ফরচুনেটলি, দ্য মিল্ক

ফরচুনেটলি, দ্য মিল্ক

উৎসর্গ

আমার মরহুম পিতা ডেভিড কে, যিনি বেঁচে থাকলে খুব আনন্দের সাথে এই গল্পটা সবাইকে শোনাতেন। আর আমার ছেলে মাইকেলকে, যে তার একটা শব্দও বিশ্বাস করত না।
– এন… জি…

আমার বাবাকে, যিনি গল্প কথক ছিলেন। আর ছিলেন সবাইকে হাসাতে ওস্তাদ। তোমাকে খুব মিস করি।
— এস… ওয়াই…

.

ফ্রিজে কমলার রস ছাড়া আর কিছু নেই! সিরিয়াল যে ভিজিয়ে নেব, তার আর উপায় কই? অবশ্য কেউ যদি মনে করে যে টোস্টিওস (একটি সিরিয়ালের ব্রাণ্ড)-এর সাথে কেচাপ বা মেয়োনেজ বা আচার খেতে ভাল লাগবে, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু আমার তা মনে হয় না, আমার পিচ্চি বোনেরও না। যদিও আমার বোন উল্টা-পাল্টা জিনিস, এই যেমন—চকলেট মেশানো মাশরুম খেয়ে অভ্যস্ত!

‘দুধ নেই?’ জিজ্ঞেস করল ছোট বোন।

‘না।’ উত্তরে বললাম। তা-ও থাকতেও তো পারে ভেবে, জ্যামের পিছনে আরেকবার দেখে নিলাম।

নাহ, একটুও নেই!

আম্মু এক কনফারেন্সের কাজে কোথায় জানি গিয়েছে। ওখানে তার সরীসৃপের উপর একটা লেখা উপস্থাপন করার কথা। যাবার আগে আমাদেরকে খুব ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার অনুপস্থিতিতে কোন-কোন কাজটা করা খুব জরুরি।

আব্বু পেপার পড়ছিল। আমার মনে হয় না, পেপার পড়ার সময় তার দুনিয়াদারির কোন খবর থাকে!

‘শুনেছ আমার কথা?’ আম্মুরও মনে হয় একই ধারণা। ‘কী কী করতে বলেছি?

‘শনিবার বাচ্চাদেরকে অর্কেস্টা প্রাকটিসে নিয়ে যেতে ভুলো না। বুধবার রাতে ভায়োলিন; তুমি যে কয় রাত থাকবে না, সে কয় রাতের জন্য খাবার রান্না করে রেখে গিয়েছ; বোঝার সুবিধার জন্য প্রতিটায় লেবেলও লাগিয়ে দিয়েছ; বাড়ির বাড়তি চাবিটা আছে নিকোলসনদের কাছে; মিস্ত্রি আসবে সোমবার সকালে; তাই সে আসার আগে ভুলেও উপর তলার টয়লেট ব্যবহার করা বা ফ্ল্যাশ করা যাবে না; গোল্ডফিশদের খাবার দিতে যেন ভুলো না; তুমি আমাদের সবাইকে ভালবাস আর বৃহস্পতিবার ফিরে আসবে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল আব্বু।

আমার মনে হয় আম্মুও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ‘হুম, ঠিক আছে।’ বলে সবাইকে চুমু খেল। তারপর বলল, ‘ওহ, আরেকটা কথা। আমাদের দুধ প্রায় শেষ। কিনে নিয়ো।’

আম্মু চলে যাবার পর, আব্বু চা বানিয়ে খেল। অল্প একটু দুধ ছিল তখনো।

এক নাম্বার খাবারের প্যাকেটটা গরম করলাম আমরা, কিন্তু তা করতে গিয়ে এমন গোলমাল পাকিয়ে ফেললাম যে ঠিক হলো—ইণ্ডিয়ান এক রেস্তোরাঁয় খাওয়া হবে আজ। রাতে ঘুমাবার আগে, আব্বু আমাদেরকে এক মগ করে গরম চকলেট বানিয়ে খাওয়ালেন, যেন আম্মু না থাকার দুঃখ একটু হলেও লাঘব হয়।

এসবই গত রাতের কথা।

বর্তমানে ফিরে আসি, ‘সিরিয়াল খেয়ে নাও।’ বলল আব্বু। ‘মনে রেখো, আজ বিকালে অর্কেস্টা প্রাকটিসে যেতে হবে।’

সিরিয়াল খেতে পারব না।’ মন খারাপের সুরে বোন বলল।

‘কেন?’ আব্বু বলল, ‘আমাদের সিরিয়ালের কোন অভাব নেই। টোস্টিওস আছে, মুয়েসলি আছে। আমাদের বাটিরও অভাব নেই। চামচটা গেল কই? চামচ জিনিসটা কিন্তু দারুণ। কাঁটা চামচের মতো, কিন্তু ওরকম খোঁচা খোঁচা না।’

‘দুধ নেই।’ বললাম।

‘দুধ নেই।’ বোন পুনরাবৃত্তি করল।

আব্বুকে দেখে মনে হলো, চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল বলবে, এমন কিছু যেন নাস্তায় খাই যেটা বানাতে দুধ লাগে না। এই যেমন সসেজ। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, দুধ ছাড়া সে চা খাবে কীভাবে! চেহারা কালো হয়ে এল সাথে সাথে।

‘আহারে, আমার বাছারা!’ বলল আব্বু, ‘এক্ষুণি মোড়ের দোকানটায় যাচ্ছি। দুধ আমি আনবোই আনব।’

‘ধন্যবাদ।’ বোন বলল।

‘তবে ননী-মুক্তগুলো এনো না।’ সাবধান করে দিলাম, ‘খেতে তো পানির মতো লাগে।’

‘ঠিক,’ বলল আব্বু, ‘ও জিনিস আনাই যাবে না।’

বাইরে বেরিয়ে গেল সে।

একটা বাটি টেনে নিয়ে তাতে টোস্টিওস ঢাললাম, তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। শুরু হলো অপেক্ষা।

***

‘কতক্ষণ হলো?’ জানতে চাইল বোন।

‘অনেকক্ষণ,’ জানালাম।

‘আমিও তাই ভেবেছি।’

কী আর করা, কমলার রস খেলাম প্রথমে। কিছুক্ষণ ভায়োলিন বাজালো বোন।

এক সময় বিরক্ত হয়ে বন্ধ করার অনুরোধ জানালাম। কথা শুনল।

তবে আমাকে ভেঙচি কাটার পর!

‘এখন কতক্ষণ হলো?’ জিজ্ঞেস করল খানিক পরেই।

‘অনেক-অনেকক্ষণ।’ বললাম।

‘আচ্ছা, যদি আব্বু আর কখনো ফিরে না আসে?’ আবার জিজ্ঞেস করল। ‘তাহলে আর কী, আচার খেয়ে থাকতে হবে।’

‘নাস্তায় আচার খাওয়া ঠিক না।’ উত্তরে বলল বোন, ‘আর আমার আচার খেতে একদম ভাল লাগে না। যদি আব্বুর কোন খারাপ কিছু হয়? আম্মু কিন্তু আমাদের দুষবে।’

আমার মনে হয় কোন বন্ধুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে বলতে আর সময়ের কথা খেয়াল নেই।

একটা শুকনো টেস্টিওস মুখে পুরলাম-দেখি কেমন লাগে! মন্দ না, কিন্তু দুধ হলে আরও মজা পাওয়া যেত।

দরজায় ‘ধুপ ধাপ’ একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু পরেই আব্বু ঘরে ঢুকল।

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ জানতে চাইল বোন।

‘হুম, মজার একটা ব্যাপার হয়েছে।’ বলতে শুরু করল আব্বু।

‘দোকানে কারও সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল, আর গল্পে গল্পে কয়টা বাজে সেদিকে কোন নজর ছিল না, তাই না?’ বললাম আমি।

‘প্রথমে তো দোকানে ঢুকেই দুধ কিনলাম।’ আব্বু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলা শুরু করল, ‘আর মি… রনসনের সাথে দেখাও হয়েছিল। তিনি খবরের কাগজ কিনছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ কথা হয়নি। আমি দোকান থেকে বেড়িয়ে ঘরে ফিরছি, এমন সময় মাথার উপর অদ্ভুত এক শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকটা এরকম-থুমমমমথুমমম। উপরে তাকিয়ে দেখি, মার্শাল রোডের উপরে একটা বিশাল রুপালি সসার উড়ছে!

‘হায় খোদা!’ নিজেকেই বললাম আমি, ‘এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।’

‘একের পর এক! এই রুপালি সসার দেখাটাই একমাত্র অদ্ভুত ঘটনা না?’ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম আমি।

‘ঠিক বলেছ-অদ্ভুততর।’ ব্যাখ্যা দিল না আব্বু। ‘ওই সসারটা থেকে কেমন একটা আলোর স্তম্ভ বের হচ্ছিল—এক ধরনের চকচকে, ঝকঝকে আলো। এমনকী দিনের আলোতেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এরপর অবাক হয়ে দেখি, আমাকে কে যেন সসারে তুলে নিয়েছে। তবে কপাল ভাল, দুধের প্যাকেটটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।

সসারটার ডেক ছিল ধাতুর তৈরি। কমপক্ষে একটা খেলার মাঠের সমান! ‘

‘অনেক দূর থেকে তোমাদের পৃথিবীতে এসেছি আমরা।’ সসারের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর একটা বলল।

মানুষ বলছি, কিন্তু আসলে ওরা দেখতে কেমন যেন সবুজ-সবুজ আর আঠালো দেখতে। চেহারাতেও বদমেজাজি বদমেজাজি ভাব।

‘এখন তোমাকে তোমার প্রজাতির দূত হিসেবে আদেশ করছি, এই পুরো গ্রহটাকে আমাদের নামে লিখে দাও। আমরা একে নতুন করে সাঁজাতে চাই।’

‘জান থাকতে দিচ্ছি না।’ বললাম আমি।

‘তাহলে আর কী করা…’ প্রাণীটি বলল, ‘আমরা এখানে তোমার সব শত্রুদের নিয়ে আসব। ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিশ্চয় আমাদেরকে গ্রহটা লিখে দেবে।’

আমার আবার শত্রু আসবে কোথা থেকে? প্রশ্নটা ওদেরকে করতে যাব, এমন সময় একটা বড় ধাতুর দরজার উপর কিছু লেখা দেখতে পেলাম :

ইমার্জেন্সী এক্সিট
কারণ যাই হোক না কেন, দরজা খুলো না
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি!

আমি কি আর মানি! খুলে ফেললাম দরজা।

‘ও কাজ কোরো না?’ একটা সবুজ-সবুজ, আঠালো প্রাণী আঁতকে উঠল, ‘তুমি তো সময় সুড়ঙ্গকে ভিতরে এনে ফেলবে!’

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি লাফ দিলাম…

…পড়ে যেতে থাকলাম নিচে …

কপাল ভাল যে, তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম দুধের প্যাকেট। তাই যখন

সমুদ্রের পানিতে আছড়ে পড়লাম, তখনও কাছ ছাড়া হয়নি

‘এটা আবার কী?’ এক মহিলার গলার স্বর শুনতে পেলাম, ‘বড় মাছ? মৎস্য কন্যা? নাকি কোন গুপ্তচর?’

আমি বলতে চাইলাম যে, আমি উপরের একটাও না। কিন্তু তখন মুখ ভর্তি সমুদ্রের পানি, তাই গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। টের পেলাম কেউ একজন আমাকে টেনে তুলছে একটা জাহাজে। উপরে উঠে দেখি, ডেকে অনেকে দাঁড়িয়ে। সবাইকে খুব বিরক্ত মনে হলো।

‘কে তুমি, স্থল-প্রেমী?’ মহিলা বলল, মাথায় বিশাল এক হ্যাট পরা। কাঁধে একটা তোতা পাখি।

‘গুপ্তচর! গুপ্তচর!! কোট পরা সিন্ধু ঘোটক! অথবা নতুন প্রজাতির কোন মৎস্য কন্যা!’ উপস্থিত পুরুষরা বলল।

‘এখানে কি করছ?’ জানতে চাইল মহিলা

‘বলছি,’ শুরু করলাম, ‘মোড়ের দোকানটাতে গিয়েছিলাম আমার ছেলে-মেয়ের

সকালের নাস্তার আর আমার চায়ের জন্য দুধ কিনতে। এরপরই দেখি—

‘মিথ্যে বলছে, মহামান্যা!’

কাটলাস (এক ধরনের তলোয়ার) টেনে বের করল মহিলা, ‘তোমার এত বড় সাহস? জলদস্যুর রাণীর সাথে মিথ্যা কথা বল?’

কপাল ভাল যে, দুধের প্যাকেটটা কাছ ছাড়া করিনি। তাই দেখাতে পারলাম।

‘যদি আমি মিথ্যা কথা বলেই থাকি, তাহলে এটা এখানে কীভাবে এল?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

একেবারে মুখ বন্ধ হয়ে গেল সবার। ‘দয়া করে,’ বললাম, ‘যদি আমাকে আমার গন্তব্যের ধারে-কাছে কোথাও নামিয়ে দিতে, খুব উপকার হত।’

‘তা তোমার গন্তব্যটা কোথায়?’ জলদস্যুদের রাণী জানতে চাইল।

‘মার্শাল রোড আর ফ্লেচার লেন যেখানে এক হয়েছে, সেখানে।’ জানালাম, ‘আমার ছেলে-মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘তুমি এখন একটা জলদস্যুর জাহাজে, সোনামণি,’ জলদস্যুদের রাণী বলল, ‘তোমাকে কোথাও নামিয়ে দেয়া হবে না। তোমার সামনে এখন দুইটা পথ অবশিষ্ট আছে-হয় আমার সঙ্গে যোগ দাও, নাহলে তোমার গলা কেটে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হবে। মাছেরা খুবলে খুবলে খাবে তোমার দেহ।’

‘তক্তার ওপরে হাঁটতে হবে না?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘তক্তার ওপরে হাঁটা! সে আবার কি?’ সবগুলো জলদস্যু একসাথে বলে উঠল।

‘তক্তার উপরে হাঁটা!’ অবাক হলাম, ‘আসল জলদস্যুরা তো সেভাবেই সাজা দেয়! আচ্ছা বুঝাচ্ছি। এখানে কোথাও কোন তক্তা আছে?’

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজা-খুঁজি করার পর, একটা পাওয়া গেল। নিজে দাঁড়িয়ে জলদস্যুদের শেখালাম যে কীভাবে তক্তাটা রাখতে হয়। একবার ঠিক হলো যে, তক্তাটাকে পেরেক পুঁতে জায়গামতো আটকে রাখা হবে। কিন্তু রাণী ঠিক করল, সবচেয়ে মোটা দুই জন জলদস্যুকে তক্তার এক মাথায় বসিয়ে রাখাই যথেষ্ট।

‘আচ্ছা, তুমি এই তক্তার উপর দিয়ে হাঁটতে চাও কেন?’ রাণী জানতে চাইল।

তক্তার প্রায় শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আমি। পায়ের নিচে শুধু ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের নীল জলরাশি।

‘আসলে,’ বললাম, ‘আমি জলদস্যুদের নিয়ে লেখা অনেক বই পড়েছি। আর ওগুলোতে সব সময় দেখা যায় যে, উদ্ধারকারী দল ঠিক তখনই আসে, যখন—’

উদ্ধারের কথা শুনেই জলদস্যুরা হাসতে শুরু করল। সে এমন হাসি যে তার দমকে পেটের চর্বিগুলো যেন থলথল করে উঠল, তোতা পাখি ভয় পেয়ে উড়াল দিল।

‘উদ্ধার?’ বলল ওরা, ‘এখানে কে উদ্ধার করতে আসবে? আমরা এখন সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে।’

‘তারপরও,’ ওদের হাসিতে হতোদ্যম না হয়ে বললাম, ‘যদি উদ্ধারের বিন্দুমাত্র আশাও থাকে, তাহলে তা ঘটবে তক্তার উপর দিয়ে হাঁটার সময়।’

‘কিন্তু এহেন কর্ম তো এর আগে আমরা করিনি।’ রাণী বলল, ‘এই নাও। একটা স্প্যানিশ ডাবলুন দিলাম। এখন আমাদের সাথে যোগ দাও। অনেক মজার মজার অভিযানে যাই আমরা। এই আঠারো শতকে একজন বুদ্ধিমান আর আগ্রহী জলদস্যু অনেক উন্নতি করতে পারে।’

আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়া ডাবলুনটা আঁকড়ে ধরলাম। ‘পারলে তো ভালই হত, জানালাম ওকে, ‘কিন্তু আমার ছেলে মেয়েরা যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের সকালের নাস্তার জন্য দুধ দরকার।’

‘মর তাহলে!
হাঁট তক্তার উপর দিয়ে!’

একেবারে শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলাম। হাঙ্গর ঘোরা ফেরা করছে। সেই সাথে পিরানহাও—

তখনই প্রথম বারের মতো আব্বুকে থামিয়ে দিলাম আমি।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ বললাম, ‘পিরানহা মিষ্টি পানির মাছ। সমুদ্রে ওরা কী করছে? ‘ঠিক বলেছ।’ আব্বু বলল, ‘আমার ভুল, পিরানহা আরও পরে এসেছে। তো, যে কথা বলছিলাম…

তক্তার একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছি, নিচে মৃত্যু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় দড়ি দিয়ে বানানো একটা সিঁড়ি আমার কাঁধে এসে বাড়ি খেল। একটা ভারী, গমগমে গলার চিৎকারও শুনতে পেলাম, ‘তাড়াতাড়ি! দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়!

আমাকে কি আর দুইবার বলা লাগে? সাথে সাথে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম দড়ি। কপাল ভাল, দুধের প্যাকেটটা কোটের পকেটের খুব ভেতরে রাখা ছিল। জলদস্যুরা আমাকে অনেক বকাবকি করল। এমনকি দুই একটা গুলিও ছুঁড়ল, কিন্তু একটাও গায়ে লাগেনি। উপরে উঠে এলাম।

এর আগে কখনো কোন বেলুনে চড়িনি। খুব শান্ত আর নীরব লাগল উপরে এসে। বেলুনের একমাত্র প্রাণীটি বলল, ‘আশা করি সাহায্য করেছি বলে কিছু মনে করোনি। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব বিপদে আছ।’

আমি উত্তরে বললাম, ‘তুমি তো দেখছি… স্টেগোসোরাস (এক ধরনের ডায়নোসর)!’

আমি একজন আবিষ্কারক,’ উত্তর এল। ‘আমি এই উড়ন্ত জিনিসটাও আবিষ্কার করেছি। এর নাম দিয়েছি প্রফেসর স্টেগের উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক।’

‘এর নাম বেলুন।’ বললাম আমি।

‘আসল নাম-প্রফেসর স্টেগের উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক।’ বলল সে, ‘আর এই মুহূর্তে আমরা আছি একশো পঞ্চাশ মিলিয়ন বছরের ভবিষ্যতে।’

‘আসলে,’ বাধা দিলাম, ‘আমরা আছি প্রায় তিনশো বছর অতীতে।’

‘তুমি কি শক্ত-পশমযুক্ত-ভেজা-সাদা-কুরকুরে পছন্দ করো?’ আমাকে পাত্তা না দিয়ে প্রশ্ন করল ডায়নোসর।

‘নারিকেল?’ আমি আন্দাজ করলাম।

‘আমি আগে ওদের নাম দিয়েছি।’ বলল প্রফেসর স্টেগ। একটা নারিকেল তুলে নিলে কড়কড় করে খেয়ে ফেলল, একেবারে খোলসহ!

নিজ হাতে বানানো টাইম মেশিনটা দেখাল এরপর। জিনিসটাকে নিয়ে খুব গর্বিত মনে হলো ওকে। ওটা আসলে বড় একটা কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো। মাঝখানে অনেকগুলো নুড়ি শোভা পাচ্ছে। আবার সাইডে লাগানো আছে বিভিন্ন আকৃতির পাথর। একটা বড় লাল বাটনও (বোতাম) দেখতে পেলাম। আবার ভালভাবে তাকালাম পাথরগুলোর দিকে। ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ বললাম, ‘এগুলো তো হীরা…আর নীলকান্তমণি আর রুবি।’

‘আসলে,’ বলল সে, ‘ওদের নাম হলো বিশেষ-উজ্জ্বল-পরিষ্কার-পাথর, বিশেষ- উজ্জ্বল-নীল-পাথর আর উম—’

‘বিশেষ-উজ্জ্বল-লাল-পাথর?’

‘ঠিক বলেছ। আমি ওদেরকে এই নাম দেই প্রায় একশো পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে। যখন আমি আবিষ্কার করছিলাম আমার এই আসলেই-নড়াচড়া-করে-এমন- টাইম-মেশিন।’

‘যাই হোক।’ ওকে বললাম, ‘আমার সৌভাগ্য যে একেবারে সঠিক সময়ে তুমি এসে আমাকে উদ্ধার করেছ। আমি সময় সুড়ঙ্গে হারিয়ে গিয়েছি। বাসায় ফেরা প্রয়োজন। আমার ছেলে মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নাস্তার জন্য দুধ দরকার।’ প্যাকেটটা দেখালাম, ‘এই সেই দুধের প্যাকেট। যদিও সম্ভবত একশো পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে এর নাম ছিল ভেজা-সাদা-পান করার মতো-বস্তু।’

‘আপনার অবগতির জন্য জানাই-ডায়নোসররা সরীসৃপ।’ প্রফেসর স্টেগ আমাকে শুধরে দিল, ‘আমাদের দুধের কোন প্রয়োজন নেই।’

‘নাস্তার জন্য সিরিয়াল তো খাও, নাকি?’ জানতে চাইলাম।

‘অবশ্যই!’ উত্তর এল, ‘ডায়নোসর সিরিয়াল খুব ভালবাসে। বিশেষ করে যেগুলোতে বাদাম থাকে, ওগুলো।’

‘সিরিয়াল খাও কীসে ভিজিয়ে?’ জানতে চাইলাম।

‘কমলার রসের সাথে। অথবা এমনি শুকনো। কিন্তু তোমার বলা কথাটা আমি আমার বইতে লিখবঃ সুদূর ভবিষ্যতে, ছোট ছোট স্তন্যপায়ীরা নাস্তার সিরিয়াল দুধে ভিজিয়ে খায়। ওহ, বলা হয়নি তোমাকে-বর্তমানে ফিরে অসাধারণ একটা বই লিখব ঠিক করেছি।

‘আসলে,’ বললাম, ‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এটা অতীত। জলদস্যুদের দেখতে পাচ্ছ না?’

‘নাহ। ভবিষ্যৎ।’ কিছুতেই মানবে না যেন প্রফেসর, ‘ডায়নোসরেরা নক্ষত্রে পাড়ি জমিয়েছে। পৃথিবীর শাসনভার ছেড়ে গিয়েছে স্তন্যপায়ীদের হাতে।’

‘তাহলে, ওখানে গিয়েছ তোমরা!’ আমি বললাম, বিশাল এক রহস্যের সমাধান এমন সহজ হবে তা কল্পনাও করিনি।

‘হ্যাঁ, নক্ষত্রে। সবাই চলে গিয়েছে।’

‘সে যাই হোক।’ এবার একটু জোর দিয়ে বললাম, ‘আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারবে?’

‘উম…’ উত্তর এল, ‘হ্যাঁ এবং না।’

‘মানে কী?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে আমি খুশী হব। অনেক বেশি খুশী। কিন্তু নিয়ে যেতে পারব না। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয় না যে আমি নিজেই বাড়ি ফিরতে পারব। আমার টাইম মেশিন কেমন জানি উল্টা-পাল্টা আচরণ করছে। আমার একটা বিশেষ-উজ্জ্বল-সবুজ-পাথর দরকার। আমি ওই বাটন অনেকবার চেপেছি। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।’

‘বাটন? বড়-লাল-চাপার-জিনিস না?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘আরে না। এর নাম বাটন। আমার আন্টি বাটনের নামে নাম।’

‘আমি চেপে দেখব?’

‘মন চাইলে দেখ।’

আমি বাটন চাপলাম। সূর্য যেন আকাশের পথে দৌড় লাগাল, আকাশে একবার চাঁদ আর আরেকবার সূর্য দেখতে পেলাম। এই রাত তো এই দিন। রাগান্বিত মাছির মতো দুলতে শুরু করল বেলুন।

দড়িগুলো সর্বশক্তিতে আঁকড়ে ধরলাম আমি। কপাল ভাল, ডান হাত দিয়ে তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছি দুধের প্যাকেট।

অবশেষে বেলুন থামলে দেখতে পেলাম, তখন রাত নেমেছে। প্রফেসর স্টেগের হিসাব অনুযায়ী, আরও মাত্র এক হাজার বছর অতীতে চলে এসেছি। প্ৰায় পূর্ণিমা।

‘আমার ছেলে মেয়ের কাছ থেকে আরও দূরে সরে এসেছি।’ মন খারাপ করে বললাম।

‘আহ, কিন্তু এখনও তোমার হাতে দুধ আছে।’ প্রফেসর স্বান্তনা দিল, ‘যেখানেই দুধ, সেখানেই আশা। ওদিকে দেখ, উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক নামাবার জন্য একদম নিখুঁত একটা মঞ্চ।’

মঞ্চের উপর বেলুন নামিয়ে, আমরাও নিচে নেমে পড়লাম। মঞ্চটা একটা জঙ্গলের মাঝখানে, দুই পাশে দুইটা মশাল জ্বলছে। বেশ কয়েকজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। হাতে অনেকগুলো তীক্ষ্ণ পাথরের ছুরি।

‘এটা কি বেলুন নামাবার মঞ্চ?’ ওদেরকে প্রশ্ন করলাম।

‘না।’ মোটা একজন উত্তর দিল, ‘এটা আমাদের মন্দির। গত বছর একদম ফসল ফলেনি। তাই দেবতাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন বলি দেবার জন্য কিছু একটা পাঠান…যেন সেটাকে উৎসর্গ করতে পারি। ঠিক তখন তুমি ওই জিনিসটায় করে নেমে এসেছ, সেই সঙ্গে এনেছ তোমার দানবটাকে।’

‘আগে ভাগে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি।’ শুকনো লোকটা বলল, ‘তোমরা না এলে আমাকেই বলি হতে হত। অনেক ধন্যবাদ। এখন তোমাকে আর তোমার দানবকে উৎসর্গ করা হবে।’

‘কিন্তু আমার বাচ্চারা নাস্তা খাবার জন্য আমার অপেক্ষা করছে।’ বললাম, ‘দেখ!’ দুধের প্যাকেটটা দেখিয়ে বললাম।

‘এরা সবাই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল কেন?’ প্রফেসর স্টেগ জানতে চাইল। ‘এই আচরণ কি লোমহীন স্তন্যপায়ীদের জন্য স্বাভাবিক? নাকি একটা শক্ত-পশমযুক্ত- ভেজা-সাদা-কুরকুরে উঁচু করে ধরে দেখব কী হয়?

‘নারিকেল!’ বললাম আবারও, ‘ওগুলোকে নারিকেল বলে!’

‘তোমার হাতে কী?’ মোটা লোকটা জিজ্ঞেস করল।

‘দুধ।’ জবাব দিলাম

‘দুধ!’ আঁতকে উঠল সবাই, আরও নিচু হয়ে গেল। পারলে যেন মাটিতে মিশে যায়।

‘ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে আমাদের উদ্দেশ্যে,’ মোটা লোকটা বলল, ‘যে একজন মানুষ আর এক উঁচু পিঠের দানব আসমান থেকে গোল ভাসমান জিনিসে করে নামবে—’

‘উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক।’ ঠিক করে দিল চিকন লোকটা।

‘হ্যাঁ, ওই জিনিসে করে নামবে। আমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে এমন হলে যদি সেই মানুষটা এক প্যাকেট দুধ আমাদের সামনে উঁচু করে ধরে, তাহলে তাকে উৎসর্গ করা যাবে না। বরঞ্চ তাকে আগ্নেয়গিরির কাছে নিয়ে গিয়ে উপহার হিসাবে স্প্লডের সবুজ চোখ দিয়ে দিতে হবে।’

‘স্প্লড?’

‘সে আমাদের দেবতা।’

‘এই ভবিষ্যদ্বাণী দেখি,’ বললাম, ‘একেবারে নিখুঁত। কবে পেয়েছ?’

‘গত বুধবার।’ গর্বের সাথে মোটা লোকটা বলল, ‘স্পডের পুরোহিত গভীর রাতে একটা ফিসফিসানি আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে ওঠে। স্বর্গীয় আওয়াজের মালিককে অনেক খুঁজেও সে দেখতে পায়নি। তাছাড়া মন্দিরের একেবারে উপরে একা একা ঘুমাচ্ছিল বলে, ওর সাথেও কেউ ছিল না। তাই আমরা ধরে নিয়েছি, হয় স্প্লড নিজে, না হয় তার কোন দেবদূত পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলেছে।’

বনের পথ ধরে একসাথে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। প্রফেসর স্টেগ বেলুনে ওঠার দড়িটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে। তাই বেলুনটাও আমাদের সাথে সাথে আসছে। প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা আগ্নেয়গিরির কাছে গিয়ে পৌঁছালাম।

খুব একটা বড় না আগ্নেয়গিরিটা। তবে সক্রিয়, এখন ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

আগ্নেয়গিরির একপাশে এক বিশাল ভয়ংকর-দর্শন চেহারা খোদাই করা। ঠিক তার মাঝখানে একটা মাত্র চোখ। আর সেই চোখটা বানানো হয়েছে আমার দেখা সবচেয়ে বড় এমারেল্ড দিয়ে।

‘একটা বিশেষ-উজ্জ্বল-সবুজ-পাথর!’ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল প্রফেসর স্টেগ।

মোটা লোকটা উপরে উঠল আগ্নেয়গিরি বেয়ে।

‘কপাল ভাল যে, স্প্লড নিজেই তার চোখ তোমাদেরকে দিতে বলেছেন।’ চিকন লোকটা বলল, ‘কারণ আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণীতে আছে যে যদি কোন কারণে স্পডের চোখ খুলে নেয়া হয়, তাহলে মহান স্প্লড জেগে উঠবেন আর রাগে সারা এলাকা জ্বালিয়ে দেবেন।’

‘এই নাও।’ মোটা লোকটা ফিরে এসেছে।

আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে সেই এমারেল্ড। প্রফেসর স্টেগ বেলুনের দড়ি ধরে উপরে উঠে এমারেল্ডটাকে টাইম মেশিনে ফিট করল।’

‘থামো, থামো। স্টেগ না একজন স্টেগোসোরাস?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে দড়ি বেয়ে উঠল কীভাবে?’

‘আকারে অনেক বড় হলেও, খুব দ্রুত আর চালু সে। দেখনি, অনেক মোটা লোকও খুব ভাল নাচতে পারে?

‘গল্পে পনি (এক ধরনের ঘোড়া) নেই?’ বিরক্ত স্বরে আমার বোন প্রশ্ন করল, ‘আমি তো ভেবেছিলাম এতক্ষণে পনি চলে আসবে!’

‘বলতে দাও,’ আবু বলল। ‘তো, যা বলছিলাম:

মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি, হাতে ধরে আছি দড়ির সিঁড়ি। এমন সময় মাটি কেঁপে উঠল। ছোটখাট একটা আগ্নেয়গিরি যেন ফেটে পড়ল।

‘স্প্লড রাগ করেছেন!’ চিকন লোকটা বলল, ‘তিনি তার চোখ ফেরত চান।’

হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হলো। বেলুনটা এক লাফে বাতাসে ভাসল, আমিও সেই সাথে ভাসলাম। দেখতে পেলাম, নিচে লাভা বইছে।

কপাল খারাপ, হাত থেকে দুধের প্যাকেটটা পড়ে গেল। খুব জোরে আঁকড়ে ধরিনি যে, তাই। স্পডের ঠিক মাথার উপরে গিয়ে পড়ল ওটা।

প্রফেসর স্টেগ তার লেজ দিয়ে দড়িটাকে উপরে টেনে তুলল।

‘দুধের প্যাকেট পড়ে গিয়েছে!’ তাকে বললাম।

‘খারাপ খবর।’ বলল সে।

‘কিন্তু কোথায় পড়েছে তা দেখেছি। ঠিক স্পডের মাথার উপরে, আগ্নেয়গিরির পাশে।’

প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘হায় স্প্লড! ওটা কী?’

আমাদের চোখের ঠিক সামনে, আমাদেরটার মতোই দেখতে একটা বেলুন আগ্নেয়গিরির পাশে এসে উপস্থিত হলো। একজন মানুষ খুব তাড়াহুড়ো করে দড়ি বেয়ে নিচে নামল। বড় এমারেল্ডটা স্পডের চোখের জায়গায় রেখে, মাথার উপর থেকে প্যাকেটটা তুলে নিল। এরপর আবার দড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতেই, উধাও হয়ে গেল বেলুন।

ছোট আগ্নেয়গিরিটার অগ্নি উৎপাত হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল, যেন কেউ সুইচ টিপে বন্ধ করে দিয়েছে।

‘অদ্ভুত না?’ প্রফেসর বলল।

‘আসলেই,’ আমি একমত হলাম। হতাশ, ক্লান্ত আর বিষাদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ‘বেলুনের ওই লোকটা আমার দুধ চুরি করেছে। আমরা অতীতে হারিয়ে গিয়েছি। চারপাশে শুধু জঙ্গল, জলদস্যু আর আগ্নেয়গিরি। কোন দিন বাড়ি ফিরতে পারব কি না জানি না। আমার ছেলে মেয়েরা নাস্তা পাবে না। এই বেলুনে চড়ে উড়তে উড়তেই আমাদের মৃত্যু হবে।’

‘এর নাম বেলুন না।’ প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক। আর কী বোকার মতো কথা বলছ। মনে হয় ঠিক করে ফেলেছি।’

এমারেল্ডটাকে জায়গামতো বসিয়ে দিল সে, আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করল সুতা আর কিছু টেপ। সব কাজ শেষ করে চেপে দিল লাল বাটন।

‘এবার কোথায় যাচ্ছি?’ জানতে চাইলাম। আগের মতোই রাত আর দিন চোখের সামনে দিয়ে পার হচ্ছে।

‘অনেক, অনেক ভবিষ্যতে!’ প্রফেসর স্টেগ বলল।

একসময় থামল মেশিনটা।

এখন একটা ঘাসযুক্ত সমতল ভূমির উপর ভাসছি আমরা। আমাদের নিচে একটা খুব ছোট ধুসর পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

‘ওই যে,’ প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘এখন আগ্নেয়গিরিটা সুপ্ত। কিন্তু দেখ!’

সুপ্ত আগ্নেয়গিরিটার পাশে এখনও স্পডের চেহারা ভালভাবে বোঝা যায়। যদিও সময়ের কারণে অনেকটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই বড় সবুজ এমারেল্ডটা এখনও আগের জায়গাতেই আছে।

‘যাও,’ প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘ওই বিশেষ-উজ্জ্বল-সবুজ-পাথরটা নিয়ে এসো।’ আমি বেলুনের এক ধারে গিয়ে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। এমারেল্ডটা খুলে নিলাম ওর জায়গা থেকে।

আমার নিচে, সমতল ভূমিতে ততক্ষণে অনেকগুলো পনি এসে জড়ো হয়েছে। এমারেল্ডটা যখন তুলে নিলাম, তখন ওদের একজন আমাকে লক্ষ করে বলল, ‘তুমি নিশ্চয় সেই দুধ-হারিয়ে ফেলা লোক? আমাদের গল্পে তোমার কথা আছে।’

‘আচ্ছা তোমার একপাশে একটা উজ্জ্বল নীল তারা কে একে রেখেছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘জানি, জানি।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল পনিটা। ‘সবাই এই কাজটাই করছে আজকাল। অনুজ্জ্বল নীল তারা সেই আদ্যিকালের স্টাইল।’

প্রফেসর স্টেগ বেলুনের বাস্কেট থেকে ঝুঁকে তাকাল, ‘জলদি কর! যদি এই আগ্নেয়গিরি আবার জেগে ওঠে তো খবর আছে।’

আগ্নেয়গিরিটা একটা বিশাল ঢেকুর তোলার আওয়াজ করে ধ্বসে পড়ল!

‘ওরকম হবারই কথা ছিল।’ একটা চকমকে কেশরের সবুজ পনি বলল।

‘ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল নিশ্চয়ই?’ আমি বলাম।

‘আরে নাহ! আমরা চালাক,তাই বুঝতে পেরেছি।’ এ কথা শুনে সবগুলো পনি নড করল। আসলেই একদল চালাক পনি ওরা।

‘আহা। পনির কথা শুনে যে কি ভাল লাগছে।’ আমার বোন বলল।

.

বেলুনের বাস্কেটে ফিরে এলাম। প্রফেসর স্টেগ টাইম মেশিন থেকে আগের এমারেল্ডটা খুলে নতুনটা লাগিয়ে দিল

‘আর যাই করো না কেন,’ সাবধান করে দিল আমাকে, ‘এই দুটো পাথর যেন একে অন্যকে স্পর্শ না করতে পারে না।’

‘কেন?’

‘কারণ, আমার হিসেব মতে যদি দুইটা আলাদা সময়ের একই বস্তু একে অন্যের সংস্পর্শে আসে, তাহলে দুটো জিনিসের যে কোন একটা ঘটবে। হয় মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। অথবা তিনটা অসাধারণ বামন হাওয়া থেকে উদয় হবে। তাদের মাথায় থাকবে ফুলদানী। আর তারা নাচতে শুরু করবে।’

‘তাই নাকি? এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলতে পারলে?’ আমি বললাম।

‘দেখো, এটা বিজ্ঞান। তবে যাই হোক, দুটোর মাঝে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’

‘মন খারাপ নাকি?

হ্যাঁ। দুধের কথা মনে পড়ছে। আমার ছেলে মেয়েরা এখন নাস্তা করতে পারবে না-’

।‘তাইতো, দুধ!’ প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘অবশ্যই!’ সাথে সাথে নিজের লেজ দিয়ে চাপল লাল বাটনটা।

জুম করে একটা আওয়াজ হলো, এরপর থর্প, সবশেষে থ্যাং। আবার সবকিছু ঘোরা শুরু করল।

এরপর এল অন্ধকার।

নিকষ কালো অন্ধকার।

‘উপস,’ বলল প্রফেসর স্টেগ, ‘একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। এক সপ্তাহ হবে। দাঁড়াও…’

প্রফেসর স্টেগ বাস্কেটের ধারে গিয়ে উঁকি দিল।

‘এক্সকিউজ মি?’ বলল, ‘কেউ আছে?’

‘আমি আছি।’ নিচ থেকে অবাক একটা গলা ভেসে এল, ‘স্পডের পুরোহিত। আকাশে কে? পাখি? কিন্তু পাখির মতো তো শোনাচ্ছে না।’

‘আমি পাখি নই।’ প্রফেসর স্টেগ বলল, ‘আমি খুব সুন্দর কিন্তু রহস্যময় একজন। তোমাকে ভবিষ্যদ্বাণী শোনাতে এসেছি। এত গুরুত্বপূর্ণ সেই বাণী যে… উম … মানে, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মন দিয়ে শোন। যখন এক বিশাল আর সুদর্শন উঁচু পিঠঅলা প্রাণী—’

‘দানব।’ ওকে মনে করিয়ে দিলাম, ‘ভবিষ্যদ্বাণীতে দানবের কথা বলা আছে।’

‘এক কুৎসিত দেখতে মানুষ সাথে নিয়ে—’ যোগ করল প্রফেসর স্টেগ।

‘অপ্রয়োজনীয় কথা-বার্তা…’ বিড় বিড় করতে করতে বললাম।

‘—উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক নিয়ে নামবে, তাদেরকে তখন কোনভাবেই বলি দেয়া যাবে না। বরঞ্চ তাদেরকে নিয়ে যেতে হবে আগ্নেয়গিরির কাছে। আর তাদেরকে উপহার দিতে হবে স্পডের চোখ। ওদেরকে কীভাবে চিনবে? বলছি। মানুষটার হাতে থাকবে দুধের প্যাকেট।’

‘এটা কি ভবিষ্যদ্বাণী?’ গলাটা জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে কি শস্য সংক্রান্ত কিছু আছে?’

‘দুঃখিত, নেই।’

‘আহ, কী আর করা। যাই হোক ধন্যবাদ, হে রহস্যময় আওয়াজ।’

আমি লাল বাটন চাপলাম।

দিনের আলোয় চলে এলাম।

মনে হলো খুব পরিচিত কোথাও এসে পড়েছি। আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়বে যেন! ‘তাড়াতাড়ি!’ বললাম, ‘আমাকে এমারেল্ডটা দাও!’

একটু দূরে আরেকটা বেলুন দেখতে পেলাম। বাতাসে এখন ধোঁয়া আর ছাই এর রাজত্ব। কিন্তু তারই মাঝে উড়ে চলছে বেলুনটা। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি, প্রফেসর স্টেগের পাশে দাঁড়ানো, হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছি। দেখে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে।

প্রফেসর স্টেগ—মানে, এখন আমার পাশে দাঁড়ানো প্রফেসর স্টেগ-আমাকে এমারেল্ডটা ধরিয়ে দিলেন।

দড়ি বেয়ে খুব দ্রুত নেমে পড়লাম, এমারেল্ডটা আটকে দিলাম জায়গা মতো। সাথে সাথে আগ্নেয়গিরি আবার সুপ্ত হয়ে গেল। দুধের প্যাকেটের খোঁজে আশপাশে তাকালাম এবার। জানি, স্পডের ঠিক মাথার ওপর পড়েছে।

কপাল ভাল, দুধের প্যাকেকটা এমন জায়গায় পড়েছে যে জ্বলন্ত লাভা তার স্পর্শ পায়নি, অক্ষত আছে সেটা। তুলে নিয়ে মুছে ফেললাম। বেলুনে ফিরে যাবার জন্য দড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। প্রফেসর স্টেগ বাটন চাপল।

আবার অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু।

এখন আমরা অশুভ-দর্শন টাওয়ার আর নীরব একটা দুর্গের উপর ভাসছি। বন্ধু- বৎসল জায়গা বলে মনে হচ্ছে না। আকাশে দল-বেঁধে বাদুড় উড়ছে। আধা-খাওয়া চাঁদটাকে যেন ঢেকে ফেলেছে।

‘আমার জায়গাটা পছন্দ হচ্ছে না।’ প্রফেসরকে বললাম।

‘আমার তো ভালই লাগছে।’ উত্তরে বলল, ‘মনে হচ্ছে সূর্য উঠলে জায়গাটা খুব সুন্দর দেখাবে।’

খুব জোরে একটা শব্দ হলো। অনেকটা ফ্লাট! এর মতো। দেখতে পেলাম, বাদুড়গুলো মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রক্তশূন্য, প্রায় সাদা দেখতে মানুষগুলো। একদম সামনের লোকটা টাক মাথার। দেখে হাসি পেল, কিন্তু গিলে ফেললাম। কারণ—এদের সবার দাঁত অসম্ভব তীক্ষ্ণ!

‘হামরা উম্পায়ার (আঞ্চলিক টান। আসলে বলতে চাইতে-আমরা ভ্যাম্পায়ার), বলল ওরা, ‘হেইটা (এটা) কী? তোমরা কারা? উত্তর দাও, নাহলে হামরা (আমরা) তোমাদের মেরে পেলবো (ফেলব)।’

‘আমি প্রফেসর স্টেগ।’ গমগমে গলায় স্টেগোসোরাস উত্তর দিল। ‘আর এ আমার সহকারী। আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে এসেছি। আমি আমার বর্তমানে ফিরতে চাই। আর আমার সহকারী ভবিষ্যতে ফিরতে চায়-নাস্তা খেতে।’

নাস্তার কথা শুনে, ‘উম্পায়ার’ রা যেন আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

‘হামরা এখনো নাস্তা করিনি।’ আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হামরা সাধারণত কিলবিল করা কেঁচো, কমলার রস দিয়ে খাই। কমলার রস মেশালও ওগুলো আরও কিলবিল করে। স্প্যাগেটির মতো। কিন্তু যদি তা না পাই, তাহলে হামরা সহকারীকে খাব বা দরকার হলে প্রফেসরকে খাব।’

উম্পায়ারদের একজন একটা কাঁটাচামচ বের করল, চোখে ক্ষুধা নিয়ে মেপে দেখল আমাকে।

সবচেয়ে টাক মাথা আর বড় বড় চোখের উম্পায়ার জানতে চাইল, ‘হেইটা কী? বক্স?’

‘আমার সবচেয়ে দামী আবিষ্কার।’ গর্বের সাথে বলা শুরু করল প্রফেসর স্টেগ, কিন্তু আমি বাধা দিলাম।

‘স্যাণ্ডউইচ রাখার জন্য।’ আমি বললাম।

‘স্যাণ্ডউইচ?’ বলল উম্পায়ার।

‘হ্যাঁ, স্যাণ্ডউইচ।’ যতটা সম্ভব দৃঢ় স্বরে বললাম!

‘হামরা ভেবেছি, হেটা টাইম মেশিন।’ প্রধান উম্পায়ার বলল, মুখে তার সবজান্তার হাসি, ‘হামরা ভেবেছিলাম, এটা দিয়ে দুনিয়া জয় করব।’

‘আসলেই স্যাণ্ডউইচ রাখার জিনিস।’ আমার গলার স্বর আরও দৃঢ় হয়ে গেল।

‘এই বাটন চাপলে কী হবে তাহলে? একজন মহিলা উম্পায়ার জিজ্ঞেস করল। তার লম্বা কালো চুল চেহারার প্রায় পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। কেবল এক চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখছে সে, অন্যটা চুলে ঢাকা!

বাঁধা দেবার আগেই বাটন চাপল সে। আমরা ছয় ঘণ্টা সামনে এগিয়ে গেলাম।

‘দেখেছ?’ আনন্দের সাথে বলল প্রফেসর। ‘একটু সূর্যের আলোতে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে জায়গাটা?’

প্রধান উম্পায়ার বলল, ‘কী? সূর্য-’ কথা শেষ করার আগেই যেন গলে পরিণত হলো কালো তেলতেলে ধোঁয়ায়। ওর বন্ধুদেরও একই অবস্থা।

‘হ্যাঁ।’ বললাম, ‘দিনের আলোতে জায়গাটা আসলেই সুন্দর!’

প্রফেসর তার মেশিনের পাথর, সুতা আর বাটন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু পর বলল, ‘এতক্ষণে মনে হয় ঠিক মতো সাজাতে পেরেছি। পরের বারেই তোমার সময়, জায়গা আর নাস্তার কাছে পৌঁছে দিতে পারব।’

কিন্তু লেজ দিয়ে বাটনটা স্পর্শ করার আগেই, একটা গলা শুনতে পেলাম। বলছে, ‘পরে বোঝাচ্ছি। মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে :

একটা হাত এসে আঁকড়ে ধরল দুধের প্যাকেট। এতক্ষণ ধরে যে জিনিসটা খুব সাবধানে বয়ে বেড়াচ্ছি, ছিনিয়ে নিল সেটাকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি, বেশ সুদর্শন এক লোক। চেহারা দেখতে পাইনি, তবে পিঠ দেখে অমনটাই মনে হল। আমার দুধের প্যাকেট ধরে আছে! একটা জানালার ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম, পরক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই জানালাটাও।

‘আমার দুধ!’

‘আহা, বলেছেই তো পরে বোঝাবে।’ স্বান্তনা দিল প্রফেসর, ‘একটু ধৈর্য ধর।’

আবার জানালাটা দেখা গেল। সেই একই গলা শুনতে পেলাম, ‘ধরো!’ আর সেই সাথে জানালা দিয়ে আমার দিকে ধেয়ে এল দুধের প্যাকেটটা।

কপাল ভাল, দুধের প্যাকেটটা ঠিক আমার পেটে এসে পড়ল, আমিও ধরে ফেললাম।

‘বলেছিলাম না?’ প্রফেসর সন্তুষ্ট চিত্তে বলল, ‘সব পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক।’

‘কিন্তু বলেছিল পরে ব্যাখ্যা করে বোঝাবে।’ আমি শক্ত গলায় বললাম, ‘এটা কোন ব্যাখ্যা হলো?’

‘বলেছি ‘পরে’ বোঝাবে।’ এবার প্রফেসর স্টেগ বললেন, ‘পরে তো হয়নি। এখনও ‘এখন’ আছে। কিছুক্ষণ পরে ছাড়া ‘পরে’ হবে না।’

আবার পাথর, সুতা আর নুড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। বলল, ‘অবশেষে! তোমার ঘরের কো-অর্ডিনেট ঠিক করা শেষ।’ আমাকে জানাল, ‘এবার নাস্তার কাছে ফেরার পালা।’

‘তাহলে কি বাইরে গেলে এখন বেলুনে বসে থাকা এক স্টেগোসোরাসকে দেখা যাবে?’ আমি আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম।

‘নাহ।’ আব্বু আমাকে নিরাশ করল, ‘কেন যাবে না, সে কথাই বলছি।’

‘আমার মনে হয়, আরও কয়েকটা উম্পায়ার গল্পে থাকলে ভাল হত। কিন্তু নম্র, ভদ্র আর সুন্দর উম্পায়ার।’ আমার বোন আশা নিয়ে বলল।

‘নম্র, ভদ্র আর সুন্দর উম্পায়ার? অসম্ভব।’ আব্বু ওকেও নিরাশ করল।

‘বাটনটা কি তুমি চাপতে চাও?’ প্রফেসর স্টেগ জিজ্ঞেস করল।

কথা না বলে চেপে দিলাম লাল বাটন। কানে তালা লাগানো একটা আওয়াজ হলো, চোখের পলকে পার হয়ে এলাম অনেকগুলো বছর। বেলুন থামলে দেখি, মার্শাল রোড আর ফ্লেচার লেন যেখানে এক হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। উপর থেকে আমাদের বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। এমনকি পিছনের বাগানে রাখা বাই সাইকেল আর খরগোশের খাঁচা দেখতেও কোন বেগ পেতে হচ্ছিল না।

‘এসে পড়েছি!’ খুশী হয়ে চাপড়ে দিলাম প্রফেসর স্টেগের পিঠের উঁচু অংশ।

‘তোমাকে যাত্রাপথের সঙ্গী হিসেবে পেয়ে অনেক আনন্দ পেয়ে-আরগহ—’ বলল প্রফেসর। কথার মাঝখানে থেমে গেল কারণ, একটা পরিচিত থামমম-থামমম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। লাল বাটনটা চাপার জন্য হাত বাড়িয়েছি, কিন্তু কাজটা সারার আগেই বেলুন শুদ্ধ কেউ আমাদেরকে যেন টেনে নিল। দেখি একটা বিশাল ধাতুর ডেকে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সসারের ডেক-চিনতে পারলাম। মেজাজ খারাপ করে আছে এমন চেহারার কয়েকজন সবুজ আঠালো প্রাণী অনেকগুলো চোখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘হা, হা!’ অনেকগুলো প্রাণী একসাথে বলে উঠল, ‘ভেবেছিলে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়েছ! ভুল ভেবেছিলে! এখন আমাদেরকে পৃথিবী লিখে দাও। আমরা নতুন করে সাজাব। শুরুতেই সব গাছ সরিয়ে নেব। ওদের জায়গায় বসাব প্লাস্টিকের ফ্লেমিংগো।’

‘কেন?’

‘আমাদের প্লাস্টিকের ফ্লেমিংগো খুব পছন্দের। আমাদের মতে, পৃথিবীর সব শিল্পের মধ্যে ওগুলোই সবচেয়ে সুন্দর আর পারফেক্ট। তাছাড়া গাছের চেয়ে ময়লাও হয় কম।’

‘আমরা মেঘের জায়গায় সুগন্ধি মোমবাতি বসাব।’

‘আমরা সুগন্ধি মোমবাতিও খুব পছন্দ করি।’ এক বড় সবুজ আঠালো প্ৰাণী ব্যাখ্যা করল; দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেউ নাকের শিকনি দিয়ে বানিয়েছে ওদের।

আমাদের সাজানো প্লেটও খুব পছন্দ।’ আরেকজন বলল। ‘চাঁদের জায়গায় তাই সাজানো প্লেট বসাবো।’

‘একটা বিশাল বড় সাজানো প্লেট। পৃথিবীর সব উল্লেখযোগ্য জায়গা ওতে আঁকা থাকবে।’

‘এরপর ওই সব উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলোকে ওগুলোরই ছবি আঁকা প্লেট দিয়ে বদলে দেব। আইফেল টাওয়ারের জায়গায় থাকবে আইফেল টাওয়ার আঁকা এক বিশাল বড় প্লেট। আর অস্ট্রেলিয়ার জায়গায় থাকবে আসলেই বিশাল বড় একটা অস্ট্রেলিয়ার ছবি আঁকা প্লেট।’

‘আমাদের আগের সাক্ষাত থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।’ দেয়ালের সাথে লেগে থাকা এক আঠালো প্রাণী বলল, ‘যদি লক্ষ্য কর তাহলে দেখবে, যে দরজা খুলে সময় সুড়ঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলে, সেটা শক্ত করে বন্ধ করে রেখেছি।’

আসলেই বন্ধ করা। অনেক বড় একটা তালা ঝুলছে। সেই সাথে নোটিশ লেখা

দূরে থাকো

সেই সাথে লাল কালিতে আরেকটা টেপের উপর লেখা:

এদিকে এলোই না,

তার নিচে হাতে লেখা:

ব্যবহারের জন্য অন্য দরজার দিকে যাও,
ভাল কথা-পালানো অসম্ভব।

‘তোমার টাইম মেশিনের পাওয়ারও সব শুষে নেয়া হয়েছে।’

প্রফেসরের দিকে তাকালাম। তার বর্ম-পরা হাতগুলো ল্যাগব্যাগ করে ঝুলছে। আর তার লেজ… কী আর বলব, দুই পায়ের ফাঁকে গিয়ে সেঁধিয়েছে। আসলে স্টেগোসোরাসদের পা নেই, তবে থাকলে এমনটাই হত।

‘সময় সুড়ঙ্গে তোমাদের কর্মকাণ্ড আমরা খুব কাছ থেকে লক্ষ করেছি।’ একটা পর্দার সামনে বসে থাকা বড় আঠালো এলিয়েন বলল।

‘দেখো, এই গ্রাণ্ডেলডরফার চাপলে কী হয়।’ আরেকজন বলল। এর শরীর যেন গলে পড়ছে। দেয়ালের সাথে শরীরের অর্ধেকটা লাগানো। পাশেই একটা বড় কালো উজ্জ্বল বাটন।

‘ওটাকে বাটন বলে।’ বললাম।

‘কী সব পাগলের মতো কথা বলছ! আমরা আমাদের আন্টি, নেসি গ্রাণ্ডেলডরফারের নামে এর নামকরণ করেছি।’ বলল সে। চেপে দিল কালো বাটনটা। কী দিয়ে চাপল, তা বলা কঠিন। আঙুল হতে পারে, আবার শিকনিও হতে পারে।

চড়চড় করে একটা আওয়াজ হলো,
এরপর ফিজজজজ

আচমকা দেখতে পেলাম, আমাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন রাগান্বিত আর বিরক্ত জলদস্যু, ওই জঙ্গলের কয়েকজন কালো চুলো মানুষ, অসন্তুষ্ট দেখতে এক দেবতা, এক বাটি ভর্তি পিরানহা আর কয়েকজন উম্পায়ার।’

‘পিরানহা যে এখানে কি করছে, তাই এখন পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না।’ আমার বোন বলল।

‘ওদের হাত থেকে খুব কষ্টে পালিয়েছিলাম, কিন্তু বলতে ভুলে গিয়েছি।’ আব্বু

বলল, ‘তবে কপাল ভাল যে সাথে দুধের প্যাকেটটা ছিল, তাই পালাতে পেরেছিলাম।

‘আমিও তাই ভেবেছি।’ অবিশ্বাসের সুরে বললাম।

আব্বু পাত্তা দিলো না :

‘অহ হো,’ বললাম।

‘মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ জলদস্যুরা চিৎকার করে উঠল।

মহান স্পডের উদ্দেশ্য উৎসর্গ হবার জন্য তৈরি হও।’ কালো চুলো লোকগুলো বলল।

‘ওরা আমার চোখ চুরি করেছে! তা-ও দুইবার!’ মহান স্প্লড গরগর করে উঠল। ‘হামরা ওই দুইজনকে খেতে চাই।’ লম্বা এক মহিলা উম্পায়ার দাবী জানাল। পিরানহাগুলো কিছুই বলল না, কিন্তু বাটিতে যেভাবে নড়াচড়া করল তাতে মনে হলো না আমাদের নিয়ে ভাল কিছু করতে চায়।

‘কপাল খারাপ।’ প্রফেসর স্টেগ মন খারাপ করে বলল, ‘পালানোর কোন পথই দেখতে পাচ্ছি না। আমাদেরকে আটকে ফেলেছে, মেশিনটাও ব্যবহার করতে পারব না। এমন পরিস্থিতিতে আমার শক্তিশালী টাইম মেশিনটা ব্যবহার করেও ছোট একটা জানালা খোলা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু এত ছোট জানালা দিয়ে আমাদের কেউ পার হতে পারবে না

‘পারবে জানালা খুলতে?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছোট একটা হলেই হবে, আমাদের ঠিক আগের অবস্থানে।’

‘অবশ্যই। কিন্তু তাতে কী লাভ?’

‘তাড়াতাড়ি!’ আমি বললাম, ‘খোল।’

প্রফেসর স্টেগ নাকের ডগা দিয়ে বাটন চাপল।

প্রথমে জুম! আর পরে প্লিপ! আওয়াজ হলো। সামনে একটা জানালা দেখতে পেলাম, ছোট। কিন্তু একটা হাত ঢোকান যাবে।

তাই করলাম।

‘পরে বোঝাচ্ছি।’ বললাম আমি, ‘মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।’ আমার নিজের হাত থেকে দুধের প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিলাম… ঠিক পনেরো মিনিট আগের দুধের প্যাকেট।

‘তুমি নিশ্চয় দুধ খুব পছন্দ কর!’ আঠালো এলিয়েনরা বলল, ‘কিন্তু দুধের মতো ভাল জিনিসের প্রতি তোমার আগ্রহও আমাদেরকে থামাতে পারবে না। তোমার এই বাজে ডিযাইনের গ্রহকে আমরা সাজাবোই সাজাবো।’

‘থামানো উচিত।’ বললাম, ‘আমার ডান হাতে কী?’

‘অ্যা, দুধের প্যাকেট।’ বলল ওরা।

‘আর ডান হাতে?’

থমকে গেল ওরা। কিছুক্ষণ পর এক এলিয়েন, যে কিন্তু এত সবুজ আর এত ছোট আর আঠালো যে, যে-কেউ বলবে-সে আসলে এক প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগা হাতির নাকের শিকনি, বলল, ‘পনেরো মিনিট আগেকার একই দুধের প্যাকেট।’

‘ঠিক বলেছ।’ বললাম, ‘এবার ভেবে-চিন্তে জবাব দাও। যদি আমি এই দুই জিনিসকে স্পর্শ করাই তাহলে কী হবে?’

আঠালো এলিয়েনগুলো সাদাটে সবুজ হয়ে গেল। জলদস্যু, কালো চুলো লোক আর পিরানহা ওদের দিকে তাকালো, বিহ্বল। যেন ব্যাখ্যা চায়। উম্পায়ারদের অবস্থাও তাই।

‘যদি একই জিনিসের দুই সময়ের অস্তিত্ব একে অন্যের সংস্পর্শে আসে, মহান স্প্লড গমগমে গলায় বলল, ‘মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।’

‘একটা আগ্নেয়গিরি কীভাবে এতকিছু জানে?’ এলিয়েনদের একজন প্রশ্ন করল। ভূমির অংশ হয়ে থাকার কিছু সুবিধা আছে। ভাবার জন্য অনেক সময় পাওয়া যায়,’ স্প্লড বলল। ‘তাছাড়া আমি কিছু ম্যাগাজিনও পড়ি।’

আমি কাশলাম, মনে আশা-নিশ্চয়ই ভয়ংকর শোনাচ্ছে কাশির আওয়াজ।

‘তাহলে?’ জানতে চাইলাম।

‘স্প্লড যা বলল,’ মেনে নিল এলিয়েন, ‘মানে মহাবিশ্ব ধ্বংস হবার ব্যাপারে যা বলল আরকি…’

‘তাহলে,’ বললাম, ‘যদি মহাবিশ্বের ধ্বংস না চাও, তাহলে ফিরে যাও। আর সবাইকে এখান থেকে যার যার জায়গায় পাঠিয়ে দাও।’

এলিয়েনরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আসল।

এরপর চেপে দিল গ্রাণ্ডেলডরফার।

উম্পায়ার, জলদস্যু, পিরানহা, স্প্লড আর কালো চুলো সবাই উধাও হয়ে গেল। ‘আচ্ছা,’ এক এলিয়েন আশাবাদী গলায় বলল, ‘শুধু দক্ষিণ গোলার্ধটাকে সাজাতে দাও।’

‘অসম্ভব।’ বললাম, ‘এখন আমাদেরকে যেতে দাও, নাহলে কিন্তু ‘ এলিয়েনরা আমার দিকে তাকাল, এরপর তাকাল একে-অন্যের দিকে। শেষ-মেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘ঠিক আছে।’

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শোনা সবচেয়ে জোরালো আওয়াজে কেউ একজন বলল-

‘গ্যালান্টিক পুলিস,
কেউ নড়বে না।’

আমার হাত কেঁপে উঠল। কিন্তু কপাল ভাল, দুধের প্যাকেট দুইটা একে অন্যকে স্পর্শ করল না, মহাবিশ্বও বেঁচে গেল।

লাল আর নীল আলো জ্বলল কিছুক্ষণ। এরপর যার-যার স্পেস-বাইক থেকে নেমে এল প্রায় এক ডজন উর্দি পরা ডায়নোসর। হাতে অশ্রুতপূর্ব লম্বা আর ভয়াবহ রকমের ভয়ানক দেখতে অস্ত্র। আঠালো এলিয়েনদের দিকে তাক করল ওগুলো।

‘তোমাদের বিরুদ্ধে অন্যের গ্রহে অনুমতি ছাড়া অনুপ্রবেশ আর সাজানোর অভিযোগ আছে।’ সৎ আর ভারিক্কী চেহারার এক টাইরানোসোরাস রেক্স বলল, ‘সেই গ্রহ থেকে পালিয়ে অন্য গ্রহে গিয়ে আবার একই কাজ করার অভিযোগ-ও। তোমরা আঠারোটা গ্রহের অধিবাসীদের সাথে অপরাধমূলক আচরণ করেছ, তবে সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছ উন্নত রুচির দফা-রফা করে!’

‘কিন্তু আমরা রিগেল ফোরে যা করেছি, সেটা তো শিল্প!’ এক আঠালো এলিয়েন বলল।

‘শিল্প? রিগেল ফোরের লোকরা… .’ এক এনকিলোসোরাস বলল, ‘প্রতি রাতে চোখ তুলে দেখতে পায়, চাঁদকে ঘিরে তিনটা চিনা মাটির হাস সাঁতার কাটছে!’

একটা বিশাল দেহ আমাদের দিকে এগিয়ে এল। মাথাটা এত উপরে যে দেখাই যাচ্ছিল না। ‘তুমি কে?’ প্রফেসর স্টেগকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘আর তোমার গরিলা দুই সময়ের একই দুধের প্যাকেট ধরে আছে কেন?’

‘আমি গরিলা নই।’ বললাম, ‘আমি এক মনুষ্য… বাবা।’

‘মানুষটা দুধের প্যাকেট ধরে আছে, কারণ—এই শয়তান এলিয়েনদের ভাগিয়ে দেবার জন্য আর কোন উপায় ছিল না।’ প্রফেসর স্টেগ বলল।

পুলিশ ক্যাপ পরা এক ডিপ্লোডোকাস মুখ খুলল, কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।

টাইরানোসোরাস পুলিশটা, ততক্ষণে সবুজ আঠালো এলিয়েনদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। তবে হাতকড়াটার আসলে হাতকড়ার চেয়ে গোলাপি দড়ির সাথেই মিল বেশি। অবশ্য তা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে, কারণ এলিয়েনদের না হাত আছে আর না কব্জি। আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল সে।

‘কী অদ্ভুত একটা সকাল!’ অবাক হয়ে বলল সে, ‘একটা দু’পেয়ে জন্তু। একটা স্টেগোসোরাস। একটা উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহক…’ থেমে গেল আচমকা, যেন কী বলছিল ভুলে তা গিয়েছে।

আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটা টেরানডন উড়ে এসে প্রফেসর স্টেগের পায়ের কাছে এসে নামল। প্রফেসরের মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘এও কি সম্ভব…? আপনি কি .? প্রফেসর স্টেগের সুচালো-মহাকাশে-যাওয়ার-মেশিন, প্রফেসর স্টেগের আসলেই-কাজ-করে-টাইম-মেশিন এর আবিষ্কারক? আপনি কি সেই আমার সুদূর ভবিষ্যতের অভিযান আর সেখানে আমি কি দেখেছি বইটার লেখক? ডায়নোসরদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী ডায়নোসর? ম্যাম, আপনিই কি সেই প্রফেসর স্টেগ?’

‘হ্যাঁ।’ প্রফেসর বলল (ম্যাম? আমি তো এতক্ষণ ভেবেছিলাম সে পুরুষ!), ‘আর এ আমার সহকারী।’

টেরানডনটি আমার দিকে একটা ডানা বাড়িয়ে দিল, করমর্দন করতে চাচ্ছে। আমিও অবচেতনভাবে আমার ডান হাতের দুধের প্যাকেটটা বাম হাতে নিলাম…

যেখানে আরেকটা প্যাকেট ধরে রেখেছি।

সবাই আঁতকে উঠল।

কপাল খারাপ, একে অন্যকে স্পর্শ করল প্যাকেট দুইটা।

দম বন্ধ করে ফেললাম।

প্রথমে একটু ফিজজজজজ করে আওয়াজ হলে, যেন একটা বিশাল বড় বাস্কেটে একগাদা বিড়ালের বাচ্চা রেখে দেয়া হয়েছে আর সেগুলো গরগর করছে।

প্রফেসর স্টেগ চোখ বন্ধ করে ফেললেন, ‘আমি দেখতে চাই না। ‘

তিনটা বেগুনি বামন মাথায় ফুলদানী নিয়ে যেন হাওয়া থেকে উদয় হলো। নাচতে শুরু করল তারা।

‘মহাবিশ্ব কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে?’ টাইরানোসোরাস বলল। মুখ খিচে চোখ বন্ধ করে আছে।

‘চোখ খোল সবাই!’ বললাম আমি।

সবাই মিলে বামনদের নাচানাচি দেখলাম আমরা। ওরা মানুষও না আবার ডায়নোসরও না। বেগুনি চামড়া আর মাথায় একটা ফুলদানী। ওতে আবার অনেকগুলো ফুলও ফুটে আছে। দারুণভাবে নাচল ওরা। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে আওয়াজ করল ‘ওই!’ আর ‘ওলে!’ আর ‘পারটাং!’ আর তারপর যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনি আচমকা হাওয়া হয়ে গেল।

‘এমন ঘটার সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল,’ বলল প্রফেসর স্টেগ, ‘কপাল ভাল, মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়নি।’

লেজটা দিয়ে বাটন চাপল আবার। সময় সুড়ঙ্গে একটা জানালা দেখা গেল। জানালার অন্য পাশে আমাকে দেখা গেল—অবাক, হতভম্ব!

‘ধরো!’ আমি চিৎকার করে ছুঁড়ে দিলাম দুধের প্যাকেটটা। জানালা বন্ধ হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে দেখতে পেলাম, অতীতের আমার পেটে গিয়ে বাড়ি খেল সেটি।

সবুজ আঠালো এলিয়েনগুলোকে জেলে পাঠিয়ে দিয়ে, মহাকাশের ডায়নোসরেরা আমাদেরকে ঘিরে ধরল।

‘আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’ বলল ডিপ্লোডকাস। ‘প্রফেসর স্টেগ! ঠিক যেমনটা কমিকে পড়েছি। যে ডায়নোসর আমাদেরকে শিখিয়েছেন, সুদূর ভবিষ্যতের স্তন্যপায়ীরা নাস্তার সিরিয়ালে দুধ মেশায়। বাটনের আবিষ্কর্ত্রী। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার গরিলা নিয়ে!

‘গরিলা না, মনুষ্য-বাবা।’ প্রফেসর স্টেগ শুধরে দিলেন। উপস্থিত ডায়নোসরেরা আঁতকে উঠল। ‘তিনি কত জ্ঞানী!’ আর ‘কত চালু মগজ’ আর ‘এই জন্তু আর গরিলার মাঝে পার্থক্য কী? জুতা?’—এ ধরনের কথা বলা বলি করা শুরু করল ওরা।

প্রফেসর স্টেগ বললেন, ‘এই মনুষ্য-বাবাটা একদম প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে আছে। এখন ওর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে। তাই এসো, হে মহাকাশের ডায়নোসরেরা-ওকে আমরা ডায়নোসরদের মহান গান শুনিয়ে বিদায় দেই।’

আমাকে খুব দারুণ এক গান শুনিয়ে বিদায় দিল ওরা। গানটা এরকম, ‘কাল রাতে কী করেছ জানো, কিন্তু আজ সকালে কেমন বোধ করছ?’ এরপর আরেকটা গান শোনাল-’আলকাতরার কাছে যেয়ো না, গায়ে লেগে থাকবে।’ মহাকাশের পুলিশ ডায়নোসরেরা ওদের নিয়ে লেখা একটা গান শোনাল। সবশেষের গানটা ছিল ‘আমার আছে দারুণ একগাদা শক্ত-পশমযুক্ত-ভেজা-সাদা- কুরকুরে-পরে জানতে পারলাম, গানটা প্রফেসর স্টেগের আন্টি বাটন লিখেছে।

সারা বিশ্বে ডায়নোসরদের একসাথে গান গাওয়ার চেয়ে সুন্দর আর কোন দৃশ্য নেই।

‘এখন,’ বলল প্রফেসর স্টেগ, ‘উড়ন্ত-গোল-প্রাণী-বাহকে করে ফিরে যাবার সময় হয়েছে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আমি মহাবিশ্ব ঘুরে দেখতে চাই। এরপর নিজের সময়ে ফিরে গিয়ে, সে ব্যাপারে একটা বই লিখব।’

‘আসলে আপনি একটা না অনেকগুলো বই লিখবেন।’ ডিপ্লোডোকাস বলল, ‘তার মাঝে প্রফেসর স্টেগের ভবিষ্যতের গাইড বইটা আমার সবচেয়ে পছন্দের। আমাকে অনেক দুঃখের সময়ে পথ দেখিয়েছে।’

ডায়নোসরদের বিদায় জানালাম, বিশেষ করে প্রফেসর স্টেগকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম। সে অনেকবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে।

‘ওসব বোলো না।’ বলল সে, ‘আমাদের দু’জনের কপাল ভাল যে তোমার কাছে দুধের প্যাকেট ছিল। সব দুধের প্যাকেট কিন্তু মহাবিশ্বকে বাঁচায় না।’

‘আমি মহাবিশ্বকে বাঁচিয়েছি।’ বললাম, ‘দুধের প্যাকেট না।’

এরপর সব ডায়নোসর একে একে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ছবি তুলল।

‘এই দুধ দিয়ে কি করবে?’ আমাকে জিজ্ঞেস করল ওরা, ‘জাদুঘরে দেবে নাকি?’

‘না, ও-কাজ করব না।’ আমি জানালাম, ‘আমার ছেলেমেয়েকে দিব। ওরা সিরিয়ালের সাথে মিশিয়ে খাবে। আমার চায়েও ব্যবহার করতে পারি।’

প্রফেসর স্টেগ বেলুনের বাস্কেটে উঠে পড়লেন। সেই শেষবার দেখেছি ওকে। সসারটা উজ্জ্বল হতে হতে হারিয়ে গেল। এতটাই উজ্জ্বল যে আমার চোখ ঝলসে উঠল।

যাই হোক, চোখ ঠিক হলে দেখতে পেলাম, পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। অক্ষত।

কপাল ভাল, ডায়নোসরেরা ছবি তোলা শেষ হলে ফিরিয়ে দিয়েছিল দুধের প্যাকেট।

তাই প্যাকেট হাতে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

এখন এই যে, তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

.

আব্বুর কথা শেষ হলো।

আমি আমার বোনের দিকে তাকালাম, আর আমার বোন তাকাল আমার দিকে। এরপর আমরা দু’জনেই আমাদের চারদিকে তাকালাম। দেয়াল পঞ্জিকায় একটা বেলুন আঁকা, আমার ডায়নোসর আর আমার বোনের খেলার পনি পড়ে আছে রান্নাঘরের টেবিলে। সেই সাথে নজর পড়ল ওর ভ্যাম্পায়ার বই আর আমার ছোট বেলায় আঁকা আগ্নেয়গিরির ছবির উপর।

সব কিছু দেখা শেষ করে আবার আব্বুর দিকে তাকালাম।

‘আমরা যে একটা কথাও বিশ্বাস করিনি, তা আশা করি বুঝতে পেরেছ?’ আমার বোন বলল।

‘এক অক্ষরও না।’ আমি যোগ করলাম।

‘বিশেষ করে তুমি কীভাবে পৃথিবীকে নতুন করে সাজানোর হাত থেকে বাঁচিয়েছ অথবা কীভাবে জলদস্যুদের হারিয়েছ… সে-গুলো।’

‘না, একটুও বিশ্বাস করিনি।’ বললাম আমি।

আব্বু শ্রাগ করল, ‘তোমাদের ইচ্ছা।’ বলল সে, ‘তবে আমি সত্যি কথাই বলছি। প্রমাণও করতে পারব।’

‘কীভাবে?’

‘হ্যাঁ, কীভাবে?’ আমার বোন জিজ্ঞেস করল।

‘এই যে,’ আব্বু রান্নাঘরের টেবিলের উপরে প্যাকেটটা দেখে বলল, ‘দুধের প্যাকেটটা।’

এরপর মন দিল খবরের কাগজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *