ফর ইওর আইজ অনলি (পার্ট ১)

ফর ইওর আইজ অনলি — জেমস বন্ড

পাতালপুরীর মায়াবী

এক জোড়া চোখ চওড়া কালো রবার গগলস্-এর পেছনে শীতল চকমকির মতই ঝিকমিক করছিল। ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে উড়ে চলেছে বি.এস.এ.এম. টোয়েন্টি মোটর সাইকেল, ধেয়ে চলেছে কক্ষচ্যুত উল্কার মত। প্রচণ্ড বেগে ঝন্‌ঝন্‌ করে কাঁপছে যন্ত্রযানের ধাতব দেহ, থরথর করে কাঁপছে আরোহীর দেহ, উত্তাল হয়ে উঠছে রক্ত, কিন্তু কাঁপন নেই, চঞ্চলতা নেই, উত্তেজনা নেই–শুধু ঐ দুটি প্রত্যঙ্গে দুটি হিমশীতল চোখ–যা পাথরের মত কঠিন আর চকমকির মতই অগ্নিগর্ভ।

গগলস আচ্ছাদিত স্থির দুই চোখের দৃষ্টি হ্যান্ডেলবারের ওপর দিয়ে সামনে বিস্তৃত অঞ্চল–করাল সে চাহনির সঙ্গে তুলনা চলে কেবল রাইফেলের নলের–কিংবা যেন একজোড়া আতস কাঁচ। যার ফোকাস সুদূরে নিবদ্ধ।

গগলস্-এর নিচে উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে মুখগহ্বরে প্রকট হয়ে উঠছে সারি সারি দাঁত ঠিক যেন দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে চালক। এমন কি ঢিবি ঢিবি দাঁতের ওপর দু সারি সাদাটে মাড়িও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। হাওয়ার ঝাপটায় ফুলে উঠেছে দু গাল। থরথর করে কাঁপছে ছোটার বেগে। লৌহ শিরস্ত্রাণের নিচেই ভয়াল মুখের দু পাশ দিয়ে নেমে এসেছে দীর্ঘ কব্জিবন্ধ আর চামড়ার দস্তানায় আচ্ছাদিত একজোড়া হাত। যেন সুবিশাল কোন পশুর আক্রমণোদ্যত কালো থাবা।

লোকটার পরনে রয়্যাল কোর অব সিগন্যালস-এর ডেসপ্যাঁচ রাইডারের ইউনিফর্ম। অলিভ গ্রীন রঙ করা মোটর সাইকেল। ভালবৃ আর কারবুরেটরের বিশেষ কয়েকটা উন্নতি সাধন আর সাইলেন্সারের কিছুটা অংশ সরানোর ফলে গতিবেগ যেন মুঠোয় এসে গেছে। ঠিক এমন মেশিনই দেখা যায় ব্রিটিশ আর্মিতে। পোশাক আর যন্ত্রন দেখে লোকটার সম্বন্ধে যে ধারণাই মনে আসুক না কেন, তা ভেঙে যায় পেট্রল-ট্যাঙ্কের ওপর ক্লিপ দিয়ে আঁটা একটা গুলি ভরা লাগার রিভলবার দেখে।

মে মাস। সকাল সাতটা। সিধে রাস্তা। দু পাশে জঙ্গল। বসন্তের সকাল। তাই ছোট ছোট আলোকময় কুয়াশা ভাসছে এখানে-সেখানে। পথের দু পাশেই শ্যাওলা আর ফুলের কার্পেটে মোড়া বনতল। দানবাকৃতি ওক গাছের সারি। ভার্সাই আর সেন্ট জার্মেন-এর মায়াবী রয়্যাল ফরেস্ট। বুক ফুড়ে এলিয়ে থাকা সিধে রাস্তাটার নাম ডি-৯৮। এই অঞ্চলের গাড়ি-ঘোড়া যাতায়াত করে এ রাস্তায়। এইমাত্র প্যারিস মন্তেজ-এর মোটর রাস্তা পেরিয়ে এল মোটর সাইক্লিস্ট। সে রাস্তায় মোটর গর্জনের আওয়াজে কান পাতা দায়। সব গাড়িই চলেছে প্যারিসের দিকে। কিন্তু মোটর সাইক্লিস্ট চলেছে উত্তরে সেন্ট জার্মেন-এর দিকে। এদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সড়ক, স্নিগ্ধ সবুজ অরণ্য আর আধমাইলটাক সামনে দ্রুত সঞ্চরমান একটি বিন্দু ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না।

ছুটে চলেছে আর-একজন রয়্যাল কোর ডেসপ্যাঁচ রাইডার। বয়স কম। চেহারা অনেক ছিপছিপে। মনের আনন্দে বাইক চালাচ্ছে তরুণটি। মিষ্টি সকালের আমেজ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে যেন। গতিবেগ রেখেছে যেন ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল। মনে মনে ভাবছে আটটা নাগাদ হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে ডিমগুলো খাওয়া যায় কিভাবে। ভাজা করে, না ঘেঁটে নিয়ে?

পাঁচশ গজ, চারশ, তিন, দুই, এক। পেছনদিককার মোটরবাইক-চালক ধ্বসে পড়া তারার মতই প্রচণ্ডবেগে আসতে আসতে সহসা কমিয়ে আনল গতিবেগ…ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল। দাঁতের ফাঁকে টিপে খুলে ফেলল ডানহাতের দস্তানা এবং খোলা দস্তানাটা গুঁজে রাখল শার্টের বোতামের ফাঁকে। তারপর হাত নামিয়ে ক্লিপ খুলে তুলে নিল রিভলবারটা।

 এবার নিশ্চয় সামনের মোটর সাইকেলের ড্রাইভিং আয়নায় ফুটে উঠেছিল পেছনদিককার মোটর সাইকেলের প্রতিবিম্ব। এই সকালে আরেকজন ডেসপ্যাঁচ রাইডার দেখে তরুণ চালকও নিশ্চয় অবাক হয়েছিল। তাই হঠাৎ চট করে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিল। এ সময়ে একই পথে দু দুজন ডেসপ্যাঁচ রাইডার আসাটা একটু বিচিত্র সন্দেহ। নেই। মনে মনে ভাবল, হয়ত আমেরিকান বা ফ্রেঞ্চ মিলিটারি পুলিশ। আট জাতির ন্যাটো সংঘ থেকেও হয়ত কেউ আসতে পারে এ সময়ে। কিন্তু তাদের ইউনিফর্ম চিনবার পর যুগপৎ বিস্ময় ও হর্ষ দেখা দিল তরুণের মনে। লোকটা কে তা দেখা দরকার। ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল নেড়ে ইশারায় জানায়, ক্রুশের চিহ্ন তার চোখে পড়েছে। নিজেও গতিবেগ কমিয়ে আনে তিরিশের ঘরে। পেছনের চালক যদিও বয়োজ্যেষ্ঠ, তাহলেও পাশাপাশি হলে গল্প করা যাবেখন। এক চোখ সামনে পথের ওপর রেখে আরেক চোখ দিয়ে কোণাকুণিভাবে দেখে, দর্পণের বুকে দ্রুত আগুয়ান দ্বিতীয় ডেসপ্যাঁচ রাইডারকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা ছায়ামূর্তি ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে আয়নায়। লোকটা কে? মনে মনে ঝালিয়ে নেয় হেডকোয়ার্টার কম্যান্ডের স্পেশাল সার্ভিস ট্রান্সপোর্টেশন ইউনিটে ব্রিটিশ ডেসপ্যাঁচ রাইডারদের নামগুলো। অ্যালবার্ট, সিড, ওয়ালি–ওয়ালি হতে পারে। ঐ রকমই গাঁট্টাগোট্টা চেহারা দেখা যাচ্ছে।

রিভলবারধারী কমিয়ে আনছে গতিবেগ। ব্যবধান মাত্র পঞ্চাশ গজের। হাওয়ায় ধাক্কা ততটা না থাকায়, মুখ এখন অবিকৃত। প্রতিটি মাংসপেশী যেন পাথরে কুঁদে গড়া…কঠোর…নির্মম…মমতাহীন। বন্দুকের নলের মত লক্ষ্যভেদী দুই কালো চোখের মধ্যে এবার দপ করে জ্বলে উঠল লাল ফুলিঙ্গ। চল্লিশ গজ, তিরিশ। ভারি সুন্দর একটা ম্যাগপাই পাখি বনের মধ্যে থেকে হঠাৎ ছুটে এল তরুণ ডেসপ্যাঁচ রাইডারের সামনে। একেবেঁকে গিয়ে ফের ঢুকে পড়ল ঝোঁপের মধ্যে। মাইলপোস্টে দেখা গেল সেন্ট জার্মান আর বেশি দূরে নেই। মাত্র এক কিলোমিটার, তরুণ চালক নিঃশব্দে হাসল। মনে পড়ল সেই প্রবাদ-একটামাত্র ম্যাগপাই দেখা মানে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া।

বিশ গজ পেছনে রিভলবারধারী চালক দু হাত তুলে নিল হ্যান্ডেলবারের ওপর থেকে। রিভলবার তুলে নল রাখল বাম বাহুর ওপর এবং ট্রিগার টিপল মাত্র একবার।

তরুণ চালকের দু হাত এক ঝটকায় উঠে এল হ্যান্ডেলবারের ওপর থেকে। দুটো হাতই একযোগে খামচে ধরল পিঠের পেছনে শিরদাঁড়ার মাঝখানটা। টলমল করে উঠল মাতালের মত রাস্তার ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে ধেয়ে গেল তার মোটর সাইকেল, লাফিয়ে টপকে গেল একটা খানা এবং ঘাড় মুচড়ে আছড়ে পড়ল ঘাস-ফুল ছাওয়া মাঠে। পরক্ষণেই আর্তনাদ করে পেছনের দুরন্ত চাকার ওপর দাঁড়িয়ে উঠল দ্বিচক্রযান এবং ধীরে ধীরে এসে পড়ল মৃত চালকের গায়ে। বেশ কিছুক্ষণ প্রচণ্ড শব্দ, ভয়ানক ঝাঁকুনি এবং তরুণ চালকের পোশাক ও ঘাসফুল দলাইমলাই করার পর আস্তে আস্তে নীরব হয়ে গেল বি.এস.এ.-র তর্জন-গর্জন।

বো করে ঘুরে গেল হত্যাকারী। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই। মোটর সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে দাঁড় করাল। রাস্তার পাশে। এক লাথিতে হুইলবোট নামিয়ে টান মেরে দাঁড় করিয়ে দিল ইস্পাতের যন্ত্রযান। তারপর ধীরপায়ে বুনোফুল মাড়িয়ে আর দীর্ঘচ্ছদ গাছের তলা দিয়ে এসে দাঁড়াল মৃতের পাশে। বসল হাঁটু গেড়ে। টান দিয়ে ওঠাল লাশের চোখের পাতা। নিণ-তারকা–জীবনের কোন আলোই নেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক হ্যাঁচকায় মৃতের পিঠ থেকে খুলে নিল কালো চামড়ার ডেসপ্যাঁচ কেস। শার্টের বোতাম খুলে বুকের ভেতর থেকে টেনে বের করল একটা দোমড়ানো চামড়ার মানিব্যাগ। মণিবন্ধ থেকে সস্তার রিস্টওয়াচটা এমন টান মেরে খুলে আনল যে, দু জায়গায় লম্বা হয়ে গেল বেনটেক্সক্রোম ব্রেসলেট।

উঠে দাঁড়াল হত্যাকারী। কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে নিল ডেসপ্যাঁচ কেস। রিস্টওয়াচ আর মানিব্যাগটা পকেটে খুঁজতে গুজতে কান পেতে কি যেন শুনল। না, অরণ্যশব্দ আর বিধ্বস্ত বি.এস.এ. থেকে উত্থিত ধাতব পটপট শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। রাস্তার দিকে এগোল হত্যাকারী। ফিরে চলল যে-পথে এসেছে, ঠিক সেই পথেই–অতি সন্তর্পণে এবং টায়ারের ছাপ বাঁচিয়ে। খানার কাছে নরম মাটির সামনে আরো হুশিয়ার হল খুনে চালক। তারপর এসে দাঁড়াল মোটর সাইকেলের পাশে। একবার শুধু ফিরে তাকাল ঘাসফুল ছাওয়া উপত্যকার দিকে। মন্দ না! পুলিশ-কুকুর ছাড়া এ হত্যা রহস্যের সমাধান করার ক্ষমতা কারো নেই। দশ মাইল রাস্তার তদন্ত করা মানে কয়েকদিনের ব্যাপার। এসব ব্যাপারে ঝুঁকি কখনো নিতে নেই। চল্লিশ গজ দূর থেকেও গুলি চালাতে সে পারত। কিন্তু সাবধানের মার নেই জেনে এগিয়ে এসেছে আরো বিশ গজ। আর ঘড়ি-মানিব্যাগ নেওয়াটা হয়েছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। বিপথে চালনা করার মোক্ষম ফিনিশিং টাচ।

 খুশি হয়ে হ্যাঁচকা ঠেলা মেরে রোট থেকে মোটর সাইকেল নামাল লোকটা। স্মার্ট জকির মতই টুক করে উঠে বসল সিটে এবং সবেগে পদাঘাত করল স্টার্টারের ওপর। খুব আস্তে আস্তে, স্কিড চিহ্ন যাতে না পড়ে, এমনিভাবে গাড়ির গতিবেগ বৃদ্ধি করতে লাগল রহস্যময় চালক এবং অচিরেই আবার দেখা গেল সিধে সড়ক বেয়ে ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে ফিরে চলেছে একজন ডেসপ্যাঁচ রাইডার। হাওয়ার ঝাঁপটায় আবার প্রকট হয়ে উঠেছে তার দস্ট্রা, যেন হাসছে দাঁত খিঁচিয়ে।

হত্যাস্থলের চারদিকে এতক্ষণ যেন শ্বাসরোধ করে দাঁড়িয়েছিল অরণ্যভূমি। এবার ধীরে ধীরে, আবার বইতে লাগল শ্বাস-প্রশ্বাস, স্পন্দিত হল অরণ্যবক্ষ।

 সে রাতে জেমস্ বন্ডের মদ্যপান শুরু হয়েছিল ফোকে-তে। নেশা করার মত কিছু নয়। ফ্রেঞ্চ কাফেতে সিরিয়াসলি মদ খাওয়া খুবই মুশকিল। ফুটপাতের রোদে বসে তো আর ভদ্কা-হুঁইস্কি-জিন গেলা যায় না। লাঞ্চের ঠিক আগেই গলা ভিজিয়ে নেওয়ার শ্যাম্পেনও আছে কিন্তু রাত হলেই আবার চড়াতে ইচ্ছা যায় একটা-পর-একটা কোয়ার্ট। এত শ্যাম্পেন খাওয়ার পরিণাম টের পাওয়া যায় রাত গম্ভীর হলে। পার্নড মন্দ নয়, কিন্তু দল বেঁধে না খেলে মেজাজ হয় না। বন্ডের আবার যুৎসই লাগে না। এসব কারণেই বন্ড পছন্দ করে এমন মদ যা কাফেতে বসে পান করা যায়। যাতে নেশা কম হয়। কিন্তু গান-বাজনার সঙ্গে জমে। বিটার কাম্পারি, সিনজানোতে এক চাকলা পাতিলেবু আর সোড়া মিশিয়ে খাওয়ার মেজাজই আলাদা। বন্ডের পছন্দ পেরিয়ারের সোজ। কেননা, কমজোরী মদকে সবচেয়ে কম দামে জাতে তুলতে হলে দামী সোডা মেশানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

প্যারিসে এলে বারবার এক ঠিকানায় আস্তানা নেয় বন্ড। খায় একই জায়গায়। মানে, বেশ কয়েকটা বাধাধরা ঠিকানার মধ্যেই তার প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে থাকে। যেমন ওঠা চাই টার্মিনাস নর্ড-এ। কেননা, স্টেশন হোটেল বন্ডের এমনিতেই পছন্দ। তার ওপর এ হোটেলের নাম বিশেষ কেউ জানে না, ভড়ংও কম। খাওয়া চাই কাফে ডিলাপে, রোটান্ডে আর ডোর এতে। এ সব জায়গায় খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটা লোককে দেখা যায়। খাওয়ার স্বাদও বেশ খানদানী। মদে টং হওয়ার ইচ্ছে হলে আশা চাই হ্যারিজ বারে। এখানকার মদে নেশা তো জমেই, সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায় মোল বছর বয়সে প্রথম প্যারিস আসার অভিজ্ঞতা। কন্টিনেন্টাল ডেলী মেল-এ নাগার বিজ্ঞাপন পড়ে অক্ষরে অক্ষরে তাই মেনে চলেছিল বন্ড! ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলেছিল, স্যাঙ্ক রু তো নু। বলার পর থেকেই শুরু ওর জীবনের এক স্মরণীয় রাতের, যার শেষ হয়েছিল যুগপৎ দুটি জিনিস হারিয়ে কৌমার্য আর নোটকেস। ডিনার খেতে হলে বন্ড যায় বড় বড় রেস্তোরাঁয়। যেমন–ভেফোর, ক্যানেটন, লুকাস কাটন, কোচেন ডি অর। ডিনার খেয়ে বন্ড যায় প্লেস পিডাল-এ নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার জন্য। অঘটন কিছু না ঘটলে হাঁটতে হাঁটতে প্যারিসের পথ মাড়িয়ে ঘুমোবার জন্য। হোটেলে ফিরে আসে।

আজ রাতে কিন্তু ধূলিধূসরিত ঠিকানাপঞ্জির ধার দিয়েও গেল না বন্ড। এল মান্ধাতা আমলের বল ড্যান্সের আসরে। অস্ট্রোহাঙ্গারিয়ান সীমান্ত অঞ্চলে একটা সমস্যা সমাধানের ভার ছিল বন্ডের ওপর। কিছুই সুরাহা হয়নি। কথা ছিল কয়েকজন হাঙ্গেরিয়ানকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার। স্টেশন ফাইভের চাইকে গাইড করার জন্য সরাসরি বন্ডকে পাঠানো হয়েছিল। গোটা অপারেশনের তদারকের ভার ছিল বন্ডের ওপর। ভিয়েনা স্টেশন তাতে চটেছে। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। একজন মারা গেছে ফ্রন্টিয়ার মাইল অঞ্চলে। পরের দিনই লন্ডন হেডকোয়ার্টারে ফিরে রিপোর্ট দেবার কথা বন্ডের। মন তাই খারাপ। দিনটা সে তুলনায় সত্যিই ভাল। সারা প্যারিস যেন হাসছে। বন্ড তাই ঠিক করেছিল সারা শহরটা একবার ঘুরবে। সঙ্গে এক রূপসীকে নিতে হবে। রূপসীর চোখে টাকার লালসা থাকবেই থাকবে। বন্ড সে পাওনাও মেটাবে পঞ্চাশ হাজার ফ্লা দিয়ে।

রেস্তোরাঁয় বসে মদের অর্ডার দিয়ে এসব কল্পনা করে বন্ড মনে মনে হাসছিল। বন্ড তো জানে প্যারিসে এই তার শেষ লীলাখেলা। মহাযুদ্ধের পর থেকেই প্যারিস তার দু চোখের বিষ। ১৯৪৫-এরপর থেকে প্যারিসে তার একটা দিনও আনন্দে কাটনি। কাটবে কি করে? শহরের সে রূপ, সে আভিজাত্য যেন লুটেপুটে নিয়েছে মোটরের স্রোত। থাবায় ধরে কাড়াকাড়ি করেছে রাশিয়ান আর রুমানিয়ান, বুলগেরিয়ান আর জার্মান। শহরের যা দেখার জিনিস তা যেন চোখেই পড়ে না তাদের দৌরাত্ম্যে।

মার্বেল বাঁধানো টেবিলের ওপর সশব্দে ট্রে নামিয়ে রাখল ওয়েটার। খুলে দিল পেরিয়ারের ছিপি। বরফের টুকরো ভর্তি ছোট্ট বালতিটাও রাখল টেবিলে। বন্ড বরফ তুলে ভাসিয়ে দিল মদের গ্লাসে। তারপর সোডা মিশিয়ে ঠোঁটের কাছে তুলল। এক চুমুক গলা ভিজিয়ে ধরাল সিগারেট। আজ সন্ধ্যেটা মাটি হল দেখা যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ত আসবে মেয়েটা। কিন্তু খোলস বাদ দিয়ে দেখতে গেলেই ঠকতে হবে। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে হয়ত বুর্জোয়া ফরাসিদের চামড়া ভিজে-ভিজে, পুরু, লোমকূপের ছেদাও বেশ বড়-বড়। সোনালি চুল মখমল টুপির নিচেই কেবল সোনালি, গোড়ায় হয়ত বাদামী আর পিয়ানোর তারের মত কর্কশ। নিঃশ্বাসে নিশ্চয় ভূত-তাড়ানো রসুনের বিকট গন্ধ; পিপারমেন্ট দিয়েও যা নাকি ঢাকা যায় না। ছিমছাম যে তনু দেখে মনে রঙ আসে, হয়ত তা ভেতরে ভেতরে তার আর রবারের বর্ম দিয়ে মোড়া। হয়ত বন্ডের নোটকেসও চুরি যাবে এ মেয়ের হাতের ম্যাজিকে।

একটা থেতোমেতো মিশমিশে কালো গাড়ি রাশিরাশি গাড়ির স্রোত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে পার্ক করল ধার ঘেঁষে। সঙ্গে সঙ্গে যা হয়। ব্রেকের আর্তনাদ, হর্নের কানফাটা কান্না আর পথচারীদের চিৎকারে সৃষ্টি হল মহাসোরগোলের। কোন কিছুতেই কর্ণপাত না করে টুক করে নামল একটা মেয়ে, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এল হনহন করে।

উঠে বসল বন্ড। কল্পনায় যা-যা ভেবেছিল, মেয়েটির মধ্যে সেইগুলো বাদ দিয়ে আর সবই আছে। মাথায় বেশ লম্বা চুল। রেনকোটে তন্বীদেহ ঢাকা থাকলেও চলার ভঙ্গিমা থেকে বেশ বোঝা গেল সৌন্দর্য সে অঙ্গের সর্বত্র। চোখে মুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। সেই সঙ্গে মিশে আছে ডানপিটে ডানপিটে ভাব। গাড়ি চালানোর বেপরোয়া ধরন দেখেই অবশ্য তা অনুমান করা যায়। ভিড়ের ধাক্কায় মুখটা ঈষৎ ব্যাজার, দুই ঠোঁট দৃঢ়সংবদ্ধ।

মেয়েটি আসছে এদিকেই, কিন্তু বন্ডের টেবিলে নয় নিশ্চয়। হয়ত অন্য কারো সঙ্গে সাক্ষাতের মতলব নিয়েই আসছে। দেরি হয়ে গেছে, তাই এত অসহিষ্ণু ভাব। ভালবাসার পাত্রকে দেখতে আসে যারা, এ মেয়ে যেন তাদেরই অন্যতম। এ জাতের মেয়েরা একলা কখনো থাকে না। কপাল খারাপ বন্ডের। মখমলের চুলের নিচেই ঝিলমিল করছে। সোনা-সোনা চুল–আহা রে!

মেয়েটা সোজা তাকিয়েছে বন্ডের দিকে। হাসছে…।

বন্ড সামলে ওঠার আগেই টেবিলের সামনে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল রূপসী। বন্ডের চমকিত চোখের পানে তাকিয়ে হাসল। বলল, দেরি হওয়ার জন্য কিছু মনে করবেন না। বেরোতে হবে এখুনি। অফিসে চলুন। ক্র্যাশ ডাইভ। শেষ শব্দ দুটো প্রায় ফিসফিস করেই বলল সুন্দরী।

কল্পলোক থেকে এক ঝটকায় বস্তুলোকে ফিরে এল বন্ড। এ মেয়ে লাইনের মেয়ে। ক্র্যাশ ডাইভ শব্দ দুটো একটা সংকেত, সিক্রেট সার্ভিস ধার করেছে সাবমেরিন সার্ভিস থেকে। এ সংকেতের অর্থ হল–সংবাদ মোটেই শুভ নয়। খুবই খারাপ।

পকেটে থেকে কিছু রেজগি বের করে টেবিলে ছুঁড়ে দিল বন্ড। বলল, বেশ তো, চলুন। সঙ্গে সঙ্গে উঠল দুজনে। এ-টেবিল ও-টেবিল কাটিয়ে পৌঁছল ফুটপাতে। মেয়েটির গাড়ি তখনো ট্রাফিক অবরোধ করে দাঁড় করানো। পুলিশ এখুনি এল বলে। টুক করে স্টিয়ারিং-এর সামনে বসল সুন্দরী। ইঞ্জিন চালুই ছিল। সেকেন্ড গীয়ারে দিতেই পিছলে এগিয়ে গেল গাড়ির স্রোতের সঙ্গে।

আড়চোখে দেখল বন্ড। ফ্যাকাশে চামড়া মখমলের মতই পেলব। চুল তো নয় যেন সোনালি রেশম। গোড়া পর্যন্ত সোনালি। বলল, আসছেন কোত্থেকে? এত তাড়াহুড়োই-বা কেন?

সামনে চোখ রেখে বলল সুন্দরী, আসছি স্টেশন থেকে। গ্রেড টু অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। নাম, মেরী অ্যান রাসেল। ডিউটিতে থাকলে আমার নাম সেভেন সিক্সটি ফাইভ। এত তাড়াহুড়ো কেন, তা জানি না। হেডকোয়ার্টার থেকে এম. এ-র পাঠানো সিগন্যালটা শুধু দেখেছি। খুবই জরুরী। এখনি খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে। বড়কর্তা বললেন, প্যারিসে এলেই আপনি বাঁধা-ধরা কয়েকটা জায়গায় নাকি যাতায়াত করেন। ঠিকানার ফিরিস্তিটা ধরিয়ে দিলেন আমাকে আর একটি মেয়েকে। বলে হাসল রূপসী। আমি সিধে এলাম হ্যারিজ বারে। ফোকেতে না পেলে অন্য রেস্তোরাঁয় যেতাম।

বন্ড বলল, ফাইন! আমার সঙ্গে মেয়ে বান্ধবী থাকলে কি করতেন, শুনি?

 হেসে ফেলল রূপসী, তাকে আমার গাড়িতে তুলতাম। আপনাকে ওঠাতাম ট্যাক্সিতে।

বুদ্ধির জাহাজ দেখছি। সার্ভিসে আছেন কদ্দিন

 পাঁচ বছর। স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ এই প্রথম।

কাজকর্ম কি রকম লাগছে।

ভালই। ছুটির দিন আর সন্ধ্যেগুলো যেন কাটতেই চায় না। প্যারিসে বন্ধু জোটানো সহজ, বলে মুখভঙ্গি করল সুন্দরী। কিন্তু কিছুই চায় না। এমন বন্ধু পাওয়া দুষ্কর। বাসে চড়াও ঝামেলা। পেছন থেকে চিমটি কেটে কেটে কালসিটেই করে দ্যায়। তাই বাসে চড়া ত্যাগ করলাম। কিনলাম এমন একটা বদখত গাড়ি যার ধারে-কাছে কেউ গাড়ি ভেড়াতে চায় না। তফাতে থাকে সব সময়ে।

কথাটা যে কতখানি সত্যি তা প্রমাণ করার জন্যই যেন রঙ পয়েন্টে এসে সহসা বেলাইনে গাড়ি হাকাল সুন্দরী। সঙ্গে-সঙ্গে দু ভাগ হয়ে গেল গাড়ির স্রোত, পথ ছেড়ে দিল ওর ভাঙাচোরা ত্যাবড়ানো গাড়িকে। গাড়ি ঢুকল এভি ম্যাটিগসনে।

বন্ড বলল, বাঃ, কিন্তু এ কায়দা সব সময়ে খাটাতে যাবে না।

ডিউটিতে থাকলেই খাটাতে হয়, নইলে নয়। বলতে বলতে গাড়ি এসে দাঁড়াল ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের স্টেশন এফ, অর্থাৎ ফরাসি শাখার প্যারিস সদর দপ্তরের সামনে।

বন্ড নামল। বলল, কাজ মিটলে আপনার দর্শনলাভ ঘটবে তো? ভয় নেই, চিমটি আমি কাটি না। তবে আপনার মতই বড় একঘেয়ে লাগছে প্যারিসকে।

মীল নীল রূপসী চক্ষু ঈষৎ বিস্ফারিত হল, সানন্দে।

খিলেন পেরিয়ে হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করল বন্ড। এ স্টেশনের হেড, মানে, উইং কম্যান্ডারে র‍্যাটরে মানুষটি একটু স্থূলকায়। গোলাপী গাল, সাদা সাদা চুল ব্যাকব্রাশ করা পেছনে। একটু শৌখিন পোশাকে অভ্যস্ত। চেহারায়, চালচলনে মনেই হতে পারে ভালমন্দ আর সুখাদ্য নিয়েই বুঝি তার জগৎ। কিন্তু নীলচে আর ধূর্ত চোখ দুটিই ধরিয়ে দেয় বাইরের ছলনাটুকু। দারুণ ধূমপানের অভ্যাস ভদ্রলোকের। অফিস ঘরে টেকা দায় তাম্রকূটের উৎকট গন্ধে। বন্ডকে দেখতেই যেন হাঁপ ছাড়লেন। বললেন, কে পাকড়াও করল?

রাসেল। ফোকেতে নতুন মনে হল।

মাস ছয়েকের পুরানো। কাজ ভালই করছে। যাক, আগে কাজের কথা। বলে ইন্টারকমের সুইচ টিপে হুকুম দিলেন, লন্ডন হেডকোয়ার্টারে M-কে খবর পাঠাও জিরো জিরো সেভেনকে পাওয়া গেছে। কাজ বোঝানো হচ্ছে। বন্ধ করল সুইচ।

তাম্রকূটের ধোঁয়াশা থেকে সরে গিয়ে জানালার সামনে বন্ড দাঁড়াল। আধ ঘণ্টা আগেও একঘেয়েমি লাগছিল প্যারিসকে। এখন আর লাগছে না।

হেড অফ এফ বললেন, গতকাল সকালে একটা খুন হয়েছে। সেন্ট জার্মেন স্টেশনে যাওয়ার সময় পেছন থেকে গুলি খেয়েছে ডেসপ্যাঁচ রাইডার। ডেসপ্যাঁচ কেসে অনেক গোপনীয় দলিল ছিল। খোয়া গেছে সেই কেস, ঘড়ি আর মানিব্যাগ।

বন্ড বলল, কি মনে হয় আপনার, মামুলী রাহাজানি না, ঘড়ি আর মানিব্যাগ নেওয়া হয়েছে শুধু চোখে ধুলো দেবার জন্য?

বলা মুশকিল। সিকিউরিটি এখনো ভাবছে। সকাল সাতটা নাকি রাহাজানির সময় নয়। যাক, আপনি গিয়ে কথা। বলুন। আপনি যাচ্ছেন M-এর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে। খুব ভাবনায় পড়েছেন ভদ্রলোক। বলে একটা ম্যাপ বিছিয়ে ধরলেন এফ এর বড়কর্তা। এই হল ভাসাই। পার্কের উত্তরে এই যে চার মাথা-এখানে কাটাকুটি হয়েছে দুটি রাস্তার–প্যারিস মন্তেজ আর ভার্সাই মোটর রাস্তা। আরো শ খানেক গজ উত্তরে যান। ন্যাটো গোষ্ঠীর শাখা শেপ এর ঘাটি। প্রতি বুধবার সকাল সাতটায় শেপ -এর ঘাঁটি থেকে বেরোয় একজন একজন স্পেশাল সার্ভিস ডেসপ্যাঁচ রাইডার। সঙ্গে থাকে সাপ্তাহিক গোপন বার্তা। সেন্ট জার্মেন-এর বাইরে যে ছোট্ট গা-টা দেখছেন, এইখানে আমাদের হেড কোয়ার্টারে কাগজপত্র তুলে দিয়ে সাড়ে সাতটার সময়ে ওকে আবার ফিরে যেতে হয় শেপ সদর দপ্তরে। সাবধানের মার নেই, তাই সোজা রাস্তায় না গিয়ে ওর ওপর অর্ডার আছে এন ৩০৭ রাস্তা ধরে সেন্ট জার্মেন-এর জঙ্গল পেরিয়ে ঘাঁটিতে পৌঁছানোর। দূরত্ব প্রায় বারো কিলোমিটার। মোটর সাইকেলে যেতে সময় লাগে খুব জোর পনেরো মিনিট। গতকাল সকালে কোর অব সিগন্যালের করপোর্যাল বেস গিয়েছিল ডেসপ্যাঁচ কেস নিয়ে। মজবুত মানুষ। কিন্তু সাতটা পঁয়তাল্লিশেও না ফিরে আসায় পাঠানো হল আরেকজনকে। সে গিয়ে দেখল, বেটস্ রাস্তাতে নেই, ঘাঁটিতেও পৌঁছায়নি। সোয়া আটটায় সিকিউরিটি ব্রাঞ্চ গা-ঝাড়া দিল। নটায় রাস্তা বন্ধ হল। পুলিশ আর সার্চ পার্টি তন্নতন্ন করে খুঁজল সারাদিন। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ পুলিশ কুকুর পেল বেটস্-এর লাশ। ততক্ষণে রাস্তায় সূত্র মুছে গেছে গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াতে। বলতে বলতে ম্যাপটা মুড়ে বন্ডের হাতে তুলে দিলেন এফ-কর্তা। বিমান ঘাটি, জাহাজঘাটা, সীমান্ত, সব জায়গাতেই পাহারা বসেছে। কিন্তু এ কাজ যদি পাকা হাতের হয়, তাহলে গোপন দলিলের বান্ডিল দুপুরের আগেই দেশছাড়া হয়েছে, অথবা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্যারিসের কোন দূতাবাসে ঠাই পেয়েছে।

অসহিষ্ণু কণ্ঠে বন্ড বলল, তা তো বটেই। কাজেই আমি গিয়ে কি করব? খামোকা সময় নষ্ট। এ কাজ আমার নয়। M কি ভেবেছেন?

সহানুভূতির হাসিতে, সত্যি বলতে কি একই কথা আমিও M-কে বলেছিলাম। উনি বললেন, জেমস্ বন্ডের চোখে অদৃশ্য সূত্রও ধরা পড়ে। সব কটা ঘাটির কড়া পাহারার মধ্যেও এখন এ কাণ্ড ঘটে গেল, তাহলে বুঝতে হবে, এমন একজন ছদ্মবেশী শত্রু সেখানে রয়েছে যাকে কেউই লক্ষ্য করছে না। সে হতে পারে মালী, কি পিওন, কি আদালী। ওকে যখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তখন সে যাক। আমি বলেছিলাম, সব রকম অদৃশ্য সূত্রের কথাই। শেপ ভেবেছে। উনি বললেন, পুঁথিগত বিদ্যের দৌড় ওঁর জানা আছে। বলেই লাইন কেটে দিলেন।

বন্ড হেসে বলল, দেখি তাহলে কি করা যায়। রিপোর্ট দেব কাকে?

রাসেলকে। চব্বিশ ঘণ্টাই ওকে পাওয়া যাবে। তাছাড়া আপনাকে তো রাসেলই খুঁজে এনেছে। আপনার ধাতও বুঝে ফেলেছে নিশ্চয়। চলবে?

চলবে।

মোটর রাস্তায় গিয়ে ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে গাড়ি হাঁকাল বন্ড। যথাসময়ে শেপ -এর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে ব্রেক কষলো প্রথম চেক পয়েন্টে। এগিয়ে এল একজন আমেরিকান পুলিশম্যান। পরনে ধূসর ইউনিফর্ম। বন্ডের পাশ পরীক্ষা করে ছেড়ে ছিল। তার পরেই পাশ পরীক্ষা করল এক ফরাসি পুলিশম্যান। বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে আঁটা ফর্মে লিখে নিল খুঁটিনাটি। প্লাস্টিক উইন্ড স্ক্রীনে নাম্বার লাগিয়ে ওকে ঢুকতে দিল ভেতরে।

কার পার্কে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছেন বন্ড। এমন সময় নাটকীয়ভাবে ভোজবাজির মত দপ করে জ্বলে উঠল সারি সারি। আর্ক ল্যাম্প। বন্ডের সামনের রাস্তা নিমেষে যেন দিন হয়ে গেল। নুড়ি বিছানো পথ মাড়িয়ে এক লাফে সিঁড়ির চারটে ধাপ পেরিয়ে চওড়া দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনীর সুপ্রীম হেডকোয়ার্টারে। এবার পাশ পরীক্ষা করল আমেরিকান ও ফরাসি মিলিটারি পুলিশ। লাল টুপি পরা একজন বৃটিশ পুলিশ ওকে নিয়ে গেল সুদীর্ঘ করিডর দিয়ে। দু পাশে সারি সারি অফিসের দরজা।

একটা দরজায় লেখা কর্নেল জি. এ. স্ক্রাইবার। চীফ অব সিকিউরিটি, হেডকোয়াটার্স কম্যান্ড। ভদ্রলোক মাঝবয়েসী। বাঁশের মত শক্ত মজবুত সিধে চেহারা, জাতে আমেরিকান। পাক ধরেছে চুলে। কথাবার্তা হাবভাব বিনয় বিগলিত, যেন ব্যাংক ম্যানেজারিতে পোক্ত মানুষটি। রূপোর ফ্রেমে বাঁধানো কয়েকটা ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ বসানো টেবিলে। ফুলদানিতে সাদা গোলাপ। ঘরে তাম্রকূটের গন্ধ একেবারেই নেই। নিরাপত্তার চুলচেরা ব্যবস্থার তারিফ করল বন্ড। কর্নেলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, বারে বারে এই যে চেকিং, এর ফলে পঞ্চম বাহিনী এখানে নাক গলাতে সাহস পাবে না। এর আগে এরকম ঘটনা কখনো ঘটেছে। মানে, কেউ চড়াও হয়েছিল কি? দলিল-টলিল খোয়া গেছে।

কোনটাই হয়নি, কম্যান্ডার, আমার এ হেডকোয়ার্টার নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু বাইরের ঘটনাগুলো নিয়েই যত ভাবনা। আপনাদের সিক্রেট সার্ভিসের স্থানীয় দপ্তর ছাড়াও আমাদের ছাড়া-ছাড়া সংকেত অনেকগুলো রয়েছে। চৌদ্দটা বিভিন্ন জাতির হোম মিনিস্ট্রি তো রয়েছেই। কাজেই কোত্থেকে কি খবর বেরিয়ে যাচ্ছে, সে হিসেব রাখা আমার সাধ্য নয়।

সায় দিল বন্ড, তা তো বটেই। উইং কমান্ডার র‍্যাটলের সঙ্গে আপনার কথাবার্তার পর নতুন কিছু ঘটেছে?

বুলেটটা পাওয়া গেছে। আমি বুলেট, লাগায় শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। খুব সম্ভব তিরিশ গজ দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছে। যদি ধরে নেওয়া যায়, এঁকেবেঁকে না চলে সিধে চলেছিল আমাদের ডেসপ্যাঁচ রাইডার, তাহলে ধরতে হবে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় ছোঁড়া হয়েছে বুলেটটা। যেহেতু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফায়ারিং-এর প্রশ্ন উঠছেই না, সুতরাং নিশ্চয়ই কোন গাড়িতে চেপে পিছু নিয়েছিল হত্যাকারী।

সেক্ষেত্রে ড্রাইভিং আয়নায় তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছে আপনার লোক?

খুব সম্ভব দেখেছিল।

কেউ পিছু পিছু আসছে জানতে পারলে, চোখে ধুলো দেবার জন্য বিশেষ কোন নির্দেশ কি আপনার লোকজনদের দেওয়া হয়?

হয় বৈকি। মৃদু হেসে কর্নেল বললেন। বলা হয় টপ স্পীডে ঝড়ের মতো হাওয়া হয়ে যেতে।

আপনার লোকটি কত স্পীডে আছাড় খেয়েছে।

খুব বেশি নয়, বিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। কি বলতে চান বলুন তো?

খুনটা পাকা হাতের কি শৌখিন হাতের, এ বিষয়ে আপনারা মনস্থির করতে পেরেছেন কিনা জানি না। কিন্তু আমি পেরেছি। ধরে নিচ্ছি আয়নার বুকে পেছনের আততায়ীকে আপনার লোক দেখেছিল এবং দেখবার পরেও স্পীড বাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করেনি। সুতরাং আমরা অনায়াসে বলতে পারি, পেছনের লোকটাকে সে শত্রু হিসেবে দেখেনি, দেখেছে। বন্ধু হিসেবে। তা থেকে আমরা কি পাচ্ছি আততায়ী এমন একটা লোক ছদ্মবেশ নিয়েছিল, যা ঐ পরিবেশে এমন কি অত সকালেও, অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে আপনার লোকের কাছে।

কর্নেল ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে, কম্যান্ডার, আপনি যে পয়েন্টটা বললেন, এ নিয়েও আমরা ভেবেছি। গতকাল দুপুরে কম্যান্ডিং জেনারেল জরুরী নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটি কমিটি তৈরি হয়ে গেছে। সেই মুহূর্ত থেকে কোন সম্ভাবনাই বিবেচনা করতে বাকি রাখিনি আমরা কমান্ডার। কেসটা সম্বন্ধে আমরা যা ভেবেছি তাছাড়াও মৌলিক কোন পয়েন্ট যদি কারো মাথায় এসে থাকে, মগজের গ্রে ম্যাটারের দিক দিয়ে তিনি আইনস্টাইনের সমতুল্য। নতুন করে ভাববার, নতুন করে আলোচনা করবার মত কোন বিষয়ই আর নেই এই কেসে।

এবার সহানুভূতির হাসি হেসে বন্ড বলল, সেক্ষেত্রে আজ রাতে আপনার আর সময় নষ্ট করতে চাই না। আপনাদের আলোচনার পুরো রেকর্ডগুলো যদি দেখতে দেন তো কেসটা সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে পারি। দয়া করে আপনাদের ক্যান্টিন আর গেস্ট কোয়ার্টার দেখিয়ে দিতে বলবেন কাউকে?

নিশ্চয়, নিশ্চয়। ঘন্টা টিপে ধরলেন কর্নেল। কদম ছাঁট এক ছোকরা প্রবেশ করতেই বললেন, প্রক্টর, কম্যান্ডারকে ভি.আই.পি কোয়ার্টারে নিয়ে যাও। ঘর দেখিয়ে বার আর ক্যান্টিনে নিয়ে যেও। তারপর বন্ডের দিকে ফিরে খেয়ে দেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন। কাগজপত্র বার করে রাখছি। এ অফিসেই পাবেন। অফিসের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাহলেও আপনার যা দরকার প্রক্টরকে বলবেন, ও এনে দেবে। হাত বাড়িয়ে–ঠিক আছে কাল সকালে আবার দেখা হবে।

গুড নাইট জানিয়ে ছোকরার পেছন পেছন বন্ড বেরিয়ে এল। সুদীর্ঘ করিডর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মনটা আবার দমে গেল। জীবনে অনেক বিপজ্জনক কাজের ঝাঁকি সে নিয়েছে কিন্তু এরকম অসহায় সে বোধ করেনি। আশার এতটুকু রশ্মি কোথাও নেই। চৌদ্দটা দেশের জাদরেল সিকিউরিটি ব্রেনরা যেখানে নাজেহাল হয়ে গেছে। সেখানে তার মত ক্ষুদ্র ব্যক্তির এই হঠকারিতা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। ভি.আই.পি. কোয়ার্টারের স্পার্টান বিলাসিতা আর মোগলাই স্বাচ্ছন্দে শয়ন করে বন্ড সে রাত্রে মনে মনে হিসেব করল, আরো দিন দুয়েক কেসটা নিয়ে সে মাথা ঘামাবে। মেরী অ্যান রাসেলের সঙ্গসুখ উপভোগ করবে। তারপর শুটোবে পাততাড়ি।

দুদিন নয়,চারদিন পর যখন ভোরের আলো ফুটল সেন্ট জার্মেন জঙ্গলের মাথায়, দেখা গেল একটা মস্ত ওক গাছের ইয়া মোটা শাখায় শুয়ে আছে জেমস বন্ড। নজর রয়েছে বনতলের এক টুকরো স্ব-তুন সবুজ ভূমিখন্ডের ওপর। বনভূমির চারদিকেই ঘন জঙ্গল। একপাশে ডি ৯৮ সড়ক যে সড়কে কদিন আগেই একটা মানুষ খুন হয়েছে।

বন্ডের আপাদমস্তক বিচিত্র পোশাকে আচ্ছাদিত। ছত্রীবাহিনীর সাহসী সৈনিকরা শত্রু অঞ্চলে নামবার আগে এ ধরনের পোশাক পরে নেয় সারা অঙ্গে সবুজ, বাদামী আর কালোর ছোপ আর ডোরা গাছের পাতার সঙ্গে মিশে থেকে শত্রুর শ্যেন দৃষ্টিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর অপকৌশল। দু-হাতও ঢাকা এই একই রঙের পোশাকে। মাথার ওপর একটা হুড। চোখ আর মুখের জন্য শুধু দুটো ফুটো সেই মুখোশে। শত্রুকে ধাপ্পা দেওয়ার পক্ষে অভিনব ক্যামোফ্লেজ সন্দেহ নেই। সূর্য উঠলে এ ধাপ্পা আরো নিখুঁত হয়ে ওঠে। তখন আরো গাঢ় হয়ে ওঠে এ ছায়া এবং গাছের ঠিক নিচে দাঁড়ালে গাছের ওপরে ঘাপটি মেরে থাকা উর্দিপরা মানুষটিকে কেউ দেখতে পায় না।

শেপ সিকিউরিটিতে দু-দুটো দিন নষ্ট হয়েছে। লাভ কিছুই হয়নি। নতুন কোন তথ্য আবিষ্কার করতে পারেনি সে, বরং দুর্নাম কুড়িয়েছে বিস্তর। এক প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করার ফলে। যে তদন্ত একবার হয়ে গেছে, ফের তার ওপর নতুন জেরা শুরু করার ফলে অপ্রিয় হতে হয়েছে। তৃতীয় দিন সকালে সরে পড়বার মতলব আঁটছিল বন্ড, ভাবছিল যাওয়ার আগে কর্নেলকে একটা টেলিফোন করা যাক, এমন সময় কর্নেল নিজেই টেলিফোন করলেন–কম্যান্ডার, ভাবলাম খবরটা আপনাকে দেওয়া দরকার। কাল শেষরাতের দিকে পুলিশ কুকুরের শেষ দলটাও ফিরে এসেছে। গোটা জঙ্গলটাকে তন্ন তন্ন করেছে। রহস্যের কিনারা করা যাবে বলে আপনি যে থিওরী পেশ করেছিলেন তারও ইতি হল সেই সঙ্গে। দুঃখিত স্বরটা কিন্তু মোটেই দুঃখিত ঠেকল না বন্ডের কাছে কিছুই পাওয়া যায়নি? কিসসু না।

মিছেই সময় নষ্ট করলাম। কর্নেলের মেজাজ খিঁচড়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই বাঁকা সুরে বন্ড বলল, পুলিশ কুকুরের ডিউটি অফিসারকে পেলে দুটো কথা জিজ্ঞেস করতাম।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপনার সব ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। ভাল কথা, কম্যান্ডার, এখানে আর কদিন থাকার প্রোগ্রাম আছে। আপনার জানতে পারলে ভাল হয়। আরও কিছুদিন আপনার সঙ্গ পেলে খুশি হতাম। কিন্তু সমস্যা আছে আপনার। ঘরটা নিয়ে। হল্যান্ড থেকে নাকি একটা বড় পার্টি আসছে দিন কয়েকের মধ্যেই। টপ লেভেল অফিসার। শুনলাম, আপনার ওখানে জায়গার বড় অভাব।

কর্নেলের সঙ্গে ঘরকন্না যে মোটেই জমবে না বন্ড তা আঁচ করেছিল আগেই। তাই কথাটা শুনে টেলিফোনেই অমায়িক হাসি হেসে বলল, তা বেশ, তা বেশ। আমি বরং আমার চীফকে একবার ফোন করে দিই। উনি কি বলেন শুনে আপনাকে ফোন করছি।

দয়া করে তাই করুন। একই রকম অমায়িক সুরে জবাব দিলেন কর্নেল, এবং একই সঙ্গে সশব্দে রিসিভার নামল দু জনের।

চীপ ডিউটি অফিসার জাতে ফরাসি। ধূর্ত চোখ। কুকুরের আস্তানায় গিয়ে দেখা করল বন্ড। কিন্তু লোকটির বেশি খাতির দেখা গেল অ্যালসেসিয়ানদের সঙ্গে মধুর সঙ্গ ছেড়ে নড়তেই চায় না। ঘেউ ঘেউ আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে দেখে বন্ড তাকে নিয়ে এল ডিউনি রুমে। ছোট ঘর, হুক থেকে ঝুলছে দূরবীন, ওয়াটার প্রুফ, গামবুট, কুকুর খেদানোর খোঁচা, এবং আরো কত কি টুকিটাকি জিনিস। টেবিলে বিছানো সেন্ট জার্মেন জঙ্গলের একটা বড় সড় ম্যাপ। পেন্সিল দিয়ে চৌকোনা খুপরিতে দাগানো ম্যাপটা দেখিয়ে বলল ডিউটি অফিসার– প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে এসেছে আমাদের অ্যালসেসিয়ান দল। কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আপনি কি বলতে চান কোথাও এদের চেন টেনেও ধরা হয়নি?

মাথা চুলকে বলল ডিউটি অফিসার–না, তা অবশ্য বলতে চাই নাই। দু একটা খরগোশ নিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছিল হতভাগারা। একবার একজোড়া শেয়ালও দেখেছিল। মৃগয়া খেলা হয়েছিল বলতে পারেন সিয়ে। চেন টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে বিলক্ষণ বেগ পেতে হয়েছিল আমাদের। খুব সম্ভব জিপসীদের গন্ধও পেয়েছিল কুকুরগুলো।

ও! খুব উৎসাহ দেখাল না বন্ড, জিপসীদের কোথায় দেখেছিলেন? ম্যাপের ওপর দেখান।

আঙুল দিয়ে জায়গাটা দেখাল ডিউটি অফিসার, নামধামগুলো নেহাতই সেকেলে। এই হল ইটয়েল পারফেট। খুন যেখানে হয়েছে। এই দেখুন, সেই জায়গা ক্যারিফোর দ্য কুরী। এই যে এখানে ত্রিভুজের তলায় ক্যারিফোর রয়্যাল। যে রাস্তায় খুন হয়েছে। তাকে আড়াআড়িভাবে ক্রশ করেছে এই ক্যারিফোর রয়্যাল। পকেট থেকে একটা পেন্সিল বের করে ক্রশ চিহ্নের ঠিক মাঝখানে একটা ফুটকি দিয়ে বলল, মঁসিয়ে, এই হল ফাঁকা জায়গাটা। পুরো শীতকালটা একটা জিপসীদল আড্ডা গেড়েছিল এখানে। ওরা গেছে গত মাসে। জায়গাটা পরিষ্কার হয়েছে বটে, কিন্তু জিপসী কুকুরের গন্ধ এখনও মাস কয়েক থাকবে।

কুকুরগুলোকে বন্ড দেখল। সবাই যেন নেকড়ের বাচ্চা। তারপর ডিউটি অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে টুকটাক কয়েকটা জিনিস নিয়ে নিজের গাড়িতে গেল।

ঝড়ের বেগে সেন্ট জার্মেন বনরক্ষক অফিসে পৌঁছতে দেরি হল না। ওরা বললে, জিপসীরা সত্যিই ছিল ওখানে। খাঁটি রোমান চেহারা। ফ্রেঞ্চ বলতে পারত না। দু একটা ভাঙা ভাঙা শব্দ ছাড়া। চালচলন ভালই। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। উৎপাত করেনি। কারো কোন নালিশও নেই। ওদের দলে ছিল দুজন পুরুষ, দুজন মেয়ে। কবে গেছে তা কেউ বলতে পারবে না। কেউ দেখেনি। হঠাৎ একদিন জানা গেল জিসীর দল নেই। সপ্তাহখানেক হল গেছে। জায়গাটা কিন্তু ভালই পছন্দ করেছিল। দিব্বি নিরিবিলি।

কুখ্যাত ডি-৯৮ রাস্তা ধরেই জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি হাঁকাল বন্ড। দূর থেকে মোেটর রাস্তার ব্রীজ দেখা যেতেই গতিবৃদ্ধি। করে সিকি মাইল থাকতে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। নিঃশব্দে গড়িয়ে চলল গাড়ি। গড়াতে গড়াতে গাড়ি এল ক্যারিফোর রয়্যালে। ব্রেক কষল বন্ড। মার্জারের মত শব্দহীন চরণে লাফিয়ে পড়ল রাস্তায়। নির্জন বনভূমির মধ্যে এতখানি হুঁশিয়ারির জন্য নিজেকে একটু বোকা বোকাই মনে হল। তবুও পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে। যে ফাঁকা জায়গায় ডেরা নিয়েছিল জিপসীরা, সন্ধানী চোখে উন্মুক্ত সেই অংশটুকুই অন্বেষণ করতে থাকে বন্ড।

বেশি খুঁজতে হয় না। গাছপালার কুড়ি গজ ভেতরেই রয়েছে এক খণ্ড সবুজ তৃণভূমি, কিনারায় দাঁড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় আর গাছপালার অন্তরালে থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিল গোটা জমিটার ওপর। তারপর অতি সন্তর্পণে, অত্যন্ত হুঁশিয়ার হয়ে পা দিল জমিতে। সতর্ক পদক্ষেপে পেরিয়ে এসে দাঁড়াল এদিকের প্রান্তে।

দুটো টেনিস কোর্ট জুড়লে যা হয়, খোলা জায়গাটার মাপ তাই। পুরু গালিচার মতই ঘন ঘাসের স্তরে ঢাকা। শ্যাওলা ফুলও আছে প্রচুর। লিলিজ অব দি ভ্যালী এবং রুবেলের স্তবক শোভা পাচ্ছে কিনারা বরাবর গাছের নিচে নিচে। একধারে রয়েছে একটা নিচু ঢিবি। কাঁটাঝোঁপ আর কাঁটা গোলাপের ঘন ঝোপে আগাগোড়া ঢাকা। অজস্র ফুল ফুটেছে ঝোঁপটায়। ঝরা পাপড়ি গড়িয়ে পড়েছে ঢিবির গোড়া পর্যন্ত।

ঝোপটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বন্ড। তাতেও মন ভরল না। গোটা ঢিবিটাকে একটা পাক দিয়ে এল। হেঁট হয়ে দেখল শিকড় পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে। কিন্তু মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।

শেষবারের মত অনুবীক্ষণ চোখে তন্ন তন্ন করে গোটা মাঠটাকে দেখে নিল বন্ড। তারপর এসে দাঁড়াল এমন একটা কোণে, যেখান থেকে রাস্তা সব চাইতে কাছে। এই জন্যই কি ঘাস জমিতে চলাচলের একটা রেখা ফুটে উঠেছে? ঘাসগুলো যেন দোমড়ানো, লোক চলাচলের আবছা চিহ্ন না?

পথটা জিপসীদের পায়ে পায়েও সৃষ্টি হতে পারে। অথবা বনভোজনে উৎসাহী তরুণ তরুণীদের দাপটেও সম্ভব। রাস্তার একদম ধারে দুটো গাছের মাঝ দিয়ে পথটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে।

গুড়ি দুটো পরীক্ষা করার জন্য হেঁট হয়েছিল বন্ড। ঘ্রাণ নিয়েছিল। তারপর জানু পেতে বসে নখ দিয়ে গুঁড়ির ছাল থেকে তুলে এসেছিল কাদার একটা পাতলা চাপড়া।

কাদার নিচেই গুঁড়ির ওপর একটা সুস্পষ্ট আঁচড়-চিহ্ন। গভীর দাগ। কাদা দিয়ে কায়দা করে লুকোনো দাগটা।

বাঁ-হাতে কাদার চাপড়াটা ধরে থুথু ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিল বন্ড এবং আবার সযত্নে ঢেকে দিল আঁচড়ের দাগটা যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবে।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই সাঙ্গ হল গুঁড়ি পরীক্ষা। দেখা গেল, এদিকের গুঁড়িতে রয়েছে সবসুদ্ধ তিনটে আঁচড়ের চিহ্ন আর ওদিকের গুঁড়িতে চারটে।

দ্রুত পদক্ষেপে বনভূমি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল বন্ড। ঢালু জায়গায় ব্রীজের নিচেই দাঁড় করানো ছিল ওর গাড়ি। ব্রেক ছেড়ে ঠেলা দিতেই গড়িয়ে নেমে এল বেশ খানিকটা। ফাঁকা জায়গাটা থেকে বেশ খানিকটা দূরে না আসা পর্যন্ত ইঞ্জিন চালু করল না, সাহসও হল না।

তাই আবার ফিরে এসেছে বন্ড, এসেছে সেই নির্জন বনতলে। এবার আর ঘাসের ওপর নয়, গাছের ওপর। এসেছে। অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এত প্রচেষ্টা ভস্মে ঘি ঢালার সামিল হবে কিনা, সে শঙ্কাটাও মনে আছে। কিছুতেই তাই স্বস্তি পাচ্ছে না বেচারী।

M-এর হুকুমেই ওকে আসতে হয়েছে এখানে। উনি বলেছেন, গন্ধ যখন পাওয়া গেছে, সেই গন্ধ জিপসীদের গন্ধ হলেও জায়গাটা দেখা দরকার। কারণ বন্ডের রিপোর্ট ছিল, কুকুরেরা গন্ধ পেয়েছিল জিপসীদের…পুরো শীতকাল কাটিয়ে তারা গেছে গত মাসে…কোন নালিশ নেই…উধাও হয়েছে রাতারাতি।

একেই বলে অদৃশ্য সূত্র। অদৃশ্য মানুষের সূত্র। ঘটনার পটভূমিকায় যারা রয়েছে, তারা এতই পরিচিত যে ভুলেও মনে হয় না নাটের গুরু তারাই। ছ জন পুরুষ আর দু জন মেয়ে ছিল। জিপসীদের দেশ। ফরাসি ভাষায় দখল ছিল। না বললেই চলে। ধোকা দেবার মতলব থাকলে জিপসীদের ছদ্মবেশে সুবিধে কিন্তু অনেক। স্থানীয় ভাষা না জানালেও কিছু এসে যায় না। পরদেশী হয়েও তারা পরদেশী নয়–কারণ তারা জিপসী। ওদের কেউ-কেউ নাকি ঘোড়ায়-টানা ছাউনি দেওয়া গাড়ি চেপে বিদেয় হয়েছে, যারা পুরো শীতকালটা ঘাঁটি গেড়েছিল বনের মধ্যে, তারাই গোপন বিষয় বানিয়ে যায়নি তো? টপ সিক্রেট কাগজপত্র ছিনিয়ে এনে ফের এই গোপন ঘাঁটিতেই ঘাপটি মেরেছে হয়ত ওদেই সাঙ্গ-পাঙ্গ। ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার পক্ষে অভিনব ষড়যন্ত্র সন্দেহ নেই।

কে জানে হয়ত সবটাই বন্ডের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, চমকপ্রদ ফ্যানটাসি রচনা। অন্তত এই ধারণা বন্ডের ছিল সে দিন পর্যন্ত, কিন্তু যখনি গাছের গোড়ায় দেখেছে রহস্যজনক আঁচড়চিহ্ন, তখনি ফ্যানটাসি হয়েছে ফ্যাক্ট, সন্দেহ গেড়েছে যুক্তির শেকড়।

দু দুটো গাছের গুঁড়ির আঁচড়চিহ্ন অভ্যস্ত যত্ন সহকারে কাদামাটি দিয়ে লেপা। সব কটা চিহ্নই রয়েছে একটা বিশেষ উচ্চতায়-যে উচ্চতায় ঠেলে নিয়ে যাওয়া যে কোন ধরনের সাইকেল প্যাডেলের ঘষা লেগেই গাছের ছালে এ আঁচড় লাগা সম্ভব।

হয়ত সমস্তটাই অসম্ভব কপোল-কল্পনা। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষীণ এই সূত্রটাই জেমস বন্ডের পক্ষে যথেষ্ট। একটা সমস্যা তবুও খচ খচ করতে থাকে মনে। আবার হানা দেওয়ার সাহস কি হবে বিবরবাসীদের? হয়ত একবারই তারা ছোঁ মেরেছে বাজপাখির মত আর ফিরবে না।

আর যদি তারা দুরন্ত দুঃসাহসী হয়? নিজেদের নিরাপত্তার ওপর প্রচণ্ড আস্থা থাকে? তবে আবার বেরিয়ে আসবে গোপন কন্দর ছেড়ে।

অনুমতিটা স্টেশন এফ ছাড়া আর কারো কাছে বলেনি বন্ড। মেরী অ্যান রাসেল সব শুনে হুঁশিয়ার থাকতে বলেছেন বন্ডকে এফ এর কর্তা বাজে কথার মানুষ নন। তিনি সেন্ট জার্মেনে তাঁর ঘাঁটিতে হুকুম পাঠিয়েছেন বন্ডকে যেন সবরকম সাহায্য করা হয়। কর্নেল স্ক্রাইবারকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বন্ড সেন্ট জার্মেনের গোপন ঘাঁটির ক্যাম্পে ডেরা নিয়েছে। ঘাঁটিটা একটা বেনামী গাঁয়ের পেছনের রাস্তায় বেনামী বাড়িতে। ক্যামোফ্লেজের ছদ্মবেশ এই ঘাঁটি থেকেই পাওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে চারজন সিক্রেট সার্ভিসের জোয়ান। বন্ডের হুকুম পেলেই তারা আনন্দে আটখানা হয়ে হাত চালাবে। সবারই মনে হচ্ছে বন্ড যদি রহস্যের কিনারা করে শেপ ইনটেলিজেন্সকে উচিত শিক্ষা দেয়, তবেই সিক্রেট সার্ভিসের স্বাধীনতা অব্যাহত থাকবে। M-এর অনেকদিনের দুশ্চিন্তাও যাবে। দর্পচূর্ণ হবে শেপ এর, গৌরব বাড়াবে সিক্রেট সার্ভিসের।

ওক গাছের শাখায় শুয়ে নিজের মনেই হাসল বন্ড। যুদ্ধ শুধু বাইরে নয়, যুদ্ধ ঘরেও। দুটো দলেরই উদ্দেশ্য এক শত্রুর উচ্ছেদ। অথচ নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে কি বিপুল উদ্যম শক্তিরই না অপচয় করেছে। নিজেদের মধ্যে আগুন ছোঁড়াছুড়ি না করে যদি শত্রুর দিকেই তা নিক্ষিপ্ত হত তাহলে পঞ্চমবাহিনীর অস্তিত্ব কোণকালে মুছে যেত দেশ থেকে।

সাড়ে ছ টা বাজে। সকালের নাস্তার সময় হল। সন্তর্পণে বন্ডের ডান হাত বিচিত্র পোশাকের পকেট হাতড়াতে লাগল এবং তারপরেই উঠে এল মুখের জায়গায় হুডের মত কাটা ফাঁকটুকুর সামনে। রয়ে সয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুষল গ্লুকোজ ট্যাবলেটটা। তারপর আর একটা। চোখ কিন্তু সরল না উন্মুক্ত তৃণভূমির ওপর থেকে, লাল কাঠ বেড়ালিটা অনেকক্ষণ ধরেই খেলা জুড়েছে টিবিটার আশে পাশে, কুটকুট করে খাচ্ছে ছোট ছোট শেকড়। অবশেষে ঢিবির তলায়। এসে দু-থাবার মধ্যে নতুন একটা খাদ্যবস্তু ধরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাই নিয়ে। ঘন ঘাসের মধ্যে হুটোপাটি করছিল একজোড়া বুনো পায়রা, বনভূমির নৈঃশব্দ ভঙ্গ হচ্ছিল কেবল ওদেরই প্রেম কূজনে। একটা কাঁটা ঝোঁপের ওপর বাসা নির্মাণ করার জন্য টুকিটাকি বস্তু সংগ্রহে নিদারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল একজোড়া চড় ই। গোলাপ ঝোঁপের ওপর ঐকতান শুরু করে দিল মধুমক্ষিকার দল। দলে ক্রমশ ভারি হচ্ছে ওরা। বিশ গজ দূরে ডালপাতার আড়ালে ওক গাছের শাখায় শুয়ে সমস্তই স্পষ্ট দেখতে পেল জেমস্ বন্ড। এ যেন ঠাকুরমার ঝুলি থেকে আহরণ করা একটা অপরূপ রূপকথা। দীর্ঘ সমুন্নত বৃক্ষের শির ধুইয়ে অরুণ কিরণ স্বর্ণধারার মত ঝরে পড়ছে আশ্চর্য সবুজ ঘাসজমির ওপর। নাচছে। ভোমরা। গাইছে পাখি। আনন্দের হিল্লোলে হিল্লোলিত সতেজ ঘাসগুলিও। রাত চারটে থেকে গাছে উঠে ঘাপটি মেরে বসে আছে বন্ড। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে গেলে ভোর যে এমন অপরূপ হয়ে দেখা দেয় তা এর আগে কখনো এমনভাবে প্রত্যক্ষ করেনি সে।

বিহঙ্গকুলের দৌরাত্ম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হতভাগারা ঝটাপটি করতে করতে বন্ডের মাথায় এসে বসলেই কেলেঙ্কারী।

বিপদজ্ঞাপক সঙ্কেতটা সর্বপ্রথম এল পায়রাদের কাছ থেকে। আচম্বিতে প্রচণ্ড পাখা ঝটপটানির শব্দ তুলে জমি। ছেড়ে সবাই আশ্রয় নিল গাছের ডালে। তারপর বাকি পাখিরাও তৃণভূমি ছেড়ে চম্পট দিল গাছ লক্ষ্য করে। সবশেষে ছুটল কাঠবিড়ালির দল।

নীরব হয়ে গেল বনভূমি। গোলাপকুঞ্জের ওপর গুণগুণ ভ্রমর সঙ্গীত ছাড়া আর কোন শব্দই নেই তৃণভূমিতে। নিঃশব্দ। আশ্চর্য নিঃশব্দ।

ব্যাপার কি? কিসের জন্য বিপদজ্ঞাপন সংকেত? কি দেখে ভয় পেল নিরীহ পায়রা, পাখি আর কাঠবিড়ালির দল?

 ধীরে ধীরে উত্তাল হয়ে উঠতে লাগল বন্ডের হৃদপিণ্ড। দূরবীনের মত তীক্ষ্ণ চোখ দুটো তৃণভূমির প্রতি বর্গইঞ্চি স্থান খুঁটিয়ে দেখতে লাগল অস্বাভাবিক কোন সূত্রের আশায়।

আর, তারপরেই ধড়াস করে উঠল বুকটা। গোলাপ ঝোপে কি যেন নড়ছে না?

নড়াটা এত সামান্য, এত অল্প যে ধর্তব্যের মধ্যে নয়। অথচ তা অসাধারণ। ধীরে ধীরে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে, একটি মাত্র কাঁটাবৃত্ত উঠে আসছে ওপরকার শাখার মাথা ছাড়িয়ে। অস্বাভাবিক রকমের সিধে আর মোটা একটা গোলাপবৃন্ত।

আস্তে আস্তে উঠে আসতে লাগল বোঁটাটা। ঝোঁপের ফুটখানেক ওপরে না উঠা পর্যন্ত অব্যাহত রইল উধ্বগতি। তারপরেই দাঁড়িয়ে গেল।

বোঁটাটার ডগায় একটিমাত্র লাল গোলাপ। ঝোঁপের ফুটখানেক ওপরে উঠে থাকার জন্যই বুঝি অস্বাভাবিক লাগছিল গোলাপটা–তা না হলে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এ আর এমন আশ্চর্য কি! সিধে ভঁাটার ওপর একটা লাল গোলাপ। প্রকৃতির সৃষ্টিতে কত বৈচিত্র্য আছে এও তার মধ্যে একটা, তার বেশি কিছু নয়।

কিন্তু এমন সুন্দর গোলাপটির মধ্যেই এবার ঘটল এক অকল্পনীয় পরিবর্তন। আচম্বিতে, অত্যন্ত ধীরে-ধীরে, নিঃশব্দে পাপড়িগুলো কাঁপতে লাগল, আস্তে আস্তে খুলে যেতে লাগল এবং ঝুলে পড়তে লাগল বাইরের দিকে। হলুদ গর্ভকেশর গুটিয়ে সরে গেল পাশে।

আর, সূর্যের আলো টিকরে পড়ল আধুলির মত বড় একটা কাঁচের লেন্সের ওপর। মনে হল, লেন্সটা যেন সিধে তাকিয়ে রয়েছে বন্ডের পানেই। কিন্তু পরক্ষণেই আস্তে-আস্তে বোটার ওপর ঘুরে যেতে লাগল অবিশ্বাস্য এই গোলাপ চক্ষু; অত্যন্ত ধীর-ধীরে পুরো একটা পাক দিয়ে, সমস্ত তৃণভূমি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, আবার ফিরে তাকাল বন্ডের পানে।

অবশেষে যেন নিশ্চিন্ত হয়েই আবার পাপড়ি আর গর্ভকেশরগুলো উঠে এসে ঢেকে দিল কাঁচ-চক্ষু, এবং ধীরে ধীরে নজরে আসে এমনি গতিতে নেমে গেল, বিচ্ছিন্ন বোটটা মিশে এক হয়ে গেল অন্যান্য বৃন্তের সঙ্গে।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে এতক্ষণ পড়েছিল বন্ড। এবার যেন ছিপি-খোলা সোডার বোতলের মতই পাঁজর খালি করে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। ক্ষণেকের জন্য চোখ বুজে জিরেন দিল চোখের টনটনিয়ে ওঠা স্নায়ুগুলোকে।

জিপসী! গোলাপবৃন্তের খোলস ঢাকা কলকজা বাউন্ডুলে জিপসীদের মাথা থেকে বেরোয়। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানরা মাথা চাড়া দিতে ইংরেজরাও যা বানাতে পারেনি এমন কি জার্মানরা নিজেরাও যে অভিনব যন্ত্র কল্পনাতে আনতে পারেনি, এখানকার তৃণভূমির পাতালপুরীতে তা সৃষ্টি করে গেছে কয়েকজন জিপসী! ঘাস-ছাওয়া মাটির ঢিবির নিচে গর্ভগৃহ থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গোলাপের ছদ্মবেশ পরানো আশ্চর্য যন্ত্র-চক্ষু! পেরিস্কোপ!

ভয়ের হিমশীতল স্রোত বন্ডের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। অনুমানটা তাহলে সঠিক! কিন্তু এর পরের দৃশ্যটা কি?

মাটির ঢিবির দিক থেকে এবার একটা শব্দ ভেসে এল।

অদ্ভুত শব্দ। যেন অতি উচ্চগ্রামে গুনগুন করছে অগুন্তি ভোমরা। অতি তীব্র এবং সেই কারণেই প্রায় অশ্রুত পাতলা ভ্রমর গুঞ্জনের সেই অপার্থিব চাপা শব্দটা জাগ্রত হল নিরীহ দর্শন গোলাপ কুঞ্জের তলা থেকে।

ইলেকট্রিক মোটর চলার শব্দ। পুরোদমে মোটর চলছে। আচম্বিতে ঈষৎ কেঁপে উঠল গোটা গোলাপের ঝাড়টা। সদলবলে শূন্যে ছিটকে গেল মধুমক্ষিকা বাহিনী। কিছুক্ষণ ভেসে থাকবার পর আবার নেমে এল গোলাপঝাড়ে।

খুব ধীরে ধীরে, যেন জাদুমন্ত্রবলে। একটা চিড় দেখা দিয়েছে ধরিত্রীতে। গোলাপ ঝাড়ের ঠিক মাঝ-বরাবর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ফাটলটা। ক্রমশ আলো চওড়া হল। মসৃণ গতিতে যেন উন্মোচিত হচ্ছে নাগলোকের পাতাল বিবরে।

এবার গোলাপঝাড়ের দু পাশ খুলে যাচ্ছে দু দিকে হুবহু দু পাল্লা দরজার মত। নিবিড় তমসায় ঢাকা রন্ধ্রলোক আরও প্রকট হচ্ছে। পাল্লার ভেতরের দিকে ঝুলছে গোলাপের শেকড়, এবং শেকড় সমেত, গোলাপ সমেত ভূগর্ভ পুরীর সিংদরজার বিশাল পাল্লা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কলকজার ভ্রমরগুঞ্জন। ঈষৎ বাঁকানো পাল্লা দুটোর কিনারা ঝিকমিক করছে সূর্যালোকে। চকচকে ধাতুর দরজা। তার ওপর সযত্নে পুঁতে দেওয়া হয়েছে গোলাপ ঝাড়।

সাবাস বিভীষণবাহিনী! সাবাস তোমাদের শয়তানি বুদ্ধি!

দু হাট হয়ে খুলে গেল ধাতুর দরজা। দু পাশে খাড়া হয়ে রয়েছে দ্বিধাবিভক্ত গোলাপ কুঞ্জ। নির্বিকার অলিকুল নিশ্চিন্ত মনে তখনও মধু আহরণে ব্যস্ত। সূর্যের আলোয় এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাটির তলায় পুরু ধাতুর স্তর। যেন মাটিতে পোঁতা অতিকায় ডিম–যার ওপরটা হঠাৎ দু ভাগ হয়ে গেছে ডাকিনী মন্ত্রে।

বক্র দরজার মাঝে কালো আঁধার পাতলা হয়ে এসেছে ওপরের দিনের আলোয়, আর ভেতরের ইলেকট্রিক আলোয়। মোটর চলার আওয়াজ থেমেছে। ঝিকিমিকি বিদ্যুত্বাতি আড়াল করে এবার বিবর মুখে আবির্ভূত হল একটা মাথা আর একজোড়া কাঁধ।

যেন একটা মানুষ চিতা। শব্দহীন সঞ্চরণ। সজাগ চাহনি। সতর্ক পদক্ষেপে উঠে এল একটা লোক। গুঁড়ি মেরে বসল বাঘের মতই। সূচিতীক্ষ্ণ চোখ বুলিয়ে নিল সবুজ তৃণভূমির ওপর। লোকটার হাতে একটা রিভলভার।

পর্যবেক্ষণ সন্তোষজনক হল নিশ্চয়। তাই ঘাড় ফিরিয়ে হাতের ইঙ্গিত করতেই ফাটলপথে উঠে এল আরও একজন। কিম্ভুতকিমাকার তিন জোড়া জুতা প্রথম ব্যক্তির হাতে তুলে দিল দ্বিতীয় ব্যক্তি। এবং পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

একজোড়া জুতা বেছে নিল প্রথম লোকটা। নিজেই বুটসুদ্ধ পা গলাল তার মধ্যে। ফিতে বাঁধল। আরও সহজভাবে চলাফেরা শুরু হল পাতালবাসীর। কিম্ভুতকিমাকার জুতার চ্যাটাল শুকতলার নিচে ঘাস ঈষৎ দুমড়ে গিয়েই আবার খাড়া হয়ে যেতে লাগল। জুতার ছাপের চিহ্ন মাত্র পড়ল না কোথাও।

মনে মনে তারিফ না করে পারল না বন্ড।

বেরিয়ে এল দ্বিতীয় ব্যক্তি তার পেছনে আরেকজন। দুজনে মিলে পাতাল গহ্বরের ভেতর থেকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে এল একটা মোটর সাইকেল। কাঁধে চওড়া চামড়ার পটিতে বাইকটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে নিল। সিধে হয়ে দাঁড়াতেই প্রথম ব্যক্তি প্রত্যেকের পায়ে বেঁধে দিল সেই বিচিত্র দর্শন জুতা। তারপরে তিনজনেই হেঁটে চলল রাস্তার দিকে। গাছের ছায়ায় ভৌতিক মূর্তির মতই তিনজনে এগিয়ে চলল। পা ফেলল অতি সন্তর্পণে। পা তুলল অতি সন্তপণে। ভঙ্গিমা দেখেই তাদের অভিপ্রায় বোঝা যায়। নিঃশব্দে অভিযানের উদ্দেশ্য অত্যন্ত কুর, অত্যন্ত কুটিল।

অবরুদ্ধ উদ্বেগে বন্ড এতক্ষণ কাঠ হয়ে শুয়েছিল। এবার পাঁজরা খালি করে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।

বটে! এইটেই তাহলে পঞ্চমবাহিনীর গোপন ঘাঁটি। সব কটা ছাড়া ছাড়া ঘটনাই এবার এক সূতায় গেঁথে যাচ্ছে। মোটরবাইক বাহী অনুচর দু জনের পরনে ধূসর রঙের ঢিলে আলখাল্লা। কিন্তু দল নায়ক প্রথম ব্যক্তির পরনে রয়্যাল কোর অব সিগন্যালস এর ইউনিফর্ম। মোটর সাইকেলের রঙ অলিভ গ্রীন–বি.এস.এ.এম-টোয়েন্টি। বৃটিশ আর্মির রেজিস্ট্রেশন চিহ্নিত করা পেট্রল ট্র্যাঙ্কে।

এরপর আশ্চর্য হওয়ার আর কিছুই রইল না। এই কারণেই অত কাছ থেকে দেখেও নিহত হওয়ার আগে বেচারী ডেসপ্যাঁচ রাইডার কোন বদ সন্দেহ করতে পারেনি। ভেবেছে সহকর্মী। কিন্তু টপ সিক্রেট দলিলপত্র নিয়ে এরা এ তল্লাট ছেড়ে যখন বাইরে যায়নি, তখন অনুমান করে নিতে হবে রেডিওর শরণ নিয়েছে। অর্থাৎ, গুপ্ত খবরের সারাংশ। নিশুতিরাতে বেতার মারফত পাচার করে দিয়েছে আপন ঘাঁটিতে। পেরিস্কোপের বদলে গোলাপের উঁটার ছদ্মবেশ পরানো এরিয়েল উঠে এসেছে ঝোঁপের মধ্য থেকে। পাতাল কক্ষে সচল হয়েছে জেনারেটর এবং ইথারের মধ্যে দিয়ে সাংকেতিক সংবাদ বর্ডার পেরিয়ে গেছে শত্রুপক্ষের ঘাটিতে।

সাঙ্কেতিক সংবাদ। বিবর ঘাঁটিতে যত সঙ্কেত আছে, সবই জানা যাবে বন্ড যদি একবার ভেতরে ঢোকে। এই সুযোগে কিছু ভুয়া খবরও পাঠানো যেতে পারে শত্রু শিবিরে। এদের মূল ঘাঁটি নিশ্চয় রাশিয়ার সোভিয়েত মিলিটারি ইনটেলিজন্স নিয়ন্ত্রণ করছে এই পাতাল ঘাটিতে। রেসের ঘোড়ার মত দৌড়াতে থাকে বন্ডের চিন্তাধারা।

অনুচর দু জন ফিরে আসছে। বিবর ঘাটিতে প্রবেশ করল দু জনে এবং মাথার ওপর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল গোলাপঝাড় সমেত আশ্চর্য পাল্লা দুটো। দলপতি মোটর-সাইকেল নিয়ে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বন্ড দেখল ছটা পঞ্চান্ন।

বটে! বটে! সকাল সাতটায় আবার নতুন ডেসপ্যাঁচ রাইডার শিকারের উদ্দেশ্যেই এই অভিযান। হয়ত শিকারী জানে না যে, ডেসপ্যাঁচ রাইডাররা সপ্তাহে একদিনই বেরোয়। জানলেও হয়ত ভেবেছে, সদ্য খুন হয়ে যাবার পর শেপ কর্তৃপক্ষ রুটিন পালটেছে। স্রেফ নিরাপত্তার খাতিরে ডেসপ্যাঁচ রাইডার নির্দিষ্ট দিনে না বেরিয়ে বেরোবে হয়ত অন্য কোন দিনে। হুঁশিয়ার লোক বটে। খুব সম্ভব এদের গুপ্তচর-প্রধানের নির্দেশ আছে, গ্রীষ্ম আসার আগেই যতখানি সম্ভব কাজ গুছিয়ে নেওয়া। এরই মধ্যে তো টুরিস্ট আসা শুরু হয় গেছে। সাবধানের মার নেই তাই পাতালপুরী বন্ধ রেখেই সরে যাবে নিরাপদ স্থানে। আবার ফিরে আসবে শীতকালে। আরও কত প্ল্যান থাকতে পারে কু-চক্রীদের কে জানে। তবে আরো একটা খুন হবে বন্ড সে বিষয়ে নিশ্চিত।

মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়। সাতটা দশের সময় ফিরে এল পালের গোদা। উন্মুক্ত তৃণভূমির কিনারায় একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মাত্র শিশ দিল বিচিত্রি সুরে। যেন মহা উল্লাসে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠল কোন সুকণ্ঠী পাখি।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে যেতে লাগল গোলাপ ঝাড়ের সিং দরজা। বিচিত্র জুতা পরে বেরিয়ে এল দুই অনুচর। দলপতির পিছু পিছু উধাও হল গাছের সারির আড়ালে। ফিরে এল একটু পরেই। দু কাঁধে চামড়ার ফিতেতে ঝুলছে মোটর সাইকেলটা। বাঘা চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হল দলপতি। কেউ কোথাও নেই। আস্তে আস্তে নেমে গেল পাতাল পথে এবং বিশাল পাল্লা দুটো এসে বন্ধ করে দিল প্রবেশ পথ। গুণগুণ করতে লাগল ভোমরার দল। চিহ্ন রইল না কোথাও।

আরো আধঘণ্টা কাঠ হয়ে শুয়ে রইল বন্ড। বনভূমির স্বাভাবিক প্রাণ চাঞ্চল্য আবার ফিরে এসেছে সবুজ ভূমি খণ্ডে। ঘণ্টা খানেক পরে যখন খর সূর্যকিরণে ছায়া আরো গাঢ় হল, নিঃশব্দে বন্ড নেমে এল। সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে শাখার ওপর দিয়ে পিছলে পিছলে পৌঁছাল গুঁড়ির কাছে, টুক করে লাফ দিল শ্যাওলা ঢাকা ঘাসের কার্পেটে এবং অদৃশ্য হল।

সেদিন সন্ধায় সব শুনে চেঁচামেচি শুরু করল মেরি অ্যান রাসেল। বলল, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে। এ কাজ আপনাকে আমি করতে দেব না। এফ কর্তাকে দিয়ে ফোন করছি কর্নেল স্ক্রাইবারকে। এ কাজ শেপ -এর কাজ। আপনার নয়।

ধাঁ করে বন্ড বলল, খবরদার, ওসব করতে যাবেন না। কাল সকালে ডিউটি ডেসপ্যাঁচ রাইডারের বদলে আমাকে খুশি মনে পাঠাতে পারেন কর্নেল স্ক্রাইবার। খুশিটা তিনি মুখেও প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ অবস্থায় এর বেশি আর কিছু জানার অধিকার তার নেই। তাছাড়া এ নিয়ে মাথা ঘামানোর আর ইচ্ছে নেই ভদ্রলোকের, ফাইল বন্ধ করে অন্য প্রসঙ্গ ভাবছেন। যা বলি শুনুন। লক্ষ্মী মেয়ের মত টেলিপ্রিন্টারে রিপোর্টটা M-কে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন

গোল্লায় যাক আপনার M। গোল্লায় যাক আপনার সার্ভিস। হিস্ট্রিয়ার রোগিণীর মত চেঁচিয়ে উঠেছে রাসেল। গলায় রাগ আর কান্না মিশিয়ে এ কি ছেলেখেলা হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মেকী লড়াই? একাই একশ হবেন? আসলে আপনি বাহাদুরী দেখিয়ে নাম কিনতে চান।

বিরক্তি আর চাপতে পারে না বন্ড। ধমকে উঠে বলে, হয়েছে-হয়েছে, অনেক হয়েছে। এখুনি টেলিপ্রিন্টারে পাঠিয়ে দিন রিপোর্টটা, আমার হুকুম।

আরক্ত মুখে ক্ষণকাল তাকিয়ে যেন হাল ছেড়ে দিল রাসেল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর হুকুম জাহির করতে হবে না। যা করবার আমি করছি। কিন্তু সাবধানে থাকবেন। চোট না লাগে। গুড লাক।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা। কাল রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন রইল, কেমন? আর মেনন ভিলেই ভাল। গোলাপী শ্যাম্পেন আর জিপসীর বেহালা বাজনা। প্যারিস মানেই রুটিন কাণ্ড। রাজি?

মন্দ কি! সুতরাং আরো হুঁশিয়ার হবেন তো?

বলা বাহল্য অযথা ভাববেন না। গুড নাইট।

নাইট।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে গোটা প্ল্যানটাকে মনে মনে ঘষে মেজে ঝকঝকে তকতকে করে তুলল বন্ড। ডিউটি বুঝিয়ে দিল এফ স্টেশনের চার জোয়ানকে।

আর একটি সুন্দর সকাল।

অভিযানের জন্য তৈরি হচ্ছে জেমস বন্ড। বেশ জাঁকিয়ে বসেছে বি, এস, এ. মোটরসাইকেলের ওপর। অনতিকাল পরেই দ্বিচক্রযানে চেপে শুরু হবে তার দুঃসাহসের খেলা-জীবন আর মৃত্যুর জুয়া খেলা। পরিণামটা কি তা বন্ড নিজেও জানে না। ক্যারিফোর রয়্যালের রাস্তায় কি যে ঘটবে, তা না জেনেও শান্ত তার লোহার মত স্নায়ু।

ঘুটঘুট করে চলেছে মোটর বাইকের ইঞ্জিন। সিগন্যাল কোরের করপোর্যাল বন্ডের হাতে তুলে দিল শূন্য ডেসপ্যাঁচ কেসটা। বলল, আপনাকে দেখে স্যার মনে হচ্ছে রয়্যাল কোরেই আপনি জীবন কাটালেন। চুলটা অবশ্য একটু ঘাঁটলে ভাল হত। কিন্তু ইউনিফর্মটি যা মানিয়েছে না। বাইকটা কিরকম লাগছে স্যার?

স্বপ্নের পক্ষিরাজ। কত দিন যে চালাইনি।

ঘড়ির দিকে তাকাল করপোর্যাল। সিগন্যাল দেওয়ার সময় হয়েছে। চোখ তুলে বললে, সাতটা বাজতে আর দেরি নেই। ও-কে!

বুড়ো আঙুলের ইঙ্গিত পেতেই গগলসটা টেনে চোখের ওপর নামিয়ে দিল বন্ড। হাত নেড়ে বিদায় জানাল করপোর্যালকে। বুটের ঠোক্কর মারল গীয়ারে, কাকর-বিছানো পথের ওপর দিয়ে সবেগে ঘুরে গিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে গেল মেন গেটের মধ্য দিয়ে।

পেরিয়ে গেল ১৮৪ নং রাস্তা, এল ৩০৭ নং সড়ক। বেলী এবং নয়জি-লেরয়ের মধ্যে দিয়ে সেন্ট নম। এখান থেকে আচমকা বাঁক নিলেই ডি, ৯৮ সড়ক–খুনের রাস্তা। ঘাসের পাটির ওপর বাইক দাঁড় করাল বন্ড। আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল ৪৫ কোল্টের লম্বা নলটার ওপর। পেটের কাছে রিভলভার গুঁজে খুলে রাখল জ্যাকেটের বোতাম। এবার রওনা হওয়া যাক-অন ইওর মার্কস! গেট সেট…!

চকিতে ক্ষিপ্রতায় মোড় ঘুরল বন্ড এবং নিমেষে গতিবেগ বৃদ্ধি করল ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে সুড়ঙ্গটা–প্যারিস মোটর চলা রাস্তার সুড়ঙ্গ। পাহাড়ের বুক চিরে সুদীর্ঘ টানেল। দেখতে দেখতে হাঁ বড় হল সুড়ঙ্গের, গিলে ফেলল বন্ডকে। কানে তালা লাগার উপক্রম হল একসস্টের প্রচণ্ড শব্দে…যেন মুহর্মুহু কামান দাগার শব্দ। মিনিট খানেকের জন্য সুড়ঙ্গ পথের স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগল। পরক্ষণেই আবার সূর্যালোক। টানেলের মুখ ছোট হয়ে যাচ্ছে পেছনে। পেরিয়ে এল ক্যারিফোর রয়্যাল। চোখের সামনে দিগন্তবিস্তৃত পিচঢালা পথ যেন তেল মাখানো…জ্বলছে সোনা সোনা রোদে। মাইল দুয়েক পথ জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। পাতা আর শিশিরের মিষ্টি সৌরভ। গতিবেগ চল্লিশে কমিয়ে আনল বন্ড। স্পীডের ঝাঁকুনিতে থর থর করে কেঁপে উঠল বাঁ হাতের ড্রাইভিং আয়না। আয়নার বুকে দ্রুত অপসৃয়মান গাছের সারি আর সীমাহীন সিধে সড়ক ছাড়া আর কিছু নেই কোথাও।

তবে কি ভয় পেয়েছে হত্যাকারী? ঘাপটি মেরে রয়েছে পাতাল পুরীতে? হয়ত আগে থেকেই চর মারফত খবর পৌঁছে গেছে ভূগর্ভ-ঘাঁটিতে, তাই আজ বিবর মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে পাতালকেতু।

ওকি! ওকি! ঐ তো, একটা কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে না? পেটমোটা কনভেক্স গ্লাসের ঠিক কেন্দ্রে একটিমাত্র ফুটকি…দেখতে দেখতে তা পরিণত হল মাছিতে…মাছি থেকে ভীমরুল…এবং ভীমরুল থেকে গুবরে পোকায়। এবার স্পষ্ট দেখা গেল একটা ক্র্যাশ হেলমেট ঝুঁকে পড়েছে বাইকের হ্যান্ডেল বারের ওপর…দুটো মস্ত কালো থাবা আঁকড়ে রয়েছে হাতল দুটো।

সর্বনাশ! এ যে দেখছি উল্কার মত ছুটে আসছে। দর্পণের বুক থেকে চকিতে বন্ডের চোখ ঘুরে গেল সামনের বিস্তৃত পথের ওপর…পরক্ষণেই ফিরে এল কনভেক্স গ্লাসের ওপর। খুনেটার ডান হাত রিভলবারটা তুলে নিলেই…।

গতি কমিয়ে আনল জেমস বন্ড–পঁয়ত্রিশ, তিরিশ, কুড়ি। মসৃণ ধাতুর মত ঝিকমিক করছে সামনে পিচ ঢালা পথ। আততায়ীর ডান হাতটা আর হ্যান্ডেলবার ধরে নেই। লৌহ শিরস্ত্রাণের নিচে দুটো গগলসের কাঁচ সূর্যের আলোয় যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে দু মালসা অঙ্গারের মত।

সময় হয়েছে। ভয়ানক জোরে ব্রেক কষলো বন্ড এবং চক্ষের নিমেষে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে রাস্তার ওপর পিছলিয়ে বোঁ করে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল বি.এস.এ.কে। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হল ইঞ্জিন।

এমন আকস্মিক ক্ষিপ্রতা সত্ত্বেও দেরি করে ফেলেছিল বন্ড। উপর্যুপরি দুবার গর্জে উঠল হত্যাকারীর আগ্নেয়াস্ত্র। একটা বুলেট বন্ডের ঊরুর পাশ দিয়ে গেঁথে গেল সিটের স্প্রিং এ।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কোল্ট রিভলবার। মাত্র একবার।

টলমল করে উঠল হত্যাকারীর মোটর বাইক। যেন একটা অদৃশ্য দড়ির ফাঁস জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে হ্যাঁচকা টানে রাস্তার ওপর তুলে নিয়ে গেল বাইক সমতে খুনে চালককে। এলোমেলোভাবে সড়ক বেয়ে ছুটতে ছুটতে এক লাফে টপকে গেল পাশের খানা এবং পরক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ল একটা বীজগাছের গুঁড়ির ওপর। মুহূর্তের জন্য গুঁড়ির গায়ে সেঁটে রইল বাইক সমেত চালক। তারপরেই ঝনঝন শব্দে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের ওপর।

বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল বন্ড। ধীর পদে গিয়ে দাঁড়াল ধোঁয়া ওঠা দোমড়ানো ইস্পাত আর বিকৃতভাবে মোচড়ানো দেহটার পাশে। নাড়ি দেখবার আর দরকার হল না। বুলেট যেখানেই লাগুক না কেন, ক্র্যাশ হেলমেটটা ডিমের খোলার মতই চুরমার হয়ে গেছে সংঘর্ষের ফলে।

ঘুরে দাঁড়াল বন্ড। কোল্টটা আবার খুঁজে রাখল পেটের কাছে বেল্টের ফাঁকে। কপাল ভাল তার। আততায়ীর বুলেট আর একচুল এদিক দিয়ে গেলেই…

বি.এস.এ. র ওপর লাফিয়ে বসল বন্ড। ফিরে চলল ক্যারিফোর রয়্যালের দিকে।

জঙ্গলের মধ্যে আঁচড়কাটা একটা গাছের গুঁড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করাল বি-এস-এ কে। তারপর গেল খোলা মাঠটার কিনারায়। মাথার ওপরে ঝাকড়া আখরোট গাছ। তাই জায়গাটা একটু ঝুপসি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে যতদূর সম্ভব নকল করার চেষ্টা করল সেই বিচিত্র শিশ ধ্বনির। যেন খুশি মনে গান গেয়ে উঠল বনের পাখি। হত্যাকারীর চিচিং ফাঁক সংকেত।

একবারই শিশ দিল বন্ড। তারপর দুরু দুরু বুকে শুরু হল প্রতীক্ষা। তবে কি ভুল হল শিশের সুরে?

ঠিক তখুনি কেঁপে উঠল গোলাপ ঝাড়। শুরু হল তীক্ষ্ণ তীব্র গোঁ-গোঁ গজরানি। মোটর চলছে।

কোল্টের ইঞ্চি খানেকের মধ্যে বেল্টের ফাঁকে বুড়ো আঙ্গুল আটকে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইল বন্ড। আর খুনখারাপি করার ইচ্ছে নেই। অনুচর দুজনকে সশস্ত্র বলে তো মনে হয়নি। কাজেই কি প্রয়োজন অযথা রক্তপাতের।

বাঁকানো দরজাটার পাল্লা দুটো দু হাট হয়ে খুলে গেছে। ফাঁক দিয়ে প্রথমে বেরিয়ে এল একজন–তারপরে সেই অদ্ভুত জুতা। তারপরে আর একজন।

চ্যাটাল জুতা। ধড়াস করে উঠল বন্ডের বুক। জুতার কথাটা একদম মনেই ছিল না। নিশ্চয় ঝোঁপের মধ্যে কোথাও লুকানো আছে জুতাজোড়া। আহাম্মক কোথাকার। দেখে ফেলল নাকি ওরা?

মন্থর চরণে হিসেব করে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এল দুই পাতালবাসী–বিশ ফুট দূরে এসে কি যেন বলল সামনের লোকটা। রাশিয়ান ভাষা বলেই মনে হল। জবাব দিল না বন্ড।

উত্তর না পেয়ে থমকে দাঁড়াল দুই মূর্তি, অবাক হয়ে বন্ডের দিকে তাকাল–সম্ভবত সাংকেতিক প্রত্যুত্তরের আশায়।

বিপদ ঘনিয়ে আসছে। চক্ষের নিমেষে রিভলবারটা টেনে নিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে গেল বন্ড। গর্জে উঠল ভয়ালকণ্ঠে, হ্যান্ডস্ আপ।

কোল্টের নল নেড়ে হাত ওপরে তোলার ইঙ্গিত করে বন্ড। সঙ্গে সঙ্গে পুরোধা ব্যক্তি জোর গলায় কি একটা হুকুম দিয়েই ছিটকে ধেয়ে এল সামনে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ব্যক্তিও ছুটে গেল পাতালপুরীর চিচিংফাঁক দরজার দিকে।

গাছের আড়াল থেকে দড়াম করে ধমক দিয়ে উঠল একটা রাইফেল এবং পা মুচড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পলায়নমান লোকটা। এদিক সেদিক থেকে ছুটে আসছে, এফ স্টেশনের চার জোয়ান।

সামনের লোকটা লাফ দিয়েছে বন্ডকে লক্ষ্য করে। এক হাঁটুর ওপর বসে পড়ল বন্ড, কোল্টের নল চালাল লোকটাকে লক্ষ্য করে। গায়ে লাগল ঠিকই, কিন্তু তারপরেই যেন মাথার ওপর পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। একইসঙ্গে দুজনে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। বন্ডের চোখ লক্ষ্য করে এগিয়ে এল আঙ্গুলের নখ। চক্ষের পলকে বন্ড পাশে সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষম একটা আপারকাট খুঁসিতে ছিটকে পড়ল বন্ড জমির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত দেহের ওপর লাফিয়ে পড়ল পাতালবাসী এবং ডানহাতের কব্জি মুচড়ে ধরে রিভলবারের নলের মুখ আস্তে আস্তে প্রচণ্ড শক্তিতে ফিরিয়ে দিতে লাগল বন্ডের দিকে।

আর খুন করার ইচ্ছে ছিল না বলেই সেফটি ক্যাচটা তুলে রেখেছিল বন্ড। প্রাণপনে চেষ্টায় বুড়ো আঙ্গুলটা সরিয়ে আনতে লাগল সেফটি ক্যাচের দিকে।

তৎক্ষণাৎ বুটের লাথি এসে পড়ল মাথার পাশে। মাথা ঘুরে অবশ হাত থেকে খসে পড়ল রিভলবারটা। লালচে কুয়াশার মধ্যে দেখল কোল্টের মৃত্যুমুখী নল অব্যর্থ নিশানায় স্থির হয়ে গেল তার খুলি টিপ করে। মৃত্যু, এবার মৃত্যু। অনুকম্পা দেখিয়েছিল বন্ড, তারই দাম দিতে হচ্ছে নিজের জীবন দিয়ে। কিন্তু একি!

আচম্বিতে উধাও হল কোল্টোর কালো নল। দেহের ওপর থেকে সরে গেল লোকটার গুরুভার বন্ধু। টলতে টলতে হাটুর ওপর উঠে বসল বন্ড। তারপর সিধে হয়ে দাঁড়াল। পায়ের কাছেই চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে পাতালপুরীর সেই লোকটা। পিঠের কাছে রক্ত গড়াচ্ছে।

আশেপাশে বন্ড তাকাল। এফ স্টেশনের চার জোয়ান দাঁড়িয়ে দল বেঁধে। স্ট্র্যাপ খুলে ক্র্যাশ হেলমেটটা হাতে নিল বন্ড। মাথার পাশে হাত বুলোত বুলোতে বলল, সাবাস! কাজটা কার?

কেউ জবাব দিল না। চারজনেই কেমন বিমূঢ়।

বন্ড নিজেও ঘাবড়ে গেল। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে শুধাল ব্যাপার কি?

হঠাৎ চোখে পড়ল দলবদ্ধ চার জোয়ানের পেছনে কি যেন একটা নড়ছে। দেখা গেল আর একটা বাড়তি পা। মেয়েরী পা!

অট্টহাস্য করে ওঠে বন্ড। কাষ্ঠহাসি হেসে চার জোয়ান তাকায় পেছনে। বাদামী শার্ট আর কালো জীন পরে ওদের পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এল মেরী অ্যান রাসেল–দু হাত শূন্যে ভোলা। এক হাতে .২২ টার্গেট পিস্তল।

হাত নামিয়ে পিস্তলটা কোমরে গুজতে গুজতে বন্ডের সামনে রাসেল এল। উদ্বিগ্ন স্বরে-দোষটা এদের নয়, আমার। আমি ওদের পেছন ছাড়িনি। এসেছিলাম বলেই এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। পাছে আপনার গায়ে গুলি লাগে, এই ভয়ে তো কেউ গুলিই করছিল না।

চোখে চোখ রেখে মৃদ্যু হাসল বন্ড, না এলে হয়ত আজ রাতের খানাটাই বরবাদ হয়ে যেত, তাই না?

বলেই চার জোয়ানের দিকে ফিরল। বলল কাটখোট্টা গলায়, অলরাইট। একজন মোটর সাইকেল নিয়ে চলে। যান। কর্নেল স্ক্রাইবারকে রিপোর্টটা দিয়ে আসুন। বলবেন, ওরা না আসা পর্যন্ত আমি মাটির নিচে নামতে পারছি না। জনা দুয়েক অ্যান্টি-স্যাবোটেজ এক্সপার্ট যেন আনেন। ফাঁদ পাতা থাকতে পারে দরজায় মুখেই। ঠিক আছে?

সুন্দরীকে কাছে টেনে নিল বন্ড। বলল, আর আপনি আসুন আমার সঙ্গে। একটি পাখির বাসার সন্ধান দেব।

 সেটাও কি আপনার হুকুম?

হ্যাঁ।

.

রিসিকো মানে ঝুঁকি

ইন দিজ পিজনিস ইজ মাচ রিসিকো।

পুরু, বাদামী গোঁফের তলা দিয়ে বেরিয়ে এল শব্দগুলো। কথাটা ইংরেজি। কিন্তু বিকৃত উচ্চারণের দরুন অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। বক্তা বলতে চাইছে, ইন দিজ বিজনেস ইজ মাচ রিস্ক। অর্থাৎ এ কাজে ঝুঁকি অনেক। কিন্তু বিজনিসকে পিজনিস আর রিস্ককে রিসিকো বলায় খটকা লাগা স্বাভাবিক।

বক্তার কুচকুচে কালো শক্ত চোখজোড়া এবার নিবদ্ধ হল বন্ডের মুখে আর হাতের ওপর। বন্ড তখন অতি সন্তর্পণে একটা কাগজের দেশলাই ছিঁড়ছে। দেশলাইয়ের ওপরে ছাপা অ্যালবর্গো কলম্বা ডি ওরো।

কুচকুচে কালো চোখ দুটো যে বন্ডের চামড়া ছিদ্র করে মন পর্যন্ত দেখছে, বন্ড তা টের পেল। ঘণ্টা দুয়েক ধরেই চলছে এই নিরীক্ষণ পর্ব। এক্সেলসিওর পানাগারে আসার পর থেকেই। এসেছে ঐ শুফো মন্তানের সঙ্গেই আলাপ জমাতে। সেই থেকে চুলচেরা দেখা শুরু হয়েছে।

বন্ড শুনে এসেছিল যে লোকটার সঙ্গে তার মোলাকাৎ ঘটবে। নাকের নিচে তার ইয়া মোটা গোঁফ আছে। এক গ্লাস আলেকজান্দ্রা সুরা নিয়ে বসে থাকবে গোটা একটা টেবিল জুড়ে। শুনে হাসি পেয়েছিল বন্ডের। লোম চেনবার গোপন সংকেত এমন মেয়েলীও হয়। আলেকজান্দ্রা মানেই ক্রিম মেশানো পানীয়। গতানুগতিক চিহ্নের চাইতে ভাল। ভাঁজ করা খবরের কাগজ পড়া, বোতামের ঘরে ফুল গুঁজে রাখা বা হলদে দস্তানা পরে থাকার রেওয়াজ গুপ্তচরদের মধ্যে চালু আছে। এসব সংকেত দেখলেই একজন স্পাই আরেকজন স্পাইকে চেনে। কিন্তু ক্রিস্ট্যাটোস বড় জবর চিহ্ন লাগিয়েছে। বারে ঢুকে বন্ড দেখেছিল জনাবিশেক লোককে। কিন্তু গোঁফ কারো নেই। এককোণে শুধু টেবিলে শোভা পাচ্ছে ক্রিম আর ভদ্কার তালট্যাঙা গ্লাস। আর কোনদিকে না তাকিয়ে বন্ড গিয়ে বসেছিল টেবিলের সামনে চেয়ারে।

ওয়েটার এল–গুড ইভনিং স্যার। সিনর ক্রিস্ট্যাটাস টেলিফোন করতে গেছেন।

গডন দিয়ে এক গ্লাস নিপ্রোনি আনো, বলেছিল বন্ড।

বলতে-বলতে দৈত্যাকার ক্রিস্ট্যাটোস এসে পৌঁছেছিল। খেলনা চেয়ারের মত ছোট্ট চেয়ারটাকে তুলেছিল লোমশ হাতের বিশাল থাবা দিয়ে। দুলিয়ে রেখেছিল গুরুভার ছাপার ঠিক নিচে। দুঃখিত, অ্যালফ্রেজের সঙ্গে কথা ছিল।

করমর্দনের ধার দিয়েও যায়নি ক্রিস্ট্যাটোস। যেন অনেক দিনের চেনাজানা। সম্ভবত একই কারবারের কারবারী। আমদানি রপ্তানি কারবারের মতই। আর কেউ কমবয়সী পুরুষটাকে দেখলে মনে করত বুঝি আমেরিকান। উঁহু। তা তো নয়। পোশাক তো ইংরেজদের মত।

ছোকরা আছে কি রকম? স্বাভাবিক গলা বন্ডের।

 ছোট হয়ে এসেছিল সিনর ক্রিস্ট্যাটাসের কুচকুচে চোখ।

কথাটা তাহলে মিথ্যে নয়। লোকটা পেশাদারই বটে। মুখে বলেছিল, একই রকম। আপনার কি মনে হয়?

পোলিও রোগটা খুব সাংঘাতিক তো!

নিগ্রোনি এসে গিয়েছিল। জমিয়ে বসেছিল দু জনে। দু জনেরই মনে পরস্পরের প্রতি সমীহ। কম যায় না কেউই।

এই গেল মোলকাতের প্রথম ধাক্কা। তারপরও গেছে দু-দুটো ঘণ্টা। বন্ডকে তখনো খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে যাচাই করে চলেছে ক্রিস্ট্যাটোস। কম মজা নয় তো, মনে মনে ভেবেছে বন্ড। বন্ডকে গোপন কথা বলা যায় কি না, বন্ডের ওপর ভরসা রাখা যায় কিনা, এই নিয়ে যেন পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্ত নেই ক্রিস্ট্যাটাসের কথাবার্তায়। লোকটার এই অতিরিক্ত হুঁশিয়ারি একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত করেছে বন্ডকে। M ঠিক লোকই চিনেছেন। ক্রিস্ট্যাটোস অনেক খবর রাখে। নইলে বলত না ইন দি পিজনিস ইজ মাচ রিসিকো।

ছেঁড়া দেশলাইয়ের শেষ ফালিটা ছাইদানিতে ফেলে বলল বন্ড, যে ব্যবসার লাভ শতকরা দশ টাকার বেশি আর যে কাজ রাত নটার আগে সারা যায় না, শুনেছি তা নাকি সাংঘাতিক বিপজ্জনক ব্যাপার। যে কাজের কথা বলতে বসেছি, তাতে টাকা পাবেন শতকরা হাজার। গভীর রাত ছাড়া এ কাজ শেষ করার কথা ভাবাও যায় না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, দু দিক দিয়েই ঝুঁকি প্রচুর এ কাজে। বলেই গলা খাটো করল– টাকার অভাব নেই। এ বিজনেসে। ডলার, সুইস ফ্রাঁ, ভেনিজুয়েলান বলিভার–যা চাইবেন তাই পাবেন।

বাচলাম। আমার আবার ইটালিয়ান লীরা বড় বেশি জমে গেছে কিনা, মেনু তুলে নিয়ে বলল ক্রিস্ট্যাটাস। এবার কিছু খাওয়া যাক। খালি পেটে ইমপরট্যান্ট পিজনিস নিয়ে কথা বলা যায় না।

এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ আগে বন্ডকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন M। বন্ড গিয়ে দেখল ভদ্রলোকের মেজাজ সপ্তমে চড়ে রয়েছে। খেঁকিয়ে উঠে শুধিয়েছিলেন জিরো জিরো সেভেন, হাতে কাজের চাপ আছে?

কাগুজে কাজ কিছু আছে।

ধাঁ করে পাইপ নামিয়ে M বললেন, কাগুঁজে কাজ মানে? ও কাজ নেই কারো?

মানে তেমন গতর খাটানো কাজ নেই।

তাই বললেই তো হয়, লাল ফিতে বাঁধা একগাদা ফাইল নিয়ে এমন জোরে M টেবিলে ছুঁড়লেন যে বন্ডকে লুফে নিতে হল।

নাও, কাগুজে কাজ আরো কিছু করো। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ব্যাপার–আফিংয়ের চোরাই কারবার। হোম অফিস আর মিনিস্ট্রি অফ হেলথ-এর কাগজপত্র জেনেভার আন্তর্জাতিক আফিং কনট্রোল-এর ইয়া মোটা রিপোর্ট নিয়ে গিয়ে পড়। সারাদিন রাত ধরে পড়। কাল রোম যাবে। পালের গোদাদের পেছন নেবে। পরিষ্কার?

সায় দিল বন্ড। M-এর তিরিক্ষে মেজাজের কারণটা এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে। আসল কাজ থেকে অন্য কাজে অধস্তন অফিসারদের টানলেই সাংঘাতিক মেজাজ খিঁচড়ে যায় ওর। আসল কাজ হল গুপ্তচরবৃত্তি, দরকার মত তছনছ করা, ধ্বংস করা, আগুন বোমা ইত্যাদি দিয়ে শক্ত ঘাঁটি লণ্ড ভণ্ড করা। এ ছাড়া কিছু করা মানেই সিক্রেট সার্ভিসের নামমাত্র তহবিলের অপচয়।

জিজ্ঞাস্য কিছু আছে জাহাজের গলুইয়ের মত ঠেলে বেরিয়ে এল M-এর চোয়াল। যার মানে অতি পরিষ্কার। বন্ড যেন এখুনি ফাইল বগলে নিয়ে কেটে পড়ে। M-এর, এর চাইতেও অনেক দরকারী কাজ আছে।

বন্ড হাড়ে হাড়ে জানতে পেরেছে M-এর অভিনয়। M-এর মাথায় বেশ কয়েকটা পোকা আছে। মাঝে মাঝে নড়ে ওটে পোকাগুলো৷ সিক্রেট সার্ভিসে নামজাদা হয়ে গেছে প্রতিটি পোকা। M-এর তাতে জ্বক্ষেপ নেই। পোকাগুলো স্রেফ খোশমেজাজি খেয়াল যেমন, দাড়িওলা কাউকে চাকরি দেওয়া হবে না। পুরোপুরি দোভাষীদেরও স্থান নেই সার্ভিসে, ক্যাবিনেট মিনিস্টারদের সুপারিশ নিয়ে এলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া, ফতোবাবুর মত জামাকাপড় পরা। পুরুষ বা নারীদের দু চক্ষে দেখতে না পারা, ডিউটির সময় বাদে অন্য সময় স্যার বললেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা এবং স্কচ সাহেবদের মাথায় নিয়ে নাচা। চার্চিল বা মন্টগোমারির মত নিজের খোস মেজাজ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন M। ওয়াকিবহাল থেকেও পাখি পড়ান না পড়িয়ে বন্ডকে কোন কাজে পাঠানো মোটেই পছন্দ করতেন না।

সবই জানত বন্ড। দুটো জিজ্ঞাস্য আছে, স্যার। এ কারবারে কেন নাক গলাচ্ছি চোরা কারবারীদের খবরাখবর কি স্টেশন ওয়ানের কাছে পাওয়া যাবে।

তেতো চোখ কটমট করে তাকালেন। তারপর চেয়ার ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে মেঘ দেখতে দেখতে জম্পেশ টান দিলেন পাইপে। দেখ জিরো জিরো সেভেন, মাদক জিনিসের কারবারে সার্ভিস নাক গলায়, এ আমি চাই না। বছরের প্রথম দিকে তোমার মেক্সিকো পাঠিয়েছিলাম আফিং চাষীদের তাড়া দিতে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলে সেবার। সেবার পাঠিয়েছিলাম স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের মুখ রাখতে। এবার ফের সেই অনুবোধ এসেছিল ইটালিয়ান গ্যাংটাকে শায়েস্তা করার জন্য। সরাসরি না বলে দিয়েছিলাম। তখন রোনি ভ্যালান্স আমাকে টপকে ধরাধরি শুরু করে হোম অফিস আর মিনিস্ট্রি অফ হেলথ এর দফতরে। চাপ এলে মিনিস্টারদের কাছ থেকে। বলে পাঠালাম, তোমাকে এখন ছাড়া যাবে না। কারণ এখানকার কাজ তোমার বদলে অন্য কাউকে দেওয়া যাবে না। তখন প্রাইম মিনিস্টারের কাছে ধরনা দিল দু জন মিনিস্টার। একটু থেমে আবার বললেন M প্রাইম মিনিস্টার ছিনে জোকের মত বোঝালেন, ব্যাপারটা নাকি সোজা নয়। আফিং আর মরফিন থেকে তৈরি পাহাড় প্রমাণ হিরোইন পাচার হচ্ছে দেশের মধ্যে। উদ্দেশ্য, সমাজের মনোজগতে বিপর্যয় আনা। এও একধরনের যুদ্ধ। মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেওয়া। স্রেফ টাকা পেটা নাকি উদ্দেশ্য নয়। ইটালিয়ান গ্যাংয়ের পেছনে আরো কুচক্রী আছে।

তেতো হাসি হাসলেন M যুক্তিটা খুব সম্ভব রোনি ভ্যালান্স এর আবিষ্কার। আমেরিকার মত ইটালীতেও আফিং এর চোরাই চালান তরুণ সমাজকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে সরকার হিমসিম খাচ্ছে। কিছুই করতে পারছে না। ভ্যালান্সের প্রেত ফৌজ অবশ্য মাঝের লোকেদের দু একজনকে বার করেছে। মাল আসছে ইটালী থেকেই–টুরিস্টদের গাড়ি বোঝাই হয়ে। ইটালিয়ান পুলিশ আর আন্তজার্তিক পুলিশকে নিয়ে সাধ্যমত করেছে ভ্যালান্স। দু চারটে ধরপাকড় হয়েছে। কিন্তু জালের মাঝখানে পৌঁছতে পারেনি।

বাধা দিল বন্ড, নিশ্চয় কেউ বুক দিয়ে আগলাচ্ছে।

 হতে পারে। প্রাইম মিনিস্টারের অর্ডার পাবার পর ওয়াশিংটনের কথা বলেছিলাম। সি.আই.এ. অনেক কিছু জানে। আফিং দফতরের একটা ঘাটি ইটালীতেও মোতায়েত আছে যুদ্ধের পর থেকেই। সি.আই.এ.-র সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। আমেরিকান ট্রেজারী ডিপার্টমেন্টের একটা শাখা আফিং মরফিনের চোরাই চালান বন্ধ করার জন্য সিক্রেট সার্ভিস গাছের কিছু লোক পোষে। অদ্ভুত ব্যবস্থা। এফ.বি.আই. কেন যে মুখ বুজে সয়ে যায় বুঝি না। বলে, ফেলে চেয়ার ঘুরালেন M–সি.আই.এ.-র চাই অ্যালান জালেস একজনের নাম আমাকে দিয়েছে। লোকটার নাম ক্রিস্ট্যাটোস। দু মুখো সাপ। আসলে স্পাই। আফিং কারবারীদের খবরাখবর নিতে হলে আফিং চালানের ভান করতে হয়। তাই একটু আধটু সে কাজও করে। ডালেস খবর পাঠিয়েছে ক্রিস্ট্যাটোসকে। পরশুদিন তোমার সঙ্গে দেখা করবে রোমে। ডালেসের কাছে ও শুনেছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে আমাদের এক মহা চৌকস লোক যাচ্ছে কথা বলতে। বাকিটুকু এ ফাইল পড়লেই পাবে।

ঘর নিস্তব্ধ। বন্ড ভাবছিল, গোটা ব্যাপারটা যেন কেমন রহস্যজনক। বিপজ্জনক তো বটেই। সেই সাথে যাচ্ছেতাই রকমের নোংরা।

ফাইল বগলে বন্ড উঠে টাকার খেলায় নামতে হবে মনে হচ্ছে। চালান বন্ধ করতে কত খরচ করবেন?

রুক্ষ গলায় M বললেন, এক লাখ পাউন্ড। যে কোন দেশের টাকা ভাঙিয়ে দেব। প্রাইম মিনিস্টারের হিসেবে লাখ পাউন্ড। আমার হিসেবে দরকার পড়লে আরও লাভ পাউন্ড। কার্পণ্য করতে যেও না। মাদক কারবারে ঝুঁকি অনেক। অপরাধ মহলে এর চাইতে বিপজ্জনক আর জটিল চক্রান্ত জাল আর নেই।

মেনু তুলে নিয়ে বলল ক্রিস্ট্যাটোসমিস্টার বন্ড, ফাঁকা কথায় আমার রুচি নেই, ছাড়বেন কত?

পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। গ্যাংটার চিহ্ন যেন কোথাও না থাকে।

উদাস কণ্ঠ ক্রিস্ট্যাটোসের তা তো বটেই। টাকা তো খোলাম কুচি নয়। ফুটি, শুয়োরের মাংস আর চকলেট আইসক্রিম আনাই। রাতে আমার কম খাওয়া অভ্যাস। কিয়ান্তিতেও অরুচি নেই।

ওয়েটারকে বিদেয় করে খড়কে কাঠি চুষতে লাগল ক্রিস্ট্যাটাস। দেখতে দেখতে মুখ হল তোল হাঁড়ির মত। যেমন গম্ভীর, তেমনি, নূর। চোখ ঘুরতে লাগল ঘরময়। চঞ্চল, অশান্ত চাহনি ঝলসে উঠতে লাগল থেকে-থেকে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে যেন মনস্থির করে ফেলল ক্রিস্ট্যাটোস। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাথরুমে যাচ্ছি, বলে উধাও হল রেস্তোরাঁর পেছনে।

হঠাৎ বেজায় খিদে পেয়ে গেল বন্ডের। সেইসঙ্গে গলা কাঠ হয়ে এল পিপাসায়। কিয়ান্তি ঢেলে ভরল পেল্লায় গ্লাস। আধ গ্লাস খেয়ে রুটিতে হলদে মাখন মাখিয়ে ঠাসতে লাগল মুখে। ক্রিস্ট্যাটোসকে নিয়ে আর ভাবনা নেই। কাজের লোক। আমেরিকানরা অত ভরসা রাখে? নিশ্চয় ফোন করছে কাউকে। ফিরবে এখুনি। আচ্ছা, ফ্রান্স আর ইটালী ছাড়া পাকানো রুটি আর মাখন আর কোথাও এমন সুস্বাদু হয় না কেন?

চৌকোনা ঘরের অপর কোণে বসে ফুরফুর চুলওলা চনমনে মেয়েটা বলল সঙ্গের হাসিখুশি ভদ্রলোককে হাসিটা নিষ্ঠুর হলে কি হবে, চেহারায় তো ময়ুর ছাড়া কার্তিক। গুপ্তচররা তো এত সুন্দর হয় না। আপনার ভুল হয়নি তো?

সুপুরুষ সঙ্গী তখন স্প্যাগেটি খেতে ব্যস্ত। মুখ থেকে প্লেট পর্যন্ত ঝুলছিল সেঁউইয়ের লম্বা সূতা। সঙ্গিনীর কথায় এক কামড়ে সূতা কেটে টম্যাটো সস-মাখন-ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঢেকুর তুলল সশব্দে। বলল, এসব ব্যাপারে স্যানটোসে বাজে খবর দেয় না। স্পাই দেখলেই ঠিক চেনে। এই গুণের জন্যই তো ওকে বারোমাস বাস্টার্ড ক্রিস্ট্যাটোসের পেছনে লাগিয়ে রেখেছি। স্পাই ছাড়া শুয়োরটার সঙ্গে সন্ধ্যে কাটাতে কেউ চায়? তবুও সন্দেহের শেষ রাখব না। বলে পকেট থেকে টিনের যন্ত্র বার করে কটকট শব্দ করল। ঘরের অপর কোণ থেকে কাজ ফেলে রেখে দৌড়ে এল হোটেল ম্যানেজার।

ইয়েন্স, স্যার।

খাইয়ে লোকটা কেবল ঘাড় কাৎ করল। ইশারা বুঝল হোটেলে ম্যানেজার। হেঁট হতেই কানে কানে হুকুম দিল উদর প্রেমিক। সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরের কাছে অফিসিও লেখা দরজার সামনে গিয়ে ভেতরে উধাও হল।

এরপর যে দাবাবোড়ের খুঁটি চালা শুরু হল। দাবার ছকের ওপর দিয়ে দানের খুঁটি যেমন ধাপে ধাপে নড়ে চড়ে এগোয় কিস্তিমাৎ ঘরের দিকে, ঠিক সেইভাবেই অনুষ্ঠিত হল একটা দৃশ্য। স্পাগটি চিবুতে চিবুতে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সব দেখল পেটুক লোকটা।

অফিসিও লেখা দরজা দিয়ে ফের বেরিয়ে এল হোটেল ম্যানেজার। কড়া গলায় হুকুম দিল দু-নম্বরকে, চারজনের বাড়তি টেবিল।

তাড়াতাড়ি চোখে চোখে চাইল দু নম্বর। সায় দিল ঘাড় হেলিয়ে। ম্যানেজারের পেছন পেছন এসে দাঁড়াল বন্ডের টেবিলের পাশে। তুড়ি মারতেই কয়েকজন এসে দাঁড়াল পাশে। এদিক-ওদিকে রাখা দুটো টেবিলের পাশে এল দুটো বাড়তি চেয়ার, তৃতীয় বাড়তি চেয়ারটা এল বন্ডের টেবিলের পাশ থেকে। চতুর্থ চেয়ারটা এল অফিসিও লেখা দরজার দিক থেকে–বয়ে নিয়ে এল হোটেল ম্যানেজার নিজেই। বাকি তিনটে চেয়ারের সঙ্গে চতুর্থ চেয়ারটি সাজিয়ে রাখবার পর মাঝখানে বসানো হল একটা টেবিল। কাঁচের টুকিটাকি বাসনপত্র সাজানো হল টেবিলে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল হোটেল ম্যানেজার। বলল, সে কি! বললাম তিনজনের টেবিল পাততে, অথচ, চেয়ার দিয়েছ চারটে। কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজেই নিজের চেয়ারটা সরিয়ে রাখল বন্ডের টেবিলের পাশে। হাত নাড়তেই টেবিল চেয়ার সাজাতে যারা ছুটে এসেছিল, তারা ছিটকে গেল যে-যার কাজে।

সব মিলিয়ে এক মিনিটও লাগল না। খুবই নিরীহ ব্যাপার। গোবেচারা তিনজন ইটালিয়ান ঢুকল রেস্তোরাঁয়। ত্রিমূর্তিকে খাতির করে এনে নতুন পাতা টেবিলে বসিয়ে দিল হোটেল ম্যানেজার।

বন্ড দেখেও কিছু দেখল না। ক্রিস্ট্যাটোস কাজ গুছিয়ে ফিরে আসতেই খাবার এসে গেল।

খেতে খেতে বাজে কথার ঝুড়ি উপুড় করল দুই মূর্তি। ইলেকশন, আধুনিকতম আলফা রোমিও, ইটালিয়ান ও ইংলিশ জুতার তুলনা-সব নিয়েই কথার ফোয়ারা ছোটানো। ক্রিস্ট্যাটোস নিজেই একটা কথার জাহাজ। কথা বলার কায়দায় ওস্তাদ। সব ব্যাপারের ভেতরে শাসটুকু জানে। খবর পরিবেশন করে কথার ফাঁকে ফাঁকে_ধাপ্পা বলে মনে হয় না। আমেরিকানরা লোকটাকে নিয়ে কেন মেতেছে, বন্ড তা উপলব্ধি করল। ক্রিস্ট্যাটোস কথার ধোকড় হলেও কাজের লোক।

কফি এল। কালচে রঙের সরু চুরুট ধরিয়ে কথার তুবড়ি অব্যাহত রাখল ক্রিস্ট্যাটোস। দাঁতের ফাঁকে নেচে নেচে উঠতে লাগল কালচে চুরুট। দু হাত টেবিলের ওপর রেখে টেবিলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খাটো গলায় বলল, এবার পিজনিস। আমি হাত মেলালাম। অ্যাদ্দিন আমেরিকানদের অনেক খবর দিয়েছি। যা কাউকে বলিনি, তা আপনাকে বলব। এরা আমেরিকায় কারবার করে না। যা কিছু কারবার ইংল্যান্ডে–আর কোথাও নয়। ইয়েস?

বুঝলাম। সব কারবারেই একটা এখতিয়ার থাকে।

ঠিক। খবর দেবার আগে শর্তটা জানানো দরকার। ইয়েস?

তা তো বটেই।

টেবিল ক্লথ নিরীক্ষণ যেন আরো বাড়ল। সিনর ক্রিস্ট্যাটোস বলল, আমেরিকান ডলারে চাই দশ হাজার ডলার। কাল লাঞ্চ খাবার আগেই ছোট নোটে পুরো টাকা আনবেন। গ্যাংটাকে ধ্বংস করবেন আপনি। কাম ফতে হলে দেবেন আরো বিশ হাজার। বন্ডের মুখের ওপর দিয়ে পিছলে গেল ক্রিস্ট্যাটোসের চাহনি, আমার লোভ নেই। যা দিয়েছিলেন, তার সবটা কিন্তু নিলাম না।

দাম তো ভালই।

 দোসরা শর্ত। যদি মরেও যান, কোত্থেকে এত কথা জানালেন বলতে পারবেন না।

 বেশ।

তেসরা শর্ত। গ্যাংয়ের চাই লোকটা অতি জঘন্য বলেই ফের চোখ তুলল ক্রিস্ট্যাটোস। কালো চোখে দেখা গেল লাল ঝিলিক। শুকনো শক্ত ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে চুরুটের অংশের ফাঁকে, তাকে শেষ করতে হবে–খুন।

সিধে হয়ে বসল বন্ড। অদ্ভুত চোখে তাকাল ক্রিস্ট্যাটাসের পানে। এ যে জালের মধ্যে জাল। চক্রান্তের ফাঁকে চক্রান্ত। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নেওয়ার তোড়জোড়। ক্রিস্টাটোসের দরকার একজন বন্দুকবাজকে। মজা হচ্ছে এই যে ক্রিস্ট্যাটোস ভাড়া করছে না বন্দুকবাজকে, বন্দুকবাজই ভাড়া গুণছে ক্রিস্ট্যাটোসকে তার পুরোনো শত্রুকে নিপাত করার জন্য। মজা মন্দ নয়ত। সিক্রেট সার্ভিসের টাকায় ক্রিস্ট্যাটোসের শত্রু নিধন।

কিন্তু কেন? বড় বলল।

প্রশ্ন করবেন না। মিথ্যে বলতে চাই না।

কফিতে শেষ চুমুক দিল বন্ড। দলগত অপরাধের পুরোনো কেচ্ছা নিশ্চয়। হিমবাহের মত। কিন্তু তা নিয়ে দরকার কি বন্ডের? ওর কাজ বিশেষ ধরনের। সে কাজ সারতে গিয়ে কারো উপকার হয়ত হোক, ক্ষতি কি? M মোটেই ব্যাজার হবেন না এতে। বন্ডের ওপর হুকুম আছে আফিং চালানোর গোটা গ্যাংটাকে ধ্বংস করার। নামহীন এই লোকটাই যদি গ্যাং-লীডার হয়, তাকে ধ্বংস করতেই হবে। হুকুম তাই। মুখে বলল, কথা দিতে পারছি না। সে ভাবনা আপনার। কেউ যদি আমাকে মারতে আসে, আমি তাকে মারব। প্রাণে মারব। নইলে নয়।

একটা টুথপিক টেনে নিয়ে আঙুলের নখ সাফ করতে লাগল ক্রিস্ট্যাটোস। এক হাতের পাঁচটা আঙ্গুল পরিষ্কার হবার পর চোখ তুলে–কথা না পেলে আমি কাজ করি না। তবে এক্ষেত্রে করব। কারণ, টাকা ঢালছেন আপনি–আমি নয়। আপনি দিচ্ছেন, আমি নিচ্ছি। বেশ, তাহলে খবর শুনুন। শোনবার পর আপনি কিন্তু একা হয়ে যাবেন। আমি আর নেই। কালই আমি করাচি যাচ্ছি। ইমপরট্যান্ট পিজনিস। খবর দিয়েই আমি খালাস। কাজ সারবেন একা।

রাজি।

চেয়ারটাকে বন্ডের চেয়ারের কাছে সরিয়ে আসল সিনর ক্রিস্ট্যাটাস। মিহি গলায় তুরন্ত গতিতে শুরু হল খবর দেওয়া। খবরটা যে হুঁকা, তার প্রমাণস্বরূপ তারিখ, নাম বলতে দ্বিধা করল না। বাজে বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে খেদিয়ে দেওয়া দু হাজার বদমাস লুঠেরা ডেরা নিয়েছে এ দেশে। পুলিশের মার্কামারা দাগাবাজ লিস্টে নাম উঠেছে প্রত্যেকের। কুকীর্তি এদের এত জঘন্য যে ওদের মধ্যে চাই বলতে একশ জন। সাংঘাতিক র্দুদে এই একশ জন টাকা জোগাড় করে সটকেছে বেরুট, ইস্তামবুল ট্যানজিয়ার আর ম্যাকাওতে। চারটে জায়গাই বিশ্বের বৃহত্তম স্মাগলিং কেন্দ্র। দাগাবাজদের আর একটা বড় দল মাল লেনদেন নিয়ে ব্যস্ত। এদের মধ্যে যারা মহাপ্রভু, তারা বেনামীতে মিলানে ওষুধের কারখানার মালিক হয়েছে। এটা হল একটা ঘাটি। বাইরের দল আফিং, মরফিন, হিরোইনের চোরাই চালান দিচ্ছে এই কারখানায়। ঘোট ঘোট জাহাজে ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে, একদল স্টুয়ার্ডের যোগসাজসে ইটালিয়ান উড়োজাহাজে। সপ্তাহ সপ্তাহ ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস রেলপথে আসছে চোরাই চালান। ইস্তামবুলের ট্রেন ক্লিনারদের টাকা খাইয়ে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাবতীয় চামড়ার গদির নিচে লুকানো হয় আফিং। মিলানের ওষুধ কোম্পানির নাম ফার্মোসিয়া কলম্বা এস এ। এই কারখানার মূল কাজ হল মাল পাচার করা আর কাঁচা আফিং থেকে হিরোইন বানানো। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি হরেক রকম নিরীহ দর্শন মোটরগাড়িতে এই মাল ডেলিভারি হচ্ছে ইংল্যান্ডের দালালদের কাছে।

এই পর্যন্ত শুনে বন্ড বলল, আমাদের কাস্টমস কিন্তু ঘুমোয় না। এ ধরনের চোরাই চালান ধরা ওদের কাছে। ছেলেখেলা। মোটরে লুকানোর জায়গাও তেমন নেই। মালটা থাকে কোথায়?

বাড়তি চাকার মধ্যে। এক একটা বাড়তি চাকার মধ্যে বিশ হাজার পাউন্ড দামের হিরোইন বওয়া যায়।

ধরা পড়ে না? মিলানের ভেতরে আনার সময়ে, ভেতর থেকে বাইরে নেওয়ার সময়ে কেউ দেখে না?

দেখে তো বটেই। ধরাও পড়ে। কিন্তু পোড় খাওয়া লোক তো। থানা পুলিশের হ্যাপা পোহাতে অভ্যস্ত। ধরা পড়লেও মুখ খোলে না। জেল হলে প্রতিবছর জেলে থাকার দরুন পায় বছর পিছু দশ হাজার ডলার। বউ বাচ্চা থাকলে তাদের ভার পালের গোদার। এ ছাড়াও কাম ফতে হলে মোটা টাকা প্রাপ্তি তো আছেই। কো-অপারেটিভ ব্যবস্থা। লাভের ভাগ সকলেই পাবে। পালের গোদা পাবে সিংহের বখরা।

বেশ! পাশের গোদাটি কে?

সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে তার নাম দি ডাভ। আসল নাম, এনরিকো কলম্বো। এই রেস্তোরাঁর মালিক। এখানে আপনাকে এনেছি সেই কারণেই চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। কোণের টেবিলটা দেখুন। ফুরফুরে চুলওলা মেয়েটার পাশে মোটা লোকটার নাম এনরিকো কলম্বো। মেয়েটা অবশ্য ভিয়েনার এক শয্যা বিলাসিনী। নাম, লিলবম।

বটে! বটে! বন্ড কিন্তু তাকাল না। টেবিলে বসবার আগেই তাকানো হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁর কারোরই বাকি নেই তাকানোর। মেয়েটার চোখে খুশি ওপচাননা নিউঁকি চাহনি। তনুশ্রী ঘিরে এমন একটা সজীবতা, প্রাণোচ্ছলতা, মিষ্টতা, যে ঘরের কোণ যেন আলো করেছে তার একার রূপে। যেমন চুল তেমনি চোখ। হাসি হাসি মুখ। কণ্ঠ ঘিরে কালো ফিতে। জেমস বন্ড টেবিলে বসার পর থেকেই আড়চোখে দেখেছে, বারংবার তার দিকে তাকাচ্ছে সুন্দরী। সঙ্গী ভদ্রলোকের কাপ্তেন-চেহারা। মেয়েরা বর্তে যায় এমনি কাপ্তেন পাকড়ালে। খুশি উজ্জ্বল, পকেট ভারি। দিন কয়েক দিব্বি ফুর্তি লোটা যায়। নাঃ, লিলবমের রুচি আছে।

চকিতে দেখে নিল বন্ড। কি নিয়ে খুব হাসাহাসি চলছে দু জনের মধ্যে। রূপসীর গালে টোকা মারল টাকাওয়ালা কাপ্তেন সঙ্গী। উঠে দাঁড়াল, হন হন করে গিয়ে অফিসিও লেখা দরজা ঠেলে উধাও হল ভেতরে।

বটে! এই লোকটিই তাহলে আফিং চোরাই চালানের কর্ণধার। এরই মাথার জন্য লাখ পাউন্ড দর হেঁকেছেন M। একেই সংহার করতে চাইছে ক্রিস্ট্যাটোস বন্ডকে রি।

খামোকা দেরি করে লাভ কি? নামা যাক কাজে। রূঢ়ভাবে মেয়েটির দিকে তাকাল বন্ড। মেয়েটিও তাকাল। বন্ড হাসল। মেয়েটি যেন দেখেও দেখল না। শুধু মিষ্টি হাসল। তারপর সিগারেট টেনে নিয়ে ঠোঁটে বুলিয়ে ধোয়া ছাড়ল কড়িকাঠের দিকে। গলা আর সারা মুখ এগিয়ে ধরল সামনে, যেন কারও প্রত্যাশায়। এ ইশারার মানে জানে বন্ড। মেয়েটি অফার করছে।

সিনেমা ভাঙার সময় হয়েছে। এখুনি ভিড় বাড়বে রেস্তোরাঁয়। খালি টেবিল সাফ করা আর নতুন টেবিল পাতা শুরু হয়েছে। তদারক করছে হোটেল ম্যানেজার। ছুরি-কাটার ঝনঝন শব্দের সঙ্গে মিশেছে গ্লাসের টুংটাং আওয়াজ আর ন্যাপকিনের খসখসানি। বন্ডের আনমনা চোখের ওপর দিয়েই পাশের বাড়তি চেয়ারটা সরে গেল পাশের টেবিলে। ছ জনের জায়গা হবে সেখানে।

এনরিকো কলম্বোর রোজকার অভ্যেস নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল বন্ড। কোথায় থাকে? মিলানের ওষুধ কারখানার ঠিকানা কি? আরও ব্যবসা আছে নাকি? কথায় কথায় খেয়ালই রইল না। বাড়তি চেয়ারটা এ টেবিল সে টেবিল ঘুরতে ঘুরতে উধাও হল অফিসিও লেখা দরজার ভেতরে।

চেয়ার এসে পৌঁছাল অফিসের মধ্যে। হোটেল ম্যানেজারকে বিদেয় করে ভেতর থেকে দরজায় চাবি দিল এনরিকো কলম্বো। এল চেয়ারের সামনে। বেজায় পুরু গদীটা তুলে রাখল টেবিলে। গদীর পেছনে জিপ চেন ধরে টান দিতেই পেট ফাঁক হয়ে গেল কুশানের। টান দিতেই বেরিয়ে এল একটা গ্রুন ডিগ টেপরেকর্ডার। মেশিন তখনও চলেছে। সুইচ বন্ধ করে টেপ চালাল পেছন দিকে। রেকর্ডার থেকে টেপ খুলল। বসাল প্লেব্যাকের ওপর। স্পীড আর ভলম ঠিকঠাক করে এসে বসল চেয়ারে। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কান পেতে শুনতে লাগল কথোপকথন। মাঝে এটা ওটা টিপে পেছন ঘুরিয়ে কয়েকটি কথা বার বার শুনল। সবশেষে শোনা গেল বন্ডের চি চি কণ্ঠ-বটে! বটে!

তারপর আর শব্দ নেই। নীরবতা অনেকক্ষণ। কেবল রেস্তোরাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ-লহরী। আর কোন কথা নেই। সুইচ বন্ধ করল এনরিকো কলম্বো মূক মেশিনটার দিকে চেয়ে রইল পুরো এক মিনিট। নিবিড় তন্ময়তা ছাড়া চোখে মুখে আর কোন ভাবনার মেঘ নেই। ধীরে ধীরে মেশিনের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরল অন্যদিকে শূন্য চাহনি। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বলল আপন মনে–স্বৈরিণীর বাচ্চা! উঠে দাঁড়াল আরো ধীরে। দরজার কাছে গিয়ে খুলল তালা। ফের তাকাল নডিপ মেশিনের দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল আর একবার–স্বৈরিণীর বাচ্চা! বলে, দরজা খুলে গেল বাইরে। বসল কোণের সেই টেবিলে।

দ্রুত, চাপা, জরুরী কণ্ঠে মেয়েটিকে কি যেন বলল এনরিকো কলম্বো। ঘাড় নেড়ে সায় দিল রূপসী, তাকাল ঘরের অপর প্রান্তে বন্ডের পানে। বন্ড আর ক্রিস্ট্যাটোস তখন টেবিলে ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

যেন অকস্মাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ভিয়েনা সুন্দরী। রুষ্ট-রুক্ষ গলায় বললে কলম্বোকে জঘন্য লোক বটে আপনি। আপনার অনেক কুকীর্তি আমি শুনেছি। কাছে আসতেও বারণ করেছে কতজন। হাড়ে হাড়ে এখন বুঝছি ঠিক কথাই বলেছে সবাই। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। থার্ডক্লাস রেস্তোরাঁয় ভারি তো ডিনার খাইয়েছেন, মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? মুখে যা আসে তাই বলছেন। যা নয় তাই চাইছেন।

ধাপে ধাপে উচ্চগ্রামে উঠল রূপসীর কণ্ঠ। বলতে বলতে টান মেরে হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে ছিটকে গেল চেয়ার ছেড়ে। যে পথ দিয়ে বন্ড বাইরে যাবে। ঠিক তার পাশের একটা টেবিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে লাগল বন বেড়ালির মত।

রাগে কালচে হয়ে গিয়েছিল এনরিকো কলম্বোর মুখ। ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে ফেটে পড়ল অ্যাটম বোমার মত তবে রে অস্ট্রিয়ান স্বৈরিণী

খবরদার ইটালিয়ান ব্যাঙ, দেশ তুলে কথা বলবেন না। বলেই অর্ধেক ভর্তি মদের গ্লাস তুলে এমন তাগ করে ঝাঁকুনি মারল যে গ্লাস রইল হাতে, কিন্তু গ্লাসের সব মদটা গিয়ে পড়ল এনরিকোর মুখে। তেড়ে এক কলম্বো। মেয়েটা টুক করে কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়াল বন্ডের পথ জুড়ে। ক্রিস্ট্যাটোসকে নিয়ে বন্ড এসেছিল বেরোনোর পথে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়াল বিনীতভাবে।

ন্যাপকিন দিয়ে মখের মদ মুছতে মুছতে রাগে ফুলতে লাগল কলম্বো। গর্জে উঠল ভয়ানক কণ্ঠে বেরোও বেরোও! আর যেন কোনদিন তোমার মুখ না দেখি। বলেই থু থু করে মেয়েটির সামনের মেঝেতে থুতু ফেলে হন হন করে উধাও হল অফিসিও লেখা কামরার ভেতরে।

হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এল হোটেল ম্যানেজার। সবারই খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে চেঁচামেচিতে। বন্ড অতি সহজ ভঙ্গিমায় মেয়েটির কনুই ধরে বলল, আসুন, ট্যাক্সি ডেকে দেব?

এক ঝটকায় কনুই ছাড়িয়ে নিল রূপসী। খেঁকিয়ে উঠল রাগত গলায়, শুওর! শুওর! সব পুরুষই শুওর! বলেই বুঝল অসভ্যতা হয়ে যাচ্ছে। বলল আড়ষ্ট ভঙ্গিমায়। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। বলতে বলতেই এগোল বাইরের দরজার দিকে।

গুঞ্জনধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে ছুরি-কাঁটার ঠনঠনাঠন শব্দ আবার শুরু হল রেস্তোরাঁয়। কৌতুকের হাসি সবার চোখেই। তাই মুখরোচক আলোচনা টেবিল টেবিলে। হোটেল ম্যানেজার বিনয়াবনত ভঙ্গিমায় খুলে ধরল দরজা। বন্ডকে বলল, মঁসিয়ে, মাপ চেয়ে রাখছি। আপনি থাকায় জিনিসটা মিটে গেল সহজেই। ট্যাক্সি ব্রেক কষল সামনে। দরজা খুলে ধরতেই মেয়েটি আগে উঠল। পেছনে বন্ড।

জানালা দিয়ে ক্রিস্ট্যাটোসকে বন্ড বলল, কাল সকালে ফোন করব। বলেই রূপসীর দিকে ফিরে– হোটেল অ্যাম্বাসাডার।

চলল ট্যাক্সি। কিছুক্ষণ কারো মুখে কথা নেই। বন্ড বলল, কোথাও গিয়ে একটু ড্রিঙ্ক করলে হত না?

নো, থ্যাংস্। আজ আর শরীর মন বইছে না।

 অন্য কোন রাতে?

 কিন্তু কালকেই যে ভেনিস যাচ্ছি।

আমিও তো যাচ্ছি। কাল রাতে একসঙ্গে গেলে হয় না?

হেসে ফেলল মেয়েটি–ইংলিশ ম্যানরা তো জানতাম লজ্জায় নেটিপেটি হয়! আপনিও তো ইংলিশ তাই না? নাম কি? কি করেন?

ইংলিশ তো বটেই। নাম বন্ড-জেমস বন্ড। বই লিখি–অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। এখন লিখছি মাদক জিনিসের চোরাই চালান নিয়ে। কাহিনীর অকুস্থল হল রোম আর ভেনিস। কিন্তু মহামুশকিলে পড়েছি। আফিং চোরাই চালানের বিন্দু বিসর্গ জানি না আমি। তাই এখানে ওখানে ঘুরে খবর জড়ো করছি। আপনি জানেন নাকি?

তাই বুঝি ক্রিস্ট্যাটোসের সঙ্গে ডিনার গিলছিলেন? হাড়ে হাড়ে চিনি ওকে। বজ্জাতের শিরোমণি। না, মশাই, না। গল্প টল্প আমি জানি না। সবাই যা জানে, আমিও তাই জানি।

বন্ডের গলায় যেন উৎসাহ উপচে পড়ল– আমিও তো তাই চাই। গল্প মানে তা গালগল্প নয়! বুজরুকি নয়। যা সত্যি, যা ঘটেছে। তা পেলেই বর্তে যাব। কানাঘুষো তো চলে। তারই দাম তো হীরের সমান–অন্তত আমার মত লেখকের কাছে।

হেসে ফেলল রূপসী-হীরের সমান?

বন্ড বলল, অত রোজগার না করলেও মন্দ রোজগার নয় আমার। ফিল্মে এ জাতীয় কাহিনী আমার অগ্রিম স্বরূপ কিছু টাকা পেয়েছি। এখন যদি গল্পটাকে খাঁটি রূপ দিতে পারি, তাহলেই মোটা দাও পেটা যাবে। রূপসীর কোলে হাত রাখল বন্ড। হীরের দাম দিতে পারি যদি গল্পটা ফিল্ম কোম্পানি কিনে নেয়। ভ্যানিম্লিফের হীরের ক্লিপ দেব। রাজি?

এবার হাত সরিয়ে দিল রূপসী। হোটেল অ্যামবাসডার এসে গেছে। ট্যাক্সির দরজা খুলেছে। রাস্তার আলোয়। নক্ষত্রের মত জ্বলছে সুন্দরী-নয়ন। সিরিয়াস চাহনি। বন্ডকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল নক্ষত্র চক্ষু। তারপর– পুরুষ মানেই শুওর। দু-চারটে পুরুষ অবশ্য কম মাত্রায় শুওর। অলরাইট। দেখা আমাদের হবে। তবে ডিনার টেবিলে নয়। যা বলব, তা ভোলা জায়গায় বলা যায় না। রোজ বিকেলে লিজেতে গোসল করতে যাই। জায়গাটার নাম বাগনি আল বেরোনি। ইংলিশ কবি বায়রন ঘোড়ায় চড়তেন যেখানে। উপদ্বীপের উঁচাল প্রান্তে। পরশু বেলা তিনটে নাগাদ আমাকে পাবেন। রোদ পোহাব। বালির পাহাড়ের মধ্যে। ফিকে হলদে ছাতার নিচে। টোকা না মেরে উঁকি দেবেন না। নাম ধরে ডাকবেন। মিস লিলবম আমার নাম।

বলেই ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল রূপসী। বন্ডও নামল। হাত নেড়ে গুডনাইট জানিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল লিলবম। পেছন থেকে ঢলঢলে দেহ রেখার দিকে চিন্তাকুটিল চোখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল বন্ড। তারপর ফিরে এসে ট্যাক্সিতে বলল হোটেল ম্যাজিওনেলে যেতে।

রেলপথে রোম থেকে ভেনিস যেতে হলে ল্যাগুনা এক্সপ্রেসে যাওয়াই ভাল। আরাম বেশি। ছাড়ে রোজ দুপুরে। লন্ডন হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে কাজের কথা সেরে কোনমতে ছুটন্ত ট্রেনে উঠে বসল বন্ড। পেছনের কামরা। অ্যালুমিনিয়াম কোচ!

যথাসময়ে এল শহরের রাণী ভেনিস। গ্রান্ড ক্যানালের রক্ত রাঙা সূর্যাস্ত সব অবসাদ যেন ধুইয়ে মুছিয়ে দিল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও গেল সেরা হোটেলে একটানা আধঘণ্টা ঘুমোবার পর।

ভেনিস আসার সেরা মাস হল মে আর অক্টোবর। রোদে তখন মাইলের পর মাইল হাঁটা যায়। টুরিস্টের ভিড়ও তুঙ্গে পৌঁছয় না। ভিড় বাড়লেও ভেনিস কাতর নয়। হাজার হাজার টুরিস্টকে একসঙ্গে জায়গা দেবার ক্ষমতা বোধ। করি সারা বিশ্বে একমাত্র ভেনিস শহরেই আছে।

পরের দিন সারা সকালটা শহরের পথে ঘাটে টো টো করে ঘুরে বেড়াল বন্ড। কয়েকটা গির্জাতেও গেল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উধাও হল পাশের দরজা দিয়ে। চোখ রইল পেছনে। মতলব তো শহর দেখা নয়। পেছনে ফেউ লাগলে তাকে দেখা। কিন্তু কেউ নেই।

নিশ্চিন্ত হয়ে সকাল সকাল লাঞ্চ খেয়ে নিল বন্ড। হোটেলে ফিরে ঘর বন্ধ করে কোট খুলল। বার করল অটোমেটিক ওয়ালথার পি-পি-কে। সেফটি ক্যাচ লাগিয়ে প্র্যাকটিস করল বার কয়েক। খাপ থেকে কত তাড়াতাড়ি রিভলবার টেনে বার করা যায়, সে মহড়াও হল। বার দুয়েকেই খুশি হল বন্ড। রিভলবার ফিরে গেল চামড়ার হোল্ডারে। নিচে এসে স্পীডবোটে চেপে রওনা হল অ্যালবেরোনি অভিমুখে। কাঁচের মত হ্রদের জলরাশি তোলপাড় হল জলযানের গতিবেগে।

লিডো উপদ্বীপের যেদিকে ভেনিস, সেদিকের অ্যালবোনি জেটি থেকে আধ মাইলটাক ধূলি ধূসর পথ। উপদ্বীপের চল প্রান্তে এ যেন অন্য এক জগৎ। পরিত্যক্ত মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করছে সবকিছু। কলোনী পত্তনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ঘরদোর যেমন, তেমনি পড়ে। জেলেদের গাঁ। ছাত্রদের স্বাস্থ্যনিবাস। ইটালিয়ান নেভীর কামান রাখার স্তূপ। এখন অবশ্য ঝোপে ঢাকা। গত যুদ্ধের নিদর্শন। প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এরই মাঝে গলফ খেলার জন্য খানিকটা জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, মাইন পোঁতা অঞ্চল। মাইন সরানোর সময় কারো হয়নি। তাই মরার খুলি আর আড়াআড়ি হাড় আঁকা তক্তায় লেখা–সাবধান, মাইন পোঁতা আছে। সারা অঞ্চল বিষাদের ছায়ায়। থমথমে। অথচ দূরত্ব বেশি নয়। হ্রদ পেরিয়ে ভেনিস থেকে ঘণ্টাখানেকের কম সময় লাগে এ তল্লাটে আসতে।

আধ মাইল হাঁটতেই ঘেমে উঠেছিল বন্ড। বাবলার ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিল। সামনেই কাঠের জীর্ণ খিলেন। নীল রঙে লেখা বাগানি অ্যালবেরোনি। ওদিকে কয়েকটা ভাঙাচোরা কাঠের ঘর, শখানেক গজ পর্যন্ত বালুকাবেলা, নীল কাঁচের মত টলটলে সমুদ্র। স্নানাথী একজনও নেই। কেউ আসে বলেও মনে হয় না। অথচ খিলেন পেরোতেই রেডিওতে ক্ষীণ বাজনা শোনা গেল। শব্দটা আসছে ভাঙাচোরা কাঠের ঘরগুলোর ভেতর থেকে।

সমুদ্রের ধার বরাবর হাঁটতে লাগল বন্ড। বাঁদিকে সাগর-বেলা ঈষৎ বেঁকে গেছে লিভোর লোকালয় পর্যন্ত। ডানদিকে আধ মাইল গেলেই সমুদ্র প্রাচীর শীর্ষে মাঝে মাঝে অক্টোপাস জেলেদের মাচা। সাগরবেলার পেছনে বালির টিলা। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা গলফ মাঠের কিছু অংশ। বালির পাহাড়ের কিনারায় প্রায় পাঁচশ গজ দূরে জ্বলজ্বল করছে এক টুকরো উজ্জ্বল হলুদ রঙ।

সেই দিকেই পা চালাল বন্ড।

কে ওখানে?

 বিকিনির ঊর্ধ্বাংশ নিমেষে ওপরে টেনে তুলল পেলব দুটি হাত। সামনে এসে দাঁড়াল বন্ড। ছাতার ঝলমলে ছায়ায় ঢাকা পড়েছে কেবল মুখটি। শরীরের বাকি অংশ রোদে মেলা, সূর্য-জ্বলা ঘি রঙ ঢাকা সাদা-কালো তোয়ালে আর কালো বিকিনি দিয়ে।

আধবোজা চোখ মেলে তাকায় লিলবম। এসেছেন পাঁচমিনিট আগে। পইপই করে বলা সত্ত্বেও টোকা মারেননি।

ছাতার ছায়ায় বসে পড়ল বন্ড। বসল সুন্দরীর গা ঘেঁষে। রুমাল বার করে মুখ মুছে বলল, মরুভূমির মাঝে তালগাছ বলতে তো দেখছি এই ছাতা। ঝটপট ছায়ায় বসতে কার না ইচ্ছে করে। দেখা সাক্ষাতের এই কি জায়গা?

হাসল সুন্দরী– স্বভাবে আমি গ্রেটা গার্বো। একলা থাকতে চাই।

সত্যিই কি একলা।

না তো কি? বডিগার্ড এনেছি বলে মনে হয়?

 আপনার মতে পুরুষ মানেই তো শুওর

কিন্তু আপনি হলেন ভদ্রলোক শুওর। খুকখুক করে হাসল সুন্দরী। বনেদী শুওর। তাছাড়া, এ জায়গায় ওসব চলেও না। যা বলি, সব চাইতে বড় কথা, আমরা এসেছি ব্যবসার কথা বলতে। আপনাকে আফিং চোরাই চালানের গল্প শোনাব। দাম দেবেন হীরের ক্লিপ কিনে দিয়ে। তাই তো? নাকি মত পালটেছেন?

না, পালটাইনি। এবার শুরু করলেই হয়।

 প্রশ্ন করুন। আমি জবাব দিচ্ছি। বলুন কি জানতে চান, উঠে বসল সুন্দরী। দু-চোখের রং উধাও হয়েছে, সিরিয়াস চাহনি এখন বেশ হুঁশিয়ার।

পরিবর্তনটা নজরে এল বন্ডের। সাদা গলায় বলল, শুনলাম আপনার বন্ধু কলম্বো নাকি এ কারবারে বড় কারবারী। তার কথাই আগে বলুন। গল্পে ও চরিত্র জমবে ভাল। নাম পালটে দেব, ভয় নেই। খুঁটিয়ে বলুন। কারবার চালায় কিভাবে? লেখকরা যা কল্পনায় আনতে পারে না, তা বলে যান আমি কাজে লাগাই।

হাত দিয়ে চোখ ঢেকে সুন্দরী বলল, এনরিকো যদি জানতে পারে তার রহস্য ফাঁস করেছি, আমার ছাল ছাড়িয়ে নেবে।

জানতে পারলে তো।

মিস্টার বন্ড, এনরিকো জানে না এমন কিছু নেই। স্রেফ অনুমানের ওপরেও মরণ-মার মারতে পেছ পা হয় না ও। বলেই চকিতে ঘড়ির দিকে তাকাল সুন্দরী। কে জানে পিছু নিয়ে এখানেও এসেছে কিনা। ভয়ানক সন্দিগ্ধ মন ওর। এবার গলা কেঁপে যায় লিলবমের। চোখে মুখে ভয়ার্ত ভাব–আপনি বরং যান। এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।

সোজাসুজি ঘড়ির দিকে তাকায় বন্ড। সাড়ে-তিনটে। ঘাড় ফেরায়। ছাতার পেছন দিক দিয়ে বালুকাবেলার ওপর দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরে ভাঙা কাঠের ঘর পর্যন্ত।

তিনজন ষণ্ডামার্কা পুরুষ তালে তালে পা ফেলে আসছে এই দিকে। রোদে তেতে ওঠা বালির হলকায় যেন থির থির করে নাচছে ভাঙা কাঠের ঘর, নাচছে তিনমূর্তি। তবুও আসছে। বুঝি কুচকাওয়াজ করছে। তালে তালে পা ফেলছে। অবিকল ফৌজী সৈন্যের মত।

টপ করে উঠে দাঁড়ান্স বন্ড। বলল নিরস স্বরে– বুঝেছি। কলম্বোকে বলবেন, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবনী লেখা শুরু করলাম। লেখা আমার থামবে না। চললাম। বলেই দৌড়াল উপদ্বীপের ছুঁচোল প্রান্তের দিকে। সেখান থেকে ঘুরে গাঁয়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানো কঠিন হবে না।

নির্জন সৈকতে ত্রিমূর্তির মধ্যে যেন জোরে হাঁটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। দ্রুত ছন্দে আন্দোলিত হল কনুই আর পা-তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেল গতিবেগ। একজন হাত নেড়ে ইশারা করল শায়িত সুন্দরীর কাছে এসে। হাত নেড়ে সায় দিল লিলবম। তারপর শুল পাশ ফিরে। মানুষ শিকারে যেন অরুচি–তাই আর ফিরেও তাকাল না।

ছুটন্ত অবস্থায় নেকটাই খুলে পকেটে রাখল বন্ড। গরমে দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে গা বেয়ে। তিন মূর্তিরও সেই অবস্থা। সহনশক্তি কার বেশি। এ যেন তারই পরীক্ষা। উপদ্বীপের ডগায় পৌঁছে লাফিয়ে উঠল সমুদ্র প্রাচীরের ওপর। তাকাল পেছনে। সর্টকাট করছে দুটো ফেউ। মরার মাথা খুলি আঁকা বিপদ সংকেতের পরোয়া না রেখে ঢুকে পড়েছে মাইন পোঁতা অঞ্চলে। ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে। চওড়া পাঁচিল বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল বন্ড।

শার্ট ঘামে সপসপে হয়ে গেছে। পা টনটন করছে। মাইল খানেক দৌড়ানো হয়ে গেছে। আর কত দূর? পাঁচিলের মাঝে-মাঝে সেকেলে কামানের কংক্রিট স্তম্ভ। আরও মাইল খানেক গেলে তবে যদি গায়ের মধ্যে ঢাকা যায়। এদিকে স্যুট পর্যন্ত ভিজে গেছে ঘামে, ট্রাউজার্সের ভিজে কাপড়ে পা আটকে-আটকে যাচ্ছে। পেছনে তিনশ গজ ব্যবধানে আসছে এক মূর্তি। ডাইনে বালির টিলা ভেঙে আরো দুজন।

বন্ড ফন্দি আঁটছিল ছোটার বেগ কমিয়ে এনে হাঁটতে-হাঁটতে পেচনের তিন ছিনেৰ্জোক গুলি মেরে কুপোকাৎ করার। এমন সময় উপর্যুপরি দুটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।

প্রথম দৃশ্যটা দেখা গেল সামনে। জনা ছয়েক জেলে হাতে বর্শার মত কি যেন। কেউ দাঁড়িয়ে পানিতে কেউ পাঁচিলের গা ঘেঁষে।

দ্বিতীয় নাটকটা ঘটল ঠিক পেছনেই। আচম্বিতে বালির পাহাড় থরথরিয়ে কেঁপে উঠল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। মাটি, বালি আর একটি মানুষের খণ্ড-বিখণ্ড হাত-পা-বড় ফোয়ারার মত ছিটকে গেল শূন্যে। ধাক্কার ঢেউ মাটি বয়ে এসে কাঁপিয়ে দিল বন্ডকেও। গতি কমিয়ে আনল বন্ড। বালি পাহাড়ের দ্বিতীয় আগন্তুকও দাঁড়িয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের মূর্তির মত নিস্পন্দ। ঝুলেপড়া চোয়াল কাঁপছে ভয়ার্ত ঘড়-ঘড়ানিতে। পরমূহুর্তেই দু হাতে মাথা চেপে ধরে আছড়ে পড়ল বালির ওপর। লক্ষণ দেখেই বুঝল বন্ড, কেউ-না-আসা পর্যন্ত ও আর নড়ছে না। এসে ওকে নিয়ে যাবে, তবেই ভয়ের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবে বিটলে বদমাস।

হাঁফ ফেলল বন্ড। বাকি রইল একটা শয়তান। পথও বেশি নয়। শ দুই গজ গেলেই জেলেদের দলে ভিড়ে পড়া। যাবে। মনে মনে কয়েকটা ইটালিয়ান শব্দ সাজিয়ে নিল বন্ড। জেলেরা এদিকেই তাকাচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য। বর্শাধারী জেলেদের দেখতে পেয়েও পেছনের ছিনেজোক রাস্কেলটা এখনো পাই পাই করে তার দিকেই ছুটে আসছে। দূরত্ব মাত্র শ খানেক গজ। হাতে একটা রিভলবার।

সামনের জেলেরাও ছড়িয়ে পড়েছে। অবরোধ করেছে বন্ডের পথ। মাঝে একটা মস্ত লোক। কোমরে লাল রঙের গোসল করার জাঙিয়া। সবুজ মুখোশ মাথার ওপর টেনে তোলা।

দু হাত পাছায় রেখে সিধে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লাগানো নীল রঙের সাঁতারু পাখনা বেরিয়ে রয়েছে দু পাশে। দূর থেকে মনে হল যেন রঙিন ফিল্মের সেই ব্যাঙ মানুষ–টোড হলের মিস্টার টোড। বন্ড ছুটছিল, এখন হাঁটতে লাগল। হাঁপাতে লাগল হাপরের মত। ঘর্মাক্ত হাতটা আপনা হতেই চলে গেল কোটের নিচে একটানে বার করল রিভলবার। হারপুন বাগিয়ে জেলেরা তাগ করছে বন্ডকে। মাঝখানের লোকটা এনরিকো কলম্বো।

কলম্বো দেখল পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে বন্ড। গজ বিশেষ দূরে আসার পর বলল শান্তকণ্ঠে– সিক্রেট সার্ভিসের মিস্টার বন্ড। খেলনা পিস্তলটা নামিয়ে রাখুন। নড়বেন না। ওখানেই দাঁড়ান। সি-ও-টু হারপুন বন্দুক এত কাছ থেকে ফসকায় না। ইংরাজিতে পাশের লোককে গত সপ্তাহ অ্যালবেনিয়ান বদমাসকে কত গজ দূরে গেঁথেছিলে মনে আছে?

বিশ গজ। হারপুন এ ফোড় ও ফোড় হয়ে গিয়েছিল। কি মোটাই না ছিল লোকটা–এর দ্বিগুণ তো বটেই।

থমকে গেল বন্ড। পাশেই লোহার চ্যাটাল খুঁটি দেখে বসল আয়েশ করে। রিভলবারটা রাখল কোলে–নল ফেরানো রইল কলম্বোর মস্ত ভূড়ির দিকে।

বলল, পাঁচটা হারপুন দিয়েও আমার একটা বুলেটকে আটকানো যাবে না কলম্বো। আমি মরব, আপনিও মরবেন।

হাসিমুখে ঘাড় নেড়ে সায় দিল কলম্বো। বন্ডের পেছনেই পা টিপে টিপে আসছিল–পিছু নেওয়া সেই আততায়ী। রিভলবারের কুঁদো দিয়ে একবার মাত্র মোক্ষম ঘা মারল বন্ডের করোটি আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে।

মাথার চোট নিয়ে অজ্ঞান হবার পর জ্ঞান ফিরে পেলেই দারুণ বমি বমি লাগছিল। অসহ্য সেই অবস্থাতেও দুটি অনুভূতি প্রবল হল বন্ডের মগজে। প্রথম, সে রয়েছে সমুদ্রে দুলন্ত জাহাজের মধ্যে। দ্বিতীয়, কে যেন একটা ভিজে তোয়ালে দিয়ে তার কপাল মুছিয়ে ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে প্রবোধ দিচ্ছে। আবার ব্যাঙ্কে এলিয়ে পড়ল বন্ড। শরীরে শক্তি যেন আর নেই। কেবিনটা ছোট্ট। মেয়েলী সুগন্ধ ভাসছে। রুচিসম্মত পর্দা। দেওয়ালের রঙে একই রুচির ছাপ। একজন নাবিক ঝুঁকে রয়েছে বন্ডের মুখের ওপর। চেনা চেনা লাগল লোকটাকে। জেলে সেজে হারপুনধারীদের মধ্যে ছিল বোধহয়। বন্ড চোখ খুলতেই হাসি মুখে বলল, ভাল তোর ব্যথা করছে না সেরে যাবে। দাগও মিলিয়ে যাবে চুলের আড়ালে। মেয়েদের চোখে পড়বে না।

ফ্যাকাশে হেসে ঘাড় নাড়ল বস্তু। নড়তেই দারুণ যন্ত্রণায় চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে এল। হাতঘড়িতে দেখল সাতটা বাজে। দু চারটে কথা বলে লোকটা দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল।

ভাবগতিক দেখে মনে হল না বন্ডকে শত্রু মনে করা হচ্ছে। কে জানে কি মতলব কলম্বোর। রফায় আসতে চায় মনে হচ্ছে। উঠে বসল বস্তু। মুখ ধুয়ে সিগারেট ধরাল। ড্রয়ারের মধ্যেই তার রিভলবার ছাড়া সবকিছু পেল।

নটা নাগাদ চেনা নাবিকটা এসে বন্ডকে নিয়ে গেল অন্য এক সাজানো ঘরে। টেবিলের দু পাশে দুটো চেয়ার। নিকেল চকচকে ট্রলীতে থরে থরে সাজানো খাবার। পোর্টহোল খুলে বন্ড দেখল। অন্ধকার দিগন্ত। এক থোকা হলদেটে আলোক কণা।

খটাং করে হ্যাচওয়ের ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকল কলম্বো। কৌতুক আর দুষ্টুমি যেন নেচে নেচে উঠছে দুই চোখে। চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, বন্ধু আসুন, বসুন, খান, কথা বলুন। কাজের কথা হোক। কি নেবেন? জিন, হুইস্কি, শ্যাম্পেন? সারা বোলোগনা চষেও এমনি খাসা সসেজ কোথাও পাবেন না। আমার বাগানের অলিভ। সেঁকা চীজ, তাজা ডিম, রুটি, মাখন। সাদামাটা খাবার। কিন্তু খেয়ে তৃপ্তি পাবেন। আসুন, দৌড়ঝাঁপ তো কম হয়নি। ক্ষিদে নিশ্চয় পেয়েছে।

কলম্বোর সংক্রামক হাসি বন্ডকেও হাসাল। হুইস্কিতে সোডা মিশিয়ে নিয়ে বসল চেয়ারে। বলল, এত কাণ্ডকারখানার দরকার ছিল কি? সোজা পথেই তো দেখা করা যেত। আপনার শাঙাৎ ঐ হাঁদারাম মেয়েটাকেও বলিহারি যাই। যেচে আপনার ফাঁদে পা দেব বলেই তো এসেছি। চীফকে তখুনি বলেছিলাম। মেয়েটার কথাবার্তা সুবিধের নয়। এরকম একটা কিছু আঁচ করা গিয়েছিল বলেই ব্যবস্থা করে এসেছি। আগামীকাল দুপুর বারোটার মধ্যে ছাড়া না পেলে আন্তর্জাতিক পুলিশ আর ইটালিয়ান পুলিশ আপনাকে তুলোধোনা করে ছাড়বে।

ভড়কে গেল কলম্বো। বলল, ফাঁদে পা দিচ্ছেন যদি জানতেনই তো আমার তিন সাঙাকে এড়িয়ে পাচ্ছিলেন কেন? ওদের পাঠিয়েছিলাম আপনাকে আমার জাহাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এলেই পারতেন। অত ছুটোছুটি করার ফলে হল কি? না। আমার দলের একজন কমলো। আপনার খুলিও চুরমার হতে হতে বেঁচে গেল। বুঝি না কি দরকার ছিল এই প্রহসনের।

লোক তিনটের চেহারা মোটেই ভাল লাগেনি আমার। কারা খুনি আর কারা খুনি নয়–দূর থেকে দেখলেই চিনতে পারি। ভাবলাম, উজবুকের মত ঠ্যাঙাড়ে দিয়ে ঠেঙিয়ে ঢিউ করার মতল আপনার। ঠ্যাঙাড়ে আনার দরকার ছিল কি? লিলবম একাই তো আনতে পারত আমাকে।

মাথা নাড়তে নাড়তে কলম্বো বলল, লিল তো আর কিছুই চায়নি। শুধু আপনার পেট থেকে বেশ কিছু কথা বার করে নিতে চেয়েছিল। এখন যা ঘটল, তাতেও মর্মান্তিক চটেছে আমার ওপর। একে তো খাঁটি বন্ধু পাওয়া মুশকিল। তার ওপর এক বিকেলেই দু-দুটো শত্ৰু আমি বানালাম। সত্যি সত্যিই মুষড়ে পড়ে কলম্বো। ইয়া মোটা খানিকটা সসেজ ক্যাচ করে কেটে নিয়ে এক কামড়ে ছাড়িয়ে নিল বাইরের ছাল। মুখে ঠেসে চিবুতে লাগল কচ কচ করে। মুখভর্তি। তা সত্ত্বেও একগ্লাস শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে আধচিবানো সসেজ ধুইয়ে নামিয়ে দিল পাকস্থলীতে। বলল, উদ্বেগ বাড়লেই খাওয়া বাড়ে আমার। কিন্তু যা খাই, তা হজম করতে পারি না কিছুতেই। এই মুহূর্তে আমার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছেন আপনি। বলছেন, ইচ্ছে করলেই বিনা ঝাটে দেখা করা যেত। কিন্তু তা কি করে জানব বলুন। শুধু শুধু ম্যারিও মরল। মরার দোষটাও পড়ল আমার ঘাড়ে। অথচ ওকে আমি বলিনি মাইন পোঁতা জমি পেরিয়ে শর্টকার্ট করতে। দম করে টেবিলে ঘুষি মারল কলম্বো। না, না এ দোষ আমার নয়। দোষ আপনার। আপনিই তো কথা দিয়েছিলেন খুন করবেন আমাকে। মনে খুন বাইরে বন্ধুত্ব–একি হয়? খুন করব মনে করে কেউ বন্ধুর মত দেখা করতে পারে? বলুন, সত্যি কিনা? এক যাচকায় বেশ খানিকটা পাকানো রুটি টেনে নিয়ে মুখে ঠাসল কলম্বো, দুই চোখ জ্বলতে লাগল চুল্লীর মত।

বলছেন কি? বন্ড বিস্মিত।

বাকি রুটিটা খাওয়া হল না। ছুঁড়ে দিয়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল কলম্বো। উত্তেজিতভাবে পায়চারী শুরু হল সেলুনের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত। কিন্তু চাহনি আটকে মইল বন্ডের ওপর। পরক্ষণেই একটানে একটা ড্রয়ার খুলল। ভেতরে একটা টেপ রেকর্ডার। বন্ডের চোখে চোখ রেখেই মেশিনটাকে বার করল। একটা সুইচ টিপল।

গলায় পি পি আওয়াজ শুনেই হুইস্কির গ্লাস ঠোঁটের কাছে তুলল বন্ড। চোখ রইল মেশিনের ওপর। পি পি কণ্ঠ বলছে, ঠিক খবর দেবার আগে শর্তটা জানানো দরকার ইয়েস? একই গলায়, আমেরিকান ডলারে মাই দশ হাজার ডলার। কাল লাঞ্চ খাবার আগেই ছোট নোটে পুরো টাকা আনবেন…যদি মরেও যান…এত কথা কোত্থেকে জানলেন কাউকেই বলতে পারবেন না…গ্যাংয়ের চাই লোকটা অতি জঘন্য। তাকে খুন করতে হবে। কান খাড়া করল বড়। এবার শোনা যাবে নিজের কণ্ঠ। অনেকক্ষণ বিরতি। এরপর আসছে শেষ শর্তে রাজি হবার পালা। কি বলেছিল বন্ড, কথা দিতে পারছি না। সে ভাবনা আপনার। কেউ যদি আমাকে মারতে আসে, আমি তাকে মারব। প্রাণে মারব। নইলে নয়।

খটাস করে মেশিন বন্ধ করল কলম্বো। এক ঢোকে হুইস্কি শেষ করল বন্ড। বলল, বারে। আমি যে খুন করব কথা দিয়েছি। শুনে তা বোঝা গেল না।

বিষণ্ণ চোখে তাকাল কলম্বো।–ইংলিশ ম্যানের এ কথার মানে আমার কাছে একটাই। খুন করা আপনার মনে ছিল। যুদ্ধের সময় ইংরেজের হয়ে লড়েছি। কিংস্ মেডেল পেয়েছি। দেখবেন? বলেই ফস করে পকেট থেকে রূপার ফ্রিডম মেডেল বার করল।

 কলম্বোর চোখ থেকে চোখ সরাল না বন্ড টেপে তো আরো কথা আছে। সব কি মিথ্যে? ইংরেজের হয়ে লড়া ফুরিয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধেই লড়ছেন টাকার লোভে।

ঘোৎ করে উঠল কলম্বো। তজনা দিয়ে মেশিনে খোঁচা মেরে–শুনেছি, সব শুনেছি। বস্তা বস্তা ধাপ্পা। বলেই আবার প্রচণ্ড ঘূষির চোটে ঝনঝন শব্দে নেচে উঠল টেবিলের গ্লাসগুলো। সে চিৎকার করল, মিথ্যে! মিথ্যে! সব মিথ্যে! বলেই চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে খপ করে তুলল হুইস্কির বোতল। হড় হড় করে আঙুল চারেক ঢালল বন্ডের গ্লাসে। ফের বসল চেয়ারে। শ্যাম্পেনের পুরো বোতলটা কাছে টেনে নিয়ে সংযত কণ্ঠে, সব অবশ্য মিথ্যে নয়। তর্ক করলাম না সেই জন্যই। বিশ্বাস করতেন না। ফাঁড়িতে টেনে নিয়ে যেতেন, ঝামেলায় ফেলতেন, আমাকে খুন করতে পারুন পারুন কেলেঙ্কারীর চুড়ান্ত করতেন। আমার কারবার ডকে উঠিয়ে ছাড়তেন। তাই ঠিক করলাম ফাঁকা কথায় কাজ নেই। হাতেনাতে আপনাকে দেখিয়ে দেব। যে সত্য খুঁজতে এসেছেন ইটালীতে, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা চাক্ষুষ দেখবেন। কাল ভোর হবার আগেই আপনার কাজ ফুরোবে, নটে গাছটি মুড়োবে।

বন্ড শুধু বলল, ক্রিস্ট্যাটোসের কথায় কোন মিথ্যে নেই কোথাও।

মাই ফ্রেন্ড, আমি স্মাগলার। চোরাই চালানদার। শুল্ক ফাঁকিতে ওস্তাদ। সত্যি শুধু এইটুকু। সারা ভূমধ্যসাগরে খুব সম্ভব আমার চাইতে উঁদে স্মাগলার আর কেউ নেই। ইটালীতে পাচার আমেরিকান সিগারেটের অর্ধেক আমি আনাই ট্যানজিয়ার থেকে। সোনা? ব্ল্যাক মার্কেটের একমাত্র সাপ্লায়ার হলাম আমি। হীরে? বেরুটে আমার নিজের জোগাড়ে রয়েছে–সরাসরি যোগাযোগ আছে সিয়েরা লিয়োন আর সাউথ আফ্রিকা পর্যন্ত। পুরোনো আমলে সোনা হীরে তত পাওয়া যেত না। তখন চালান দিতাম অরিও মাইসিন, পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধপত্র। আমেরিকান প্রভাব যে সব হাসপাতালে, তার প্রতিটিতে ঘুষ দিতে হত। এমন কি সিরিয়া, পারস্য থেকে ডানা কাটা পরীদের এনে নেপলসের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেও কসুর করিনি। জেল পালানো কয়েদীদেরও সীমান্ত পার করে দিয়েছি মোটা দাও পিটে। কিন্তু আবার কলম্বোর প্রচণ্ড ব্ৰজমুষ্টি নেমে এল টেবিলের ওপর। আফিং, কোকেন, মরফিন, হিরোইন-নো নেভার! জীবনে ওপথ মাড়াইনি। নোংরা জঘন্য পাপ। পাপ আর কোথাও নেই–আছে শুধু এতে। শূন্যে উঠল ব্ৰজমুষ্টিমাই ফ্রেন্ড, মায়ের নামে দিব্বি দিয়ে বলছি, ও ব্যবসা আমার নয়।

এতক্ষণে যেন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল বন্ড। আলোর দিশা দেখা গেল সেই মুহূর্তে। কলম্বোর কথা অবিশ্বাস করা যায় না। লোভী বোম্বেটে বেচারীর ওপর মনটাও নরম হয়ে এল। ক্রিস্ট্যাটাস বড় জবর চাল চেলেছে। মুখে বলল, কিন্তু আপনাকে ফাঁসিয়ে ক্রিস্ট্যাটাসের লাভ কি?

মাই ফ্রেন্ড। ক্রিস্ট্যাটাস কু-বুদ্ধির জাহাজ। ও যে কত গভীর পানির মাছ তা কল্পনায় আনা যায় না। এতবড় দু মুখো খেলায় নজীর স্মাগলিং ইতিহাসে আর দুটি নেই। আমেরিকান গুপ্তচরদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে এক আধটা চুনোপুঁটিকে ধরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু সে চাল ইংলিশ খেলায় চলবে না। এত মাল পাচার হচ্ছে ইংল্যান্ডে যে কহতব্য নয় মোটা ব্যবসার মোটা চুনোপুঁটির দরকার। তাই এবারে বলি দেওয়া হচ্ছে আমাকে। দিলে ক্রিস্ট্যাটাস আড়ালেই থেকে যায়, ওর কারবারও রক্ষে পায়। দুদিন মেহনত করলে ভোলাম কুচির মত টাকা ওড়ালেই আমার টিকি ধরে ফেলতেন। আমার কাজ কারবারও ফাঁস হয়ে যেত। যতই ঝুঁকতেন আমার দিকে, ততই আসল রাঘব বোয়ালের কাছ থেকে দূরে সরে আসতেন। শেষকালে আমাকে ফাটকে পুরে তবে ছাড়তেন। আসল পালের গোদারা হেসে কুটিপাটি হত আপনার সফঝম্প আর আমার কুপোকাৎ অবস্থা দেখে।

ক্রিস্ট্যাটাস আপনাকে কুপোকাৎ করতে চায় কেন?

মাই ফ্রেন্ড, খবর গজ গজ করে আমার পেটে। আমি জানি না এমন খবর কিছু নেই। স্মাগলিং করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঠোকাঠুকি হয়। দু দলে মারপিটও হয়ে যায়। এই তো সেদিন এই জাহাজ নিয়েই একহাত লড়লাম অ্যালবেনিয়ার একটা বোটের সঙ্গে। ওদের এক ব্যাটাই প্রাণে বেঁচেছিল। অন্তর টিপুনি দিতেই তার পেট থেকে অনেক কথা বেরিয়ে এল। তারপর একটা সাংঘাতিক ভুল করলাম। শুওরটাকে টির্যানাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই থেকে বাস্টার্ড ক্রিস্ট্যাটোসের নজর আমার পেছনে লেগেছে। তবে কি জানেন। নেকড়ের মত দাঁত খিঁচিয়ে হাসল কলম্বো– ও জানে না আরও একটা মারাত্মক খবর আমি জেনে গেছি। সেই খবর জেনেই যাচ্ছি কাল সকালে এক টক্কর লড়তে। সান্তা মেরিয়ার আনকোনার উত্তরে ছোট্ট একটা মাছ ধরার বন্দর আছে–হাতাহাতি হবে সেইখানেই। দেখা যাক–কে হারে কে জেতে।

নরম গলায় বন্ড বলল, এত খাটছেন নেবেন কত

 এক পয়সাও নয়। কাকতালীয় বলতে পারেন, কিন্তু আপনার আমার স্বার্থ একই। শুধু একটা শর্ত। আজ যা বললাম, তা আপনি, আমি আর দরকার হলে আপনার লন্ডনের কর্তা ছাড়া আর কেউ যেন না জানে। কথাটা যেন ইতালীতে ফিরে না আসে। রাজি?

রাজি।

উঠে দাঁড়াল কলম্বো। ড্রয়ার খুলে বার করে আনল বন্ডের রিভলবার। নিন মাই ফ্রেন্ড, দরকার হলেও হতে পারে তাই কাছেই রাখুন। পারেন তো খানিকটা ঘুমিয়ে নিন। ভোরে রাম আর কফি পাবেন। হাত বাড়িয়ে দিল কলম্বো। হাতে হাত মেলাল বন্ড। নিমেষে বন্ধু হয়ে গেল দুজনে।

কলম্বিনা জাহাজের মাঝি মাল্লা বলতে বার জন। ছোকরা বয়েসী, লোহাপেটা চেহারা। কলম্বো নিজের হাতে মগভর্তি কফি আর রাম দিল প্রত্যেকের হাতে। সেলুন ঘরে তখন লণ্ঠন ঝুলছে। ঝাড়ের লণ্ঠন। ঘর ছাড়া গোটা জাহাজটা অন্ধকার। ট্রেজার আইল্যান্ড উপন্যাসে বর্ণিত উত্তেজনা আর ষড়যন্ত্রের আমেজ মন্দ লাগছে না। কলম্বো, বারো সাঙাতের প্রত্যেকের হাতিয়ার টেনে দেখল। পরখ করল। তারিফ করল। হাতিয়ার বলতে লাগার রিভলবার আর ভাঁজ করা ছুরি। দেখে শুনে বন্ডের মনে হল, মহা ঘোড়েল পোক এই এনরিকো কলম্বো। জীবনে অনেক ঝড়ঝাঁপটা মাথা পেতে নিয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার, দুঃসাহস, রোমাঞ্চ ভরা জীবনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষেছে অনেকবার। এ জীবন ক্রিমিন্যালের জীবন–অপরাধে সমাকীর্ণ। মুদ্রা আইন ভণ্ডুল করেছে, তামাকের একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, কাস্টমস আর পুলিশকে ঘোল খাইয়েছে। তা সত্ত্বেও লোকটার হাবভাবে এমন একটা নাবালক নাবালক ভাব যে বদমাইশের শিরোমণি বলে ঠিক মনে হয় না। কু-কাজগুলোকে ও করলে কিছু মনে হয় না। কি রকম যেন অপরিপত্ব নষ্টামির ছোঁয়াচ সব কিছুতেই।

ঘড়ি দেখল কলম্বো। বার স্যাঙাৎকে ঘর থেকে সরিয়ে লণ্ঠনের সলতে কমিয়ে দিল। ভোরের শুচি শুভ্র আলোর আভা তিমির রাতকে সবে স্নান করতে শুরু করেছে। বন্ডকে নিয়ে ডেকে উঠল। ঢিমেতালে মিশমিশে কালো পাথুরে উপকূল ঘেঁষে এগোচ্ছে জাহাজ। সামনের দিকে তাকিয়ে কলম্বো বলল, মোড় ঘুরলেই বন্দর। এখন কেউ দেখতে পায়নি আমাদের। জেটিতে ঠিক এই জাহাজের মতই আরও একটা জাহাজ দেখার আশায় আছি। র‍্যাম্পের ওপর দিয়ে দেখবেন হয়ত বিস্তর নিউজপ্রিন্ট কাগজের রোল নেমে যাচ্ছে সরাসরি জাহাজ থেকে গুদামের ভেতর। নিরীহ দর্শন। কাগজ। পাহাড়ের মোড় ঘুরেই পুরোদমে গিয়ে পাশে ভিড়ব আমরা। রেলিং টপকে যাব ও জাহাজে। মারপিট হবেই। মাথাও ভাঙবে। গুলি চলবে কিনা জানি না। ওরা না চালালে চালাব না। যদি চালাইতো আপনি হাত লাগাবেন। তাতে যদি আপনার মৃত্যু হয় জানবেন আপনি শহীদ হয়ে গেলেন। কেননা আপনার দেশের শত্রু। মরতে আমিও ভয় পাই না। ও জাহাজ অ্যালবেনিয়ার জাহাজ। মাঝিমাল্লাও অ্যালবেনিয়ার, দুদে গুণ্ডাসব।

অলরাইট।

বস্তের মুখের কথা ফুরোতে না ফুরোতেই ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাফে টং করে আওয়াজ হল। পায়ের তলায় থর থর করে কেঁপে উঠল পাঠাতন। পাহাড়ের মোড় ঘুরে ক্ষুদে জাহাজটা দশ নট গতিবেগে ধেয়ে গেল বন্দর অভিমুখে।

কলম্বো বাজে কথা বলেনি। পাথুরে জেটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা জাহাজ। পতপত করে উড়ছে পালগুলো। ডেকের পেছনের দিক থেকে কাঠের পাটাতন ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে ডাঙার ওপর গুদামের দরজায়। ঢেউ খেলানো টিনে ছাওয়া গুদাম। উন্মুক্ত দরজায় নিঃসীম অন্ধকার। ভেতরে টিমটিম করছে কয়েকটা বিদ্যুৎ বাতি। জাহাজের ডেকে থরে থরে সাজানো নিউজপ্রিন্টের পেল্লায় পেল্লায় রোল। ডেক ঠাসা এই রোলে। কাঠের ঢালু পাটাতনে একটা একটা রোল নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। নিজের ভারেই গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নিউজপ্রিন্ট, হুড়মুড় করে ঢুকে যাচ্ছে গুদামের মধ্যে। জনাবিশ পুরুষ ব্যস্ত তদারকির কাজে। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে না পড়লে কাহিল করা মুশকিল হবে। কলম্বোর জাহাজ আর ও জাহাজের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ। ওদের দু জন এদিকেই তাকিয়ে আছে। একজন দৌড়ে নেমে গেল। তার আগেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হুকুমজারী করল কলম্বো। ইঞ্জিন থামল। থেমেই ফের চালু হল উল্টোদিকে। ব্রীজের ওপর দপ করে জ্বলে উঠল একটা প্রকাণ্ড সার্চলাইট। গায়ে গায়ে ভিড়তেই সার্চলাইটের আলোয় দিন হয়ে গেল অ্যালবেনিয়ান ট্রলারের ডেক। গায়ে গা ঠেকাতে না ঠেকাতেই লোহার আঁকশি দিয়ে রেলিং-এ রেলিং আটকে দিল কলম্বোর সাঙাত্রা। দিয়েই টপকে গেল ও জাহাজে। পুরো ভাগে দেখা গেল এনরিকো কলম্বোকে।

বন্ড অন্য ফন্দি এটেছিল। শত্রুপক্ষের জাহাজে পা দিয়েই একদৌড়ে ডেক পেরিয়ে রেলিং টপকে মারল ঝাঁপ। বারো ফুট নিচেই পাথরের জেটি। বেড়ালের মত চার হাত পায়ের ওপর জেটিতে অবতীর্ণ হল বন্ড। কিছুক্ষণ আর নড়ল না। গুঁড়ি মেরে ভেবে নিল পরবর্তী পন্থা। ডেকের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। গোড়ার দিকের একটা গুলিতে চুরমার হল সার্চলাইট। ভোরের আবছা আলোয় অব্যাহত রইল ফায়ারিং। শত্রুপক্ষের একজন চার হাত-পা ছড়িয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল ঠিক সামনেই।

লাইট মেশিনগান চালু হল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। গুদামের মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে এল আগুন। আঁকে ঝাঁকে বুলেট সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে এল বন্ডকে লক্ষ্য করে। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

সেই দিকেই দৌড়াল বন্ড। তবে জাহাজের ছায়ায় গা মিলিয়ে। তা সত্ত্বেও দেখে ফেলল মেশিনগানধারী। এক ঝাঁক বুলেট সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে এল বন্ডকে লক্ষ্য করে। ঝাঁপ দিল বন্ড। ঢালু পাটাতনের আড়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ল উপুড় হয়ে। বুলেট এখনো আসছে। মারণ বুলেট। মাথা কুটছে মাথার ওপরকার ঢালু পাটাতনে। কেঁচোর মত বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল বন্ড। স্বল্প পরিসর ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তবুও যেতে হবে বন্ডকে।

সহসা ধপাধপ দুমদাম শব্দ শোনা গেল মাথার ওপরে। গড়গড় দড়াম শব্দে কি যেন গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। বন্ড বুঝল কি ব্যাপার। কলম্বোর এক সাঙাৎ নিশ্চয় দড়ি কেটে দিয়েছে। কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে দিয়েছে পাহাড় প্রমাণ সবকটা নিউজপ্রিন্ট রোল। এই হল সুবর্ণ সুযোগ। পাটাতনের ছাউনি থেকে ছিটকে গেল বন্ড বাঁদিকে। মেশিনগানধারী নিশ্চয় আশায় আছে বন্ড ডানদিকে বেরোবে। কেননা ঘাতক নিজেই রয়েছে সেই দিকে ওৎপেতে গুদামের দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে।

শত্রুর মারণাস্ত্রের ঝকঝকে নল ঈষৎ ঘুরে গিয়ে বন্ডকে তাগ করার আগেই এক সেকেন্ডের মধ্যে বন্ড দুবার গুলিবর্ষণ করল। নিষ্প্রাণ আঙুল তখনও ট্রিগার টিপে থাকায় এক পাক টলে গেল মেশিনগান, এলোপাথারি গুলিবর্ষণ করতে করতে লাশ নিয়েই আছড়ে পড়ল মাটিতে।

টেনে দৌড়াল বন্ড–লক্ষ্য গুদামের খোলা দরজা। মাঝপথেই সহসা পিছলে পড়ল পা-দড়াম করে সটান আছড়ে পড়ল মাটিতে। চোট লাগল মাথাও মুখে কালচে মত কি একটা তরল বস্তু ঝরছে। ধুত্তোর বলে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে পড়ল বন্ড। ফের দৌড়াল গুদামের দিকে। একটু আগেই নিউজপ্রিন্টের পাহাড় হুড়মুড় করে এসেছে সেখানে। বন্ড গা ঢাকা দিতে চায় রোল গুলোর আড়ালে। একটা রোলের চাকলা উঠে গেছে মেশিনগানের বুলেট বর্ষণে। কালচে বস্তুর ধারা ঝরছে, মাখামাখি হয়ে গেছে বন্ডের মুখ। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। এ গন্ধের আঘ্রাণ এর আগেও একবার পেয়েছে বন্ড মেক্সিকোতে। কাঁচা আফিং। এ গন্ধ এত সহজে ভোলা যায় না।

মাথার খুব কাছ দিয়েই একটা বুলেট গিয়ে বিধল গুদোমের দেওয়ালে। ট্রাউজার্সে রিভলবার মুছে নিয়ে বন্ড ছিটকে গেল দরজার ভেতরে। কি আশ্চর্য। কেউ তো গুলি করল না। খোলা দরজায় ওর ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে দু-চারটে গুলি ভেতর থেকে ছুটে আসবে এই আশাই বন্ড করেছিল। কিন্তু কোথায় কি! নিবিড় শান্তি বিরাজ করছে ভেতরে। আলো নেভানো। তবে ফিকে আলোয় দু পাশে সাজানো নিউজপ্রিন্ট, মাঝখানে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সঙ্কীর্ণ গলিপথ। গলির শেষে একটা দরজা। যেন হাতছানি দিচ্ছে বন্ডকে।

প্রচণ্ড সেই প্রলোভনের মধ্যে মৃত্যুর গন্ধ পেল বন্ড। পা টিপে টিপে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল। গুলিবর্ষণ এখন আর ঘনঘন নেই। কুমড়োপটাস শরীর নিয়ে থপ থপ করে দৌড়ে এল কলম্বো। বন্ড বলল, দরজায় দাঁড়ান। ভেতরে যাবেন না। কাউকে ঢুকতে দেবেন না। আমি পেছনে যাচ্ছি। নেউলের মত ক্ষিপ্রচরণে গুদামের দেওয়াল ঘুরে দৌড়াল পেছনের দিকে।

প্রায় পঞ্চাশ ফুট লম্বা গুদামের শেষ প্রান্তে গিয়ে গতি হ্রাস করল বন্ড। খরগোশের মত হাল্কা পায়ে এগোল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে। ঝটিতে উঁকি দিল পেছনের দরজার দিকে মাথা টেনে নিল সঙ্গে সঙ্গে। পেছনের দরজায় ওৎ পেয়ে রয়েছে একজন লোক। চোখ রয়েছে দরজার ছিদ্রে। হাতে একটা যন্ত্র। যন্ত্র থেকে তার বেরিয়েছে। দরজার তলা দিয়ে গেছে গুদামের ভেতরে। একটা মিশমিশে কালো হুডখোলা গাড়ি দাঁড়িয়ে গা ঘেঁষে। ইঞ্জিন চলছে মৃদুশব্দে। গাড়ির মুখ ফেরানো ধূলিধূসর রাস্তার দিকে।

লোকটা ক্রিস্ট্যাটাস।

হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বন্ড। লক্ষ্য যাতে অব্যর্থ হয়, তাই দু-মুঠোর মধ্যে ধরল রিভলবার, দ্রুতগতিতে কয়েক ইঞ্চি সরে গিয়ে গুদামের কোণ পেরিয়ে গুলিবর্ষণ করল ক্রিস্ট্যাটেসের পা লক্ষ্য করে গুলি ফসকে গেল। পায়ের কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে ধুলোয় আলোড়ন তুলে উধাও হল বুলেট এবং পরে শোনা গেল বিস্ফোরণের গুরুগুরু গর্জন। টিনের দেওয়ালের প্রচণ্ড ধাক্কায় শূন্য পথে ছিটকে গেল বন্ড।

মাটিতে পড়েই ফের উঠে দাঁড়াল সে। দুমড়ে-মুচড়ে অদ্ভুত তেড়াবেঁকা আকার নিয়েছে গুদাম, প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ছে তাসের বাড়ির মত।

ক্রিস্ট্যাটোস গাড়িতে উঠে বসেছে এবং এর মধ্যেই এগিয়ে গেছে গজ বিশেক। পেছনের চাকায় ধুলো উঠছে ফোয়ারার মত। বন্ড দু-পা ফাঁক করে শিকারীর ধ্রুপদী ভঙ্গিমায় দাঁড়াল। ওস্তাদ বন্দুকবাজেরা নিশানা প্র্যাকটিস করতে গেলে এই ভঙ্গিই নেয়। খুব সাবধানে তাক করল। গর্জে উঠল ওয়াথার রিভলবার। একবার দু বার…তিনবার। শেষগুলি যখন ছুটল, ক্রিস্ট্যাটোস তখন পঞ্চাশ গজ দূরে। চলন্ত গাড়িতেই সিঁটিয়ে উঠে পেছনে হেলে পড়ল ওর দেহ। স্টিয়ারিং থেকে ঝাঁকি মেরে শূন্যে উঠল দু-হাত। সারস পাখির মত গলা লম্বা করে শূন্যে বার কয়েক মাথা ঠুকেই এলিয়ে পড়ল সামনে। ডান হাতটা এমনভাবে বেরিয়ে রইল, বাইরে যেন সিগন্যাল দিচ্ছে ডাইনে মোড় নেওয়ার। দৌড়াতে যাচ্ছিল বন্ড, ভেবেছিল গাড়ি এবার থামবে, কিন্তু মেঠো পথের গাড়ি-চলার গভীর খাতে চাকা বেঁধে যাওয়ায় অব্যাহত রইল গাড়ির এগিয়ে চলা। নিষ্প্রাণ ডান পা-টাও নিশ্চয় এক্সিলেটরে চেপে রয়েছে এখনো। তাই থার্ড গীয়ারের প্রচণ্ড বেগ নিয়ে বেগে উড়ে চলল হুডখোলা ল্যানসিয়া গাড়ি।

না-দৌড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল বন্ড। মেঠো পথের ওপর দিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে অতি দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে ল্যানসিয়া। ভোরের কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রিস্ট্যাটোস। উলটে গেল না। টলমলও করল না–দূর হতে দূরে অপসৃত হল, যেন এক আশ্চর্য ভৌতিক গাড়ি ভূতুড়ে হাতের চালনায়।

সেফটি ক্যাচ লাগিয়ে ট্রাউজার্স বেল্টে রিভলবার খুঁজে রাখল বন্ড। ফিরে দেখল কলম্বো আসছে। আনন্দে আটখানা মূর্তি। মাড়ি পর্যন্ত বার করে সে কি দাঁতাল হাসি। কাছে আসতেই শিউরে উঠল বন্ড। কেননা, আচম্বিতে ওকে দু হাতে জাপটে দুগাল চুমুতে-চুমুকে ভরিয়ে দিল কলম্বো।

আরে, আরে করছেন কি মশাই, পরিত্রাহি ডাক ছাড়ল বন্ড।

অট্টহাসিতে আকাশ পর্যন্ত বুঝি কাঁপিয়ে দিল কলম্বো, ওরে আমার শান্তশিষ্ট ইংলিশম্যানরে! ডাকাবুকো ডানপিটে! ডরান না কাউকে, ভয় শুধু আবেগকে। কিন্তু আমি বলেই ধাই করে বুকে দুরমুশ পেটা ঘুষি মারল– এনরিকো কলম্বো-প্রেমে পড়েছি আপনার। ঢাক পিটে বলব সবাইকে-লজ্জা কিসের? বুক আমার দশ হাত। আরে মশাই, আপনি যদি ঐ ব্যাটা মেশিনগানারকে না খতম করতেন তাহলে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত এতক্ষণে। কাউকেই আর জ্যান্ত ফিরতে হত না। আপনি থাকায় মরেছে শুধু দু জন, চোট খেয়েছে, বাকি প্রত্যেকেই। কিন্তু অ্যালবেনিয়ান ব্যাটারা সব পটল তুলেছে–ছ জন ছাড়া। ছ জনেই চো-চা দৌড় দিয়েছে গাঁয়ের দিকে। পালিয়ে যাবে কোথায়, সেখানেও পুলিশ ও পেতে আছে। ক্রিস্ট্যাটাস বাসটার্ডকেও মোটর সমেত যমের দক্ষিণ দুয়োর দেখিয়ে দিয়েছেন আপনি। আহা রে! সেকি গুলির বহর। দেখবার মত! মেন রোডে পড়লে চলন্ত মোটরের হালটা কি দাঁড়াবে তাই ভাবছি। হাত দেখিয়েছে। তো ডান দিকে, মরেও যেন সে খেয়াল থাকে। বাঁ হাতের কারবার বড়ই সর্বনাশা কিনা! সোল্লাসে বন্ডের কাঁধে থাপ্পড় মারল কলম্বো।

মাই ফ্রেন্ড, এবার কেটে পড়ার পালা। অ্যালবেনিয়ান জাহাজের সব কটা কল খুলে দিয়েছি। হু-হুঁ করে পানি ঢুকছে। তলিয়ে যাবে এখুনি। এ অঞ্চলে টেলিফোন কোথাও নেই। পুলিশ খবর পেতে-পেতেই আমরা লম্বা দেব। খবর তো দেবে জেলের দল। ওদের মোড়লকে টিপে দিয়েছি। অ্যালবেনিয়ানদের দু চক্ষে দেখতে পারে না ওরা। কাজেই আমরা পগারপার হব নির্বিঘ্নে।

বিধ্বস্ত গুদাম ঘরের ফাঁক ফোকর দিয়ে লেলিহান অগ্নিশিখা সবে দেখা দিয়েছে। সুমিষ্ট উদ্ভিজ্জ পোড়ার কুণ্ডলী পাকানো ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে আসছে আকাশ। জেটিতে ফিরে এল কলম্বো আর বন্ড। অ্যালবোনিয়ান জাহাজ তলিয়ে গেছে। পানি ছল-ছল করছে ডেকের ওপর। হাঁটুপানি ভেঙে সেই ডেক পেরিয়ে কলম্বিনায় গিয়ে উঠল দুই মূর্তি। সেখানেও বিস্তর করমর্দন আর পিঠে থাবড়া সইল বন্ড। ইঞ্চিন চালু হল সঙ্গে-সঙ্গে। কিছুদূর যেতে না যেতেই পাহাড়ের গায়ে একদল জেলেকে দেখা গেল। কলম্বো ইটালিয়ান ভাষায় কি যেন বলল তাদের। সঙ্গে সঙ্গে ওরা হাত নেড়ে বিদায় জানাল। এক জনের মন্তব্য শুনে হাসির হররা ছুটল গোটা জাহাজে। হাসতে-হাসতে কলম্বো বন্ডকে বলল, ওরা আমাদের আবার আসতে বলছে। কেননা অ্যানকোনার সিনেমার চাইতে আমরা নাকি জমাটি খেল দেখিয়ে গেলাম।

হঠাৎ নিজেকে বড় নোংরা মনে হল বন্ডের। উত্তেজনাও যেন উধাও হল রক্ত থেকে। নিচে গিয়ে দাড়ি কামাল ধার করা ব্লেডে, শার্ট পালটাল ধার করা শার্ট পরে। পোর্টহোল খুলে দিয়ে দেখল সবুজ উপকূল আর. নীল সমুদ্র। রিভলবারের পোড়া বারুদের গন্ধে কিন্তু তখনও জিঘাংসা, মৃত্যু আর আতংকের স্মৃতি।

সেলুনে গেল বন্ড। দেখল পর্বত প্রমাণ ডিমভাজা, মাংসের চপ, কফি আর রাম নিয়ে জবর ঘাট শুরু করেছে। কলম্বো। বন্ডকে দেখেই মুখভর্তি টোস্ট চিবোতে-চিবোতে বলল, হে বন্ধু, অ্যাদ্দিনে কিস্তিমাৎ করা গেল। গুদামভর্তি কত আফিং পুড়লো জানেন? পুরো এক বছরের সাপ্লাই। কাঁচা আফিং এখান থেকে যেত নেপলসে ক্রিস্ট্যাটাসের কেমিক্যাল কারখানায়। ক্রিস্ট্যাটাস মিথ্যে বলেনি। কারখানা আমারও আছে মিলানে। মাল পাচারের সুবিধের জন্যই এ কারখানা আমারই। বাদবাকি যা কিছু বলেছে ক্রিস্ট্যাটোস, সবই নিজের কীর্তি চালিয়েছে আমার নামে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়েছে। ক্রিস্ট্যাটোসই কাঁচা আফিং থেকে হিরোইন বানিয়ে চ্যালা চামুণ্ডাদের দিয়ে লন্ডনে চালান দেয়, আমি নই। জাহাজভর্তি পাহাড় প্রমাণ কাঁচা আফিংয়ের দাম কমসে কম দশ লাখ পাউন্ড। অর্থাৎ মাল বিক্রি হয়ে গেলেই ক্রিস্ট্যাটাস পাচ্ছে দশ লাখ পাউন্ড। মাই ডিয়ার জেমস্, আসল ব্যাপারটা তাহলে বলি আপনাকে। দশ লাখ পাউন্ডের মাল কিনতে একটা কানাকড়িও খরচ হয়নি ক্রিস্ট্যাটোসকে। কেন জানেন? উপহার, রাশিয়ার উপহার। পুরো মালটা রাশিয়া ওকে, প্রেজেন্ট করেছে ইংল্যান্ডের সর্বনাশ করার জন্য। মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রের সামিল এই জাহাজভর্তি আফিং ছড়িয়ে দেওয়া হবে ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে। নেশায় বুঁদ করে সর্বনাশ করা হবে তরুণ সমাজের। আফিং-এর অভাব নেই রাশিয়ায়। জাহাজ ভর্তি যত চান, পাবেন। দিয়েও ওদের ভাড়ার ফুরোবে না। ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য আফিং চাষ হচ্ছে ককেসাস অঞ্চলে। অ্যালবেনিয়া ওদের বড় ঘাঁটি। আফিংয়ের অভাব নেই। অভাব শুধু ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ইংল্যান্ডের বুকে নিয়ে ফেলার উপযুক্ত লোকবল, জোগাড়যন্ত্র ইত্যাদি। ক্রিস্ট্যাটোস ওদের সেই অভাব পূর্ণ করেছে। আফিং ক্ষেপণাস্ত্রকে সুকৌশলে নিয়ে গিয়ে ফেলছে ইংল্যান্ডে। রাশিয়া তার মনিব। মনিবের হুকুম মতই ট্রিগার টিপে আফিং ক্ষেপণাস্ত্রের। আজ মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে গোটা ষড়যন্ত্রটাকে নাশ করলাম আমরা আপনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে। নিশ্চিন্ত মনে দেশে ফিরতে পারেন এখন। গিয়ে বলতে পারেন। আফিং চালান আজ থেকে বন্ধ হয়ে গেল। হক কথাটাও বলবেন আশা করি। বলবেন, দুই দেশের লড়াইয়ের ভয়ঙ্কর এই চোরাই হাতিয়ারের উৎক্ষেপণ কেন্দ্র কিন্তু ইটালী নয়। আমাদের পরম শত্রু রাশিয়া রয়েছে সব কিছুর মূলে। ওদেরই গুপ্তচর দফতরের অভিনব রণকৌশল মনস্তাত্তিক লড়াইয়ের আশ্চর্য অস্ত্র এই আফিং চালান। বিনা পয়সা হিরোইন বিতরণ। অবশ্য এটা আমার অনুমান। আসল ব্যাপারটা জানার জন্য হয়ত আপনাকেই পাঠানো হবে মস্কোতে। ভায়া জেমস্ সে সুদিন যদি আসে, তাহলে আল্লাহ্ করুন যেন আপনার প্রিয় বান্ধবী লিলবমের মত অপরূপ একটা সঙ্গিনীও জুটে যায়, তাহলেই দেখবেন রহস্য আপনার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিচ্ছে।

তার মানে? মিস কম আমার বান্ধবী হতে যাবে কেন? ও তো আপনার।

প্রবলবেগে মাথা নাড়াতে-নাড়াতে কলম্বো বললেন, ভায়া জেমস, বান্ধবী আমার বিস্তর। ইটালীতে তো আপনাকে এখন দিন কয়েক থাকতেই হবে। রিপোর্ট লিখতে হবে, খুকখুক হাসি হেসে– আমি যা বললাম, তা বাজিয়ে দেখতেও হবে তো। আমেরিকান ইনটেলিজেন্সে গিয়ে দোস্তদের সঙ্গেও আধঘণ্টা নিশ্চয় কাটাবেন জীবন কাহিনী শোনাতে। ডিউটির ফাঁকে-ফাঁকে সঙ্গী তো চাই, নইলে আমার এমন সুন্দর দেশের সৌন্দর্য কে দেখাবে আপনাকে? অসভ্য দেশে গৃহস্বামীরা অনেক বউয়ের মধ্যে থেকে একটা বউকে বেছে নিয়ে সম্মানীয় অতিথিকে দেয় আপ্যায়নের জন্য। আমিও অসভ্য। আমার বউ নেই। কিন্তু লিলবমের মত বান্ধবী আছে বিস্তর। লিলবম বিলক্ষণ বুদ্ধিমতী। আমার নির্দেশের দরকার হবে না। আপনার পথ চেয়েই সে রয়েছে হয় তো। পকেট থেকে একটা বস্তু বার করে ঠ করে টেবিলে ফেলল কলম্বো। বুকে হাত রেখে বলল সিরিয়াস চোখে– অন্তর থেকে দিলাম। জানি, লিলবমের অন্তরও সায় দেবে।

বস্তুটা তুলে নিল বন্ড। ভারি ধাতুর পাতে লাগানো একটা চাবি। পাতে খোদাই করা হোটেলের নাম আর ঘরের নম্বর :

অ্যালবার্গো ভ্যানিযেলি। রুম ৬৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *