ফতেপুর সিক্রি – ৫

৫.

পৃথ্বীরাজ রাঠোরের গৃহে রানীর স্বহস্ত-রচিত কোমল শয্যায় শুয়েও একমুহূর্তের জন্য ঘুমোতে পারল না জিৎ। সারারাত ধরে সে শুধু ছটফট করল।

রানীর চিন্তা তার মস্তিষ্ক থেকে সরে গেছল তখন। পরিবর্তে অন্য একটি চিন্তা তাকে চেপে ধরেছিল। যখন তার চোখের দু’পাতা বন্ধ হয়েছে, তখনি তার সামনে ভেসে উঠছে পাগড়ী-পরা একটি কিশোরের মুখ। কিশোর পাগড়ী খুলে ফেলে দিলে হয়ে যায় লীলাবতী।

লীলাবতী সিক্রিতে কেন ফিরে এল? সে কি উদয়পুরে যায়নি? বলবার মতো অবস্থা বা সময় তখন ছিল না। সব কথা জানতে হলে আগামী কালের সুদীর্ঘ দিবসের প্রহরগুলি কাটিয়ে গভীর রাত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন লীলাবতী স্তব্ধ সরাইখানার সেই কোণের ঘরটি ছেড়ে আস্তে পা টিপে বেরিয়ে আসবে। তারপর খুব সবাধানে এসে প্রবেশ করবে তার ঘরে।

আজই রাতে সে জিৎ সিং-এর ঘরে আসবে বলেছিল। কিন্তু সম্ভব ছিল না। যে-রানী এখন নিজের ঘরে নিজের শয্যায় নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে, সেই রানীর দেহখানা এতক্ষণে ছুরিকা-বিদ্ধ অবস্থায় অথবা আফিমের বিষে নীল হয়ে পড়ে থাকত কোথাও। তাই আজ এতদিন পরে এমন বিস্ময়কর পরিস্থিতির মধ্যেও লীলাবতীর সঙ্গে নির্জনে সাক্ষাৎ করার লোভ তাকে সামলে নিতে হয়েছিল। এ বড় সামান্য কথা নয়।

রাত শেষ হয়। ভোরের পাখি জেগে ওঠে একটি একটি ক’রে। আর একটু বেলা হবার অপেক্ষায় শুয়ে থাকে জিৎ সিং। রাতের বেলা লীলার সঙ্গে দেখা করবার আগে তার একটি বিরাট কর্তব্য রয়েছে। ইখতিয়ার-উল-মুখকে পত্র দিতে হবে। সেই পত্র নিয়ে সন্ধ্যার পর উধমের দলের অশ্বারোহী দূত ধাবিত হবে গুজরাট অভিমুখে।

অবশেষে শয্যা ছাড়ে জিৎ। বাইরে বের হয়ে আসে। উধমের ঘরের দিকে যায় সে। গিয়ে দেখে তখনো ঘুমিয়ে রয়েছে উধম। তাকে জাগাবার চেষ্টা করে না জিৎ। আস্তে আস্তে রাস্তায় যায়।

রাস্তায় এসেই দেখে মাধব দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে। এত ভোরে তাকে দেখবে আশা করেনি। যাচ্ছে কোথায় সে? অত ব্যস্তই বা কেন? সে মাধবকে ডাকে। রীতিমতো চমকে ওঠে সে।

—কোথায় যাচ্ছ মাধব?

—আপনাকেই তো খুঁজতে বের হয়েছি। কাল রাতে সরাইখানায় ফেরেননি দেখে ভাবনা হয়েছিল। তাই ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়েছি।

—বাদশাহী মহলের দিকে কেন যাচ্ছ? সেখানেই আমি থাকব আশা করেছিলে?

একটু ঘাবড়ে যায় মাধব। তারপর বলে,—সব দিকেই দেখব ভেবেছিলাম।

—চল। খুঁজে তো পেলে। এবারে সরাইখানায় চল।

মাধব ইতস্তত করে বলে,—একবার যখন বাইরে এসেছি, একটু ঘুরে আসি। এখুনি ফিরব।

জিৎ সিং মাধবের চোখের দিকে চেয়ে বলে, —সত্যি কথা বল তো মাধব, চাকরির ব্যাপারে যাচ্ছো না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। নওরোজের ব্যাপার তো কয়েকদিনের মধ্যেই মিটবে। তাই ভাবলাম, এবারে ভালোভাবে চেষ্টা করবে।

—বেশি দেরি করো না।

—এখুনি চলে আসব।

—কালকে সব ঠিকভাবে চলেছিল তো? কারও কোনো অসুবিধে হয়েনি?

—না।

—সেই ছেলেটির কি খবর?

—কাল আবার পেছু নিয়েছিল। ওকে রাখা চলবে না।

—আমি আজই ব্যবস্থা করব।

মাধবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,—ওকে তাড়িয়ে দেবেন?

—নিশ্চয়ই।

সরাইখানায় ফিরে প্রথমেই স্নান সেরে নেয় জিৎ সিং।

শরীর শীতল হয় জিৎ সিং-এর। সে নিজের ঘরে এসে বসে। তারপর ইখতিয়ারের কাছে পত্র লিখতে শুরু করে। প্রথমে ভেবেছিল দুপুরবেলা লিখবে। কিন্তু দুপুরে হয়তো ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে। অনেকদিনের ঘুম একসঙ্গে জমা হয়েছে। আজকের দিনে সুযোগ বুঝে তারা চেপে ধরবে।

পত্রটির গুরুত্ব অনেকখানি। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে মেবারের মঙ্গল। এটিকে যদি ইখতিয়ার কিংবা মীর্জা অবহেলা ক’রে বসে, তবে অনেক দুঃখ আর দুর্দশা সইতে হবে রানা প্রতাপ সিংহকে।

একটির পর একটি অক্ষর বসায় জিৎ সিং। প্রতিটি পংক্তি লিখে বার বার ক’রে পড়ে। তারপর দ্বিতীয় পংক্তি শুরু করে। কোথাও এতটুকু ফাঁক, যুক্তির এতটুকু অসারতা যাতে প্রকাশ না পায়, তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে।

অর্ধেক লেখা না হতেই বাইরে পদশব্দ শোনে। তাড়াতাড়ি শয্যার নিচে পত্রটি রাখে সে। তারপর মুখ তুলে দেখে মাধব এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভেতরে।

মাধব আড়চোখে শয্যার দিকে চেয়ে বলে,—কিছুই হল না।

বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে জিৎ বলে,–সে কথা এখন না বললেও চলত। মাধব আর একবার শয্যার দিকে চেয়ে বলে,—ভাবলাম আপনি হয়তো শুনতে চাইবেন।

—যাও।

মাধব তাড়াতাড়ি চলে যায়।

রাগে জিৎ সিং-এর গা-জ্বালা করে। রাগ হয় তার নিজের ওপরই। কপাট বন্ধ ক’রে দিয়ে লিখতে পারত সে। তাহলে এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হত না। যতই বিশ্বস্ত হোক না কেন মাধব এ জাতীয় পত্র গোপনেই লেখা উচিত।

আবার লিখতে শুরু করে জিৎ, কপাট খুলে রেখেই লিখে যায়। কারণ এরপর কপাট বন্ধ করলে অনর্থক মাধবের কৌতূহলকে উসকে দেওয়া হবে। মানুষ একবার কৌতূহলী হয়ে উঠলে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। বিশেষত মাধবের মতো ছেলে, যে এককালে আগ্রায় বিখ্যাত রহিমবক্সের সঙ্গে পরিচিত ছিল, যে এখন বাদশাহী মহলের প্রধান দরওয়াজা দিয়ে নির্বিকারভাবে ভেতরে প্রবেশ করে। বয়সে কম হলেও ওর বুদ্ধি পরিণত। অনেক অধিক বয়সের মানুষের চেয়েও বেশি পরিণত।

ঘরের বাইরে আবার কে যেন এসে দাঁড়ায়। তাকে সোজাসুজি দেখতে না পেলেও তার ছায়া কপাটের ওপাশে নড়ে ওঠে। জিৎ সিং পা টিপে টিপে গিয়ে দেখে মাধব এক মুঠো ধানের কুঁড়ো নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে বুনো পায়রাদের সামনের। জিৎকে দেখে সে হাসে।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে একটু দূরে আড়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিরস্ত্রাণ মাথায় লীলা। তাকে দেখে লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করেনি বলেই জিৎ দেখতে পায়।

বুনো পায়রার দল কুড়োগুলো শেষ করে উড়ে যায়। মাধব চলে যায় রান্নাঘরে।

জিৎ সিং নিজের ঘরে ঢোকে। লীলা সঙ্গে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করে না। সে ঘরে এসে প্রথমে পত্রটি লেখা শেষ করে। সেটিকে শয্যার ভাঁজে রেখে কপাট বন্ধ ক’রে লীলার ঘরের সামনে গিয়ে ধাক্কা দেয়। কপাট খুলে যায়।

—তুমি মাধবের পেছনে দাঁড়িয়ে কি করছিলে লীলা?

ফিসফিস ক’রে লীলা বলে,—ওকে আমার ভালোবোধ হয় না। কেমনভাবে যেন তাকায়। চলবার ভঙ্গিও সহজ নয়। তাই সুযোগ পেলে ওকে অনুসরণ করি।

—তুমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ।

—হয়তো তাই। কিন্তু ওসব কথা থাক। তোমার বোনের কথা বল।

—নিরাপদে রয়েছে।

—যাক, তোমার দুশ্চিন্তা দেখে আমিও সুস্থির হতে পারছিলাম না।

—তার কী বিপদ ঘটতে বসেছিল, তুমি জান?

—না। তবে সাংঘাতিক কিছু বলে বুঝতে পেরেছিলাম।

জিৎ সিং সংক্ষেপে মীনাবাজারের ঘটনার কথা জানায় তাকে।

লীলা একটু চুপ করে থেকে বলে,–তোমার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবেন রানী।

লীলা আরও কিছু বলতে চাইছিল। সেইসময় তার ঘরের সামনে মাধবের উদয় হয়।

জিৎ সিং হঠাৎ চিৎকার ক’রে ওঠে,–আমার লোকজনের পেছনে এখনো তুমি ঘুরছ বলে শুনেছি। তোমার আর এখানে থাকা চলবে না।

লীলা কণ্ঠস্বর মুহূর্তে পরিবর্তিত ক’রে বলে,—মাধব বলেছে তো? ও আমায় তাড়াতে চায়। সত্যি বলছি, একবারও আমি ওর পেছনে ঘুরিনি। ও আমার সঙ্গে ভাব করতে চায় না। শুধু শুধু কেন ওর পেছনে ঘুরব?

মাধব ছুটে ভেতরে এসে বলে,—মিথ্যে কথা, ও মিথ্যে কথা বলছে।

জিৎ সিং তাড়াতাড়ি বলে,—আমি জানি, ও মিথ্যে কথা বলছে। আমি আর ভুলছি না। আজই তোমার সরাইখানায় শেষ দিন। কাল সকালে উঠে পথ দেখতে হবে।

লীলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,– আমায় তাড়িয়ে দেবে?

—হ্যাঁ দেব।

—এবারের মতো ক্ষমা কর।

—বার বার ক্ষমা করা যায় না, তুমি নির্লজ্জ। তবে মাধব ক্ষমা করলে আমি এখানে থাকতে দিতে রাজি আছি।

মাধব চেঁচিয়ে ওঠে,—কখনই ওকে ক্ষমা করি না আমি। ও চলে যাক।

লীলাবতী দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। জিৎ সিং তার অভিনয় দেখে বিস্মিত হয়। গুণের অন্ত নেই লীলার। কিন্তু আগামীকাল সরাইখানা ছেড়ে যাবে কোথায় সে? রানীর গৃহে রাখা চলতে পারে সাময়িকভাবে। রানী এখনো জানে না, লীলা রয়েছে এখানে। তবে উধম জানে। রানীকে বিকেলে গিয়ে বলতে হবে। সে নিশ্চয় আপত্তি করবে না।

.

রানী লীলার কথা শুনে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। সে বার বার করে বলে দেয়, সিক্রিতে যতদিন থাকবে লীলাবতী, ততদিন তার বাড়িতে থাকবে। এমন কি লীলার যদি ইচ্ছে হয়, সারাজীবনই তার কাছে কাটাতে পারে। অমন একজন সঙ্গী পাওয়া মহা সৌভাগ্যের বলে মনে করে রানী।

জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়। মাধবের সামনে আগামীকাল সকালে শিরস্ত্রাণপরা ছেলেটিকে হাত ধরে হিড়-হিড় ক’রে বাইরে বের করে দেবে সে। অদূরে অপেক্ষা করবে উধম। সে-ই লীলাকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে আসবে পৃথ্বীরাজের গৃহে।

সব ঠিক ক’রে সে সরাইখানায় ফেরার জন্যে রাস্তার কাছে আসে। উধম ফটক অবধি তার সঙ্গে এসে বলে,—ইখতিয়ারকে লেখা পত্রটি সঙ্গে নিয়ে এলে পারতে। এখনি পাঠিয়ে দিতাম। অশ্বারোহী প্রস্তুত।

—প্রথমে সঙ্গে আনব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার পরেই মনে হল, সেটা ঠিক নিরাপদ হবে না। তাই রেখে এসেছি।

উধমকে ফটকের সামনে রেখে জিৎ সিং হাল্কা মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সরাইখানার পথ ধরে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সে শুনতে পায়, ম্যায় ভুখা হুঁ।

চমকে ওঠে জিৎ সিং।

চেয়ে দেখতে পায় একজন ছিন্নবসন অন্ধ ভিখারী একটি ভাঙা পাত্র হাতে নিয়ে অতি ধীরে ধীরে পথ চলছে। পথিকরা যতি দয়া ক’রে সেই পাত্রে কিছু খাদ্য খেতে দেয়, তবেই তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে। সে ক্ষুধার্ত। সত্যিই সে ক্ষুধার্ত। তার চলায় তার ভঙ্গীতে ক্ষুধার্তের ছাপ স্পষ্ট।

জিৎ সিং এগিয়ে গিয়ে তার ভাঙা পাত্রে পয়সা ফেলে দেয়।

অন্ধ এক হাত অতিকষ্টে ওপর দিকে তুলে বলে,—খোদা তোমার মঙ্গল করুন।

তার আশীর্বাদ জিৎ সিংকে পুলকিত করে।

সামনেই সরাইখানা। জিৎ সিং ভাবে, অন্ধটিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু খাবার দেওয়া যেতে পারে। সে পিছন ফিরে চায়। কিন্তু অন্ধ নেই। সে অদৃশ্য হয়েছে।

উত্তেজিত জিৎ সিং অনেকটা ছুটে যায়। খুঁজে পায় না অন্ধকে।

আপনমনে হেসে ওঠে সে। বাদশাহ্ এবারও তাকে ফাঁকি দিয়ে গেলেন।

দ্রুত সরাইখানায় ঢুকতে গিয়েই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে লীলা। লীলার মাথার চুল লুটিয়ে পড়েছে নিচে। শিরস্ত্রাণ নেই। তার চোখমুখ লাল।

—কি হয়েছে লীলা? মাধব কোথায়?

—তোমার ঘরে।

—আমার ঘরে? সেখানে কি করছে?

—চল।

লীলা এগিয়ে যায়। জিৎ তাকে অনুসরণ করে।

—সে তোমায় চিনে ফেলেছে লীলা?

—চিনলেও ক্ষতি নেই আর।

উৎকণ্ঠিত জিৎ, তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

মেঝের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সামন রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে রয়েছে মাধব। তার বুকে লীলার সেই বহু বিখ্যাত ছোরা বিঁধে রয়েছে।

—এ কী করেছ লীলা? মাধবকে হত্যা করলে শেষে?

—হ্যাঁ। তবু দুঃখ থেকে গেল, শেষ রক্ষা করতে পারলাম না।

—তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

একটি পত্র লিখছিলে তুমি আজকে আমি লুকিয়ে দেখেছি।

রুদ্ধশ্বাসে জিৎ বলে,—হ্যাঁ।

—মাধব সেটিকে চুরি ক’রে রাস্তায় একজন লোককে ছুঁড়ে দিয়েছে।

—কোন্ লোককে?

—একজন অন্ধ ভিখারীকে। কিন্তু পত্রটি পড়তে দেখেই সেই অন্ধ সেটিকে কুড়িয়ে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করে। অন্ধত্বের কোনো লক্ষণই তখন আর ছিল না তার মধ্যে।

—বাদশাহ্।

—কি বললে জিৎ?

—বাদশাহ্ পেয়েছেন সেই পত্র। ওই ভিখারী স্বয়ং বাদশাহ।

—এতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে জিৎ?

ধীর স্বরে জিৎ বলে,—হ্যাঁ। চূড়ান্ত ক্ষতি। এই মুহূর্তে সিক্রি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে, জীবনের আশা নেই। তবু শেষ চেষ্টা ক’রে দেখব।

—তুমি বলছ কি জি?

—চল লীলা। তোমায় পৃথ্বীরাজের গৃহে পৌঁছে দেব। সেখানে তোমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখান থেকে একটি ঘোড়া নিয়ে আমায় যেতে হবে। চল, আর দেরি করো না।

দুজনা রাস্তায় বের হয়ে ছুটতে থাকে। তারা জানে বাদশাহ্ তাঁর প্রাসাদে পৌঁছোবার পরই অসংখ্য অশ্বারোহী বের হয়ে আসবে সেখান থেকে। তারা চারদিক তোলপাড় ক’রে তুলবে, যতক্ষণ না জিৎ সিংকে খুঁজে পায়।

ছুটতে ছুটতে লীলা বলে,—আমার ছুরি এক মুহূর্ত দেরিতে গিয়ে বিঁধেছিল। নইলে এই পত্ৰও ঘরের মেঝেতে পড়ত মাধবের সঙ্গে।

—মাধবকে যে বাদশাহ্ নিজে বশ করেছেন ধারণা করতে পারিনি। মূর্খ বলে আমি ধারণা করতে পারিনি। নইলে নির্বিবাদে প্রাসাদে যাওয়া-আসা দেখেই ওকে আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল। চাকরির খোঁজে সে ওভাবে যাতায়াত করতে পারে না। আমি মূর্খ! মাধবকে আমি বিশ্বাস করতাম।

পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি পৌঁছতেই সোজা উধমের কাছে যায় জিৎ। তাকে সংক্ষেপে সব ঘটনা জানিয়ে বলে,—পত্রটি খোয়া গেলেও তোমার লোক পাঠিও উধম। তার মুখের কথাও বিশ্বাস করতে পারে ইখতিয়ার-উল-মুখ।

স্থির কণ্ঠে উধম বলে, —পাঠাবো।

—একটি ভালো দেখে ঘোড়া দাও আমায় উধম।

লীলাবতী বলে উঠে,–একটি নয়, দুটি।

—তুমি যাচ্ছ লীলা?

—যাবো না?

—না।

—সময় নষ্ট করো না জিৎ। আমি তোমার সঙ্গে যাব। একথা তুমি ভালোভাবেই জানতে

উধম অল্প সময়ের মধ্যেই দুটি অশ্ব প্রস্তুত করে সামনে এনে বলে,—তোমায় বিদায় দিতে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে জিৎ। কারণ জীবনে তোমার সঙ্গে দেখা হবার আর সম্ভাবনা নেই।

জিৎ সিং হেসে বলে—আমার মৃতদেহটি দেখলেও দেখতে পার।

—না, তাও দেখব না।

—ঠিক। আচ্ছা চলি উধম। রানীকে কি বলবে?

—বলব লীলাবতী মেয়েটিকে বিশেষ সুবিধের বলে মনে হল না। ভুলিয়ে ভুলিয়ে জিৎকে বোধহয় আবার উদয়পুরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

লীলাবতী খিলখিল করে হেসে ওঠে। জিও সে হাসিতে যোগ দেয়।

সন্ধ্যার অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে এসেছে তখন। ওরা দুজনা পৃথ্বীরাজ রাঠোরের গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলে।

ক্রমে সিক্রির রাজপথ ফুরিয়ে যায়। ওরা অসমতল প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ছুটতে থাকে। আঁধার আরও গভীর হয়। কোথাও কিছু দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় পশ্চাতে বহুদূরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মশালের আলো দিভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে। বাদশাহী অশ্বারোহীরা খুঁজতে বের হয়েছে তাদের।

—আরো একটু জোরে চালাতে পারবে লীলা।

অন্ধকারের মধ্যে লীলার জবাব আসে,—চেষ্টা করতে পারি।

—চেষ্টা করো।

জিৎ জানে অজানা অচেনা রাস্তায় ছুটে চলা খুবই মারাত্মক। তবু উপায় নেই। কারণ তার চেয়েও মারাত্মক কিছুর হাত থেকে বাঁচবার জন্যে এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।

ওরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যায়। মশালের আলো আর দেখা যায় না। হাঁপাতে হাঁপাতে লীলা বলে,—আমার মনে হয় জিৎ, রাতে ওরা আর খুঁজবে না। ওরা তো জানে না আমাদের সাথে ঘোড়া রয়েছে।

—কিছু বলা যায় না।

—মশালের আলো তো দেখতে পাচ্ছি না।

—মশাল নিভিয়ে দিয়ে চেষ্টা করতে পারে। আমি হলে অন্তত তাই করতাম।

—আমার ঘোড়া বড় ঘামছে।

—আমারটিও। উধম সেরা দুটি ঘোড়া দিয়েছে।

—উধম লোকটি ভয়ংকর রকমের ভালো জিৎ।

—সে আবার কেমন কথা হল?

—হ্যাঁ। ঠিক কথাই হল। ভয়ংকর রকমের ভালো লোক বড় একটা দেখা যায় না।

সামনে উঁচু জমি রয়েছে সম্ভবত। কারণ ঘোড়ার গতি একটু মন্থর হয়। দিনের আলো থাকলে, এই জমির পাশ কাটিয়ে তারা যেতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ফলে, ঘোড়া দুটি বেশি পরিশ্রান্ত হবে।

—আমরা কোথায় যাচ্ছি জিৎ?

—জানি না। তবে এইটুকু বলতে পারি, সিক্রি থেকে দূরে সরে আসছি। আর একথাও বলতে পারি, এইভাবে নাক বরাবর গেলে সামনে পাব যমুনা নদী।

—কি ক’রে বুঝতে পারছ জিৎ?

—ওই তারা দেখে।

—যাক্ নিশ্চিন্ত হলাম।

—কেন?

—তুমি সবই জান দেখছি।

এতক্ষণে এই প্রথম জিৎ সিং হেসে ওঠে হোহো ক’রে।

আরও কিছুদূরে গিয়ে জিৎ ঘোড়া থামায়। অন্ধকারের মধ্যে যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে নেয়। তারপর বলে,—এবারে আমরা আস্তে আস্তে যাব লীলা। ঘোড়াকে বিশ্রাম দিতে হবে। কালকের সারাদিন পড়ে রয়েছে।

—বেশ তো। ভালো কথা।

—হঠাৎ এত স্ফুর্তি হল কেন তোমার? কথাগুলো যেন আনন্দে নাচছে।

—নাচবে না? আমরা যে বিয়ে করে বাড়ি ফিরছি।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে সজোরে ধাক্কা দেয় কথাটা। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, –তোমার এই রসিকতা ঠিক উপভোগ করা গেল না।

—গেল না? আমি ভাবলাম বুঝি ঠিক শংকরীর রসিকতার মতোই উচ্চাঙ্গের হয়েছে আমার রসিকতা। তাই মনে মনে গর্ব হচ্ছিল।

—উদয়পুরে গিয়েছিলে?

—হ্যাঁ।

—ফিরে এলে কেন?

—এখনো বুঝছ না? তোমার জন্যে। শুধু তোমার জন্যে।

—ঠাট্টা নয়। সত্যি কথা বল।

লীলা তার ঘোড়াটিকে জিৎ সিং-এর একেবারে পাশে নিয়ে আসে। তার হাতের ওপর একটা হাত গাঢ়স্বরে বসে,—সত্যি কথাই বলছি জিৎ।

—কিন্তু কেন?

—তোমায় পাব বলে। আমি মস্ত ভুল করেছিলাম জিৎ। আমি ভুল না করলে চিরকাল তোমারই জন্যে অপেক্ষা করতাম। কিকা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। তোমার সেই ঘোড়াটি তাঁকে ফেরত দিতে গিয়ে প্রথম বুঝলাম, তোমার ওপর তিনি কতখানি নির্ভর করেন। তাঁর প্রথম সেনাপতির ওপরও অতটা নির্ভর তিনি করেন না। সেই মুহূর্তে আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম তুমি যা করছ তার তুলনা হয় না।

লীলাবতী হঠাৎ থেমে যায়। সে জিৎ-এর একখানি হাত নিজের গালের সঙ্গে বুলিয়ে নিয়ে বলে—ভগবান আমায় সৃষ্টি করেছেন তোমার জন্যে জিৎ। তোমাকে আনন্দ দেবার, তোমার সেবা করবার জন্যে একলিঙ্গ আমার দেহ-মন গড়ে ছিলেন। আমি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাম, তাই এত কষ্ট পেয়েছি।

অনেকক্ষণ পর জিৎ বলে,—উদয়পুরে ফিরে গিয়ে কোথায় থাকবে তুমি?

তোমার কাছে। তুমি আমায় গ্রহণ কর জিৎ। কিকা আমাদের এই মিলনে আগে থেকেই আশীর্বাদ ক’রে রেখেছেন।

—কিকা অনুমতি দিয়েছেন?

—হ্যাঁ জিৎ।

—কিন্তু তা কি সম্ভব?

লীলার কণ্ঠে বিষাদ মাখা স্বর ফুটে ওঠে। সে বলে,—তুমি রাজি না হলে অবশ্য কিছুই করতে পারি না আমি। তোমার রাজি না হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কথাটা আমার এর আগে

একবারও মাথায় আসেনি। আমায় ক্ষমা কর জিৎ।

—তুমি বিধবা বলে একথা ভাবছ লীলা?

—হ্যাঁ।

—আমি সেকথা ভাবছি না।

লীলার স্বরে আবার আগ্রহ ফুটে ওঠে,–কোন্ কথা তবে ভাবছ জিৎ?

—আমি ভাবছি সর্দার যশোবন্তকে দেবী যে কথা বলেছিলেন। আমাদের মিলন হবে না।

—ওকথা তুমি ভুলে যাও। যশোবন্ত নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিল।

—বেশ। ভুললে আমারই মঙ্গল।

তাদের কথা শেষ হবার আগেই অদূরে বন্দুক গর্জে ওঠে গুডুম।

লীলার ঘোড়াটি সামনের দু’পা একবার শূন্যের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে লীলা তৎপরতার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লাফায়

জিৎ সিং তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের পেছনে তুলে নিয়ে বলে,—আমাকে শক্ত ক’রে জড়িয়ে ধর।

দুজন সওয়ার নিয়ে অবশিষ্ট ঘোড়াটি আবার ছোটে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে শত্রুরা একেবারে কাছে এসে পড়েছে। সংখ্যায় তারা কতজন কে জানে?

বাদশাহ তাকে পালিয়ে যেতে দেবার জন্যে সখ করে এতগুলো অশ্বারোহী ছেড়ে দেননি। জীবিত অথবা মৃত, জিৎ সিংকে তাঁর চা-ই। কারণ পত্রটি পাঠ ক’রে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন জিৎ সিং ব্যক্তিটি কে। আরও বুঝেছেন সাধারণ গুপ্তচর সে নয়, অনেক উঁচুদরের, অনেকবেশি কৌশলী। জিৎ সিং জানে, এই মুহূর্তে কিকার চেয়েও তাকে পেলে তিনি খুশী হবেন। কিকার মৃতদেহের চেয়ে তার মৃতদেহ এখন বাদশাহের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। কারণ কিকা শুধু মেবারে যুদ্ধ করবেন। সারা হিন্দুস্থানকে মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলবার চেষ্টা করবেন না।

—লীলা!

—জি!

—তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?

—না। খুব ভালো লাগছে। আমি ভাবছিলাম জিৎ, ঘোড়াটা খোয়া গিয়ে বোধহয় ভালোই হল।

—তা ঠিক। তবে দুজনার ভার এই জীবটি কতক্ষণ বইতে পারবে জানি না।

—শত্রুরা এখনো কাছাকাছি আছে কি?

—হ্যাঁ লীলা। আমার ধারণা তারা আমাদের অনুসরণ করছে।

লীলাবতী আর কিছু বলে না। জিৎ সিং সামনের দিয়ে ঝুঁকে ঘোড়ার পিঠের ওপর মিশে থাকে। লীলাবতীর দেহও ঠিক তেমনিভাবে তার দেহর সঙ্গে মিশে থাকে।

—জিৎ।

—বল লীলা।

—আমাদের বাঁচতেই হবে জিৎ। নইলে আমার স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

—চেষ্টার ত্রুটি করব না।

লীলা যতটা সম্ভব ঝুঁকে পড়ে জিৎ-এর কানের কাছাকাছি মুখ এনে বল,—আমি কল্পনা ক’রে রেখেছি জিৎ, কীভাবে তোমার হাত ধরে আমার ঘরের ভেতরে নিয়ে যাব। নিজের হাতে তোমার পোশাক খুলে দেব। তোমায় হাওয়া করব। ওড়না দিয়ে তোমার ক্লান্ত মুখের ঘাম মুছে দেব। তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে হাসবে এসব দেখে, তাই না জিৎ?

—না লীলা।

—রাতে তোমার জন্যে সুন্দরভাবে শয্যা রচনা করব। তুমি শুয়ে পড়লে তোমার মাথায় অনেকক্ষণ ধরে হাত বুলিয়ে দেব, যতক্ষণ না তুমি আমার—

বন্দুক গর্জে ওঠে।

লীলার দেহ কেঁপে ওঠে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে আসে।

—তোমার লাগল লীলা?

অতি কষ্টে লীলা বলে, —হ্যাঁ জিৎ।

জিৎ সিং ব্যস্ত হয়ে ওঠে—কোথায়?

—তুমি থেমো না জিৎ। ছুটে চল। আমার জন্যে ভেবো না।

—তোমার বেশি লাগেনি তো?

—না। জোরে চল। আরও জোরে।

জিৎ পাগলের মতো ঘোড়া ছোটায়। এদের হাত থেকে লীলাকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? কতদূরে গেলে একটি নিরাপদ স্থান মিলবে, একটি আশ্রয় মিলবে? শুধু তেমন আশ্ৰয় পেলে লীলার ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করতে পারে সে। কতদূর?

লীলার হাত আলগা হয়ে আসে অশ্বের গতিতে। জিৎ সিং চেঁচিয়ে ওঠে,–চেপে ধর লীলা, শক্ত করে চেপে ধর।

লীলা ক্ষীণ চেষ্টা করে, পারে না। জিৎ সিং নিজেই লীলার হাত দুখানি একটি একটি ক’রে টেনে নিয়ে তার গলার সঙ্গে জড়িয়ে দেয়। কিন্তু একটু পরেই আবার শিথিল হয়ে যায় হাত দুখানি।

এইভাবে কতক্ষণ চলে খেয়াল থাকে না জিৎ সিং-এর। শেষে অন্ধকার আরও ফিকে হয়ে আসে। চারদিকে গাছপালা মাঠ প্রান্তর সবই একে একে তার দৃষ্টিগোচর হয়। সে দেখতে পায় ঠিক সামনেই বয়ে চলেছে যমুনা নদী।

যমুনার জল দেখে তৃষ্ণা পায় জিৎ-এর। সে চারিদিকে ভালোভাবে দেখে নেয়। শত্রুর কোনো চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে জিৎ।

যমুনার তীরে এসে ঘোড়া থামায়। লীলাবতীর চোখে মুখে জল দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে হবে। তার ক্ষতস্থানও দেখতে হবে। বন্দুকের গুলি কোথায় লেগেছে, দেখবার অবসর মেলেনি এ পর্যন্ত।

ঘোড়া লাগাম ছেড়ে দিয়ে লীলাবতীকে ভালোভাবে ধরে মাটিতে নামে জিৎ। নদীর তীরে শুইয়ে দেয়। তারপর লীলাবতীর মুখের দিকে ভালোভাবে চাইতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে জিৎ সিং। সমস্ত পৃথিবীও কেঁপে ওঠে তার সামনে। মাটি কাঁপে, গাছপালা কাঁপে, যমুনার জল কাঁপে। এই প্রথম প্রকৃত সত্য সে জানতে পারে—লীলাবতীর দেহ প্রাণশূন্য। এতক্ষণ সে লীলাবতীর শব বয়ে নিয়ে আসছিল।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরটা সহসা শীতল হয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত সে নড়তে পারে না। তারপর জোর ক’রে সে বসে পড়ে লীলাবতীর প্রাণহীন দেহের পাশে। তার ক্ষতস্থান পরখ করে। পৃষ্ঠদেশের সামান্য নিচে গুলি গিয়ে প্রবেশ করেছে। তাকে হয়তো বাঁচানো যেত। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে তাদের উভয়ের স্বপ্ন সার্থক হতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব হল না। আহত হবার পর এই দীর্ঘ পরিশ্রম আর ঝাঁকুনি তাকে বাঁচতে দিল না। সে নিজের দেহে গুলি নিয়ে জিৎ সিংকে বাঁচিয়ে রেখে গেল। জীবনের স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেল। সে চলে গেলে। রেখে গেল এক চিরদুঃখী পুরুষকে, বেঁচে থাকলে যে-পুরুষের হৃদয় আমৃত্যু কেঁদে চলবে।

যমুনার জলের দিকে চেয়ে জিৎ সিং আপন মনে বলে ওঠে,—এতদিনে সত্যিই আমি আমার শক্তিকে হারিয়ে ফেললাম লীলা। কই, উঠে দাঁড়াবার মতো বলও তো পাচ্ছি না।

কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। লীলার শেষকৃত্য তাকেই সমাধা করতে হবে। লীলাকে সে এইভাবে ফেলে রাখতে পারে না। মৃতের রক্তশূন্য মুখের দিকে চেয়ে জিৎ সিং উঠে দাঁড়াল।

যমুনার জলের ধারে নেমে যায় সে। কোষ থেকে তার দীর্ঘ তলোয়ারটি বের করে জলের কিনারায় নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করে। লীলাকে সে অজানার উদ্দেশে ভাসিয়ে দিতে পারে না। তাকে সযত্নে রেখে যাবে এইখানে। যদি কখনো সম্ভব হয়, আবার ফিরে আসবে সে। এসে চিতার অগ্নিতে সমর্পণ করবে তার দেহাবশেষ।

খনন শেষ হলে জিৎ সিং লীলাবতীর কাছে যায়। দেহটিকে সযত্নে তুলে নিয়ে ফিরে আসে সমাধিস্থানে। একটু পরেই তার সব চাইতে প্রিয় এই মুখখানি, এই দেহটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে চিরদিনের তরে। শত মাথা কুটলেও তখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে পাষাণী পৃথিবীর বুকের ওপর।

একদৃষ্টে লীলাবতীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে জিৎ সিং। তার খেয়াল থাকে না, অনুসরণকারীরা এতদূর অবধিও ধাওয়া করতে পারে। সে অনুভব করতে পারে না, দেরি হয়ে গেলে তার জীবনও শেষ হয়ে যেতে পারে। লীলাবতীর দেহের পাশে তার দেহও পড়ে থাকতে পারে এই যমুনারই কূলে।

অনেকক্ষণ পরে সে লীলাবতীর হাত দুখানি নিজের দুই হাতে তুলে নিয়ে অনুচ্চ অথচ সুদৃঢ়কণ্ঠে বলে,–আমি ছুটে চলব লীলা। তুমি আমায় শেষ আদেশ করে গেছ, না থামতে। আমি থামব না। আত্মহত্যার শত প্রলোভনেও আমি ভুলব না। বাবার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে একদিন যে-শপথ গ্রহণ করেছিলাম, সে-শপথ আমাকে আরাবল্লী থেকে আগ্রা অবধি টেনে এনেছিল। সেখান থেকে সিক্রি। আজ তোমার দেহ স্পর্শ করে জীবনে এই দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণ করছি আমি, গতিহীন হয়ে পড়ব না কখনো। মেবারের মঙ্গলের জন্যে এই গতি যদি আবার আমায় আগ্রা থেকে আরবল্লীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, আমি তাই যাব। তবে আমার একটি অনুরোধ আছে লীলা। আমার একটি কাজের জন্য আগে থেকেই তোমার কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। তুমি আমায় ক্ষমা করবে জানি। কিন্তু তুমি একা ক্ষমা করলে শুধু হবে না, স্বর্গে বাবার কাছ থেকেও আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। বাবার সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াবে তুমি তখন তোমার মুখ দেখে তিনি কঠোর হতে পারবেন না। তাঁর এই অযোগ্য পুত্রকে মার্জনা করবেন। আমি আমার নিত্য-সঙ্গী এই তলোয়ারটি তোমার পাশে রেখে যাবো লীলা। আমার সব চাইতে প্রিয় একটি জিনিস যখন আমায় ছেড়ে গেল, তখন অপরটিকেও আঁকড়ে রাখি কেন? তোমার সঙ্গেই থাক। আমি শূন্য হৃদয় আর শূন্য হাত নিয়ে নতুনভাবে শুরু করি আজ থেকে।

জিৎ সিং তার মুখখানাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনে লীলাবতীর মুখের ওপর। তারপর তার ললাটে এঁকে দেয় দীর্ঘ চুম্বনের রেখা।

মৃতদেহকে মাটির নিচে সযত্নে নামিয়ে দেয় জিৎ। কোষ সমেত তলোয়ারটি কোমর থেকে খুলে নিয়ে তার পাশে রেখে অবিচল হস্তে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে থাকে।

সূর্য তখন তার রক্তবর্ণ পরিত্যাগ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যমুনার জলে সেই উজ্জ্বলতার প্রতিচ্ছবি।

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *