ফতেপুর সিক্রি – ২

২.

রাতের অন্ধকারে শিবিরের মধ্যে প্রত্যেকেই রঙিন নেশায় মেতে ওঠে। জিৎ সিং সাধারণ ব্যক্তি হয়েও, এইদিনের সবচাইতে খ্যাত ব্যক্তি হিসাবে তার স্থান হয়েছে বাদশাহের অনতিদূরে। মানসিংহের কাছ থেকে কয়েক হাত মাত্র দূরত্ব। মানসিংহ এর মধ্যে একটি কথাও বলেননি তার সঙ্গে। তাঁর মনে যেন কিসের দ্বন্দ্ব চলেছে। তিনি মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। নইলে জিৎ সিং আশা করেছিল, গর্দভের সংখ্যা দেখে সব বিরূপতা ভুলে গিয়ে তিনি কাছে ডাকবেন। তিনি তা ডাকলেন না।

শিবিরের মধ্যে এত কাছে বসেও তিনি একবার জিৎ সিং-এর দিকে চাইলেন না। অথচ রণথম্ভোরে এই মানসিংহই তাকে কতখানি বিশ্বাস করেছিলেন।

নেশা জমে ওঠে রাত গভীর হবার সঙ্গে সঙ্গে। জিৎ সিংই একমাত্র ব্যক্তি যে কিছু পান করেনি। সে নেশাগ্রস্তদের দিকে চায়। কেউ ঝিম্ ধরে বসে রয়েছে। কেউ বিজ্ঞের মতো হাসে। আবার কেউ কথায় চিৎকারে শিবিরকে জমিয়ে রাখছে। বাদশাহ্ শেষোক্ত দলের। তিনি রীতিমতো মাতাল হয়ে পড়েছেন। মাতাল হয়ে তিনি এক একজনকে এক একটি প্রশ্ন করেন। সেই প্রশ্নের তৎপর জবাব না পেয়ে ক্ষেপে ওঠেন। ছুটে গিয়ে মারতে চান। মানসিংহ তাঁকে কোনোরকমে সামলে রাখেন, আর রাখে সৈয়দ মুজফ্ফর।

সেই সময় বাদশাহ্ হঠাৎ আসন ছেড়ে উঠে এসে জিৎ সিং-এর সামনে দাঁড়ান। তার দিকে চেয়ে বলেন,—তুমি একজন বীর। আমি জানি তোষামোদের ধারে কাছেও তুমি যেতে পারবে না কোনোদিন। আমি তোমায় একটি প্রশ্ন করব। তার ঠিক জবাব চাই। দেবে কি না বল।

জিৎ সিং একবার সবার দিকে দৃষ্টি ফেলে। তারা ছবির মতো নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছে। কারণ এভাবে বাদশাহ্ সামনা-সামনি কারও সুখ্যাতি করেন না বড় একটা। তাছাড়া তোষামোদকে যে তিনি এত ঘৃণা করেন, একথাটা এমনভাবে প্রকাশ করেন না কখনো। নেশার ঘোরে প্রকাশ করে ফেলায় শিবিরের সবাই কেমন যেন দমে যায়।

জিৎ সিং শান্ত স্বরে বলে,—যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা থাকে, আমি সঠিক জবাবই দেব জাহাঁপনা।

—বহুত আচ্ছা। শোন। আজকের ঘটনা তোমার জানা রয়েছে। আগের অনেক ঘটনাও তুমি শুনে থাকবে আমার সম্পর্কে। এসব থেকে তোমার কি এই ধারণাই হয় না যে নিজের জীবন সম্বন্ধে আমার মায়া খুব কম?

জিৎ সিং একটু ভেবে নিয়ে বলে—নিজের জীবনের মায়ায় কোনো সংকল্প থেকে আপনি কখনো সরে আসবেন না। নিজের জীবনের মায়ায় কোনো আনন্দ থেকে আপনি কখনো বঞ্চিত হতে চাইবেন না জাহাঁপনা।

অধৈর্য হয়ে বাদশাহ্ বলে ওঠেন,—অত কথা আমি জানতে চাইছি না। আমি শুধু জানতে চাইছি নিজের জীবনের ওপর আমার কিছুমাত্র মায়া রয়েছে কি না। এক কথায় তার জবাব চাই। জিৎ সিং মাথা নীচু করে। দাঁত দিয়ে নীচের ওষ্ঠ চেপে ধরে সেই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে নেয়। তার মস্তিষ্কে একটি অতি কূট বুদ্ধি জেগে ওঠে। সে মুখ তুলে বলে,—নিজের জীবনের ওপর আপনার মায়া খুবই কম, প্রায় না থাকার মতো।

বাদশাহ্ আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠেন।

কিন্তু তাঁর হাততালি বন্ধ হয় জিৎকে আবার মুখ খুলতে দেখে। জিৎ সিং বলে,একটি বিষয় আপনাকে না জানালে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলা বাকি থেকে যায়।

—কোন্ বিষয়ে?

—যে সমস্ত বংশ হিন্দুস্থানে বহুদিন ধরে বসবাস করছেন সেই সব বংশের বীর পুরুষদের বিষয় আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে করি। কারণ নিজেদের জীবন সম্বন্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। এতটা নিরাসক্ত যে হেলায় সেই জীবনকে বিসর্জন দিতেও বাধে না। অতটা নিরাসক্ত আপনি চেষ্টা করলেও হতে পারবেন না জাহাঁপনা।

বাদশাহ্ ক্ষেপে ওঠেন,—পারব না? আমি পারব না? আলবত পারব। কী রকম নিরাসক্তির কথা তুমি বলছ বুঝিয়ে দাও।

—আপনি যদি আপনার ওই তলোয়ারটি খুলে নিয়ে উঁচিয়ে রেখে, ওইসব বংশের কোনো বীরকে ছুটে আসতে বলেন সেই উদ্যত তলোয়ারের অগ্রভাগের দিকে, তবে কোনোরকম দ্বিধা, কোনোরকম চিন্তা না করেই সে ছুটে আসবে। অসির অগ্রভাগ তার বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে পৃষ্ঠদেশ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এমন হামেশাই হয়েছে। এখনো হয়। আপনি কি তা পারবেন? হিন্দুস্থানে আপনার বাস তিন পুরুষের। আরও অন্তত কয়েক পুরুষ না গেলে ওইরকম নিরাসক্তি আসতেই পারে না আপনাদের রক্তে।

সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। মানসিংহ এতক্ষণে বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইলেন জিৎ সিং-এর দিকে। জিৎ সিং কিন্তু সে সমস্ত খেয়াল করে না। তার দৃষ্টি বাদশাহের দিকে। সে লক্ষ্য করে, তার কথার কী প্রতিক্রিয়া ঘটছে মত্ত বাদশাহের মনে।

এরপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যায়। বাদশাহ্ তাঁর অসিটি মানসিংহের পাশে শক্তভাবে খাড়া করে রেখে দ্রুত এগিয়ে যান বিপরীত দিকে। তারপর ছুটে আসেন সেই তলোয়ারের অগ্রভাগে নিজেকে বিদ্ধ করবার জন্যে।

জিৎ সিং-এর চক্ষুদ্বয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তবু সে সবার মতো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাধা দেবার জন্যে, যদিও সে বুঝতে পারে বাধা দেওয়া অসম্ভব।

কিন্তু সেই মুহূর্তে রাজা মানসিংহ ক্ষিপ্রগতিতে তাঁর ডান পা দিয়ে তলোয়ারটিকে ফেলে দেন। ফেলে দিলেও তার অগ্রভাগ আঙুলে লাগে। রক্তপাত হয় আঙুল থেকে।

বাদশাহ্ সেই রক্তপাতে ভ্রূক্ষেপ করেন না। তিনি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে দু’হাতে মানসিংহের টুটি চেপে ধরে তাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন। মানসিংহের চক্ষুদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হয়। একটু পরেই তাঁর শ্বাসরোধ হবে। তিনি মারা যাবেন।

জিৎ সিং ছুটে দিয়ে বাদশাহের হাত ধরে টানে। কিন্তু সেই হাত লোহার সাঁড়াশীর মতো শক্ত এবং তাতে অসীম বল। জিৎ সিং বিফল হয় প্রথম চেষ্টায়। শেষে মরিয়া হয়ে সে আর সৈয়দ মুজফ্ফর সজোরে টেনে ধরে বাদশাকে। মানসিংহ মুক্ত হন। তবু কিছুক্ষণ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন,–মানসিংহকে আমি ক্ষমা করব না। আমি ওর গর্দান নেব।

মানসিংহ গা ঝেড়ে উঠে বলেন,–আপনি কিন্তু ভুল করেছেন জাহাঁপনা। গর্দান আমার নেওয়া উচিত হবে না। গর্দান নিন এই বিশ্বাসঘাতকের।

জিৎ সিং কেঁপে ওঠে।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে মানসিংহ বলেন,–এই যুবক, বয়সে একেবারে নবীন। কিন্তু সিক্রিতে এর চেয়ে বড় শত্রু আর কেউ নেই। সারা হিন্দুস্থানে আছে কি না জানি না। এখন বুঝতে পারছি রণথম্ভোর অভিযানের পর ফিসফিস ক’রে যে কথা একান ওকান ঘুরে আমার কানেও এসে পৌঁছেছিল তার মধ্যে সত্য রয়েছে। সেদিন এই যুবকই আপনার ছদ্মবেশের কথা রাজারাও-এর খুল্লতাতকে জানিয়ে দিয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। আজ আবার এই যুবকই আপনাকে মত্ত অবস্থায় দেখে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আপনাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল আত্মহত্যা করবার জন্যে।

আমীর ওমরাহদের অস্ত্রের ঝনঝনানি সমস্ত বনভূমির স্তব্ধতাকে যেন প্রকম্পিত করে। ক্রোধ আর প্রতিহিংসায় তাদের অন্তর ফুলে ফুলে উঠেছিল। তারা চঞ্চল হয়ে ওঠে, বাদশাহের হুকুম উচ্চারিত না হতে দেখে।

জিৎ সিং-এর মুখ বিবর্ণ হয়। তবু নিজের আত্মসংযমের সবটুকু শক্তি ব্যয় ক’রে হেসে ওঠে। বাদশাহ্ও সে হাসিতে যোগ দেন।

সবাই বিমূঢ়। বাদশাহের হাসির ধরনে তাদের সব উদ্যম, আর উৎসাহ শূন্যে মিলিয়ে যায়। তারা হতবাক্।

বাদশাহ্ মানসিংহকে বলেন,—রাজা, আপনি সাহসী এবং বীর। বুদ্ধিমানও বটে। কিন্তু এই যুবকটির বেলায় আপনার বুদ্ধিকে নিয়ে বড় বেশি টানাটানি করেছেন। একে আমি চিনি। আমাকে হত্যা করার ইচ্ছে থাকলে, আজ গভীর বনের ভেতরে সে সহজেই সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারত। সেখানে কেউ ছিল না। কেউ জানত না কে আমায় হত্যা করল। আপনি যেকথা শুনেছেন, আমার কানেও তা এসেছে। শুধু সেই কারণেই আজ একে শিকারে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।

বাদশাহ্ মত্ত অবস্থাতেও তাঁর সঙ্গে জিৎ সিং-এর বনের মধ্যে সাক্ষাতের ঘটনা যথাযথ বর্ণনা করেন।

মানসিংহ মাথা নীচু ক’রে বসে পড়েন। অন্য সবাই আসন গ্রহণ করে।

জিৎ সিং আড়চোখে মানসিংহের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে। কিছুমাত্র বুঝতে অসুবিধা হয় না তার যে প্রমাণাভাবেই শুধু তিনি চুপ ক’রে রয়েছেন। মনেপ্রাণে বাদশাহের কথা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি।

হায় রাজপুত! হায় রাজোয়ারা!

.

লীলাবতীর কথা প্রতিটি দিনই বার বার মনে হয় জিৎ সিং-এর। তাকে রেখে এসেছিল সেই অচেনা রাস্তার ওপর। তারপর থেকে কোনো সংবাদই জানে না। সে নিরাপদে উদয়পুরে পৌঁছতে পারল কি না তাও বুঝতে পারে না। তার ঘোড়াটি রানা প্রতাপসিংহকে ফিরিয়ে দিয়েছে কি না তাই বা কে জানে। অথচ সে কথা দিয়েছিল উদয়পুরে পৌঁছেই লোক মারফত সংবাদ পাঠাবে।

দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় জিৎ সিং। কিন্তু চিন্তা করা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই তার। এখন তার পক্ষে সিক্রি ছেড়ে উদয়পুরে যাওয়া অসম্ভব। কারণ কিকা সিংহাসনে আরোহণের পর বাদশাহের মস্তিষ্ক রহস্যজনক হয়ে উঠেছে। যে-কোনো মুহূর্তেই তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান শুরু করতে পারেন। তবে ভরসা এই যে, নওরোজের দিন এগিয়ে আসছে। বেশি আর দেরি নেই। নওরোজের আগে অনিশ্চিত যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে অমন একটি দিন জীবন থেকে কমে যাবে বাদশাহের। অমন দিনকে কোনো কিছুর বিনিময়েই তিনি হারিয়ে ফেলতে রাজি নন, এ অভিজ্ঞতাটুকু জিৎ সিং-এর হয়েছে। কারণ আগ্রায় থাকতে জিৎ সিং লক্ষ্য করেছে নওরোজের অপেক্ষায় কতখানি ব্যাকুল হয়ে থাকতেন বাদশাহ্। সারা বছর ধরেই যেন এই বিশেষ দিনটির জন্য দিন গুনে চলেন তিনি। মৃগয়ায় গিয়ে যেমন শক্তিমত্ততা তাঁকে চঞ্চল ক’রে তোলে, এইসময় ঠিক তেমনি আর এক মত্ততা তাঁকে উন্মাদ ক’রে তোলে। হারেমের হাজার বেগমও তখন তাঁর কাছে স্বাদহীন বর্ণহীন বলে মনে হয়। তিনি চান প্রতিটি রাতের জন্যে একটি ক’রে নারী—যে নারী হবে অপরূপ অথচ যার সঙ্গে জীবনে আগে কখনো দেখা হয়নি, পরেও দেখা হবার সম্ভাবনা থাকবে না।

ভবঘুরের কাছে নওরোজের বর্ণনা শোনবার পর থেকে এই দিনগুলি সম্বন্ধে জিৎ সিং-এর মনে রয়েছে একটি আতঙ্ক। সে আতঙ্ক একেবারেই অমূলক নয়। কারণ যে কয়েকটি নওরোজ দেখবার দুর্ভাগ্য হয়েছে জিৎ সিং-এর তার মধ্যেই দু-একটি রাজপুত কুলললনার সতীত্ব-গর্ব ধ্বংস হয়েছে। দু চারটি রাজপুত অথবা মুঘল পরিবারের শান্তিময় জীবন বিঘ্নিত এবং চিরদিনের জন্যে বিধ্বস্ত হয়েছে।

ভাবতে ভাবতে জিৎ সিং-এর মাথায় একটি বুদ্ধি জাগে। নওরোজের সময়টি মুঘল বাদশাহ্ কে বিব্রত করবার সব চাইতে প্রকৃষ্ট সময়। এই দিনগুলির ঠিক আগে যদি মেবারের মুঘল অধিকৃত অংশ আক্রমণ করেন কিকা, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না বাদশাহের পক্ষে।

ঘরে গিয়ে দোয়াত আর কলম বের ক’রে ছোট্ট একটি চিঠি লিখে ফেলে সে রানা প্রতাপকে সম্বোধন করে। তারপর সেটিকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে উধমের হাতে দেবার জন্যে। প্রতিদিনই অনেকবার ক’রে সরাইখানায় আসে উধম। আগ্রায় পৃথ্বীরাজের বাড়িতে যত কাজ ছিল, সিক্রিতে এসে তা অনেক কমে গেছে। কারণ সিক্রির বাড়িতে এ পর্যন্ত নিজের অশ্বশালা অবধি ক’রে উঠতে পারেননি রাজা। মাত্র দু-তিনটে অশ্ব তিনি বাড়িতে রাখেন। বাকিগুলি অন্যান্য আমীর- ওমরাহদের অশ্বের মতো বাদশাহী অশ্বশালাতেই রয়েছে আপাতত। এতে জিৎ সিং এবং উধম উভয়েরই সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া পৃথ্বীরাজের বাড়িটি সরাইখানার থেকে বেশি দূরে নয়। দিনের মধ্যে যখন তখন এসে ঘুরে যেতে অসুবিধা হয় না উধমের।

সিক্রিতে এসে প্রিয়ার সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ হয়নি জিৎ-এর। উধমকে বলা রয়েছে পৃথ্বীরাজের বাড়িতে সে এলেই যেন সংবাদ দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথ্বীরাজের বাড়িতে এ-পর্যন্ত একবারও সে আসেনি। প্রাসাদ এলাকার অভ্যন্তরে সজ্জিত অট্টালিকা পেয়ে সে হারেমের বেগমদের মতো সবার চোখের অন্তরালে চলে গেছে। জিৎ সিং বুঝতে পারে প্রচণ্ড অভিমানেই প্রিয়া নিজেকে ওভাবে লুকিয়ে রেখেছে। লীলাবতীর কথা এখনো সে ভুলতে পারেনি। এখনো তার হৃদয়ে ঈর্ষার আগুন জ্বলছে। নইলে প্রাসাদে সম্ভব না হলেও পৃথ্বীরাজের বাড়িতে জিৎ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ক’রে নিত

প্রিয়া। নামটি এখন আর তার মনে বিশেষ কোনো সাড়া জাগায় না। ঢোলপুর থেকে ফিরে আসবার পর থেকে হিন্দুস্থানের লক্ষ লক্ষ নারী আর প্রিয়ার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য যেন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এখন আর তার মুখ মনে পড়লে অন্তরের মধ্যে সেই আগের পুলক জাগে না। যে পুলক সত্যিই জাগতে শুরু করেছিল, নেশাও ধরতে শুরু করেছিল। এমন কি একথাও ভেবেছিল জিৎ সিং লীলাবতী যদি কখনো ডেকেও পাঠায়, তবু সে যাবে না। সে ভেবেছিল লীলার মধ্যে কোনো রহস্য নেই, রোমাঞ্চ নেই, প্রিয়াই তার জীবনকে এক রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে।

কিন্তু সব যেন কী হয়ে গেল। ঢোলপুরের একটি রাত তার যত্নের গড়ে তোলা স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার ক’রে দিল। স্বপ্ন—সত্যিই স্বপ্ন। তার মধ্যে বাস্তবের কোনো স্পর্শই ছিল না। লীলাবতীকে মনের এক কোণে মিথ্যার আবরণে ঢাকা দিয়ে রেখে সে স্বপ্নজাল বুনে চলেছিল। তাই আবরণ সরে যেতেই স্বপ্ন টুটে গেল। সে বুঝতে পারল লীলাবতী তাকে জীবনে গ্রহণ করতে না পারলেও, সে তারই। সে ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে লীলাবতীর আর কেউ নেই। হয়তো আর কখনো উভয়ের মধ্যে দেখা হবে না। তবু এক অদৃশ্য দৃঢ় বন্ধন উভয়কে চিরকাল বেঁধে রাখবে। সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হবার উপায় নেই। তাই জয়পাল যেমন লীলাবতীর জীবনে এসেছিল, আবার চলে গেছে, প্রিয়াও তেমনি তার জীবনে এসেছে, সময় এলেই চলে যাবে। এ সবের মধ্যে অন্তরের আসল টান নেই।

তবু প্রিয়াকে তার বড় প্রয়োজন। প্রিয়া ছাড়া সিক্রিতে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যার দ্বারা কার্যোদ্ধার হতে পারে। বাদশাহের সঙ্গে একদিন শিকারে গিয়েই আমীর ওমরাহদের মুখের দিকে চেয়ে সে বুঝতে পেরেছে ওরা কেউ তার সঙ্গে অবাধে মিশবে না। মিশলেও মানসিংহের সেই ভূমিকা নেবার পর গোপন সংবাদ জানাবার মতো বিশ্বাস তাকে কেউ আর করতে পারবে না। আজ যদি দরবারে তার স্থান খুব উচ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবু কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে প্রিয়াই ভালো।

উধম এলে তার হাতে কিকাকে লেখা পত্রটি দিয়ে জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়। তারপর সে তার তলোয়ার বের করে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। যখন কোনো কাজই থাকে না, তখন এই অস্ত্রটির দিকে চেয়ে বহুক্ষণ বসে থাকতে পারে। এসে সে ক্লান্ত হয় না, অধৈর্য হয় না। মাধব একদিন বলছিল, তলোয়ারের দিকে চেয়ে সে নাকি বিড়বিড় ক’রে কথা বলে। মাধবের কথা বিশ্বাস হয়নি তার ছেলেটি বড় বেশি চালাক। এত বেশি চালাক জানলে, সরাইখানায় তাকে কাজ দিত না সে।

আগ্রায় তার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে চেয়ে কষ্ট হয়েছিল। শুধু তারই কষ্ট হয়নি উধমের মতো মানুষেরও মন টলেছিল। তাই সেখানকার সরাইখানা থেকে সে-ই মাধবকে সরিয়ে এনেছিল। কিন্তু এখানে এসে কিছুদিন স্ফূর্তিতে কাজ করার পর আজকাল কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছে। কাজে মন নেই। সব সময়ে তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির মধো রয়েছে অপরাধী ভাব, রয়েছে চতুরতা। এ দৃষ্টির অর্থ উদ্ধারের মতো সময় ক’রে উঠতে পারে না জিৎ। সে সরাইখানার হিসাব মিলিয়ে প্রতিদিন দেখেছে ভালোই লাভ হয়। যদি লাভ না হত তবে অন্যরকম সন্দেহ করতে পারত। সেদিক দিয়ে মাধবকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। তার একটি মাত্র দোষ কাউকে কিছু না বলে মাঝে মাঝে সরাইখানা ছেড়ে অসময়ে বের হয়ে যায়। এজন্যে তাকে গালমন্দ করেছে জিৎ। কোথায় যায়, প্রশ্ন করলে, কথার উত্তর দেয় না। চুপ ক’রে থাকে। এখানে রহিমবক্স নেই। থাকলে, মনে করতে পারত, তার কাছেই আবার যাওয়া শুরু করেছে বাড়তি পয়সার আশায়।

মাধবের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় জিৎ দেখে, বাইরে রাস্তার ওপর একজন লোক দাঁড়িয়ে সরাইখানার ভেতরের কাউকে ইশারা করছে। তীব্র কৌতূহল জাগে জিৎ-এর মনে। সে একপাশে সরে যায়, যাতে তার ওপর কারও নজর না পড়ে।

একটু পরেই মাধব এসে দাঁড়ায় রাস্তার ওপর। তারপর জিৎ-এর জানালার দিকে সে দৃষ্টিপাত করে। জিৎ সিং ভাবে, মাধবের বোধহয় ধারণা সে এখন ঘুমিয়ে রয়েছে। কারণ সে জানে, তার মালিকের খাওয়া ও ঘুমোনো আর সবার মতো সাধারণ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত নয়। কত সময় মাধব দেখেছে ভোরের আগেই শয্যা ছেড়ে জিৎ বাইরে চলে গেছে। আবার কখনো দেখেছে গভীর রাত অবধিও সে ফেরেনি। পরদিন দেখেছে অনেক বেলা অবধি শয্যার ওপর গভীর নিদ্রায় মগ্ন তার নতুন প্রভু।

মাধব রাস্তার লোকটির সঙ্গে চাপা গলায় কিছুক্ষণ কথা বলে। তারপর আর একবার জিৎ সিং-এর ঘরের দিকে চেয়ে এগিয়ে আসে।

জিৎ শয্যার ওপর শুয়ে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে। একটু পরেই সে বুঝতে পারে মাধব তার দরজার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালেও তার ছায়া পড়ে। কারণ পশ্চিমের সূর্য দরজা দিয়ে দেয়ালে এসে পড়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মাধব। সে বোধহয় নিশ্চিন্ত হতে চায় জিৎ-এর নিদ্রা গভীর কি না। তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। সে আবার রাস্তায় এসে নামে।

দেয়ালের ছায়া-সরে যাবার পরও একটু সময় শুয়ে থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ে জিৎ। সে ছুটে সরাইখানার সমস্ত ঘর খুঁজে দেখে মাধব নেই। তারপর অসিটি নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই তার চোখে পড়ে কিছুদূরে অপরিচিত লোকটির সঙ্গে মাধব দ্রুতপদে এগিয়ে চলেছে।

জিৎ সিং তার পেছু নেয়। চলতে চলেত শেষে বাদশাহী মহলের প্রধান ফটকের সামনে এসে উপস্থিত হয় ওরা। জিৎ সিং থেমে যায় দূরে। সে বিস্মিত না হয়ে পারে না। কারণ প্রাসাদের ফটকের সামনে অমন নির্বিবাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মাধব, একথা সে কখনো কল্পনাও করেনি। সে দেখতে পায় ফটকের প্রহরী তাদের দেখেও কিছু বলল না। আগের মতোই এধার ওধার করতে লাগল। দূর থেকে প্রহরীর মুখ দেখতে না পেলেও সে যে শক্তিশালী পুরুষ এবং রীতিমতো সতর্ক, তার দেহের দৈর্ঘ্য আর চালচলন দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না জিৎ সিং-এর।

শেষে বিহ্বল জিৎ সিং দেখতে পায় মাধবকে নিয়ে তার সঙ্গী বিনা বাধায় ফটকের ভেতর দিয়ে প্রাসাদ-এলাকায় প্রবেশ করে। দুচোখ হাত দিয়ে ঘষে নেয় জিৎ। আবার চেয়ে দেখে। দেখতে পায়, মাধব ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রাসাদের অভ্যন্তরে সুন্দর পথ ধরে।

জিৎ সিং রাস্তার ধারে একটি উঁচু জায়গায় বসে পড়ে। বসে, আকাশপাতাল ভেবেও কোনো কিনারা খুঁজে পায় না। কেন মাধব এখানে এল, কেনই বা প্রহরী বাধা দিল না তাকে?

ভাবতে ভাবতে সূর্য অস্ত যায়?

তারপর একসময়ে সে দেখে, মাধব একা বের হয়ে আসছে ভেতর থেকে। প্রহরী তাকে কি যেন প্রশ্ন করল। সে তার মাথা একদিকে হেলিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়ে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসে। জিৎ-এর ইচ্ছে হয় তার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি চেপে ধরতে। কিন্তু সেই ইচ্ছাকে রূপ দিতে গেলে মাধবের উদ্দেশ্যটি তার চিরকাল অজানা থেকে যাবে। তার চাইতে সে ফিরে যাক সরাইখানায়। সরাইখানার ঘরের মদ্যে নিস্তব্ধ রাতে জেরা করে ভয় দেখিয়ে পেটের কথা টেনে বের করলেই চলবে।

জিৎ সিং একপাশে লুকিয়ে পড়ে। মাধব দেখতে পায় না তাকে। সে আগের মতোই ছুটে চলে রাস্তা ধরে। তার বোধ হয় ভয় হয়েছে। এতক্ষণে জিৎ সিং-এর দিবানিদ্রা ভেঙেছে। এতক্ষণে তার খোঁজ পড়েছে সরাইখানায়।

মাধব রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হতেই জিৎ সিং ধীরে ধীরে প্রাসাদের ফটকের দিকে এগিযে যায়। উদ্দেশ্য তার, প্রহরীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে যদি জানা যায়, ছোকরা কেন এসেছিল প্রাসাদের ভেতরে। কেনই বা তাদেরকে বাধা দেওয়া হল না।

সে কাছে যেতেই প্রহরীর পায়চারি থেমে যায়। সে তার বিরাট বপুখানা ফটকের মাঝখানে খাড়া ক’রে হাঁকে,—কৌন হ্যায়।

মুহূর্তে জিৎ সিং-এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে প্রহরীর মুখখানা দেখেই চিনে ফেলে। আগ্রায় বীরবলের গৃহের সদর দরওয়াজায় এই প্রহরীই তাকে ডেকে অনেক জ্ঞানের কথা শুনিয়ে ছিল একদিন। তাকে দেখে ভেবেছিল একজন কিশোর মাত্র। জিৎ সিং ভাবে, আজও তো বেলা ডুবে গেছে। আজও তেমন ভুল হওয়া বিচিত্র নয়। যদি অবশ্য তার মুখখানা প্রহরীর মনে থাকে। আগ্রায় যে সম্বোধন করতে শিখিয়েছিল লোকটি সেই সম্বোধনই এতদিন পরে আবার করে। জিৎ বলে,—আমায় চিনতে পারলে না চাচা?

—চাচা? আমি আবার কার চাচা হতে গেলাম? দেখি দেখি কাছে এসো তো। চাঁদবদনখানা একবার দেখি আগে।

জিৎ সিং ভালোমানুষের মতো তার মুখখানা বাড়িয়ে দেয় কাছে গিয়ে।

—নাঃ, চিনতে পারছি না তো! তবে চেনা চেনা ঠেকছে বটে।

জিৎ সিং অভিমানের স্বরে বলে,—এখন তো ওকথা বলবেই। এখন যে আমার গোঁফ গজিয়েছে ভালোমতো। কিন্তু তোমার সঙ্গে সেদিন দেখা না হলে এ গোঁফ কি গজাতো?

—কেন? কেন? গজাতো না কেন?

—তুমি সেদিন আমায় ছেলেমানুষ বলায় মনে কত আঘাত পেয়েছিলাম জানো? তারপর থেকে রোজ আমি বেশি পয়সা খরচ করে অর্জুন হাজমের ভাইপোর শ্বশুরকে ডেকে ক্ষুর দিয়ে কামাতাম। তাইতো অকালে এমন গজিয়ে গেল।

প্রহরী হোহো ক’রে হেসে বলে,—ও, এ বারে মনে পড়েছে। সেই লম্বা তলোয়ার। এখনো এটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ?

—কি করব? যেখানে যাই, সবাই আমাকে ছোট বলে। তাই সঙ্গে নিয়ে বেড়াই। এটাকে তো কোউ ছোট বলতে পারবে না।

প্রহরী আর এক চোট হেসে ওঠে। তারপর বলে,—এবারে সব মনে পড়েছে। যাই বল, এই অল্প সময়ে সত্যিই খুব বড় হয়েছ। এখন আর ছোট বলে মনে হয় না। তো বাপু, এখানে এসে জুটলে কেন আবার? আগ্রায় তো বেশ ভালোই ছিলে।

—ভালো না ছাই। বাদশাহ্ যেখানে নেই সেখানে কেউ ভালো থাকে?

—এখানে করবে কি?

—চাকরির চেষ্টা করছি। তোমার দলে নিয়ে নাও না।

—আমি কি নেবার মালিক?

—কী যে তুমি বল চাচা। আমি জানি না ভাবছ? তুমি ইচ্ছে করলে সব পার।

প্রহরী একটু গম্ভীর হয়। তার আত্মমর্যাদা ফুলে ফেঁপে ওঠে। জিৎ সিং-এর প্রতি সন্তুষ্টির দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে বলে,—ঠিক আছে, আমি দেখছি।

—তোমার তো চাচা খুব উন্নতি হয়েছে।

—উন্নতি?

—উন্নতি নয়? আগে ছিল বীরবলের বাড়ির দরওয়াজায়, এখন খাস বাদশাহী মহলের প্রধান দরওয়াজায়। এটা কম উন্নতি নাকি?

লোকটি ঢোক গিলে বলে,—তা হয়েছে বটে। তবে এখন তো বীরবলের বাড়ীর প্রহরীর দরকার নেই।

—কেন? দরকার নেই কেন?

—এখন তো তাঁর বাড়ি প্রাসাদের এলাকার মধ্যেই। তাঁর বাড়ি ঠিক নয়। তাঁর মেয়ের বাড়ি। বাদশাহ্ তাঁর মেয়েকেই বাড়িটি দিয়েছেন। তবে তিনি মেয়ের কাছেই থাকেন।

—তাই নাকি? কোন্ বাড়িটা চাচা? ওইটা?

—না। ওখানে থাকেন একা সালিমা বেগম। তিনি কিছুদিন ধরে একাই রয়েছেন। সিক্রিতে প্রথম তো তিনিই আসেন। তারপর থেকে আর হারেমে যাননি।

জিৎ সিং চোখেমুখে কোনোরকম কৌতূহল প্রকাশ না ক’রে বলে,—তবে বীরবলের মেয়ের বাড়ি কোন্‌ টি?

প্রহরী জিৎ সিং-এর হাত ধরে একাপাশে টেনে নিয়ে আঙুল উঁচু ক’রে দেখিয়ে হেসে বলে ওঠে,–কেন? ওই বাড়ির ওপর অত নজর কেন?

—এমনিতেই। তুমি আগে ওদের প্রহরী ছিলে বলে জিজ্ঞাসা করছি।

—ভালো কথা।

—হঠাৎ অমনভাবে কথা বলছ কেন চাচা?

—কিছু নয়। গোঁফদাড়ি ভালোরকম উঠেছে বলে বলছি।

—তাতে কি হল?

—কিছুই হল না।

—জিৎ সিং সব বুঝেও চুপ করে থাকে। তারপর একটু পরে ডাকে,—চাচা।

—বল।

—আগ্রায় তুমি বলেছিলে বীরবলের বাড়ির ভেতরে যেতে দেবে। এখানে দাও না।

—ওরে বাবা। ও কথা মুখেও এনো না।

—কেন?

—এখন যে এটা বাদশাহী মহল।

—তাতে কি হল? আমি তো শুধু ওই বাড়িতে যাব।

—দূর পাগল। তাই কখনো হয় নাকি? ধরা পড়লে তোমার গর্দান তো যাবেই, আমার গর্দান ও বহাল তবিয়তে থাকবে না।

—তুমি শুধু আমায় ভয় দেখাচ্ছ। তুমি ইচ্ছে করলে যে সব পার তাই কি আমি জানি না। ওই তো একুট আগে একটা ছোকরা বাইরে এল। বাদশাহী মহলের কেউ তো নয় সে

—অ্যাঁ? দেখে ফেলেছ? কতক্ষণ এসেছ এখানে?

—অনেকক্ষণ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তারপর যেই দেখলাম আমার চাচা রয়েছে। অমনি ছুটে তোমার কাছে চলে এলাম।

—হুঁ। ওই ছোকরা তো গেছল সালিমা বেগমের কাছে।

—সালিমা বেগম? কেন?

—চাকরির জন্যে। কোন্ সরাইখানায় নাকি কাজ করে। ভালো লাগে না সেখানে। তাই আসতে চায় এখানে।

জিৎ সিং-এর বুকের ভার অনেকটা লাঘব হয়ে যায়। বেচারা মাধব। বাদশাহী মহলে কাজ করবার সাধ তার অনেকদিনের। আগ্রায় সেই জন্যেই উধমের এক কথায় সরাইখানার কাজ ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। তারপর এখানে নতুন জায়গায় কিছুদিন মন দিয়ে কাজ করবার পর আবার উস্থ শুরু করেছে। কাজে তাই মন নেই। সব সময় অন্যমনস্ক। কাজে বিশেষ ফাঁকি না দিলেও, মন দিচ্ছে না বলে চোখে তার ফুটে ওঠে অপরাধী ভাব।

প্রহরীর দিকে চেয়ে বিগলিতের হাসি হেসে জিৎ বলে,—আমাকেও তেমনিভাবে ছেড়ে দাও না। আমিও তো কাজ চাই। ধরা পড়লে বলব সেকথা।

প্রহরী কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে, তুমি দেখছি নাছোড়বান্দা।

তাকে নিমরাজি হতে দেখে জিৎ উৎসাহিত হয়ে চেপে দরে বলে,—হ্যাঁ চাচা। আমি নাছোড়বান্দা। বীরবলের বাড়ি দেখবার সাধ আমার বহুদিনের। তুমি তো জানই সেকথা। তবে কেন এমন ঝুলিয়ে রাখছ চাচা। তুমি মেহেরবানী করলেই তো সব হয়ে যায়।

—হুঁ। কিন্তু একটা কথা তোমার মগজে ঢুকছে না।

—কোন্ কথা?

—চাকরির খোঁজে এসে কেউ অত বড় তলোয়ার ঝুলিয়ে রাখে?

জিৎ সিং যেন এতক্ষণে নিজের বোকামি বুঝতে পারে। চাচা না দেখিয়ে দিলে জন্মে যেন এই বোকামির কথা বুঝতে পারত না। সে এক হাত জিভ বার ক’রে দাঁত দিয়ে কেটে বলে, –তাই তো, একদম ভুলে গেছলাম।

—হুঁ হুঁ। গোঁফ গজালে কি হবে? আসলে তো বাচ্চা।

—হ্যাঁ চাচা। তুমি একথা বললে আর আমার মন খারাপ হবে না। তুমি যখন আমায় ভেতরে যেতে বলবে, এটাকে ওই পাশে লুকিয়ে রেখে দিয়ে যাব। কবে আসব বল? কবে তোমার সুবিধে হবে?

—কবে? আজকের মতো সুবিধে কোনোদিনও হবে না। বাদশাহ্ আর বীরবল দুজনাই বাইরে গেছেন।

জিৎ সিং-এর মন আনন্দে নৃত্য ক’রে ওঠে,—তাই নাকি? কিন্তু বীরবলের মেয়ে? তিনিও বাইরে?

—না, সে ভেতরে আছে। তবে শয্যাশায়ী।

—শয্যাশায়ী? কবে থেকে?

—সিক্রিতে আসবার পর থেকেই। অসুখ-বিসুখ নেই, অথচ খাওয়ায় নাকি কোনো রুচি নেই দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। শালিবাহন কবরেজ নিজে দেখছেন। তাঁকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করি যখন এখান দিয়ে যান। হাজার হলেও এককালে বীরবলের বাড়িতেই তো ছিলাম। তিনিই বলে কয়ে এই কাজটি আমায় দিয়েছেন।

—শালিবাহন কি বলেন?

—তিনি মুচকি হেসে বলেন, এসব রোগের কথা নাকি আমরা বুঝব না।

জিৎ সিং আরও বিস্মিত হয়। তারপর ক্ষিপ্রহস্তে তলোয়ারটি খুলে নিয়ে পাশে একটি জায়গায় লুকিয়ে রেখে এসে বলে,—তবে আমি যাই ভেতরে?

—যাও, কিন্তু অযথা দেরি করবে না বলে দিচ্ছি। মনে রেখো, বীরবল যে-কোনো সময়ে ফিরে আসতে পারেন।

জিৎ সিং তার ঘাড়টিকে কোনোরকমে একপাশে হেলিয়ে প্রহরীর প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। প্রিয়াকে অন্তত দেখতে পাবে সে। মেয়েটি অসুস্থ। তাকে সে ভালোবাসে না ঠিক, কিন্তু তার ওপর সহানুভূতিও রয়েছে, মায়াও জন্মেছে। প্রিয়া তাকে বিশ্বাস করে। সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু প্রিয়ার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে সে বিচলিত না হয়ে পারেন না। কোনোদিনই পারবে না। প্রিয়া তার জীবনের এমনই এক নারী, যে নারী লীলাবতী যতদিন বেঁচে থাকবে তার মনের মধ্যে ততদিনই বেঁচে থাকবে।

বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জিৎ। অতি সাবধানে সে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার জমে উঠতেই বাড়ির বাতিগুলি সব জ্বলে উঠেছে। কিন্তু কে যে জ্বালালো বুঝবার উপায় নেই। কারণ একজনকেও সে দেখতে পায় না। সে আরও এগিয়ে যায়। চারদিকে সুদৃশ্য পর্দা ঝোলানো রয়েছে। সেই সব পর্দার আড়ালে রয়েছে ঘর। একটি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে সে, ভেতরেও পর্দা ঝুলছে। কিন্তু প্রিয়া নেই সে-ঘরে। প্রিয়া কোন্ ঘরে আছে খুঁজে বের করতে হবে।

সে অগ্রসর হতে যায়, ঠিক সেই সময় প্রাসাদের প্রধান ফটকে কোলাহল ওঠে। জিৎ সিং তাড়াতাড়ি একটি বাতায়ন-পথে মুখ বাড়ায়। সে দেখতে পায়, একদল লোক অশ্ব পৃষ্ঠে প্রধান ফটক পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না, কে এলেন। বাদশাহ্ ছাড়া এত জানান দিয়ে ভেতরে কেউ প্রবেশ করে না। জিৎ সিং একটু ভেবে নেয়। কারণ বাদশাহ্ যখন এসেছেন, তখন বীরবলও সঙ্গে রয়েছেন।

স্তব্ধ পুরীর ওদিকে পায়ের শব্দ পাওয়া যায় এতক্ষণে। ভৃত্য এবং পরিচারিকারা এগিয়ে যাচ্ছে প্রভুর আগমন প্রত্যাশায়। এখন ওদের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া উচিত হবে না। এ সময়ে ধরা পড়লে ব্যাপারটা অনেকদূর অবধি এগিয়ে যাবে। অনেক কৈফিয়ত দিয়েও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি সে একটি কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।

কক্ষটি বেশ বড় এবং সুসজ্জিত। দেখলেই বোঝা যায়, বাইরের বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনা ক’রে এনে এখানে বসানো হয়। জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়ে একটি ভারী পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। সে জানে এ-ঘরে আনবার কোনোই সম্ভাবনা নেই বীরবলের। তিনি সোজা নিজের শয়নকক্ষে চলে যাবেন। কিংবা তাঁর কন্যার সঙ্গে গিয়েও দেখা করতে পারেন। কারণ কন্যা তাঁর অসুস্থ।

পর্দার পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে জিৎ সিং। সে শুনতে পায়, তার কক্ষের বাইরে দিয়ে অনেকগুলি ভারী পায়ের শব্দ অন্যদিকে চলে যায়। সেই সঙ্গে ভাঙা ভাঙা কথাও তার কানে আসে। বীরবল বোধহয় কোনো ভৃত্যের সঙ্গে কথা কইছেন।

সে চট্ ক’রে বাইরে বের হয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। প্রধান ফটকের প্রহরীর অবস্থা সে অনুমান করে। এতক্ষণে সে হয়তো নিজের হাত কামড়াতে শুরু করেছে। তাকে তার দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি দিতে হবে। প্রিয়ার সঙ্গে আজ আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই।

জিৎ সিং পর্দা সরাবার জন্যে হাত বাড়াতেই কারা যেন ছুটে আসে সেই কক্ষে। সে খুব আস্তে পর্দার একটি দিক সামান্য একটু তুলে ধরে দেখে দুজন ভৃত্য ব্যস্তভাবে সমস্ত আসবাব এবং গদি পরিষ্কার করছে।

মনের ভেতরে নিদারুণ অস্বস্তিতে ভরে ওঠে জিৎ-এর নিশ্চয়ই বীরবল এঘরে আসবে একবার। কতক্ষণ থাকবে বলা যায় না। এভাবে ফাঁদের মধ্যে ধরা পড়ার জন্যে মন তার সর্বদা প্রস্তুত থাকলেও, এতটা সে আশঙ্কা করেনি।

কিন্তু ভৃত্যদের একজনের কথা কানে যেতেই জিৎ সিং-এর বুক কেঁপে ওঠে। ভৃত্যটি বলে—বাদশাহ্ যে এ-সময়ে এখানে আসবেন আমি ভাবিনি।

—এ বাড়িতে আসতে তাঁর আবার সময় অসময় আছে নাকি? কী চোখেই যে দেখেছেন মেয়েটিকে।

—যাঃ, তোর কথা বড় নোংরা।

—নোংরা ভাবলেই নোংরা। আমি কি খারাপ ভেবে বলেছি নাকি?

—কথার সুর শুনলেই বোঝা যায়।

—তোর মনই আসলে নোংরা।

—থাম্ থাম্। আফিমের কৌটো নিয়ে আয়। এখানে বসেই তো চোখ বুজে হাত বাড়াবেন তাকিয়ার পাশে।

—ওঁর নিজের কাছেই তো রয়েছে।

—তা থাকলেও, এ বাড়িতে এসে তিনি নিজের কৌটোর আফিম সেবন করেন না। তাই তো এক কৌটো আফিম আনিয়ে রেখে দিয়েছেন কত্তা। যা শিগগির। এতদিন এসেছিস্, এখানকার হালচাল জানলি না?

ভৃত্যটি চলে যায়। জিৎ সিং দেখে অপরজন ঘরের ভেতরে এটা ওটা ধরে নাড়ছে, আর আপন মনে গজগজ করছে। সে বুঝতে পারে বাদসাহের আগমন বেচারার শান্তি ভঙ্গ হয়েছে। তার আরামের ব্যাঘাত ঘটেছে।

একটু পরে একটি কৌটো নিয়ে ফিরে আসে আগের ভৃত্যটি। তারপর পর্দার দিকে চেয়ে বলে,—ওগুলো সব পরিষ্কার আছে তো?

জিৎ সিং-এর শরীর শক্ত হয়। পর্দা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই বিপদ। ঘরের অসন্তুষ্ট লোকটি তাকে ধমক দিয়ে বলে,–বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়। অত কাজ দেখাতে গেলে কোনোদিনই আর বিশ্রাম পাবি না। পর্দার দিকে কেউ নজর দেয় নাকি রাতের বেলা। খুব বেশি নোংরা হলে আলাদা কথা।

সেই সময়ে পায়ের শব্দ শোনা যায়। ভৃত্য দুজনা চোখের পলকে দরজার দুধারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাদশাহ্ আকবর প্রবেশ করেন ঘরের ভেতরে। পেছনে বীরবল। ভৃত্য দুজন নিয়ম মাফিক সম্মান জানিয়ে বাইরে অদৃশ্য হয়। জিৎ সিং লক্ষ্য করে, বাদশাহ্ এবং বীরবল উভয়ের মুখই ভারাক্রান্ত। প্রিয়ার অসুখ বোধহয় বেড়েছে।

বাদশাহ্ তকিয়ায় হেলান দিয়ে পাশ থেকে আফিমের কৌটো তুলে নিয়ে আনমনে সেটি খুলে কিছুটা আফিম গুলি করে মুখের মধ্যে ফেলে দেন। সব কিছুই তিনি করেন অভ্যাসবশে। কারণ এদিকে তাঁর মন নেই।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বাদশাহ্ প্রশ্ন করেন,—বৈদ্য শালিবাহন এখনো সেই একই ধারণা পোষণ করেন?

—হ্যাঁ। তিনি সেই কথাই বলছেন বার বার। পৃথ্বীরাজ রাঠোর ছাড়া ওকে সুস্থ ক’রে তোলা অসম্ভব।

জিৎ সিং-এর বিস্ময় মাত্রা ছাড়ায়। পৃথ্বীরাজ রাঠোর কী ভাবে সুস্থ করবেন প্রিয়াকে সে ভেবে পায় না।

বাদশাহ্ গম্ভীরস্বরে বলেন,—তুমি ঠিকই শুনেছিলে তো? পৃথ্বীরাজের নামই বলেছিল। না, অন্য কেউ?

—পৃথ্বীরাজ। অন্য কোনো নাম নয়। আমি সে সময়ে মেয়ের সামনে বসেছিলাম। কালাঞ্জর জয়ের পরের ঘটনা। আগ্রায় সেদিন হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়েছিল। ওর ঘরে গিয়ে দেখি বিছানার ওপর শুয়ে রয়েছে। চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছল। আমি প্রশ্ন করলাম,—কি হল তোর? আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে উঠেছিল—পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়িতে আমি যাব, নইলে বাঁচব না। সে সময়ে কিন্তু ওর জ্ঞান ছিল না।

বাদশাহ্ মৃদু হেসে বলেন,—এত সব অবিবাহিত যুবক থাকতে শেষে পৃথ্বীরাজকে পছন্দ করল ও?

—মেয়েদের মনের কথা! কাকে যে ওদের পছন্দ হবে কেউ বলতে পারে না। তবে পৃথ্বীরাজ উপযুক্ত পাত্র বটে। অমন চেহারা, অমন স্বভাব আর অমন বীরত্ব কয়জন যুবকের মধ্যে দেখতে পাবেন জাহাঁপনা? মেয়ের পছন্দের প্রশংসা না করে পারি না।

—সে কথা ঠিকই। শুধু গলদের মধ্যে তার একটি রানী রয়েছে। কিন্তু এক রানীকে নিয়েই সে সারাজীবন কাটাতে হবে, তেমন কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম কোথাও আছে নাকি বীরবল? তোমার মেয়েটিকেও তো সে স্বচ্ছন্দে নিতে পারে।

জিৎ অবাক্ হয়। পৃথ্বীরাজকে ভালোবাসে প্রিয়া? চোখে দেখলেও যে বিশ্বাস করবে না সে। কোথাও ভুল হয়নি তো? নাও হতে পারে? হয়তো পৃথ্বীরাজকেই সে বরাবর ভালোবাসত। তাই তার বাড়িতে অত ঘন ঘন যেত। জিৎ সিং এসে পড়ায়, কয়েক দিনের জন্যে হয়তো সব ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল একটা সাময়িক মোহে। সেই মোহ এখন টুটে গিয়ে আবার পূর্বাবস্থা ফিরে এসেছে। তাই নতুন ক’রে সে পৃথ্বীরাজকে চায়।

বাদশাহের কথা শুনে বীরবল নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেন,—না। পৃথ্বীরাজ সে শ্রেণীর মানুষ নয়। নিজের স্ত্রীর প্রতি তার আশ্চর্য রকমের ভালোবাসা। সে বিশ্বাস করে না জীবনে দুজন স্ত্রীলোককে ভালোবাসা যায় কিংবা তাদের একসঙ্গে ঘরে রাখা যায়। এ ব্যাপারে পৃথ্বীরাজ অত্যন্ত একনিষ্ঠ। আমি তার সঙ্গে নানান্ ভাবে আলোচনা ক’রে বুঝেছি।

বাদশাহ্ কিছুক্ষণ ঝিম্ ধরে বসে থাকেন। বোধহয় আফিমের নেশায় একটু ধরেছে তাঁকে। পেছন দিক থেকে মানুষটির দিকে চাইলে কল্পনাও করা যায় না, এঁর মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে অফুরন্ত কর্মোন্মাদনা, অসাধারণ শক্তি, অতুলনীয় সাহস আর অনন্ত কষ্ট সহিষ্ণুতা। আর রয়েছে ভোগলিপ্সা।

সহসা বীরবলের ভগ্ন কণ্ঠস্বরে বাদশাহের পৃষ্ঠদেশ থেকে জিৎ সিং-এর দৃষ্টি অপসারিত হয়। সে অবাক্ হয়ে দেখে বীরবলের মতো অত বড় মানুষটি চোখের জল ফেলছেন।

—জাহাঁপনা। এই একটি মাত্র মেয়ে আমার। এর দশা দেখে আমার সব শান্তি নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। দিনের পর দিন কিরকম দুর্বল হয়ে পড়ছে। আপনি তো নিজেই দেখেছেন। ওর চোখের দৃষ্টি সব সময়ে বহুদুরে নিবদ্ধ থাকে। সে দৃষ্টি কাকে যেন খুঁজে পাচ্ছে না। আপনি সারা হিন্দুস্থানের অধীশ্বর। আপনিও যা জগদীশ্বরও তাই। আপনি আমার সহায় হোন।

বাদশাহ্ আরও কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে ধীরে ধীরে বলেন,–তোমার মেয়ের মনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে, তার হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে আমি কিছুদিন থেকেই চিন্তা করছি। একটি উপায়ও খুঁজে পেয়েছি।

বীরবলের কণ্ঠস্বরে আগ্রহ ঝরে পড়ে। বলেন,–কোন্ উপায় জাহাঁপনা?

—বলছি। কিন্তু তার আগে আমি জেনে নিতে চাই, তুমি আমার সহায় হবে কি না। তোমার মেয়েকে ঠিক আগের মতো হাসিখুশি ক’রে তুলতে তুমি বিনা দ্বিধায় আমাকে সমর্থন করবে কিনা?

—করব। নিশ্চয়ই করব জাহাঁপনা। মেয়ের জন্যে যদি বুকের রক্ত দিতে হয় তাও দেব। বাদশাহ্ হেসে ওঠেন,—না। অত কিছু দিতে হবে না। আমি চাই শুধু তোমার সমর্থন। এ সমর্থনও চাইতাম না, যদি পৃথ্বীরাজের সঙ্গে তোমার অতটা সদ্ভাব না থাকত।

—তবে কি আপনি তাকে বাধ্য করবেন আমার মেয়েকে গ্রহণ করতে? তাতে কি মেয়ে আমার সুখী হবে?

—বাধ্য আমি করব না। তবে এমন অবস্থায় সে পড়বে, যাতে বিয়ে করতে একটুও আপত্তি করবে না।

—যদি আপত্তি না থাকে, সবটুকু বলে নিশ্চিন্ত করুন।

—তার আগে কথা দাও, এ-ব্যাপার নিয়ে তুমি হৈচৈ করবে না। কিংবা আমাকে বাধা দেবে না।

—কথা দিচ্ছি। আমার মেয়ের জীবনের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে সব কথাই দিতে পারি।

—ঠিক আছে। শোনো এবারে। পৃথ্বীরাজের পত্নী এক অসামান্য রূপসী নারী। আমি দেখেছি তাকে। -এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

—ওড় নারী রত্নটির ওপর বহুবার আমার চোখ পড়েছে। কিন্তু অনেক কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। কারণ ও হল পৃথ্বীরাজের স্ত্রী। পৃথ্বীরাজ আমার সব চাইতে বিশ্বস্ত রাজপুত বীরদের মধ্যে একজন। পৃথ্বীরাজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে—ভালোবাসা রয়েছে।

—সেকথা আমি জানি জাহাঁপনা।

—হ্যাঁ জান। আবার একথাও জান যে তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ তার চাইতেও বেশি আর তোমার মেয়ের প্রতি আমার স্নেহ অপরিসীম।

—জানি জাহাঁপনা।

—তাই তোমার মেয়ের জীবন রক্ষার্থে পৃথ্বীরাজের একটু ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে। তার ক্ষতি করতে বাধ্য হচ্ছ। আর বাধ্য হচ্ছি বলে, আজ পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী এই মুহূর্তে কেউ নয়। কারণ আমার বহুদিনের শয়নের স্বপনের কামনার ধনকে আমি লাভ করব। চিরকালের জন্যে নয় যদিও।

পর্দার আড়ালে জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরটা যেন কেমন করতে থাকে। একবার সে ভাবে সঙ্গে তলোয়ারটি থাকলে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে ওই কামান্ধ ব্যক্তিটিকে টুকরো টুকরো ক’রে দিত। কিন্তু তলোয়ার নেই, লুকিয়ে রেখে এসেছে প্রধান ফটকের কাছে। তাই হিন্দুস্থানের বাদশাহ আজ রক্ষা পেয়ে গেলেন। এতক্ষণে বুঝতে পারে জিৎ সিং প্রিয়ার অসুস্থতার সংবাদ কেন পৌঁছোয়নি রানীর কাছে। ইচ্ছে করে গোপন রাখা হয়েছে। কারণ পৃথ্বীরাজ এতে জড়িত।

পাশের বাতায়ন দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় জিৎ সিং-এর। তারপর তড়িৎবেগে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি পৌঁছে চিৎকার ক’রে তার রাখীবন্ধনের বোনকে ডেকে বলবে, —শিগগির পালাও বোন। নিজের নারীত্বের সম্মান যদি অটুটু আর অক্ষত রাখতে চাও এখনি সিক্রি ছিড়ে পালাও। দূরে, বহু দূরে, যেখানে গেলে বাদশাহের কামাগ্নি তোমায় স্পর্শ করতে পাারবে না। পালিয়ে যাও, যেখানে কিকা রয়েছেন, লীলাবতী রয়েছে। একমাত্র সেখানে গেলে হিন্দু-মুসলমান সমস্ত রমণীরাই তাদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে জীবন কাটাতে পারবে। পালাও।

বীরবল গম্ভীরস্বরে বলে,—কিন্তু জাহাঁপনা

—কোনো ‘কিন্তু’ নয় বীরবল। তোমার মেয়েকে বাঁচতে হলে এছাড়া দ্বিতীয় পথ আমার জানা নেই। পথ জানা নেই বলে এখনি সেকথা ভাবতে আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগছে। ভয়ের নয়, আনন্দের শিহরণ। ওই অমূল্য রত্নটি এবারের নওরোজে মীনাবাজার থেকে আমি সযত্নে সংগ্রহ করে নেব। এতদিনে আমি অন্তত সম্মতি পেয়েছি। যদিও জানি, সম্মতি না দিয়ে তোমার উপায় নেই। কারণ পৃথিবীতে তোমার মেয়ের চেয়ে আপন আর কেউ নয় তোমার। এতদিন আমি অনেক নারীকে সংগ্রহ করেছি বীরবল, কিন্তু এবারের নওরোজের স্মৃতি চিরকাল একখণ্ড হীরকের মতো জ্বল্ জ্বল্ করবে আমার জীবনে আমার মনে।

জিৎ সিং-এর সারা গা ঘামে ভিজে উঠেছিল। তার কপাল বেয়ে টস্ ক’রে ঘাম ঝরে পড়ছিল। উত্তেজনা ক্রোধ, ভয় অপমান আর হতাশার মিশ্রণে, তার দেহ মন এক অস্বাভাবিক অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল।

আকবরের বক্তব্য শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে জিৎ সিং আড়াল থেকে বীরবলের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে পায় কালপীর সেই ব্রাহ্মণের মুখে আপত্তির রেখা ফুটে উঠতে না উঠতেই মিলিয়ে গেল। জিৎ ভাবে আকবরের মতো বীরবলও তার দিকে পেছন ফিরে বসলে বড় ভালো হত। কারণ তাহলে এই মুখখানাকে দেখতে হত না—যে মুখ একজন তেজস্বী রাজপুত রমণীর সর্বনাশ হবে জেনেও উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে না। শুধু একবার মাত্র ঢোক গিলে সে মুখ এক সাংঘাতিক পাপকে প্রশ্রয় দিয়ে গেল। অমন মুখ দর্শনেও গায়ের ভেতরে রি রি করে ওঠে।

বাদশাহ্ আর বীরবল অবশেষে গাত্রোত্থান করেন। তাঁরা বাইরে চলে যান। জিৎ সিং তবু অপেক্ষা করে। সে বাতায়নপথে দেখতে পায় বাদশাহ্ ধীরে ধীরে আপন মহলের দিকে চলে যাচ্ছেন। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ সেই ভৃত্য দুইটি আসতে পারে জায়গাটি আবার গুছিয়ে ঠিক করে রাখতে।

কিন্তু তারা এল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও তারা এল না। সারা বাড়ি আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বীরবল হয়তো তাঁর নিজের কক্ষে গিয়ে অবসর নিচ্ছেন আর বিবেকের সঙ্গে লড়াই করছে।

জিৎ সিং পর্দা সরিয়ে বাদশাহ্ যেখানে বসেছিলেন, সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচু হয়ে আফিমের কৌটো তুলে নিয়ে তার পোশাকের ভেতরে রেখে দেয়। তারপর এদিকে ওদিকে চেয়ে রওনা হয় এই ঘৃণ্য পুরীটি ছেড়ে যাবার জন্য। প্রিযাকে দেখবার জন্যে যে আগ্রহ জেগেছিল তার মনে সেই আগ্রহের আর লেশমাত্রাও অবশিষ্ট নেই। তাকে এখন ছুটতে হবে পৃথ্বীরাজের গৃহে। খবর দিতে হবে রাখীবন্ধনের বোনকে। এখন আর তাকে রাখীবন্ধনের বোন বলে মনেও হয় না। মনে হয় তারই আপন বোন, একই মায়ের গর্ভে, একই পিতার ঔরসজাত।

জিৎ সিং ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। দুদিকের পর্দাগুলো মৃদুমন্দ হওয়ায় দুলছিল। সে আরও এগিয়ে যায়।

—শোন।

ঠিক পাশে থেকে কে ডাকল? জিৎ সিং থমকে দাঁড়ায়। তারপর ভাবে, এবারে জোরে দৌড়তে হবে। নইলে ধরা পড়ে যাবে। সে কিছুতেই নিজেকে ধরা দিতে পারে না। সে ধরা দিলে তার বোনের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে আগামী নওরোজের দিনে

জিৎ সিং দৌড়োতে গিয়েই বাধা পায়। পর্দার আড়াল থেকে একটি শীর্ণ পাণ্ডুর হাত বের হয়ে এসে তার বাহু চেপে ধরে।

জিৎ সিং চেয়ে দেখে তাকে বাধা দেবার শক্তি সে হাতের নেই। তাড়াতাড়ি পর্দা সরিয়ে ফেলে সে। প্রিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে।

কী চেহারা হয়েছে প্রিয়ার! এত শীর্ণ, এত রক্তশূন্য!

জিৎ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে।

দুর্বল কণ্ঠে প্রিয়া বলে,—এখানে তুমি কি ক’রে এলে জিৎ?

—অনেক চেষ্টায়।

—কেন?

—তোমায় দেখব বলে। তুমি আমায় ভুল বুঝে রাগ করে থাকলেও, আমি তো তা পারি না। আমার বুক যে জ্বলে যাচ্ছিল। তবু প্রাসাদের অভ্যন্তরে আসতে সাহসীই হইনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রহরের পর প্রহর। আর মাথা কুটতাম। তারপর যখন শুনলাম, তুমি অসুস্থ তখন মরিয়া হয়ে উঠলাম। মনের মধ্যে যেটুকু শঙ্কা ছিল মুছে গেল এক ফুৎকারে। চলে এলাম। আমি চলে এলাম প্রিয়া।

—তুমি তবে লীলাবতীকে—?

—লীলাবতী? সে তো আমার দেশের মেয়ে।

—তুমি তুমি ভালোবাসো না?

—বাসি। কিন্তু তোমার প্রতি আমার যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসা ঠিক নয়। সে ভালোবাসা অন্যরকমের।

—কি রকমের?

জিৎ সিং-এর মনে দ্বিধা জাগে। মিথ্যা কথা সে বলতে চায় না কিন্তু প্রিয়া জোর করলে মিথ্যা তাকে বলতেই হবে। কারণ তাকে যেতে হবে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়িতে। সে ধরা দিতে পারে না। তার বোনের সম্মানকে ঘিরে কালো মেঘ এগিয়ে আসছে।

—অন্য রকমের প্রিয়া। ভালোবাসা কতরকমের হয় তা তো জান। তুমি কি তোমার বাবাকে ভালোবাসো না?

—জিৎ, তোমার কথার ওপর আমার জীবন নির্ভর করছে। আমাকে দেখেও কি তুমি বুঝতে

পারছ না সেকথা?

তার কথার ওপর জীবন নির্ভর করছে প্রিয়ার। বেশ, মিথ্যা বললে যদি প্রিয়ার জীবন রক্ষা পায় তবে কেন সে মিথ্যা বলবে না?

—সে ভালোবাসা অন্য রকমের প্রিয়া। তাকে বুকে টেনে আনা যায় না। সে ভালোবাসায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস ক’রে কথা বলা যায় না। সে ভালোবাসায় আমার হাতখানা টেনে নিয়ে তোমার মতো সে তার বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতে পারবে না। সে ভালোবাসায় রাতের বেলায় পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে নিজের দেহের ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে চিন্তামুক্ত হওয়া যায় না। সেইরকম ভালোবাসি আমি লীলাবতীকে প্রিয়া। তাই তার অমঙ্গল ঘটছে জেনে ছুটে গেছলাম। তবে যদি তুমি রাগ ক’রে থাকো, আমি অসহায়। কারণ আমি একজন নগণ্য লোক, আর তুমি হলে—

প্রিয়া এক হাতে জিৎ-এর গলদেশ বেষ্টন করে, অপর হাতে তার মুখ চেপে ধরে। দুচোখ বেয়ে তার অবিরল ধারে অশ্রু ঝরে। সে ফিসফিস করে বলে,—আমায় ক্ষমা কর জিৎ। কিন্তু আমিও কি কম শাস্তি পেয়েছি?

—শুধু সেই জন্যই কি তোমার এ দশা প্রিয়া?

—হ্যাঁ জিৎ শুধু সেই জন্যে। আর কোনো কারণ নেই। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো কারণ আমায় এই অবস্থায় এনে দিতে পারে না।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সে প্রিয়ার চোখের দিকে চাইতে পারে না। মনে মনে ঈশ্বরকে ডেকে বলে,–হে একলিঙ্গ, আমি ঘোরতর পাপ করেছি। এ পাপ থেকে উদ্ধার আমি পাবো না জানি। উদ্ধার পেতে আমি চাইছি না। শুধু একটি মাত্র প্রার্থনা তোমায় জানাই, প্রিয় যেন জীবনে শান্তি খুঁজে পায়। আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম, তার ভালোবাসায় ভেতরের সমস্ত খাদ এভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে খাঁটি সোনা ক’রে তুলবে, তাহলে হয়তো কখনই এই অভিনয়ের পথে পা বাড়াতাম না। দেশের মঙ্গলের জন্যেও না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। আজকের মতো আমায় শক্তি দাও, শেষ অভিনয় ক’রে যাবার। আজকের এই অভিনয় তাকে আবার সুস্থ করে তুলবে, সজীব করে তুলবে। তারপর আমি আর কখনো ওর জীবন-পথে ফিরে আসতে চাইব না, ফিরে আসব না।

—কী ভাবছ জিৎ? চল আমার ঘরে।

—আজ আর যাবো না প্রিয়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে। হয়তো এই দেরি হয়ে যাওয়ায় আমার বিপদ ঘটতে পারে। আজকের মতো বিদায় নিতে অনুমতি দাও।

প্রিয়া একটু সময় চুপ ক’রে থাকে। জিৎ সিং দেখতে পায় দুর্বল শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় সে টলছে। তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ফেলে সে। প্রিয়া তার বুকের ওপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে বলে,—এবারে আমি ভালো হয়ে যাব জিৎ। আবার আগের মতো হবে। বাদশাহ্ আর বাবা আমাকে ভালো হতে দেখে অবাক্ হয়ে যাবেন।

—আনন্দিতও হবেন তাঁরা। কারণ তোমায় তাঁরা সত্যিই ভালোবাসেন।

—হ্যাঁ। কিন্তু তাঁরা কি ভাবেন জান?

—কি?

—এক অদ্ভুত কথা ভাবেন। সেকথা, আমি কল্পনাও করতে পারি না। তাঁদের ধারণা পৃথ্বীরাজ রাঠোরের জন্যে আমার এই দশা হয়েছে।

—কি করে বুঝলে?

—আমার পরিচারিকা শুনে বলেছে আমায়।

সে আর কিছু শোনেনি?

—না। আজকেও বাদশাহের সঙ্গে আবার অনেক কথা হয়েছে। একটি ঘরের ভেতরে। বাইরে থেকে কেউ শুনতে পায়নি। তুমি একটু আগে এলে তোমার বিপদ হত জিৎ। কারণ বাদশাহ্ এতক্ষণ এখানেই ছিলেন।

জিৎ ভীত হবার ভান করে বলে,—সত্যি! ভগবান বাঁচিয়েছেন বলতে হবে।

জিৎ সিং প্রিয়াকে ছেড়ে দেয়। সে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। কিন্তু প্রিয়া তার হাত চেপে ধরে আবার। একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে তার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে বলে,– তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। মুখের রঙ রোদে পুড়ে গেছে। সারাদিন তোমার এত কি কাজ জিৎ?

জিৎ-এর মনে হয় সে আর সহ্য করতে পারবে না। স্ত্রীলোকের মতো কেঁদে ফেলবে না বটে, তবে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে সব সত্য প্রকাশ করে ফেলবে। প্রিয়ার এই মমতাময়ী রূপ তার মনের সব মিথ্যে সব অভিনয়কে টেনে বের করে আনতে চায়। সে প্রিয়ার মাথায় হাত রেখে এবার একটু ম্লান হাসে। তারপর দ্রুতপদে বের হয়ে যায়।

ফটকের কাছে যেতেই প্রহরী তাকে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল বেরিয়ে আসে। সেই জল আর থামতে চায় না—কী চাচা, ধরা পড়ে গেছ নাকি?

কাঁদতে কাঁদতে প্রহরী বলে,—আমি ভেবেছিলাম তুমি ধরা পড়ে গেছ। ভেবেছিলাম এতক্ষণে তোমার গর্দান নেওয়া হয়ে গেছে। আমার গর্দান নেবার জন্যেও বুঝি ছুটে আসছে ওরা। কিন্তু তুমি বেঁচে আছো। ধরা পড়োনি! আমার প্রাণ আর চাকরি দুটোই টিকে থাকল তবে।

লোকটির জন্যে দুঃখ হয় জিৎ সিং-এর। সে বুঝতে পারে অনেক ক্রোধের উত্তাপে প্রথমটা ভুগেছে লোকটি। তারপর বাদশাহ্ এসে প্রবেশ করার পর থেকে নিদারুণ অশান্তিতে ভুগেছে দীর্ঘ সময়। শেষে তার মন ভগ্নদশায় এসে পৌঁছেছিল। জিৎ সিংকে অক্ষত শরীরে ফিরতে দেখে সে কান্না চাপতে পারেনি। তার সব ক্রোধ সব অশান্তি জল হয়ে গেছে।

—তোমার চাকরি খায় কার সাধ্যি? আমাকে অত বোকা ঠাওরাও নাকি?

—না। তুমি হলে গিয়ে পাক্কা ধুরন্ধর। তোমায় চিনতে আমার ভুল হয়েছিল। ওইখান থেকে তোমার সেই বিদঘুটে তলোয়ারটি নিয়ে ভাগো।

—সে কি চাচা! আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছ?

—না। তাড়াবো কেন? তবে আমার কাছে আর কখনো এসো না। তোমার চমৎকার গোঁফ উঠেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছ। শুধু শুধু পরের ঘাড়ে ভর না দিয়ে নিজের পায়ে চল। তাতে অনেকের অশান্তি কমবে।

জিৎ সিং দেখতে পায় লোকটির পা কাঁপছে তখনো। সে বুঝতে পারে, এত বড় শরীর নিয়েও কেন সে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে পারে না। ওই বিশাল বাহুখানা নিয়েও, কেন তার উন্নতি হয় না! বৃদ্ধ বয়স অবধি দরওয়াজায় পাহারা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই ওর।

—আচ্ছা চাচা, চলি তবে। তুমি যখন একেবারেই সহ্য করতে পারছ না আমায়।

প্রহরী কোনো কথা না বলে অন্যদিকে মুখখানাকে ঘুরিয়ে রাখে। জিৎ সিং পৃথ্বীরাজের গৃহে যাবে বলে স্থির করে প্রথমে। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই সে তার মত পরিবর্তন করে। এই রাতে সেখানে গিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। কারণ পৃথ্বীরাজ এ সময়ে নিশ্চয়ই গৃহে আছেন। তিনি জিৎকে পছন্দ করলেও তাঁর সামনে বোনকে ডেকে, নওরোজের কথা বলা যাবে না। আর তাঁর উপস্থিতিতে বোনকে আড়ালে ডেকে সব বললে, তাঁর অমর্যাদা করা হয়। তার চেয়ে আগামীকাল দিনের বেলায় একসময় পৃথ্বীরাজ-পত্নীর সঙ্গে দেখা করাই শ্রেয় বলে ভাবে সে। এমন কিছু তাড়া নেই। এখনো বেশ কিছুদিন বাকি রয়েছে নওরোজের।

পৃথ্বীরাজের বাড়ির পাশ দিয়েই সরাইখানায় যাবার পথ। সে বাড়িটির সামনে এসে থেমে যায়। ফটকের কাছে সরে এসে উঁকি দিয়ে দেখে, উধম সামনের ছোট্ট খোলা জায়গাটিতে অন্ধকারের মধ্যে একা বসে রয়েছে। বসবার ভঙ্গি দেখেই চেনা যায় তাকে। মুখ দেখে চেনবার মতো আলো ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *