ফতেপুর সিক্রি – ৩

৩.

সে আস্তে ডাকে উধমের নাম ধরে।

লাফিয়ে ওঠে উধম। জিৎ-এর কণ্ঠস্বর কানে যেতে এগিয়ে আসে তার কাছে।

—ওখানে একা একা বসে কি করছ উধম?

—ভূত তাড়াচ্ছি।

—তাড়াও। ঠিক চিঠিখানা পাঠিয়েছ কিকাকে?

—তক্ষুনি। কিছু ভেবো না।

—জিৎ সিং একটু বিষণ্ণ হেসে বলে,—প্রিয়ার সঙ্গে দেখা করে এলাম।

উধমের চোখে কৌতূহল ফুটে ওঠে মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু কথার মধ্যে কৌতূহল প্রকাশ করা তার স্বভাব নয়। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,—সুসংবাদ বলতে হবে।

—কোথায় দেখা হল, আন্দাজ করতে পার?

—পথে ঘাটে হবে হয় তো।

—উহুঁ! তার নিজের বাড়িতেই।

—অসাধ্য সাধন করেছ বলতে হবে। তবে তোমার পক্ষে নতুন কিছু নয়।

—–কাল আমি আসব উধম। রানীর সঙ্গে জরুরী কথা আছে। খুব জরুরী।

—প্রিয়া কিছু বলেছে বুঝি?

—না। তবে তার বাড়ি থেকেই জেনেছি।

—উচিত মনে করলে, আমাকেও বলো।

—বলব।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে সরাইখানার দিকে চলে যায়। সে উধমের কথা ভাবতে ভাবতে চলে। লোকটির মধ্যে দয়া মায়া মমতা সবই রয়েছে, অথচ কিছুরই বহিঃপ্রকাশই নেই। অনেক সাধনার পর অন্তরের ভাবাবেগকে এভাবে সংযত রাখা সম্ভব। সারইখানায় ফিরতে মাধবের কথা প্রথম মনে হয় তার। এতক্ষণের মধ্যে একবারও তার কথা মনে হয়নি। অথচ তাকেই অনুসরণ করে আজ সে এতগুলো ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়েছিল। মাধব যদি আজ ওভাবে সরাইখানা ছেড়ে চলে না যেত, তাহলে আগামী নওরোজের দিনের জন্য সেই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা তার অজানাই থেকে যেত। মাধব যদি বাদশাহী মহলে প্রবেশ না করত, তবে ফটকের সেই চেনা প্রহরীটির সঙ্গেও সাক্ষাৎ হত না তার। আর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে প্রিয়ার সঙ্গে এমন আচম্বিতে দেখা হয়ে যেত না। সে জানতে পারত না মুঘল দরবারের এক অতি সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষের কন্যা তাকে সত্যই ভালোবাসে, যে ভালোবাসা হিংসা দ্বেষ হীনতা ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এক স্বর্গীয় স্তরে এসে উপস্থিত হয়েছে। মাধবের জন্যে আজ সে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেল। সে বুঝতে পারল ভালোবাসার প্রতিদানে ছলনা করা সম্ভব নয়। ভালোবাসার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার সম্ভব নয়। তাই আজ সে পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে এসেছে চিরকালের জন্যে। প্রিয়ার সামনে আর কোনোদিনও সে গিয়ে দাঁড়াবে না। তার জন্যে যদি মেবারের ক্ষতি হয়, উপায় নেই।

মাধবকে সে ভর্ৎসনা করবে না। মাধব নতুন কাজের খোঁজ করছে বাদশাহী মহলে। করবেই তো। জীবনে নিজের উন্নতি কে না চায়? সবাই দেশের চিন্তায় নিজের সুখ নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে না। দিতে পারলে মানসিংহ পৃথ্বীরাজ প্রমুখ বীরেরা এসে মুঘল দরবারের শোভাবর্ধন করতেন না।

স্বার্থপর হতে হতে শেষে মানুষ এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে যে নিজের ভাগিনেয়ী, নিজের কন্যাকে অবধি তখন পর বলে মনে হয় তার কাছে। তাদেরও যে আত্মা রয়েছে, প্রাণ রয়েছে একথা সে ভুলে যায়। তাদের আত্মা, তাদের দেহ, তাদের গৌরব ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে সম্পদ, সম্মান, প্রতিপত্তি আর নিরাপত্তা লাভের জন্যে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় যখন পৌঁছোয় মানুষ, তখন তার সঙ্গে পশুর পার্থক্য থাকে শুধু চেহারায়। মানুষের স্বার্থপরতার এই সুযোগ নিয়েই মুঘল হারেম দিনের পর দিন জমজমাট হয়ে উঠছে আর মুঘল রাজত্ব বিস্তৃত হতে হতে পশ্চিম আর দক্ষিণে সমুদ্রতটে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে।

মাধবকে সে কিছুতেই তিরস্কার করবে না।

সরাইখানায় প্রবেশ করতেই বাতি হাতে মাধব এগিয়ে আসে। জিৎ সিং মাধবের অপরাধী ভাব লক্ষ্য করে। সে মনে মনে হাসে।

মুখে বলে—সব ঠিক আছে তো মাধব?

তার শান্ত স্বরে মাধব রীতিমতো বিস্মিত হয়। সে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,—হ্যাঁ। সন্ধের পরে একজন রাজপুত এসেছে সরাইখানায়। সিক্রিতে নতুন।

—ভালোভাবে দেখাশোনা করেছ তো?

—হ্যাঁ। একেবারে কম বয়স।

—কার?

—ওই রাজপুতের। দাড়ি-গোঁফও ওঠেনি

—একা এসেছে?

—হ্যাঁ। বলল, কিছুদিনের মধ্যেই ওর বাবাও আসবে। সিক্রিতে কাজ নেবে।

—তা তো নেবেই। সিক্রি ছাড়া সারা হিন্দুস্থানে কাজ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন্ ঘরে আছে ছেলেটি?

—একেবারে কোণের ছোট ঘরটায়।

—চল, দেখে আসি।

—কপাট বন্ধ করে দিয়েছে সে। বলল, অনেক দূর হেঁটে এসেছে। খুব ক্লান্ত। অল্পকিছু খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে।

—ঘোড়া নেই সঙ্গে?

—না।

—সে কি?

—বলল, কোনো ব্যবসায়ীর গাড়ি আসছিল সিক্রিতে। সেই গাড়িতে ওর বাবা তুলে দিয়েছিল। সেই গাড়ি সিক্রির কাছাকাছি এসে অচল হয়ে যায়। তার একটি ঘোড়া মরে যায়। সেখানে থেকে হেঁটে আসছে।

—আচ্ছা যাও।

মাধব বাতি হাতে কিছুদূর যেতেই জিৎ সিং আবার তাকে ডাকে। সেই ডাক মাধবের কানে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে বাতিসুদ্ধ তার হাতখানা ভীষণভাবে কেঁপে উঠে। সে কাঁপুনি জিৎ-এর নজর এড়ায় না।

মাধব আবার কাছে এসে দাঁড়ালে তার রক্তশূন্য মুখের দিকে চেয়ে জিৎ বলে,—অত ভয় কিসের মাধব? এখানেও রহিমবক্স এসেছে নাকি?

—অ্যাঁ? না।

—তোমার গলা কাঁপছে কেন?

মাধবের চোখ ফেটে জল বার হয়।

—কথায় কথায় কেঁদো না মাধব। এখানে কাজ করতে ইচ্ছে না হলে সোজা আমায় বলবে সেকথা। এতে ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমায় ছেড়ে দেব। কিছু মনে করব না।

—আমি কোথাও যাবো না।

জিৎ-এর রাগ হয় মনে মনে। কুসংসর্গে কিছুদিন থেকে ছেলেটি সরলতা হারিয়ে ফেলেছে। সে বলে,–কেন? বাদশাহী মহলে?

—অ্যাঁ।

—শুনতে পাওনি আমার কথা? বাদশাহী মহলে কাজ পেতে পারো না?

—না।

—সেই কথাই আজ বললেন বুঝি সালিমা বেগম?

মাধবের হাতের বাতি মাটিতে পড়ে যায়। সে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, —আমার কোনো দোষ নেই। সত্যিই আমার কোনো দোষ নেই।

জিৎ সিং বাতিটা তুলে বলে,—দাঁড়াও সোজা হয়ে। আমি জানি তোমার কোনো দোষ নেই। ভালোকাজের খোঁজ করায় কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু সেকথা স্পষ্ট ক’রে আমায় বললেই পার। যদি কাজের তদ্বিরের জন্যে প্রাসাদে যাবার প্রয়োজন হয়, আমায় বলবে। আমি ছেড়ে দেব। মাধবের কান্না সহসা থেমে যায়। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিৎ-এর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তার দৃষ্টিতে আবার ফুটে ওঠে সেই আগের চতুরতা। সে তাড়াতাড়ি ঘাড় কাত ক’রে হেসে বলে,—আচ্ছা।

পরদিন সকাল হতেই জিৎ দেখে মাধবের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। তার সেই অপরাধী ভাব অদৃশ্য হয়েছে। সে স্ফূর্তির সঙ্গে কাজ করছে। মনে মনে ভাবে জিৎ, অন্য চাকরি নেবার ব্যাপারে স্বাধীনতা পেয়েই মাধবের উৎসাহ বেড়েছে। সে জানে, যখন খুশি হবে এ-কাজ ছেড়ে দিতে পারবে।

কিন্তু মাধবকে নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। তার আসল কর্তব্যই রয়েছে বাকি। পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি যেতে হবে। দেখা করতে হবে তার বোনের সঙ্গে।

তার আগে একবার নতুন রাজপুত বালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে মন্দ হয় না। অতটুকু কিশোরকে সিক্রির মতো জায়গায় একা আসতে দিতে সাহস পায় যে মানুষ, সে নিশ্চয়ই মাধবের বাবার মতো অত দরিদ্র কিংবা তার রয়েছে প্রচণ্ড সাহস। জিৎ সিং কোণের ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। একটু অবাক্ হয়। বেলা কম হয়নি। এখনো দরজা খোলেনি কেন?

ধাক্কা দেয় জিৎ সিং।

ভেতর থেকে প্রশ্ন হয়,–কে?

কণ্ঠস্বর শুনে জিৎ বোঝে কিশোরই বটে। বালকত্বের সীমা ছাড়ালে যে গাম্ভীর্যটুকু আসে কণ্ঠে সেই গাম্ভীর্য হয়েছে।

—দরজা খোলো। আমি সরাইখানার মালিক।

—এখন খুলব না।

—অনেক বেলা হয়েছে।

—বাবা বলে দিয়েছে, সিক্রিতে খারাপ লোকের অভাব নেই। খুব সাবধানে থাকতে হবে। জিৎ সিং একা একাই হেসে ওঠে। তারপর বলে,—তাই বলে দরজা বন্ধ ক’রে থাকবে?

—হ্যাঁ। খাবার সময় শুধু খাব।

—ওভাবে থাকলে মরে যাবে।

—মরে যাই যাব। আমি তোমার ঘর ভাড়া নিয়েছি, পয়সা দেব, ব্যস্। আমায় তো তাড়িয়ে দিতে পারবে না।

—না। তাড়াব কেন? আমিও যে রাজপুত।

—নাম কি?

—জিৎ সিং।

—নামটা খুব জানা। অনেক রাজপুতের আছে এ-নাম।

—তা আছে, দরজা খোলো।

—তুমি সত্যিই ভালো লোক তো?

—ভালো কি না কি ক’রে বলব? নিজেকে তো সবাই ভালো বলে।

—মানে চোর ডাকাত নও তো?

জিৎ সিং এক চোট হেসে বলে,—না না, খোলো শিগগির। আমার অন্য অনেক কাজ আছে।

—তবে সেই কাজগুলো আগে সেরে এলে না কেন বাপু?

—ছিঃ, পাগলামি করো না। সরাইখানার কে কে এল আমায় দেখতে হয়।

—আচ্ছা দাঁড়াও। পাগড়ীটা বেঁধে নিই আগে।

—পাগড়ী? এখন পাগড়ী বেঁধে কি করবে?

—বাবার হুকুম। বাবা বলে দিয়েছে। সিক্রিতে পাগড়ী বেঁধে না চললে লোকে মুঘল ভেবে মোগলাইখানা খাইয়ে দেবে।

একথার আর জবাব দিতে পারে না জিৎ। কারণ নিঃশব্দে হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরে যায়। তার ভয় হয় হাসির শব্দ শুনতে পেলে ছেলেটি আবার বেঁকে বসবে।

দরজা খোলার শব্দ হতেই জিৎ থেমে যায়। সে দেখতে পায় দরজা খুলে দিয়ে ছেলেটি আবার শয্যার ওপর গিয়ে বসে।

—একি? জানালা বন্ধ ক’রে রেখেছে কেন?

—নতুন জায়গা যে।

—তাই বলে অন্ধকার ক’রে রাখবে? আমি খুলে দিচ্ছি।

—না না, খুলো না। আমি নিজেই খুলব।

জিৎ সিং ছেলেটির দিকে চায়। আবছা অন্ধকারেও তার ঋজু-দেহ আর শক্ত বাঁধুনি জিৎ-এর চোখ এড়ায় না। ভবিষ্যতে বলবান পুরুষ হতে পারবে। তার চাহনি দেখে ছেলেটি মুখ নিচু করে।

—তোমার নামটি কি?

—বিজয়।

—বাঃ, সুন্দর নাম তো?

—হ্যাঁ।

—তা, অত লাজুক কেন?

—বাবা বলেছে লাজুক হওয়া ভালো একটু।

বাবা সে কথাও বলে দিয়েছে? বাবা কোন্ কথা বলে দেয়নি ভাই?

ছেলেটি গোঁজ হয়ে নিচের দিকে চেয়ে বলে,—তুমি ঠাট্টা করছ। আমি ঠাট্টা পছন্দ করছি না।

—আচ্ছা আর ঠাট্টা করব না। তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ হল। যেমন সুন্দর নাম, তেমনি সুন্দর ছেলে। আবার পরে আসব।

—না, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তুমি আর এসো না।

—বেশ, তাই হবে। আমি আসব না। তুমি আমার সরাইখানায় রয়েছে। তোমার সুবিধে তো দেখতে হবে। কোনো অসুবিধে হলে জানিও।

ছেলেটি তেমনি বসে থাকে।

জিৎ সিং ঘর ছেড়ে চলে যায়। ভাবে এত সঙ্কোচ এত দ্বিধা যে ছেলের তাকে একলা সিক্রির মতো জায়গায় আসতে দেয় কেমন বাবা।

পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়িতে এসে পৌঁছোতেই উধম জানায় কর্তা বাড়িতে নেই। জিৎ সিং জানত এ সময়ে পৃথ্বীরাজ বাড়ি থাকেন না। দরবারে যান। তবু উধমের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে সে ভেতরে যায়।

জিৎ সিং মনে মনে ঠিক ক’রে এসেছে, সব কথা সে তার বোনকে জানাবে না। শুধু সাবধান করে দেবে নওরোজের ব্যাপারে। কারণ এমন একটি অবিশ্বাস্য কথা বললে, জিৎ সিং-এর ওপর তার ধারণা হয়তো পালটে যাবে। জিৎ সিংকে অবিশ্বাস ক’রে ফেলবে। বাদশাহ্ তার স্বামীর প্রতি কতটা সদয় সে জানে। তাছাড়া জিৎ সিং যে গোপনে প্রিয়ার বাড়িতে গিয়ে বাদশাহের আলোচনা সহসা শুনে ফেলেছে, একমাত্র উধম ছাড়া আর কারও কাছে একথা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার চাইতে শুধু একটু সাবধান ক’রে দিলে কাজ হতে পারে। অনেক কৈফিয়ত থেকে সে বেঁচে যাবে তাতে।

রানী জিৎকে দেখে হেসে বলে,—সরাইখানায় বুঝি খুব ভালো রান্না হয় জিৎ? –কেন? একথা বললে কেন?

—বোনের বাড়িতে যে একদিনও খেতে চাও না।

—বোনও তো ভাই-এর সরাইখানায় একদিনও পদার্পণ করে না।

রানী বিস্মিত হয়ে বলে,—ওই সরাইখানায়?

—হ্যাঁ। ওটা যে আমার বাড়িও।

—না। তুমি নিজের বাড়ি কর। আমি যাব, নিশ্চয় যাব। দিনের মধ্যে হাজার বার যাব।

—সেই চেষ্টাই করব তাহলে।

—হ্যাঁ। আর সেই সঙ্গে একটি সুন্দর দেখে বউ।

সিক্রিতে এসে লীলাবতীর সব কথা রানীকে বলেছে জিৎ। শুধু বলেনি, কেন তাদের মিলন হল না। লীলাবতীর কথা জানাবার পরও রানী প্রায়ই তাকে বিয়ের ব্যাপারটা ঠাট্টা করে। সে জানে, লীলাবতীর প্রতি তার প্রেম কত গভীর, তবু বলতে ছাড়ে না। সে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে, পুরুষমানুষকে অত সহজে পরাজয় স্বীকার করতে নেই। একটি নারী পুরুষমানুষের সব কিছু ব্যর্থ ক’রে দিতে পারে না। তাকে এগিয়ে যেতে হয়।

—বউ? আমাকে পছন্দ করবে নাকি কেউ?

—ইস্। খুব যে গর্ব দেখছি। কেন, ঠিকই তো আছে। এবার গিয়ে প্রস্তাব ক’রে ফেল না? টুকটুকে বউও মিলবে, অগাধ ধন-সম্পত্তিও মিলবে।

জিৎ সিং কৃত্রিম উদাসীনতার ভান ক’রে বলে,—সে চলে গেছে বহুদূর।

রানী প্রথমে ভাবে, লীলাবতীর কথা বুঝি বলছে জিৎ। তারপর বুঝতে পেরে প্রশ্ন করে, -বহুদুর? কোথায় গেল আবার?

—কেন? আমাদের সীমানার বাইরে, বাদশাহী মহলের মধ্যে।

—তা হোক। তবু তাকে লাভ করা এমন কিছু শক্ত নয়। অন্তত তোমার পক্ষে।

জিৎ সিং কিন্তু এ বিষেয় তার ঠাট্টা-তামাশার জের বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। পারে না দুটি কারণে। প্রথমত লীলাবতী তার মনের মধ্যে একই ঔজ্জ্বল্য নিয়ে চিরকাল বিরাজ করবে। দ্বিতীয়ত, প্রিয়ার আসল পরিচয় লাভের পর তার সম্বন্ধে কোনোরকম হাল্কা আলোচনায় যোগদান করা তার পক্ষে অসম্ভব।

তাই জিৎ গম্ভীর হয় রানীর কথা শুনে। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

রানী তার কাছ এসে হাত ধরে বলে,– আমায় ক্ষমা করা ভাই। সব কিছু জেনেশুনে এভাবে কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। তবু, না বলে থাকতে পারি না। আমি যে তোমার বোন। ভাই-এর শুকনো মুখ দেখে কোনো বোন স্থির থাকতে পারে?

—তোমার কোনো অন্যায় হয়নি। আমিও তোমরা সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথা চালিয়ে যেতে পারি। তবে মাঝে মাঝে কেন যেন ইচ্ছে করে না। তোমার সামনে বিশেষ ক’রে এই অনিচ্ছা জাগে। তুমি যে সব জান। তোমার কাছে কিছুই লুকোবার নেই।

—আমি প্রায়ই একথা ভাবি ভাই, লীলাবতী কেন তাড়াহুড়ো ক’রে বিয়ে ক’রে বসল। আর কিছুদিন কি সে অপেক্ষা করতে পারত না? কালপীর সর্দারকে বুঝিয়ে বললে সে কী রাজি হত না।

জিৎ সিং একটু ঘুরিয়ে বলে,—রাজি হলেও, সে রাজিতে তার অন্তরের সায় থাকত না। সব সময় তার ভয় ছিল, যে-কোনো মুহূর্তে মৃত্যু এসে তাকে হাতছানি দেবে। গোপাল সিংকে প্রদত্ত আশ্বাসের দাম থাকবে না। তাই জয়পালের সঙ্গেই বিয়ে দিল।

—আর তুমি? তুমিই বা কেন চলে এলে উদয়পুর ছেড়ে?

—সেকথা তো বহুদিন আগেই বলেছি।

—হ্যাঁ বলেছ। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আমার বিশ্বাস তোমাদের দুজনার জীবন নষ্ট হবার মূলে রয়েছে তোমাদের হটকারিতা।

—এখন আর ওসব কথা বলে লাভ নেই বোন।

রানী চুপ ক’রে যায়। জিৎ সিং ঠিকই বলেছে। অতীতকে নিয়ে টানাটানি করার কোনো অর্থ নেই। কিছুটা সময় চুপ ক’রে কেটে যায় দুজনার। বাইরের খোলা জায়গায় উধম খুব মনোযোগের সঙ্গে একটি ঘোড়ার গাত্র মার্জনা করছিল। জিৎ সিং সেদিকে চেয়ে ভাবে, ওই লোকটিকে দেখলেই একসঙ্গে শ্রদ্ধা আর অনুরাগ এসে তার মনকে আপ্লুত করে। সে নির্নিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।

রানী সহসা বলে ওঠে, নওরোজের কেমন আয়োজন চলছে জিৎ?

—হ্যাঁ নওরোজ। এই নওরোজের ব্যাপারেই আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

—নওরোজের ব্যাপারে? কেন?

—এবারে মীনাবাজারে তুমি যাবে বোন?

—কেন যাব না? প্রতিবার গিয়ে থাকি।

—প্রতিবার যাও। কোনোই সন্দেহ নেই তাতে। গত বছর আগ্রায় থাকতে আমিই তোমায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম, তোমার দোকানের জিনিসপত্র সমেত। বালার মসলিন বিক্রি করেছিলে তুমি। প্রশংসাও পেয়েছিলে। কিন্তু এবারে তুমি যেও না।

রানীর মুখ চোখ দেখে মনে হয়, সে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছে। কোনোমতে সে বলে,

—কেন?

—আমার অনুরোধ।

—এমন অনুরোধ তুমি করছ কেন জিৎ আর এই অনুরোধ আমি রাখবার চেষ্টা করলে রাজাই বা ভাববে কি, বাদশাহই বা কি মনে করবেন।

—তুমি শয্যায় শুয়ে থেকো সেদিন। বলবে, ভীষণ মাথার যন্ত্রণা হয়েছে।

—সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্য শালিবাহন এসে উপস্থিত হবেন। খুঁটিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তাঁর চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয় জিৎ কিন্তু কেন? কেন তুমি মীনাবাজারের ব্যাপারে এত চিন্তিত হচ্ছ?

—তুমি জান না?

রানী কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে শান্তস্বরে বলে,—জানি। কে না জানে? সারা হিন্দুস্থানের সবাই জানে এইদিন অনেক রমণী বাদশাহের কামনার বলি হয়। খুবই খারাপ, খুবই ঘৃণ্য কাজ এটি। যে বাদশাহের গুণের অন্ত নেই, এই একটি দোষ তাঁর সব গুণকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলে। অথচ নিরুপায় সবাই। প্রতিবাদ করার শক্তি বা সামর্থ্য কারও নেই। কিন্তু তুমি ভুল করছে জিৎ। আমাকে ওই ভাগ্যহতা নারীদের দলে টেনো না। আমি বীর পৃথ্বীরাজ রাঠোরের পত্নী। আমি মেবারের কন্যা।

—তাতে কি এসে যায় কিছু?

—নিশ্চয়। বাদশাহ্ আমাকে শ্রদ্ধা করেন।

জিৎ সিং-এর মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। তার কানে ঝংকৃত হয় বীরবলের গৃহে বাদশাহের উক্তিগুলি।

সে রানীর দিকে চেয়ে বলে,—যদি আমি অপ্রিয় বলি, কিছু মনে করো না। কামনার আগুনে অনেক শ্রদ্ধার জিনিসই পুড়ে খাক্ হয়ে যায়। এটি ভাবাবেগের কথা নয়, রূঢ় বাস্তব।

রানীর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। তার দৃষ্টিতে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। সে আস্তে আস্তে বলে, —আমি বিশ্বাস করি না।

জিৎ-এর ক্ষণেকের জন্যে মনে হয়, বাদশাহের সমস্ত কথাগুলো হুবহু শুনিয়ে দেয় রানীকে। কিন্তু তেমন ইচ্ছা দমন করা ছাড়া গতি নেই। তাই জবাবে সে বলে,–তোমার এই বিশ্বাস অটুট থাকলে আমার চাইতে কেউ বেশি খুশি হবে না।

এরপর দুজনা চুপচাপ বসে থাকে। কথা যেন ফুরিয়ে গেছে। উভয়ের অন্তরের যোগসূত্রও যেন সাময়িকভাবে ছিন্ন হয়ে গেছে।

শেষে এক সময়ে জি রানীর দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বলে,—আমি তোমার ভাই। আমি যত বড় স্বার্থপরই হেই না কেন, তোমরা কোনো অনিষ্ট আমি দেখতে চাই না। এ বিষয়ে মনে কোনো সন্দেহ পোষণ করো না কখনো।

—না জিৎ। সন্দেহ করার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তবে তোমার কথা শুনে আমার মন বিশ্রী হয়ে গেল। বাদশাকে অতিরিক্ত সন্দেহ করতে গিয়ে তোমার সূক্ষ্ম রুচিবোধ কোথাও যেন ব্যাহত হয়েছে।

—হয়তো তাই। তবে আমার একটি অনুরোধ অন্তত রেখো।

—মীনাবাজারে আমি যাবোই। তোমার সন্দেহ কত অসার, শুধু এইটুকুই প্রমাণ করতে এবারে মীনাবাজারে আমাকে যেতেই হবে

—যেও। বাধা দেবো না আমি। তবে একটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেও।

—কোন্ জিনিস?

—একটি ছোট্ট ছোরা। তোমার নিশ্চয়ই আছে। অনেক রাজপুত রমণীই এ জিনিস সঙ্গে রাখে।

রানী মাথা নীচু ক’রে থাকে।

—কথার জবাব দাও বোন। আমি তোমার কথা আদায় করে নিয়ে যেতে যাই।

—মীনাবাজারে সে-জিনিসও নিয়ে যাবার প্রশ্ন ওঠে না জিৎ। মীনাবাজার আনন্দের জায়গা, রক্তপাতের নয়।

—হ্যাঁ। মীনাবাজার আনন্দের জায়গা। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেই আনন্দের সব রসটুকু যদি একজন পান করবার চেষ্টা করে, তবে অনেক সময় রক্তপাত না ঘটালেও রক্তপাত ঘটাবার ভীতি প্রদর্শন না করলে মান বাঁচে না।

রানী হেসে বলে,–এ পর্যন্ত কোনো রমণীই বাদশাহকে সেই ভয় দেখায়নি জিৎ। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে, সারা দেহে একরাশ অমূল্য অলঙ্কার ধারণ ক’রে গর্বিত পদে গৃহে ফিরছে সেই সব রমণী।

—তুমি সেই দলে?

রানী ছিকে দূরে সরে গিয়ে চিৎকার ক’রে ওঠে, জিৎ।

—বোন, আমি তর্ক করবার জন্যে এখানে আসিনি। আমি শুধু এই অনুরোধটুকু করতে এসেছি। একলিঙ্গের দিব্যি দিয়ে বলছি, শুধু এইবারের মতো আমার অনুরোধ রাখো। আর কোনোবার বলতে আসব না। আর কোনোবার হয়তো দেখাও হবে না তোমার সঙ্গে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানী বলে,–বেশ।

জিৎ তার পোশাকের ভেতর থেকে একটি কৌটো বের করে। বীরবলের গৃহে বাদশাহ যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে এটিকে তুলে নিয়েছিল গতকাল। রানীর দিকে কৌটোটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,—আর এটিও।

—কী ওটি?

—আফিম।

—কোথায় পেলে তুমি?

—ঘটনাচক্রে আমার হাতে এসে গেছে। এটিও সঙ্গে রেখো। কারণ বাদশাহের ওপর অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নাও পেতে পার। নিজের বুকেও হয়তো বসাতে সময় পাবে না বাদশাহের তৎপরতায়। তখন এই কৌটো থেকে একদলা নিজের মুখের মধ্যে ফেলে দেওয়া এমন কিছু কঠিন হবে না।

জিৎ সিং-এর দিকে অবাক্ দৃষ্টিতে একবার চেয়ে সেটিও হাতে নেয় রানী। জিৎ ভাবে, রানী যদি তার দলের কেউ হত, তবে কোনোরকম অন্যায় না করেও মুঘল বাদশাহকে হত্যার সুযোগ মিলত। নিজের সম্মান রক্ষার্থে যে-কোনো নারী পুরুষকে হত্যা করতে পারে।

কিন্তু ওকথা ভেবে লাভ নেই। রানী তার দলের কেউ নয়। রানীকে সে গুপ্তচরে পরিণত করতে পারে না। রানী যেন কোনোদিন ধারণাও না করতে পারে যে, তার রাখীবন্ধনের ভাই কোন্ কাজে প্রবৃত্ত রয়েছে মুঘল রাজধানীতে।

.

বাদশাহী মহলের চত্বরে অজস্ব দোকানপাট উঠেছে। সেগুলিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হল। পৃথ্বীরাজ রাঠোর কদিন ধরে তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে পত্নীর এই দোকানটি সযত্নে সাজিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ধারণা এবারও বাদশাহের প্রশংসা লুটবে তাঁর প্রিয়তমার দোকানটি। কারণ এবারে তিনি অনেক কষ্ট স্বীকার করে দক্ষিণ দেশ থেকে আনিয়েছেন চন্দন-কাঠের বহুবিধ দ্রব্য। সেই সব দ্রব্যে যে সূক্ষ্ম কারুকার্য রয়েছে, বাদশাহের মতো ব্যক্তিও খুব বেশি দেখেননি তেমন জিনিস

রানীর সঙ্গে জিৎ-এর দেখা হয়েছে বহুবার। প্রতিবারই জিৎ মনে করিয়ে দিয়েছে ছোরা এবং আফিমের কৌটোর কথা। শেষের দিকে রানী রীতিমতো বিরক্ত হয়েছে। অনেক সময়ে কথার উত্তরও দেয়নি। জিৎ মনে মনে দুঃখ পেয়েছে, মুখে কিছু প্রকাশ করেনি। মুখে প্রকাশ করলে হয়তো তার সঙ্গে সম্পর্কও চুকিয়ে দেবে রানী। রক্তের সম্বন্ধ নেই তাদের। একটি সামান্য সুতোর রাখীর জোর রক্তের চেয়ে বেশি হতে পারে না।

উধমকে সব কথা বলেছে জিৎ। শুনে উধম কোনোরকম মন্তব্য প্রকাশ করেনি। নওরোজের দিন সকালে উধম জিৎ সিং-এর কাছে এসে বলল যে, উদয়পুর থেকে তার লোক ফিরে এসেছে। কিকার হাতে পত্র পৌঁছেছে। তিনি পত্র পেয়ে খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন। যে ক্ষুদ্র সৈন্যদল অনেক চেষ্টায় তিনি গড়ে তুলেছেন, তাই দিয়েই চিতোরের আশেপাশে আক্রমণ চালাবেন।

জিৎ সিং আনন্দে আত্মহারা হয়। সে মনে মনে কল্পনা করে এতক্ষণে হয়তো চিতোরের মুঘল সৈন্যরা ঘুম ভেঙে শুনেছে গ্রাম এবং প্রান্তর অতিক্রম ক’রে এগিয়ে আসছেন মেবারের নবীন রানা বীর প্রতাপ সিংহ।

উধমের সামনে বসে জেগে স্বপ্ন দেখে জিৎ। চিতোরকে রাহুমুক্ত করা কি সম্ভব হবে না কিকার পক্ষে?

জিৎ-এর স্বপ্ন ভাঙে উধম চলে যাবার আরও অনেক পরে। সে দেখতে পায় গগ করতে করতে মাধব এগিয়ে আসছে তারই দিকে। স্বপ্ন থেকে একেবারে বাস্তবের শক্ত মাটির ওপর পড়ে সে।

—কি হয়েছে মাধব?

—ওই ছেলেটির কথা বলছি। কোণের ঘরে রয়েছে যে।

—কী হয়েছে তার?

—আমার ধারণা ও বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। নইলে এতদিনের মধ্যে ওর বাবা তো এল না?

—হয়তো কোনো কাজে আটকে পড়েছে।

—আমার বিশ্বাস হয় না। আপনি একটু খোঁজ করবেন?

—কি লাভ? আমার দেখবার দরকার কি অত? যতদিন পয়সা দিচ্ছে, ততদিন ঠিক আছে।

—কিন্তু বড় বেশি পেছনে লাগছে আমার?

—তোমার পেছনে লাগছে? ঘর ছেড়ে বের হয় তাহলে?

—হবে না কেন? শুধু বড়দের কাউকে দেখলে ঘরের কপাট বন্ধ ক’রে দেয়।

—জানি। সিক্রির লোকদের বিশ্বাস করে না ও।

—সারা সময়টা সরাইখানার ভেতরে ঘুরঘুর করে, আর আমার পেছনে যেন বেশি ঘোরে।

—তোমার কম বয়স দেখে বোধ হয় আলাপ করবার ইচ্ছে।

—না। আলাপ করবার ইচ্ছে ওর একটুও নেই।

—তবে তোমার পেছন ঘুরবে কেন?

—কী জানি? বুঝতে পারি না। ওকে আপনি চলে যেতে বলুন।

—সে কি? যাবে কোথায়? সিক্রিতে হিন্দুদের জন্যে আর একটিও সরাইখানা খোলেনি এখনো।

—তা হোক। আপনি চলে যেতে বলুন। আমার মনে হয় ও খুব খারাপ। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।

—উদ্দেশ্য? ওই রকম ভীতু ছেলের? আচ্ছা, চল দেখি একবার!

জিৎ সিং মাধবকে নিয়ে ছেলেটির ঘরের কাছে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। সে ধাক্কা দেয়।

—কে?

—আমি জিৎ সিং।

—এই সাত সকালে আবার কি হল?

—কপাট খোলো। কথা আছে।

—পরে খুলব।

—এখুনি খোলো। জরুরী দরকার।

—না।

জিৎ সিং চেঁচিয়ে বলে,—তাহলে এই সরাইখানা ছেড়ে চলে যাও।

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর উত্তর আসে—চলে যাব? কোথায় যাব?

—যেখানে খুশি। আমি তার কি জানি?

—বাঃ। খুব আক্কেল দেখছি?

রাগে জ্বলে ওঠে জিৎ সিং। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে,—বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও। কথা বলতে শেখোনি?

ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় না। জিৎ সিং বুঝতে পারে ছেলেটি ভয়ে কাঁপছে। কারণ কথায় সে যত বড় ওস্তাদই হোক, আসলে ভীতু।

কিছুক্ষণ পর করুণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,—আমাকে কি সত্যি সত্যিই চলে যেতে বলছ? আমি আর কখনো এ ভাবে কথা বলব না।

মায়া হয় জিৎ সিং-এর। শান্ত কণ্ঠে বলে,—কপাট খোল তবে।

খুলে যায় কপাট। ভেতরে তেমনি অন্ধকার। ছেলেটি প্রথম দিনের মতোই নিজের শয্যার ওপর বসে।

মাধব এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবারে ফেটে পড়ে। বলে,–তোমায় আজ আমি ছাড়ছি না।

—কেন? আমি কি দোষ করেছি?

—আমার পেছনে লেগেছ।

—না তো!

—না? রান্নাঘরে গিয়ে কে উঁকি দেয়। আমি যখন মালিকের ঘর পরিষ্কার করি তখন তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখ?

—সেটা দোষের হল? আমি কাজ শিখতে চাই, সেটা দোষের?

—লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো কেন তবে? সামনে এলেই পার?

—তুমি যদি শেখাতে না চাও?

—ওসব চলবে না। এখানে থাকতে এসেছো, যতদিন ইচ্ছে থাকো। আমার কাজ দেখা চলবে না।

—বেশ। এবার থেকে ঘরে বসে থাকব।

জিৎ সিং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। এবারে বলে, —ঘরে বসে থাকার কথা বলছি না। তবে কাজের সময় ওকে বিরক্ত করো না।

মাথা হেলিয়ে ছেলেটি বলে,– আচ্ছা।

জিৎ সিং বেশিক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করে না। তার অন্য চিন্তা। মন পড়ে রয়েছে তার পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি। মাধবকে শান্ত হতে দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়। কারণ নওরোজের দিনগুলিতে সরাইখানায় ভিড় বাড়ে। একটু পরেই লোক আসতে শুরু করবে। এই সব ব্যস্ততার মধ্যে যদি মাধবের মেজাজ ঠিক না থাকে, তবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। তাই সে ফয়সালা ক’রে দিতে নিজে এসেছিল অল্প বয়সীদের ঝগড়ায়। নইলে ছেলেটির পাকা পাকা কথা সত্ত্বেও তাকে খুব খারাপ লাগে না জিৎ-এর। যদিও এপর্যন্ত ভালোভাবে তার মুখখানি দেখবারও সুযোগ মেলেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *