দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ফরমাইয়ে

ফরমাইয়ে

আহা। আপনার কী সুন্দর সংসার। কী শান্তির সংসার। ঝগড়া নেই, ঝাঁটি নেই। সবাই হাসছে, খেলছে, গাইছে। পায়ে-পায়ে বেড়াল ঘুরছে। লোমওয়ালা আদুরে কুকুর সোফার ওপর ছবির কুকুরের মতো বসে আছে। বলতে পারেন, রহস্যটা কী। কেমন করে করলেন এমন?

খুব সহজ। এর আবার রহস্য কী? ইচ্ছে করলে আপনার সংসারেও এই ছিরি আপনি আনতে পারেন। তাহলে শুনুন একটা পুরোনো গানের গোটা-দুই লাইন, দু-চার দিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে। সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালা কালের কর্তা এসে। এই গানই হল আমার গৃহ শান্তির উৎস। আমি নিজেকে কর্তা ভাবি না। সব সময় আমি ভাবি, আমি এক বড়লোকের বাড়ির উর্দিপরা চাকর। ডিগনিফায়েড সার্ভেন্ট। কী রকম চাকর। রেস্তদার চাকর। পয়সাকড়ি চায় না, উলটে দুহাতে যোগান দিয়ে যায়। দুটো শব্দ আমি মনে মনে অনবরত বলি, জি হাঁ, আর ফরমাইয়ে।

আজ ফুলকপি এনো না, বাঁধাকপি। জি হ্যাঁ। আজ আর কাটা পোনা নয়, ট্যাংরা। জি হাঁ। আজ যেমন করেই হোক পলতার পলুমাসির বাড়ি গিয়ে বাতের তেলটা দিয়ে আসবে। জি হাঁ। অফিস থেকে ফেরার পথে চিৎপুরের মশারিপটিতে নেমে ছয় বাই সাত মাপের একটা মশারি কিনে আনবে। জি হাঁ। যাওয়ার পথে খানিকটা ঘুরবে। মানে তিন-চার মাইল উজিয়ে যাবে, সেখানে সেই বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান, সেখানে প্রেসক্রিপশানটা জমা দিয়ে অফিসে চলে যাবে তারপর ছুটির পর আবার যাবে, ওষুধটা নেবে, নিয়ে বাড়ি চলে আসবে। জি হাঁ। একবারও বললুম না কাঠফাটা রোদে অফিসের তাড়া মাথায় নিয়ে কেমন করে প্রেসক্রিপশন জমা দেব বা ফেরার পথে ওষুধ নিয়ে কেমন করে মাঝরাস্তা থেকে ভিড়ের বাসে উঠব। গড়িয়ায় গোপালের মেয়ের বিয়ে, তুমি তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে আসবে, আমরা সব রেডি হয়ে থাকব। তুমি আসামাত্রই বেরিয়ে পড়ব। জি হাঁ। একবারও বললুম না কেমন করে ডালহৌসি থেকে সোদপুরে আসব, এসেই আবার গড়িয়া ছুটব। তারপর আবার ফিরে আসব সোদপুর। এরপর শরীরের কী হাল হবে। পিজিতে পদ্মপিসি পড়ে আছেন। গলব্লাডার উচ্ছেদ হয়েছে। অফিস থেকে টুক করে বেরিয়ে একবার দেখে আসবে। বলবে, মিঠুর পরীক্ষা তো, তাই আমি কোথাও নড়তে পারছি না। জি হাঁ। একবারও বললাম না, মিঠুর পরীক্ষা বলে তো কোনও কিছুই বন্ধ নেই। প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প চলছে চুটিয়ে। জমিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখা হচ্ছে। পাখার ব্লেডগুলো ময়লা হয়েছে। চেয়ারে টুল চড়িয়ে খুলে একটু সাফ না করলে, লোকে কী বলবে। জি হাঁ। একবারও বললুম না, হাওয়ার বেলায় সবাই আর সাফাইয়ের বেলায় আমি? আমি কখনও কিছু খেতে চাই না। যে যা দেয়, তাই হাসি-হাসি মুখে খাই। খিদেয় পেট জ্বলে গেলেও বলি না। কখনও বলে, আজ তুমি মুড়ি খাও। বেশ, তাই খাই। মিইয়ে গেছে যাক। বোধ হয়, কৌটোর ঢাকনা খোলা ছিল। আমার কী দরকার বাবা, কে খুলেছে, কেন বন্ধ করেনি। এই সব প্রশ্ন করে জল ঘোলা করার। কোনও দিন বললে, আজ দুটো রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট, তোমার জলখাবার। বেশ বাবা, তাই হোক। আমি যখন বাপের বাড়িতে ছিলুম, তখন আমার হম্মি তম্বি সাজত। এই খাব না, ওই খাব না, বলে টান মেরে ফেলে দেবার সাহস ছিল। এখন আমি ওদের গোয়ালে থাকি। রোজ আমাকে দুইলে শতখানেক টাকার মতো পায়। আবার দুধ ছাড়াও যেমন ঘুঁটে মেলে, সেই রকম এদিক-সেদিক থেকে গোটাপঞ্চাশ টাকা কামাই হয়। আমাকে সিকিউরিটি খাড়া করে ধার দেনাও মেলে। ইনস্টলমেন্টে মাল আসে। কোনও কোনও দিন ফ্যামিলি আনন্দে থাকলে ঠান্ডি পোলাও-এর বদলে ভাত-ভাজা জোটে। সঙ্গে একটা ফিশ-ফ্রাই।

ঠান্ডি পোলাওটা কী?

ঠান্ডা ভাত।

আর ভাত-ভাজাটা কী?

ওই যে বাঙালি বাড়ির রসিকতা ফ্রায়েড রাইস।

রবিবার আমি ছুটির বার বলে কোনও রকম আরাম খোঁজার চেষ্টা করি না। সেদিন আমি গজলিয়ার মেজাজে থাকি। যখনই প্রশ্ন শুনি, আজ তোমার অন্য কোনও কাজ আছে? সঙ্গে সঙ্গে আমি আদাব করে বলি, ‘ফরমাইয়ে জি।’

তাহলে যাও না সিনেমা দেখে দেখে পচে গেছে। থিয়েটারের গোটা কতক টিকিট কেটে আন না। জি হাঁ। রবিবার বাসে-ট্রামে পা ঠেকাব না, এই প্রতিজ্ঞা আর রইল না। বিকেলে মত বদলে গেল। জানা গেল, টিভি তুরুপের তাস ফেলেছে। থিয়েটারের টিকিট বিক্রি করে এসো। সকালের ক্রেতা সন্ধ্যায় বিক্রেতা। থিয়েটার তো আর সিনেমা নয়, যে বাতাসে টিকিট দোলানো মাত্রই দুশো লোক ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় লজ্জা-লজ্জা মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলুম—টিকিট টিকিট। থিয়েটারের প্রবেশ-পথে আলো জ্বলছে। অভিনেতা অভিনেত্রী, নর্তকীদের বড় বড় ছবি দিয়ে চারপাশ সাজানো। সুন্দর সুন্দর পোশাক-পরিহিত নরনারীরা, খুশি-খুশি মুখে এপাশ-ওপাশ দিয়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে টিকিট টিকিট করছি। কোনও ক্রেতা নেই। আমারও কোনও তাগিদ নেই। বিক্রি হয় হবে। না হয় ছিঁড়ে ফেলে দেব।

সংসার নামক থিয়েটারের বাইরে দাড়িয়ে টিকিট বিক্রি। কেনা টিকিট আবার বিক্রি। ওইতেই পরম সুখ। সংসারেও শান্তি। না অভিনেতা, না দর্শক। আছিও বটে, নেইও বটে। নিজেকে খাটাতে চাই না, মুখ বুজে খেটে যাই। যেমন বাইবেল বলেছেন—মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাঁচো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *