ফাঁসির পরে অট্টহাসি
সাফোকশায়ারে ছোট্ট শহর বেরি-সেন্ট-এডমন্ডস। শহরের তুলনায় জেলখানাটা বড়ো। আর সে-জেলখানার বন্দোবস্তও ভালো। অন্তত তিনটে শায়ারের যত মারমুখো দুঁদে কয়েদি, সবাইকে এনে পোরা হয় বেরির কারাগারে। এখান থেকে এ যাবৎ কেউ জেল ভেঙে পালাতে পারেনি, এমন মজবুত এর গাঁথনি, আর এমন হুঁশিয়ার এর জেলার।
কাজেই উইলিয়াম কর্ডারের স্থানও বেরি কারার নিভৃত সেলের ভিতরেই নির্দিষ্ট হল। পোলস্টেড গাঁয়ের লাল খামারে (রেড বার্ন-এ) খুন হয়েছিল মেরায়া মার্টেন। সে খুনের দায়ে ধরা পড়ে ওই কর্ডার লোকটা। বিচার চলে দীর্ঘদিন ধরে। ততদিন আসামি আবদ্ধ থাকে বেরিতে। যতদিন ছিল, কারাধ্যক্ষ আর কারাপ্রহরীদের জীবন দুর্বহ করে তুলেছিল নিজের হিংস্র বদমেজাজ দিয়ে। যাহোক, অবশেষে একদিন রাতারাতি একটা ফাঁসিকাঠ খাড়া করা হল জেলখানার চত্বরে, আর ভোর বেলাতেই তা থেকে লটকে দেওয়া হল খুনি কর্ডারকে।
এখন কথা এই, খুনও অনেকে করে, আর ফাঁসিও হয় অনেক খুনি আসামির। কিন্তু ফাঁসিকাঠে উঠবার সময় বা ফাঁসির দড়ি গলায় পরবার সময় কেউ হাসির গররা ছুটিয়ে দিয়েছে গলা থেকে, এমনটা কখনো দেখা বা শোনা গিয়েছে কি? অন্য কোথাও হয়তো যায়নি, কিন্তু বেরির জেলখানায় এই আশ্চর্য ব্যাপারটি ঘটেছিল। চাক্ষুষ দেখেছে এবং স্বকর্ণে শুনেছে একটা ম্যাজিস্ট্রেট, একটা ডাক্তার, একটা যাজক তো বটেই, তাদের বাদ দিয়েও অন্তত এক ডজন কারা-কর্মচারী।
যারা দেখেছিল বা শুনেছিল, তারা অবশ্য গুজব ছড়াবার সুযোগ পায়নি। কড়া নিষেধ এসে গিয়েছিল উপর থেকে। কর্ডারের শেষ মুহূর্তের অট্টহাসিকে বিবেচনা করা হয়েছিল তার বেপরোয়া উদ্ধত মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক বলে কর্তৃপক্ষ যা ভেবেছিলেন, তা হল স্রেফ এই কথা যে বদমাইশ খুনিটার সে-হাসি নির্জলা একটা উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়। ‘ফাঁসি দিয়ে শাসন করবি, সে-বান্দা আমি নই’— এই ধরনের একটা আস্ফলন মাত্র। অসার্থক হলেও একটা আস্ফালন দস্তুরমতো। মরণকালে আইনের মুখের উপরে এটা ছুড়ে মারতে পেরে হয়তো বেশ একটু আত্মপ্রসাদই ও অনুভব করে থাকবে।
পাছে কর্ডারের দৃষ্টান্তে অন্য কয়েদিদেরও ভিতরে ওইরকম বেপরোয়া মনোভাব সংক্রামিত হয়, এই ভয়েই ওর সেই অসময়ের হাসিটার কথা বেমালুম চেপে যেতে চেয়েছিলেন কারাবিভাগের কর্তারা। কিন্তু বাতাসেরও কান আছে, এমনকী বাতাসের রসনারও অভাব নেই। ফলে কর্ডারের অট্টহাসির কথা অন্তত গোটা চার-পাঁচ কাউন্টিতে প্রবাদের মতো ছড়িয়ে পড়ল দিনে দিনে। লোকে জানল, মরার পরেও কর্ডার এখনও রোজ রাতে হানা দেয় বেরির জেলখানায়, আর অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তোলে গোটা বাড়িটা।
গুজব চলতে থাকুক, এদিকে বেরির জেলখানাটা উঠে গেল বেরি থাকে। না, কয়েক একর জোড়া ইমারতটা কেউ তুলে নিয়ে গেল না, আলাদিনের গল্পের জাদুকরের মতো। সেটাকে যথাস্থানেই ফেলে রেখে কারাধ্যক্ষ একদিন অন্য শহরে চলে গেলেন তাঁর ওয়ার্ডারবাহিনী, তাঁর কয়েদি পলটন, তাঁর খাতাপত্রের পাহাড় সবকিছু সঙ্গে নিয়ে। বেরি শহরটা জায়গা ছোটো, যাতায়াতের সুবিধা এখানে কম, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একটা কারাগার এখানে রাখতে গেলে তাতে পরিবহণ-খাতে অনাবশ্যক খরচা পড়ে অত্যধিক, ইত্যাকার বহুবিধ ওজর এবং আপত্তি তুলে কারাবিভাগ থেকে ফতোয়া জারি হল যে বেরির জেল উঠিয়ে দেওয়া হোক এবং জেলখানার বাড়িটা দেওয়া হোক বিক্রি করে।
বলা সোজা মশাই, সে হুকুমটি কাজে পরিণত করা বেশ দুঃসাধ্য। কে কিনতে আসবে জেলখানা? যেখানে হাজার হাজার কয়েদির দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়েছে এক-শো বছর ধরে? সে-সব নিঃশ্বাস বুঝি জড়িয়ে রয়ে যায়নি ওই ইটকাঠের গায়ে গায়ে? আর সেই কর্ডারের অট্টহাসি? সে-হাসির কথা কে না জানে মশাই এ-তল্লাটে?
পড়ে রইল বাড়ি ঢের ঢের দিন। খদ্দের জোটে না।
সরকার ক্রমাগত দাম কমিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িটা যদি আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে এইভাবে, সমূহ লোকসান হবে। তার চেয়ে, আধা-কড়িতে ছেড়ে দিতে পারলেও তহবিলে আসে কিছু।
এল! সেই আধা-কড়িই একদিন এল। খদ্দের জুটলেন এক থার্স টন হপকিন্স, পেশা যাঁর ভূত-তত্ত্বের গবেষণা। প্রচণ্ড শখ ভদ্রলোকের ওদিকটাতে। যেখানে ভূতের গন্ধ টের পেয়েছে কেউ, সেইখানেই ভদ্রলোক ছুটেছেন ব্লাড হাউন্ডের মতো। ভূত কতরকম। ভূতেদের মতি প্রকৃতি কীরকম, ভূতেরা কী করে, কেন করে— এ সবই তাঁর নখদর্পণে। এককথায় ভূতের ব্যাপারের অমন বিশেষজ্ঞ সারা ব্রিটেনে দ্বিতীয় কেউ নেই।
বেরির জেলখানায় কর্ডারের ভূত এখনও অট্টহাসি হেসে বেড়ায় রাতে-বিরেতে— এ জনরবটা কেমন করে যেন ঢুকে পড়েছে হপকিন্সের কানে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার জন্য তিনি কারাবিভাগের বড়োকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন গিয়ে। সে কর্তাটি শুধু এই খবরই রাখেন যে, অট্টহাসির গুজবটা চাপা দেওয়া এবং অস্বীকার করাটাই এ যাবৎ ছিল কারাবিভাগের নীতি। তিনি ঝেড়ে জবাব দিলেন, ‘আপনার মুখে এরকম কথা শুনে অবাক হয়েছি স্যার! এই বৈজ্ঞানিক যুগেও কোনো ভদ্রলোক যে ভূতের মতো অবাস্তব পদার্থ এবং ভূতের হাসির মতো অশ্বডিম্বে বিশ্বাসী হতে পারেন, তা কে জানত!’
কর্তা ভেবেছিলেন, তাঁর তরফ থেকে ওরকম জোরালো অস্বীকৃতি শুনবার পরে বাড়ি কেনার ব্যাপারে হপকিন্স মহাশয়ের সব দ্বিধা একমুহূর্তে কেটে যাবে। ‘কিনব’ বলে সেইখানে একাসনে বসেই তিনি দরদাম ঠিক করে পাকাকথা দিয়ে যাবেন। কিন্তু হায় ভগবান! এ যে উলটো বুঝলি রাম হয়ে গেল! কর্ডার আর হাসে না শুনে অমন উৎসাহী খদ্দেরটা যেন মিইয়ে গেল একেবারে, ‘পরে খবর দেব’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল বিদায়ী করমর্দনের জন্য।
কথাবার্তা সব ভেস্তেই যেত গেল-না যে, সেজন্য যা-কিছু ধন্যবাদ, তা পাওনা হল ডিপার্টমেন্টের কনিষ্ঠ কেরানি ডেভিডসনের। একান্তই দৈবানুগ্রহ বলা যেতে পারে এটাকে, কিন্তু ডেভিডসন ছিল হপকিন্সের খুড়তুতো মামির ভাসুরপো, ভূত এবং ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানার সম্বন্ধে হপকিন্সের প্রবল আগ্রহের কথা তার অজানা ছিল না। হপকিন্স যে বেরির জেলখানা কিনতে চাইছেন, সে-খবরটাও জানা ছিল তার।
এখন হপকিন্স তো আশাহত হয়ে মলিনমুখে নেমে যাচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে, সেই সিঁড়িতে দেখা ডেভিডসনের সঙ্গে। ওকে দেখামাত্রই হপকিন্স ফেটে পড়লেন রাগে, ‘আজেবাজে গুজবে কান দিয়ে বেশ খানিকটা বেফায়দা ঝামেলা পোয়াতে হল বন্ধু! ভূতের হাসি নাকি কস্মিনকালে কেউ শোনেনি বেরির জেলাখানায়। তাই যদি হবে, আমাকে তাহলে টেনে আনার অর্থ কী এ-ব্যাপারে? একটা পুরোনো জেলখানা কিনে আমার কী স্বর্গলাভ হবে শুনি? আসলে তো আমি কিনতে চেয়েছিলাম সেই হাসিটাই—’
‘ভূতের হাসি কস্মিনকালে কেউ শোনেনি বেরিতে, এই কথা আই জি বললেন নাকি আপনাকে?’— রহস্যটা ঠিকই আঁচ করে ডেভিডসন।
‘বললেন না?’— রীতিমতো ঝাঁঝালো হপকিন্সের কণ্ঠস্বর, বললেন বেশ রসান দিয়েই। বললেন, ‘ভূতের হাসিটা নাকি অশ্বডিম্ব। শোনো একবার, অশ্বডিম্ব!’
ডেভিডসন হপকিন্সের কাঁধে হাত দিয়ে কানে কানে বলল, ‘সাহেব এ বিভাগে নতুন, তা জানেন না বুঝি? উনি অফিসের হাল-হদ্দ জানেন না কিছু, কীসের জন্য কী করা হয়েছে, বুঝে নিতে পারেননি এখনও। ভূতের হাসি মোটেই অশ্বডিম্ব নয়, ডিপার্টমেন্টে পুরোনো লোক যত আছে, সবাই যাতে হলপ নিয়ে সেকথা আপনাকে শোনায়, তার আমি ব্যবস্থা করছি।’
সেদিনকার মতো হপকিন্সকে বিদায় দিয়ে ডেভিডসন এত্তেলা পাঠাল, সে একবার বড়ো সাহেবের সঙ্গে কথা কইতে চায়। ঠিক কীরকমভাবে ও ভাষায় সে কথা কইল সেই সাক্ষাৎকারে, সে-বর্ণনা এখানে দেবার দরকার নেই। কিন্তু তার ফলে হপকিন্সের কাছে একখানা আধা-সরকারি চিঠি গেল দুই-একদিনের মধ্যেই, যার মর্ম হল এই যে, ভূতের হাসি-বিষয়ক ব্যাপারটা সম্বন্ধে কারাবিভাগ তাঁর সঙ্গে আর এক দফা আলোচনা করতে চায়। পূর্ববর্তী আলোচনায় ভুলক্রমে তাঁকে অসত্য খবর দেওয়া হয়েছিল। হাসিটা আদৌ অশ্বডিম্ব নয়।
অন্তত দশটা পুরোনো কর্মচারী কারাবিভাগের, অন্তত দশখানা পুরোনো ফাইল এদিনকার কথাবার্তার সময়ে হাজির করা হল হপকিন্সের সামনে। কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করে এবং ফাইলগুলো পড়ে হপকিন্স এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন যে—
যাক সে কথা। এক মাসের মধ্যেই হপকিন্স মালিক হয়ে বসলেন বেরির ভূতপূর্ব জেলখানায় এবং ওই এক মাস পরেই কনিষ্ঠ কেরানি ডেভিডসনের প্রমোশন হয়ে গেল জ্যেষ্ঠ শ্রেণিতে।
হপকিন্সের আনন্দের অবধি নেই। তিনি সপরিবারে উঠে এলেন ভূতপূর্ব জেলখানাতে। কারাধ্যক্ষের বাড়ি যেটা ছিল আগের আমলে, সেইটাই হল তাঁর বাসগৃহ। কয়েদিদের ব্যারাকগুলি ভেঙেচুরে আধুনিক বাসগৃহে পরিণত করার পরামর্শ অনেকেই দিয়েছিল তাঁকে। তা করলে ওগুলো ভাড়া হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে, প্রচুর পয়সা আমদানি হতে পারত তা থেকে। কিন্তু হপকিন্স ও পথ মাড়াতে রাজি নন। ব্যারাক যেভাবে আছে, সেইভাবেই থাকবে। তাতে যদি কেউ ভাড়া নিতে রাজি থাকে, নিক। ভাঙতে তিনি নারাজ। বাড়ির চেহারা যদি বদলে দেওয়া হয়, কর্ডারেরা রাতের বেলায় এসে হয়তো চিনতেই পারবে না তাদের পুরোনো আড্ডাকে, অট্টহাসি না-হেসে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে হয়তো তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে আবার। অমন বোকামি করবেন না হপকিন্স।
তা, যে-অবস্থায় আছে— সেই অবস্থাতেই কিছু কিছু ভাড়া হয়েও গেল ব্যারাক। গুদোম করবার জন্য ভাড়া নিল ব্যবসায়ীরা। এ-ব্যবস্থা বেশ মনোমতোই হল হপকিন্সের। গুদোমের কাজ তো দিনের বেলায়। রাতে সব নিঝুম পুরী। ভূতেদের সেখানে হাজিরা দেওয়ার অসুবিধা কিছু নেই। কর্ডার অবশ্যই আসবে এবং হাসবে সেই অট্টহাসি, যা শুনবার লোভেতেই মবলগ পয়সা ঢেলে হপকিন্স এই বিটকেল ইমারতগুলির মালিকানা লাভ করেছেন।
কিন্তু, দিন ক্রমে কেটে যায়, কোথায় সে হাসি? কর্ডার তো আসে না!
হপকিন্স বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উপর চটে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সেই খুড়তুতো মামির ভাসুরপো ডেভিডসনের উপরে। তিনি তো রেগেমেগে চলেই আসছিলেন ‘কিনব না’ বলে, ওই লোকটাই তো ফাঁদে ফেলল তাঁকে!
তবে হ্যাঁ, হাসি শুনতে না-পান, অন্য একদিকে হপকিন্সের একটা সুযোগ ঘটে গেল একদিন। এ বাড়ি না-কিনলে তা হত না।
বেরির এক মুর্দাফরাশ একদিন এসে দেখা করল তাঁর সঙ্গে। এখানে যখন জেলখানা ছিল, জেলের মড়াদের গতি এই লোকটির হাত দিয়েই হত। নাম এর হাউলার।
খ্রিস্টান মাত্রই মরবার সময় এই আশা নিয়ে মরে যে গির্জাসংলগ্ন কবরখানার পবিত্রভূমিতে সমাধি লাভ করবে তার দেহটা। তবে সবাইয়ের ক্ষেত্রেই যে সে আশা ফলবতী হয়, তা নয়। খুব মহাপাপী যারা, এমন কিছু কিছু লোক বঞ্চিতও হয় সে সৌভাগ্য থেকে। গির্জার কবরখানায় স্থান পায় না তাদের শব। বাইরের কোনো অপবিত্র পোড়ো জায়গাতে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা হয় তাদের। সমাধি দেওয়ার বেলায় ধর্মীয় কৃত্য কিছু আছে, এসব হতভাগ্যের বরাতে তাও সবসময় জোটে না।
কর্ডারেরও জোটেনি।
জেলখানাতে ফাঁসি হয়ে গেল নরহন্তার। গির্জা রাজি হল না তার মৃতদেহকে গ্রহণ করতে। ওই মুর্দাফরাশ হাউলারের হাতেই শবটা তুলে দিলেন কারা-কর্তৃপক্ষ। হাউলার এক বনের ভিতর পুঁতেও ছিল সেটাকে, কিন্তু দুই-একদিন পরেই তা তুলতে হল আবার।
তুলতে হল, কারণ দেহটার এক খদ্দের পেয়ে গেল হাউলার। লন্ডনের এক বেসরকারি হাসপাতাল। ছাত্রদের পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য শবব্যবচ্ছেদ দরকার, শব না-কিনে হাসপাতালের উপায় কী?
হাউলার কিন্তু এ কর্ম আগে কখনো করেনি, মড়া যখনই হাতে পেয়েছে, কবর দিয়েছে বনের ভিতরে। কিনে নেবার প্রস্তাব আগে সে পায়নি কখনো, প্রলোভনেও পড়েনি। কিন্তু এবার এল প্রস্তাব, প্রলোভন জয় করা শক্ত হল বেচারি হাউলারের পক্ষে।
কিন্তু বিবেকেও বাধে। হলই বা মুর্দাফরাশ, তার কি আর বিবেক বলে কিছু নেই? বড়ো দোটানায় পড়ে গেল বেচারি। কবর থেকে মৃতদেহ তোলা বেআইনি তো বটেই, কিন্তু সেটা বড়ো একটা গ্রাহ্য করে না ও। ও ভাবছে, জিনিসটা পাপ বলে গণ্য হবে ভগবানের দপ্তরে। কবর দেবার পরে মড়াটা খুঁড়ে তোলা এবং বিক্রি করে দেওয়া?— অন্যথায়।
কিন্তু খুঁড়ে না-তুললে মবলগ পয়সা মাঠে মারা যায় যে!
তখন অনেক ভেবে হাউলার একটা ফন্দি বার করল। দেহটা সে বেচবে, কিন্তু মাথাটা নয়। ওই মাথাকে সে নতুন করে কবর দেবে আবার। মাথাই তো উত্তমাঙ্গ, মাথার কবরই কবর। দেহের বরাতে যা ইচ্ছে তাই হোক গে না!
সেই ফন্দি অনুযায়ীই কাজ করল সে। হাসপাতাল মুণ্ডহীন ধড়টা নিয়ে গেল, হাউলার মুণ্ডটাকে আবার কবরস্থ করে সান্ত্বনা দিল নিজের বিক্ষুব্ধ বিবেককে।
এই গেল আগের ব্যাপারে। এখন হোক বর্তমানের কথা।
হাউলার কষ্টে পড়েছে। বুড়ো হয়েছে, খাটতে পারে না আগের মতন। এদিকে জেলখানা উঠে যাওয়ার দরুন এখানকার চাকরিটাও সে হারিয়েছে। দিন চলা দায়।
এই অবস্থায় সে শুনতে পেয়েছে একটা খবর। জেলখানার বর্তমান মালিক নাকি কর্ডার সম্বন্ধে খুব কৌতূহলী। তার ভৌতিক হাসি শুনবার আশাতেই তিনি নাকি এই ইটের গাদাগুলো কিনে নিয়েছেন দেদার অর্থ ব্যয় করে। হাসি তিনি শুনতে পেয়েছেন কিনা, তিনিই জানেন। কিন্তু সে হাসি যে মুখ থেকে বেরিয়েছিল, সেই মুখখানা যদি হাউলার তাঁকে এনে দিতে পারে, নেবেন কি মালিক?
মালিক লাফিয়ে উঠলেন প্রস্তাব শুনে। নেবেন না কেন? অবশ্যই নেবেন। মুখ অর্থাৎ মাথা! মাথার আকর্ষণে মাথার মালিকই এসে হাজির হবে একদিন! আসে যদি হাসতেও পারে! ও-মাথা হপকিন্সের চাই-ই।
হাউলার মাথাটা এনে দেখাল। তারপর হপকিন্সের আদেশমতো সেই মাথাকে পরিষ্কার করে ফেলল। হাড় ছাড়া তাতে আর অবশিষ্ট রইল না কিছু। হপকিন্স তখন সেই খুলিটা দিলেন লন্ডনে পাঠিয়ে। সেখানকার কারিগরেরা ওটা আরও পরিষ্কার করে পালিশ লাগিয়ে দিল ওতে। চাঁদিতে ফিকে গোলাপি রং, দাঁতে সাদা রং, আর চোখের গর্ত দুটোতে কাচের চোখ পরে খুলিটার বাহার খুলল খুব।
বাড়ি ফিরে এসে হপকিন্স একটা কাচের বাক্সে পুরে ফেললেন ওটা, বাক্সটা সাজিয়ে রাখলেন ড্রয়িংরুমে একখানা টিপয়ের উপরে। দেখা যাক, এইবার কর্ডার আসে কিনা।
তা, দুই-একদিন পরেই কর্ডার এল।
ড্রয়িংরুমে বসে আছেন হপকিন্স লাঞ্চের পরে, ভৃত্য এসে খবর দিল, এক আধাবয়সি ষণ্ডা গোছের লোক দেখা করতে চাইছে—
‘কীরকম লোক?’— জিজ্ঞাসা করলেন হপকিন্স।
‘মাথায় লোমওয়ালা টুপি, গলা-খোলা লাল চেক-এর জামা—’
হপকিন্সের মনে পড়ে গেল। টনক নড়ল বলতে গেলে। সেই হাউলার একটা বর্ণনা দিয়েছিল কর্ডারের চেহারার। হপকিন্সের প্রশ্নের জবাবেই বলেছিল অবশ্য কথাটা। ফাঁসিকাঠে যখন তোলা হল ওকে, ওর মাথায় ছিল লোমওয়ালা টুপি, ওর গায়ে ছিল লাল চেক কাপড়ের গলা-খোলা কোট।
‘নিয়ে এসো তো মানুষটাকে!’— হুকুম দিলেন হপকিন্স। দিলেন, তবে ততটা উৎসাহের সঙ্গে নয়। দিনের বেলায় ভূতেরা কেমন যেন বেমানান। ঝলমলে রোদ্দুর রহস্য রোমাঞ্চের পরিবেশ সৃষ্টির অনুকূল নয়। আর সে পরিবেশ না থাকলে আসল ভূতকেও জোলো মনে হবে।
‘নিয়ে এসো’— হুকুম দিয়েছেন হপকিন্স, কিন্তু ভৃত্য পারল না তাকে নিয়ে আসতে। ও ফিরে গিয়ে আর দেখতে পায়নি লোকটাকে।
হপকিন্স মনে মনে হাসলেন। মাথা আটক পড়েছে, কর্ডার না-এসে করবে কী? আসতেই হবে। হাসতেই হবে সেই অট্টহাসি, যার আগাম দাম কারাবিভাগকে গুনে দিয়ে এসেছেন হপকিন্স, কয়েক মাস আগেই।
তার পরের দিনও।
সকাল বেলায় জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন হপকিন্স, সমুখেই সেই লোমওয়ালা টুপি, সেই লাল চেক-এর গলা-খোলা জামা। আগেকার দিনে আস্তাবল ছিল যে-ঘরটা, এখন গ্যারেজে পরিণত হয়েছে, তারই দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দেবার চেষ্টা করছিল মূর্তিটা, হঠাৎ পিছন ফিরে তাকাল, চোখাচোখি হল হপকিন্সের সঙ্গে, তার পরেই চোখের পলকে অদৃশ্য।
আর সন্দেহ থাকতে পারে না। আনাগোনা শুরু হয়েছে ভূতের।
হপকিন্সকে কিন্তু সাবধান হতে হল। কর্ডার খুশি নয় তাঁর উপরে। এক পলকের জন্য ওই যে চোখাচোখি হল তাঁর সঙ্গে, তাইতেই ওর চোখের ভাষা উনি পড়ে ফেলেছেন। সে-চোখ ছিল হিংস্র, তার ভাষা ছিল জিঘাংসা। জীবনকালে কর্ডার ছিল খুনে ঘাতুক, মরণের পরেও যে তাই রয়ে গিয়েছে, ওই চোখের দৃষ্টি দেখবার পরে কারও আর সে-বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তবে, কথা এই যে ভূত আর করবে কী হপকিন্সের? ওরা হাসুক কাশুক ভেংচি কাটুক, সত্যিসত্যি কারও ঘাড় মটকাবার ক্ষমতা ওরা রাখে— এমনটা হপকিন্স বিশ্বাস করেন না। তবু হ্যাঁ, সাবধান উনি আছেন, থাকবেনও।
সেইদিনই ডিনারের পরে প্রমাণ হয়ে গেল যে সাবধান হয়েও ভূতের হামলা থেকে বাঁচা যায় না। হপকিন্স বসে ছিলেন লাইব্রেরি ঘরে, তার পাশের ঘরটাই সেই ড্রয়িংরুম। বসে বসে একখানা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন ভদ্রলোক, প্রেততত্ত্বের বই।
এমন সময়ে ঠিক তাঁরই সামনেই যেন একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটল। ঘরের মেঝেটা, তাঁর চেয়ার থেকে তিন-চার ফুট দূরত্বের ভিতরেই— দুলে উঠল আচমকা, আর হপকিন্স চেয়ারটা পিছনে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াবার আগেই বিকট একটা আওয়াজ তুলে মেঝেটা ফেটে যেন চৌচির হয়ে গেল। নীচে থেকে ভলকে ভলকে উঠতে লাগল কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত পূতিগন্ধ, নিশ্ছদ্র!
হপকিন্স হতচকিতের মতো তাকিয়ে আছেন সেইদিকে, নাকে রুমাল চাপা দেবার মতলবে হাতখানা সবে ঢুকিয়েছেন পকেটে, এমন সময়ে তুমুল একটা শোরগোল ড্রয়িংরুমে। মানুষ-গোরু-কুকুর-শেয়াল-বাঘ-বেবুন সব যেন একসাথে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে মরছে নিদারুণ আক্রোশে।
ওখানে এখন না-যাওয়াই উচিত, কথাটা মনে না-পড়েছিল, এমন নয়। তবু কী জানি কেন লাইব্রেরি ছেড়ে ড্রয়িংরুমের দিকেই ছুটলেন হপকিন্স। ডাইনিংরুমের ভিতর দিয়ে সোজা পথ, ছুটলেন সেই পথেই। দরজা বন্ধ ছিল ওদিককার, খুলে ফেলতেই মনে হল, একটা ঘূর্ণিঝড় যেন এসে আছড়ে পড়ল তাঁর মুখে-বুকে-সর্বাঙ্গে। তারই ধাক্কায় হপকিন্স পিছন পানে ছিটকে এসে পড়লেন ডাইনিং টেবিলের উপরে। গড়িয়ে পড়ার সময় ওই টেবিলেরই পিতলে বাঁধানো কোণটা লেগে গেল কপালে, কাটল কিনা, রক্ত পড়ছে কিনা, সে-চিন্তা করার আর সময় হল না তাঁর, মেজেতে গড়িয়ে পড়লেন মূর্ছিতের মতো।
আর গড়িয়ে পড়তে পড়তে হপকিন্স শুনতে পেলেন, একটা আকাশ-ফাটানো দানবীয় অট্টহাসিতে গমগম করছে সারা বাড়িটা।
জ্ঞান যখন ফিরল, তখন হপকিন্স সোফায় শুয়ে আছেন লাইব্রেরি ঘরে, চাকরেরা তাঁকে তুলে এনেছে এখানে। এসেছেন তাঁর স্ত্রীও উপর থেকে নেমে, ভদ্রমহিলার মুখে উদবেগ আর ভয়ের সঙ্গে সমান ওজনে যে মিশে আছে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার চিহ্ন, তা হপকিন্সের বা ভৃত্যদের কারোই বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভূতের ব্যাপারে স্বামীর এই অলক্ষুণে কৌতূহল এই ভদ্রমহিলার চিরদিনই অপছন্দ।
কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে, সেটা খেয়াল করেননি হপকিন্স, তিনি যে-জিনিসটা খেয়াল করেছেন, তা হল এই লাইব্রেরি ঘরে ধোঁয়া আর নেই এবং তার চেয়েও যা বড়ো কথা, ঘরের মেঝে ফাটেওনি, চটেওনি।
হপকিন্স উঠে এইবার ড্রয়িংরুমের দিকে গেলেন। যতই ভয় করুক, তাঁর স্ত্রীকেও কাজেই যেতে হল এবং যতই অনিচ্ছা থাকুক, তাঁর ভৃত্যদেরও। সবাই গিয়ে দেখলেন, ড্রয়িংরুমের অবস্থা লাইব্রেরির মতো শান্ত নয় মোটেই। ঘরময় ছড়িয়ে আছে কাচের আর হাড়ের টুকরো। কর্ডারের মাথাটা বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তার কাচের আধারসমেত।
কর্ডারের অট্টহাসি আর কখনো শুনতে পাননি হপকিন্স।