ফর টেক অফ
বোম্বে থেকে এসেছে। সূর্যর ফ্ল্যাটে গেট টুগেদার পার্টি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কেউ কনিয়াক সিপ করছে। কেউ-বা ড্রাম্বুই বা অন্য লিকুয়োর।
—তোমরা কি উঠবে না আজ কেউ?
পরমা কিঞ্চিৎ অধৈর্য গলায় বলল।
—আরে বোসোই-না। শুক্রবারের রাত। সুজয়ও তো কলকাতায় নেই, তোমার অত তাড়া কীসের? নাইট ইজ ভেরি ইয়াং। ওরা সমস্বরেই বলল।
—না: এগারোটা বাজে। তাড়া আমার নিজের জন্য নয়। তোমাদের না-হয় অফিস ছুটি, কিন্তু কাল আমার মেয়ের স্কুল আছে ভাই।
—আহা! মেয়ে যেন এক তোমারই আছে। আমরা যেন একেবারেই ঝাড়া হাত-পা!
মাঝবয়েসি সুন্দরী সুমি, ঝংকার দিয়ে বলল।
—রাবড়িটা কেমন এনেছিলাম বলো?
সূর্য শুধল।
—দারুণ।
অশেষ সার্টিফিকেট দিল।
পরমার মনে হল। এদের কারওরই বাড়ি যাওয়ার তাড়া আদৌ নেই। সকলেরই ফ্ল্যাট বা বাড়ি একটা আছে বটে, শোয়ার ঘরও আছে, স্বামী বা স্ত্রী, কিন্তু পরমার মনের গভীরে বাড়ি বলতে যে একটা গভীর সখ্যতা, প্রেম, আর উষ্ণতার নীড়ের কল্পনা ছিল; সেই নীড়ের সঙ্গে তার নিজের অথবা বন্ধুবান্ধব চেনাজানাদের প্রায় কারওরই বাড়ির কোনো মিল নেই।
পরমা, অশেষকে একবার ইঙ্গিতে বারান্দাতে ডাকল। নিভৃতে।
সূর্যর ফ্ল্যাটে গেট টুগেদার পার্টি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
মাল্টিস্টোরিড বাড়ির বারো-তলার বাইরে বারান্দায় অন্ধকার ছিল। আলো জ্বালেনি কেউ। অনেক নীচে হ্যালোজেন ভেপারের আলো-জ্বলা রঙিন কলকাতা। হলুদরঙা হেডলাইট জ্বালিয়ে যাওয়া-আসা করছে গাড়ি।
পরমা নীচের পথে চেয়ে বলল, খুব কুয়াশা হয়েছে না?
—হুঁ। কাল সকালে আমার দিল্লি যেতে হবে। ফ্লাইট ডিলেড না হয়ে যায়!
পরমা একদৃষ্টে অশেষের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
একটা সময়ে এই মুখটিকে কত কাছ থেকে, কতক্ষণ ধরে দেখেছে। মানুষটির কত কাছাকাছি এসেছে। কত বার। কত গভীর সুখের, অভিমানের, রাগের সব মুহূর্তগুলি। আজ সবই যেন নীচের পথের বেদানারঙা আলো-জড়ানো, নীলাভ কুয়াশারই মতো হয়ে গেছে। মনে পড়ে না কিছুই আর তেমন করে। মনে পড়বার সময়ই হয় না। তবু, কুঁড়ির টিফিন ভরতে ভরতে বা জানলার সামনে বসে চা খেতে খেতে মধ্যসকালের কাগজওয়ালার ‘কাগজ বিক্রি আছে….? কাগজ….? শিশি বো—তল’ ডাকে, বুকের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন এক শূন্যতা বোধ করে ও।
পুরোনো কথা; শুধুই অশেষের কথা মনে পড়ে। পরমার নিজের জীবনটাকেও বিক্রির জন্য জড়ো করে রাখা পুরোনো কাগজ বা খালি শিশি বলে মনে হয় কখনো কখনো।
—কী ভাবছ?
অশেষ জিজ্ঞেস করল।
—কিছু না, এমনি….। তুমি আছ কেমন?
—ভালোই বোধ হয়। আসলে, নিজের সম্বন্ধে ভাবার সময় কোথায় পাই? সবই আছে। শুধু সময় নেই।
—তা ঠিক। কারওরই ভাবার সময় নেই আজকাল।
—উদবৃত্ত সময় যদি কারওর হাতে এতটুকুও থাকেও, তাহলেও তো আমরা তাকে ‘কিল’ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই না? এই সময়ের আমরা, সকলে এমনই হয়ে গেছি। সময়কে সময় বলে মনে হয় তোমার?
—জানি না। ভালো কী মন্দ সেটুকু ভাবারও যে সময় নেই।
—ইস, তোমার সঙ্গে একটুও একা থাকা হল না, কথা হল না। ভারি খারাপ তুমি। আবার কবে আসবে? এবারই সুযোগ ছিল। সুজয় তো ফার-ইস্টে গেছে, সাত দিনের জন্যে অফিসের কাজে; বললাম তো একটু আগে। তুমি এলেও যদি, তা-ও খবর না-দিয়ে। আর চলে যাচ্ছ, কালই সকালে! ভাবতেও পারি না, ভাবলেও কষ্ট হচ্ছে এত।
অশেষ বলল, বা রে! সীমা এ-পার্টিতে আমাকে না ডাকলে তোমার সঙ্গে দেখাই তো হত না। জানতেও পেতাম না। তুমিও খুব লোক কিন্তু!
—তোমার কাছে আমার ঠিকানা বা ফোন নাম্বার ছিল না?
—না।
—কেন? রাখতে ইচ্ছে করেনি?
—না:। কী লাভ? কে আর হৃদয় খুঁড়ে হায়! বেদনা জাগাতে চায়।
একমুহূর্ত চুপ করে থেকে পরমা বলল, তুমি কি আমাকে সত্যি ভুলে গেছ? সত্যি সত্যি?
অশেষ পাইপটা ধরাল দু-হাতের মধ্যে নিয়ে।
পরমা উৎসুক চোখে মনোযোগের সঙ্গে অশেষকে লক্ষ করছিল। ওর জীবনে একটা সময়ে যেমন করে পাইপটিকে ধরেছে দু-হাতের পাতাতে এখন, তেমনই আদরে অশেষ দু-হাতের পাতার মধ্যে পরমার মুখটিকে নিত। কী সোহাগ! কী সোহাগ!
পাইপ ধরিয়ে, হাসল অশেষ।
হাসিটি ঠিক সেইরকমই আছে। মুখ শুধু সামান্য ভারী হয়েছে। কিছুটা বয়সের কারণে, কিছুটা মদ্যপানে; কিন্তু তার আকর্ষণ পরমার কাছে আগের মতোই প্রবল আছে।
একথাটা আবিষ্কার করেও খুবই বিব্রতবোধ করল পরমা। অথচ ওর স্বামী সুজয়, অশেষের চেয়ে অনেক বেশি হ্যাণ্ডসাম। সকলেই বলে। অনেক বেশি ওয়েলপ্লেসড ইন লাইফ। সবদিক দিয়েই ভালো। তবু, কেন যে এমন হয়; কার যে কাকে ভালো লেগে যায়! চেহারাই তো মানুষের সব নয়। পয়সা-প্রতিপত্তি, এসবও নয়।
—ছেলেবেলার বন্ধু প্রদীপ এসেছিল হোটেলে আজ সকালে।
অশেষ বলল।
—রামকুমারবাবুর একটি গান গাইছিল, ‘ওগো কেমনে বলো-না? ভালো না-বেসে থাকি গো? পাগল করেছে মোরে ওই দুটি আঁখি গো……’
বলেই, হাসতে হাসতে এককলি গেয়েই উঠল অশেষ। চাপাস্বরে।
একটু বেশিই হাসছে অশেষ। বোধ হয় ‘হাই’ হয়ে গেছে সামান্য।
পরমা ভাবল।
অনেক টুকরো টুকরো পুরোনো কথা দপ দপ করে মনে পড়ে যেতেই রাতের আকাশে অসংখ্য নীলাভ দ্যুতির তারা হয়ে ছড়িয়ে গেল কথাগুলি। পরমার আকাশে।
অস্ফুটে ও বলল, ইস, তুমি এখনও কী ভালো গাও! চর্চা করো?
—করি। হোয়েন আই অ্যাম ইন মাই স্যাংচুয়ারি। ইন দ্যা বাথরুম। ওনলি, অন হলিডেজ অ্যাণ্ড সানডেইজ। অন দ্যা থ্রোন।
পরমা হেসে বলল। তুমি সেইরকমই অসভ্য আছ।
পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বলো, আবার কবে আসবে কলকাতায়, এর পরের বার?
—যখন কাজ পড়বে।
—কবে কাজ পড়বে?
—কী জানি? চাকর মানে চাকরই। কুড়ি হাজার টাকাই মাইনে পাই, আর দশ টাকাই পাই। আমি, একটি ঘূর্ণি হয়ে গেছি পরমা। আমার হাতে হাত রেখে দেখেছিলে-না একবার? চৈত্রশেষের ডিগারিয়া পাহাড়ের নীচের টাঁড়ে জসিডিতে দ্বারিক মিত্তিরের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে। মনে আছে? ঘূর্ণি? ঠিক তেমনই জীবনটা। প্রত্যেকটা দিনই ঘূর্ণি!
—দ্বারিকদা কেমন আছে?
-দু-জনে এখানে? অন্ধকার বারান্দাতে? ভেরি সাসপিসাস।
—চমৎকার। অবস্থার সামান্য হেরফের হয়েছে বটে কিন্তু মানুষটির কোনোই হেরফের হয়নি। অমন বড়োমনের বাঙালি আমি দেখিনি। এমন বাঙালিও নয়, যিনি কারওরই নিন্দা করেন না।
পরমা কী যেন বলতে গেল অশেষকে। ঠিক সেই সময়েই মৃণালিনী বারান্দাতে এল। গোয়েন্দার মতো। মেয়েরা পুরুষের চেয়ে অনেকই ভালো গোয়েন্দা হতে পারেন, যদি হন।
গলায় রসিকতার রং চড়িয়েই বলল বটে, কিন্তু সেটা রসিকতার মতো আদৌ শোনাল না।
এই মেয়েটির চোখ আছে সুজয়ের ওপর।
ভাবল, পরমা।
—দু-জনে এখানে? অন্ধকার বারান্দাতে? ভেরি সাসপিসাস। এদিকে সকলেই তোমাদের খুঁজছে। পরমাকে গাইতে বলছে।
—ইমপসিবল। আমি না। গুড্ডিকে বলো; আমি তো বাংলা গান গাই। ও ইংরেজি গান গাইবে। তোমরা সকলে তো ইংরেজিই ভালোবাসো।
মৃণালিনী আজ এমন শরীর-দেখানো একটি পোশাকে এসেছে যে, পরমা মেয়ে হয়েও খুবই লজ্জা পাচ্ছে ওর কারণে। শরীর ছাড়া, দেখানোর মতো মেয়েদের কি আর কিছু নেই?
মৃণালিনী বলল, তাহলে তা-ই বলি গিয়ে সকলকে।
ও চলে যেতেই, পরমা নীচু গলায় তাড়াতাড়ি অশেষকে বলল , আমাকে পৌঁছে দেবে অশি?
—শিয়োর।
তারপর বলল, তোমাকে পৌঁছে দিলে বোম্বেতে কিন্তু চিরদিনই প্রাইজ দিতে তুমি আমায়। যদিও কনসোলেশন প্রাইজ। ফার্স্ট প্রাইজ তো সুজয়কেই দিলে। কিন্তু এখানে যে গুঁফো ড্রাইভার আছে সঙ্গে।
—তবু— চলো।
পরমা বলল। আমার দেরি হয়ে গেছে খুবই। কুঁড়ির স্কুল আছে-না কাল! দেরি করে ফিরলে, আয়া মুখঝামটা দেবে।
সকলকে গুড নাইট, আর বাই-ই….করে ওরা বিদায় নিল।
মৃণালিনী ভুরু তুলে বলল, হুজ ড্রপিং ইউ পরমা? অশেষ?
অশেষ তাড়াতাড়ি কথাটা অন্যদিকে চারিয়ে দিয়ে বলল, আমি তো আর ড্রাইভ করছি না, ড্রাইভার আছে। অসুবিধা নেই। পরমার আলিপুরের বাড়ি নাকি আমার হোটেলের কাছেই পড়বে। আমি তাজ বেঙ্গলে উঠেছি। আই অ্যাম ইন আ হারি। মাস্ট শোভ অফ নাউ। মাই ফ্লাইট ইজ অ্যাট সিক্স। ভোর পাঁচটাতে রিপোর্ট করতে হবে। ডিজগাস্টিং। আই রিয়েলি হেইট দিজ আরলি-মর্নিং ফ্লাইটস।
দুই
গাড়িতে পেছনের সিটে পাশাপাশি বসল ওরা দু-জন। অশেষ পরমার হাতটি তুলে তার দু-হাতের মধ্যে নিয়ে কোলের ওপর রাখল।
পরমার হাত আগে খুব ঘামত। পুরোনো দিনের মতো এখন আর ঘামে না। আগের মতো নরমও নেই হাতের পাতা। বহিরঙ্গে অনেকই বদলে গেছে ও।
পরমাও ভাবছিল, অশেষও অনেকই বদলেছে।
কাল কোনোরকমে যাওয়াটা পেছোতে পারো না? তাহলে সন্ধেটাতে আমরা কোথাও মিট করতাম, গল্প করতাম, খেতাম; আগের মতো।
ইংরেজিতে বলল পরমা, যাতে ড্রাইভার বুঝতে না পারে।
—যাওয়া ক্যানসেল? হ্যাঁ, তা করতে পারি। ক্যানসেলেশন চার্জ লাগবে। সে, কোম্পানি বুঝবে। তুমি বললে, করব। কিন্তু মিট করব আর কেনই-বা? হাত ধরে বসে থাকা ঘাড়ে মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলার দিন কি আর আছে? নিরপরাধ, নির্জলা মিটিং! কী লাভ? তা ছাড়া দেখাটা করবে কোথায়? আমি তো কলকাতার কিছু চিনি না। কোথায়?
—কোনো ক্লাবে?
—অনেকেই যে চেনে তোমাকে।
—কোনো হোটেলের ইটিং প্লেসে?
—সেখানেও তা-ই।
—কোনো রেস্তরাঁতে?
—মে বি, উই উইল বাম্প অন দা ফেসেস উই হেইট। তার চেয়ে বরং তোমার বাড়িতেই আসতে পারি আমি। কখন আসব বলো?
—না না, না। আয়া এবং কুঁড়ি দু-জনেই তোমাকে চেনে। আর সুজয় ভীষণ মিন; ন্যারো মাইণ্ডেড। জানতে পারবে ও।
অশেষ হাসল।
তাহলে তুমি বরং আমার হোটেলের ঘরেই চলে এসো। রুম নাম্বার থ্রি ওয়ান ফাইভ। সুজয় তো তোমাকে পুরোনো করে দিল। আমি একবার নতুন চোখে দেখে তোমাকে নতুন করে দিই। কি? আপত্তি? একবারের জন্যেও কি আমি পেতে পারি না তোমাকে?
পরমার গলার স্বর কেঁপে গেল। ভীরুও হয়ে ওঠল ও। বলল, জানি না। আমি সত্যিই জানি না। খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু লজ্জা করে। ভয় তো করেই।
—তুমি তো রোজই সুজয়ের, অনুক্ষণ; চব্বিশ ঘণ্টা। আমার কি আধঘণ্টারও হতে পারো না? সন্ধের পর থেকে তাহলে ঘরেই থাকব আমি। চলে এসো। ভীরু পায়রা; সাহসী হও। প্লিজ, ডু কাম!
—কাল ভোরে যাওয়াটা ক্যানসেল করতে পারবে তো? নইলে আমি মিছিমিছি—
—নো প্রবলেম। দেখানোর জন্যে সকালে অ্যাজ ইউজুয়াল এয়ারপোর্টে যাব। মনে হয়, ফ্লাইট ডিলে থাকবেই ফগের জন্যে। টিকিটে ‘ডিলেড’ লিখিয়ে নিয়ে ফেরত চলে আসব। কাল তো রবিবারও। সোমবার সকালের ফ্লাইটে বোম্বে পৌঁছে সোজা অফিস যাব। ডাইনারসের কার্ড সঙ্গে আছে। নো প্রবলেম। সোমবার আবার বোর্ড-মিটিং আছে। এসো, কালই তুমি এসো। আমি যাচ্ছি না কাল তাহলে। সোমবার ভোরে পৌঁছোতেই হবে।
পরমা আদুরে গলায় বলল, যেয়ো না! আমার জন্যেই যদি তুমি ওভাররেস্ট করো, তাহলে তোমার একদিনের হোটেলের বিল আমিই দেব। ইন অ্যাপ্রিসিয়েশন অফ…অর ফর ওল্ড টাইমস সেক।
অশেষ হাসল।
বলল, ফাইন! পরকীয়া প্রেম করলে তোমার মতো বড়োলোকের বউয়ের সঙ্গেই করতে হয়।
—যদি কেউ দেখে ফেলে?
—দেখলে দেখবে। অত ভয় করলে চলে না। একটাই জীবন পরমা। তোমার জন্যে আমার কষ্ট হয়; আমার স্ত্রী, মানে অরা-র জন্যেও হয়। অরা-ও ওর প্রথম প্রেমিক শ্যামলদাকে ভুলতে পারেনি। পুরো ব্যাপারগুলোই ফুলিশ। অথচ আমরা সকলেই মোর অর লেস হেল্পলেস।
একটু চুপ করে থেকে অশেষ বলল, তুমি ডিভোর্স নিতে পারো না?
—না! ও-কথা বোলো না। কুঁড়ি। কুঁড়ির জন্যে পারি না। ও-কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমি অত স্বার্থপর হতে পারি না।
—অরাও ঠিক এরকমই বলে। সোম-এর জন্যে। আমি ওকে বলেছিলাম, খুশি মনে ডিভোর্স দিয়ে দেব; যদি চায়। ও শ্যামলদাকে সত্যিই ভালোবাসে। তা হলেও অনেকই কমপ্লিকেশন। তার শ্যামলদাও বিবাহিত এখন। গ্রেট ফান। বাট, হাউ স্যাড। তাই না।
—আমাদের সন্তানেরা; কুঁড়ি আর সোম কি আমাদের এই স্যাক্রিফাইসের কথা মনে রাখবে বড়ো হলে? ওরা কি কখনো রিয়ালাইজ করবে, আমাদের একটাই জীবন আমরা শুধু ওদেরই মুখ চেয়ে কীভাবে নষ্ট করলাম! পুরোপুরি।
পরমা বলল।
তারপরই বলল, এই যে দ্যাখো, ওই বাড়িটা; আমার বাড়ি এসে গেল।
—ইয়া। প্রিয়ার বাড়ি অনেক দূরে; ভেবেছিলাম। পথ বেশি হলে ভালোই হত।
আরও কিছুক্ষণ তোমার কাছে থাকতে পারতাম।—ভেরি ফানি! না। তোমার বাড়ি। কানে লাগে কথাটা।
—স্বামীর বাড়ি, মানে শ্বশুরবাড়ি। এই-ই এখন আমার বাড়ি।
নামবার সময় অশেষ পরমার হাতে চাপ দিল। তাহলে কাল। এনি টাইম। আফটার সিক্স।
ভীষণ খুশি অথচ ভয়ার্ত কাঁপা গলায় পরমা বলল, আচ্ছা।
তিন
পিসু ‘ম্যান ওয়াচিং’ বইটা পড়তে দিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল অশেষ। গভীর ঘুম হঠাৎ ভাঙিয়ে দিয়ে ফোনটা পুটুর পুটুর করে শিলাবৃষ্টির মতো কানের মধ্যে বাজল।
এখন এমন সময়ে ফোন এলেই বড়ো ভয় করে অশেষের। বিশেষ করে যখন বোম্বের বাইরে থাকে ও। সোম-এর ইনফ্যানটাইল ডায়াবেটিস আছে। মায়ের শরীর খারাপ। তার ওপর বয়সও হয়েছে। ছোটোভাইয়ের সঙ্গে আন্ধেরিতে থাকেন মা। কখন কী খবর আসে?
গভীর রাতের টেলিফোনকে বড়ো ভয় ওর।
—ইয়েস। ভয় ভয় গলায় বলল, অশেষ।
—অ্যাই! সরি! তোমার ঘুম ভাঙালাম। আমি পরমা বলছি। সাবধানি ফিসফিসে গলায় পরমা বলল। যেন ও-প্রান্তে কেউ শুনতে না-পায়।
—কী হয়েছে? প?
উৎকন্ঠার গলায় অশেষ শুধোল।
—শোনো। তুমি না, কাল সকালে যাওয়াটা ক্যানসেল কোরো না। হ্যাঁ (! ) আমার খুব ভয় করছে। তা ছাড়া ড্রাইভারকেই-বা কী বলব? ট্যাক্সি করে তো কখনোই কোথাওই যাই না।
অশেষ হাসল চাপা গলায়।
—পাগলি! তুমি একটা রিয়্যালি পাগলি! তাহলে আমিই তোমার কাছে যাব। পর্বত মহম্মদের কাছে। নিয়ম তো তাই-ই।
—ইঃ। না না। কেলেঙ্কারি হবে। না না:।
—কেলেঙ্কারির ভয় করলে কখনোই কোনো কেলেঙ্কারি করা যায় না। তুমি এখনও ইমম্যাচিয়োরড আছ। কী চাও তা নিজেই জানো না। ভীরুরা কিন্তু জীবনে কিছুই পায় না।
—সত্যিই পারি না। আমি পারি না।
—তাহলে আমার সঙ্গে কাল চলো বোম্বে? যাবে? তোমাকে ওবেরয় টাওয়ার্সে রেখে দেব। মহারানির মতো। সাত দিন আমাদের জীবনে যত এবং যতরকম মজা, দু-জনেরই অ্যাকাউন্টে জমা আছে, যা তামাদি হয়নি এখনও তার সবটুকুই দু-জনে মিলে জমজমিয়ে চেটেপুটে খরচ করে তোমাকে আবার কলকাতায় তোমার স্বামীর কাছেই পৌঁছিয়ে দিয়ে যাব। নিজহাতে তোমাকে চান করাব, ভাত খাওয়াব। কি? কোনো মানুষ সাত দিনের জন্যেও কি হারিয়ে যেতে পারে না? জীবনের সমস্ত ক-টি দিনই তো হিসেবে বাঁধা। হিসেবের হাজার হাজার দিনের মধ্যে জীবনভর দিনগুলোর মাত্র সাতটি দিনও কি থাকতে পারবে না হিসেবের বাইরে? আমাকে দিলেই না-হয় অল্প ক-টা দিন। তুমি ক্ষয়ে যাবে না পরি। তোমাকে ফুরিয়ে দিলেও, নতুন করে ভরে দেব আবার।
—পাগল তুমি! কুঁড়ির স্কুল আছে। যা হয় না, তা হয় না। ওরকম করে বললে, বুঝি কষ্ট হয় না আমার?
—বুঝেছি।
—কী বুঝেছ?
—যা বোঝার?
—তুমি আবার কবে আসছ কলকাতায়?
অশেষ চুপ করে রইল।
—এই যে, শুনছ? শুনতে পাচ্ছ?
—জানি না। এলে, ফোন করব।
—যখনই করো, দুপুরে কোরো কিন্তু, বিটুইন টেন টু ফাইভ। আর শনি-রবি ছাড়া। ও থাকলে কিন্তু ঝামেলা করবে। ও তোমার মতো উদার নয়। ভেরি ভেরি মিন, পসেসিভ। আই হেইট হিম।
—ঠিক আছে। ডোন্ট হেইট এনিওয়ান।
—কী করব? আমি যে পারি না। লাভ আর হেইট-এর মধ্যে যে, অন্য কিছুই দেখি না আমি।
—ছাড়ছি।
—আমাকে একটা চুমু দাও, ফর ওলড টাইমস সেক।
অশেষ, আদুরে গলায় বলল।
চাপা হাসি হাসল পরমা। চু:! করে একটা আলতো শব্দ হল রিসিভারে। তারপর কাঁদো-কাঁদো গলায় ও বলল, রাখো ফোন।
—তুমি আগে।
অশেষ পুরোনো দিনের মতো বলল।
পরমা রিসিভার নামিয়ে রাখল।
অশেষও রিসিভার নামিয়ে, হাত বাড়িয়ে আলো জেলে বেড-সাইড টেবিল থেকে চিঠিটি তুলে নিল। কাল সকালে ওর ফ্লাইট টেক অফ করার পর এই চিঠিটি পরমার কাছে পৌঁছে দিতে বলবে ড্রাইভারকে; এই-ই ঠিক করেছিল।
একটা বড়ো হাই তুলতে তুলতে চিঠিটা খাম থেকে বের করে খুলল অশেষ।
নিজের লেখা চিঠি, নিজের চোখেই অচেনা বলে মনে হচ্ছিল। চিঠিটাই অচেনা নাকি ও নিজেই নিজের কাছে অচেনা?
প, কল্যাণীয়াসু।
আমার আজকে না গেলেই নয়। সোমবার ফ্লাইট কোনো কারণে ডিলেড হলে বোর্ড মিটিং অ্যাটেণ্ড করতে পারব না। মিটিং দশটায়। শার্প। ইন আ ম্যানস লাইফ। নাথিং ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান হিজ ওয়ার্ক।
পরের বারে এসে তোমাকে নিশ্চই ফোন করব। রাগ কোরো না।
আমাদের ‘জীবন’ বলতে বোধ হয় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবটাই একটা ডে-ইন ডে-আউট, মনোটোনাস, ডিসগাস্টিং অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত, দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস, মাস থেকে বছর, জীবন থেকে মৃত্যু, পুরোটাই একটা বিচ্ছিরি অভ্যেস। শুধুই রুজিরোজগারের, প্রতিযোগিতার; কামড়াকামড়ির।
আমরা রোবো হয়ে গেছি, পরমা। আটারলি গাটারলি রোবো।
আমাকে ক্ষমা কোরো।
ইতি তোমার অশি।
অশেষের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। ভাগ্যিস চিঠিটা রাতেই পাঠায়নি ড্রাইভারের হাতে।
পড়ার পর চিঠিটা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলল। পার্সের ভেতরের খাঁজে, যেখানে ‘ডাইনারস’ ক্লাবের কার্ডটা রাখে, সেইখানে পরমার একটি ছবি ছিল। দশ বছর আগের ছবি। ছবিটাকেও বের করল হাই তুলতে তুলতেই। চোখের খুব কাছে এনে দেখল একবার। জুহু বিচে দাঁড়িয়ে আছে পরমা। সাদা শিফন শাড়ি। মুক্তোর মালা ও ইয়ার টপ। মুক্তোর মতো হাসি।
চুমু খেল একটা। অনেকক্ষণ ঠোঁটটা চেপে থাকল; শেষবারের মতো দেখে নিল, তারপর কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে, ছেঁড়া চিঠিটার সঙ্গে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দিল।
নিজের জাগতিক উন্নতির জন্যে নিতান্তই প্রয়োজনীয় কিছু জাগতিক জিনিস ছাড়া সঙ্গে এই ‘স্পেস-এজ’-এ আর কিছুই রাখতে নেই। যতখানি ভারশূন্য করে রাখা যায় নিজেকে ততই ভালো। প্র্যাকটিকাল, প্রাগমাটিক কৃতী পুরুষ অশেষ ভাবল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
তারপর, হাত বাড়িয়ে আলোটা নিবিয়ে, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
অ্যালার্ম কল দিতে বলেছে ঠিক তিনটে পঞ্চাশ মিনিটে। উঠে পড়ে, দাড়ি কামাবে; চান করবে।
ততক্ষণে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত এয়ারপোর্টের ডিপারচার লাউঞ্জে দীর্ঘ সারি পড়বে অশেষ-এর মতো, করিতকর্মা, দ্রুতগতি, সুপারম্যান, হাই-ফ্লাইং মানুষদের।
মাইক্রোফোনে ভেসে আসবে…… প্লিজ. প্রসিড ফর সিকিউরিটি চেক…..
আরও একটি দিন শুরু হবে।
প্রেমহীন।
অবকাশহীন।
সময় সময়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে সময়কে ধর্ষণ করতে করতে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে আবর্তিত হবে। এয়ারবাস-এর পাইলট-এর গলা ভেসে আসবে ককপিট থেকে দরজা-বন্ধ প্লেনের মধ্যে ‘ক্যাবিন ক্রুজ., প্লিজ বি অ্যাট ইয়োর স্টেশনস ফর টেক অফ……ফর টেক—অফ প্লিজ……..