও পারে, না-ও পারে। ১ এপ্রিল, দূতাবাসের সামনে কুশপুত্তলিকা দাহ। ১৫ এপ্রিল, বিশ্বসংহতি দিবস। বিশাল মিছিলের লাগাতার পথ পরিক্রমা। ২৫ এপ্রিল, আফ্রিকা দিবস। মুক্তিকামী মানুষের ক্রন্দনে শহরবাসীর ক্রন্দন। ১৬ মে, বন্ধ। জনকল্যাণে সব বন্ধ রাখার জাতীয় ডাক। ২০ মে, সমাজতন্ত্রের সংরক্ষণে মানবশৃঙ্খল। ২১ মে, যুব-মিছিল। ২২ মে, কিশোর মিছিল। ২৩ মে, প্রৌঢ় মিছিল। ২৪ মে, কলকারখানা খোলার তাগিদে ২৪ ঘণ্টা বন্ধ। ২৯ মে, শক্তি-মিছিল। ১ জুন, শহরের টাকে আম জনসভা।

বি: দ্র: সব কিছু অচল হয়ে যেতে পারে। প্রসূতি পথেই প্রসব করতে পারেন। হৃদরোগীর হাসপাতালের পথ স্বর্গের পথ হতে পারে। পরীক্ষার্থীর কেন্দ্রে পৌঁছোনো নিজের দায়িত্বে। দয়া করে আগুন লাগাবেন না, দমকল জল দিতে পারবে না। আন্ত্রিক বাঁধাবেন না, অ্যাম্বুলেন্স যাবে না। যাঁরা খাবি খাচ্ছেন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে মৃত্যুকে ধরে রাখুন। বিবাহের বরকনের বাড়ির কাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকুন। লগ্ন পেরিয়ে গেলে কেউ দায়ী হবে না। যাঁরা ট্রেন বা প্লেন ধরতে চান কুরিয়ার সার্ভিসের সাহায্য নিন।

কালবেলা : দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোর আগের পনেরো দিন। দরজা জানলা দেবদূতের জন্যে খোলা রাখুন। যমদূত ভেবে দুর্ব্যবহার করলে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে। টিভি, রেডিয়ো যা-ই বলুক না কেন, রক্তদান শিবিরে বোতলখানেক দেওয়ার মতো, স্থাবর-অস্থাবর বেচে আমাদের ছেলেদের ছপ্পর ভরে দিন। দেশ থেকে ধর্ম বিদায় হলেও বারোয়ারি পাওয়ারফুল।

।। ৩ ।।

(মন্ত্রীর ঘর। সচিব আর মন্ত্রী মুখোমুখি। শিল্পসচিব ঘরে ঢুকছেন। নাম বিমল বসু। সবাই বলেন, এ সর্ট অফ বসু। টুকটুকে আদুরে চেহারা। বড়লোকের ছেলে। তিনি চেয়ার নিতে নিতে বলছেন—)

শিল্পসচিব : এ সর্ট অফ হেভি শর্টফল। এ সর্ট অফ কেঅস।

মন্ত্রী : আমি আমাদের তিন এক্সপার্টকে ডেকেছি। একটা কমিটি না করলে এ সমস্যার সমাধান নেই। হোয়াট এ সিচ্যুয়েসান।

শিল্পসচিব : এ সর্ট অফ ভেকসিং প্রবলেম। ক্রনিক ডিজঅর্ডার। এ সর্ট অফ সাবোতাজ। ইন্ডাস্ট্রি গেল। উইদাউট পাওয়ার প্রাোডাকসান তো নিল হয়ে গেল। আপনার বোর্ডের ওই পাওয়ার জেনারেসান কার্ভ আমার ঘরের ভেতরের বোর্ডের ওপর দি ইন্ডাস্ট্রি কার্ভের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে পাতালে নেমে গেছে। ভার্চুয়ালি ইউ আর রেসপনসিবল ফর দ্যাট।

মন্ত্রী : বাজে কথা বলবেন না। একদম বাজে বকবেন না। আপনার ক’টা ইন্ডাস্ট্রি বেঁচে আছে, মশাই! নদীর এপার, ওপার মহাশ্মশান। সব তো লালবাতি জ্বেলে বসে আছে। পাওয়ারের ঘাড়ে পা তুলে দিলেই হল। রাশিয়ার সমাজতন্ত্র ফিরে এলে রুবল আসবে। স্টেডিয়ামে নাচ হবে। খাড়া ঈশ্বরের পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হবে। পাওয়ারের বন্যা বইবে আগামী শতাব্দীতে। আলো, আরও আলো, আলোয় আলোকময়, তখন আপনি কী করবেন?

শিল্পসচিব : ‘দোষ কারও নয় গো মা, স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।’ দায়ী ওই লেবার আর ট্রেড ইউনিয়ন। আপনার পাশের ঘর। যাচ্ছে আর তালা ঝোলাচ্ছে। এ সর্ট অফ ছেলেখেলা।

মন্ত্রী : এটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে পদযাত্রা করে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমরা ইউনাইটেড, আমরা একটা ফ্রন্ট। আমরা আমাদের ব্যাক দেখাব কেন? সব কিছুর জন্যেই সব কিছু হচ্ছে।

(প্রায় একই রকম দেখতে তিনজন ঢুকলেন। সভ্য, ভব্য, গম্ভীর। এঁরা এক্সপার্ট। তিনজনের আসল নাম হারিয়ে গেছে, এখন যে নামে পরিচিত তা হল, ফান্ডামেন্টাল মিত্র, ডিপ দাস, বেসিক ঘোষ। তিনজন বসলেন।)

মন্ত্রী : একটা কিছু করতে হয়। পার্মানেন্ট। এই দু-দিন অন্তর ফুস। আমার পাওয়ার কি দেশলাই! মোমবাতি! ভয়ঙ্কর রেগে গেছি, মশাই। আপনারা তিনজন ডুইং নাথিং।

(ঘরে আর একজন ঢুকলেন বেশ লম্বা চওড়া। আর এক বিশেষজ্ঞ। এঁকে সবাই ডাকেন রুট রায়।)

মন্ত্রী : আরে, আপনি আছেন? ভেবেছিলুম বিদেশে। বসুন, বসুন। কী অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন ওদেশ থেকে?

রুট : (বসতে বসতে) ইলেকট্রনিকস। এজ অফ ইলেকট্রনিকস। সব কর্ডলেস।

মন্ত্রী : তাতে কি পাওয়ারলেস পাওয়ার করা সম্ভব হবে!

ফান্ডামেন্টাল মিত্র : না, না, তা কী করে সম্ভব! পাওয়ারের ফান্ডামেন্টালটা কী? হোয়াট ইজ পাওয়ার!

শিল্পসচিব : এ সর্ট অফ এনার্জি। একটা শক্তি।

বেসিক ঘোষ : না না। হোয়াট ইজ দি বেসিক। বেসিকটা কী? এনার্জি পাওয়ার, না পাওয়ার এনার্জি! উদাহরণ। এগজাম্পল—আমাদের মন্ত্রীমহোদয়কে ধরা যাক—পাওয়ারে আসার পর এনার্জি হল, না এনার্জি আসার পর পাওয়ারে এলেন। এই পয়েন্টটা ক্লিয়ার করতে পারলেই হয়ে গেল।

মন্ত্রী : তাহলেই পাওয়ার প্রবলেম মিটে যাবে? রাগ্য হেসে উঠবে?

ডিপ দাস : বিফোর দ্যাট, আমাদের একটু ডিপে যেতে হবে। পাওয়ার আসে কোথা থেকে? জেনারেট করতে হয়। জেনারেশন ইজ দি পয়েন্ট। হু জেনারেটস। ধরা যাক, মন্ত্রীমহোদয় আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্ট। তিনি নিজেকে ঘি, দুধ, ছানা, ননি খাইয়ে পাওয়ারফুল হচ্ছেন। পাওয়ার জেনারেট করছেন।

মন্ত্রী : আই প্রাোটেস্ট। ওগুলো সবই ধনতান্ত্রিক খাদ্য। আই ডোন্ট টাচ। আর টাচ করার উপায়ও নেই, সুগার, কোলেস্ট্রাল, প্রেশার…

শিল্পসচিব : ডিফিকাল্ট উচ্চারণ, ইট শুড বি কোলেস্টেরল।

মন্ত্রী : ওই হল মশাই। সার্ভিসের এই লোকগুলোর কেবল ভুল ধরা স্বভাব। আমার খাদ্য হল গণতান্ত্রিক কাম সমাজতান্ত্রিক খাদ্য—ভাত, ডাল, রুটি, তরকারি।

ডিপ দাস : পার্টিলাইন থেকে বেরিয়ে আসুন। একটা সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। দেশ ইজ ইন ডিপেস্ট ক্রাইসিস। তাপ্পি মেরে চলবে না। ঘুঁটের মতো গণদেওয়ালে স্লোগান মেরেও হবে না। গণধোলাইতে মানুষ মরবে, অন্ধকারে ঠেকাতে পারবেন না। খাদ্য শব্দটা মিসলিডিং, মিসগিভিং, মেসম্যাশরাইজং, মিসক্রিয়েটিং, মিসপ্লেসিং, মিসফায়ারিং, মিসগাইডিং, মিসরিপ্রেজেন্টিং মনে হলে, বলুন ফুয়েল। দেহযন্ত্রে ফুয়েল না দিলে পাওয়ার আসবে কোথা থেকে। সেই পাওয়ার থেকে আসবে এনার্জি। লিম্ব এনার্জি, ভোক্যাল এনার্জি। নির্বাচনের আগে এত চেল্লাবার শক্তি আসে কোথা থেকে তাহলে?

ফান্ডামেন্টাল মিত্র : তাহলে, সেই ফান্ডামেন্টাল—ফুয়েল থেকে পাওয়ার, পাওয়ার থেকে এনার্জি।

বেসিক ঘোষ : হল না, হল না। পাওয়ার আর এনার্জি এন্টায়ারলি ডিফারেন্ট। একটা মজুরেরও এনার্জি আছে, মন্ত্রীর পাওয়ার নেই। পাওয়ারের চেয়ে বড় হল পাওয়ার হাউস।

রুট রায় : রাইট ইউ আর। রুটে যান, রুটে যান। রুটস অফ পাওয়ার। এনার্জি ইজ নট পাওয়ার মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস। পাওয়ারের সোর্স কোথায়। উদাহরণ না দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে না। ওইজন্যেই ইংরেজিতে বলে এগজাম্পল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট। ধরুন একটা বাঘ শুয়ে আছে। হঠাৎ লেজ নাড়তে শুরু করল। লেজ নিজে নড়ে না নাড়াতে হয়। বাঘের পাওয়ারে লেজ নড়ছে। বাঘের পাওয়ার আসছে তার ফুড এনার্জি থেকে। ফুড হল ফুয়েল। এটা একটা কেস। আবার দেখুন একটা সাধারণ মানুষ রাস্তা দিয়ে আসছে, কিছুই না। কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। মন্ত্রী আসছেন, সামনে পিছনে বডিগার্ড। লোক পথ ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে পাওয়ার হল মন্ত্রীর উপাধি। মন্ত্রীর চেয়ার। আসলে কোনও পাওয়ারই নেই, সবটাই আরোপিত। চেয়ারটা কেড়ে নিন, উপাধি খুলে নিন, ফিনিশড।

বিদ্যুৎ সচিব : আমরা কিন্তু ইলেকট্রিক পাওয়ারের কথা বলছি।

ডিপ দাস : না, না ওকে বাধা দেবেন না। উনি ডেপথে যাচ্ছেন। একে বলে ইন ডেপথ স্টাডি।

রুট রায় : একেবারে রুটে চলে যান। আমার মনে হয় একেবারে আরণ্যক কাল থেকে শুরু করা উচিত। অরণ্য, অসভ্য, বেদ, তপোবন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, দল, উপদল, কোঁদল, মিশর, ব্যাবিলন, রোম, গ্রিস, শক, হুন, মোগল, পাঠান, ইংরেজ উপনিবেশ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, পপুলেশন একসপ্লেসান, পার্টি, মার্ডার অফ ইন্ডিরা, রাজীব টেররিজম, সেসেসানিস্ট মুভমেন্ট, রাম জন্মভূমি, বাবরি মসজিদ অ্যান্ড পাওয়ার।

মন্ত্রী : সর্বনাশ! কেস এত সিরিয়াস! এ তো মশাই এক জীবনে কুলোবে না।

সর্ট অফ বসু : কুলিয়ে যাবে কুলিয়ে যাবে। সিসটেম ইঞ্জিনিয়ারিং-এর যুগ। কম্পিউটারে ফেলে কনডেন্সড মিল্কের মতো কনডেন্সড করে ফেলা হবে। দশ বালতি দুধ ছোট্ট একটা টিনে। এ সর্ট অফ প্যাঁড়া।

ফান্ডামেন্টাল বসু : আগে আমাদের স্টাডি করতে হবে গ্রোথ অফ সিভিলাইজেশান। ম্যান অ্যান্ড মেশিন রিলেশন। মানুষ যন্ত্র চালায়, না যন্ত্র মানুষ চালায়। আর যে মানুষ যন্ত্র চালায় তাকে কোন মানুষ চালায়। পাওয়ার যন্ত্রের, না পাওয়ার মানুষের।

সর্ট অফ বসু : তার মানে এ সর্ট অফ জিগস পাজল।

রুট রায় : আমরা যদি একটু-একটু করে রুটে যাই তাহলেই দেখতে পাব…

মন্ত্রী : আপনারা কি কোনও গাছের কথা বলছেন! পাওয়ার প্ল্যান্ট মানে কি পাওয়ার গাছ।

রুট রায় : অবশ্যই। কত রকমের পাওয়ার আছে জানেন? ম্যান পাওয়ার, হর্স পাওয়ার, মিলিটারি পাওয়ার, পলিটিক্যাল পাওয়ার, স্পিরিচুয়াল পাওয়ার, ডেসট্রাকটিভ পাওয়ার, কনস্ট্রাকটিভ পাওয়ার, মাসল পাওয়ার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার, থার্মাল পাওয়ার, হাইডেল পাওয়ার। পাওয়ার ক্রমশই মহীরুহের আকার নিচ্ছে। পাওয়ারের অজস্র শেকড় সভ্যতার গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছে।

ডিপ দাস : তার মানে ডিপে যাচ্ছে।

রুট রায় : তার মনে আমাদের রুটে যেতে হবে। মানুষের আবিষ্কার আজ আমাদের বাঁশ। ফ্যারাডে, গিলবার্ট, গ্রে, ফ্রাঁসোয়া দুফে, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন গ্যালভানি, ভোল্টা সবাই মিলে এই আছোলাটি আমাদের দিয়ে গেছেন। যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন কি হত? এই তো মাত্র এক শতাব্দী আগের পৃথিবী। ম্যান পাওয়ার, হর্স পাওয়ার, স্টিম পাওয়ার, হাইড্রলিক পাওয়ারেই সব কাজ হত। দিনে দিন, রাতে রাত। মানুষ বলত, বেলাবেলি সব কাজ সেরে নাও হে। এখানকার পৃথিবী কি তখনকার চেয়ে ভালো হতে পেরেছে। তাহলে একালের কবি কেন আক্ষেপ করে বলবেন, দাও ফিরে সে অরণ্য। একই তো ব্যাপার, সভ্যতার কংক্রিট অরণ্যে মানুষই বাঘ, সিংহ, বাইসন, সাপ, গন্ডার, দাঁতাল হাতি, হনুমান, বাঁদর, ছাগল, ভেড়া, গরু হয়েছে, খুন, জখম, লুট, ডাকাতি, ধর্ষণ, মর্ষণ কি বাকি আছে।

মন্ত্রী : আপনার রুট আর কতটা ডিপে যাবে?

রুট রায় : মাত্র একশো বছর গেছে স্যার। এখনও তিরিশ হাজার বছর যেতে হবে। বাঁদর হল মানুষ। হোমোস্যাপিয়েন। সেই মানুষ হল বাঁদর। এ টেল অফ লং থার্টি থাউজেন্ড ইয়ারস।

ফান্ডামেন্টাল মিত্র : ব্যাপারটা গেঁজে যাচ্ছে। আমরা আউটলাইন হয়ে গেছি।

মন্ত্রী : সে তো গেছিই। পার্টিলাইন ছাড়া আর তো কোনও লাইন খুঁজে পাচ্ছি না।

বেসিক ঘোষ : দু:খ করবেন না, স্যার। গতস্য শোচনা নাস্তি। অনুশোচনায় অ্যাসিড হয়। অ্যাসিড টু আলসার। আলসার টু ক্যানসার। সূর্যের দিকে তাকান।

মন্ত্রী : আবার সূর্য টেনে আনলেন!

বেসিক ঘোষ : অফ কোর্স! কেন টানব না, স্যার? সবচেয়ে বড় পাওয়ার হাউস। চাঁদকে চিরকাল আলো দিতে পেরেছে! পনেরো দিন শুক্লপক্ষ, পনেরো দিন কৃষ্ণপক্ষ। কামডাউন টু আর্থ। পৃথিবী সূর্যের সাবস্ক্রাইবার। চব্বিশ ঘণ্টার বারো ঘণ্টাই লোডশেডিং। ভোল্টেজ কমতে কমতে, ভুস। টোট্যাল অন্ধকার। রোজ, নিত্য, এই একই অবস্থা। অত বড় একটা পাওয়ার হাউস গোটা পৃথিবীটাকে চব্বিশ ঘণ্টা আলো দিতে পারে না। দুনিয়াটাকে নানা ফেজে ভাগ করে নিয়েছে। সূর্যের কোনও দু:খ আছে। তার বিরুদ্ধের কোনও গণআন্দোলন চলে?

ফান্ডামেন্টাল মিত্র : একটা ফান্ডামেন্টাল পয়েন্ট পাওয়া গেল। একটা নয়, দুটোই বলা যেতে পারে। প্রথম হল, পৃথিবীকে যদি অ্যাকসিসে জ্যাম করে দেওয়া যায়। ঘোরাটা বন্ধ করে দেওয়া। পৃথিবী ঘুরবে না। তা হলে চব্বিশ ঘণ্টাই দিন। মানুষ আর লোডশেডিং, পাওয়ার ফেলিওর বলে চেল্লাতে পারবে না। পরের নির্বাচনে দেখে নেব বলে শাসাতে পারবে না।

মন্ত্রী : সে কী করে সম্ভব?

বেসিক ঘোষ : হোয়াট নট? জ্যামের বেসিকে যান। কত রকমের জ্যাম আছে? ট্রাফিক জ্যাম, ইলেকট্রনিক ওয়েভ জ্যাম, ড্রেন জ্যাম, ট্রেন জ্যাম, পোস্ট্যাল জ্যাম, স্টম্যাক ইসোফেগাস কোলন জ্যাম, ব্রেন জ্যাম। আমরা সবরকম জ্যামে স্পেসালাইজ করেছি। বিশেষত ট্রাফিক জ্যামে। শহরের একদল ট্রাক ড্রাইভারকে পৃথিবীর টপে তুলে দিন। তাদের পকেটে কিছু পয়সা, বিড়ি দিয়ে দিন। ব্লাডার ফুল করে দিন কান্ট্রি লিকারে। সঙ্গে দিন ট্রাফিক কনস্টেবল। অ্যায়সা জ্যাম করে দেবে, নট নড়ন, নট চড়ন। পারফেকসানে পৌঁছে দিয়েছি, স্যার। কল বন্ধ , জল বন্ধ, দুধ বন্ধ, হাসপাতাল বন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, হাইকোর্ট বন্ধু, ডাক বিলি বন্ধ। আমরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে গরুর দুধ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের চিন্তাভাবনাও বন্ধ করে দিতে পেরেছি আমরা।

মন্ত্রী : আপনি শেষে বাজারি সাংবাদিকদের মতো ব্যঙ্গের পথেই চলে গেলেন। আমাদের এই ভয়ঙ্কর ক্রাইসিসে।

বেসিক ঘোষ : সি এম থাকলে আপনার এই কথায় কি বলতেন জানেন—ক্রাইসিস! হোয়াট ক্রাইসিস! ক্রাইসিস কিছু আছে নাকি! আমি তো বিদেশে কোনও ক্রাইসিস দেখলুম না। সুন্দর জায়গা। সুন্দর আবহাওয়া। চমৎকার খাওয়াদাওয়া পরিষ্কার শহর, রাজপথ। আপনি বলবেন; কথাটা হচ্ছে এদেশ নিয়ে।

সি এম : এদেশ, এদেশ করিস কেন? এদেশ তো আর বিদেশ নয়।

আপনি : কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেকার সমস্যা!

সি এম : বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! এখনও যাচ্ছে। সব বন্ধ হয়ে যায়নি! তাহলে কী করলেন আপনারা! আমার হাতে যে-ক’টা দফতর আছে তার সাকসেস দেখেও শিক্ষা হল না! আমার শেষ টার্গেট, ভঙ্গদেশ নাম পালটে বন্ধদেশ করব। আপনারা এখনও বলছেন, যাচ্ছে। সব যায়নি। বেকার? বেকার মানে? লন্ডনের বেকারদের নামে গোটা একটা রাজপথ দেখে এলুম—বেকার স্ট্রিট।

আপনি : আজ্ঞে, সে বেকার এ বেকার নয়!

সি এম : কোন বেকার! আপনি তো দেখছি সব জানেন! সব জেনে বসে আছেন!

আপনি : বেকার মানে….

সি এম : বুঝেছি, ইংরেজি বাংলা এক করে বসে আছেন। বলতে চাইছেন, বেকার মানে যার কার নেই। সকলের কার থাকে? আপনারা কী ভেবেছেন? দেশটাকে আমেরিকা করতে চান! ল্যাকিজ অফ ইয়াঙ্কিজ!

আপনি : আজ্ঞে, সাকার এর উলটোটা।

সি এম : সাকার! ধর্ম। ধর্মে ধরেছে। যুধিষ্ঠির ডিজিজ! আমরা নিরাকারে যেতে চাইছি! আমার ড্রিমটা শুনুন, একটা শ্মশান, বিশাল-বিশাল, ম্যাজেস্টিক, মাইটি শ্মশান। প্রেতের দল, প্রেতিনীর হাসি, চিতা বহ্নিমান, শ্মশানকালী। প্রেতেরা চাঁদার খাতা হাতে খ্যা-খ্যা করে ঘুরছে। লোক দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, নিহত হচ্ছে। ঢাউস ঢাউস স্পিকার গান ছাড়ছে, আঁখো মে লাগা পেয়ার, চাকুম চাকুম। তিনটে ‘ব’ নিয়ে আমাদের কারবার। চারটেও বলতে পারেন। ফোর ‘ব’জ—বাঁদর, বন্ধ, বারোয়ারি, বম্ব।

আপনি : তাহলে পাওয়ারের কী হবে!

সি. এম : পাওয়ার বাড়ান। চশমা পালটান। ছানি কাটান। তার আগে দেখুন ম্যাচিয়োর করেছে কিনা?

আপনি : আজ্ঞে, সে পাওয়ার নয়।

সি এম : তাহলে আবার কী? গান শোনেননি, চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে!

(মন্ত্রীর ঘরের দরজা খুলে গেল। বলিষ্ঠ এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন—)

ভদ্রলোক : আমি পাওয়ার প্ল্যানার। ইন সর্ট—পিপি।

মন্ত্রী : বসুন, বসুন, আমরা ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছি।

শিল্পসচিব : ভুল হল স্যার, অনেক দূর পেছিয়েছি।

বিদ্যুৎসচিব : ভুল হল স্যার, অনেকটা পৌঁছিয়েছি।

বেসিক ঘোষ : না, না, অনেকটা কেঁচিয়েছি।

রুট রায় : না, না, অনেকটা গেঁজিয়াছি।

পিপি : আপনারা যা-ই করে থাকুন করুন, আমরা আমাদের মেগা-কম্পিউটারে প্রবলেমটা ফিড করেছিলুম, সলিউশান এসেছে। আপনাদের কসমেটিক ট্রিটমেন্ট চেহারা ফিরবে না। ডিজিজ প্ল্যান্টে নেই, আছে আমাদের জাতীয় মনে। অন্য পাওয়ার পাওয়ারফুল হওয়ায় আসল পাওয়ার শেষ। কয়লায় লোহা। কর্মচারীতে ইউনিয়ানের গরল। ম্যানেজমেন্টে ভয়ের খোঁচা। আপনারা দোদুল্যমান।

মন্ত্রী : সত্য কথা বলেন কেন? প্রাণের মায়া নেই!

পিপি : অ্যামনেও মরব, অমনেও মরব। আপনারা একটা কাজ ভালোই করেছেন, মেরে-মেরে মরণটাকে শেষ করে দিয়েছেন।

মন্ত্রী : যিনিই আসছেন, গাদাগাদা কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। সলিউসানটা বলুন না!

পিপি : দিন পেছোতে হবে। অর্থাৎ ঘড়িকে আমরা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেব। সাতটার জায়গায় আটটা বাজাব।

বেসিক ঘোষ : দেখেছেন, আমাদের মাথা কম্পিউটার প্রতিম। বলছিলুম না, জ্যাম করতে হবে।

মন্ত্রী : মাত্র এক ঘণ্টায় কী হবে! এইরকম করুন না, বেলা বারোটায় ভোর হল তেরোটায় ব্রেকফাস্ট, পনেরোটায় অফিস, সতেরটায় ছুটি, আঠারোটায় যেযার বাড়ি।

পিপি : মানে, যাকে বলে বারোটার জায়গায় আঠারোটা বাজানো।

মন্ত্রী : একসময় জমিদাররা বারোটার সময় ঘুম থেকে উঠত। ছাতে উঠে পায়রা ওড়াত।

শিল্পসচিব : এ সর্ট অফ প্রিনসলি অ্যাপ্রাোচ।

ফান্ডামেন্টাল মিত্র : ব্যাক টু ফিউডালিজম।

বেসিক ঘোষ : দিন ছোট, রাত বড়।

ডিপ দাস : মানে চির-শীত।

রুট রায় : মানে হাইবারনেশান।

মন্ত্রী : মানে একটা ইতিহাস, একটা রেকর্ড! যা কেউ পারেনি, টার্নিং দি ক্লক।

(ক্যাঁক, ক্যাঁক, টেলিফোন)

মন্ত্রী : হ্যালো। পাওয়ার। না না, শাওয়ার না, পাওয়ার। ধ্যার মশাই, গ্রেপস আর সাওয়ারের সাওয়ার নয়, না না, বাথরুমের শাওয়ারও নয়, পাওয়ার। হ্যাঁ হ্যাঁ, পাওয়ার শু-এর পাওয়ার। এতক্ষণ লাগল বুঝতে! কী প্রবলেম! অ, ডিউক আসছেন! সন এ ল্যুমিয়ের! পাওয়ার চাই। ময়দানের ফাউন্টেন! আমরা এক্সপার্টদের ডেকেছি। মিটিং চলছে। এ মিটিং-এ কিছু না হলে, ময়দানে বিশাল জনসভা ডাকব। তাতেও না হলে বের করব, ব্রহ্মাস্ত্র, পদযাত্রা, মানবশৃঙ্খল। কী বলছেন? এতেও যদি না হয়! আমরা আবার বসব আমাদের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে—ফাবেডিরু। বুঝলেন না! ফান্ডামেন্টাল, বেসিক, ডিপ, রুট। রুটে যেতে পারলেই তো হয়ে গেল। আরে মশাই, মুটে নয়, রুটে। ঘুঁটে? ঘুঁটে নয়, রুটে। দাঁড়ান—আর ফর রোগ, ও ফর ওল্ড, ও ফর ওভার, টি ফর টাউট। কে বলছেন আপনি!

(মন্ত্রীর হাত থেকে রিসিভার পড়ে গেল। কাতরে উঠলেন—ওরে বাবারে! ইংল্যান্ড থেকে সি এম কথা বলছিলেন। আর এ তো রিভার ছিল। ও তে তো অলিভ ছিল, টি তে তো টেরিফিক ছিল) ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক। সর্ট অফ বোস উঠে গিয়ে ফায়ার অ্যালার্মে হাত রাখলেন। চিৎকার উঠল, আগুন, আগুন। শর্ট সার্কিট, শর্ট সার্কিট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *