ফাঁদ
[ We’re all in our private traps, clamped in them,
and none of us can ever GET OUT. ]
–Norman Bates– Psycho
দু’হাতে বৃষ্টির চাদর সরাতে সরাতে যখন বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছালাম তখন আপাদমস্তক ভিজে গেছি৷ এমনকি পিঠের ব্যাগটা পর্যন্ত৷ পিছনের রাস্তাটায় এখন আর গাড়িঘোড়ার দেখা নেই৷ এমনকি রাস্তাটাই চোখে পড়ছে না ভালো করে৷ বেশ বিরক্ত লাগল আমার৷ আশপাশে অন্য বাড়িও আছে বটে কিন্তু সেগুলো বেশ খানিকটা দূরে৷ হাতটা মুখের সামনে এনে আমি ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলাম৷ নাঃ, সেটাও জলে ঢেকে গেছে প্রায়৷ নেহাত ওয়াটারপ্রুফ বলে এখনও সেকেন্ডের কাঁটাটা ঘুরে চলেছে খচখচ করে৷
আমি সামনের দোতলা বাড়িটার দিকে তাকালাম৷ মোটামুটি পুরনোই বলা চলে৷ উপরের কার্নিস থেকে সরলরেখায় জল পড়ে চলেছে৷ সেই জলেই একতলার চৌকাঠ ডুবে রয়েছে৷ ধীরপায়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলাম৷ বাড়িটার পাশেই একটা লম্বা লাইটপোস্ট৷ তার আলোয় দরজার উপর নামটা চোখে পড়ল৷ — মহাদেব ঘোষ৷ চারপাশে খুঁজেও কলিংবেল চোখে পড়ল না৷ অগত্যা দরজার উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিলাম৷
বৃষ্টিটা এতক্ষণে আরও জোরে ঝাঁপিয়ে এসেছে৷ ফলে আওয়াজটা নিজের কানেই পৌঁছাল না৷ অগত্যা হাত মুঠো করে জোরে ধাক্কা দিলাম কয়েকবার৷ বেশিক্ষণ এই বৃষ্টিতে ভিজলে অবধারিত নিউমোনিয়া৷
মিনিট তিনেক পরে সামনের কাঠের দরজাটা মৃদু শব্দ করে খুলে গেল৷ আমি তাকিয়ে দেখলাম মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ওপারে৷ তাঁর মাথা জোড়া প্রশস্ত টাক৷ পরনে একটা সাদা পাজামা আর কবজি অবধি ঢাকা ফুলশার্ট৷ লোকটার মুখটা বেশ সাদামাটা৷ ইনি সম্ভবত মহাদেব ঘোষ৷ মনে জোর পেলাম৷ মুখের সামনে থেকে হাত দিয়ে জল সরাতে সরাতে বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন বৃষ্টি শুরু হল…’
‘ছাতি নেই?’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলেন ভদ্রলোক৷ থতমত খেয়ে একটু থেমে গিয়ে বললাম, ‘আসলে যখন আমি বেরিয়েছি তখন ঝাঁঝালো রোদ ছিল৷ তাই আর খেয়াল ছিল না৷’
‘তা বললে পরে হয়? ছাতি ছাড়া বর্ষাকালে বেড়ানোটাই একটা বোকামো৷ কী হবে এবার?’
আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি৷ আমার কেমন অস্বস্তি লাগল৷ ভদ্রলোক হলে এতক্ষণে ভিতরে আসতে বলত— অন্তত তিনি একাই থাকেন যখন৷ আমতা আমতা করে বললাম, ‘সামনে তো কিছু চোখেও পড়ছে না৷ বৃষ্টিটা কমা অবধি…’
‘কমা অবধি এখানে থাকবেন, তাই তো?’
আমি মাথা নাড়লাম৷ সরু জলের ধারা এখনও পিঠে এসে পড়ছে৷ চারপাশ থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে ঢুকে পড়ছে জামার ভিতরে৷ কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘মুখ দেখে তো ষন্ডাগুন্ডা বলে মনে হয় না৷ আসুন ভিতরে৷’
মনটা খিঁচড়ে গেছিল৷ লোকটার ব্যবহার ভারি অদ্ভুত৷ অবশ্য তাঁকে ছাড়া আমার গতিও নেই এখন৷ টেবিলের উপর থেকে একটা কাপড় তুলে আমার হাতে দিতে দিতে ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করলেন৷ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাবেন কোথায়?’ লক্ষ করলাম লোকটার হাতে একটা টিভির রিমোট৷
‘আট নম্বর মুরলী পাল রোড৷’
‘সে তো অনেক দূর৷ এতক্ষণে গাড়িঘোড়াও বন্ধ হয়ে গেছে৷’
আমি মাথা মুছতে মুছতে করুণ মুখে হাসলাম৷ ঘরটা মাঝারি সাইজের৷ আগেকার দিনের বাড়িতে একতলায় একটা বড়োসড়ো ড্রয়িংরুম থাকত৷ এঘরটাও অনেকটা সেইরকম৷ তবে জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই বললেই চলে৷ বুঝলাম মহাদেব ঘোষ বেশিরভাগ সময়টা দোতলাতেই কাটান৷ লোকজনও বিশেষ আসে না তার কাছে৷ দীর্ঘদিন একা থাকতে থাকতেই হয়তো লোকাচার প্রায় ভুলেই গেছেন৷ আমি কাপড়টা আবার টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললাম, ‘আপনাকে প্রায় জোর করেই বিপদে ফেললাম৷’
‘হ্যাঁ তা একরকম ফেলেছেন বইকি৷’ তিনি ব্যাজার মুখ করে বললেন৷ দিনতিনেক যা গরম পড়েছে ভেবেছিলাম আজ রাতটা একটু মন দিয়ে লেখাপড়া করব৷ তা আর হবে না বোধহয়৷’
‘এ বাবা৷ আমি একটু পরেই চলে যাব… আর আপনি আপনার পড়াশোনা…’
‘যাবেন কোথায়?’
‘অ্যাঁ?’
‘মানে কীভাবে যাবেন? সাঁতার ছাড়া তো উপায় দেখছি না৷’
আমি আর উত্তর দিলাম না, পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে ভেজা কাপড়ের উপরে রেখে দিলাম৷ মহাদেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘বিনয় জিনিসটার কোনও সায়েন্টিফিক ভ্যালু নেই জানেন তো৷ এমনকি সাইকোলজিক্যালি যদি দেখেন…’
আমি ধীরেধীরে উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসে পড়লাম৷ বুঝলাম তিনি নিজে থেকে প্রায় কোনও ভদ্রতাই করবেন না৷ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একবার দেখে নিলাম৷ দুটো মিসড কল৷ ফোনটা যে এখনও চলছে এই আমার সৌভাগ্য৷
ঘরের ভিতরে একখানা মোমবাতি জ্বলছে৷ চতুর্দিকটা ঢেকে আছে হলুদ আলোয়৷ অথচ দোতলার সিঁড়িতে সাদা টিউবলাইটের আলো এসে পড়েছে৷ অর্থাৎ লোডশেডিং হয়নি৷ আশ্চর্য! একতলায় কি একটা বাল্বও লাগাননি ভদ্রলোক? সামনের চেয়ারটায় বসে এখনও কী যেন বলে চলেছেন তিনি, আমি এবার মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম, ‘এই সবই হল ইমোশান৷ আর ইমোশান মানেই হল মানুষের দুর্বলতা৷ এই দেখুন আপনাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে আমার মায়া হল, আমিও আপনাকে ভিতরে ডেকে নিলাম, এবার ধরুন আপনি হলেন জেলপালানো দাগি খুনে৷ আপনি আমার গলা কেটে খুন করে ঘরে যা আছে নিয়ে চম্পট দিলেন…’
আমার একবার বলতে ইচ্ছা করল যে আপনার ঘরে আছেটাই বা কী, যে নিয়ে পালাব৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়ে বললাম, ‘বুঝতে পারছি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন… আসলে আমি ভাবলাম আপনি একা থাকেন…’
‘তাই খুনটা করা সহজ হবে…’
‘এ বাবা! না না…’
‘আরে জানি জানি সব… তা দাগি আসামি নও যখন তখন তুমি কর কী?’
এতক্ষণে আমার ভিতরের অস্বস্তিটা একটু কমল৷ হেসে বললাম, ‘এই একটুআধটু লিখি-টিকি…’
‘মানে সাহিত্য! ছ্যাছ্যা… এর থেকে তো জেলপালানো আসামি হলে নিশ্চিন্ত হতাম৷’
আমি আবার থতমত খেয়ে বললাম, ‘কেন বলুন তো?’
‘কেন আবার কী? এই যে এত গাদাগুচ্ছের মানুষ ইচ্ছা হলেই গল্প, কবিতা, নাটক এইসব লিখে ফেলছে, কাগজপত্রে ছাপছে, আর লোকে সময় নষ্ট করে পড়ছে, তাতে কার কী লাভটা হচ্ছে বলতে পার?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এতে লাভ-লোকসানের কী আছে৷’
‘নেই? একটা গোটা জাতি খালি কবিতা লিখতে লিখতে ফুঁকে গেল, জগদীশ চন্দ সত্যেন বোস যাদের রক্তে তারা মুখে রং মেখে মঞ্চে উঠে নাটক করছে! নাটক৷
আমার বেশ মজা লাগল, সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘তা আপনি এসব লেখেননি কোনওদিন?’
ভদ্রলোক বিমর্ষভাবে মাথা নামালেন, ‘তা লিখেছি এককালে, কিন্তু তখন আমি নেহাতই ছোট৷ তখনও ঠিকভুলের জ্ঞান হয়নি৷’
‘তারপর?’
মহাদেব ঘোষ আমার কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু থেমে গেলেন৷ বাড়ির কোন এক প্রান্ত থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ আসছে৷ যেন বড়ো চেহারার কোনও কুকুর আর্ত স্বরে ডেকে উঠেছে৷ আশ্চর্য, এ বাড়িতে যে কুকুর আছে সে কথা তো আগে বলেননি ভদ্রলোক৷ বার দুয়েক হয়ে থেমে গেল শব্দটা৷ কেমন যেন খটকা লাগল আমার৷ মহাদেববাবুর মুখেও ধীরে ধীরে কেমন যেন একটা ভয়ের রেখা ফুটে উঠছে, সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি কুকুর পোষেন নাকি?’
‘কই… না তো… ওটা মনে হয় পাশের বাড়ির…’
‘পাশের বাড়ি! সে তো অনেকটা দূরে৷ এতদূর থেকে কুকুরের ডাক এত জোরে শোনা যাচ্ছে?’
‘কী জানি৷ বড় চেহারার কুকুর হয়তো৷’
‘আপনি আগে শোনেননি?’
‘না৷’
বেশ বুঝতে পারলাম কিছু একটা আড়াল করতে চাইছেন ভদ্রলোক৷ আমি আর বেশি উৎসাহ দেখালাম না৷ কুকুরে যে আমি খুব একটা ভয় পাই তা নয়, কিন্তু আওয়াজ শুনে যে জাতের কুকুর মনে হল তাতে তাকে সামনে দেখলে সেই সাহস কতক্ষণ থাকবে সন্দেহ৷ মহাদেব উঠে পড়লেন৷ দু-পা এগিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা জলের বোতল তুলে নিয়ে খানিকটা জল খেলেন৷ তারপর ঢাকনা আটকে বললেন, ‘তুমি ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে জানেন কিছু?’
কুকুরের ব্যাপারটাই ঘুরছিল আমার মাথায়৷ মাথা তুলে বললাম, ‘কিসের সম্পর্কে?’
‘ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণবস্তু৷’
‘নামটা শুনেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক…’
‘বোঝার চেষ্টা করনি, তাই তো?’
আমি উত্তর দিলাম না৷ ভদ্রলোক এবার একটা একপেশে হাসি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘তা না জানাটা আর দোষের কী বলুন৷ তোমার মতো মানুষদের সেকথা না জানলেও চলবে৷ অথচ আমি আমার গোটা জীবনটা ওই ডার্ক ম্যাটারের পিছনে দৌড়েই কাটিয়ে দিয়েছি৷’
‘বলেন কী! আপনি বিজ্ঞানী?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম৷
‘তা বলতে পার৷ তবে পেশাদার বিজ্ঞানী আমি নই৷ যখন যে ভূত মাথায় চাপে তখন সেটা নিয়ে আমি মেতে উঠি৷ একসময় দেদার গল্প কবিতা লিখতাম, সেটা গিয়ে জ্যোতিষচর্চার দিকে ঝুঁকলাম, কিছুদিন পড়াশোনা করতেই বুঝলাম ওসব স্রেফ গাঁজাখুরি, তবে পড়াশোনা যে একেবারে বৃথা গেল তা নয়, জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে লেখা বেশ কিছু ম্যাগাজিন তখন প্রতি সপ্তাহে আমার বাড়ি আসত৷ তাতেই একদিন ডার্ক ম্যাটার নিয়ে একটা আর্টিকেল চোখে পড়ল৷ ব্যস, আমাকেও এক নতুন ভূতে পেয়ে বসল৷ তখন বয়স কম, পয়সাকড়িরও অভাব ছিল না৷ আমি গবেষণা শুরু করলাম৷ ছোটোখাটো কিছু ইনস্টিটিউট থেকে ডাকও পড়ল৷ মোটা মাইনের চাকরি৷ যদিও এইসব আমাকে কোনওদিনই টানেনি৷ নিভৃতে বছর বারো গবেষণা করার পর একটা আস্ত পেপার লিখে ফেললাম৷’
‘বাবা! বলেন কী! তারপর?’
মহাদেব ঘোষ চেয়ারের পিছন দিকে পিঠ এলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘তারপর আমি কী করতে পারি বলে তোমার মনে হয়?’
‘যদি সত্যিকারের গবেষণাপত্র হয় তবে পিয়ার রিভিউ করিয়েছেন৷’
‘নাঃ ওইটাই আমি করাইনি৷ আমি গবেষণা করেছিলাম নিজের কৌতূহলে৷ লোক জানাজানি করে আমার কী লাভ?’
আমি অবাক হয়ে গেছিলাম৷ খানিক ভেবে নিয়ে বললাম, ‘কিন্তু গবেষণা যখন করেইছেন তখন কাগজপত্র বাইরে আনতে আপনার তো ক্ষতি কিছু নেই৷ বিশেষ করে মানুষের যদি তাতে উপকার হয়…’
‘ডার্ক ম্যাটার কি ওষুধপত্র, যে মানুষের উপকার হবে? আর আমি অত লোকজন পছন্দও করি না৷’
আমি মাথা নামিয়ে নিলাম৷ বুঝলাম লোকটার মাথায় কিছু একটা গন্ডগোল আছে, নাহলে এত কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে মাথাটা৷ ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ দুটো এখন সিলিং ফ্যানের দিকে স্থির হয়ে গেছে৷ বাইরে থেকে এখনও ক্রমাগত বৃষ্টির আওয়াজ ভেসে আসছে৷ মোমের শিখাটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে৷
‘আচ্ছা এই ডার্ক ম্যাটার জিনিসটা ঠিক কী বলুন তো?’
মহাদেব ঘোষ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ তারপর মাথা নামিয়ে বললেন, ‘যাক, এতক্ষণে একটা দরকারি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছ৷ শুনে নাও, তোমার কোনও সায়েন্স ফিকশনের গল্পে কাজে লেগে যেতে পারে৷’
কথাটা বলে উঠে পড়লেন ভদ্রলোক৷ মনে হল এতদিন পরে কেউ এই নিয়ে প্রশ্ন করায় খুশিই হয়েছেন৷ হঠাৎ আমার মনে হল আবার সেই কুকুরের ডাকটা শোনা যাচ্ছে৷ এবার আগের থেকে আরও বেশি স্পষ্ট৷ ডাকটা যে এবাড়িরই দোতলা থেকে আসছে সে ব্যাপারে এখন আর সন্দেহ নেই৷ সেটা চাপা দেওয়ার জন্যেই অনেকটা জোরগলাতেই বলতে লাগলেন ভদ্রলোক, ‘১৯৩৩ সালে ফ্রিজ টুইকি নামে এক বিজ্ঞানী কমানক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গবেষণা করছিলেন৷ বলাবাহুল্য অতদিন আগে মহাকাশ গবেষণা মুখের কথা ছিল না৷ সবথেকে বড়োকথা, বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা তখন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি নিয়ে মেতেছেন, আকাশের দিকে চোখ দেওয়ার সময় নেই কারও৷ তো এরমাঝে এই টুইকি কমানক্ষত্রপুঞ্জের ভর মাপতে গিয়ে একটা আজব ব্যাপার লক্ষ করেন৷ কোনও নক্ষত্রপুঞ্জে তারাগুলো একসাথে দলবেঁধে থাকে তাদের অভিকর্ষ বলের জন্যে৷ যে নক্ষত্রপুঞ্জে যত বেশি তারা আছে, তাদের একসাথে থাকার প্রবণতাও তত বেশি৷ তো টুইক দেখলেন কমানক্ষত্রপুঞ্জের যা ভর, তাতে তারাগুলোর কাছাকাছি থাকার কথাই নয়৷ তারাগুলোর মোট ভর যদি আরও চারশোগুণ বেশি হয় তাহলেই তারা কাছাকাছি থাকতে পারবে৷ টুইক পড়লেন চিন্তায়৷ তাহলে কি নক্ষত্রপুঞ্জের ভিতরে আরও কিছু আছে যা আমাদের দেখাশোনার বাইরে? এর উত্তর টুইক দিতে পারেননি, তবে তাঁর গবেষণা আরও কিছু বিজ্ঞানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাঁরা হিসেব করে থ হয়ে যান৷ মহাবিশ্বের যা কিছু আমরা দেখতে পাই তার পরিমাণ মাত্র ফাইভ পারসেন্ট, এবং তার পাঁচগুণেরও বেশি, অর্থাৎ টোয়েন্টিসেভেন পারসেন্ট ডার্ক ম্যাটার৷’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম৷ মহাদেব ঘোষ এখন টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার পিছনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ চোখ দেখে মনে হল দেওয়ালের গায়ে অদৃশ্য কিছু দেখার চেষ্টা করছেন৷ কুকুরের ডাকটা এতক্ষণে থেমে গেছে৷ মিনিটকয়েক নিস্তব্ধে কেটে গেল৷ আমি নড়েচড়ে বসে বললাম,
‘তো গবেষণার কাগজপত্র এখনও আপনার কাছেই আছে?’
‘হ্যাঁ৷ ফেলে তো দিতে পারি না৷’ উদাস গলায় বললেন তিনি৷ তারপর মন দিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘তুমি একটু বসো, আমি উপর থেকে আসছি৷’
মহাদেব ঘোষ সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যেতে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম৷ এতক্ষণে মিসড কলের সংখ্যা বেড়েছে৷ চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে আমি রিংব্যাক করলাম৷
‘পেলে কিছু?’
‘এখনও পাইনি, তবে আছে জানতে পেরেছি৷’
‘একতলায় নেই৷ যেভাবেই হোক দোতলায় যাবার চেষ্টা কর৷’
‘দেখছি৷ মনে হয় অসুবিধা হবে না৷’
‘খুব সাবধান৷ লোকটা যতটা সহজ মনে হয় ততটা নয়৷’
‘বুঝতে পারছি৷ মনে হয় একটা কুকুর পুষেছে৷’
‘বল কী! কাগজপত্র গার্ড দেওয়ার জন্য কুকুর!’
সিঁড়ির কাছে পায়ের আওয়াজ হতে আমি ফোনটা কেটে দিলাম৷ অনর্থক খানিক নাড়াচাড়া করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম৷ মহাদেব ঘোষ আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এতক্ষণে, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সোফায় শুয়ে ঘুম হয় তো?’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে বললাম, ‘আমার তো একতলার মেঝেতেই ভালো ঘুম হবে৷’
‘এই বৃষ্টির দিনে মেঝেতে শোয়া আর রাস্তায় শোয়া একই ব্যাপার৷ তাছাড়া ব্যাপারটা স্বাস্থ্যকরও নয়৷ উপরে আসুন৷’
আমি আর আপত্তি করলাম না৷ যেভাবেই হোক উপরে আমাকে যেতেই হবে৷ অন্তত যেঘরে তাঁর কাগজপত্র থাকে সেই ঘরটা কিছুক্ষণের জন্য দরকার আমার৷ সিঁড়িতে পা রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা আপনি বললেন একটা না একটা নেশা সবসময়ই আপনার মাথায় চেপে থাকে৷ ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আপাতত গবেষণা করছেন না মনে হয়৷ এখন তাহলে কী?’
আমার সামনে কয়েকটা ধাপ এগিয়ে গেছিলেন মহাদেব ঘোষ৷ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, ‘ট্র্যাপ৷ বা বাংলায় বললে, ফাঁদ৷’
উপরটা নিচতলার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা৷ লম্বা প্যাসেজের একদিকে লাইন দিয়ে তিনটে ঘর৷ তার প্রথম দুটো খোলা, একেবারে শেষেরটা বন্ধ৷ খোলা ঘরদুটোর মধ্যে একটা বোধহয় রান্নাঘর, আর একটা শোয়ার৷ বন্ধ ঘরটার দিকে আমি একবার তাকিয়ে নিলাম৷ বড়োসড়ো একটা তালা ঝুলছে সেটার গায়ে৷ ঘরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি বললাম, ‘হঠাৎ ফাঁদ নিয়ে এত আগ্রহ?’
‘আগ্রহ হওয়ার মতোই জিনিস৷ এককালে কত বুদ্ধি খাটিয়ে কত ভাবনাচিন্তা করে যে এইসব ফাঁদ বানানো হত তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না৷’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি দেখেছেন নাকি সেসব?’
‘কিছু দেখেছি৷ তবে বেশিরভাগই পড়ে জেনেছি৷’
‘মানে আপনি জঙ্গলেও গেছেন?’
‘কেন? জঙ্গলে যাব কেন?’
‘না মানে পশুজন্তু ধরার ফাঁদ তো জঙ্গলেই দেখা যায়৷’
মহাদেব ঘোষের মুখে কেন জানি না একটা মুচকি হাসি খেলে গেল, ঘরের দিকে এগোতে এগোতে তিনি বললেন, ‘পশুজন্তু ধরার ফাঁদে কোনও আগ্রহ নেই আমার৷ আমি মানুষ ধরার ফাঁদের কথা বলছি৷’
‘মানুষ ধরার ফাঁদ! কী রকম?’
মহাদেব ঘোষ ঘরে ঢুকে লম্বা সোফার উপর বসতে বসতে বললেন, ‘তা আছে নানারকম৷ তার মধ্যে আমার সব থেকে বেশি ভালো লাগে ফটোবম্ব ট্র্যাপ৷’
‘সেটা কী জিনিস?’
প্রশ্নটা করেই বুঝলাম আবার একটা বড়োসড়ো বক্তৃতা দিতে চলেছেন ভদ্রলোক৷ আমি চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম৷ ঘরে আসবাবপত্র বলতে প্রায় কিছু নেই৷ যে সোফার উপর বসে আছি সেটাতেই হয়তো কাটাতে হবে আজকের রাতটা৷ অন্তত যতক্ষণ না ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়ছেন ততক্ষণ এঘরেই থাকতে হবে৷ তিনি ঘুমিয়ে পড়লে শুরু হবে আমার কাজ৷ মাস্টার কি আবার সাথেই আছে৷ ফলে তালা খোলাটা অসুবিধার কিছু হবে না৷ একঘণ্টার মধ্যে কাজ হাসিল করে আর দাঁড়াব না এখানে৷ সকালে উঠে ভদ্রলোক…
‘এ ফাঁদটা তৈরি করেছিল জার্মান সেনারা৷’ ভদ্রলোক বলতে শুরু করেছেন৷ আমি সেইদিকে মন দিলাম, ‘মানে কিছু জার্মান সেনা তাদের বদরাগী অফিসারদের উপর বেজায় খাপ্পা ছিল৷ কারণে-অকারণে অফিসারদের কাছে নানাভাবে লাঞ্ছিত হত তারা৷ এদিকে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ম, করারও কিছু নেই৷ ফলে এক দল সেনা মাথা খাটিয়ে এক অদ্ভুত প্ল্যান বের করল৷ যাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না৷ যুদ্ধ চলাকালীন কিছু বড়সড় বিল্ডিং সেনাবাহিনী দখল করে রাখত৷ সেখানে দেওয়ালের গায়ে কিছু পায়াভারী অফিসারদের ছবি টাঙানো থাকত দেওয়ালে৷ তো একদল বিপ্লবী সেনা রাতের অন্ধকারে সেই ছবি সরিয়ে দেওয়ালে গর্ত করে তার তলায় বোমা ফিট করে আবার ছবি দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিত জায়গাটা৷ শুধু ঢাকা দেওয়ার সময় ছবিটা একটুখানি চোখে পড়ার মতো তেরচা করে লাগাত৷ বোমাটা এমন ভাবে ফিট করা হত যে তেরচা ছবিটা কেউ সোজা করতে গেলেই ফেটে যাবে বোমাটা৷ যাকে বলে বুবি ট্র্যাপ৷ এবার মজাটা হল সাধারণ খাপ্পা সৈন্যরা সেনা অফিসারের বাঁকানো ছবি সোজা করতে যাবে না৷ সেটা করবে একমাত্র অফিসারের বাধ্য পা চাটা মোসায়েবরা, বা অফিসার নিজে৷ আর সাথে সাথে বোমাটাও বার্স্ট করবে৷’
ঘটনাটা শুনতে শুনতে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম৷ ধীরে ধীরে বললাম, ‘অর্থাৎ অফিসার নিজের অজান্তেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনবেন৷’
‘একজ্যাক্টলি৷ আর সেটাই হল ভালো হিউম্যান ট্র্যাপের বৈশিষ্ট্য৷ তেমন আরও কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ট্র্যাপ আছে… তবে আজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে৷’
হাতদুটো দু’পাশে ছড়িয়ে মহাদেব ঘোষ উঠে পড়লেন৷ আমি মোবাইলটা বের করে একবার সময় দেখে নিলাম৷ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি৷ ঘরের পাখাটা এখন বন্ধ৷ খোলা জানলা দিয়ে আলগা বৃষ্টির ছাট এসে ঢুকছে ঘরে৷ জানলার নিচটা ভিজে রয়েছে৷ আমি মুখ তুলে বললাম, ‘ওইদিকের ঘরটা বন্ধ দেখলাম, খোলেন না নাকি?’
‘ওটা আমার লেখাপড়ার ঘর৷ দরকার না পড়লে যাই না ওঘরে৷’
‘আপনার কাগজপত্র সব ওখানেই থাকে?’
‘আমার গবেষণাপত্রের কথা বলছ?’
আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘শুধু তা কেন, সব মিলিয়েই বলেছি৷ তবে ওটা দেখতেই বেশি ইচ্ছা করছে৷’
একটু আগের সেই বিদঘুটে হাসিটা আবার হেসে ঘোষ বললেন, ‘ওসব দেখে কী লাভ তোমার? সায়েন্সের লোক হলে তাও…’
‘তা অবশ্য ঠিক৷’
আমি মাথা নামিয়ে নিতে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহাদেব ঘোষ৷ যাওয়ার আগে বলে গেলেন যে রাতে কোনও দরকার পড়লে যেন তাঁকে না ডাকি৷ একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না তার৷ আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে তেমন হল অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷
পাশের ঘর থেকে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ আসতে আমিও ভেজিয়ে দিলাম দরজাটা৷ তারপর আবার পকেট থেকে বের করলাম মোবাইল ফোনটা, নম্বরটা কল লিস্টেই ছিল, রিডায়াল করতে ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল—
‘কত দূর এগোলে?’
‘আশা করছি আজ রাতেই হয়ে যাবে৷’
‘ঘরটা দেখেছ?’
‘নাঃ৷ তবে তালা দেখে মনে হল খুলতে অসুবিধা হবে না৷’
‘সে ব্যাপারে তোমার উপর বিশ্বাস আছে আমার৷ জাস্ট বি কুইক অ্যান্ড বি কোয়াইট৷ আর হয়ে গেলে একটা ফোন কর৷’
ফোনটা কেটে দিয়ে পাশে রেখে দিলাম সেটা৷ পায়ের কাছ থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে ভিতরের জিনিসপত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ ছোট টর্চটা বের করে রাখলাম৷ অন্তত ঘণ্টাখানেক কিছু করার নেই আমার৷ ততক্ষন একচোট ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হত না৷ কিন্তু মাঝরাতে সে ঘুম না ভাঙলেই সমস্যা৷ আচ্ছা সত্যি কি গবেষণার কাগজপত্র হাতে পেলে বিজ্ঞানের কিছু লাভ হবে? ডার্ক ম্যাটার বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলে সেসব আমার ধারণার বাইরে৷ ঝড় জলের মধ্যে এতটা রিস্ক নিয়ে কাগজগুলো হাতাতে হচ্ছে খালি পয়সার লোভে৷ অবশ্য এ কাজে বিপদের আশঙ্কা কম৷ কথাটা ভাবতেই কুকুরের ডাকটার কথা মনে পড়ে গেল আমার৷ সত্যি কি ওঘরে কুকুর পুষে রেখেছেন মহাদেব ঘোষ? সাধারণ কোনও কুকুর হলে আমার ভয়ের তেমন কারণ নেই, কিন্তু কুকুরদের ঘুম খুব পাতলা৷ আমি ঘরে ঢুকলে সে যদি চেঁচামেচি শুরু করে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না৷
বেশ কিছুক্ষণ সেইভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রা এসে গেছিল, এমন সময় মোবাইলটা কেঁপে উঠতে ঘুমটা ভেঙে গেল৷ থতমত খেয়ে উঠে বসেই আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, নাঃ বেশিক্ষণ ঘুমাইনি৷ রাত দেড়টা বাজছে৷ এতক্ষনে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক৷ এখন কাঁপছে ফোনটা, আমি সেটা কানে লাগিয়ে বিরক্ত গলায় বললাম, ‘এতবার ফোন করলে অসুবিধা হয় খুব৷’
‘একটা জিনিস কনফার্ম করার জন্য ফোন করলাম৷’
‘কী জিনিস?’
‘বুড়ো আদৌ কোনও কুকুর পোষেনি৷’
‘তাহলে ডাক শুনলাম যে৷’
‘বলতে পারব না৷ কিন্তু আমাদের ইনফরমার জানাচ্ছে ও বাড়িতে কোনও কুকুর নেই৷’
‘তাহলে কী আছে?’
‘বুঝতে পারছি না৷ তবে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না৷ গো অ্যাহেড৷’
সোফা থেকে উঠে পড়ে আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে৷ পিঠে ব্যাগ নিলাম, হাতে নিলাম টর্চটা৷ তারপর বিড়ালের মতো দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ প্যাসেজটা আপাতত অন্ধকারে ঢেকে আছে৷ কোনও সাড়াশব্দ নেই৷ মহাদেব ঘোষের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ৷ তার তলা দিয়ে আলো ঢুকছে না৷ ভদ্রলোক নাকি আপাতত ফাঁদ নিয়ে মেতেছেন৷ এইরকম খ্যাপাটে লোকের মাথায় কখন যে কী খেয়াল চাপে তা আগে থেকে কেই বা জানতে পেরেছে? পকেট থেকে মাস্টার কিটা বের করে আমি ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ চাবিটা তালার ভিতর ঢোকাতেই একটু আগের শোনা সেই কুকুরের ডাকটার কথা মনে পড়ে গেল আমার৷ কুকুর যদি ওখানে নাই থাকে তাহলে আছেটা কী?
দরজার উপরে একবার কান রাখলাম আমি, নাঃ কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না৷ মনের জোরে ভর করেই চাবিটা ঘুরিয়ে দিলাম৷ খচ করে একটা শব্দ করে খুলে গেল তালাটা৷ আমি দু’সেকেন্ড দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম, পাশের ঘর অবধি যাওয়ার কথা নয় শব্দটার, তাও সাবধানের মার নেই৷ ধীরে ধীরে কাঠের দরজা ঠেলে আমি ভিতরে ঢুকে এলাম৷
ঘরের ভিতরটা বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঢেকে আছে৷ কুকুর বা বড়োজাতের কোনও প্রাণীই চোখে পড়ল না৷ জানলাটা খোলা৷ একটা কথা ভেবে কেমন যেন খটকা লাগল আমার৷ ঘরের মেঝে ভিজে নেই, অর্থাৎ বৃষ্টি হওয়ার সময় বন্ধ ছিল জানলাটা৷ ঘণ্টাখানেক হল বৃষ্টি থেমেছে৷ তারপরেই কেউ এসে জানলা খুলেছে৷ তবে কি মহাদেব ঘোষ এখনও ঘুমাননি? দরজার দিকে আর একবার তাকালাম আমি৷ আগের মতোই অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেখানে৷ ব্যাপারটা মন থেকে সরিয়ে আমি ঘরের ভিতরটা ভালো করে খুঁজতে লাগলাম৷ ছোটোখাটো দু’একটা পড়ার টেবিল চোখে পড়ছে৷ তার উপরে কিছু কাগজপত্র আছে বটে কিন্তু সেসব দরকারি কাগজ বলে মনে হল না৷ জানলার ধার ঘেঁষে দুটো কাঠের আলমারি আছে, সেগুলোর দিকেই এগিয়ে গেলাম আমি৷ আমি যা খুঁজছি সেটা এখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি৷ আলমারির দরজা ভেজানো ছিল৷ সেটা টেনে খুলতেই হতাশ হলাম৷ কিছু পুরনো জামাকাপড় ভিড় করে রাখা আছে৷ দু’একটা মেয়েদের জামাকাপড়ও রাখা আছে তার ভিতর৷ একসময় যে ভদ্রলোক সংসার করারও চেষ্টা করেছিলেন তা বোঝা যায়৷ আমি একটু হেসে পাশের আলমারিটার দিকে সরে এলাম৷ দেখে বোঝা যায় আগের থেকে এ আলমারিটা বেশ ব্যবহার করেন তিনি৷ হাতল ধরে টানতে এটাও খুলে গেল৷ অন্ধকারের ভিতরেও অবাক হয়ে দেখলাম রাশিরাশি ফাইল সাজানো আছে তার ভিতরে৷ সব মিলিয়ে অন্তত শ-দুয়েকের কম হবে না৷ নিচের দিকের ফাইলগুলোয় ধুলো পড়ে গেছে৷ তার ভিতর থেকেই একটা টেনে নিলাম আমি৷ বাইরের দড়ি খুলে ভিতরে উঁকি দিয়ে আবার হতাশ হলাম৷ কাঁচা হাতে আঁকা কিছু পোর্ট্রেট আছে সেখানে৷ নিচে আঁকিয়ের নাম সই করা আছে— এম ঘোষ৷ এই উত্তেজনার মুহূর্তেও ভারি অবাক লাগল আমার৷ এককালে সাহিত্যে করেছেন, ছবি এঁকেছেন, রীতিমতো বিজ্ঞানচর্চা করেছেন, অথচ কোনও কিছু নিয়েই বেশিদিন থেমে থাকেননি৷ ফলে একসময় গিয়ে সব কাগজপত্রই স্থান পেয়েছে এই আলামারিতে, ছবির পাশের ফাইলগুলোতে কিছু কবিতা আর সাহিত্যচর্চার নিদর্শন৷ সেগুলো আবার আগের মতো রেখে দিয়ে আমি উপরের আলমারির দিকে হাত বাড়াতে যাব এমন সময় একটা চেনা ডাক কানে আসতেই আমার বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল৷ কাঁপা কাঁপা পায়ে পিছন ঘুরে দাঁড়াতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ কী আশ্চর্য! সমস্ত ঘরে আমি ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী নেই৷ আওয়াজটা তবে আসছে কোথা থেকে?
মিনিটখানেক সেইরকম স্তম্ভিত হয়েই দাঁড়িয়েছিলাম, এমন সময় দরজার দিক থেকে আর একটা গলা ভেসে এল, ‘তুমি যা খুঁজছ তা এই ঘরে নেই৷’
সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজার গায়ে একটা ইঞ্চিতিনেক পাল্লা সরে গেছে, আমার টর্চের আলোয় মহাদেব ঘোষের মুখের মাঝখানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেখানে৷ খচ করে একটা আওয়াজ হতে বুঝলাম বাইরে থেকে ঘরের তালা বন্ধ করে দিয়েছেন ভদ্রলোক৷
‘আপনি… আপনি… ঘুমিয়ে পড়েছিলেন…’
এবার চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল, ‘শিকারের গল্প পড়নি? সেই যে গাছের নিচে টোপ দিয়ে শিকারি সারারাত মাথায় বসে অপেক্ষা করে কখন বাঘ ফাঁদে পড়বে৷’
মহাদেব ঘোষের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে৷ প্রচণ্ড অস্বস্তি শুরু হয়েছে আমার৷ টর্চ নামিয়ে নিলাম৷
‘যাই হোক, বাঘের কথায় মনে পড়ল৷ বাঘের ডাক শুনেছ কখন? কাছ থেকে?’
কথাটা শেষ হতেই ঘরের ভিতর একটা তীব্র চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল, বাঘের ডাক৷ আমি ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম— কিন্তু এতক্ষণ শব্দের উৎসটা চিনতে পেরেছি আমি৷ ঘরের ভিতরেই কোথাও লুকানো স্পিকার থেকে আসছে শব্দগুলো৷ কিন্তু সেগুলো চলছেই বা… মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, রিমোট কন্ট্রোল৷ ঘরে ঢোকামাত্র মহাদেব ঘোষের হাতে রিমোট কন্ট্রোল দেখেছিলাম, কিন্তু একতলায় একটাও টিভি দেখিনি৷
‘আসলে একটা ভাল ফাঁদের বৈশিষ্ট্য কী জান? শিকার নিজেই একটু একটু করে এগিয়ে এসে ধরা পড়বে৷ কখনও লোভে, আবার কখনও মোহে, তুমি অবশ্য আমার গবেষণা টাকার জন্য চুরি করছ না নিজের নামে চালাতে চাইছ, তা আমি জানি না৷ কিন্তু এটুকু বলতে পারি এঘরে সেসব কিছু নেই৷’
‘আপনি মিথ্যে বলছেন৷’
আমি মাথা নিচু করেই বললাম৷ কথাটা হয়তো ভাল করে খেয়াল করেননি মহাদেব ঘোষ, তিনি পাল্লায় কান রেখে বললেন, ‘কী বললে?’
‘বললাম এখন আপনি মিথ্যে বলছেন, কাগজ আপনার এঘরেই আছে৷’
‘ও, তাই নাকি? কী করে বুঝলে?’
‘আমার মন বলছে যে আলমারি পুরনো জামাকাপড় রেখেছেন তার ভিতরেই আছে কাগজগুলো৷ জামাকাপড়গুলো আপনার বিগত জীবনের স্মৃতি বহন করছে, কাগজগুলোও তাই৷ সেগুলো সাধারণ কাগজের সাথে রাখবেন বলে মনে হয় না৷’
আবার সেই চাপা হাসির শব্দটা শোনা গেল, ‘আগেই বলেছিলাম ইমোশান জিনিসটা আখেরে মানুষকে ডোবায়৷ বেশ, এত নিজের উপর বিশ্বাস যখন আজ রাতটা এই ফাঁদে আটকা পড়ে ঘরময় খুঁজে দেখ৷ যদি পাও তো সে কাগজ তোমার৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ খানিকক্ষণ পড়ে ওপাশ থেকে আবার কথা শোনা গেল, ‘আমি ভোর ঠিক সাড়ে ছ’টায় ঘুম থেকে উঠি৷ কাল সকালে উঠতে একটু দেরি হবে হয়তো৷ ঘুম ভাঙার পর আমি তোমায় দরজা খুলে দেব৷ ততক্ষণ সময় আছে তোমার হাতে৷ খুঁজে বের কর৷’
টর্চটা দরজার দিকে ফেলতে আর তাঁকে দেখতে পেলাম না আমি৷ আমাকে চ্যালেঞ্জটা করেই দরজা থেকে সরে গেছেন তিনি৷ আমি ধীরপায়ে এগিয়ে এসে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম৷ দ্রুত কতগুলো ভাবনা আসছে মাথায়৷ সবার আগে এঘরের আলোটা জ্বালা দরকার৷ বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার আছে বলে মনে হয় না৷ পকেট থেকে পেন বের করে টেবিলের উপরে রাখলাম আমি৷ তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আলমারিগুলোর দিকে…
সকালে মুরগির ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘরটা সূর্যের আলোয় ভরে গেছে৷ বলা বাহুল্য মুরগির ডাকটা আসছে লুকানো স্পিকার থেকে৷ মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম আটটা বেজেছে৷ রাতে কাজকম্ম শেষ করে পাঁচটার সময় ঘুমিয়েছি এটুকু মনে আছে৷ টেবিল থেকে উঠেই প্রথমে চোখ পড়ল আমার ব্যাগটার দিকে৷ এখনও আগের মতোই রাখা আছে সেটা৷ অর্থাৎ কারও হাত পড়েনি৷ ঘরের দরজা কিন্তু খোলা৷ ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম আমি৷ নামতেই মহাদেব ঘোষকে চোখে পড়ল৷ কাল রাতে আমি যে সোফাটায় বসেছিলাম সেটাতেই বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন৷ আমাকে দেখেই তাঁর মুখে অমায়িক হাসি খেলে গেল—
‘সকালে গেছিলাম তোমার ঘরে, ভাবলাম কাল রাতে অনেক ধকল গেছে, সকাল সকাল ডেকে লাভ নেই৷’
‘তা ধকল গেছে বটে৷ অনর্থক খুড়োর কলের পিছনে ছুটলাম৷’
আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম কিছু পাবে না৷ তোমার একগুঁয়েমি৷’
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘ও ঘরে যে কাগজগুলো নেই তা আমি কাল রাতেই বুঝেছি৷ আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো কী করেছেন সেগুলোর?’
মহাদেব ঘোষ এবার একটা করুণ হাসি হেসে বললেন, ‘সেসব অনেকদিন আগেই বিদায় করে দিয়েছি৷ কুড়ি বছর মহাকাশের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি৷ ভাবলাম যেক-টা দিন বেঁচে আছি আর ওসব নিয়ে ভাবব না৷ উলটে বাড়িতে উটকো লোক এলে তাকে থিসিসের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলতেই আনন্দ বেশি৷’
‘যেমন কাল রাতে আমাকে ফেললেন৷’
‘আমি কিন্তু ফেলিনি৷ তুমি নিজেই গিয়ে ধরা দিয়েছ৷’
‘তা বটে৷’
আমি মন দিয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম৷ ঘরের ভিতরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে৷ কাল রাতের দিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছিল৷ রাতে জানলা বন্ধ করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷
‘ভেবে দেখলাম তোমারও উদ্দেশ্য সাধু ছিল না৷ আমারও নয়, শোধবোধ হয়ে গেল, কী বল?’
আমি চা-টা শেষ করে মুখ তুলে বললাম, ‘আচ্ছা মহাদেববাবু, আপনার মতে একটা ভালো ফাঁদের বৈশিষ্ট্য কী?’
‘ওই যে কাল রাতে বললাম, শিকার নিজের ইচ্ছায় এসে ধরা দেবে৷’
‘উঁহুঁ, আমার মনে হয় একটা ভালো ফাঁদে শিকার বুঝতেও পারবে না সে ফাঁদে পড়েছে৷’
‘যাঃ, তা আবার হয় নাকি?’
‘কী জানি…’
চায়ের কাপটা রেখে আমি উঠে পড়লাম৷ ব্যাগটা দু’কাঁধে নিতে নিতে বললাম, ‘আজ চলি তাহলে৷’
‘হ্যাঁ সেই ভালো৷ নিজের উপরেই বিশ্বাস হয় না আমার৷ কখন কী ফাঁদে ফেলে দিই৷’
আমি একগাল হেসে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ রাস্তাটা গোড়ালি অবধি জলে ঢেকে আছে৷ চলতে গেলে ছপছপ করে আওয়াজ হচ্ছে৷ পাশ দিয়ে মাঝেমধ্যে দু-একটা সাইকেল জল কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই জলের ঢেউ এসে লাগছে আমার পায়ে৷ সেইভাবে খানিকটা এগোতে মনে হল মোবাইলটা কেঁপে উঠছে৷ সেটা কোনমতে পকেট থেকে বের করে দেখলাম ফোন আসছে৷ রিসিভ করে বললাম—
‘বলুন৷’
‘পেলে ওগুলো?’
আমি চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে নিচু গলায় বললাম’—
‘হুম, পেয়েছি৷’
‘জানতাম, তোমাকে কাজ দেওয়া মানে করেই ছাড়বে৷ কত পাতা?’
‘শ-দুয়েক হবে৷ কাল সারারাত টুকতে গিয়ে আমার হাত এখনও অবশ হয়ে আছে৷
‘কী নিয়ে লেখা?’
‘মেনলি সামাজিক৷ তার মধ্যে প্রেম, চাওয়া-পাওয়া, সম্পর্কের টানাটানি এইসবও আছে৷ এটুকু বলতে পারি আপনার কাটতি কম হবে না৷
‘সে আর বলতে৷ মহাদেব ঘোষের উপন্যাস বলে কথা৷ পুজোসংখ্যাটা জমে যাবে৷’
‘সে জমান৷ আমি আধঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি, টাকাটা রেডি রাখুন৷’
ফোনটা রেখে দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম আমি৷ তারপর আবার জল কাটিয়ে হাঁটতে লাগলাম…