কোয়ানটম অভ সোলেস–সান্ত্বনার পরিমাপ
জেমস বন্ড বলল, বিয়ে যদি করি তো করব এয়ার-হোসেটেসকে, এই আমার বরাবরের ইচ্ছে।
ডিনার পার্টি শেষ হতে চলেছে। রাত তখন সাড়ে-নটা। অন্য দুই অভ্যাগতকে প্লেন ধরিয়ে দিতে গেছে গর্ভনরের এ.ডি.সি.। সু-সজ্জিত ড্রইংরুমের আরামদায়ক চেয়ারে বসেছিলেন গভর্নর আর বন্ড। আরামদায়ক চেয়ারে বসেও মোটেই আরাম পাচ্ছিল না বেচারী বন্ড। মনে মনে পছন্দ হাতলঅলা শক্ত কুশনের চেয়ার-এমন চেয়ার যাতে বসলে মাটিতে পা ঠেকে থাকবে। নরম সোফায় বসে তাই যুত হচ্ছিল না মোটই।
ন্যাসো জায়গাটাও মোটেই মনে ধরেনি বন্ডের। এ তল্লাটে বড় লোক ছাড়া যেন কেউ থাকে না। শীতকালে যারা বেড়াতে আসে, তারাও নিজেদের টাকার পাহাড়, অসুখ-বিসুখ আর চাকর-বাকরের সমস্যা ছাড়া আলোচনাই করে না। জমিয়ে আড্ডা মারতে জানে না কেউ। যে দু জনকে এই মাত্র এ.ডি.সি. প্লেনে চড়িয়ে দিতে গেল, তারাও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। মিস্টার এবং মিসেস হার্ভে মিলার টাকার কুমির। নিবাস কানাডায়। বউটা খুব সম্ভব ইংরেজ মেয়ে। কিন্তু এত বকবক করে যে কান ঝালাপালা করে দেয়। থিয়েটার নিয়ে বন্ডের কাছে আলোচনা করতে গিয়ে নিজেই বেকুব বনেছে। কেননা, দুবছর হল থিয়েটারের মঞ্চ চোখেও দেখেনি বন্ড। একবারই গিয়েছিল, তাও একজনের পিছু নিয়ে। ফলো করতে গিয়ে থিয়েটার দেখতে হয়েছিল।
বন্ডের অনুমান বেরসিক এই দম্পতাঁকে সঙ্গদান করার জন্যই বন্ডকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গভর্নর। নেহাত্ব কর্তব্য। সাতদিনও হয়নি এ অঞ্চলে এসেছে বন্ড। রুটিন মাফিক কাজ। কিউবাতে ক্যাসট্রেী বিদ্রোহীদের কাছে গোলাবারুদের এন্তার চোরাই চালান যাচ্ছে আশপামের রাষ্ট্র থেকে। আমেরিকা দু-জাহাজ হাতিয়ার ধরে ফেলতেই ক্যাসট্রোর। সমর্থকরা ঘাটি নিয়েছে জ্যামাইকা আর বাহামায়। বন্ডের ওপর ভার পড়েছিল এ ঘাঁটি ভেঙে দেওয়ার। ধরপাকড়ের ধার দিয়েও যায়নি ও। রাতের আঁধারে দু-জাহাজ হাতিয়ার পাচার বন্ধ করেছে অভিনব উপায়ে। পুলিশ লঞ্চে চেপে জাহাজে পৌঁছেছে। অন্ধকারে গা মিশিয়ে ডেকে উঠেছে। প্রতিটি ভোলা পোর্টহোলের মধ্যে দিয়ে এক-একটা থারমাইট বোমা ফেলে নিমেষে চম্পট দিয়েছে। দূর থেকে দেখা গেছে পানির ওপর অগ্নিদেবের প্রলয় নৃত্য। M-এর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে বন্ড, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে।
গভীর রাতের প্রচও অগ্নিকাণ্ডের হোত যে জেমস বন্ড স্বয়ং, এ তথ্য পুলিশ প্রধান আর সঙ্গী দু জন অফিসার ছাড়া আর কেউ জানে না। এমন কি গভর্নরকেও কিছু বলা হয়নি। ভদ্রলোক শান্তিকামী মানুষ, অশান্তি দিয়ে অশান্তি নিবারণের পন্থায় বিশ্বাসী নন। এই কারণেই বন্ডকেও তার মনে ধরেনি মোটেই। বন্ডের সূঙ্গে প্রথম করমর্দনের মধ্যেই বিতৃষ্ণাটা প্রকাশ করে ফেলেছেন। যে যাই বলুক, বন্ডের মত বিপজ্জনক লোকের সঙ্গে মাখামাখি করে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতটা তো নষ্ট করতে পারেন না গভর্নর!
কাজেই ভিজে ভিজে আসরকে একাই মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল গর্ভনরের এ.ডি.সি,। ডিনার শেষে বিরক্তিকর হার্ভে মিলার দম্পতাঁকে এয়ার পোর্টেও নিয়ে গেছে। ঠিক তখন, কথায় কথায় বন্ড বলে ফেলেছিল বউ করলে এয়ার হোস্টেসকেই বউ করা উচিত। উড়োজাহাজের এই সেবিকা মেয়েরা নাকি যাত্রীদের বড়ই আদর-যত্ন করে। আসলে, বিয়ে করে গোলাম হওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই বন্ডের। কফি এবং মদ্যপান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটি নেই। তাই সময় কাটানোর জন্যই এয়ার হোসটেস প্রসঙ্গ এনেছিল বন্ড।
গভর্নর চুরুটে ফের আগুন দিলেন, বললেন, আপনার মতই এয়ার-হোস্টেস-এর জন্য পাগল হয়েছিলেন ভদ্রলোক। সে কাহিনী শুনলে মন কাঁদে। শুনতে চান তো বলতে পারি।
গভর্নরকে কথা বলানোর সুযোগ পেয়ে লুফে নিল বন্ড। সোৎসাহে বলল, নিশ্চয়, বলুন না। বলে আর-এক পেগ। ব্র্যান্ডি নেবার উসিলায় সোফা ছেড়ে গিয়ে বসল হাতলঅলা উঁচু চেয়ারে।
চুরুটের নীলচে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে শুরু করল গভর্নর।
ধরুন তার নাম মাস্টার্স, ফিলিপ মাস্টার্স। কর্মজীবনে বলতে গেলে আমার সমসাময়িক। এক বছরের সিনিয়র ছিলাম আমি। অক্সফোর্ডে স্কলারশিপ নিয়ে পড়েছে। তারপর দরখাস্ত করেছে কলোনীয়ান সার্ভিসে চাকরির জন্য। খুব একটা ধূর্ত না হলেও প্রচণ্ড খাটতে পারত ফিলিপ। কথাবার্তায় মনে দাগ রাখত। কাজেই ইন্টারভিউ বোর্ডে মনোনীত হলও। প্রথমেই যেতে হল নাইজেরিয়া। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে গলাগলি বন্ধুত্ব হল দুদিনেই। নাইজেরিয়ার লোকদেরকে আপনজনের মত দেখেছিল বলে ভালবাসাও পেয়েছিল। স্থানীয় লোকদের এত কাছে টেনে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল ওর মনের একটা বিচিত্র গঠনের জন্য। ঐ বয়সের ছেলেরা হয় মেয়ে-পাগল। ফিলিপ কিন্তু হল নাইজেরিয়াবাসী পাগল। সমাজের মেয়েদের দিকে কোন নজরই ছিল না ওর। এমনিতেই মুখচোরা। নিজে আগুয়ান হয়ে মেয়ে পটানোর বিদ্যেতে নেহাতই নাবালক। পড়াশুনোর ফাঁকে সময়ও পায়নি। চাকরিতে ঢুকেও সেই হাল হল। অর্থাৎ আকর্ষণটা মেয়েদের দিকে না গিয়ে গেল স্থানীয় বাসিন্দাদের দিকে।
বন্ড বলল, আফ্রিকার মেয়েদের আবার বার্থ কনট্রোলে বড় অরুচি। সেদিকে আশা করি হুশিয়ার হয়েছিল ফিলিপ মাস্টার্স।
বন্ডের পাথির্ব ভাবনায় ব্যাজার হলেন গভর্নর। মুখে বললেন, যৌনতত্ত্ব নিয়ে কিন্তু এ গল্প আমি কঁদিনি। কাফ্রি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করার কথা কোনদিন কল্পনাই করেনি ফিলিপ। জোয়ান ছেলেদের মধ্যে যৌন অজ্ঞতা আজকাল হামেশা দেখা যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। সে আমলেও একরকম ছেলে দেখা যেত। যেমন ফিলিপ মাস্টার্স। শরীর মনে নিখুঁত পুরুষ, সুসভ্য নাগরিক। অথব মেয়ে পাগল নয় মোটেই।
ব্র্যাভিতে চুমুক দিল বঙ। গল্পটা জমেছে ভাল।
গভর্নর বললেন, নাইজেরিয়ার প্রথম শ্রমিক সরকারের আমলেই ফিলিপের চাকরি শুরু। লেবার গভর্নমেন্ট প্রথমেই পররাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে বসে। ফলে, নয়া গভর্নর আসে নাইজেরিয়াতে। অধিবাসীদের প্রগতি চিন্তার শুরুতেই গভর্নর অবাক হলেন ফিলিপকে দেখে। হোকরা সরকারী পুলিশের তোয়াক্কা না রেখে বহু আগে থেকেই স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে জমিয়ে বসেছে। খুব উৎসাহ দিতে লাগলেন গভর্নর। উঁচু পদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভারও দিলেন। ফিলিপের বদলির সময় হতেই এমন উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রশস্তি দিয়ে সুপারিশ করলেন যে এক ধাক্কাতেই ডবল প্রমোশন হয়ে গেল। ফিলিপ বারমুডায় বদলি হল অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পোস্টে।
বারমুডায় আমারই সহকারী হয়ে এল ফিলিপ। কিন্তু বারমুডা পৌঁছানোর আগের কাহিনীটা আগে বলে নিই। নাইজেরিয়া থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে আকাশপথে লন্ডন এল ফিলিপ। নাইরোবি থেকে ইম্পিরিয়াল এয়ারওয়েজ বি.ও.এ.সি.-র প্লেন সার্ভিস ছিল। ফিলিপের সেই প্রথম আকাশ-যাত্রা। মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার সময়ে একটু ভয় ভয় করেছিল। এয়ার হোসটেস একটা লজেন্স দিয়েছিল মুখে রাখতে। সিট-বেল্টাও এটে দিয়ে গিয়েছিল। তেমন বেশি যাত্রী ছিল না। একটু পরেই এয়ার-হোেসটেস ফিরে এল। মিষ্টি হেসে বলল, এবার খুলতে পারেন বেল্ট।
কিন্তু বেল্ট খুলতে গিয়ে চোখ মুখ লাল করে ফেলল ফিলিপ। মেয়েটির মিষ্টি রূপ দেখে প্রথম থেকেই মজেছিল বেচারা। অথচ যেচে আলাপ জমাবার সাহস নেই। অবস্থা দেখে মেয়েটি নিজেই হেঁট হয়ে খুলে দিল বেল্ট। জীবনে এত কাছে কোন যুবতাঁকে পায়নি ফিলিপ। ফলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হল আরক্ত-মুখে। মেয়েটি তাই দেখে মোহিনী হাসি হেসে বসল চেয়ারের হাতলে। জিজ্ঞেস করল কদ্দূর যাওয়া হচ্ছে কোত্থেকে আসা হচ্ছে। দেখতে দেখতে আলাপ জমিয়ে ফেলল এয়ার-হোসটেস। প্রায় সমবয়েসী এমন রূপসী চেহারার মেয়ের সঙ্গে এত সহজভাবে আলাপ করা যায় দেখে ফিলিপ নিজেই অবাক হল। আফ্রিকা সম্বন্ধে অনেক কথা শুনতে চাইল মেয়েটি। ফিলিপকে উপলব্ধি করিয়ে ছাড়ল যে ফিলিপ সামান্য লোক নয়।
ফলে, নিচের মেঘমালার দিকে তাকিয়ে উন্মনা হল ফিলিপ। এরকম নিখুঁত রূপ বড় একটা দেখা যায় না। নাতিদীর্ঘ তনু সুঠাম সুগঠিত। দুধে-গোলাপে মেশানো রঙ। ঝিকিমিকি চুল, ছিমছাম কায়দায় উঁচু করে বাঁধা। চেরী। ফলের মত টুকটুকে রঙ, হাসি-হাসি অধর। নীল-নীল চোখে কৌতুকোজ্জ্বল দুষ্টুমি। নাম রোডা লোয়োলিন।
রোডাকে নিয়ে আকাশ-পাতাল কল্পনায় মত্ত হল ফিলিপ। মুখ-চোরা ছেলেমাত্রই প্রেমে পড়লে স্বপ্নসৌধ রচনা করে মনে-মনে। ডিনারে নেমন্তন্ন করলে বা একসঙ্গে থিয়েটার দেখতে চাইলে রোডা মুখ বেঁকিয়ে না-বলে বসবে না। তো? এখনো দুটো দিন তো রোডার সঙ্গে কাটাতে হবে। তারপর? তারপর কি আর দেখা হবে? রোডার সাহচর্যের প্রত্যাশী নিশ্চয়ই অনেকেই। রোভা কি বিবাহিতা?
দুপুরের খাবার নিয়ে এল রোডা। ট্রে-টা দুই হাঁটুর ওপর রাখতে গিয়ে চুলের ঘষাটা লাগল ফিলিপের গালে। সেলোফেনের মোড়ক খুলে-খুলে কিভাবে খেতে হয়, দেখিয়ে দিল রোডা। কিভাবে স্যালাড ড্রেসিং-এর প্লাস্টিক ঢাকনি খুলতে হয়, তাও বুঝিয়ে দিল। সংক্ষেপে, ফিলিপকে নিয়ে এমন কাণ্ড করল যেন সে একটি খোকা, কিসসু জানে না।
আকাশ-যাত্রা শেষ হলে ঘামতে-ঘামতে ডিনার খাওয়ার নেমন্তন্ন জানাল ফিলিপ। ভেবেছিল হাসতে-হাসতেই তা প্রত্যাখ্যান করবে রোডা। কিন্তু কি সাংঘাতিক অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স! এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল রোডা। একমাস পরেই ছাড়ল ইম্পিরীয়ান এয়ারওয়েজের চাকরি। বিয়ে হয়ে গেল দু জনের। তারও এক মাস পরে ছুটি ফুরোতে বারমুডা রওনা হল ফিলিপ।
এই পর্যন্ত শুনে বন্ড বলল, আমার তো মনে হয় যে স্রেফ লোভে পড়ে ফিলিপ মাস্টার্সকে বিয়ে করেছিল রোডা। সমাজের উঁচু মহলে ওঠার লোভ, গভর্নরের টি-পার্টিতে রূপ দেখানোর আকাঙ্ক্ষা। গল্পের শেষে নিশ্চয় দেখা যাবে, বউ-হত্যা করেছে মাস্টার্স, তাই না।
না বললেন গর্ভনর। তবে ধরেছেন ঠিকই। উদ্দেশ্য নিয়েই ফিলিপকে বিয়ে করেছিল রোডা। আকাশে ওড়ার চাকরিতে বিপদ অনেক, ঝুঁকি অনেক। খুব সম্ভব সেই কারণেই চাকরি-জীবনে ইতি দিয়ে ঘর-সংসারে মন দিল রোডা। বারমুডা এসে হ্যাঁমিল্টনের উপকণ্ঠে বাংলো নিল। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। বিশেষ করে বোডার। তার প্রাণোচ্ছলতা, তার মিষ্টি মুখের কথায় বশ মানল সবাই। মাস্টার্স নিজেও যেন পালটে গেল। দেখে দুঃখ হত। বউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমসিম খেত বেচারী। জামাকাপড় ঝকঝকে রাখা, চুল চকচকে রাখা, সামরিক গোঁফ রেখে তাগড়াই চেহারা বানানো, ইত্যাদি বহুবিধ কষ্টকর ব্যাপার নিয়ে অষ্টপ্রহর সে কি প্রাণান্ত পরিশ্রম!
ছ মাস মহানন্দে কাটাল দুজনে। ওদের সুখ সবাইকেই সুখী করল। তারপর থেকেই শুরু হল গিন্নীর গজ গজানি। ককটেল পার্টি ফের কবে হবে? অমুকের স্ত্রী মার্কেটে যাবার সময়ে তাকে নিয়ে যায় সে নিয়ে যায়, না কেন? আর একটা পোমোশন না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চা হলে মানুষ করার সঙ্গতি কোথায়? সারাদিন একা-একা আর ভাল্লাগে না, ইত্যাদি। তারপর শোনা গেল, বউ-এর মন জোগাতে হামেহাল মেহন করছে ফিলিপ। সকালে উঠে বউকে সকালের নাস্তা এনে দেওয়া থেকে শুরু করে বিকালে বাড়ি ফিরে ঘর ঝাট, সিগারেটের ছাই আর চকোলেটের মোড়ক পরিষ্কার কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এমন কি সিগারেট আর মদ খাওয়া ছেড়ে দিল ফিলিপ। সাধু কারণে নয়-বউয়ের দামী পোশাকের পয়সা জোগাতে-নইলে অমুকের বউয়ের কাছে মান থাকছে না এয়ার হোসটেসের। কি করে যে বউকে খুশি করবে, দিনরাত তাই ভাবত ফিলিপ। শেষে ধরল গ। ডুবল এইতেই।
গলফ খেলা শিখতে শুরু করল রোডা। শেখায় ত্রুটি রইল না। ঘর্মাক্ত কলেবরে রোভার প্র্যাকটিসের বহর দেখে স্বয়ং গভর্নরও তারিফ করলেন বহুবার। তারপর এল একটা কমপিটিশন। রাডার জুটি হল যে, নামতার ট্যাটারসাল। বয়েসে ছোকরা। বড়লোকের ছেলে। দেখতে ময়ূরছাড়া কার্তিকের মত। ভাল সঁতারু। বজরা আর স্পীডবোটের মালিক। কাজেই বান্ধবীর অভাব নেই। এক শয্যায় চটপট না শুতে দিলে কোন মেয়েকেই বজরা, স্পীডবোট বা নাইট ক্লাবে নিয়ে যায় না। কাজেই কি চরিত্র বুঝতেই পারছেন।
রোডা আর ট্যাটারসাল বিস্তর খেটে জয়ী হল প্রতিযোগিতায়। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বউকে অভিনন্দন জানাল ফিলিপ। জীবনে সেই শেষ অভিনন্দন জানানো হল গিন্নীকে-কেননা পরের দিন থেকে ট্যাটারসাল ছোরার সঙ্গে উড়তে শুরু করল রোডা।
রেখে-ঢেকে নয়। খোলাখুলি ফিলিপের সঙ্গে শুরু হল ব্যভিচার। নিষ্ঠুর আঘাতের পর আঘাত দিয়ে চলল গোবেচারা স্বামীকে দগদগে ঘায়ের ওপর পর-পর খোঁচা মারতে তিলমাত্র দ্বিধা করল না রোডা। এমন কি ছলছুতোয় শোবার ঘরও আলাদা করে নিল–কারণ ফিরতে তো প্রায়ই রাত হয়। গিন্নীর জন্য রাত জেগে বসে না থেকে আলাদা ঘরে ঘুমিয়ে পড়লেই পারে ফিলিপ।
ঢি ঢি পড়ল সমাজে এক মাসের মধ্যেই। কেলেংকারী চরমে ওঠার আগেই গর্ভনরের স্ত্রী নিজে একদিন বোডাকে বোঝালেন। ফিলিপকেও শক্ত হতে বললেন। বাড়িতে ঝগড়া, কান্না রোজ রাতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। বউকে একরাতে। প্রায় গলা টিপেই মারতে গেল ফিলিপ। তার যে মুখ স্বর্গের সুখ ভাসত, বারমুডায় আসার বছর খানেকের মধ্যেই সে মুখে নরকের ছায়া দেখলাম। ফিলিপ বন্ধুবান্ধব কাউকে এ প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলতে দিত না–বলতে গেলই খেঁকিয়ে উঠত জখমী কুত্তার মত। একদিন বড় করে আমার মদ গেলালাম। কলতলায় গেল ফিলিপ। তারপরেই-ধড়াস করে কি যেন আছড়ে পড়ল। শুনেই দৌড়ালাম। দেখলাম, ক্ষুর দিয়ে কব্জির ধমনী কাটবার চেষ্টা করছে ফিলিপ।
আত্মহত্যার সেই প্রচেষ্টার পর সত্যিই আমরা ভয় পেলাম। গর্ভনরকে ধরলাম। তিনি বললেন, ফিলিপের চাকরিই থাকে কিনা সন্দেহ। কাজকর্ম তো গোল্লায় গেছে। সমাজেও তার বউ কেলেংকারী করে বেড়াচ্ছে। যাক, অনেক ধরাধরি করে ফিলিপকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হল মাস পাঁচেকের মেয়াদে নতুন কাজের ভার দিয়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাচলাম সবাই। রোডা মাস্টার্সের ব্যভিচার নিয়েও মাথা ঘামানো বন্ধ করলাম।
রুমাল বার করে কপাল মুছলেন গর্ভনর। হুইস্কি ঢেলে নিজে গলায় ঢাললেন। বন্ডকেও দিলেন। দেখা গেল স্মৃতির রোমন্থর করতে গিয়ে বিলক্ষণ উত্তেজিত হয়েছেন তিনি। মুখ লাল হয়েছে, চোখেও চকমকির ঝিকিমিকি দেখা। দিয়েছে।
বন্ড বলল, ভারি নষ্ট মেয়ে তো। পাকা স্বৈরিণী। পরে অনুতাপ জেগেছিল নিশ্চয়?
নতুন একটা চুরুট ধরিয়ে নিয়ে গর্ভনর বললেন, না। অনুতাপের অবকাশ ছিল না। সময় ভালই কাটছিল। তাল গাছের বালিতে শুয়ে কেলি করা থেকে শুরু করে স্পীডবোটে চেপে মাঝ দরিয়ায় গিয়ে রোমান্স করা–সবই তো হচ্ছিল, বেশিদিন এ আনন্দ নাও টিকতে পারে। রোডা কি তা জানত না? নিশ্চয় জানত। এ কথাও জানত যে, সে সময় এসে ফিলিপের কাছে চোখের পানি ফেলে নাকিসুরে কেঁদে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে খন। এখন তো মজা করে নেওয়া যাক। বাকি সময়টুকু কাটাবার জন্য দুদণ্ড ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য, জামাকাপড় পালটানোর জন্য স্বামীর বাংলো তো রইলই। ফিলিপ যদি বেঁকে দাঁড়ায় তো স্বামীর অভাব হবে না। আরো চটকদার স্বামী তুড়ি মারলেই পাওয়া যাবে গলফ ক্লাবে।
রোডার এই অহংকারকে যাচাই করার জন্যই যেন ট্যাটারসাল এবার সরে দাঁড়াল। গভর্নর আর তাঁর স্ত্রী ছোকরার বাপ-মাকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে, তাঁরা উঠতে বসতে মান্য করতে লাগল ছেলেকে। কেলেংকারীর কেচ্ছায় যে কান পাতা দায়। ট্যাটারসালও দেখল, গরমের ছুটি কাটাতে মার্কিন সুন্দরীরা আসছে দ্বীপে। এ সময়ে একটু মুখ না বদলালে মেজাজ আসছে না। রোডাকে অছিলা দেখাল। বাবা হাত খরচ বন্ধ করে দেবে ভয় দেখিয়েছে। কাজেই আজ থেকে মেলামেশা বন্ধ। রোড টু শব্দটি করল না। ওতো জানত, এ ঘটনা একদিন-না-একদিন ঘটবেই। ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে এল গভর্নরের বউয়ের কাছে। কথা দিল এবার থেকে ফের ঘর-সংসারে মন দেবে। ফিলিপকে সুখী করবে। বাড়ি বসে রোজ মহড়া দিতে লাগল, ফিলিপ ওয়াশিংটন থেকে দিন পনের পরে ফিরলেই কিভাবে অনুতাপের কান্না কাঁদতে হবে। কি কি সাজানো কথা বলতে হবে। এয়ার হোসটেস সুলভ মিছরী ভিজানো গলায় সোহাগ চাইবে। আবার জোড়া বিছানা পাতবে ইত্যাদি।
ফিলিপ মাস্টার্স বাড়ি ফিরল সেই সময়ে।
থামলেন গর্ভনর। তারপর বললেন, আপনি বিয়ে করেননি। সব নর-নারীর সূত্রের যোগ কিন্তু একটা জায়গাতেই ঠেকে আছে। বিবাহিত জীবনে সব অপরাধ ক্ষমা করা যায়। এমন কি খুন করার ক্ষমাও পাওয়া যায় কিন্তু মনুষ্যত্বের অভাব ঘটলে বিবাহ ভেঙে যায়। কয়েকশ দম্পতির ক্ষেত্রে আমি একই কাণ্ড দেখেছি। একজন অসুস্থ না সুস্থ, জীবিত মৃত, মানবিকতার এই সহজ অনুসন্ধিৎসাও যখন অপর জনের মধ্যে জাগে না, সহজতম মনুষ্যত্বের যখন এইভাবে মৃত্যু ঘটে, বিবাহ তখন ভাঙতে বাধ্য। ল অভ দি কোয়ানটাম অভ সোলেস নাম করণ করেছি এই থিয়োরীর।
বন্ড বলল, ভারি চমৎকার নাম তো। মনে দাগ রেখে যায়। কোয়ানটাম অভ সোলেস স্বাচ্ছন্দ্যের পরিমাপ। বন্ধুত্ব না প্রেম টিকে থাকে শুধু এই আরামের পরিমাপের ওপর। মানুষ এই আছে এই নেই। পরস্পরের প্রতি দরদ যখন শূন্য হয়, মৃত্যুকামনা তার জায়গা নেয়–কোয়ানটাম অভ সোলেস দাঁড়ায় শূন্যের ঘরে।
গর্ভনর বললেন, ফিলিপ মাস্টার্স, যে মুহূর্তে বাংলোর চৌকাঠ পেরোচ্ছে। সেই মুহূর্তে কেউ তার বউকে হুঁশিয়ার করে দিলে ভাল হত। ওপর ওপর দেখেও কিছু বোঝেনি রোডা। যদিও ফিলিপের সে গোঁফ আর নেই, চুল আবার আগের মতই উস্কখুস্ক। চিবুকের রেখা শক্ত। রোড়া সাদাসিধে একটা ফ্রক পরে বই নিয়ে বসেছিল। রোডা এমনভাবে বসেছিল যাতে ফিলিপ ঘরে ঢুকলেই বই থেকে চোখ তুলবে বোডা। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না। যেন সাত চড়ে রা টি নেই মুখে। এমনি বিনীতভাবে তাকিয়ে থাকবে। ফিলিপ আগে কথা বললে রোড়া উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়াবে। স্বাগত জানিয়ে একে একে সব খুলে বলবে আর অঝোরে কাঁদবে। ফিলিপ তখন ওকে বুকে টেনে নেবে। প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাবে রোন্ডা। জীবনে আর হ্যাঁন করব না ত্যান করব না।
হুবহু সেইভাবেই বোবা চোখে বই থেকে মুখ তুলল রোডা। ফিলিপ নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল ম্যান্টল পিসের সামনে। আনমনা চোখে চাইল রোডার দিকে। উদাসীন শীতলতা ছাড়া আর কিছু নেই চোখে। পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বার করে বলল, এ বাড়ির প্ল্যান। দু ভাগ হল বাড়ির ঘরদোর। তোমার, তোমার ভাগে রান্নাঘর আর তোমার শোবার ঘর। আমার ভাগে এই ঘর-আর বাড়তি শোবার ঘর। আমি যখন থাকব না তখন বাথরুমে যেতে পার। কাগজটা রোডার খোলা বইয়ের ওপর ফেলে–আমার ঘরে আর কখনো ঢুকবে না। আমার বন্ধু-বান্ধব এলে অবশ্য আসবে। রোড়া কিছু বলার আগেই ফিলিপ বলল, প্রাইভেটে তোমার সঙ্গে আমার এই শেষ কথা। এরপর তুমি কথা বললেও আমি জবাব দেব না। কিছু বলবার থাকলে চিরকুট লিখে কলতলায় রেখে দেবে। ঘড়ি ধরে খাবার দাবার যেন পাই ডাইনিং রুমে। আমার খাওয়ার পরে তুমি ডাইনিং রুমে আসবে। ঘরসংসার দেখার জন্য মাসে কুড়ি পাউন্ড তোমায় দেব। এ টাকা প্রতি মাসের পয়লা তারিখে আমার অ্যাটনীর মারফত পাবে। তোমাকে আমি ডিভোের্স করছি। একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ তোমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ সাজিয়ে কেস খাড়া করে দিয়েছে। বারমুডায় আমার মেয়াদ ফুরোবে আর এক বছর পরে। আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ শুরু হবে এখন থেকেই। এই এক বছর সবার সামনে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মতই অভিনয় করতে হবে।
কথা শেষ করে পকেটে হাত গুঁজে বিনয় কোমল চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল ফিলিপ। রোডার চোখে তখন অশ্রুর ধারা বইছে। নির্বিকার গলায় ফিলিপ বলল, যদি বিশেষ কিছু বলবার থাক বলতে পার। নইলে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের বলতে যা কিছু আছে সঙ্গে নিয়ে যাও–ডিনার খাব রোজ রাত আটটায়। এখন সাড়ে সাতটা বাজে।
থামলেন গভর্নর। চুমুক দিলেন হুইস্কিতে। বললেন, রোডা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কান্নাকাটি, মিনতি, অনুরোধ কিছুই কাজে লাগেনি। ফিলিপ কিন্তু অটল। শেষকালে রাজি হতেই হল রোডাকে। সঙ্গে কানাকড়িও নেই। দু বেলা খাওয়া আর রাত্রে মাথা গোঁজার জন্য এ প্রস্তাব মেনে নিতে হল। তারপর ফিলিপ কাজে ডুবে গিয়েছিল। আগের মতই তুখোড় কর্মবীর হওয়ার জন্য সবাই খুশি হয়েছিল। যাক, একটা সুখী দম্পতির সুখ তাহলে ফিরে এসেছে।
এক বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। ফিলিপের বদলির সময় এল। বহু বিদায় সম্বর্ধনায় স্বামী স্ত্রী হাজির হল যুগলে। ফিলিপ সবার কাছে বলল, রোডা জিনিসপত্রের বিলি ব্যবস্থা করে পরে যাবে। কিন্তু জাহাজে ফিলিপকে উঠিয়ে দিতে রোডা আসেনি দেখে অবাক হয়েছিলাম। ফিলিপ জানালেন, শরীর খারাপ, তাই আসেনি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের খবর ইংল্যান্ড থেকে বারমুডায় এল। গভর্নরের স্ত্রীর কাছে হাউমাউ করে যোডা প্রথম সব কথা ফাঁস করল। ফিলিপের সর্বশেষ মারের কথাও বলল ফোঁপাতে ফোঁপাতে।
হুইস্কিতে ফের চুমুক দিলেন গভর্নর, যেদিন বারমুড়া ছেড়ে যাচ্ছে ফিলিপ সেই দিনই কলতলায় গিয়ে রোডার লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেছে কলতলায়। ফিলিপ ছিঁড়ে কুচিকুচি করে রেখে দিয়েছে বেসিনের তাকে। সেবার চিরকুটের ওপর ছিল, সন্ধ্যে ছ টায় বসবার ঘরে তার দেখা পাওয়া যাবে। যথাসময়ে রান্নাঘর থেকে চুপিসাড়ে ঘরে ঢুকল রোডা। আবেগ দিয়ে আগেই অনেক চেষ্টা করেছিল রোড়া স্বামীকে টলানোর, কিন্তু বৃথা। তাই মিনমিনে গলায়, কাছে মাত্র দশ পাউন্ড রয়েছে, ফিলিপ গেলে খাবে কি?
আমার দেওয়া জড়োয়া গয়না আর ফার বেঁচে দিও।
খুবজোর পঞ্চাশ পাউন্ড হবে তাতে।
গতর খাঁটিয়ে রোজগার কর।
কাজ খুঁজতে সময় তো লাগবে। থাকব কোথায়? পনের দিনের মধেই এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। উপোস করে থাকব আমি?
ফিলিপ ঠাণ্ডা চাহনিতে বলল, তুমি রূপসী, উপোস কখনও করতে হবে না।
ফিলিপ, একটু দয়া কর। গভর্নমেন্ট হাউসে গিয়ে ভিক্ষে করলে কি তোমার মুখোজ্জ্বল হবে?
দু চারটে টুকিটাকি জিনিস ছাড়া বাড়িতে নিজস্ব কিছুই ছিল না। ফার্নিচার সমেত ভাড়া নেওয়া বাংলো। আগের সপ্তাহ লিস্ট মিলিয়ে গেছে ফার্নিচারের। ফিলিপের নিজস্ব বলতে ছিল শুধু একটা পুরোনো মরিস গাড়ি আর রেডিওগ্রাম। বউয়ের চিত্তবিনোদনের শেষ চেষ্টা এই রেডিওগ্রাম। এইটা কিনে দেওয়ার পরেই গল খেলায় মাতে রোড়া।
গিন্নীর দিকে শেষবারের মত তাকাল ফিলিপ। বলল, বেশ, গাড়ি আর রেডিওগ্রাম তোমাকে দিলাম। গুড বাই, বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
বন্ডের দিকে তাকালেন গভর্নর। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন, ভাবছেন, বিদায়কালে ফিলিপ উদারতা দেখিয়ে গেল, তাই না? শুনুন তাহলে। ফিলিপ বারমুড়া ছেড়ে যেতেই রোডা গয়না আর ফার নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে পুরোনো জিনিসপত্র বেচাকেনার দোকানে গেল। গয়নায় পেল চল্লিশ পাউন্ড আর ফারের বদলে সাত পাউন্ড। গাড়ি বেচতে গিয়ে দেখা গেল, ফিলিপ গাড়িটা কিনেছে হায়ার পারচেজ চুক্তিতে। অর্থাৎ মাসে মাসে টাকা দিতে হচ্ছে তাও কয়েক মাসের টাকা বাকি। সব মিলিয়ে দু শ পাউন্ড হবে। ফিলিপকে উকিলের চিঠি দেওয়া হয়েছে শুনেই রোড়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। গাড়ি বেচা তো দূরের কথা দুশ পাউন্ডের দেনার দায়ে পেট্রোল সমেত গাড়ি ছেড়ে আসতেই সে রাজি। কিন্তু তা নিয়ে তো দুশ পাউন্ড ওঠে না। কোর্টে মামলা উঠবেই। ফিলিপের দেনার দায়ে রোডাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। যাক, অনেক কথা কাটাকাটির পর রোডা রেহাই পেল। এবার রেডিগ্রামের দোকান। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। এই বস্তুটিও কেনা হয়েছে দফায় রফায় টাকা দেবার শর্তে। দেনা সেখানেও। অতিকষ্টে সেখানেও একটা রফায় এল রোডা। রেডিওগ্রাম তো গেলই নগদ দশ পাউন্ডও গেল। বাড়ি ফিরে সারাদিন মুখ গুঁজে কাঁদল রোডা। তার দর্প চূর্ণ হয়েছে। বিদায়কালেও ফিলিপ লাথি মেরে গেল।
একটু থেমে গর্ভনর বললেন, মানুষ মানুষকে যত ঘৃণাই করুক, যত অপছন্দই করুক আরাম বা সান্ত্বনা পেলেই সব ভুলে যায়। যার নাম দিয়েছি কোয়ান্টাম অভ সোলেস। সেই জিনিস খানিকটা ফিলিপকে দিলেই রোডার সাতখুন মাপ করে দিত ফিলিপ। কিন্তু নৃশংস ব্যবহার, নিষ্ঠুর আচরণ, নির্মম ঔদাসীন্য ছাড়া সে কিছুই পায়নি বোডার কাছে। অন্তর কতখানি বিষিয়ে গেলে মানুষ অতটা নির্মম হতে পারে। পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার চরমতম নমুনা দেনা সমেত রেডিওগ্রাম আর গাড়িটা রোডাকে দিয়ে যাওয়া। ফিলিপ যখন নেই, তখনও যাতে ফিলিপের ঘৃণা রোডাকে দগ্ধে দগ্ধে মারে তার সুচারু ব্যবস্থা, নিখুঁত ফন্দি।
বন্ড বলল, ঘৃণার বিষে অন্তর নীল হয়ে গেলে এমনিই হয়। দুঃখ হচ্ছে মেয়েটার জন্য। তারপর কি হল?
উঠে দাঁড়ালেন গভর্নর, রাত বারোটা বাজে। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই। যেতে যেতে বলছি। ফিলিপের কি হল আগে শুনুন। চাকরিতে আগের মত মনপ্রাণ ঢেলে দিল কিন্তু আগের মত আর নাম হল না। রোজা তার মনকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মানবিকতা জিনিসটা মুছে গিয়েছিল মন থেকে। তাই কিছুদিন পরেই সে অবসর নিয়ে ফিরে গেল তাদের কাছে যাদের কাছে সে ভালবাসা পেয়েছিল, যেখান থেকে এই কাহিনীর শুরু–সেই নাইজিরিয়ান।
মেয়েটার?
অবস্থা খুবই শোচনীয় হল। শুধু দাক্ষিণ্যের ওপর আর কতদিন চলে। আবার এয়ার হোসটেস হবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু অভব্যভাবে চাকরি ছাড়ার ফলে সে দরজাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রূপ ভাঙিয়ে কিছুদিন রক্ষিতা হিসেবেও ছিল অনেকের কিন্তু বারমুডায় বার কয়েক হাতবদল হবার পর রূপোজীবীকে সাধারণ স্বৈরিণীর পর্যায়ে নামতেই হবে। রোডার সেই অবস্থা হল। পুলিশের নেক নজর পড়ল তার ওপর। ঠিক তখন বিধাতা আবার সদয় হলেন তার ওপর। দেখলেন অনেক সাজা পেয়েছে মেয়েটা, তাই গভর্নরের স্ত্রীর দয়ায় একটা চাকরী জুটল জ্যামাইকায়। হোটেল রিসেপশনিস্টের কাজ। বড় হোটেল। বহু ধনীর আবির্ভাব ঘটে সেখানে। এখানে এলেন একদিন কানাডার এক কোটিপতি। শীতকাল কাটিয়ে দেশে ফিরবার সময় রোডাকে কানাডায় নিয়ে বিয়ে করলেন। রোডা এখন তার সহধর্মিনী।
দারুণ কপাল তো। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া।
ঠিক তা নয়। জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। ফিলিপের অনেক ক্ষতিই করেছে রোডা। তার সাজাও পেয়েছে। আসলে দায়ী হল ফিলিপের বাবা মা। ছেলেকে তারা ভঙ্গুর করে গড়েছিল। তাই ধাক্কায় গুঁড়িয়ে ফের মজবুত হয়েছিল ফিলিপ। রোডাকে বিধাতা পাঠিয়েছিলেন ওকে শক্ত করার জন্যই। রোড নিমিত্তমাত্র। যাক, রোডা এখন সুখী। তার স্বামীও সুখী। আজ রাতে তাদের মুখ আপনিও দেখেছেন।
বন্ড হেসে বলল, ধন্যবাদ এই গল্পের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। মিসেস হার্ভে মিলারকে আমি সইতে পারছিলাম না কিছুতেই। এ কাহিনী শোনাবার পর তাকে কোনদিন ভোলা যাবে না। আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছেন আমাকে। আজ থেকে আর কাউকে অবজ্ঞা করব না।
করমর্দন করে বন্ড বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হোটেলে যেতে যেতে ভাবতে লাগল আগামীকালের কন্ফারেন্সের কথা। মিটিং আছে মিয়ামীর উপকূল প্রহরী আর গোয়েন্দা দপ্তরের সঙ্গে। একদিন এসব ভালই লাগত, রোমাঞ্চ বোধ হত। কিন্তু এখন সব কিছুই নিরর্থক, একঘেয়ে মনে হল।
.
হিলডাব্রান্ড একটি দুষ্প্রাপ্য মাছ
গভীর পানির জগতের স্ট্রিঙ-রে মানেই মূর্তিমান বিভীষিকা। ভোঁতা নাক থেকে মারাত্মক লেজ পর্যন্ত লম্বায় দশ ফুট। এক পাখনার ডগা থেকে আর এক পাখনার ডগা পর্যন্ত ছ ফুট। গাঢ় ধূসর রঙ। ঈষৎ বেগুনী আভা মেশানো সোনালি বালির বুক থেকে উঠে কিছুদূর সাঁতরে যেতেই দূর থেকে মনে হল যেন একটা কারো ভোয়ালে ঢেউয়ের তালে ভেসে ভেসে যাচ্ছে।
কৃত্রিম পাখনা লাগিয়ে সাতরাচ্ছিল বন্ড। চোখ স্ট্রিঙ-রের ওপর। খাবার দরকার না হলে মাছ মারে না বন্ড। কিন্তু স্ট্রিঙ-রেকে সে মারবেই। কারণ স্ট্রিঙ-রে সত্যিই শরীরী আতংক।
এপ্রিল মাস। সকাল দশটার মিঠে আমেজ আকাশে বাতাসে। সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের মাহে দ্বীপের একটি অগভীর হ্রদে, হারপুন বন্দুক নিয়ে নেমেছে বন্ড। চোখের আড়াল করছে না স্ট্রিঙ-রেকে। ও জানে, একটু পরেই ক্লান্ত হয়ে ফের বালিতে ঢুকে ঝিমোবে। পানির তলে ঐ মূর্তিমান বিপদ।
ছায়ামায়ায় আগুনের মত জ্বলছে ভারত মহাসাগরের দানবাকার অ্যানিমোন গুল্ম। ঝিকিমিকি করছে হীরে মানিকের মত মাছের দল। প্রবাল স্তূপের সেকি বাহার। বন্ডের চোখ কিন্তু এসব নিয়ে আর তন্ময় নয়। স্ট্রিঙ-রে নীল দর্পণের মত শান্ত পানিতে ঢেউ তুলে ফিরেছে জিরোবে বলে। অতি সন্তর্পণে মাথা তুলল বন্ড। গগলস্-এর পানি বার করে তাকাল সামনে। কিন্তু স্ট্রিঙ-রেকে আর দেখা গেল না।
ডগায় ক্ষুদে ত্রিশূল গাঁথা শক্তিশালী হারপুন বাগিয়ে এবার শুরু হল ড্রিঙ-রেকে খোঁজার পালা। এগোতে হচ্ছে খুব সাবধানে। পানি তোলপাড় হলেই আবার উধাও হবে ট্রিঙ-রে। আবছা অন্ধকারে অন্য বিপদের আশঙ্কাও করছে বন্ড। অবশ্য পানিতে রক্ত মিশলেই হাঙর জাতির আগমন সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তা না হলে–
আচমকা মসৃণ বালির ওপর দুটি মাত্র ফুটো দেখল বন্ড। নাকের গর্তের মত দুটি ছিদ্র। গর্ত ঘিরে থির থির করে। বালি কাঁপছে। গর্তের ঠিক পেছনেই বালি খানিকটা উঠে রয়েছে–অর্থাৎ স্ট্রিঙ-রের লুকানো দেহ। ল্যাজের ধাক্কাটা কোনদিকে আসতে পারে হিসেব করে নিল বন্ড। তারপরেই হারপুন বন্দুক নামিয়ে টিপল ট্রিগার।
ওপর দিকে বালি লাফিয়ে উঠল। সেকেন্ড কয়েক কিছুই দেখা গেল না। পরক্ষণেই টান টান হল হারপুনের দড়ি। ঐতো ড্রিঙ-রে। বিষাক্ত পাখনা নেড়ে পালাচ্ছে হারপুন গাথা শরীর নিয়ে। বিষযুক্ত যে পাখনায় মৃত্যু ঘটেছে ইউলিসিসের। যার ধাক্কায় আস্ত গাছ সুদ্ধ উপড়ে আসতে পারে, যার একটিমাত্র ঝাঁপটায় ভারত মহাসাগরের বিষ। ছড়ানো পানিতে মৃত্যু অনিবার্য–তার ছোঁয়াচ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে রইল বন্ড। এককালে স্ট্রিঙ-রের ল্যাজ দিয়ে দাস ব্যবসায়ীরা চাবুক বানাতো। সিসিলিতে এ চাবুক রাখা বেআইনি হলেও ঘরে ঘরে তা আছে, ব্যভিচারিণী স্ত্রীদের শায়েস্তা করার জন্য। মারাত্মক সেই ল্যাজের ঝাঁপটা যেন ক্রমশ কমে আসছে। অগভীর পানিতে এসে আচম্বিতে শূন্যে লাফিয়ে উঠল স্ট্রিঙ-রে, আছড়ে পড়ল বালির ওপর। রোদ্দুরে সাদা পেট উল্টে খাবি খেতে লাগল অতিকষ্টে।
যমালয়ের পথ দেখতে পেয়েছে স্ট্রিঙ-রে। কিন্তু ভারি মাছটাকে নিয়ে বন্ড এখন করে কি?
খাকী শার্ট আর ট্রাউজার্স পরা বেটেখাটো মোটাসোটা একটা লোক হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল তালগাছের ছায়া থেকে। বলল, সাবাস, মিঃ জেমস বন্ড।
বন্ড বলল, ফাইডেল, এ ব্যাটা তো দেখছি সহজে মরবে না। হারপুনটা গায়ে গেঁথে রয়েছে। কাউকে পাঠিয়ে দেবেন? কাহাতক দাঁড়িয়ে থাকা যায়।
ভাগ্যিস ঠিক জায়গায় হারপুন মেরেছেন। নইলে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে পাথরে আছড়াতো আপনাকে। যাক, লোক পাঠাচ্ছি আপনার হারপুন উদ্ধারের জন্য। ল্যাজটা দরকার না কি?
হেসে ফেলল বন্ড, নিয়ে করবে কি? ঘরে বউ তো নেই।
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিল ফাইডেলের স্টেশন ওয়াগন। সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে প্রায় সবকিছুই বার্বে ফ্যামিলির দখলে। বার্বে এদের কনিষ্ঠতম কুবের। গাড়ির দিকে যেতে যেতে সে বলল, মিলটন ক্রেস্টের নাম শুনেছেন? মার্কিন কুবের। ক্রেস্ট হোটেল গ্রুপের মালিক। ক্রেস্ট ফাউন্ডেশনের কর্ণধার। এমন একখানা বজরার মালিক যার জুড়ি সারা ভারত মহাসাগরে নেই। নাম ওয়েভক্রোস্ট। দেখবার মত বজরা। সুন্দরী বউ থেকে পেল্লায় ট্রানসিসটর গ্রামোফোন পর্যন্ত, সবই আছে ঐ বজরায়। আগাগোড়া এয়ারকন্ডিশন করা। দামী কার্পেট পাতা ব্রেক ফাস্টে প্যারিসের সেরা শ্যাম্পেন। আরে মশাই কি যে নেই সেখানে তাই ভাবি। মিস্টার ক্রেস্ট বজ্জাত হলেন তো বয়ে গেল। বজরাটা তো আরাম দেয়।
আরাম দিক, না দিক তাকে আমার কি?
মাই ফ্রেন্ড, মিস্টার ক্রেস্টের সঙ্গে দিন কয়েক হাওয়া খেতে বেরোচ্ছি। আপনিও আসছেন। ডাকসাইটে সুন্দরী মিসেস ক্রেস্টও থাকছেন। যাচ্ছি শাগ্রিন দ্বীপে। বছর পাঁচেক ও তল্লাটে যেতে পারিনি। ক্রেস্টের খুব শখ হয়েছে যাবার। ভদ্রলোকের নাকি সামুদ্রিক নমুনা সংগ্রহের বাতিক। ফাউন্ডেশনের ব্যাপার। শানি দ্বীপে এমন কতকগুলো মাছ পাওয়া যায় যা নাকি দুনিয়ার আর কোথায়ও পাওয়া যায় না। রগড় কম নয় দেখে নিয়ে যাচ্ছি ওদের পথ দেখিয়ে।
রগড় জমবে ভালই। কিন্তু আমাকে টানাহ্যাঁচড়া কেন?
একঘেয়ে দিনগুলো আর কাটাতে পারছিলাম না বলে। ক্রেস্টকে শুনিয়ে দিলাম, আপনার মত দুদে ডুব সাঁতারু বড় একটা চোখে পড়ে না। শুনেই লাফিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। জানতাম আপনি এখানেই আছেন, শেষকালে একজন জেলের কাছে জানলাম, কে একজন ডাকাবুকো সাদা চামড়া নাকি আত্মহত্যার মতলব এটে সমুদ্রে ডুব দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম আপনিই সেই আত্মঘাতী পুরুষ।
অট্টহাসি হেসে বন্ড বলল, বুঝি না এরা কেন সমুদ্রকে এত ভয় পায়। সাঁতার জানে এমন সিসিলি সুন্দরীও মেলা ভার।
রোমান ক্যাথলিক তো। খালি গা হতে চায় না। আপনাকেও বলি, উপোষী হাঙরের পাল্লায় পড়লে মজাটা টের পেতেন। পাথুরে মাছ মাড়ালে তো কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে ধনুকের মত দেহ তেউড়ে যেত সাংঘাতিক যন্ত্রণায়।
বন্ড বলল, জুতো পরলে বা পায়ে ন্যাকড়া জড়ালেই পাথুরে মাছকে টেক্কা মারা যায়।
মাসখানেক আগে বন্ডকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন M। হুকুম দিয়েছিলেন সিসিলি যেতে। বলেছিলেন, মালদ্বীপের জাহাজ ঘাঁটিতে বড় অশান্তি দেখা দিয়েছে। সিংহল থেকে কম্যুনিস্ট আসছে। ফলে স্ট্রাইক আর স্যাবোটাজ লেগেই আছে। যন্ত্রপাতি তছনছ হচ্ছে গোপনে। হয়ত ঘাঁটি সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে সিসিলিতে। জায়গাটা হাজার মাইল দক্ষিণে হলেও নিরাপদ। তা সত্ত্বেও একটা রিপোর্ট দেওয়া দরকার। তাই তোমায় পাঠাচ্ছি। বছর কয়েক আগেও কিছু গোলমাল ছিল ওখানে। জাপানি জেলে নৌকা। ইংল্যান্ডের দাগাবাজ, ফ্রান্সের সঙ্গে আঁতাত। যাক, গিয়ে দ্যাখ। নিরপেক্ষ রিপোর্ট পাঠাও। আর হ্যাঁ, বেশি রোদ লাগিও না। সর্দিগর্মি হবে।
দিন সাতেক আগেই রিপোর্ট লেখা শেষ করেছে বন্ড। লিখেছে, জায়গাটা সত্যিই নিরাপদ। তুলকালাম কান্ড ঘটতে পারে শুধু একটি কারণে। সে কারণটি হল, সিসিলি সুন্দরীদের ভুবনমোহিনী রূপ। পাওয়া যায় অঢেল–চাইলেই হল।
রিপোর্ট শেষ। হাত খালি। এখন কবে কাম্পালা জাহাজে মোম্বাসা যাওয়া হবে, তারই প্রতীক্ষা। গরমে প্রাণ আইঢাই করলেও রেহাই নেই।
বার্বে ভবনেই ডেরা নিয়েছিল বন্ড। সাতটা দিন কেটেছে তালকুঞ্জে আর সমুদ্র গোসল নিয়ে। সাঁতারের পোশাক ছেড়ে মালপত্র নিয়ে ওখান থেকেই দু জনে রওনা হল ক্রেস্টের বজরা অভিমুখে। দূর থেকে ওয়েভক্রেস্ট-কে দেখে আহামরি কিছু মনে হয় না। বন্ডের পাকাচোখ কিন্তু এক পলকেই বুঝেছিল। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেবার উপযুক্ত এ জাহাজ। দারুণ মজবুত। পলকা বজরা নয় মোটেই।
ডেকে উঠে বসবার ঘরে ঢুকল বন্ড। হিমেল হাওয়ার গা যেন জুড়িয়ে গেল। দামী দামী আসবাবপত্রে ঘর ঠাসা। এ ঘর যেন জাহাজে মানায় না–মানায় রাজপ্রাসাদে। নীলচে কার্পেট, রূপালী দেওয়াল। সাদাটে কড়িকাঠ। মস্ত গ্রামোফোনের পাশেই সাইনবোর্ডে থরে থরে সাজানো মদিরা সম্ভার। মাঝের টেবিলে হায়াসিনথ-এর গুচ্ছ! ম্যাগাজিনের স্তূপ।
কিহে জেমস্, কি বলেছিলাম?
বন্ডের চোখে অকৃত্রিম তারিফ সত্যিই এমন না হলে সাগরে অভিযান মানায়! হাওয়া কত তাজা দেখেছেন!
এ হাওয়া টিনভর্তি বাসি হাওয়া। তাজা হাওয়া পাবেন বাইরে।
কথাটা মিলটন ক্রেস্ট বললেন। কখন যেন ঘরে এসেছেন ভদ্রলোক। বছর পঞ্চাশ বয়স, মজবুত গড়ন, ফিকে বাদামী চোখ। ঢুলুঢুলু চোখে অপরিসীম তাচ্ছিল্য। কথা বলার ধরনে গা পিত্তি জ্বলে যায়। হামফ্রি বোগার্টের কণ্ঠস্বর মনে করিয়ে দেয় তার কণ্ঠস্বরে। ডানবাহুতে আঁকা উল্কি–নোঙরের ওপর উড়ছে ঈগল পাখি। বন্ড মনে মনে বলল, হেমিংওয়ে হবার ইচ্ছেও আছে কিন্তু আমার সঙ্গে জমবে না মোটেই।
কার্পেট মাড়িয়ে এসে হাত বাড়ালেন ক্রেস্ট আপনার নাম বন্ড? কি সৌভাগ্য আজ। ডুব সাঁতারে অ্যাকোয়ালা নেন, না এমনিই ডুব মারেন?
এমনিই। বেশি গভীরে যাই না। নিছক শখ।
বাকি সময়টা কি করেন?
সরকারি চাকরি।
সশব্দে অনুকম্পার হাসি হেসে বললেন, দাসত্ব আপনাদের রক্তে। বলিহারি যাই আপনাদের, মানে, ইংরেজদের। তামাম দুনিয়ায় আপনাদের টেক্কা মারতে পারে এমন খানসামা আর বাটলার তো দেখি না।
বন্ডের মেজাজ সপ্তমে চড়তে চড়তে আটকে গেল প্রায় বিবস্ত্রা এক সুন্দরীর আর্বিভাবে। রোদে জ্বলা সারা গা। পরনে এক চিলতে বিকিনি ছাড়া কিছুই নেই।
এই তো মানিক আমার। ছিলে কোথায় এতক্ষণ? শ্রীমুখ কতক্ষণ দেখিনি বলত? এসো আলাপ করিয়ে দিই। ইনি মিস্টার বার্বে। আর ইনি মিস্টার বন্ড। বলে রূপসীর দিকে হাত বাড়িয়ে–ইনি হলেন আমার স্ত্রী, মিসেস ক্রেস্ট। পঞ্চম মিসেস ক্রেস্ট। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা তো, সন্দেহ হতে পারে আদৌ বউ ভালবাসে কিনা। তাই বলে রাখি, ভদ্রমহিলা স্বমী অন্ত প্রাণ। তাই না মানিক।
কি যে করা মিল্ট, ভুবনমোহিনী হাসি হেসে বলল মিসেস ক্রেস্ট। মিস্টার বন্ড, মিস্টার বার্বে, এক ঢোক সুরাপান হয়ে যাবে না কি?
এখন নয়, এখন নয়, সরব হলেন মিস্টার ক্রেস্ট। আগে যার যা কাজ বুঝিয়ে দিই।
যথা?
আমি হলাম গিয়ে ওয়েভক্রেস্টের ক্যাপ্টেন। মিস্টার বার্বে, কি বলে ডাকা যায় বলুন তো আপনাকে? ফাইডেল? উঁহু, বড় বড় নাম। আমি ফিডো বলেই ডাকব। আপনি আমার সঙ্গে ডিউটি দেবেন ব্রীজে। মিস্টার বন্ড, ডাক নাম কি আপনার? জেমস? আমি বলব, জিম। মিসেস ক্রেস্টকে স্বচ্ছন্দে লিজ বলে ডাকতে পারেন। মা ভৈঃ। দুজনে মিলে চটপট পাঞ্চ খাবার আগেই মদ্য পানের সরঞ্জাম সাজিয়ে ফেলুন তো। এবার যাওয়া যাক।
খরগোশের মত ক্ষিপ্রচরণে চোখের আড়াল হলেন মিস্টার ক্রেস্ট। মিসেস ক্রেস্ট বলল, কিছু মনে করবেন না ওর। কথায়। ওর ঠাট্টার ধরনটাই অমনি।
বন্ড হেসে বলল, ওঁর জানার এখন অনেক বাকি। আমেরিকাতেও এমন কথা বলেন?
আমেরিকানদের উনি ভালবাসেন। ঝাল ঝাড়েন কেবল আমার ওপর। তাও জাহাজে উঠলেই। ওঁর বাবা তো খাঁটি জার্মান। তাই ধারণা, ইউরোপীয়ান মাত্রেই ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছে। তর্ক করে লাভ নেই বলেই চুপ করে থাকি।
বটে! আবার সেই বস্তাপচা জার্মান দম্ভ ইংরেজ বউকে নিশ্চয় তাহলে ক্রীতদাসী জ্ঞান করেন। আপনাদের বিয়ে হয়েছে কদ্দিন
দু বছর। ওঁরই একটা হোটেলে রিসেপসনিস্ট ছিলাম। উনি একদিন আমাকে দেখেই এত ভালবাসলেন যে কি বলব। যেখানেই যাই সেখানেই রাজরাণীর মত খাতির পাই।
খাতির জিনিসটা ওর খুবই পছন্দ, তাই না? তা ঠিক।
এবার আর হাসতে পারল না সুন্দরী। ভেতরে উনি কিন্তু ক্ষুদে নবাব। পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কাণ্ড। ঐ রে, ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। আপনি ডেকে যান, আমি আসছি।
বেরিয়ে এল বন্ড। দেখল, মাঠের সবুজ তীরভূমি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। মিস্টার ক্রেস্ট কি পাড় মাতাল? মিসেস ক্রেস্ট কি যমের মত ভয় করে স্বামীকে দু বছর হল বিয়ে হয়েছে। কতই বা বয়স মেয়েটির। তিরিশের বেশি নয়। ছাইয়ের মত উজ্জ্বল চুল। বড় ভাসাভাসা চোখ। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই। নখে রঙ নেই। স্বামীর হুকুম হয়ত সাজগোছ আচ্ছা, ভদ্রলোক পুরুষত্বহীন নন তো? বাইরের হাঁকডাক আর হম্বিতম্বি দিয়ে ভেতরের দুর্বলতাকে ঢাকবার চেষ্টাও হতে পারে। এ লোকের সঙ্গে চার পাঁচদিন এক জাহাজে থাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
হ্যাল, জিম আমার বউ কোথায়? বোটডেক থেকে হাঁক শোনা গেল মিস্টার ক্রেস্ট-এর।
আসছেন।
এক লাফে বোট ডেক থেকে নিচের ডেকে নেমে এলেন মিস্টার ক্রেস্ট-জাহাজ দেখবেন তো চলুন ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।
শুরু হল জাহাজ পরিক্রমা। সবকিছুই মিস্টার ক্রেস্টের মুখস্থ। গড়গড় করে একাই বলতে লাগলেন টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি। ঘুরতে ঘুরতে এলেন নিজের শোবার ঘরে। দরজায় টোকা না দিয়েই ঢুকলেন ভেতরে। দেখা গেল, ড্রেসিং টেবিলে বসে মিসেস ক্রেস্ট সাজগোজ করছে।
তোমাকে বললাম না মদের গ্লাস রেডি করতে। তা না করে সাজতে বসেছ? জিম এর জন্য এক পোঁচ বেশি রুজ লাগানো হচ্ছে বোধহয়? হামফ্রি বোগার্ট কণ্ঠে বললেন, মিঃ ক্রেস্ট।
মুখ আমসি করে উঠে মিসেস ক্রেস্ট–এই আসছি বলেই উধাও হল পাশের দরজা দিয়ে।
যেন কিছুই হয়নি। এমনিভাবে এ ঘরের বর্ণনায় মুখর হলেন মিঃ ক্রেস্ট। বন্ডের চোখ কিন্তু ডবল বেডের পাশের টেবিলে রাখা চাবুকটার ওপর। ফুট তিনেক লম্বা চামড়ার হাতলঅলা চাবুক। শংকর মাছের ল্যাজ দিয়ে বানানো।
বিছানা ঘুরে গিয়ে চাবুকটা তুলল বন্ড। বলল, পেলেন কোথায়? আজ সকালেই তো একটা শংকর মছ খতম করলাম।
শুকনো হাসি হেসে মিস্টার ক্রেস্ট বললেন, আরবরা শুনেছি বউ শায়েস্তা করে এটা দিয়ে। আমাকেও এক ঘায়ের বেশি কোনদিন দিতে হয়নি। এক ঘায়েই সিধে হয়ে যায় লিজ। চাবুক বটে। সাংঘাতিক কাজ দেয়।
শক্ত চোখে তাকায় বন্ড সিসিলিতে এ জিনিস ঘরে রাখা বেআইনি জানেন তো?
এ জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ার সিসিলির নয়। চলুন, গলা কাঠ হয়ে গেছে, একটু মদ খাওয়া যাক।
লাঞ্চের আগে ভডকা আর লাঞ্চের সঙ্গে বিয়ার খেলেন মিস্টার ক্রেস্ট। অত খেয়েও গলা কাঁপল না। টেবিল মাতিয়ে রাখলেন একাই। ফাউন্ডেশন বস্তুটা কি, তা বুঝিয়ে দিলেন। আমেরিকায় যার টাকা বেশি, যে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চায়, তাহলে সৎ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের নামে এক কাড়ি টাকা গচ্ছিত রাখলেই হল। টাকাটা নিজের নামে বা আত্মীয়স্বজনের নামে রাখলে চলবে না। ক্রেস্ট ফাউন্ডেশনে এক কোটি ডলার রেখেছেন। সেই টাকা ভেঙে বৈজ্ঞানিক অভিযানের নামে বছরে তিনমাস সাত সমুদুর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শখও মিটছে আর টাকারও সদগতি হচ্ছে। দুষ্প্রাপ্য নমুনা সংগ্রহ করছেন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জন্য। টাকা ছড়ালেই নমুনা মেলে। মিস্টার। ক্রেস্ট গিয়ে সোজা গভর্নরকে একটা চেক লিখে দিলেন। দশ হাজার ডলার দান করছেন। সুইমিং পুল বানিয়ে বাচ্চাদের। সাঁতার শেখাতে হবে। প্রতিদানে পেলেন কাকাতুয়া আর কচ্ছপ। শামুকের অনেকগুলো নমুনা সংগ্রহ করলেন একজনকে পাঁচ হাজার ডলার চেক দিয়ে। সে তো এইভাবে খোলাম কুচির মত টাকা ছড়িয়ে এর মধ্যেই লম্বা ফর্দের তিনভাগ নমুনা জোগাড় করে ফেলেছেন।
বন্ড বলল, দেশে ফিরলে আপনাকে মেডেল দেওয়া উচিত। মাছ সম্বন্ধে কি যেন বলছিলেন?
ড্রয়ার খুলে টাইপ করা একটা কাগজ বার করলেন মিস্টার ক্রেস্ট।
শুনুন। দুষ্প্রাপ্য মাছ হিলডাব্রান্ডকে সর্বপ্রথম জাল ফেলে ধরেন প্রফেসর হিলডাব্রান্ড সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের শাগ্রিন দ্বীপের কাছে ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে। এ মাছ কাঠ বিড়াল জাতীয় মাছদের মধ্যে নাকি অনন্য। একটা মাছই আজ পর্যন্ত ধরা পড়েছে। লম্বায় ইঞ্চি ছয়েক। ঝকঝকে গোলাপী রঙ-তাতে আড়াআড়িভাবে কালো ডোরা। পাখনাগুলো। গোলাপী। ল্যাজ কালো। চোখ বেশ বড়, রঙ গাঢ় নীল। সাবধানে ধরা দরকার। পাখনাগুলো নাকি সাংঘাতিক রকম উঁচলল। এই হল হিলডাব্রান্ড মাছের কেচ্ছা। পুঁচতে একটা মাছের জন্য কয়েক হাজার ডলারের শ্রাদ্ধ। তা সত্ত্বেও কিনা রাজস্ব বিভাগে বছর দুয়েক আগে শুনেছিলাম ফাউন্ডেশনটাই নাকি চারশ বিশ কারবার।
ফস করে লিজ বলল, কথাটা মিথ্যে নয়, মিল্ট। দামী দামী নমুনা না দেখাতে পারলে ট্যাক্সের ছিনেজেকরা কিন্তু তোমার এই বজরা আর যত বাজে খবর সবই বন্ধ করবার চেষ্টা করে আসছে গত পাঁচ বছর ধরে।
মানিক, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্যান প্যান না করলেই ভাল করতে। ফল কি হল জানো? চাবুকের এ ঘা পাওনা। হল। আজ রাতেই পাওয়া মিটিয়ে দেব, কেমন?
তৃতীয় দিন ভোরবেলা শাগ্রিন দ্বীপ দেখা গেল দূর থেকে। সবুজের সঙ্গে সাদা মেশানো একটা বন্দু দূরদিগন্ত থেকে এগিয়ে আসছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বন্ড।
নোঙর ফেলা হল দশ ফ্যাদম দূরে। স্পীডবোট চেপে পৌঁছানো হল দ্বীপে। যেন একটা ক্ষুদে প্রবাল দ্বীপ। ষাট বিঘে বালি আর প্রবাল। নেকলেসের মত পাথরের বলয়ের মধ্যে শান্ত পানি, অগভীর, চওড়ায় প্রায় পঞ্চাশ গজ। মেঘের মত কালো আকাশে পাখির দল ডাঙা ছেড়ে শূন্যে উঠল দ্বীপে নামতে। পাখির বিষ্ঠার অ্যামোনিয়া গন্ধ। সাদাটে চওড়া কাকড়ার সাঁতার।
সাদা বালির ওপর তাঁবু খাটানোর হুকুম দিলেন মিস্টার ক্রেস্ট। সাঁতারের মুখোশ পরে বন্ড আর ফাইডেল বার্বে ঝাঁপ দিল পানিতে। মিসেস ক্রেস্টও ডুব দিয়ে শামুক তোলার খেলায় মাতলেন। কে বলবে, গতদিন এই মেয়েটিই কেবিন থেকে বেরোয়নি। মিস্টার ক্রেস্ট শরীর খারাপের অছিলা দিয়েছিলেন।
পানির তলায় প্রতিটি জলচর জীবের চালচলন দেখতে দেখতে সাঁতরে চলল বন্ড। বন্ডের চোখ খুঁজছে হিলডাব্রান্ড মাছকে, মন কিন্তু ভাবছে লিজকে। স্বামীহত্যা না করে বসে মেয়েটা। চাবুকে ফের হাত দিলেই রিভলবার বা ছোরা নিয়ে হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে পিশাচ পতিদেবতার ওপর। বিচারে রেহাই পাবে লিজ। বন্ড কি ওর কানে সেই মন্ত্র দেবে? বলবে কি– লিজ, স্বামী হত্যা করতে চাও তো করে ফ্যাল। না, এমনও তো হতে পারে মেয়েটা ধর্ষকামী? পিটুনী না খেলে আনন্দ পায় না।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একপাক ঘুরে এল বন্ড। ফাইডেল বার্বেও পৌঁছে গেছে। বন্ডকে দেখেই বড় বড় শুক্তি দেখলাম। আকারে যেন ফুটবল। কাকাতুয়া মাছও বিস্তর। ভাবছি ফিরে গিয়ে লোক পাঠাব। জাহাজ ভর্তি করে নিলে, মোটা দাও পেটা যাবে।
তাঁবুতে ফিরে আসতেই মিস্টার ক্রেস্ট প্রায় ঢেঁকিয়ে উঠলেন শূন্য হস্ত দেখে। নিজেই পানিতে নামলেন। সঙ্গে ওদের একটা মুখোশ।
কিছুক্ষণ পরেই হাঁকডাক ভেসে এল। বন্ড আর ফাইডেল বার্বে গিয়ে দেখল হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মিস্টার ক্রেস্ট চেঁচাচ্ছেন। দু দুটো ওস্তাদ পানি তোলপাড় করে যা পারেনি, মিস্টার ক্রেস্ট পানিতে নেমেই তা পেরেছেন। নীল পানির আবছা অঞ্চল, ঐখানে হিলডাব্রান্ডকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে।
বন্ড বলল, বেশ তো, ধরবেন কি করে?
পানিতে বিষ ঢেলে। ব্রাজিলে এই দিয়ে মাছ ধরে। গাছের শেকড়ের নির্যাস। নাম রোটনন। এতে মাছের কানকোর মধ্যে রক্তবহা ধমনী-শিরাগুলো কুঁচকে যায়। দম বন্ধ হয়ে মারা যায় মাছ। মানুষের কিছু হয় না কানকো নেই বলে। জিম, তুমি গিয়ে দেখ। হিলডাব্রান্ডকে ল্যাজ নাড়তে দেখলেই আঙুলের ইশারা করবে। তবে আমি পানিতে রোটেনন ঢালব। পাঁচ গ্যালনের একটা মাত্র টিন ছাড়া আর নেই, কাজেই নষ্ট না হয়।
পানিতে মুখ ডুবিয়ে ওৎ পেতে রইল বন্ড। মিনিটের মধ্যে হিলডাব্রান্ডকে দেখা গেল ওর মুখের কাছে। মুখোশ দেখে সুট করে উধাও হল নীলচে কুয়াশার মধ্যে।
পানির নিচে বিচিত্র সাম্রাজ্য দেখে মনটা যেন কিরকম হয়ে গেল বন্ডের। পাঁচ হাজার মাইল দূরে একটা মিউজিয়ামের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য একটি মাত্র মাছ হত্যা করার দরকার। কিন্তু পানিতে বিষ ঢাললেই সেই বিশেষ একটির সঙ্গে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে জলচর জীবরা মারা পড়বে। নিজেকে অপরাধী মনে হল বন্ডের। মনে হল নাগাসাকির ওপর অ্যাটম বোমা ফেলার তোড়জোড় চলছে-ট্রিগার টেপার ভার বন্ডের ওপর।
হিলডাব্রান্ড আবার আসছে। জলজ উদ্ভিদের নীল কুয়াশার মধ্যে ল্যাজ নেড়ে বেরিয়ে এল উজ্জ্বল গোলাপী মাছটা। কাছে আসতেই পানির মধ্যেই মুখ রেখেই মুখোশের মধ্যে খেঁকিয়ে উঠল বন্ড, বেরো, বেরো, দূর হ। বলেই হারপুন দিয়ে মারল এক খোঁচা। পই পই করে আবার উধাও হল হিলডাব্রান্ড।
স্যাবটাজ করল বন্ড। মিস্টার ক্রেস্টের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য মাছটাকে দিল খেদিয়ে, তারপর ইশারা করতেই টিনভর্তি বিষ পানিতে ঢেলে দিলেন মিস্টার ক্রেস্ট।
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্রোতের টানে ভেসে এল রাশি রাশি মৃতদেহ। মরা অক্টোপাস। বান মাছ তলপেট সাদা মাছ আরও কত জলচর জীব। থ হয়ে দেখতে লাগল বন্ড। মৃতদেহের সংখ্যা কমে আসছে। বেঁচে গেল হিলডাব্রান্ড।
সহসা নীল কুয়াশার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল উজ্জ্বল গোলাপী সেই মাছটা। সিধে আসছে বন্ডকে লক্ষ্য করে। পানিতে হাত ডুবিয়ে জোরে হাত নাড়াল বন্ড। তবুও আসছে হিলডাব্রান্ড। সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ওর আসার পথেই হাঁটতে শুরু করল বস্তু। আশপাশে ভাসছে মরা মাছ। তার মধ্যে লাল কালো ভারি সুন্দর হিলডাব্রান্ড থমকে দাঁড়াল, কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। পরমুহূর্তে ছিটকে এল বন্ডের দুপায়ের ফাঁকে। আর নড়ল না।
মিস্টার ক্রেষ্টের হাতে বন্ড মাছটা তুলে দিল। তারপর ঝাঁপ দিল পানিতে।
ফেরার পথে রাত্রে ভোজসভার আয়োজন করলেন মিস্টার ক্রেস্ট। খেতে বসে আকণ্ঠ মদ গিলে যাচ্ছেতাই বলতে লাগলেন বন্ড আর ফাইডেল বার্বেকে। সব মদ মিশিয়ে প্রায় বোতল খানেক মদ গেলার পরও কথা জড়াল না। একটা গ্লাস টেবিল থেকে ঠিকরে গেল মেঝেতে। তারপরেই শুরু হল আক্রমণ। প্রথমে ঝেড়ে কাপড় পরালেন বন্ডকে। বর্তমান বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র বলতে শুধু তিনটি–আমেরিকান, রাশিয়া আর চীন। ইংল্যান্ডে প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আর একটা রাণী ছাড়া কিছু নেই। ফ্রান্সে মেয়ে সস্তা। ইটালীতে শুধু রোদ পোহানো। জার্মানিতে এখনো যৎসামান্য আছে বটে। কিন্তু দু দুটো যুদ্ধে হেরে ওরা ভূত হয়ে গেছে।
কান ঝালাপালা হল বন্ডের। তাই মুখটিপে শুধু বলল, আমেরিকা সম্বন্ধেও একটা শুনি।
কি?
আমেরিকা ছিল শিশু, হয়েছে সরাসরি স্থবির। বুদ্ধি পাকানোর সুযোগ ঘটেনি।
বাঃ, কথাটা মন্দ নয় তো। বলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন মানিক, এই কথাটাই তুমি সেদিন বলছিলে না?
শংকা ঘনিয়ে এল লিজের চোখে। বলল, আমি তো ঠাট্টা করেছিলাম। খবরের কাগজে কমিক ছবি দেখে। বলেছিলাম যততো ছেলেমানুষী।
ঠাট্টাটা ভালই। মনে থাকবে। নিশ্চয় মনে থাকবে মানিক।
বন্ডের ইচ্ছে হল একটা ঘুষি মেরে থামিয়ে দেয় মাতালটাকে। কিন্তু তার আগেই ভদ্রলোক ফাইডেল বার্বেকে ফিজে, বলিহারি যাই তোমাদের এই দ্বীপমালাকে। ম্যাপে প্রথমবার দেখে ভেবেছিলাম মাছির বিষ্ঠা। মানুষ এখানে থাকে কি করে? এলাম শুধু তোমাদের ফ্যামিলির কেচ্ছা শুনে। তোমাদের কে একজন না কি শ-খানেক জারজ সন্তানের জন্ম দিয়েছে।
আমার কাকা, গ্যাসটন। ফ্যামিলির নাম ডুবিয়েছেন উনি। জিনিসটা কারোরই ভাল লাগেনি। আমাদের অবস্থাও খারাপ হয়েছে ওর জন্য।
অবস্থা? কড়ির কারবার নাকি?
না। একশ বছর আগে কচ্ছপ আর মুক্তো চালান দেওয়া হত। এখন নারিকেল।
পরিবারের জারজদের কুলি বানায় নিশ্চয়? মন্দ নয়। এরকম কুলির দল তো আমিও বানাতে পারি। বলেই তাকালেন বউয়ের পানে। নতুন নষ্টামি শুরু হওয়ার আগেই বন্ড ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডেকে গিয়ে দাঁড়াল খোলা হাওয়ায়। দশ মিনিট পরে লিজ ডেকে এসে দাঁড়াল।
ক্লান্ত কণ্ঠ লিজের, শুতে যাচ্ছিলাম। তারপর ভাবলাম খোলা হাওয়ায় একটু ঘুরে যাই।
বেশ করেছেন। আমি তো ডেকে দাঁড়াই তারা দেখবার জন্য। এত তারা একসঙ্গে জীবনে দেখিনি।
জানেন তো, ছোটবেলায় আমি ভাবতাম তারাগুলো আসলে আকাশের ছিদ্র।
বেশ করতেন। বৈজ্ঞানিকদের সব কথা বিশ্বাস না করাই ভাল। আপনার দেশ কোথায়?
নিউ ফরেস্ট। রিংউড। ইচ্ছে আছে আবার সেখানে যাবার।
যান না। এখানে তো আপনার মন বিষিয়ে উঠেছে দেখছি।
বন্ডের বাহুতে হাত রাখল লিজ, ও কথা বলবেন না। লোকজন আমার ভাল লাগে। কথা বলতে ভাল লাগে। আপনার সঙ্গে এই যে কয়েক মিনিট কাটিয়ে গেলাম, একি ভোলবার। কিছু মনে করবেন না। হঠাৎ ইচ্ছে হল হাত ধরবার। এবার যাই, শুইগে।
সিল্ক মসৃণ স্বরটা ভেসে এল ঠিক পেছন থেকে বটে! বটে! শেষে ডুব সাতারুর সঙ্গে হলায় গলায়।
দেখা গেল, সেলুনের দরজার ফ্রেমে মিস্টার ক্রেস্টের দু হাত মাথার ওপরকার কাঠে। আলো পেছনে থাকায় মনে হচ্ছে যেন একটা মস্ত বেবুন দাঁড়িয়ে।
এক পা এগিয়ে এল বন্ড। নিশপিশ করে উঠল দু হাত। চট করে চোখ দিয়ে মেপে নিল মিস্টার ক্রেস্টের তলপেট কতখানি দূর। মুখে বলল, হট করে কিছু ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়, মিঃ ক্রেস্ট। মুখ সামলে কথা বলবেন। বড় বাড়াবাড়ি করছেন আজ রাতে। এখনো যে চোয়াল খুলে দিইনি, এই যথেষ্ট। মাতাল কোথাকার। যান, শুয়ে পড় ন।
আরে, আরে! লোকটা বলে কি। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা রূপার হুইসল বার করলেন মিস্টার ক্রেস্ট। এক পা এগোলেই ফুঁ দেব। বাঁশি বাজলেই তোমার দেহটা টপকে গিয়ে পড়বে সমুদ্রে। তারপর জাহাজটাকে ঘুরিয়ে এনে ঘুরন্ত প্রপেলার দুটো চালিয়ে দেওয়া হবে তোমার পেটের ওপর দিয়ে। গাঁট্টাগোট্টা মাঝিমাল্লা কেন রাখি, এবার বুঝেছ? মাথায় ঢুকেছে তো? তাঁদড়ামো না করে এস, ফের বন্ধু হয়ে যাই। মানিক, এস, শোবার সময় হয়েছে।
ভয়ার্ত হরিণীর মত গোৎ খেল লিজ। পিশাচ স্বামীর বাহুর তলা দিয়ে এক দৌড়ে উধাও হল ভেতরে।
কিছু মনে করো না। কেমন বলে মিস্টার ক্রেস্টও চলে গেলেন। শোবার ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দিলেন মিস্টার ক্রেস্ট।
শাওয়ারে বেশ করে গোসল করে আধঘণ্টা পরে ডেকে এল বন্ড। খোলা ডেকে শুতে বড় আরাম। তাই গাদা করা একটা ডানলোপিল গদি টেনে নিয়ে বিছানা পাতছে, এমন সময়ে নারীকণ্ঠের আর্ত চিৎকার ভেসে এল মিস্টার ক্রেস্টের শোবার ঘর থেকে। নিঃসীম যাতনায় ঝাঁকিয়ে উঠছে লিজ।
বিছানা ফেলে দৌড়াল বন্ড। ওর শোবার ঘরের দরজায় হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নিল। করছে কি বন্ড? দাম্পত্য কলহে কেন সে নাক গলাচ্ছে অসহ্য হলে লিজ খতম করে দিক না শয়তানটাকে–বভরে তাতে কি?
ফিরে আসছে বন্ড, এমন সময় আর্ত চিৎকারটা আর একবার শোনা গেল। এবার আরো নিস্তেজ।
এ অবস্থায় ঘুম আসে না। কিন্তু আকাশের তারা দেখতে দেখতে কখন জানি বন্ড ঘুমিয়ে পড়েছিল। নাক ডাকার বিফল শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল।
বোট ডেকে দোলনা বিছানায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে মিস্টার ক্রেস্ট। পোর্ট ভিক্টোরিয়া থেকে রওনা হবার পর থেকে বোট ডেকে উনি শুচ্ছেন। স্পীডবোট আর ডিঙি নৌকার মাঝে দোলনা বিছানা খাঁটিয়ে টেনে ঘুমোন। কিন্তু কোনদিন নাক ডাকে না। আকণ্ঠ মদের ওপর খান কয়েক ঘুমের বড়ি পড়েছে নিশ্চয়।
কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল বন্ড। তিতিবিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত উঠে পড়ল বন্ড। ভাবল বিছানা নিয়ে ফাইডেল বার্বের কেবিনে শোবে মেঝের ওপর।
ঠিক এমনি সময়ে মাথার ওপরে বোট থেকে একটা ভারি বস্তু আছড়ে পড়ল ধড়াম করে। সঙ্গে সঙ্গে হচড় পাঁচড়ের আওয়াজ আর মারাত্মক ঘড়ঘড়ানি শব্দ। মিস্টার ক্রেস্ট কি দোলনা বিছানা থেকে পড়ে গেলেন ঘুমের ঘোরে?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বোট ডেকের সিঁড়িতে পা দিল বন্ড। কানে ভেসে এল আরও একটা ভয়ানক শব্দ। এক জোড়া। গোড়ালি খটাখট শব্দে উধাও হল দূরে ডেকের পাটাতনে পলায়মান শব্দের অর্থ কি, তা বন্ডের অজানা নয়।
লাফিয়ে শেষ কয়েকটা ধাপ উঠল বন্ড। দেখল, ফুটফুটে চাঁদের আলোয় চিৎপাত হয়ে পড়ে মিস্টার ক্রেস্ট। কাছে। গিয়ে যা দেখল তা অবিশ্বাস্য দেহ মন শিউরে উঠল।
দম আটকানো সেই বিকট মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাইরে লটপট করছে লাল কালো একটা বস্তু। মিস্টার ক্রেস্টের জিভ ওটা নয় হিলডাব্রান্ডের ল্যাজ।
মারা গেছেন মিস্টার ক্রেস্ট। মারা গেছেন অতি ভয়ানকভাবে। নিশ্চয় হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন ভদ্রলোক। সেই সময়ে মাছটাকে কেউ ঠেসে দিয়েছে মুখের ভিতর। কিন্তু সুতীক্ষ্ণ শলাকার মত পাখনা আরো গেঁথে গেছে গালে–চামড়া ফুটো হয়ে বেরিয়ে এসেছে। কি কদাকার কুৎসিতই না দেখাচ্ছে। ভয়ঙ্কর মৃত্যুতে রোমাঞ্চিত হল বন্ড।
আদূরে সাজানো সারি সারি কাঁচের জার। দুষ্প্রাপ্য নমুনাগুলো জারে ডুবিয়ে রাখা হয় ফরমালিনের মধ্যে। একটা জারের পলিথিন ঢাকনি মেঝেতে পড়ে–ভেতরের নমুনাটা উধাও।
গিয়ে দাঁড়াল লাশের পাশে। খুনি কে? ফাউডেল বার্বে, না, লিজ ক্রেস্ট খাবার টেবিলে বংশের কেচ্ছা নিয়ে ফাইডেল বার্বেকে মিস্টার ক্রেস্ট যেভাবে স্ক্রিপ করেছে। তার প্রতিশোধ কি? অথবা আর লিজা অত্যাচারী স্বামী নিধনের অভিনব এ পন্থা। দুষ্প্রাপ্য মাছ দিয়ে দুবৃত্ত স্বামী হত্যা।
কিন্তু এ যে চরম হঠকারিতা। তদন্ত হবেই। হলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। বন্ডও জালে জড়িয়ে পড়বে।
কাজেই নিজেকে বাঁচানোর জন্য লাশ পাচার করা দরকার এখুনি। বোট ডেকের দু পাশের সিঁড়ি। ওপাশে ইঞ্জিন ঘরের আওয়াজে পাইলট নিশ্চয় কিছু শোনেনি। হেঁট হয়ে দেখল বন্ড। চারফুট নিচে আপনার ডেক। মাত্র তিন ফুট চওড়া প্যাসেজের পরেই ছ ফুট উঁচু রেলিং। তারপর সমুদ্র। জিনিসটাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন দোলনা ছিঁড়ে পড়ে গেছেন মিস্টার ক্রেস্ট, তারপর গড়িয়ে গিয়ে নিচের ডেক আর রেলিং টপকে তলিয়ে গেছেন সমুদ্রে।
সেলুন থেকে ছুরি এনে দোলনার দড়ি কাটল বন্ড। মেঝেতে রক্তের দাগ মুছল। কাঁচের জার থেকে দোলনা পর্যন্ত ফরম্যালিন পড়েছিল মেঝেতে তাও মুছল। লাশটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে রাখল বোট ডেকের কিনারায়। সিঁড়ি বেয়ে এল নিচের ডেকে। লাশের তলায় দাঁড়িয়ে আলগোছে নিষ্প্রাণ বপুটাকে টেনে আনল কাঁধের ওপর। মাতালের মতই। হাত পা এলিয়ে রইল দেহটা, সমুদ্রের দিকে ফিরে রেলিং টপকে ছুঁড়ে দিল। শেষবারের মত দেখা গেল, রক্তমাখা পাখনা গাঁথা সেই বিকট মুখচ্ছবি।
ওৎ পেতে রইল বন্ড। ছুরি সমেত ফরমালিন আর রক্তে মাখা ভিজে ন্যাকড়াটা ছুঁড়ে দিল সমুদ্রে। নেমে এসে শুল ডানলোপিলোয়। ঘড়িতে তখন সওয়া দুটো। দশ মিনিট যেতে না যেতেই ঘুমিয়ে পড়ল অকাতরে।
সন্ধ্যে ছ টা নাগাদ নর্থ পয়েন্টে ফিরে এল ওয়েভক্রেস্ট। ডেকে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল ওরা তিনজন–বন্ড, ফাইডেল বার্বে আর লিজ। মাঝে দাঁড়িয়ে লিজ। সাদা ফ্রকে কালো বেল্ট, গলায় সাদা কালো রুমাল। শোকের পোশাক। তিনজনেই উদগ্রীব নিজের নিজের গোপন কথা বলার জন্য। কিন্তু মুখ খুলছে না কেউই। কাজেই আবহাওয়া। রীতিমত থমথমে। সেদিন সকালে যেন তিনজনে ষড়যন্ত্র করে বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল। বেলা দশটায় রোদ্দুরে চোখ খুলল বন্ড। গোসল সেরে গিয়ে দেখে, ফাইডেল বার্বে তখনো ঘুমে কাদা। মদের নেশা নাকি কাটতেই চাইছে না। ঘুম ভাঙার পরেই অবশ্য সবার আগে মনে পড়েছিল, মদের টেবিলে মিস্টার ক্রেস্টের রূঢ় আর ফ্যামিলি কে নিয়ে টিটকিরি। বলেছিল, একদিন না একদিন এই নোংরা মুখটা জন্মের মত বন্ধ করে ছাড়বে।
লক্ষণ দেখে বন্ড ঠিক বুঝল না যে ফাইডেলই খুনী। খাবার ঘরে গিয়ে নিজেই সকালের নাস্তা সাজিয়ে খেতে বসেছে, তখন লিজ এল। চোখের কোণে কালি। না বসে দাঁড়িয়েই সকালের নাস্তা খেতে লাগল। মুখচ্ছবি কিন্তু অত্যন্ত শান্ত এবং সহজ। ঘুম এত দেরিতে ভাঙল কেন? কাল রাতে ঘুমের বড়ি গিয়েছিল যে।
এগারটা বাজল। অথচ একটা জলজ্যান্ত নিষ্ঠুর নিধন নিয়ে কেউই কথা বলছে না দেখে বন্ড বলল, ব্যাপার কি? মিস্টার ক্রেস্ট কোথায়?
ভুরু কুচকে লিজ, কোথায় আর, নাক ডাকাচ্ছেন বোট ডেকের দোলনা বিছানায়।
ফাইডেল বলল, পাইলট হাউজেও যেতে পারেন।
বন্ড বলল, এখনো বোট ডেকে নাক ডাকা মানে রোদ্দুরে রোস্ট হওয়া।
লিজ বলল, তাও তো বটে। যাই গিয়ে দেখি। বলে পা দিল বোট ডেকের সিঁড়িতে। কয়েক ধাপ উঠেই থমকে গেল। উদ্বিগ্ন গলায়, জিম, উনি তো নেই এখানে। দোলনা বিছানা ছিঁড়ে ঝুলছে।
ফাইডেলের কথাই ঠিক। দেখি পাইলট হাউজে।
কিন্তু পাইলট হাউজ কেন, সারা জাহাজেও খুঁজে পাওয়া যায়নি মিস্টার ক্রেস্টকে, দোলনা বিছানা যখন ছেঁড়া তখন নিশ্চয় উনি ঘুমের ঘোরেই গড়িয়ে সমুদ্রে তলিয়ে গেছেন। ভয়ংকর পরিণতিটা, পরিণতি মুখ ফুটে বলার সঙ্গে সঙ্গে লিজ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।
ক্যানন পয়েন্ট ঘুরে এগোল ওয়েভক্রেস্ট। বন্ড দেখল ওদের দিকে কাস্টমস লঞ্চ আসছে। আগুনের মত খবরটা এখুনি ছড়িয়ে পড়বে।
ফাইডেল বার্বে বলল, ঘাবড়াবেন না। এরা আমার বন্ধু। চীফ জাসটি আমার কাকা। একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে সবাইকে। কাল হয়ত একটা তদন্ত হবে। রেহাই পাবেন পরশু।
তাই নাকি? ঘামের ফোঁটা চকচক করে লিজের চোখের নিচে। এ ঝামেলা মিটলে আর এক ঝামেলার শুরু। কোথায় যে যাব, তাই জানি না। জেমস্ আপনি তো মোম্বাসা যাচ্ছেন। একই সঙ্গে যাওয়া যাবে, কেমন?
সিগারেট ধরিয়ে দ্বিধার ভাবটা গোপন করার চেষ্টা করল বন্ড। মিস্টার ক্রেস্টের মুখবিবরে ঠাসা সেই মাছটার দৃশ্য ভোলা যায় না কিছুতেই। কাজটা কার? লিজের? না, ফাইডেলের?
কাষ্ঠ হাসি হেসে ফাইডেল, ব্রাভো, মাই ফ্রেন্ড। আপনার মত কপাল হলে আমি বর্তে যেতাম। কিন্তু মনটা খুব খচ খচ করছে একটা ব্যাপারে। মাছটার কথা ভেবেছেন? মস্ত ঝুঁকি কিন্তু। আমেরিকার সেই মিউজিয়াম থেকে টেলিগ্রাম এলে কি খুব স্বস্তি পাবেন? মাছ না পাওয়া পর্যন্ত জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।
চকমকির মত কঠিন হয়ে ওঠে বন্ডের চোখ। এ কথার মানে হত্যাকারী ফাইডেল নয় লিজ।
কিন্তু সহজ সুন্দর গলায় লিজ বলল, হিলডাব্র্যান্ড বৃটিশ মিউজিয়ামে যাবে।
স্তব্ধ হল ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দ। ঝনঝন করে নোঙরের শেকল নামল শান্ত উপসাগরে।
.
একান্ত গোপনীয়
জ্যামাইকার সবচেয়ে সুন্দরী পাখি হল ডক্টর হামিং বার্ড। কেউ কেউ বলে সারা পৃথিবীতে নাকি এর চাইতে সুন্দর পাখি আর নেই। ডক্টর হামিংবার্ডের আর এক নাম, স্টীমার টেল। পুরুষ পাখিরা লম্বায় ৯ ইঞ্চি। তার মধ্যে সাত ইঞ্চি শুধু পুচ্ছ। দুটো লম্বা কালো পালক আড়াআড়িভাবে বেঁকে পড়ে থাকে একটা অপরটার ওপর। পালকের ভেতরকার কিনারায় ঈষৎ বক্রতা–শামুক ডিজাইন প্রান্তদেশ সামান্য ঢেউ খেলানো। মাথা আর খুঁটি মিশমিশে কালো। ডানা গাঢ় সবুজ, দীর্ঘ চঞ্চু হলদে মিশানো উজ্জ্বল লাল, চোখ ঝকঝকে আস্থা জাগানো কুচকুচে কালো। দেহ পান্না সবুজ। এমন ঝলমলে যে বুকে রোদ্দুর পড়লে চোখ ধাধিয়ে যায়। জ্যামাইকার প্রিয় পাখিদের আটপৌরে নাম দেওয়ার রেওয়াজ আছে। তাই ট্রোকিলাস পলিটমাস কে ডক্টর বার্ড নামে ডাকা হয়। কারণ এ পাখির দু পাশে টানা কালো পালক দুটো দেখলেই ডাক্তারের কথা মনে পড়ে। পরনে কালো কুল-অলা কোট, সেকেলে ডাক্তার।
ডক্টর বার্ডদের দুটো পরিবারকে বিশেষ করে ভালবাসতেন মিসেস হ্যাভলক। বিয়ের পর কনটেন্টে আসার পর থেকেই এদেরকে উনি দেখেছেন। দুই পরিবারের ভালবাসা, বাসা বাঁধা, কোদল করা আর মধু খাওয়া–সবই। দেখেছেন। মিসেস হ্যাভলকের বয়স এখন পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। আদিতে এসেছিল দুটি জুটি। পিরামাস আর থিসবি। জ্যাফনিস আর কোলি ছিল ওদের আটপৌরে নাম। তারপর থেকেই সব জুটিরই ঐ একই নাম থেকে গেছে। মিসেস হ্যাভলক চা খেতে বসে তাকিয়ে ছিলেন পিরামাসের দিকে। চওড়া ঠাণ্ডা বারান্দায় চায়ের আয়োজন সাজানো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসেস হ্যাভলক দেখছিলেন রণদেহী পিরামাসকে। কারণ, ড্যাফনিস পিরামাসের এতিয়ারে গোৎ খেয়ে ঢুকেছে মধুর লোভে। নিজের এলাকার মধু লুটে পুটে নেওয়ার জন্য। মাঠভরা হিবিসকাস আর বোগেন ভিলার রঙচঙে ফুলের ওপর উড়তে উড়তে উধাও হল আঙুর আল কমলার কুঞ্জ বনের দিকে। মিসেস হ্যাভলক জানেন, ওরা ফের আসবে।
চায়ের কাপ নামিয়ে মিসেস হ্যাভলক পাটুম পেরিয়াম স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে বললেন, সত্যি, ওদের দেখলে ভয় হয়, ভালোও লাগে।
ডেইলি গ্রীনার কাগজের ওপর তাঁকালেন হ্যাভলক, কাদের কথা বলছ।
পিরামাস আর ড্যাফনিস।
তা যা বলেছ, নামগুলো অবশ্য একটু বোকা বোকাই মনে হল, বললেন, মনে হচ্ছে এবার আসরে নামবে বাটিসটা। ক্যাসট্রা চাপ দিয়েই চলেছে–কমানোর লক্ষণ নেই। আজ সকালে বারক্লেতে চ্যাপ বলছিল এর মধ্যেই কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা বাজারে আসছে। সহজ টাকা নয়, হুমকি দেওয়া টাকা। বেলেয়ার না কি বিক্রি হয়ে গেছে। দাম শুনলে চক্ষু চড়ক গাছ হবে। যে বাড়ি আসছে বারের বড় দিনের মধ্যেই লাল পিঁপড়ের চাপ হবে, সেই বাড়ি সমেত গরু ভেড়া চরবার মাঠের হাজার খানেক বিঘের দাম কিনা দেড় লাখ পাউন্ড। রাতারাতি মাথা না বিগড়োলে বিতিকিচ্ছিরি বু হারবার হোটেল কেনে না। এমন কথাও শুনেছি যে জিমি ফারকুয়ারসনও নাকি নিজের জায়গাজমি বেচবার খদ্দের পেয়ে গেছে। পানামা রোগে যে জমি ছেয়ে গেছে সে জমিরও খদ্দের জোটে।
উরসুলা বর্তে যাবে জমি বিক্রি হলে। বেচারী আর টিকতে পারছে না এখানে। তবে কিউবার লোকজন গোটা দ্বীপটা কিনে নেবে। এটাও তো ভাল ঠেকছে না। টিম, এত টাকা ওরা পাচ্ছে কোথা থেকে?
লুঠতরাজ, সমিতির ফান্ড, সরকারি টাকা–আল্লাহ জানে। চোর ডাকাতে তো ছেয়ে গেছে দেশটা। ডলার পালটানোর সুযোগ জ্যামাইকায় আছে। বেলেয়ার যে কিনেছে, বলতে গেলে সে সুইটকেশ ভর্তি টাকা উপুড় করে দিয়েছে আচেন হিমস এর অফিসে। গোলমাল মিটে গেলে বা ক্যাসট্রো এসে গেলে ফের বেচবে জমি। কিছু লোকসান হয় হোক, টাকাটা তুলে নিয়ে সরবে অন্য কোন চুলায়। বেলেয়ারের মত এমন ভাল জমি জমার শেষে এই হাল হল। ফ্যামিলির কেউ মনে করলে এ জমি কিনতে পারত।
বিলের ঠাকুরদার আমলে জমির আয়তন ছিল কিন্তু দশ হাজার একর। ঘোড়ায় চড়ে সীমানা পেরোতে লাগত ঝাড়া তিন দিন, বললেন মিসেস হ্যাভলক।
মোটা টাকা পেলেই বিল খুশি। এতক্ষণে বোধহয় লন্ডনের টিকিট কেটেও বসেছে। আদি বাসিন্দাদের আর একজন সরল। দুদিন পরে কেউ থাকবে না–আমরা ছাড়া। ভাগ্য ভাল, জুড়ির মন বসে গেছে এখানে।
তাতো বটেই, বললেন মিসেস হ্যাভলক। বলে ঘন্টা বাজালেন। ড্রইংরুম থেকে আগাথার পেছনে এল ফেপ্রিন্স। আগাথা নিগ্রো মেয়ে। নীলচে কালো রঙ। মস্ত বপু। মাথায় সাদা কাপড়ের সাবেকী ঘোমটা। আগাথা হ্যাভলক পরিবারের ঘর-সংসার দেখাশুনা করে।
আর ফেপ্রিন্স মেয়েটি এসেছে পোর্ট মেরিয়া থেকে। সাদা আর কালো চামড়ার মিলনে বর্ণসংকর। দেখতে বেশ ছিমছাম। ফেপ্রিন্স আগাথার কাছে কাজ শিখছে।
মিসেস হ্যাভলক বললেন–আগাথা, বোতল ভরা শুরু করা যাক। এ বছর পেয়ারা একটু আগেই উঠেছে দেখছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু বোতল যে আরো চাই।
কেন? গত বছরেই তো হেনরি থেকে সেরা বোতল দু ডজন এনে দিলাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু কিছু বোতল চুরমার হল এই সেদিন।
সেকি! কে ভাঙল?
তা তো জানি না, রূপার ট্রে নিয়ে মিসেস হ্যাভলকের মুখের ভাব দেখল আগাথা।
জ্যামাইকাতে ভাঙচুর যে হামেশাই ঘটে এবং নষ্টামির মূল যে চিরকালই নিপাত্তা থাকে, মিসেস হ্যাভলক তা জানেন। কাজেই কতা না বাড়িয়ে বললেন, যাক গে, যা যাবার গেছে। এবার কিংসটন গেলে আরো কয়েকটা বোতল এনে দেব।
আজ্ঞে হ্যাঁ বলেই উধাও হল বাড়ির ভেতর।
মিসেস হ্যাভলক এবার সেলাইয়ে মন দিলেন। চোখ রইল জাপানিজ হ্যাট আর মাংকি ফিডল –এর মস্ত ঝোঁপের দিকে। পুরুষ পাখি দুটো এসেছে। খানদানি কায়দায় ল্যাজ তুলে ফুলের ঝোঁপের এদিক ওদিক ঘুরছে। গাছের মগডালে বসে একটা পাখি সান্ধ্য-সংগীত শুরু করেছে।
পোর্টল্যান্ড-এর ব্লু মাউন্টেনের একেবারে পূর্ব অঞ্চলে ক্যানডল ফ্লাই পীক পাহাড়ের সানুদেশে বিশ হাজার একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কনটেন্ট। হ্যাভলক পরিবারে কনটেন্ট এসেছে পুরস্কার স্বরূপ। আদি হ্যাভলক। কনটেন্ট পুরস্কার পান অলিভার ক্রমওয়েলের কাছ থেকে। দ্বীপের যে কটা প্রাইভেট সম্পত্তি আছে, তার মধ্যে সব চাইতে সমৃদ্ধ হল কনটেন্ট। এত ভাল তত্ত্বাবধান কোথাও নেই। বাড়িটাও দো আঁসলা টাইপের। মেহগনি কাঠের থাম, পুরোনো পাথরের দোতলা বাড়ি। দু পাশে একতলা ছাউনি। জ্যামাইকার বিশেষ ধরনের চওড়া ঝোলানো ছাদ। রূপালি দেবদারুর পাতলা তক্তা দিয়ে ছাওয়া। ঢালু বাগান বারান্দার সামনেই। বাগান যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে বিশ মাইল ব্যাপী জঙ্গল। প্রান্তে সমুদ্র।
স্লীপার নামিয়ে কর্নেল হ্যাভলক বললেন, গাড়ির আওয়াজ শুনলাম মনে হচ্ছে।
মিসেস হ্যাভলক দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, পোর্ট অ্যানটোনিওর ফেডেরা এলে চটপট বিদেয় কর বাপু। ইংল্যান্ড নিয়ে ওদের নাকিকান্না আর সইতে পারি না। রাতের খাবার জুড়িয়ে হিম হয়ে গিয়েছিল মনে আছে? আমি যাই। আগাথাকে দিয়ে বলে পাঠাব মাথা ব্যথা করছে।
ড্রইংরুমের দরজায় আবির্ভূত হল আগাথা। গা ঘেঁষে এল আরও তিনটে লোক। ঝটিতি বলল আগাথা কিংসটন থেকে এসেছেন। কর্নেলকে দরকার।
পুরোধা ব্যক্তি আগাথাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এল। মাথায় তখন পানামা টুপি। কিনারাটা যেন বড্ড বেশি দুমড়ে উঁচু করা। বাঁ হাত দিয়ে টুপি নামিয়ে পেটের কাছে রাখল লোকটা। এগিয়ে এল লোকটা। হাত বাড়িয়ে দিল কর্নেলের দিকে। বলল, আমি মেজর গোনজালিশ। আসছি হাভানা থেকে। কর্নেল, ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।
উচ্চারণটা অদ্ভুত। জ্যামাইকার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা যেমন কথা বলার আমেরিকান ঢং নকল করে, অনেকটা তেমনি। কর্নেল হ্যাভলক দাঁড়িয়ে মেজরের প্রসারিত হাত আলতো করে ছুঁলেন। দরজার দু পাশে দাঁড়ানো দুজনকে দেখলেন। দু জনেরই হাতে দুটো নতুন হোল্ডঅল। প্যান আমেরিকান বিমানযাত্রীরা যে ধরনের ব্যাগ রাত্রে ব্যবহার করে–অবিকল তাই। কর্নেলের চোখের সামনেই হোল্ড অল দুটো মেঝেতে নামিয়ে রাখল দেখে মনে হল দুটো ব্যাগেই গুরুভার কিছু রয়েছে। দুজনের মাথায় চ্যাটাল সাদা ক্যাপ। কপালে টানা চক্ষুন্ত্রাণ স্বচ্ছ আর সবুজ। পায়ে হলদেটে জুতা।
মেজর বলল, আমার দুই সেক্রেটারি।
পকেট থেকে পাইপ বার করলেন কর্নেল। তামাক ঠাসতে ঠাসতে চোখ রইল মেজর আর তার দুই সেক্রেটারির ওপর। মেজরের চোখা চোখা পোশাক। ঝকঝকে জুতা আর অপর দু জনের নীল রঙের জিনস্ আর ক্যালিপসো শার্ট। ভাবলেন, কি কায়দায় এদের স্টাডিরুমে ড্রয়ারে রাখা রিভলবারের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়।
মুখে বললেন, বলুন কি করতে পারি?
দুহাত দু পাশে ছড়িয়ে দিলেন মেজর গোনজালিস। দু চোখে কৌতুক খেলে গেল, বলল কাজটা স্রেফ ব্যবসা নিয়ে কর্নেল। হাভানার এক বিশেষ ভদ্রলোকের আমি প্রতিনিধি। চমৎকার মানুষ। আপনার ভালই লাগবে। উনিই পাঠিয়েছেন আমাকে আপনার জমিজমার দর জানতে।
মিসেস হ্যাভলক এতক্ষণ মেজরের কথা শুনছিলেন। এবার স্বামীর গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। গলায় হৃদ্যতা এনে বললেন, মেজর, প্রস্তাবটা খুবই লজ্জাকর। এত ধূলো মাড়িয়ে এতটা পথ এলেন শুধু এই কথা বলতে আপনার বন্ধুর উচিত ছিল খবর নিয়ে আগে জানা। তিনশ বছর হল আমার স্বামীর পরিবার এখানে রয়েছে। কাজেই কনটেন্ট বেচবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আপনার বন্ধুর মাথায় এমন ধারণা এল কোত্থেকে।
ছোট অভিবাদন জানাল মেজর। হাসিমুখে ফিরল কর্নেলের দিকে। মিসেস হ্যাভলকের কথা না শোনার ভান করে– আমার বন্ধুটি শুনেছেন। জ্যামাইকায় যে কটা সেরা এস্টেট আছে, কনটেন্ট তাদের অন্যতম। আমার বন্ধু কিন্তু দারুণ উদার। যে কোন ন্যায্য দাম আপনি হাঁকতে পারেন।
কর্নেল হ্যাভলক দৃঢ় গলায় বললেন, মিসেস হ্যাভলক যা বললেন, তা শুনেছেন নিশ্চয়। এ সম্পত্তি বিক্রি হবে না।
হেসে ফেলল মেজর গোনজালিস। এমনভাবে বলল যেন দুগ্ধপোষ্য বালককে কিছু বোঝানো হচ্ছে–কর্নেল বোধহয় আমাকে ঠিক ধরতে পারেননি। কনটেন্ট ছাড়া জ্যামাইকার আর কোন সম্পত্তি কেনার অভিপ্রায় আমার বন্ধুর নেই। জমিজমা কিনে জ্যামাইকায় ডেরা বাধাতে চান।
ধীর গলায় কর্নেল বললেন, বুঝলাম। আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে সে জন্য দুঃখিত। আমার জীবদ্দশায় কনটেন্ট বিক্রি হবে না। এখন আসতে পারেন। আমাদের আবার তাড়াতাড়ি ডিনার খাওয়ার অভ্যাস। এদিক দিয়ে যান। কাজেই গাড়ি পাবেন। চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।
মেজর গোনজালিসের দেতো হাসিতেও এবার বুঝি একটা দাঁত কম দেখা গেল। দুই চোখে হুশিয়ার দৃষ্টি। দাঁড়ান, মশাই, দাঁড়ান, বলেই সংক্ষিপ্ত হুকুম দিল, আর কাটা কাটা হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে খসে গেল খুশির মুখোশ। অস্বস্তি বোধ করে মিসেস হ্যাভলক আরও সরে দাঁড়ালেন স্বামীর পাশে।
লোক দুটো নীল রঙা প্যান-আমেরিকান থলি তুলে এগিয়ে এল সামনে। হাত বাড়াল মেজর গোনজালিস। একে একে টান পড়ল জীপার চেনে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হল থলির মুখ। দুটো ব্যাগই মার্কিন ডলারে ঠাসা। আবার দু হাত দু পাশে ছড়িয়ে মেজর–একশ ডলারের নোট। আসল, জাল নয়। পাঁচ লক্ষ ডলার। আপনাদের টাকার হিসেবে অবশ্য এক লক্ষ আশি হাজার পাউন্ড। কর্নেল, দুনিয়ায় আস্তানা বাধবার ভাল জায়গার অভাব নেই। আমার বন্ধু মনে করলে আরও বিশ হাজার পাউন্ড জুড়ে দু লাখ পাউন্ড দিতে পারেন। এক সপ্তাহের মধ্যে জানাবেন কি করবেন। দলিল পত্র তো নেই, শুধু এক তা কাগজে আপনি সই করে দিন, বাকিটা আইনবিদরা করে নেবেন। আবার হাসি-রাজি তো? আপনি হ্যাঁ বললেই থলি দুটো রেখে বিদেয় হই। আপনিও ডিনার খেয়ে নিন।
আগের মত ক্রোধ আর বিতৃষ্ণা মিশানো চোখে বললেন, বেঁটে বন্ধু ছাড়া দুশমন। টাকা ঠাসা নোংরা দুটো থলি? টিমির সে কি রাগ! মুখের ওপর বলে দিল, বাপু হে, টাকা নিয়ে কেটে পড় চটপট।
মুখ নামিয়ে কর্নেল হ্যাভলক বললেন, ভেবেছিলাম কথায় ফাঁক রাখিনি। কোন দামেই এ সম্পত্তি বিক্রি হবার নয়। আমেরিকান ডলারের ওপর আর সবার মত আমার মোহ নেই। এখন বিদেয় হোন।
এবার মেজর গোনজালিস-এর হাসির হলকা উধাও হল। নরম গলায় বলল, কর্নেল, আপনার কথায় ফাঁক ছিল না, ছিল আমার কথায়। আমার বন্ধুর শেষ কথাটা এখনো বলা হয়নি। আপনি রাজি না হলে পরবর্তী পথ করতে যেন দ্বিধা না করি, এ নির্দেশ আছে আমার ওপর।
আচম্বিতে ভয় পেলেন মিসেস হ্যাভলক। কর্নেলের বাহুতে চাপ দিলেন সজোরে। কর্নেল বললেন, মেজর, আর হামলা করবেন না, যান। নাইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।
গোলাপী জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চেটে নিল, চোখে মুখে এখন কেবল নির্দয় নির্মমতা। বললে কর্কশ গলায়, আপনার জীবদ্দশায় তাহলে এ সম্পত্তি বিক্রি হবার নয়। কর্নেল, এই আপনার শেষ কথা? পেছনে দুই চেলার হাত পৌঁছাল খোলা শার্টের মধ্যে দিয়ে কোমরের কাছে। ধারাল পশব দুই চোখ নিবদ্ধ হল মেজরের তুড়ি দেওয়ার দুটি আঙুলের ওপর।
সভয়ে মুখে হাত রাখলেন মিসেস হ্যাভলক। যা বলতে গেলেন কিন্তু ঢোক গিললেন সশব্দে। এও কি সম্ভব নিজের বাড়িতেই খুন করার হুমকি! তাই কোন মতে বললেন, হ্যাঁ, এই আমার শেষ কথা।
মেজর বলল, তাহলে সম্পত্তির বদলে মালিকের সঙ্গেই কথা বলবেন আমার বন্ধু। মানে, এবার কথা হবে আপনার মেয়ের সঙ্গে।
সঙ্গে সঙ্গে তুড়ি ধ্বনি শোনা গেল দুই আঙুলে। সামনে থেকে সরে দাঁড়াল মেজর। গুলিবর্ষণের সুবিধের জন্য। দুই স্যাঙাতের ঝকঝকে শার্টের নিচ থেকে বেরিয়ে এল দুটো বাদামী রঙের বাদুরে হাত। কদাকার দর্শন শশার মত চেহারা, ধাতব নল দুটো থরথর করে কেঁপে, গর্জে উঠল। নিষ্প্রাণ দেহ দু টো মেঝেতে আছড়ে পড়ার পরেও স্তব্ধ হল না গুলি বর্ষণ।
অবশেষে হেঁট হল মেজর গোনজালিস। কোথায় কোথায় বুলেট বিঁধেছে পরখ করল। তারপর তিন ব্যক্তি ঢুকল গোলাপী-সাদা ড্রইংরুমে। সেখান থেকে কারুকাজ করা মেহগনি হলঘর। সবশেষে জমকালো সদর দরজা চৌকাঠ পেরিয়ে আর তাড়াহুড়ো করল না তিন মূর্তি। ধীরে ঘুরে উঠে বসল কালো রঙের ফোর্ড কনসাল সিজন গাড়িতে। নাম্বার প্লেট জ্যামাইকার। মেজর বসল চালকের আসনে। পেছনের আসনে দুই বন্ধুকধারী। জোড়া খুনের ঠিক বিশ মিনিট পরে পৌঁছাল বন্দরের বাইরে। চোরাই গাড়িটা লুকানো হল রাস্তার ধারে ঘাসের আড়ালে। সেখান থেকে স্পল্পালোকিত পথে সিকি মাইল হেঁটে তিন বাটুর পৌঁছাল জেটিতে। প্রতীক্ষমান স্পীড বোটের চালু ইঞ্চিন বুঁদ বুদ করে পানি কাটছিল। তিন মূর্তি ওঠে বসতেই জানা গেল এগুলো জলযান। অদূরে ভাসছিল পঞ্চাশ টন ওজনের ক্রিসক্র্যায়াট, জাহাজ। নোঙর আধতোলা। ওপরে উড়ছিল মার্কিন পতাকা। দু দুটো ঝকমকে আন্তেনার শিক দেখেই বোঝা যায় এ জাহাজ টুরিস্ট জাহাজ। এসেছে হয় কিংসটন নয় মন্টেগু বে থেকে। তিন বাটকুল ডেকে ওঠেতেই স্পীডবোটকে তুলে নেওয়া হল ওপরে। দুটো ক্যানো ঘুরপাক খাচ্ছিল জাহাজের আশে পাশে-ভিক্ষা চাইছে। মেজর একটা পঞ্চাশ সেন্ট ছুঁড়ে দিতেই ন্যাকড়া পরা লোক দুটো ক্যানো ছেড়ে ডুব মারল পানিতে মুদ্রার খোঁজে। গর গর করে উঠল ইঞ্জিন। শুরু হল যাত্রা। তীর থেকে জেলেরা দেখল রাজহাঁসের মত পানি কেটে এগিয়ে চলেছে টুরিস্ট জাহাজ। তর্ক বির্তক শুরু হল জাহাজের যাত্রীদের নিয়ে। নিশ্চয় কোন ফিল্মস্টার জ্যামাইকায় ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরছে।
কনটেন্টে র চওড়া বারান্দায় সূর্যের শেষকিরণ যেন থমকে দাঁড়াল রক্তের দাগের ওপর। একটা ডক্টর বার্ড রেলিং পেরিয়ে এসে মিসেস হ্যাভলকের নিস্পন্দ হৃদপিণ্ডের খুব কাছে কি যেন নিরীক্ষণ করল। পরক্ষণেই উড়ে গেল ঝোপে।
ছোট্ট স্পোর্টস গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সশব্দে মোড় ফিরছে গাড়িটা। মিসেস হ্যাভলক বেঁচে থাকলে এখুনি চেঁচিয়ে উঠতেন– জুড়ি অনেকবার বলেছি ওভাবে মোড় ঘুরিসনি। বড় কাঁকর ছিটকোয়। ঘাসকাটা মেশিনের দফারফা হচ্ছে শুধু তোর জন্যই।
***
একমাস পরের ঘটনা। লন্ডন শহর। অক্টোবর মাস। শীতের সবে শুরু। রিজেন্ট পার্কে ঘাসকাটা চলছে। শব্দ ভেসে আসছে M এর অফিসঘরের খোলা জানালা দিয়ে। ঘাস কাটার এ যন্ত্র মোটরে চলে। জেমস্ বন্ড তাই ভাবছিল সাবেকী আমলের মেশিনের ট্যাং ট্যাং লোহার আওয়াজ বুঝি বিদায় নিচ্ছে ধরিত্রীর শব্দ জগৎ থেকে।
বন্ডের নানা ভাবনার মধ্যে M কাজের কথায় এসেও আসতে পারছেন না। বন্ড জানিয়েছিল, হাতে কাজ নেই। তাই খুশি মনে কাজ প্রত্যাশা করছিল। অফিস টাইমে ডিউটিতে থাকার সময়ে M কখনো নাম ধরে ডাকেন না। তখন জেমস্ বন্ডের নাম 007। কিন্তু আজ সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। M বন্ডকে নাম ধরে ডেকেছেন। হয়ত ব্যক্তিগত কিছু, হয়ত হুকুম নয় অনুরোধ করবেন M। বন্ড নিজেও লক্ষ্য করল, M-এর সাংঘাতিক স্বচ্ছ, তুহিন শীতল চোখের আকাশে একটা উদ্বেগ ভাসছে।
চেয়ার ঘুরিয়ে বসলেন M। দেশলাইয়ের বাক্স জোরে টেবিলে নিক্ষেপ করলেন। লাল চামড়ার ওপর দিয়ে হড়কে এল বন্ডের সামনে। বন্ড খপ করে ধরে ফের ফিরিয়ে দিল টেবিলের মাঝে। M হেসে বললেন, জেমস, আমাদের সকলেই জানে কার কি কাজ, তাই না? কিন্তু আমি বড় একা।
ভুরু কুচকে বন্ড বলল, বুঝেছি, অ্যাডমিরালকে হুকুম দিয়ে হয়। তাই তিনি একা। বাকি সবাই শুধু হুকুম তামিল করেই খালাস।
পাইপ নামালেন M গোড়ায় একজনকে মজবুত হতেই হবে। সে শুধু ঠিক করবে এবার কি করণীয়। চল্লিশের পর মজবুত থাকা যায় না। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অনেকে ভগবানের কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত। কষ্ট পায়, ট্র্যাজেডি : ঘটে। অসুখে ভোগে। জেমস, বিপজ্জনক সে বয়স এখনো তোমার আসেনি। তুমি এখনো দেহে এবং মনে মজবুত। সে হিসেব জানা আছে।
প্রশ্নটা নেহাতই ব্যক্তিগত, মোটেই পছন্দ হল না বন্ডের। বউ নেই, ছেলেপুলেও নেই। ট্র্যাজেডি কি জিনিস সে জানে না। কোন অসুখ বিসুখও কখনো হয়নি। তাই দ্বিধা জড়িত কণ্ঠে, ইয়ে ব্যাপারটা কি জানেন, কাজ যাই হোক না কেন, কারণটা যদি ন্যায্য হয়, তাহলে যে কোন শক্ত অবস্থায় খাড়া থাকবার ক্ষমতা আমার আছে।
দেখলে তো, অধীর কণ্ঠ M-এর, তুমিও আমার হুকুমের প্রত্যাশায় বসে, আমি যা বলব, তার এক পাও বাইরে যাবে না। আমাকেই ভাবতে হবে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। বলে সামলে নিলেন নিজেকে, কি আর করা যায়। আমার চাকরিই তো তাই।
M-এর জন্য দুঃখ হল বন্ডের। এই প্রথম M-কে ভেঙে পড়তে দেখল সে। নিশ্চয় M এবার নিজেই কোন ঝামেলায় পড়েছেন। কিন্তু কিসের ঝামেলা? বন্ড শুধাল–স্যার, আমাকে দিয়ে কিছু হবে কি?
বন্ডের দিকে বারেক তাকিয়ে চেয়ার জানলার দিকে ঘুরিয়ে M বললেন, হ্যাভলকের কথা মনে পড়ে কি?
কাগজে পড়েছিলাম। জ্যামাইকার প্রধান দম্পতি। একরাত্রে মেয়ে বাড়ি ফিরে দেখল দুজনেই গুলিতে ঝাঁঝরা। খুব সম্ভব আততায়ীরা হ্যাঁভানার গুণ্ডা। সংসারে দেখাশুনা করে যে মেয়েটি, সে বলেছিল, তিনটে কিউবার মত দেখতে লোক এসেছিল। গাড়িটা চোরাই গাড়ি। সেই রাতেই বন্দর থেকে একটা বজরা প্যাটানের জাহাজের রওনা হয়েছিল। স্যার, আর জানি না। এ কেস আমার কাছে পাঠানো হয়নি।
না পাঠানোর কারণ ছিল। কেসটা আমার ব্যক্তিগত এখতিয়ারের। তাই কারো হুকুম ছিল না এ নিয়ে ঘামানোর। হ্যাভলক দম্পতি আমার স্থানীয় বন্ধু। ওদের বিয়েতে আমি বেটাম্যান ছিলাম। ১৯২৫ সালে মাল্টায় বিয়ে করেছিল ওরা।
অ।
হ্যাভলকরা লোক ভাল। স্টেশন সি-কে বলেছিলাম একটু চোখ রাখতে। কিন্তু ব্যাটিসটার স্যাঙাতদের টিকিও ছুঁতে পারল না। অথচ ক্যাসট্রো এখনো রয়েছে। ক্যাসট্রোর গুপ্তচরে তো সরকারী দপ্তর ছেয়ে গেছে। হ্যাভলকদের খুন করিয়েছে ভন হ্যাঁমারস্টাইন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে জাল ছিঁড়ে যে কটা নাৎসী গা ঢাকা দিয়েছিল, অন হ্যাঁমারস্টাইন তাদের অন্যতম। লোকটা আগে ছিল হিটলারের গুপ্ত পুলিশ গেস্টাপোতে। ব্যাটিসটার চাকরিতে বহাল হয়ে হ্যাঁমারস্টাইন মন দিয়ে কাজ করেছে। অর্থাৎ চর-চক্ৰ উৎখাত। ব্ল্যাকমেল করে অনেক টাকাও জমিয়েছে। বেশ জমিয়ে বসেছিল। কিন্তু ক্যাসট্রোর জয় জয়কারে আসন টলছে। সবার আগে চম্পট দেওয়ার প্ল্যান করল হ্যাঁমারস্টাইন। কিউবার বাইরে টাকা পাঠাতে লাগল। জমিজমা কেনার ভার রইল গোনজালিস নামে এক অফিসারের ওপর। দু-দুটো খুনে স্যাঙাৎ অষ্টপ্রহর আগলে বেড়ায় গোনজালিসকে। গোনজালিসের কাজই হল সব চাইতে ভাল সম্পত্তি চড়া দামে কেনা। হ্যাঁমারস্টাইনের টাকার অভাব নেই, আর কুবুদ্ধিরও অভাব নেই। তাই টাকার প্রলোভনে ব্যর্থ হলে, গোনজালিস খোকাখুকুদের গায়েব করেছে। বিঘের পর বিঘে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। জ্যামাইকার অন্যতম সেরা সম্পত্তির মালিক হ্যাভলক দম্পতি। গোনজালিস সেখানে এসেছিল। হ্যাঁমারস্টাইনের হুকুম ছিল, মিষ্টি কথায় বেচতে না চাইলে যেন হ্যাভলকদের পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের পঁচিশ বছরের মেয়ের ওপর চাপ দেওয়া হয়েছে। তারপর যা হবার হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে কুকীর্তির জন্য হ্যাঁমারস্টাইনকে বরখাস্ত করেছে ব্যাটিসটা। গোনজালিস হ্যাভলকদের রক্তে হাত রাঙিয়ে হাওয়া হয়েছে। সেই থেকে হ্যাঁমারস্টাইনও উধাও সঙ্গে তিন চ্যালা। ভাল সময়েই গেছে। কেননা ক্যাসত্ৰেী এল বলে।
গেছে কোথায়? ধীর গলা ধরে।
আমেরিকায়। উত্তর ভার্নমেন্টে। ক্যানাডিয়ান বর্ডারের ধারে কাছেই। একো হ্রদ বলে একটা জায়গা আছে। চারপাশে পাহাড়, মাঝে লেক। লোকজন আসার বালাই নেই। মোটা টাকায় হ্যামারস্টাইন সেই জায়গায়টা ভাড়া নিয়েছে।
খবরটা পেলেন কার কাছে।
এডগার হুভারকে কেস রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম। হুভার একে চেনে। মিয়ামি থেকে ক্যাসট্রো পর্যন্ত গুলিগোলার বহরে ও ব্যতিব্যস্ত। মার্কিন মুলুকের লুঠতরাজি টাকার স্রোতহ্যাভানায় জুয়া আর নাচের আড্ডায় আসবার পর থেকেই হাভানা নিয়ে টনক নড়েছে হুভারের। ওর কাছেই খবর পেলাম, হ্যাঁমারস্টাইন ছ মাসের ভিসা নিয়ে আমেরিকায় এসেছে। হুভারের খুব উৎসাহ ওকে জ্যামাইকায় চালান দেওয়ার। আমি এখানকার অ্যাটনী জেনারেলের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, হ্যাঁভানা থেকে সাক্ষী না আসা পর্যন্ত ওকে জ্যামাইকায় পাঠানো যাবে না। হ্যাভানা থেকেও কেউই আসবে না। হুভার ওর ভিসা বাতিল করতে চাইলে আমি রাজি হইনি পাহাড় অঞ্চলের কমিশনারকে ধরতে উনি একটা টহলদারী প্লেন পাঠিয়ে দিলেন একো লেক অঞ্চলের সীমানা বরাবর। প্লেন যা দেখবার সব দেখে এসেছে। অন্যান্য সাহায্যও ওঁর কাছে পাওয়া যাবে। এবার ভাবছি, কি করব। সে ভাবনা তো আমারই।
এতক্ষণে বন্ড বুঝল, কেন M এত উদ্বিগ্ন, কেন উনি মীমাংসায় পৌঁছোনোর ভারটা নিজের কাঁধে না রেখে অন্যের কাঁধে রাখতে চান। নিহত ব্যক্তিরা M-এর বন্ধু। হত্যাকারীর নামও জানেন M, এক্ষেত্রে খুনীর বিচারের ভার তিনি নিতে পারেন না। কোন বিচারকই নিতে পারেন না। পরিস্থিতিতে রায় দিতে হবে এমন একজনকে, যে হ্যাভলকদের চেনে না, হামারস্টাইনকে জানে না।
বন্ডই সেই ব্যক্তি। M চাইছেন বন্ড রায় দিক। দণ্ডের ভারও নিজের হাতে তুলে নিক। হ্যাঁমারস্টাইন জংলী আইন প্রয়োগ করেছিল নিরীহ অসহায় দুটি বয়োবৃদ্ধ মানুষের ওপর। এ অপরাধের সমুচিত শাস্তির বিধান একমাত্র জংলী আইনেই আছে। প্রতিহিংসা চিরকালেই প্রতিহিংসা–সেখানে মায়া-দয়া নেই।
বন্ড বলল, স্যারনির্দ্বিধায় বলছি, রক্তের বদলে রক্ত চাই। বিদেশী গুপ্তাদের শায়েস্তা করতে হলে ইংলিশ দাওয়াইয়ের চাইতে মিষ্টি মধুর আর কিছু নেই।
চেয়ে রইলেন M। উৎসাহ বা মন্তব্য–কোনটাই ধ্বনিত হল না নীরব কণ্ঠে।
বন্ড বলল, ফাঁসি নয়, এদের খুন করা দরকার।
বন্ডের দিকে আর তাকালেন না M। ক্ষণেকের জন্য শূন্য দৃষ্টি যেন ধাবিত হল অন্তরের অন্দর। এরপর হাত বাড়ালেন ওপরের ড্রয়ারের ভেতরে। বেরুল একটা পাতলা ফাইল। ওপরে যথাবিধি কিছুই লেখা নেই। অত্যন্ত গোপনীয় ফাইলের পরিচিত চিহ্ন সেই লাল তারাও নেই।
এইবার বেরুল একটা রাবার স্ট্যাম্প আর প্যাড। প্যাডেস্ট্যাম্প টিপে ফাইলের কোণে ছাপ দিলেন M। তারপর ফাইল এগিয়ে দিলেন ভের দিকে।
জ্বলজ্বল করতে লাগল রক্ত রাঙা স্যানসেরিফ টাইল।
ফর ইওর আইজ অনলি, অর্থাৎ, একান্ত গোপনীয়।
কথা বললে না বন্ড। নীরবে সায় দিল। ফাইল তুলে নিয়ে মার্জার চরণে নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে। দুদিন পরে শুক্রবারের কমেট প্লেনে ময়ট্রিয়ন পৌঁছাল জেমস্ বন্ড। কমেটে আকাশে উড়তে মোটেই ভাল লাগে না বন্ডের। বড় উঁচুতে ওড়ে, ছোটেও শব্দের আগে, যাত্রীও একগাদা। আহারে, মান্ধাতা আমলের স্ট্রাটোক্রুজারের, সে-সব দিন কি আর আসবে। আটলান্টিক পেরোতেই লাগত দশ ঘন্টা। ডিনার খেয়ে টেনে ঘন্টা সাতেক নাক ডাকানো যেত বাকে। পশ্চিম দিগন্তের সোনালি আলোয় কেবিন ভরে উঠলে ধীরে-সুস্থে নেমে এসে বি.ও.এ.সি. মার্কা পেঁইয়া সকালের নাস্তা খাওয়ার সে মজা এখন আর নেই। এখানে সব কিছুই যেন পলক ফেলতে না ফেলতে ঘটে যায়। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের দুলুনি। আট ঘণ্টায় লন্ডন থেকে মনট্রয়ল।
মনট্রিয়লে নেমে প্লিমাউথ সেলুন হাঁকিয়ে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের সদর অফিসে পৌঁছাল বন্ড। জায়গাটার নাম ওটাওয়া। ধূসর রঙের পেল্লায় ইমারতের ভেতরে ঢুকে কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাইল। নিজের নাম বলল শুধু জেমস্। M-এর নির্দেশ ছিল তাই। একটা ছোকরা করপোর্যাল ওকে নিয়ে গেল চারতলায়। একগাল। আসবাবপত্রে ঠাসা একটি ঘরে একজন সার্জেন্টের হাতে ওকে সঁপে দিয়ে বিদায় নিল। সার্জেন্ট কার সঙ্গে যেন ইন্টারকমে কথা বলে নিল। তারপর মিনিট দশেক প্রতীক্ষা। অবশেষে ডাক পড়ল যে ঘরে, সে ঘরে ঢুকতেই জানালার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়াল নীলরঙা স্যুট পরা দীর্ঘকায় এক পুরুষ। দেখে বয়স বেশি মনে হয় না। পাতলা হেসে বলল, মিটার জেমস? আমার নাম কর্নেল…ধরুন, কর্নেল জল।
করমর্দনের পর কর্নেল বলল, আপনাকে স্বাগত জানাতে কমিশনার নিজে হাজির থাকতে পারলেন না বলে উনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সর্দিতে কাহিল হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক, কি ধরনের সর্দি বুঝতেই পারছেন, কৌতুক উজ্জ্বলিত চক্ষু কর্নেলের। কূটনৈতিক ঠাট বজায় রাখতে এমনি সর্দি সকলেরই হয়। ওঁর আদেশে আপনার সেবায় আমি রইলাম। সারাদিনটা যা বলবেন, তাই করব। বুঝলেন?
বড় বুঝল। হাড়ে-হাড়ে বুঝল। কমিশনার সব সাহায্যই দেবেন–কিন্তু দানা পরে। আঙুলের ছাপ কোথাও পড়বে না–অথচ কাজ হাসিল হয়ে যাবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। হুঁশিয়ার হল বন্ড।
বলল, লন্ডন থেকে অবশ্য শুনেই এসেছিলাম, কমিশনার নিজে এ ব্যাপারে থাকবেন না। আমার কর্তাও তা চান না। কমিশনারকে আমি চিনি না, তাঁর হেডকোয়ার্টারের ছায়াও মাড়াইনি। সুতরাং আসুন না মিনিট দশেক প্রাণ খুলে কথা বলা যাক।
কর্নেল জল হেসে ফেলল, নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার ওপরেও হুকুম আছে, গাওনাটা আগে ভাগে গেয়ে নিয়ে কাজে হাত দেবার। বুঝতেই তো পারছেন, অনেকগুলো বেআইনি ব্যাপার করব আপনাকে-আমাতে। বাজে হল ছুতোয় শিকারের লাইসেন্স নেওয়া, সীমান্তের কানুন ভাঙা, সবশেষে আরও খারাপ কাজ করা। তাই না?
হুবহু তাই। এখান থেকে একবার বেরালে কেউ কাউকে চিনতেই পারব না। জেলে আটকা পড়লে তো কথাই নেই। বলুন, এবার কি?
ড্রয়ার টেনে একটা ফাইল বার করল কর্নেল। প্রথমেই রয়েছে একটা ফর্দ। পয়লা দফায় পেন্সিল ঠেকিয়ে তাকাল বন্ডের দিকে। তীক্ষ্ণ চোখ পিছলে গেল বন্ডের সাদা-কালো কুকুর-দাত প্যাটার্নের ট্যুইড-স্যুট, সাদা শার্ট আর এক চিলতে কালো টাইয়ের ওপর দিয়ে।
বলল, জামাকাপড়। ফাইল থেকে বেরুল একটা কাগজ। নিন, পুরোনো জামাকাপড়ের দোকানের ঠিকানা এতে আছে, আর আছে একটা ফর্দ, চট করে চোখে লাগে, এমনি বাহারি পোশাকের ধার দিয়েও যাবেন না। খাকি শার্ট, গাঢ় বাদামী জীন্স, পাহাড়ী বুট। দেখে নেবেন যাতে পরে অস্বস্তি না হয়। কেমিস্টের ঠিকানাও রইল। গেলেই বাদামী রঙ পাবেন। গ্যালন খানেক কিনবেন। বেশ করে গোসল করবেন। এসময়ে পাহাড়ে বাদামী রঙ বিস্তর দেখবেন। প্যারাসুট কাপড়ের দরকার হবে না। ঘাপটি মারবার জন্য বাড়তি কিছুই লাগবে না, বুঝলেন? ধরা যদি পড়েন তো দেখা যাবে জাতে আপনি ইংরেজ, কানাডায় এসেছেন শিকারের নেশায়, পথ ভুলেছেন, সীমান্ত পেরিয়েছেন। : রাইফেল? বাইরের ঘরে মিনিট দশেক বসে ছিলেন আপনি। সেই ফাঁকে আমি নিজেই নিচে গিয়েছিলাম, আমার প্লিমাউথে রাইফেলটা রেখে এসেছি। নতুন মডেলের স্যাভেজ ৯৯ এফ, ওয়েদারবাই ৬৬২ স্কোপ, ট্রিগার টিপলেই পাঁচটা গুলি বেরোবে পর-পর। ম্যাগাজিনে বুলেট থাকে একসঙ্গে বিশটা, হাইভেলসিটি ২৫০-৩.০০০। বাজারে এর চাইতে হাল্কা শিকারী রাইফেল আর নেই। ওজন মাত্র সাড়ে-ছ পাউন্ড। আমার এক বন্ধুর রাইফেল। যে কোন দিন ফেরৎ পেলেই চলবে। না পেলেও বন্ধুবর মন খারাপ করবে না। পরখ করে দেখেছি পাঁচশ গজ দূর পর্যন্ত এর বুলেট ছোটে। বন্দুকের লাইসেন্স, বলে লাইসেন্সটি এগিয়ে দিল কর্নেল পাসপোর্টে যে নাম দিয়েছে, লাইসেন্সও, সেই নামে রইল। শিকারের লাইসেন্সও ঐ নামে। খেয়াল রাখবেন, হরিণ মারবার মরসুম এখন নয়। ছোটখাট শিকার ছাড়া বড় শিকারের ছাড়পত্রও নয় এ লাইসেন্স। ড্রাইভিং লাইসেন্স নতুন করে দিলাম। হ্যাঁভারস্যাক, কম্পাস গাড়িতে রেখে এসেছি। ভাল কথা, নিজস্ব রিভলবার কাছে আছে নিশ্চয়।
তা আছে। ওয়ালথার পি,পিকে, বার্নল মানি হোর।
নাম্বারটা দিন। নাম্বার ছাড়া একটা লাইসেন্স আনিয়ে রাখিয়েছি। দৈবাৎ এ রিভলবার ফেরৎ এলে ধামাচাপা দেবার পথ পরিষ্কার রইল।
রিভলবার বার করে নাম্বারটা বলল বন্ড। ফর্মে লিখে নিয়ে ফেরৎ দিল কর্নেল।
এবার, ম্যাপ। এসো কোম্পানির এই ম্যাপেই কাজ হবে। তাটের সব কিছুই এতে পাবেন। উঠে এসে ম্যাপটা বন্ডের সামনে টেবিলে বিছিয়ে ধরে কর্নেল-১৭ নম্বর রাস্তা ধরে মনট্রিয়ল ফিরে যাবেন। তারপর ৩৭ নম্বর রুট ধরুন, সেন্ট অ্যানির ব্রীজ পেরিয়ে ফের ধরুন ৭ নম্বর রাস্তা। পাইক নদী পৌঁছে স্ট্যান ব্রীজের কাছে নেবেন ৫২ নাম্বার রুট। ফ্রেলিবার্গ পৌঁছে গাড়ি গ্যারেজে রাখুন। রাস্তা ভালই, জিরেন নিয়ে সব মিলিয়ে ঘণ্টা পাঁচেকের মোটর হাঁকানো। ঠিক আছে খেয়াল রাখবেন, ফ্রেলিবার্গে যেন রাত তিনটে নাগাদ পৌঁছাতে পারেন। গ্যারেজের ছোকরার ঘুম লেগে থাকবেই। গাড়ি থেকে কি-কি নামালেন, অত খেয়াল থাকবে না। চেয়ারে ফিরে গেল কর্নেল। এবার ফাইল থেকে বেরুল দু-তা কাগজ। প্রথম কাগজে-পেন্সিলে আঁকা একটা ম্যাপের খসড়া। দ্বিতীয়টিতে আকাশ থেকে তোলা একটা ফটোগ্রাফ।
গভীর চোখে তাকাল কর্নেল বিপদ এলেই আগে পুড়িয়ে ফেলবেন কাগজ দুটো। কাজ হয়ে গেলেও পুড়িয়ে ফেলবেন। পেন্সিলে আঁকা এই যে ম্যাপ দেখছেন, এটা একটা গোপন রাস্তা। এককালে যত খুনে গুণ্ডা বাটপাড় এপথে যাতায়াত করত–আগলার। এখন ওরা স্থলপথ ছেড়ে আকাশ পথে কাজ সারে। অতএব আপনি এ পথে নিরাপদ সেকাল হলে নির্ঘাৎ গুলি খেয়ে মরতেন। সবুজ পাহাড়ে পৌঁছানোর এই হল গোপন পথ। তারপর চড়াই ভেঙে উঠবেন উপত্যকার ওপর। এই যে ক্রুশ চিহ, এইখানে রয়েছে একো লেক। ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে পুব দিক থেকেই আসা উচিত।
দূরত্ব কত? মাইল দশেক?
সাড়ে-দশ। ঐেলিগৃসবার্গ থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। ছ টা নাগাদ আসল জায়গায় পৌঁছাবেন। দিনের আলোয় ঘণ্টাখানেক। বাকি পথটুকু দেখে শুনে হাঁটবেন। বলে, চৌকোণা ফটোগ্রাফটা এগিয়ে দিল কর্নেল।
বন্ড দেখল, লন্ডনে যে ছবি সে দেখে এসেছে, তারই মাঝের অংশ বড় করে দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। পাথরের একসারি বাড়ি। স্লেটপাথরের ছাদ। ঝিলিমিলি জানালা, ছাউনি দেওয়া ছাদ, দরজার সামনেই ধুলোভরা রাস্তা, পাশেই গ্যারেজ আর কুকুরের ঘর। বাগানের পাশে পাথর বাধানো চত্বর–ফুলঝোঁপের বর্ডার। সামনেই দু-তিন একর সবুজ মাঠ–লেক পর্যন্ত। নকল হ্রদ। পাথরের টেবিল চেয়ার–বাগানে বসার উপযুক্ত। সাঁতারুর পাটাতন, মানে, ডাইভিং বোর্ড। পানি থেকে ওঠবার মই।হ্রদের পর থেকেই জঙ্গল-খাড়াই ভাবে উঠে গেছে ওপরে। কর্নেলের ইচ্ছে এই দিক দিয়েই হানা দেওয়ার। ছবিতে জনমানব নেই। পাথর বাঁধানো চত্বরে শুধু অনেকগুলো দামী অ্যালুমিনিয়ামের গার্ডেন ফানিচার্স। কাঁচের টেবিলে মদ। বন্ডের মনে পড়ল, বড় ছবিতে টেনিস কোর্ট আর আস্তাবলও ছিল। সব মিলিয়ে একো লেক হল কোটিপতির বিশ্রামালয়। নিশ্চিন্ত মনে অ্যাটম বোমার আওতা থেকে বহু দূরে বসে শ্রান্ত মনকে চাঙা করে নেওয়ার নিকেতন। এ নিকেতন আপাতত এমন একজনের দখলে, ক্যারিবিয়ান কূটনীতিতে যে দশটি বছর ঝড় তুলেছে এবং ছমাস জিরিয়ে নিচ্ছে শক্তির ব্যাটারিতে নতুন চার্জ দেওয়ার জন্য।হ্রদ থাকায় সুবিধেও অনেক। রক্তাক্ত হাত সহজেই ধুয়ে নেওয়া যাবে।
শূন্য ফাইল বন্ধ করল কর্নেল জন্স। টাইপ করা ফর্দটা কুচিয়ে ফেলে দিল ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে। বন্ডের সঙ্গে দরজা গিয়ে বলল, আর্মিতে যখন ছিলাম, এ ধরনের, দু একটা কাজ আমাকেও করতে হয়েছে। পুলিশের কাজে সে মজা নেই, পেনশনের প্রত্যাশায় হাত পরিষ্কার না রাখলেই নয়। যাক, কাগজেই খবরটা পড়া যাবে খন। বলে হাসল কর্নেল–ভাল হোক, মন্দ হোক খবরতো!
ধন্যবাদ জানিয়ে করমর্দন করল বন্ড। শুধাল–ভাল কথা, স্যাভেজ রাইফেলে কটা টান লাগে। একটা না দুটো? টার্গেট দেখলে এক্সপেরিমেন্টের সময় না পেতে পারি।
একটানেই কাজ হবে। হেয়ার-ট্রিগার। টার্গেট না আসা পর্যন্ত ট্রিগারে যেন আঙুল না লাগে। তিনশ গজ পাল্লার মধ্যেও আসবেন না। শুনেছি, শয়তানগুলোর লক্ষ্য নাকি ব্যর্থ হয় না। বেশি কাছে না যাওয়াই মঙ্গল। এক হাতে পাল্লা খুলে ধরে অপর হাত বন্ডের কাঁধে রাখল কর্নেল, কমিশনার একটা কথা হামেশা বলেন, বুলেট যেখানে পৌঁছায়, খামোকা সেখানে মানুষ পাঠিও না, কম্যান্ডার, কথাটা খেয়াল রাখবেন।
সমস্ত রাত এবং পরের দিনটাও মনট্রিয়লের বাইরে কো-জী মোটর কোর্টে কাটাল বন্ড। তিন রাত্রির অগ্রিম পাওনা আগেই মিটিয়ে দিল বন্ড। জিনিসপত্র দেখে শুনে নিতে হল, কিছু গ্লুকোজ বড়ি। খানিকটা মাংস (সেঁকা) আর রুটি কিনে নিজেই স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেল। একটা অ্যালুমিনিয়ামের বড় ফ্ল্যাঙ্ক কিনে তিন ভাগ ভরল হুইস্কিতে, এক ভাগ কফি দিয়ে। সন্ধ্যে হতেই ডিনার খেয়ে খানিকটা ঘুমিয়ে নিল। তারপর ওয়ালনাট রঙ পানিতে গুলে, বেশ করে গা ধুয়ে নিল। এমনকি চুলের গোড়া পর্যন্ত রাঙিয়ে নিল। ফলে চোখের নিমেষে বন্ডের রঙ পাল্টে রেড ইন্ডিয়ান হয়ে গেল। রাত দুপুর হতে না হতেই নিঃশব্দে পাশের দরজা খুলে গিয়ে বসল প্লিমাউথে। যথাসময়ে পৌঁছাল ফ্লেলিগসবার্গে।
কর্নেল জন্স বলেছিল, গ্যারেজে যে ছোকরা সারারাত ডিউটি দেয়, ঘুম চোখে সে কিছু লক্ষ্য করবে না। কিন্তু বন্ড দেখল, ছোরার চোখে ঘুম নেই।
মিস্টার কি শিকারে যাচ্ছেন?
বন্ড কাঁধের রাইফেল নামাতে নামাতে বলল, হু।
শনিবার হাইগেট ঝরণার ধারে একটা ভারি সুন্দর বীভার মেরে আনলেন একজন।
তাই নাকি? অন্যমনস্কভাবে বলে বন্ড বেরিয়ে পড়ল গ্যারেজ থেকে। সদর রাস্তা ধরে খানিক হাঁটতেই ডাইনে দেখা গেল কালচে পথটা। পায়ে চলা রাস্তা সেঁধিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। আধঘণ্টা চলার পর দেখা গেল একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। অন্ধকার খামার বাড়ি। বাড়ি প্রদক্ষিণ করে নদীর ধারে যেতেই আবার পথটা পাওয়া গেল। এবার তিনমাইল যেতে হবে। কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল, এবার নীরবতা। লম্বা পা চালিয়ে বন্ড এগোল। নরম পাহাড়ী জুতায় বেশ আরাম। ভোর চারটে নাগাদ জঙ্গল কমে এল, ডাইনে ফ্রাঙ্কলিনের আলো দেখা গেল। পিচের রাস্তা পেরিয়ে ফের মেঠো পথ। পাঁচটা নাগাদ ১০৮ ও ১২০ নম্বর সদর রাস্তা পেরিয়ে শুরু চড়াই ভাঙা। বেশ খানিকটা উঠে বন্ড ম্যাপটা পুড়িয়ে ফেলল। মনের চোখে বন্ড পাহাড়ের ওদিকের দৃশ্য দেখল। জানালায় পর্দাটানা বাড়ির মধ্যে ঘুমোচ্ছে চারটে রক্তলোভী মানুষ-পশু। জল্লাদ যাচ্ছে চার শয়তানকে যমালয়ের রাস্তা দেখাতে।
বন্ড পাহাড়ের মাথায় উঠেও নিচের উপত্যকা দেখতে পেল না। একটু জিরিয়ে একটা ওক গাছের মগডালে উঠল বন্ড। এবার চোখের সামনে ভেসে উঠল সবুজ পাহাড়ের দিগন্ত ছোঁয়া বিস্তার। পুব আকাশে সূয্যদেবের স্বর্ণগোলক। দু হাজার ফুট ঢালু জঙ্গলের প্রান্তে চওড়া মাঠ, হ্রদ, বাড়ি
ভোরের আলো মিনিট পনেরোর মধ্যেই হ্রদের পানিতে পড়ল। সবুজ মাঠ আর স্লেট ছাদ ঝলমল করে উঠল। রঙ্গমঞ্চ পরিষ্কার। এবার নাটক শুরু হবে।
পকেট থেকে টেলিস্কোপ বার করে টার্গেট দেখতে লাগল বন্ড। মাঠের কিনারায় দাঁড়ালে বাড়ির ছাদ রাইফেলের আওতার পাঁচশ গজের মধ্যে। ড্রাইভিং-বোর্ড আর হ্রদের তীর আসে তিনশ গজের মধ্যে। চার শয়তান কখন কি করে কিছুই জানা নেই, তাই সবুর করাই ভাল। কিন্তু বেটারা সকালে ওঠে কখন?
প্রশ্নের জবাবে পর্দা উঠে গেল একটা জানালা থেকে। স্প্রিং রোলারের শব্দ অত দূর থেকেও স্পষ্ট ভেসে এল বন্ডের কানে। একো লেক নামের তাৎপর্য এতক্ষণে বোঝা গেল। প্রতিধ্বনি হ্রদ। সামান্য আওয়াজের প্রতিধ্বনিও গম গম করে উঠে আসছে হ্রদে প্রতিহত হয়ে পাহাড় বেয়ে। কিন্তু বন্ডের নড়াচড়ার শব্দ নিচে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই।
বাদিকের একটা চিমনির ডগায় ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। বন্ড কল্পনা করল, নিশ্চয় মাংসের বড়া আর ডিম ভাজা শুরু হবে এখুনি। সেই সঙ্গে গরম গরম কফি। কিঞ্চিৎ খাদ্য উদরে দেওয়া দরকার, তারপর ফায়ারিং পয়েন্টে নেমে শুরু হবে গুলি বর্ষণ।
কিন্তু রুটি গলায় আটকালো। উদ্বেগ বাড়লে যা হয় আর কি। গলা কাঠ হয়ে আসছে, কল্পনায় দেখল, স্যাভেজ রাইফেল গুলি বর্ষণ শুরু করেছে। মিশমিশে কালো বুলেটগুলো যেন ধীর গতিতে নেমে যাচ্ছে নিচে উপত্যকার গোলাপি চামড়া লক্ষ্য করে। চামড়া ছিঁড়ে যেন তপ্ত বুলেট প্রবেশ করল ভেতরে…আরও ভেতরে…ধীরে এগুচ্ছে ছন্দিত হৃদপিণ্ডের দিকে…টিশু আর শিরা উপশিরা সরে সরে পথ করে দিচ্ছে বুলেটটাকে।
ফ্লাস্কে চুমুক দিল বন্ড। হুইস্কি আর কফির মিশ্রণ পৌঁছল পাকস্থলীতে, শরীর গরম হচ্ছে। রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে অতি সন্তর্পণে নামতে লাগল গাছপালার ফাঁক দিয়ে। এমনভাবে নামতে লাগল যেন কোন শব্দ না জাগে। কিন্তু শব্দ জাগল। সমগ্র বনস্থলী সজাগ হল বন্ডের অনধিকার প্রবেশে। দুটো বাচ্চা নিয়ে ভয়ার্ত চোখে পালাল একটা হরিণী। একটি ভারি সুন্দর কাঠঠোকরা পাখি মহা সোরগোল তুলল। বেশ কয়েকটা ডোরাকাটা কাঠবেড়ালী দাঁত খিঁচিয়ে গলা বাড়িয়ে বেজায় লম্ফ ঝম্প শুরু করল। বন্ড মহা ভাবনায় পড়ল।
কিন্তু না। সেরকম কিছুই দেখা গেল না। শেষে ওকগাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে বন্ড দেখল তখনো জানলায় পর্দা নামানো। ধোঁয়া উঠছে শুধু একটা চিমনি দিয়ে।
আটটা বাজে। ঢালু মাঠের মাঝে মস্ত একটা মেপল্ গাছকে মনে ধরল বন্ডের। জামা কাপড়ের সঙ্গে রঙে দিব্বি মিশ খাবে ও গাছ। ঘাপটি মারবার উপযুক্ত জায়গা। হৃদ আর বাড়ি দুদিকেই নজর রাখা যাবে। তবে ঘাসের মধ্যে দিয়ে বুকে হেঁটে পৌঁছতে হবে। হাওয়া বইছে। যতক্ষণ হাওয়া বইবে, ততক্ষণ বন্ডের গতিও গোপন থাকবে। নইলে–
আচম্বিতে একটা শব্দ শোনা গেল। মট করে একটা ডাল ভাঙল বাঁদিকে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু পেতে বসে পড়ল বস্তু। ঝাড়া দশ মিনিট ওৎ পেতে রইল।
পশু পাখিরা শুকনো ডাল ভেঙে শব্দ সৃষ্টি করে না। শুকনো কাঠ বিশেষ বিপদ সংকেত বহন করে ওদের কাছে। তাই ওরা অত হুঁশিয়ার। তবে কি জঙ্গলেও পাহারা বসিয়েছে হ্যাঁমারস্টাইন?
সন্তর্পণে কাঁধ থেকে রাইফেল নামাল বন্ড। বুড়ো আঙুল রইল সেফটি ক্যাচে। সহসা দুটো হরিণ হেলতে দুলতে এগিয়ে গেল গাছের দিকে, যেখানে ডাল ভেঙেছে। শান্ত চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল বন্ড। পাহারাদার নয়, এরাই শব্দ সৃষ্টি করেছে।
ঘাসের মধ্যে দিয়ে সাপের মত বুকে হেঁটে পাঁচশ গজ যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, তবুও বন্ড এগুলো। হাওয়া বইছে, ঘাস দুলছে।
আকাশ থেকে দেখলে মনে হত যেন মস্ত একটা উদবিড়াল ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগুচ্ছে। না, একটা নয়–দুটো উদবিড়াল। কেননা, ঘাস সমুদ্রে পেছন থেকে এগিয়ে আসছে আর একজন বন্ডের মতই ঘাসের মধ্যে বুকে হেঁটে।
বন্ড কিন্তু কিছুই টের পায়নি। লক্ষ্য শুধু মেপল গাছের দিকে। বিশ ফুট দূরে এসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য থামল। হাঁটু আর কনুই টনটন করছিল। তাই ম্যাসাজ করছে, এমন সময়ে ফিসফিসানি শোনা গেল বাঁদিক থেকে। শুনেই আচমকা ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে কট করে উঠল বন্ডের পিঠের শিরদাঁড়া।
লাশ ফেলে দেব আর এক ইঞ্চি নড়লেই, গলাটা মেয়েলী। কিন্তু হুকুমটা কঠোর।
বন্ডের বুকের মধ্যে দুরমুশ পেটা শুরু হয়ে গেল তীরের ডগা দেখে। মাত্র আঠারো ইঞ্চি দূরে ঘাসের মধ্যে থেকে মাথা তাগ করে রয়েছে নীলচে ইস্পাতের তীরের ফলা।
ধনুকটা জমির সঙ্গে সমান্তরাল করে ধরা, ঘাসের মধ্যে লুকানো ছিলের সঙ্গে তীর ধরে, আঙুলটার গাঁট পর্যন্ত সাদা হয়ে গিয়েছে। পটভূমিকায় জ্বলজ্বল করছে একজোড়া ধূসর চোখ, ঘামে চকচকে রোদে-পোড়া তামাটে চামড়া। থুথু দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল বন্ড। অতি সন্তপর্ণে ডান হাত এগোল রিভলবারের দিকে। মোলায়েম স্বরে–তুমি আবার কে হে?
তীরের ডগা ভয়ঙ্কর ভঙ্গিমায় নড়ে উঠল। বামাকন্ঠ ডানহাত নড়াবেন না। কাধ ফুটো করে দেব। কে আপনি? গার্ড
না। আপনি কে?
আহাম্মক। কি করছেন এখানে? উচ্চারণ শুনে মনে হল স্কটল্যান্ড বা ওয়েলস-এর বাসিন্দা।
হে রবিনা। তীর ধনুকটা নামালে হয় না? নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলা যেত।
রিভলবারে হাত দেবেন না বলুন?
না। আপাতত ঘাসজমির ভেতর থেকে বেরুনো যাক। বলে আর দ্বিধা করল না বন্ড। ফের কনুই আর হাঁটুর ওপর দিয়ে দেহটাকে সরীসৃপ ভঙ্গিমায় টেনে নিল মেপল গাছের দিকে। মেয়েটির ব্যবস্থা হবে তারপর। গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার আগেই এ মেয়েকে গুলির পাল্লার বাইরে সরাতে হবে।
গাছের গুঁড়ির কাছে পৌঁছল বন্ড। উটে দাঁড়াল অতি সাবধানে। রোদ্দুরে জ্বলন্ত পাতার মধ্যে দিয়ে দেখল, অনেকগুলো জানালার পর্দা এর মধ্যেই সরে গেছে। ভোলা উঠোনে জমজমাট সকালের নাস্তার আয়োজন করছে দু জন কাফ্রী মেয়ে। কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বন্ড বসল। ঘাসের ভেতর থেকে মেয়েটা বেরিয়ে। এল। হাতে তীর ধুনক, তবে ছিলে এখন ঢিলে।
মেয়েটাকে দেখতে বেশ। তবে জামাকাপড়ে চুলে শ্রী নেই। শার্ট আর ট্রাউজার্স ছেঁড়া, কাদামাখা। পোশাক জলপাই সবুজ রঙের। সোনালি রঙের চুল আঁট করে বাঁধা। চোখে মুখে বুনো রূপ, উঁচু হনু, রূপো রূপো ধূসরাভ ভৎর্সনা মেশানো চোখ। একটা হতে কালসিটে আর আঁচড়ের দাগ। আঁচড় কনুইতেও। হাতে ধনুক আর কোমরের বেল্টে শিকারী ছুরি ছাড়া আর কোন হাতিয়ার নেই। নিতম্বে একটা ছোট্ট বাদামী ক্যানভাসের ব্যাগ–খুব সম্ভব খাবারের থলি। সব মিলিয়ে এ রূপ দেখলেই মনে হয়, সুন্দরী কিন্তু বিপজ্জনক নারী। বন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি নিবিড়। জঙ্গল তার নখদর্পণে। জীবনপথে একলা চলার সাহস আছে। সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক অতি ক্ষীণ।
চমৎকার! মনে মনে ভাবল বন্ড। হেসে বলল, তোমার নাম দিলাম রবিন হুড–রবিন হুডের মহিলা সংস্করণ। আমার নাম জেমস্ বন্ড। ছিপি খুলে ফ্লাস্ক এগিয়ে দিয়ে খাও কফি আর আগুন-পানি একসঙ্গে মেশানো। চাও তো শুকনো মাংসও দিতে পারি। নাকি, ফল আর শিশির খাওয়া অভ্যেস?
কাছে এল সুন্দরী। কিন্তু গজখানেক তফাতে বসল। বসার কায়দা রেড ইন্ডিয়ানদের মত। মুখে ফ্লাস্ক উপুড় করে খানিকটা তরল আগুন গলায় ঢালল। ধন্যবাদ শব্দটা কোনমতে আউড়ে তীরটা গুঁজে রাখল তৃণে। চোখে চোখ রেখে বলল, চুপিসাড়ে জঙ্গলে ঢুকেছেন মনে হচ্ছে। হরিণ শিকারের মরসুম শুরু হতে এখনো তিন সপ্তাহ দেরি। এখানে হরিণ পাবেন রাত্রে, যদি আরও ওপরে ওঠেন তবে দিনেই হরিণ পাবেন। গোটা দলটা পাবেন কিন্তু শব্দ করতে পারবেন না।
তুমিও কি সেই মতলবে ঘুর ঘুর করছ? শিকারী? দেখি লাইসেন্সটা।
বিনা বাক্যব্যয়ে বুকপকেট থেকে এক তা কাগজ বার করল। লাইসেন্সই বটে। ভাবমেন্টের বেনিংটন থেকে জুডি হ্যাভলকের নামে লাইসেন্স বেরিয়েছে। একটা ফর্দর পারমিটও রয়েছে। তীর ধনুকের জায়গায় রয়েছে। জুডি হ্যাভলকের বয়স পঁচিশ। জন্মস্থান, জ্যামাইকা।
ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল বন্ড। সর্বনাশ! মেয়েটার সাহস তো কম নয়।– জুডি, তুমি একটা মেয়ে বটে! জ্যামাইকা থেকে মাঠ-বন-প্রান্তর পেরিয়ে এসেছ পিতৃহত্যার শোধ নিতে ঐ তীর ধনুক দিয়ে? চীনদেশের সেই প্রবাদটার কথা মনে পড়ছে। প্রতিহিংসা নিতে যাওয়ার আগে, দুটো কবর একসঙ্গেই খুঁড়ে রেখ।
কে আপনি? কি করছেন এখানে? এত কথাই বা জানলেন কি করে?
নাম তো শুনলেই, আমার আবির্ভাব লন্ডন, মানে স্কটল্যান্ড থেকে। তোমার কথা আমি জানি, নিচের বাড়ির ঐ ওরা যাতে কোনদিন তোমাকে না জ্বালাতে পারে, সে ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে।
আমার অত্যন্ত প্রিয় টাট্ট ঘোড়াকে ওরা বিষ খাইয়ে মেরেছে। আমার ছোটবেলার অ্যালেসেশিয়ানকে গুলি করে খতম করেছে। তারপরেই এল একটা চিঠি, মরণের হাত অগুন্তি। একটা হাত উদ্যত হল তোমার শিরে। বিশেষ একটা দিনে খবরের কাগজে একটা নোটিশ ছাপতে হবে–হুঁকুম শিরোধার্য জুডি। সিধে গেলাম পুলিশ ফাঁড়িতে। তারা অভয় দিল। আর বলল, ভয় দেখানোর চিঠির লেখক কিউবার গুণ্ডারা বলেই মনে হয়। কিউবাতে গিয়ে নামী। দামী পোশাক আর গয়না পরে সেরা হোটেলে উঠে জুয়া খেলার খেলায় মাতলাম। কাজেই সবাই আমাকে ছেকে ধরল। আমিও এমন ভান করলাম যেন রোমাঞ্চের অন্বেষণে এতদূর আসা। জিজ্ঞেস করতে করতে অবশেষে খুঁজে পেলাম ঐ শয়তানের তর্জনীর নির্দেশে নিচের বাড়িটা দেখাল জুডি। কিন্তু বীরপুরুষ তখন কিউবা ছেড়ে পালিয়েছে। ব্যাঠিসটা নাকি অনেক কুকীর্তির খবর জেনে ফেলেছিল। বাকিটুকু উদ্ধার করলাম এক হোমরাচোমরা পুলিশ অফিসারের পেট থেকে। সে জন্য অবশ্য আমাকে একটু বেশি রকমের ঢলাঢলি করতে হয়েছিল। যাক, কিউবা থেকে সোজা গেলাম আমেরিকায়। পিংকারটনরা নাকি পৃথিবীর বিখ্যাত ডিটেকটিভ। মোটা টাকার বিনিময়ে ঐ হতভাগার এখানকার ঠিকানা পেলাম। এই হল আমার কাহিনী।
এখানে এলে কি করে?
বেনিংটন পর্যন্ত আকাশপথে। তারপর হেঁটে। চারদিন হেঁটেছি। সবুজ পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। জ্যামাইকার পাহাড়ে আমার বাড়ি। এখানকার চাইতে চড়াই উত্রাই সেখানে আরো বিপজ্জনক।
বেশ, এবার মতলব কি? মানে, কি করা হবে?
ভন হ্যামারস্টাইনকে তীর দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করা হবে। তারপর ফের হাঁটাপথে ফেরা হবে বেনিংটনে।
কথা বলার শব্দ ভেসে এল নিচের উপত্যকা থেকে। বন্ড উঠে ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখল দু জন মেয়ে আর তিনটে পুরুষ উঠানে দাঁড়িয়েছে। হাসি আর কথার মধ্যে চেয়ারে বসল। একটা চেয়ার শূন্য। এ চেয়ারের দু পাশে দুটি মেয়ে বসে। চেয়ারের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় টেবিলের মাথার দিকে।
টেলিস্কোপ বার করল বন্ড। লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল কালচে রঙের বামনাকার তিনটে পুরুষকে। একজনের মুখে হাসি যেন আর ধরে না। গোনজালিস এরই নাম সন্দেহ নেই। অপর দু জনের চাষাড়ে চেহারা।
মেয়ে দুটি শ্যামাঙ্গী। কিউবার নিচু মহলের স্বৈরিণী বলেই মনে হল। পরনে অতি উজ্জ্বল গোসলের কাপড়, বিস্তর সোনার গহনা। সুদৃশ্য বানরের মত হাসি আর কিচকিচ কথায় মত্ত, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কেননা ভাষাটা স্পেনীয়।
বন্ড টের পেল, পেছনে দাঁড়িয়েছে রূপসী বনমালা। টেলিস্কোপ দিয়ে বন্ড বলল, স্মার্ট লোকটা হল মেজর গোনজালিস। অন্য দু জন বন্দুকবাজ বডিগার্ড। মেয়ে দুটোকে চিনি না। ভন হ্যাঁমারস্টাইন এখনো আসেনি।
টেলিস্কোপে দেখে মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গেই ফেরত দিল। মন্তব্য করল না। বাবা-মার হত্যাকারীদের চিনতে পারল কি জুডি হ্যাভলক?
স্বাগত ধ্বনির উল্লাস কণ্ঠ ভেসে এল কানে। খর্বকার চৌকোনো চেহারার, প্রায় উলঙ্গ একটা লোক বেরিয়ে এল। টেবিল পেরিয়ে সবুজ লনের কিনারায় গিয়ে শরীর চর্চা শুরু হল। পুরো পাঁচ মিনিট চলল।
বন্ড মানুষটাকে দেখছিল। লম্বা প্রায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। মুষ্টিযোদ্ধাদের মত গড়ন। কুচকুচে কালো ঘন লোমে বুক ও পিঠ ঢাকা। হাতে পায়েও কালো লোমের কম্বল। কিন্তু একগাছি চুলও নেই মুখে ও মাথায়। মাথার পেছন দিকে একটা টোল। সম্ভবত পুরোনো চোট। জার্মান অফিসারের মত মুখের গড়ন চারচৌকো, কঠোর, উদ্ধত। ন্যাংটা ভুরুর তলায় চোখ দুটো শুওরের মত কুকুতে। ঠোঁট দুটো কদাকার রকমের পুরু, লালচে। মনিবন্ধে জড়োয়া ব্রেসলেটে সোনার মস্ত রিস্টওয়াচ। M-এর ফাইলে ভন হ্যাঁমারস্টাইনের যেভাবে বর্ণনা আছে। লোকটা অবিকল সেইরকমই।
বন্ড রূপসী বনমালার মুখ নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর দেখল। এতদূরে এসে দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু এ মেয়েকে নিয়ে তো ঝামেলা হবে। শেষ মুহূর্তে হয়ত তীরধনুক বার করে গোলমালও বাধাতে পারে। বেশি কিছু নয়, করোটির নিচে ঘাড়ের ওপর ছোট এক ঘা মারলেই জ্ঞান হারাবে জুডি। তারপর কাম ফতে না হওয়া পর্যন্ত মুখ আর হাত বেঁধে রাখলেই হল। বন্ড রিভালবারে হাত রাখল।
ধড়ফড় করল না বনমালা। কয়েক পা পিছিয়ে, মাটিতে টেলিস্কোপ রেখে ধনুক তুলে তুন লাগাল। বন্ডের দিকে– নষ্টামি বুদ্ধি ছাড় ন। তফাতে থাকুন আমার নজর সবদিকেই। মেরে পোস্তা ওড়াতে না পারি, তীর আমার ফসকায় না। একশ গজ দূর থেকেও পাখিরা রেহাই পায়নি আমার ধনুকের সামনে। খামোকা আপনার পায়ে তীর মারতে চাই না, পথ ছাড়ুন, মরণ বাড় বাড়বেন না।
খেঁকিয়ে উঠল বন্ড, অনেক ইডিয়েট মেয়েমর্দানী দেখেছি। এমনটি কখনো দেখিনি। ফাজলামি ছাড়, খেলনার হাতিয়ার নামাও। এ কাজ ব্যাটাছেলের–খামোকা নালা কেটে পানি আনতে যেও না। তীর ধনুক দিয়ে চার চারটে শয়তানের মহড়া নেওয়ার প্ল্যানটা কি শুনি?
একগুয়ে দুই চোখে যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। ক্রোধে কঠিন ঠোঁট নেড়ে বলল, গোল্লায় যান আপনি। বেশি টেণ্ডাই মেণ্ডাই করবেন না–সরে দাঁড়ান। খুন হয়েছে আমার বাবা-মা, আপনার নয়। এর আগেও আমি একটা দিন ও রাত্রি কাটিয়েছি। ওরা কি করে আমি জানি। আর হ্যাঁমারস্টাইনকে কোন সময়ে মাটিতে ফেলা যায় তাও আমি জানি। অন্যকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। যা বলি তা করুন। নইলে পস্তাবেন। হ্যাঁমারস্টাইনকে আমিই নিপাত করব। এই আমার পণ। ত্রিভুবনে কেউ নেই আমাকে রোখে।
মহাফাঁপরে পড়ল বন্ড। মেয়েটা ফাঁকা আওয়াজ দেবার পাত্রী নয়। তাই মোলায়েম গলায়– জুডি, সব চাইতে ভাল হয়, যদি দু জনে হাত লাগাই। লন্ডনে তোমাদের একজন ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আছেন। তাঁর হুকুমেই এসেছি ওদের খতম করতে। আমার যে হাতিয়ার, তার পাল্লাও তোমার হাতিয়ারের পাঁচগুণ। বেশি। উঠোনে ঐ অবস্থায় আমি সবকটাকে খুন করতে পারি। কিন্তু আরো সুবিধে হবে ওরা যখন লেকে গোসল করতে আসবে। আমি ঠিক তখন গুলি চালাব। তীর ছুঁড়ে আমাকে বরং সাহায্য কর।
না। ইচ্ছে হলে আপনি বরং আমাকে সাহায্য করলে করতেও পারেন। ওরা দল বেঁধে পানিতে নামবে-বন্দুকবাজ গার্ড দুটো ছাড়া। কালকেও দেখেছি এগারটা নাগাদ জলকেলি করেছে কুত্তার দল। পানিতে ওরা নামবেই। টমিগানের মত বন্দুক নিয়ে ঐ বেঁটে বকেশ্বর দুটো পাড়ে বসে পাহারা দেবে। কাল রাতে আমি নিচে গিয়ে একটা জায়গা বেছে এসেছি। তীর ছোঁড়ার উপযুক্ত জায়গা। চললাম সেখানে যদি এখনো সুবুদ্ধির উদয় না ঘটে, কাটমোল্লার যা হাল হয় আপনারও তাই হবে, বলে ছিলেয় আরো খানিকটা টান মারল রূপসী।
রেগে বন্ড বলল, বেশ, তাই হোক। একবার বেরোই জঙ্গল থেকে, তারপর এমন টাইট দেব যে ঠেলা বুঝবে। যাও চালাও তীর। আমিও নজর রাখছি। কাজ বাগিয়ে যদি ফিরতে পার তাহলে ভালই। না পারলে আমাকেই নামতে হবে। ধড়মুণ্ডু যা পাই, তুলে নিয়ে আসব খন।
ছিলেতে ঢিলে দিল রূপসী। বলল, এই তো সুবুদ্ধি হয়েছে। এ তীর একবার চামড়ায় ঢুকলে টেনে বার করাও মুশকিল। আমাকে নিয়ে আদিখ্যেতা না করে খেয়াল রাখবেন টেলিস্কোপের লেন্সে যেন রোদ না লাগে। নিচ থেকে লেন্সের ঝিকিমিকি দেখে ফেললেই মুশকিল। যেন শেষ কথা বলা হল, এমনিভাবে অদ্ভুত হাসল সুন্দরী। পর মুহূর্তে উধাও হল জঙ্গলের মধ্যে।
ধীরে-ধীরে চোখের আড়াল হল গাঢ় সবুজ তন্বী। জাহান্নামে যাক জুডি। নিমেষে মনটা তেঁতো হয়ে যায় বন্ডের। এ পরিস্থিতিতে আগেভাগে গুলি চালানোও সম্ভব নয়–মেয়েটা তাহলে মরবে। জবুথবু হয়ে বসে থাকা ছাড়া পথ নেই। আগে ঐ মেয়েমানী তীর ছুঁড়বে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
বাড়ির সামনে নড়াচড়ার আভাস দেখেই চোখে টেলিস্কোপ লাগাল বন্ড। ব্রেকফাস্টের এঁটো বাসনপত্র সরাচ্ছে ঝি দুটো রূপোজীবী দুটোর পাত্তা নেই। বন্দুকবাজ যুগলও নিপাত্তা। কোচে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছে ভন হ্যাঁমারস্টাইন। মাঝে মাঝে কথা বলছে মেজর গোনজালিসের সঙ্গে। কোচের পায়ের কাছে বাগান চেয়ারে বসে চুরুট টানছে মেজর। মধ্যে মধ্যে কাৎ হয়ে তামাক পাতা ফেলছে থু থু করে। পালের গোদার কথা পরিষ্কার না শুনলেও ভাষাটা ইংরেজি বুঝেছিল বন্ড। সাড়ে-দশটা। ঠুটো জগন্নাথের মত কাঁহাতক বসে থাকা যায়। গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে স্যাভেজ রাইফেলের প্রতিটি অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে নিল বন্ড।
হাতে আর কোন কাজ নেই। শুরু হল আকাশ-পাতাল চিন্তা। ভন হ্যাঁমারস্টাইন নিঃসন্দেহে সমাজের শত্রু। এ রকম বদমাইশের চটপট অক্কা পাওয়াই উচিত। জুডি এসেছে বাবা-মার হত্যার শোধ তুলতে। কিন্তু বন্ড? বন্ড কেন এসেছে? তার সঙ্গে হ্যাঁমারস্টাইনের কোন বিবাদ তো নেই? তবুও সমাজের শত্রুকে ধরণীর বুক থেকে সরিয়ে দেওয়াই। তার কাজ, তার পেশা, তার ব্রত। বন্ডের ডাক পড়েছে ভন হ্যাঁমারস্টাইনকে দুনিয়া থেকে সরানোর জন্য।
সহসা লাফিয়ে উঠল বন্ড। উপত্যকায় এক ঝলক আগুন দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের নির্ঘোষ শোনা গেছে। দ্বিতীয় নির্ঘোষের সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তাক করল বন্ড।
দেখা গেল, নীল ধূসর পালক ছড়িয়ে একটা মাছরাঙা পাখি ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল হ্যাঁমারস্টাইনের পায়ের কাছে। গুলিবিদ্ধ পাখি, ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল হ্যাঁমারস্টাইনের হাতে ধরা টমিগানের নল থেকে। হাসছে আর হাততালি দিচ্ছে সাঙ্গপাঙ্গরা। পালের গোদা মেয়ে দুটিকে হুকুম করার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে দুটি শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এল।
বন্দুকবাজ দুই স্যাঙাৎ টমিগানে গুলিভরা নতুন ম্যাগাজিন লাগাল। দু জনেই হেলান দিয়ে দাঁড়াল বাধের গায়ে। একই সঙ্গে শ্যাম্পেনের বোতল দুটো শূন্যে নিক্ষেপ করল ভন হ্যাঁমারস্টাইন। একই সঙ্গে ঘুরে গিয়ে একই সঙ্গে টমিগান তুলে একসঙ্গে ট্রিগার টিপল দু জনে। গুলিবর্ষণের বজ্রনির্ঘোষে থরথর করে কেঁপে উঠল উপত্যকা। পাখির দল ককিয়ে উঠে উড়ল আকাশে। গুলির ঘায়ে ছিন্নভিন্ন ডালপালা ঠিকড়ে গেল লেকের পানিতে। একটা বোতল নিমেষে গুঁড়িয়ে পাউডার হয়ে গেল। আর একটা সেকেন্ডের পরেই দু টুকরো হয়ে গেল একটি মাত্র বুলেটের ঘায়ে। বিজয়ী বন্দুকবাজের গর্ব হল, আর মাথা হেট হল অন্যজনের।
হ্যামারস্টাইন লেকের দিকে এগুচ্ছে। এবার গোসলপর্ব শুরু হবে। মেয়ে দুটি আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। ঘাসের ওপর কোট বিছিয়ে বসে পড়েছে গোনজালিস। বন্দুকবাজ দুই বডিগার্ড টমিগান কোলে নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে, প্রহরায় ত্রুটি নেই। হ্যামারস্টাইন এত অপকর্ম করেও যে এতদিন কেন বেঁচে আছে, বন্ড এবার বুঝল।
কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা? সময় বয়ে যাচ্ছে বলে বন্ড ছটফট করে। রাইফেল বাগিয়ে গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় বন্ড। হ্যাঁমারস্টাইন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ডাইভিং বোর্ডে, পানিতে ঝাঁপ দেবার জন্য হাঁটু বেকেছে। দুই হাত দুলছে– লাফিয়েছে হ্যাঁমারস্টাইন, দু পা লাফ দেবার তক্তা ছেড়ে তখনও শূন্যে–ঠিক সেই সময়ে একটা রূপালী ঝলক দেখা গেল হ্যাঁমারস্টাইনের পিঠে। পরমুহূর্তেই দেহটা গোঁৎ খেয়ে গিয়ে পড়ল লেকের পানিতে।
গোনজালিস উঠে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই কিছু চোখে পড়েছে কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু বন্দুকবাজ দুই ঠ্যাঙাড়ের চোখে দ্বিধা নেই। ওরা দেখেছে এইমাত্র কি ঘটে গেল। টমিগান উদ্যত হুকুম পেলেই হয়।
অবিশ্বাসী চোখে তখনো লেকের পানিতে তাকিয়ে আছে গোনজালিস। জার্মান গুরুর দেহ লেকের পানি তোলপাড় করে ডুবে গেছে। খুব জোরে ডুব দিয়েছে তো! কিছুক্ষণ পরেই ভাসল দেহটা। পানিতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে হ্যাঁমারস্টাইন ভাসছে। পিঠের বাঁদিকে চ্যাটাল হাড়টার ঠিক নিচেই বিঁধে রয়েছে একটা চকচকে বস্তু। অ্যালুমিনিয়াম পালক ঝলসাচ্ছে সূর্যের আলোয়। ধীরে ধীরে পানি লাল হচ্ছে।
তীক্ষকণ্ঠে মেজর গোনজালিস কি যেন বলল। আর গর্জে উঠল টমিগান। আগুনের স্রোত বয়ে গেল নল দিয়ে। গাছপালা, ঝোঁপঝাড় লণ্ডভণ্ড করছে নির্মম বুলেট রাশি। বন্ডের স্যাভেজ গর্জে উঠল। বাঁদিকের বন্দুকবাজ মুখ থুবড়ে পড়ল। ডানদিকের বন্দুকবাজ দৌড়াচ্ছে লেকের দিকে। ছুটন্ত অবস্থাতেই বন্ড গুলি করল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আবার ট্রিগার টিপল। ছুটন্ত লোকটার হাঁটু দুমড়ে পড়ল লেকের পানিতে। পানিতে পড়েও টমিগানের নল গিয়ে গুলি উড়ে গেল। লোকটা মারা গেছে কিন্তু আঙুল টাইট হয়ে বসে রয়েছে টিগারে।
লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বন্ড যে ক টি সেকেন্ড সময় দিয়েছিল মেজর গোনজালিসকে, তারই মধ্যে মেজর গিয়ে লুকিয়েছে প্রথম বন্দুকবাজের আড়ালে। সেইখান থেকেই টমিগান চলল মেপলগাছ লক্ষ্য করে। স্যাভেজের আগুন ঝলক দেখেই আঁচ করেছে শক্রর হদিস।
পর পর দু বার গুলি করল বন্ড। দুটি গুলিই বিধল মড়ার গায়ে। আবার বন্ড তাক করল। একটা ছোট ডাল ভেঙ্গে পড়ল নলের ওপর। ডাল সরিয়ে লাশের আড়াল থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাগানের চেয়ার টেবিলের দিকে মেজর দৌড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে লোহার মস্ত টেবিলটাকে ঢালের মত ফিরিয়ে ধরেছে মেজর। আড়ালে বসে টমিগান চালাচ্ছে। বন্ডের গুলি লোহায় লেগে ঠিকরে যাচ্ছে। বার বার টেলিস্কোপিক সাইট ঠিক করতে বন্ডের সময়ও লাগছে। মেজর বার বার অবস্থান পালটাচ্ছে।
বন্ড দেখল মহা বেগতিক। খোলা মাঠে গিয়ে সামনাসামনি টক্কর দেওয়া যাক। সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে ঢালু মাঠের মধ্যে দৌড়াল বন্ড। মেজরও খলিফা। দেখল এভাবে সময় নষ্ট না করে লেক পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলে ঘুরে এসে বন্ডকে এক হাত নিতে সুবিধে হবে। সেও আড়াল থেকে বেরিয়ে লেকের দিকে দৌড়াল। এমন। সময়ে খোলামাঠে বন্ডকে দেখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ঘাসজমির ওপর। একঝাক গুলি বর্ষণ করল। বন্ড পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্কম্প হাতে লক্ষ্য স্থির করল টেলিস্কোপিক সাইটের মধ্য দিয়ে। ক্রস চিহ্নটা যেই স্পষ্ট হল মেজরের হৃদপিণ্ডের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টিপল। গোনজালিস দু হাত শূন্যে তুলে হুড়মুড় করে তলিয়ে গেল হ্রদের পানিতে।
সবুর করল বন্ড। না মেজরের ভেসে ওঠার লক্ষণ নেই। বন্ড হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে মেপলগাছের দিকে এগিয়ে গেল।
দেখল, গুঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুডি হ্যাভলক। ডান বাহু দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তীর ধনুক পড়ে পায়ের কাছে।
কাঁধে হাত রাখল বন্ড। জুডি, আর ভয় নেই। খেল খতম। কোথায় লাগল?
তেমন কিছু নয়। হঠাৎ কি যেন বিধে গেল। উঃ এমন যে হবে ভাবতেও পারিনি?
ওরা পেশাদার খুনে–তাই বলেছিলাম এ কাজ পুরুষের। মেয়েদের নয়। যাকগে দেখি হাতটা। চটপট চম্পট দিতে হবে। নষ্ট মেয়েগুলো এতক্ষণে বুঝি বর্ডার ফোর্সকে খবর দিতে দৌড়াচ্ছে।
ঘুরে দাঁড়াল জুডি। জুডির কোমরের বেল্ট থেকে শিকারী ছুরি নিয়ে ওর কাঁধের শার্ট কেটে দিল বন্ড। বুলেট বিধে নেই, মাংসপেশী চিরে হাঁ করেছে। নিজের খাকি রুমাল তিনফালি করল বন্ড। গিঁট দিয়ে লম্বা করল। ফ্লাস্ক থেকে কফি আর হুইস্কি ঢেলে ক্ষতস্থান ধুয়ে দিল। হ্যাঁভারস্যাক থেকে পাউরুটি বেরুল। ক্ষতস্থানে পাউরুটি চাপা দিয়ে বেশ করে বাঁধল ঘেঁড়া রুমাল। তারপর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা ফাস করে ঝুলিয়ে দিল জুডির গলায়। গোলাপী ঠোঁট দুটি বন্ডের ঠোঁটের অত্যন্ত কাছে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ব্যবধান। রূপসীর গায়ের গন্ধে উতলা হল মন। কেমন জানি বুনো গন্ধ। আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল ঠোঁটে। জুডির চোখে বিস্ময় আর তৃপ্তি। এবার ঠোঁটের দু প্রান্তে দুটি চুমু দিতেই হেসে ফেলল সুন্দরী। সরে দাঁড়িয়ে বন্ডও হাসল।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? শুধোয় জুডি
লন্ডনে, বলল বন্ড। এক বৃদ্ধ সেখানে তোমায় দেখবার জন্য উতলা। তার আগে যাব কানাডায়। তোমার পাসপোর্টর একটা গতি করতে হবে। তোমার কিছু জামাকাপড় জিনিসপত্র তো চাই। দিন কয়েক লাগবে। থাকব কো জী হোটেলে।
জুডি শুধু তাকাল। মেয়েটা যেন হঠাৎ পালটে গিয়েছে। নরম গলায় বলল, হোটেলে এর আগে কখনো থাকিনি। বেশ হবে।
হেঁট হয়ে রাইফেল আর হ্যাঁভারস্যাক কাঁধে তুলে নিল বন্ড। আর এক কাঁধে ঝুলল জুডির ধনুক আর তুণ। এগলো মেঠো পথে। পেছন পেছন এল জুডি হ্যাভলক। হাঁটতে হাঁটতেই খুলে দিল মাথার ফিতে। এক রাশ হাল্কা সোনালি চুল এলিয়ে পড়ল দু কাঁধে।