ফরিদপুর জেলা – কোটালিপাড়া রামভদ্রপুর কাইচাল খালিয়া চৌদ্দরশি খাসকান্দি কুলপদ্দি

ফরিদপুর জেলা

কোটালিপাড়া

বিশাল বনস্পতিও ধরাশায়ী হয় প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ায়, বুনো হাতির পায়ের চাপে সাজানো ফুলের বাগান যায় বিপর্যস্ত হয়ে। ঠিক তেমনি তো হয়েছে আমার পুববাংলার হাজার হাজার সোনার পল্লি-প্রতিমার অবস্থা–জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম ভুল রাজনীতির আকস্মিক অশনিপাতে। বহুপুরুষের যত্নে গড়া কত বাড়িঘর আজ পড়ে আছে শ্রীহীন হয়ে, খাঁ খাঁ করছে কত বিদ্যায়তন, কত দেউল। শিবশূন্য শিবালয়গুলোতে হয়তো চলেছে অশিবের হানাহানি, হয়তো বা অনেক মঠ-মন্দির লুপ্তও হয়ে গেছে এত দিনে। আর ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ তো নতুন কিছু নয়–দেবালয় ধ্বংসের অভিযান অনেকবারই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ভারতবাসীকে।

একটা ক্রুদ্ধ রুদ্র নিশ্বাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবহমান ধারা যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে পুববাংলায়। অতীত ইতিহাসের কত গৌরবময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাংলার এক-একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে; কিন্তু আজ যেন এক একটা ছেড়ে আসা গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে পল্লিমায়ের সেই সব স্মৃতির আভরণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগবিদিকে। এমনি এক গ্রাম-মায়ের কোল থেকেই প্রথম সূর্য-প্রণাম করেছিলাম আমি প্রায় বছর চল্লিশ আগে। আজন্ম আত্মীয় সে মাটি আজ আমার পর–এ সত্য, না স্বপ্ন! সত্য হলেও গ্রামকে নিয়ে গর্বের যে অন্ত নেই।

আমার জন্মভূমি কোটালিপাড়া শুধু গ্রাম নয়, আবার পরগনাও। বাংলার এককালীন বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপ সম্বন্ধে যেমন বলা হত-নবদ্বীপে নবদ্বীপ গ্রাম, পৃথক পৃথক কিন্তু হয় এক নাম’, এও অনেকটা তাই। পাশাপাশি কাজোলিয়া, মাজবাড়ি, পশ্চিমপাড়া, ডহরপাড়া, পিঞ্জুরি, ঊনশিয়া, মদনপাড়, দিঘির পাড়, রতাল এবং এমনি আরও বহু জনপদের সমষ্টিগত গ্রাম-নাম কোটালিপাড়া। এসব জনপদের লোকেরা বাইরে গিয়ে চিরকালই নিজেদের পরিচয় দিয়ে আসছে কোটালিপাড়ার অধিবাসী বলে। গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত এই পরগনা গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পুণ্যতোয়া ঘাগর নদ। ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির দিনে লক্ষ লক্ষ লোককে এর শীতল জলে স্নান করে গঙ্গাস্নানের পুণ্যার্জন করতে। সে উপলক্ষ্যে এর তীর জুড়ে বসত বিরাট মেলা। আজও কি বসে সেই মেলা? মেলার উল্লাসে মেতে ওঠার মতো মানুষের মন কি আজও আছে কোটালিপাড়ায়? আমার মন যে তা বিশ্বাসই করতে চায় না। ঘাগরেরই কোলে গড়ে উঠেছিল ঘাগর বন্দর। সে বন্দরের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। দেশের মাটিকে বিদায় দিয়ে আসার আগেও দেখে এসেছি কত দূর-দূরান্তরের কত পণ্যবাহী নৌকার ছড়াছড়ি সে বন্দরে! সেদিন এক বন্ধু এসে জানাল, ঘাগর বন্দরের যৌবনোচ্ছাস আর নেই, বার্ধক্যের ঝিমুনি লক্ষ করে এসেছে সে তার চোখে।

মনে পড়ে ঝনঝনিয়া, দেওপুরা, বরুয়া এবং বাগিয়া বিলের কথা। বিশাল জলরাশি বুকে ধরে এসব বিল এ অঞ্চলের মাটিকেই শুধু রসসিক্ত করেনি, এ পরগনার মানুষের মনেও বইয়ে দিয়েছে রসের বন্যা। কত গায়ক, বাদক, কথক এবং আরও কত জ্ঞানী-গুণী জন্মগ্রহণ করেছেন এ মাটিকে ধন্য করে। এই কোটালিপাড়ায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্যের কথা প্রবাদ-বাক্যে পরিণত হয়েছিল। ‘বারোশো বামুনের তেরোশো আড়া, তার নাম কাশ্যপপাড়া’–-একটি অংশের পরিচয় থেকেই বাকি কোটালিপাড়া সম্বন্ধেও মোটামুটি একটা ধারণা মিলবে। কারণ প্রায় সব কোটালিপাড়া জুড়েই রয়েছে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের বাস। লক্ষাধিক লোকের বাসভূমি এ পরগনায় লক্ষ শিবের পুজো হত বলে কাশীতুল্য স্থান হিসেবে এর ছিল ব্যাপক প্রসিদ্ধি। নবদ্বীপ, বিক্রমপুর, ভাটপাড়া–বাংলার ব্রাহ্মণ্যবিদ্যার এই মুকুটমণিদলের মধ্যে কারও চেয়ে ন্যূন নয় আমাদের কোটালিপাড়ার স্থান।

এ অঞ্চলে এক-একটি দেবস্থান গড়ে উঠেছে এক-একটি গ্রামের কেন্দ্র-পীঠরূপে। সিদ্ধান্তের খোলার বহুবিশ্রুত চড়কপুজোর কাহিনি যে কত পুরোনো তা জানা নেই। অনেক অলৌকিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই চড়কপুজোর সঙ্গে। ভয়ে ও শ্রদ্ধায় এ এলাকার মুসলমানেরাও চড়কঠাকুরকে প্রণামি দিয়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করে আসছে চিরকাল। হরিণাহাটি ও পশ্চিমপাড়ার কালীবাড়ির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে অনেক পুরোনো কথা। মদনপাড়ের গোবিন্দের, সিদ্ধান্তবাড়ির বুড়ো ঠাকুর, রতালের মনসাদেবী, সিদ্ধেশ্বরী মাতা ও লক্ষ্মী নারায়ণের বিগ্রহও সমধিক প্রসিদ্ধ।

একেবারে ছোটেবেলা থেকেই রতালের মনসাদেবী সম্বন্ধে কত গল্প শুনে আসছি। জনপ্রিয় দেব-দেবীর মধ্যে বাংলাদেশে মনসাদেবী নাকি একেবারে জাগ্রত। রঘু গাইনের নাম আজও কোটালিপাড়ার লোকের মুখে মুখে। এক সময় ফরিদপুরে সর্বত্র মনসার গান গেয়ে বেড়াতেন ইনি সদলবলে। সে প্রায় শ-দুই বছর আগেকার কথা। প্রত্যাদেশে মনসা পেয়ে যে দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রঘু গাইন তাই আজ রতালের মনসাদেবী নামে খ্যাত। আদিষ্ট গীতাবলি অবলম্বনেই মনসার গান গাইতেন রঘু গাইন। অনেক অভূতপূর্ব ঘটনার কথা প্রচলিত আছে এই দেবী ও তাঁর ভক্ত রঘু গাইন সম্বন্ধে। ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে আশ্বিনের ঝড়ে রতালের গাইন বাড়ির সব ঘর ধুলিসাৎ হলেও যে ঘরে মনসার চামর ছিল সে ঘরখানি ঠিক দাঁড়িয়েই ছিল। আশ্চর্য ঘটনা বই কী। কিন্তু আজ যে সেই মনসাদেবীর চামর নিয়েই রঘু গাইনের বংশধরগণকে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা প্রবাসী হতে হল, অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া তাকে আর কী বলব? রঘু গাইনের প্রপৌত্র, রমাকান্ত গাইনের সময়ে এক রাত্রিতে নাকি ডাকাত পড়েছিল তাঁদের বাড়িতে। কিন্তু মনসাদেবী যে বাড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী ডাকাতের ক্ষমতা কী যে সে বাড়ির কোনো ক্ষতি করবে? নাগকুল নাকি এমনি ভাবে ঘিরে রেখেছিল বাড়ির চারদিকের সীমানা যে, দস্যুদল সাপের ‘ফোঁস ফোঁস’ শব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আর সাহস পায়নি। এ অনেককাল আগেকার কথা। রঘু গাইনের মনসাভক্তি সম্বন্ধে ছোটোবেলায় একটি অদ্ভুত কাহিনি শুনেছিলাম। সেই অলৌকিক ঘটনার কথা আজও মনে পড়ছে। ফরিদপুর জেলার বাইটামারি গ্রামে কোনো এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে এক নবজাতকের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে হয়েছে মনসা পুজো। মনসা ভাসানের গান গাইবার জন্যে আমন্ত্রণ হয়েছে দুটি বিখ্যাত দলের। তার মধ্যে একটি হল রঘু গাইনের দল। গাইনের দল আসতে একটু দেরি করে ফেলায় ধনী গৃহস্থামী এতটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন যে, তাঁদের গানের আর প্রয়োজন নেই বলেই জানিয়ে দিলেন তিনি। আর কোনো উপায় না দেখে, ফিরে যাওয়ার আগে মনসাদেবীকে একবার প্রণাম জানিয়ে যেতে চাইলেন রঘু গাইন। প্রার্থনা মঞ্জুর হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশও দেওয়া হল যে, কৃত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তাঁকে পশ্চার্দিক থেকে দেবীকে প্রণাম করতে হবে- আসরে ঢুকে সম্মুখ থেকে তাঁকে প্রণামের অধিকার দেওয়া হবে না। তাতেই রাজি হলেন রঘু। মন্ডপের পেছনে গিয়ে গানের সুরে প্রণাম জানালেন তিনি দেবীকে। অপূর্ব তন্ময়তা সে গানে। সমবেত জনতা যখন সে সুরের মূর্ঘনায় বিভোর সেই অবকাশে কখন যে দেবী প্রতিমা ঘুরে গেছে পেছন দিকে কেউ তা লক্ষই করেনি। যখন চোখে পড়ল, তখন সে কী শোরগোল! শেষপর্যন্ত উলটো দিকেই দেবীর সামনে নতুন করে আসর বসিয়ে রঘু গাইনের মনসা ভাসানের গান শুনতে হল সবাইকে! কঠোর বাস্তবের আঘাতে বিপর্যন্ত আজকের বাঙালি দেব-দেবীর এসব অলৌকিক কাহিনি কী করে বিশ্বাস করবে?

তালতলা ভজন কুটিরের হরিসভার কথা মনে পড়ে। প্রতি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাশুভ্র সন্ধ্যায় বসত সেখানে ভাগবতপাঠের আসর। ভক্তিযুক্ত মন নিয়ে কত পল্লিবাসী নর-নারী আসত সেখানে কৃষ্ণ-কথা শুনতে, আমিও যেতাম। সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরেও দেখেছি অজস্র লোক সমাগম হত বার্ষিক উৎসবে, শিবচতুর্দশী ও কালীপুজো উপলক্ষ্যে। রতালের মহাশক্তি আশ্রমে লোকেদের ভিড় লেগেই থাকত। আমাধ্যক্ষ আচার্য বরদাকান্ত বাচস্পতি জ্যোতিষ ও তন্ত্রশাস্ত্রে সুপন্ডিত। এঁর জ্যোতির্বিদ্যায় মুগ্ধ হয়ে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এসে আপদে বিপদে জড়ো হত সেখানে। বাস্তবিকপক্ষে মহাশক্তি আশ্রম কোটালিপাড়ায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলনক্ষেত্র। শুধু বাংলা দেশের নয়, ভারতের দূরান্তবর্তী অঞ্চল থেকেও অনেক লোককে আসতে দেখেছি এ আশ্রমে জ্যোতিষী মাহাত্মের ফলোভের জন্যে। বাচস্পতি মশায়ের গণনা সম্বন্ধে কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প রয়েছে তারও শেষ নেই। শুধু গণনাকার্যের জন্যেই নয়, ভজনকীর্তনে, কাঙালি ভোজনে, অতিথিসেবায় সর্বদাই থাকত এ আশ্রম মুখরিত। রতালের মনসাবাড়ি নামেও খ্যাত ছিল এ বাড়ি। আশ্রমমাতা জ্ঞানদাদেবী প্রসাদবিতরণে, দরিদ্রনারায়ণসেবায় ছিলেন অন্নপূর্ণারূপিণী। পঞ্চাশের মন্বন্তরে কত হিন্দু মুসলমানের যে প্রাণরক্ষা হয়েছে এই আশ্রমমাতার কৃপায় গ্রামবাসীরা কি সে-কথা ভুলতে পারে! কিন্তু তবু এঁদের সবাইকে চলে আসতে হয়েছে প্রিয় গ্রাম ছেড়ে। শুনেছি সেই মহাশক্তি আশ্রম উঠে এসেছে কলকাতা পাইকপাড়ায়। সেখানে নাকি লোকের ভিড়ের অন্ত নেই, শ্রীশ্রীনারায়ণ ঠাকুরের দর্শনার্থী সেখানে আসে দলে দলে। কিন্তু কোটালিপাড়ার সেই পরিবেশ পাওয়া কি সম্ভব কলকাতায়? আমার গাঁয়ের হরিসভায় আর ভাগবতপাঠের আসর বসে না, সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে আর হয় না উৎসব আয়োজন!

কত মহাজ্ঞানী ও গুণীজনের আবির্ভাবে ধন্য আমার কোটালিপাড়া। আবার কি আমরা ফিরে যেতে পারব না সেখানে? পথহারা হয়েও পথ চলতে চলতে তার আকুল আহ্বান সব সময়ই তো শুনতে পাই, কিন্তু তার ডাক শুনেও পা এগোতে চায় না কেন সেদিকে? আজও কি পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত হয়নি আমাদের পাপের? আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই কোটালিপাড়ার অতীতকে স্মরণ করে। বেদান্ত শাস্ত্রে আচার্য শঙ্করতুল্য মহাপন্ডিত স্বর্গীয় মধুসূদন সরস্বতী জন্মপূত ঊনশিয়া কোটালিপাড়ারই অন্তর্গত। মধুসূদনের পান্ডিত্যের তুলনা বিরল। তাই তো কাশীর পন্ডিতসমাজে আজও প্রচলিত প্রশস্তিবচনে বলা হয়েছে তাঁর সম্বন্ধে,

মধুসূদন সরস্বত্যা পারং বেত্তি সরস্বতী।
পারং বেত্তি সরস্বত্যা মধুসূদন সরস্বতী।।

মধুসূদন সরস্বতীর বিদ্যার পরিমাণ স্থির করা একমাত্র দেবী সরস্বতীর পক্ষেই সম্ভব এবং একমাত্র মধুসূদন সরস্বতীই দেবী সরস্বতীর জ্ঞানপরিধির পারংগম। বিদ্যাদায়িনী সরস্বতীর সঙ্গে যার তুলনা করেছেন কাশীর পন্ডিতসমাজ তাঁর জন্মস্থানের লোক আমরা আজ গ্রাম মায়ের কোলছাড়া হয়ে অজ্ঞান অববাধের মতো ঘুরে বেড়াই চরম অসহায়তায়। মধুসূদন রচিত ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ অদ্বৈত বেদান্তের প্রামাণিক গ্রন্থরূপে ভারতের সর্বত্র প্রসিদ্ধিলাভ করেছে। এবং ভারতের বাইরেও রয়েছে মধুসূদনের গুণমুগ্ধ বহু দার্শনিক পন্ডিত। নবদ্বীপ পাকা টোলের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ও পরে কাশীরাজের বৃত্তিভোগী কাশীবাসী প্রসিদ্ধ বৈদান্তিক ও নৈয়ায়িক স্বর্গীয় জয়নারায়ণ তর্করত্ন, জয়পুর রাজ কলেজের প্রাক্তন ন্যায়াধ্যাপক স্বর্গত কালীকুমার তর্কতীর্থ প্রমুখ পন্ডিতেরাও ছিলেন ঊনশিয়ারই অধিবাসী। বাস্তবিকপক্ষে কোটালিপাড়ার প্রধান গৌরব পন্ডিতস্থান হিসেবেই। এ অঞ্চলের পন্ডিতদের মধ্যে আজও যাঁরা জীবিত রয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে ব্যাসকল্প মহাপন্ডিত মহামহোপাধ্যায় ভারতাচার্য হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের কথা। ইনি আজ স্থানান্তরে একক সাধনায় মহাকায় মহাভারত রচনায় নিমগ্ন। পশ্চিমপাড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কোটালিপাড়ার প্রথম মহামহোপাধ্যায় পরলোকগত রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন ও প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক স্বর্গীয় শশীকুমার শিরোরত্ন। প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ স্বৰ্গত রাধারমণ রায় এবং বর্তমান যুগের ভারতখ্যাত অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরশিল্পী তারাপদ চক্রবর্তীও (নাকুবাবু) এ গ্রামেরই ছেলে। আধুনিক শিক্ষায় সুপন্ডিত রাজনীতিবিদ ডা. ধীরেন্দ্রনাথ সেনের বাড়ি ছিল দিঘির পাড়ে এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক চপলাকান্ত ভট্টাচার্যের গ্রামও কোটালিপাড়ারই মদনপাড়। বাঙালি শিল্পপতিদের অন্যতম স্বৰ্গত কর্মবীর সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন হরিণহাটিতে। কোটালিপাড়াকে বড়ো করার, সমৃদ্ধ করার কত পরিকল্পনা ছিল তাঁর! রতালে জন্মেছিলেন সুপন্ডিত ও সুগায়ক-কথক রঘুমণি বিদ্যাভূষণ এবং জ্যোতির্বিদ গোপাল মিশ্র। তাঁরা উভয়েই দেহরক্ষা করেছেন দীর্ঘকাল আগেই কিন্তু তাঁদের দেহই শুধু নয়, তাঁদের কীর্তিধন্য নামও যে জড়িয়ে আছে আমার গাঁয়ের সোনার মাটির সঙ্গে!

সমগ্রভাবে ব্রাহ্মণপ্রধান হলেও কোটালিপাড়ার কাসাতলী, গোয়ালঙ্ক, পিঞ্জুরী প্রভৃতি কয়েকটি জনপদ বৈদ্যপ্রধান এবং আধুনিক শিক্ষায় ও প্রগতির ক্ষেত্রে এঁরা অগ্রণী।

সাত সাতটি হাট, দুটো দৈনিক বাজার, চারটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, দুটো সংস্কৃত কলেজ, দশ-বারোটি টোল, এবং তার ওপর থানা, ডাকঘর, সাবরেজেস্টারি অফিসে সবসময় জমজমাট থাকত আমার সাধের কোটালিপাড়া। আর আজ? এখন নাকি সরকারি অফিস ছাড়া একটি বাজার, দুটি হাট ও একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় কোনোরকমে অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করছে বিদির্ণ কঙ্কালের মতো। সংস্কৃত শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ছিল যার আসল পরিচয় সেখানে আজ একটিও টোল নেই, একজনও অধ্যাপক নেই–কোটালিপাড়ার মানুষ আমরা ভাবতেও যে পারি না সে-কথা!

আজ কত স্মৃতি জাগে মনে। বড়ো বড়ো পুজোপার্বণের কথা নাই বা বললাম! আমার গাঁয়ের মেয়েরা-মায়েরা মিলে বছরের পর বছর মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করেছে সারাবৈশাখ মাস ধরে –প্রতিমঙ্গলবারে। তাঁদের সমস্ত মঙ্গলকামনার প্রতিদানে ঘোর অমঙ্গলের অন্ধকারে কেন আমাদের ঠেলে দিলেন মা মঙ্গলচন্ডী? তবে এই চরম অঙ্গলকে অতিক্রম করেই পরমমঙ্গলের সন্ধান পাব আমরা? ছোটোবেলায় আমার দু-বোনকে দেখেছি তারাব্রত করতে। তাদের মতো তাদের সমবয়সি মেয়েরাও করত এ ব্রত পালন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। কত আকাঙ্ক্ষা কত আকুতিই না প্রকাশ পেত ব্রতচারিণীদের উচ্চারিত ছড়া-মন্ত্রের কলিতে কলিতে। পৌষ সংক্রান্তি থেকে মাঘ মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্তও চলত এই ব্রতচার। পরিষ্কার উঠোনে আঁকা হত কত সুন্দর আলপনা। সে অলপনার ঘরে দাঁড়িয়ে তারা-বন্দনার গান গাইত আমার দু-বোন ছড়া কেটে কেটে। কী মিষ্টিই না লাগত তা শুনতে আর কী অপূর্ব পরিবেশই না সৃষ্টি হত শীতের সন্ধ্যায়! আজও মনে পড়ে গভীর মনোযোগ দিয়েই আমি শুনতাম তারাব্রতের মাহাত্ম-কথা আমার বোনেদের মুখে। তারা সুর করে বলত,

তারা পূজলে কী বর পায়?
ভীম অর্জুন ভাই পায়,
শিবের মতো স্বামী পায়,
কার্তিক গণেশ পুত্র পায়,
লক্ষ্মী সরস্বতী কন্যা পায়,
নন্দী ভৃঙ্গী নফর পায়,
জয়া বিজয়া দাসী পায়।
তারা পূজি সাঁজ রাতে,
সোনার শাঁখা পরি হাতে।

হায়, এত বর লাভের প্রত্যাশা সত্ত্বেও আমার পুববাংলার মা বোনেদের আজ কী হাল? তাদের ব্রত, তাদের সমস্ত শুভকামনা কবে সার্থক হবে? কবে আমরা আবার সগৌরবে গিয়ে ঘর বাঁধব আমাদের পুববাংলায়?

.

রামভদ্রপুর

যে দেশের জন্যে আমি হা-হুঁতাশ করছি সে দেশ আজ আর আমার নয়! স্বভূমি, স্বদেশ আজ আমার পরভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দেশে জন্মেছি, যে দেশের ধূলিকণা আমার শরীর গড়েছে, যে দেশের নদীর জল, গাছের ফল আমাকে এত বড়োটি করেছে সে দেশের ওপর আমার আজ কোনো দাবিই নেই ভেবে মনটা হু হু করে উঠছে। ফুল না ফুটতেই ফুল ঝরাবার খ্যাপামি এল কী করে বুঝতে পারি না হাজার চেষ্টা করেও। হয়তো এই অবস্থাটিকেই রূপ দেওয়ার জন্যেই কবিগুরু লিখেছেন,

‘কোন সে ঝড়ের ভুল,
ঝরিয়ে দিল ফুল
প্রথম যেদিন তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল।। হায় রে!
নবপ্রভাতের তারাসন্ধ্যাবেলা হয়েছে পথহারা।…
…হায় গো দরদি কেহ থাক যদি শিরে দাও পরশন।
এ কি স্রোতে যাবে ভেসে দূর দয়াহীন দেশে
কোনখানে পাবে কূল। হায় রে!’

সত্যি, প্রথম যেদিন এই মকুলমাধুরী মেলেছিল সেইদিনই উঠল জীবনসমুদ্রে ঝড়! সারাবেলা বীণার সুর বাঁধতে গিয়ে কঠিন টানে কেঁদে উঠে ছিন্ন তার যেন রাগিনী দিল থামিয়ে। জীবনের ছন্দে প্রস্তুত হতে গিয়ে ভাগ্যে ঘটল নির্বাসন। আজ মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের এই নির্বাসন দন্ড হল কোন দোষে? নবপ্রভাতের তারা সন্ধেবেলায় পথহারা হল কেন? বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রুপে আজ আমরা সর্বহারা’ নামে পরিচতি। সর্বত্র নাসিকাকুঞ্চন ছাড়া অন্য পুরস্কার তো কপালে জুটল না! অবাঞ্ছিত হয়ে আর কতকাল আত্মার অবমাননা করব? স্রোতে কি বৃথাই যাব ভেসে, কূলে তরি কি কোনোদিনই লাগবে না? এই পথের ধার থেকে তুলে কোন দরদি মানুষ গৃহে দেবে স্থান তা জানি না!

নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার গ্রাম রামভদ্রপুরের কথা। মরুভূমির মাঝখানে নামটি যেন মরুদ্যানের শান্তির প্রলেপ এনে দেয় মনে। মাদারিপুর মহকুমার অধীনে, মেঘনার এক অখ্যাত শাখানদীর পশ্চিমে নতমুখে সহস্র লাঞ্ছনা মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে আমার জন্মভূমি রামভদ্রপুর। আজ মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে আমার গ্রামের ডাক শুনি; আমাদের ফিরে যাওয়ার জন্যে যেন আকুল মিনতি করছে সে। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হয় না, আমার দেশজননী আমাদের কোলে টেনে নেবেন ভেবে মন নেচে উঠছে পেখম তুলে। যাব, নিশ্চয়ই যাব আমরা ফিরে মায়ের কোলে। আমরাও তত দিন গুনছি আশাপথ চেয়ে। আবার আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে গলা জড়িয়ে সুখ-দুঃখের গল্প করব আগের দিনের মতো।

মনে পড়ছে আমাদের গ্রামের বাজারের কথা। নদীর ধারে বসত বাজার। এই বাজারে হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে কেনাকাটা করত জিনিসপত্র। দোকানপাটগুলো ছিল মানুষের যেন মিলনতীর্থ, সবাইকে বেঁধে রেখেছিল বন্ধুত্বের সুতোয় একত্রে। কেরামতের মশলার দোকানের খরিদ্দার ছিলাম আমরা, আবার বিখ্যাত হরলালবাবুর দোকানে রিয়াজদ্দি, দিনালি, মোবারক মুনশি আড্ডা দিত দিনরাত। সম্প্রদায় হিসেবে দোকান নির্বাচনের জঘন্য মনোভাব কোনোকালেই আমাদের ছিল না। মনে পড়ছে মাছ কেনার সময় ঠোঙার প্রয়োজন হলে অকুতোভয়ে চলে যেতাম কেরামতের দোকানে। একদিনের জন্যেও তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। আবার অন্য দিকে, রিয়াজদ্দির কোনোদিন তরকারি বিক্রি না হলে সোজা সে নিতাই কুড়ির দোকানে বা হরলালবাবুর মুদিখানায় গিয়ে ডালাভরতি তরকারি রেখে দিত পরের দিন বিক্রি করার আশায়। বেতের ডালাখানি চৌকির নীচে রাখবার সময় সে হয়তো মুচকি হেসে কোনো কোনো দিন বলত—’কর্তা, থুয়ে গেলাম ডালাটা। আপনার তরকারির দরকার নাই? লাগে তো কন থুইয়ে আসি বাড়িতে। পয়সা হেইটা কাইল দিবেন কর্তা।’ গ্রামবাসীর ওপর গ্রামবাসীর এই যে সহজ বিশ্বাস, সে বিশ্বাসের গলা টিপল কে?

বর্ষাকালে বাজারে যাওয়ার পথে জল উঠত জমে। গ্রামের লোকজন তখন ভাসিয়ে দিত নৌকার শোভাযাত্রা। যারা কষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার দুঃসাধ্য চেষ্টা করত তাদের ডেকে মুসলমান ভাইরাই আত্মীয়তার সুরে বলত,–‘কর্তা গো যাইতে কষ্ট হইব–নৌকা যোওন লাগে।’ মনে পড়ে ছোটোবেলায় দুষ্টুমি করে দলবেঁধে তাদের নৌকো চেপে পাড়ি দিতাম অন্য গ্রামের দিকে সকলের অজ্ঞাতে। কখনো বা নৌকো দিতাম ভাসিয়ে স্রোতের মুখে। নৌকার মালিক ঘাটে নৌকা না দেখে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াত এদিক-ওদিকে। কিন্তু এজন্যে তাদের মুখ মলিন হতে কোনোদিন দেখিনি, নৌকো খোঁজার পরিশ্রম কোনোদিন তাদের অসহিষ্ণু করে তোলেনি।

পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথে মুসলমানেরা যখন মাথায় তরকারির বোঝা আর হাতে দুধের হাঁড়ি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠত তখন আমি, কুমুদ, মাখন, সতীশ প্রভৃতি ছেলেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাদের মোট নিজেদের মাথায় তুলে নিয়ে সাহায্য করেছি। বাবুদের সাহায্য করতে দেখে তারা সভয়ে কত সময় দ্বিধাজড়িত গলায় বলেছে—‘এটা করেন কী কর্তা, আমিই নিতে পারুম’ এইভাবেই চলে এসেছে আমার গ্রামের দৈনন্দিন জীবন। সেদিনের সরল সহজ জীবন কি আমরা চেষ্টা করলে আবার ফিরে পেতে পারি না?

বাজারের পাশেই ছিল মধ্য ইংরেজি স্কুল। সামনে ছোটো মাঠ, তার পরেই মেঘনা নদীর শাখার উত্তালতরঙ্গমালা যেন সমস্ত বাধাবিপত্তিকে চূর্ণ করে কূলে এসে আছড়ে পড়ার সাধনায় ব্যস্ত। লাল-নীল-বাদামি-হলুদ পাল তুলে চলে নৌকার ঝাঁক,–দূর থেকে ময়ূরপঙ্খি বলে ভুল হয়। হয়তো এপার দিয়ে পাট বোঝাই নৌকা তিন হাজার মন মাল নিয়ে চলেছে। গুণ টেনে। মাঝিদের পেশিবহুল কালো কালো শরীর বেয়ে ঝরছে স্বেদধারা। গুণ টানার পরিশ্রমে পিঠের শিরগুলো উঠছে ফুলে। পরিশ্রমও যে মানুষকে সময় সময় কত মনোরম করে তোলে তার পরিচয় আমরা সেদিন পেয়েছি। মাঝিদের লোভনীয় স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিজেদের ক্ষীণ শরীর মিলিয়ে কত সময় লজ্জিত হয়েছি মনে মনে।

গ্রামের ধনী ঈশানচন্দ্র দে মশায়ের ছেলে ললিতমোহন দের অর্থে তৈরি হয়েছিল আমাদের গ্রামের মধ্য ইংরেজি স্কুলটি। টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বা বাড়ি, সমস্ত গ্রামের বিদ্যাবিতরণ কেন্দ্র। নীচের ক্লাসে আমার সঙ্গে পড়ত আকুবালী আর ফজলুল বলে দুজন সহপাঠী। তিনজনের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকার দরুনই হয়তো আমরা তিনজনের বন্ধুত্বের ত্রিভুজ গড়ে ছিলাম সেদিন। ওদের ফুলকাটা সাদা টুপি, আর রঙিন ভেলভেটের ফেজ দেখে কত সময় মন খারাপ করে ঘরের এককোনায় বসে থেকেছি–আমাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ওরা কত সাধ্যসাধনা করেছে কারণ নির্ণয়ের জন্যে। পরে কারণ জানতে পেরে হেসে নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের টুপি দিয়েছে আমার মাথায় চড়িয়ে। মুহূর্তে মনের মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দিত হাসির সূর্ব। তাদের টুপি মাথায় দিয়ে তাদেরই সঙ্গে খেলা করেছি কতদিন। কিন্তু আজ? জাতিভেদের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে আর পারবে কেউ এমনভাবে অন্যের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্যে নিঃস্বার্থ ত্যাগ করতে?

মনে পড়ে আকুবালী আমাদের বাড়ি এলে মা ওকে আম, কলা, দুধ দিতেন বাটি ভরে। আকুবালী আকণ্ঠ ভোজন করে স্বহস্তে বাটিটি ধুয়ে রাখত বারান্দায়। বারণ করলেও শুনত না। জানি না কোথা থেকে আকুবালী শিখেছিল এ ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলা! আমাদের খাওয়ার সময়েই হয়তো কোনো কোনোদিন এসে পড়েছে করিমচাচা কিংবা জয়নাল। থপ করে চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ে আকুবালীর দিকে রাগত দৃষ্টি হেনে বলেছে—’তুই তো খাইয়া লইলি পেটটা ভইরা, আমরা পেটটা ভরুম না? দেননা মাঠাইন দুইটা আম খাইয়া লই। কর্তাগো সিন্দুইরা গাছের আমগুলা বড়ো মিষ্টি!’ কত আনন্দ করেই না মা খাওয়াতেন তাদের। আজও হাসি পায় তাদের ভোজনপর্বের দৃশ্যটা মনে পড়লে। আগ্রহ ভরে চেটে চেটে আম খাওয়ার ঢং দেখলে মনে হত যেন বহুদিন থেকে ওরা উপবাসী! খাওয়ার পরেই কলকেতে ভরে নিত তামাক।

এই যে সামাজিক হৃদ্যতা সেদিন দেখেছি তার মৃত্যু হল কোন চক্রান্তকারী ডাইনির মন্ত্রে? মানুষ মানুষকে কেন আজ এড়িয়ে চলছে পশুর মতো? আমরা কি স্বার্থপরতা, নীচতা, শঠতা ভুলে গিয়ে আবার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারি না? সাধারণ মানুষ কেন হিংস্র হবে, কেন মানবীয় গুণগুলোকে বিসর্জন দিয়ে পরের ক্রীড়নক হয়ে উঠবে? কাকে ছেড়ে কার চলে সংসারে? আবার কি আমরা মানুষ হতে পারব না, একত্রে মিলেমিশে থাকতে পারব না?

প্রতিবৎসর বাসন্তি পুজো হত আমাদের বাড়িতে। এ পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের ধনী-মানী জ্ঞানী-গুণীর নিমন্ত্রণ তো হতই, সেই সঙ্গে নিমন্ত্রণ হত সমস্ত গ্রামবাসীর। এ উৎসবে দেখেছি আমাদের চেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল মুসলমান ভাইরা। এই দিনটির জন্যে তারা উদগ্রভাবে প্রতীক্ষা করে থাকত বছরের প্রথম দিন থেকে। তাদের আগ্রহে পুজো যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। তারাই সংগ্রহ করে আনত বলির মোষ। নিয়ে আসত চাঁদপুর থেকে মালপত্র সুশৃঙ্খলভাবে। পুজোর ঢাকের আওয়াজে সমস্ত গ্রামখানি হয়ে উঠত জীবন্ত, বহুদূর থেকে ঢাকের শব্দ শুনে লোক আসত ছুটে। এ পুজোকে প্রত্যেকে নিজের বলে গ্রহণ করায় সেদিন কোনোরকম গোলযোগই দেখা দিত না গ্রামে। গ্রামবাসীদের মধ্যে আত্মীয়তাপূর্ণ ব্যবহারই সমস্ত জিনিসটিকে করে তুলত মধুময়।

আমাদের বাড়িতে থাকত জংগু ঢালি আর এলাহিবক্স। তারা বাগান তদারক করত, কাঠ চিরত, নৌকা বাইত-বলতে গেলে কঠোর পরিশ্রমের সব কাজগুলোই তারা সমাধা করত বিনা বাক্যব্যয়ে। সকালবেলা একগামলা পান্তাভাত খেয়ে লেগে যেত কাজে। ভাত খাওয়ার ব্যঞ্জনও ছিল তাদের কত অনাড়ম্বর–একটি পেঁয়াজ আর একগন্ডা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে এত নির্বিবাদে এত ভাত খাওয়া যেতে পারে তা এলাহিবক্সদের খাওয়া না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না! জীবনযাত্রা এত সরল ছিল বলেই তাদের পক্ষে সবই সেদিন ছিল সম্ভব, কিন্তু আজ আর সেদিন নেই। বিলাসের ফাঁসে পড়ে সকলেই হয়ে উঠেছে বিলাসী, এখন সারল্য তাই হয়েছে বিতাড়িত। আগে যারা কর্তাবাড়ির প্রসাদ পেয়েই নিজেদের মনে করেছে ধন্য, আজ তাদের মনোভাব অন্য ধরনের। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে আম কুড়োনোর ছবি। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বাগানে আম কুড়োতে গেলে জংগু আর এলাহিবক্স কত সমাদর করে আমাদের হাতে আম দিত তুলে। বাগান জমা দেওয়া সত্ত্বেও তারা আপনা থেকে কোনোদিনও একটি আম নেয়নি, সমস্ত আম পৌঁছে দিয়েছে আমাদের বাড়িতে। কর্তামা বা বাড়ির অন্য কেউ ডালায় ভরে যে কটা আম তাদের দিতেন তাই বাড়ি নিয়ে যেত তারা হাসিমুখে পরমপরিতৃপ্তির সঙ্গে। ডালা কাঁধে তুলতে তুলতে বরঞ্চ কৃতার্থ হয়ে বলত, ‘পোলাপানেরে থুইয়া আমি একলা খামু কেমন কইরা, আপনাগো দয়াইত তবু পোলাপানরা আম জাম খাইতে পায়।’ একথা কি বঞ্চিতের কথা? আজ ভারাক্রান্ত মনে ভাবি সময় সময় মানুষের সৌহার্দ্যবোধ কেন নষ্ট হল? আমাদের আত্মীয়তাবোধ কি তাহলে চোরাবালির ওপর ছিল প্রতিষ্ঠিত, না হলে, তা এমন অতলতলে তলিয়ে গেল কী করে হঠাৎ?

মনে পড়ে আমাদের বাড়ির সর্বজনীন তামাক খাওয়ার দৃশ্যের কথা। ঘরের বারান্দায় থাকত তামাকের সাজসরঞ্জাম। বাজারের পথে বাড়ি হওয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা ভিড় থাকত লেগে। যে কেউ তামাক খেত, তার শাকরেদ হত জংগু আর এলাহি। বিনামূল্যে এই সামান্য তামাকের আকর্ষণ ছিল অদ্ভুত, যতক্ষণ ধোঁয়া না পেটে পড়ত ততক্ষণ সবাই যেন স্থবির হয়ে বসে থাকত গোলাকার হয়ে! বিদেশি পথিকরাও শ্রমলাঘবের জন্যে এখানে ক্ষণিকের জন্যে না বসে যেতে পারত না। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি সেদিন নেশার কাছে সমস্ত জাতিভেদ হয়েছিল পরাজিত। সেটা ছিল মানুষের বিশ্রামাগার, ঘর্মক্লেদাক্ত দেহে রৌদ্রের খর তাপ থেকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যেই আত্মীয়তার সুর উঠত নিবিড় হয়ে বেজে। ধোঁয়ার অক্ষরে অক্ষরে সেদিন লেখা হত–’সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই!

শৈশবের কোমল মনে যে ছাপ একবার পড়ে তা হয়ে থাকে অক্ষয়। এখন হুবহু মনের মানচিত্রে সমগ্র গ্রামখানি জ্বলজ্বল করছে। মনে পড়ে বাজার থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে প্রশস্ত রাস্তাটি–তার দু-পাশে কুমোর, নাপিত, কামার ইত্যাদি নানা শ্রেণির বাস। আধ মাইল যাওয়ার পর ডাইনে বাঁয়ে বেঁকে গিয়ে গাঁয়ের দু-পাড়া এসে মিশেছে চৌমাথায়। এই মোড়টিই গ্রামের কেন্দ্রস্থল। ডাইনের রাস্তাটি মুসলমান পাড়ার বুক চিরে চলে গেছে কার্তিকপুর পর্যন্ত, বাঁয়ের রাস্তা গেছে গ্রামের উচ্চশ্রেণির বাবুমশায়দের পাড়া ছুঁয়ে। এই রাস্তার ওপরেই পড়ে মুন্সেফ সাহেবের বাড়ি, নাম ‘বাবুবাড়ি’। ঝাউগাছ সমন্বিত প্রশস্ত খোয়া বাঁধানো চওড়া রাস্তাটি বাবুবাড়ির আভিজাত্যের পরিচায়ক। সেদিন ঝাউগাছের বুক থেকে সোঁ সোঁ শব্দ করে যে হাওয়া যেত ছুটে আজ সে শব্দ শুনলে মানুষের আর্তনাদ বলেই ভুল হবে! মনে হবে সহস্র দুঃখ-দুর্দশায় বুক ফাটানো আর্তনাদ ফেটে পড়ছে ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে। জানি না মুন্সেফ সাহেব সে দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়েছেন কি না! রাবণের চিতাগ্নির মতো এই যে মনের আগুনের আর্তস্বর অহর্নিশি শব্দায়িত হচ্ছে এর শেষ কোথায়?

এখানেই পুজোর সময় হত থিয়েটার। থিয়েটারের জন্যে সমস্ত গ্রামবাসীরাই উদগ্রীব হয়ে দিন গুনত, চাঁদা তুলত, হাতে লিখে প্রোগ্রাম তৈরি করত। পুজোর ছ-মাস আগে থেকেই সিনগুলো নতুন হয়ে ঝলমলিয়ে উঠত। গ্রামের চিত্রকর মল্লিকমশায় ছিলেন এই দৃশ্যপট সজ্জার পান্ডা। তিনি দৃশ্যপটে আঁকতেন। রামভদ্রপুরেরই গ্রাম্য ছবি। আমার গ্রামের ছবি ড্রপসিনের গায়ে কী চমৎকার লাগত তা আজ ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।

পুজোর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে মহীসারের বৈশাখী মেলার কথা। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে সাত দিন সে মেলা হত স্থায়ী। আমরা গুরুজনদের কাছ থেকে পৃথক পৃথক ভাবে পয়সা জমিয়ে মেলা দেখতে যেতাম হইহুল্লোড় করে। চৈত্র সংক্রান্তিতে সুদূর হাটখোলার একমাইল উত্তরে সারাদিন মেলায় কাটিয়ে বাড়ি ফিরতাম ক্লান্ত চরণে। হাতের পুঁটলিতে বাঁধা থাকত পুতুল, বাতাসা, কদমা, জিলিপি, বাদামভাজা ইত্যাদি লোভনীয় বস্তুসম্ভার। মহীসারের মেলাতে রবারের বল, মাটির গণেশ আনতেই হবে এই ছিল আমাদের নিয়ম। সেসব দিন কি আমাদের জীবনে আর ফিরে আসবে না? এই মেলা উপলক্ষ্যে আমাদের গ্রামে বাইচ খেলা ছিল প্রধান আকর্ষণ। শান্ত মেঘনার শাখানদীতে বাইচ খেলা সেদিন সমস্ত গ্রামবাসীকে উদ্দীপনা দিয়েছে তার তুলনা পাওয়া ভার। নদীর তীরে একটা দীর্ঘ বাঁশে পেতলের একটি কলসি থাকত ঝুলানো। বাইচ আরম্ভ হলে দ্রুত নৌকো চালিয়ে যে প্রতিযোগিতায় জিতে ওই কলসি নিতে পারবে তারই শ্রেষ্ঠত্ব সকলে নিত স্বীকার করে। চক্ষের পলকে তীব্র গতিতে নৌকোগুলো সব হয়ে যেত অদৃশ্য। নদীর বুকে কালো কালো বিন্দু যেন ছুটে চলেছে, সহস্র চোখে তারই দিকে তাকিয়ে থাকত অজস্র মানুষ। উৎসাহের বাষ্পে ফেটে পড়া সে মানুষের আজ এ কী অবস্থা! যারা একদিন আনন্দকেই জেনেছিল জীবন বলে, আজ তারা উলটো পথের পথিক হল কেন? উপনিষদ বলছে যে আনন্দ থেকেই মানুষের জন্ম, আনন্দের মধ্যেই তার লয়। কিন্তু আমরা তো তার প্রমাণ পেলাম না! আনন্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও আনন্দের মধ্যে তো বিদায় নিতে পারলাম না। তবে কি স্বর্গ থেকে এ বিদায় ক্ষণস্থায়ী? আবার আমরা আনন্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হব? মহাজন বাক্য তো নিষ্ফল হয় না, অবিশ্বাসী আমরা সব সময় স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করতে পারি না বলেই অযথা দুঃখ পাই। উপনিষদ সত্য, উপনিষদ অভ্রান্ত, উপনিষদের কথা নিষ্ফল হতে পারে না। আবার আমরা মানুষ হব, আবার আমরা সুখী-স্বচ্ছল হব। একাগ্রমনে কান পেতে শুনুন, আকাশে বাতাসে উঠছে আনন্দের সুর। আনন্দের মধ্য দিয়ে আনন্দকে চিনে নেওয়াই কর্তব্য আমাদের।

.

কাইচাল

পুজোর ছুটি। ‘ঢাকা মেল’ ধরবার জন্যে ছুটে চলেছি। স্টেশন একেবারে জনারণ্য। তবু এ ভিড় অগ্রাহ্য করেই প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে রওনা হয়েছি। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ালদা থেকে ট্রেন বেরিয়ে গেল। কলকাতার আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে চলেছি। চেনা চেনা গ্রাম ও শহরের পাশ দিয়ে হু হু করে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছি। আমার গ্রাম আমাকে ডাকছে ফরিদপুর জেলায় কাইচাল আমার গ্রাম।

ট্রেন থেকে নেমে নৌকোঘাটায় গিয়েছি, অমনি শত কণ্ঠে চিৎকার হয়েছে—’কোহানে যাবেন কত্তা, এদিকে আসেন।’ যে নৌকোখানি দেখতে একটু ভালো, গেলাম তার নিকট। মাঝির নাম মৈনুদ্দিন, এই তার আসল পেশা আর এমন বিশ্বাসী সে যে, নৌকোয় কিছু ফেলে গেলেও ফিরিয়ে দিয়ে যায়, সুতরাং ভাড়ার প্রশ্নই উঠল না।

নৌকো চলেছে। নৌকোর বাইরে বসে আছি, সব দেখছি। মাঝি বললে,–‘কর্তা, ছইর মধ্যে যান রইদ লাগবে।’ অবসন্ন দেহ, তবু ঝিম ধরে বসে আছি, কী যে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। ফরিদপুরে ‘মাইজা মিয়ার খাল’ বিখ্যাত, তার মধ্যে নৌকো পড়েছে। মৈনুদ্দিন মাথাল নামিয়ে রেখে মাজার গামছা কষে নিল। চইরটাকে একটানে বের করে নিয়ে এক চিৎকার দিয়ে বলল, ‘যার যার হাতের বায়ে।’ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলাম, দেখি কিছু সাহায্য করতে পারি কি না। মৈনুদ্দিন দিল না, বলল—’আপনার নাগবে না, আপনি বসেন।’

নৌকো ছেড়ে দিলে, জিজ্ঞাসা করি কখন পৌঁছোতে পারব। সে বললে, সন্ধ্যাসন্ধি। পাট ভরতি, মুসুর ভরতি, আরও কতরকম পসরা ভরতি কত নৌকো ঝুপঝাঁপ শব্দে চলেছে নিকটবর্তী কোনো এক বন্দরের হাটে।

ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বুঝলাম এসে পড়েছি, তবে আশপাশে ছোটো ছোটো আরও গ্রাম রয়েছে, তাই আমার গ্রাম কতদূর তা বুঝতে পারছি না! মৈনুদ্দিন বলল,–‘এই তো কাইচালের বিল, এটা পার হলেই আপনাগো গ্রাম দেহা যাবেনে।’

কাইচাল গ্রামের বাবুদের বিল। এর অনেক ইতিহাস আছে। আশপাশে ভূত-পেতনি ঘোরে আর বিলের মধ্যে সিন্দুকের ঘড় ঘড় শব্দও নাকি অনেকে শুনেছে। ফইটকার খালের মুখে একটা ভ্যাসালের কাছে গেলাম। সনাতন মাঝির ভ্যাসাল, ওপরে সে আছে, একটা ছোটো হ্যারিকেন লণ্ঠন বাঁধা। মাছটাছ আছে নাকি সনাতন?’ বলতেই একখান চার-পাঁচ সের ওজনের নলা এবং সের আড়াই পরিমাণ টাটকানি দিল সে। বলল, ‘লইয়া যান, দাম এখন দেওয়া নাগবে না। খালের ভেতর দিয়ে একখানা মুসলমান গ্রাম পার হতেই কানে ভেসে এল দোতারার ক্ষীণ শব্দ, বুঝলাম আমাদের গ্রামের নাপিতপাড়ার প্রসন্ন শীল। এ তল্লাটে ও ছাড়া আর কেউ এ যন্ত্র বাজায় না। আর জানতাম কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রোজই ও দোতারা বাজায়। হঠাৎ ‘কাহার’ বাড়ির আলো দেখলাম, প্রশ্ন এল, ‘যায় কেডা?’ নৌকো গিয়ে ঘাটে লাগল।

গল্প শুনেছি যাতে বাইরের কোনো শত্রু কোনো হিন্দুর গ্রাম আক্রমণ করতে না পারে এইজন্যে এ তল্লাটের প্রায় প্রত্যেকখানি গ্রামই চতুর্দিকে মুসলমানদের দিয়ে ঘেরা। আমাদের গ্রামখানিও তেমনি। বহুপুরাতন গ্রাম, জমিদার প্রধান স্থান। কালীমন্দির শিবমন্দির, পুরোনো দিঘি, রামসাগর, শানবাঁধানো ঘাট ইত্যাদিতে তার সাক্ষ্য দেয়। বসু মজুমদারেরা পুরাতন বাসিন্দা। ছেলেগুলো উচ্চশিক্ষা পাওয়ায় সবাই প্রবাসী। তাই নাটমন্দিরের ওপরে উঠেছে বট পাকুড় গাছ, ভেতরে বাস করেছে কবুতর আর পেঁচা, তবু কিন্তু কোনো পুজো-অর্চনা বাদ যায় না।

প্রায় সমস্তরকমের জাতের বাস আছে এ গ্রামে। ভদ্র এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি থাকায় আশপাশের সমস্ত লোকের আচার-ব্যবহার ভদ্র। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত গৃহস্থের প্রায় সকলেরই ধানের গোলা, গাইগোরু এবং পুকুর আছে। তারপর প্রত্যেকখানি বাড়িই আম, নারিকেল, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছে ঘেরা; প্রত্যেকের সঙ্গেই যেন নিবিড় আত্মীয়তার বন্ধন। প্রত্যেকটি ঋতু উপভোগ করেছি পরিপূর্ণভাবে, কোকিলের কুহু কুহু রব, দোয়েলের শিস, পাপিয়ার তান। প্রকৃতিদেবী যেন আপন হাতেই সাজিয়েছেন গ্রামকে। উত্তর এবং দক্ষিণে প্রশস্ত মাঠ। শীতের দিনে দেখেছি পরিপূর্ণ যুবতীর ন্যায় মাঠখানি নানারকম রবিশস্যে ভরা–আবার বর্ষাকালে দ্বীপের ন্যায় মনে হয়েছে গ্রামটিকে। শীতের দিনে কাদের গাছি এসেছে খেজুর গাছে হাঁড়ি পাততে। ছেলেদের দল ছুটেছে তার পেছনে পেছনে,–‘ও গাছি একটা চুমড়ি দেবে?’ গাছি বলেছে, ‘পান নইয়া আইস।’ তার সাজ দেখলে মনে হত যেন সে কোনো যুদ্ধে যাচ্ছে।

নির্মল ঘোষ, বিমল ঘোষমহাশয়রা বাড়ি আসছেন শুনলে সারাতল্লাটে সাড়া পড়ে যেত। আশপাশের গ্রামের লোকজন উদগ্রীব হয়ে উঠত দেখা করবার জন্যে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা হয়ে উঠত চঞ্চল। খেলাধুলোর বন্দোবস্ত হত সকালে, দুপুরে, বিকালে–যাতে কেউ বাদ না যায়। সে কী আনন্দ! প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পুরস্কার পেত। গ্রামের পূর্বদিকে সাত-আট মাইল দূর থেকে নির্মলবাবুর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ঘর দেখে লোকে ‘ওই কাইচাল’ বলে এ গ্রাম ঠিক করে। কয়েক বৎসর হল একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয়ও তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ছাড়া দেশের ও দশের অনেক উপকার এবং কাজ এঁরা করেছেন। এঁদের কাজকর্ম দেখে সকলেই বলাবলি করত, লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্যে এঁরা দু-ভাই দৃঢ়সংকল্প।

এঁরা যখন চলে এসেছেন তখনও নির্জীব হয়নি গ্রাম। ছোটো হিস্যার খোকাদার কাছারিঘরের দোতলায় প্রায় সব সময় চলেছে নাচের মহড়া–এক, দুই, তিন। বড়ো হিস্যার কাছারিতে চলেছে নামকরা অভিনেতাদের পার্ট, কত অঙ্গভঙ্গি সহকারে মাস্টার তাদের শেখাচ্ছেন। তারপর মণীন্দ্রমোহন বসু মজুমদারের কাছারিতে চলেছে গান-বাজনার তোড়জোড়।

গ্রামে ছিল পোস্ট-অফিস। দূর গ্রাম থেকে কোনো লোক এসেছে দরকারে, যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে যাবে; কিন্তু ভুলে গেছে সে তার জরুরি কাজ। একাছারি ওকাছারি ঘুরে দেখেশুনে ডাকঘরে যেতে যেতে ডাকঘর হয়ে গেছে বন্ধ!

গ্রামের মোহন শীল বিকট কালো পোশাক পরে কপালে বড়ো একটা সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে খাড়াহাতে জল্লাদের ভূমিকায় যখন থিয়েটারের আসরে অবতীর্ণ হয়েছে তখন অনেক ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। খোকাদার প্রকান্ড আটচালা ঘরে হচ্ছে যাত্রাগান–গ্রামের রাশভারী প্রকৃতির লোক সুরেশচন্দ্র ঘোষমহাশয় দলের সেক্রেটারি, দক্ষিণারঞ্জন বসুমহাশয় ম্যানেজার, শ্রোতার সংখ্যা অধিকাংশই মুসলমান, কিন্তু ‘টু’ শব্দটি নেই। কারণ জমিদার বাড়িতে গান, তারপর স্বয়ং জমিদাররা উপস্থিত। জায়গায় জায়গায় পেয়াদা এবং বরকন্দাজরা বাঁশের এবং বেতের লাঠি হাতে দন্ডায়মান হয়ে খবরদারি করছে।

যখন চড়ক পুজো এসেছে, তখন কী মাতামাতিই না শুরু হয়েছে। বালা সন্ন্যসীরা নানারূপ কৃচ্ছসাধন করে এই জাগ্রত এবং ক্রুদ্ধ দেবতার পুজোর জন্যে তৈরি হয়েছে। খোকাদার বেলতলা পুকুরের মধ্যে প্রকান্ড একটি আস্ত গাছ ডুবে আছে–যে সে গাছ নয়, ওর ভেতর রয়েছে দেবতা! প্রবাদ আছে চড়ক পুজোর ঢাকের বাজনা শুনলে ওই গাছ ভেসে ওঠে। এই পুজোর দিন যত সব ভূত, পেতনি, দানব, দত্যি নেমে আসে এবং অবাধে যাতায়াত করে; তাই ওইদিন আগে থেকেই সাবধান হয় ছেলে-মেয়েরা।

গাজন গান হবে। গ্রামের অক্ষয় পাল এবং নগরবাসী মন্ডল পুরাণ আলোচনার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে, কতলোক জমেছে। জ্ঞানীজন সব বসেছে সম্মুখে, পাশে দুটো ঢাক তৈরি হয়ে রয়েছে। হচ্ছে গাজন গান, কী সে আনন্দ! একবার শ্যাওড়া গাছের ডাল কাটায় গ্রামের একটা ছেলে ভীষণ অসুখে আক্রান্ত হয়। বাঁচবার আশা তার মোটেই ছিল না। পরে প্রকৃত ঘটনা জেনে মানত করে পুজো দেওয়া হয় গাছের গোড়ায়। তারপর সে রোগমুক্ত হয়। আমি নিজে দেখেছি। কাজেই অবিশ্বাস করতে পারি না। তবে হতে পারে কাকতালীয়।

বীজ বপনের সময় বৃষ্টির পাত্তা নেই। সারামাঠ প্রখর রৌদ্রতাপে ফেটে খাঁ খাঁ করছে। কৃষককুল হায় হায় করছে। অহোরাত্র কীর্তন হচ্ছে। হঠাৎ কেউ বলল গ্রামের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত নিশাতলা–ওখানকার দেবতা স্বপ্নে বলেছে পুজো দিতে! অমনি সবাই মিলে সেখানে গিয়ে দেবতার পুজো দেয়, তিন-চার মন দুধ দিয়ে যে যে গাছে দেবতা আছে তাদের স্নান করায়। আমরা দেখেছি সেই দিনই কি পরের দিন ভীষণ বৃষ্টি হয়ে মাঠ ভাসিয়ে দিয়েছে! বুদ্ধিতে এসবের ব্যাখ্যা চলে না। কী হিন্দু কী মুসলমান সবাই ওই জায়গাটিকে ভয় করে এবং ভক্তিও করে। হায়, আর কি কোনোদিন ফিরে যাব না সে দেশে, আমার সোনার গাঁয়ে!

কালীবাড়িতে আছেন জাগ্রত কালী, পাশে সাতটি শিব। প্রত্যহই পুজো হয়। আমরা শুনেছি আমাদের কালীবাড়িতে নরবলি পর্যন্ত হয়েছে!

ফাগুন মাস। কলকাতা থেকে সুধাংশুবাবু এসেছেন। অনেক গুলি এনেছেন। বাড়িতে তাঁদের বন্দুক আছে। ছেলের দল সব তৈরি হয়েছে ঘোড়ামারার বিলে পাখি শিকারে যাবে। কত আনন্দ এতে পেয়েছে গ্রামের ছেলেরা। তিন-চারটে বাতাবি লেবুর গাছ ছিল, কেউ কোনোদিন পাকা লেবু দেখেনি–কারণ ওসব দিয়ে ফুটবলের কাজ চালাতে হয়েছে।

পশ্চিমপাড়ার ঠিক কোনায় ছিল নগেন-ক্ষিতীশদের বাড়ি। তাদের মার সঙ্গে আমার মায়ের ছিল খুব ভাব। দুজনেই বিধবা। নিজের তিনটি ছেলে থাকা সত্ত্বেও কী ভালোই না বাসতেন তিনি আমাকে। প্রত্যেকদিনই গিয়েছি তাঁদের বাড়িতে আর কিছু মুখে না দিয়ে কোনোদিনই ফিরতে পারিনি। অনেকে মনে করিয়ে দিত, আমি ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু মাসিমার অপত্য স্নেহের কাছে কোনো কথাই টিকত না। মনেপ্রাণে মাসির মুখে হাসি দেখতে চেয়েছি। নগেন ক্ষিতীশ থাকত বিদেশে। মাসির দুঃখ, তারা ঠিকমতো চিঠি দেয় না। নগেন বড়োভাই হয়েও ক্ষিতীশের বিয়ের জন্যে চেষ্টা করছে না, আরও কত কী মাসি নালিশ জানাত আমার কাছে। আজ নগেন, ক্ষিতীশ, মাখন তিনজনেই সংসারী হয়েছে, বেশ সুখে-শান্তিতেই আছে। কিন্তু মাসি তাঁর বউ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে দেশে থাকতে পারলে তাঁর কত বেশি আনন্দ হত!

তারপর বিশ্বকর্মা পুজোয় ভাঙার গাঙে নৌকাবাইচ। রতন সর্দার সকালেই তার বাবরি চুলে সাবান দিয়ে ফুলিয়েছে, কপালে বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা দিয়েছে, লাল গামছা একখানা পরেছে, আর একখানা মাজায় বেঁধে এক হাতে ঢাল এবং অপর হাতে লকলকে ধারালো খঙ্গ নিয়ে নৌকোর ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আশিহাত লম্বা নৌকো, দশ-বারো হাত হবে তার গলুই। দু-পাশে পেতলের চক্ষু, আরও কত কী দিয়ে সাজানো। গলুই-এর ওপরে পেতলের দুটি সাপ ফণা তুলে রয়েছে এবং নৌকোর দোলায় দোলায় উভয়ে উভয়কে আঘাত করছে। রতন সর্দার বোল বলছে,

আমার নায়ে হোলক গাবি কে, আরে হোলাবিলাই শাদি করবে কাহই আইনা দে।

গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির প্রত্যেকটি আমগাছের কোনো-না-কোনো নাম রয়েছে। আমাদের পুকুরপাড়ে উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল একটা খুব উঁচু আম গাছ–নাম তার থোপঝুড়ি। ওই গাছের মাথায় ছিল বড়জিয়াল পাখির বাসা। তারা ওই স্বামী-স্ত্রীতে প্রহরে প্রহরে ডাকত। পুকুরপাড়ের গাছে ছিল মাছরাঙার গর্ত। মাছরাঙা পুকুর থেকে মাছ ধরে পেয়ারা গাছের ডালে বসে খেত। আমি বাঁশ-গুলি দিয়ে অন্য অনেক পাখি মেরেছি, কিন্তু এদের কোনোদিন মারিনিঃ |||||||||| পূর্বপাড়ায় ত্রিনাথের মেলা। কে যেন গান ধরেছে,-”আমার ঠাকুর তেন্নাথের যে করিবে হেলা…’, তারপর যেন কী ভুলে গেছি। গণশা গিয়েছে সেখানে, তাই কামিনীদি ডাকছে, ও গণশা, গরে সোমত্ত বউ, আর তুই গান শুনছিস?’ কামিনীদি শুতে যেতে পারছেন না। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর সেসব বিলাপ শুনতাম।

এখানে আমার ঘুম ভাঙানোর কেউ নেই, কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আমার ঘরের কোণে বেতের ঝোপে ডাহুক ডাহুকি, আরও কতরকম পাখির ঐকতান ভোরে আমার ঘুম ভাঙাত। |||||||||| গ্রামের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বৃদ্ধ ঘোষালমশায়কে। তিনি যখন মাথায় কলসি নিয়ে অপরূপ ভঙ্গিতে নাচতেন, তখন গ্রামের কত লোক এসেছে তা দেখবার জন্যে। এখনও লোকমুখে সে নাচের খবর শুনতে পাওয়া যায়। |||||||||| অক্ষয় চক্রবর্তীমশাই চামর দুলিয়ে রামায়ণ গান করতেন। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সব

তন্ময় হয়ে বসে শুনত। রামের বীরত্বে কে না পুলকিত হয়েছে, লক্ষ্মণের কথায় কার না শরীরে রোমাঞ্চ দিয়েছে, সীতার দুঃখে কে না অভিভূত হয়েছে? কিন্তু আজ সেসব স্মৃতি!

আজকাল পঞ্চায়েত প্রথার কথা খুবই শুনছি। অথচ আমার গ্রামে এ সব সময়েই ছিল। আশপাশের কোনো গ্রামে বা কোনো লোকের সঙ্গে কারো ঝগড়া-বিবাদ হলে জমিদার বাড়ির পেয়াদা গিয়ে নিয়ে আসত তাদের খবর দিয়ে। গ্রামের প্রবীণ লোকদের ডাকা হত, জমিদার উপস্থিত থাকতেন, সূক্ষ্ম বিচার হত, উভয়েই খুশি মনে গল্প করতে করতে চলে যেত। এইভাবে কত লোক অযথা অর্থব্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। |||||||||| গ্রামের চতুষ্পর্শ্বে দু-তিন মাইলের মধ্যে ভাঙার হাট, পোড়াদিয়ার হাট, নরকান্দার হাট, ফলিখালির হাট আর আউরাকান্দির হাট-বর্ষাকালে দেখেছি কত লোক কত রকমের নৌকোয় করে ছুটেছে হাটের দিকে। আবার শুকনোকালে দেখেছি মাঠের ভেতর দিয়ে নানা রাস্তায় লোক ছুটেছে কাতারে কাতারে হাটের দিকে। কারও মাথায় ধামার ভেতর কয়েকটি লাউ কিংবা কিছু বেগুন, না হয়তো অন্য কোনো তরিতরকারি, কারও হাতে দুধের ভাঁড়। এরা সবাই আপন আপন খেত কিংবা বাড়ির জিনিস নিয়ে চলেছে হাটে। তারা ধানের দর, পাটের দর, ভাঙার হাটে কয়খানা ধানের নৌকো এসেছে ইত্যাদি বলাবলি করতে করতে চলেছে।

জমিদার বাড়িতে পুণ্যা হবে। কাছারিঘর সাজানো হয়েছে। ভোর হতেই প্রজারা সব আসছে দুধ মিষ্টি আর টাকা নিয়ে। এদিকে আটটায় সর্দারি খেলা হবে, নামকরা সব সর্দাররা এসেছে। কে কত ভালো খেলা জানে আজ তার প্রমাণ হবে স্বয়ং জমিদারের সামনে। আফা সর্দার কলসির ওপর থালা উপুড় করে বাজাতে আরম্ভ করেছে, আর আর সর্দাররা পা তুলে নেচে নেচে কতরকমের কায়দা দেখাচ্ছে। এসব দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।

.

খালিয়া

নদীর নাম কুমার, গাঁয়ের নাম খালিয়া। নামের মধ্যেই মূর্ত হয়ে রয়েছে নদীটির পরিচয়। কুমারের মতোই সংযত ও সাবলীল ছন্দে অবিরাম বয়ে চলেছে সে তার অনির্দেশ্য যাত্রায় মধুমতীর উদ্দেশে। তার যাত্রাপথের দু-ধারে রেখে যায় সে তার অকৃপণ দাক্ষিণ্যের পরিচয়। তার অফুরান প্রাণ-বন্যার পরশে দু-তীর ঘিরে সে গড়ে তুলেছে অপরূপ স্বপ্নদ্বীপ…ছোটো ছোটো গ্রাম। নদী আর খাল, শিমুল আর বকুল, বেত-বাতাবির ঝোঁপ-ঝাড় আরও কত অজস্র নাম জানা-না-জানা গাছ-গাছালির সবুজে শ্যামলে ঘেরা আমার এই ছেড়ে আসা গ্রাম খালিয়া।

আজ থেকে প্রায় চারশো বছর পূর্বে এক অপরাহু বেলা প্রায় শেষ হয় হয়। গোধূলির অন্তিম রক্তরাগ ছড়িয়ে পড়েছে কুমার নদীর প্রশান্ত জলধারায়। এমনি সময়ে তার তীরে এক প্রাচীন অশ্বত্থামূলে গভীর চিন্তামগ্ন এক তরুণ বসে বসে ভাবছে তার অনাগত বিধিলিপি। তার প্রশস্ত ললাটে পড়েছে গভীর চিন্তার সুস্পষ্ট রেখা। অনির্দেশ্য পথের উদ্ৰান্ত তরুণ যাত্রীর মনের একটি বন্ধ দুয়ার সহসা খুলে গেল। দূর-প্রান্তরের পানে তাকিয়ে চেয়ে থেকে দুঃসাহসিক অভিযাত্রী স্বগতোক্তি করল,–‘ওই প্রান্তরই হবে আমার প্রাচীন অশ্বথের আশ্রয়।’

বাংলার ইতিহাসের পাদটিকায় এই তরুণ ব্রাহ্মণ রাজারাম রায় নামে পরিচিত। রাজারাম আপনার বাহুবলে কালক্রমে ফরিদপুর জেলার এই কুমার নদীর তীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চলে একাধিপত্য বিস্তার করে খালিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর পাতার কুটির রূপ নিল সাতমহলা প্রাসাদে। তাঁর সেই বিশালায়তন প্রাসাদের এক-চতুর্থাংশ মাত্র আজ বর্তমান।

রাজারাম শুধু নিজের প্রাসাদ তৈরি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, যেসব কারিগর, মজুর ও শিল্পীর অক্লান্ত শ্রম ও মমতায় তাঁর প্রাসাদটি গড়ে উঠেছিল, রাজারাম তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক, জমি, জায়গা প্রভৃতি দান করে নিজ গ্রামের পাশেই তাদের প্রতিষ্ঠিত করে দেন। এ ছাড়া রাজারাম তখনকার দিনে বিখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশের সুসন্তানদের এনে নিজ গৃহের আশপাশে তাদের বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে দেন। ধীরে ধীরে রাজারামের প্রাসাদটিকে ঘিরে গড়ে উঠল একখানি ঐশ্বর্যশালী ব্রাহ্মণপ্রধান গ্রাম।

কালক্রমে রাজারামের জমিদারি ও প্রতাপ এত দূর বিস্তৃত হয়েছিল যে, তদানীন্তন মোগল সম্রাট রাজারামকে রায় চতুর্ধারী উপাধিতে অলংকৃত করেন। ‘চতুর্ধারী’ শব্দের শব্দগত অর্থ হল যিনি চারিটি সেনাবাহিনীর অধিনায়ক। এই চতুর্ধারী শব্দই ক্রমে লোকমুখে রূপান্তরিত হয় চৌধুরিতে। কথিত আছে একবার বারোভূঁইয়াদের অন্যতম প্রধান সীতারাম রায় রাজারাম রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু দোর্দন্ড প্রতাপ রাজারাম তাঁর অজেয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় সীতারামকে পরাভূত করেন। এই অজেয় সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ছিল নমঃশূদ্র প্রজাবৃন্দ। এরা একদিকে যেমন দুঃসাহসী ও দুর্দম, তেমনি সরল ও নম্র এদের প্রকৃতি। এরা প্রধানত জমির চাষ-আবাদ ও কুটির শিল্পের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত। অনেকে করত মাঝি-মজুরের কাজ। আবার এরাই ছিল তখনকার দিনে প্রতাপশালী ভূস্বামীদের মজুত জঙ্গিবাহিনী।

কালের আবর্তনে সেই রাজারামের আমল অতীত হয়ে গিয়েছে কবে। তবু অলিখিত ইতিবৃত্ত ভাস্বর আখরে লেখা রয়েছে গাঁয়ের অন্তরের মণিকোঠায়। ছেলেবেলায় আমরা ঠাকুমা-দিদিমার মুখে রাজারাম রায়, জয়চন্দ্র রায়, তাঁদের পার্শ্বচর ভোলা বাগদি, রহিম শেখের রোমাঞ্চকর জীবন-কথা শুনে ভেবেছি–সত্যি কি তেমনি কাল কোনোদিন ছিল, না এ সবই কাল্পনিক রূপকথার কোনো অবাস্তব কাহিনি।

আড়াইশো বছরের ব্রিটিশ শাসন তার দুষ্টক্ষতের চিহ্ন যদিও রেখে গেছে পূর্ববাংলার প্রতিপল্লিতে, তবু সে আমলেও গ্রামগুলো যে কিছুটা উন্নত ও আধুনিক হয়েছিল সে-কথা অস্বীকার করব না। আমাদের খালিয়া গ্রামও কয়েকটি বিষয়ে আধুনিককালের সঙ্গে তাল রেখে চলেছিল। আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে খালপাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ডাক ও টেলিগ্রাফ অফিস। আধুনিক সভ্যতার এক অমূল্য অবদান এই ডাক ও তার বিভাগ। সাতসমুদ্র তেরো নদী পারের আপন মানুষের নিরালা মনের কথা তারা এনে পৌঁছে দিয়েছে গাঁয়ের মানুষের কাছে। রোজ সকালে দেখতাম আমাদের গাঁয়ের ডাক-পিয়োন জলধর তার সেই চিরপরিচিত জীর্ণ ছাতাটি মাথায় দিয়ে একটা হলদে ক্যাম্বিসের ব্যাগ কাঁধে করে যখন বাজার খোলায় এসে হাজির হত তখন চারদিক থেকে গাঁয়ের লোকেরা তাকে অস্থির করে তুলত চিঠির তাগাদায়। যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন একদিন সারাপাশ্চাত্য জগতের অগ্রগমনে দিয়েছিল অবিস্মরণীয় গতিবেগ–যার ঢেউ-এর দোলায় টেমস নদীর উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অবধি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, তার ক্ষীণ রেশ আমাদের এই আত্মভোলা কিশোরকুমার নদীর প্রশান্ত বুকেও এসে লেগেছিল। তাই দেখে এক সময় গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবনিতা বিস্ময়ান্বিত হত। সেই প্রথম বিস্ময়ের পর অনেক দিন অতীত হয়ে গেছে, এখন আর গাঁয়ের লোকেরা জাহাজ দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে না।

কত তন্দ্রাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় আকাশে উড়োজাহাজের ঝাঁক দেখে গাঁয়ের ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা মায়ের কোলে জড়োসড়ো হয়ে ডাগর চোখ দুটো তুলে বলত, ‘মা! ওই বুঝি সেই পরনকথার ব্যাঙ্গমা পাখি?’ গাঁয়ের শ্ৰীকণ্ঠ মুদি বলত, ও হল পুষ্পক রথ। কতদিন দেখেছি খালিয়া বাজারের পুলের কাছে শ্ৰীকণ্ঠ মুদির সেই দোকানটা হর ঠাকুরদার বক্তৃতায় সরগরম হয়ে উঠেছে। দেখেছি, হর ঠাকুরদা মাঝে মাঝে তাঁর হাত দু-খানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাইচরণ, নিতাই, রসুল মিয়াদের বোঝাচ্ছে,–‘বোঝলা কিনা রসুলভাই, সেই যে মহাভারতে ল্যাখছে পুষ্পক রথের কথা। হেই পুষ্পক রথই হেন উড়োহাঁস জাহাজ অইয়া আকাশে উইড়া বেড়ায়।’ শ্ৰীকণ্ঠও ঠাকুরদার কাছ থেকেই শুনেছে পুষ্পক রথের কাহিনি। রসুল নিরক্ষর চাষি। সে মহাভারত পড়েনি। তবু ওই শ্ৰীকণ্ঠ মুদির দোকানে বসেই সে মহাভারতের গল্প শুনেছে অনেকদিন। রসুল তার দাড়ির মধ্যে হাত বুলোতে বুলোতে বিজ্ঞের মতো কইত, ‘তা কথাডা ঠাউরমশায় যা কইছ হেথা একালে মিথ্যা নয়।’

গ্রামের বাজারে প্রতিবৎসর মেলা বসত চার বার! একটি বারুণীর দিনে, একটি পয়লা বৈশাখে, আর রথের সময় দু-দিন। পয়লা বৈশাখের মেলার নাম ‘গলুয়ের মেলা’। এইদিনে আগে কবিগান হত এবং অনেক দল পাল্লা দিয়ে গান করত। একবার একজন মেয়ে কবিওয়ালি প্রতিপক্ষকে বলেছিল,

ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি কুনো,
মুখপোড়া গাবুর একটা বুনোনচ্ছার তোরে করব তুলোধুনো।

বলাবাহুল্য সকলের মতে তারই জিত হল।

আমাদের গাঁয়ের পূর্বপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত ছিল একটি প্রথম শ্রেণির উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। রাজারামের নাম অনুসারেই গাঁয়ের লোকে তার নাম দিয়েছিল রাজারাম ইনস্টিটিউট। আশপাশের দু-দশখানা গাঁয়ের ছেলেরা এই শিক্ষায়তন থেকেই প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। তাদের মধ্যে অনেকে আজ সমগ্র দেশের বরেণ্য সারাদেশের গৌরব। ভারতীয় জাতীয় মহাসভার সভাপতি দেশবরেণ্য অম্বিকা মজুমদারমশায়ও একদিন এই রাজারাম ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন। বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ সাধক কবি ও দার্শনিক কিরণচন্দ্র দরবেশও ছিলেন এই খালিয়া গ্রামেরই ছেলে। তিনিও ছিলেন একদিন এই রাজারাম ইনস্টিটিউটের ছাত্র। বর্ষাকালে যখন খালিয়ার পথঘাট নদীনালা একাকার হয়ে যেত তখন আমাদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণও জলে থইথই করত। ছাত্ররা তখন দূরদূরান্তর থেকে নৌকো করে এসে স্কুলে পড়াশোনা করত। যাদের নৌকো থাকত না তাদের ভোঙায় অথবা কলাগাছের ভেলায় করে স্কুলে আসতে হত। গাঁয়ের ছেলেদের মধ্যে লেখাপড়া শেখার আগ্রহ যে কত প্রবল ছিল এ থেকেই তার কিছুটা বোঝা যায়। এই বিদ্যালয়টির পেছনে ছিল অনাড়ম্বর শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অকৃত্রিম অনুরাগ। কিন্তু আজ সে বিদ্যালয়টির চারদিক ঘিরে গুমরে উঠছে শুধু এক ‘নাই নাই’ রব। নাই সেসব নীরব দেশকর্মী শিক্ষকেরা–নাই সেসব দুষ্টুমি আর খুশিতে উজ্জ্বল কিশোর ছাত্রদের কলরব।

বিদ্যালয়টির পাশেই ছিল একটি সাধারণ গ্রন্থাগার। গাঁয়ের উৎসাহী তরুণ কর্মীরা এই গ্রন্থাগারটি গড়ে তুলেছিল।

স্বদেশি যুগে যেদিন বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর-একপ্রান্ত অবধি বেজে উঠেছিল পরাধীনতার শিকল-ভাঙার ঝনঝনানি সেদিনও আমার এই ছেড়ে আসা গ্রামখানি সিংহের মতো অধীর হয়ে উঠেছিল শিকল ভাঙার উন্মাদনায়। বাবার কাছে শুনেছি কত নিস্তব্ধ অমারাত্রির অন্ধকারে খালিয়ার মুক্তিপাগল দুর্বিনীত তরুণদল তাদের স্বাধীনতার সাধনায় মগ্ন ছিল লোকচক্ষুর অগোচরে ঝোঁপ-জঙ্গল ঘেরা কালীমন্দিরের আঙিনায়! সেখানে চলত বিপ্লবীদের লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, বন্দুক চালনা, বোমা তৈরি, আর চলত গভীর মন্ত্রণা কী করে বেনিয়া দস্যু শ্বেতাঙ্গদের হটিয়ে দেওয়া যায় সাগরপারে। সারাভারতের বিপ্লবী বীর বালেশ্বর সংগ্রামের প্রথম শহিদ কিশোর চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরির সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিল এই খালিয়া গ্রামের ঝোপে-জঙ্গলে। যে স্বাধীনচেতা রাজারাম প্রাণের নিবিড় মমতায় গড়ে তুলেছিলেন এই খালিয়া গ্রাম-দেহের প্রতি রক্তবিন্দু দিয়ে রক্ষা করেছিলেন তার স্বাধীনতা, বহুযুগান্তে তারই এক বংশধর তরুণ বিপ্লবী চিত্তপ্রিয় সারাভারতের মুক্তির জন্যে বালেশ্বরের যজ্ঞভূমিতে নিজের অস্থিমজ্জা রক্তমাংস আহুতি দিয়ে পিতৃঋণ শোধ করে গেছে। জবাব দিয়েছে খালিয়া গ্রামের মুখপত্র সারাবাংলার হয়ে–সারাভারতের পক্ষ থেকে উদ্ধত শ্বেতাঙ্গ শাসনের ও শোষণের প্রতিবাদে। সেই শহিদ-তীর্থ খালিয়া গ্রামের মানুষ আজ ভারত শাসকদের কাছে উদবাস্তু মাত্র–আর কিছু নয়। কী মর্মান্তিক পরিহাস!

আজ আমার-ছেড়ে আসা গ্রামের কথা লিখতে বসে একটি দিনের কথা কেবলই মনে পড়ে। গ্রামে তখন শারদোৎসবের ধুমধাম। বহুদূরদেশ থেকে প্রবাসীরা সব গাঁয়ে ফিরে এসেছে মাটির মায়ের টানে। আমাদের গাঁয়ে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দুর্গোৎসব হয়ে থাকে। তাই পুজোর কটাদিন গাঁয়ের কারুরই থাকা-খাওয়ার কোনো বিধিনিয়ম থাকে না। সব বাড়িতেই সকলের নিমন্ত্রণ। ফেরার দিন সকাল থেকেই সব জিনিসপত্র বাঁধাছাদা শুরু হয়ে যায়। বিকেলেই বাড়ি থেকে যাত্রা করতে হবে। দিনটা দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে গড়িয়ে গেল। বিকেল বেলায় দেখি রাজুদা বাইরের দাওয়ায় বসে গুড়ক গুড়ুক করে তামাক খাচ্ছে। মাথায় একটা লাল গামছা পাগড়ির মতো করে বাঁধা। রাজুদা আমাদের নৌকোর মাঝি। জাতে নমঃশূদ্র। আমাকে দেখেই রাজুদা বলে উঠল,–‘কি ছোটো-কর্তা, দেরি করতে আছ ক্যান। হ্যাঁসে তো ইস্টিমার পাব না য়্যানে। হকাল হকাল বাইরাইয়া পড়ো।’ বাড়ির দিঘির ঘাট থেকে যখন আমাদের নৌকা ছাড়ল তখন দিনের সূর্য ক্লান্ত হয়ে সন্ধের কোলে চলে পড়েছে। নৌকা যখন খালের প্রান্তে সাধুর বটতলার পাশ দিয়ে কুমার নদীতে পড়ল তখন গোধূলির স্বর্ণরেণু ছড়িয়ে পড়েছে আমার ছেড়ে আসা গ্রামখানির ওপরে। আমার ভাইবোনেরা নৌকার ছইয়ের ওপর বসে দেখছে সেই অপরূপ বিলীয়মান ছবি। গাঁয়ের সীমানা ছেড়ে যতই দূরে চলে আসছিলাম ততই আমার মন ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল কী এক অনির্দেশ্য বেদনায়। চোখ দুটো হয়ে উঠছিল অশ্রুছলছল। কী যেন নেই! কী যেন হারিয়েছি, কাকে যেন চাই, কাকে যেন আর পাব না– এমনি এক অসহায় মর্মরাঙা বেদনা আমার বুকের মধ্যে গুমরে উঠছিল। সেই অব্যক্ত বেদনার মূল আমি নিজেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুধু অজ্ঞাতে অস্ফুটে কখন বলে চলেছিলাম,

মাতৃভূমি স্বর্গ নহে সে যে মাতৃভূমি,
তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা
যদি দু-দিনের পরে
কেহ তারে ছেড়ে যায় দু-দন্ডের তরে।

গ্রাম ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে পল্লিকবির রচিত একটি গান। লক্ষ্মণের শক্তিশেলে শ্রীরামচন্দ্র খেদোক্তি করে বলছেন,

সুমিত্রা মা বলবে যখন,
রাম এলি তুই কই রে লক্ষ্মণ–
(আমি) কোন প্রাণ ধরে বলব তখন :
মাগো, তোমার লক্ষ্মণ বেঁচে নাই।

দেশজোড়া লক্ষ্মণের দল আজ শক্তিশেলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কবে তাদের সবার মূৰ্ছা ভাঙবে সে আশায় দিন গুনছি।

.

চৌদ্দরশি

রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং মানুষের মধ্যে বাঁচবার জন্যে প্রেরণার বাণীও দিয়ে গেছেন আমাদের। কিন্তু আমরা মানুষের কাছ থেকে নির্বাসিত হলাম, তাদের মধ্যে ঠাই তো পেলাম না! যেখানে আজীবন কাটালাম সেখানে আমাদের আর কোনো স্থান নেই আজ। কীর্তিনাশ ও যেখানে তার স্বভাবগুণে আমাদের বসবাসের জন্যে ‘চৌদ্দরশি’ জায়গাটি সৃষ্টি করল, সেখানে হিংস্র মানুষ আমাদের থাকতে না দিয়ে তার কুটিল অনুদার মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছে। কালবৈশাখীর হঠাৎ ঝড়ের তান্ডবে শীতের ঝরাপাতার মতো উড়ে গেলাম নিজের দেশ থেকে। এ ঝড় কোথা থেকে এল? কার অদৃশ্য কারসাজিতে আমাদের বাস্তুভিটে ছেড়ে আসতে হয়েছে? সমস্ত কিছু থাকা সত্ত্বেও কেন আজ আমরা ‘উদবাস্তু’ নামে চিহ্নিত হচ্ছি? একেই হয়তো অদৃষ্টের পরিহাস বলে! অঘটনপটন পাটোয়ারের দল যে তান্ডব সৃষ্টি করেছে তার ‘বলি’ আমরাই হলাম ভেবে মাঝে মাঝে চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে।

আমাদের গ্রামের নাম চৌদ্দরশি। গ্রাম ছেড়ে এসেছি বটে, কিন্তু তার স্মৃতি ভুলতে পারছি কই? যেখানকার বাতাসে আমার সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না মিশে রয়েছে তাকে এক কথায় মনের মণিকোঠা থেকে ঝেড়ে ফেলি কেমন করে? দৈহিক অপসরণ সম্ভব হলেও কল্পনার অশ্বমেধ ঘোড়াকে আটকাব কোন জাদু মন্ত্রে? এখনও অসতর্ক মুহূর্তে গ্রামের নদীর ধারের, বাবুদের ডাক্তারখানার, স্কুলের মাঠের, বাগানবাড়ির স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। চৌদ্দরশি কি আজও প্রাণমাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সকলকে আকর্ষণ করছে?

ফরিদপুর শহর থেকে চৌদ্দরশির দূরত্ব মাত্র পনেরো মাইল। বর্ষাকালে টেপাখোলা হয়ে নৌকোয় যেতে হয়, অন্য সময় মোটরে। ফরিদপুর জেলার সকলেই আমাদের গ্রামের নাম জানেন। জিজ্ঞাসা করলে সকলেই রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেন, যদিও মূল চৌদ্দরশি বলে কোনো নির্দিষ্ট গ্রামই নেই। পূর্বে স্থানটির বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যেত কীর্তিনাশা পদ্মানদী। অকস্মাৎ তার গতিপথ বিপরীতগামী হওয়ায় তার বুকে প্রকান্ড চর জেগে ওঠে। যেখানে যখন চর জাগত জমিদারের লোক এসে মাপামাপি করত রশির ক্রমিক সংখ্যায়। এই চরগুলোই গ্রামের ভূমিকা। গ্রাম গড়ে ওঠে কীর্তিনাশার আনুকূল্যে, কিন্তু গ্রামের নাম থেকে যায় রশিমাপের সংখ্যাতত্ত্বের ওপরেই। এমনিভাবে পত্তন হয়েছে বাইশরশি, সাতরশি, নয়রশি ইত্যাদি নানা গ্রামের, আর এইসব গ্রামের সমষ্টিই শেষ পর্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করেছে চৌদ্দরশি ডাকনামে।

চৌদ্দরশি গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে গ্রামের জমিদারবাবুদের কথা। ‘জমিদার’ নামটির মধ্যে যে ভয়াবহতার চিহ্ন থাকে তা এঁদের মধ্যে ছিল না। এ জমিদারেরা অমায়িক। ফরিদপুর, বরিশাল, পাবনা জেলায় এঁদের বিরাট জমিদারি–এমন প্রতিপত্তিশীল জমিদার পূর্ববঙ্গে খুব কমই ছিল। তিন শরিকের জমিদারি, তিন ভাইয়ের তিন হিস্যে। তিনজনের বাড়ি, মন্দির, বাগান, দিঘি নিয়ে যেন তিনটি শহর। আমলা-কর্মচারী, পাইক-পেয়াদা, সেপাই, মোসায়েবের দল গিসগিস করত। বাবুরা পায়ে হেঁটে কোথাও বেরুতেন না, তাঁদের প্রত্যেকের ছিল সুসজ্জিত পালকি। পালকি-বেহারাদের হেঁইও হোহেঁইও হো-র একটানা শব্দ শুনেই বোঝা যেত কোন জমিদারবাবু আসছেন। পালকির সামনে পেছনে চলত বন্দুকধারী সেপাই। মনে পড়ছে বাবুদের দেখবার জন্যে গ্রামের ছেলে-বুড়ো এসে জুটত রাস্তার দু-পাশে। সে জনতায় হিন্দু-মুসলমান পৃথক হয়ে থাকত না,-গা ঘেঁষাঘেষি করে সবাই উঁকি দিত পালকির দরজায়। দেড়মাইল দূরে গ্রাম্যনদী ভুবনেশ্বরী। নদী চলার পথে জমা থাকত বাবুদের বড়ো বড়ো বজরা। আয়তনে ছিল মোটরলঞ্চের চেয়েও বড়। ত্রিশ চল্লিশ জন মাঝিমাল্লা ছাড়া এ বজরা চালানো সম্ভবপর হত না। মাঝিমাল্লারা ছিল প্রায় সকলেই মুসলমান। হিন্দু-জমিদারের সুখ-সুবিধের জন্যে তারা একদিন প্রাণ পর্যন্ত তুচ্ছ করতে পারত। গ্রাহ্যই করত না হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের জিগিরকে। বাবুদের পেয়াদাও ছিল সকলেই মুসলমান তাদের লাঠি সড়কির ওপরেই নির্ভর করত বাবুদের মানসম্ভ্রম, প্রতিপত্তি, সেখানে কোনোদিন তো ভেদাভেদ দেখিনি। এক হিন্দু জমিদারের মুসলমান লাঠিয়ালরা বাবুর সম্মান রক্ষার জন্যে অন্য জমিদারের মুসলমান লাঠিয়ালের মাথা চূর্ণ করে এসেছে দ্বিধাহীন চিত্তে! ঠিক এর উলটোটাও হয়েছে। তখন মানুষ ছিল বড়ো। ধর্মের বিকৃতরূপ মানুষের মাথা খারাপ করতে পারেনি। মুসলমান পরিবারের সাহায্যার্থে কত হিন্দুকে নিঃস্বার্থভাবে দান করতে দেখেছি। বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে টাকা পয়সা আসার গল্প শুনেছি। জমিদাররা ছিলেন এমনি ধনী। জাতিধর্ম নির্বিশেষে বহাল করতেন কর্মচারী। তাঁদের কাছে ধর্ম বড়ো ছিল না, বড়ো ছিল কর্মঠ লোকের অকৃত্রিম পরিশ্রম। মুসলমানরাও বুঝত সে কথা, তাই তাদের কাজে কোথাও ফাঁকি থাকত না। বড়ো হিস্যের রায়বাহাদুর মহেন্দ্রনারায়ণ, মেজো হিস্যের রমেশচন্দ্র ও ছোটো হিস্যের দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন প্রসিদ্ধ। তাঁদের জমিদারি তদারকের জন্যে থাকত তিনজন অবসরপ্রাপ্ত জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট।

হিন্দু হলেও তিন শরিকের মধ্যে কখনো কখনো বিবাদ বাধত, কিন্তু সে কলহের ফল সাধারণত হত শুভই। জনসাধারণ তাঁদের কলহমন্থন করে লাভ করত অমৃত। বড়োবাবু নিজের সুনামবৃদ্ধির জন্যে যেই দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, মেজোবাবু তার পালটা জবাব দিলেন ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজ বসিয়ে। ছোটোবাবু চুপ করে থাকতে পারেন না। ফরিদপুরে উদবোধন করলেন সিনেমা হাউসের। এমনিভাবে সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জনগণ পেল হাই স্কুল, হাসপাতাল, কলেজ ইত্যাদি। এগুলো থেকে সুযোগ-সুবিধে পেত গ্রামবাসীরাই। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানের গন্ডি টেনে কোনোদিন এসব প্রতিষ্ঠানকে খাটো করা হয়নি। আজ আর সেদিন নেই।

গ্রামে দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করেই সবচেয়ে বড়ো আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা হত। সবচেয়ে ধুম হত জমিদারবাড়িতে। গ্রামবাসীরা যে যেখানেই থাক, এসে জমায়েত হত এই সময়টিতে। কয়েকদিনের জন্যে গ্রামের বুকে অপূর্ব হিল্লোল জাগত যেন। পুজোর তোড়জোড় চলত একমাস আগে থেকে। এই উপলক্ষ্যে ময়দান ভরে যেত রকমারি দোকানপাতিতে, কার্নিভাল ও সার্কাসে। আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে ভরে যেত দেশ। এই আনন্দের পূর্ণাহুতি হত তখন যখন কলকাতা থেকে আসত নামকরা যাত্রার দল। আজ আর যাত্রাগানের আদর নেই তার এই উৎসভূমি কলকাতায়। কিন্তু মনে পড়ে দেশে আমরা যাত্রা শোনবার জন্যে কত রাত্রি পর্যন্ত উৎসুক হয়ে কাটিয়েছি। কত রাত্রি অনিদ্রায় কেটে গেছে কোন দল আসছে তারই জল্পনা-কল্পনায়! কোন দলের কোন অভিনেতা অন্যদলের চেয়ে ভালো তা নিয়ে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেছে ভেবে আজ এত দুঃখের মধ্যেও হাসি আসে! যাত্রাগান শোনার জন্যে শ্রোতারা আসত দূরান্তরের গ্রাম থেকে। বিদেশ থেকে আসত আত্মীয় পরিজনবর্গ। অপূর্ব আনন্দ কোলাহলে দিনগুলো কোথা দিয়ে যে চলে যেত বোঝাই যেত না। টনক নড়ত গ্রাম ছাড়বার সময়। সাময়িকভাবে গ্রাম ছাড়তেও যাদের চোখে জল আসত সেদিন, আজ তারা চিরতরে কী করে গ্রাম ছেড়ে দিন কাটাচ্ছে?

মনে পড়ে বাড়ির বাঁধানো পুকুরঘাটে, বাগানের মধ্যে কত আশাময় ভবিষ্যৎ সুখস্বপ্নের কথা হয়েছে। পুজোর একসপ্তাহ আগে থেকে রাতের পর রাত জেগে হয়েছে গান শোনা এবং গাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা। নবমীর মোষ বলি দেখে কত ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে চোখ বুজে রয়েছে। পশুরক্ত দেখে মুসলমানকে আতঙ্কিত হতে দেখেছি সেদিন। কিন্তু আজ কাদের প্ররোচনায় মানুষের রক্তও মানুষের মনে বিতৃষ্ণা আনতে পারছে না? অসভ্য পার্বত্য জাতির মধ্যে আজও নরবলি হয়ে থাকে শুনি। কিন্তু বাংলা তথা ভারতবর্ষের বুকের ওপর দিয়ে ওই যে নরমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়ে গেল, তা যেন সেইসব বর্বর জাতিকেও লজ্জা দেয়।

আমাদের স্কুলটি ছিল বড়ো চমৎকার। সামনে খোলা মাঠ, পেছনে শ্রেণিবদ্ধ আমবাগান। মাঝখানে বাঁধানো পুকুর। ছবির মত পরিবেশ। আমাদের মাস্টারমশায় সুরেশবাবু ছিলেন সেই স্কুলের প্রাণ। পড়াশোনায়, খেলাধুলায় তিনি অনুপস্থিত থাকলে পন্ড হয়ে যেত সব কিছুই। আজ বহু কর্মীপুরুষের সান্নিধ্যে এসেও তাঁর কর্মনিষ্ঠার মনোমুগ্ধকর ছবি বড়ো হয়ে চোখের সামনে ভাসছে দিনরাত। তাঁরই উৎসাহে আমাদের “Rashi’s Eleven Football Club”-এর জন্ম হয়েছিল! ফুটবল খেলার জন্যে আমরা তখন পাগল,–ফুটবলের জন্যে রাজ্যপাট বিলিয়ে দিতেও তখন আমরা পেছপা নই! রাম, মালি, লক্ষ্মণ, বিশু, ব্ৰজা, নৃপেন আর সুরেশবাবুকে নিয়ে আমরা পনেরো-বিশ মাইল পথ পাড়ি জমাতাম ম্যাচ খেলার জন্যে। কোনো বাধাই আমাদের আটকে রাখতে পারত না।

ডাক্তারখানার পুকুরঘাটে ছিল আমাদের আড্ডাখানা। বিকেল হতে-না-হতেই এসে জমায়েত হতাম সেখানে। জার্মানির ফ্যাসিবাদ নিয়ে, চার্চিলের ইম্পিরিয়ালিজম নিয়ে, আমেরিকার অ্যাটম বম নিয়ে, আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্য নিয়ে আমাদের তর্কের শেষ থাকত না। এ আড্ডায় হিন্দু-মুসলমানের অবাধ গতায়াত ছিল। শান্তির সপক্ষে উভয় সম্প্রদায়ই ছিল সমান উৎসুক। কিন্তু শান্তির জন্যে যেসব যুক্তিজালের অবতারণা হত সেদিন, আজ আঘাত পেয়ে বুঝেছি তা ছিল ভুয়ো! মুখে শান্তির বুলি আউড়ে মনে সংগ্রামের বিষ জিইয়ে রেখে মানুষ আর যাই করুক দেশের দশের মঙ্গল সাধন করতে পারবে না কোনোদিন। মানবতাবোধের অপমান সমগ্র মানবজাতিকেই হাড়ে হাড়ে পঙ্গু করে দেবে একদিন।

চৌদ্দরশির বাজার আমাদের তল্লাটের নামকরা বাজার। মঙ্গলবার ও শনিবারে হাট বসার জন্যে বহুদূর গ্রামাঞ্চল থেকেও লোক আসত বেচাকেনার জন্যে। ধান, চাল, পাট, দুধ, মাছ, তরিতরকারির রাশি রাশি অস্পষ্ট ছবি আজ মনে পড়লে স্বপ্ন বলে ভুল হয়। অল্প মূল্যে বেশি জিনিস এখানে কোথায় পাওয়া যাবে বলুন? ‘দুধ বা মাছ’ কোনোদিন আমাদের গ্রামে সের হিসেবে বিক্রি হয়নি। খুব মাগগি বাজারেও চার আনায় আড়াই সের খাঁটি দুধের হাঁড়ি কিনেছি। তরিতরকারি তো নামমাত্র মূল্য।

বুধাই শীলকে মনে পড়ে। ‘বুদ্ধিদা’ বলে আমরা ডাকতাম তাঁকে। সংগীতবিদ্যায় তাঁর কৃতিত্ব স্মরণযোগ্য। তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার যন্ত্রে তাঁর হাত ছিল অসাধারণ। তাঁর আঙুলের স্পর্শ পেয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলো যেন কথা বলে উঠেছে। আমরা ছিলাম তাঁর বাজনার নিয়মিত শ্রোতা। বাবুদের বাড়িতে গানবাজনার আসর বসলেই বুদ্ধিদার ডাক পড়ত সকলের আগে। ওঁদের বাড়িতে শিক্ষকতা করে তাঁর সংসার নির্বাহ হত। আজ বুদ্ধিদা কোথায়? সংহারের উন্মত্ত পরিবেশের মধ্যে সংগীতের সৃজনী প্রতিভা কোনো নিরাপদ দূরত্বে তাঁকে নিয়ে যেতে পেরেছে কি না জানি না! দূরে গিয়েও তিনি বেঁচে আছেন কি না তাই বা কে বলে দেবে? ডাক্তারখানার পুকুরে আজ আর লোকসমাগম হয় না শুনেছি। স্কুলের মাঠের আর সে পরিবেশ নেই, সুরেশবাবুও অন্য কোথাও পলাতক, পূজাবকাশে জনতার ভিড় নেই, জমিদারবাড়িতেও পুজো বন্ধ। সব আনন্দ কে যেন একসঙ্গে অপহরণ করে নিয়ে এক অভিশপ্তভূমিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছে সমস্ত দেশটিকে। আমরা আজ আপন ঘরেই তাই পরবাসী।

.

খাসকান্দি

অনেকদিন আগেকার কথা।

চাকরি উপলক্ষে কিছুদিন ছিলাম অসমের, এক মহকুমা-শহরে। আত্মীয়স্বজনবিহীন প্রবাসজীবনে তখন আসন্ন ছুটির মধুর আমেজ। সকালে সবে ঘুম থেকে উঠেছি। এমনসময় দেখা দিলেন এক নব-পরিচিত বন্ধু। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুতে উঠলাম। দেয়ালে পেরেক ঠুকে সাজানো ছিল একগাদা টুকরো কাগজ। তাতে টুথ-পাউডার ঢেলে নেওয়া রোজকার অভ্যেস। সেদিনও ছিঁড়ে নিলাম একটুকরো কাগজ। আপন মনেই বললাম : আর একুশ দিন।

বন্ধু শুধালেন : কীসের একুশ দিন?

হেসে বললাম : ছুটির বাকি।

পেরেক ঠোকা কাগজগুলোর দিকে চেয়ে বন্ধু শুধোলেন : তাই কি ওতে লিখে রেখেছেন একুশ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু একুশ নয়, পর পর লেখা আছে এক পর্যন্ত।

বন্ধু বিস্মিত হলেন : কেন বলুন তো?

কারণ একটা দিন যায় আর ভেবে আনন্দ পাই যে, ছুটিটা আরও একটা দিন এগিয়ে এল। ওঃ, ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্যে আপনি তো একেবারে পাগল দেখছি!

সবিনয়ে জবাব দিলাম : শুধু বাড়ি যাবার জন্যে নয়, পাগল হয়ে আছি গাঁয়ে যাবার জন্যে ।

বলেন কী, এই বয়সেও গাঁয়ের জন্যে আপনার এত মমতা? গাঁয়ের মাটির জন্যে এত তীব্র আকর্ষণ।

নিশ্চয়ই! তাই তো কবি দেবেন সেন বলেছেন,

সব তীর্থ সার
তাই মা তোমার কাছে এসেছি আবার।

আরও অনেক কথাই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সেদিন বলেছিলাম। বন্ধু একটুখানি হেসেছিলেন মাত্র।

আমিও হেসেছিলাম সেদিন রাতে। জাগরণে নয়, স্বপ্নে।

ধুলো-ঢাকা যশোর রোডের বুকে নেমেছে বৈশাখী পূর্ণিমার উজ্জ্বল জ্যোছনা। পথের দু ধারে অর্জুন গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ প্রহরীর মতো। আলো-ছায়ার আলপনা আঁকা পড়েছে ধুলোর রাস্তায়।

ওই তো দেখা যায় বাঁশতলার পুল। বর্ষার খরস্রোত কুমারের উদ্ধত জলধারা যখন ওই সংকীর্ণ পুলের সংকীর্ণতর ছিদ্রপথে পথ খুঁজে মাথা আছড়াত অবিশ্রাম, পুলের মুখে তখন প্রতিবৎসর সৃষ্টি হত একটা তীব্র ঘূর্ণাবর্ত। ছেলেবেলায় আমরা ওকে বলতাম ‘বাটি’। ক্ষুধার্ত কুমার-নন্দন যেন মুখর মুখব্যাদান করে আছে তীব্র আক্রোশে। ছেলেবেলায় আমরা পুলের ওপর থেকে ওর ক্ষুধার্ত মুখে ফেলে দেখতাম কচুর পাতা, বটের ছোটো ডাল, ভাঁট ফুল, আরও কত কী। সেগুলো স্রোতের মুখে দু-তিনটে পাক খেয়ে ঘূর্ণাবর্তের অতল গহ্বরে যেত তলিয়ে। আমরা উচ্ছ্বসিত আনন্দে হেসে উঠতাম করতালি দিয়ে। ঘটনার ক্ষুরধার ঘূর্ণাবর্তে আজও অতলে তলিয়ে যাচ্ছে জীবনের আশা, আনন্দ, করতালি। কিন্তু আজ আর হাসবার অবসর নেই। আজ শুধু ক্রন্দন। কুমার, পদ্মা, মেঘনার তীরে তীরে শুধুই মর্মভেদী হাহাকার।

কিন্তু যে-কথা বলছিলাম।

ওই বাঁশতলার পুলের পাশ দিয়ে জেলা বোর্ডের ছোটো রাস্তা। দু-পাশ ধরে ছোটো ছোটো খেজুর গাছের সারি। ধানের খেত। দিগন্তবিস্তৃত গজারের বিলের রহস্যময় হাতছানি।

রাস্তা ধরে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেই ছোটো কাঠের একটা পুল। মস্ত বড় একটা তেঁতুল গাছের ছায়া দিয়ে ঘেরা। পুলের দু-পাশ দিয়ে কাঠের রেলিং! সকাল-সন্ধ্যায়, সময়ে অসময়ে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সকলের ওটা বেওয়ারিশ আড্ডার জায়গা। বর্ষায় ওর আশপাশে ছোটো ছোটো ছিপ দিয়ে মাছ ধরে ছোটো ছোটো ছেলেরা। বসন্ত সন্ধ্যায় ওই রেলিংয়ে ভর দিয়ে গলা ছেড়ে গান গায় কিশোর বালকের দল। যুবকদের আড্ডা-ইয়ার্কি চলে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। ক্রমে রাত বাড়তে থাকে। ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাকে মন্থর হয়ে আসে পল্লির আকাশ। বৃদ্ধেরা তখন ওই পুলে জমায়েত হয় সমাজ পঞ্চায়েতের ভূমিকা নিয়ে। ন্যায় ও অন্যায় শাসনের রকমারি ফতোয়া জারি করে। পুলের নীচে খালের জলধারা কুলকুল রবে বয়ে চলে।

এই তো পৌঁছে গেলাম গাঁয়ে।

গ্রাম, কিন্তু ম্যালেরিয়া-বিধ্বস্ত, নিরানন্দ, কুঁড়েঘর সম্বল কতকগুলো জীর্ণ শীর্ণ স্বপ্নহীন মানুষের বাসভূমি নয়। ঝকঝকে টিনের দু-তিন মহলা বাড়ি, আম-জাম নারিকেল-সুপারি কাঁঠালের বাগান, তাল-খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে ঘাট বাঁধানো কাক-চক্ষু জলভরা পুকুর, ত্রিনাথ-বাউল-হরিকীর্তন-যাত্রাদলের আনন্দধ্বনি মুখরিত প্রাঙ্গণ, আর পর্যাপ্ত আহার-নিদ্রা লালিত-তৈলচিক্কণ মানুষ–এই নিয়ে গড়া একটি মানববসতি। এই বাংলার গ্রাম। তোমার আমার সকলের। হায় রে সেদিন!

গ্রামে ঢুকতেই বাঁ-দিকে আগাছায় ঢাকা একটি পোড়ো ভিটে। গ্রামের ছেলে-বুড়ো যাকেই পরিচয় জিজ্ঞাসা করো, বলবে–হরিকাকার ভিটে।

ক্ষণেকের তরে সময়ের নদীতে লাগুক উজানের টান। ফিরে চলো কুড়ি বছর আগেকার এক মধুর চৈত্রসন্ধ্যায়।

হরিকাকার বাড়ি। সামনে আমগাছে ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের একপাশে চৈত্র পুজোর আসন পাতা।

দাওয়ায় বসে আছেন হরিকাকা। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের সরকারি কাকা। একহারা কালো চেহারা, করিৎকর্মা লোক। গ্রামের যাত্রাদলে পার্ট করেন। অর্জুনের ভূমিকা থেকে ঘেসড়ার ঘুঙুর-নৃত্য অবধি সব অভিনয়ে তিনি সমান দক্ষ।

হরিকাকা এবার জুড়ে দিয়েছেন চৈত্র পুজোর মেলা।

বিকেল হতেই গাঁয়ের শৌখিন ছেলে-বুড়োর দল একে একে জমতে লাগল কাকার আঙিনায়। আম গাছের তলায় কলার পাতা পেতে সবাই এক সঙ্গে পেল খিচুড়ি প্রসাদ। তারপর সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল বেলোয়ারি সং নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ। কেউ সাজল লোলজিহ্বা খঙ্গহস্ত মহাকালী, কেউ-বা বাঁশরিভূষণ শ্রীনন্দন কেউ ত্রিশূলধারী শ্মশানচারী ভোলানাথ, আবার কেউ-বা নৃত্যপরায়ণা সুন্দরী উর্বশী।

সারারাত ধরে চলে গৃহ হতে গৃহান্তরে সং নিয়ে পল্লিপরিক্রমা। পল্লিবাসীরা পরম আগ্রহে সঙের দলকে বাড়িতে ডেকে নেয়। গান শোনে। নাচ দেখে। সাধ্যমতো ‘বিদায়ি’ দেয় চাল ডাল পয়সা। দেখতে দেখতে সঙের দলের ভান্ডারীর ঝুলি ভরে ওঠে। কালের কুটিল গতি! সেই পল্লীবাসীরা আজ কোথায়?

অতএব ওপথ ছেড়ে চলো যাই গ্রামের ‘তরুণ পাঠাগারে। ওপাড়ার মুখুজ্জেদের কাছারি বাড়িতে গাঁয়ের ছেলেদের নিজের হাতে গড়া পাবলিক লাইব্রেরি। অনেকরকম বই ওখানে পাবে। গণেশ দেউস্করের দেশের কথা থেকে পাঁচকড়ি দে-র নীলবসনা সুন্দরী পর্যন্ত। পড়তে পড়তে সবুজ সঙ্ঘের মুখপত্র হাতে-লেখা মাসিক পত্রিকা ‘তরু’-র কয়েকটি পুরোনো সংখ্যাও হয়তো পেয়ে যাবে। তাতে কত সম্ভব অসম্ভব ধরনের লেখার সন্ধান পাবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারো না। দেশ-উদ্ধারের এক বিষম জ্বালাময়ী পরিকল্পনার যে আভাস ওতে প্রকাশিত হয়েছিল তার সন্ধানে একদিন পরমপরাক্রমশালী ব্রিটিশ শক্তির পর্যন্ত টনক নড়ে উঠেছিল। হাসবার কথা নয়। সত্যি, ওই পাঠাগারে অনেকবার পুলিশ সার্চ করেছে। কিন্তু সার্চের দিন আজ গত হয়েছে। ওই পাঠাগারের পাশের রাস্তা দিয়ে এখন ‘মার্চ’ করে চলেছে নতুন কালের পুলিশ। জানি না সে মার্চ কোনো ফার্স’ হয়ে দাঁড়াবে কি না। সেখানকার একালের অধিবাসীরা আজ গৃহহারা বাস্তুত্যাগী। তাদের হাতে ভিক্ষার ঝুলি।

কিন্তু গ্রাম পরিক্রমার এখনও অনেক বাকি। হরিকাকার বাড়ি বাঁয়ে রেখে, ডাইনে ফেলে অশ্বত্থা-গজানো উঁচু দোলমঞ্চ-চলো আরও এগিয়ে!

উলুধ্বনি শুনতে পাচ্ছ? বেলা এখন দুপুর। গাঁয়ের কোনো সম্ভ্রান্ত সীমান্তিনী বুঝি ‘দুধ-চিনি’ দিতে এসেছে পুজোমন্ডপে। কবে হয়তো ছেলের জ্বর হয়েছিল গরম লেগে। স্নেহময়ী মাতা মানত করেছিল পুত্রের রোগমুক্তি হলে পুজোমন্ডপে দেবীর আসনে দেবে দুধ-চিনি। ও তারই কণ্ঠের উলুধ্বনি। তুমি যদি এখন সেখানে উপনীত হও, তাহলেও প্রসাদ পাবে একটু চিনি বা একটুকরো বাতাসা। পল্লির দেবসেবার সঙ্গে মানব-সেবার যোগ অঙ্গাঙ্গি।

ওই পুজোমন্ডপে এ গাঁয়ের ‘টাউন হল’, আশপাশের পাঁচ গাঁয়ের ফৌজদারি দেওয়ানি আদালত। বছরে একবার এখানে হয় মহিষমর্দিনী দুর্গাপুজো। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো সকলের মন পুজোর তিনদিন বাঁধা থাকে এই মন্ডপের চতু:সীমানায়। গান বলল, বাজনা বল, আনন্দ বল, উৎসব বল,–সারাগাঁয়ের উচ্ছ্বসিত আনন্দ-ধারা ওকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ওই পুজোমন্ডপ গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। সন্ধ্যায় ওখানে গ্রামবৃদ্ধ সমাজপতিদের সভা বসে। কত আলাপ-আলোচনা, বিচারদন্ড চলে। প্রতিরবিবারে বসে হরি-সংকীর্তনের আসর। কলিযুগের মুক্তিমন্ত্র হরিনাম আর মৃদঙ্গের বোলে নৈশ পল্লির তারাভরা আকাশ মুখর হয়ে ওঠে। হায় রে! বাংলার সে-আকাশ জুড়ে আজ সর্বহারা আর্তনাদ, মৃত্যুর বীভৎস হাহাকার।

ওই পথ ধরে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে টিনের আটচালায় বসেছে পাঠশালা। কানাই মাস্টার রজব মৌলবির শিক্ষাদান চলেছে অব্যাহত গতিতে। পাঠশালার সামনে দেখবে, ছেলেরা সার ধরে দাঁড়িয়ে নামতা পড়ছে সমবেত কণ্ঠে–দুই একে দুই, দুই দু-গুনে চার ইত্যাদি।

তাই বলে এই ভরা দুপুরবেলা ওপথ ধরে আর যেয়ো না কিন্তু। জানো না তো আর কিছুটা এগিয়েই পথ শেষ হয়েছে পুরোনো কালীখোলায়। বেতের ঝোঁপ আর ভাটির জঙ্গল দিয়ে ঘেরা সামান্য একটু জায়গা। দুটো প্রাচীন বট গাছ শাখা-প্রশাখা মেলে জায়গাটা একেবারে ঢেকে রেখেছে। তারি একপাশে খড়ের ভাঙা মন্দিরে বিকট দর্শন বিরাট কালীমূর্তি। উইয়ের ঢিপিতে ঢেকে গেছে পদতলে শায়িত মহাদেবের অর্ধেক দেহ। কাটা-কুমড়োর লতা এসে ঘিরে ধরেছে কালামূর্তির রূপালি মুকুট। একপাশে হয় তো আস্তানা গেড়েছে শেয়াল। ও নাকি মা কালীর জাগ্রত রক্ষী। তোমাকে দেখে যদি হঠাৎ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে চেঁচিয়ে ওঠে, তবে আর রক্ষা নেই। মা কালীর তৃতীয় নয়ন নাকি তাহলে বিদ্যুৎ চমকের মতো একবার তোমার ওপর দিয়ে খেলে যাবে। আর অমনি তুমি বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে–

আর কোথায় যাও? এই তো গ্রামের শেষ। ওই তো সামনে ধু-ধু করছে চম্পার বিল। তার থই থই-করা কালো জলে লাল পদ্মফুলের আলোকরা শোভা। সেই পদ্মফুল একদিন দিয়েছিলাম কিশোরবেলায় বন্ধুর হাতে অনুরাগের লীলাকমল করে। ফুল পেয়ে কিশোর বন্ধু উচ্ছ্বসিত হয়ে আমায় প্রণাম করেছিল। তার ছেলেমানুষিতে আমি হেসে উঠেছিলাম অট্টহাসি। সেই হাসি হেসেছিলাম আর-একদিন অসমের এক মহকুমা-শহরে। জাগরণে নয়, লীলাকমলের স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু যে স্বপ্ন এতক্ষণ তোমায় দেখালাম, সে তো শুধুই স্বপ্ন নয়। একদিন তো এই-ই সত্য ছিল। যে গ্রামটিকে কেন্দ্র করে একদিন স্বপ্নের জাল বুনেছিল অনেক কিশোরমানুষ সে তো একটি গ্রামমাত্র নয়, সে যে গ্রামকেন্দ্রিক বাঙালি সভ্যতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

গ্রামের নাম খাসকান্দি। ফরিদপুরের জেলা শহর থেকে যশোর রোড ধরে মাত্র সাত মাইল দুরে একটি সম্পন্ন-গ্রাম। সকাল বেলাকার নগর-সংকীর্তনের দল, দুপুরের পাঠশালা, অপরাহুের দুধের বাজার আর রাতের যাত্রাদলের আসরের জন্যে আশপাশের অনেক মানুষের মুখে মুখে একদিন ফিরত এই গ্রামের প্রশংসাধ্বনি। কিন্তু সে গ্রামের কথা আজ বুঝি আবাস্তব স্বপন-কাহিনিতেই পর্যবসিত হয়। হায় রে ধূলিলুষ্ঠিত বিশুষ্ক পলাশ, লীলাকমল! হায় রে আমার সোনার গ্রাম–আমার ছেড়ে-আসা গ্রাম!

.

কুলপদ্দি

ছোটোবেলার দিদিমার কোলে বসে এক স্বপনপুরীর গল্প শুনতাম। সেখানে গাছে গাছে সোনা ফলত। হিরার মতো বৃষ্টিরা ঝাঁক বেঁধে নেমে আসত সেই দেশের বুকে। নদীর কলতানে শোনা যেত বীণার ঝংকার। কত আগ্রহ নিয়ে সেই দিন সেই গল্প শুনেছি আর প্রশ্নের পর প্রশ্নে বিরক্ত করে তুলেছি বৃদ্ধা দিদিমাকে। সেদিন কি একবারও ভেবেছি যে আমাকেও একদিন এমনি গল্প শোনাতে হবে সকলকে; মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই পঙ্গু মন নিয়ে দিদিমার অভিনয় করতে হবে সারাটা দেশের সামনে?

দিদিমা মারা গিয়েছেন অনেককাল, কিন্তু অক্ষয় হয়ে আছে সেই স্বপনপুরী। সেদিনকার অবুঝ মনে সহানুভূতি জাগ্রত বন্দিনি রাজকন্যার জন্যে, আজ নিজের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে নিজের ওপরই অনুকম্পা হয়। তাই মনে মনে এখন স্বপ্নের জাল বুনি, স্মৃতির কুসুম নিয়ে রচনা করি তারই কাহিনি, কবিরা কল্পনায় যাকে গড়ে তোলে কাব্যে, আজন্ম শহরবাসীরা যার ছবি দেখে স্বপ্নে।

আড়িয়ালখাঁ নদী নয় নদ। স্ত্রী নয়, পুরুষ। কিন্তু তাকে পুরুষ কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। শুধু আমি কেন, তরঙ্গভঙ্গে উজ্জ্বল আড়িয়ালখাঁর তীরে দাঁড়িয়ে জগতের সবচেয়ে বেরসিক লোকও বোধ হয় বলতে পারে না- খাঁ সাহেব এমন নেচে নেচে কোথায় যাচ্ছ তুমি? তবু আড়িয়ালখাঁ নদী নয়, নদ। তার নাম গঙ্গা বা যমুনার মতো কিছুই হতে পারবে না, তার নাম থাকবে–আড়িয়ালখাঁ।

এই আড়িয়ালখাঁর তীরে আমার গ্রাম–কুলপদ্দি। দেশের কুলপঞ্জিতে এর জন্মতারিখের সন্ধান পাওয়া যায়নি, তাই নামকরণের ইতিহাসটিও জানানো গেল না; তবে গাঁয়ের বহুপুরোনো স্মৃতি পুরোনো বন্ধুর মতোই মনের পর্দায় জড়িয়ে জড়িয়ে রয়েছে।

প্রকান্ড গ্রাম। প্রায় পাঁচ হাজার অধিবাসীর সুখ-দুঃখের কাহিনি দিয়ে এর ইতিহাস গড়া আর ভৌগোলিক সীমারেখার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় মাদারিপুর মিউনিসিপ্যালিটির বাঁধানো খাতায়। পৌর-প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীভূত গ্রাম। তাই আশপাশের গ্রামগুলোর কাছে সে ভোজসভায় নৈকষ্যকুলীনের মতো, দেবসভায় ইন্দ্রতুল্য। যদিও বিদ্যাসাগরের মতো কেউ জন্মাননি আমাদের গ্রামে, কোনো বাদশাহি আমলের ইমামবাড়াও নেই এর ত্রিসীমানায়, তবু সেজন্যে কোনো দুঃখ নেই আমাদের। সেখানে যা আছে তাই যথেষ্ট-শালুকভরা বিল, গাছে গাছে পোষ-না মানা পাখি, ধু-ধু করা মাঠে সোনার ফসল।

কতদিন নির্জন মাঠে শুয়ে শুয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি। মনে হত এই গাঁয়ের একজন বলেই হয়তো চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ত আমার ঘরে! শরতের বাতাস উতলা হয়ে উঠত শেফালি ফুলের গন্ধে। বৈশাখের অপরাহ্বে যেখানে গাঁয়ের ছেলেরা ফুটবল খেলত আনন্দের প্রস্রবণ বইয়ে দিয়ে, বর্ষার ভরা বাদলে সেখানেই ডিঙি নিয়ে আসত ভিন গাঁয়ের লোকেরা বাজারে সওদা করতে। জ্যোৎস্না রাতে বড়ো গাঙের মাঝি জোর গলায় গান ধরত—’মরমিয়া রে, ও মরমিয়া। মোর মনের কথা কইমু আজি তোরে।’ সেই পল্লিগীতির সুরটুকু এখনও আমার মনে লেগে রয়েছে, শহরের কোলাহলে আজও তা মুছে যায়নি।

নাগমশাই ছিলেন পাঠলারার শিক্ষক। ছোটোখাটো লোকটি বয়সে নয়, আকৃতিতে। তাঁর বেতখানির কথা মনে পড়ে। সুদীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে স্ত্রী সুনন্দা এবং ওই বেত্রদন্ডখানা তাঁর সুখ-দুঃখের সঙ্গী। ওই বেতখানা দেখিয়ে দেখিয়ে সেদিন তিনি ছাত্র পড়াতেন। আজ সে-স্কুল ভেঙে গিয়েছে, ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে নাগমশায়ের গতানুগতিকতা।

কেশবদাকে ভুলিনি। কী দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল তাঁর যুবামহলে! গাঁয়ের এমন একটি ছেলেও ছিল না যে কেশবদার কথার অবাধ্য হতে সাহস পেত। সময়টা ছিল অগ্নিযুগ। আমি স্কুলে পড়ি। একদিন দুপুর বেলা স্কুল হতে ফিরছি, হঠাৎ কেশবদার সঙ্গে দেখা,–এই শোন তো। একেবারে attention-এ দাঁড়িয়ে পড়লাম।

কেশবদাকে ভালো লাগত। আদর্শ যাঁর উজ্জ্বল তাঁকে ভক্তি করা স্বাভাবিক। তাঁর ডাকে একবার নিঃশব্দে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি চাপা গলায় বলেছিলেন,’বন্দুক ছুঁড়তে জানিস?’

একটু অবাক হয়েছিলাম, মনে মনে ভেবেছিলাম–দু-দুটো বন্দুক আমাদের বাড়িতে, আর বন্দুক ছুঁড়তে জানি না? কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের বন্দুক দুটি ছিল অহিংস, আমাদের মতোই বৈষ্ণব। তা ছাড়া কেশবদার নিকট মিথ্যে বলাটাও ঠিক হবে না। বললাম,–না কেশবদা। এখনও শিখিনি।

আয় শিখিয়ে দেব।

একটু ভয় হল, তবু কেশবদার পেছন পেছন জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে বসলাম।

এটাকে কী বলে জানিস? ছোট্ট একটা চকচকে বন্দুক বার করলেন কেশবদা। এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। শঙ্কিত নয়নে চারদিকে তাকাতেই হেসে বলেন কেশবদা, ‘ভয় নেই, তুই দেখ না ভালো করে।

কেশবদা পিস্তলটা গুঁজে দিলেন আমার হাতে।

কয়েকটা দিনমাত্র কেশবদার শিষ্যত্ব করেছি। তারপর একদিন সকালবেলা শুনি, কেশবদার বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে ইংরেজ সরকার–দেশপ্রেমের অপরাধে।

আজও সেই কেশবদাকে দেখছি। বার্ধক্য এসেছে, তাঁর দেহে নয় শুধু, মনেও। ছোটোদের কয়েকটা ইজের আর প্যান্ট নিয়ে মানিকতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফেরি করছেন। নিঃসম্বল দেশকর্মী সংসারের ঘানি টানবার আর কোনো উপায়ই খুঁজে পাননি। এমনি কত ব্যর্থতার ইতিহাস জমে আছে সংসারের স্তরে স্তরে। জীবনের মাশুল দিয়ে কত জনেই তো পেল শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান কে তার হিসাব রাখে? তবু আজ গাঁয়ের পরিচয়ে কেশবদার পরিচয় না দিয়ে পারলাম না।

শুধু কেশবদার দেশপ্রেম নয়, কত ইন্দ্রনাথের মাছ চুরির কাহিনি বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় আমার গাঁয়ে, কত কবির কল্পনা অনাদৃত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে এর ঘাটে-পথে, কিন্তু বাইরের জগতের সঙ্গে কে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেবে?

ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙত বৈতালিকের গীতে। রাত্রিশেষে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভৈরবীর সুর ছড়াত আমাদের হরেকৃষ্ণ বৈরাগী। তার গানের বিষয়বস্তু ছিল–রজনি প্রভাত হয়ে এল, পাখিরা শিস দিতে আরম্ভ করেছে, একটু পরেই পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠবে, হে রাধাকান্ত! রাধিকার হৃদয়বল্লভ! আর কত ঘুমোবে, এবার তুমি জাগো। হরেকৃষ্ণ আর কার ঘুম ভাঙায় জানি না। রাধিকার হৃদয়বল্লভ তো সর্বত্রই আছেন, কিন্তু হরেকৃষ্ণের সুর আজ আর সেখানে ঝংকৃত হয় না কেন?

ষোলোখানা পুজো হত আমাদের গ্রামে। সে এক রাজসিক ব্যাপার! প্রায় শ-খানেক ঢাকের বাজনায় সমস্ত গ্রামটি সারারাত্রি সজাগ হয়ে থাকত। নবমীর রাত্রিতে শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেত অফুরন্ত আনন্দে। কুঞ্জদা হয়তো হঠাৎ বিচিত্রভঙ্গিতে একটু ‘লোকনৃত্যম’ দেখিয়ে দিতেন তাঁর পূজ্যপাদ খুডোমশায়কে, অনন্ত হয়তো রাত এগারোটায়ই এঁদো পুকুরটায় গা ডুবিয়ে জোর গলায় সূর্যস্তব শুরু করে দিত। অবশ্য এসব তাদের ইচ্ছাকৃত অপরাধ নয়, পরোক্ষে কোনো একটি তীব্র রসসুধা গ্রহণের প্রত্যক্ষ ফল।

কেষ্ট ডাক্তারের ঘরের আড্ডটি ভেঙে গেছে। সেখানকার নড়বড়ে চেয়ারগুলো হয়তো এতদিনে নতুন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। কী জ্বালাতনটাই না করতাম ডাক্তারকে! সকলের সেরা ছিল অনাথ, ভগবান তাকে মোটেই সুস্থ থাকতে দেননি। তার ছোঁয়াচ লাগলেই চেয়ারটেবিলগুলো চিৎকার জুড়ে দিত। আলমারিগুলো পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকত অকাল-মৃত্যুর আশঙ্কায়। ডাক্তার ছিল আমাদেরই বয়সি, ডাক্তারির চেয়ে আমাদের সে বেশি পছন্দ করত, আর সেজন্যেই আড্ডাটি জমত ভালো। আজ আর সেখানে আড্ডা জমে না। সেই অহেতুক উচ্ছ্বাস অসময়েই থেমে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ডাক্তারের কাছে আমরা এখন পরদেশি।

মনে পড়ে সরলা পিসির কথা। একটি লিচু কি আম তার গাছ থেকে নিয়েছ কী আর রক্ষা নেই। চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে তুলবে। বার বার বলবে,–‘আমার নাম সরলা। পাঁচু চ্যাটাজ্জির নাতনি আমি। আমি কাউকে ভয় করি নে। বখাটে ছেলেদের তোয়াক্কা রাখি আমি!’ কথাটা ইতিপূর্বে আরও শুনেছি, মেঘনাদবধকাব্যে প্রমীলা সুন্দরী বলেছিল,–‘রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী; আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?’ সরলা পিসির কথাটা এরই আর এক সংস্করণ বলে বখাটে ছেলেরা ধরে নিত।

গ্রামটি সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ফুটবল খেলায়। মহকুমায় সে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহকুমায় সীমা ছাড়িয়েও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। দূরের কোথাও কোথাও খেলতে গেলে কুলপদ্দির নাম শুনেই অগণিত লোক হত মাঠে। শুনেছি গাঁয়ের দু-একজন খেলোয়াড় ইদানীং কলকাতা এসে কোনো কোনো দলে নাম লিখিয়েছে। আমাদের ফরওয়ার্ড প্রিয়লালই যে একদিন মেওয়ালাল হয়ে দাঁড়াবে না তাই-বা কে বলতে পারে?

গাঁয়ে সর্বজনীন আনন্দের সাড়া জাগত বিজয়া-সম্মিলনী আর নববর্ষ উৎসবে। এর উদ্যোগপর্ব যা চলত তা মহাভারতের উদ্যোগপর্বকেও হার মানায়। গাঁয়ের মাঝখানে কোনো বিরাট নাটমন্দিরে দু-তিন দিন ধরে এর অনুষ্ঠান চলত। জলসা ও অভিনয় তো হতই, তা ছাড়া আবৃত্তি, রসরচনা, হাস্যকৌতুক ইত্যাদির প্রতিযোগিতায় শহরের এবং আশপাশের গাঁয়ের শিল্পীরাও এসে যোগ দিতেন।

খেজুরের গুড় ও ইলিশ মাছের জন্যে প্রসিদ্ধ এই অঞ্চল। আড়িয়ালখাঁর জলে হাজার হাজার জেলে-ডিঙি ইলিশ মাছের আশায় ঘুরে বেড়াত। লাইনের স্টিমারগুলো রাস্তা না পেয়ে ভোঁ ভোঁ করে চিৎকার করত। সে চিৎকার এখনও কানে বাজে।

আমার জীবনের স্মৃতি ওই আড়িয়ালখাঁর সঙ্গে মিশে আছে। আড়িয়ালের জলে মুছে যেত আমার দেহের ধূলি, শান্ত হত মনের আবেগ। শিশুকালে এর তীরে বসে কত খেলা করেছি, চলতি স্টিমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কত দৌড়েছি, কৈশোরে তার রুদ্রমূর্তি দেখে ভীতও হয়েছি; কতদিন এর তীরে বসে দিগন্তের মন-মাতানো ছবি দেখেছি। আজ কোথায় গেল সেসব, কত দূরে সেই আড়িয়ালকে ফেলে এসেছি। গাঁয়ের ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে এত শান্তি আছে, ওই নিরক্ষর গ্রামবাসীর অন্তরে যে এত ভালোবাসা আছে, ওই আড়িয়ালখাঁর ঘোলাটে জলে যে এত আকর্ষণী শক্তি আছে, তা এতদিন এমন করে অনুভব করিনি, আজ দেখি, আমার সমস্ত মন জুড়ে আছে সেইসবেরই স্মৃতি!

আমার সেই সাধের গ্রাম ধ্বংসের মুখে। আমার বাল্যের লীলাভূমি, কৈশোরের খেলাঘর, যৌবনের স্বর্গ পরিত্যক্ত, শূন্য-লোকালয়। এক নিষ্ঠুর আঘাতে সে আজ মৃতপ্রায়। শুধু আমার গ্রামের নয়, এমনি কত শত শত গ্রামের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীর বুকে আজ জ্বলছে অনির্বাণ চিতা, কণ্ঠে শুধু হা-হুঁতাশ, চোখে জল! কিন্তু সবই কি ভাগ্য? যদি তাই হয় তবে এই নিষ্ঠুর আঘাত আমি মেনে নিতে পারব না। দেশের ভাগ্যনিয়ন্তাদের ওপর থাকবে আমার চিরন্তন অভিশাপ, ভাগ্যের বিরুদ্ধে থাকবে বিদ্রোহ! আর আমার হতভাগ্য দেশবাসীকে অনুরোধ করব স্মরণ করতে কবিগুরুর সেই বাণী–’ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে, ভিক্ষা না যেন যাচি।

1 Comment
Collapse Comments
পিংকু সাহা June 24, 2022 at 2:58 am

প্রণাম নিবেন,আপনার পুরো নাম ঠিকানা ফোন নম্বর দিবেন।

আমার বাড়ী কোটালীপাড়া। আমরা এখনো কোটালীপাড়া থাকি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *