ফাঁদ
“মাটিড্ডাকের অপিশ খুইজছেন?”
“হ্যাঁ।”
“এই সমোনে সিটি কলেজ। সিটি কলেজ পার হইয়ি গিয়ে খাড়া পুবে কটা হাড়োয়ারের দুকান দ্যখপেন। ওই হাড়োয়ারের দুকান গুনার ভেতর দিই এটা গলি গ্যাছে। ঐ গলি দি গিইয়ে এট্টা পুরনোন বাড়ি পাবেন। বাড়ির নিচে দ্যখপেন এটা চাদ্দুকান আছে। শরীফের চাদ্দুকান। ঐটেই মাট্টিজ্জাকের অপিশ।”
পান বিড়ির বুড়ো দোকানদার খুব কষ্ট করে থেমে থেমে কথাগুলো বলল। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত পরিপাটি ভদ্রলোকটি খুব কষ্ট করে কথা গুলো বুঝলেন। তারপর চোখের রিমলেস চশমাটা বামহাত দিয়ে ঠিক করে গলি ধরে সামনে হাঁটতে লাগলেন। চিপা গলি। লোকজনের ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে হচ্ছে ভদ্রলোককে। হাতে ধরা ফোল্ডার ব্যাগটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি।
এদিকে বেশির ভাগই টাইলস, ফিটিংস আর হার্ডওয়ারের দোকান। সকাল আটটাতেই এত ব্যস্ততা! মাথায় করে শ্রমিকেরা বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। এই চিপা গলির ভেতরে ঠেলাগাড়িও ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। এলোমেলো কোলাহল। গালাগালি। লোহা কাটার শব্দ। পুরো গলিটা পার হতে ভদ্রলোকের অনেক বেশী সময় লাগল।
গলি থেকে বেরিয়েই বড় রাস্তা পড়ল। সিটি কলেজের সাইন বোর্ড দেখা গেল। খাড়া পূর্ব দিকে হাঁটতে হল না। কয়েকটা হার্ডওয়ারের দোকান এমনিই চোখে পড়ল। সেই দোকানগুলোর পাশে একটা সরু গলি। গলি দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে মেইন রাস্তার কোলাহল চাপা পড়ে গেল। কয়েকটা পুরনো বাড়ি দেখতে পেলেন ভদ্রলোক। ভাঙা চোরা। একটা বাড়ির দোতলার ঝুল বারান্দা দেখে মনে হল যেন যেকোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। বাড়িগুলোর ওপাশে আগাছা ঘেরা একটা ডোবা।
একটা চায়ের দোকান দেখা গেল ঠিকই। কিন্তু সেটা বন্ধ। ওটাই শরীফ টি স্টল কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু, তার আর প্রয়োজন ছিল না।
দৈনিক মাটির ডাক লেখা মরচে পড়া সাইনবোর্ডটা কোনরকমে ঝুলে থাকতে দেখা গেল বন্ধ চায়ের দোকানের ছাপড়ার ওপরে। ভদ্রলোক টি-স্টলের পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। খোলা দরজা দিয়ে রোদ কিছুদূর গিয়ে আর এগোতে পারেনি। তাই ভেতরটা বেশ অন্ধকার। ঢোকার ঘরেই দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। স্যাঁতস্যাঁতে একটা গন্ধ সারা ঘরে। ভদ্রলোক টেবিলে টোকা দিয়ে বললেন, “কেউ আছেন?” প্রশ্নটা অন্ধকার রুমের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হল। টেবিলের ওপারে একটা দরজা অবশ্য দেখা যাচ্ছে। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন না। বাইরের ঘরে দাঁড়িয়ে আবার ডাকলেন।”কেউ আছেন?”
কিছুক্ষণ পরে ভেতর থেকে চিকন গলায় কে যেন বলল, “কে?”
“একটু বাইরে আসবেন প্লিজ? কিছু কথা ছিল।”
দরজার ওপাশের অন্ধকার থেকে এক ক্ষীণকায় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। চোখে মোটা ফ্রেমের পুরু কাঁচের চশমা। মাথাভরা কোঁকড়া চুল। ভদ্রলোক বললেন, “আমি একটু পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা বলতে চাই।”
লোকটা টেবিলের ওপারের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন, “বসেন।” ভদ্রলোক টেবিলের এপারের একটা চেয়ার টেনে বসলেন। লোকটা বললেন, “আমিই এই পত্রিকার সম্পাদক জয়ন্ত মল্লিক।”
ভদ্রলোক বাম হাত দিয়ে রিমলেস চশমাটা আরেকবার ঠিক করে নিলেন। তারপর করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলেন ডান হাত। মুচকি হেসে বললেন, “আমি শাকিল মাহমুদ। পেশায় একজন উকিল। একটা ল’ফার্ম খুলেছি এই কয়েক মাস হল। এই যে আমার কার্ড। আজকে আপনার পত্রিকায় ছাপা একটা খবরের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
জয়ন্ত মল্লিক করমর্দন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “বলেন?”
“আপনি একাই এই পত্রিকা চালান নাকি?”
“না। একা একটা পত্রিকা চালানো যায়? আরও কয়েকজন আছে। ওরা দুপুরের পরে আসে।”
“যাই হোক, যে জন্য এসেছি। তারাগাছিতে যে লাশটা কাল পাওয়া গিয়েছে সেই ব্যাপারে একটু কথা বলতাম।”
জয়ন্ত মল্লিকের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পরে বললেন, “ঐ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।”
শাকিল মাহমুদ মুখের হাসি না সরিয়েই বললেন, “আপনাকে বেশি কিছু বলতে হবে না, শুধু বলেন লাশটার বিরুদ্ধে যে দুটো মামলা হয়েছে সে দুটো মামলা কারা করেছে।”
“সেটাও বলতে আমি বাধ্য নই। আপনি থানায় যোগাযোগ করতে পারেন। পত্রিকা অফিসে কোন মামলা করা হয় না।”
“আমি জানি এখানে কোন মামলা করা হয় না। কিন্তু যদি মামলার ব্যাপারে একটু বলতেন, আমার মত নবীন আইনজীবীর অনেক বেশি উপকার হত।”
“আমি তো সংবাদ ছাপাই। উপকার অপকার কোনটা করার দায়িত্ব তো আমি নিয়ে রাখিনি ভাই।”
“তারমানে আপনি একটা সংবাদ ঠিক না ভুল সেটা যাচাই বাছাই না করেই সংবাদ ছাপান মল্লিক বাবু?”
“আমি কি সেটা বলেছি?
“এই যে বললেন আপনি শুধু সংবাদ ছাপান। এখন একটা সংবাদ সত্যি না মিথ্যা এইটা আপনি বিচার করবেন না!
“আপনার কি ধারণা এই সংবাদটা ভুয়া?”
আইনজীবী ভদ্রলোক এই কথার উত্তরে কিছুই বললেন না। আস্তে আস্তে শিকার ফাঁদে পা দিচ্ছে। এখন শুধু ধৈর্য্য ধরতে হবে। ভদ্রলোক দুই ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, “যদি ভুয়া নাই হত, তাহলে আপনি আমাকে মামলার ব্যাপারে বলতেন। আমি তো বেশি কিছু জানতে চাইনি ভাই।”
জয়ন্ত মল্লিক নিরুত্তর। উভয় পক্ষেই নীরবতা। আইনজীবী ভদ্রলোক এবার কণ্ঠটা সামান্য নামিয়ে বললেন, “আমি তো সাংবাদিক ফোরামেও যেতে পারতাম। পারতাম না? বলেন তো মল্লিক বাবু? ভুল সংবাদ ছাপার শাস্তি কি তা তো আপনি জানেন? পেনাল কোডে সাত বছরের কারাবাস।”
মল্লিক বাবু আইনজীবী ভদ্রলোকের ঠোঁটে শীতল হাসি দেখতে পেলেন। উত্তুরে বাতাস বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। মল্লিক বাবু ঢোঁক গিললেন। মাথা নিচু করে বললেন, “প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য মাঝে মাঝে এইরকম সংবাদ ছাপা দোষের কিছু না। মাঝে মাঝে এই রকম সংবাদ অনেকেই ছাপে। যেন অহেতুক কৌতূহল তৈরি না হয়।”
আইনজীবী ভদ্রলোকের এটুকুই জানার ছিল। উনি ব্যাগ থেকে একটা ছোট ভয়েস রেকর্ডারের সুইচ অফ করতে করতে বললেন, “এখন বলেন কার আদেশে এই সংবাদটা ছেপেছেন? আপনার কথাগুলো এই ক্যাসেটে বন্দী হয়ে আছে। শুধু বলবেন সংবাদটা কে ছাপতে বলেছে। ব্যস, তারপর আপনার ছুটি।”
একটু পরে জয়ন্ত মল্লিককে নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে মেজর রঞ্জন শাকিল মাহমুদকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিল। লোকটার জন্যই এত সহজে কাজটা করা গেল। এই চশমা ও ব্যাগ সব উনারই দেওয়া। জোর জবরদস্তি করে কিছুই হয় না, হলেও অস্থায়ী।
জয়ন্ত মল্লিককে নিয়ে থানায় গেল রঞ্জন। ওসি খাইরুল ইসলাম থানায় নেই। হাসপাতালে আছেন। ল্যান্ডরোভার ছুটল হাসপাতালে।
ল্যান্ডরোভারটা যখন হাসপাতালের দিকে ছুটছে ঠিক সেই সময়েই হোটেল সুকর্ণের ৩০৫ নাম্বার রুমে ফিরোজ বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। রঞ্জন তার চাবির ব্যাগটার সাথে ওই চাবিটাও নিয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে চাবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হত, চাবিটা আসলেই সে চেনে কিনা। রঞ্জনকে দুবার ফোনও করেছেন ফিরোজ। তার ফোন সুইচড অফ।
কিছুক্ষণ পরে হোটেল বয় নক করল। মেজর জেনারেল ফিরোজ দরজা খুলতেই হোটেল বয় বলল, “আপা বারাইছেন।”