ফরওয়ার্ড ব্লক—তার যৌক্তিকতা

ফরওয়ার্ড ব্লক—তার যৌক্তিকতা

(গোপনে ইউরোপে যাওয়ার সময় কাবুলে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়।)

কোনও আন্দোলনের বিবর্তনকে একটি গাছের বিকাশের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্তঃপ্রেরণা থেকেই তা বেড়ে ওঠে এবং প্রতিটি ধাপে তা থেকে নতুন নতুন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যাতে এর অগ্রগতির ধারাটি অব্যাহত থাকে। নতুন শাখা-প্রশাখা আর বের না হলে বুঝতে হবে সেই আন্দোলন ক্ষীণ বা মৃতপ্রায় হয়ে আসছে।

যে ভূমিতে আন্দোলনের জন্ম সেই ভূমি থেকেই সে তার প্রাণরস আহরণ করে বটে তবে আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক ইত্যাদি বাইরের থেকেও তা গ্রহণ করে পুষ্টি লাভ করে। একটি জীবন্ত আন্দোলনের পক্ষে অভ্যন্তরীণ প্রাণরস ও বাইরের পুষ্টি দুটোই দরকার।

আন্দোলনের মূল স্রোতধারা যখন শুকিয়ে যেতে থাকে কিন্তু সামগ্রিকভাবে আন্দোলনের প্রাণরক্ষা বজায় থাকে তখনই অনিবার্যভাবে বামপন্থী দলের জন্ম হয়। অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বামপন্থী দলের প্রধান কাজ হল তাকে শক্তিশালী করে তোলা। বামপন্থী দলের উদ্ভবের পর এর সঙ্গে আন্দোলনের মূল স্রোতধারা, যা এখন দক্ষিণপন্থী রূপে পরিচিত হয় তার সঙ্গে বিরোধ বাধে। এই সংঘর্ষ অবশ্য সাময়িক, এর মধ্য দিয়েই আন্দোলন উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছয় এবং তখন সংঘর্ষের অবসান হয়। একপ্রকার মতৈক্য বা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সংঘর্ষের মীমাংসা হয় যার ফলে বামপন্থীরা সামগ্রিকভাবে আন্দোলনটিতে প্রাধান্য লাভ করে। এভাবে বামপন্থীরাই আন্দোলনের মূল স্রোতে পরিণত হয়।

বিবর্তনের এই ধারাকে দার্শনিক ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়, ‘ক্রিয়া’ (‘Thesis’) থেকেই সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়া (‘Antithesis’) এবং এ দুয়ের দ্বন্দ্বের অবসান হয় ‘সমন্বয়ে’র (‘Synthesis’) মাধ্যমে। এই সমন্বয়ই বিবর্তনের পরের পর্যায়ে ‘ক্রিয়া’র রূপ গ্রহণ করে।

ক্রমবিকাশের এক প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় ‘দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়া’ (‘dialectical process’)। একে ঠিকমতো বুঝতে পারলে গত কয়েক দশকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার একটা নতুন অর্থ এবং তাৎপর্য জানা সম্ভব। এই দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা এখন গান্ধীজির আন্দোলন পর্যালোচনা করব।

এই পর্যায়ে বলা যায়, আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যে সবসময়েই ক্ষতিকর এবং অবাঞ্ছনীয় তা মনে করা ভুল। বরং এটা বলাই ঠিক যে, ইতিহাসের দিক থেকে যে সংঘর্ষের সৃষ্টি তা প্রগতির জন্যে অপরিহার্য, সেটা চিন্তা বা কাজ যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন।

কোনও একটি আন্দোলন বা তার একটি বিশেষ পর্যায় কখন তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে নিশ্চল হয়ে পড়বে তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত তার বাইরে থেকে শক্তি গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে এবং নতুন সৃষ্টি করতে থাকে ততক্ষণ এর ধ্বংস সূচনা হয় না।

এখন গান্ধীজির আন্দোলনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাক। ১৯১৯ সালের মধ্যে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ভারতে এক নতুন পরিস্থিতি দেখা দেয় এবং সেই সঙ্গে নতুন সমস্যাও। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর মোকাবিলা করতে পারেনি কারণ তার গতিশীলতা তখনই হারিয়ে গেছে। যদি কংগ্রেসকে সঞ্জীবিত ও গতিশীল করতে হয় তার জন্যে স্পষ্টতই প্রয়োজন হল বামপন্থী চিন্তাধারার। এই মুহূর্তে গান্ধী আন্দোলন রূপে দেখা দিল বামপন্থী চিন্তাধারা। কিছুদিনের জন্যে সংঘাত বাধল এবং পুরনো নেতারা কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হলেন কিংবা তাঁরা স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন। শেষপর্যন্ত একটা ‘সমন্বয়’ ঘটল। কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর মতবাদ মেনে নিল এবং বামপন্থীরাই কার্যত আসল কংগ্রেস হয়ে দাঁড়াল।

১৯২০ সালে গান্ধীবাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে প্রতিষ্ঠিত হল এবং দু’ দশক তার প্রাধান্য বজায় রইল। কেবলমাত্র মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিত্বের জন্যেই তা সম্ভব হয়নি; তা সম্ভব হয়েছে অন্যান্য ভাবধারা ও নীতিকে গ্রহণ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল বলে। শেষের কারণটি না থাকলে অনেক দিন আগেই কংগ্রেসের ওপরে গান্ধীবাদের প্রভাবের অবসান ঘটত। গত বিশ বছর ধরে কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধীবাদের প্রাধান্যের সময় যখনই কোনও বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে তখনই গান্ধী-আন্দোলন সেই বিদ্রোহের অনেকগুলি ভাবধারা ও নীতি গ্রহণ করে তার গতি থামিয়ে দিয়েছে। কেবল সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে, পরিবর্তিত অবস্থায় সঙ্গে সে আর মানিয়ে নিতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৩ সালে স্বরাজ্য দলের উদ্ভবের পর যে সংঘাত দেখা দেয় তা অল্পকাল স্থায়ী হয়। ১৯২৫ সালে কানপুর কংগ্রেসে গান্ধীপন্থীরা স্বরাজ্য দলের আইনসভার মধ্যে অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার নীতি মেনে নেয় এবং কংগ্রেস সেই নীতিকে গ্রহণ করে।

আবার ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতা কংগ্রেসে স্বাধীনতার প্রশ্নে ইন্ডিপেণ্ডেন্স লীগের উদ্যোগে গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। মহাত্মা গান্ধী ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস সমর্থন করেন এবং স্বাধীনতা বিষয়ক আমাদের প্রস্তাবটি তাঁর বিরোধিতার জন্যে গৃহীত হয়নি। কিন্তু এক বছর পরে লাহোর কংগ্রেসে তিনি নিজে এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, অতঃপর স্বাধীনতাই হবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য।

এরূপ সমন্বয়ের দ্বারা গান্ধী-আন্দোলন তার প্রগতিশীল চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল এবং কোনও বড় রকমের বামপন্থী আন্দোলনের উদ্ভবে বাধা দিয়েছিল। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে গান্ধী-আরউইন চুক্তির পরে সাময়িকভাবে পিছিয়ে পড়লেও ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে গান্ধীজি তাঁর হৃত জমি পুনরুদ্ধার করেন।

আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং ১৯৩৩ সালে তার প্রত্যাহারের পরে একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব এবং তার ফলে নতুন বিদ্রোহের সৃষ্টি হল। এটা হল দক্ষিণপন্থীদের তরফ থেকে। আন্দোলনের ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে গান্ধীপন্থীদের একটা বড় অংশ দাবি করে যে, ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার আগে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোর কংগ্রেসে আইনসভা সংক্রান্ত যে কর্মপন্থা বাতিল করা হয়েছিল তা আবার গ্রহণ করা হোক। ১৯৩৪ সালে গান্ধীজি এই দাবি মেনে নিলেন। তার কারণ কংগ্রেসের জন্যে তাঁর তখন কোনও বিকল্প পরিকল্পনা ছিল না। এ ঘটনাতেই আভাস পাওয়া গেল যে গান্ধী আন্দোলনে নিশ্চলতা দেখা দিয়েছে। আইনসভা সংক্রান্ত কর্মপন্থা আবার আরম্ভ হওয়ার প্রায় সমকালে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির মাধ্যমে যে বামপন্থী বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল তাতে এই ধারণাই প্রমাণিত হয়।

গান্ধী-আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা এবং অপরের সঙ্গে মানিয়ে চলার শক্তি একদিনেই নষ্ট হয়নি। ১৯৩৪ সালে এবং তার পরেও কংগ্রেস সোস্যালিস্ট এবং অন্যান্য বামপন্থীদের প্রতি গান্ধীপন্থীদের মনোভাব মোটের ওপর উদার ছিল। বস্তুত ১৯৩৬, ১৯৩৭ এবং ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে কংগ্রেস সোস্যালিস্টদের সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। (১৯৩৮ সালে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।) ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে গান্ধীপন্থীরা কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্যে আমাকে সমর্থন করেন। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হরিপুরা কংগ্রেসে যখন এক বছরের জন্যে আমি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করি গান্ধীজি তখন স্পষ্টই এমন মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে, ওয়ার্কিং কমিটিতে সোস্টালিস্টদের গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনও আপত্তি থাকতে পারে না।

১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে নিখিল ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভার পর মহাত্মা গান্ধীর মনোভাবে একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন, যার ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি, ঘটে। একটি বিতর্কমূলক বিষয়কে কেন্দ্র করে বামপন্থীরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। সেই সময়েই গান্ধীজিকে একজন বলতে শোনেন যে, কংগ্রেসের কাজ পরিচালনার ব্যাপারে বামপন্থীদের সঙ্গে কোনও আপস চলতে পারে না। এর কয়েক মাস পরে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে কংগ্রেস সভাপতি পদে আমার পুনর্নির্বাচনে বিরোধিতা করে তিনি সেই মনোভাবেই প্রমাণ দিলেন।

১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে গান্ধীবাদ আরও গতিহীন এবং সঙ্কীর্ণ ছিল। ঐ একই বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে হরিপুরা কংগ্রেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয় তা হল ফেডারেশন ও আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে। ফেডারেশন সম্পর্কে আপসহীন বিরোধিতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও সারা বছর জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গান্ধীবাদী ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে নেপথ্যে আপস আলোচনা চলেছে। আমার সভাপতিত্বের বিরুদ্ধে গান্ধীপন্থীরা যে অভিযোগ এনেছিলেন তাতে প্রথমে ছিল ফেডারেশন সম্পর্কে আমার আপসহীন বিরোধিতার মনোভাব। দ্বিতীয় অভিযোগটি ছিল, গান্ধীপন্থীদের মতে আমার বামপন্থীদের প্রতি অহেতুক বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব। তৃতীয় অভিযোগটি ছিল আমি যে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির পরিকল্পনা ও পরে তা গঠন করেছিলাম সেই সম্পর্কে। গান্ধীপন্থীদের মতে এতে কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন করে, যে শিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল গান্ধীপন্থীদের গঠনমূলক কর্মপন্থার অন্যতম প্রধান বিষয়, ব্যাপক শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থাকেই উৎসাহ দেওয়া হবে। পরের অভিযোগটি হল স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম আবার আরম্ভ করার আগে আমি ব্রিটিশ সরকারকে একটি চরমপত্র দেবার কথা বলেছি।

১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষই বুঝতে পারলেন যে ভবিষ্যতে গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের মৈত্রীর সম্পর্ক আর বজায় থাকবে না। আগেই বলেছি যে, গান্ধীজি নিজে খোলাখুলিভাবে তার মনোভাবের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, মিউনিখ চুক্তির সময় কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে এটা স্পষ্ট হল যে ভবিষ্যতে ভারত যদি যুদ্ধের সঙ্কটের মধ্যে পড়ে তাহলে গান্ধীপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ এড়ানো যাবে না। একথা সত্য যে, ১৯২৭ সাল (মাদ্রাজ কংগ্রেস) থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনগুলিতে যুদ্ধের বিষয়ে কংগ্রেসের নীতি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা হয়েছিল এবং এই যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতির বিষয়ে কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে সাধারণ অবস্থায় কোনও মতানৈক্য, কোনও বিরোধ তো দূরের কথা, থাকতে পারে বলে আশা করা যেত না। তা সত্ত্বেও মিউনিখ চুক্তির আগে আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সময়ে বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যেসব আলোচনা হত তাতে আর কোনও সন্দেহ থাকল না যে, কংগ্রেসের আগের অধিবেশনগুলিতে গৃহীত যুদ্ধের বিষয়ে প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে গান্ধীপন্থীদের কোনও উৎসাহ নেই এবং প্রয়োজন হলে বা সুবিধা বুঝলে সেই প্রস্তাব না মানতে তাঁরা দ্বিধা করবেন না। এখন যে দুটি প্রশ্নে বামপন্থীরা ভীষণভাবে আগ্রহী এবং যে বিষয়ে তাঁরা কোন আপস মেনে নিতে প্রস্তুত নন তা হল ফেডারেশন ও আসন্ন যুদ্ধ। ফলে এই দুটি বিষয়ে গান্ধীপন্থীদের দ্বিধাগ্রস্থ ও আপসমূলক মনোভাব ভবিষ্যতে তাঁদের সঙ্গে বামপন্থীদের একটি বিচ্ছেদ ঘটানোর পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।

মিউনিখ চুক্তির ফলে ইউরোপে কিছুকালের জন্যে যুদ্ধ শুরু হওয়া স্থগিত থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছাত্ররা সহজেই বুঝতে পারলেন যে যুদ্ধ এড়ান যাবে না এবং তা আসন্ন। আমার মনে তখন এই বিশ্বাস জাগল যে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীদের ওপর জোর করে ফেডারেশন চাপিয়ে দেবে না। ফেডারেশন আর ভারতীয়দের কাছে আশু সমস্যা নয়, কাজেই এবার তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপন্থা স্থির করা দরকার। ফেডারেশন সম্পর্কে যখন বহু-প্রত্যাশিত সংগ্রাম শুরু করার সম্ভাবনা আর নেই তখন কীভাবে তাঁরা আর তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন?

১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর ভারত সফরের সময়ে আমি এই সমস্যার একটি সমাধানের প্রস্তাব দিই। আমি বলি যে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সরকারের উদ্যোগী হয়ে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই। সাময়িকভাবে হলেও ফেডারেশনের প্রস্তাবটি যখন মুলতুবী আছে এবং যুদ্ধ প্রায় আসন্ন তখন কংগ্রেসেরই উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরু করা দরকার। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে চরমপত্র দেয়া এবং জাতীয় সংগ্রামের জন্যে দেশকে তৈরি করাই তার প্রকৃষ্ট উপায়। নভেম্বর মাস থেকে আমরা এই কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকি এবং ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ত্রিপুরী কংগ্রেসে এটি প্রস্তাবের আকারে পেশ করা হয় কিন্তু গান্ধীপন্থীদের চেষ্টায় এটি অগ্রাহ্য হয়। প্রস্তাবটিতে অন্যান্য কথার মধ্যে বলা হয়েছিল যে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে চরমপত্র দাখিল করার পরে সুস্পষ্ট উত্তর দেবার জন্যে তাদের ছ’ মাস সময় দেওয়া হবে। ত্রিপুরী কংগ্রেসের ছ’মাস পরে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হলে যে গান্ধীপন্থীরা ত্রিপুরীতে এই প্রস্তাবের এত বিরোধী ছিল তাঁরাও তখন এই প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছিলেন।

ইউরোপে যুদ্ধ ঘোষণার অল্প পরেই মহাত্মা গান্ধী, যিনি ছিলেন তখনকার কংগ্রেসের কার্যত ডিরেক্টর, যুদ্ধের ব্যাপারে বিনাশর্তে ব্রিটেনের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্যে বিবৃতি দিলেন। এগারো বছর ধরে কংগ্রেস যেসব প্রস্তাব বারবার গ্রহণ করেছে তা সুবিধা বুঝে ভুলে যাওয়া হল। (যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরে ফেডারেশনের প্রস্তাব সরকারীভাবে মূলতুবি রাখা হয়।)

১৯৩৮ সালের পর থেকে আমরা, বামপন্থীরা, যেসব বিষয়ে গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে বিরোধের মুখোমুখি হয়েছি এবং যে বিষয়ে কোনও আপস সম্ভব হয়নি তা হল স্বাধীনতার জন্যে জাতীয় সংগ্রাম পুনরায় শুরু করা এবং ভারতীয়দের পক্ষে যুদ্ধ সম্পর্কে যথার্থ নীতি স্থির করা। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী ঘরোয়া বৈঠকে এবং প্রকাশ্যে একথা বারে বারে ঘোষণা করে এসেছেন যে, সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্যের কোনও কথাই উঠতে পারে না এবং কেউ যদি এ রকম কোনও আন্দোলন শুরু করেন তো তাতে দেশের ক্ষতি করা হবে। একথা অবশ্য সত্য যে ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে গান্ধীজির উদ্যোগে ব্যক্তিগ্রহ সত্যাগ্রহ শুরু হয়েছিল। তবে গান্ধীজি নিজে ঘোষণা করেছিলেন, এবং যে কথা আমরা সবাই ভালভাবে জানি, যে তা স্বাধীনতা লাভের জন্যে কোন গণ-সংগ্রাম নয়। ভারতে এবং ইংল্যান্ডে দায়িত্বশীল ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে তেমন বিব্রত করেনি। যুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেনের জয়লাভ ছিল মহাত্মা গান্ধীর কাম্য এবং তার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে তিনি সরকারকে বিব্রত করার মতো কোনও অবস্থা সৃষ্টি করতে চাননি। স্বাধীনতা লাভের জন্যে গণ-আন্দোলন শুরু করা হলে সেরকম অবস্থার সৃষ্টি হত।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে শর্তহীন সহযোগিতার কথা বলেছিলেন কিন্তু ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যুদ্ধ-বিরোধী প্রচার চালানোর জন্যে স্বাধীনতা দাবি করলেন। ১৯৩৮ সালের পর থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্যে জাতীয় সংগ্রাম আবার শুরু করার সকল প্রচেষ্টার তিনি নিন্দা করে এসেছেন কিন্তু ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে সেই মনোভাব বদল করে তিনি এমনকি ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেন। মনোভাবের এই পরিবর্তনের, তা যতই সামান্য হোক না কেন, কারণ সম্পর্কে কি প্রশ্ন উঠতে পারে না? যদি বলা যায় যে বামপন্থীদের চাপের জন্যেই এই পরিবর্তন ঘটেছে তাহলে কথাটা কি ভুল হবে?

দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে গান্ধীজি যে নীতির কথা প্রচার এবং সমর্থন করে এসেছেন, তাঁর এই বয়সেও যে তিনি চাপের জন্যে সেই নীতির পরিবর্তন, আংশিকভাবে হলেও, করতে পেরেছেন এতে প্রমাণিত হয় যে, অবস্থার সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারেন এবং তাঁর মন পরিবর্তনশীল। তা সত্ত্বেও সেই সময়ের প্রয়োজন হিসাবে তা যথেষ্ট ছিল না। আমরা এখন ইতিহাসের ‘ব্লিৎসক্রিগ’ যুগে বাস করছি এবং সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে না পারলে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। গান্ধীজি যে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে এবং জাতিকে পরিচালনা করতে এখনও সক্ষম তার প্রমাণ তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিতে পারেননি। এতে আগে যা বলেছি আমাদের সেই বিশ্বাসই সমর্থিত হয় যে-গান্ধী-আন্দোলন গতিহীন এবং সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে।

১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে গান্ধীপন্থীরা উদার ভাবধারার প্রতি যে আপসহীন মনোভাবের পরিচয় দিয়ে আসছেন এবং কংগ্রেস থেকে প্রগতিশীল ও সংস্কারকামী শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করার জন্যে তাঁদের যে ক্রমবির্ধমান ইচ্ছা ও চেষ্টার পরিচয় পাওয়া গেছে তা থেকে প্রমাণ হয় যে তারা কেবল অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা এবং গতিশীলতা হারিয়ে ফেলছেন না সেই সঙ্গে একটি দুষ্টচক্রের মতো নিজেরা ক্রমশ বেশিমাত্রায় নিশ্চল হয়ে পড়ছেন। গান্ধীপন্থীদের জন্যে গান্ধীজি যে সমস্ত অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন (যেমন নিখিল ভারত কাটুনি সঙঘ, গান্ধী সেবা সঙ্ঘ, হরিজন সেবক সঙ্ঘ, নিখিল ভারত গ্রামীণ শিল্প সমিতি, হিন্দী প্রচার সমিতি ইত্যাদি) সেগুলি অরাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থের সৃষ্টি করে ভবিষ্যতে গান্ধী-আন্দোলনের রাজনৈতিক গতিশীলতা ক্ষুণ্ণ করবে এবং তা ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এবং অন্য সবকিছুর চেয়ে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় জীবন এবং মন্ত্রিত্বের পদ রাজনীতির ক্ষেত্রে গান্ধীবাদের সমাধি রচনা করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।

গান্ধী আন্দোলনের যেটুকু বিপ্লবী প্রাণশক্তি ছিল, অন্য সবকিছুর চেয়ে মন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণই তার বেশি ক্ষতি করেছে। একথা বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না যে, এর প্রভাবে বহু কংগ্রেস কর্মী বিপ্লবের কন্টকময় পথ থেকে সরে এসে নিয়মতান্ত্রিক শাসনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের পথ ধরেছেন। ১৯৩৭ সালে বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১৯৩৮ সালের কংগ্রেসের মধ্যে নয়া-নিয়মতান্ত্রিকতা ভয়াবহভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তারপর থেকে কংগ্রেসের নিজের তৈরি এই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে’র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হল বামপন্থীদের প্রধান কাজ। নিয়মতান্ত্রিকতার দিকে কংগ্রেসের এভাবে এগিয়ে যাওয়া কীভাবে রোধ করা যায়, নয়া-নিয়মতান্ত্রিক মনোভাবের বদলে জনগণের মনে নতুন করে কীভাবে আবার বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করা যায়, সাহসের সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধকালীন সঙ্কটের মোকাবিলা করা যায়, কীভাবে কংগ্রেসকে আবার আপসহীন জাতীয় সংগ্রামের পথে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সবশেষে কীভাবে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়— ১৯৩৮ সালের পর থেকে বামপন্থীদের কাছে এগুলিই হল প্রধান সমস্যা।

গান্ধী-আন্দোলন আজ সে শুধু নিয়মতান্ত্রিকতার শিকার হয়েছে তা নয় সেই সঙ্গে কর্তৃত্বের মোহও তাকে গ্রাস করেছে। কোনও সংগ্রামী সংগঠনের মধ্যে কিছু পরিমাণে কর্তৃত্বের মোহ থাকা স্বাভাবিক এবং তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আজ যে কর্তৃত্বভাবের বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে তার কারণ সেই একই নিয়মতান্ত্রিকতা। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পরে গান্ধীপন্থীরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এই ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে নিজেদের দখলে যাতে থাকে সেজন্যে তারা এখন উদ্বিগ্ন। ইদানীং কংগ্রেসের মধ্যে যা ঘটছে তা হল ‘ক্ষমতা দখলে’র রাজনীতি, যদিও খানিকটা নকল ধরনের। ‘ক্ষমতার লড়াই’-এর উৎস হল ওয়ার্ধা। গান্ধীপন্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে চিরকাল তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারেন সেজন্যে কংগ্রেসের মধ্যে সবরকম বিরোধিতাকে গুঁড়িয়ে ফেলাই হল এই ‘ক্ষমতা দখলের রাজনীতি’র লক্ষ্য। কিন্তু এ কৌশল সফল হবে না। প্রকৃত ক্ষমতা এখনও আসেনি এবং আমরা যদি নিয়মতান্ত্রিকতার নিরাপদ পথ দিয়ে চলি তা কখনই আসবে না। গান্ধীপন্থীদের পক্ষে কংগ্রেস থেকে সব বিরোধী শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করে তাকে একটি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীতে পরিণত করা নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে তাঁরা ভারতের জন্যে স্বাধীনতা আনতে সক্ষম হবেন। প্রকৃত ক্ষমতা না এলে প্রকৃত ‘ক্ষমতা দখলের রাজনীতি’ও সম্ভব নয়। আজ আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা নকল ‘ক্ষমতা দখলের রাজনীতি’ মাত্র।

গান্ধীপন্থীরা যদি একটি বিপ্লবী শক্তি হতেন তাহলে নিজেদের জন্যে একচেটিয়াভাবে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করলে বা কর্তৃত্ব করে কাজ করলে ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনও আপত্তি থাকত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গান্ধীবাদীদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা নেই। তাঁরা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সফল হবেন এমন কোনও আশা নেই। ফলে আমাদের গান্ধীপন্থী বন্ধুরা যতই নিজেদের ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবকে সুদৃঢ় করতে চেষ্টা করবেন ততই তাঁরা কংগ্রেসকে গতিশক্তিহীন করে তুলবেন। বিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে বেশিমাত্রায় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কংগ্রেসকে এখনকার চেয়ে ঐক্যবদ্ধ করা হয়তো সম্ভব কিন্তু এই প্রক্রিয়া বহিঃশত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি করবে এবং শেষপর্যন্ত তা কংগ্রেসের ‘গণ-ভিত্তি’র মূলে আঘাত করবে এবং দেশের মানুষের ওপর কংগ্রেসের যে প্রভাব রয়েছে তাও হ্রাস করবে।

গান্ধীপন্থীদের নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা কংগ্রেসের মধ্যে ‘দক্ষিণপন্থী সংহতি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। চোখের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে একাজ চলছিল এবং মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর তা ত্বরান্বিত হয়েছে। এই বিপদটা বুঝতে পারার পর বামপন্থীরা আত্মরক্ষার জন্য যখন নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলেন তখন গান্ধীবাদী মহলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। তাঁদের কাছে আত্মসংহতি অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী সংহতিই হল ন্যায়সঙ্গত এবং স্বাভাবিক কিন্তু বামপন্থী সংহতি হল অপরাধ।

গান্ধীবাদ যখন থেকে গতিশক্তি হারাতে শুরু করেছে এবং এর বিরুদ্ধে এক বৃহৎ বামপন্থী দল আত্মপ্রকাশ করেছে তখন থেকে গান্ধীপন্থীরা দক্ষিণপন্থী হয়েছেন এবং গান্ধীপন্থী সংহতি বলতে দক্ষিণপন্থী সংহতি বোঝায়।

দর্শনের ভাষায় বলা যায়, দক্ষিণপন্থী সংহতি হল ‘ক্রিয়া’ (Thesis) এবং এর ‘প্রতিক্রিয়া’র (Anti-thesis) জন্যে দরকার বামপন্থী সংহতি। এই ‘প্রতিক্রিয়া’ এবং তার ফলে দুয়ের মধ্যে সংঘাত না ঘটলে আর অগ্রগতি সম্ভব নয়। যাঁরা প্রগতিতে বিশ্বাস করেন এবং তা চান তাঁদের উচিত বামপন্থী সংহতির কাজে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করা এবং এর ফলে উদ্ভূত সংঘাতের জন্যে তাঁদের তৈরি থাকতে হবে। বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে যেখানে আমি সভাপতি পদে ইস্তফা দিয়েছিলাম তার অল্প কিছুদিন পরে ১৯৩৯ সালের মে মাসে ফরওয়ার্ড ব্লক জন্মলাভ করে।

নিম্নলিখিত পদ্ধতির যে কোনও একটি অনুসরণ করে বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলা সম্ভব হত:

(১) একটি দল গঠন করা এবং তার মধ্যে সমস্ত বামপন্থী শক্তিকে সমবেত করা। এ কাজ করা অবশ্য সম্ভব হয়নি কারণ বামপন্থী বলে দাবি করে এরকম কয়েকটি দল ইতিমধ্যেই বর্তমান ছিল এবং তারা একটিমাত্র দলের অনুকূলে নিজের অস্তিত্বকে লোপ করতে চায়নি।

(২) এমন একটি নতুন ব্লক সংগঠিত করা যাতে সমস্ত বামপন্থী ব্যক্তি এবং বর্তমান বামপন্থী দল, ইচ্ছা করলে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও, যোগ দিতে পারে।

ফরওয়ার্ড ব্লক যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এটাই ছিল তার প্রথম লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা। তা বর্তমান বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিংবা তাদের কারুরই ক্ষতিসাধন করতে চায়নি। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রস্তাব গ্রহণ করে, স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও বামপন্থী দলগুলি যদি ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিত তাহলে সহজে এবং অবিলম্বে বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলা যেত এবং দক্ষিণপন্থীরা এক দুর্জয় শক্তির সম্মুখীন হতেন। কিন্তু বামপন্থী স্বার্থের পক্ষে দুর্ভাগ্য যে এই চেষ্টা সফল হয়নি কারণ কয়েকটি বামপন্থী দল তাদের সভ্যদের নবপ্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এসব দলের এই দুর্বোধ্য মনোভাবের কারণ কী সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করার দরকার নেই।

(৩) এ অবস্থায় বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার জন্যে নতুন করে আর একবার নিম্নোক্তভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল। বামপন্থী দলগুলি ও ফরওয়ার্ড ব্লক নিজেদের মধ্যে স্থির করল যে বামপন্থী সংহতি কমিটি (Left-consolidation Committee) নামে একটি নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি সমস্ত বামদলগুলির মুখপাত্র হিসাবে কাজ করবে, কিন্তু বামপন্থী সংহতি কমিটির সকল সদস্যের মধ্যে মতৈক্য হলেই তবে কাজ করবে।

১৯৩৯ সালের জুন মাসে বোম্বাইয়ে বামপন্থী সংহতি কমিটি গঠিত হয় এবং অবিলম্বে তার আশ্চর্য ফল দেখা গেল। এই প্রথম সমগ্র বামপন্থী শক্তি একটি ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত আকারে নিখিল ভারত কংগ্রেস অধিবেশনে, যা তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, আত্মপ্রকাশ করল। সংখ্যায় অল্প হলেও বামপন্থীদের বিরোধিতার ফলে কংগ্রেস গঠনতন্ত্রের কয়েকটি পরিবর্তন করানো হল না। দক্ষিণপন্থীরা এই পরিবর্তন ঘটাতে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সেই অধিবেশন ছিল বামপন্থীদের কাছে নৈতিক দিক থেকে জয়লাভ। বামপন্থীদের পক্ষে এটিকে এক শুভ সূচনা বলা যেতে পারে।

কিন্তু ১৯৩৯ সালের ৯ জুলাই বামপন্থী সংহতি কমিটির ওপর প্রথম আঘাত এল এবং এ আঘাত হানলেন এম. এন. রায়। জুন মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বোম্বাই অধিবেশনে বামপন্থীদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও যে দুটি বাম-বিরোধী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার প্রতিবাদে এই কমিটি ৯ জুলাই সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জুলাই মাসে কংগ্রেস সভাপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ একটি বিবৃতি দিয়ে বামপন্থীদের সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন, অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই ভীতি প্রদর্শনের ফলে এম. এন. রায় একেবারে শেষ মুহুর্তে ঘোষণা করলেন যে, তাঁর দল র‍্যাডিক্যাল লীগ প্রতিবাদ দিবস পালনে যোগ দেবে না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে টেলিগ্রাফ-বার্তা পাঠিয়ে তিনি অনুরোধ করলেন, কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দল যাতে প্রতিবাদ দিবসে অংশগ্রহণ না করে তার জন্যে তিনি যেন তাঁর প্রভাবকে কাজে লাগান। সকলে তখন এম. এন. রায়কে বামপন্থী নেতা বলে জানত এবং তাঁর র‍্যাডিক্যাল লীগ ছিল বামপন্থী সংহতি কমিটিতে অংশগ্রহণকারী অন্যতম দল। সুতরাং তাঁর কাজে বামপন্থী স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হল এবং দক্ষিণপন্থীরা তাতে খুব খুশি হলেন।

র‍্যাডিক্যাল লীগ এভাবে সরে দাঁড়ানোর ফলে একটু অসুবিধা হলেও কমিটির অন্যান্য সদস্যরা যথারীতি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বযুদ্ধের ফলে উদ্ভূত দেশের অবস্থায় তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার সঙ্কল্প আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অক্টোবর মাসে এক নতুন সঙ্কট দেখা দিল যখন কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের নেতারা লক্ষ্ণৌতে ঘোষণা করলেন যে তাঁদের দল নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলবে এবং বামপন্থী সংহতি কমিটির নির্দেশ মানবে না। এই ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের আলোচনা কিছুকাল চলেছিল।

বামপন্থী সংহতি কমিটির ওপরে পরবর্তী আঘাত এল ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন ফরওয়ার্ড ব্লক ও ন্যাশনাল ফ্রন্টের মধ্যে বিচ্ছেদ দেখা দেয়। এ পর্যন্ত এই দুই দলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগে অক্টোবর মাসে নাগপুরে যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে মধ্যপ্রদেশ ও বেরার ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের কংগ্রেস সোস্যালিস্টরা যোগদান না করলেও ফরওয়ার্ড ব্লক, কিষাণ সভা ও অন্যান্য দলের সঙ্গে ন্যাশনাল ফ্রন্ট উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিল। পরে অক্টোবর মাসে লক্ষ্ণৌতে কংগ্রেস সোস্যালিস্টরা বামপন্থী সংহতি কমিটি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও ফরওয়ার্ড ব্লক ও ন্যাশনাল ফ্রন্ট একযোগে কাজ করতে থাকে। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক জানতে পারল যে বাইরে বামপন্থী সংহতি কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করলেও ন্যাশনাল ফ্রন্ট ভেতরে ভেতরে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আরও জানা গেল ন্যাশনাল ফ্রন্টের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে ফরওয়ার্ড ব্লককে প্রতিবিপ্লবী সংগঠন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার সম্বন্ধে নানা বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ফরওয়ার্ড ব্লক ও ন্যাশনাল ফ্রন্টের মধ্যে এক বৈঠকে বিষয়টি তোলা হয়। ন্যাশনাল ফ্রন্ট ঐ প্রবন্ধের দায়িত্ব স্বীকার কিংবা তা প্রত্যাহার করতে রাজী হয়নি। তখন ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতারা তাদের জানিয়ে দিলেন যে ‘একটি প্রতিবিপ্লবী’ সংগঠন বামপন্থী সংহতি কমিটিতে ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না।

ন্যাশনাল ফ্রন্টের আচরণে বোঝা গেল যে নিজেদের সংগঠনকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তারা বামপন্থী সংহতি কমিটিকে ব্যবহার করতে চান এবং কমিটির অন্যান্য সমস্যদের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রকাশ্যে ও গোপনে আপত্তিকর প্রচার চালিয়ে যাবেন।

১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বিচ্ছেদ হওয়ার পরে ন্যাশনাল ফ্রন্ট খোলাখুলিভাবে ফরওয়ার্ড ব্লককে জানিয়ে দিল যে, ফরওয়ার্ড ব্লক যদি কংগ্রেস থেকে পৃথকভাবে কোনও জাতীয় আন্দোলন করে তাহলে ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রকাশ্যে তার নিন্দা ও প্রতিরোধ করবে।

ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা শাখা ও ন্যাশনাল ফ্রন্টের মধ্যে অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে বিরোধ দেখা দেওয়ায় দু’দলের মধ্যে ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পায়।

বামপন্থী সংহতি কমিটি গঠিত হওয়ার আগেও বাংলায় এ ধরনের একটি সংগঠন ছিল। ফলে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে বামপন্থীদের বিপুল সংখ্যাধিক্য ছিল। তাঁদের অধিকাংশই ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত হওয়ার পর এই দলে যোগ দেন। সর্বভারতীয় স্তরে বামপন্থী সংহতি কমিটি গঠিত হওয়ায় স্বভাবতই বামপন্থী ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসে অংশগ্রহণের জন্যে ১৯৩৯ সালের ৯ জুলাইয়ের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতির (অর্থাৎ আমার) বিরুদ্ধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ফ্রন্ট-সহ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বামপন্থীরা সকলেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। শীঘ্রই বুঝতে পারা গেল, ওয়ার্কিং কমিটির এই ব্যবস্থা আসলে ভবিষ্যতের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এবং নিগ্রহের সুদীর্ঘ কর্মপন্থার সূচনা মাত্র। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বামপন্থীরা তখন স্থির করলেন যে তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির কাছে নতিস্বীকার না করে প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন। কয়েক মাস পরে স্পষ্ট বোঝা গেল, ওয়ার্কিং কমিটি সবরকম ব্যবস্থা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এমনকি বৈধ বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটিকে সাময়িকভাবে খারিজ করে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হতে পারে। এই সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা দুর্বলতার পরিচয় দিতে শুরু করলেন এবং ওয়ার্কিং কমিটির নিগ্রহমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদী মনোভাব বজায় রাখতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। অন্য বামপন্থীরা এই ঘটনাকে কঠোর সংগ্রামের মাঝে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করলেন। মনে হল, শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ভয়ে ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা ভয় পেয়েছেন। তাঁরা কিন্তু তাঁদের আসল মনোভাব ঢেকে রাখতে চাইলেন এবং মূল প্রশ্নটি এই বলে এড়াতে চাইলেন যে, ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে সংগঠনগত কোনও সংঘাতে না গিয়ে বামপন্থী সংগঠন হিসাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির উচিত ব্যক্তি স্বাধীনতার (Civil Liberty) দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা। অন্য বামপন্থীরা তা করতে বেশ প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু তাঁরা একই সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটির বিরুদ্ধে সংগঠনগত প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিছুদিন উত্তেজনার পর শেষপর্যন্ত ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও অন্য বামপন্থীদের মধ্যে একটি মীমাংসা হল। তাতে স্থির হয়, ব্যক্তি স্বাধীনতার দাবিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি আন্দোলন করবে এবং ওয়ার্কিং কমিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ব্যাপারে ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীদের অন্য বামপন্থীদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।

১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে আগের সিদ্ধান্তমত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি আন্দোলন শুরু করল এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জনসভা হতে লাগল। কিছুদিন বাদে কিন্তু দেখা গেল যে ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা যখন কোনও জনসভার আয়োজন করেন তখন তাঁরা পূর্বেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি হলওয়েল মনুমেন্ট সত্যাগ্রহ শুরু করে। ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা তাতে যোগ তো দেনইনি, বরং তাঁদের কয়েকজন কার্যত তার বিরোধিতা করেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে রামগড়ে সারা-ভারত আপসবিরোধী সম্মেলনের পর যখন ফরওয়ার্ড ব্লক দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু করার কথা ঘোষণা করে তখন ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা তাতে বাধা দেবার জন্যে সবরকম চেষ্টা করেছিলেন।

আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা এই পর্যন্ত। কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর বিষয়েও ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা প্রতিশ্রুতিমত কাজ করেননি এবং তাঁরা সরে পড়তে লাগলেন। বামপন্থী প্রভাবিত বৈধ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিকে অবাঞ্ছনীয় ও বেআইনীভাবে খারিজ করে ওয়ার্কিং কমিটি যখন তার জায়গায় একটি অ্যাডহক কমিটি তৈরি করল তখন ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা কিন্তু নিঃশব্দে অন্য বামপন্থীদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন। অন্য বামপন্থীরা স্থির করলেন যে তাঁরা হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করবেন এবং বৈধ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কোনও পক্ষেই তাঁরা যোগ দেবেন না, এই ঘোষণা করে ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীরা প্রথমে নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করলেন। অল্পদিন পরে অবশ্য তাঁরা তাঁদের সদস্যপদকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে অ্যাডহক কমিটির কাছে আবেদন করতে শুরু করলেন। আজ তাঁরা তাঁদের সমস্ত লজ্জা বিসর্জন দিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করছেন যে তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন না।

বাংলাদেশে ফরওয়ার্ড ব্লক ও অন্যান্য বামপন্থীদের প্রতি ন্যাশনাল ফ্রন্টপন্থীদের আচরণের প্রতিক্রিয়া সারা ভারতেও দেখা দিল এবং ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় সর্বভারতীয় বিভিন্ন বিষয়ে দু’দলের মধ্যে যে ব্যবধান দেখা দিয়েছিল তা আরও বেড়ে গেল।

১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনাবলীর পর বামপন্থী সংহতি কমিটিতে রইল শুধু ফরওয়ার্ড ব্লক ও কিষাণ সভা। দিনে দিনে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। তাদের সহযোগিতা এবং প্রচেষ্টায় ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে রামগড়ে কংগ্রেসের বার্ষিক আধিবেশন চলাকালে একই সময়ে নিখিল ভারত আপসবিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন খুবই সফল হয়েছিল।

একটি প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে, ফরওয়ার্ড ব্লক আদৌ কেন গঠন করা হল এবং কেন বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার দায়িত্ব অন্য বামপন্থী দলগুলির ওপর দেওয়া হল না। বস্তুত, সে রকম চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এরপর এমন এক পরিস্থিতি দেখা দিল যখন বামপন্থীদের এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করা এবং দক্ষিণপন্থী সংহতির ভয়াবহ বিপদকে প্রতিহত করার জন্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে উঠল।

১৯৩৪ সালে ও তারপরে কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি, র‍্যাডিক্যাল লীগ এবং এরকম আরও কয়েকটি সংগঠন গঠিত হওয়া এবং ন্যাশনাল ফ্রন্টের কংগ্রেসে যোগদানের সিদ্ধান্তের ফলে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এরকম বৃদ্ধি চলেছিল কিন্তু ১৯৩৮ সালে তা বাধা পায় এবং ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে তা স্পষ্ট লক্ষ্য করা গিয়েছিল। হরিপুরা কংগ্রেসের পরে বিভিন্ন দলের বামপন্থীরা একযোগে চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই চেষ্টা চলে। ঐ সময় একটি বামপন্থী ব্লক (Left Block) গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং এটি গঠন করার উদ্যোগ নিতে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল ফ্রন্টকে অনুরোধ করা হয়েছিল। এইসব প্রচেষ্টায় আমি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমার মতো আরও অনেকে, যাঁরা তখনও পর্যন্ত কোনও দলে যোগ দেননি, বামপন্থী ব্লককে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল ফ্রন্ট দু’টি দলই প্রথম দিকে বামপন্থী ব্লক গঠনের প্রস্তাবে খুব উৎসাহ দেখিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা এই চিন্তা ত্যাগ করেছিল।- কেন তারা এরকম করেছিল তা আজও আমার কাছে রহস্য থেকে গেছে। হয়তো তারা ভেবেছিল বামপন্থী ব্লক গঠিত হলে এবং যদি তা বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে তাদের নিজ নিজ দলের গুরুত্ব হ্রাস পাবে। সে যাই হোক, সময়মত ওই বামপন্থী ব্লক প্রতিষ্ঠিত হলে তা যে ফরওয়ার্ড ব্লকের স্থান নিত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বামপন্থী ব্লক গঠনের ব্যর্থতার জন্যে প্রধানত কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল ফ্রন্ট দায়ী।

বর্তমান দলগুলি বামপন্থী স্বার্থকে রক্ষা করতে পারল না কেন এবং কেনই বা একটি নতুন সংগঠনের প্রয়োজন হল? এর উত্তর হল, যে কোনও কারণেই হোক বামপন্থী দলে যাদের যোগ দেওয়া উচিত ছিল এবং সেখানে যাদের নিয়ে আসা যেত তাদের সবাইকে বর্তমান দলগুলি ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। হয়তো তারা সমাজতন্ত্রবাদ প্রচারে বেশি ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সেটা হল ভবিষ্যতের ব্যাপার। আশু কর্তব্য ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্টকে আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে আরও তীব্রতর করা। দক্ষিণপন্থী সংহতির বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রদেশে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি কংগ্রেসের এগিয়ে যাওয়ার মনোভাবটি অনেক কংগ্রেস কর্মী বেশ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করে থাকেন। অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্টকে আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী করতে তারা স্বভাবতই তখন বেশি আগ্রহী। এসব মানুষের সহায়তায় দক্ষিণপন্থী আক্রমণকে প্রতিহত করা এবং কংগ্রেসে বামপন্থী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা যেত। এজন্যে স্থির করা হয়েছিল বামপন্থী ব্লকের কর্মসূচী হবে ন্যূনতম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কর্মসূচী, যার ভিত্তিতে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করে দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যাবে।

ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠার সময়ে আমাদেরও ওই একই উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের আশু কর্তব্য ছিল নিয়মতান্ত্রিকতার পথে কংগ্রেসের এগিয়ে যাওয়াকে বাধা দেওয়া, কংগ্রেসকে আবার একটা বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, জাতীয় সংগ্রামের পথে তাকে ফিরিয়ে আনা এবং আসন্ন যুদ্ধজনিত সঙ্কটের জন্যে দেশকে তৈরি করা।

ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু প্রথমে যেমন ভাবা হয়েছিল, অন্য দলগুলিকে একত্র করে একটি মঞ্চে আনতে তা সক্ষম হয়নি। তার অর্থ কি এই যে বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার কোনও আশা নেই? না, এর অর্থ হল অন্য কোনও উপায়ে বামপন্থী সংহতি গড়ে তুলতে হবে।

বামপন্থা বলতে আসলে কি বোঝায় সে বিষয়ে দু’-একটি কথা বলা দরকার। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যখন নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করছে তখন আমরা কীভাবে স্থির করব কে আসল বামপন্থী এবং কে তা নয়?

ভারতীয় জীবনের বর্তমান রাজনৈতিক পর্বে বামপন্থা বলতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা বোঝায়। রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা (মহাত্মা গান্ধীর বর্ণিত ‘স্বাধীনতার সারবস্তু’ নয়) এবং স্বাধীনতা লাভের উপায় হিসাবে আপসহীন জাতীয় সংগ্রামে যিনি বিশ্বাস করেন তিনিই প্রকৃত বামপন্থী। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর বামপন্থা বলতে বোঝাবে সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর জাতীয় জীবনের পুনর্গঠন হবে জনগণের কর্তব্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের আগে সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন কোনমতেই সম্ভব নয়।

প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের অর্থাৎ বামপন্থীদের সব সময়ে দুটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে হয়। ভারতেও তেমনি তাদের একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার ভারতীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করার জন্যে দুর্বল জাতীয়তাবাদীদের অর্থাৎ দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের শুধু বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের চেনা দালালদের হাতে নয়, তাদের দক্ষিণপন্থী বন্ধুদের হাতেও নিগৃহীত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সময়ে সময়ে কোন নির্যাতন বেশি কঠোর এবং মারাত্মক তা বলা কঠিন। তবে বর্তমান ভারতের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ওপর নির্যাতন করার ব্যাপারে দক্ষিণপন্থীরা যে কোনও রকম নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধা করবেন না। তার কারণ তাঁরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন এবং সমস্ত বিরোধিতাকে দমন করে ভবিষ্যতে সেই ক্ষমতাকে একচেটিয়াভাবে নিজেদের অধিকারে রাখার জন্যে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

একই সঙ্গে দু’টি রণাঙ্গনে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং উল্লিখিত দু’-রকম নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা একই সময়ে এক ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে পারেন, দু’ ধরনের নির্যাতন নয়। আবার অনেকে আছেন যাঁরা বিদেশী সরকারের নির্যাতন সহ্য করতে পারেন কিন্তু দক্ষিণপন্থী বন্ধুদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে ভয়ে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু যদি আমরা প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হই এবং সে হিসাবে কাজ করতে চাই তাহলে একসঙ্গে দু’টি রণাঙ্গনে লড়াই চালানো এবং সবরকম নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস আমাদের সঞ্চয় করতে হবে।

ভারতে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের দেখা হয় যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দেন এবং বড় বড় কথা বলেন। সমাজতন্ত্রের কথাও বলেন। কিন্তু সংগ্রামের মুখোমুখি হলে এঁরা দায়িত্ব এড়িয়ে যান এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা যুক্তি বানিয়ে বলেন। এঁরা হলেন ছদ্ম-বামপন্থী, যাঁরা এমনই কাপুরুষ যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে এঁরা বলেন যে উইনস্টন চার্চিল (যাঁকে আমরা কঠোর সাম্রাজ্যবাদী বলে জানি) এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। কারণ ব্রিটিশ সরকার নাৎসী ও ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে বলে ব্রিটিশ সরকারকে বিপ্লবী শক্তি বলা এই ছদ্ম-বামপন্থীদের একটা ফ্যাশন। কিন্তু এঁরা সুবিধেমত ভুলে যান ব্রিটেনের এই যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী দিকটির কথা এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপ্লবী শক্তি সোভিয়েট ইউনিয়ন নাৎসী সরকারের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে আবদ্ধ।

যাঁরা সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত কিন্তু দক্ষিণ পন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে চান তাঁরা এক পৃথক অজুহাতের দোহাই দেন। ঐক্যরক্ষার জন্যে অজুহাতে তাঁরা নিজেদের দুর্বলতা গোপন করেন। এরকম একটা সুন্দর অজুহাত আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। সকলেরই দু’ ধরনের ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য করা উচিত— কাজ করার জন্যে ঐক্য আর কাজ না করার জন্যে ঐক্য। একথা কারোর কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে একজন প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আর যাঁরা তা নন তাঁদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠা অসম্ভব। সকল অবস্থায় ঐক্য যদি আমাদের লক্ষ্য হয় তাহলে কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে কংগ্রেসের বাইরে যাঁরা আছেন কিংবা যাঁরা কংগ্রেসের বিরোধী তাঁদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা হবে না কেন? একটা সীমার পর ঐক্যের অজুহাত দেখানো ঠিক হবে না। ঐক্য নিশ্চয়ই কাম্য কিন্তু তার জন্যে আদর্শ ও নীতির মধ্যে মিল থাকা চাই। যে ঐক্যের জন্যে নিজের আদর্শ বা বিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে হয় তার কোনও মূল্য নেই এবং তা অকর্মণ্যতা সৃষ্টি করে। আর প্রকৃত ঐক্য সব সময়েই শক্তির উৎস এবং কাজে প্রেরণা দেয়। ঐক্যের অজুহাতে দক্ষিণপন্থীদের সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এইসব মতামতের বিচারে সহজেই স্থির করা যাবে কে প্রকৃত বামপন্থী এবং কে তা নন এবং তার কাজ এবং আচরণের দ্বারা ফরওয়ার্ড ব্লক নিজেকে একটি প্রকৃত বামপন্থী সংগঠন হিসাবে প্রমাণ করতে পেরেছে কি না।

এখন প্রশ্ন হল, শেষপর্যন্ত কীভাবে বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলা যেতে পারে। আমরা দেখেছি বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার জন্যে তিনটি সম্ভাব্য পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এও জানি যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দল নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করে থাকেন। তাহলে ভবিষ্যতে কীভাবে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠবে?

এ প্রশ্নের উত্তর হল, ইতিহাস একদিন কারা প্রকৃত বামপন্থী তা স্থির করে দেবে। ইতিহাস একদিন শস্য থেকে ভুষিকে অর্থাৎ, প্রকৃত বামপন্থী থেকে ছদ্ম-বামপন্থীদের পৃথক করে দেবে। এরকম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ার পর যাঁরা প্রকৃত বামপন্থী তাঁরা সবাই একত্রিত হবেন এবং তাঁদের মধ্যে মিলন ঘটবে। এই রকম স্বাভাবিক বা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলা যাবে। এ জন্যে দু’টি ফ্রন্টে সংগ্রাম চালানোর অগ্নি-পরীক্ষা একান্ত প্রয়োজন। এই পরীক্ষায় যাঁরা উত্তীর্ণ হবেন তাঁরাই প্রকৃত বামপন্থী এবং তাঁরা সবাই যথাসময়ে একত্রিত হবেন।

ভারতীয়রা একটি সজীব জাতি এবং তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের মৃত্যু হতে পারে না। দক্ষিণপন্থীদের যেহেতু জড়ত্ব গ্রাস করেছে সেজন্যে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে ঐতিহাসিক কারণে একটি বড় ধরনের বামপন্থী আন্দোলন প্রয়োজন। সংঘর্ষ দেখা দিতে বাধ্য, কিন্তু তা অল্পকালের জন্যে। শেষপর্যন্ত দেশের সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপরে বামপন্থী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

ফরওয়ার্ড ব্লক তার জন্ম থেকে বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর কাজকর্মের ফলে কিষাণ সভার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য বামপন্থী শক্তিও দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে বামপন্থী সংহতি গড়ে তোলার জন্যে অধিকাংশ কৃতিত্ব পাবে ফরওয়ার্ড ব্লক। একই সঙ্গে দু’টি ফ্রন্টে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় দক্ষিণপন্থীদের নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রমাণ করেছে যে, তা একটি প্রকৃত বামপন্থী সংগঠন। যেখানে অন্য দলগুলি ব্যর্থ হয়েছে, ফরওয়ার্ড ব্লক সেখানে সফল হয়েছে।

দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে গান্ধীপন্থীদের যে সম্পর্ক, ঠিক তেমনি সম্পর্ক বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লকের। দর্শনের ভাষায় বলা যায় দ্বিতীয়টি হল প্রথমটির ‘প্রতিক্রিয়া’। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্ট ফরওয়ার্ড ব্লক সব সময়েই গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে গভীর ও মৌল পার্থক্য রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে শেষপর্যন্ত একটা আপস করার কথা গান্ধীবাদ বিবেচনা করে থাকে। তার কারণ আপস মীমাংসাই হল গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের (অথবা আইন অমান্যের) পরিণতি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লক কোনরকম সম্পর্ক রাখবে না। সামাজিক দিক থেকে দেখা যায় গান্ধীবাদের সঙ্গে ধনী (‘haves’) অথাৎ কায়েমী স্বার্থের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অনিবার্য কারণে দরিদ্ররা (‘have-nots’) আজ শ্রেণী-সচেতন হয়ে ওঠায় গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। তাই দেখা যায় কুড়ি বছর আগের তুলনায় আজ অবস্থা অনেক বদলে গেছে। আজ গান্ধীবাদ বিপুল সংখ্যক কৃষক, কারখানার শ্রমিক কিংবা মধ্যবিত্ত যুব সমাজ ও ছাত্রদের, যাদের অধিকাংশই ছিলেন দারিদ্র-পীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, আর আকৃষ্ট করতে পারছে না। বিপ্লবোত্তর পুনর্গঠন সম্পর্কে গান্ধীবাদী পরিকল্পনা, যা অংশত মধ্যযুগীয় এবং অংশত সমাজতন্ত্রবিরোধী, ফরওয়ার্ড ব্লকের পরিকল্পনার বিপরীত। ফরওয়ার্ড ব্লকের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির এবং তার লক্ষ্য হল সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন।

১৯৩৯ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফরওয়ার্ড ব্লকের আদর্শ ও কর্মসূচীর প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় ছাড়া তার মূলনীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। সেই বিষয়টি হল, ১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সম্মেলনে এই সংগঠনকে দল (Party) বলে ঘোষণা করা হয়। পূর্বের মতো আজও তা স্বাধীনতার লাভের জন্যে আপসহীন জাতীয় সংগ্রামে বিশ্বাসী এবং বিপ্লবোত্তর কালে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন হল এর লক্ষ্য।

ফরওয়ার্ড ব্লক এ পর্যন্ত কী সাফল্য লাভ করেছে এবং ভবিষ্যতে এর কী সম্ভাবনা আছে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অপ্রাসঙ্গিক নয়। অত্যুক্তি বা আত্মপ্রশংসা না করে আমরা এই দাবিগুলি করতে পারি:

(১) দক্ষিণপন্থীদের কাজের ফলে কংগ্রেস যেভাবে শক্তিহীন ও মৃতকল্প হয়ে পড়েছিল, বামপন্থী শক্তি গড়ে তুলে ফরওয়ার্ড ব্লক তা থেকে কংগ্রেসকে রক্ষা করেছে। এভাবেই সে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা অনেকটাই পালন করতে পেরেছে।

(২) নিয়মতান্ত্রিকতার দিকে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে, জনগণের মধ্যে নতুন বিপ্লবী মনোভাব সৃষ্টি করতে এবং কংগ্রেসকে আবার সংগ্রামের পথে, তা সে যতই অল্পমাত্রায় হোক না, ফিরিয়ে আনতে ফরওয়ার্ড ব্লক সফল হয়েছে। আজ আর কেউ একথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে রামগড়ে অনুষ্ঠিত আপসবিরোধী সম্মেলনের আগে ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে যে প্রচার এবং সম্মেলনের পরে যে কাজ করা হয় তারই ফলে মহাত্মা গান্ধী ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

(৩) যুদ্ধ সম্পর্কে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

(৪) ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রচার এবং কাজকর্মের ফলে যুদ্ধ সম্পর্কে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে নীতি গ্রহণ করা হয়, তা বর্জন করে, ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ সম্পর্কে যে নীতির কথা কংগ্রেসের তরফে বলা হয়েছিল সেই নীতি আবার মানতে কংগ্রেস ও মহাত্মা গান্ধী বাধ্য হন।

(৫) বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে ফরওয়ার্ড ব্লক যেসব কারণে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি বিচার-বিশ্লেষণ করেছে এবং কংগ্রেসের ভাবগত ও আদর্শগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে শক্তি সঞ্চার করেছে।

(৬) কোনও ব্যক্তি বা দল যাতে কোনও ব্যাপারে, বিশেষ করে যুদ্ধ-সঙ্কট এবং জাতীয় সংগ্রামের মতো বড় ব্যাপারে পিছু হটে না আসে সেজন্যে কংগ্রেস ও দেশবাসীকে সাবধান করে দেবার উদ্দেশ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক সতর্ক-প্রহরীর ন্যায় কাজ করে যাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়:

(১) ভবিষ্যতে কংগ্রেসের অগ্রগতি যাতে নির্বিঘ্ন হতে পারে তার জন্যে ফরওয়ার্ড ব্লক যথাসময়ে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হবে।

(২) ফরওয়ার্ড ব্লক প্রমাণ করবে যে তা হল ভবিষ্যতের দল— যে দল জাতীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য লাভের জন্যে নেতৃত্ব দেবে এবং তারপর জাতীয় পুনর্গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ভারতের মাটি থেকে উদ্ভূত হওয়ায় এবং একই সঙ্গে পারিপার্শ্বিক ও বহির্জগতের যা কিছু শুভ ও কল্যাণকর তা গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকায় এই দল তার দ্বৈত ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। এই দল একদিকে জাতীয় সংগ্রামকে তার আকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে এবং অন্যদিকে স্বাধীনতা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে এক নতুন ভারত গড়ে তুলবে।

(৩) যথাযথ দায়িত্ব পালন করে এই দল জগৎসভায় ভারতকে আবার তার যোগ্য এবং ন্যায়সঙ্গত আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে।

(৪) মানুষের প্রগতি আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার সীমানা ছাড়িয়ে আরও কয়েক ধাপ তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ভারত যাতে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্যে এই দল চেষ্টা করবে।

যে সমস্ত চিন্তাভাবনা আজ ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যদের মনে সবকিছুর আগে জেগে রয়েছে সেগুলি সংক্ষেপে হল:

ফরওয়ার্ড ব্লক চায়

(১) পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা এবং তা অর্জনের জন্যে আপসহীন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম।

(২) সম্পূর্ণ আধুনিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

(৩) দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাপক শিল্প-উৎপাদন।

(৪) উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় সামাজিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ।

(৫) ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।

(৬) প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে সমান অধিকার।

(৭) ভারতীয় সমাজের সকল শ্রেণীর জন্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা।

(৮) স্বাধীন ভারতে এক নতুন বিধান (New Order) গড়ে তোলার জন্যে সাম্য ও ন্যায়বিচার নীতির প্রয়োগ।

ফরওয়ার্ড ব্লক একটি বিপ্লবী এবং গতিশীল সংগঠন। এ কারণে এই দল কতকগুলি নীতি বা মামুলি নীতিকথা রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে লেখা বিষয়ের কথা বলে না। এই দল বহির্জগত থেকে জ্ঞান লাভ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করতে আগ্রহী। এই দল মনে করে যে প্রগতি বা বিবর্তন একটি চিরন্তন ধারা এবং এক্ষেত্রে ভারতের অনেক কিছু দেওয়ার আছে।

ফরওয়ার্ড ব্লকের ভবিষ্যৎ কর্মধারা সম্পর্কে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে, ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এর জন্ম হয়েছে এবং এর মৃত্যু ঘটবে না। যদি এর অস্তিত্বের কোনও দার্শনিক যৌক্তিকতা থাকে তাহলে এই দল নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবে। যদি এই দল ভারতের স্বার্থ, মানবতা এবং মানুষের প্রগতির জন্যে কাজ করতে পারে তাহলে সে বেঁচে থাকবে ও বিকাশ লাভ করবে এবং পৃথিবীর কোনও শক্তি তাকে ধ্বংস করতে পারবে না।

সেজন্যে এগিয়ে চলুন, হে আমার দেশবাসী, আরও এগিয়ে চলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *