1 of 2

ফাঁদ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ফাঁদ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রাত অনেক হলে বাগানের দিক থেকে ক্রাঁও ক্রাঁও করে একটা পেঁচা ডেকে ওঠে। মল্লিকদের কুকুরটা সন্দিগ্ধভাবে দু-একবার ডেকেই সপ্রশ্ন চুপ করে যায়। আমি জানি, এইবার তার আসার সময় হয়েছে।

আমাদের বাড়িটা বেশ বড়। লোকজন তত কিছু নেই। ওপরে-নিচে চারটে করে আটটা ঘর। নিচের দুটো ঘরে থাকেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় আর তাদের মেয়ে শ্রাবন্তী। একটা ঘরে পুরনো আসবাবের আবর্জনা। বাকিটাতে বাড়ির সাবেক আমলের চাকর ষষ্ঠীদাস। তার বয়সও প্রায় সত্তর হয়ে এল। সারারাত খকখক করে কাশে আর একটু শব্দ হলেই ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, যাঃ! যাঃ! আমি জানি, কাকে সে এমন করে তাড়াতে চায়।

ওপরের চারটে ঘরে আমার জীবনযাত্রা। আমার আর শ্রুতির। শ্রুতি বড় ঘুমকাতুরে। সে কিছু টের পায় না। এই যে আমি কাকে এত রাতে দরজা খুলে দিই, কার সঙ্গে কথা বলি, কিছু না। আমার আদরের ভেতর শ্রুতি কখন গভীর ঘুমে এলিয়ে যায়। তার শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস শুনতে শুনতে হঠাৎ চমক ভাঙে প্রাকৃতিক সংকেতের মতো পেঁচার চিৎকার। তারপর বাগানের দিকে শনশন করে ওঠে বাতাস। গাছপালা দুলতে থাকে। পুরনো জানলাটা খটখট করে শব্দ করে। তারপর সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ। সে আসছে উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠি। সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ। সে ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

দরজা খুলে আমি একটু সরে দাঁড়াই। টের পাই তার ঘরে ঢোকা তার শরীরের গন্ধ। গন্ধটা ছেঁড়া ঘাসের মত কিংবা ভিজে মাটির মত, অথবা পাখির বাসার মত ঈষৎ ঝঝাল, সঠিক বলা কঠিন, কারণ তার গন্ধটা যেন খুবই প্রাকৃতিক। হয়তো সে প্রকৃতির খুব ভেতর দিকে চলে গেছে বলেই। জীবজগতের অবচেনায় এই গন্ধ থাকে কি? বুঝতে পারি না। তার অশরীরী শরীরের কোন গন্ধ থাকার কথা নয়। তাকে প্রশ্ন করলে সে বলে তাই বুঝি? জানি না তো।

তাকে বলি, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।

সে বলে, আমি তো এরকমই।

না। তুমি এরকম ছিলে না।

সে একটু হাসে। তা ঠিক। ছিলাম না।

কেমন ছিলে সে তো মনে পড়ে তোমার, নাকি পড়ে না?

বোকা। মনে না পড়লে এলাম কেন?

তাহলে তুমি নিজেকে দেখাও। আমারও তো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।

তুমি ভয় পাবে।

তোমাকে আমি ভয় পাব না স্মৃতি! তুমি আমারই অপরাংশ হয়েছিলে একসময়।

একটু পরে সে বলে, পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে।

তাহলে থাক।

বরং চলো আমরা বাগানে যাই।…

আমরা বাগানে গিয়ে বসে থাকি। কথা বলি। পুরনো সব কথা…অতীত থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে। দুঃখের কথা। সুখের কথা। কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই ষষ্ঠীদাসের ডাক শুনতে পাই। সে লণ্ঠন হাতে আমাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে। আসে। সে বড় ধূর্ত মানুষ। সব টের পায়। আমাকে বকাবকি করে। বলে, ঘুম হয় না তো ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন? এমনি করে হিমে বসে থাকলে যে উন্টে অসুখে পড়বে।…

হতচ্ছাড়া ষষ্ঠীদাসের দৌরাত্ম্যে অবশেষে বাগানে গিয়ে কথা বলা ছাড়তে হল। কিন্তু বুঝতে পারলাম, কেন স্মৃতি ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে চাইত না। শ্রুতিকে ও ঈর্ষা করত। ঘুমন্ত শ্রুতির পাশে গিয়ে দাঁড়ালে আমার খুব ভয় হত। বলতাম, ওখানে কী করছ? এখানে এস। শ্রুতি জেগে যেতে পারে।

জাগলেও তো আমাকে দেখতে পাবে না।

কে জানে। মেয়েরা হয়তো সব টের পায়।

সে হাসত। হুঁ, পায়ই তো! তুমি যখন শ্রুতিকে আদর কর, দূর থেকে টের পাই। মনে হয়, আমার যদি শরীর থাকত!

ওকে মেরে ফেলতে তো?

হুঁ।

এখন পার না?

না।…একটু পরে বলল ফের, আমি আর কিছু পারি না। শুধু যাওয়া আসা ছাড়া। মনে হল, ও কাঁদছে। বললাম, ওকে ঈর্ষা কোর না। ও তোমারই সহোদরা।

শোনো!

বলো।

তুমি কাকে বেশি ভালবাস এখন…শ্রুতিকে না আমাকে?

দুজনকেই।

মিথ্যা! আমি তোমার চারঘরের সংসার ঘুরে দেখেছি, এখন যা-যা যেমন হয়ে আছে, আমার সময়ে তেমন কিছুই ছিল না। ওই ড্রেসিং টেবিলটা পর্যন্ত নতুন! আর শ্রুতির কত শাড়ি! কত বিদেশি সেন্ট! কত…।

শ্ৰতি একটু বিলাসী প্রকৃতির মেয়ে। আর তুমি জান, তুমি ছিলে সাদাসিধে। সাজতে ভালবাসতে না। টাকাকড়ি খরচ করতে দিতে না। মনে পড়ে, সেবার তোমার জন্য অত সুন্দর একখানা কাঞ্জিভরম কিনে আনলাম! তুমি শ্রুতিকে পরতে দিলে। আর একবার…।

হঠাৎ থেমে গেলাম। টের পেলাম। ও নেই। চলে গেছে। এখনকার মত মাথা ভাঙলেও আর ফিরে আসবে না। কোথায় যায় ও? জীবজগতের সীমানা পেরিয়ে প্রকৃতির কোন গভীরতর স্তরে গিয়ে বসে থাকে ও? আমি যদি ওকে অনুসরণ করে যেতে পারতাম সেখানে!…

একরাতে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি থামল না। মধ্যরাতে একটু কমল মাত্র। তারপর তার আসার সংকেত শুনতে পেলাম বাগানের দিকে। দরজা খুলে দিলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।

সেই মুহূর্তে শ্রুতি জেগে গেল। চমকে ওঠা গলায় বলল, কোথায় গেলে? এই তো! অন্ধকারে দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছ?

সে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিল। ভারি হাতে দরজা আটকে দিয়ে বললাম, বৃষ্টি দেখতে যাচ্ছিলাম বারান্দায়।

শ্রুতি একটু চুপ করে থাকার পর বলল, জানলা থেকে দেখা যায় না?

ছাঁট আসছে যে!

তোমার কী হয়েছে?

কই, কিছু না।

আমার ধারণা, তুমি সারারাত জেগে থাক।

যাঃ! কে বলল?

আমি জান। তুমি…তোমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না আমার পাশে? শ্রুতি স্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে বলল, কতবার হাত বাড়িয়ে তোমাকে খুঁজি পাই না।

আশ্চর্য! আমি তো তোমার পাশেই থাকি!

শ্রুতি বালিশে মুখ গুঁজে বলল, কোথায় থাক তুমিই জান।

ওর কাছে এসে পিঠে হাত রেখে বললাম, ঘুমোও।

তুমি?

আমার ঘুম পাচ্ছে না। আর বৃষ্টিটা কী সুন্দর—শোন!

আমি জানি, কেন ঘুম হয় না তোমার। দিদির কথা মনে পড়ে তো?

হঠাৎ ওকথা কেন শ্রুতি?

 হাসতে হাসতে বললাম, ছিঃ! যে মরে গেছে তাকে ঈর্ষা করতে আছে?

কে মরে গেছে? দিদি মরে নি। দিব্যি বেঁচে আছে। পাগল! কী সব বলছ শ্রুতি?

শ্রুতি ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বলল, বেঁচে নেই—তোমার মনে? ষষ্ঠীদা বলে, তুমি রাতে বাগানে গিয়ে বসে থাক—কেন আমি যেতে দিই এমন করে? কেন বাগানে যাও তুমি? বল!

ঘুম আসে না।

এত ভাবলে ঘুম তো আসবেই না। শ্রুতি আবার পাশ ফিরে শুল। ফের আস্তে করে বলল, আরও অনেক কথা জানি। বলব না।

কী জানে, সে কিছুতেই বলল না। কিছুক্ষণ সাধাসাধি করে ছেড়ে দিলাম। মনে হচ্ছিল শ্রুতি কেঁদে ফেলবে—অথবা এক নেপথ্যের কান্না ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে। অবশ্য খুব শক্ত মেয়ে সে, জানি। স্মৃতির একেবারে উল্টো। সে প্রচণ্ড সাহসী। বেপরোয়া। স্পষ্টভাষী মেয়ে। কিন্তু স্মৃতির মতো জেদি নয়।

পরের রাতে আমার উৎকণ্ঠা ছিল স্মৃতির আসা না টের পেয়ে যায় সে! এ রাতে বৃষ্টি ছিল না। নরম চেহারার একটুকরো চাঁদ ছিল বাগানের মাথায়। পোকামাকড় ডাকছিল বৃষ্টির স্মৃতি নিয়ে। ফিকে জ্যোৎস্নায় ভিজে গাছপালা আর ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে রাতের ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল ঘরে। ভাবছিলাম, কাল রাতে ফিরে গেছে অমন বাধা পেয়ে, আজ কি করে আসবে স্মৃতি?

এল—কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নয়। জানালার ওধারে দাঁড়িয়ে বলল, এসেছি।

এ রাতে কোন প্রাকৃতিক সংকেত শুনলাম না। কোন পূর্বাভাষ না। মল্লিকদের কুকুরটাও বুঝি অগাধ ঘুমে লীন। বললাম, ভেতরে আসছ না কেন?

একটা কথা বলতে এলাম শুধু।

কী কথা?

আমি আর আসব না।

জানালার রড শক্ত করে ধরে বললাম, না। তোমাকে আসতেই হবে—আমি যতদিন বেঁচে আছি। আমার রাতগুলো তোমার জন্যেই রেখেছি, আর দিনগুলোকে শ্রুতির জন্য।

সে একটু হাসল। তুমি বড়লোক মানুষ। তোমার কত খেয়াল!

না, না। খেয়াল নয়। এমনটা হয়ে গেছে–তুমি বুঝতে চেষ্টা কর লক্ষ্মীটি! চিরকাল আমার বরাতটাই এরকম। কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে না আমার। আরও দেখ, আমার সব বাস্তব আর কল্পনাও আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। ওরা দুটো দিকে, মধ্যিখানে আমি। টাগ অফ ওয়ারের নিষ্ঠুর খেলা।

ওসব কথা আমার মাথায় ঢোকে না, আমি যাই!

শোন, শোন! একটা কথা বলে যাও।

কী?

তুমি কেন আর আসবে না? শ্রুতির জন্যই কি?

শ্রুতির জীবন আমার মত নষ্ট হয়ে যাক, তা চাইনে। আমি তার দিদি।

শোন, শ্রুতির বদলে তোমাকেই চাই।

এমনি করে একদিন আমার বদলে শ্রুতিকে চেয়েছিলে, মনে পড়ে? কী? চুপ করে গেলে যে?

আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা কর।

দেখ আমি যেখানে আছি, সেখানে ক্ষমা বা অনুতাপ বলে কোন কথা নেই। তোমার মনে পড়ে? ওই খাটে আমি শুয়েছিলাম। আমার শ্বাসকষ্ট। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। তখন তুমি আর শ্রুতি পাশের ঘরে ছিলে। একটু পরে শ্রুতি এল। ওকে দেখেই চমকে উঠলাম। তার শরীরে তোমার ছাপ পড়েছিল। জলের গ্লাস তার হাতে কাঁপছিল।

তুমি ধাক্কা মেরে গ্লাসটা ফেলে দিলে। শব্দ শুনে দৌড়ে এলাম…

জানালায় কী করছ?

শ্রুতির চমকে ওঠা প্রশ্নে আমিও খুব চমকে উঠলাম। সে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় উঠে বসল। তীব্র দৃষ্টিতে আমরা দিকে তাকিয়ে বলল, আবার তুমি জেগে আছ?

ঘুম আসছে না। দেখ, অদ্ভুত জ্যোৎস্না উঠেছে।

শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে বলল, তুমি চাও, আমিও দিদির মত মরে যাই, তাই না?

আঃ কী বলছ শ্রুতি!

তুমি বুঝি ভাবছ আমি কিছু টের পাই না? শ্রাবন্তীর দিকে এবার তোমার চোখ পড়েছে।

ছিঃ! চুপ কর।

শ্রুতি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। না—চুপ করব না। তুমি চাইছ, আমিও দিদির মত সুইসাইড করি, আর তুমি শ্রাবন্তীকে বিয়ে কর।

তি! চুপ কর। কী বলছ তুমি? স্মৃতি সুইসাইড করেনি।

করেছিল। আমি জানি। শ্রুতি নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বরে বলল। ক্যাপসুলটা খেয়ে রিঅ্যাকশান হচ্ছিল, ডাক্তার সেটা বন্ধ করতে বলেছিলেন। দিদির বালিশের তলায় কৌটোটা দেখেছিলাম। কৌটোটা খালি ছিল।

আশ্চর্য। তুমি বলনি! কেন বলনি শ্রুতি?

তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। শ্রুতি মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল।

তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে সে শুয়ে পড়ল। টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে দিল। জানলার বাইরে বাগানের দিকে জ্যোৎস্নার ভেতর কুয়াশার মত কী একটা দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতিই কি? শ্রুতিকে ডাকলাম, শ্রুতি, শোন!

কী?

শ্রাবন্তীর কথা তোমার মাথায় এল কেন? তার সঙ্গে তো আমার দেখাও হয়। তেমন কিছু আলাপও নেই। তাছাড়া সে তো তোমার কাছেও আসে না।

বাইরে কী হয় তুমিই জান। সারাদিন কোথায় থাক, কী কর, আমি কি দেখতে যাই?

শ্রুতি, ফুড রিলিফের কাজে আমাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয় আজকাল। অন্যকিছুতে মন দেবার সময় কোথায়?

তুমি লিডার মানুষ। তোমার মনে কত দয়া। এমনি করে সেবার ফ্লাডের সময় তুমি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলে। তখন বুঝিনি, এই বাড়িটা তোমার একটা ফাঁদ।

ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, ঠিক আছে। ওদের চলে যেতে বলব। ওদের এরিয়া থেকে মারে জল নেমে গেছে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে শ্রুতি! নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কাল রাতে তুমি বললে, স্মৃতিকে ভুলতে পারিনি। আজ রতে বলছ, শ্রাবন্তীর জন্য…

কথা কেড়ে শ্রুতি বলল, তাই ভেবেছিলাম। পরে মনে হয়েছিল, যে মরে গেছে–গর পেছনে কেন তুমি ছুটবে? যে বেঁচে আছে রক্তমাংসের শরীরে, তার পেছনে ছোটাই স্বাভাবিক। নয়? বল তুমি।

কিন্তু তুমি তো আছ! তুমি তো জীবিত।

আমি বাসি হয়ে গেছি। দিদিও তোমার কাছে বাসি হয়ে গিয়েছিল। তাই তুমি আমার পেছনে ছুটেছিলে। কিন্তু জেনে রাখ, আমি দিদির মত বোকা নই।

তর্ক করে লাভ নেই। ফেমিনিন লজিক। আমি চুপ করে থাকলাম। শ্রুতিও চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রতি আমাকে বাধা দিল না।

বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কতক্ষণ। স্মৃতি কি আর কোনদিন আসবে না কথা বলতে? জ্যোৎস্নায় হেমন্তের গাঢ় কুয়াশা জড়ানো। ঘুম জড়ানো গলায় খুব গভীর থেকে পোকামাকড় গান গাইছে। সামনে শীত—তখন ওরা আরও গভীরে দীর্ঘ ঘুমের দিকে যাবে। কোথায় সেই প্রাকৃতিক অভ্যন্তর-জঠরের উষ্ণতা যেখানে বাইরের পৃথিবীর হিমকে পৌঁছতে দেয় না? সেখানে কি স্মৃতিও ঘুমোতে চলে গেল জীবজগতের অবচেতনায়?

আমার কষ্টটা বাড়ছিল। স্মৃতিকে আমি ভালবাসতাম। শ্রুতিকেও হয়তো ভালবাসি—চেষ্টা করি। পেরে উঠি না। খালি মনে হয়, শ্রুতি আমার জন্য নয়, আমার সংসারের জন্য। একটি প্রয়োজনীয় ফিলার শ্রুতি। আর স্মৃতি ছিল আমার জন্য—আমার সংসারের বাইরে একটি নিজস্বতার প্রতীক। স্মৃতি, কেন গেলে?

যাই নি। সে ফিসফিস করে বলল। এই তো আছি!

কিন্তু কোথায় আছ? আগের মত কাছে আসছ না কেন?

পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছি ক্রমশ। নিজেকে কুড়িয়ে জড়ো করা যাচ্ছে না।

মনে হল, চারদিকে ঘাস, গাছপালা, পোকামাকড়, শিশির, কৃষ্ণপক্ষের জ্যোৎস্না আর কুয়াশার ভেতর থেকে স্মৃতির শ্বাসপ্রশ্বাস জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। সে বলছে, আমি আছি। আমি আছি।

আর চারপাশ থেকে আবছা এক গন্ধ ঘেঁড়া ঘাসের পাতা অথবা শেকড়ের, বৃষ্টিভেজা মাটির, জলের, পাখিদের বাসার গন্ধের মতো কটু স্মৃতির দ্বিতীয় জীবনের গন্ধ। প্রকৃতির নিজস্ব গন্ধ।

লণ্ঠনের আলো ফুটে উঠল। দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছিল। ষষ্ঠীদাসের ডাকাডাকি শুনতে পাচ্ছিলাম। সে সব টের পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *