বিনুর বয়স তেইশ তখন , রোগে ধরল তারে । ওষুধে ডাক্তারে ব্যাধির চেয়ে আধি হল বড়ো ; নানা ছাপের জমল শিশি , নানা মাপের কৌটো হল জড়ো । বছর দেড়েক চিকিৎসাতে করলে যখন অস্থি জরজর তখন বললে , “ হাওয়া বদল করো । ” এই সুযোগে বিনু এবার চাপল প্রথম রেলের গাড়ি , বিয়ের পরে ছাড়ল প্রথম শ্বশুরবাড়ি । নিবিড় ঘন পরিবারের আড়ালে আবডালে মোদের হত দেখাশুনো ভাঙা লয়ের তালে ; মিলন ছিল ছাড়া ছাড়া , চাপা হাসি টুকরো কথার নানান জোড়াতাড়া । আজকে হঠাৎ ধরিত্রী তার আকাশভরা সকল আলো ধরে বর বধূরে নিলে বরণ করে । রোগা মুখের মস্ত বড়ো দুটি চোখে বিনুর যেন নতুন করে শুভদৃষ্টি হল নতুন লোকে । রেল-লাইনের ওপার থেকে কাঙাল যখন ফেরে ভিক্ষা হেঁকে , বিনু আপন বাক্স খুলে টাকা সিকে যা হাতে পায় তুলে কাগজ দিয়ে মুড়ে দেয় সে ছুঁড়ে ছুঁড়ে । সবার দুঃখ দূর না হলে পরে আনন্দ তার আপনার ই ভার বইবে কেমন করে । সংসারের ঐ ভাঙা ঘাটের কিনার হতে আজ আমাদের ভাসান যেন চিরপ্রেমের স্রোতে — তাই যেন আজ দানে ধ্যানে ভরতে হবে সে — যাত্রাটি বিশ্বে র কল্যাণে । বিনুর মনে জাগছে বারেবার নিখিলে আজ একলা শুধু আমিই কেবল তার ; কেউ কোথা নেই আর শ্বশুর ভাশুর সামনে পিছে ডাইনে বাঁয়ে ; সেই কথাটা মনে করে পুলক দিল গাঁয়ে । বিলাসপুরের ইস্টেশনে বদল হবে গাড়ি ; তাড়াতাড়ি নামতে হল । ছ-ঘণ্টা কাল থামতে হবে যাত্রিশালায় , মনে হল এ এক বিষম বালাই ! বিনু বললে , “ কেন , এ তো বেশ । ” তার মনে আজ নেই যে খুশির শেষ । পথের বাঁশি পায়ে পায়ে তারে যে আজ করেছে চঞ্চলা — আনন্দে তাই এক হল তার পৌঁছনো আর চলা । যাত্রিশালার দুয়ার খুলে আমায় বলে । — “ দেখো , দেখো , এক্কাগাড়ি কেমন চলে । আর দেখছ বাছুরটি ওই , আ মরে যাই , চিকন নধর দেহ , মায়ের চোখে কী সুগভীর স্নেহ । ওই যেখানে দিঘির উঁচু পাড়ি — সিসু গাছের তলাটিতে পাঁচিলঘেরা ছোট্ট বাড়ি ওই যে রেলের কাছে — ইস্টেশনের বাবু থাকে ?— আহা ওরা কেমন সুখে আছে । ” যাত্রীঘরে বিছানাটা দিলেম পেতে , বলে দিলেম , “ বিনু এবার চুপটি করে ঘুমোও আরামেতে । ” প্ল্যাটফরমে চেয়ার টেনে পড়তে শুরু করে দিলেম ইংরেজি এক নভেল কিনে এনে । গেল কত মালের গাড়ি , গেল প্যাসেঞ্জার , ঘণ্টা তিনেক হয়ে গেল পার । এমন সময় যাত্রীদের দ্বারের কাছে বাহির হয়ে বললে বিনু , “ কথা একটা আছে । ” ঘরে ঢুকে দেখি কে - এক হিন্দুস্থানি মেয়ে আমার মুখে চেয়ে সেলাম করে বাহির হয়ে রইল ধরে বারান্দাটার থাম । বিনু বললে , “ রুক্মিনী ওর নাম । ওই যে হোথায় কুয়োর ধারে সারবাঁধা ঘরগুলি ওই খানে ওর বাসা আছে , স্বামী রেলের কুলি ; তেরো শো কোন্ সনে দেশে ওদের আকাল হল — স্বামী-স্ত্রী দুইজনে পালিয়ে এল জমিদারের অত্যাচারে । সাত বিঘে ওর জমি ছিল কোন্-এক গাঁয়ে কী-এক নদীর ধারে — ” বাধা দিয়ে আমি বললেম হেসে , “ রুক্মিনীর এই জীবনচরিত শেষ না হতেই গাড়ি পড়বে এসে । আমার মতে , একটু যদি সংক্ষেপেতে সার ো অধিক ক্ষতি হবে না তায় কারো । ” বাঁকিয়ে ভুরু , পাকিয়ে চক্ষু , বিনু বললে খে পে — ‘ ক খ্ খোনো না , বলব না সংক্ষেপে । আপিস যাবার তাড়া তো নেই , ভাবনা কিসের তবে । আগাগোড়া সব শুনতেই হবে । ” নভেল-পড়া নেশাটুকু কোথায় গেল মিশে । রেলের কুলি র লম্বা কাহিনী সে বিস্তারিত শুনে গেলেম আমি । আসল কথা শেষে ছিল , সেইটে কিছু দামি । কুলি র মেয়ের বিয়ে হবে , তাই পেঁচে তাবিজ বাজুবন্ধ গড়িয়ে দেওয়া চাই ; অনেক টেনেটুনে তবু পঁচিশ টাকা খরচ হবে তারি ; সে ভাবনাটা ভারি রুক্মিনীরে করেছে বিব্রত । তাই এবারের মতো আমার ‘ পরে ভার কুলি নারীর ভাবনা ঘোচাবার । আজকে গাড়ি চড়ার আগে একেবারে থোকে পঁচিশ টাকা দিতেই হবে ওকে । অবাক কান্ড এ কী । এমন কথা মানুষ শুনেছে কি । জাতে হয়তো মেথর হবে , কিংবা নেহাত ওঁচা , যাত্রীঘরের করে ঝাড়ামোছা , পঁচিশ টাকা দিতেই হবে তাকে! এমন হলে দেউলে হতে কদিন বাকি থাকে । “ আচ্ছা , আচ্ছা , হবে , হবে । আমি দেখছি মোট এক শো টাকার আছে একটা নোট , সেটা আবার ভাঙানো নেই! ” বিনু বললে , “ এই ইস্টিশনেই ভাঙিয়ে নিলেই হবে । ” “ আচ্ছা , দেব তবে ” এই বলে সেই মেয়েটাকে আড়ালেতে নিয়ে গেলেম ডেকে ,— আচ্ছা করেই দিলেম তারে হেঁকে — “ কেমন তোমার নোকরি থাকে দেখব আমি! প্যাসেঞ্জারকে ঠকিয়ে বেড়াও! ঘোচাব নষ্টামি! ” কেঁদে যখন পড়ল পায়ে ধরে দু-টাকা তার হাতে দিয়ে দিলেম বিদায় করে । জীবন-দেউল আঁধার করে নিবল হঠাৎ আলো । ফিরে এলেম দু-মাস যেই ফুরাল । বিলাসপুরে এবার যখন এলেম নামি , একলা আমি । শেষ নিমেষে নিয়ে আমার পায়ের ধূলি বিনু আমায় বলেছিল , “ এ জীবনের যা-কিছু আর ভুলি শেষ দুটি মাস অনন্তকাল মাথায় রবে মম বৈকুণ্ঠেতে নারায়ণীর সিঁথের ‘ পরে নিত্য সিঁদুর - সম । এই দুটি মাস সুধায় দিলে ভরে বিদায় নিলেম সেই কথাটি স্মরণ করে । ” ওগো অন্তর্যামী , বিনুরে আজ জানাতে চাই আমি সেই দু-মাসের অর্ঘ্যে আমার বিষম বাকি , পঁচিশ টাকার ফাঁকি । দিই যদি আজ রুক্মিনীরে লক্ষ টাকা তবুও তো ভরবে না সেই ফাঁকা । বিনু যে সেই দু-মাসটিরে নিয়ে গেছে আপন সাথে , জানল না তো ফাঁকিসুদ্ধ দিলেম তারি হাতে । বিলাসপুরে নেমে আমি শুধাই সবার কাছে “ রুক্মিনী সে কোথায় আছে ?” প্রশ্ন শুনে অবাক মানে — রুক্মিনী কে তাই বা ক-জন জানে । অনেক ভেবে “ ঝামরু কুলির বউ ” বললেম যেই , বললে সবে , “ এখন তারা এখানে কেউ নেই । ” শুধাই আমি , “ কোথায় পাব তাকে । ” ইস্টেশনের বড়োবাবু রেগে বলেন , “ সে খবর কে রাখে । ” টিকিটবাবু বললে হেসে , “ তারা মাসেক আগে গেছে চলে দার্জিলিঙে কিংবা খসরুবাগে , কিংবা আরাকানে । ” শুধাই যত , “ ঠিকানা তার কেউ কি জানে । ” — তারা কেবল বিরক্ত হয় , তার ঠিকানায় কার কাছে কোন্ কাজ । কেমন করে বোঝাই আমি — ওগো আমার আজ সবার চেয়ে তুচ্ছ তারে সবার চেয়ে পরম প্রয়োজন ; ফাঁকির বোঝা নামাতে মোর আছে সেই একজন । “ এই দুটি মাস সুধায় দিলে ভরে ” বিনুর মুখে শেষ কথা সেই বইব কেমন করে । রয়ে গেলেম দায়ী মিথ্যা আমার হল চিরস্থায়ী ।