ফাঁসি
ফাঁসি! অবশেষে এ রকম মারাত্মক বিষয় নিয়ে রম্যরচনা? সর্বনাশ! কিন্তু সম্পাদক মহোদয়, আমার কী দোষ? আপনারাই তো দলবদ্ধভাবে আমাকে এই অনিবার্য পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
গত দশ-পনেরো বছরে আমাকে বোধহয় হাজারখানেক রম্যরচনা নামক এই অখাদ্য ব্যঞ্জন পরিবেশন করতে হয়েছে। সাপ-ব্যাঙ, হাঁচি-কাশি, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি হরেক দ্রব্য ব্যবহার করেছি। অবশেষে এখন দেওয়ালে পিঠ পড়েছে। এখন খুন-ধর্ষণ-ফাঁসি এই সব ভয়াবহ উপাদানের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
সুতরাং নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
জটিল আলোচনায় প্রবেশের ছলে ফাঁসির বিষয়ে দু’-একটা গল্প বলে নিই।
ইংরেজ রাজত্বের গোড়ার দিকের কথা। তখনও সব জেলার সদর জেলে ফাঁসির কাঠগড়া তৈরি হয়নি। কোথাও তেমন ফাঁসির হুকুম হলে শহর থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ফাঁকা জায়গায় ফাঁসির বন্দোবস্ত করা হত।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আমাদের ভারতবর্ষে স্মরণকাল থেকে প্রাণদণ্ডের প্রচলন আছে, কিন্তু ফাঁসি দেওয়া ছিল না। এটি একটি নির্ভেজাল ইংরেজ অবদান।
ভারতবর্ষে প্রাণদণ্ড হত শূলে চড়িয়ে কিংবা কোতল করে। কখনও কখনও জীবন্ত অবস্থায় মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে হিংস্র জন্তু দিয়ে খাওয়ানো হত। কখনও হাতির পদদলিত করে হত্যা করে সাজা দেওয়া হত। সেসব নৃশংস এবং নিষ্ঠুর বর্ণনায় কাজ নেই।
সে যা হোক ইংরেজরা এসে ফাঁসির প্রচলন করল। ফাঁসির সেই প্রথম যুগের গল্প। শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে বধ্যভূমিতে প্রাণদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত আসামিকে শান্ত্রীরা নিয়ে যাচ্ছে।
যাওয়ার পথে তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। আসামি তীব্র আপত্তি করতে লাগল। এইরকম ঘন দুর্যোগের মধ্যে, ঝড় জল মাথায় করে সে এতটা পথ হাঁটতে পারবে না। তা ছাড়া আজ কিনা তার ফাঁসি।
এই কথা শুনে শান্ত্রীপ্রধান যা বললেন সেটা স্মরণীয়। শান্ত্রীপ্রধান বললেন, ‘ওহে শুধু শুধু চেঁচামেচি করছ। তুমি তো কাঠগড়া পর্যন্ত শুধু যাচ্ছ, সেখানেই তুমি শেষ। তোমাকে আর ফিরতে হচ্ছে না। আমাদের কথা ভেবে দেখো, তোমাকে ফাঁসিতে চড়িয়ে তারপরে এই দুর্যোগে এতটা পথ আবার হেঁটে ফিরতে হবে।’
ফাঁসির মতো নিষ্ঠুর বিয়োগান্ত বিষয়ে কিন্তু সরস কাহিনীর অভাব নেই। দু’-একটি আগে কোথাও কোথাও এদিক ওদিক বলেছি, এবার একত্রে দেখা যাক।
রামাবতার যাদব একজন কুখ্যাত কঞ্জুষ ব্যক্তি। সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু এবং ব্যবসার অংশীদারকে লস্যির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে খুন করেছিলেন।
কিন্তু রামাবতারবাবুর শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশ সন্দেহবশত তাঁকে গ্রেপ্তার করে চালান দেয় এবং যথাসময়ে দায়রা আদালতের বিচারে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। এরপরে ওপরের আদালতগুলিতেও সেই প্রাণদণ্ডের আদেশ বহাল থাকে।
রামাতারবাবু পাটনা জেলে রয়েছেন। ফাঁসির দিন ঘনিয়ে এসেছে। জেলের ভিতর খুব তোড়জোড় চলছে।
দু’-চার বছরে একটি ফাঁসির কেস হয়। ফাঁসির মঞ্চ অব্যবহারে পড়ে থাকে। প্রত্যেকবার ব্যবহারের আগে মঞ্চ সারাই হয়, নতুন দড়ি কেনা হয়, কপিকলে গ্রিজ দেওয়া হয়। ফাঁসির আসামির ওজনের দ্বিগুণ ওজনের বালির বস্তা ঝুলিয়ে টেস্ট করা হয়। ফাঁসির সময়ে একচুল এদিক ওদিক হলে সাংঘাতিক কথা।
ফাঁসির আসামিদের জেলার সাহেব বিধি মতো খোঁজখবর নেন। এইরকম একদিন রামাবতার জেলার সাহেবকে বললেন, ‘স্যার, জেলের মধ্যে খুব ব্যস্ততা দেখছি আজ কয়দিন। এটা কি আমার ফাঁসির ব্যবস্থা করার জন্যে?’
কী আর করবেন জেলারসাহেব, মৌনভাবে ব্যাপারটা স্বীকার করলেন।
রামাবতার বললেন, ‘খুব খরচ হচ্ছে স্যার?’
জেলারসাহেব চুপ করে থাকলেও, তাঁর পাশে ডেপুটি জেলার ছিলেন। তিনি বললেন, ‘তা হচ্ছে।’ এই বলে তিনি খরচের একটা ফিরিস্তি দিলেন মুখে মুখে।
যথা, ফাঁসি কাঠ সারানো হাজার টাকা, তিন মণ বালির বস্তা পাঁচশো টাকা, মোম দিয়ে পাকানো দুই প্রস্থ দড়ি দেড়শো টাকা, কপিকলের গ্রিজ ইত্যাদি দুশো টাকা। এ ছাড়া ফাঁসুড়েকে দিতে হবে পাঁচশো টাকা আর তার দুই সহকারীকে দুশো-দুশো চারশো টাকা।
মুখে মুখে হিসেব করে ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, ‘তা, তিন হাজার টাকার বেশি খরচা হয়ে যাবে।’
রামাবতার সেদিন এই খরচের বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবাভাবি করলেন। পরদিন সকালে আবার যখন জেলার-ডেপুটি জেলার রোঁদে বেরিয়েছেন রামাবতার যাদব করজোড়ে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হুজুর, আমার একটা নিবেদন আছে।’
কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আসামিকে স্বাভাবিকভাবেই একটু মায়ার চোখে দেখেন। জেলার সাহেব বললেন, ‘বলুন, কী নিবেদন।’
রামাবতার বললেন, ‘হুজুর, আমার ফাঁসির আয়োজনে সরকারের তিন হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে।’
জেলার সাহেব বললেন, ‘এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। শুনলাম, ফাঁসুড়েদের মজুরি বেড়ে যাচ্ছে।’
রামাবতার বললেন, ‘আমার কথা শুনুন স্যার। আমাকে এক হাজার টাকা দিন আর দশ-পনেরো টাকা দিয়ে এক গাছা দড়ি কিনে দিন। উঠোনের ওই নিম গাছটার ডালে আমি নিজেই গলায় দড়ি দিচ্ছি। এতে সরকারেরও দু’-আড়াই হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। আর আমারও হাজার টাকা থাকবে।’
সবাই অবশ্য রামাবতার যাদবের মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে পুরনো ফাঁসুড়ে জগা পরিণত বয়েসে মারা যাওয়ার পর তার ছেলেকে ফাঁসুড়ে নিয়োগ করা হয়। বলা বাহুল্য, এই ফাঁসুড়ের কাজটি পূর্ণ সময়ের নয়, দৈনিক তো আর ফাঁসি হয় না। এটা একটা সাময়িক কাজ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বংশগত।
কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটির ফাঁসুড়ে হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সে ছিল খুব নরম স্বভাবের লোক। কাউকে ফাঁসি দেওয়ার কথা সে ভাবতে পারে না।
কিন্তু পারিবারিক বৃত্তি মানুষ সহজে ছাড়তে পারে না। সুতরাং বাবার মৃত্যুর পর জগার ছেলে নগা সরকারি ফাঁসুড়ে নিযুক্ত হল এবং দুঃখের বিষয় নিযুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ফাঁসির কেস এসে গেল। নগাকে জেল থেকে তলব করা হল ফাঁসুড়ের কর্তব্য পালনের জন্য।
কর্তব্যের দায়ে নগা নির্দিষ্ট দিনে জেলখানায় এসেছে। বারবার তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। নগার এই অবস্থা দেখে সে যাকে ফাঁসি দিতে এসেছে সেই কয়েদি বলল, ‘আপনি এত ঘামছেন কেন? আপনাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’
নগা বলল, ‘ভাই, ঘামছি কি সাধে? আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। জানো, এর আগে কোনওদিন আমি কাউকে ফাঁসি দিইনি। এই আমার প্রথম ফাঁসি।’
এই শুনে ফাঁসির আসামি বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? আমার তো কোনও ভয় করছে না। আমার তো এর আগে ফাঁসি হয়নি। এটা আমারও প্রথম ফাঁসি।’