ফাঁসি-দেওয়ার চর

ফাঁসি-দেওয়ার চর

‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন’— ওলন্দাজ ভাষা শিখতে গিয়ে ওই কথাটাই সকলের আগে শিখল সাম।

ডন্ডার এন ব্লিকসেন অর্থাৎ কিনা থানডার অ্যান্ড লাইটনিং অর্থাৎ কিনা বাজ ও বিদ্যুৎ! কাউকে যদি জোর গালাগাল দেওয়ার দরকার হল বা কাউকে যদি বাপ-মা তুলে শাপশাপান্ত করার ঝোঁক চাপল, তক্ষুনি ওলন্দাজ জোয়ান চড়া গলায় হেঁকে উঠবে, ‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন—’

সাম ওই দামি কথাটাই শিখল সকলের আগে, যদিও সে ওলন্দাজ নয়। ওলন্দাজ তো নয়ই, কী যে সে কেউ তা জানে না। কোমনি-প পাহাড়ের নীচে ওই যে উপসাগরের দরাজ বিস্তার, তারই সৈকতে একদা ভোর বেলায় দেখা গেল একটা ধুমসো কালো দৈত্যাকার প্রাণীকে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিক দিয়ে যার নাকি খানিকটা আদল আসে মানুষের চেহারার সঙ্গে। সেই প্রাণীটাই হল সাম।

আগের রাতে ঝড় হয়ে গিয়েছে খুব। সকাল বেলার সমুদ্রের ধারে দেখা গেল এই জীবটাকে। স্বভাবতই কোমনি-প-র লোকেরা ধরে নিল ঝড়ে কোনো জাহাজ ডুবেছে কাল, ধারে-কাছে কোনো এক জায়গায়, সেই জাহাজেই হয়তো ছিল এই নরাকার প্রাণীটা। তাকে জিজ্ঞাসা করে ফায়দা নেই কিছু, কারণ সে তখন অজ্ঞান। অচেতন ধড়টাকে টিউনিস ভ্যান গিসেন নিয়ে গেল তার সরাইখানায়।

আগে অর্থাৎ ওলন্দাজেরা যে যুগে মালিক ছিল এই উপনিবেশটার, তখন নাম ছিল এই সরাইখানার ‘প্রিন্স অব অরেঞ্জ’, এখন ইংরেজ আমল, যদিও সরাইয়ের মালিক এখনও ওলন্দাজবংশীয়ই রয়ে গিয়েছে, ওলন্দাজদের জাতীয় বীর ‘প্রিন্স অব অরেঞ্জ’-এর নামটা ছেঁটে দিতে হয়েছে সরাইয়ের সাইনবোর্ড থেকে। এখন সে বোর্ডে লেখা সাদাসিধে ইংরেজি নাম একটা ‘ওয়াইল্ড গুজ’, অস্যার্থ ‘বুনো হাঁস’।

সরাইটা নামের দিক দিয়ে আভিজাত্য হারাল বটে, কিন্তু তাতে ওর দবদবা কমল না একটুও। লোকজন, গাধা-ঘোড়া হরদম যাচ্ছে এবং আসছে। তাদের সোর হাঙ্গামের ভিতর মাঝে মাঝে কর্কশ কণ্ঠের হুঙ্কার একটা শোনা যায় এখন, ‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন’— এ হল সামের গর্জন।

সে খায় দায়, খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ায়। কাজ তাকে কিছু দেয়নি সরাইওয়ালা টিউনিস ভ্যান গিসেন, তবে সে নিছক বসে বসে খায় যে, তাও নয়। কাজ সে করে, তবে হুকুম করে কেউ তাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নেবে, এমন বান্দা সে নয়। যখন তার মর্জি হল, কুড়ুল নিয়ে কাঠ চিরে দিল বিরাট একটা পাঁজা। কিংবা হয়তো জেলে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দরিয়ায়। সারা দিন পরে ফিরল যখন, নৌকোর খোল মাছে বোঝাই।

এইরকম সব কাজই সে করে এক-একটা। সে সবের ফাঁকে ফাঁকে গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরেই বেড়ায়। কদাচিৎ কোনো নতুন খদ্দের যদি চাকর মনে করে তাকে ফরমায়েশ করেছে কিছু, অমনি সাম রুখে উঠেছে ‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন’ বলে। যারা জানে শোনে, তারা ঘাটায় না ওকে। এখনও তাদের ধারণা, চেহারায় মানুষের মতো হলে হবে কী, আদতে ওটা দরিয়ার ভূত একটা। দরিয়ার অতল তলে কত কী আজগুবি চিজ থাকে, কে তা জানবে, বলো!

সবাইয়ের মনে মনে ভয়, পাতাল থেকে উঠে এসেছে, পাতালেই একদিন আবার ফিরে যাবে ও। তবে অমনি অমনি যাবে না, ভ্যান গিসেনের ‘বুনো হাঁসকে’ বগলদাবা করে নিয়েই যাবে।

ভ্যান গিসেনকে আকারে ইঙ্গিতে একথা কেউ কেউ বলেছেও, কিন্তু সরাইওলার মনটা ভালো, সে সামকে তাড়াবার কথা মনেও ঠাঁই দেয়নি। একটা নিরাশ্রয় লোক দৈবগতিকে তার কাছে এসে পড়েছে, তাকে তাড়িয়ে দিলে ভগবান নারাজ হবেন বলেই ধারণা তার।

মোটের মাথায় অভাগা সাম তার কালো চামড়া আর তেরিয়া মেজাজের দরুন এ অঞ্চলে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই প্রায় চক্ষুশূল। তা বলে শুধু ভ্যান গিসেনের অনুকম্পা সম্বল করেই সে এখানে বাস করে না। দস্তুরমতো অনুরক্ত ভক্তও একটি জুটে গিয়েছে তার বরাত গুণে। সে একেবারে ফেলনা লোকও নয় এখানকার, খোদ গিসেনেরই ভাগনে সে।

হ্যাঁ, নিঃসন্তান গিসেন একটি ভাগনেকে এনে কাছে রেখেছে, ভবিষ্যতে তাকেই যথাসর্বস্বের ওয়ারিশ করে যাওয়ার মতলবে। নাম জিয়ন জোস ভ্যান্ডারস্ক্যাম্প। নামের শেষ অংশটাকে প্রাধান্য দিলে সার্থকনামা, এক নম্বরের স্ক্যাম্প অর্থাৎ বদমাইশ। পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই সে নাম-করা দুর্বৃত্ত। মামার শাসন মানে না, গ্রামবাসীদের চোখ রাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খটখট করে হাসে। কারও বাগানে ফোটা ফুল বা পাকা ফল এক ঘণ্টাও টেকে না তার দৌরাত্ম্যে, গোরু ঘোড়াগুলোকে ধরে ধরে তাদের লেজে ঝাড়ালো কাঁটা বেঁধে দেয়, তারা যত ছোটে তত কাঁটার খোঁচা খায় আর খোঁচা যত খায়, ছোটে তত প্রাণপণে।

সামকে বড়ো পছন্দ এই জিয়ন জোস ভ্যান্ডারস্ক্যাম্প ছোকরার। স্বভাব দুবৃত্ত দু-জনেই কিনা! নিজেদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি করে নিয়ে জিয়ন বনে গেল সামের শাগরেদ। সাম যখন মোচার খোলার মতো একখানি ডিঙি নিয়ে সমুদ্রে ভাসে, তখন জিয়ন হয় তার সাথি। সাম তাকে মাছ ধরাই শুধু শেখায় না, দশ-বিশ মাইলের ভিতর সমুদ্রের কোথায় কোন চড়া আছে, কোন চড়ায় দুই-চারদিন লুকিয়ে বাস করবার কতখানি সুবিধা আছে, উপকূলের পাহাড়ে চোরা-গুপ্তা গুহা কোথায় রয়েছে, যা বোম্বেটেদের কাজে আসত ওলন্দাজ আমলে লুটের মাল মজুত রাখবার গুদাম হিসেবে, এসবই একে একে দেখিয়ে শুনিয়ে দেয় সযত্নে।

জিয়ন আর সামের এই দোস্তি ভ্যান গিসেনের কোনোদিন মনঃপূত ছিল না, কিন্তু করবে কী লোকটা? শাসন এরা মানবে না, শাসন করার মতো ধাতু দিয়ে গিসেনের স্বভাবটা গড়াও নয়। ফলে ওই দুটোর স্বেচ্ছাচার ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলল। এক একবার ডিঙি নিয়ে বেরুবার পরে পাঁচ-সাতদিন করে তারা গরহাজির থাকতে লাগল কোমনি-প থেকে।

বছর দুই এইভাবে কাটল, তারপর একদিন যে বেরুল ওরা, আর মোটেই ফিরল না। মাস গেল, বছর গেল, টিকিটিরও পাত্তা নেই ওদের। ভ্যান গিসেন অথৈ জলে পড়ল। ছেলে নয় বটে জিয়ন, কিন্তু ছেলের মতো করেই ওকে মানুষ করেছে সে। তাকেই বুনো হাঁসের রাজ্যপাটের উত্তরাধিকার দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে রেখেছে কবে থেকে। এখন সে গেল উবে, গিসেন করে কী এই ‘বুনো হাঁস’ নিয়ে?

কিছুই তাকে করতে হল না, মরে সে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেল একদিন। এটা ঘটল, জিয়ন নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার বছর পাঁচেক পরে।

সরাইখানা বেওয়ারিশ, কাজেই তা বন্ধ হয়ে গেল। গাঁয়ের কয়েক জন মাতব্বর এসে সব দরজায় তালা মেরে দিয়ে গেল একদিন। ‘বুনো হাঁস’-এর সাইনবোর্ডের প্রথমে গেল রং চটে, তার পরে গেল কাঠামো পচে। টিনখানা মাটিতে পড়ে যেতেই গাঁয়ের কোনো সজাগ গিন্নি এসে সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে গেল রান্নাঘরের পাল্লাহীন জানালায় গুঁজবার জন্য। সাইনবোর্ডের খাম্বাটা শুধু ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল দড়িহীন ফাঁসিকাঠের মতো।

মানুষের আনাগোনা ওখানে আদৌ নেই, থাকে শুধু একপাল খোঁকি কুকুর। পিছন দিকের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। সেই পথ দিয়ে দলে দলে ঢোকে তারা। তাদের ঐকতান চিৎকার যখন শুরু হয় রাত্তিরে, আধমাইল দূরের বাড়িগুলোতেও মানুষ ঘুমোতে পারে না, কচি ছেলেরা ককিয়ে ওঠে ভয় পেয়ে।

দশ বছর কাটল ভ্যান গিসেনের মৃত্যুর পরে।

সেই সময় একদিন একখানা লঞ্চ এসে ঢুকল কোমনি-প-র উপসাগরে। স্টিমার এ দরিয়ায় আসে বছরে মাত্র দুই-একবার। দশ-বিশ মাইলের ভিতর যে কয়খানা দোকান আছে, তাদের চাহিদামতো গেরস্থালি জিনিসপত্র জোগান দেবার জন্য। আর যা জলযান এখানে ঘোরাফেরা করে, তা হল জেলেডিঙি। লঞ্চজাতীয় পদার্থ বোধ হয় এই প্রথম দেখা গেল এ সমুদ্রে।

কার এ নতুনরকম ইস্টেম্বর গো? দলে দলে লোক এসে সারি দিয়ে দাঁড়াল কূলে কূলে। স্টিমার বা ইস্টেম্বর ক্রমে কাছে ঘনিয়ে এল এবং আশ্চর্য ব্যাপার, এদিক-ওদিক না-তাকিয়ে ঠিক সেই জায়গাটির দিকেই এগিয়ে এল— একমাত্র যেখানে এই বৃহৎ জলযানটা ভেড়ানো সম্ভব হতে পারে।

কোমনি প’-বাসীরা ভাবে, এ-লঞ্চে এমন লোক নিশ্চয়ই কেউ আছে, যার কাছে এই জংলা উপকূল অজানা জায়গা নয়। কে সে লোক হতে পারে?

যখন তারা জানল যে কে সে লোক, তখন অবাক হল তারা। একজন নয়, একজোড়া লোকই রয়েছে এই লঞ্চে, যারা এই উপকূলের প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে চেনে, নিজের হাতের তেলোর মতো। সে-জোড়ার একজন হল জিয়ন, আর একজন সাম, পরলোকগত ভ্যান গিসেনের ভাগনে একটি, আশ্রিত নিগ্রো অন্যটি। ওই যে ‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন’ হুঙ্কার উঠেছে মাঝে মাঝে একটা কালা আদমির মুখ থেকে, ও তো সাম ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। সাম আর জিয়ন আবার একা আসেনি, এসেছে বিরাট এক দল নিয়ে। আর কী চমৎকার দল যে সেটা। এরা যে জনে জনে বোম্বেটে, গলা-কাটা ডাকাত, তা একনজরেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। হরেকজাতের লোক আছে দলটাতে, জনা বিশেক অন্তত গুনতিতে। দাড়িওয়ালা মুশকো জোয়ান সব, গায়ের রং কারও সাদা, কারও তামাটে, কারও-বা সামের মতোই কালো। লম্বা লম্বা দাঁত, চওড়া চওড়া কান, মুখে অসভ্য গালিগালাজ, কথায় কথায় অশ্লীল বুকনি। কোমরে কারও ছোরা, কারও পিস্তল, সবাইয়েরই হাতে মোটা মোটা ডান্ডা, কারও লোহার, কারও বা কাঠের।

এই গোটা দলটা যখন হইহই করে নেমে পড়ল কোমনি-প-তে, গাঁয়ের লোকগুলো সরে গিয়ে যে যার বাড়ির দোরে দাঁড়াল। এরা যে কী মনে করে এসেছে এখানে, কে জানে। কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যে এসেছে— এটা মনে করতে সাহস হচ্ছে না কারও। এরকম একটা ডাকুর দল প্রাণান্তেও কোনো সৎ কর্ম করবে না, এটা অনায়াসেই অনুমান করে নেওয়া যায়।

ডাকুর দল কিন্তু তেমন কোনো অসাধু মতলবের আভাস দিচ্ছে না আপাতত। জিয়ন আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। সেই জিয়ন। সে আর এখন অজাতশ্মশ্রু কিশোরটি নেই। লম্বা-চওড়া জোয়ান সেও হয়েছে, কালো দাড়ি তারও মুখে ফরফর করে উড়ছে সামুদ্রিক হাওয়ায়। আগে আগে পথ দেখিয়ে সে সঙ্গীদের নিয়ে এল তার মামার বাড়ির সমুখে, সেই ভূতপূর্ব ‘বুনো হাঁসের’ আড্ডায়, যা এখন দুই কুড়ি খেঁকি কুকুরের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে।

দরজায় দরজায় তালা। দুই-একটা তালা ওরা ভেঙে ফেলতেই, গাঁয়ের মোড়লেরা সাহস করে এগিয়ে এল দুই-একজন। ‘ভাঙো কেন, এই যে চাবি’— বলল তারা। তারাই চাবি বন্ধ করে রেখেছিল বাড়িটা, সে চাবি মালিকের হাতে সঁপে দেওয়াই কর্তব্য তাদের। মালিক তো ভ্যান গিসেনের অবর্তমানে এখন এই জিয়ন ভ্যান্ডার স্ক্যাম্পই।

জিয়ন তাদের অনেককেই চিনল। আর অবাক কাণ্ড, চিনবার সঙ্গে সঙ্গেই অতি অমায়িক ব্যবহার শুরু করল তাদের সঙ্গে। তাদের পিঠ চাপড়ে, তাদের কুশল প্রশ্ন করে, তাদের বাড়ির ভিতর বসিয়ে হাতে হাতে মদের গেলাস ধরিয়ে দিয়ে, দস্তুরমাফিক দহরম-মহরম জাঁকিয়ে তুলল একেবারে। বসাবার জন্য আগের আমলের বেঞ্চিগুলো রয়েছে, আর মদ? ডজন ডজন নানা দেশীয় মদ জিয়নেরা সাথেই নিয়ে এসেছে লঞ্চে করে।

জিয়ন যা জানাল, তাতে পাকাপাকিভাবে কোমনি-প-তে বসবাস করার জন্যই সে এসেছে। একা সে নয়, সাম তো বটেই, তার অন্য সব বন্ধুরাও থাকবে তারই বাড়িতে। অন্তত কিছুদিন তো থাকবেই তারা। সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে হয়রান হয়ে পড়েছে সবাই, কিছুদিন এখন শক্ত ডাঙায় চরে বেড়াবার বাসনা তাদের। তারপর আবার হয়তো দুই-একবছর পরে বাণিজ্যের নেশা চাগিয়ে উঠতে পারে তাদের। তখন তাহলে বেরুবে আবার। হ্যাঁ, সাথিরা বেরুবে আবার। কিন্তু জিয়ন আর যাচ্ছে না। সাম আর সে এইখানেই থেকে যাবে ‘বুনো হাঁসের’ বাসায়। কুকুরগুলো? থাক-না, বেশ জমজমাট রেখেছে ওরা বাড়িটা।

জঙ্গল-জঞ্জাল ঠিক ততটুকুই পরিষ্কার করে নিল ওরা, যতটুকু না-করলে চলাফেরা একদম করা যায় না। কোণে কোণে দেদার জমে রইল ইট পাথরের কুচো আর ভাঙা চেয়ার বেঞ্চির কাঠ। যেখানে খুশি, সামের সঙ্গীরা বিছানা পেতে ফেলল যে-যার। পালা করে রান্না করতে লাগল এক একজনে, আর মুহুর্মুহু গিলতে লাগল দামি দামি মদ! লঞ্চটার আর্ধেক ওরা মদের বোতলেই ভরতি করে এনেছে।

সাম মাছ ধরে, জিয়ন শিকারে বেরিয়ে যায়, নিত্যি ওদের মচ্ছব লেগে রয়েছে ভাঙা বাড়িতে। এক একদিন জিয়ন প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়েও খাতির জমাবার চেষ্টা করে। গেরস্ত পছন্দ করুক বা না-করুক সেটা, ওর সঙ্গে অভদ্রতা করা বা ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার সাহস কারও নেই। এক কুড়ি ডাকু যার হুকুমবরদার, তাকে ঘাঁটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ভাঙা বাড়ি মেরামতের মতলব কিন্তু জিয়নের দেখা যায় না। ‘আর কেন ভাই’— পড়শিরা ওকথা তুললেই সে জবাব দেয়, ‘ভবঘুরের জীবন। কবে আছে কবে নেই, তার জন্যে আবার মেরামত করতে যাবে কে? সংসারী হবার জন্য আমি জন্মাইনি। মামার আস্তানায় ছাদ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তার নীচে থাকব। সে ছাদ যেদিন ধসে পড়বে, আমিও ভেগে পড়ব।’

ভেগে পড়তে হলই একদিন অবশ্য, তবে তখন-তখনই নয়, আর বাড়ির ছাদ ধসে পড়ার জন্যও নয়। হল কী, আর একখানা লঞ্চ একদিন সকালে দেখা গেল কোমনি-প-র উপসাগরে, আর তা দেখেই ‘বুনো হাঁসের’ বাসিন্দারা (কুকুরেরা নয়, ডাকুরা) শুরু করে দিল দৌড়োদৌড়ি, ঝাঁপাঝাঁপি।

এবারকার এ লঞ্চ পুলিশের।

একদল দুর্দান্ত জলদস্যুর খোঁজে এরা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরছে কয়েক বছর ধরে। এখান থেকে তাড়া খেয়ে দস্যুর দলটা ওখানে যায়, ওখান থেকে তাড়া খেয়ে সেখানে। এমনই লুকোচুরি করতে করতে অবশেষে একদিন তারা বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গেল। পুলিশ কেমন করে জানবে যে, তারা কোমনি-প-র ‘বুনো হাঁসের’ ডানার তলায় আশ্রয় নিয়েছে এসে? তারা সাতসাগর তোলপাড় করে করে পাগলের মতো ঘুরতে লাগল ওদের খোঁজে।

খোঁজ তারা পেল বছর দুই পরে। তার পরই তাদের লঞ্চও এসে ভিড়ল কোমনি-প-তে কিন্তু কূলে নামার ফুরসুত তারা পেল না। নামবার আগেই দেখল, বোম্বেটে লঞ্চ হেল-গেট অর্থাৎ নরকের দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে বাহির সমুদ্রের দিকে পালাচ্ছে।

একটা বিরাট চড়া কোমনি-প থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরে, তার ওপাশের খাঁড়িটাকে বলে নরকের দুয়ার, কারণ ওখানে জলের তলায় এত ডুবো পাহাড় রয়েছে যে তাদের ভিতর দিয়ে নিরাপদে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব ওয়াকিবহাল পাইলট ছাড়া অন্য কারও সাধ্য নয়।

তা ওয়াকিবহাল পাইলট বোম্বেটে দলে একজন আছে, সে হল সাম।

সামই লঞ্চ রেখে এসেছে ওখানে, নিরাপদে থাকবে বলে। পুলিশের লঞ্চ সমুদ্রে দেখেই সে সব ডাকুকে ডেকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে আর সাঁতার কেটে এগুতে লাগল নরকের দুয়ার পানে। পুলিশ লঞ্চ তাদের দেখলও বটে, ধাওয়াও করল বটে তাদের পিছু, কিন্তু গ্রামবাসীরাই কূল থেকে চেঁচিয়ে পুলিশকে সতর্ক করে দিল, ‘ওদিকে লঞ্চ চালিয়ে যাবেন না, ভেঙে যাবে লঞ্চ—’

পুলিশ তখন লঞ্চ আর চালাল না, নৌকো নামাল। নৌকো নিয়ে নরকের দুয়ারে তারা পৌঁছোবার আগেই সাম তার দলবল নিয়ে নিজেদের লঞ্চে গিয়ে উঠল আর দশ মিনিটের ভিতরেই সেটা চালিয়ে দিয়ে ছুটল বাহির দরিয়ায়।

তিনটি মাত্র বোম্বেটে— কেলভিন, টেলকু আর ওডেঙ্গা— কী জানি কেন, পিছিয়ে পড়েছিল সাঁতার দেবার সময়। তারা পারল না লঞ্চে উঠতে। ধরা পড়ে গেল ওই তিনটি দুর্বৃত্ত, আর সঙ্গেসঙ্গে পুলিশ তিনটি ফাঁসি খাড়া করে ফেলল ওই মস্ত চড়াটায়, আর বিনা বাক্যব্যয়ে বোম্বেটে তিনটেকে লটকে দিল তাতে!

তারপর তারা অন্য নিরাপদ পথ ধরে সমুদ্রে বেরিয়ে গেল, বড়ো দলটার সন্ধানে।

সন্ধান যে পেয়েছিল, তা বোঝা গেল আরও একবছর বাদে।

একবছর বাদে কোমনি-প-বাসীরা সবিস্ময়ে একদিন দেখল, দু-টি লোক একটা ডিঙি বেয়ে চলে আসছে উপকূল লক্ষ করে। কূলে তারা উঠল যখন, বিস্ময় তাদের বেড়ে গেল চতুর্গুণ। কারণ লোক দুটো সেই অবিস্মরণীয় জিয়ন আর সাম। সামের মুখ দিয়ে আজও সেই ডণ্ডায় এন ব্লিকসেন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে।

ওদের সাথি সাঙাতেরা কেউ সাথে নেই, ওরাও আসেনি লঞ্চে চড়ে। দলটা হয় ধরা পড়েছে, নয়তো লঞ্চসমেত সমুদ্রে ডুবেছে। ওরা দুটো বেঁচে ফিরেছে কোনো ফিকিরে, দুই-চারদিন, মানে খোঁজ পেয়ে পুলিশ আবার যতদিন না-হানা দেয় এসে, ততদিন একটু নিরিবিলি বসে হাঁপ ছেড়ে নেবার জন্যই ফিরে এসেছে এই ‘বুনো হাঁসের’ ডেরায়।

লঞ্চ সঙ্গে আনতে পারেনি যদিও, ডিঙিতেই ওরা মদের বোতল এনেছে এক কাঁড়ি। মাছ ভাজে আর তারই সহযোগে মদ গেলে ক্রমাগত দু-টিতে বুনো হাঁসের ভূতপূর্ব হোটেলে বসে। এবারে আর গাঁয়ের লোকের সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্টা তাদের নেই, ওদের আসল পরিচয় পাওয়ার পরে কেউ যে আর ওদের কাছে ভিড়তে চাইবে না কোনো কারণেই, এ বোধ তাদের আছে। সাম তো কোনেদিনই সামাজিক জীব নয়, এবার জিয়নও পড়শিদের এড়িয়ে চলছে।

কিন্তু স্রেফ সাম আর জিয়ন, জিয়ন আর সাম, আর দুই কুড়ি কুকুর— এ পরিবেশে বেশিদিন টেঁকা তো জিয়নের মতো চঞ্চল স্বভাবের লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। আড্ডার অভাব পীড়া দিচ্ছে জিয়ন বেচারিকে! মনমরা হয়ে উঠছে দিন দিন। কী করা যায়? কী করা যায়, একটুখানি নতুনত্ব আমদানি করার জন্য এই একঘেয়ে জীবনে?

প্রধান খাদ্য মাছ। তাই প্রায় রোজই ওরা ডিঙিটি নিয়ে বেরিয়ে যায় মাছ ধরতে। সেদিনও গিয়েছে। বেরিয়েছে দুপুরের পরেই। মাছ ধরেছেও প্রচুর। নেশা হিসেবে মাছ ধরার নেশা যে অতি প্রবল, তা আর না-জানে কে? নেশায় মশগুল হয়ে ওরাও হুঁশপবন হারিয়ে ফেলেছে, খেয়াল নেই যে বেলা আর বেশি নেই, উপরন্তু আকাশে আনাগোনা শুরু হয়েছে ঝোড়ো মেঘের।

হুঁশ হল কড়াৎ-কড় একটা বাজ ডেকে উঠতেই।

সাম বলল, ‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন! সন্ধ্যে আর ঝড়, এ দুটোর আগে বাড়ি পৌঁছোনো শক্ত হবে দেখছি—’

জিয়ন জবাব দিল, ‘মোটেই না, হেলগেট দিয়ে ঢুকে পড়ো, পথ আর্ধেক কমে যাবে।’

তা অবশ্য যাবে। কিন্তু ঝড় যদি ওঠে হেলগেটের ভিতর থাকতেই, ডিঙি বাঁচানো যাবে কি? চোরা পাহাড়ের গুঁতো খেয়ে ওর তলা ফেঁসে যাবে নির্যস।

কিন্তু বেপরোয়া সামও। পাছে জিয়ন ভাবে যে সামটা ভয় পেয়ে গেল, সেই ভয়েই সাম ডিঙি চালিয়ে দিল নরকের দুয়ারের ভিতর দিয়ে। ঝড় এখনও ওঠেনি। যদি আর আধ ঘণ্টার ভিতর না ওঠে, ডিঙির কোনো ভয় নেই।

সামনের চরটা ফাঁসি-দেওয়ার চর। চরটা চার-যুগের, কিন্তু নামটা একান্তই হালের। সেই যে জিয়ন আর সামের এককালের কলিজার দোস্ত কেলভিন ওডেঙ্গারা ধরা পড়েছিল বছর খানিক আগে, সেই যে পুলিশ তাদের ফাঁসি দিয়েছিল এই চড়াটাতে, সেই থেকে কোমনি-প-বাসীরা এই নামহীন পুরোনো চরের নতুন নামকরণ করেছে ফাঁসি-দেওয়ার চর। এবারে ‘বুনো হাঁসে’ ফেরার পরে জিয়নেরা শুনেছে এ-নামের কথা।

কোমনি-প-র উপকূল থেকে সোজা সামনেই দেখা যায় চরটা। সোজা সামনে তাকিয়েছেও সাম আর জিয়ন দুই-চার দিন। দেখেছে তিনটে নৃত্যশীল ফাঁসির লাশ ফাঁসিকাঠ থেকে হাওয়ায় দুলছে আর দুলছে, ক্রমাগতই দুলছে। পুলিশের উদ্দেশে একটা অকথ্য গালাগালি উচ্চারণ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওরা।

কিন্তু আজ তো লাশগুলোর একেবারে গা ঘেঁষেই যেতে হবে! আজ তো আর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে রেহাই নেই! এঃ, প্রায় সন্ধ্যেবেলা—!

সেদিনে রেওয়াজ ছিল দুর্দান্ত ডাকাত বা বোম্বেটেদের ফাঁসি দিতে হলে দড়ির সঙ্গে একটা লোহার শিকল গলায় পরিয়ে দেওয়া হত। দড়িটা পচে যাবে অল্প দিনেই, শিকলটা থাকবে অক্ষয় হয়ে। বছরের পর বছর মড়াটা ঝুলতে থাকবে ফাঁসিকাঠে। মাংস পচে গলে খসে পড়ুক না, কঙ্কালটা তো বজায় থাকবে কয়েক বৎসর! ততদিন অন্য দুর্বৃত্তেরা চোখে দেখুক ওই কঙ্কাল আর নিত্যিনতুন করে হাড়ে হাড়ে বুঝুক যে কুকর্মে আখেরে ফায়দা নেই।

কেলভিনদের তিনটে কঙ্কাল তাই লোহার শিকল থেকে ঝুলছেই এখনও।

অমন যে লোহার মানুষ সাম, সেও একবার ওদের দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু জিয়ন, ডানপিটে জিয়ন বুঝি সামকে লজ্জা দেবার জন্যই জোরে জোরে হেসে উঠল হা হা করে।

হাসতে হাসতে সে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওহে কেলভিন টেলকু ওডেঙ্গা, ওখানে নেচে নেচে তো পেট ভরবে না। চলে এসো আমার সঙ্গে, ”বুনো হাঁসের” হোটেলে পেট ভরে মাছভাজা আর মদ খাওয়াব।’

‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন! কী যা তা বলছ?’ রেগে ওঠে সাম। তার উত্তরে আর একবার হাহা করে হাসে শুধু জিয়ন।

ওরাও হেলগেট থেকে বেরুল, ঝড়ও এল দুরন্তবেগে, সঙ্গে তেমনই বৃষ্টি। তবে সাম ওস্তাদ নেয়ে, ডিঙি ঠিক নিরাপদে এনে ভিড়িয়ে নিল উপকূলে। জিয়ন বলল, ‘আমি ডিঙি বেঁধে রেখে পরে আসছি, তুমি মাছের ঝুড়ি নিয়ে আগে চলে যাও, আগুন-টাগুন জ্বালো গে চটপট—’

সাম চলে গেল।

মিনিট পনেরো বাদেই বাড়ি পৌঁছল জিয়নও। ভিতরে ঢুকতেই তার কানে এল একটা উদ্দাম হুল্লোড় চলছে উপরতলার খাওয়ার ঘরে। আর তারই মাঝখান থেকে মাঝে মাঝেই বেজে উঠছে ঝনঝন শিকলের আওয়াজ।

সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে সাম, দৈত্যাকার সাম ঠকঠক করে কাঁপছে ভয়ে। ‘কী? কী? ও কীসের গোলমাল? কারা এসেছে?’ জিয়নের প্রশ্নেও একটা ভয়ের আভাস। একটা অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে, এটা তার মনের থেকেই কুডাক ডেকে উঠল কে যেন!

‘ডন্ডার এন ব্লিকসেন! এসেছে দোস্তরা। যাদের নেমন্তন্ন করে এলে ফাঁসি-দেওয়ার চরে। আমরা আসার আগেই তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে খাওয়ার টেবিলে।’— থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়িতেই বসে পড়ল সাম।

জিয়নেরও প্রথমটা যেন বসে পড়ারই অবস্থা। কিন্তু সামের চাইতে মনের জোর তার বেশি। ভূত? এসেই থাকে যদি, জিয়ন ভয় পাবে না তাদের দেখে। সে উঠতে লাগল সিঁড়িতে। পা কাঁপছে? তা কাঁপুক। ভূতগুলোকে বাজিয়ে না-দেখে সে ছাড়বে না। পিস্তল সে বাগিয়ে ধরেছে তাতে—

সিঁড়ির উপরেই ঘরটা। দরজা খোলাই। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়েই সে দেখতে পেল তিনটে কঙ্কাল বিদঘুটে ভঙ্গিতে ছড়িয়ে বসে আছে টেবিলের পাশে। তাদের গলায় লোহার শিকল থেকে থেকে বেজে উঠছে ঝনঝন করে। ভূতেরা ক্রমাগত চিল্লাচ্ছে, লাও সরাব! লাও মাছভাজা! নেমন্তন্ন খেতে এয়েছি। অনেক দিন খাইনি, পেটভরে খাওয়াও দোস্ত—’

জিয়নের দিকে ওদের চক্ষুহীন চক্ষুকোটর যেই ঘুরল, তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তিনটে কঙ্কাল, আর সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যে এসেছে! এই যে এসেছে!’ লাফিয়ে লাফিয়ে তারা দোরের দিকে এগুল, আর সঙ্গেসঙ্গে একলাফে জিয়ন এসে পড়ল মাঝ সিঁড়িতে। টাল সামলাতে পারল না, গড়াতে গড়াতে নীচে পড়ল, পতন শেষ হল যখন, ঘাড়টা তার মটকে গিয়েছে।

পরের দিন দুই কুড়ি কুকুর তার লাশটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে যখন, গাঁয়ের লোক ছুটে এল সেখানে। লাশটা জিয়নের, তা তারা চিনল। কিন্তু সাম? সাম কোথায়? প্রথমে লোকগুলো ভাবল, জিয়নকে খুন করে সাম তার পয়সাকড়ি নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু সে-ধারণা যে তাদের ভুল, তাও তারা বুঝল দিন দুই বাদে। ওদের ডিঙিটা দেখা গেল, উপসাগরে ভাসছে উলটো হয়ে। আর সামকেও পাওয়া গেল সেই জলেই, আরও খানিকটা দূরে। এক ঝড়ের রাতে সমুদ্র থেকে উঠেছিল, আর এক ঝড়ের রাতে ডুবল সেই সমুদ্রেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *