ফতেপুর সিক্রি – ৪

৪.

পৃথ্বীরাজের বাড়ি পৌঁছে জিৎ দেখে উধম শকট প্রস্তুত করছে। একটু পরেই রানী যাত্রা করবে মীনাবাজারে। বাজারে গিয়ে তার চন্দন-কাঠের সামগ্রী নিয়ে দোকান আলো ক’রে বসবে। তারপর সন্ধ্যার পর একসময়ে আসবেন বাদশাহ্। এসে নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে দেখবেন রানীর দ্রব্যাদি। উচ্চ প্রশংসায় মুখরিত হবেন, যার ফলে রানীর মুখে হাসি ফুটবে। গর্বের হাসি। সেই সুযোগে রানীর হাতের সঙ্গে বাদশাহের হাতের স্পর্শও লাগতে পারে। কারণ এই স্পর্শের প্রতিক্রিয়া দেখেই তিনি সাধারণত তাঁর পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করেন বলে শুনেছে জিৎ। জেনে নিয়েছে মীনাবাজারের ভেতরের রহস্যের অনেক কাহিনী। যদি বাদশাহের স্পর্শলাভে তাঁর ঈন্সিত নারী লাজে রাঙা হয়ে ওঠে কিংবা সেই নারী যদি আনন্দে বঙ্কিম কটাক্ষে বাদশাহের দিকে চায়, তবে আমীর ওমরাহের সাহায্য ছাড়াই তিনি সেই নারীকে নিয়ে যান তাঁর সেই কলঙ্কিত বেদিতে। তবে সিক্রির বেদি কিংবা সেইকক্ষ এপর্যন্ত কলঙ্কিত হয়নি। আজই হবে তার অশুভ সূচনা

কোনো নারী যখন বাদশাহের স্পর্শে বিরক্ত বোধ করে, তখনই আসে আমীর ওমরাহের দল। তারা রমণীটিকে কোনোরকমে ভুলিয়ে তাকে দোকান থেকে বের করে ঘিরে নিয়ে চলে সেই কক্ষে। এরা এতটা দক্ষ, যে এদের ব্যূহের মধ্যে পড়ে একাকিনী রমণী অসহায় হয়ে পড়ে। চেষ্টা করলেও ব্যূহ ভেদ করতে পারে না। তার আর অন্য উপায় থাকে না।

উধম আর তার শকটের দিকে চেয়ে ভাবতে ভাবতে জিৎ-এর বুক কেঁপে ওঠে। কোনো কিছুতে তার বুক বড় কাঁপে না। কিন্তু এটি অন্য জিনিস। এখানে প্রতিবিধানের কোনো পথই খোলা নেই। তাই বুক না কেঁপে পারে না।

জিৎ সিং-এর ইচ্ছে হয়, ছুটে ভেতরে গিয়ে রানীকে জোর ক’রে আটকে রাখে। দু-পা অগ্রসরও হয়। কিন্তু উধমের ডাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

উধম কাছে এসে বলে,—অমন পাগলের মতো করছ কেন? চুপচাপ থাকো না?

—কি ক’রে চুপচাপ থাকব, তুমি তো সবই জান? চুপ করে থাকা যায়?

—আমি তো আছি স্থির হয়ে, একটুও অস্থির হইনি।

—তুমি পাষাণ। তোমার ওই বুকের পাঁজর কয়টির মধ্যে হৃৎপিণ্ড নেই। তোমার দয়া মায়া মমতা কিছুই নেই।

বিষাদের হাসি হেসে উধম বলে,—ঠিক বলেছ। দয়ামায়া থাকলে অনেক আগে পাগলৱ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম।

তার কথা শুনে বিস্মিত হয় জিৎ। সে উধমের চোখের দিকে চাইতে পারে না। কারণ সে তখন ঘোড়াকে দানা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।

—তুমি কী বলতে চাও উধম? শেষবারের মতো রানীকে বাধা দেবার চেষ্টা করব না?

—না। সঙ্গে রাজা নিজে রয়েছেন। তিনি ওঁর স্বামী।

—কিন্তু স্বামী যদি এসব ষড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গও না জানেন, তবে আমাদের মতো লোকের কর্তব্য কি?

—তোমার কর্তব্য তুমি করেছ জিৎ? এর পর শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তুমি সব কিছু ওঁদের কাছে খুলে বলতে পার না, কারণ সেকথা প্রকাশ করলে সিক্রিতে এবং আগ্রায় তোমার আগমনের উদ্দেশ্যের কথাও বলতে হয়। তাই বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতেই হবে।

—ক্ষুদ্র স্বার্থ! রানীর সম্মান, তার সতীত্বকে তুমি বলছ ক্ষুদ্র স্বার্থ?

দৃঢ়স্বরে উধম বলে ওঠে,—হ্যাঁ জিৎ। মেবারের স্বাধীনতার তুলনায় একজন রাজপুত রমণীর সম্মান ক্ষুদ্র বৈ কি।

স্তম্ভিত জিৎ ভাবে, কতখানি নিঃস্বার্থ হলে, কতখানি ভাবাবেগবর্জিত হলে মানুষ প্রকৃত সত্য এমন জোর দিয়ে বলতে পারে। এটি তার হৃদয়হীনতা নয়। উধমের হৃদয় কতখানি উত্তপ্ত তা তার জানা আছে।

নিজের মনকে উধমের মতো দৃঢ় করবার চেষ্টা করে জিৎ রানী তার রাখীবন্ধনের ভাই। কিন্তু রানীকে উধমও কম শ্রদ্ধা করে না, কম ভালোবাসে না। উধম যদি এতটা কঠিন হতে পারে, সে-ই বা পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার গায়ের ওপর হাত রেখে জিৎ সিং আপন মনে বলে, নিশ্চয় পারব, নিশ্চয়ই পারব।

অবশেষে রানী বের হয়ে আসে গৃহ থেকে। পৃথ্বীরাজও আসেন তার সঙ্গে। রানী জিৎকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। জিৎ-এর মন দমে যায়। তার মনে হয়, পাদুটো হঠাৎ বড় বেশি দুর্বল হয়ে গেল। সে এগিয়ে যেতে পারে না।। বলতে পারে না,—জিনিস দুটো নিয়েছ বোন?

বলবার মুখ নেই আর তার। সে বুঝতে পারে, আর সে রানীর রাখীবন্ধনের ভাই নয়। সে এখন রাস্তার লোক। উধমের দিকে একবার চায় জিৎ। অধম তার চোখ দুটো দিয়ে বলে ওঠে,

—এসবে অত মন খারাপ করো না।

কিন্তু তাতে সান্ত্বনা পায় না সে। মাথাটাকে নীচু ক’রে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয় জিৎ‍ পৃথ্বীরাজ তার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলেন,—অত বিষণ্ণ কেন জিৎ বাদশাহ্ মীনাবাজারে তেমায় ঢুকতে দেবেন না বলে কি?

মুখে হাসি টেনে আনতে হয়। নইলে রাজাকে অসম্মান করা হয়। রাজা মানুষটি ভালো। তাই জিৎ বলে,–সে আশা করি না রাজা। সে বাসনাও আপাতত নেই।

—কেন?

—মরে গেলেও মেয়ে হবার সাধ আমার হবে না কোনোকালে।

রাজা হোহো ক’রে হেসে তাঁর রানীর দিকে চান। রানী কিন্তু ততক্ষণে গাড়ির ভেতরে বসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে।

রানীর এই ভাবান্তর রাজা অতটা খেয়াল না করে বলে ওঠেন,—শুনলে তো তোমার ভাই-এর কথা?

গম্ভীরস্বরে রানী শুধু বলে, —হুঁ।

—দেখলে জিৎ, তোমার কথায় তোমার বোনের রাগ হয়েছে। শুভযাত্রার আগে এভাবে কখনো বলতে হয়?

শুভযাত্রাই বটে। জিৎ-এর হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়, ভীষণ হাসি পায়। তার ইচ্ছে হয় অট্টহাস্য ক’রে উঠতে। এত জোরে হাসবে সে, যা শূন্যের মধ্যে ভয়ঙ্কর তরঙ্গ তুলবে। তারপর সেই তরঙ্গ ধেয়ে যাবে মীনাবাজারের দিকে। সেখানে গিয়ে মরুভূমির ঝড়ের মতো সেখানকার সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে।

একটু জোরেই হেসে ওঠে জিৎ। ঠিক স্বাভাবিক হাসি নয়।

পৃথ্বীরাজ অবাক্ হয়ে তাকান। রানী মুখ ঘুরিয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে।

এমন কি উধমেরও লাগম-ধরা হাত দুটো স্থির হয়ে যায়।

পৃথ্বীরাজ শকটের কাছে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি ফিরে এসে জিৎকে কোমলস্বরে প্রশ্ন করেন, তুমি সুস্থ আছো তো জিৎ?

—হ্যাঁ রাজা। আমি সুস্থ আছি। অনেকদিন হাসি চেপে রেখেছিলাম। তাই হঠাৎ এমন হয়ে গেল। আমায় ক্ষমা করুন।

গাড়ি চলে চায়। জিৎ সিং কিছুক্ষণ সেইদিকে চেয়ে থেকে দ্রুতপদে সরাইখানায় ফিরে যায়। বিকেল গড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই।

সরাইখানায় অনেক লোকের ভিড়। মাধব হিমশিম খায়। সবাই খাওয়াদাওয়া সকাল সকাল মিটিয়ে নিয়ে মীনাবাজারের কাছাকাছি ঘুরবে। দেখবার অধিকার কারও নেই, অথচ বাইরে ভিড় করার একান্ত আগ্রহ রয়েছে সবার। কী যে লাভ তাতে, কেউ জানে না। তবু সকলে জানে, অস্বাভাবিক অনেক কিছুই ঘটতে পারে এখানে। আর সেইসব ঘটনার তাজা স্বাদটুকু লাভের লোভ সবার

জিৎকেও যেতে হবে। গিয়ে দাঁড়াতে হবে উধমের গাড়ির পাশে। উধম সমস্ত সময়টাই সেখানে কাটাবে আজ। কখন রানী গৃহে ফিরবেন ঠিক নেই। রাত দুপুরও হতে পারে, ভোরও হয়ে যেতে পারে।

রানীর কথা ভাবতে বুকের ভেতরটা কেমন ক’রে ওঠে জিৎ-এর। সে কর্মব্যস্ত মাধবের চোখ এড়িয়ে সামনের রাস্তায় নামে। বুক ভরে শীতল বাতাস নেয়। একটু প্রকৃতিস্থ হয় সে।

রাস্তা থেকে সে নিজের সরাইখানার দিকে চায় সেখানে যেন উৎসব লেগেছে। এত বেশি আলো কোনো রাতেই জ্বলে না। এত লোক কখনো আসে না। মাধব অদ্ভুত পারদর্শী। সব কিছু এক হাতে সামলে নিচ্ছে।

জিৎ সিং রাস্তা থেকে আবার ভেতরে আসে। কিছুক্ষণ দেখাশোনা করে। মনের ভেতর আবার একটু অশান্ত হয়ে ওঠে। সে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

ঘর আলো ছিল না। আবছা অন্ধকার। এই অন্ধকারই সে চায়। সে একা থাকতে চায়। শয্যায় ওপর বসে একটু জোরে বলে ওঠে,–তোমায় বাঁচাতে পারলাম না বোন। আমার কথা তুমি শুনলে বাঁচতে পারতে।

হঠাৎ দেখতে পায় জিৎ ঘরের কোণ থেকে কে যেন দরজায় দিকে সরে যাচ্ছে। পা টিপে টিপে অতি সাবধানে সরে যাচ্ছে সে। জিৎ-এর চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সে তার পা দুটোকে মেঝের ওপর শক্ত করে রাখে। দরজার কাছে আসবার সঙ্গে সঙ্গে ওই মূর্তিটিকে ধরে ফেলতে হবে। বাদশাহ্ নিশ্চয়ই তাকে সন্দেহ করেছেন। সন্দেহ ক’রে তার ওপর নজর রেখেছেন। তিনি সন্দেহ না করলে আর কে-ই বা আসবে তার ঘরে? চোর আসতে পারে। আজকের ভিড়ের মধ্যে সুযোগ পেয়ে চোরও এসে মিশেছে হয়তো। তারপর সুবিধে মতো সবার অলক্ষ্যে এই ঘরে এসে ঢুকেছে। সে জানে মালিকের ঘরে টাকাকড়ি থাকে।

জিৎ সিং মনে মনে ভাবে চোরই যেন হয়। চোর হলে তাকে দু-ঘা দিয়ে ছেড়ে দিলে চলবে। কিন্তু বাদশাহের কেউ হলে কিছুই করা যাবে না। অক্ষত দেহে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ সে বাদশাহের সন্দেহভাজন হতে চায় না। লোকটি ঘরে যতক্ষণই থাকুক—কিছুই পায়নি, যদি সে বাদশাহের কেউ হয়। কারণ তেমন কিছু ঘরে নেই। একে ছেড়ে দিলে এর কাছ থেকে বাদশাহ্ তার কার্যাবলীর কোন হদিশ পাবেন না। তবু বাদশাহের চরের চেয়ে চোর ভালো। কারণ লোকটি যদি বাদশাহের চর হয়, তবে বুঝতে হবে সে অনেক আগে থেকেই তার পেছনে ঘুরছে পরেও ঘুরবে। দরওয়াজার কাছাকাছি মূর্তিটি যেতেই জিৎ সিং এক লাফে তার হাতটি চেপে ধরে। এভাবে হাত চেপে ধরা মারাত্মক জেনেও সে নিজেকে সংযত করতে পারে না। কারণ অপর পক্ষ কোনো ধারালো অস্ত্র তার বুকে বিঁধিয়ে দিতে পারত।

কিন্তু সে কিছুই বিধিয়ে দেয় না। চাপা গলায় শুধু চিৎকার ক’রে ওঠে,—ছাড়ো না। আমার ঘরে চলে যাই।

—তুমি? আমার ঘরে তুমি এসেছ?

—দেখতেই তো পাচ্ছো এসেছি।

—মাধব তবে ঠিকই বলেছে। কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে সরাইখানায় আছো তুমি। তাই সারাদিন ঘর অন্ধকার ক’রে কপাট লাগিয়ে বসে থাকো।

—না না, ওসব মিথ্যে কথা। সত্যি বলছি কোনো উদ্দেশ্য নেই।

—তবে কেন এখানে এসেছো লুকিয়ে?

—এমনি। আমাকে ছেড়ে দাও, আর কখনো আসব না। শপথ করছি।

—না।

—ছাড়বে না?

—না।

ছেলেটি রুখে ওঠে,—আমায় অবিশ্বাস করছ?

—শোন। মেজাজ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এদিকে এসো। তোমার পেট থেকে সব কথা বের না করে আমি আজ ছাড়ছি না। আমাকে তুমি চেনো না।

উদ্ধত ভঙ্গিতে ছেলেটি জবাব দেয়,—খুব চিনি।

রাগে জিৎ সিং ছেলেটির হাতে সজোরে চাপ দেয়।

ব্যথায় সে কুঁকড়ে জিৎ-এর কাছে সরে এসে বলে,—উঃ, লাগে।

—এত নরম হাত। এই হাত নিয়ে সিক্রিতে এসেছে কাজের খোঁজে? বিশ্বাস হয় না। তুমি নিশ্চয় এই সিক্রিরই ছেলে। কারও নির্দেশে এখানে আছো। কেউ বোধ হয় সন্দেহ করেছে এই সরাইখানা থেকে অনেক গোপন খবর পাওয়া যাবে। ঠিক কি না?

—না। ওসব তুমি কল্পনা করছ।

জিৎ সিং-এর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে ছেলেটির হাতে আরও জোর চাপ দেয়।

এবারে ব্যথায় অব্যক্ত একটি স্বর বের হয় তার মুখ দিয়ে। সেই স্বর শুনে জিৎ সিং চমকে ওঠে। সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়। দরজার কাছ থেকে ছেলেটিকে টানতে টানতে নিজের শয্যার কাছে নিয়ে গিয়ে বলে,–কে তুমি?

ছেলেটি নীরব। সে মাথা নীচু করে।

—তোমার মাথার পাগড়ী খোলো।

সভয়ে এক হাতে মাথা চেপে ধরে উত্তর দেয় সে—না।

—জিৎ সিং জোর করে তার মাথার পাগড়ী খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব ক’রে একরাশ ঝাঁকড়া নরম চুল তার হাতের ওপর লুটিয়ে পড়ে।

বিশ্বাস হতে চায় না জিৎ সিং-এর। সে যেন এক স্বপ্ন দেখছে। কিশোরের ছদ্মবেশে একটি মেয়ে রয়েছে তারই সরাইখানায়। কিন্তু কেন, কী হতে পারে?

—তুমি ছেলে নও?

—না জিৎ।

এবারের কণ্ঠস্বর শুনে জিৎ সিং পাগলের মতো চেঁচিয়ে ওঠে, কে?

—আলোর সামনে নিয়ে গিয়ে মুখ দেখে, তবে আমায় চিনতে হবে জিৎ?

—লীলাবতী?

—হ্যাঁ। সাধে কি আর ওই অন্ধকার ঘরে বসে থেকে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতাম? কিন্তু এখন তো কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি আমার পাগড়ীটা বেঁধে দাও জিৎ। এখুনি হয়ত মাধব এসে পড়বে। রাতের বেলায় আসব আমি। তখন সব বলব

—লীলা। তুমি লীলা?

—হ্যাঁ জিৎ আমি লীলা। রাতে আসব। মনে নেই সেই উদয়সাগরের তীরে তুমি চলে আসার আগের রাতে আমি গেছলাম তোমার ঘরে? তেমনিভাবে আসব।

—সেভাবে আর কোনোদিনই আসবে না, আমি জানি।

লীলা কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকে। অন্ধকারের মধ্যে সে জিৎ সিং-এর মুখের দিকে চায়। তারপর তাড়াতাড়ি বলে,—পরে কথা হবে। আমি চলি, পাগড়ী বেঁধে দাও লক্ষ্মীটি।

পাগড়ী বাঁধতে বাঁধতে জিৎ বলে,—কিন্তু আজ রাতে আমি নাও থাকতে পারে ঘরে।

—–ও, আমি ভুলেই গেছলাম। তোমার বোনের জন্য খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছ তাই না?

—তুমি একথা কোথায় জানলে?

—ঘরে এসে তুমি আপন মনে কথা বলছিলে। খুবই হতাশ হয়েছ, নইলে মনের চিন্তা মুখে বলবার অভ্যাস তো তোমার আগে ছিল না। চলি জিৎ। আজ না হোক, কাল তো দেখা হবে, কিংবা পরের দিন। তবে অন্য সময়ে তুমি আমার ঘরে যেও না।

লীলা তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যায়।

জিৎ সিং শয্যার ওপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর এক ঝঙ্কায় উঠে পড়ে। আজেবাজে চিন্তা করবার সময় নেই মোটে। মীনাবাজারে তাকে যেতেই হবে।

.

ভেতরের অসংখ্য বাতির আলো বাইরে ঠিকরে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কিন্তু একটি রূপসীর ও রূপের আলো দেখবার সৌভাগ্য হয় না বাইরের উৎসুক জনসাধারণের। তবু তারা অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে জিৎ সিং লক্ষ্য করে, আগ্রার চেয়ে সিক্রির জনতার সংখ্যা অনেক কম। আগ্রা বহুদিনের নগরী, সেখানে বসতি অনেক ঘন। সিক্রি এখনো সাধারণ মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। কবে হয়ে উঠবে, কেউ বলতে পারে না। কারণ জলকষ্ট এখানে খুবই তীব্র। বাদশাহের একান্ত মনোযোগ সত্ত্বেও জলকষ্ট দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হয়তো কোনোদিনই হবে না।

জিৎ সিং জনতার দিকে একবার চেয়ে দেখে। ওরা কত সরল, কত অজ্ঞ। ওরা জাঁকজমকই দেখে। ওরা হয়তো জানে না এত সব জাঁকজমকের পশ্চাতে শুধু একটিমাত্র উদ্দেশ্যই বর্তমান সেটি হল বাদশাহের দৈহিক ভোগবাসনার চরিতার্থতা সাধন। সেই কুৎসিত ভোগবাসনার বলি হবে আজ রাত্রে বীর যোদ্ধা পৃথ্বীরাজ রাঠোরের তেজস্বিনী পত্নী। কেউ আজ সেই হতভাগিনী নারীকে রক্ষা করতে পারবে না। রাজা মানসিংহ নয়, তানসেন নয়, মুনিম খাঁ নয়, কেউ নয়। বীরবল তো আজ স্তব্ধ হয়ে আমীর ওমরাহের দলের মধ্যে বসে থাকবে। তার মন এতটা নীচ নয়। কিন্তু স্বীয় কন্যার মঙ্গলের জন্যে সে সব করতে পারে। এর থেকে প্রমাণ হয়, তার মন অতটা উঁচুও নয়। উঁচু হলে নিজের সুখ সাধ, নিজেক কন্যার জীবনের বিনিময়েও আজ সে রুখে দাঁড়াত।

পৃথ্বীরাজের রানী আজ নিজে শুধু বাঁচাতে পারে নিজেকে, যদি সে জিৎ-এর অনুরোধ রক্ষা করে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। মীনাবাজারে যাত্রা করার পূর্ব মুহূর্তে তার মুখের দিকে চেয়েই বুঝেছিল জিৎ সিং, তার মতো তার প্রস্তাবকেও ঘৃণা করতে শুরু করেছিল রানী।

জিৎ সিং পৃথ্বীরাজের শকট খুঁজে পায়। কাছে গিয়ে দেখে উধম নেই। শকটের দরজা বন্ধ সন্দেহ হয় তার। একটানে গাড়ির দরওয়াজা খুলে ফেলে।

উধম নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল।

বিস্মিত হয় জিৎ। সবকিছু জেনে-শুনেও উধম নির্বিকার। নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।

সজোরে উধমকে ধাক্কা দেয় জিৎ।

ধড়মড় ক’রে উঠে চোখ কচলে নিয়ে জিৎ সিংহকে দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়। বলে,—ওঃ, তুমি? আমি ভেবেছিলাম রানী এলেন বুঝি, বাড়ি ফেরবার জন্যে।

—ছি ছি, উধম। আমি তোমার কাছ থেকে এমনটি প্রত্যাশা করিনি।

—কী প্রত্যাশা করেছিলে তবে?

—প্রত্যাশা করেছিলাম, অন্ততপক্ষে চিন্তাগ্রস্ত দেখব তোমায়। ভেতরে এখন কী ঘটছে ভাবতে পারো?

উধম গম্ভীর হয়ে বলে,—ওসব কথা থাক। একটি চিন্তা আমায় একটু বিচলিত করেছে। রানা প্রতাপ নিশ্চয়ই আক্রমণ শুরু করেছেন। সেই আক্রমণের কথা জানতে বাদশাহের বেশিদিন লাগবে না। চিতোর থেকে মুঘল দূত আসতে দেরি হবে না একটুও। তারপর? তারপর আমাদের কর্তব্য কি? বাদশাহ্ যে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান শুরু করবেন। খুব বেশি দেরি হলে সাতদিন। তাঁর বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতাপ কতদিন লড়তে পারবেন?

রাখীবন্ধন বোনের কথা মন থেকে মুছে যায় জিৎ-এর। সরাইখানায় ফেলে আসা লীলাবতীর কথাও ভুলে যায়। সে গাড়ির ভেতরে লাফিয়ে উঠে উধমের পাশে বসে বলে,–কিকা কোনোদিন খুব সহজে মুঘল বাহিনীর সম্মুখীন হবেন না।

—দেশ রক্ষা তবে করবেন কি ভাবে?

—সম্মুখীন হবেন না বলেই দেশরক্ষা করতে পারবেন। আমার সঙ্গে তিনি অনেক বিষয়ে আলোচনা করতেন, একথা তোমায় বলেছি। একদিন তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠলেও মেবারের সৈন্যদল সংখ্যায় বাদশাহের সৈন্যবাহিনীর সমকক্ষ কোনোদিনই হতে পারবে না। মরুভূমির দেশ রাজোয়ারাতে অত লোকসংখ্যা নেই। তাই তিনি কোনো সুযোগ পেলেই অন্যভাবে মুঘল বাহিনীকে ঘায়েল করবেন। আরাবল্লীর দুর্গম গিরিপথ, তার অরণ্য তাঁর নখদর্পণে দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে তিনি মুঘল সৈন্যদের অতিষ্ঠ করে তুলবেন, পরাজিতও করবেন।

উধম বলে,—বাদশাহ্ যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তিনি যদি তাঁর সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে মেবারের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করেন, তবে প্রতাপসিংহের এই কৌশল কার্যকরী হবে কি না সন্দেহ

—সমস্ত শক্তি বাদশাহ্ কোনোদিন নিয়োজিত করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন না কিকা কারণ হিন্দুস্থানে মেবারই একমাত্র স্থান নয়, যেখানে অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে।

—তবু জিৎ, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। তুমি হয়তো জান না, দুদিন আগেই বাদশাহ্ প্রকাশ্য দরবারে বলেছেন, কিকা এখন শক্তিহীন। তবু তিনিই তাঁর প্রধানতম শত্রু।

—বলেছেন একথা?

—হ্যাঁ। এর থেকে তুমি বুঝতে পারবে প্রতাপকে তিনি কতখানি গুরুত্ব দেন। গুরুত্ব দেন বলেই তিনি ‘কিকা’ নামটিকে ভুলতে পারেন না। এ পর্যন্ত কখনো প্রতাপ নাম উচ্চারণ করেননি তিনি।

জিৎ সিং মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়। তার মন দুলে ওঠে। কিন্তু তখনই সে আবার ঝুঁকে পড়ে উধমের দিকে। বলে,—বাদশাহ্ যদি সত্যিই মেবারের দিকে রওনা হন, তাহলে সেই খবর তুমি কত আগে পৌঁছে দিতে পারবে উধম?

—সেটা নির্ভর করে বাদশাহের রওনা হবার ওপর। সাতদিনের সময় প্রয়োজন হবে তাঁর, সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিতে। ধর, কাল থেকেই যদি তিনি আয়োজন শুরু করেন, তবে কালই আমার লোক ছুটে যাবে। তার মানে, বাদশাহ্ তাঁর দলবল সব নিয়ে উদয়পুরে পৌঁছোবার অন্তত একপক্ষ কাল আগে প্রতাপ খবর পেয়ে যাবেন। আমার লোকের গতি হবে খুব দ্রুত

—চমৎকার। তাতেই চলবে।

—তোমাকে বেশ নিশ্চিন্ত বলে মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমি জানি বাদশাহ্ ভীষণ রকমের জেদী মানুষ। সেই জেদ যদি একান্তই পেয়ে বসে তাঁকে, তবে দেশের অন্য অংশ হাতছাড়া হয়ে যাবার ঝুঁকি নিয়েও তিনি মেবারকে ধ্বংস করবেন। কোনোদিকে ফিরে পর্যন্ত চাইবেন না।

—একথা আমি বিশ্বাস করি না উধম।

—কেন?

—মেবার যত বড় কঠিন ঠাঁই-ই হোক, এখানকার রাজস্ব খুব সামান্য। তাই এর চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধিশালী কোনো অংশ হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিলে, তিনি এখনই মেবারের দিকে ঝুঁকবেন না।

উধমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মীনাবাজারের ঘেরা জায়গার কোনো ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আলো এসে তার চোখে পড়ায়, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। জিৎ সিং-এর হাত চেপে ধরে উধম বলে,–তোমার মতলব কি জিৎ?

—কি ক’রে বুঝলে আমার মতলব রয়েছে?

—এতদিন ধরে দেখছি, ওটুকু বুঝতে পারব না?

—হ্যাঁ, মতলব রয়েছে আমার। এই গাড়িতে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মতলবটা হঠাৎ মাথায় এসে গেল। বলব?

—নিশ্চয়ই

—আমি গুজরাটের কথা ভাবছিলাম। এই গুজরাটের মতো ঐশ্বর্যশালী জায়গা এক বাঙলা মুলুক ছাড়া হিন্দুস্থানে আর একটিও নেই। তাই ভাবছি, এ সময়ে গুজরাটকে একটু নাড়া দিয়ে দিতে পারলে ভালো হত। গুজরাট যদি নড়েচড়ে ওঠে তাহলে বাদশাহ্ মেবারের কথা একেবারে ভুলে যাবেন। গুজরাট এখন তাঁর কোষাগারের বৃহত্তম অংশ পূর্ণ করে।

—নাড়া দেওয়া কি সম্ভব হবে?

—একেবারে অসম্ভব নয়। মুজাফ্ফর শাহের কথা মনে আছে? যিনি বাদশাহের আক্রমণের ভয়ে শস্যক্ষেতের ভেতরে লুকিয়েছিলেন?

—হ্যাঁ, তাঁকেই তো এখনো সেখানকার নবাব ক’রে রেখেছেন বাদশাহ্।

—বাদশাহ্ তাঁকে নবাব ক’রে রাখলেও ওখানকার প্রতাপশালী মীর্জারা একটু পছন্দ করে না তাঁকে। মীর্জাদের কতখানি শক্তি রয়েছে সেকথা এখন আর কারও অজানা নেই। সেই মীর্জাদেরই একজন মুজফ্ফর শাহকে গদিচ্যুত করতে চায়। তাছাড়া মীর্জাদের পরস্পরের ভেতরও খুব সদ্ভাব নেই।

উধম বিস্মিত হয়ে বলে,—এত সব ভেতরের খবর কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?

—করেছি। একজন ভালোলোকের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছি। লোকটি যদি এখানে থাকত, তাহলে এতদিনে বাদশাহের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারত। কিন্তু সে মুঘল বাদশাহের অনুরক্ত নয়। সে মীর্জাদের বিশ্বস্ত। মীর্জা মহম্মদ হোসেনের সেনাপতি সে। নাম ইখতিয়ার- উল্-মুখ। বিরাট পুরুষ

—কোথায় দেখা হল তার সঙ্গে?

—এই সিক্রিতেই দেখা হয়েছে। মাঝে মাঝে সাধারণ পথিকের বেশে এসে এখানকার হালচাল জেনে যায় ইখতিয়ার। কথায় কথায় তার মনোভাবটা জেনে নিয়ে আমিও খুব সায় দিয়েছিলাম। বলেছিলাম—উদ্দেশ্য আমাদের এক, মুঘল বাদশাহের অধীনতাপাশ ছিন্ন করা। শুনে সে খুশী হয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল উধম। বয়সে তার চেয়ে আমি অনেক ছোট হলেও এ-বন্ধুত্বের মধ্যে কৃত্রিমতা বিশেষ ছিল না। এখান থেকে চলে যাবার সময়ে সে-ই বলেছিল, এতদূর বার বার আসতে তার খুবই অসুবিধা হয়। শুনে আমি বলেছিলাম, কোনো জরুরী খবর থাকলে আমিই তাকে জানাবো। কষ্ট করে তার এত দূরে আসবার কোনো প্রয়োজন নেই।

—সেই জরুরী খবর দেবার সময় এসে গেছে বলে তুমি মনে করছ জিৎ?

—হ্যাঁ। রানা প্রতাপকে আক্রমণের কথা জানিয়ে কালই ইখতিয়ারকে পত্র দেব আমি। লিখে দেব, মেবারে আবার আগুন জ্বলছে। এ-আগুন দাবাগ্নির মতো প্রবল না হলেও একেবারে সামান্য নয়। এই সময়ে যদি মীর্জা মহম্মদ হোসেন গুজরাটেও আগুন জ্বালতে পারেন তবে তাঁর একটি সুযোগ মিলতে পারে মুজাফ্ফর শাহকে তাড়িয়ে সেই গদি অধিকার করার। কারণ দুদিকে এক সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে বাদশাহ্ আকবরের মতো ব্যক্তিও বিচলিত হবেন। তাছাড়া গুজরাটের দূরত্ব খুব কম নয়।

—তোমার এই কথা ইখতিয়ার-উল-মুখ শুনবে বলে তোমার ধারণা?

—হ্যাঁ। ইখতিয়ার-উল-মুখ আমায় বিশ্বাস করেন। সে যদি আমায় বিশ্বাস না করত তবে তাকে ভাঁওতা দিয়েও কার্যোদ্ধার করতে পারতাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সেই সম্পর্ক নয়। সে জানে আমার সব স্বার্থ মেবারকে ঘিরে। এটুকু তার কাছে আমি স্পষ্ট ক’রে বলে রেখেছি। সেও তেমনি স্পষ্ট করে বলেছে তার নিজের স্বার্থের কথা। আমি তাকে সব কিছু খুলে লিখলে এ সুযোগ সে নষ্ট হতে দেবে না। তোমার লোককে প্রস্তুত রেখো উধম।

—কালই?

—হ্যাঁ কালই সন্ধ্যায়।

উভয়ে পরামর্শ শেষে শকটের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

রাত অনেকটা গভীর হয়েছে। যে জনতা অদম্য কৌতূহল নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, তারা অনেকটা পাতলা হয়ে গেছে। পড়ে রয়েছে যারা, তারা নিশ্চয় কাছে পিঠে থাকে। শকট চালকও রয়েছে কিছু তাদের মধ্যে।

জিৎ সিং-এর আবার রানীর কথা মনে পড়ে যায়। বেশ ভুলে ছিল এতক্ষণ।

মনে হতেই আবার সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ছটফট করতে শুরু করে। বার বার সে মীনাবাজারের দরওয়াজার সামনে যায় আবার ফিরে আসে।

উধম তার হাবভাব দেখে কাছে গিয়ে পিঠে হাত রেখে বলে,—উতলো হয়ো না জিৎ। স্থির হয়ে দাঁড়াও এক জায়গায়। রানীর ভাগ্যে যা রয়েছে তাই হবে। উতলা হয়ে লাভ নেই।

~সেকথা আমিও জানি। কিন্তু মন তো মানে না। সে যে আমার বোন উধম। আমি যদি পুরুষ না হয়ে মেয়ে হতাম বেশ হত। এতক্ষণে মীনাবাজারের ভেতরে গিয়ে রানীর খোঁজ নিতে পারতাম।

—সব মেয়েই কি যেতে পারে?

—রূপসী হলে?

—হ্যাঁ। তাদের গতি দুর্নিবার।

সহসা জিৎ-এর কি যেন মনে পড়ে যায়। সে উধমের হাত ধরে বলে,—একটা কাজ করবে ভাই।

—–কি কাজ?

—তোমার গাড়ি নিয়ে সরাইখানায় যাবে আমার সঙ্গে?

কেন? এত রাতে সেখানে কেন?

—তোমায় বলতে সুযোগ পাইনি। সেখানে লীলা এসেছে।

—লীলা? ঢোলপুরের লীলাবতী? যাকে তুমি—

—হ্যাঁ। শিগগির চল। তাকে সাজিয়ে আনলে কেউ কুরূপা বলবে না। সে মোটামুটি সুন্দরী। চল উধম। দেরি করো না।

—কিন্তু লীলাবতী মীনাবজারে গিয়ে নিজেই হয়তো ওই রকমের বিপদে পড়ে যাবেন।

—না। তাকে তুমি চেনো না। তার বিপদ ঘটানো অসম্ভব।

—রানীকে তিনি খুঁজে বের করতে পারবেন?

—পারবে। সে ইচ্ছে করলে সব পারে। চল উধম। আর দেরি করো না।

ঠিক সেই সময় মীনাবাজারের দরওয়াজার দিকে লক্ষ্য পড়ে উধমের। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার দৃষ্টি অনুসরণ ক’রে জিৎ সিং দেখে রানী বের হয়ে আসছে, পৃথ্বীরাজ রাঠোরের রানী। সে একাই আসছে। সঙ্গে তার স্বামী নেই। ধীর পায়ে বের হয়ে আসছে রানী। একটুও টলছে না। সমস্ত জনতা যে তার দিকে চেয়ে রয়েছে তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই তার। মাথার ওড়না খসে পড়েছে একদিকে। কিন্তু সে অবিচল পায়ে এগিয়ে আসছে। তবে তার দৃষ্টি ঠিক স্বাভাবিক নয় সেই দৃষ্টির ভেতরে কী যে রয়েছে, আর কী যে নেই বুঝে উঠতে পারে না জিৎ।

সব পরিষ্কার হয়ে যায় জিৎ-এর কাছে। ওই দৃষ্টির অর্থ তার কাছে জলের মতো সহজ হয়ে যায়। যে ঘটনা ঘটবার আশঙ্কায় এতদিন ধরে তার উদ্বেগের অন্ত ছিল না, তাই ঘটে গেছে। রানীর এতদিনের সুস্থ সুন্দর জীবনের মোড় সহসা ঘুরে গেছে আজ। যদি বেশিক্ষণের জন্য নয়। স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে তার ভগিনী কতক্ষণই বা জীবিত থাকবে?

জিৎ সিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে চেয়ে দেখে উধম গিয়ে রানীর হাত ধরেছে। হাত ধরে তাকে নিয়ে চলেছে শকটের দিকে। জিৎ সিং ভাবে, মনের জোরে ধীর পায়ে বাইরে এলেও বিধ্বস্ত দেহ আর বিমূঢ় চিত্ত নিয়ে একা রানীর পক্ষে নিজের শকট চিনে নেওয়া অসম্ভব।

শকটের সামনে দাঁড়িয়ে উধম ডাকে,—চল জিৎ।

তার নাম শুনেই রানী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চায়। তারপর পাগলের মতো ছুটে এসে জিৎকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের ওপর মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।

জনতার যে অবশিষ্টাংশ তখনো দাঁড়িয়ে ছিল ভাঙা আসরে, তারা মজাদার খোরাক পেয়ে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে রইল।

মুহূর্তের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় জিৎ। তারপর একপা পেছনে সরে গিয়ে দুহাতে রানীর মাথাটা তুলে ধরে বলে সে,—গাড়িতে ওঠো বোন ওতে বসে কথা হবে।

গাড়ির ভেতরে কিন্তু কোনো কথা বলতে পারে না জিৎ। তার বিষণ্ণ মন অস্বস্তিতে ভরে ওঠে। সে বুঝতে পারে না কি ভাবে শুরু করবে। কোনো সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করলে তা প্রহসনের মতো শোনাবে। অথচ কিছু না বললেও হয় না।

শেষে উধম বাঁচিয়ে দেয় তাকে। সে চালকের জায়গা থেকে একটু জোরে বলে,—বাড়ির দিকেই যাব তো রানীমা?

—হ্যাঁ উধম।

রানীর স্থির কণ্ঠস্বরে বিস্মিত হয় জিৎ। সে দেখে চোখের জলও মুছে ফেলেছে রানী। কিন্তু পরক্ষণেই আবার দুচোখ প্লাবিত হয়। সে জিৎ-এর বাহুর ওপর মাথা রেখে ভগ্ন স্বরে বলে, –ভাই, আমায় ক্ষমা কর। তোমায় আমি অবহেলা ক’রেছিলাম।

মনে মনে জিৎ ভাবে, এখন আর ক্ষমা করেই বা কি হবে? যা হবার তা তো হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্য রকম সামলে নিয়েছে বটে রানী। মেয়েরা বোধহয় সব পারে। মুখেই তাদের বড় বড় কথা শুধু।

—বল জিৎ, আমায় ক্ষমা করেছে?

—যদি বলি আমি ক্ষমা করেছি, তাতে শান্তি পাবে বোন?

—পাব না। তুমি বলছ কি জিৎ? তোমায় যে আজ সহস্রবার ‘ভাই’ বলে ডাকতে সাধ হচ্ছে।

—–তোমার ওপর আমি রাগ করিনি বোন। তবে আঘাত পেয়েছিলাম বৈ কি।

রানী আবার কাঁদো। সে বলে,–তোমায় আমি আঘাত দিয়েছিলাম। ভগবান আমায় কি কখনো ক্ষমা করবেন?

—তুমি বাড়ি গিয়ে কি করবে বোন?

—ঘুমোবো। হয়তো ঘুম আসবে না। তবু নিজের শয্যার ওপর শুয়ে নিশ্চিত হব। তুমিও আমার সঙ্গে বাড়ি অবধি চল জিৎ। তোমায় অন্য ঘরে শয্যা পেতে দেব নিজের হাতে। আর ভাবব, এক রাতের জন্যে অন্তত আমার ভাই পাশের ঘরেই রয়েছে, যে ভাই আমার মঙ্গলের জন্যে আমারই দেওয়া আঘাত নিঃশব্দে সহ্য করে যায়। তুমি অসাধারণ জিৎ। তোমার তুলনা হয় না।

জিৎ সিং-এর বিস্ময় বৃদ্ধি পায়। একজন ধর্ষিতা রমণী যে এভাবে কথা বলতে পারে তার ধারণা ছিল না। মন তার বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়,—এসব কথা এখন বলে লাভ কি বোন? যা হবার তা তো হয়ে গেছে।

—কী হয়ে গেছে?

জিৎ সিং জবাব দিতে পারে না। জবাব দেবার কিছুই নেই তার। ওসব কথা কিভাবে বলতে হয় জানে না সে।

রানী তার মুখের দিকে চেয়ে আবছা অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে থাকে। তারপর সহসা চেঁচিয়ে ওঠে,—না জিৎ তা হয়নি। তুমি ভুল ভেবে বসে রয়েছে এতক্ষণ। আমি ঠিক আগের মতোই রয়েছি। আমি আগের মতোই পৃথ্বীরাজকে স্পর্শ করতে পারি। বাদশাহ্ আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারেননি।

জিৎ-এর মনে হল যে যেন স্বপ্নে শুনছে এসব কথা। ঘুম ভাঙলেই আবার সত্য ঘটনার রূঢ়তা তাকে আঘাত করবে। তাই সোজা হয়ে বসে সে দেখে, সত্যিই জেগে রয়েছে কি না

রানী বলে,–তোমায় আমি অবহেলা করতে পারি। কিন্তু ভুলে যাও কেন ভাই, তোমার আদেশ বা অনুরোধ সব সময়েই আমার শিরোধার্য। দেখবে? এই দেখো।

রানী তার কোমর থেকে ছোরা আর আফিমের কৌটো বের ক’রে জিৎ-এর হাতে দেয়। জিৎ সিং সেই দুটো জিনিস হাত দিয়ে ভালো ভাবে অনুভব ক’রে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, —তুমি আত্মরক্ষা করতে পেরেছ বোন?

—হ্যাঁ জিৎ। আজ আমি সসম্মানে গর্বের সঙ্গে নিজের স্বাধীন ঘরে ফিরে যাচ্ছি। এ তোমারই দান।

—বাদশাহ্ আহত?

—না জিৎ। তাঁকে আহত করবার প্রয়োজন হয়নি। তাঁর বুকের সামনে তুলে ধরেছিলাম আমার অস্ত্র। কে যেন আমার দেহ-মনে এনে দিল অসাধারণ বল আর অপরিসীম সাহস। এত বল আর এত সাহস নিজের মধ্যে কখনো অনুভব করিনি জিৎ। আমি স্পষ্ট দেখলাম, আমার পাশে সহসা এসে দাঁড়ালেন সিংহের ওপর আরূঢ় স্বয়ং দেবী। বাদশাহ্ সেই মূর্তি দেখতে পেলেন জিৎ। কারণ তিনি চমকে উঠে চোখ বন্ধ করলেন। তারপর ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে অত্যন্ত বিনীতভাবে আমায় বাইরে যাবার পথ দেখিয়ে দিলেন।

—কোথায় এ সব ঘটল বোন?

—কোথায় ঘটল আমি জানি না। নিজের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ একদল আমীর ওমরাহের ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। কিছুতেই নিজেকে বের ক’রে আনতে পারলাম না সেই ভিড়ের ভেতর থেকে। ওইভাবে গণ্ডিবদ্ধ অবস্থায় আমি গিয়ে পৌঁছলাম বাদশাহের সামনে। আমার মনে হয়েছিল প্রথমে, ওরা যেন আপন খেয়ালে পথ চলছে। পরে বুঝলাম, সব কিছুই সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয়েছে বাদশাহের নির্দেশে।

জিৎ সিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,–আমার একটা প্রধান দুশ্চিন্তার অবসান হল আজ।

—হ্যাঁ। এই দুশ্চিন্তা বহুদিন ধরে তোমাকে স্থির থাকতে দেয়নি। আজ আমি মর্মে মর্মে একথা অনুভব করছি। তাই প্রশ্ন করি কবে তুমি সঠিকভাবে জানতে পারলে এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে? কোথায়? কী ভাবে?

জিৎ একটু থেমে বলে,—সবই অনুমান বোন

—আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড় জিৎ।

—সুবিধেমতো তুমি তোমার বয়সের সুযোগ নাও। এ তোমার অন্যায়। এই যে বাড়ি এসে গেল। নিশ্চিন্তে ঘুমোও গে। অনেক ঝড়-ঝাপ্‌টা গেছে তোমার মনের ওপর।

—না। আমার প্রশ্নের জবাব না পেলে নিজেকেও ঘুমোবো না, তোমাকেও আজ ঘুমোতে দেব না। তুমি আজ রাতে এখানেই তো থাকবে।

জিৎ সিং-এর কণ্ঠস্বর ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে ওঠে। সে বলে, –এর জবাব তুমি জীবনে কখনো পাবে না। কারণ, এর ওপর তোমার সারা জীবনের শান্তি নির্ভর করছে। তোমার সম্মান রাখা আমার যেমন কর্তব্য, তোমার জীবনে শান্তি যাতে অটুট থাকে, সেটুকু দেখাও আমার তেমনি কর্তব্য। শত রজনী আমায় জাগিয়ে রেখেও এর জবাব তুমি পাবে না।

রানীর মুখ গম্ভীর হয়। কিন্তু সে কিছু বলে না। জিৎ-এর চরিত্র সে ভালোভাবেই জানে! জিৎ যতুটুকু নিজে থেকে প্রকাশ করতে চায় ততটুকু শোনাই ভালো। সে যে-কথা বলতে না-চায়, সে কথা শোনবার কৌতূহল অদম্য হলেও শোনা উচিত নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *