ফাঁকি – রাজকুমার মৈত্র
পথ চলতে চলতে লোকটা থমকে দাঁড়াল।
‘অলেস্টারের’ পকেট হাতড়ে বের করল সিগারেট প্যাকেট।
একটা সিগারেট মুখে গিয়ে লোকটা এদিক—ওদিক তাকিয়ে সিগারেট প্যাকেট—টা অলেস্টারের পকেটে রেখে দিয়ে দেশলাই বের করল।
এক হাতে লোকটা কি করে দেশলাইটা জ্বালাবে লক্ষ করছিল জুবিলি সার্কাসের ‘জোকার’ হারাণ দত্ত।
লোকটা অনায়াসে একহাতে দেশলাই জ্বালাল দেখে হারাণ দত্ত এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল। লোকটা সিগারেট ধরাতে পাশ থেকে হারাণ দত্ত বলে উঠল, আগুন প্লিজ।
লোকটা চমকে হারাণ দত্তর দিকে ফিরতে একমুখ হেসে সে বললে, চিনতে পার?
হারাণ—? লোকটার চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে।
হারাণ হো হো করে হেসে উঠল : আমি ভূত নই হে। একেবারে জলজ্যান্ত হারাণ দত্ত। এসো এসো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটবো না। কতদিন পর দেখা বলো তো? কোথায় রেঙ্গুন আর কোথায় কলকাতা—
হারাণ লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে চায়ের দোকানে চুকল। চায়ের অর্ডার দিয়ে সে বললে, বাস থেকে তোমায় দেখতে পেয়ে নেবে পড়লাম।
লোকটা মৃদু হাসল। হারাণ জিজ্ঞাসা করল, তোমার ডান হাতটা খোয়ালে কী করে!
—ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে।
চু—চু—চু, মুখে একটা শব্দ করে হারাণ বললে সহজ ভাবে, অ্যাক্সিডেন্টেই যে তোমার মৃত্যু হবে এটা সবাই জানত, কিন্তু জগন্নাথ হবে সেটা কেউ ভাবেনি। কী করছ আজকাল?
—কিচ্ছু না।
—চলছে কি করে?
—চলছে না!
—ও। হারাণ গম্ভীর হল।
বয় চা দিয়ে গেল। হারাণ গরম পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। এবার লোকটা প্রশ্ন করল, তুমি রেঙ্গুন থেকে কবে এলে?
—প্রায় মাস চারেক হবে। চাকলাদার সাহেবকে মনে আছে? সেই যে, রেঙ্গুনে ‘বার্মিজ সার্কাসের’ খেলোয়াড় মহীতোষ চাকলাদার?
নামটা শুনে লোকটার চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠল। একটা উত্তেজনার রেশ তার মুখটাকে কঠিন করে তুলল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, নাম শুনেছি!
হারাণ দত্ত উৎসাহ পেয়ে বলতে লাগল, ওই চাকলাদার সাহেব আমায় টেনে নিয়ে এস। আরে লোকটাকে যত ভালো বলে মনে হয়েছিল ঠিক তা নয়। ব্যাটা আস্ত ঘুঘু। নিজের মেয়ের নামে একটা সার্কাস খুলছে। বেছে বেছে লোক নিচ্ছে। কিন্তু মাইনের নামে ঢুঁ ঢুঁ। যদি রোজগার হয় তবে বোনাস দেবে, মাইনে দেবে। মানে রামরাজত্ব, উইদআউট সীতা। হারাণ হেসে উঠল।
লোকটার মুখে—চোখে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যায়। হারাণ সেটা বুঝতে পারে না। তার পিঠ চাপড়ে বললে, বাই দি বাই চাকলাদার সাহেব একজন পাক্কা ম্যানেজার খুঁজছেন।
—তাই নাকি? লোকটা আগ্রহ দেখাল।
হারাণ দত্ত লাফিয়ে উঠল—দি আইডিয়া। তোমাকে পেলে নিশ্চয় বুড়োটা খুশি হবে। চলো চলো এখনই তোমাকে নিয়ে যাব। হাসতে হাসতে লোকটার পিঠ চাপড়ে সে বললে, তুমি সার্কাসকে ভুলে গেলেও সার্কাস তোমায় ভুলতে পারে না ব্রাদার। ডান হাতটা যমরাজকে ঘুষ দিয়ে ভালোই করেছ। অনেককাল জ্বালাবে। ওঠো ওঠো।
লোকটা হারাণের কথামতো উঠে দাঁড়াল।
চাকলাদার সাহেব লোকটাকে দেখে সত্যিই খুশি হলেন। তার পিঠ চাপড়ে বললেন, তোমার নাম কে না জানে রাখেশ। তুমি সার্কাস জগতে একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ছিলে। তোমার মতো ‘ট্রাপিজের’ খেলা আজকাল আর কেউ দেখাতে পারে না। ইউ আর গড সেন্ড। ঠিক তোমার মতোই একজন লোক আমার দরকার। আশা করি আমার পার্টিতে তোমার থাকতে কোনো আপত্তি হবে না।
লোকট অর্থাৎ রাখেশ সরকার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
মহাখুশি হয়ে মহীতোষ চাকলাদার রাখেশ সরকারকে জুবিলি সার্কাসের ম্যানেজারের পদে বহাল করে নিলেন।
চাকলাদার সাহেবের হোটেল থেকে বেরিয়ে রাখেশ যখন পথে নামল তখন কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেছে। বাঁ হাতে অলেস্টারের কলারটা তুলে দিয়ে সে বড় বড় পা ফেলে এগোয়। সঙ্গে চলল হারাণ দত্ত। পথ চলতে চলতে হারাণ বললে, চাকলাদার সাহেবকে সাধেই কি ঘুঘু বলেছি, কেমন তোমায় বাগিয়ে নিল দেখলে তো?
লোকটা কোনো উত্তর দিল না।
চাকলাদার সাহেব বিপত্নীক।
একমাত্র মেয়ে জুবিলি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই। জুবিলির যখন মাত্র আট বছর বয়স সেই সময় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। দেখতে দেখতে এগারোটা বছর কেটে গেল। জুবিলির এখন বয়স উনিশ। মায়ের রূপ আর বাপের সাহস নিয়ে সে বড় হয়ে উঠেছে। চাকলাদার সাহেব নিজের হাতে তাকে গড়ে তুলেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন সার্কাসের প্রতিটি মনোরম খেলা।
এক—কালে চাকলাদার সাহেবও নামকরা ‘ট্রাপিজ’ খেলোয়াড় ছিলেন।
জুবিলি গেছে সিনেমা দেখতে। ফিরতে রাত হবে।
চাকলাদার সাহেব ভাবেন তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। তিন বন্ধুতে তাঁরা বেরিয়েছিলেন ভাগ্যান্বেষে, বর্মায়।
সে আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা—
মহীতোষ চাকলাদার, অবনীশ সরকার আর পরিতোষ লাহা। এই তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান ছিলেন অবনীশ সরকার। কারণ, বর্মাতে গিয়ে সে—ই সর্বাগ্রে কাজ পেল ‘ন্যাশনাল সার্কাস পার্টিতে’। অবনীশের গর্ব ছিল তার স্বাস্থ্য। গ্রিসিয়াসি দেবতার মতো সুগঠিত ছিল তার অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ। তাই বুঝি প্রথম দর্শনেই ন্যাশনাল সার্কাস পার্টির মালিক প্রবাসী বাঙালি সদানন্দ হালদার খুশি হয়ে তাকে কাজ দিলেন। শুধু তাই নয়, অল্পদিনের মধ্যে অবনীশ সরকার ন্যাশনাল সার্কাসের নামকরা ‘ট্রাপিজ’ খেলোয়াড় হয়ে উঠল। সদানন্দ হালদারের একমাত্র কন্যাসন্তান রূপসী হীরা অবনীশকে গোপনে পত্র দিয়ে জানাল যে সে তাকে বিবাহ করতে চায়। অবনীশ রাজি হল পরিতোষ লাহা ও চাকলাদার সাহেবের কথামতো। কথাটা সদানন্দবাবুর কানে উঠল। তিনি মহা আনন্দে অবনীশের সঙ্গে হীরার বিবাহ দিলেন। অবনীশ সরকার ন্যাশনাল সার্কাসের অন্যতম মালিক হল।
এরপর অবনীশের কথামতো চাকলাদার সাহেব ও পরিতোষ লাহা কাজ পেল ন্যাশনাল সার্কাস পার্টিতে।
তিন বন্ধুতে ক্রমশ নামকরা খেলোয়াড় হয়ে উঠলো। চারিদিকে তাদের নামডাক ছড়িয়ে পড়ল।
এইভাবে মহাসুখে পাঁচ—সাত বছর কেটে গেল। তিন বন্ধুকেই সদানন্দবাবু ভালোবাসতেন নিজের পুত্রের মতো। ইতিমধ্যে অবনীশ দুই পুত্রসন্তানের জনক হল। পরিতোষ দুই ছেলের নামকরণ করল—যুবরাজ ও সেনা। সুখের সংসার অবনীশের। স্ত্রী হীরার স্বামী—পুত্র নিয়ে গর্বের সীমা নেই।
কিন্তু হীরার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। পরিতোষের হিংসা তার জীবনে টেনে দিল পূর্ণচ্ছেদ।
চাকলাদার সাহেব সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি। আজ অনুশোচনায় তাঁর অন্তর হাহাকার করে ওঠে। আজকের এই অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি, সবই যেন তাঁর বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। তাঁর মনে হয় যেন একটা বুকচাপা কান্না তিনি অহরহ শুনতে পান। যেন মাটির নীচে থেকে কান্নাটা ভেসে আসে। কান্নাটা অতি পরিচিত…..অতি আপন জনের…..
সামান্য একটা মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্যে সব ছারখার হয়ে গেল। অবনীশ ছিল ট্রাপিজের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। আর তিনি এবং পরিতোষ ছিলেন অবনীশের পরেই। তাঁরা দুজনেই অবনীশের সঙ্গে পেরে উঠতেন না। এ ছাড়া অবনীশ হতে যাচ্ছিল ন্যাশনাল সার্কাসের মালিক। এই দুই কারণেই পরিতোষ অবনীশকে সহ্য করতে পারত না।
একদিন কথায় কথায় পরিতোষ অবনীশকে বলে বসল যে তাদের দু’জনকে ন্যাশনাল সার্কাসের পার্টনার করে নিতে। অবনীশ হেসে বললে, কথাটা আমাকে বলে লাভ নেই। সদানন্দবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে হীরা। কথাটা হীরাকে বলা উচিত।
এ কথার পর পরিতোষ মুখে কিছু বলেনি বটে কিন্তু অন্তরে জ্বলে পুড়ে গিয়েছিল।
কথাটা কিন্তু চাপা রইল না। সদানন্দবাবুর কানে উঠল। রাগে তিনি ফেটে পড়লেন। পরিতোষকে ডেকে তার মুখের ওপর স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে ন্যাশনাল সার্কাস পার্টির পার্টনার হওয়ার স্বপ্ন যেন সে না দেখে। মাইনে করা লোক হিসেবে থাকতে যদি তার মন না চায় তবে আনায়াসে চলে যেতে পারে।
লজ্জায় অপমানে পরিতোষ সেদিন দুমড়ে গিয়েছিল। অবশ্য এতটা অবনীশ আশা করেনি। সে ভেবেছিল হয়তো বা সদানন্দবাবু পরিতোষের মাইনে বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হল।
ন্যাশনাল সার্কাস ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার সাহস ছিল না পরিতোষের। কারণ সদানন্দবাবু ছিলেন সর্বজনবিদিত এবং এত বেশি মাইনে আর কেউ দিতে পারে না। অগত্যা অপমান সহ্য করেও পরিতোষ চুপ করে রইল। কিন্তু প্রতিহিংসা নেবার জন্য সর্বদা সজাগ হয়ে রইল।
একদিন খেলা তখন শেষ হয়ে এসেছে। সদানন্দবাবু নিজের কেবিনে বসে মদ খাচ্ছেন। পরিতোষ সাবধানে শিকারি বিড়ালের মতো কেবিনে প্রবেশ করে দেখল তিনি বেহুঁশ। এই সুযোগে পরিতোষ চোখের পলকে মদের গ্লাসে ‘পটাসিয়াম সাইনাইড’ মিশিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলো।
চাকলাদার সাহেব ছিলেন একমাত্র সাক্ষী। কিন্তু পরিতোষের প্ররোচনায় তিনি বিচারকের সামনে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি অনায়াসে বললেন যে তিনি অবনীশকে সদানন্দবাবুর মদের গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিতে দেখেছেন। উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বললেন যে, সদানন্দবাবু ও অবনীশের মধ্যে দু’দিন আগে প্রচণ্ড ঝগড়া হয় সার্কাস পার্টির পার্টনারশিপ নিয়ে। সদানন্দবাবু রাগে অবনীশকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি তাঁর মেয়ে হীরার মুখ চেয়ে।
পরিতোষ ওই এক কথা বললে।
বিচারে অবনীশের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। হীরার গর্ব হল খর্ব। লজ্জায়, ঘৃণায় সে আত্মহত্যা করল দিন—চারেক পরে। পরিতোষ এই সুযোগ খুঁজছিল। যুবরাজ আর সেনাকে ফাঁকি দিয়ে ন্যাশনাল সার্কাসের মালিক হল। নামটা বদলে নামকরণ করল ‘বার্মিজ সার্কাস’। যুবরাজ আর সেনা যে কোথায় গেল, তাদের কী হল কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
মাঝে মাঝে জুবিলির দিকে তাকিয়ে সেই ছোট্ট শিশু দু’টির কথা আজও মনে পড়ে চাকলাদার সাহেবের। মনটা বড় দুর্বল হয়ে যায়। সে সময় তিনি পরিতোষকে কত অনুনয়—বিনয় করেছিলেন। অন্তত ছেলে দু’টির খাওয়া—পরার যেন অভাব না হয়।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। পরিতোষ কিছুতেই রাজি হল না।…..
এই ঘটনার পরও পাঁচ বছর কেটে গেল। চাকলাদার সাহেব পরিতোষ লাহার সঙ্গ ছাড়েননি। শেষে পরিতোষ নিজেই আলাদা হয়ে গেল। চাকলাদার সাহেবকে সে ফাঁকি দেয়নি। কিছু টাকা দিয়ে এক বার্মিজ ভদ্রলোকের কাছে সার্কাসটা বিক্রি করে টাকাপয়সা নিয়ে ফিরে আসে ভারতবর্ষে। চাকলাদার সাহেব বার্মিজ সার্কাসে চাকরি করতে লাগলেন, একজন সাধারণ খেলোয়াড় হিসাবে।
দেখতে দেখতে আরও বিশটা বছর কেটে গেল। চাকলাদার সাহেব দেশে ফিরে এলেন। বর্মাতেই তিনি বিবাহ করেছিলেন এক প্রবাসী বাঙালির মেয়েকে। আজ স্ত্রী নেই, কিন্তু জুবিলি আছে। আর আছে প্রচুর অর্থ। দেশে ফিরে জুবিলি গোঁ ধরে বসল সার্কাস পার্টি খুলবে। মেয়ের আব্দার রক্ষা করতে গিয়েই এই জুবিলি সার্কাসের পত্তন।
রাত্রি দশটায় জুবিলি ফিরে চাকলাদার সাহেবকে একটা খবর দিল যে, বার্মিজ সার্কাসের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় সোমরাজ ভারতবর্ষে আসছে। খবরটা চাকলাদার সাহেবকে খুশি করতে পারল না। কারণ তিনি বেশ ভালো করেই জানেন যে, জুবিলি আর সোমরাজের মধ্যে একটা মেলামেশা রেঙ্গুনে থাকতেই গড়ে উঠেছিল। সোমরাজ জুবিলিকে বিবাহ করবে বলে প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু জুবিলি তখন সম্মত হয়নি চাকলাদার সাহেবের কথামতো। সোমরাজ ভালো খেলোয়াড় হতে পারে কিন্তু বদমেজাজি। কাউকে সে শ্রদ্ধা করতে পারে না। এমনকি চাকলাদার সাহেবকেও সে শ্রদ্ধা করত না। স্পষ্ট মুখের ওপর ‘বুড়ো শয়তান’ বলে গালাগালি দিত। যাই হোক, সেই সোমরাজের নামটা শুনে চাকলাদার সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে সেটা প্রকাশ না করে বললেন, দেখ মা, এটা বাংলাদেশ, এখানে খেলা দেখাবার মতো লোকের অভাব হবে না! তা ছাড়া আমি আজ এমন একজনের দেখা পেয়েছি যে, সোমরাজের চেয়ে শতগুণে ভালো খেলোয়াড় ছিল এককালে।
—কার দেখা পেয়েছ বাবা? প্রশ্ন করল জুবিলি।
—রাখেশ সরকার। এই তো বছর চারেক আগেও রেঙ্গুনে রাখেশের খেলা দেখে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে এক সার্কাস পার্টির সঙ্গে রাখেশ রেঙ্গুনে গিয়েছিল মনে নেই!
জুবিলি রাখেশের নাম বহুবার শুনেছে। রেঙ্গুনে থাকতে খেলাও দেখেছে। সেই রাখেশ….!
চোখদুটো কপালে তুলে জুবিলি বললে, সত্যি বলছ বাবা, রাখেশবাবুর দেখা তুমি পেয়েছ?
চাকলাদার সাহেব খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ মা। তাকে আমি জুবিলি সার্কাসের ম্যানেজার করে নিয়েছি। সে একাই একশো। তার ডান হাতটা ‘অ্যাক্সিডেন্টে’ নষ্ট হয়ে গেলেও অনায়াসে খেলোয়াড় তৈরি করে নিতে পারবে।
জুবিলি খুশি হল।
সেই রাত্রে রাখেশ যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত বারোটা। পার্ক সার্কাসে একটা অপরিসর গলির মধ্যে সে থাকে। ঘরের অবস্থা দেখে সহজেই মনে হয় রাখেশ হারাণ দত্তকে মিথ্যা বলেনি। কোনোরকমে তার দিন চলে। ঘরের জানলা—দরজা বন্ধ করে সে লাইট জ্বালল। তারপর গায়ের অলেস্টার খুলে ফেলল। তারপর শার্ট—আশ্চর্য, দেখা গেল, রাখেশের ডান হাতটার কিছুই হয়নি। কেবল হাতটা বাহুর সঙ্গে আষ্টে—পৃষ্ঠে বাঁধা। বাঁধনটা খুলে ডান হাতটা বাঁ হাতে ‘ম্যাসেজ’ করতে করতে আপন মনে সে হেসে উঠল।
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল পরপর তিনটে ছবি। একটি পুরুষ ও একটি নারীর, আর ঠিক তার পাশেই ছোট দুটি শিশুর ছবি। রাখেশ ছবিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল হাসতে হাসতে। ক্রমশ তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। চোখ দুটোয় ফুটে উঠল নেকড়ের ক্ষুধিত দৃষ্টি। দাঁতের ওপর দাঁত ঘষে সে বিড়বিড় করে বললে, তোমরা রেখে গেছ আমাকে শুধু প্রতিশোধ নেবার জন্যে। প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। পরিতোষ লাহা মরেছে। এবার মহীতোষ চাকলাদারের পালা।
রাখেশ পুনরায় হেসে উঠল। হাসতে হাসতে ডান হাতটা সামনে মেলে ধরতে দেখা গেল তার ডান হাতে ছ’টি আঙুল। সেই অস্বাভাবিক আঙুলটায় হাত বুলোতে বুলোতে সে ছবিগুলোকে লক্ষ করে বললে, এই একমাত্র প্রমাণ। আর কোনো প্রমাণ আমি ফেলে আসিনি। আর কোনো প্রমাণ নেই।
আপন মনে রাখেশ হাসতে লাগল।
পরের দিন চাকলাদার সাহেব রাখেশকে ‘জুবিলি সার্কাসের’ ম্যানেজার পদে বহাল করে নিলেন। রাখেশের হাতে টাকা এলো।
জুবিলিকে দেখে রাখেশ সহসা চোখ ফেরাতে পারল না। সত্যি সে সুন্দরী। শুধু তাই নয় তার মিষ্টি ব্যবহারে রাখেশ মোহিত হল। জুবিলি সেদিন রাখেশকে না খাইয়ে ছাড়ল না। খেতে বসে রাখেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার তার সোমরাজের কথাটা মনে হতে লাগল। কোথায় যেন দুজনের মিল আছে। একসময় সে জিজ্ঞাসা করল, সোমরাজকে চেনে কিনা?
রাখেশ অসম্মতি জানাল।
জুবিলির প্রশ্ন শুনে চাকলাদার সাহেব বললেন, সোমরাজের সঙ্গে তোমার চেহারার কিছুটা মিল আছে কিনা।
রাখেশের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা দিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল—সোমরাজ কি বাঙালি?
—না—না মোটেই বাঙালি নয়। খাস বার্মিজ। তবে অনেকটা বাঙালির মতো দেখতে। হয়তো ওর ঠাকুমা বা ঠাকুরদা বাঙালি ছিল।
চাকলাদার সাহেব যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন। রাখেশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার কোনো ভাই—টাই নেই?
—না, আমার আর কেউ নেই।
রাখেশ মুখ নীচু করে খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর চাকলাদার সহেব পুনরায় বলতে লাগলেন, যেবার তুমি রেঙ্গুনে খেলা দেখাতে গিয়েছিলে সেবার তোমার ‘ট্রাপিজের’ খেলা দেখে আমার বারবার একজনের কথা মনে হচ্ছিল। ঠিক তোমারই মতো সে খেলা দেখাত, অবিকল তোমার মতো।
জুবিলি লাফিয়ে উঠল, বুঝেছি, তোমার সেই বন্ধু অবনীশ সরকারের কথা বলছো তো?
—হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস মা, অবনীশ। অবিকল অবনীশের মতো লাগছিল রাখেশকে।
রাখেশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। তার চোয়াল দুটো বারবার দৃঢ় হয়ে উঠতে লাগল। মনে হয় যেন সে এখনই গর্জন করে উঠবে। জুবিলি হঠাৎ প্রশ্ন করল,—ওকি রাখেশবাবু, এই শীতে আপনি ঘামছেন কেন? অলেস্টারটা খুলে ফেলুন না?
—না—না গরম কোথায়? কিছু দরকার নেই। রাখেশ অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিল।
জুবিলি বকবক করতে লাগল, বাবার ‘স্টকে’ অনেক গল্প আছে। শুনতে এত ভালো লাগে! বল না বাবা, তোমাদের তিন বন্ধুর কথা। তুমি, অবনীশ কাকা আর পরিতোষ কাকা কেমন করে বড় হলে?
চাকলাদার সাহেবের মুখটা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, সে একদিন গেছে। সেদিনের কথাগুলো আজ মনে হলে নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, তিন বন্ধুর মধ্যে কেবল আমিই বেঁচে আছি। এই সেদিন পরিতোষ মারা গেল। তার যে অস্বাভাবিক মৃত্যু হবে সেটা জানতুম। হয়তো এরপর আমার পালা।
হঠাৎ চাকলাদার সাহেব টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন অন্য ঘরে। একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। চাকলাদার সাহেব যে হঠাৎ এতখানি মুষড়ে পড়বেন জুবিলি আশা করেনি। রাখেশের আর খেতে ভালো লাগছে না। জুবিলি সেটা বুঝতে পেরে আবহাওয়াটাকে হাল্কা করবার জন্যে বললে, বাবা ওঁর বন্ধুদের ভীষণ ভালোবাসতেন কিনা তাই পরিতোষ কাকার মৃত্যুটা তিনি সহ্য করতে পারেন না। রাখেশ কোনো উত্তর দিল না। জুবিলি বলতে লাগল, জানেন, পরিতোষ কাকাকে একটা লোক গলা টিপে খুন করেছে। পুলিশের ধারণা যে লোকটা পরিতোষ কাকাকে খুন করেছে তার হাতে ছ—টা আঙুল আছে।
রাখেশ চমকে উঠল।
জুবিলি বললে, বাবার ধারণা, অবনীশ কাকার বড় ছেলে যুবরাজই পরিতোষ কাকাকে খুন করেছে। কারণ তার ডান হাতে নাকি ছ—টা আঙুল আছে। জুবিলি ঠোঁট উলটিয়ে আবার বললে, কী জানি বাবা, আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। অবনীশ কাকার ছেলেরা কখনই বেঁচে নেই। থাকলে নিশ্চয়ই দেখতে পেতুম। বাবার যত বাজে চিন্তা। জানেন, বাবা কেন সোমরাজকে সহ্য করতে পারেন না। তাঁর ধারণা সোমরাজ বোধহয় অবনীশ কাকার ছেলে।
রাখেশ আবার চমকে উঠল। তার বাঁ হাতের মুস্টি দৃঢ় হয়ে উঠল। জুবিলি হাসতে হাসতে বললে, কিন্তু বাবার ধারণা একেবারেই মিথ্যে। আমি সোমরাজের মাকে দেখেছি, খাঁটি বার্মিজ মহিলা।
রাখেশ কিছুটা আশ্বস্ত হল, কিন্তু মানসিক উত্তেজনা কমল না। জিজ্ঞাসা করল,—সোমরাজের মা আপনাকে কিছু বলেছিলেন নাকি তার সম্বন্ধে?
—হ্যাঁ, বলেছিলেন বৈকি। সোমরাজের জন্ম সিঙ্গাপুরে। ওর বাবা জাহাজের খালাসি।
—ও। রাখেশের উত্তেজনা কমে গেল। জুবিলি আব্দারের সুরে বললে, আমাকে ‘ট্রাপিজের’ খেলা শিখিয়ে দিতে হবে।
—আচ্ছা। রাখেশ সম্মতি জানাল।
জুবিলি রাখেশকে নিয়ে হাওড়া ময়দানে এলো। অনেকখানি স্থান জুড়ে তাঁবু পড়েছে। রাখেশ লক্ষ করল সার্কাসের সমস্ত কিছুই জোগাড় হয়েছে। কোনো কিছুরই অভাব নেই। তাঁবুর ভেতর খেলোয়াড়েরা সকলেই অনুশীলন করতে ব্যস্ত। জুবিলি ও রাখেশকে দেখে হারাণ দত্ত হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো, বললে, ম্যানেজার সাহেব প্রথম দিনই ‘লেট’।
রাখেশ হেসে উত্তর দিল, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।
হারাণ হো হো করে হেসে উঠল।
জুবিলি পোশাক পরিবর্তন করতে চলে গেল।
হারাণ জুবিলির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে একবুক নিশ্বাস নিয়ে বললে, আহা এমন রত্নের যদি মামা হতে পারতুম গো। যাকগে, এসো তোমার সঙ্গে খেলোয়াড়দের আলাপ করিয়ে দিই।
হারাণ দত্ত সকলকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললে, সেই বিখ্যাত খেলোয়াড় রাখেশ সরকার আজ জুবিলি সার্কাসের ম্যানেজার হয়ে এসেছেন।
—থ্রি চিয়ার্স ফর কমরেড রাখেশ, হিপ হিপ হুররে।
সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
এরপর আবার অনুশীলন আরম্ভ হল।
রাখেশ লক্ষ করল জুবিলি প্রায় সমস্ত খেলাই জানে। তার দেহ—সৌষ্ঠব সত্যিই সুন্দর। রাখেশের দৃষ্টি মুগ্ধ হল। জুবিলির পর অন্যান্য সকলে অনুশীলন করে দেখাল।
রাখেশ অনেকের ভুল শুধরে দিতে লাগল। চাকলাদার সাহেব একপাশে দাঁড়িয়ে রাখেশকে লক্ষ করছিলেন। একসময় আপন মনে তিনি বলে উঠলেন, আজ যদি পরিতোষ বেঁচে থাকতো তবে সেও ভুল করত। আশ্চর্য, আশ্চর্য মিল দুজনের মধ্যে।
জুবিলি চাকলাদার সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার কানে কথাটা যেতে সে বললে, একদিন সোমরাজকে দেখেও তোমার ওই কথা মনে হয়েছিল বাবা। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না বাবা, অবনীশ কাকার ছেলেদের তোমার এত ভয় কেন?
—সে তুই বুঝবিনে মা, সে তুই বুঝবিনে।
চাকলাদার সাহেব যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন।
চাকলাদার সাহেব সত্যিই যেন কেমন হয়ে গেছেন।
পরিতোষ লাহার মৃত্যু তাঁর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। রাত্রে দরজা—জানলা খুলে শুতে তাঁর ভয় করে। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে তিনি চিৎকার করে ওঠেন। ভাবেন, কে যেন তাঁর টুঁটি টিপে ধরেছে। দম আটকে আসে। চিৎকার শুনে জুবিলি ছুটে আসে পাশের ঘর থেকে। দেখে, ভয়ে চাকলাদার সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ছাইয়ের মতো। ঠক ঠক করে কাঁপছেন। জুবিলি প্রশ্ন করে, কিন্তু কোনো কথা বলতে তাঁর সাহস হয় না। পাছে জুবিলি তাঁকে ঘৃণা করে। মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তিনি একজনের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন চিরকালের মতো। সদানন্দের হত্যাকারীকে তিনি সাহায্য করেছেন। এত বড় অন্যায়, এত বড় পাপকে জুবিলি হয়তো কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু আর যে তিনি না বলে পারছেন না। তাঁর মনের ওপর পাপটা যেন দিনকে দিন চেপে বসছে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করে ওঠেন। জুবিলিকে চলে যেতে বললেন, পাছে এক অসতর্ক মুহূর্তে সকল কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। হয়তো জুবিলি রাখেশকে বলে দেবে। রাখেশ পুলিশে খবর দেবে।
কথাটা মনে হতেই চাকলাদার সাহেবের গলা—বুক শুকিয়ে যায়। ওই রাখেশই কি অবনীশের ছেলে যুবরাজ! যুবরাজের ডান হাতে ছ—টা আঙুল আছে। পরিতোষের গলায় যে হাতের ছাপ পুলিশ আবিষ্কার করেছে সে হাতেও ছ—টা আঙুল আছে। অন্তত পুলিশ রিপোর্ট তাই বলে। যে রাত্রে পরিতোষকে হত্যা করা হয় তার পরের দিনই পুলিশ এসেছিল তাঁর কাছে। যদি কোনো হদিশ চাকলাদার সাহেব দিতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনো হদিশ দিতে পারলেন না। তবে পুলিশ যখন বললে যে হত্যাকারীর ডান হাতে ছ—টি আঙুল আছে তখন তিনি চমকে উঠলেন। ধাঁ করে তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা মনে পড়ে গেল। অবনীশের যখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তখন তার বড় ছেলে যুবরাজের বয়স সাত বছর। সেই যুবরাজের ডান হাতে ছ—টি আঙুল আছে। আর তার পক্ষে পরিতোষকে হত্যা করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশের শত প্রশ্নের পরেও তিনি যুবরাজের নামটা বলতে পারলেন না। তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল, যেভাবে যুবরাজ প্রতিশোধ নিয়েছে সেটা তার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় নয়। তিনি হলেও এইভাবে শত্রুনিপাত করতেন। তবু….? নিশ্চিন্ত হতে পারেননি চাকলাদার সাহেব। যুবরাজ তাঁকেও হত্যা করবে। তিনিও কম অপরাধী নন।
আবার রাখেশের কথাটা মনে পড়ে গেল। রাখেশের ডান হাতটা নেই। অতএব আঙুলের প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং রাখেশ যুবরাজ নয়, হতে পারে না। কিন্তু….এরপরেও চাকলাদার সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে। রাখেশ অলেস্টারটা ভুলেও খুলতে চায় না কেন?
জুবিলি সার্কাসের অনুশীলন শেষ হল।
এইবার শো আরম্ভ হবে। রাখেশের পরিচালনায় দলটি বেশ সুগঠিত হয়েছে। জুবিলি ট্রাপিজের খেলা অনেকটা আয়ত্ত করেছে। যদিও এখনও তাকে অনুশীলন করতে হবে। তবু সে গোঁ ধরে বসল যে প্রথম দিন প্রথম শোতে সে খেলা দেখাবে। চাকলাদার সাহেব প্রমাদ গুনলেন। কিন্তু রাখেশ তাঁকে অভয় দিল। জুবিলির কোনো বিপদ হবে না।
প্রথম শোতে জুবিলি ‘ট্রাপিজের’ খেলা দেখাতে লাগল।
চাকলাদার সাহেব নিজের কেবিনে বসে রইলেন ভয়ে। আর প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন যে—কোনো দুঃসংবাদের জন্যে।
জুবিলি ট্রাপিজের খেলা দেখাচ্ছে। রুদ্ধনিশ্বাসে জনতা তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক একটা খেলা শেষ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে জনতা করতালি দিচ্ছে।
একপাশে দাঁড়িয়ে জুবিলির খেলা দেখছিল রাখেশ। সে চাকলাদার সাহেবের কেবিনের দিকে চলল সকলের অলক্ষে।
রাখেশকে দেখে চাকলাদার সাহেব চমকে ওঠেন : তুমি?
মৃদু হেসে রাখেশ বললে, জুবিলি বেশ ভালোই খেলা দেখাচ্ছে।
—তুমি চলে এলে কেন?
—আপনাকে ডাকতে।
—না—না রাখেশ, আমি যাব না। আমার ভয় করে!
—ভয়, কীসের ভয়?
—অ্যাঁ, না—না কিছু না। আমাকে একটু জল দাও তো?
চাকলাদার সাহেব ভয়ে যেন কুঁকড়ে গেছেন। রাখেশ জল আনবার জন্যে কেবিনের বাইরে গেল।
কেবিনের বাইরে জলের কুঁজোটা রয়েছে। গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে রাখেশের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। এই সুযোগ….কেউ জানবে না। সবাই জুবিলির খেলা দেখছে। এই সুযোগ। গ্লাসসুদ্ধ হাতটা কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি গ্লাসটা রেখে অলেস্টারের পকেট থেকে বের করল একটা ছোট্ট শিশি। মুখটা তার বীভৎস হয়ে উঠল। শিশির মুখটা খুলে গ্লাসে ঢালতে গিয়েও পারল না সে। তার হাতটা ভয়ানক কাঁপছে। কী হল কে জানে? কে যেন আসছে। রাখেশ তাড়াতাড়ি শিশিটা পকেটে রেখে দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল।
চাকলাদার সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, জল আনতে এত দেরি? রাখেশ মৃদু হেসে উত্তর দিল, দুটো হাত থাকলে দেরি নিশ্চয় হত না। চাকলাদার সাহেব লজ্জিত হলেন। রাখেশের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে গিয়েও পারলেন না। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রাখেশকে জুবিলির খেলা দেখতে যেতে বললেন। মৃদু হেসে রাখেশ চলে গেল। চাকলাদার সাহেব তাঁর প্রিয় কুকুরটার সামনে কিছুটা জল ফেলে দিলেন। কুকুরটা জল খেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চাকলাদার সাহেব জল খেলেন।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন চলে গেল।
জুবিলি সার্কাস আজ এখানে, কাল সেখানে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। প্রচুর অর্থ উপার্জন হয়।
চাকলাদার সাহেবের ভয় অনেকটা কমে গেছে। এখন তাঁর ধারণা হয়েছে যে হয়তো বা পরিতোষকে অন্য কেউ হত্যা করেছে। অন্তত অবনীশের ছেলেরা নয়। ভয়টা তাঁর অহেতুক।
ভয়টা কমে গেল কিন্তু চাকলাদার সাহেবের অর্থের প্রতি লোভটা বেড়ে গেল। প্রথমটা তিনি বলেছিলেন, জুবিলি সার্কাসের অর্থাগম যত বাড়বে খেলোয়াড়রা তত বেশি বোনাস পাবে। কিন্তু আজ তাঁর মনে হচ্ছে খেলোয়াড়রা নিজেদের পারিশ্রমিক হিসাবে তাঁর কাছ থেকে বেশি দাবি করছে। প্রায়ই তিনি কথাটা রাখেশকে বলতে লাগলেন। শুধু তাই নয় জুবিলিকে একদিন বলে বসলেন যে রাখেশের প্রয়োজন নেই। তিনিই ম্যানেজারের পদটা ‘ম্যানেজ’ করতে পারবেন। জুবিলি প্রবল আপত্তি করল, বললে, রাখেশ চলে গেলে চাকলাদার সাহেবের পক্ষে সার্কাস চালানো সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি খেলোয়াড় রাখেশকে দেবতার মতো ভক্তি করে।
কথাটা ঠিক।
জুবিলি সার্কাসের প্রতিটি খেলোয়াড় রাখেশকে দেবতার মতো ভক্তি করে। অবশ্য এরও একটা কারণ আছে। রাখেশ প্রতিটি খেলোয়াড়ের সুখ—সুবিধা যে ভাবে দেখে এতে ভক্তি আসাটা খুবই স্বাভাবিক। কার মাইনে কম, অথচ বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে কারণ ছেলের অসুখ। মনমরা হয়ে খেলোয়াড়টি জন্তু—জানোয়ারের খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। রাখেশ দেখতে পেয়ে খেলোয়াড়টিকে কাছে ডেকে অনেক অনুনয়— বিনয় করে যখন জানতে পারল ঘটনাটা, তখন রাগে ফেটে পড়ল। হতভাগা, আমাকে বলিসনি কেন? আমি কি মরে গিয়েছি! কাঁদলে কি টাকা আসবে! এই নে টাকা, এখুনি পাঠিয়ে দে। একগোছা টাকা খেলোয়াড়টির হাতে গুঁজে দিতে সে অঝোরে কিছুক্ষণ কেঁদে বললে, রাখেশদা তাহলে বোধহয় বউটাও বাঁচত। বিনা চিকিৎসায় বউটা অ্যানেমিয়ায় মারা গেল।
এই কথা শুনে রাখেশও না কেঁদে পারেনি। সারারাত সেদিন সে ঘুমোতে পারল না। নিজের কেবিনে পায়চারি করেছে।
জুবিলিও সেই রাত্রে ঘুমোতে পারেনি।
কথাটা তার কানেও গিয়েছিল। জোকার হারাণ দত্ত তাকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললে, রাখেশ সত্যিই মহৎ নইলে নিজের মাইনের সমস্ত টাকাটা হুট বলতেই কি দিয়ে দিতে পারত। লজ্জায় জুবিলি এতটুকু হয়ে গেল। নিজেকে বড় ছোট মনে হল। তার নামেই সার্কাস। সে নিজেই মালিক। খেলোয়াড়দের সুখ—দুঃখটা তারই দেখা উচিত। কিন্তু সে বা তার বাবা চাকলাদার সাহেব খেলোয়াড়দের কোনো খোঁজখবরই রাখেন না। এই সুযোগে রাখেশ তার মহত্ত্ব প্রকাশ করার সুযোগ নিল। জুবিলি কিছুতেই পারল না। মাঝরাতে যখন দেখল রাখেশের কেবিনের আলোটা জ্বলছে তখন সে ড্রয়ার থেকে একগোছা টাকা নিয়ে রাখেশের কেবিনে গেল।
কেবিনের দরজায় টোকা পড়ল। রাখেশ চমকে উঠল, কে?
—আমি জুবিলি। দরজা খুলুন।
—কী দরকার?
—আগে দরজা খুলুন।
—মাপ করবেন এত রাত্রে দরজা খুলতে পারব না। যা বলার কাল সকালে বলবেন। রাখেশ কিছুতেই দরজা খুলতে চাইল না। সে যে কেন দরজা খুলতে চায় না তা একমাত্র সেই জানে। তার ডান হাতটা সারাদিনের মধ্যে রাত্রিতেই বিশ্রাম পায়। জুবিলি ফিরে গেল মর্মাহত হয়ে। সন্দেহ যে হয়নি তা নয়। কেন রাখেশ দরজা খুলল না। অনেকবার শুনেছে যে রাত্রে নাকি রাখেশ কখনোই দরজা খোলে না। কেন যে খোলে না কেউ বলতে পারে না। আজ সে প্রমাণটা জুবিলি পেল।
পরের দিন সকালেই জুবিলি আবার চলল রাখেশের ঘরে। জুবিলিকে দেখে রাখেশ প্রশ্ন করল অবাক হয়ে, কাল সারারাত ঘুমোননি বুঝি?
—না। ঘুমোতে পারিনি শুধু আপনার জন্যে।
—আমার জন্যে? এমন কী অপরাধ করলাম শুনি?
—অপরাধ নয়, বিনয়ের ছেলের অসুখ, তার স্ত্রী মারা গেছে, কথাটা আমাকে বললে আমি কি টাকা দিতাম না, না দিতে পারি না!
—ছি—ছি, আপনি টাকা দিতে পারেন না এমন কথা ভুলেও ভাবতে পারি না।
—তবে আপনি তাকে টাকা দিতে গেলেন কেন?
—কারণ বিনয়ের টাকার প্রয়োজন ছিল।
—প্রয়োজনটা কি আমি মেটাতে পারতাম না?
—পারতেন। কিন্তু আপনার কাছে টাকা চাইতে বিনয় ভরসা পায়নি।
—কেন?
—এ কেনর উত্তর আপনারা কোনোকালেই বুঝতে পারবেন না মিস চাকলাদার। বিনয় আমাকেও বলতে চায়নি। আমি জোর করে তার কাছে কথাটা আদায় করেছি।
রাশেখ অদ্ভুত ভাবে হাসল। অত্যন্ত সহজ ভাবে বলতে লাগল, মিস চাকলাদার, পেটের দায়ে যারা সার্কাস পার্টিতে খেলা দেখাতে আসে তাদের সঙ্গে জন্তু—জানোয়ারের পার্থক্যটা সাদা চোখে ধরা পড়ে না। তাই জোকার বিনয় আপনাকে তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবরটা দিয়ে আপনাদের দয়া ভিক্ষা চায়নি। জানোয়ারের খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। চাকলাদার সাহেব ওকে কাঁদতে দেখে ভেংচি কেটে বলেছিলেন, ‘কীরে হতভাগা জানোয়ারগুলোকে কাঁদতে শেখাচ্ছিস! ভাগ এখান থেকে।’ তাড়া খেয়ে বিনয় চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে সবকিছু জিজ্ঞাসা করলাম। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাখেশ বললে, দোষ আপনাদের দিই না। দোষ ওদের পেটের ক্ষিদের। মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় কত সহজে নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারে তা যদি কোনোদিন বোঝবার শক্তি ভগবান আপনাদের দিতেন তাহলে অযথা কষ্ট করে আমার কাছে ছুটে আসতেন না।
জুবিলি আর কোনো কথা বলতে পারল না। মাথা হেঁট করে চলে এলো।
এরপর চাকলাদার সাহেবের সঙ্গে জুবিলির বোধহয় কোনো আলোচনা হয়। কেননা, কিছুদিন পরেই প্রতিটি খেলোয়াড় জানতে পারল যে তাদের মাইনে বেড়েছে। সবাই বছরে চারটে বোনাস পাবে। সবাই খুশি হল।
জোকার হারাণ দত্ত টিপ্পুনি কেটে বললে—বিনয়ের বউটি পয়মন্ত ছিল দেখছি।
বিনয় দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলল।
এরপরের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
রাখেশ ও জুবিলিকে প্রায়ই নিভৃতে দেখা যেতে লাগল। ওদের মধ্যে যে কীসের আলোচনা হয় তা কেউ বলতে পারে না। কানাঘুষা উঠল। কেউ বললে ‘কোর্টশিপ’। আবার কেউ বললে, জুবিলি রাখেশকে খেলাচ্ছে।
কথাটা চাকলাদার সাহেবের কানে উঠল।
প্রথম চাকলাদার সাহেব বিশ্বাস করেননি। কিন্তু সেদিন গভীর রাত্রে যখন স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে, জুবিলি রাখেশের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে সেদিন তাঁর আর কোনো সন্দেহ রইল না। তিনি জ্বলে উঠলেন। জুবিলি নিজের কেবিনে ফিরে আসতেই তাকে রূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?
সহজ ভাবে জুবিলি উত্তর দিল, ললিতার অসুখটা খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে বাবা, তাই ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম।
—কিন্তু আমি তোমায় রাখেশের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি জুবিলি।
—ঠিক দেখেছ বাবা, রাখেশবাবু এতক্ষণ হাসপাতালে ছিলেন। এইমাত্র ফিরলেন কিনা, তাই খবরটা নিতে গিয়েছিলাম।
—কাল সকালে খবরটা অনায়াসে নিতে পারতে। একটা সামান্য মেয়ের জন্যে তোমার এত মাথা ঘামানো উচিত নয়।
—উচিত নয় তোমার পক্ষে, কিন্তু আমি মালিক হয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারি না।
—তাই নাকি! এসব রাখেশের উস্কানি নিশ্চয়ই—
—হ্যাঁ। রাখেশবাবু আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।
—জুবিলি, নির্লজ্জতার একটা সীমা আছে! চাকলাদার সাহেব ধমকে উঠলেন। দাঁতের ওপর দাঁত চেপে বললেন, রাখেশ তোমার সর্বনাশ করতে চায়। দাঁড়াও আজই তাকে বিদেয় করব।
চাকলাদার সাহেব এগোতেই জুবিলি তাঁর পথ আগলে দাঁড়াল। বললে, বাবা, রাখেশবাবুকে অপমান করতে গিয়ে তুমি নিজেকে ছোটো কারো না।
—পথ ছেড়ে দাঁড়াও।
—না। তুমি ভুলে যেও না জুবিলি সার্কাসের মালিক আমি। রাখেশবাবুকে কিছু বলার অধিকার তোমার নেই।
চাকলাদার সাহেব যেন চাবুক খেয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন, জুবিলি!
জুবিলি আর দাঁড়াল না। নিজের কেবিনে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
উক্ত ঘটনার পর জুবিলি বেশ কয়েকদিন রাখেশের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করল না। রাখেশ খোঁজ করতে গিয়ে ফিরে এলো। শুনল জুবিলির নাকি শরীর খারাপ, দেখা করতে পারবে না।
কিন্তু হারাণ দত্ত বললে, জুবিলির কিছুই হয়নি, চাকলাদার সাহেব ওদের মেলামেশাটা ভালো চোখে দেখেননি। তাই জুবিলির গোঁসা হয়েছে ইত্যাদি।
রাখেশ উদ্বিগ্ন হল মনে মনে।
পরের দিন সকালে সার্কাসের একটি মেয়ে জুবিলির একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠিটা পড়ে রাখেশ ‘থ’ হয়ে গেল।
জুবিলি লিখেছে। রাখেশবাবু, আমার চিরকালের একটা ইচ্ছে ছিল একটা আদর্শ সার্কাস পার্টির মালিক হব। সেই আশা নিয়েই জুবিলি সার্কাসের গোড়াপত্তন করেছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি করতে পারলাম না। একটা সন্দেহ বাবার মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। আপনার সঙ্গে আমার মেলামেশাটা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না। আর সেই কারণেই একটা ক্রোধ তাঁর মনে দানা বেঁধে উঠেছে। কিন্তু আমি বেশ ভালো করেই জানি, আপনি আমার পাশে না থাকলে হয়তো আমার স্বপ্ন সফল হবে না। হয়তো আমি আদর্শভ্রষ্ট হব। আবার আপনার সঙ্গে কোন সম্পর্কে মেলামেশা করব ভেবে পাচ্ছি না। আজ দু—দিন কেবলই চিন্তা করছি, কেমন করে দু—কুল রক্ষা করব। শেষে হারাণদা একটা মীমাংসা করে দিলেন। এই দোটানার মধ্যে থেকে আপনিই আমায় উদ্ধার করতে পারেন। আমার আপত্তি নেই আপনার স্ত্রী বলে নিজের পরিচয় দিতে।
ইতি—
জুবিলি।
চিঠিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল রাখেশ। কোথায় সে এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। চাকলাদার সাহেবের গলা টিপে তাঁকে হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু এ কী হল তার। জুবিলির চিঠি পেয়ে তার মনে হচ্ছে জুবিলির কোনো ক্ষতি করতে সে পারবে না। জুবিলি, জুবিলি জুবিলির সঙ্গ ভালো লাগে। ভালো লাগে ওর হাসি। ভালো লাগে ওর অভিমান ভরা মুখটি। সবই যেন ভালো লাগে। তাই বুঝি সেদিন রাত্রে সুযোগ পেয়েও চাকলাদার সাহেবের জলের গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিতে গিয়েও তার হাতটা কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু পরিতোষ লাহাকে হত্যা করতে গিয়ে তার হাত কাঁপেনি। অনায়াসে তার টুঁটি টিপে হত্যা করেছিল। পরিতোষ লাহার প্রাণহীন দেহটা যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তখন কী তৃপ্তি সে পেয়েছিল। কী অপরিসীম আনন্দে মনটা ভরে গিয়েছিল।
শুধু একটি ভুল করেছিল সে। আজ সেই ভুলের জন্যে তাকে সদা—সর্বদা অলেস্টারটা গায়ে দিয়ে থাকতে হয়। ডান হাতটা দুমড়ে বাহুর সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয়। যদি সেদিন একটা দড়ির সাহায্যে পরিতোষ লাহাকে হত্যা করত তাহলে আজ জুবিলির চিঠিটা পেয়ে তাকে চিন্তা করতে হত না। শুধু ডান হাতটার জন্যে….
জুবিলি যদি জানতে পারে তার ডান হাতে ছ—টা আঙুল তাহলে….? স্ত্রীর অধিকার হলে সে জানতে পারবেই যে ডান হাতটা সে লুকিয়ে রেখেছে। কারণটা তাকে বলতে হবে না, অনায়াসে সে বুঝতে পারবে। তখন? তখন কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে! না, কখনোই না। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। চাকলাদার সাহেব জানতে পারবেন। পুলিশে খবর দেবেন। তারপর….? পরিতোষের হত্যাকারী হিসাবে পুলিশ তাকে কারারুদ্ধ করবে।
সেদিন রাত্রে রাখেশ ঘুমোতে পারল না। বারবার জুবিলির চিঠিটা পড়ল। কোনো কিনারা সে খুঁজে পায় না। কী উত্তর দেবে। জুবিলিকে প্রত্যাখ্যান করবে? কিন্তু তারপর এখানে আর থাকা যায় না। চলে যেতে হবে। আবার সেই অভাব—অনটন। সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হবে।
শীত শেষ হয়ে আসছে। অলেস্টার আর গায়ে রাখা যাবে না। এখনই অনেকে সন্দেহ করে। গরমকালেও গায়ে দিলে সন্দেহটা বাড়বে। তখন সে কী কৈফিয়ত দেবে!
রাখেশ ডান হাতটা বারবার দেখতে লাগল।
জুবিলিকে স্ত্রী হিসেবে পেতে মন চায়। কিন্তু উপায়! হ্যাঁ উপায় তাকে একটা করতেই হবে।
রাত শেষ হয়ে এলো প্রায়।
রাখেশ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, যেন সকল সমস্যার সমাধান সে করে ফেলেছে।
সকালে ঘুম ভাঙল।
তাড়াতাড়ি হাত—মুখ ধুয়ে কোথাও যাবার জন্যে সে প্রস্তুত হল। নেবার মতো কী বা আছে। একটা ছোট্ট সুটকেসে জামা—কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখল। সুটকেসটা হাতে নিয়ে কেবিনে চাবি দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকল জুবিলির কেবিনে। জুবিলি তখন একাই ছিল। রাখেশকে দেখে সে লজ্জায় মাথা হেঁট করল। রাখেশ একটু ইতস্তত করে বললে, তোমার চিঠি আমি পেয়েছি জুবিলি। কিন্তু সে চিঠির উত্তর আজ তোমায় দিতে পারলাম না কারণ আজ এখুনি আমায় যেতে হবে।
—কোথায়? জুবিলি শঙ্কিত হল।
—দু’ মাসের জন্যে আমি কলকাতায় যাব। সেখান থেকে চিঠি দিয়ে সবই জানাব। একটু থেমে রাখেশ পুনরায় বললে, তোমায় আদর্শভ্রষ্ট করব না জুবিলি। আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করো, আমি ফিরে আসব।
—ফিরেই যদি আসবে তবে চলে যাচ্ছ কেন?
—এই কেনর উত্তর আজ দিতে পারব না জুবিলি। তবে, একদিন তুমি সবই জানতে পারবে। তখন যাতে আমায় ক্ষমা করতে পার সেই ব্যবস্থাই করতে যাচ্ছি। এই নাও কেবিনের চাবি।
রাখেশ আর দাঁড়াল না, চাবিটা জুবিলির হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলো।
রাখেশ কলকাতায় ফিরে এলো।
সেই পার্ক সার্কাস, সেই নোংরা ঘর। দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, বাবা, মা, আমি তোমাদের অধম সন্তান। পরিতোষ লাহার রক্ত আমার ডান হাতে লেগে আছে। কিন্তু মহীতোষ চাকলাদারকে হত্যা করতে গিয়েও পারলাম না। আমার হাতটা বারবার কাঁপছে। মন কিছুতেই সায় দিল না। আমি স্বীকার করছি শুধু জুবিলির জন্যে আমি পারিনি। তাকে—তাকে আমি ভালোবেসেছি। হয়তো তোমাদের কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব। কিন্তু তোমাদের আমি কথা দিচ্ছি বাবা, আজ না পারলেও দু’মাস পর নিজেকে বিপদমুক্ত করে নিয়ে জুবিলির অলক্ষে চাকলাদার সাহেবকে আমি হত্যা করব। তোমরা আমায় ক্ষমা করো।
রাখেশ এবার তার ভায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বললে, সেনা, তোকে আজও আমি ভুলতে পারিনি ভাই। সব সময় মনে হয় তুই যেন আমার জন্যে আজও হাসপাতালে অপেক্ষা করছিস। সেনা, সেনা ভাই। ওরে আজ যদি তুই আমার পাশে থাকতিস—রাখেশ আর বলতে পারল না। দুই চোখে তার জল ছাপিয়ে এল। কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল।
রাখেশ যখন ডাঃ শিবনাথ মুখুজ্জ্যের চেম্বারে এল তখন বেলা ন—টা। ডাঃ শিবনাথ প্লাস্টিক সার্জারিতে একজন নামকরা ডাক্তার। রাখেশেরই সমবয়সি।
রাখেশকে দেখে ডাঃ শিবনাথ খুবই আশ্চর্য হলেন।
—রাখেশ, এতদিন পরে তুমি—?
—যাক, এতদিন পরেও যে তুমি আমায় চিনতে পেরেছ সেজন্যে ধন্যবাদ।
—ধন্যবাদটা আমি তোমায় জানাব রাখেশ। কেননা, তোমার মতো একজন নামকরা ‘ট্রাপিজ’ খেলোয়াড় যে আমাকে দয়া করে মনে রেখেছে সেইটেই আশ্চর্য।
—অতি বিনয় জিনিসটাই খারাপ শিবনাথ।
ডাঃ শিবনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কী মনে করে?
—দরকারি কথা আছে। তোমার এখন সময় হবে না বোধহয়। রাত বারোটার সময় আসবি।
ডাঃ শিবনাথ সম্মতি দিলেন।
রাত বারোটার সময় ডাঃ শিবনাথের চেম্বারে বসে কথা হচ্ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে। রাখেশ বলতে লাগল, বর্মা থেকে ফেরার পথে যেবার সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজডুবি হয়, সেবার আমি ছিলাম বলেই তুমি বেঁচে গিয়েছিলে। দশ মাইল সাঁতরে এসেছিলাম তোমায় নিয়ে, মনে আছে?
—হ্যাঁ, সেই সময়ই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তুমি যদি সেদিন আমায় রক্ষা না করতে তাহলে আজ এত নামডাক, এত ঐশ্বর্যের মুখ আমি দেখতে পেতাম না। আমার অন্ধ মা—বাবার যে কী হত বলতে পারি না। তাঁরা হয়তো না খেতে পেয়ে মরে যেতেন। তাঁদের আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না সে সময়। রাখেশ, সেদিনের সেই উপকারের কথাটা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না। রোজই তোমার কথা ভাবি। মরবার সময় আমার মা, আমার হাতদুটি ধরে বারবার করে বলে গিয়েছিলেন, যেন তোমায় কখনও অমর্যাদা না করি। তিনি প্রাণভরে তোমায় আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। আমি তোমার কাছে চিরঋণী। বলো, কীভাবে তোমার কাজে লাগতে পারি? টাকাপয়সা—
বাধা দিয়ে রাখেশ বললে, না না, টাকাপয়সার প্রয়োজন নেই ভাই।
—তবে?
উত্তর না দিয়ে রাখেশ তার অলেস্টারটা খুলে ফেলল। তারপর শার্ট।
ডাঃ শিবনাথ চমকে উঠলেন। দেখলেন রাখেশের ডান হাতটা দুমড়ে বাহুর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।
—ওকি, তুমি যে বলেছিলে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে তোমার হাতটা কাটা গেছে?
—মিথ্যে বলেছিলাম।
—কেন?
—কারণ,—রাখেশ তার অলেস্টারের পকেট থেকে খবরের কাগজের একটা ভাঁজ করা টুকরো বের করে ডাঃ শিবনাথের হাতে দিল। ডাঃ শিবনাথ খবরের কাগজের ভাঁজটা খুলে পড়তে লাগলেন। ওতে পরিতোষ লাহার হত্যার কাহিনি লেখা আছে। পুলিশের ধারণা পরিতোষ লাহাকে যে হত্যা করেছে তার ডান হাতে ছটি আঙুল আছে। ডাঃ শিবনাথ পরম বিস্ময়ে রাখেশের দিকে তাকাতে দেখলেন, সে তার ডান হাতের অস্বাভাবিক আঙুলটায় হাত বুলোচ্ছে।
তিনি অর্ধস্ফুট স্বরে বললেন, তুমি খুনি?
—হ্যাঁ। পরিতোষ লাহা ছিল আমার বাবার বন্ধু। কিন্তু বন্ধুর ছদ্মবেশে সে আমার মা—বাবার যে কত বড় সর্বনাশ করেছে সে তো তুমি জানো না বন্ধু। দাদামশাইকে ‘পটাসিয়াম সায়নাইড’ খাইয়ে হত্যা করার মিথ্যা অপরাধে বাবা জেলে গেলেন। মা আত্মহত্যা করলেন। আমি ছোট ভাইয়ের হাত ধরে পথে—পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সেদিন শুধু পরিতোষ লাহার জন্যে আমরা দুই ভায়েতে একমুঠো ভাত খেতে পাইনি। পনেরো দিন একনাগাড়ে পথের ধারে না খেতে পেয়ে, প্রচণ্ড শীতে ঠান্ডা লেগে আমার ছোট ভাই সেনার ‘নিমোনিয়া’ হয়ে গেল। আমি ভিক্ষে করে যা পাই তা দিয়ে কোনোরকমে সেনার আধপেটা খাওয়া হয়। শেষে সেনা যখন মরণাপন্ন তখন এক ভদ্রলোক দয়া করে সেনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন আর আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারলাম না। ভদ্রলোক কিছুদিন পরই দেশ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে সপরিবারে দেশে চলে গেলেন। আমি আবার পথে এসে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক যে কোন হাসপাতালে সেনাকে ভর্তি করেছিলেন জানতাম না। যাবার সময় ঠিকানাটা দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেমন করে জানি না ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলি। বিশ্বাস করো ডাক্তার, প্রতিটি হাসপাতাল আমি খুঁজেছি। পাইনি। কোথাও সেনাকে খুঁজে পেলাম না। ডাক্তার, আজও আমার মনে হয় সেনা যেন হাসপাতালেই আছে, আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। কবে আমি আসব, কবে তাকে নিয়ে আসব হাসপাতাল থেকে! বলতে বলতে রাখেশ কেমন যেন দুমড়ে গেল। তার চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।
ডাঃ শিবনাথ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন।
রাখেশ কিছুটা শান্ত হয়ে বললে, ডাক্তার, পরিতোষ লাহার টুঁটিটা টিপে যখন তাকে হত্যা করলাম তখন বড় তৃপ্তি, বড় আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো ভাই, চাকলাদার সাহেবকে কিছুতেই হত্যা করতে পারিনি। পরিতোষ লাহার রক্ত আমার মনে বিভ্রম জাগিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে প্রতিশোধ নেবার অধিকার আমার নেই। এভাবে আমার মা—বাবার আত্মা কখনোই তৃপ্ত হবে না। আমি ভুল করছি। কেন আমি অপরাধ করলাম, কেন নিজের জীবনে টেনে নিয়ে এলাম অশান্তি। আমি সুখী হতে চাই, আমি মানুষকে ভালোবাসতে চাই।
রাখেশ ডাঃ শিবনাথের হাত দুটি চেপে ধরে বিনয়ের সুরে বললে, ডাক্তার, জুবিলি জানে আমার ডান হাতটা নেই। চাকলাদার সাহেব জানেন আমি যুবরাজ নই। আমি রাখেশ, জুবিলিকে আমি ভালোবাসি।
—রাখেশ—!
—আমার ডান হাতটা যদি তুমি অপারেশন করে বাদ দিতে পার, তবে তোমার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকবো।
—সেকি! ভালো হাতটা কেটে বাদ দেবে? ডাঃ শিবনাথ আঁতকে ওঠেন।
—হ্যাঁ। নইলে আমি ধরা পড়ে যাব। পুলিশ আমার হাতের ছাপ পেয়েছে পরিতোষ লাহার গলায়। ওরা আমায় জেলে পাঠাবে। জুবিলি আমাকে ঘৃণা করবে। ডাক্তার, জুবিলিকে আমি কথা দিয়ে এসেছি। ফিরে গিয়ে তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করব। তুমি অমত করো না ভাই। আমার হাতটা অপারেশন করে বাদ দাও।
—বেশ আমি অমত করব না। একদিন তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছিলে। শুধু সেই জন্যেই অমত করব না। ডাক্তার হয়েও অপরাধীকে প্রশ্রয় দেব। কিন্তু এরপর তুমি আর কোনোদিন আমার কাছে এসো না।
ডাঃ শিবনাথ চেম্বার ছেড়ে চলে গেলেন।
দু’মাস পরে রাখেশ যখন জুবিলি সার্কাসে ফিরে এলো তখন ম্যানেজারের পদে সোমরাজ বহাল হয়েছে। সকালে অন্যদিনের মতো অনুশীলন চলছিল। রাখেশ তাঁবুতে গিয়ে জুবিলি ও সোমরাজকে একসঙ্গে দেখল ট্রাপিজের অনুশীলন করতে। ওদের কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠেছে জায়গাটা। অন্যান্য সকলেই তাদের ঘিরে হাসি—ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। রাখেশ একপাশে অনাহুতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর ওদের খেলা শেষ হল। জুবিলি হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিল। যাবার সময় তার নজর পড়ল রাখেশের ওপর। সাপ দেখে মানুষ যেমন চমকে ওঠে, জুবিলিও সেইভাবে চমকে উঠল : তুমি? আপনি কতক্ষণ এসেছেন?
—অনেকক্ষণ। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল রাখেশ। ইতিমধ্যে সোমরাজ এসে দাঁড়াল জুবিলির পাশে।
জুবিলি জিজ্ঞাসা করল—কোথায় কাজ করছেন আজকাল?
রাখেশের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আজ তার গায়ে অলেস্টারটা নেই। তাকে খুবই দুর্বল দেখাচ্ছে।
জুবিলির প্রশ্ন তাকে আঘাত দিয়েছে বোঝা গেল।
সে কোনো উত্তর দেবার আগেই চাকলাদার সাহেব এসে পড়লেন। রাখেশকে দেখে তিনিও চমকে উঠলেন। তাঁর চোয়াল দুটো দৃঢ় হয়ে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন—একি তোমার চেহারা হয়েছে রাখেশ, অসুখ—বিসুখ করেছিল নাকি?
—হ্যাঁ। সামান্য একটু—ও কিছু নয়।
—তা এতকাল কোথায় ছিলে বল তো? সেই যে হঠাৎ না বলে চলে গেলে। আশ্চর্য, তোমাকে খুঁজতে দু’বার কলকাতায় লোক পাঠিয়েছিলাম।
—আমি দেশে গিয়েছিলাম।
—ও। তা ভালোই করেছিলে। যাক, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে সোমরাজ। তুমি চলে যাবার পর বাধ্য হয়ে আমি চিঠি দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি। তোমার অনুপস্থিতিতে একাধারে ওই সব করছে। এবার যখন তুমি এসে পড়েছ তখন আর ভাবনা নেই। কি বলিস জুবিলি?
জুবিলি সম্মতিসূচক হেসে চলে গেল।
রাখেশ ভেবেছিল জুবিলি তাকে দেখে খুবই আনন্দিত হবে। কিন্তু আনন্দের কোনো চিহ্নই সে দেখতে পেল না। সোমরাজ একদৃষ্টে রাখেশের দিকে তাকিয়েছিল। মৃদু হেসে রাখেশ তাকে বললে—আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম মিঃ সোমরাজ।
সোমরাজ কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। চাকলাদার সাহেব নিম্ন কণ্ঠে বললেন, ছেলেটির ভীষণ দেমাক। ওকে আসতে বলে ভুল করেছি। এসো এসো—।
রাখেশকে সঙ্গে নিয়ে চাকলাদার সাহেব তাঁবুতে ফিরে গেলেন।
সোমরাজ, সোমরাজ আর সোমরাজ, সকলের মুখে ওই এক কথা। সোমরাজ শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। সোমরাজ জুবিলি সার্কাসের গর্ব।
কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। রাখেশকে আমলই দেয় না। শুধু রাখেশের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রাখেশ কথা বলতে গেলে উত্তর না দিয়ে চলে যায়। হারাণ দত্ত বলে, সোমরাজ তাকে হিংসা করে। কারণ জুবিলি।
জুবিলিকে সোমরাজ বিয়ে করতে চায়। সে নাকি হারাণ দত্তকে বলেছে যে, রাখেশ যদি জুবিলির সঙ্গে মেশামেশি করবার চেষ্টা করে তবে তাকে সে খুন করবে।
কথাটা শুনে রাখেশ শুধু হাসল।
কিন্তু আশ্চর্য, এসে পর্যন্ত জুবিলি রাখেশের সঙ্গে দেখা করেনি। তাকে দেখা করবার সুযোগও দেয়নি কেন? তবে কি তার আসল পরিচয়টা সে জানতে পেরেছে? কিন্তু তাই যদি হবে তবে চাকলাদার সাহেব তাকে নিশ্চয়ই কিছু বলতেন। তবে কি সোমরাজবাবুকে জুবিলি—?
না—না, কখনই তা হতে পারে না। সে কথাটা কিছুতেই সে ভাবতে পারে না। সে জুবিলিকে ফিরে আসবে বলে গিয়েছিল। তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। নানান চিন্তা রাখেশকে ঘিরে ধরে। চিন্তার কোনো কিনারা করতে পারে না।
কিনারা হল সেইদিন সন্ধ্যায়। সার্কাসের একটি মেয়ে এসে জুবিলির চিঠি দিয়ে গেল। জুবিলি লিখেছে, রাখেশবাবু, আমি আশা করিনি আপনি আবার ফিরে আসবেন। কলকাতা থেকে আপনার চিঠি পেয়ে অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল। আপনি বিয়ে করে নিশ্চয়ই সুখী হয়েছেন। আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো করতেন। অন্তত আমার উপকার হত। আপনি বোধহয় শুনেছেন সোমরাজ একজন ভালো খেলোয়াড়। রেঙ্গুনে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তখন ও আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হইনি নানা কারণে। আপনার চিঠি পাওয়ার পর যখন বুঝলাম, আপনি আমায় অযথা অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন চিরকালের মতো তখন সত্যিই আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আমার মনের অবস্থা বুঝে বাবা সোমরাজকে চিঠি দিলেন আসবার জন্যে। সোমরাজ এলো। কিন্তু তাকে কর্মী হিসেবে গ্রহণ করতে মন সায় দিলেও আপনার জায়গায় বসাতে মন চাইল না। যাই হোক, সোমরাজ কিন্তু আমায় নিরাশ করেনি। আপ্রাণ চেষ্টা করে সার্কাসটা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ইতি জুবিলি।
একবার নয় বারবার চিঠিটা পড়ল রাখেশ। আশ্চর্য, সে—তো কোনো চিঠি দেয়নি জুবিলিকে। আর সে বিবাহিত! এত বড় মিথ্যা কথা সে কখনোই লেখেনি। কে লিখল? কে জুবিলিকে প্রবঞ্চনা করল? তার মনে হল এখনই সে ছুটে যায় জুবিলির কাছে। তাকে সব কথা খুলে বলে। জুবিলি তাকে ভুল বুঝেছে।
এই সময় হারাণ দত্ত এল।
রাখেশ তাকে জুবিলির চিঠিটা দিতে সে বললে, আমি সবই জানি ব্রাদার। এসব কারসাজি চাকলাদার সাহেবের। তুমি চলে যাওয়ার পরই চাকলাদার বুঝতে পারলেন যে, জুবিলি তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তোমরা নাকি বিয়ে—থা করে সংসারী হতে চাও। তখন তিনি এক চাল খেললেন। তোমার জবানবন্দিতে একটা চিঠি লিখলেন যে, তুমি বিয়ে করেছ। আর কোনোদিন ফিরবে না। জুবিলি যেন অন্য কাউকে বিয়ে করে—ইত্যাদি। নানান আজে—বাজে কথা লিখে জুবিলির নামে পাঠালেন কলকাতা থেকে।
জুবিলি চিঠি পেয়ে কেঁদে আকুল হল। আমাকে পাঠাল কলকাতা। আমি পার্ক সার্কাসের ঠিকানায় গিয়ে তোমার কোনো খোঁজ পেলাম না। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। কেঁদে কেঁদে জুবিলির অসুখ করে গেল। শেষে চাকলাদার সাহেব চিঠি লিখে রেঙ্গুন থেকে সোমরাজকে নিয়ে এলেন। তারপর বুঝতেই পারছ বেচারি জুবিলি বাধ্য হয়ে সোমরাজকে সহ্য করছে। হারাণ দত্ত নিম্ন কণ্ঠে বললে, ভায়া জুবিলি তোমাকে আজও ভালোবাসে। যদি তাকে পেতে চাও তবে আগে সোমরাজকে এখান থেকে তাড়াও। তারপর জুবিলিকে সব কথা বল।
হারাণ দত্ত চলে গেল।
রাখেশের চোখদুটো ক্ষুধিত নেকড়ের মতো জ্বলতে লাগল। কেবলই তার মনে হতে লাগল—সে ভুল করেছে। চাকলাদার সাহেবকে হত্যা না করে সে ভুল করেছে। শয়তান, মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তার নিরপরাধ বাবাকে জেলে পাঠিয়েছে। তার মাকে আত্মঘাতী করতে বাধ্য করেছে। আবার ভুয়ো চিঠি দিয়ে তার জীবন বিষময় করে তুলেছে। প্রতিশোধ, প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। প্রথমে সোমরাজ তারপর চাকলাদার সাহেব। এক ঢিলে দুই পাখি তাকে শিকার করতেই হবে।
চাকলাদার সাহেব মনে মনে হাসেন। কাঁটা দিয়ে তিনি কাঁটা তুলবেন। জুবিলির আর কোনো আকর্ষণ নেই রাখেশের ওপর সেটা তিনি লক্ষ করেছেন। এবার সোমরাজকে তাড়াতে হবে। তারপর জুবিলি সার্কাস তুলে দিয়ে আবার নতুন করে সার্কাস খুলবেন নিজের নামে। তিনি হবেন মালিক। বোকা মেয়েটিকে আর ভুলেও মালিক করা চলবে না। মেয়েটি সে রাত্রে স্পষ্ট তাঁর মুখের ওপর বলেছিল—সেই জুবিলি সার্কাসের মালিক, চাকলাদার সাহেবের কোনো অধিকার নেই। বোকা মেয়ে—
সোমরাজ জুবিলিকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আজও জুবিলি মন থেকে সায় দিতে পারে না। কত করে তাকে বোঝায় তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়, সোমরাজ জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে কারণটা জুবিলি কোনোদিনই বলেনি। সোমরাজ রাখেশের নামটা উচ্চারণ করতে জুবিলি কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলে, সোমরাজ ভুলে যেও না আমি তোমার মনিব।
তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জুবিলি নিজেকে এড়িয়ে নেয়। কিন্তু এমনি করে কতকাল সহ্য করবে সে।
আজ সকালে রাখেশকে দেখে তার মনটা ছটফট করছে। মনে হচ্ছে এখুনি ছুটে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন সে বিয়ে করল। আর যদি অন্য কোনো নারীকে সে ভালোবেসেছিল তবে তাকে আশা দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল কেন? বিয়ে করেই বা ফিরে এলো কেন? কথাটা মনে হতেই জুবিলির চোখ ছাপিয়ে জল এসে পড়ল। তার কীসের দোষ, কীসের অপরাধ?
এই সময় সোমরাজ এসে পড়ল। সোমরাজকে দেখে সে হঠাৎ চটে উঠল—কেন তুমি আমাকে বিরক্ত করতে এলে সোমরাজ। প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। সোমরাজের চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠল—তীক্ষ্ন হাসি তার ঠোঁটের কোণে খেলে গেল, বললে, এক আকাশে কখনই চন্দ্র, সূর্য একসাথে ওঠে না জুবিলি। কথাটা তোমায় জানিয়ে গেলাম।
সোমরাজ বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।
জুবিলি মনে মনে প্রমাদ গুনল। সোমরাজ যে গোঁয়ার, হয়তো রাখেশের কোনো ক্ষতি করে বসবে। কী করবে সে! কী করা উচিত!
দু’দিন দু’রাত ভেবে একটা উপায় পেল।
জুবিলি রাখেশকে চিঠি লিখল। সেই চিঠি একটু আগে রাখেশ পড়েছে।
সেই রাত্রে যখন সার্কাস শুরু হল তখন রাখেশ নিজের কেবিনে ছিল। কিছুক্ষণ পর সে বেরিয়ে এল। সকলের অলক্ষে গেল ড্রেসিংরুমে। কেউ তাকে লক্ষ করল না। পকেট থেকে একটা ‘ফিউজ তার’ বের করে ‘চেরিয়ট’ খেলার মোটা দড়ির গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর দড়িটায় ‘পেট্রোল’ ঢেলে ভিজিয়ে দিয়ে চলে এল।
সোমরাজের বুদ্ধিতে সার্কাসে একটা খেলা দেখানো হত সবার শেষে। খেলাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘চেরিয়ট রেস’। সাতটি ঘোড়াতে একটি ‘চেরিয়ট’কে টানবে। ‘চেরিয়টের’ ওপর দাঁড়িয়ে থাকে জুবিলি। ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুবিলি চাবুক মারে ঘোড়াগুলোর পিঠে। ঘোড়াগুলো একসঙ্গে ছুটতে আরম্ভ করতেই কোথা থেকে ছুটে এসে সোমরাজ ঘোড়াগুলোর মুখের লাগাম সামনে থেকে চেপে ধরত। ঘোড়াগুলো হাজার চেষ্টা করলেও এক পা নড়তে পারত না। জনতা রুদ্ধনিশ্বাসে সোমরাজের দিকে তাকিয়ে থাকত। খেলা শেষ হলে জনতার করতালিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠত।
কিন্তু এই খেলার পিছনে যে কারচুপি আছে সে কথা এক সার্কাসের লোক ছাড়া আর কেউ জানত না। ‘চেরিয়টের’ পিছনের চাকার সঙ্গে একটা মোটা শক্ত দড়ি বাঁধা আছে। আর সেই দড়ির অপর প্রান্তটা পর্দার অন্তরালে ড্রেসিংরুমে একটি লোহার খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। হাজার টানলেও ছিঁড়বে না। চেরিয়টটি পর্দার কাছেই দাঁড় করানো থাকে। সাতটা ঘোড়া চাবুক খেয়ে ছোটবার চেষ্টা করতেই সোমরাজ তাদের গতিরোধ করে কিন্তু আসলে ‘চেরিয়ট’টা শক্ত দড়ি দিয়ে লোহার খুঁটির সঙ্গে বাঁধা তাই ঘোড়াগুলো এক পাও এগোতে পারে না।
এই খেলাটি সোমরাজের মাথা থেকে এসেছে। জুবিলি প্রথমটা প্রবল আপত্তি করেছিল কিন্তু চাকলাদার সাহেব নাছোড়বান্দা। অগত্যা জুবিলিকে রাজি হতে হয়।
আজও সেই খেলাটি দেখানো হবে। রাখেশ সেইজন্যেই আগেভাগে চেরিয়টের দড়িতে পেট্রোল ঢেলে ‘ফিউজ তার’ জড়িয়ে এল। সার্কাস শেষ হয়ে এল। এবার ‘চেরিয়ট’ রেস দেখানো হবে। সোমরাজ তার গলার সোনার হারটা খুলে হারাণ দত্তর হাতে দিল। রোজই এই খেলাটা দেখাবার আগে সে তার হারটা হারাণ দত্তর হাতে দেয়। হারটিতে একটি লকেট ঝুলছে।
সোমরাজকে প্রস্তুত হতে দেখে রাখেশ ‘ফিউজ তারে’ আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাঁবুতে ফিরে এসে দাঁড়াল। জুবিলি দামি পোশাক পরেছে। যেন সে পরির দেশের রানি। চেরিয়টের ওপর উঠে দাঁড়াল। রুদ্ধনিশ্বাসে জনতা অপেক্ষা করতে লাগল। এই সময় হারাণ দত্ত রাখেশের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললে—জোচ্চুরি করে নাম কেনাটা আমার সহ্য হয় না ব্রাদার। চলি, এই হারটা সোমরাজের খেলা শেষ হয়ে গেলে ওকে দিয়ে দিও। রাখেশের হাতে হারটি গুঁজে দিয়ে হারাণ দত্ত চলে গেল। ঘণ্টা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জুবিলি চাবুক চালাল ঘোড়াগুলোর পিঠে। ঘোড়াগুলো চিৎকার করে ছুটতে যেতেই সোমরাজ লাফিয়ে এগিয়ে এসে ঘোড়াগুলোর সামনে পথ আগলে দাঁড়াল।
এদিকে দড়িতে আগুন ধরে গেছে। আর একটু টান পড়লেই ছিঁড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে সোমরাজের যে কী অবস্থা হবে চিন্তা করে রাখেশ মৃদু হাসল। তারপর পুলিশের কাছে সে প্রমাণ করে দেবে চাকলাদার সাহেব সোমরাজকে হত্যা করার জন্যেই দড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। এক ঢিলে দুই পাখি। উত্তেজনায় রাখেশ অজ্ঞাতে হারের লকেটটার ওপর চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। লকেটের ভেতরটায় একটা ছবি দেখে রাখেশ চমকে উঠল। তার পার্ক সার্কাসের ঘরে এমনি একটা ছবি দেওয়ালে টাঙানো আছে। যুবরাজ ও সেনার ছোটবেলার ছবি। রাখেশ চমকে ওঠে। সোমরাজ তখন প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলে ধরেছে ঘোড়াগুলোকে। আর সময় নেই, এই মুহূর্তে দড়িটা ছিঁড়ে যাবে। রাখেশ বুঝতে পারল ওই সোমরাজই তার ভাই সেনা।
সে চিৎকার করে উঠল, সেনা—!
চক্ষের পলকে ছুটে গিয়ে সে সোমরাজকে প্রবল ধাক্কা দেয়। আচমকা ধাক্কা খেয়ে সোমরাজ একপাশে ছিটকে পড়ে।
রাখেশ বাঁ হাতে ঘোড়ার মুখের লাগাম চেপে ধরে।
ঠিক সেই সময় দড়িটা ছিঁড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো দশমণি চেরিয়টটা নিয়ে রাখেশের ওপর দিয়ে চলে গেল। চারিদিকে হাহাকার উঠল।
রাখেশের রক্তাক্ত দেহটা যখন সবাই মিলে ধরাধরি করে নিয়ে এলো তার কেবিনে তখন তার শেষ অবস্থা।
সোমরাজ শুধু জিজ্ঞাসা করল, আমার নাম তুমি জানলে কী করে? বলো বলো তুমি কে?
ম্লান হেসে রাখেশ বললে, আমায় চিনতে পারলি নে ভাই, আমি যুবরাজ।
—দাদা—সোমরাজ ডুকরে কেঁদে উঠল। বললে, দাদা আবার তুমি আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছ! দাদা—দাদা—।
রাখেশের তখন কথা বলার শক্তি নেই। সোমরাজ তার বুকের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে। জুবিলি দাঁড়িয়েছিল তার পায়ের কাছে। রাখেশ তাকে ইশারা করে কাছে ডেকে বললে, আমি তোমার জন্যেই ফিরে এসেছিলাম জুবিলি। তোমায় মিথ্যে সংবাদ দিয়েছেন তোমার বাবা।
রাখেশ আর বলতে পারল না। সব শেষ হয়ে গেল। জুবিলি কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল তার পায়ের ওপর—ওগো ফিরে এসো, ফিরে এসো, আমি যে আজও তোমার পথ চেয়ে বসে আছি।
—