2 of 2

ফল্গু

ফল্গু

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় আড় হয়ে কী একটা বই নাড়াচাড়া করছি। আজকাল এইরকমই হয়েছে। কী খাচ্ছি, কী পড়ছি, কিছুই আর তেমন খেয়াল থাকে না। খেয়াল করিও না। কিছুটা অভ্যাস, কিছুটা সংস্কার এইভাবেই জীবন চলছে। অভ্যাসে বাজার যাই। অফিসে ছুটি। সংস্কারে বই টেনে নিই। পাতা ওলটাই। বয়েস বেড়ে গেছে। চোখের তেজ কমেছে। তেমন দেখতে পাচ্ছি না। উঠে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসব, সে শক্তিও যেন নেই। রোজই ওইরকম হয়। দু-চার পাতা নাড়াচাড়া করতে না করতেই শরীর খ্যাস করে নেতিয়ে পড়ে। রোজই এই সময়টায় আমার এক সমস্যা হয়—কে মশারি খাটাবে! আমি না আমার বউ? এদিকে সাংঘাতিক মশার উপদ্রব। মশারি ছাড়া এক মুহূর্ত শোবার উপায় নেই। আর রোজ রাতেই এই মশারি-পলিটিক্স হয়। বউ বলবে—’চারটে কোণ খাঁটিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো। আমার সৃষ্টি-কাজ পড়ে আছে, আমার অপেক্ষায় থেকো না। গতরটা একটু নাড়াতে শেখো। এই গতর শব্দটা শুনলেই আমার মাথায় খুন চেপে যায়। মেয়েদের জগতের বিশ্রী একটা শব্দ। অশ্লীল তো বটেই। আজ আমি অপেক্ষায় আছি। কাল, পরশু, তার আগের দিন পর পর তিনদিন আমি মশারি খাঁটিয়েছি। আজ আর আমি নেই। মরে গেলেও নেই। বইটার পাতা ওলটাচ্ছি আর মনে মনে বলছি—এ লড়াই জিততে হবে। আজ আর আমি নেই। আর ঠিক সেই সময় রান্নাঘর থেকে চিৎকার ‘এলিয়ে না থেকে মশারিটা ফেলে চারপাশ ভালো করে গোঁজো। জীবনে একটা কাজ অন্তত ভালো করে করতে শেখো।’

‘পর পর তিনদিন আমি মশারি ফেলেছি, আজ আমি মরে গেলেও ফেলব না।’

‘তাহলে মরো, মশার কামড় খেয়েই মরো। যখন ম্যালেরিয়া হবে তখন বুঝবে ঠেলা।’

‘হলে তোমার আমার একসঙ্গেই হবে, এক যাত্রার তো আর পৃথক ফল হয় না।’

‘ওই আনন্দেই থাকো, মেয়েদের ম্যালেরিয়া হয় না। হলে অম্বল হয় বাত হয়, পিত্তপাথুরী হয়। স্বামীদের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়।’

‘আচ্ছা।’ আমি সুর টানলুম।‘

হাওয়া বইছে এলোমেলো। রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটার সময় আমি আর ফাটা কাঁসি নিয়ে তরজা শুরু করতে চাই না। এ পাড়ায় আমার একটা সম্মান আছে। অনেকেই প্রণাম-ট্রণাম করে। বাড়ির লোক ঝাঁটা মারলে কী হবে বাইরে আমার অল্প-বিস্তর খাতির। একসময় ভালো ফুটবল খেলতুম, ফরোয়ার্ড লাইনে। সেকালে ফুটবলের তেমন কদর ছিল না, একালের ছেলেরা তো। বল-পাগল। সেই কারণেই অতীতের গোলন্দাজ হিসেবে একালে আমার খাতির। আমার পায়ে বল মানেই গোল। এই তো গত দুর্গাপূজায় পাড়ার ক্লাব আমাকে সংবর্ধনা জানালে। একটা টিনের ট্রে, তার ওপর ছোট সাইজের একটা নারকেল, ছোট বাক্সে চারটে সন্দেশ। সে যাই হোক, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনও মূল্য হয় না। গলায় একটা রজনীগন্ধার শুকনো শুকনো মালা পরিয়ে দিল টুলটুলে একটা মেয়ে। মালাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলুম। একেই বলে মহানুভবতা। লোককে দেখানো, আমি কতটা নির্লোভ, নিরহঙ্কারী। সবার আগে একটু বড় একটা মেয়ে প্রদীপ দিয়ে আমাকে বরণ করেছিল। মেয়েটি মনে হয় আমার ব্যক্তিত্বে ভয় পেয়ে। গিয়েছিল, তা না হলে আমার গোঁফে ছ্যাঁকা দিয়ে দেবে কেন? আমার এক গোছা ঝোলা ঝোলা গোঁফ পড়পড় করে পুড়ে গেল। সে যাক, দোষটা আমারই। একালে কেউ অত বড় গোঁফ রাখে। না। সেই যে আমি গোঁফ কামালুম, এখন আমার ঠোঁট সাফ। বয়সটাও যেন অনেক কমে গেছে। আগে অচেনা লোকমাত্রই কিছু জিগ্যেস করার হলে কথা শুরু করত হিন্দিতে। এখন বাংলাতেই করে। সভার সভাপতি মহাশয় গলায় একটা পাট করা মাদ্রাজি চাদর পরিয়ে দিলেন। আমাকে। আবার দু-চার কথা বলতে হল। আমি বলেছিলুম—ফুটবলই আমাদের জীবন। দুটো পা যেন স্বামী-স্ত্রী জুটি; আর বল হল গোল, মানে বিশ্ব। এই বিশ্ব হল স্বামী-স্ত্রীর খেলা। ঠিক বোঝাবুঝি, মেলামেশা হল তো, খেলা হয়ে গেল কবিতা। দুটো পায়ের আন্ডারস্ট্যান্ডিংই হল খেলোয়াড়ের সাফল্যের মূল কথা। উঃ, সে কী হাততালি! তিন মিনিটে হিরো! অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে শ’খানেক তরুণ তেড়ে এল। যার খাতা নেই সে এগিয়ে ধরল ঠোঙা। মনে হয় বাদামটাদাম খাচ্ছিল। সই করতে করতে আমার জান কয়লা। ফড়াক ফড়াক ছবি তুললেন ফটোগ্রাফার। এক নেতা এসে বললেন—নেক্সট ইলেকশানে আমরা আপনাকে পার্টির টিকিট দেব। যদি জিততে পারেন, যদি আমরা মিনিস্ট্রি ফর্ম করতে পারি, জেনে রাখুন আপনি হবেন ক্রীড়া-মন্ত্রী। আমি। সেই গ্যাস খেয়ে বাড়িতে এসে একটা উলটো-পালটা করে ফেললুম। মন্ত্রীদের মতো মেজাজ। দেখাতে গিয়েছিলুম। সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়। আমার একমাত্র স্ত্রীর সঙ্গে একমাস বাক্যালাপ বন্ধ ছিল। টিনের ট্রে-টা দেখে বলেছিল, আজকাল এক প্যাকেট বড় সার্ফ কিনলে ওইরকম ট্রে ফ্রি পাওয়া যায়। চাদরটা দেখে বলেছিল, ব্যান্ডেজ হিসেবে ভালোই। নারকেলটা হাতে নিয়ে বলেছিল, একটা মোচা নিয়ে এলে ছোলা দিয়ে ঘন্ট করা যাবে। সংবর্ধনার নারকেলে কি ঘণ্ট করা উচিত? এই সংশয় আমার ছিল। এ তো ভাবের নারকেল। ভালোবাসার উপহার। ভালোবাসার ঘণ্ট হবে! মোচার দাম কম নয়। এর পর সংবর্ধনায় যাঁরা নারকেল দেবেন, তাঁরা যদি একটা করে মোচাও দেন তো বেশ হয়। আমার বউ আবার হিসেব করে ছেলেকে বুঝিয়ে দিলে বুড়ো বয়সে তার বাপের কীরকম ভীমরতি ধরেছে। একশো এক টাকা চাঁদা কানমলে নিয়ে গিয়ে কুড়ি টাকার মাল ঠেকিয়েছে, পরের বছরের জন্যে গলায় পরিয়ে দিয়েছে ব্যান্ডেজ। গামছার সিম্বল। ওরে আমার বড় পেলোয়াররে! সারা রাত বাতের যন্ত্রণায় কোঁ-কোঁ করে। তিন পা হেঁটে সাতবার হাপরের। মতো হাঁপায়।

যাক, যারা আমার গৌরবোজ্জ্বল অতীত দেখতে পায় না, দেখলেও দেখতে চায় না, তাদের আমার কিছু বলার নেই। বাঙালি ইতিহাসবিমুখ জাতি, আমরা সবাই জানি। এরা ইতিহাস বলতে বোঝে আকবর বাদশার ইতিহাস। সিনেমার ‘ফ্লাশব্যাক’ দেখবে, একটা জ্যান্ত মানুষের ফ্লাশব্যাক শুনবেও না, বিশ্বাস করবে না। আমাদের যেন অতীত থাকতে নেই। আমরা সব বর্তমানের সরীসৃপ। আবার বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলুম। এবার মলাটে চোখ পড়ল। র‍্যাক থেকে ভালো বই টেনেছি—গীতা মাহাত্ম। এই বয়েসে যে বইয়ের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, সংসার সবের ছিরি তো দেখছি। কতদিন ভাবি সন্ন্যাসী হয়ে কেটে পড়ব, পারি। অন্য কিছুর জন্যে নয়, শুধু মাত্র বাথরুমের ভয়ে। গৃহত্যাগের সময় নিজের বাথরুমটাকে তো আর নিয়ে যেতে পারব না। যত্রতত্র আমার পোষায় না। ঘেন্না করে।

দরজার কাছ থেকে আমার রাখওয়ালের একটু চড়া গলা শোনা গেল—’কী হল, মশারির চারটে কোণ আর দয়া করে খাটাতে পারছনা, গতরটা একটু নাড়াও! না পরের গতরে যতটা হয়ে যায়!’

আবার সেই অশ্লীল শব্দটা। উঠে বসলুম। গতর বললেই, লুঙ্গি পরা, বিশাল ভূঁড়ি আর পাছাওলা একটা নির্বোধ ভোগীর চেহারা ভেসে ওঠে। বিছানায় শুয়ে যারা মিঠি মিঠি গলায় গুন গুন করে ডাকে, ‘কই গো, কই গো, তোমার হল।’ বউ তেলানো পাটি। আমি সব অর্থে তার বিপরীত। জীবনে বউকে হ্যাঁ গা, কই গা, শুনছ বলিনি। সেন্টার ফরোয়ার্ডের স্ট্রেটকাট কথা। পায়ে বল নাও, ছ’বার ড্রিবল করে ঢুকিয়ে দাও নেটে। আর তাকাতাকি নেই, ফিরে এসো মাঝ-মাঠে। আমার গুরু আমাকে জপের মন্ত্র দিয়েছিলেন, ‘অ্যাটাক, অ্যাটাক’। আমি ঝাঁঝেই বললুম:

দ্যাখো গতর গতর বলবে না। গতর হয় মেয়েদের। আমার মতো খেলোয়াড়দের হয় ফিগার। আমার একেবারে কঞ্চির মতো শরীর। মশারি আজ আমি খাটাব না, খাটাব না, খাটাব না। দিস ইজ নট মাই জব।’

‘খাটিয়ো না, খাটিয়ো না।’

গলা তো নয় গোলা। একেবারে সংলগ্ন বাড়ির প্রতিবেশী মশারি ফেলা অন্ধকার ঘর থেকে দাবড়ে উঠলেন, ‘আয় চোপ।’ ভদ্রলোক সূর্য ডোবার পর থেকেই চড়াতে থাকেন। এখন তিনি পুরো চড়ে আছেন। আমি কিছু মনে করলুম না। জানি সকালেই তিনি বিনীত গলায় বলবেন—’কী দাদা, বাজারে চললেন?’ আমরা জানি, মাতালে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।

আমার ছেলে। ওই একটি মাত্রই ছেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললে—’আশ্চর্য, দিন দিন। তোমাদের বয়েস বাড়ছে না কমছে?’ বলেই সরে পড়ল। সবে প্রেম করে বিয়ে করেছে। মৌতাতে আছে। নতুন বউমা বিয়ের পর দিনসাতেক মশারি খাঁটিয়ে পরিপাটি বিছানা করে শ্বশুর, শাশুড়ির সেবা করেছিল। তারপর শোনা গেল স্পন্ডিলোসিস হয়েছে। হাতের খিল জ্যাম হয়ে গেছে। ওপর দিকে আর উঠছে না। যা পারছে তলার দিক থেকে সব হাতড়ে নিচ্ছে। মানুষের কপাল মন্দ হলে যা হয়। কে কাকে সেবা করে! এখন বধূ আর পুত্রবধূ দুজনের সেবা করে প্রারব্ধ ক্ষয় করি। ছেলে তো বিয়ে করেই দায় সেরেছে। একালের ছেলেদের তো কোনও কর্তব্যবোধ নেই। প্রেম করার সময় খিদমত খাটত তা আমি জানি। তখন মাছ খেলছিল, এখন মাছ জালে। আর তো কোনও ভয় নেই। এখন খাও দাও আর বগল বাজাও। নিধিকেষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াও।

পাখার স্পিড বাড়িয়ে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। প্রথমত রেগে আছি, অভিমানে একেবারে টসটসে। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের হুল যে সহ্য করতে পারে, মশা তার কী করবে। সেই আছে না, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়! নিদ্ৰাতেই মানুষের সব দুঃখের অবসান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লুম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাত কত তা জানি না। ঘরে গুমোট গরম। পাখা বন্ধ। কানের কাছে ঝাঁক ঝাঁক মশার কালোয়াতি। রাস্তার আলো শোওয়ার আগে জ্বলছে দেখেই শুয়েছি। এখন চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মানে লোডশেডিং। মেঝেতে। আপাদমস্তক সাদা চাদর ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে। আমার পঁচিশ বছরের প্রাচীন অভিমানী বউ। যত বয়েস বাড়ছে, তত মেদ বাড়ছে। তত বাড়ছে রাগ আর অভিমান। এইটুকু বুঝলুম ইলেকট্রিক সাপ্লাই চলে বউদের নির্দেশে। তানা হলে ঠিক এইসময়ে লোডশেডিং হবে কেন? আমাকে অন্যায় রণে হারিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। যেমন কুরুক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা বসে গেল।

যাই হোক, সামান্য একটু যা ঘুমিয়েছি তাইতেই আমার রাগ জল হয়ে গেছে। আমি খাটে, বউটা আমার মেঝেতে। মনটা গুমরে উঠল, আহা পরের মেয়ে! বাপ নেই, মা নেই। মেরেছ কলসির। কানা, তা বলে কি প্রেম দোব না। খাট থেকে অন্ধকারে ঠাহর করে করে নামলুম। তারপর খুঁজে খুঁজে গোল গোল হাত দুটো ধরে তোলার চেষ্টা করলুম। ও বাবা, এ যেন এক পেল্লায় বোয়াল। মাছ, পিছলে যায়। একবার এ-পাশ একবার ও-পাশ। আবার আমার রাগ চড়ছে। কী উঠবে না? মার টান। হেঁইয়ো, মারি হেঁইয়ো, আউর থোড়া হেঁইয়ো, বয়লট ফাটে হেঁইয়ো, ঘাস বিচুলি। হেঁইয়ো। হাতখানেক তুলি তো, থ্যাস করে শুয়ে পড়ে। আমার বউ যে এত ভারী জানা ছিল না। যেন জগদ্দল পাথর। বোম্বে ছবির নায়িকা হলে হিরোর ভাত মারা যেত, কারণ একটা-দুটো সিন এইরকম থাকতই যেখানে নায়ক নায়িকাকে দু-হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে বনের ধারে পাগলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে আর গাইছে—মেরা পেয়ার ঝুলতা রহে, ঝুমঝুম। বোম্বে ছবির নায়করা তো সব প্রেমে আধপাগলা মতো হয়ে যায়। তা এই নায়িকাকে কে তুলবে? এক গব্বর সিং পারতে পারে। যাই হোক, আমার রোক চেপে গেল—কী? স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খাটে তুলতে পারব না! কত ছোবড়ার ওজনদার গদি আমি তুলেছি একা। অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ান ওয়েট লিফটারদের স্মরণ করে, মারলুম আর এক টান। চাগাবার চেষ্টা করলুম। আর তখনই বুকের ডানপাশে যেন ওয়ার্ল্ড হেভি ওয়েট চ্যাম্পিয়ানের এক ঘুসি পড়ল। নিথর নিস্পন্দ হয়ে এল শরীর। পরাজিত মুষ্টিযোদ্ধা যেভাবে স্লো-মোশানে রিং-এর মধ্যে পড়ে যায় আমিও সেইভাবে। পড়ে যেতে যেতে বললুম—’যাঃ সুধা, তুমি বিধবা হলে। হার্ট-অ্যাটাক।’ আর কোনও বড় কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই। উঃ, হৃদয় আটকে গেলে, মানুষের কী যে হয়! কোথায় রেল রোকো, বাংলা বনধ। হৃদয় বন্ধের মতো কিছু নেই।

চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে আমি। শরীর অবশ। দম পড়ছে, আবার বন্ধ হচ্ছে। একটু বাতাসের জন্য মানুষের কী ছটফটানি। আমার বউ এতক্ষণ জেগে জেগে মশকরা করছিল। বিধবা শব্দটায় চাঁদমারি হল। আচ্ছন্ন চেতনা নিয়েই বুঝতে পারছি, অন্ধকারে উঠে বসেছে। প্রথম প্রথম বিধবা হতে সকলেরই ভয় লাগে। ওই অবস্থাতেও নিজেকে হিরো মনে হচ্ছে। ফেলেছি তুরুপের তাস। খেলো, নন্দিনী, খেলো। আমি রামায়ণের রাম। আবার এ-ও মনে হচ্ছে—চলে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে। আবার একটা গানের লাইনও মনে পড়ছে সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী। মরে যাবার সময় মানুষের কত কী মনে পড়ে। মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ ভালোবাসা পায় মনে।

আমার বউ আমার বুকে ভর রেখে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। যেন বারান্দার রেলিং-এ হাতের ভর রেখে রাস্তার লোক দেখছে। বেশ মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করলে—’কোথায় রেখেছ?’

এই সময় এই প্রশ্নের একটাই অর্থ, পাশবই, চেকবই, সেভিংস এইসব রেখেছ কোথায়? তুমি তো চললে। সেখানে গিয়ে তো আর তুড়ুম ঠুকতে পারব না। তখনও আমার একেবারে বাক্যরোধ হয়ে যায়নি। অস্পষ্ট হলেও স্মৃতি আর চেতনা দুটোই কাজ করছে। আমি। কোনওরকমে বললুম ‘ভেবো না তুমিই নমিনি, কাগজপত্র, চেকবই, পাসবই সবই আলমারির লকারে আছে। চাবিটা আছে মাটির যে গোপালমূর্তি, তার ভেতরে। রুমালে জড়ানো।’ এর পর আর আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরুল না, গোঁ করে উঠলাম। আমার বউ বললে—’যাও, তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলব না, মানুষকে কেবল তোমার কামড়ানো স্বভাব।’ আমি মনে মনে বললুম—’হায় রে। এখনও তুমি বুঝলে না, আর হয়তো পনেরো মিনিট পরেই তোমাকে প্রথামতো ডুকরে কেঁদে উঠতে হবে। তুমি ভাবছ আমি বোধ হয় অভিনয় করছি, তা কিন্তু নয়, একেই বলে হার্ট অ্যাটাক! অব্যর্থ পরোয়ানা।’ ভাবলুম, কিন্তু বলতে পারলুম না কিছু। কোঁক, কোঁক শব্দ হল কয়েকবার। তখন আমার বউ সরে এসে বললে, ‘তোমার সেই অম্বলের ওষুধটা কোথায়? অফিসে আজ কী গিলে মরেছিলে? হার্ট অ্যাটাক না হাতি! একে বলে গ্যাস।’

আমি বলতে চাইলুম—’পাগলি, সবাই গ্যাসই ভাবে। মরলে তবেই বোঝা যায় গ্যাস না। করোনারি।’ প্যাঁক করে একটা শব্দ বেরোল মাত্র। আমার বউ তখন উঠে আলো জ্বালাল। আমার দিকে তাকিয়েই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। স্বপ্নের ঘোরে যেন দেখছি সব। ছেলেকে ডাকছে। ভদ্রমহিলার হইহই করা স্বভাব। এমনভাবে ডাকছে বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে। আমার ছেলের ঘুম সহজে ভাঙে! তার ওপর সবে বিয়ে করেছে। এক সময় ছেলের গলা পাওয়া গেল। ঘুম জড়ানো, বিরক্তি মেশানো গলায় বলছে—’এত রাতে ডাক্তার, তোমার মাথা খারাপ। হয়েছে নার্সিংহোম? গাড়ি পাবে কোথায়! কোনওরকমে ভোর পর্যন্ত ম্যানেজ করো, তারপর যা হয় করা যাবে। বাবাকে তো চেনো! তিলকে তাল করা স্বভাব। এর আগেও তো দেখেছ!’

মনে মনে বললুম, ‘তাই না কি সোনা! বাবারা বুঝি তোমাদের সেবার জন্যে অমর হবে। খালি ফুয়েল ঢেলে যাবে সোনা, আর তোমরা শুধু কপচে যাবে! পাখি সব করে রব।’

তিন জোড়া পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশে বাবুরা এসে গেছেন। আমার ছেলে আবার জাত আমেরিকান। জিনস পরেই ঘুমোয়। উবু হয়ে বসতে পারছে না। এখুনি পেছন ফেঁড়ে যাবে। পুত্রবধূ আমার বুকের উপর হাত রেখে বারে বারে ডেকেই যাচ্ছে, ‘বাবা, বাবা, ও বাবা!’ যেন হার্ট অ্যাটাকের এইটাই চিকিৎসা, বাবা, বাবা করলেই হৃদয় খুলে যাবে।

আমার বউ বলছে, নিশ্চয় আজ ঘুগনি খেয়েছে। ঘুগনি দেখলে তো আর লোভ সামলাতে পারে না। আজ তো সোমবার। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। আজ ওদের অফিস ক্যান্টিনে ঘুগনির ডেট।

আমি সব শুনছি, আর মনে মনে হাসছি। এত যন্ত্রণাতেও হাসি। কেন হাসব না! ছেলেবেলায় কত আবৃত্তি করেছি—জীবন-মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য।

ছেলে বলছে—’এই অবস্থা কতক্ষণ হয়েছে?’

‘তা প্রায় আধঘণ্টা।’

ছেলে আমার হেসে উঠল। ‘আধঘণ্টা! তাহলে জেনে রাখো ব্যাপারটা হার্টের নয়, পেটের। হার্ট হলে কী হত জানো, পাকা আমটির মতো, টুপ করে খসে যেত। এ তোমার ঘুগনি কেস। তলপেটে নারকেল তেল, সাবান আর জল মিশিয়ে ডলতে থাকো। পায়ের তলায় নখ দিয়ে কুডু কুডু করে দ্যাখো তো!’

আমার বউ বললে, ‘মাগো, সাতজন্ম পায়ে সাবান দেয় না, ওই পায়ের তলায় আমি মরে গেলেও হাত দোব না।’

মনে মনে বললুম—’পিটপিটে বামনী, এখুনি মরলে ওই পায়েই তো আলতা মাখিয়ে ছাপ তুলবে।’

ছেলে বললে, ‘তোমার আবার বেশি বেশি। আমি যে প্যান্টের জন্যে নীচু হতে পারছি না।’

বউমা বললে, ‘আমি দেখছি।’

আঙুলে বড় বড় নখ। সেই নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। আমি ঝড়াক করে পা টেনে নিলুম।

ছেলে বললে, ‘বুঝেছি, এ তোমার মাকে টাইট দেবার চেষ্টা। থ্রম্বোসিস হলে পায়ে কোনও সাড় থাকত না। চলে এসো সুমিতা। ও স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, নিজেরাই ফয়সালা করে নিক।’

মনে মনে বললুম, ‘ও হে ছোকরা, তোমার বউয়ের আঙুলে যে ফ্যাশানের নখ, অ্যালসেশিয়ানকেও হার মানায়। ওই আঁচড়ে মরা মানুষও ঠ্যাং সরাবে বাপ। পায়ে সাড় থাকলে কী হবে, শ্বাস যে এদিকে বন্ধ হয়ে এল। পালসটা দ্যাখো, বিট মিস করছে কি না!’

আমি তিনবার ব্যাঙের মতো কোঁক কোঁক করলুম। ল্যাভেন্ডার পাউডারের গন্ধ উড়িয়ে নবদম্পতি বিদায় নিল। পড়ে রইলুম আমি আর আমার বোকা বউ। পঁচিশ বছরের পোড় খাওয়া একটি জীব। কোথা থেকে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে তলপেটে চেপে ধরল। ফ্যাঁস ফাঁস করে একটু কাঁদল। বউটার ধৈর্য একটু কম। কোনও কাজ একটানা বেশিক্ষণ করতে পারে না। এমনি মানুষটা বেশ ভালো, তবে অবুঝ। বয়েস হলে কী হবে, বালিকার স্বভাব। আমি চলে গেলে বুড়িটার কী হবে! ছেলের সংসারে আয়াগিরি করতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমার চোখেই জল এসে গেল। আমার বউ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘তুমি চলে গেলে আমি আত্মহত্যা করব, মাইরি বলছি, আমি আত্মহত্যা করব, আমার কে আছে বলো!’

তিন-চার ফোঁটা চোখের জল টপাটপ আমার গালে কপালে পড়ল।

আমি আমার অবশ হাত দুটো তোলার চেষ্টা করলুম। প্রথমে পারছিলাম না। পরে পারলুম। পারলুম মনের আবেগে। মন তো আর হৃদয়ে থাকে না। মেয়েটাকে আস্তে আস্তে পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরলুম। রাতের ধরিত্রীর মতো ঠান্ডা শীতল একটি শরীর। ধীরে ধীরে আমার হাতে চাপ বাড়ছে। কাছে টানছি, কাছে, আরও কাছে। আমার অর্ধ অঙ্গকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি, যেন হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করছি। হাপুস কাঁদছে আমার বউ। আমি কথা বলার চেষ্টা করলুম। পারলুম। আমার বাক্য ফিরে এসেছে। বললুম, ‘মাইরি বলছি, আমার একটা মাইলড স্ট্রোকই হয়ে গেল। আমি আজ ঘুগনি খাইনি, কিছুই খাইনি। স্রেফ তোমার জন্যেই আমার হৃদয়ের বাধা খুলে গেল।’

আমার বুকের ওপর বউয়ের মাথা। চুলের আর সে শোভা নেই। দেহে আর সে উত্তাপ নেই, কিন্তু চোখে অনেক জল এসেছে। ভেতরে একটা সমুদ্র তৈরি হয়েছে।

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?

আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার চির বালিকাবউ ধরা ধরা গলায় বললে, ‘বুঝতে পারো না বোকা!’ আমার চোখের সামনে খেলে গেল অতীতের দৃশ্য, একটা গাছ, এক টুকরো জমি, সবুজ ঘাস, এক তরুণ আর তরুণী, কাঁধে মাথা হাতে হাত। অদৃশ্য এক স্টার্টার বাঁশি বাজিয়ে দিলেন, শুরু হল চলা। আজও চলছি। কোথায় সেই লাল ফিতে! কত দূরে। মনে মনে আমার ছেলেকে বললুম —’কী প্রেম করিস তোরা? দেখে যা প্রেম কাকে বলে? চোখের জল ছাড়া প্রেম হয়!’ একটা হৃদয় হলে আজ যবনিকা পড়ে যেত। দুটো হৃদয় মিলেছিল বলেই রয়ে গেলুম। থাকি না আর কিছুকাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *