ফতেপুর সিক্রি – ১

১.

সিক্রি!

শুধু পাথর। সবুজের চিহ্ন অতি বিরল। আমীর ওমরাহেরা এ-স্থান আগে দেখেছে। কিন্তু তাদের বেগমদের নাসিকা চারদিকে দৃশ্য দেখে কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সেই কুঞ্চনের কথা সালিমা বেগমের কানে যায়। তিনি সবাইকে ডেকে একদিন বলেন,–এই সিক্রি মুসলমানদের পবিত্র স্থান একে ঘৃণা করো না। ভালোবাসতে শেখ। এই সিক্রি বর্তমান বাদশাহকে উপহার দিয়েছে তাঁর বংশধর। আবার এই সিক্রিই বহুদিন আগে ভারতের বুকে মুঘল আধিপত্যের গোড়াপত্তন করেছিল। কারণ এর নিকটেই তখনকার ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর রানা সঙ্ঘের সঙ্গে বাবরের সাক্ষাৎ ঘটে এবং সেই সাক্ষাতের ফলাফল তোমাদের কারও অজানা নেই।

সালিমা বেগম আরও অনেক কিছুই বলেছিলেন হতাশ রমণীকুলকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে। সান্ত্বনা তারা পেয়েছিল কি না জানা যায় না। তবে তারপর থেকে প্রকাশ্যে সিক্রির দুর্নাম কেউ আর রটনা করেনি।

জিৎ সিং আর উধমের সরাইখানা প্রথম দিনেই লোকে পরিপূর্ণ হল। অনেকে জায়গা না পেয়ে শুধু আহারের জন্যে বসে রইল। মাধবের কাজের অন্ত নেই। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজন রয়েছে। মাধবকে অনেক আগেই উধম আগ্রার সরাইখানা থেকে সরিয়ে একজন রাজপুত সর্দারের বাড়িতে কাজে দিয়েছিল। সেখানে শান্তিতে ছিল সে। তবে এই অতিরিক্ত শান্তি মাধবকে চঞ্চল ক’রে তুলেছিল। মাঝে মাঝে তাই উধমের কাছে এসে অন্য কাজের জন্যে সাধাসাধি করত। সিক্রিতে এসে সে পরিতৃপ্ত। কারণ ছোট হলেও এই সরাইখানার ভার তারই ওপর দিয়েছে জিৎ সিং, পূর্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে।

দিনে দিনে সিক্রির চারদিকে নতুন অট্টালিকা উঠতে থাকে। জায়গাটি আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোরম হয়ে ওঠে। জলকষ্ট কমে যায় অনেক।

সেই সময়ে একদিন মেবারের খবর এসে পৌঁছালো। সে-খবর শুনে জিৎ সিং হয়তো আনন্দে নৃত্য ক’রে উঠত, যদি না তার সামনে সেই সময় দাঁড়িয়ে থাকত আকবর বাদশাহের দরবারের কর্মচারী। বাদশাহ্ জিৎ সিংকে ঠিক মনে রেখেছেন। আগামী কাল ডেকে পাঠিয়েছেন দরবারে।

তবু তার মুখচোখে আনন্দের বহিঃপ্রকাশটুকু কর্মচারীর দৃষ্টি এড়ায়নি। সে গম্ভীর হয়ে বলে উঠেছিল—বাদশাহ্ কিন্তু এ খবর শুনে ভ্রূকুঞ্চিত করেছেন। তিনি যে-সংবাদে সন্তুষ্ট নন। আপনার পক্ষে তাতে আনন্দ প্রকাশ করা শোভা পায় না। বিশেষ ক’রে আপনি যখন বাদশাহের প্রিয়পাত্র।

—আমি প্রিয়পাত্র এ-কথা আপনাকে কে বলল?

—প্রিয়পাত্র না হলে একজন সামান্য সরাইখানার মালিককে মুঘল বাদশাহ্ দরবারে আমন্ত্রণ জানাতেন না।

—হয়তো কোনো কাজ রয়েছে। কিংবা হয়তো তিনি আমায় শাস্তি দেবেন।

লোকটি হেসে ওঠে,—শাস্তি? শাস্তি দিতে হলে তিনি অন্য কাউকে পাঠাতেন। তার জন্যে অন্যলোক রয়েছে। আপনি জানেন না কর্মচারীদের মধ্যে আমার স্থান কত উঁচুতে। বাদশাহ্ যাঁদের কাছে আমায় পাঠান, তাঁরা সবাই হিন্দুস্থানের বিখ্যাত ব্যক্তি। সাধারণ মানুষের কাছে আমি যাই না।

—কিন্তু আমি সাধারণ।

—আপাতদৃষ্টিতে সেইরকম দেখাচ্ছে বটে। কিন্তু আমি জানি, বেশিদিন আপনি এই সাধারণ অবস্থার মধ্যে থাকবেন না।

—আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কালই এক হাজারী মনসবদারী পেয়ে যাব।

—আপনি ঠাট্টা করছেন? করুন। তবে শুনে রাখুন, এই মুহূর্তে যদি তেমন কিছু পেয়ে যান তাতেও বিস্মিত হব না আমি। এমন অনেক দেখা অভ্যাস আছে আমার। মুনিম খাঁকে দেখলাম, সামসুদ্দিনকে দেখলাম, আসফ খাঁ আর আবুল ফজলকেও দেখলাম। বাদৌনী—কত আর নাম করব? অনেক দেখেছি। ওঁরা সবাই রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছেন।

—আপনি হিন্দু হলে বলতাম, আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। কিন্তু আপনি হিন্দু নন। তাই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যেন আপনার আরও অনেক উন্নতি হয়।

কর্মচারীটি চলে যায়। জিৎ সিং ছুটে একটি ঘরে প্রবেশ ক’রে দরজা বন্ধ ক’রে দেয়। তারপর সত্যি সত্যিই নাচতে থাকে, অন্তত সে-নাচে ছন্দ না থাকুক দেহের গতি আছে। তার অনেকদিনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। কিকা হয়েছেন মেবারের রানা। মেবারের সিংহাসনে এখন রানা প্রতাপসিংহ। কিন্তু সহজে তিনি হতে পারেননি রানা। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে উদয়সিংহ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে প্রভাবশালী সর্দারদের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন, মেবারের পরবর্তী রানা হবে জগমল। হয়েও ছিল তাই। উদয়সিংহের মৃত্যুর পর জগমলই সিংহাসনে বসল। কারণ অধিকাংশ সর্দার মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে প্রদত্ত তাদের কথার খেলাপ করতে চায়নি। কিন্তু এর মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিল। কয়েকজন সর্দার খুবই অসন্তুষ্ট হয়। আর তারা সরাসরি কথাও দেয়নি উদয়সিংহকে। এই অসন্তুষ্ট সর্দার কয়েকজনের ধূমায়মান ক্রোধকে উস্কে দিলেন গোয়ালিয়রের একজন প্রাক্তন রাজা। রাজ্য হারিয়েও রাজোয়ারার প্রতি ভালোবাসা তাঁর রয়েছে তেমনি অটুট। তাই শেষবারের মতো। লড়বার জন্য সমস্ত রাজোয়ারার নায়ক হতে পারেন, এমন একজন পুরষকে খুঁজতে খুঁজতে তিনি উদয়পুরে এসে তাঁর সাক্ষাৎ পেলেন।

সেই পুরুষটি প্রতাপসিংহ। তাই জগমল সিংহাসনে উপবিষ্ট হলে তিনি খুবই উত্তেজিত হলেন। সেই উত্তেজনা সংক্রামিত হল ঝালোর রাও আর বৃদ্ধ রায়ৎ কৃষ্ণের হৃদয়ে। তাঁরা সবাই মিলে এগিয়ে গেলেন সিংহাসনের দিকে, জগমল যেখানে উপবিষ্ট। বাইরে তখন উদয়সিংহের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আর প্রতাপসিংহ তখন তাঁর অতি প্রিয় অশ্ব চেতককে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছিলেন অশ্বশালা থেকে। একটু পরেই তিনি চিরবিদায় নেবেন উদয়পুর থেকে। চলে যাবেন গভীর বনে। সেখানে পাহাড়ীয়াদের উপযুক্ত ক’রে তুলবেন।

বৃদ্ধ কৃষ্ণ আর গোয়ালিয়রের রাজাকে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে জগমল বিস্মিত হল। সে চেঁচিয়ে উঠল,—আর কত দূর এগোবেন আপনারা? এটা রাজসভা। আপনারা বিধিসম্মতভাবে যতটা এগোতে পারেন তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছেন।

তবু থামলেন না ওঁরা, এগিয়ে এলেন। মেবারের সচিব সেই মুহূর্তে সব কিছু বুঝে নিয়ে সহাস্যে বলে উঠলেন,—আপনি একটা মস্ত ভুল করেছেন রানা। যে জায়গাটিতে আপনি বসে রয়েছেন, সেটি আপনার নয়, আপনার ভাই-এর।

সচিবের কথা শেষ হবার পূর্বেই ওরা দুইদিক থেকে জগমলের দুই হাত ধরে টেনে নামিয়ে তাকে সিংহাসনের সামনের একটি আসনে বসিয়ে দিল।

বাইরে ছুটে গিয়ে একজন প্রতাপকে ডেকে আনল। তাঁকে হাত ধরে সম্মানের সঙ্গে সিংহাসনের সামনে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার সবার দিকে চাইলেন। দেখলেন সর্দারদের মুখে স্মিত হাসি। দেখলেন জগমল সিংহাসন থেকে দূরে একটি আসনে মুখ নীচু করে বসে রয়েছে। সব বুঝে নিয়ে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে সিংহাসনে উঠলেন। উঠেই গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন,—আমাদের পুরাতন প্রথা ভুললে চলবে না। আমরা রাজপুত। আজ‍ই গৌরীদেবীর জন্য বরাহ শিকার করে উৎসর্গিত করা হবে।

জিৎ সিং যখন এইসব কথা শুনছিল, তখন তার শরীরে জেগে উঠছিল পুলক শিহরণ। তারপর যখন সে শুনল জগমলকে কিভাবে হাত ধরে টেনে তুলে দেওয়া হল সিংহাসন থেকে তখন সে আনন্দে নেচে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু নেচে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ সেই মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছিল দরবারের কর্মচারীটি।

তাই এতক্ষণ পরে একা বন্ধ ঘরের মধ্যে সে পাগলের মতো লাফাতে থাকে। একে নাচও বলা যায়, উন্মত্ততাও বলা যায়। সে ভালোভাবেই জানে, এই মুহূর্তে তার মতো আরও অনেক রাজপুত নৃত্য করছে। যারা সংবাদটি আগে পেয়েছে, তারা আগে নৃত্য করেছে। আর যারা পরে শুনবে, তারা পরে নাচবে।

কিছুক্ষণ পর শান্ত হয় জিৎ। সে ধীরেসুস্থে বাইরে আসে। বাইরে এসে মাধবকে ডাকে।

মাধব এখন তার হাতের লাঠি।

.

পরদিন দরবারে পৌঁছে বাদশাহের আগে মানসিংহের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। মানসিংহের কাছে মনে মনে সে অপরাধী। কারণ তিনি তাকে অতটা প্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও সে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছে খুব কম। রণথম্ভোর অভিযানের পর মানসিংহের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তার কাছে। এরপর যদি কখনো মেবার আক্রমণে মানসিংহ অংশগ্রহণ করেন, তবে অবশ্য তাঁকে খোশামোদ করতেই হবে। কিন্তু কেন যেন তার মনে হয়েছে, বাদশাহ্ মানসিংহের ওপর মেবার আক্রমণের ভার কখনই দেবেন না।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে, তাকে দেখেই মানসিংহ মুখ ঘুরিয়ে নেন। তাঁর মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। সেই চিহ্ন দেখে দমে যায় জিৎ সিং। সে কোনোরকমে বাদশাহকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

বাদশাহ্ তার দিকে চেয়ে বলে ওঠেন,—ও তুমি! জিৎ সিং তোমার নাম?

—হ্যাঁ জাহাঁপনা।

—তুমি আমার খুবই পরিচিত, অর্থাৎ তোমার মুখটি। ও মুখ আমি অনেকবার দেখেছি। জিৎ সিং চুপ ক’রে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারে না, কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

—তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। বিশেষ করে একটা বেখাপ্পা ধরনের তলোয়ার হাতে নিয়ে তুমি যে অজেয় হয়ে ওঠো, এ খবরও আমার জানা। তোমায় আমি সত্যিই বাহবা না দিয়ে পারি না। সেই অস্ত্রটি কোথায়?

জিৎ সিং সেটি রেখে এসেছিল উধমের কাছে। কারণ দরবারে তলোয়ার ঝুলিয়ে কোনো রথী মহারথীরাই প্রবেশ করতে পারেন না। মানসিংহও নন। পারেন শুধু একজন। তিনি হলেন সুরজন রাও। রণথম্ভোরে চুক্তিতে এটুকু তিনি লিখিয়ে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ নিজে লিখে বাদশাহকে দিয়ে সহি করিয়ে নিয়েছিলেন। বাদশাহ্ নিজে লিখতে জানেন না। লেখাপড়া শেখবার অবকাশ জোটেনি তাঁর ঘটনাবহুল জীবনে। তিনি শুধু নিজের নামটি সই করা শিখে নিয়েছেন। প্রয়োজন হলে অনভ্যস্ত হাতে কলম ধরে শিশুর মতো ধীরে ধীরে নিজের নামটি লিখে দেন।

জিৎ সিং বলে,—অস্ত্রটি রেখে এসেছি, জাহাঁপনা।

বাদশাহ্ একটু চুপ করে থেকে মানসিংহের দিকে ঘুরে বলেন,–এই লোকটিই রণথম্ভোরে পত্র নিয়ে গেছল না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। মানসিংহ নির্বিকারভাবে বলেন।

বাদশাহ্ আর একবার আপাদমস্তক দেখে নেন জিৎ সিং-এর। তাঁর সেই দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। জিৎ সিং একটু সংকুচিত না হয়ে পারে না।

—শিকারে গেছ কখনো?

—আজ্ঞে, খুব কম গেছি।

—ঠিক আছে। আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমায়। দু-চারদিনের মধ্যেই যাবার ব্যবস্থা করছি।

আমীর ওমরাহদের মধ্যে উৎসাহের গুঞ্জন শোনা যায়। তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, —বাঘ তো বেশ কিছুদিন দেখা যাচ্ছে না জাহাঁপনা

বাদশাহ্ হেসে বলেন,—বাঘ নয়। এবার এক অদ্ভুত জীব শিকার করব আমরা।

—হাতি জাহাঁপনা?

—না। হাতিও নয়।

—বন্য বরাহ শিকারও অবশ্য মন্দ হবে না।

বাদশাহ্ আরও জোরে হেসে বলেন,—তাও নয়, এবারে আমরা গর্দভ শিকারে যাব। এক সঙ্গে অনেকগুলি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়,—গাধা!

—হ্যাঁ। বুনো গাধা। মন খারাপ হয়ে গেল? হিংস্র জন্তু না হলে আপনারা তুষ্ট হন না। দেখব গাধাই ক’টা শিকার করতে পারেন আপনারা।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে এর মধ্যেই দরবার কক্ষ চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। চারদিকে আড়ম্বরের শেষ নেই। দেখে মনেও হয় না নতুন তৈরি হয়েছে এই দরবার-কক্ষ। মনে হয় বংশপরম্পরায় এই একই কক্ষে মুঘল বাদশাহ্রদের দরবার বসে আসছে।

জিৎ সিং আরও লক্ষ্য করে দরবারে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তির্যক দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে। তাদের কারও চোখে বিদ্রূপ, কারও চোখে ঈর্ষা আবার কারও চোখে শুধুই কৌতূহল। সে বুঝতে পারে আজ থেকে সিক্রিতে তার শত্রুসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। এবার থেকে আরও সাবধানে তাকে অগ্রসর হতে হবে।

.

সিক্রি থেকে পনেরো ক্রোশ দূরে এক অরণ্যের ধারে এসে সবাই উপস্থিত হল। শিবিরের বাহুল্য বাদশাহ্ পছন্দ করেন না মৃগয়ার সময়। একটি মাত্র বড় শিবির সঙ্গে আনা হয়েছে, যেখানে মৃগয়ার আগে এবং পরে সবাই এক সঙ্গে মিলিত হতে পারে। শ’খানেক সাধারণ লোকও সঙ্গে রয়েছে। তারা বিশ্রাম নেবে উন্মুক্ত আকাশের নীচে।

বাদশাহের স্বভাব জিৎ-এর জানা ছিল। অনেকের কাছেই সে শুনেছে শিকারের সময় তিনি মত্ত হয়ে ওঠেন। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তাঁর। সে সময় নিজের প্রাণটিকেও তিনি গ্রাহ্য করেন না। কতবার হিংস্র বাঘ কিংবা মত্ত হাতির পেছু ধাওয়া করে বিপদে পড়েছেন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করতে সবাই ব্যর্থ হয়ে তাঁর জীবনের আশা পরিত্যাগ করেছে কতবার। কিন্তু প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত তিনি কৃতকার্য হয়ে ফিরে এসেছেন। তাঁর ধারণা অত সহজে মৃত্যু হতে পারে না তাঁর। নিজের জীবনের ভার ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে বাদশাহের। দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর, হিন্দুস্থানে মুঘল রাজত্বের ভিত্তিকে দৃঢ় করবার জন্যেই জন্ম। নইলে কালাঞ্জর অবরোধ কালে বীর শের শাহ্ অকস্মাৎ অগ্নিদগ্ধ হয়ে কখনো মারা যেতেন না। নইলে ছেলেবেলার হাজার ঝড়-ঝাপটা আর বিপদকে তিনি কাটিয়ে উঠতে পারতেন না।

এসব কথা জিৎ সিং বহুবার শুনেছে বহুজনের কাছে। তবে আজকের শিকারে বড় রকমের ঝুঁকি নেবার প্রশ্ন নেই। কারণ গাধা কখনো মাংসাশী হয় না। গাধাকে ছেলেবেলা থেকে তৃণগুল্ম না দিয়ে শুধু যদি মাংস খেতে বাধ্য করা হত তবে হয়তো তেমন কিছু হলেও হতে পারত। তবু তার নখ নেই। তার শ্বা-দত্ত আছে বলেও শোনা যায়নি। সুতরাং সেদিক দিয়ে সঙ্গের আমীর ওমরাহরা আজ অনেকটা নিশ্চিন্ত। তবে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া কখনই সম্ভব নয়। কারণ কোনো বনেই শুধু গর্দভ বিচরণ করে না। অন্য পশুও থাকে।

আকবর শাহ্ শিবিরের মধ্যে সবাইকে ডেকে বলেন,—আজকের শিকারের বীরত্ব দেখাবার সুযোগ নেই। সুযোগ থাকলে সে বীরত্বের সব চাইতে বড় অংশীদার প্রতিবারের মতো আমিই হতাম। আজকে শুধু নিজের ক্ষিপ্রগতি আর কৌশলকে কাজে লাগাতে হবে। দেখা যাক আপনাদের মধ্যে কেউ আমাকে পরাস্ত করতে পারেন কি না।

আমীর ওমরাহেরা একসঙ্গে বলে ওঠে, অসম্ভব।

—কেন? অসম্ভব কেন?

কালাঞ্জর বিজয়ী বীর মজনুন খাঁ চোখ বুজে হেসে বলে,—আপনি বাদশাহ্।

—বাদশাহ্ হলে কি সব বিজয়েই সবার চেয়ে ভালো হতে হবে?

—অন্যান্য বাদশাহ্ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারি না, তবে আপনি সবার চেয়ে সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ।

আকবর হেসে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন মজনুন খাঁ আরও উঠতে চায়। সে মানসিংহ, মুনিম খাঁ আর সামসুদ্দিনের মতো সম্ভ্রান্ত হতে চায়। কিন্তু তাকে আর বেশি উঠতে দেওয়া চলে না।

ধীরে ধীরে বলেন বাদশাহ্,—তানসেন এ কথা শুনলে বিস্মিত হত। তার চেয়ে ভালো গান আমি জানি, এ কথা নিশ্চয়ই সে বিশ্বাস করবে না। ওই তো বীরবল বসে রয়েছে, ওকে জিজ্ঞাসা কর তো, ওর চেয়ে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারি কি না? তাছাড়া একটি বিষয়ে এখানে উপস্থিত সবার চেয়ে নিকৃষ্ট। আমি লিখতে জানি না।

মজনুনের মুখখানা কালো হয়ে যায়। সে অন্য সবার পেছনে অদৃশ্য হয়। দরবারের পুরোনো লোকেরা ভাবে ভালো হয়েছে। খোঁতা মুখ ভোঁতা হয়েছে ওর। বড় বেশি গর্ব হয়েছিল। ব্যাটা বোঝে না যে বাদশাহ্ নির্বোধের তোষামোদে ভোলেন না তাঁকে তোষামোদ করতে হলে, বীরবলের কাছে একমাস শিক্ষা নিতে হবে।

জিৎ সিং আজ আমীর ওমরাহের দলে মধ্যে। কারণ সে বাদশাহের নিমন্ত্রিত। নিমন্ত্রিত বলেই তার পোশাক-পরিচ্ছদে তেমন পরিপাট্য না থাকলেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কোনোরকমের আপত্তি তোলেনি। তবে যখনই কারও সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে তখনই সে তার চোখের মধ্যে দেখেছে অবজ্ঞা আর ঘৃণার ভাব। তবু সে অস্বস্তি অনুভব করেনি। সে জানে, আজ যদি তার কথায় আর কাজে বাদশাহ্ সন্তুষ্ট হন তাহলে এদের অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত দেখা করতে পারবে সে। তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কারণ প্রিয়ার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করার দিন চলে গেছে। এখন প্রিয়া বলতে গেলে একরকম ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের জন্য এদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই। তাই এদের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করতে হবে।

বাদশাহ্ বলেন—এবারে আমরা যাত্রা করব। প্রত্যেকে যা যা প্রয়োজন সঙ্গে নিন। তারপর নিজের মতো বনের ভেতরে চলে যান। পাশাপাশি কিংবা কাছাকাছি থাকবার প্রয়োজন নেই। যাবার আগে প্রত্যেকে আমার কাছ থেকে এক একটি ক’রে তামার চাকতি নিয়ে যাবেন। সেই চাকতিতে খোদাই করা রয়েছে বিভিন্ন রকমের চিহ্ন। যাঁর ভাগ্যে যে চাকতি পড়বে, তিনি সেই চিহ্নের অধিকারী। গাধা শিকার ক’রে তার কপালের ঠিক মাঝখানে চাকতির চিহ্নটি এঁকে দেবেন তলোয়ার দিয়ে। এতে সুবিধে হবে এই যে, শিকার শেষে সেগুলোকে সংগ্রহ করে এনে এই শিবিরের সামনে ফেললে সহজেই বোঝা যাবে, কে কয়টি মেরেছে।

জিৎ সিং-এর ভাগ্যেও একটি চিহ্ন মেলে। সেটিকে সযত্নে শিরস্ত্রাণের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সবার মতো সে-ও ঘোড়া ছুটিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করে। বাদশাহের হুকুম, গাধা ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী হত্যা করা চলবে না। তবে হিংস্র প্রাণী সম্মুখে পড়লে স্বতন্ত্র কথা

জিৎ সিং গর্দভের খোঁজে অরণ্যের ভেতরে অনেকটা দূরে চলে যায়। কিন্তু কোথাও একটি গর্দভপ্রবরেরও দেখা পায় না। আশেপাশে দুরে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, অশ্বের হ্রেষারব, চিৎকার সবই তার কানে আসে। তাদের তৎপরতার আভাস পেয়ে তার সন্দেহ থাকে না, তারা শিকার পেয়েছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে চাইতে চাইতে চলতে থাকে। যত ভেতরে প্রবেশ করে, ততই হতাশায় ভরে যায় তার মন। যদি একটিও শিকার তার ভাগ্যে না জোটে, তবে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের যে বিদ্রূপ এ পর্যন্ত অনুচ্চারিত রয়েছে তা কণ্ঠস্বরের ভেতর দিয়ে বর্ষিত হবে। বাদশাহ্ও তার অকৃতকার্যতায় কৌতুক অনুভব করবেন।

ভাবতে ভাবতে জিৎ সিং আরও এগিয়ে যায়। চারদিকে নিস্তব্ধ। এতদূরে কেউ-ই এগিয়ে আসেনি। তারা হয়তো প্রয়োজন বোধ করেনি। শিকার মিললে শুধু শুধু কেন এতদূর আসতে যাবে তারা?

জিৎ সিং দেখতে পায় অরণ্য এক জায়গায় ফাঁকা হয়ে আসছে। আর কিছুদূর গেলেই বন শেষ হয়ে যাবে। বনের অপর প্রান্তে উপস্থিত হবে সে। সেখানে রয়েছে হয়তো কোনো জনপদ। তাদের কাছে সে জেনে নিতে পারবে ওই বিদঘুটে জন্তুদের হদিশ। ক্ষীণ আশা জাগে জিৎ সিং-এর মনে। আর সেই সঙ্গে সে আপন মনেই হোহো করে হেসে ওঠে। জীবনে একটি মুহূর্তের তরেও সে কখনো কল্পনা করেনি যে গাধার জন্যে তাকে এমন ভীষণভাবে চিন্তিত হতে হবে।

বন শেষ হয়। কিন্তু কোথায় জনপদ?

সামনে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। মানুষের চেয়েও উঁচু সেই তৃণ। আর সেই তৃণভূমিতে যাদের সে বিচরণ করতে দেখল, তাদের পরিবর্তে স্বয়ং একলিঙ্গকে দেখলেও তখন বোধহয় বেশি খুশি হত না।

একটি নয়। অনেক, অনেক গর্দভ। তারা কখনো বা বাইরে আসছে, কখনো তৃণের ভেতরে গা ঢাকা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করে জিৎ। সে বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। ঘোড়া ছুটিয়ে গেলে ওদের একটিও থাকবে না। কোথায় পালিয়ে যাবে ঠিক নেই। তার চেয়ে ঘোড়া থেকে নেমে গোপনে ওই তৃণের মধ্যে আত্মগোপন ক’রে থাকতে হবে। সামনে যে আসবে তলোয়ারের আঘাতে তাকে শেষ করতে হবে।

জিৎ সিং অন্যপথে ঘুরে গিয়ে সুবিধেমতো জায়গা দেখে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ে ঘোড়াটিকে শক্ত ক’রে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে সে ধীরে ধীরে গিয়ে তৃণভূমির মধ্যে গা-ঢাকা দেয়। তারপর সুবিধেমতো একটি জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়াবার আগেই একটি গাধা সামনে এসে পড়ে। সে নিমেষে তলোয়ার টেনে নিয়ে সেটিতে আঘাত করে। কোনো চিৎকার পর্যন্ত করতে পারে না সেটি। শুধু পড়ে গিয়ে তার পেছনের পা বারদুয়েক ছুঁড়ে শান্ত হয়ে যায়। জিৎ সিং-এর মন খারাপ হয়ে যায়। একে শিকার বলে না। এর নাম হত্যা। এর চেয়ে সিক্রির সরাইখানার সামনে বসে বসে পায়রা মারাতেও উত্তেজনা আছে। তার ইচ্ছে হয় শিবিরে ফিরে যেতে। সঙ্গে সঙ্গে ওমরাহদের মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে নিজেকে শক্ত করে।

এরকম বহুক্ষণ তার জ্ঞান থাকে না। কারণ সারা তৃণভূমিতে একটু একটু ক’রে এগিয়ে সে অনেক গাধাকে সামনে পেল। একটিকেও ফিরে যেতে দিল না। শেষে এক সময়ে নিজের পোশাক আর তলোয়ারের দিকে চেয়ে সে শিউরে ওঠে। চিতোর অবরোধের সময়ও বোধহয় কোনো মুঘল কিংবা রাজপুতের অসি রক্তে এতটা রাঙা হয়ে ওঠেনি। জিৎ সিং এক জায়গায় বসে পড়ে। তার হাত ব্যথা করছিল। সে বসে বসে ভাবে। গাধাগুলোকে ঝোঁকের মাথায় সে মেরেছে, কিন্তু তাদের মাথায় চাকতির চিহ্নটি এঁকে দিতে সে বিচলিত হয়। তবু চিহ্ন এঁকে দেয় সে।

তারপর আবার বসে পড়ে। অনেকক্ষণ বসে থাকে। সামনে দিয়ে কত গাধা চলে যায়, ভ্রূক্ষেপ করে না। সে ভাবে, সূর্যাস্তের এখনো অনেক দেরি, এত আগে ফিরে যাওয়া উচিত হবে কি না।

হঠাৎ সে শুনতে পায় ঠিক তারই পেছন থেকে একজন বলে ওঠে,–কে, জিৎ সিং? চমকে ফিরে চাইতেই সে দেখে স্বয়ং বাদশাহ্ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরও অস্ত্রটি রক্ত মাখা তাঁরও দেহ রক্তাপ্লুত।

তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে জিৎ সিং।

বাদশাহ্ মৃদু হেসে বলেন,—তুমিও অনেক গাধা মেরেছ দেখতে পাচ্ছি। কতগুলো মেরেছ?

—গুনিনি জাহাঁপনা।

—অনেক মেরেছ দেখছি। আমার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে।

এ-প্রশ্নের উত্তর দেবার সাধ্য নেই তার। সে চুপ করে থাকে।

—এ স্থানটির খবর কোথায় পেলে তুমি? তোমাকে কেউ বলে দিয়েছিল?

—আজ্ঞে না। দৈবাৎ এসে পড়েছি।

—ও, তোমার ঘোড়া কোথায়?

—বনের ধারে বাঁধা রয়েছে।

—আচ্ছা চল।

জিৎ সিং বাদশাহকে সামনে এগিয়ে যেতে পথ দেয়। কিন্তু তিনি সেভাবে যেতে চাইলেন না। তিনি জিৎ সিংকে পাশে নিলেন। মনে মনে হাসে জিৎ সিং। হাসলেও বাদশাহের সাবধানী মনটাকে প্রশংসা না ক’রে পারে না। ছেলেবেলা থেকে ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে মানুষ হয়ে এই সাবধানগুলি তাঁর স্বভাবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো তিনি সচেতনভাবে এসব করেন না।

জিৎ সিং দেখে বাদশাহের অশ্ব তার অশ্বের কাছাকাছি বাঁধা ছিল। তবে গাছের আড়াল পড়ে যাওয়ার আগে নজরে পড়েনি।

—জিৎ সিং।

—জাহাঁপনা।

—আমি বুঝলাম, আমার অনেক আমীর ওমরাহের চেয়ে তোমার কষ্টসহিষ্ণুতা আর ধৈর্য অনেক উঁচুদরের। শিবিরে গিয়ে দেখতে পাবে তাদের অনেকে বনের মধ্যে বেশিদূর না এসেই ফিরে গেছে। অনেক দেখবে একটি গাধাও মারতে পারেনি।

জিৎ সিং চুপ করে শোনে।

বাদশাহ্ কিছুক্ষণ ঘোড়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাকে আদর করেন। তার কাঁধে হাত বুলিয়ে দেন। তার পিঠে থাবা মারেন। তার পা পরীক্ষা করেন। অশ্বজাতিকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন। হারেমের বেগমের চেয়েও ঘোড়া তাঁর ঘনিষ্ঠতর সাথী। ছেলেবেলা থেকে এদের সান্নিধ্যেই তাঁর কেটেছে। সবচেয়ে বেশি কেটেছে এদের পিঠে। তাই তাঁর পা দুটো অমন বাঁকা।

—দেখি জিৎ সিং, এই তো তোমার সেই বিখ্যাত অস্ত্রটি, দেখি। অনেকে অনেক কথা বলে এটি সম্বন্ধে।

একটু ইতস্তত করে জিৎ সিং। ক্ষণেকের জন্যে সন্দেহ জাগে তার মনে। বাদশাহ্ কি সব জেনে-শুনে কৌশলে তাকে নিরস্ত্র করতে চাইছেন?

কিন্তু এ সন্দেহ ক্ষণেকের। সে তার ভুল বুঝতে পারে। তাকে নিরস্ত্র করতে হলে কৌশলের প্রয়োজন কি? বাদশাহের একটি হুকুমই তো যথেষ্ট।

বাদশাহ্ তার দ্বিধাভাব লক্ষ্য ক’রে বলেন,—আপত্তি আছে কি?

—না জাহাঁপনা। সাধারণত এটিকে আমি হাতছাড়া করি না। তাই অমন হয়েছিল। এই নিন। সে তলোয়ারটি বাদশাহকে দেয়। তিনি সেটি নিয়ে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখেন। শেষে বলেন, —বহু পুরোনো জিনিস। বেশ ভারী। তোমার দেহ দেখে কেউ বলতে পারবে না, এটিকে তুমি ব্যবহার করতে পার। তবে তোমার কবজি দেখে তা বোঝা যায়। কোথায় পেলে তুমি?

—বাবার জিনিস। মৃত্যুর আগে আমায় দিয়ে গেছেন।

—তোমার বাবা কে ছিলেন?

জিৎ সিং সোজা বাদশাহের মুখের দিকে চেয়ে বলে,—চিতোরের অজিত সিং।

—নাম শুনিনি। শোনা সম্ভবও নয়। তবে তোমাকে দেখে বোঝা যায় তোমার বাবা সাধারণ মানুষ ছিলেন না।

মনে মনে আনন্দ হয় জিৎ সিং-এর মুহূর্তের জন্যে সে ভুলে যায়, কেন সে মেবার ছেড়ে আগ্রা এবং শেষে আগ্রা ছেড়ে সিক্রিতে এসে হাজির হয়েছে। বাদশাহের চরিত্রের এই সরল দিকটি তাকে মুগ্ধ না করে পারে না।

জিৎ সিং।

—জাহাঁপনা।

—এসো, এক হাত খেলে দেখা যাক্।

বিমূঢ় জিৎ সিং বলে ওঠে,—অসিযুদ্ধ জাহাঁপনা?

—হ্যাঁ। যদিও আমার অস্ত্রটি তোমারটির চেয়ে নিকৃষ্ট।

—কিন্তু!

কোনো কিন্তু নয়। আমি পরীক্ষা করতে চাই, কত বড় অসিধারী তুমি।

—এতে জখম হবার সম্ভাবনা রয়েছে জাহাঁপনা। খুন হয়ে যাবার সম্ভাবনাও রয়েছে।

—উভয়েরই রয়েছে।

জিৎ সিং স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাদশাহ্ তার তলোয়ার তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেরটি কোষমুক্ত করে দু’পা পেছিয়ে দিয়ে চিৎকার ক’রে ওঠেন,—সামলাও জিৎ সিং।

শুরু হয়ে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ আক্রমণ, আর প্রতি আক্রমণ চলে। কিন্তু কোনো ফলই হয় না। অবাক্ হয়ে জিৎ সিং ভাবে, রাম সিং-এর মতো ভারী চেহারা হওয়া সত্ত্বেও বাদশাহের গতি এত ক্ষিপ্র হল কি ক’রে? তাঁর ক্ষিপ্রতা মাঝে মাঝে তাকেও যেন ছাড়িয়ে যেতে চাইছে। নিজের ওপর রাগ হয় জিৎ সিং-এর। প্রায় মাসখানেক হতে চলল তলোয়ার নিয়ে অভ্যাস করেনি সে। শুধু বুদ্ধির খেলাতেই মত্ত ছিল। তাই তার গতিবেগে আগের সেই তীব্রতা নেই। সেই তীব্রতা থাকলে বাদশাহকে সে এতক্ষণ ধরে লড়তে দিত না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে জিৎ এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে পরাস্ত না হয়ে যদি বেঁচে ফিরে যায়, তবে আবার প্রতিদিন অভ্যাস শুরু করবে।

বাদশাহ্ও অবাক্ হন। অনেক যোদ্ধার সঙ্গে তিনি লড়েছেন, কিন্তু এমন কখনো দেখেননি। লোকে বলে রাজা মানসিংহ রাজপুতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অসিধারী। কিন্তু মান সিংহকেও তিনি একবার বেকায়দায় ফেলেছিলেন। অথচ এই নবীন যুবকের অসি-চালনা আর পায়ের কাজ অনেক বেশি সূক্ষ্ম। এর কার্যকারিতা অনেক বেশি।

দুজনাই পরিশ্রান্ত। তবু এইভাবে আরও বহুক্ষণ চলে।

শেষে একসময় বাদশাহ্ সহসা তাঁর নিজের অসি ছুড়ে ফেলে দেন। সুবর্ণ সুযোগ জিৎ-এর সম্মুখে। সিক্রি-সংলগ্ন এই বনের কিনারায় সে এই মুহূর্তে মুঘল-রাজত্বের অবসান ঘটাতে পারে। মেবার শত্রুহীন হবে। চিতোর পুনরধিকার করা যাবে সহজে। রানা প্রতাপ সিং সেই চিতোরের সিংহাসনে বসে সারা হিন্দুস্থানকে ধীরে ধীরে দখল করে নেবেন। রাজপুতদের বিজয় পতাকা আসমুদ্র-হিমাচল পতপত করে উড়বে। কিন্তু না, সে পারে না। প্রতিদ্বন্দ্বী নিরস্ত্র হলে, কিভাবে তার বুকে অসি বিধিয়ে দিতে হয় সে তা শিখেছে, যদি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী জেনে ফেলে যে সে গুপ্তচর। কিন্তু বাদশাহ্ একথা জানেন না। জানলে কখনো ওভাবে অসি ফেলে দিতেন না। দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বানও করতেন না তাকে। তাই বাদশাহকে হত্যা করা অসম্ভব।

নিজের অসিটিকে মাটিতে বিধিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

—শাবাশ জিৎ সিং।

—আপনি হঠাৎ—?

—হ্যাঁ। আমি হঠাৎ খেলা ছেড়ে ছিলাম। তোমায় পরীক্ষা করলাম। অনেকে আমায় শুনিয়েছে তুমি নাকি এখানে এসেছ গুপ্তচর বৃত্তি নিয়ে। আমারও মনে কেমন সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল, তাই তোমায় এই মৃগয়ায় আহ্বান করেছি। আমার সন্দেহের নিরসন ঘটেছে। তুমি হয়তো ভাবছ আমি নির্বোধের মতো কাজ করেছি। না। তা করিনি। এই দেখ।

বাদশাহ্ তাঁর কোমরের কাছ থেকে বন্দুকের মতো ছোট্ট একটি জিনিস বের করেন। এত ছোট বন্দুক সে জীবনে কখনো দেখেনি এবং সে হলপ করে বলতে পারে সারা ভারতবর্ষে মুষ্টিমেয় দু-চারজন ছাড়া এ জিনিস কেউ দেখেনি।

বাদশাহ্ হেসে বলেন,—এটি উপহার পেয়েছি এক বিলাতী পাদরীর কাছ থেকে।

আবার তিনি বলেন,—বুঝে দেখ ধর্ম করতে এসেও এ-জিনিস সঙ্গে এনেছে ওরা। চমৎকার অস্ত্র। তোমার এই তলোয়ার এর গুলি রোধ করতে পারত না।

জিৎ সিং-এর আফশোস হয়। সে জানে, আত্মবিশ্বাস বাদশাহের অগাধ হলেও, তিনি আসি পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সে যদি আক্রমণ চালাতো তাহলে ওই পশ্চিম দেশীয় অস্ত্রটি বার করবার সময় তিনি পেতেন কি না সন্দেহ। কখনই পেতেন না। তাঁর ওই আত্মবিশ্বাসজাত অহঙ্কারের সুযোগ সে নিতে পারল না। গুপ্তচর থেকে আরও অনেক নীচে গুপ্তঘাতকের স্তরে পৌঁছে যাবার ভয়ে সে হেলায় হারালো সুযোগটিকে। এ সুযোগ জীবনে শুধু একবারই হয়তো আসে। যেমন এসেছিল সুরজন রাও-এর জীবনে।

রাগে আর দুঃখে জিৎ-এর ভেতরটা জ্বলে যেতে থাকে।

বাদশাহ্ তার পিঠে হাত রেখে বলেন,–ঘোড়ায় ওঠো জিৎ সিং। তোমার সম্বন্ধে আমি চিন্তা ক’রে দেখব।

দুজনা পাশাপাশি চলতে থাকে শিবিরের দিকে। সূর্যের তেজ এতক্ষণে অনেকটা কমে এসেছে।

—জিৎ সিং।

—জাহাঁপনা।

কিকা রাজ্য পেয়েছে জেনে তুমি খুশি হয়েছ শুনলাম।

দরবারের কর্মচারীটি এই কথাটাও কানে তুলে দিয়েছে। আশ্চর্য এদের তৎপরতা।

ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে জিৎ উত্তর দেয়,—হ্যাঁ জাহাঁপনা, কিকা মহৎ ব্যক্তি। কিন্তু আপনি তাঁর ডাক নাম জানলেন কেমন ক’রে?

—তাঁর প্রতাপসিংহ নামও আমার জানা। তবে বারবার কিকা বলতে অভ্যস্ত। চিরকাল তাই বলব।

—ওঁকে আপনি চিনতেন?

—হ্যাঁ। রাজোয়ারার ওই লোকটি যখন কিশোর, তখন থেকেই ওঁর পরিচয় জানি। তখন থেকেই আমার জানা ছিল, কিকা যদি মেবারের সিংহাসনে কখনো বসেন, আমায় তিনি যথেষ্ট কষ্ট দেবেন। তবে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম এই ভেবে যে উদয় সিং আরও বহুদিন বেঁচে থাকবেন। তাই মাথা ঘামাইনি।

ভবঘুরের একটি কথা জিৎ সিং-এর মনে পড়ে। সে বলেছিল বাদশাহের অনেক চোখ। কিন্তু সেই চোখ যে নিজের রাজ্যসীমার বাহিরেও বহুদিন থেকে জাগ্রত রয়েছে, এ ধারণা তার ছিল না। সে বুঝতে পারে না, এতই যখন বাদশাহের কুশলতা, তখন তার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত সংবাদ এতদিনেও সংগ্রহ করতে পারলেন না কেন?

শিবিরে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে শ’খানেক লোক বনের ভেতরে ছাটে মৃত গর্দভগুলিকে সংগ্রহের জন্য।

সেই গর্দভগুলি এনে শিবিরের সামনে স্তূপীকৃত ক’রে ফেলে যখন তারা, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে অনেক বাতির সম্মুখে গণনা ক’রে দেখা যায় মৃত গর্দভের সংখ্যা একুশ। সবাই উদ্‌গ্রীব হয়ে দেখে বাদশাহ্ কতগুলি মেরেছেন। কারণ শেষ হলে চিৎকার ওঠে, —আটটি।

এবারে মজনুন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। একবার ঠকেছে সে।

কিন্তু সৈয়দ মুজফ্ফর বলে ওঠে,—একুশটির মধ্যে আটটা যখন বাদশাহের তখন আর বলে দিতে হবে না কার সংখ্যা সব চাইতে বেশি।

অধিকাংশ আমীর ওমরাহ্ একটি গাধাও শিকার করতে পারেনি। কেউ কেউ শুধু একটি করে মারতে পেরেছে।

কিন্তু ওই চাঁদ চিহ্নগুলি কার? কপালে চাঁদ এঁকেছে কার তলোয়ার? বিস্মিত হয় সবাই। একটি, দুটি, তিনটি। আরও অনেক রয়েছে।

মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সবাই।

গণ্ডোয়ানার যুদ্ধের পর আসফ খাঁয়ের প্রতাপ আগের মতো নেই। সেই যুদ্ধের পর অনেক বছর পার হয়েছে। এককালের দুর্দান্ত সেনাপতি এখন একজন নির্বিরোধী ভালোমানুষ। একবার বাদশাহের দিকে চেয়ে সে কাঁপা গলায় বলে,–এই চাঁদ চিহ্নও নিশ্চয় বাদশাহের। তিনি দুটি চিহ্ন ব্যবহার করেছেন।

বাদশাহ মৃদু হাসেন। হেসে ঘাড় নাড়েন।

—তবে?

গোনা শেষ হয়। নয়টি।

বাদশাহ্ জিৎ সিংকে কাছে ডেকে বলেন,—আজ গর্দভ হত্যায় তুমি জিতলে।

সবার দৃষ্টি বিস্ফারিত। জিৎ লক্ষ্য করে তাদের মুখের বিদ্রূপের রেখা অন্তর্হিত হয়েছে। তবু সে পুলকিত হতে পারে না। সে ভাবতে থাকে, বাদশাকে আজ হত্যা করলেও সে গুপ্তঘাতকের পর্যায়ে পড়ত না। কারণ গোপনে সে বাদশাহের মৃত্যু ঘটাত না। দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে যদি একজনের জীবনাবসান হয়, তাকে গুপ্তহত্যা বলা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *