ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
আমি ফাঁসি বিরোধী মানুষ। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। ফাঁসির বদলে অন্য যে কোনও শাস্তি তারা পেতে পারে। যাবজ্জীবন? নয় কেন? অবশ্য আজকাল আমি যাবজ্জীবনেও আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই আমি পছন্দ করি না। জেলখানাগুলো হতে পারে সংশোধনী কেন্দ্র। যতদিন মাথার কুচুটে কীটগুলো মরে যাচ্ছে, বা মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ততদিন অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন বলেছিলেন, জে লখানার ঘরগুলো হতে পারে এক একটা ক্লাসরুম, আর জেলখানাগুলো এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়। কিছুদিন আগে সুইডেনের কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, কারণ জেলে মোটে লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যুত করা যায়, যত সমতা আনা যায় মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যায়। সে সুইডেনের ব্যাপার, বাংলাদেশ তো আর সভ্য হয়নি, জেলখানা বন্ধ করে দেওয়ার স্বপ্ন না হয় আপাতত থাকুক। অন্য কথা বলি। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বলছে, বলুক। তারা সারা পৃথিবীর যে দেশেই মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে, সেই দেশকেই বলছে, মৃত্যুদণ্ডের আইন বাতিল করো। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যে দেশগুলো মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল রেখেছে, নিজেরাও মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে ঘনঘন, সেই দেশগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অত অশ্রু বিসর্জন করছে কেন? তারা কি অন্য কোনও দেশে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এমন হামলে পড়ে, এমন মড়াকান্না কাঁদে? তারা কি চীনের বা সৌদি আরবের বা। ইরানের বা আমেরিকার বা উত্তর কোরিয়ার চৌকাঠে নাছোড়বান্দার মতো এমন বসে থাকে? বাংলাদেশে অন্য কারও ফাঁসি হলে তো এদের চেহারা দেখা যায় না। তবে। কি কাদের মোল্লার ফাঁসি বলেই এত হাহাকার? কাদের মোল্লা মৌলবাদী বলে? আর। যাকেই মারো, ইসলামী মৌলবাদীর গায়ে আঁচড় কাটতে পারবে নাঃ কাদের মোল্লা যুদ্ধাপরাধী এ কথা কেউ বলছো না কেন? আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খুনীদের বিচারে নানা দেশের শোক দেখে স্তম্ভিত হই। মৌলবাদী অপশক্তির বন্ধুর সংখ্যা কম নয় আজ সারা বিশ্বে। যে পশ্চিমী দেশ গুলোকে ইসলামের শত্রু বলে ভাবা হতো, তারাও দেখা যায় ইসলামী মৌলবাদীদের প্রতি অস্বাভাবিকরকম সহানুভূতিশীল। আমার আর ইচ্ছে করে না ভাবতে কী কী রাজনীতি আছে মৌলবাদ সমর্থনের পেছনে। একাত্তরের যুদ্ধকে মৌলবাদ সমর্থক পশ্চিমী গোষ্ঠী যুদ্ধই মনে করতে চায় না। যেন গরিব দেশের যুদ্ধ কোনও যুদ্ধ নয়, তিরিশ লক্ষ মানুষের মরে যাওয়া কোনও মরে যাওয়া নয়, দুলক্ষ মেয়ের ধর্ষণ কোনও ধর্ষর্ণ নয়। যেন আমাদের দুর্ভিক্ষ, আমাদের ক্ষুধা, আমাদের অভাব, অশি ক্ষাই সত্য, আর কিছু সত্য নয়। যেন আমাদের ভাষা, আমাদের গান, ভালোবাসা, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের সাহস, আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন– কিছুই সত্য নয়, মূল্যবান নয়।
আমি মৃত্যুদণ্ডে কেন বিশ্বাস করি না, তা বলছি। কোনও প্রাণীই বা কোনও মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত পরিবেশ দেওয়া না হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি তার মস্তিষ্কে ক্রমা গত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই শিশুরাই বড় হয়ে অপরাধে আর সন্ত্রাসে নিজেদের জড়ায়। এ কি ওদের দোষ? নাকি যারা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যারা চালু রাখছে সমাজে, তাদের দোষ! একই সমাজে বাস করে আমি মৌলবাদ বিরোধী, কাদের মোল্লা বা দেলওয়ার হোসেন সাইদি মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক, চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে, মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত হচ্ছে। আরেক দলকে ধর্মান্ধ, মুখ, কূপমণ্ডুক আর বর্বর বানানো হচ্ছে, ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার জন্য সমান হলে, শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের শিক্ষা হলে, মানুষেরা মন্দ না হয়ে ভালো হতো। ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা, টুকিটাকি অপরাধ থাকলেও সমাজ এমনভাবে নষ্ট দের দখলে চলে যেতো না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করতো না। কাদের মোল্লার জন্য বিদেশের কয়েকজন কাঁদলেই আঁতকে উঠি, কিন্তু দেশের লোকেরা যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে কাদের-প্রেমে? এরাই তো এক একজন কাদের মোল্লা। এক কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার কাদের মোল্লা যে বিজ্ঞানমনস্ক মৌলবাদ-বিরোধী মানুষদের গলা কাটছে, তাদের কী করা হবে? গুটিকয় মৃত্যুপথযাত্রী অথর্ব যুদ্ধপরাধীর চেয়েও লক্ষ লক্ষ ইসলামী মৌলবাদী নিসন্দেহে ভয়ংকর। তারা আজ যুদ্ধপরাধী কাদের মোল্লার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক একজন সৈনিক।
যে দেশে সবার জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য নেই, সেই দেশে অরাজকতা থাকেই। অন্য সব ব্যবস্থার মতোই বিচার ব্যবস্থাতেও আছে গলদ। সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায় ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা না করে অপরাধীকে জেলে ভরা হয়, মেরে ফেলা হয়। ফাঁসি দিয়ে অনেক সমস্যার চটজলদি সমাধান করতে চায় সরকার। কিন্তু এতে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয় না। আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবি, মৌলবাদী অপশক্তির অবসান চাই। অবসান ফাঁসি দিয়ে হয় না, এই অবসান সুশিক্ষা দিয়ে করতে
সমাজকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ থেকে মুক্ত করতে হলে মানুষকে। শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দিতে হবে বিজ্ঞান, মানববাদ, সমানাধিকার। এই শিক্ষা পেলে শিশুদের ধর্মান্ধ, ধর্ষর্ক আর খুনী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
জামাতে ইসলামির লোকেরা যে ভয়ংকর বর্বরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশে, তা দেখে আমি অবাক হইনি। কারণ আমি অনেক বছর থেকেই জানি যে জামাতে ইসলামি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হলেও এটি একটি সন্ত্রাসী দল ছাড়া কিছু নয়। এদের রাজনীতি ঘৃণার, বৈষম্যের, অন্ধত্বের, অকল্যাণের, পঙ্গুত্বের, হত্যার। এই রাজনীতিকে সমাজে প্রবেশের করার সুযোগ দিলে এই রাজনীতি মানুষকে, দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেবে। খুব সংগত কারণেই জামাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই সন্ত্রাসী দল নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে গেলে গেল রে গেল রে বলে ছুটে এসে বাধা দেয় অনেকেই। যে দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সেই দলকে গণতন্ত্রের নামে বাঁচিয়ে রাখবো আর হাসতে হাসতে সে আপনার রগ কাটবে, আমার গলা কাটবে– এ আমরা জানি। জেনেও না জানার ভান আর কেউ করলেও আমি করি না। বাংলাদেশকে একটা ধর্মীয় মৌলবা দীতে ঠাসা, অনুন্নত, অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ দেশ হিসেবে তৈরী করার বাসনা দেশের এবং দেশের বাইরের অনেকেরই যথেষ্ট। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় প্রচণ্ড বিশ্বাসী হয়েও একটি দলকে নিষিদ্ধ করতে চাইছি, কারণ জামাতে ইসলামী রাজনৈতিক দল। হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়।
যুদ্ধাপরাধীরা প্রায় সবাই ইসলামী মৌলবাদী। মৌলবাদী-যুদ্ধাপরাধী বাইসলামী মৌলবাদীদের খুব বড় শত্রু আমি। তারা আমাকে খুন করার জন্য আজ একুশ বছর হলো ছুরিতে শান দিচ্ছে। হাতের কাছে পেলেই আমাকে জবাই করবে। এটা জেনেও আমি কিন্তু ওদের কারো ফাঁসি চাইছি না। ওরা ভালো মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানেরা প্রগতির পক্ষের মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানের সন্তানেরা যেন না জানে ধর্মান্ধ মৌলবাদ কাকে বলে, যেন সবাই একটা শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, কুসংস্কা রহীন সুন্দর পরিবেশ পায় বাস করার। সব মানুষ, এবং সব সন্তানই যেন পায়। সেই স্বপ্নের জন্য লড়াই আমার। আমি ওই সমতার সমাজ বেঁচে থাকতে দেখতে পারবো। না, কিন্তু আমি সামান্য ভূমিকা রাখতে চাই সেই সুস্থ সমাজ গড়ায়, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লিখছি, মানুষকে লড়াই কার প্রেরণা দিচ্ছি। যে দেশকে আজ দেশ বলে মনে হয় না, যে দেশ নিয়ে আজ লজ্জা হয়, চাইছি, সেই দেশ নিয়ে ভবিষ্যতের মানুষেরা গর্ব করুক। রক্তাক্ত রাজপথ নিয়ে নয়, একটি নিরাপদ স্বদেশ নিয়ে গর্ব।
ভারত এখন তরুণ তেজপাল নিয়ে ব্যস্ত। তরুণ তেজপাল তেহেলকার সম্পাদক, নামী দামী বুদ্ধিজীবী। তাঁর তেহেলকা হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে খুব সরব। যেহেতু আমি মৌলবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করছি, তেহেলকার এই ভূমিকাকে শুরু থেকেই স্বাগত জানিয়েছি। মাঝে মাঝে তেহেলকায় খুঁজেছি মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে একই রকম বলিষ্ঠ লেখা, খুঁজেছি ক্রিশ্চান মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখা। হয়তো কখনো কখনও কিছু লেখা হয়, তবে খুব বলিষ্ঠ নয়। বেশির ভাগ সময় মুসলিমদের পক্ষ নিতে গিয়ে ইসলামের গুণগানও গেয়ে ফেলে। এটিই দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় সেকুলার বা বামপন্থী নরমপন্থীদের সমস্যা। তাঁরা সব ধর্মের সব মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঠিক একই ভাবে দাঁড়ান না। কোনও এক মৌলবাদী গোষ্ঠীর অন্যায় দেখলে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন, আবার আরেক মৌলবাদী গোষ্ঠীর অন্যায় দেখেও দেখছেন না ভাব দেখান।
তেহেলকা এদিকে গোয়ায় থিংক ফেস্ট করেছে। জমকালো অনুষ্ঠান। দেশ বিদেশের নামী সব লোক, এমনকী হলিউডের বিখ্যাত সব অভিনেতাও এসেছেন। আমন্ত্রিত হয়ে। আমার এক ফরাসি বন্ধুও দেখলাম থিংক ফেস্টে আমন্ত্রিত। অবশ্য খুব অবাক হয়েছিলাম তালিবান নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেখে। আমরা কি ইতিমধ্যে জানি না তালিবানরা কী চায়, তাদের মত এবং মতলব? তালিবান নেতাকে তার মত প্রকাশের জন্য কি ভারতের সবচেয়ে প্রগতিশীল মঞ্চটি দেওয়ার দরকার ছিল? গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নারীর-অধিকারের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে, সারা পৃথিবীকে দারুল ইসলাম বা ইসলামের জগত বানানোর জেহাদি শপথ নেওয়া তালিবান নেতার বক্তব্য প্রচার খুব কি জরুরি ছিল তেহেলকার? সভ্য শিক্ষিত হিন্দুত্ব বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের আদর পেয়ে তালিবান নেতা নিশ্চয়ই মহাখুশী। থিংক ফেস্টে তালিবান নেতা অতিথি হিসেবে আসার পর মনে হলো সমাজের সবরকম বিশ্বাসের লোককে মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার শুদ্ধ বৃহত্তর গণতন্ত্রের চর্চা করছে তেহেলকা। কিন্তু মনে খচ খচ করা পুরোনো প্রশ্নটি আবার করলাম, তাহলে কি তেহেলকা সেই দিগভ্রান্ত বাম বুদ্ধিজীবীদের মতো, যাঁরা হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদকে নানা ছলছুতোয় সমর্থন করেন? ইওরোপীয় সংসদ থেকে মা নবাধিকারের ওপর সপ্তাহ খানিকের একটা কনফারেন্স শেষ করে দিল্লি ফিরেই শুনি। তেহেলকার সম্পাদক তরুণ তেজপাল তেহেলকারই একটি তরুণী সাংবাদিককে যৌন নিগ্রহ করেছে, খবরটি শুনে হতবাক বসে ছিলাম। এই দিল্লিতে খুব বেশিদিন হয়নি একটি ঘৃণ্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিরাট বিক্ষোভ হয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ সমর্থন জানিয়েছে ভারতীয়দের বিক্ষোভকে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে তেহেলকার ভূমিকাও ছিল বড়। আর এরই সম্পাদক কিনা সহকর্মী, তাও আবার কন্যার বান্ধবী, তাকে ধর্ষ ণের চেষ্টা করেছে! তরুণ তেজপাল অসম্ভব সব কাজ করেছেন সাংবাদিক হিসেবে। আবার বইও লিখেছেন, পুরস্কারও পেয়েছেন। এত বড় মানুষ হয়েও মেয়েদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখছেন। মুখে বলছেন একরকম, লিখছেন একরকম, আর কাজ করছেন আরেক রকম! এর নামই তো হিপোক্রিসি! যারা অন্য লোকের হিপোক্রেসির নিন্দা করে, তারা নিজেরাই আজ হিপোক্রিট।
তরুণ তেজপালের সঙ্গে আমার আলাপ নেই। দুহাজার সাত-আট সালে আমি যখন ভারত-সরকার দ্বারা গৃহবন্দি, আমার যখন সবচেয়ে বড় দুঃসময়, আমাকে গৃ হবন্দি করার বিরুদ্ধে লেখক অরুন্ধতী রায়ের উদ্যোগে বুদ্ধিজীবীদের যে প্রতিবাদ সভা হয়েছিল দিল্লির প্রেসক্লাবে, সেই সভায় যোগ দেওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন। ছিলেন তরুণ তেজপাল। কিন্তু তাই বলে তরুণ তেজপালের ধর্ষণকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো, তা কখনোই নয়। অতটা স্বার্থান্ধ আমি কোনওদিন নই। তবে এ কথা ঠিক যে, সেকুলার তেজপালকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যৌনহেনস্থাকারী তেজপালকে, সত্যি বলতে কী, ঘৃণা করি।
তরুণী সাংবাদিকটির, তরুণ তেজপালের, আর তত্ত্বাবধায়ক সম্পাদক সোমা চৌধুরীর যে ইমেইলগুলো প্রচার হয়েছে, তা থেকেই ঘটনাগুলো সব স্পষ্ট এখন। ওগুলো পড়লেই দোষ কার, নিদের্ষ কে, সব আমরা খুব সহজেই অনুমান করতে পারি। তরুণ তেজপাল নিজেই বলেছেন, তিনি অন্যায় করেছেন। ক্ষমা চেয়েছেন। এমন কি ছমাসের ছুটি-শাস্তিও নিয়েছেন নিজে। শেষ পর্যন্ত মিডিয়ায় খবরটা এলে থানা পুলিশ হল। তা না হলে এভাবেই হয়তো তেহেলকার তত্ত্বাবধায়ক সোমা চৌধুরী আর সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান তরুণ তেজপাল কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে পুরো ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে দিতেন। এরকম নিশ্চয়ই আরও অনেক কোম্পানীতে ঘটে। মেয়েরা ধর্ষণের বিনিময়ে চাকরি বাঁচায়। প্রতিবাদ করলে চাকরি চলে যায়। নয়তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পথে বসতে হয়। কাস্টিং কাউচের সমস্যা সারা ভারতে ভীষণ। যাদের প্রতিবাদ করার কথা এসবের বিরুদ্ধে, তারাই যদি একই চরিত্রের হয়, ধর্ষক হয়, তবে কারা আর সমাজ বদলাবে! তরুণ তেজপাল তাঁর কন্যার বান্ধবীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, এটিই সবচেয়ে সহজ পন্থা যদি তার চাকরিটি সে বাঁচাতে চায়। কী ভয়ংকর হুমকি! মৌলবাদীদের চরিত্র নষ্ট হলে, রাজনীতিকদের চরিত্র নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয় না, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয়। বুদ্ধিজীবীরাই তো অন্যায়ের অসত্যের অত্যাচারের অবিচারের প্রতিবাদ করে। সমাজকে শুদ্ধ করে, বাঁচায়, প্রগতির পথে নিয়ে যায়। কিন্তু নিজেরাই অন্যায় করলে কোন অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করবে? তরুণ তেজপাল মেয়েদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখেন। বুদ্ধিজীবী-মুখোশের আড়ালে তিনি তাঁর ধর্ষকের মুখটা আড়াল করে রেখেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি নারীবাদী-মুখোশের আড়ালে এতকালের নারীবিরোধী মুখটা যখন অনেকে বেরিয়ে এসেছে। অন্যান্য ধর্ষকদের বিরুদ্ধে তাঁরা ভীষণ সরব, কিন্তু তেজপালের ধর্ষণের ঘটনায় খুব কায়দা করে ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁকে সমর্থন করেছেন। নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করা যায় না। সোমা চৌধুরী নিজেকে বারবারই নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু ধর্ষিতা সাংবাদিক টির পক্ষে তিনি কিন্তু মূলত কিছুই করেননি, বরং ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। কেন ও দ্বিতীয়বার লিফটে চড়লো, যেন লিফটে চড়েছে বলেই ও দ্বিতীয়বার ধর্ষণের মুখে পড়েছে, যেন লিফটে চড়েছে, কারণ আগের দিনের যৌনতায় ওর সায় ছিল। শুধু সোমা চৌধুরী নন, তাঁর মতো অনেকেই গলার স্বর পাল্টে ফেলেছেন, ধর্ষণ আর ধর্ষকদের বিরুদ্ধে তাঁরা আগে যেমন গর্জে উঠতেন, তেমন আর উঠছেন না। অশিক্ষিত আর গরিবরা ধর্ষণ করলে সেই ধর্ষণকে জঘন্য অপরাধ বলা হয় আর শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ধর্ষণ করলে তাকে বলা হয়, মিসকনডাক্ট। ভারতবর্ষ বিভক্ত জাত ধর্মে ততটা নয়, যতটা শ্রেণীতে। আমার শ্রেণীর লোক, সুতরাং তাকে আমি সমর্থন করবো, সে যত অন্যায়ই করুক না কেন। অনেকের মধ্যে এরকম শ্রেণী সমর্থন দেখছি।
কোনও একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে বিভিন্ন রাজনীতির লোকেরা অন্যায়ের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সটান দাঁড়িয়ে যান। মিথ্যের প্রয়োজন হলে অবলী লায় মিথ্যে বলেন। সৎ, নিরপেক্ষ বলতে প্রায় কিছুই নেই। আসারাম নামের এক ধর্মগুরু ধর্ষণ করছে অল্প বয়সী মেয়েদের, এই খবরটা প্রচার হওয়ার পর আসা রামের ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখি, একটি রাজনৈতিক দল বলছে আসারাম কস্মিনকালেও ধর্ষণ করেনি, আবার আরেকটি দল বলছে, আলবৎ করেছে। তেজপালের ধর্ষণের বেলায়, আসারামের পাশে দাঁড়ানো দল বলছে, তেজপাল দোষী, আবার যে দলটি আসারামকে দোষ দিয়েছে, সেই দল বলছে, তেজপাল দোষী নয়, দোষী ধর্ষিতা মেয়েটিই। আর আমি যদি আসারাম আর তেজপালের দুজনের অন্যা য়ের বিরুদ্ধেই একইরকম তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করি, আমি খুব একা হয়ে পড়ি। আমার পাশে শেষ পর্যন্ত কেউ থাকে না। সবাই আমাকে ক্ষণকালের জন্য বন্ধু মনে করলেও শেষে গিয়ে আমার নাম শত্রুর খাতায় লেখে। এই সমাজে কোনও দলের হয়ে কথা না বললে একা হয়ে যেতে হয়। একা হয়ে যাওয়ায় আমার অভ্যেস আছে। চিরকালই আমি একা। যখন থেকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে একা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছি, তখন থেকেই। আমার আর কিসের ভয়!
তেজপালের বিচার যদি সঠিক না হয়, তবে যে সব কোম্পানীর উঁচু পদে বসে থাকা শত শত পুরুষ উর্ধতন বা চাকরিদাতা হওয়ার সুবাদে অবাধে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। তরুণী সহকর্মীদের, তা মহাউৎসাহে, তা মহাআনন্দে, মহা বিজয়ের সঙ্গে করে তো যাবেই, এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। কাস্টিং কাউচ জমকালো হবে আরও।
তরুণ তেজপাল নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে ভারতবর্ষে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর লোকের কোনও অভাব নেই। যৌন অপরাধ করার পরও তাঁর সমর্থক আর অনুরাগীর সংখ্যা কিছুমাত্র কমেনি। পুরুষ বলেই অবশ্য কমেনি। ধর্ষণের সঙ্গে পৌরুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ধর্ষণ আইনের চোখে হয়তো অপরাধ, নারীবিরোধী সমাজের চোখে এখনও এটি অপরাধ নয়, এটি এখনও পুরুষের অধিকার। সে কারণেই তেজপালের বিরুদ্ধে সমাজের বড় নেতারা, বড় রাজনৈতিক দল, নারীবাদী বা মানবাধিকার গোষ্ঠী একযোগে প্রতিবাদী হচ্ছে না। তেজপাল বড় সাংবাদিক, বড় বুদ্ধিজীবী– এসব বলে বলে, তাঁর যৌন নির্যাতনের অপরাধকে একটু ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য যেন একরকম আহ্বান জানানোহচ্ছে। কিন্তু কথা হল, যে লোকেরা বিনা অনুমতিতে কোনও মেয়ের যৌনাঙ্গে আঙুল ঢোকাতে পারে, তারা কিন্তু কোনও একদিন জোর খাঁটিয়ে মেয়েদের যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢোকাতে পারে। কাকে বিশ্বাস করবে মেয়েরা?
ধর্ষণের বিরুদ্ধে ধর্ষিতাকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা এখনও যায়নি। এখনও ধর্ষিতা মেয়েটিকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে লিফটে একবার তেজপাল দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার পরও কেন ও তেজপালের সঙ্গেই দ্বিতীয়বার লিফটে চড়লো। এর কারণ তো খুব সহজ, মেয়েটা তার চাকরি বাঁচাতে চেয়েছে। ধর্ষিতা হয়ে নয়, ধর্ষিতা না হয়ে চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। ধর্ষণের জন্য কোনও ধর্ষকের লিফটের দরকার হয় না। ধর্ষকরা সহজে ধরা পড়বে না এমন যে কোনও জায়গায় ধর্ষণ করে। যদি দ্বিতীয়বার মেয়েটি না চড়তো লিফটে, তাহলে কি তাকে দোষ দেওয়া হতো না? ঠিকই হতো, যারা তাকে আজ দোষ দিচ্ছে লিফটে চড়ার জন্য, তারাই বলতে কী ব্যাপার তেহেলকার সম্পাদক তোমাকে যৌন হেনস্থা করার পরও তুমি তেহেলকায় দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছো, নিশ্চয়ই তোমার সায় ছিল ওই যৌন হেনস্থায়!
তেজপাল বেশ স্পষ্ট করেই তাঁর ইমেইলে লিখেছেন যে মেয়েটির অসম্মতি তেই মেয়েটির যৌনাঙ্গে তিনি আঙুল ঢুকিয়েছেন। ইমেইল প্রচারিত হওয়ার পরও মেয়েটিকে দোষী বানানো হচ্ছে। সমাজ, সত্যি বলতে কী, ভীষণরকম নারীবিদ্বেষী। এই সমাজে সব শ্রেণীর পুরুষেরাই সব শ্রেণীর মেয়েদের যৌনাঙ্গে যা ইচ্ছে তাই ঢুকিয়ে বিকৃত আনন্দ পায়, মেয়েদের এতে সায় আছে কী নেই, তা অনেকেই মনে করে না, দেখা সবার আগে প্রয়োজন। দিল্লি বাসের অসভ্য অশিক্ষিত সেই ধর্ষক দের সঙ্গে দিল্লির সভ্য শিক্ষিত তরুণ তেজপালের পার্থক্য খুব বেশি নেই। ওদের। মতো তরুণ তেজপালও মেয়েদের যৌনবস্তু হিসেবে মনে করেন। ঘূণী করতে হলে দিল্লি বাসের ধর্ষকদের চেয়ে তরুণ তেজপালকেই বেশি করা উচিত। কারণ তিনি জেনে বুঝে অপরাধটি করেছেন। দিল্লি বাসের ধর্ষকরা নারীবাদের ওপর কোনও বই পড়েনি। নারীরা যে মানুষ, নারীরা যে যৌন বস্তু নয়, এ তাদের কেউ শেখায়নি। কিন্তু তরুণ তেজপাল সব জেনেও, নারী-পুরুষের বৈষম্য যে কোনও সভ্য সমাজে থাকা উচিত নয়, পুরুষের যে অধিকার নেই নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করার, তা বুঝেও, জোর করে এক নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে চেয়েছেন। তরুণ তেজপালের নিশ্চিতই এক জ্ঞানপাপী।
এখনকার অফিসআদালতে তথাকথিত সভ্য শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা মেয়ে-সহক র্মীদের যৌন হেনস্থা করে চলেছে, এ সকলেই জানে, এ থেকে মেয়েদের বাঁচানোর জন্যও তেজপালের শাস্তি জরুরি। তেজপালের মতো অগুণতি যৌন হেনস্থাকারীর টনক নড়বে। বুঝবে. এত নিশ্চিন্তে হেনস্থা চালিয়ে যাওয়া যাবে না, ধরা পড়লে সর্বনাশ। অবশ্য আমরা সকলেই জানি যে, শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কখনও কোনও অপরাধকে কমানো যায়নি সমাজে। আসলে তরুণ তেজপাল যে চোখে মেয়েদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখেন, পুরুষের সেই দেখার চোখটা যতদিন পাকাপাকি ভাবে বন্ধ। না হয় বা অন্ধ না হয়, ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা ইত্যাদি কমবে না।
আমার আত্মজীবনীতে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের বয়স্ক এক নামী লেখক আমাকে ছলে কৌশলে দূরের এক শহরে নিয়ে গিয়ে এক ঘরে ঘুমোবার ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখকটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। এই ঘটনা লেখার পর লোকে ওই লেখককে দোষ না দিয়ে আমাকে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের এক বড় লেখকের যৌন হেনস্থা করার খবর যেদিন বলি, ওখানেও একই অবস্থা হয়েছিল। লোকে যৌন হেনস্থাকারী লেখককে দোষ না দিয়ে আমাকে দোষ দিয়েছিল। ওঁদের ছি ছি না করে আমাকে ছি ছি করেছিল। যেন ওঁরা কেউ নন, অন্যায়টা বা অপরাধটা আমি করেছি। জানি সাধারণ লোকেরা বড় লেখক বুদ্ধিজীবীদের দেবতা বলে মনে করে। তাঁদের পক্ষে যে কোনও দুঃসময়ে দাঁড়ায়। আমি নিজে কিন্তু বানের জলে ভেসে আসা মেয়ে নই, বা এক্স ওয়াই জেড নই। দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার পাওয়া জনপ্রিয় লেখক, কিন্তু যত বড় লেখকই আমি হই না কেন, আমি মেয়ে, আমি মেয়ে বলেই কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেশিরভাগই লোকই বিশ্বাস করে যৌন হেনস্থা করার অধিকার পুরুষের আছে, এবং পুরুষের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করার অধিকার। কোনও মেয়ের নেই, বিশেষ করে সে পুরুষ যদি নামী দামী কোনও পুরুষ হয়। সমাজটা আসলে শুধু পুরুষের নয়, সমাজটা নারী বিদ্বেষী নারীবিরোধী পুরুষের।