ফণিমনসা – মণি বর্মা

ফণিমনসা – মণি বর্মা

জল, জল আর জল…

শুধু কলকল ছলছল শব্দ। বজরার গায়ে ঢেউয়ের আঘাত। যেন কালনাগিনীর হিংস্র ছোবল।

অশোক ছাদের ওপর বসে সামনের দিকে তাকিয়েছিল। দৃষ্টির শেষ সীমায় আকাশ নদীর হাতে পরিয়েছে বলয়। অস্বচ্ছ কৃষ্ণাভ একটি রেখা, হয়তো ওখান থেকেই সমুদ্রের শুরু।

কথাটা মনে হতেই ভয়ে, বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে অশোক। আবিষ্টের মতোই পেছন ফিরে তাকায়। দৃষ্টি ব্যাহত করে সেখানেও নেমে এসেছে একখানা ধূসর পর্দা। বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাদের হাসি—কান্নার জগৎ থেকে। লোকালয় এখন শুধু কল্পনার খোরাক।

জল, জল আর জল। নীচে বজরার গায়ে ঢেউয়ের আঘাত—কলকল ছলছল। একই ছন্দ, একই সুর।

সকালে যখন কাকদ্বীপ থেকে নৌকোয় ওঠে, তখন বৈচিত্র্য খুঁজে পেয়েছিল অশোক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বড় একঘেয়ে।

অথচ রমেশ এরই মধ্যে পায় বেজে—চলা জলতরঙ্গে সুরের মূর্ছনা। তার বন্ধু রমেশ—সরকারি বনবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারি। সুন্দরবনের কোনো এক দুর্গম এলাকায় তার অফিস। সেখানে বসে বহুবারই সে অশোককে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছে শিকারে যাবার জন্যে।

শিকারে যে অশোকের অরুচি ছিল তা নয়, তবে তার সেই গড়পারের বাড়ির সান্ধ্যমজলিশ ছেড়ে গহন অরণ্যে যাবার মতো উৎসাহ সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি।

কিন্তু এবার রমেশ কলকাতায় এসে যখন নতুন করেই আমন্ত্রণ জানাল, তখন আর অশোক আপত্তি করেনি। করেনি সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার লোভে। ‘ডাঙায় বাঘ জলে কুমির’ সুন্দরবন সম্বন্ধে এমনি একটা ছবি লোকের মুখে শুনে, বইয়ের পাতায় পড়ে, তার মনের পটে আঁকা হয়েছিল; কিন্তু যে ছবিতে রঙ চাপানো হয়েছে খুশির খেয়ালে—কল্পনার তুলিতে, সেটা হয়তো তার আসল রূপ নয়।

তাই নিজের চোখে একবার প্রত্যক্ষ করার প্রলোভনটুকু সে দমন করতে পারেনি।

বজরা চলেছে ভাটার টানে—তির্যক রেখায়। যেন কোনাকুনি পাড়ি দিতে চায়। কোথায়?

বহুদূরে, দিগন্তের কোলে মসিরেখার মতোই যে তটরেখার ইঙ্গিত, ওখানেই কি? ওই কি সুন্দরবন?

কৌতূহল দমন করতে না পেরে অশোক একসময় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রমেশ, চেয়ে দেখ দিকিনি, সত্যিই কি এবার তোর সাম্রাজ্য দেখা যাচ্ছে?’

পাটাতনের ওপর পাতা সতরঞ্চে বসে রমেশ একখানা বই পড়ছিল। মুখ না তুলেই জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ওই আমার সাম্রাজ্য—যেখানকার সম্রাজ্ঞী—হীন সম্রাট আমি।’

ও যেন মুখস্থ বলে গেল। নদীর প্রতিটি ঢেউ পর্যন্ত বুঝি ওর নখ—দর্পণে।

মনে মনে তারিফ করে অশোক, তবু মুখে না বলে পারে না, ‘মরুভূমির মতো জলরাশিও তো মরীচিকা দেখায়, না রে?’

রমেশ এবার বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলল। মৃদু হেসে বলল, ‘চেনা চোখকে দেখায় না।’

‘তাহলে যে দেবদাসের মতো আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘ওরে, আর কত দূর?’

রমেশ সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘সন্ধে নাগাদ মনে হয় ডাঙায় ভিড়তে পারব…’

‘সন্ধে নাগাদ!’ বেশ খানিকটা নিরাশ হল অশোক। এখনও তাহলে বহুক্ষণ ধরেই শুনতে হবে বজরার গায়ে ঢেউ ভাঙার সেই একঘেয়ে সুর। মনে হতেই রীতিমতো ঝাঁঝালো কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘আমি’ ভেবে পাই না সরকার থেকে তোকে মোটরলঞ্চ দেয় না কেন।’

হেসে উঠল রমেশ। লঘুকণ্ঠে বলল, ‘দেবে, দেবে, আর একটা লিফট পেলেই দেবে।’

এই সময় কামরার ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ কণ্ঠ ভেসে এল, ‘অশোক! রমেশ! চা ঠান্ডা হয়ে গেলে আমি জানি না কিন্তু, আর তৈরি করতে পারব না।’

রমেশ তাড়াতাড়ি বই মুড়ে বলে উঠল, ‘চল রে, আগমকে চটানো এই মাঝনদীতে ঠিক হবে না…’

‘শুধু যদি একবার গা ঝাড়া দেয়, তাহলেই ভরাডুবি।’

হাসতে হাসতে দুজনে ভেতরের কামরায় গিয়ে ঢুকল।

তাদের কথার মধ্যে পুরোপুরি না হলেও, খানিকটা সত্য যে আছে, আগম দত্তকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়।

স্থূল বপু অনেকেরই হয়, আগম দত্ত কিছু ব্যতিক্রম নয়; কিন্তু বুদ্ধিটাও তার বপুর মতোই স্থূল। তাই বন্ধুমহলে তাকে পরিহাস করে বলত, ‘আকারো সদৃশ প্রাজ্ঞঃ।’

আগম দত্ত কিন্তু রাগ করত না। মুচকে হেসে বলত, ‘তাতে তো লাভ তোদেরই। বুদ্ধির ঘরে সব দেউলে সেজে বসে আছিস। নিজের জন্যে যথেষ্ট রেখেও তোদের তবু কিছু কিছু ধার দিতে তো পারব।’

ছোট কামরা। প্রয়োজন বোধে বসার সঙ্গে শোবার কাজেও লাগানো যায়। এক কোণে সদ্য—নেভানো একটা স্টোভ, কেতলি, সসপ্যান ইত্যাদি। ধূয়িত তিন পেয়ালা চা সামনে রেখে, আগম দত্ত মাখন আর জেলি মাখানো রুটি চিবোচ্ছিল। এক এক গ্রাসে প্রায় গোটা টুকরোটাই মুখে ভরছিল সে।

ঘরে পা দিয়েই রমেশ আঁতকে উঠল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘তিষ্ঠ—তিষ্ঠ, আগম!’

পেছন থেকে অশোক বলে উঠল, ‘ওরে, আমাদের ঠকাতে গিয়ে নিজে না ঠকে যাস। গলায় যদি একবার বেধে যায়…’

আগমের দৃকপাত নেই। ভালো করে চিবোবার আগেই রুটির তালটা সে বোধ করি গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করছিল। দুস্তর সে সাধনা। সিদ্ধিলাভ করার আগেই হঠাৎ সরকে গেল; সঙ্গে সঙ্গে কাশির ধমকে বসন্ত—খোদিত মুখখানা তার বীভৎস হয়ে উঠল।

রমেশ তার মাথায় বার কয়েক চাপড় দিয়ে কপট মমতা—মাখা কণ্ঠে বলল, ‘ষাট ষাট! নিশ্চয়ই কেউ নাম করছে।’

কোনো রকমে তালটা গলাধঃকরণ করে আগম দত্ত হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘করবে না কেন? তোদের মতো চালচুলোহীন লক্ষ্মীছাড়া তো আর নই।’

অশোক ততক্ষণে তার পাশে বসে পড়েছে। চায়ের একটা কাপ নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে ভ্রূ—ভঙ্গি করে বলল, ‘বোধ হয় তিনি…’

আগম দত্ত রুটি চিবোনো বন্ধ করল না; শুধু একবার কুপিত দৃষ্টিতে তাকাল।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রমেশ মন্তব্য করল, ‘উঁহু, তিনি মুখে করেন না, মনে জপেন।’

হাসি—গল্পে জমে উঠল চায়ের আসর। এতক্ষণকার একঘেয়েমির পর অশোক যেন তবু একটু বৈচিত্র্য খুঁজে পায়।

ওদিককার কোণ থেকে হারমোনিয়ামটা টেনে এনে আগম দত্ত অশোকের সামনে রাখল। বলল, ‘নে, একখানা ধর।’

‘বিরহ সঙ্গীত?’

রুষ্ট ভঙ্গিতে আগম দত্ত বলে উঠল, ‘তোর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, অশোক। এই কি বিরহ সঙ্গীত গাইবার সময়, না পরিবেশ?’

রমেশ পরিহাস—তরল কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে কি ভগবানের নাম—গান করবে?’

কাঠের মেঝেয় প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করে আগম দত্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘উচিত—একশোবার উচিত। মোচার খোলায় চেপে চলেছি দু’কূলহারা নদী দিয়ে। সামনে সুন্দরবন। বাঘের পেটে যাব কি কুমিরের কামড় খাব, কেউ জানে না। সাক্ষাৎ যমরাজের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া…’

কথা তার শেষ হবার আগেই অশোক একখানা ভাটিয়ালি শুরু করে দিল। গলা তার শুধু মিষ্টিই নয়, দস্তুর মতো সাধা। বিরস মুখখানা ঘুরিয়ে নিয়ে আগম দত্ত কাটা জানলা দিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে রইল।

হাতে মাথা দিয়ে কাত হয়ে পড়ল রমেশ। চোখ বুজল বোধ করি রসাস্বাদনের একাগ্রতায়।

‘ওরে সুজন নাইয়া…’ অশোকের সুরেলা কণ্ঠ আকুতি জানায়, ‘জানি না নাও বেয়ে কোন বিদেশে যাবে, তার আগে একবার কি আমার ঘাটে নৌকো ভেড়াবে না? নিজের হাতে চিঁড়ে কুটে নাড়ু করেছি, দুটো নিয়ে যাও, একটা কথাও যদি বলতে না চাও, বল না; শুধু অনেক আশা করে সাজা একখিলি পান খেয়ে যাও…’

অকস্মাৎ আগম দত্ত অব্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘একী! জলে কালো ছায়া এল কোত্থেকে? মেঘ করল নাকি?’

চকিতে উঠে বসল রমেশ। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মেঘই করেছে দেখছি।’

ত্বরিত পায়ে সে বাইরে বেরিয় এল।

মাঝিরা ইত্যবসরে পাল নামিয়ে দিয়েছে। ছ’দুগুণে বারোখানা পেশিবহুল বাহুর দাঁড়ের টানে বজরা চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। ভাগীরথীতে এসে মিশেছে যে শাখা নদী, লক্ষ্য বোধ করি ওটাই। ভাটা শেষে জোয়ার আসারও আর দেরি নেই। তার আগেই ঢুকে পড়তে হবে ওই শাখা নদী ‘দা—কাটায়’।

রমেশ আর একবার ক্রমবর্ধমান কালো মেঘখানার দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঝড় আসবে নাকি, অনন্ত?’

‘আসবে বলেই তো মনে নিচ্ছে, হুজুর।’ শক্তহাতে হাল চেপে জবাব দেয় অনন্ত। ‘ভাবছি শুধু জোয়ারের আগে না এসে পড়ে। দা—কাটায় ঢোকা তাহলে মুশকিল হয়ে পড়বে…’

রমেশ তাকাল মোহানার দিকে। সাগর—সঙ্গমে এসে ভাগীরথী যেন অকস্মাৎ চাঁচর চিকুর মেলে ধরেছে। দা—কাটা সেই অসংখ্য চিকুরেরই একটি। কিন্তু চিকুরের মতোই তার চিকণ রূপ নয়। রূপ তার ভয়াল, ভীষণ। তবু দু’দিকে কূল দেখা যায়। সে কুলে বজরা ভেড়াতে পারলে আশ্রয় মেলে। অনন্ত হয়তো সেই চেষ্টাই করবে।

জলের বুকে ছায়া আরও গাঢ় হল। হিংস্র জন্তুর মতোই গর্জন করে উঠল ভ্রূকুটিকুটিল মেঘ। রমেশের মুখে চিন্তার রেখা প্রকট হয়ে উঠতে দেখে অনন্ত হেসে বলল, ‘ডরের কিছু নেই, হুজুর। ভেতরে গিয়ে গান—বাজনা করুন গে। হাওয়ায় জোর ধরেছে।’

অর্থাৎ ঝড়ের সূচনা। চাঁচর চিকুর মেলেই সে ঝড় উদ্দাম গতিতে ছুটে আসবে এখনি। শিকারি পশুর মতোই থাবা বসাবে বজরার গায়ে। যে কোনো মুহূর্তে তাকে টেনে ফেলবে উত্তাল ঢেউ নদীর বুকে।

বাইরে বেরিয়ে এসে এই সময় অশোক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কি হল রে, রমেশ? মন্দ খবর কিছু?’

রমেশ তার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘নাঃ! চল, তোর গান আবার শুরু করবি।’

কামরায় এসে অশোক আবার গান শুরু করল বটে, কিন্তু তেমন জমল না। তার কণ্ঠ ছাপিয়ে শোনা গেল ঝড়ের ক্রুদ্ধ গর্জন। প্রবল ঝাপটায় বজরাখানা একপাশে কাত হয়ে গিয়েও কোনোরকমে টাল সামলে নিল।

ভয়ার্ত শিশুর মতোই আকুলকণ্ঠে কেঁদে উঠল আগম দত্ত, ‘গেল—গেল গেল! কি কুক্ষণে তোদের সঙ্গে এসেছিলুম। জলে ডুবে শেষকালে পৈতৃক প্রাণটা যাবে রে!’

অসহায় শিশুর মতোই তার সে কান্না না রমেশ, না অশোক—কারও মনেই মমতা জাগাতে পারল না। রমেশের মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠল, আর অশোক ভেঙে পড়ল হাসির বেগে।

হাত—পা ছুড়ে আগম দত্ত তীব্রকণ্ঠে অনুযোগ করল, ‘হাসতে তোর লজ্জা হচ্ছে না? নৌকোর খোলের ভেতর যদি কলে—ধরা ইঁদুরের মতোই আটকা পড়িস…’

‘না হয় ডুবে মরব—’ বলে অশোক আর একবার হারমোনিয়ামটা টেনে নিল।

রমেশ বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’টা তোর মনে আছে, আগম? সেই’… সুরেই সে আবৃত্তি করে উঠল :

 কোথা তীর, চারিদিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল

 আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি

 লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি

 ফেনিল আক্রোশে…

আর সহ্য করতে পারে না আগম দত্ত। সে নিজেও ক্ষিপ্তের মতোই গালাগাল দিতে দিতে কামরার বাইরে যেতে গেল, ধরে ফেলল রমেশ। পরুষ কণ্ঠে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? দেখছিস না বজরার অবস্থা। বাইরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের ঝাপটায় জলে গিয়ে পড়বি…’

নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আগম দত্ত চিৎকার করে উঠল, ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে! জলে পড়ি সেও ভালো; তবু বাঁচবার আশা আছে; কিন্তু এই গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে ইঁদুরের মতো মরতে পারব না।

জোর করেই তাকে বসিয়ে দিল রমেশ।

অশোক হেসে উঠে বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘প্রাণের এত ভয়! মৃত্যুকে যদি বুড়ো আঙুল দেখাতে নাই পারলি, তাহলে বেঁচে থাকার আনন্দ কোথায়?’

আগম দত্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল; কোনো কথা বলল না। ভেতরের বাষ্প বেগটাই হয়তো তার কণ্ঠ রোধ করে দিয়েছিল।

স্বরটাকে খানিকটা কোমল করে রমেশ বলল, ‘এ তোর শহুরে ঝড় নয়, আগম। আমার অভিজ্ঞতা আছে। এর সূচনাতেই হিন্দু মাঝি ডাকে ভগবানকে আর মুসলমান মাঝি আল্লার নাম নেয়। তোদের দুর্ভাগ্য যে এমন ঝড়ের হাতে পড়লি; তবু বলব এর রূপ ভোলবার নয়। বেঁচে থাকলে একটা অভিনব অভিজ্ঞতা।’

কথাগুলো হয়তো আগম দত্তের কানেও গেল না। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে নিরুদ্ধ অশ্রুবেগে সে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।

তাকে বিদ্রুপ করতেই যেন ঝড়ের হুঙ্কার আরও প্রমত্ত হয়ে উঠল। উত্তাল ঢেউগুলো অন্ধ রোষে এসে আছড়ে পড়তে লাগল বজরার গায়ে। ঝলকে ঝলকে জল ঢুকল জানালা গলে, শতচ্ছিদ্র পথে।

এই সময় বাইরে থেকে অনন্ত মাঝির বিপন্ন কণ্ঠ ভেসে এল, ‘জোয়ার আসছে—জোয়ার আসছে…’

দাঁতে দাঁত চেপে রমেশ বিড়বিড় করে উঠল, ‘Last nail on the coffin.’ তবু বিপদের মাত্রা কতখানি জানবার জন্যেই যেন সে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

কিন্তু দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করে সেখানে তখন চলেছে রুদ্র ভৈরবের তাণ্ডব নৃত্য। ছড়িয়ে—পড়া পিঙ্গল জটাভারে আকাশ—জল একাকার হয়ে গেছে। ওপরে বাজছে মেঘের ডমরুধ্বনি। নীচে পদভরে মথিত নদীর বুকে জেগে উঠেছে সহস্র—ফণা বাসুকি। ফুলছে ক্রুদ্ধ আক্রোশে। হিংসার বিষেই বুঝি বা কালো হয়ে গেছে দিগদিগন্ত।

বিমূঢ়ের মতোই রমেশ শুধু তাকিয়ে রইল। মাঝিকে কোনো প্রশ্ন করার কথা মনেই এল না।

দাঁড়িরা নিজেদের প্রস্তুত করেই রেখেছে। যে কোনো মুহূর্তে হিংস্র কুটিল নদীর বুকে ঝাঁপ দিতে হতে পারে। মুখগুলো তাদের ইস্পাত—কঠিন। চোখের দৃষ্টিতে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রামের দৃঢ় সঙ্কল্প।

ওরা জলের জীব। জন্মে পর্যন্ত জলের সঙ্গে ওদের অন্তরঙ্গতা। এ ধরনের ঝড়ের সঙ্গে বহুবার যুদ্ধ করেছে। কালীয় নাগের মতোই ছুটে এসেছে যে বান, তার শিরে পা রেখে দমন করেছে। কিন্তু…

বন্ধুদের কথাটা ভেবে ভয় পেলো রমেশ। নৌকোডুবি যদি সত্যিই হয়, ভারী পাথরখণ্ডের মতোই তলিয়ে যাবে তারা। হাত—পা ছোড়ার সামান্য অবসরটুকুও পাবে না। উদ্বিগ্ন স্বরটাকে তাই যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে, জিজ্ঞেস করল সে, ‘অনন্ত! নৌকো দা—কাটায় ঢুকেছে কি?’

প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে অনন্ত অসম যুদ্ধ করে চলেছিল। কপাল বেয়ে তার ঘাম ঝরছ। হাত—পায়ের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে দড়ির মতোই। মুখ না ফিরিয়েই নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিল সে, ‘দা—কাটায় আর ঢুকতে পারব নি, হুজুর। দেখছেন না জোয়ার এসে গেছে।’

রমেশ নিজেও যে সেটা না বুঝেছিল, তা নয়; তবু আর্ত কণ্ঠে নির্বোধের মতোই প্রশ্ন করল, ‘কোথায় চলেছি তাহলে?’

‘বলব কি করে? এখন হাল ধরেছ নসিব।’

নিষ্ঠুর হলেও কথাটা চরম সত্য। হাল ধরে রেখেছে অনন্ত, নিছক টাল সামলাতেই। দিগদিশারী কর্ণধার আর সে নয়। জোয়ারের টানে, ঝড়ের তাড়নায় বজরা যেদিকে ভেসে যাবে, যেতে দিতে হবে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। এই সন্ধিক্ষণে জীবন—মৃত্যুর ব্যবধান অতি সূক্ষ্ম।

ভেতর থেকে অশোকের আর্তকণ্ঠ ভেসে এল, ‘আগম! ও—কাজ করিস নি…তুই কি পাগল হয়ে গেছিস…আগম!’

ত্বরিত পায়ে রমেশ কামরায় ফিরে এল।

আগম দত্ত তখন জানলা গলে জলে ঝাঁপ দেবার জন্যে প্রস্তুত। চোখে—মুখে তার দৃঢ় সঙ্কল্পের ছাপ। অশোক তার জামাটা চেপে ধরে প্রাণপণে নিবারণ করবার চেষ্টা করছে।

এ দৃশ্য দেখে রমেশ নিজেই যেন কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে; বলতে গেল, ‘আগেই মন্দটা ভেবে নিচ্ছিস কেন? এখনো তো নৌকো বাঁচতে পারে, কিন্তু কণ্ঠে তার স্বর ফুটল না।

আহত জন্তুর মতোই ফিরে তাকাল আগম দত্ত। চোখে ঝলসে উঠল জিঘাংসার চাহনি। তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বলল, ‘ছেড়ে দে বলছি।’

সজোরে জামাটায় টান দিল সে। পড়পড় করে ছিঁড়ে গিয়ে পাঞ্জাবির তলার অংশটুকু শুধু ধরা রইল অশোকের হাতে; পরমুহূর্তে আগম দত্ত ঝাঁপ দিল জলে।

বজ্রাহতের মতই দাঁড়িয়ে রইল দুই বন্ধু। আর্তধ্বনি করতেও যেন ভুলে গেল তারা। বিক্ষুব্ধ নদীর বুকে একবার শুধু দেখা গেল আগম দত্তকে হাত—পা ছুড়তে; তারপরই কোন অতল তলে ডুবে তলিয়ে গেল সে।

হা হা করে অট্টহাসি হেসে উঠল উন্মাদ প্রভঞ্জন। প্রথম বলি পেয়ে রাক্ষসী নদী যেন আরও প্রমত্তা হয়ে উঠল। শত শত লোলুপ রসনা মেলে ছুটে এল বজরাখানা গ্রাস করতে।

ঠিক সেইসময় অনন্ত চিৎকার করে উঠল, ‘পারলুম না, হুজুর, আর বাঁচাতে পারলুম না।’

প্রচণ্ড আঘাতে ভেঙে গেল হাল। সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়েই বজরাখানা কাত হয়ে পড়ল নদীর বুকে। দাঁড়িরা ছিটকে পড়ল জলে।

ছিটকে অশোকও পড়েছিল দরজাগোড়ায়। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল; কিন্তু সেদিকে নজর দেবার অবসর কোথায়? বজরা তখন লাট্টুর মতোই পাক খাচ্ছে। সেই সঙ্গে অনন্তর নিরুপায় কণ্ঠের চিৎকার, ‘ঘুন্নিতে পড়েছে, হুজুর…ঘুন্নি…’

তলিয়ে যাচ্ছে বজরা। নীচে থেকে কে যেন চুলের মুঠি ধরে টানছে। নিশ্চিত মৃত্যু কি?

জ্ঞান হারিয়ে ফেলল অশোক।

।। দুই।।

ভোরের আলো এসে পড়েছিল বালির চরে। চর ঠিক নয়, সুন্দরবনেরই প্রসারিত বাহু একখানা এগিয়ে এসেছে মোহনা পর্যন্ত। পশ্চাৎপট গভীর অরণ্যের। অস্ফুট আলোয় রূপ তার সুস্পষ্ট নয়। মোটা তুলির টানে শিল্পী যেন সামান্য ইঙ্গিতটুকুই দিয়েছেন। কোল ঘেঁষে যে প্রশস্ত গাংটা গেছে, এখন তা নিস্তরঙ্গ, শান্ত। ভাটার টানে জলও গেছে নেমে।

গত রাত্রির ঝড় যেন একটা দুঃস্বপ্ন, ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেছে। তবে কিছু চিহ্ন রেখে গেছে বালুর সমুদ্রে। তাকে করে তুলেছে তরঙ্গ—সঙ্কুল। এখানে—সেখানে ঈষৎ জেগে—থাকা কাঁটাগাছগুলোর পাতাবিহীন ডগাকে মনে হয় যেন ডুবে—যাওয়া নৌকোর মাস্তুল।

বানের জল কাল পাড়ের যতখানি পর্যন্ত লেহন করে গেছে, তার সবটুকুই কাদা—কালো, পিছল, আবক্ষ হওয়াও বিচিত্র নয়। সেই কাদার সঙ্গে বালির সমুদ্র এসে যেখানে মিশেছে, সেখানে পড়েছিল অশোকের সংজ্ঞাহীন দেহটা। দেখেই বোঝা যায় স্রোতের টানেই ভেসে এসেছে সে। তারপর ভাটার টানে জল যখন নেমে গেছে, করুণা করেই ফেলে রেখে গেছে তাকে। রেখে গেছে চরম নিগ্রহের পর। বিস্রস্ত চুলগুলো প্রায় জটা পাকিয়ে উঠেছে; সর্বাঙ্গে কাদার প্রলেপ। স্খলিত বসন ছিন্ন পালের মতোই বালিতে লুটোচ্ছে। শ্বাসপ্রশ্বাস অতি মৃদু, স্বাভাবিকও নয়; তবু বেঁচেই ছিল অশোক।

কিন্তু এমন অরক্ষিত অবস্থায় বেঁচে থাকা বোধ করি সুন্দরবন এলাকায় নিয়মবিরুদ্ধ; তাই একটা বৃহদাকার কুমিরকে দেখা গেল কিছু দূরের কাঁটাগাছটার পাশ থেকে উঁকি দিতে। জল থেকে উঠে এসেছিল জীবটা হয়তো প্রথম সূর্যের রোদ পোহাতে। সেটা যতই লোভনীয় হোক, তার চেয়ে অনেক বেশি লোভনীয় ডাঙার শিকার। মুখব্যাদানের বিশেষ ভঙ্গিটুকুই তার নিৰ্ভুল প্রমাণ।

লেজের ঝাপটায় প্রচুর বালি ছিটিয়ে কুমিরটা বেরিয়ে এল কাঁটা ঝোপের পাশ থেকে, তারপর বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল শিকার লক্ষ করে।

কিছুই জানল না অশোক; কিন্তু দেখতে পেল আর একজন। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরেঙ্গা! ওরেঙ্গা!’

বিচিত্র সে ভাষা। তার চেয়েও বিচিত্র সে নারীমূর্তি। বছর কুড়ি—একুশ বয়েস। অপরূপ রূপসী। অটুট স্বাস্থ্য। মুখে শিশুর সরলতা। খাটো শাড়িখানা কটিদেশ বেষ্টন করে কোনোরকমে বুক পর্যন্ত উঠেছে। রুক্ষ চুলগুলো পিঠে ছড়ানো।

তার ভীতিবিহ্বল কণ্ঠ শিকার—লোলুপ কুমিরটাকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারল না। দ্রুততর বেগে সে এগিয়ে চলল অশোকের দিকে।

মেয়েটি তখনও খানিকটা দূরে। আর একবার চিৎকার করে উঠে প্রাণপণে ছুটল সে, কিন্তু অশোকের কাছে পৌঁছবার আগেই, কুমিরটা বিদ্যুৎবেগে লেজের আঘাত করল তার পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে অশোকের সংজ্ঞাহীন দেহটা নীচের দিকে বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেল। কাঁটা গাছের ঝোপ একটা না থাকলে হয়তো গাংয়ের জলেই গিয়ে পড়ত।

নতুন করেই আক্রমণ করবার জন্যে আবার তৈরি হল কুমিরটা।

এবার কাঁটা গাছের সামান্য ঝোপটা আর রক্ষা করতে পারবে না। অসহায়, অচৈতন্য মানুষটা গিয়ে পড়বে গাং—এ। তারপর যে কি ঘটতে পারে সেটা তরুণীটি অজ্ঞাত নয় বলেই, মরীয়া হয়ে সে দুহাতের আঙুল চালিয়ে দিল কুমিরটার দুই চোখে।

অসহ্য যাতনায় কুমিরটা বিকট গর্জন করে উঠল। রুদ্ধ আক্রোশে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিল মেয়েটিকে। দূরে ঠিকরে পড়ল মেয়েটি। সেদিকে কিন্তু কুমিরটার আর লক্ষ ছিল না, নতুন করে আক্রমণও করল না শিকারকে। লেজের ঝাপটায় বালির সমুদ্র মন্থন করে সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। একটা ঢেউ উঠে আছড়ে পড়ল পাড়ে; কিন্তু প্রাণীটাকে আর দেখা গেল না।

মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। আঘাত সে পেয়েছিল; কিন্তু সেদিকে নজর দেবার সময় নেই। আবার নতুন কোনো জলচর জীব হয়তো শিকারের সন্ধানে উঠে আসতে পারে।

অশোকের দেহটার পাশে নতজানু হয়ে বসে সে পরীক্ষা করল লোকটা বেঁচে আছে কিনা। খুশিতে চোখ দুটো তার চকচক করে উঠল। না, বাঁচাবার চেষ্টাটা তাহলে পণ্ডশ্রম হবে না।

অশোকের বাহু দুটো শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল সে। তারপর টানতে টানতে যতটা পারল, ওপরে তুলে আনল। শুইয়ে দিল বালির ওপরই। গা থেকে জামাটা ছিঁড়ে ফেলে সে শুরু করল জ্ঞান ফিরিয়ে আনার নানারকম প্রক্রিয়া।

আনাড়ি নয় মেয়েটি। কোথাও জড়তা নেই, ভুল নেই। দেখেই বোঝা যায় এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা সে আগেও করেছে বা করতে দেখেছে।

হাত—পা উৎক্ষেপ—বিক্ষেপের পালা একে একে শেষ হয়, আর মেয়েটি সাগ্রহে অশোকের মুখের পানে তাকায়। না, জ্ঞান ফিরে আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

বিব্রত বোধ করল মেয়েটি। সূর্য অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। রোদের তেজ ক্রমেই বাড়ছে। এরপর বালি তেতে উঠবে। অসহ্য সে তাপ। চামড়ায় ফোস্কা পড়বে।

যতদূর দৃষ্টি যায়, কোথাও এমন কোনো মানুষ নেই—যার কাছ থেকে একটু সাহায্য পেতে পারে।

আর একবার অশোকের মুখের দিকে সাগ্রহে তাকাল মেয়েটি। মনে ক্ষীণ আশা—যদি জ্ঞান—সঞ্চারের কোনো লক্ষণ দেখতে পায়। নিরাশ হল সে। প্রক্রিয়ার মাত্র একটিই তখনও বাকি। জলে ডুবে শ্বাস যার রুদ্ধ হয়েছে, তার মুখে ফু দিলে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়। এমন সুফল সে ফলতে দেখেছে।

ধীরে ধীরে মুখখানা সে নামিয়ে আনল। হোক সংজ্ঞাহীন, তবু অপরিচিত যুবকের অধরে অধর স্থাপন করার কথা ভাবতেই সভ্য জগতের যে কোনো তরুণীই লজ্জায়, ঘৃণায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠত; কিন্তু তার মনে কোনো বিকার দেখা দিল না। যৌন—চেতনা জাগেনি তার।

চোখ দুটো নিবদ্ধ ছিল অশোকের মুখের ওপরই; অকস্মাৎ তাদের মাঝে চকচক করে উঠল খুশির আলো। তখনও দু—জোড়া ঠোঁটের মাঝে কিছুটা ব্যবধান। সে ব্যবধান মেয়েটি বাড়াল না, তবে দৃষ্টিও সরালো না। দেখল, লোকটির চোখের পাতা দুটো কাঁপছে, ঠোঁট দুটো ঈষৎ নড়ছে।

আনন্দের একটা অস্ফুট ধ্বনি করে উঠল মেয়েটি। বলল, ‘তংপা মায়ো—তংপা মায়ো…’

ধীরে ধীরে চোখ মেলল অশোক। শূন্য, ভাষাহীন দৃষ্টি। সামনে যেন শেষরাত্রির পুঞ্জীভূত অন্ধকার। শুধু হাতড়ে বেড়ানো।

গভীর আগ্রহে মেয়েটি কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আনো সেলা?’

ঘুরতে ঘুরতে অশোকের চোখ দুটো মেয়েটির মুখের ওপর এসে স্থির হল, একটু বা মুখর হয়ে উঠল বোবা দৃষ্টি। অস্ফূট কণ্ঠে বিড় বিড় করে বলল, ‘আনো সেলা?’

ভাষাটা নতুন, না তারই মস্তিষ্কের অভিধান থেকে অপরিচিত শব্দগুলো নিঃশেষে মুছে গেছে?

তার চোখে বিহ্বলতার ছবি ফুটে উঠতে দেখে মেয়েটির মনে হল, লোকটি হয়তো তার ভাষা বুঝতে পারেনি। আত্মবিস্মৃত ছিল বলেই সদা ব্যবহৃত—ভাষাতেই প্রশ্ন করেছিল সে। এবার বাংলাতেই প্রশ্ন করল, ‘ভালো আছ?’

তখনও সহজ হয়ে উঠতে পারেনি অশোক; তাই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আমি কোথায়?’

জবাব দিল মেয়েটি, ‘ডিংপুতে।’

ডিংপু! নামটা স্মরণ করবার চেষ্টা করল অশোক। কিন্তু পারল না। মাথায় অসহ্য যাতনা আর ভার। মনে হয় যেন ছিঁড়ে পড়বে। মেয়েটির মুখের ওপরই দৃষ্টিটা ধরে রেখে আবার প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে?’

‘আমি? আমি অসীমা।’

নামটা হয়তো ভালোই; কিন্তু অশোকের মনে হল কপালকুণ্ডলা হলেই যেন মানাত। এমনই কোনো নারীকে দেখেই তো বঙ্কিমচন্দ্র অমর চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন। বনবালা নামও নিশ্চয় বেমানান হত না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে, দু—চোখে অদম্য কৌতূহল নিয়ে অসীমা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সভ্যদেশের লোক?’

সভ্য—দেশের! নতুন করেই যেন বিস্ময়ের চমক খেল অশোক। বিচিত্র প্রশ্ন। বাংলার একান্তে বসে আজকের দিনে এমন কথা যে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, সত্যিই তা ভাবা যায় না। বিহ্বল কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ…তা…সভ্য দেশই বলতে পারো…শিকারে যাচ্ছিলুম…ঝড় উঠল…তারপর…’

পুরো ছবিটাই অশোকের চোখের সামনে ভেসে উঠল। আগম দত্ত আগেই ঝাঁপ দিয়েছিল জলে; আর রমেশ…

উঠে বসতে বসতে সাগ্রহে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আর কাউকে পেয়েছ তোমরা? আমার বন্ধুদের কি হল বলতে পারো?’

এবার বিস্ময়ের পালা অসীমার। কি যেন বোঝবার চেষ্টা করল সে, তারপর নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

জানে না? কি হল আগম দত্তের? রমেশের ভাগ্যেই বা কি ঘটল? সলিল সমাধি?

ব্যথায়, দুর্ভাবনায় অশোকের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে উঠল। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথাটাও ক্ষণিকের জন্যে ভুলে গেল সে।

তার চিন্তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না বলেই অসীমা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘উঠতে পারবে?’

‘উঠতে?’ নির্বোধের মতো তার দিকে তাকিয়ে অশোক জবাব দিল, ‘চেষ্টা করলে হয়তো পারব…’

‘তাহলে চলে এস।’

‘কোথায়?’

অসীমা নিঃসঙ্কোচে অশোকের হাত একখানা চেপে ধরে বলল, ‘যদি বাঁচতে চাও, আর দেরি করো না…’

কণ্ঠে তার এমন একটা সুর ছিল যে অশোক আর কোনো প্রশ্ন করতে সাহসী হল না। বিমূঢ়ের মতোই মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে চলল।

বালুর সমুদ্রে পা ডুবিয়ে টেনে টেনে চলা। প্রতি পদক্ষেপে দেহ যেন ভেঙে পড়তে চায়। তবু মনের শ্রান্তি আরও গভীর। বাঁচার তাগিদ লোপ পেয়েছে। ঘুচে গেছে জীবন— মৃত্যুর সীমারেখা। হয়তো একেই নির্বেদ অবস্থা বলে।

তবু বালুর সমুদ্রও একসময় পার হল তারা। শুরু হল অরণ্যের সীমানা। সূর্যের যে তাপ এতক্ষণ অসহ্য মনে হচ্ছিল, সেটাই হয়ে উঠল সহনীয়।

প্রথম দিকে বন ঘন নয়। বুক সমান উঁচু বাবলা—সুঁদরীর চারা। তাদেরই ফাঁক দিয়ে দেখা যায় জলা জায়গা। লম্বা লম্বা ঘাস জাতীয় তৃণে ঢাকা। জল আর নজরে পড়ে না।

অশোকের নিঃসাড় মনও কেমন যেন নিরাশ হয়। কোথায় সেই আরণ্যক বিভীষিকা, যা সুন্দরবনকে চিরদিন তাদের কাছে রহস্যপুরী করে রেখেছে, মৃত্যু যেখানে প্রতিটি গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে?

তবু পায়ে—চলা পথের আঁকাবাঁকা রেখা ধরে সে এগিয়ে চলে অসীমাকে অনুসরণ করে।

ক্রমশ গাছগুলো দীর্ঘ হয়, গহন হতে থাকে অরণ্যের রূপ। আশেপাশে লতাগুল্মের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। সে প্রাচীরের অন্তরালেই হয়তো হিংস্র প্রাণীরা বাস করে। অতিকায় অজগরগুলো হয়তো গাছের শাখায় আত্মগোপন করে অতর্কিতে আক্রমণ করে নিরীহ শিকারকে।

তার এক—একবার ইচ্ছে হয় অসীমাকে জিজ্ঞেস করে, সত্যিই কি তারা সুন্দরবনের গোপন অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে চলেছে? কিন্তু সুযোগ পায় না।

বন—হরিণীর মতোই লঘু, ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে অসীমা এগিয়ে চলেছে। দেখে মনে হয় এ রাজ্য তার একান্ত পরিচিত। পথের রেখা ফুটে উঠেছে বোধ করি তারই নিত্য, সহজ আনাগোনায়। বনের পশুর সঙ্গে তার পরম আত্মীয়তা।

পথ আরও দুর্গম হয়। নাম—না—জানা লতাগুল্ম আর কাঁটা গাছের সমারোহ চারদিকে। মাথার ওপর বড় বড় গাছগুলো যেন ছাতা মেলে রেখেছে। ক্ষীণ আলোয় বর্ষা—দিনের বিষণ্ণতা। তীব্র, কটু গন্ধে মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে।

একটা গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল অশোক। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, প্রগাঢ় ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে পড়তে চায়। মুখে আটা বেটেছে। জিভ খসখসে—কাটা—কাটা। প্রাণপণ চেষ্টায় কোনো রকমে সে উচ্চারণ করল, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

অসীমা একবার ফিরে তাকাল; কিন্তু কোনো জবাব দিল না। যেমন চলছিল, তেমনই চলতে লাগল।’

ক্ষীণ আপত্তি জানাল অশোক, ‘আর যে চলতে পারছি না।’

তবু চলতে হয়। মাতালের মতই টলতে টলতে অনুসরণ করতে হয় অসীমাকে।

একটু জল, ক্ষুন্নিবৃত্তির মতো কোনো বুনো ফলও যদি পাওয়া যেতো!

আর একটা পায়ে—চলা পথ বাঁ দিক থেকে এসে যেখানে মিশেছে, সেইখানে পৌঁছে অসীমা অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, ‘এই পথ দিয়ে সোজা চলে যাও।’

‘চলে যাব! আর তুমি?’

বিচিত্র একটা আলো ঝলসে উঠল অসীমার চোখে। শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করল, ‘সুট!’

সেই অজ্ঞাত ভাষা; তবে এবার অর্থটুকু বুঝতে অশোকের অসুবিধা হল না। তাকে স্তব্ধ হতে বলছে মেয়েটি।

চোখে আবার সেই আলো ঝলসে উঠল; পরক্ষণে অসীমা সতর্ক করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘সাবধান! পথ ভুল করলে কিন্তু সারা জীবনেও আর এখান থেকে বেরুতে পারবে না।’

অশোক শঙ্কিত যতখানি হল, বিস্মিত হল তার চেয়ে অনেক বেশি। জিজ্ঞেস করল, ‘একথা বলছ কেন? তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

আর একবার সতর্কবাণী এল, ‘সুট!’ তারপর অসীমা অন্তর্হিতা হল ডান দিকের ঘন অরণ্যে। শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলার শব্দও এক সময় আর শোনা গেল না।

বিমূঢ়ের মতোই অশোক দাঁড়িয়ে রইল। একটার পর একটা চিন্তা বিদ্যুৎঝলকের মতোই মাথার ভেতর ঝলসে উঠতে লাগল। পথের নির্দেশ দিয়ে মেয়েটি কোথায় যেতে বলল তাকে? কোনো লোকালয়ে কি? এক মুঠো খাবার, মাথা গোঁজার মতো একটু আশ্রয় সেখানে পাওয়া যাবে কি? তাহলে মেয়েটি সঙ্গে করেই বা নিয়ে গেল না কেন? কি ওর পরিচয়? কোথায় থাকে?

কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর খুঁজে পেলো না অশোক। একা দাঁড়িয়ে থাকতেও আর সাহস হল না।

ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত পা দু’খানা টানতে টানতে বাঁ দিকের পথ ধরে নতুন করেই আবার যাত্রা শুরু করল সে।

গুনগুন শব্দ একটা ভেসে আসছে কোথা থেকে?

অশোক থমকে দাঁড়াল। বহুদূর থেকে যেন কয়েকটা বোমারু বিমান উড়ে আসছে। কত দূর থেকে?

মুখ তুলে তাকাল অশোক; কিন্তু ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে আকাশের গোটা কয়েক টুকরো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

নাই যাক! দাঁড়িয়ে বিমান দেখবার মতো মনের বা শরীরের অবস্থা নয়। একটু জল চাই; চাই কিছু খাদ্য।

আবার পা টেনে টেনে এগোতে লাগল অশোক। গুনগুন শব্দটাও যেন বেড়ে চলল। ও নিয়ে অবশ্য সে আর মাথা ঘামাতে চায় না; তবু একটু পরেই শব্দ—রহস্যটা তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল। গুঞ্জনটা মৌমাছিদের। সামনের গাছটায় প্রকাণ্ড একটা চাক বেঁধেছে। তারই চারপাশ ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে পতঙ্গগুলো। খোপে খোপে সঞ্চিত করে রেখেছে মধুর ভাণ্ডার।

অশোক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, আর ক্ষুধার জ্বালাটা নতুন করেই যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে। একটু মধুও যদি পেত।

কিন্তু পাওয়ার উপায় কি? একটা ডাল ভেঙে নিয়ে খোঁচা দিতে অবশ্য পারে; কিন্তু সাহসে কুলোল না। ক্রুদ্ধ মৌমাছির কামড়ে মানুষ মারা গেছে, এমন ঘটনার কথা সে শুনেছে। তবু সেখান থেকে নড়তে পারে না।

দুলে উঠল অদূরের ঝোপটা। শুকনো পাতার ওপর পায়ের খসখস শব্দ।

সাগ্রহে ফিরে তাকাল অশোক। হয়তো কোনো অরণ্যবাসী বা মধু—সংগ্রহকারী। পাতার ফাঁকে আভাষ পাওয়া গেল একটা মূর্তির। পাছে লোকটি অন্যদিকে চলে যায়, তাই এক পা এগিয়ে গিয়ে অশোক ডাকল, ‘শুনছেন! একবার এদিকে আসবেন?’

শুনতে পেয়েছে নিশ্চয়। দুহাতে ডালপালা সরিয়ে এদিকেই আসছে মূর্তিটি। পাতার জাফরির ফাঁকে দেহটা ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আরও এক—পা এগিয়ে গেল অশোক এবং সঙ্গে সঙ্গে ভীতি—বিহ্বল কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল।

বিরাট দেহ একটা ভালুক হেলতে দুলতে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল।

নির্বোধের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অশোক। পালাবার শক্তি নেই—পা দুটো পেরেক দিয়ে কে যেন গেঁথে দিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের স্পন্দন। অবসন্ন দেহ বেয়ে অজস্র ঘামের ধারা নামল।

এমন একটি অতিথিকে দেখবার জন্যে ভালুকটিও বোধ করি প্রস্তুত ছিল না। সামনের পা দুখানা শূন্যে তুলে মানুষের মতোই সে এগিয়ে আসতে লাগল। ছোট ছোট চোখ দুটোয় কুটিল দৃষ্টি। মুখে বিচিত্র একটা শব্দ। তার প্রসারিত দুহাতে মৃত্যুর আলিঙ্গন।

অকস্মাৎ অশোক সজাগ হয়ে উঠল। ফিরে পেল তার হৃত—শক্তি, হৃত—সাহস। আর একবার তীক্ষ্ন, তীব্র আর্তনাদ করে ছুটতে লাগল সে।

কোথায়, কোনোদিকে কিছুই জানে না। মাথার ভেতর শুধু একটিই চিন্তা—পালাতে হবে, যেমন করে হোক বাঁচতে হবে।

কতক্ষণ উদভ্রান্তের মতোই ছুটল খেয়াল নেই। পা দুটো ক্ষত—বিক্ষত হয়ে গেল। পরনের কাপড়খানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো। অবশেষে নিঃশেষিত শক্তিতে পড়ে গেল মাটির ওপর।

কিন্তু তাতেও স্বস্তি নেই। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। অন্ধকার নেমে আসছে বন ছেয়ে।

ব্যাকুল দৃষ্টিতে অশোক চারদিকে তাকাতে লাগল। ভালুকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এ কোথায় এসেছে সে? অসীমার নির্দেশিত পথটাই বা কোথায় গেল?

শ্বাস—প্রশ্বাস একটু সহজ হতেই, অশোক নিজেকে আবার টেনে তুলল। এই বিজন অরণ্যে এমনিভাবে মৃত্যুকে সে বরণ করতে পারবে না।

আবার চলতে শুরু করল সে। দিক নেই, দিশা নেই। তবু থামবারও সাহস নেই।

অন্ধকার আরও গাঢ় হল। পায়ে পায়ে অরণ্যের হাজার বিভীষিকা। নিশ্চিত মৃত্যু যেন অসহায় শিকারকে নিয়ে খেলা করছে।

অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে চলল অশোক। এ চলা যেন কালির সমুদ্রে সাঁতরে চলা। প্রতি মুহূর্তে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা। তবু রাত ক্রমেই গভীর হয়। সময়ের প্রতিটি ছেদ—মিনিট, পল, অণুপল—যেন ভারী রোলারের মতোই মন্থর গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে পার হয়।

তার জন্যে নতুন করে কোনো উৎকণ্ঠা বোধ করে না অশোক। এ অরণ্যে সময়ের হিসাব কে—ই বা রাখে? আর রেখেই বা লাভ কি? ভয়—ভাবনা আর কিছু নেই। দেহের মতো মনটাও অসাড়, পঙ্গু হয়ে গেছে।

অকস্মাৎ দূরে অতি ক্ষীণ একটা আলোক—শিখা দেখা গেল। কালির সমুদ্রে যেন ছোট একটা প্রবাল দ্বীপ।

নিজের চোখকে অশোক বিশ্বাস করতে পারে না। সত্যিই আলোক—শিখা, না কোনো হিংস্র প্রাণীর জ্বলন্ত চোখ?

থমকে দাঁড়াল অশোক। আবিষ্টের মতোই তাকিয়ে রইল। না, বিন্দুটি একই জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে। নড়ছে না, এগিয়েও আসছে না।

চাবুকের পর চাবুক মেরে নিজের মনকে অশোক সচেতন করে তুলল, তারপর ছুটল আলোক বিন্দুটিকে লক্ষ্য করে।

অন্ধকারে ধাক্কা খেল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে। ঝুলে থাকা ডালের আঘাতে কপাল কেটে গেল। হিংস্র সরীসৃপ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল; কিন্তু সে কোনো কিছুই খেয়াল করল না। নতুন করেই বাঁচবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ঠেলে নিয়ে চলেছিল তাকে।

বিন্দু ক্রমেই বড় হতে থাকে। অস্পষ্ট একটা রূপ নেয়। জানলার লোহার গরাদ গলে আসছে এ আলোক শিখা। নীচু একটা ঘরের ইঙ্গিত, পুরু, মজবুত কাঠের। ছাউনিও তাই।

অশোকের রক্তস্রোত উত্তাল হয়ে উঠল। হাত—পা কাঁপতে লাগল ঠক ঠক করে। মাতালের মতো টলতে টলতে জানলার গরাদে মুখ রেখে সে ডাকল, ‘কে আছেন? আমায় বাঁচান…’

দৃষ্টিটা অনুসন্ধানী আলোর মতই ঘরের চারদিকে ঘুরে এল। কেউ নেই সেখানে। ছোট ঘর। কাঠের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে নানা রকম অস্ত্র। কোনোটা টাঙানো; কোনোটা বা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আছে। ওপাশে একটা দরজা। ভেতর থেকে খিল বন্ধ।

নতুন করেই আবার ভয় পেল অশোক; কিন্তু বিস্ময়টা ভয়ের মাত্রাকে ছাপিয়ে উঠল। ঘরে কেউ নেই, অথচ ভেতর থেকে খিল বন্ধ হয় কি করে?

গলাটা আরও একটু চড়িয়ে অশোক বলল, ‘কে আছেন? আমায় একটু আশ্রয় দিন। রাতের মতো একটু আশ্রয়।’

তবু কোনো সাড়া এল না। দেখাও গেল না কাউকে।

কি করবে ভেবে পেল না অশোক। ঘর যখন আছে, তখন লোকও আছে; কিন্তু কি করে অদৃশ্য হল? এত অস্ত্রশস্ত্রই বা কেন?

ঘুরে সে ঘরের সামনের দিকেই যাচ্ছিল, অকস্মাৎ দৃষ্টিটা মেঝের ওপর আটকে গেল। দেখল, একটা অংশ ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠছে।

বিস্ময়ে অভিভূত অশোক আর চোখ ফেরাতে পারল না। গলা দিয়ে শুধু একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে এল।

আরও খানিকটা উঠে গেল কাঠখানা। দেখা দিল সুগভীর এক রন্ধ্র।

অশোক বুঝল, কাঠখানার ওপর দিকে ওঠা কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়। আসলে একটা গুপ্ত দরজা খুলে যাচ্ছে। কাঠের পাল্লাটায় আঁটা একটা শেকলই তার প্রমাণ। মেঝের সঙ্গে দরজাটা এমন সুকৌশলে বসানো যে, ওপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না।

পরক্ষণে রন্ধ্রপথে দেখা গেল এক বৃদ্ধের মুখ। গোঁফ—দাড়ির ঘন অরণ্যে প্রায় ঢাকা। ছোট ছোট চোখ দুটির দৃষ্টি একজাতীয় সাপের কথাই বিশেষ করে মনে পড়িয়ে দেয়। মাথার কাঁচা—পাকা চুলে বটগাছের ঝুরির জটিলতা।

অশোক বিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইল।

মুখের পর দেখা গেল দেহ। বৃদ্ধ যেন ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন। পরনে খাকির প্যান্ট আর সাদা অর্ধেক—হাতা শার্ট।

এ আবিষ্কারে অশোকের ভয়ের চেয়ে আনন্দই হল বেশি। জানলার গরাদে মুখ চেপে ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘শুনছেন, দরজাটা খুলে দিন। প্রাণ বাঁচান আমার।’

চকিতে ফিরে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। চোখে ফুটে উঠল বিচিত্র এক আতঙ্কভরা দৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে ফুঁ দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিলেন তিনি।

ঘন অন্ধকারে ভরে উঠল ঘর। কাঠের পাটাতনে উঠল দ্রুত, লঘু পদধ্বনি। বৃদ্ধ নিশ্চয় চলে যাচ্ছেন।

মিনতিমাখা কণ্ঠে অশোক আবার আবেদন জানাল, ‘দোহাই আপনার, চলে যাবেন না। দরজাটা খুলে দিন।’

কোনো জবাব এল না।

হাতে পেয়েও বুঝি সুযোগ হারায়। অশোক ঘুরে ঘরের সামনের দিকে ছুটল। কোথায় দরজা, খোলা কি না, অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হয় না। বৃদ্ধই বা অদৃশ্য হলেন কি করে?

দাঁড়িয়ে পড়ে অশোক এদিক—ওদিক তাকাতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কি যেন একটা তার মাথা গলে গলায় এসে পড়ল। তারপর নামতে লাগল নীচের দিকে।

অশোক ভীষণ ভাবেই চমকে উঠল। ভাবল গাছের ডাল থেকে লাউডগা জাতীয় কোনো সাপ ছিটকে পড়ে পাক দিয়ে ধরেছে; কিন্তু পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। সাপ নয়, চামড়ার তৈরি ফাঁশ। দু—বাহুর ওপর চেপে বসেছে।

নিজেকে মুক্ত করে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে অশোক চিৎকার করে উঠল, ‘কে? কে তুমি?’

বাঁধন আরো কঠিন হয়। চামড়া কেটে বসবে বুঝি। মুক্তির চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে অশোক ঘুরে দাঁড়াল। নজরে পড়ল, ফাঁসের অপর প্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণমূর্তি একটা। অন্ধকারে বয়েসটা ঠিক ঠাহর করা গেল না। তবে বলিষ্ঠ গঠন বলেই মনে হল।

অশোক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করেছি আমি? আমাকে বাঁধলে কেন?’

কৃষ্ণমূর্তিটি যেন পাথরে গড়া। কোনো সাড়া দিল না। জবাব এল পেছন থেকে, ‘নিরাপদ হতে কে না চায়?’

সঙ্গে সঙ্গে টর্চের এক ঝলক তীব্র আলো তার মুখে এসে পড়ল।

চকিতে ফিরে দাঁড়াতে গেল অশোক, কিন্তু পারল না। শুধু বাঁধনের যাতনাটাই গেল বেড়ে।

সেই বৃদ্ধ ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

অশোক ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কে আপনি?’

উপহাসের হাসি হাসলেন বৃদ্ধটি। তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে, সেই কৃষ্ণকায় মূর্তির উদ্দেশে বিচিত্র ভাষায় তিনি বললেন, ‘কাট্টি সে ছে।’

ভাষা বুঝল না অশোক, কিন্তু অর্থটুকু বুঝতে বাকি রইল না যখন কৃষ্ণমূর্তিটি ফাঁসবদ্ধ অবস্থায় তাকে টানতে টানতে সেই ঘরের ভেতর নিয়ে চলল।

ভেতরে তখন প্রগাঢ় অন্ধকার। হোঁচট খেয়ে অশোক পড়েই যাচ্ছিল; কিন্তু ফাঁসের টান পেয়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল।

পেছন পেছন ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধটি। আলোটা জাললেন; তারপর ফিরে তাকিয়ে নিরস কণ্ঠে ডাকলেন, ‘অশোক সেন!’

চমকে উঠল অশোক। অব্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?’

ব্যঙ্গের হাসিতে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল ছোট ঘরখানা। কাব্যের সুরে বৃদ্ধ বললেন, ‘কস্তুরী মৃগ যে নিজের গন্ধেই ধরা পড়ে।’

‘আমায়—আমায় চেনেন তাহলে?’

আবার সেই অট্টহাসি। বিদ্রুপে, অবজ্ঞায় বৃদ্ধের গোঁফ—দাড়িবহুল মুখখানা বীভৎস হয়ে উঠল। কোনো জবাব না দিয়ে তিনি সরে এলেন গুপ্ত দরজাটার দিকে। কাটা তক্তাখানা টেনে তুলে অনুচরটিকে আদেশ করলেন, ‘নিয়ে এসো, মংটু।’

সঙ্গে সঙ্গে সেই কৃষ্ণকায় যুবকটি ফাঁসের অপর প্রান্তে টান দিল। বাধা দেবার চেষ্টা করতে করতে অশোক প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল, ‘না, আমি যাব না। কোথায় যেতে হবে না জানলে আমি এক পা—ও নড়ব না।’

সাপের মতই ছোট ছোট চোখ দুটো বৃদ্ধের জ্বলে উঠল। অনুচরের দিকে ফিরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘তোয়াং নে ছে।’

সঙ্গে সঙ্গে অশোককে প্রবল ধাক্কা দিল মংটু। অশোক ছিটকে এসে পড়ল গুপ্তপথের পাশে।

বৃদ্ধ ততক্ষণে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করেছেন।

মংটু টেনে হিঁচড়ে অশোককে গহ্বরের সামনে নিয়ে এল। নীচে অতল অন্ধকার। চেষ্টা করেও অশোক কিছু দেখতে পেলো না, তবে নিরর্থক বুঝে আর বাধা দেবার চেষ্টাও করল না। মংটুর পেছন পেছন নামতে শুরু করল।

প্রতিটি ধাপ মনে হয় যেন মৃত্যুপুরীর অন্দরমহলে ঢোকার এক একটি দরজা। প্রত্যক্ষ কিছুই করা যায় না; অথচ প্রতিমুহূর্তে অনুভূত হয়।

মাঝে মাঝে টর্চের আলো ফেলে বৃদ্ধ নিরীক্ষণ করেন সে ঠিকমতো নামছে কিনা। একটু পরেই অন্ধকারের ঘনত্ব তরল হয়ে এল। চোখের সামনে ফুটে উঠল চিত্রকরের ফিকে জলরঙে আঁকা একখানা ছবি। কাঠের সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছ, তারই হাত কয়েক দূরে অর্ধবৃত্তাকার একটা খিলান। খিলানের তলা দিয়ে যে অপ্রশস্ত পথ, তারই একধারে দেওয়ালের গায়ে নানা গঠনের বিভিন্ন রকমের অস্ত্র। অন্য দিকের দেওয়ালে টাঙানো বাঘ, ভালুক, কুমির, হরিণ প্রভৃতির ছাল।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অশোক। পরিবেশটা শুধু বিচিত্রই নয়, ভয়াবহ। বুকখানা কেঁপে উঠল তার। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় কত বিভীষিকাই বা মানুষে সহ্য করতে পারে।

কিন্তু দাঁড়াবার অবকাশ মিলল না। সামনে থেকে নির্মম ভঙ্গিতে দড়িতে টান দিল মংটু। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে যেতে হল অশোককে।

গিয়ে পড়ল যেখানে সেটা একটা চত্বরের মতো। গোটা দুই—তিন মশাল দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারই দীপ্ত আভায় লালচে হয়ে উঠেছে সমস্ত জায়গাটা।

একদিকে কাঠের একটা ঘোরানো কপিকল। ইংরেজিতে যাকে ক্যাপসটান বলে। তাতে মোটাসোটা হাতল লাগানো। জনকয়েক খর্বাকৃতি, বলিষ্ঠ গঠনের আরাকানিকে কর্মব্যস্ত দেখা গেল। কেউ সুবৃহৎ ধাতব হাঁড়িতে কি যেন একটা সেদ্ধ করছে। কেউ কাঠের পাত্রে কিছু একটা ধুতে ব্যস্ত। অন্যদিকে দেখা গেল কয়েকজন বাটালি দিয়ে কাঠের মুখ ছুঁচলো করছে।

বৃদ্ধকে দেখে তারা সবাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কোনো সম্ভাষণ করল না, মুখ তুলেও তাকাল না।

বৃদ্ধ এগিয়ে গেলেন সামনের ভারী দরজাটার দিকে। মংটুও অশোককে টানতে টানতে তাঁর পেছনে এসে দাঁড়াল।

দরজায় যে লোহার মজবুত শিক লাগানো ছিল, তারই ফাঁক দিয়ে যতটুকু অশোকের নজরে পড়ল, তাতে মনে হল ওদিকটায় ছাতার মতোই একটা গুহা রয়েছে। মৃত্যু—গুহা কি?

অশোকের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। একটা হিমস্রোত যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল।

বৃদ্ধ ফিরে তাকিয়ে কর্মরত দুজন আরাকানিকে কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিলেন, ‘সাও তু ফা।’

হাতের কাজ ফেলে আরাকানি দুজন ছুটল এবং কপিকলের কাঠের হাতলটা ধরে ঘুরতে লাগল—ঠিক যেমন ভাবে ঘানির বলদ ঘোরে। হাতের পেশিগুলো স্ফীত হয়ে উঠল তাদের। দু—পাশের কাঁধে দেখা দিল বলের মতোই দুটো মাংসপিণ্ড। পায়ে চাপ দিতে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল তারা।

অশোক বিহ্বলের মতোই তাকিয়ে রইল। কি করছে তারা, বৃদ্ধই বা কি আদেশ দিলেন—কিছুই বোঝেনি; কিন্তু পরক্ষণে অর্থটুকু পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখল কর্কশ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লোহার শিক দেওয়া ভারি দরজাটা ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে।

একটা মশাল তুলে নিয়ে বৃদ্ধ গুহার ভেতর ঢুকে গেলেন। অশোককে টানতে টানতে মংটু অনুসরণ করল তাঁকে।

গুহা দীর্ঘ, কিন্তু অপ্রশস্ত। মাথার ওপর নীচু ছাদ। দু—দিকের দেওয়ালে সারি সারি খুপরির মত ঘর।

এগিয়ে চললেন বৃদ্ধ। আবিষ্টের মতই অশোক অনুসরণ করল; কিন্তু মাত্র কয়েক পা। অকস্মাৎ ভয়ে সে অস্ফূট আর্তনাদ করে উঠল।

দেখা গেল বিরাট দেহ একটা ভালুক সামনের পা দুটো হাতের মতোই প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে—যেমন ভাবে আর একটা প্রাণী এসেছিল বনের মধ্যে।

দু—পা পেছিয়ে গেল অশোক। মুখ দিয়ে গোঁঙানির মতো অস্ফুট একটা ধ্বনি করে উঠল।

তার আতঙ্ক দেখে ভালুকটা যেন কৌতুক বোধ করল। বারকয়েক ঘ্রাণ নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে এল।

পালাবার পথ নেই। আত্মরক্ষার জন্যেই অশোক শূন্যে দু’হাত তুলে চিৎকার করে উঠল।

হা—হা করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ। অভিনয়ের ভঙ্গিতে ডাকলেন, ‘বিবি!’

ভালুকটা থমকে দাঁড়াল, তারপর যেন অনিচ্ছাভরেই আবার নিজের খুপরীতে ঢুকে গেল।

এতক্ষণে রুদ্ধশ্বাস ফেলে বাঁচল অশোক।

বৃদ্ধ ঈষৎ বিদ্রুপের সুরে বললেন, ‘অত ভয় কেন? ওটা পোষা। তা ছাড়া দেখলে তো কেমন বাধ্য।’

তবু সান্ত্বনা পায় না অশোক। তিক্ত কণ্ঠেই বলে ওঠে, ‘ছেড়ে রাখেন কেন?’

বৃদ্ধের চোখে মুহূর্তের জন্যে যেন আগুনের শিখা দেখা দিল। ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ‘বাঁধন পরতে কেই বা চায়, তা সে পশুই হোক আর মানুষই হোক।’ কথা শেষে এগিয়ে গেলেন তিনি গুহাটার শেষপ্রান্তে।

দর্শন—তত্ত্ব পরিপাক করবার মতো মনের অবস্থা নয়; তবু অশোককে পরিপাকও করতে হয়, অনুসরণও করতে হয়।

অপ্রশস্ত পথটা ডান দিকে ঘুরে গেছে। সেখানে আর একটা কপিকল। একই গড়নের, তবে অপেক্ষাকৃত ছোট। বৃদ্ধ তার পাশে দাঁড়িয়ে হাতলটা ধরে ঘোরাতে লাগলেন।

অশোক উৎকণ্ঠা আর সহ্য করতে পারল না। প্রশ্ন করল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?’

‘নিরাপদ আশ্রয়ে।’ আবার সেই ব্যঙ্গের হাসি।

সামনের ভারী দরজাটা ধীরে ধীরে উঠে যেতে লাগল। ওদিকে কারাগারের নিরন্ধ্র সেলের মতোই ছোট একখানা ঘর। মশালের আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠল।

দরজার একধারে সরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কর্কশ কণ্ঠে হুকুম দিলেন মংটুকে, ‘নে হো।’

মংটু ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে চলল অশোককে।

প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই, অশোক জানে, তবু আপত্তির সুরে চেঁচাতে লাগল, ‘না, যাব না। আপনার মতলব বুঝেছি আমি। জেনেশুনে ফাঁদে পড়তে চাই না।’

জ্বালাভরা চোখে বৃদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘পড়লেই বা ক্ষতি কি? এখুনি তো বনের জন্তু তোমায় টুকরো টুকরো করে ফেলত।’

‘তবু জ্বলন্ত উনুনে পড়ার চেয়ে গরম কড়াও অনেক ভালো…’

‘সব জায়গায় সব উপমা চলে না অশোক সেন।’ পরক্ষণে মংটুর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ হুকুম দিলেন, ‘ফাংফা।’

পেছন থেকে মংটু প্রবল জোরে ধাক্কা দিল অশোককে।

পাথরে বাঁধানো মেঝের ওপর অশোক ছিটকে গিয়ে পড়ল।

নেমে এলো দরজাটা। তড়িৎবেগে উঠে এসে, অশোক গরাদ ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে পাগলের মতোই চেঁচাতে লাগল, ‘কেন আমাকে এখানে আটকে রাখছেন? কী অধিকার আপনার?’

সে—কথার কোনো জবাব না দিয়ে বৃদ্ধ ফিরে চললেন। অশোক অসহায়ের মতোই ডাকতে লাগল, ‘যাবেন না শুনুন! একটু জল, তেষ্টার জল একটু দিয়ে যান—শুনছেন!’

উত্তরে ব্যঙ্গের হাসি ছাড়া আর কিছু শোন গেল না।

মশালের আলো অদৃশ্য হল। নেমে এল প্রগাঢ় অন্ধকার। নিজের হাতটাও দেখা যায় না।

গরাদ চেপে স্থাণুর মতোই দাঁড়িয়ে রইল অশোক। জল তৃষ্ণাটা এবার যেন নতুন করেই আকুল করে তুলল তাকে। জিভটাকে মনে হয় ব্লটিং কাগজের মতোই খসখসে। গলা চিরে গেছে। মুখে এক বিন্দু লালা নেই যে ঢোঁক গেলে।

ধীরে ধীরে ফিরল অশোক। জল চাই, যেমন করে হোক প্রাণ বাঁচানোর মতো একটু জল।

অন্ধের মতোই হাঁটতে লাগল সে। হঠাৎ পায়ে কিসের যেন ঠোক্কর খেল। সামলাতে গিয়ে হাত দু’খানা বাড়িয়ে দিল মেঝের দিকে। ছপাৎ করে একটা শব্দ; সেই সঙ্গে খানিকটা জল চলকে উঠে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে গেল।

বিশ্বাস করতে পারে না অশোক। জল? সত্যিই জল? মুখখানাকে সে নামিয়ে আনে। বোঝে মাটির পাত্র একটা, তাতেই রাখা আছে জল।

উপুড় হয়ে পড়ে সে জলে মুখ ডুবিয়ে পান করতে লাগল বন্য পশুর মতোই।

।। তিন।।

স্টিম—লঞ্চের ছোট কেবিনের ভেতর আগম দত্ত চোখ মেলে তাকাল। সংজ্ঞা তখনও ঠিক পুরোপুরি ফেরেনি; কেমন যেন একটা আবিল ভাব। ঘোলাটে দৃষ্টিটা চারদিকে ঘোরাতে লাগল সে। কোনো ছবিই যেন স্পষ্ট নয়; ‘আউট অফ ফোকাস’ স্থির চিত্রের মতো। বাইরে কোথাও থেকে ধকধক করে একটা শব্দ ভেসে আসছে; অতিকায় কোনো জন্তুর হৃদপিণ্ডের ধ্বনি যেন।

সঙ্কীর্ণ শয্যার ওপর দু’হাতের ভর দিয়ে আগম দত্ত উঠে বসল। মাথার কাছেই গোলাকৃতি ছোট ঘুলঘুলি একটা ছিল। সেইটে দিয়ে তাকাতেই দেখল, অশান্ত জলরাশি পাক খাচ্ছে; সাপের মতই ফণা তুলে এগিয়ে আসছে গর্জন করতে করতে।

চট করে মুখখানা টেনে নিয়ে, সে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘ডুবে গেল…ডুবে গেল—আমায় ছেড়ে দে অশোক…ইঁদুরের মতোই গর্তে আটকা পড়ে আমি মরতে পারব না।’

শয্যা থেকে নেমে পড়ল সে; কিন্তু দাঁড়াতে পারল না। মাথাটা টলে গেল। পা দুটোও মনে হল যেন কাগজের তৈরি; ভেঙে এল। আবার শয্যার ওপরই লুটিয়ে পড়তে হল তাকে।

তার ভয়ার্ত কণ্ঠের চিৎকার শুনেই বোধ করি বছর কুড়ি—একুশের একটি তরুণী সরু সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল। এক হাতে তার ওষুধের শিশি, অন্য হাতে কাচের গ্লাস একটা।

আগম দত্ত শূন্য দৃষ্টিতে শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল; কোনো কথা বলতে পারল না।

তরুণীটি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে, খুশিভরা কণ্ঠে বলল, ‘যাক জ্ঞান হয়েছে তাহলে।’

‘জ্ঞান? আমি কি তাহলে অজ্ঞান হয়েছিলুম?’

শিশি থেকে গ্লাসে ওষুধ ঢালতে ঢালতে তরুণীটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘ছিলুম মানে? আজ দু’দিন।’

আগম দত্ত যেন কি ঘটে গেছে, সেইটেই স্মরণ করবার চেষ্টা করে।

তরুণীটি গ্লাসটা তার সামনে ধরে বলল, ‘নিন, ওষুধটা খেয়ে নিন।’

আগম দত্ত যন্ত্রচালিতের মতোই হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিল; কিন্তু খেল না। টেনে টেনে বলল, ‘দু’দিন আমি অজ্ঞান হয়েছিলুম?’

বিশেষ একটা দৃশ্য মনে পড়াতেই বুঝি তরুণীটি এবার খিল খিল করে হেসে উঠল। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, ‘আর জল? উঃ! যা জল খেয়েছিলেন।’

আবার নতুন করেই হাসির তরঙ্গে দুলে দুলে উঠতে লাগল।

আহত কণ্ঠে আগম দত্ত বলে উঠল, ‘এটা কি আপনার হাসবার কথা হল? জলে ডুবে কোথায় আমি মরতে যাচ্ছিলুম।’

লজ্জা পেল না তরুণীটি। চকচকে চোখে বলল, ‘ডুবলেন আর কোথায়? ভাসছিলেন তো ঠিক যেন একটা বয়া। তাই না আমরা দেখতে পেলুম। দূরবিন কষারও দরকার হল না। নিন, ওষুধটা আগে খেয়ে নিন; তারপর সব শুনবেন।’

আগম দত্ত গ্লাসের ওষুধটুকু গলায় ঢেলে দিল।

‘দাঁড়ান, ডাক্তার বলেছে এবার কিছু খেতে দিতে হবে।’

তরুণীটি ফিরতেই, আগম দত্ত ডাকল, ‘শুনুন।’

ঘুরে দাঁড়াল তরুণীটি। সহজ কণ্ঠেই বলল, ‘আমার নাম রেবা—রেবা মিত্তির।’

সাগ্রহে আগম দত্ত প্রশ্ন করল, ‘জল থেকে কি তাহলে আপনারাই বাঁচিয়েছেন?’

তরল কণ্ঠে রেবা জবাব দিল, ‘এটা কি আবার জিজ্ঞেস করে জানতে হয় নাকি? কাকদ্বীপে লঞ্চ থামিয়ে বাবা ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। হাসপাতালেই পাঠাবার কথা হয়েছিল, তবে নেহাৎ আমার পছন্দ হল না।’

ফিরে আবার সে ওপরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই আগম দত্ত জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আর কারও খোঁজ পাননি? অশোক?…রমেশ?

রেবা শুধু বিস্মিতই নয়, মনে হল যেন চিন্তিত হয়ে উঠেছে। পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ওঁরাও সঙ্গে ছিলেন নাকি? কই, আর কাউকেই তো পাওয়া যায়নি!’

কথা তার শেষ হবার আগেই আগম দত্ত অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, ‘একলা আমায় তাহলে বাঁচালেন কেন? ডুবে তো গেছলুমই, না হয় মরতুম।’

রেবা হকচকিয়ে গেল। কতক্ষণ বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইল আগম দত্তের দিকে। তারপর এগিয়ে এসে, মৃদু কোমল কণ্ঠে বলল, ‘ছি, ছি! ছেলেমানুষের মতন কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে তাঁদের না জেনেই…’

আগম দত্তের শোকাবেগ তাতে মন্দীভূত হল না। একইভাবে ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলে চলল, ‘আমি ওদের আত্মীয়—স্বজনের কাছে কি বলব? কলকাতায় গিয়ে মুখ দেখাব কোন লজ্জায়? বেরুলুম তিনজন একসঙ্গে…’

তার যুক্তিটা বোধ করি রেবার নারী—হৃদয় আর্দ্র করে থাকবে। মৃদু কণ্ঠে সে সাত্ত্বনা দিল, ‘কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই, আমি বাবাকে গিয়ে বলছি ওঁদের খোঁজ করতে। আপনি যেন আর ওঠবার চেষ্টা করবেন না। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

সিঁড়ি বেয়ে সে ত্বরিতপদে ওপরের ডেকে উঠে গেল, আর আগম বিছানায় পড়ে পড়ে চোখের জল ফেলতে লাগল। অতীতের ছোট—বড় হাজার স্মৃতি এসে মনের দুয়ারে হানা দেয়।

অশোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব তার স্কুলজীবন থেকেই। একসঙ্গে খেলা করেছে। ঝগড়া—বিবাদও কম করেনি; আবার মিটে যেতেও বিলম্ব হয়নি। তারপর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন একই কলেজে ভর্তি হল, রমেশের সঙ্গে আলাপ হল সেখানেই। বলিষ্ঠ দেহ তার; মনটাও বলিষ্ঠ। তাই আলাপটা কখন যে ঘনিষ্টতায় পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল, কেউই টের পায়নি।

বন্ধু—বান্ধব, আত্মীয়—পরিজনের অনেকেই তাদের পরিহাস—ছলে ত্রিমূর্তি বলে ডাকত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। মনে মনে তারা খুশিই হত তাতে।

কলেজ থেকে বেরুবার পর চাকরি জীবনে ঢুকল তারা। দেখাসাক্ষাৎটা অনিয়মিত হয়ে উঠলেও, হৃদ্যতায় কোনো পার্থক্য ঘটেনি। আর ঘটেনি বলেই রমেশ যখন সুন্দরবন দেখার আমন্ত্রণ জানাল, তখন অপর দু—বন্ধুই সাগ্রহে সম্মতি জানিয়েছিল। তখন কে জানত, প্রমোদ— ভ্রমণ এমন একটা বিয়োগান্ত নাটকে পর্যবসিত হবে।

কিন্তু বিলাপ করার মতো অবসর মিলল না। খালের যে কিনারা ঘেঁষে স্টিম—লঞ্চটি যাচ্ছিল, সেই দিকের পাড় থেকে বহু কণ্ঠের মিলিত হৈ—চৈ ভেসে এল, ‘ইস্টিমার থামান—থামান হুজুর…একবার বাঁধতে হবে…লাশ পাওয়া গেছে—’

আগম দত্ত ঘুলঘুলিটার ভেতর দিয়ে উঁকি দিল, কি ব্যাপার কিছুই বুঝল না। শুধু নজরে পড়ল, বিশ—পঁচিশজন লোক ডাঙায় দাঁড়িয়ে হাত—পা নেড়ে চিৎকার করছে। তবু কেবিনের ভেতর সে আর থাকতেও পারল না। দুর্বল পা দুটোকে টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে চলল।

স্টিম—লঞ্চের মুখ তখন ঘুরেছে। ডেকের কিনারায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন রেবার বাবা হেমন্তকুমার। দীর্ঘ দেহ, সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়। তাঁর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রেবা। চোখে মুখে তার আতঙ্কের পাণ্ডুরতা। আগম দত্তের জন্যে যে পথ্য নিয়ে যেতে হবে, সে—খেয়ালটুকুও তার ছিল না।

পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গ্রামবাসীরা ক্রমাগত হাত নেড়ে চিৎকার করতে লাগল।

স্টিম—লঞ্চের গতি বন্ধ হতেই, খালাসিরা ওপর থেকে লম্বা লম্বা তক্তা ফেলল পাড় পর্যন্ত। তৈরি হল অস্থায়ী সেতু। তার ওপর দিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে এলেন হেমন্তকুমার। রেবারও ইচ্ছা ছিল বাপের সঙ্গে আসতে, কিন্তু হেমন্তকুমার ঘাড় নেড়ে নিষেধ করলেন।

মাতব্বর গোছের জন দুই—তিন এগিয়ে এসে প্রণাম করল। বলল, ‘শিগগির চলুন হুজুর, বড্ড বিপদ!’

ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন হেমন্তকুমার, ‘কি হয়েছে?’

‘ভোরবেলায় নফর জেলে খালে জাল ফেলছিল, হুজুর। মাছের বদলে উঠল কিনা একটা লাশ।’

হেমন্তকুমারের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল। এসব এলাকায় খুন—জখম অস্বাভাবিক কিছু নয়।

নফর জেলে ততক্ষণে সবিস্তারে বর্ণনা শুরু করেছে, ‘আজ্ঞে, দেখে তো ভদ্দরলোক বলেই মনে হল। শরীরে কোনো দাগ—টাগ নেই। জলে ডুবেই মিত্যু হয়েছে।’

বাধা দিয়ে হেমন্তকুমার বললেন, ‘চল তো, দেখি গে—’

তিনি এগিয়ে চললেন। পেছনে কলরব করতে করতে চলল গ্রামবাসীর দল। নানা মন্তব্য। বিচিত্র বিশ্লেষণ। রেবা আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। বাপের নিষেধ ভুলে গিয়ে, পায়ে পায়ে নেমে এল পাড়ে। শুধু জানতে পারল না, আগম দত্তও দূর থেকে অনুসরণ করছে তাকে।

খালের পাড় থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, হোগলা—ছাওয়া একখানা চালা ঘরের ভেতর মৃতদেহটা রাখা ছিল। চারদিক ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামবাসীরা। ছেলে—বুড়ো, নারী— পুরুষ—কৌতূহল সবায়েরই সমান। তাদের বৈচিত্র্যহীন জীবনে এ ধরনের ঘটনাই যা কিছু উত্তেজনা আলোচনার খোরাক জোগায়।

কুমিরের পেটে না গিয়ে কি করে যে মৃতদেহটা আস্ত আাছে ভেবে পায় না বংশী দাস। জিতেন গলুইয়ের স্ত্রী চোখ মুছে খেদ জানায়, ‘আহা, কাদের বাছা রে!’ ফণী সাঁপুই মন্তব্য করে, ‘পচে ঢোল হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে ডুবেছে, তাই বা কে জানে।’

হেমন্তকুমারকে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে তারা পথ ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু একেবারে দূরে সরে যেতেও পারল না।

মৃতদেহের দিকে তাকাতেই হেমন্তকুমার মনে মনে বোধ করি শিউরে উঠলেন। মুখ দিয়ে অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে এল, ‘ইস!’

কৈলাস মণ্ডল পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, আমাদের তো ঠাহর হয়, ঝড়ের রাতেই নাও—ডুবি হয়ে মারা গেছেন।’

মাথা নেড়ে সায় দিলেন হেমন্তকুমার, ‘সম্ভব।’

‘লাশ নিয়ে আমরা এখন কি করব বলে দিন, হুজুর। থানায় পাঠাচ্ছিলুম খবর দিতে, এই সময় দেখলুম আপনার লঞ্চ আসছে—’

হেমন্তকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমি লিখে দিচ্ছি। সেইটে নিয়ে কেউ থানায় চলে যাক। আর একজন লঞ্চে গিয়ে আমার নাম করে আর্মড গার্ডদের খবর দাও, দুজন যেন এখনি চলে আসে।’

অকস্মাৎ স্বর তাঁর ডুবে গেল আগম দত্তের আর্তকণ্ঠের চিৎকারে, ‘রমেশ! রমেশ!’

পাগলের মতোই দু—হাতে ভিড় ঠেলে, সে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রমেশের বুকের ওপর। ভেঙে পড়ল আকুল কান্নায়, ‘তোর কপালে এই ছিল ভাই—তোর কপালে এই ছিল!’

সচকিত হয়ে উঠল সবাই। হেমন্তকুমার কেমন যেন হতবাক হয়ে গেলেন। কানে ভেসে আসতে লাগল নানাবিধ মন্তব্য, ‘তাহলে চেনা লোক…কে হয় কে জানে…উনিই বা কে…’

রেবা এসে বাপের পাশে দাঁড়াল। অনুচ্চকণ্ঠে বলল, ‘ওঁর বন্ধু। একটু আগেই আমায় বলছিলেন।’

হেমন্তকুমার মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন আগম দত্তের কাছে। তার কাঁধে একখানা হাত রেখে সস্নেহ কণ্ঠে বললেন, ‘অদৃষ্টের ওপর তো হাত নেই। উঠে এস, বাবা।’

নতুন করেই ফুপিয়ে উঠল আগম দত্ত, না—না…’

তবু উঠতে হল তাকে। হেমন্তকুমারই টেনে তুললেন। মেয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘নিয়ে যা লঞ্চে। আমি যাচ্ছি।’

এগিয়ে এল রেবা; কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে আকুল স্বরে কেঁদে উঠল আগম দত্ত। দৃশ্যটা হয়তো হাস্যকর, তবু অতগুলো নর—নারী কারও চোখই শুষ্ক রইল না।

।। চার ।।

গুহার মতোই ছোট্ট সেই ঘরে অশোক একখানা কাঠের বেঞ্চের ওপর শুয়েছিল। চারদিকে নিছিদ্র অন্ধকার। সে অন্ধকার যেন বুক চেপে ধরে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারেনি অশোক। পারলে হয়তো চিন্তার হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্যেও নিষ্কৃতি পেত। কোন পুরাণ বা উপনিষদে যেন পড়েছিল বজ্রকীটের কথা—যে কীট নিরন্তর পাথরের বুক বিদীর্ণ করে চলেছে। ঠিক তেমনি তার মাথার ভেতর কুরে কুরে খাচ্ছে চিন্তাগুলো। কতকাল এমনি বন্দি জীবনযাপন করতে হবে? কি করতে চায় তাকে নিয়ে বিকৃত— বুদ্ধি বৈজ্ঞানিক? নতুন কোনো গবেষণা? তার দেহের অস্থি—মজ্জা, মেদ নিয়ে তৈরি হবে কোনো রসায়ন? হোক! শুধু ভবিতব্যটুকু সে যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারত, তাহলে প্রস্তুত করে রাখতে পারত মনকে। কিন্তু এই সংশয়…এই অনিশ্চয়তা…

বেঞ্চের ওপর উঠে বসল অশোক। কত রাত কে জানে? সময় এখানে নিথর। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে না। তবু দিনের যে আলোক রেখাটুকু কোন এক রন্ধ্রপথে তির্যকভাবে এসে পড়ে, সেটুকুর জন্যেই যেন লালায়িত হয়ে থাকে।

পেছনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে অশোক আবার চোখ বুজল। মনে মনে কল্পনা করবার চেষ্টা করল, সে যেন এক কবরখানায় শুয়ে আছে। তার সঙ্গে সত্যিকার প্রভেদ কি কিছু আছে? সেখানেও তো এমনই অন্ধকার—এমনই নিস্তব্ধতা। বিচিত্র সব জন্তুগুলোও কি সব মরে গেছে? এ নিস্তব্ধতা ভাঙাবার জন্যে দুর্বোধ্য ভাষায় একবার ডেকে উঠতে পারে না?

ভগবান বোধ করি তার প্রার্থনাটা শুনলেন। অকস্মাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল—দরজাটা খোলার কর্কশ শব্দে। সেই সঙ্গে আলোর রেখা একটা এসে পড়ল দেওয়ালে।

সচকিত হয়ে উঠল অশোক। এমন সময়ে কে আসতে পারে? মুক্তিদূত, না মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে যমরাজের অনুচর?

জ্বলন্ত মশাল হাতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল সেই বুনো তরুণটিকে। আলোর শিখায় তার কৃষ্ণবর্ণ দেহকে মনে হচ্ছিল যেন পাথরে—খোদা। ঘরের দরজা খুলে সে ভেতরে ঢুকল। রেখাহীন মুখে বলল, ‘টেহু ছে।’

অশোক তার ভাষাটা বুঝল না; কিন্তু বক্তব্যটুকু বুঝল। তীব্রকণ্ঠে আপত্তি জানাল, ‘না, উঠব না—যাবও না!’

মংটুর চোখ দুটো জ্বলে উঠল। হাতের অস্ত্রটা দিয়ে অশোকের কোঁকে খোঁচা দিয়ে, হিংস্র জন্তুর মতোই গর্জন করে উঠল, ‘সাট। টেহু ছে লিকা…’

অশোক আর আপত্তি করল না; করে লাভ নেই বুঝেই। ঘর থেকে বেরিয়ে সেই অপরিসর পথ। দু—দিকের খুপরিগুলোয় বিচিত্র প্রাণীগুলো কি করছে, ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। শুধু কোনো এক অন্ধকার কোণ থেকে গরিলার বিদ্রুপমাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘জয়যাত্রায় যাও গো…’

অন্য সময় হলে এখানে এ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের গানের এক কলি শুনে হয়তো সে নিজের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেই সন্দিহান হয়ে উঠত; কিন্তু কথাগুলো এখন কানে গেলেও মনে কোনো দাগ কাটল না।

সরু সিঁড়িটা বেয়ে ওপরে উঠে এল তারা।

মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে অশোক বুক ভরে একটা শ্বাস টেনে নিল। তারাভরা আকাশ যে এত উদার, বাতাস যে এমন মিষ্ট—এর আগে কোনোদিন তা মনে হয়নি।

মংটু তার মনের খবর জানত না বলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠল। হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল তাকে বনের পথ দিয়ে।

মশালের আলোয় কতটুকুই বা দেখা যায়। প্রতি পদে দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে ছোট—বড় গাছগুলো। তাদের মাথায় জোনাকির হাজার হাজার বাতি। আশপাশ থেকে ভেসে আসে ঝিঁঝিঁ জাতীয় কোনো কীটের ডাক—তীক্ষ্ন, অবিরাম।

মাথা বাঁচিয়ে এগিয়ে চলল তারা। অকস্মাৎ নুয়ে পড়া গাছের ডাল একটা প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সবেগে ওপরে উঠে গেল। মনে হল সুপ্ত অতিকায় জন্তু একটা সহসা জেগে উঠে গা—ঝাড়া দিল।

চমকে উঠল মংটু। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রশ্ন করল, ‘ওলে? ওলে?’

কোনো জবাব এল না।

অশোক নিজেও যে খানিকটা ভয় পায়নি, তা নয়। এ আরণ্যক জগতে সব কিছুই রহস্যময়। তবু কোনোরকমে সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘কেউ নয় বোধ হয়। অনেক সময় তো এমনিই…’

কথাটা মংটু বোধ করি বুঝল না। দৃষ্টিটা সেদিকে ধরে রেখেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘ওলে বাহে? মিয়া পা…’

অশোক বুঝল মংটু জবাব চায়, পরিচয় চায়…

কিন্তু কোনো জবাব এল না; তার পরিবর্তে খুব কাছ থেকেই এল মস্ত একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ।

মংটুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন এবার সব সাহস হারিয়ে ফেলল। হাত থেকে তার মশালটা খসে পড়ে নিভে গেল। ভয়ার্ত কণ্ঠে একটা অস্ফুট আওয়াজ করে সে অন্ধকারের ভেতর ছুটতে লাগল।

কি যে ঘটছে, অশোক নিজেও তার কিছুই বুঝতে পারল না। এক—বার মনে করল সেও ছুটে পালায়; কিন্তু শক্তিতে কুলোল না। তাই রুদ্ধশ্বাসে, কণ্টকিত দেহে দাঁড়িয়ে রইল।

পেছন থেকে কার একখানা হাত যেন তার পিঠ স্পর্শ করতেই ভীষণ ভাবে চমকে উঠল সে। গলা দিয়ে বিকৃত একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল, ‘কে? কে?’

ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে অসীমা চাপা গলায় বলল, ‘চুপ।’

অশোক নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। অসীমা তেমনি স্বরে আবার বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ মংটুর সঙ্গে? তোমার কি প্রাণের ভয় নেই?’

‘একথা কেন বলছ?’

সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে অসীমা বলল, ‘যদি বাঁচতে চাও, পালাও। আর দেরি করো না।’

কথা শেষে সে আর দাঁড়াল না। দ্রুতপায়ে চলে যেতে গেল, অশোক পথ আগলাল তার। মিনতিভরা কণ্ঠে আবেদন জানাল, ‘চলে যেও না—শোন। একথা কেন বললে বলে যাও—’

হিসহিস করে উঠল অসীমা, ‘বলবার সময় নেই…পালাও…যদি বাঁচতে চাও, দেরি করো না…’

অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে, আর হতবুদ্ধির মতোই দাঁড়িয়ে রইল অশোক। কোনদিকে পালাবে সে? এই ঘন অন্ধকারে পথের নিশানা কে দেবে? জীবন রক্ষাই যদি করতে চায়, তাহলে অসীমা সঙ্গে করে নিয়ে গেল না কেন।

তবু অসহায় পঙ্গুর মতোই দাঁড়িয়ে থেকে সে ধরা দিতে চায় না। পালাবার চেষ্টাই করবে। তাতে যদি মৃত্যুকে বরণ করতে হয়, হাসি—মুখেই করবে।

পেছন ফিরে পা বাড়াল অশোক। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক আগের দিনের মতোই একটা ফাঁশ এসে পড়ল তার গলায়। সেখান থেকে নেমে বেঁধে ফেলল হাত দুটো।

মুক্তির অক্ষম চেষ্টায় অশোক চীৎকার করে উঠল, ‘ছেড়ে দাও—ছেড়ে দাও আমায়।’

অন্ধকারের ভেতর থেকে মংটুর খলখল হাসির শব্দ ভেসে এল। চোখ দুটো তার শিকারি প্রাণীর মতোই জ্বলছিল। দড়িতে প্রবল জোরে টান দিয়ে সে গর্জন করে উঠল, ‘টেহু ছে।’

বাধা দেবার আর মিথ্যে চেষ্টা করল না অশোক। নির্দ্বিধায় নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিল।

মশালটা আবার জ্বেলে নিয়ে, যুদ্ধজয়ী বীরের মতই মংটু তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল।

দূর থেকে ভেসে এল কাড়া—নাকড়ার শব্দ। একটা নয়, একাধিক। কারা বাজাচ্ছে? এত রাত্রে উপলক্ষ্যই বা কি?

হাজার গণ্ডা প্রশ্ন মনে জাগলেও জিজ্ঞেস করতে প্রবৃত্তি হল না অশোকের। আর করে লাভই বা কি?

বনের পথ ক্রমে শেষ হয়ে গেল। ইঙ্গিত পাওয়া গেল বসতির। কাড়া—নাকড়া বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল নরনারীর মিলিত কণ্ঠের উচ্ছৃঙ্খল কোলাহল।

আর একটা বাঁক ঘুরতেই গভীর বিস্ময়ে অশোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে থেকে অতি অকস্মাৎই যেন একখানা কালো পর্দা সরে গেল।

সারি সারি পাতার কুটির। মাঝখানে সুবিস্তীর্ণ মাঠ একটা। মাঠের শেষে বিচিত্র গঠনের এক মন্দির। স্থাপত্য—শিল্প নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা অবশ্য অশোকের নয়; তবু তাকিয়ে না থেকে পারে না। মন্দিরের সামনে, মাঠের মাঝে কতকগুলো মশাল জ্বলছে। তারই আলোয় দৃশ্যটা প্রকট হয়ে উঠল। উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে অর্ধ—উলঙ্গ নরনারী। পরনে তাদের পাতা দিয়ে তৈরি কটিবাস; বুনো ফুল আর রঙ—বেরঙের ঝিনুকের গয়না। একদল কাড়া—নাকড়া বাজাচ্ছে। আর একদল নাচছে। বন্য, উদ্দাম সে নাচের ভঙ্গী।

নিজের কথাটা ভুলে গিয়ে অশোক হাঁ করে তাকিয়ে রইল। হয়তো অন্তকাল ধরেই থাকত, যদি না দড়িতে আচমকা টান পড়ত। মংটু সময় নষ্ট করতে রাজি নয়।

এগিয়ে চলল অশোক তার সঙ্গে। একসারি কুটির পার হয়ে, তারা মাঠের কিনারায় এসে পৌঁছতেই সবায়ের দৃষ্টি পড়ল তাদের ওপর। উল্লাসে বিকট ধ্বনি করে উঠল তারা। কাড়া— নাকড়ার বাজনাও তার সঙ্গে সমতা বজায় রেখে প্রায় কর্ণবিদারী হয়ে উঠল।

এবার শুরু হল নাচের সঙ্গে গান। বিচিত্র তার ভাষা; অত্যদ্ভুত সুর। গাইতে গাইতে এগিয়ে এল একজন পুরুষ আর একটি রমণী। পুরুষের হাতে তীর—ধনুক; নারীর হাতে ছোরা একখানা। দুজনে অশোকের একেবারে সামনে এসে বোধ করি দেখাতে চাইল নাচের কসরৎ, শোনাতে চাইল গানের বাহার।

অশোক কিন্তু সভয়ে দু—পা পেছিয়ে গেল। পুরুষটি যেভাবে তার বুক লক্ষ্য করে ধনুকে জ্যা আরোপণ করছে, মেয়েটি হাতের শাণিত ছোরাখানা তার নাকের সামনে বিদ্যুৎ চমকের মতোই ঘোরাচ্ছে, তাতে প্রাণ—পাখির যে—কোনো মুহূর্তে দেহ—পিঞ্জর ছেড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।

এ এক নিষ্ঠুর খেলা। অশোক চমকে চমকে ওঠে, আর সবাই ফেটে পড়ে বিকট উল্লাসে।

মংটু শুধু দর্শক সেজে আর থাকতে পারে না; হাতের দড়ি আলগা দিয়ে মেতে গেল খেলায়।

অশোকের দৃষ্টিতে সেটুকু এড়াল না। ভয় সত্যিকার যতটা পেল, তার চেয়ে বেশি করল ভঙ্গি। পায়ে পায়ে পাশের দিকে সরে যেতে লাগল সে। একটা জ্বলন্ত মশালের ওপর, অন্যের অলক্ষ্যে নিজের দড়ি—বাঁধা হাত দুটো ধরল। চিড় চিড় করে মৃদু একটা শব্দ। পুড়ে গেল যেমন দড়ির বাঁধন, তেমনই হাত দুটোও অক্ষত রইল না। তীব্র জ্বালা মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ল। বন্ধ হয়ে এল হৃদপিণ্ডের গতি। তবু সুযোগটুকু হারাতে অশোক রাজি নয়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে প্রাণপণে ছুটল—কোথায় কোনোদিকে তা না জেনেই।

চারদিক থেকে তুমুল কলরব উঠল, ‘সিলেবা—সিলেবা…’ ধাবমান অশোকের কানে বাজল, ‘পালাল—পালাল…’ কিন্তু কোথায় পালাবে সে? সামনে থেকে ছুটে এল এক দল। তাদের এড়াতে গিয়ে অশোক গতিপথ বদলাল; কিন্তু সেদিক থেকেও তীর—ধনুক, ছোরা—বল্লম হাতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল আর এক দলকে।

থমকে থেমে গেল অশোক। পেছন ফিরে অন্য পথে পালাতে গেল; কিন্তু তার আগেই উদ্যত ছোরা হাতে ছুটে এল মংটু। হয়তো সেটা আমূল বসিয়েই দিত অশোকের দেহে, কিন্তু তার আগেই তীক্ষ্ন নারীকণ্ঠের চিৎকার ভেসে এল, ‘এ—এ—এ—ই—ই…’

সঙ্গে সঙ্গে একখানা ছোরা অশোকের কানের পাশ দিয়ে উল্কাবেগে গিয়ে বিঁধে গেল মংটুর উদ্যত বাহুতে। যন্ত্রণায় আহত জন্তুর মতোই আর্তনাদ করে উঠল সে। হাত থেকে তার ছোরাখানা খসে পড়ল।

এই আকস্মিক ঘটনায় সকলে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল। কি যে ঘটল, সেটা ভালোভাবে বোঝবার আগেই অনতিদূরের একটা গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে নামল অসীমা। ছুটে এসে তুলে নিল মংটুর ছোরাখানা। বিচিত্র ভাষাতেই বিদ্রুপ করল ‘ভিতু’ বলে।

 মংটুর চোখ দুটো নিষ্ফল ক্রোধে জ্বলতে থাকলেও কোনো কথা বলতে সাহস করল না। আর সকলে চিত্রার্পিতের মতই দাঁড়িয়ে রইল।

অসীমা একবার অবজ্ঞার দৃষ্টিটা সকলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিয়ে, অশোকের একখানা হাত চেপে ধরল। ডাকল, ‘চলে এস।’

পা বাড়াল অশোক। সঙ্গে সঙ্গে বাঘের থাবার মতোই মংটুর হাত একখানা তার অপর কাঁধটা চেপে ধরল। হিংস্রকণ্ঠে সে বলল, ‘টেহু ছে।’

চকিতে ঘুরে দাঁড়াল অসীমা। হুকুমের ভঙ্গিতে বলল, ‘ছেড়ে দাও।’

মাথা নাড়ল মংটু। মিশ্রিত ভাষায় জানাল, ‘না…হুকু, পারিয়া।’

জ্বলে উঠল অসীমার চোখ দুটো। কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘আর আমি পারিয়ার মেয়ে নই? আমার হুকুম, ছেড়ে দাও।’

তবু মংটু তার মুঠি শিথিল করল না। একগুঁয়ে ছেলের মতোই জবাব দিল, ‘না মালি…না মালি…’

চিৎকার করে উঠল অসীমা, ‘পারবে না?’

জ্বালাভরা চোখে নিজের ছোরাখানা দিয়ে হয়তো সে মংটুকে আঘাতই করে বসত; কিন্তু তার আগেই প্রফেসার রায়ের গুরু গম্ভীর ডাক এল, ‘অসীমা!’

চকিতে ফিরে দাঁড়াল অসীমা। হাতের ছোরাখানা নামিয়ে নিয়ে অব্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বাবা!’

এগিয়ে এলেন প্রফেসার রায়। মেয়ের কাঁধে একখানা হাত রেখে স্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘মংটুর ওপর মিথ্যেই রাগ করছিস, মা। ও আমার হুকুমটুকুই শুধু পালন করছে।’

অসীমা দু—চোখে অপার বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করল, ‘তুমি ওকে খুন করতে বলেছ?’

‘না, ধরে নিয়ে যেতে। তবে পালাবার চেষ্টা করলে, পাওনাটুকু নিতে হবে বৈকি।’

তবু অসীমার বিস্ময় ঘোচে না। ‘কিন্তু পালাবে কেন?’ তুমি কি ভিতু? এবার প্রশ্নটা সে সোজাসুজি অশোককেই করে, কিন্তু অশোক কোনো জবাব দেবার আগেই প্রফেসার রায় কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভিতু। ওরা সবাই খরগোশের মতোই ভিতু। সভ্যতার মুখোশ যেদিন থেকে পরেছে, সাহস হারিয়েছে সেইদিন থেকেই।’

কথাটার ভেতর কোনো সত্য হয়তো থাকতে পারে; কিন্তু অশোক ভেবে পায় না সভ্যতার ওপর বৃদ্ধের এতখানি রাগ কেন।

অসীমা সরে এল বাপের কাছে। আদরের ভঙ্গিতে বলল, ‘ওকে আমায় দেবে?’

প্রফেসার রায় তীব্র কণ্ঠেই প্রতিবাদ করলেন, ‘নিয়ে খেলা করার মতো প্রাণী ওরা নয়, মা। তাছাড়া ওকে আমার বড় দরকার যে।’

‘কি করবে?’

‘খেলা।’ কথা শেষে হা—হা করে হেসে উঠলেন, প্রফেসার রায়। সে হাসি থেকে ঝরে পড়তে লাগল অকথ্য ঘৃণা আর তীব্র শ্লেষ।

অশোক বিহ্বল দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রফেসার রায় অশোকের একখানা হাত চেপে ধরে বললেন, ‘এস।’

এক—পা এগিয়ে এসে অসীমা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাকল, ‘বাবা!’

প্রফেসার রায় হাসলেন। ধীর, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আর কোনো কথা নয় মা। আজ শুধু আনন্দ, শুধু উৎসব।’

অশোকের হাত ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। যেতে যেতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘ভেনে টিলা।’

সঙ্গে সঙ্গে উদ্দাম হয়ে উঠল কাড়া—নাকড়ার বাজনা। নতুন করেই শুরু করল তারা নাচ— গান।

অসীমা কতক্ষণ তাকিয়ে রইল অপসৃয়মান মূর্তি দুটির দিকে। তারপর একসময় ফিরতেই নজরে পড়ল, মংটুর হাত দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছে। মমতায় কোমল হয়ে উঠল তার মুখখানা। নিজের শাড়ি ছিঁড়ে মংটুর ক্ষতস্থানটা বেঁধে দিতে লাগল।

কৃতজ্ঞতায়, আবেগে মংটু থরথর করে কাঁপতে লাগল। এতখানি অনুগ্রহ বোধ করি সে প্রভু—কন্যার কাছ থেকে আশা করেনি। বাঁধা শেষ হতেই সে লুটিয়ে পড়ল অসীমার পায়ের গোড়ায়। প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই বারবার চুম্বন করতে লাগল তার পায়ের পাতা দুটো।

আনন্দে উল্লাসে উন্মত্ত প্রায় হয়ে উঠল উৎসবমত্ত নরনারীর দল।

।। পাঁচ।।

কাঠ—দিয়ে—ছাওয়া মাটির দেওয়ালের মন্দির। দেওয়ালের গায়ে বিচিত্র সব জন্তুর আকৃতি খোদাই করা—বাঘের মাথায় বাঁকানো শিং, ষাঁড়ের গালে লম্বা দাড়ি ইত্যাদি।

অনতিপ্রশস্ত বারান্দার একদিকে বৃহদাকৃতির একটা দামামা টাঙানো। বন্ধ দরজার দু—দিকে দুটো মশাল জ্বলছে। তাদেরই আলোয় বড় বেশি চকচক করছিল চত্বরে পোঁতা হাড়কাঠটা। একটু আগেই বোধ হয় বলি হয়ে গেছে। তখনো তাজা রক্তে আশপাশের মাটি ভিজে।

সেদিকে নজর পড়তেই অশোক শিউরে উঠল। প্রফেসার রায় যে তাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তার ছিল না। জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পায়নি; কিন্তু এখন এক অজ্ঞাত ভয় যেন তাকে গ্রাস করে বসল। একটি পা—ও সে আর নড়তে পারল না।

প্রফেসার রায় বুঝলেন তার মনের ভাবটা। কৌতুকের সুরে বললেন, ‘মন্দিরে হাড়কাঠ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক…’

ধরা গলায় অশোক কোনোরকমে উচ্চারণ করল, ‘কিন্তু আমায় এখানে নিয়ে এলেন কেন?’

হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়। ‘ভয় নেই, তোমায় বলি দোব না।’

এটা মিথ্যে সান্ত্বনা কিনা, ঠিক বুঝল না অশোক, তবু কতকটা স্বস্তি যেন বোধ করে। তাঁর পেছন পেছন গিয়ে মন্দিরের বারান্দায় উঠল। এবার ভয় নয়, আশঙ্কা নয়; শুধু বিস্ময়ের পালা।

থমকে দাঁড়াল সে বিচিত্র গড়নের মূর্তিগুলোর ওপর চোখ পড়তেই। ভাস্কর সে নয়, স্থাপত্য—শিল্প সম্বন্ধেও বিশেষ জ্ঞান তার নেই; তবু মূর্তিগুলোর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজকের দিনে এমন হাস্যকর কল্পনার কারণটা বোধ করি আবিষ্কার করবার চেষ্টা করে।

প্রফেসার রায়ও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কৌতুকের সুরে প্রশ্ন করেন, ‘কি দেখছ?’

মুখ না ফিরিয়েই অশোক অর্ধস্বগত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘অদ্ভুত সব মূর্তি…’

বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে প্রফেসার রায়ের ঠোঁটের কোণে। বলেন, ‘তাই নাকি? আর কখনো দেখনি?’

ফিরে তাকায় অশোক। মাথা নেড়ে আবিষ্টের ভঙ্গিতে জবাব দেয়, ‘না, কখনো না…’

প্রফেসার রায়ের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে। চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গর্জন করে ওঠেন, ‘অন্ধ তুমি। তোমাদের সভ্য সমাজে সদাসর্বদাই এসব জীব ঘুরে বেড়ায়। চোখ নেই, তাই চিনতে পারো না।’ এগিয়ে এলেন তিনি বাঁকানো শিংওলা বাঘের মূর্তির সামনে। আঙুল বাড়িয়ে তীব্র কণ্ঠে বললেন, ‘দেখনি এরকম জীবকে—সমাজে যাঁরা নর—শার্দূল সেজে থাকেন? নখ আছে, দাঁত আছে, গর্জনও আছে; নেই শুধু শক্তি আর সাহস। তাই তাঁরা শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন না; হরিণের মতোই লুকিয়ে পরের খেতের ফসল খেয়ে বেড়ান।’

অশোক বিহ্বলের মতোই তাকিয়ে রইল।

প্রফেসার রায় সরে এসে লম্বা দাড়িবিশিষ্ট ষাঁড়ের মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন। তেমনই ভঙ্গিতে বলে চললেন, ‘আর এই হচ্ছে তোমাদের আকৃতি ষাঁড়ের, প্রকৃতি ছাগলের। লাল রং দেখলে তেড়ে আসে; কিন্তু বুদ্ধির বেলায় শুধু দাড়িই চুমরোয়…’

হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি। বিকৃত প্রতিহিংসার হাসি। তার শব্দে গভীর রাতের প্রগাঢ় স্তব্ধতা কাচের মতোই যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। অদূরের গাছ থেকে ভয় পেয়ে কর্কশ সুরে ডেকে উঠল। নিশাচর একটা পাখি।

অশোকের হাত—পাগুলো কেমন যেন শিরশির করতে লাগল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘অদ্ভুত কল্পনা আপনার।’

‘কল্পনা!’ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন প্রফেসার রায়। সরে গিয়ে দাঁড়ালেন নৃসিংহ মূর্তিটার সামনে। লেজে পা দেওয়া সাপের মতোই, হিসহিস করে উঠলেন, ‘এই যে নরপশু, এ কি শুধু মিশরী শিল্পীর ধ্যানেই ধরা দিয়েছে বলতে চাও? না, না, শিল্পী এদের প্রতিনিয়ত চোখে দেখেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন এদের বীভৎস হিংস্র রূপ—যেমন করেছি আমি।’

অশোক কি একটা বলতে গেল; কিন্তু তার আগেই মন্দিরের বন্ধ দরজাটা সজোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললেন তিনি। আদেশের সুরে বললেন, ‘এসো।’

প্রায় অশক্ত পা দুটো টানতে টানতে অশোক ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সামনেই বৃহদাকার এক বিগ্রহ। আকৃতি অনেকটা গ্রিক দেবতা ‘জুপিটারের মতো। কিন্তু কল্পনায় হিন্দু পুরাণে বর্ণিত নৃসিংহ মূর্তির প্রভাব। ‘বাঘের নখ’ জাতীয় অস্ত্র দিয়ে এক অসহায় মানুষের অন্ত্রদেশ টেনে ছিঁড়ছেন তিনি।

অশোক আর একটি পা—ও নড়তে পারে না। হোক মাটির গড়া মূর্তি, তবু তার মনে হল নির্যাতিত এক মানুষের করুণ আর্তনাদ যেন মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরছে। নিজের অজ্ঞাতসারেই সে বলে উঠল, ‘কি ভয়ানক!’

আর এক দফা হা হা করে হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়। বললেন, ‘সত্যের নগ্নরূপ চিরদিনই ভয়ঙ্কর।’ তারপরই তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন বিগ্রহের পাশেই যে অন্ধকার সুড়ঙ্গটা ছিল, তারই ভেতর দিয়ে।

অশোকের মনে হল এ—অন্ধকার বুঝি বুকে চেপে বসবে। দৃষ্টি এখানে নিরর্থক। চলতে গেলে পা দিয়ে কালির সমুদ্র মেপে মেপেই চলতে হবে—যেমন ভাবে নাবিকরা জল মাপতে মাপতে স্টিমারকে নিয়ে যায়। কোথায়, কখন এ চলার শেষ হবে, কে জানে?

অকস্মাৎ অন্ধকারের ভেতর থেকে এক অশরীরী প্রেতাত্মা যেন হি—হি করে হেসে উঠল।

অশোক সভয়ে প্রফেসার রায়ের হাতখানা চেপে ধরে আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, ‘কে ও?’

‘মন্দিরের পুরোহিত।’

আর একটা বাঁক ঘুরে প্রফেসার রায় উঁচু গলায় ডাকলেন, ‘পীতাম্বর!’

কোন এক অজ্ঞাত কোণ থেকে মশাল হাতে বেরিয়ে এল এক কদাকার বামন মূর্তি। দেহের কোনো অঙ্গের সঙ্গেই তার কোনো অঙ্গের সামঞ্জস্য নেই। আকর্ণ বিস্তৃত হাঁ। তারই ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছিল অসমান দাঁতগুলো। উল্লাসে চোখ দুটো নাচাতে নাচাতে, সে খনখনে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘এসেছে? এসেছে?’ তারপরই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল অশোকের ওপর।

সভয়ে দু—পা পেছিয়ে গেল অশোক। মনে হল শিকারি জন্তুর মতোই এখনি বুঝি লোকটা ওর নখওলা থাবাটা বসিয়ে দেবে তার দেহে।

প্রফেসার রায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম দেখছ?’

পুরোহিত অশোকের চারদিকে ঘুরে নাচতে নাচতে জবাব দিল, ‘চলবে—চলবে। খাসা বলি।’

আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে অশোকের হৃদপিণ্ডের গতিটা যেন বন্ধ হয়ে গেল।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল পুরোহিত পীতাম্বর। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘ভগবান ওরেঙ্গার কৃপা।’

প্রফেসার রায় এবার আদেশ দিলেন, ‘দরজাটা খোল।’

পীতাম্বর ছুটে গেল কোণের দিকে। লোহার যে কড়াটা ছিল, সেটা ধরে সজোরে পাশের দিকে টানতেই ভারী দরজা একটা বিকট শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে দেখা গেল গুহার মতোই রন্ধ্রপথ একটা।

অশোককে নিয়ে সেদিকে যেতে যেতে প্রফেসার রায় পীতাম্বরের উদ্দেশে বললেন, ‘কালকের ভেতরই সব ব্যবস্থা চাই।’

‘যে আজ্ঞে’ বলে পীতাম্বর বাইরে থেকে দরজাটা আবার সশব্দে টেনে বন্ধ করে দিল।

অশোক বুঝি এবার পাগল হয়ে যাবে। প্রতি পদে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন ভয়, নতুন চমক।

এক রাত্রে মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে!

তবু প্রফেসার রায়ের পেছন পেছন ঈষৎ ঢালু পথ বেয়ে নামতেই হয়। যে অংশে এর আগে তাকে আটকে রাখা ছিল, তার সঙ্গে এর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। শুধু দু—দিকে খাঁজকাটা কুলুঙ্গির পরিবর্তে ছোট ছোট ঘর।

বহু দূরে ছাদ থেকে বাতি ঝুলছিল একটা। তারই ক্ষীণ শিখায় সৃষ্টি হয়েছিল আলো— আঁধারির এক কুহক জাল। চোখের সামনে ধরা দেয় যতটা, লুকোনো থাকে বুঝি তার চেয়ে অনেক বেশি।

নামতে নামতে প্রফেসার রায় হুঁশিয়ার করে দিলেন, ‘সাবধানে এসো।’—

এত দুঃখের ভেতরও হাসি পেলো অশোকের। সাবধানে না গিয়ে যেন গত্যন্তর আছে।

পা টিপে টিপে এগোতে লাগল সে। কতটুকুই বা গেছে; এই সময় পেছন থেকে একখানা প্রকাণ্ড রোমশ হাত তার ঘাড়টা চেপে ধরল।

চিৎকার করে উঠে অশোক চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, পাশের ঘরের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে বীভৎস এক প্রাণী। প্রথম দৃষ্টিতে গরিলা বলেই মনে হয়।

অশোককে দাঁত খিঁচিয়ে মানুষের স্বরেই সে বলে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

অশোক কথাও বলতে পারে না, চোখও ফেরাতে পারে না। গরিলা—মানুষটি এবার ফিসফিস করে বলল, ‘পালাও—পালাও।’

হয়তো অশোকের আর্তনাদটা প্রফেসার রায়ের কানে গিয়ে থাকবে। ফিরে, তিনি তাদের দিকেই এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও, লিমপু।’

লিমপু আবার সেই রকম দাঁত খিঁচোল। চতুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আগে বল, আমাকে কবে ছেড়ে দেবে?’

কঠিন কণ্ঠে প্রফেসার রায় বলে উঠলেন, ‘এক কথা আর কতবার বলব? যেদিন সময় হবে।’

লিমপু জেদি ছেলের মতোই বাহানা ধরে, ‘না, আজই।’

হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন প্রফেসার রায়, ‘লিমপু!’

‘না—না—বল, নইলে আমি ছাড়ব না। কত বছর কেটে গেল। আমি আর পারছি না…’

কথা তার শেষ হবার আগেই প্রফেসার রায় বিচিত্র গড়নের একটা অস্ত্র পকেট থেকে বার করে লিমপুর বাহুমূলে আঘাত করলেন। অশোকের মনে হল সেটা তড়িৎ শক্তি সম্পন্ন; নইলে লিমপুর মত দীর্ঘাকার প্রাণীটা আর্তনাদ করে উঠে তাকে ছেড়ে দেবে কেন? প্রাণভয়ে ঘরের শেষতম প্রান্তে গিয়েই বা আত্মগোপন করবে কেন?

প্রফেসার রায় সজোরে তার হাত একখানা চেপে ধরে বললেন, ‘আর দাঁড়িয়ে থেকো না, চলে এসো।’

যেতে যেতে বিস্ময়াহত অশোক প্রশ্ন না করে পারে না, কে ও? মানুষ, না জন্তু?’

‘মানুষের দেহ; কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি সব পশুর।’

দাঁড়িয়ে পড়ে অশোক। অবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠে, ‘কি বলছেন আপনি? কি করে তা সম্ভব?’

হাসলেন প্রফেসার রায়। গর্বের সুরেই জবাব দেন, ‘বিজ্ঞানের কল্যাণে।’

‘বিজ্ঞান!’ তবুও যেন বিশ্বাস করতে পারে না অশোক।

প্রফেসার রায়ের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। শ্লেষের সুরে বললেন, ‘হ্যাঁ, বিজ্ঞান—যা নিয়ে তোমাদের সভ্যজগতের আজ গর্বের অন্ত নেই।’

আবার চলতে লাগলেন তাঁরা। আর একটা ঘর অতিক্রম করার সময় ভেতর থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, ‘এই যে! আপনার জন্যেই বসে আছি।’

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতোই অশোক ফিরে তাকাল। দেখল, ঘরের মেঝেয় মোটা শুকনো ডাল একটা পোঁতা। তার ওপর বসে আছে বৃহদাকৃতির বানর একটা। অশোককে তাকাতে দেখে সে হাসল। প্রায় অন্ধকারের ভেতরও তার সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। ডাল থেকে নেমে পড়ে, সে সদ্য—চলতে—শেখা শিশুর মতোই টলতে টলতে এগিয়ে এল প্রফেসার রায়ের দিকে। চতুর কণ্ঠে বলল, ‘শুনুন—শুনুন।’

প্রফেসার রায় এগিয়ে গেলেন। হাসি মুখে বললেন, ‘খুব দরকারি কথা বলে মনে হচ্ছে।’

মুখখানা গরাদের ওপর চেপে ধরে বানরটা ফিস ফিস করে বলল, ‘ওকে বিশ্বাস করবেন না।’ রোমশ হাতখানা বাড়িয়ে অশোককে সে দেখিয়ে দিল।

বিস্ময়াতিশয্যে অশোকের চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। প্রফেসার কিন্তু কৌতুক বোধ করেন। বলেন, ‘কেন বল তো?’

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিটা একবার অশোকের ওপর বুলিয়ে নিয়ে, বানরটা গম্ভীর মুখে বলল, ‘লোকটা খুন করতে পারে।’

‘তাই নাকি?’

প্রসন্ন হল না বানরটা। মানুষের ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আপনার ভালোর জন্যেই বলছি।’

হাসলেন প্রফেসার রায়। বললেন, ‘ধন্যবাদ!’

অশোককে নিয়ে তিনি চলতে শুরু করতেই বানরটা আবার ডাকল, ‘শুনুন!’

ফিরে প্রফেসার রায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বানরটা মুরুব্বিয়ানা চালে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে ভোট দিচ্ছেন?’

‘ভোট?’ প্রফেসার রায়ও এবার সত্যি সত্যিই বিস্মিত হলেন। কি একটা মনে হতেই চকচক করে উঠল চোখের মণি দুটো।

বানরটা ফিস ফিস করে কি যেন বলল।

অশোক শুনতে পেলো না, তবে ভয়ের বদলে ধীরে ধীরে তার চোখে কৌতুকের দৃষ্টি ফুটে ওঠে।

বানরটি এবার অপেক্ষাকৃত উঁচু গলাতেই বলল, ‘আর কাউকে বলবেন না যেন। আমাদেরও কিছু হওয়া চাই তো, বুঝলেন না?’ চোখ ছোট করে ধূর্তামির একটা ইঙ্গিত করল সে।

তার ভঙ্গি দেখে অশোক হেসে ফেলে। প্রফেসার রায় কিন্তু মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ‘বুঝেছি বৈকি। তাই হবে।’

যাবার জন্যে তিনি পা বাড়াতেই বানরটা আবার ডাকল, ‘আর একটা কথা…’

প্রফেসার রায় ফিরে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘না, আর নয়…’

সঙ্গে সঙ্গে বানরটার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘কবে আমার বিয়ে দিচ্ছেন?’

‘দোব—দোব…ব্যস্ত কেন?’

‘রোজই তো আপনি ওই কথাই বলেন; কিন্তু বিরহের জ্বালা আমি যে আর সইতে পারছি না…’ অভিমানী ছোট ছেলের মতোই সে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

হা হা করে হেসে উঠল অশোক। হোক অবিশ্বাস্য, তবু বানরটার প্রতিটি ভঙ্গি যেন সর্বাঙ্গে সুড়সুড়ি দেয়।

প্রফেসার রায় ভ্রুকুটি করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘নীল!’

বানরটি এবার ক্ষিপ্তের মতোই চিৎকার করে উঠল, ‘ভাবছেন আপনার মতলব আমি বুঝিনি? ওই লোকটার সঙ্গে আপনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান। আমি কিন্তু তাহলে ওকে খুন করব। গলায় দড়ি দিয়ে মরব।’

ছুটতে ছুটতে গিয়ে সে আবার উঁচু ডালে চড়ে বসল।

অশোক একদৃষ্টে তখনো তাকিয়ে। প্রফেসার রায় তার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই হচ্ছে মানুষের আসল রূপ। হিংসা…অবিশ্বাস…লোভ…’

অশোক যেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। জেগে উঠে, জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কি মানুষ?’

শ্লেষের সুরে প্রফেসার রায় জবাব দিলেন, ‘এখন তাই বটে।’

‘এখন তাই! তার মানে এর আগে কি ও…’

চলতে চলতে প্রফেসার রায় বাকিটুকু পূরণ করলেন, ‘ঠিক আর দশটার মতোই সাধারণ বানর ছিল।’

বিশ্বাস করতে পারে না অশোক। স্বতই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘অসম্ভব!’

চকিতে ফিরে তাকালেন প্রফেসার রায়। চোখ দুটো তাঁর অগ্নিপিণ্ডের মতোই জ্বলছিল। আহত জন্তুর মতই তিনি গর্জন করে উঠলেন, ‘অসম্ভব? পশু যে, সে কি করে পাবে মানুষের ভাষা, মানুষের বুদ্ধি?’ থামলেন তিনি। পরক্ষণে গর্বের হাসি হেসে আবার যোগ করলেন, ‘আমি দিয়েছি ওকে।’

‘আপনি?’ অভিভূত অশোক প্রায় চিৎকার করে ওঠে।

‘হ্যাঁ, আমি। তোমাদের সভ্যজগতের কোনো বিধাতা আছেন কিনা জানি না; কিন্তু এ জঙ্গলের বিধাতা আমি।’ কথা শেষে আত্মশ্লাঘার হাসি হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়।

আত্মশ্লাঘা লোকটি করতে পারেন বটে—অন্তত অশোকের তাই মনে হল প্রফেসার রায়ের রসায়নাগারে পা দিয়ে। সুন্দরবনের এক নিভৃত প্রান্তে, মাটির গর্ভে এমন সুসজ্জিত রসায়নাগার যে থাকতে পারে, না দেখলে কোনোদিনই সে বিশ্বাস করতে পারত না। বৈজ্ঞানিক গবেষণার আধুনিকতম যন্ত্রপাতিও যেমন আছে, তেমনি আছে শল্যচিকিৎসার হাজার রকমের উপকরণ।

অশোক চোখ ফেরাতে পারে না।

প্রফেসার রায় বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘কি, অবাক হয়ে যাচ্ছ?’

‘সত্যিই তাই।’ অশোক অকপটে স্বীকার করে, ‘এই গভীর জঙ্গলে এমন সর্বাঙ্গসুন্দর লেবরেটরি যে থাকতে পারে…’

‘তিলে তিলে এ—স্বর্গ রচনা করেছি আমি। এখানে বসে তোমাদের বিধাতাকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করেছি।’

দ্বন্দ্বে! প্রফেসার রায় আবার যেন হেঁয়ালি হয়ে উঠতে লাগলেন। অশোক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল।

প্রফেসার রায় সেটা লক্ষ করে রুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছ না? লিমপুকে দেখেও বুঝতে পারোনি কিছু? গরিলা মানুষ তোমাদের বিধাতা সৃষ্টি করেননি, করেছি আমি। বানরের মুখে দিয়েছি মানুষের ভাষা, তার মস্তিষ্কে দিয়েছি মানুষের শয়তানি—’

তবু যেন স্বীকার করে নিতে মন সায় দেয় না; তাই অবরুদ্ধ কণ্ঠে অশোক প্রশ্ন করে, ‘কী করে তা সম্ভব হতে পারে?’

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ঠোঁট কুঞ্চিত করে প্রফেসার রায় জবাব দিলেন, ‘সামান্য একটা অস্ত্রোপচার, গোটাকয়েক গ্লান্ডের অদলবদল। ফলে এমন সব জীব সৃষ্টি হল, যারা শক্তিতে, সাহসে, ক্ষমতায় তোমার বিধাতার সৃষ্টিকেও ছাপিয়ে যাবে…’

অশোক শিউরে উঠল। প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘কি লাভ হবে তাতে? কি চান আপনি?’

‘প্রতিশোধ।’ বিকৃতকণ্ঠে উচ্চ হাসি হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়।

অদ্ভুত এক হিমপ্রবাহ অশোকের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন নামতে থাকে। দেহের প্রতিটি রোম খাড়া হয়ে ওঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে ফেলে, ‘আপনি মানুষ নন, শয়তান!’

টেবলের ওপর রাখা বড় বড় কাচের জারগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন প্রফেসার রায়। অশোকের কথাটা কানে যেতেই চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন।

দু—চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরুচ্ছিল যেন। দাঁতে দাঁত ঘষে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, শয়তান। কিন্তু কেন? কে আমায় শয়তান করে তুলেছে? একদিন দেবতা হতেই তো চেয়েছিলুম; কিন্তু তোমাদের সমাজ, তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের আইনই আমায় তা হতে দেয়নি। বাধ্য করেছে আমায় এই জঙ্গলে এসে আত্মগোপন করে থাকতে।’ আরও হয়তো অনেক কিছুই তিনি বলতেন; কিন্তু তার আগেই কোনো এক প্রান্ত থেকে ভেসে এল লোহার শেকলের ঝনঝনানি শব্দ; সেই সঙ্গে জান্তব কণ্ঠের তীক্ষ্ন চিৎকার, ‘আ—আ—লি—ই—ই— ছা—ছা…’

সে চিৎকার অশোকের সর্বাঙ্গ যেন পঙ্গু করে দিল। ঝিমঝিম করতে লাগল তার মাথার ভেতর। ধরা গলায় বলল, ‘কে—কে ও?’

আবার রহস্যময় হয়ে ওঠেন প্রফেসার রায়। রুষ্ট ভঙ্গির বদলে মুখে দেখা দিল আত্মতৃপ্তির হাসি। অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আমার তিলোত্তমা।’ সেই প্রহেলিকা। অশোক যেন একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘দোহাই আপনার খুলে বলুন…’

‘তাই তো বলছি হে। তোমাদের বিধাতা শুনেছি তিলে তিলেই গড়ে তুলেছিলেন স্বর্গের অপ্সরাকে, আর আমি তিলে তিলে গড়ে তুলেছি…’

বাকিটুকু অসমাপ্ত রেখে তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন ঘরের শেষপ্রান্তে। দেওয়ালের মাঝখানে টাঙানো ছিল খুব পুরু কাপড়ের কালো পর্দা একখানা। পাশের দিকে যে আংটাটা ঝুলছিল, সেটা ধরে তিনি টানলেন। ধীরে ধীরে সরে গেল পর্দাখানা। ও পিঠে মোটা—মোটা লোহার গরাদ দেওয়া খাঁচা একটা। খাঁচার ভেতর ভারী লোহার শেকলে বাঁধা ছিল দৈত্যাকার একটি প্রাণী। রং তার নিকষ কালো, ছোট ছোট চোখগুলো রক্ত—লাল, অঙ্গ—প্রত্যঙ্গে অসীম শক্তির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

প্রাণীটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে প্রফেসার রায় অসমাপ্ত কথাটা শেষ করলেন,’একে।’

অশোকের কানে বুঝি তা গেল না। সে যেন এক রূপকথার রাজ্যে চলে গেছে। সেখানে সব কিছুই কাল্পনিক, সব কিছুই অবিশ্বাস্য।

হাত—পায়ে বাঁধা শেকলটায় আর একবার প্রচণ্ড টান দিয়ে প্রাণীটা তেমনই কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘আ—আ—লি—ই—ই—ছা—ছা…’

প্রফেসার রায় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। চোখে যেন তাঁর স্বপ্নের ঘোর লাগে। আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন তিনি, ‘গরিলার শক্তি, ভাল্লুকের সাহস, বাঘের হিংস্রতা—সব আছে; নেই শুধু মস্তিষ্ক।’

পর্দাটা আবার ফেলে দিয়ে, চোখ বুজে কি যেন ভাবতে লাগলেন তিনি। তারপর একসময় অশোকের দিকে ফিরে বললেন, ‘তারই জন্যে এতকাল অপেক্ষা করে আছি আমি। কিন্তু এবার…’

থামলেন তিনি; কিন্তু অশোকের মনে হল অতি অকস্মাৎই তার হৃদপিণ্ডটা গলা পর্যন্ত লাফিয়ে উঠেছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। কোনোরকমে সে উচ্চারণ করল, ‘এবার?’

প্রফেসার রায় স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সাপের মতই হিস হিস করে উঠলেন, ‘তুমি এমনিভাবে এসে পড়ে আমার যে কতখানি উপকার করেছ, অশোক সেন…’

‘কি বলতে চান আপনি?’

এক—পা এক—পা করে প্রফেসার রায় এগিয়ে এলেন তার দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে পরম নিশ্চিন্ততার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঠিক তোমার মতোই একজন সভ্য মানুষের প্রয়োজন ছিল আমার। সে প্রয়োজন আজ মিটবে তোমাকে দিয়ে।’

তাঁর বক্তব্যটা এতই সুস্পষ্ট যে অশোক ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, ‘না—না—এ কখনও সত্যি হতে পারে না। আপনি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন।’

গর্জন করে উঠলেন প্রফেসার রায়, ‘মিথ্যে ভয়?’

উপহাসের হাসি হেসে উঠে, তিনি কোণের দিকে রাখা কাচের আলমারিটার কাছে গেলেন। ভেতর থেকে বার করে নিলেন বৃহদাকারের সিরিঞ্জ একটা আর ‘অ্যাবসলিউট অ্যালকোহলে’র শিশিটা। পরম যত্নের সঙ্গে সিরিঞ্জের সূচটা তরল ওষুধে ডুবিয়ে পরিশ্রুত করে নিতে লাগলেন।

অশোক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল; আর সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি মতলব আপনার?’

‘এখনও বুঝতে পারছ না?’ ব্যঙ্গে প্রফেসার রায় ছুরির ফলার মতই যেন তীক্ষ্নধার হয়ে উঠলেন। বিচিত্র গড়নের একটা শিশি থেকে রঙিন ওষুধ সিরিঞ্জে টেনে নিতে নিতে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আবার বললেন, ‘তোমায় ঘুম পাড়ানো।’

তীক্ষ্ন কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে গেল অশোক; কিন্তু স্বর ফুটল না। শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল।

প্রফেসার রায় এগিয়ে আসতে লাগলেন অশোকের দিকে। ক্রমেই কাছে—আরও কাছে। অকস্মাৎ সে দু’হাত বাড়িয়ে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিল প্রফেসার রায়কে; তারপর অন্ধবেগে ছুটল দরজার দিকে।

কিন্তু মিথ্যা আশা তার। দরজা বাইরে থেকে কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে।

অশোক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার ওপর। পাগলের মতোই ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, ‘খুলে দিন—কে আছেন, দরজা খুলে দিন…যেতে দিন আমায়…’

পেছন থেকে ভেসে এল প্রফেসার রায়ের বিদ্রুপের হাসি।

অশোক বোঝে এ হাসির অর্থ। দরজা কোনো কারণেই আর খুলবে না; তবু বারবার ধাক্কা দেয় আর কাতর কণ্ঠে আবেদন জানায়।

প্রফেসার রায় সিরিঞ্জ হাতে তার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘কতক্ষণই বা লাগবে? এক মিনিট, তারপরই আর মুক্তি চাইবে না। গাঢ় ঘুমে চোখ তোমার বুজে আসবে…’

‘আপনি মানুষ নন—আপনি খুনী—পিশাচ!’ কথার সঙ্গে সঙ্গে মরীয়া হয়ে আর একবার সে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল প্রফেসার রায়কে। দাঁতে দাঁত ঘষে গর্জন করে উঠল, ‘ভাবছেন, আমায় এভাবে হত্যা করে নিষ্কৃতি পাবেন? দেশে পুলিশ নেই? আইন—আদালত নেই? যা খুশি, তাই করতে পারেন?’

‘হ্যাঁ, পারি।’ শান্ত কণ্ঠেই বললেন প্রফেসার রায়, ‘আর তারই জন্যে আজ বিশ বছর ধরে সাধনা আমার।’

সিরিঞ্জের সূচ অশোকের দেহে বিঁধিয়ে দেবার চেষ্টা করতেই অশোক এক—পা পেছিয়ে গেল। বলল, ‘দেবো না—যতক্ষণ জ্ঞান আছে, দেবো না—’

‘বাধা দিয়ে লাভ নেই, অশোক সেন। একবার যদি তিলোত্তমার শেকলটা খুলে দিই, তাহলে কপালে তোমার কি যে ঘটতে পারে…’

শেষ কথাগুলো তাঁর ডুবে গেল তিলোত্তমার সেই তীক্ষ্ন কণ্ঠের চিৎকারে। লোহার শেকলগুলো বেজে উঠল ঝনঝন করে।

অশোক চট করে ফিরে তাকাল। দেখল, জন্তুটা উল্লাসে নাচছে। দু—চোখ দিয়ে পৈশাচিক একটা আনন্দ যেন ঠিকরে পড়ছে।

সে দৃশ্য দেখে আত্মরক্ষার সমস্ত শক্তি যেন অশোক হারিয়ে ফেলে। হাত—পাগুলো তার শিথিল হয়ে আসে।

প্রফেসার রায় খুশি মুখে সিরিঞ্জের সূচটা বিঁধিয়ে দিলেন তার বাহুতে।

যন্ত্রণার একটা অস্ফুট ধ্বনি করে উঠল অশোক। হাত বাড়াল প্রফেসার রায়ের হাত থেকে সিরিঞ্জটা ছিনিয়ে নিতে; কিন্তু তার আগেই বিদ্যুৎ বেগে তিনি সরে দাঁড়ালেন।

অশোক চেষ্টা করল তাঁর দিকে এগিয়ে যাবার; কিন্তু মাথাটা যেন ঘুরে গেল। দেহটা মনে হল ভারি হয়ে উঠছে। না, টেনে নিয়ে এগিয়ে যাবার শক্তি তার নেই।

অসহায়, অশক্ত শিশুর মতোই সে বসে পড়ল একখানা চেয়ারে। ধীরে ধীরে চৈতন্য তার অবলুপ্ত হয়ে গেল ওষুধের ক্রিয়ায়।

পর্দার আড়াল থেকে গরাদ ধরে উল্লাসে নৃত্য করতে লাগল তিলোত্তমা—প্রফেসার রায়ের অপরূপ সৃষ্টি।

।। ছয়।।

সমুদ্রবক্ষে প্রসারিত বাহুর মতো সেই ভূমিখণ্ড—যেখানে নৌকোডুবির পর অশোক একদিন আশ্রয় পেয়েছিল। তবে পরিবেশ আজ ভিন্ন। নিস্তরঙ্গ বালির সমুদ্র বার বার যেন সচকিত হয়ে উঠছে রেবার কলকণ্ঠের গুনগুনানিতে আর খিলখিল হাসির জলতরঙ্গে।

মরুভূমির মাঝে ওয়েসিসের মতো ছায়াশীতল যে সবুজ জায়গাটুকু ছিল, সেখানেই হয়েছে ছোটখাটো একটা পিকনিকের আয়োজন।

সদ্য—তৈরি উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে রেবা মাংস সেদ্ধ করছে। পাশেই বসে আগম দত্ত একরাশ পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে। চোখ দিয়ে তার অঝোরে জল ঝরছে—হয়তো পেঁয়াজের ঝাঁঝেই; কিন্তু বার বার রেবা তাকে সস্নেহ তিরস্কার করছে, ‘আবার কাঁদছেন? দেখছেন তো, বাবা সব কাজ ফেলে আপনার বন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বেঁচে যদি তিনি থাকেন, তাহলে সন্ধান তাঁর পাবই।’

আগম দত্ত গোপনে চোখের জল মুছে ফেলে। জবাবদিহি করে, ‘বাঃ! কাঁদব কেন? একজন গেছে, আর একজনের আশাও তো ছেড়ে দিয়েছি। দেখলেন তো, বলতেই আমি পিকনিকে রাজি হয়ে গেলুম। চোখের এ জল বন্ধুর জন্যে শোকের নয়; পেঁয়াজের ঝাঁঝের।’

তার বলার ভঙ্গিতে রেবা খিলখিল করে হেসে ওঠে।

একটা গাছের ছায়ায় ক্যানভাসের আরাম কেদারায় বসে বসে হেমন্তকুমার বই পড়ছিলেন। মেয়ের হাসির শব্দে বই নামিয়ে ফিরে তাকালেন। মনটা তাঁর বিশেষ প্রসন্ন ছিল না। কে এক অশোক সেনের সন্ধান করতে সুন্দরবনের বিশাল এলাকায় অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লোকটা বেঁচে আছে কি মারা গেছে—তাই বা কে জানে?

হাতের বইখানা পাশে রেখে, তিনি উঠে মেয়ের কাছে এলেন। ভারী গলায় বললেন, ‘পিকনিকটা একটু তাড়াতাড়ি কিন্তু শেষ করে ফেলতে হবে, মা। ঠিক বারোটায় আমি লঞ্চ ছাড়ব।’

অবাক হয় রেবা। জ্বলন্ত উনুনে আর চারটি শুকনো ডালপালা গুঁজে দিতে দিতে বলে, ‘সেকি! এখনো যে অশোকবাবুর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না…’

‘তাই বলে আমি আর কতকাল বনজঙ্গল হাতড়ে বেড়াব, রেবা? আমারও তো কাজকর্ম আছে।’

‘নিরুর্দিষ্ট লোকটাকে খুঁজে বার করাও কি তোমার কাজ নয়, বাবা?’

‘বেঁচে থাকলে অবশ্য কর্তব্য; কিন্তু সেটাই তো সঠিক ভাবে জানা যাচ্ছে না। ওপরে তো আমায় এর জন্যে কৈফিয়ত দিতে হবে…।’ ধীরে ধীরে মেয়ের সামনে থেকে সরে গেলেন তিনি।

রেবা কতক্ষণ আগুনের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। হঠাৎ একসময় কান্না চাপার অস্পষ্ট শব্দটা কানে আসতেই ফিরে তাকাল। দেখল, হাতের কাজ বন্ধ রেখে আগম দত্ত ছেলেমানুষের মতোই ফোঁপাচ্ছে।

মাংসটা সেদ্ধ হতে দেরি আছে কিনা একবার দেখে নিয়ে, রেবা উঠে এল তার কাছে। মৃদু তিরস্কারের সুরে বলল, ‘এই না বললেন পেঁয়াজ ছাড়াতে গিয়ে চোখের জল পড়ছে; ছি, ছি! আশপাশে চাকর—বাকররা রয়েছে। তারা দেখলেই বা ভাববে কি?’

অশ্রুবিকৃত কণ্ঠটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে তোলবার চেষ্টা করে, আগম দত্ত করুণ কণ্ঠে বলল, ‘দোহাই আপনার, পুলিশ সাহেবকে একটু বুঝিয়ে বলুন যাতে আর দুটো দিন দেরি করেন। আমার মন বলছে অশোক বেঁচেই আছে। তাকে খুঁজে পাবই আমরা।’

রেবা মুখখানা গম্ভীর করে বলল, ‘মন বলে পদার্থটা আমাদেরও আছে; কাজেই ও নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।’ ছাড়ানো পেঁয়াজগুলো তুলে নিয়ে সে আবার হুকুমের ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি যান দিকিনি, হরি কি রাম—কাউকে চারটি কাঠ দিতে বলুন গিয়ে, নইলে উনুন নিভে যাবে…’

একটা নতুন কাজের ভার পেয়ে আগম দত্ত যেন কৃতার্থ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলে, ‘আমিই যাচ্ছি। এক্ষুনি ওই ঝোপটা থেকে শুকনো ডালপালা ভেঙে নিয়ে আসছি।’

দস্তুরমতো ছুটতে ছুটতেই সে ঝোপটার কাছে এল। এ সেই ঝোপ, যার আড়ালে বসে সেদিন বৃহদাকারের কুমিরটা অশোকের সংজ্ঞাহীন দেহটার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়েছিল।

আগম দত্ত বেছে বেছে শুকনো ডালপালাগুলো পটপট করে ভাঙতে লাগল। জমা করতে লাগল বিশেষ এক জায়গায়। একটু আগের কথাবার্তাগুলো ভোলবার জন্যেই যেন উৎসাহটা তার অত্যুগ্র হয়ে ওঠে। সামনের গাছগুলো থেকে সংগ্রহ শেষ হলেই এগিয়ে যায় পাশের দিকে; সেখান থেকে আবার অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে।

এমনি ভাবে একটা ঝোপ বেষ্টন করে ঘুরতে গিয়েই, তার চোখ পড়ে গেল কাঁটা গাছের ডালে আটকানো এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়ের ওপর। হাওয়ায় দুলতে দুলতে টুকরোটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।

এগিয়ে গেল আগম দত্ত এবং গিয়ে পাড়ের দিকে তাকাতেই ভীষণ ভাবে চমকে উঠল সে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো হল। না, ভুল তার হয়নি। এ পাড় সে চেনে। নৌকোডুবির দিন এই কাপড়খানাই অশোকের পরনে ছিল। এখানে কি করে এল? তবে কি…

কাঁপা হাতে কোনো রকমে কাপড়ের টুকরোটা ডাল থেকে খুলে নিয়েই সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ডাকতে চেষ্টা করল রেবাকে; কিন্তু উত্তেজিত কণ্ঠ দিয়ে ঘড়ঘড়ে একটা অবাস্তব শব্দ বেরিয়ে এল।

তার অবস্থা দেখে বিস্মিত রেবা জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে আগমবাবু?’

কাপড়ের টুকরোটা বিজয় পতাকার মতোই শূন্যে দোলাতে দোলাতে আগম দত্ত অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘এই দেখুন রেবাদি—এই দেখুন…’

‘কি ওটা? আপনি ওরকমই বা করছেন কেন?’

গলা ছেড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আগম দত্ত।

বিব্রত বোধ করে রেবা। সত্যিই কি লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল! গাছতলার দিকে তাকিয়ে সে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘বাবা! বাবা!’

হেমন্তকুমার ছুটতে ছুটতে মেয়ের কাছে এলেন। আগম দত্তের দিকে নজর পড়তেই রীতিমতো রুষ্ট হলেন তিনি। ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘কি হল হে? হঠাৎ মড়াকান্না শুরু করলে কেন?’

আগম দত্ত শূন্যে কাপড়ের টুকরোটা দোলাতে দোলাতে জবাব দেবার চেষ্টা করে; কিন্তু নতুন করে কান্নার বেগ এসে তার স্বর রোধ করে দেয়।

রেবা নতজানু হয়ে তার পাশে বসে পড়ে, জিজ্ঞেস করে, ‘ভয় পেয়েছেন?’

আগম দত্ত মাথা নাড়ে, কিন্তু কান্না তার বন্ধ হয় না।

হেমন্তকুমার অসহিষ্ণু ভাবে মাটিতে পা ঠুকে, হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘তবে?’

আগম দত্ত করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে, কিছু একটা বলবার চেষ্টা করে। শব্দ যেটা বেরোয়, তাতে আরও দুর্বোধ্য করে তোলে তাকে।

হরি আর রাম অনতিদূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা প্রাজ্ঞের মতো মন্তব্য করল, ‘আজ্ঞে, বাঘ—টাঘ দেখে তাহলে…’

আগম দত্ত নিজেকে বোধ করি কতকটা সামলেছিল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ফোঁস করে উঠল, ‘তোমাদের মাথা! বাঘ দেখে আমি ছুটতে ছুটতে আসব?’

রেবা হাসি গোপন করে বলল, ‘তা তো বটেই। তাহলে ছুটতে ছুটতে এলেনই বা কেন, আর হাউ হাউ করে কাঁদছিলেনই বা কি দুঃখে?’

আর একবার কাপড়ের টুকরোটা শূন্যে দোলাতে দোলাতে আগম দত্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘এই কাপড়—কাপড়—ছেঁড়া টুকরোটা দেখেই আমি চিনতে পেরেছি…’

‘কি চিনতে পেরেছেন?’

‘অশোকের এটা…সেই পাড়—জলে ডোবার দিন এইটেই পরেছিল…’

হেমন্তকুমার এক—পা এগিয়ে এসে, প্রায় অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন, ‘কি বললে? তার কাপড়? ঠিক চিনতে পেরেছ তুমি?’

‘হ্যাঁ—হ্যাঁ…মা কালীর পা ছুঁয়ে বলতে পারি…। এই দেখুন না, কালো নরুন—পাড়…কোলে পাঁচটা ধাক্কা…’গুণতে শুরু করে সে।

পিতা—পুত্রীর মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হয়। হেমন্তকুমার রেবাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আগমের কথা যদি সত্যিই হয়, তাহলে আশা করার মতো আর কিছুই তো রইল না মা।’

তিনি কি বলতে চান বুঝতে না পেরে রেবা প্রশ্ন করল, ‘কেন বাবা?’

হেমন্তকুমার সোজাসুজি না বলে, ইঙ্গিত দিলেন, ‘জানিসই তো সুন্দরবনের কুখ্যাতি। এখানে ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির…’

রুদ্ধশ্বাসে রেবা বলে ওঠে, ‘তুমি কি বলতে চাও, অশোকবাবুকে বাঘে…’

সে শেষ করার আগেই হেমন্তকুমার কাঁধ দুলিয়ে বললেন, ‘বিচিত্র কি।’

আগম দত্ত যে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কেউই লক্ষ করেননি। এই সময় ব্যাকুল কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘এ কথা কেন বলছেন স্যার? এমনও তো হতে পারে, অশোক বেঁচে আছে, কাছাকাছি কোথাও আশ্রয় নিয়েছে।’

মাথা নেড়ে, হেমন্তকুমার ভারী গলায় বললেন, ‘তাহলে আমিও কম খুশি হতুম না, আগম; কিন্তু কাছাকাছি তো দূরের কথা, আমি জানি এখান থেকে বিশ—ত্রিশ মাইলের ভেতর কোনো লোকালয় নেই।’

আগমের মুখে যেটুকু আশার আলো জ্বলছিল, সেটা অতি অকস্মাৎই যেন দপ করে নিভে গেল।

হেমন্তকুমার সেটা লক্ষ করলেন না। কি একটা ভাবছিলেন তিনি। অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘তবে…’

থেমে গেলেন তিনি। রেবা কিন্তু রেহাই দিল না তাঁকে। আরও কাছে সরে এসে গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করল, ‘তবে কি, বাবা?’

‘আমি ভাবছি, ছেলেটি যদি একবার কোনো রকমে…’ আর একবার নিজেকে সংযত করে নিলেন তিনি। ‘না, থাক।’

রেবা অধীর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘না—না—বলতে বলতে থামলে কেন তুমি? কি আশঙ্কা করছ আমাদের বলো, বাবা!’

হেমন্তকুমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কতকটা অনিচ্ছাভরেই বললেন, ‘অবশ্য শোনা কথা, মা। যদিও পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখ আছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

ম্লানভাবে হেসে তিনি থামতেই রেবা, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, ‘কিসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি? কার কথা বলছ, বাবা?’

‘প্রফেসার রায়ের—সুরজিৎ রায়…’

আগম দত্ত প্রায় লাফিয়ে ওঠে। বলে, ‘সুরজিৎ রায়? ও নাম তো আমরা কলেজে পড়বার সময় শুনেছি, স্যার…’

হেমন্তকুমার কোনো কথা বললেন না। রেবা গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তিনি বাবা?’

‘এক পাগলা বৈজ্ঞানিক।’

‘পাগলা?’

হেমন্তকুমার থমথমে মুখে বললেন, ‘পাগলা বললে হয়তো তাঁকে ভুল বলা হবে। অসাধারণ পণ্ডিত তিনি; অদ্ভুত প্রতিভাশালী। তবু তাঁর মতো ভয়ানক প্রকৃতির লোক আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত আর জন্মায়নি।’

আগম দত্ত চট করে বলে উঠল, ‘তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়েছিল শুনেছি…’

‘হ্যাঁ। বন্ধুর স্ত্রীকে হত্যা করার অপরাধে।’

শিউরে উঠল রেবা। আতঙ্ক বিহ্বল কণ্ঠে বলল, ‘বন্ধুর স্ত্রীকে! কেন বাবা?’

হেমন্তকুমার অনিচ্ছুক কণ্ঠেই আবার বললেন, ‘সে এক অদ্ভুত কাহিনি মা। যা পড়েছি, তা বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।’

ফিরে গিয়ে তিনি আরাম—কেদারাটায় বসে পড়লেন। রেবার কৌতূহল, উত্তেজনা তখন সহ্যের বাইরে চলে গেছে। কাহিনিটুকু না শোনা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। বাপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। আগম দত্ত ছায়ার মতোই সঙ্গে রইল তার।

মেয়ের অনুরোধ হেমন্তকুমার শেষ পর্যন্ত উপেক্ষা করতে পারেন না। অগত্যা কাহিনিটুকু বলতেই হয়, ‘প্রাণীতত্ত্বের গবেষণা করতে এককালে সুরজিৎ রায় বিদেশে যান। মরা—মানুষ বাঁচাবার সাধনা ছিল তাঁর। সেখানে নাকি বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁকে নিয়ে সাড়া পড়ে যায়…’

যেন রূপকথা শুনছে এমনই ভঙ্গিতে রেবা বলল, ‘মরা মানুষ বাঁচাবার! কোনো দেশের বৈজ্ঞানিক আজও যা ভাবতে পারেন না…’

মাথা নেড়ে হেমন্তকুমার বললেন, ‘ঠিক সেই জন্যেই তো ওদের দেশে সুরজিৎ রায়কে নিয়ে সাড়া পড়ে গেছিল।’

বিজ্ঞানতত্ত্ব শোনবার মতো ধৈর্য ছিল না রেবার। বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু বন্ধুর স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন কেন?’

‘নিজের স্ত্রীকে বাঁচাবার চেষ্টায়।’

আর একটা বিস্ময়ের ধাক্কা খায় রেবা আর আগম দত্ত দুজনেই। রেবা অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নিজের স্ত্রীকে!’

হেমন্তকুমার সায় দিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে চললেন, ‘হ্যাঁ। রোগেই প্রফেসার রায়ের স্ত্রী মারা যান। সেই দিনই দেখা গেল তাঁর বন্ধুর স্ত্রীও হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছেন। তদন্ত করতে করতে পুলিশ যখন তাঁর বাড়িতে হাজির হল, তখন তিনি বন্ধুর স্ত্রীর দেহটা খণ্ড খণ্ড করে কেটে গ্রন্থিগুলো বার করে নিচ্ছেন।’

রেবা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। আগম দত্তের মুখখানা দেখা গেল ছাইয়ের মতোই সাদা হয়ে গেছে।

হেমন্তকুমার পরুষকণ্ঠে বললেন, ‘কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ যে এমন নৃশংস হতে পারে…’

তিনি শেষ করার আগেই রেবা বলে উঠল, ‘থাক, থাক, বাবা। আর শুনতে পারছি না।’

আগম দত্তের হাত দুটো কিন্তু তখন মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে। ক্রোধে ফেটে পড়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু শয়তানটার ফাঁসি হল না কেন?’

হেমন্তকুমার ভ্রূকুঞ্চিত করে জবাব দিলেন, ‘তার আগেই অদ্ভুতভাবে তিনি জেল থেকে পালিয়েছিলেন।’

‘আর ধরা পড়েননি?’ নতুন করেই আতঙ্কের ছায়া ঘনায় রেবার চোখে—যেন যে কোনো মুহূর্তে প্রফেসার রায় তাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারেন।

‘না। শোনা গেছল সুন্দরবনেরই কোথাও তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। বিরাট দল গড়ে তুলেছেন অসভ্য ওরাংদের নিয়ে। তারা হিংস্র শ্বাপদের মতোই ওত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই লোকজনকে ধরে নিয়ে যায় কোনো এক রহস্যপুরীতে;আর সেই সব অভাগা মানুষ পরে প্রাণ দেয় প্রফেসার রায়ের বিজ্ঞান সাধনার হাড়কাঠেতে…’

আগম দত্ত ছেলেমানুষের মতোই ককিয়ে ওঠে, ‘সর্বনাশ! অশোক—অশোক যদি তাদের হাতেই পড়ে থাকে?’

হেমন্তকুমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমিও সেই ভয়ই করছি, রেবা। শোনা কথার যদি কোনো মূল্য থাকে, আর ছেলেটি সত্যিই তাদের হাতে গিয়ে পড়ে…’

দু—হাতে বাপের হাত একটা চেপে ধরে রেবা মিনতিভরা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তাহলে চুপ করে আছ কেন, বাবা? খোঁজ কর তাঁর। পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে বন—জঙ্গল যদি তন্ন তন্ন করে ফেল…’

হেমন্তকুমার প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তার দায়িত্ব তো কম নয়, মা। সবটাই যদি কিংবদন্তি হয়, মূলে কোনো সত্যি না থাকে, তাহলে ওপরওয়ালার কাছে কি কৈফিয়ৎ দেবো আমি? হয়তো degrade করে দেবে আমায়।’

আগম দত্ত হঠাৎ তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। হাত জোড় করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলে আমায় ছেড়ে দিন, স্যার। আমি একবার তার খোঁজ করে দেখি।’

রেবা চমকে ওঠে। বড় বড় চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত করে বলে, ‘একলা? কি বলছেন পাগলের মতো?’

আগম দত্ত উত্তেজিতভাবে বলল, ‘কি হবে, রেবাদি? না হয় মরব—এই তো। বেঁচেই বা লাভ কি? খেতে পারব না, শুতে পারব না, ঘুমুতে পারব না। সব সময় মনে হবে অশোকের আকুল ডাক যেন আমার কানে ভেসে আসছে—তার চোখের কাতর দৃষ্টি আমায় তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে…’

হেমন্তকুমার হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘থামো—থামো।’

থতমত খেয়ে থেমে গেল আগম দত্ত। নির্বোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে।

হেমন্তকুমার অস্থির চরণে কতক্ষণ পায়চারি করে, একসময় মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তোর কথাই রাখব মা। আমি আজই লোক পাঠাচ্ছি আরও armed police চেয়ে। তারপর…আমাদের ভাগ্য।’

কাঁধ দুলিয়ে তিনি ঘাটে বাঁধা লঞ্চের দিকে রওনা হলেন। রেবার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। আগম দত্তের কাছে সরে এসে কপট কণ্ঠে বলল, ‘কে বলে আকারো সদৃশ প্রাজ্ঞঃ।’

আগম দত্ত বুঝল কি বুঝল না, তার জন্যে আর অপেক্ষা না করে, সে মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা দেখতে গেল।

।। সাত।।

বনের গহনে অকস্মাৎ বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দিল। সকলেই ভীত, চকিত।

অসীমাকে ঘিরে তারা উৎসবে মেতেছিল। নাচ, গান, হৈ—হল্লা। তারই মাঝে মংটু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, ‘পারিয়া—পারিয়া…’

পুলিশ! থেমে গেল নাচ—গান। সকলের চোখে ফুটে উঠল সন্ত্রাসের দৃষ্টি। বহুকণ্ঠ একসঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘কোথায়?’

‘নিনি পিংটি।’

নদীর ঘাটে! ঠোঁট কামড়াল অসীমা। ফুলের সাজ খুলে ফেলতে ফেলতে বলল, ‘আমি বাবাকে গিয়ে বলছি। তোমরা কেউ আর হৈ—চৈ করো না…’

নিজেদের বাড়ির দিকে ছুটল সে।

বাড়ি বলতে কাঠের তৈরি একটা দোতলা। সামনে বেশ খানিকটা খোলা জমি। চারদিকে কাঠেরই বেষ্টনী। নীচের তলে প্রফেসার রায়ের গবেষণাগার। ওপরে থাকার ব্যবস্থা।

কাঠের তৈরি ভারী ফটকটা ঠেলে অসীমা ছুটতে ছুটতে ঢুকল।

প্রফেসার রায় তখন গবেষণাগারে। হাতে গ্ল্যাণ্ডের বিকল্প দুটি ডিম্বাকৃতি পদার্থ। সেগুলো নিয়ে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা বিরাট একটা নরকঙ্কালের সামনে। তার বিশেষ স্থানে বিকল্প পদার্থ দুটি সবেমাত্র সন্নিবেশিত করতে গেছেন, এই সময় বন্ধ দরজায় করাঘাত করতে করতে অসীমা ডাকতে লাগল, ‘বাবা! বাবা! দরজা খোল। শিগগির—শিগগির…’

এই বিঘ্নে রুষ্ট হলেন প্রফেসার রায়; কিন্তু মেয়ের ডাক উপেক্ষাও করলেন না। গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

ছুটে আসার পরিশ্রমে, উত্তেজনায় অসীমা হাঁফাচ্ছিল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘পুলিশ—পুলিশ, বাবা…’

‘পুলিশ!’ ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল প্রফেসার রায়ের; কিন্তু বিশেষ বিচলিত হয়েছেন বলে বোধ হল না তাঁকে। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায়?’

‘নদীর ঘাটে। মংটু দেখে এসেছে…’

হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়। অসীমা বিস্ময় আর চাপতে পারে না। ‘তুমি হাসছ?’

‘এর আগেও তারা অনেকবার এসেছে, মা; কিন্তু এ—গোলকধাঁধার খোঁজ কোনোদিনই পায়নি।’ অবজ্ঞায় ঠোঁট কুঞ্চিত করে তিনি আবার গিয়ে দাঁড়ালেন নরকঙ্কালটার সামনে।

অসীমা কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। বাপের পেছন পেছন যেতে যেতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেনই বা তারা বার বার আসে? কি চায় তারা?’

‘আমাকে।’ হাতের কাজে আবার মন দিলেন প্রফেসার রায়।

অসীমা শিউরে ওঠে; মুখ দিয়ে তার কথা সরে না।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর প্রফেসার রায় বললেন, ‘তবে আমার বিশ্বাস এবার তারা এসেছে অশোক সেনের সন্ধানেই…’

অশোক সেন? সেই সভ্য দেশের লোকটা? অসীমা কাছে এসে দাঁড়ায়। অনিশ্চিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন তুমি তাকে জোর করে আটকে রাখলে বাবা?’

ফিরে তাকালেন প্রফেসার রায়। মৃদু হেসে বললেন, ‘নিজের ইচ্ছেয় কেউ তো গলা বাড়িয়ে দিতে চায় না, মা।’

অসীমার মুখখানা ব্যথায় বিবর্ণ হয়ে যায়। দু’হাতে বাপের কর্মরত হাতখানা চেপে ধরে, আদরের সুরে বলে, ‘তুমি তাকে ছেড়ে দাও, বাবা।’

প্রফেসার রায় যেন মেয়েকে বুঝতে পারেন না। বলে ওঠেন, ‘ছেড়ে দোব? কেন রে?’

লোকটার জীবনের ওপর নিজের দাবিটা বোঝাতেই অসীমা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে, ‘আমি তার প্রাণ বাঁচিয়েছি।’

‘তবু নিজের জীবন দিয়ে বাপের ঋণটা তাকে শোধ করতেই হবে।’

প্রতিবাদের সুরেই অসীমা ডাকে, ‘বাবা!’

প্রফেসার রায় স্থির, কঠিন দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। একসময় নিরস কণ্ঠে বললেন, ‘আর কোনো কথা নয়। কাজ শেষ করতে দে আমায়, অসীমা।’

কথা শেষে তিনি একটা ব্যাটারির সুইচ টিপে দিতেই, দেখা গেল, কঙ্কালটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নাড়াতে শুরু করেছে।

অসীমা শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল; তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মন্দিরে তখন বিগ্রহের পূজা শুরু হয়েছে। আজ আর কাড়া নাকাড়া বাজছে না। গানও যেন কোন যাদুকরের প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু চলেছে নাচ। উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল নাচ— যেন গান আর বাজনার ক্ষতিটা বন্য নরনারীর দল দেহভঙ্গির মধ্যে দিয়ে পুষিয়ে নিতে চায়।

অসীমা এসে দাঁড়াল অদূরে। কেউ তাকে লক্ষ করল না। সেও তা চায় না চোখ দুটো তার কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে সে মন্দিরের ভেতরে এসে ঢুকল।

পুরোহিত পীতাম্বর তখন বৃহদাকারের একটা শাঁখ নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে বিগ্রহের আরতি করছে।

অসীমা একটুখানি দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটোয় সেই সন্ধানী দৃষ্টি। অকস্মাৎ সে দৃষ্টিতে আলো ঝলসে উঠল।

পেয়েছে—দেখতে পেয়েছে। বিগ্রহের পাশটিতেই রাখা আছে চাবির গোছাটা।

অসীমার ইচ্ছে হল একছুটে গিয়ে তুলে নেয়; কিন্তু ভরসা হল না। যদি পীতাম্বর কি অন্য কেউ দেখে ফেলে!

এক মুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে, সেও শুরু করল নাচ। অপূর্ব সুষমাময় তার দেহভঙ্গি। আদিম নরনারীর দল হৈ হৈ করে উঠল। নাচের ছন্দ হল আরো উদ্দাম। গতি গেল বেড়ে।

অসীমার কিন্তু কোনো দিকে খেয়াল ছিল না। নাচতে নাচতে অতি ধীরে, অতি সঙ্গোপনে সে এগোতে লাগল বিগ্রহের দিকে।

পীতাম্বর তাকে লক্ষ করল না। দেবতাকে তুষ্ট করতে হবে। বলি যেন গ্রহণ করেন তিনি। শাঁখ ছেড়ে সে তুলে নিল মশাল। মশালের পর এক বন্য জন্তুর অন্ত্র। নিবেদনে তন্ময় হয়ে গেল সে।

অসীমা যেন এই সুযোগটুকুরই অপেক্ষা করছিল। অন্যের অলক্ষ্যে তুলে নিল চাবির গোছা। তারপর নাচের তালে তালেই অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে।

সামনের দরজা তালা বন্ধ। হাতড়ে হাতড়ে সে চাবি লাগিয়ে খুলে ফেলল। কিন্তু কোন দিকে যাবে? গাঢ় অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হয় না। নিজের হাতটাও দেখা যায় না বুঝি।

তবু এগিয়ে চলে সে। প্রথম ঘরটা পার হবার সময় গরিলা—মানুষটা ঝুঁকে পড়ল গরাদ ধরে। ফিস ফিস করে বলল, ‘ওই দিকে—ওই দিকে।’

অসীমা প্রথমটায় ভীষণ ভাবেই চমকে উঠেছিল। পরে আবছা মূর্তিটা দেখে বুঝতে পারল উপকারী বন্ধুটি কে। কিন্তু কোনো কথা বলতে সাহস করল না; একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়েই পার হতে লাগল দ্বিতীয় ঘরখানা।

আগের দিনের মতোই ডালের ওপর বসেছিল সেই বানরটা। সড়াৎ করে সে নেমে এল মাটিতে। সাদা সাদা দাঁতগুলো তার অন্ধকারে ঝকঝক করে উঠল। হাত বাড়িয়ে অসীমার খাটো শাড়ির আঁচলটা ধরে ফেলবার চেষ্টা করে বলল, ‘কই, আমাদের বিয়ে হবে না?’

অসীমা চট করে আঁচলটা টেনে নিল। না দাঁড়িয়ে যেতে যেতেই বলল, ‘হবে—হবে—শুনছ না, বাজনা বাজছে। এবার হ্যাঁ…’

বাকি পথটুকু পার হয়ে সে অশোকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতড়াতে হাতড়াতে খুলে ফেলল তালাটা।

ভেতর থেকে অশোক বোধ হয় শব্দটা শুনতে পেয়েছিল। সরু তক্তাটার ওপর উঠে বসতে বসতে, ভীরু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কে? কে?’

অসীমা চাপা গলায় বলল, ‘চুপ! চলে এসো।’

অশোক বুঝল কে। কিন্তু অসীমা অমন লুকিয়ে এসেছে কেন? তাকে উদ্ধার করতে? হতাশার সুরে সে বলল, ‘কি করে যাব? দেখছ না শেকল বাঁধা।’

এমন সম্ভাবনার কথাটা ভাবতে পারেনি অসীমা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, সে অস্ফুট একটা ধ্বনি করে উঠল, ‘ওঃ!’ কি করবে তাহলে সে? সমস্ত চেষ্টা তার পণ্ড হয়ে যাবে? অন্ধকারের ভেতরই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অসহায়ভাবে চারদিকে তাকাতে লাগল।

ঠিক সেই মুহূর্তে কাছেই কোথাও থেকে ভেসে এল বিদ্রূপের অট্টহাসি। অসীমার হাত পাগুলো ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। মুখ দিয়ে স্বতই বেরিয়ে এল ‘ওলে? ওলে?’

উত্তরে হাসি নয়, ভেসে এল এবার হিংস্র গর্জন।

অসীমা বুঝল, কোথা থেকে স্বরটা আসছে। হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে, সে দেওয়ালে টাঙানো সেই ভারি পর্দাটা সরিয়ে দিল। দেখা গেল গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্য মানুষটা। সাদা দাঁতগুলো কড়মড় করে, সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘ই—য়ে—এ—ললা— ও—ও…’

অসীমা বিমূঢ়ের মতোই তাকিয়েছিল। সে হুঙ্কার শুনে, কম্পিত হাত থেকে তার পর্দাটা খসে পড়ল। তাড়াতাড়ি অশোকের দিকে ফিরে ভীতিবিহ্বল কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, ‘কে ও?’

অশোক শ্লেষের সুরেই জবাব দিল, ‘তিলোত্তমা—তোমার বাবারই অপরূপ সৃষ্টি।’

দেখেনি, অসীমা এর আগে কোনোদিন তিলোত্তমাকে দেখেনি। বাবাও কোনোদিন তার কাছে গল্প করেন নি। হয়তো তার কথাটা গোপন করে রাখতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু ও নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার সময় নেই। বন্দি অশোককে মুক্তি দিতে হবে। যেমন করে হোক, তার শেকলের বন্ধন কাটতে হবে।

অশোক নিরাশায় মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘কোনো আশা নেই, অসীমা। তার চেয়ে তুমি পালিয়ে যাও এখান থেকে। দু—দু’বার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ; কিন্তু এভাবে যদি তোমার বাবার মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিতে চাও…’

বাধা দিয়ে অসীমা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ চাই। তোমায় পালাতে হবে—আসছি আমি…’

হাতড়াতে হাতড়াতে আবার সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কোথায় গেল অশোক বুঝল না। মুক্তির আশা নিয়েও আর অকারণ নিজেকে উত্তেজিত করল না। কাঠের তক্তাখানার ওপরই শুয়ে পড়ল আবার।

।। আট।।

এগিয়ে চলেছে গবেষণার কাজ। সফলতার দিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। প্রফেসার রায়ের খুশির আর অন্ত নেই। শীঘ্রই এমন দিন আসবে, যেদিন তিনি হবেন বিজ্ঞান—জগতের বিস্ময়। এই বিধাতার সামনেই মাথা নত করবে সবাই।

গ্যাসে বসানো রঙিন রসায়নটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি।

আবার দরজায় ঘনঘন করাঘাত। ক্রোধে প্রফেসার রায়ের চোখ দুটো জ্বলে উঠল।

বাইরে থেকে ভেসে এল পীতাম্বরের ব্যাকুল কণ্ঠ, ‘ছুটে এসো—ছুটে এসো, রায়—সর্বনাশ হয়েছে…’

সর্বনাশ! আজ কি সব সর্বনাশ একযোগে দেখা দিতে চায়!

গ্যাসের চাবিটা ঘুরিয়ে, প্রফেসার রায় গিয়ে দরজার খিল খুলে দিলেন। পীতাম্বর ছিটকে এসে পড়ল ঘরের ভেতর। দু’হাতে মাথার চুলগুলো টানতে টানতে, হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘পারলুম না—তোমার মেয়েকে আটকাতে পারলুম না, রায়। শিকারটাকে হয়তো সে এতক্ষণ…’

আগুনের ফুলকির মতোই প্রফেসার রায়ের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল। আহত জন্তুর মতোই গর্জন করে উঠলেন তিনি, ‘You fool ! সে চাবি পেল কোথায়? তুমিই দিয়েছ তাকে…’

ভয়ে পীতাম্বরের জিভটা জড়িয়ে গেল। কোনোরকমে উচ্চারণ করল, ‘না—না…ওরেঙ্গার দিব্যি…সে আমায় ফাঁকি দিয়েছে…জানতে পেরে কেড়ে নিতে গেলুম তার কাছ থেকে…’

ক্ষিপ্তের মতোই চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসার রায়, ‘তোমায় খুন করব আমি—হাড়কাঠে বলি দেবো…অশোক সেন যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে, কেউ তোমায় বাঁচাতে পারবে না, পীতাম্বর। আমার এতদিনের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে…কূলে এসে নৌকো ডুববে…’

বয়সের ভারে মন্থর গতি। তবু নিজেকে যেন চাবুক মেরেই টেনে নিয়ে চললেন প্রফেসার রায়। চারদিকে তখন শাঁক বাজছে ঘনঘন। বন্দি পালিয়েছে—সাঙ্কেতিক ভাষায় সেইটেই ঘোষণা করতে চায়। অন্ধকারে প্রেতমূর্তির মতোই ছুটোছুটি করছে অর্ধ—উলঙ্গ নরনারীর দল। সুন্দরবনের আলুলায়িত কেশ যেন তারা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। পলাতক যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, আবিষ্কার তাকে করতেই হবে।

প্রফেসার রায় এসে ঢুকলেন মন্দিরের সুড়ঙ্গ—পথে। সঙ্গে মশাল হাতে পীতাম্বর। প্রথম ঘরটা পার হবার সময় সেই গরিলা—মানুষটা খলখল করে হেসে উঠল—যেন মস্ত এক মজার খেলা দেখছে।

তার দিকে মন দেবার অবসর ছিল না প্রফেসার রায়ের। ছুটতে লাগলেন তিনি। দ্বিতীয় ঘরখানার সামনে পৌঁছতেই গরাদের ফাঁকে মুখ রেখে বানরটা ধিক্কার দিয়ে উঠল, ‘মেয়ে যে দেখলুম কুলত্যাগ করেছে। বেশ হয়েছে! যেমন আমার সঙ্গে বিয়ে দিলে না…’ হি হি করে হাসতে লাগল জানোয়ারটা।

তার কথাগুলোও বোধ হয় প্রফেসার রায়ের কানে গেল না। তিনি এসে অশোকের ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। ভেতর থেকে তিলোত্তমা তেমনইভাবে চিৎকার করে চলেছে, ‘ই…এ…ল…লা…ও…ও…’

প্রফেসার রায় বন্দির ঘরে ঢুকলেন। যে শেকল দিয়ে অশোককে বেঁধে রাখা হয়েছিল, দেখলেন সেটা নিপুণ হাতেই কাটা। পাশেই পড়ে আছে বিচিত্র গঠনের একটা উখা। অতি তীক্ষ্ন, ধারালো দাঁতগুলো তার, মশালের আলোয় মনে হল, যেন ব্যঙ্গের হাসিতে ঝলসে উঠছে।

প্রফেসার রায় সেদিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে রইলেন। শুধু চোখ দুটো দিয়ে আগুনের হলকা বেরুতে লাগল।’

তিলোত্তমার হিংস্র গর্জনের বিরাম ছিল না। ‘ই—এ—ল—লা—ও—ও…’

পীতাম্বর ভয়ে ভয়ে বলল, ‘রায়, এখানে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এখনও হয়তো তারা বেশিদূর পালাতে পারেনি। ধরতে হলে ডিংপুর…’

অকালে ধ্যান ভাঙায় যেন মহেশ্বর কুপিত হয়েছেন, এমনই ভঙ্গিতে ফিরে তাকালেন প্রফেসার রায়। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘হ্যাঁ, ধরতেই হবে; কিন্তু মংটু আর উলপাদের হয়তো তারা নাগালের বাইরে গেছে। তবু তাদের ধরতেই হবে…’

ছুটে তিনি এগিয়ে গেলেন পেছন দিকের পর্দা—ঢাকা দেওয়ালটার দিকে।

তাঁর অভিপ্রায়টা সঠিকভাবে না বুঝলেও, একটা ভীতিকর সন্দেহে পীতাম্বরের বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। কাঁপা গলায় বলতে চেষ্টা করে, ‘ওদিকে কেন যাচ্ছ, রায়? কী করতে চাও? মতলব কি তোমার?’

বিকৃত কণ্ঠে হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়। তার কথার উত্তর না দিয়ে, একটানে পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিলেন। তারপর পকেট থেকে বার করলেন বিশেষ ধরনের একটা মস্ত বড় চাবি।

তিলোত্তমা উল্লাসে চিৎকার করতে থাকে, ‘ই—এ—ল—লা—ও—ও…’

প্রফেসার রায় তালায় চাবি লাগালেন। পীতাম্বর খপ করে তাঁর হাতখানা ধরে ফেলে, ভীতিবিবর্ণ মুখে বলে উঠল, ‘ও কাজ কোরো না, রায়—কথা শোন—’

প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে, প্রফেসার রায় তাকে দূরে সরিয়ে দিলেন, তারপর খুলতে লাগলেন তিলোত্তমার শেকলে লাগানো সুবৃহৎ তালাটা।

তিলোত্তমা অধীর হয়ে ওঠে। বিলম্ব বুঝি আর তার সয় না।

পীতাম্বর কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস করল না। মশালটা মেঝের ওপরই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে।

দপ দপ করতে লাগল মশালের শিখাটা। হয়তো যে কোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। উত্তেজনায় প্রফেসার রায়ের হাত দুটো কাঁপছিল। তিলোত্তমার পায়ের শেকলে লাগানো তালাটা খুলে ফেললেন তিনি।

তিলোত্তমা আর—একবার ঘর ফাটানো চিৎকার করে উঠল, ‘ই—এ—ল— লা—ও—ও…’

এবার হাতের শেকল। তালায় চাবি ভরিয়ে, প্রফেসার রায় কি ভেবে হঠাৎ থামলেন, আর ঘোরালেন না। পকেট থেকে বার করে নিলেন বিচিত্র গড়নের সেই অস্ত্রটা। তারপর নিজেকে প্রস্তুত রেখেই খুলে দিলেন তালাটা।

সঙ্গে সঙ্গে বিকট উল্লাসধ্বনি করে উঠল তিলোত্তমা। দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল প্রফেসার রায়ের দিকে।

এ—রকম যে ঘটতে পারে, সেটা তিনি আন্দাজই করেছিলেন। চাপা কণ্ঠে হুঙ্কার করে উঠে, হাতের অস্ত্রটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন তিলোত্তমার বাহুতে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠে, তিলোত্তমা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

প্রফেসার রায় অস্ত্রটা আস্ফালন করতে করতে আদেশের সুরে বললেন, ‘যাও, যেমন করে পারো অশোক সেন আর আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে এসো—যেখান থেকে হোক— যেমন করে হোক…’

পৈশাচিক আনন্দে তিলোত্তমার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। আর একবার গর্জন করে উঠে, ঝড়ের মতোই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একা ঘরে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসার রায়। অনেকখানি যেন নিশ্চিন্ত বোধ করেন তিনি। তিলোত্তমার শক্তি সামর্থে তাঁর বিশ্বাস আছে। মিথ্যেই তাকে তিলে তিলে সৃষ্টি করেননি।

।। নয়।।

শুধু বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে। এর কাছে সব ভয়ই হার মানে। হার মেনেছিল অশোক আর অসীমার কাছেও। বাঘের দেখা, সাপের লেখা’র ভয়ঙ্কর পরিণতিটাও তাদের নিরস্ত করতে পারেনি।

অশোকের ক্ষত—বিক্ষত পা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। অবসাদে শরীর ভেঙে পড়তে চায়। তবু অসীমা এক লহমার জন্যেও থামতে দেয় না তাকে। হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে ঝড়ের বেগে। মুখে বলে, ‘ওরা তাড়া করেছে…ধরতে পারলে ‘ওরেঙ্গা’র কাছে বলি দেবে তোমায়…’

নতুন করেই যেন আবার বল ফিরে পায় অশোক। বুক টেনে শ্বাস নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে ছুটতে থাকে। শুধু ভেবে পায় না, মেয়ে হয়ে অসীমা এত শক্তি পেল কোথায়।

পেছন থেকে ভেসে আসে মংটুর উল্লাসধ্বনি, ‘আগি দো…আগি দো… হেপা টিলা…’

সে কণ্ঠ কানে আসতেই অসীমার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে ওঠে। মংটু সন্ধান পেয়েছে তাদের। এই পথ দিয়েই যে তারা পালাচ্ছে, সেইটেই বলতে চায়। অশোকের হাত ধরে প্রাণপণে আকর্ষণ করল সে। চাপা গলায় বলল, ‘আরও জোরে ছোটো…মংটু জানতে পেরেছে…আরও জোরে…’

অশোক একটা গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাপরের মতোই হাঁফাচ্ছিল সে। প্রাণটা মনে হয় ঠোঁটের ডগায় এসে গেছে। হতাশায় ভেঙে পড়ে সে বলল, ‘আর পারছি না, অসীমা। কপালে যা আছে ঘটতে দাও…’

অসীমার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠল। তিরস্কারের সুরে সে বলল, ‘ছুট! এখনি হার মানছো? এখনও মংটু আমাদের দেখতে পায়নি। চলে এস—চলে এস…’

জোর করেই তাকে টানতে টানতে অসীমা আবার অন্ধকারে অন্তর্হিতা হল। পরক্ষণে মংটুর হাতের টর্চের আলোটা ঝলসে উঠল যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গায়। নতুন করেই পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে।

কিন্তু তার চিৎকার ডুবে গেল তিলোত্তমার হুঙ্কারে। মংটু জানত না কিছুই, তাই মেঘের ডাক বলেই ভুল করল প্রথমটা। চকিতে পেছন ফিরে তাকাল। বিশেষ কিছুই দেখতে পেল না। শুধু মনে হল ঝড় এসেছে; আর তার দাপটে মাতাল হয়ে উঠেছে গাছপালা। হেলছে, দুলছে, মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে সেগুলো।

আসুক ঝড়। তার জন্যে এক মুহূর্তও সে দেরি করতে রাজি নয়। টর্চের আলোটা চারদিকে ফেলতে ফেলতে সে ছুটল আবার; কিন্তু এবার বড় কাছ থেকেই যেন মেঘের ডাক শোনা গেল, ‘ই…এ…ল…লা…ও…ও…’

চট করে ঘুরে দাঁড়াল মংটু। হাতের টর্চটা ঘোরাতে লাগল কণ্ঠস্বরের মালিকের সন্ধানে। তীব্র আলো গিয়ে পড়ল গাছের ফাঁকে ফাঁকে আবছা এক বিরাট দেহ জন্তুর ওপর। সুস্পষ্ট কিছুই নির্ণয় করতে পারল না সে; কিন্তু টর্চটা জ্বেলে রাখতেও আর সাহসে কুলোল না। তাড়াতাড়ি বোতাম টিপে অন্ধকারের ভেতর সরে দাঁড়াল সে।

পাশ দিয়ে বয়ে গেল ঝড়ের ঝাপটা। ঝোপঝাড় দুলে উঠল; ভেঙে পড়ল ডালপালা। তাকে লক্ষ না করেই অতিকায় তিলোত্তমা ঘূর্ণি হাওয়ার বেগেই এগিয়ে চলল। কণ্ঠে সেই বিকট উল্লাসধ্বনি, ‘ই…এ…ল…লা…ও…ও…’

শুধু মংটুই সে ডাক শুনে কেঁপে উঠল না। সারা বনভূমিই মনে হল যেন থরথর করে কাঁপছে। ডানা ঝাপটে পাখির দল কলরব করতে করতে শূন্যে উড়ে বেড়াতে লাগল।

তিলোত্তমার সে হুঙ্কার সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে, বোধ করি অশোক আর অসীমার কানে এসে পৌঁছল। ডিংপুর সীমানা আর দূরে নয়। বন—জঙ্গল পাতলা হতে শুরু করেছে। দেখা দিয়েছে মাটির বুকে বালির আস্তরণ। এ আস্তরণ ক্রমেই পুরু হবে। নরম বুকে টেনে ধরবে পা দুটো। তবু টেনে টেনে আরও খানিকটা গেলেই ডানহাতি নদীর বাঁকে দেখা যাবে সেই ঘাট—যেখানে পুলিশ এসে নাকি আস্তানা গেড়েছে।

থমকে দাঁড়াল অসীমা। তিলোত্তমার গর্জনটা ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে। পাতলা ঝোপঝাড়ের আড়ালে দেখা গেল তার আবছা মূর্তিটা। ভয়ঙ্কর সে রূপ; গতি বিদ্যুতের মতই ক্ষিপ্র। তাদের ধরে ফেলতে আর কতক্ষণই বা লাগবে। নিরাপদে নদীর ঘাটে পৌঁছনো সম্ভব নয়।

বাঁচাতে হবে—অশোককে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে। তার জন্যে দরকার একটু সময়ের। কিছুক্ষণের জন্যে আটকে রাখতে হবে তিলোত্তমাকে। অশোকের দিকে ফিরে, চকচকে চোখে অসীমা বলল, ‘যাও—এখান দিয়ে সোজা চলে যাও, অশোক—যত জোরে, পারো, ছোটো…’

কি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না অশোক। প্রশ্ন করে, ‘আর তুমি?’

অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে ওঠে অসীমা, ‘আঃ! আমার জন্যে ভেবো না। তুমি যাও—পালাও…’

‘কিন্তু…’ কি একটা বলতে চায় অশোক।

অসীমা রুষ্ট ভঙ্গিতে বলে, ‘কোনো কথা নয়… আমি ফিরে যাব এখান থেকে…তুমি যাও—যাও—পালাও…’

এক রকম ধাক্কা দিয়েই সে অশোককে সরিয়ে দিল।

তার মূর্তি দেখে অশোক আর প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। কিন্তু একা নারীকে ফেলে যেতে পা—ও সরে না।

ছুটে আসছে তিলোত্তমা—জ্বলন্ত উল্কার মতোই অন্ধবেগে ছুটে আসছে।

অসীমা চকিতে একবার অশোকের অপসৃয়মান আবছামূর্তির দিকে তাকিয়ে নিয়ে, তিলোত্তমার পথরোধ করে দাঁড়াল। চোখে তার জল ঘনিয়ে এলেও, ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল হাসি। আজীবন গভীর অরণ্যে মানুষ হলেও, সে যে চিরন্তন নারী, বোধ করি তারই অভিব্যক্তি এটা।

তিলোত্তমার দৃষ্টি তার ওপর পড়তেই থমকে থেমে গেল। চোখে প্রথমটা ঘনিয়ে উঠল বিস্ময়; তারপরই দেখা দিল আদিম রিপুর লোলুপতা। দু—হাত শূন্যে তুলে উৎকট আনন্দ প্রকাশ করল সে নিজের ভাষায়, ‘ই—এ—ল—লা—ও—ও—’

অসীমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল সে ভাষা শুনে। বুকের রক্ত বুঝি হিম হয়ে গেল। তবু এত সহজেই ভেঙে পড়লে চলবে না। সময় চাই আরও কিছুক্ষণ। অশোককে নিরাপদে নদীর ঘাটে পৌঁছতে দেবার মতো যথেষ্ট অবকাশ।

তিলোত্তমার চোখে চোখ রেখে সে হাসল—মোহিনী হাসি। তারপরই বরতনুকে ছন্দায়িত করে তুলল অপরূপ নৃত্য—ভঙ্গিমায়।

তিলোত্তমা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর চোখ দুটো তার জ্বলতে থাকে দপ দপ করে। তিলে তিলে সৃষ্টি করে প্রফেসার রায় তার যাই নাম দিন, আসলে সে তো পুরুষ—আদিম, বন্য, বর্বর। রক্তে তার জোয়ার দেখা দেয়। চিৎকারে কদম ফুলের মতোই রোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে। মুখ দিয়ে অব্যক্ত একটা ধ্বনি করে, রোমশ হাত দুটো বাড়িয়ে সে অসীমার কোমরটা বেষ্টন করে ধরে।

ঠিক এটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না অসীমা। অশোককে বাঁচাতে সে আত্মবলি হয়তো দিতেই চেয়েছিল; কিন্তু সে আত্মবলির রূপ যে এমন বীভৎস তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তীক্ষ্ন, তীব্রকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠে, প্রাণপণে সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু বৃথা সে চেষ্টা। কামার্ত পশুর মতোই একটা শিৎকার ধ্বনি করে উঠে, তিলোত্তমা দু’হাতে অসীমাকে শূন্যে তুলে নিল। হয়তো বুকে চেপে গুঁড়ো গুঁড়ো করেই ফেলতো তার হাড়গুলো; কিন্তু তার আগেই তীক্ষ্নধার ছোরা একখানা বিদ্যুৎবেগে এসে আমূল বিঁধে গেল তার পিঠে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠে, তিলোত্তমা অসীমাকে আছড়ে দিল মাটির ওপর, তারপর ফিরে দাঁড়াল ঘূর্ণি—বায়ুর বেগে।

মংটু কিন্তু এতটুকু ভয় পেল না। তিলোত্তমার পেছন পেছনই ছুটে আসছিল সে। আসছিল অসীমা আর অশোককে ধরতে; কিন্তু অসীমার আর্তকণ্ঠ শুনে আসল ব্যাপারটা বুঝতে তার বাকি থাকেনি। মরীয়া হয়েই হাতের ছোরা দিয়ে আঘাত করেছিল তিলোত্তমাকে।

দু—চোখে আগুন ভরে অতিকায় দৈত্যটা তাকিয়ে রইল মংটুর দিকে। ছোরাখানা তখনও তার পিঠে বেঁধা। অজস্র ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে; কিন্তু তার জন্যে এতটুকুও কাতর মনে হল না তাকে। হঠাৎ অন্ধ—রোষে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে মংটুর ওপর।

মংটু এর জন্যে তৈরি হয়েই ছিল। প্রাণপণে যুঝতে লাগল সে। হোক অসম যুদ্ধ; তবু সহজেই সে হার মানবে না।

কিন্তু অসীমা বোকার মতোই এখনও দাঁড়িয়ে আছে কেন? মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও মংটু যে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, সে কি অসীমাকে বাঁচাবার জন্যেই নয়?

এক মুহূর্তের জন্যে অসতর্ক হয়ে পড়ল সে; হয়তো অসীমাকেই সতর্ক করতে চেয়েছিল। সেই সুযোগে তিলোত্তমা দু—হাতে তার গলাটা ধরে ফেলে প্রচণ্ডভাবে চাপ দিতে লাগল।

লোহার সাঁড়াশির মতোই আঙুলগুলো মাংস কেটে যেন গলায় বসে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসে মংটুর। অবশ হাত—পাগুলো ভাঙা ডালের মতোই নেতিয়ে পড়ে; তবু সর্বশক্তি একত্র করে, শেষ চেষ্টায় একবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘উলে নে হু—উলে নে হু…শিলপা টিকা গো…’

এখনো সময় আছে। পালিয়ে যেতে বলছে মংটু। কিন্তু অসীমা তবু একটি পাও নড়তে পারে না। কে যেন তার সব শক্তি অপহরণ করে নিয়েছে। বিহ্বলের মতোই শুধু তাকিয়ে থাকা; চোখ মেলে দেখা মংটু কেমন ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। জিঘাংসার আদিম নাটক অভিনীত হচ্ছে আদিমতর এক বনের গভীরে।

অকস্মাৎ দূর থেকে বাপের গলাটা ভেসে আসতেই সে চমকে উঠল। ফিরে তাকিয়ে দেখল তীরবেগে ছুটে আসছেন তিনি; পেছনে পীতাম্বর। চিৎকার করছেন তিনি, ‘তিলোত্তমা! তিলোত্তমা!’

সে কণ্ঠ বোধ করি তিলোত্তমার কানে গিয়ে পৌঁছল না। খেলার পুতুলের মতোই মংটুর অশক্ত দেহটাকে শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল সে। হাতের বড় বড় ধারালো নখ দিয়ে তার দেহটা ফালা—ফালা করেই ফেলত; কিন্তু তার আগেই বৈদ্যুতিক শক্তিসম্পন্ন সেই বিশেষ অস্ত্রটা দিয়ে প্রফেসার রায় সজোরে আঘাত করলেন তাকে।

যন্ত্রণায় বিকট আর্তনাদ করে উঠল তিলোত্তমা। মংটুকে ছেড়ে সভয়ে উঠে দাঁড়াল। হিংসার সে—প্রমত্ততা আর রইল না। ভঙ্গি দেখে মনে হল মন্ত্রৌষধি দিয়ে বশ করা এক বিষধর সাপ।

কিসে যে কি ঘটে গেল অসীমা ঠিক বুঝল না; বোঝবার চেষ্টাও সে করল না। ছুটে এসে দু—হাতে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে, আনন্দ—বিগলিত কণ্ঠে ডাকল, ‘বাবা!’

প্রফেসার রায়ের চোখ দুটো বুঝি বাষ্পঘন হয়ে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘ঠিক সময়েই এসে পড়েছি তাই না? কিন্তু এ তুই কি করলি মা? অশোককে কোথায় সরিয়ে দিলি? আমার এতদিনের আশা…এতদিনের সাধনা…’

অসীমা ছোট মেয়ের মতোই আদরের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আমার ওপর রাগ করেছ?’

‘রাগ?’ ম্লান ভাবে হাসলেন প্রফেসার রায়। এই একটা জায়গায় দুর্বলতা তাঁর চিরদিনই রয়ে গেল। বিধাতার প্রতিদ্বন্দ্বী হবার স্পর্ধা যিনি রাখেন, নিজের মেয়ের কাছে হার তিনি বরাবরই মেনে এসেছেন। আজও বুঝি মানতে হল। ক্লান্ত সুরে বললেন, ‘না মা, রাগ নয়, ভয় পাচ্ছি। ওরাংদের আইন যদি তোকে ক্ষমা না করে?’

‘তার জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই, বাবা।’ মিষ্ট হাসি হাসল অসীমা। ‘ওদের আইনে আমায় যদি বলি দিতে বলে, দিক; তবু সভ্য লোকটার প্রাণ যে বাঁচাতে পেরেছি, সেইটুকুই আমার সান্ত্বনা।’

আহত হলেন প্রফেসার রায়। অবোধ মেয়ে বাপের ব্যথা বোঝে না। নাই বুঝুক, তবু একটা সত্য তাঁর কাছে প্রকট হয়ে উঠল। অসীমার যে—মন এতদিন শিশুর মতোই সরল ছিল, আজ সেখানে নারীত্বের বিকাশ ঘটেছে। অশোক সেন তার কাছে শুধু বিপন্ন মানুষই নয়, তারও বেশি আরো কিছু। নিজের অজ্ঞাতসারেই বোধ করি ভালোবেসেছে তাকে।

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ইত্যবসরে পীতাম্বর ইস্পাতের তৈরি তারের ফাঁস দিয়ে তিলোত্তমাকে বেঁধে ফেলেছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘ফিরে যাবে তো, রায়?’

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে প্রফেসার রায় বললেন, ‘হ্যাঁ, চল।’

মেয়ের হাত ধরে আবার বনের গহনে ফিরে চললেন তিনি।

।। দশ।।

ভোরের নরম আলো যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়া ঝর্নার জল। সে—জলে স্নান করছে ডিংপু একলা নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে—শান্ত ভাবে, নিশ্চল দেহে। কোথাও এতটুকু চাঞ্চল্য নেই, কোলাহল নেই। যা কিছু সাড়া পাওয়া যায় নদীর ঘাটে বাঁধা হেমন্তকুমারের স্টিম লঞ্চের ডেকে।

রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আগম দত্ত চোখে দূরবিন লাগিয়েছিল। দেখছিল দূর সমুদ্রের দিকে। দূরবিনটা অবশ্য তার নয়, হেমন্তকুমারেরই। রেবাকে অনুনয় করে চেয়ে নিয়েছিল। কারণ মনের অস্থিরতা সে আর চেপে রাখতে পারেনি।

কিন্তু কুয়াশার অস্বচ্ছ পর্দায় দৃষ্টি তার বারবার অবরুদ্ধ হচ্ছিল। নদীটা যেখানে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে, সেই মোহনা দিয়ে কোনো স্টিম লঞ্চ আসছে কিনা দেখা যায় না।

আগম দত্ত বারবার দূরবিন নামায়, আবার চোখের সামনে তুলে ধরে। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যহারা হয়ে, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘কই, এখনো তো পুলিশ এল না, রেবাদি।’

রেবা ডেকেরই একদিকে বসে স্টোভে চা তৈরি করছিল। হাওয়ার ঝাপ্টা থেকে আগুনের শিখাটা আগলাতে আগলাতে, সে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল, ‘আসবে—আসবে। বাবা তো বলেইছেন যে কোনো মুহূর্তে এসে পড়তে পারে।’

‘তাহলে তো দেখতেই পেতুম।’ অধীর কণ্ঠে বলে ওঠে আগম দত্ত, ‘আমি কি অন্ধ?’

‘কে বলে?’

‘ঠাট্টা নয়, আপনি নিজেই একবার চোখে লাগিয়ে দেখুন না।’

একরকম জোর করেই সে দূরবিনটা রেবার হাতে গুঁজে দেয়।

অগত্যা উঠতেই হয় রেবাকে। দূরবিনটা চোখে লাগাতে লাগাতে বলে, ‘আপনি কিন্তু একচক্ষু হরিণের মতো কেবল জলপথেই তাকিয়ে আছেন। আর যদি ডাঙা পথ দিয়ে আসে?’

একথা আগম দত্তের মাথায় আসা উচিত হয়তো ছিল; কিন্তু আসেনি। তার জন্যে অবশ্য সে বিশেষ লজ্জাও পেলো না। সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই বলল, ‘আপনি দেখুন। আমি ততক্ষণ চা—টা না হয় করে ফেলি।’

রেবা হেসে দূরবিন দিয়ে দেখতে লাগল। প্রথমে অবশ্য নদীর দিকেই তাকাল। পরে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিল ডাঙাপথে। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখভাবের পরিবর্তন ঘটল। সেখানে ফুটে উঠল বিস্ময় আর উত্তেজনার ছবি। হাতের দূরবিনটা নামিয়ে, সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘দেখুন তো—দেখুন তো, আগমবাবু। মনে হচ্ছে যেন একটা লোক ছুটতে ছুটতে এদিকে আসছে…’

‘অ্যাঁ!’ একটা অব্যক্ত ধ্বনি করে উঠে, আগম দত্ত তার হাত থেকে দূরবিনটা প্রায় ছিনিয়েই নিল। চোখে লাগাতে গিয়ে, হাত দুটো কাঁপতে লাগল থর থর করে। তবু কোনোরকমে চেষ্টা করল। মুখে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘কই…হ্যাঁ…না…হ্যাঁ…হ্যাঁ…’

অকস্মাৎ দূরবিনটা প্রায় ছুড়েই ফেলে দিয়ে, সে চিৎকার করে উঠল, ‘অশোক!—রেবাদি, অশোক!’

পাগলের মতোই ছুটতে ছুটতে লঞ্চ থেকে সে ডাঙায় নেমে এল।

সত্যিই অশোক; কিন্তু তখন তার বাহ্যজ্ঞান ছিল না। একটা নেশার ঘোরেই যেন সে চলেছিল।

‘অশোক! সত্যিই তুই অশোক!’ আগম দত্ত দু—হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। অশোক ঘোলাটে দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল; তারপরই তার মাথাটা ঝুলে পড়ল সামনের দিকে।

আগম দত্তের সেদিকে খেয়ালই ছিল না। বিকারগ্রস্ত রোগীর মতোই সে যেন প্রলাপ বকে চলেছে, ‘তুই বেঁচে আছিস…বেঁচে আছিস, অশোক…আবার যে তোকে কোনোদিন দেখতে পাব…’শেষের দিকে গলার স্বরটা তার ভাবাবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।

আগম দত্তকে ওরকম ভাবে ছুটতে দেখে রেবা অনুসরণ করেছিল তাকে। কিন্তু কাছে এসে সে যেন বিস্ময়ের প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো। অব্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘অশোকদা! তুমি!’

অশোকের সহজ জ্ঞানটা ধীরে ধীরে ফিরে আসে। চোখের দৃষ্টিটা তার আগম দত্তের মুখের ওপর ঘুরে বেড়ায়; সেখান থেকে রেবার মুখের ওপর। অস্ফুট কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে, ‘রেবা!’

আগম দত্ত ফ্যাল ফ্যাল করে দুজনের দিকে তাকায়। উচ্ছ্বাসটা তার এবার দেখা দেয় অন্য পথে। বলে ওঠে, ‘অ্যাঁ! তোমাদের আগে থাকতেই চেনা আছে?’

অশোক শুধু হাসল। কোনো কথা বলল না। জবাব দিল রেবা, ‘আছে নয়, ছিল বলাই উচিত; কিন্তু তার জন্যে আপনার আফসোস করার কিছু নেই। ছুটে যান তো। বাবাকে গিয়ে খবর দিন; আর চা—টা করে ফেলুন। আমি অশোকদাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

আর একবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল আগম দত্ত চেঁচতে চেঁচাতে, ‘স্যার! অশোক এসে গেছে… অশোক…’

কেবিনে বসে হেমন্তকুমার দাড়ি কামাবার জন্যে তখন গালে সাবান ঘসছেন। আগম দত্তের ডাকটা কানে যেতেই সব ফেলে তাড়াতাড়ি ওপরের ডেকে উঠে এলেন। রেবার কাঁধে ভর দিয়ে যে যুবকটি আসছিল, তাকে চিনতে তাঁর কিছুমাত্র অসুবিধা হল না। সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি! তুমিই তাহলে…’

কথাটা অসমাপ্ত রেখে তিনি হৈ চৈ করে লোকজন ডাকলেন। অশোককে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতে বললেন কেবিনে। মেয়েকে উপদেশ দিলেন, ‘আমার সাদা ব্যাগে ব্র্যান্ডি আছে। আউন্সখানেক খাইয়ে দে। তারপর কিছু খেতে দিস। এখন আর কোনো কথা নয়। খানিকটা ঘুমুলে তবে সুস্থ হয়ে উঠবে।’

সুস্থ কতকটা অশোক হয়ে উঠল সেই দুপুরের দিকে। শরীরে গ্লানি যে ছিল না, তা নয়; তবু আস্তে আস্তে ওপরের ডেকে এসে বসল।

আগম দত্ত যেন এই সুযোগটুকুরই অপেক্ষা করছিল। অশোকের পাশে বসে কৌতুহলের সুরে বলল, ‘কি করে তোর এমন দশা হল, কোথায় ছিলি, কি করলি সব খুলে বল অশোক। তোর জন্যে সারা সুন্দরবন এলাকা আমরা চষে ফেলছিলুম…’

অশোক কতক্ষণ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তার আগে বল, রমেশ কোথায়?’

জবাব দিতে গিয়ে আগম দত্তের কণ্ঠ রোধ হয়ে গেল। চোখ ছেপে এল জল; কিন্তু হেমন্তকুমার ইঙ্গিত করলেন তার কাছে নিষ্ঠুর সত্যটুকু এখন প্রকাশ না করতে। নিজেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘তাঁকে চলে যেতে হয়েছে কাজে যোগদেবার জন্যে। এবার তোমার কাহিনিটা শুরু কর…’

গোড়া থেকেই শুরু করল অশোক। জ্ঞান হবার পর অসীমার সঙ্গে প্রথম কি অবস্থায় সাক্ষাত হয়েছিল; তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল মেয়েটি; কিন্তু কীভাবে পথ হারিয়ে সে প্রফেসার রায়ের হাতে বন্দি হয়…

অশোক যতই এগিয়ে চলে, সকলের উৎকণ্ঠা, উত্তেজনাও ততই বাড়ে। আগম দত্তের মন্তব্যের আর বিরাম ছিল না—’উঃ!…কী সর্বনাশ!…বলিস কিরে!…সুন্দরবনে আবার আদিবাসী আছে নাকি! এ যে বিশ্বাস হয় না…’

রেবা মাঝে মাঝে ধমক না দিলে সে হয়তো আরও প্রগলভ হয়ে উঠত তার মন্তব্যে। হেমন্তকুমার কিন্তু নীরবেই সবটুকু শুনে যেতে লাগলেন। প্রফেসার রায়ের কীর্তিকলাপ শুনে শুধু একবারই বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, ইনিই সেই বৈজ্ঞানিক।’

অশোক কিছু জানত না বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল; কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই খবর পাওয়া গেল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আসছে। রেবার অনুমানই সত্য। ডাঙাপথেই আসছে তারা।

হেমন্তকুমার উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের উদ্দেশে বললেন, ‘তোরা গল্প কর মা। আমি যাচ্ছি। প্রত্যেক মুহূর্তটা এখন দামি।’

পাটাতন দিয়ে তিনি ডাঙায় নেমে গেলেন; কিন্তু অশোকের কাহিনি বলার উৎসাহ আর রইল না। কি যেন ভাবছিল সে। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমিও যাই কাকার সঙ্গে।’

রেবা বিস্ময়ভরে বলে ওঠে, ‘কোথায়?’

‘কাকার সঙ্গে। অসীমা যে কতখানি ঝুঁকি মাথায় নিয়েছে আমায় পালাবার সুযোগ দিয়ে…’

আগম দত্ত ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘খুব বাহাদুরি হয়েছে, আর কাজ নেই। নিজে বাঁচ আগে, তারপর ‘সিভ্যালরি’ দেখাস।’

‘সিভ্যালরি নয় রে, কৃতজ্ঞতা। আমার জন্যে বেচারার যদি কোনো বিপদ ঘটে…’

রেবা কাছে এসে তার কাঁধে একখানা হাত রাখল। সমবেদনাভরা কণ্ঠে বলল, ‘ব্যস্ত হচ্ছো কেন, অশোকদা। বাবা ফিরে আসুন। ব্যবস্থা যা করবার, ওঁরাই করবেন।’

অশোক আর প্রতিবাদ করতে পারল না। শূন্য দৃষ্টিটা দূরে প্রসারিত করে একখানা ডেক চেয়ারে বসে পড়ল।

হেমন্তকুমার ফিরলেন বেশ খানিকটা পর। বিকালের আলো তখন ধূসর হয়ে এসেছে। একটা ধোঁয়াটে পর্দায় ঢাকা পড়েছে সূর্য। চারদিকে কেমন একটা ম্লান, বিষণ্ণ ভাব।

রেবা এগিয়ে এল বাপের কাছে, দেরির জন্যে বোধ করি তিরস্কার করতে; কিন্তু তাঁর গম্ভীর মুখ দেখে আর কিছু বলতে সাহস করে না। রামকে ডেকে সে চা তৈরি করতে বলল।

ডেকের এককোণে অশোক আর আগম দত্ত বসেছিল। রমেশের মৃত্যু—সংবাদটা আগম দত্ত যে আর চেপে রাখতে পারেনি, বন্ধুকে বলে ফেলেছে—সেটা অশোকের মুখ দেখেই বোঝা গেল।

দুজনের মনে একই চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তিন বন্ধুর মধ্যে দুজন যদি অভাবিত ভাবেই বেঁচে রইল, তাহলে একজন মারা গেল কেন? কার দোষে? রমেশের কোন পাপে ভগবানের এ শাস্তিবিধান?

রাম এসে জানাল চা দেওয়া হয়েছে।

উঠতে হল দু—বন্ধুকে।

চা খেতে খেতেই হেমন্তকুমার তাঁদের অভিযানের কথাটা খুলে বললেন, ‘সন্ধের পরেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। প্রফেসার রায় কাঁচা লোক নন। অশোক পালিয়ে আসায় তিনি নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবেন না; কিন্তু কি যে তাঁর মতলব, আমরা কিছুই জানতে পারছি না। তবে এইটুকু মনে হচ্ছে, আজ রাত্তিরের মধ্যে যদি তাঁর নাগাল না পাই…’

রেবা ভীতি—বিবর্ণ মুখে, ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলে, ‘কিন্তু বাবা, অশোকদার মুখে যা শুনলুম, যদি তা সত্যি হয়…’

সস্নেহ হাসি হাসলেন হেমন্তকুমার। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ভয় পাচ্ছিস?’

‘তিনি যে মানুষ নন, বাবা। পিশাচও বোধ করি তাঁর তুলনায় দেবতা।’

হেমন্তকুমারের মুখের রেখা কঠিন হয়ে উঠল। চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কিন্তু এবার তাঁর লীলাখেলা শেষ হবে, রেবা। অশোককে উপলক্ষ্য করে এত বড় সুযোগ যখন এসেছে, তখন মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভগবানের আশীর্বাদ আছে।’

চায়ের কাপটা আবার তুলে নিয়ে তিনি চুমুক দিলেন।

কতক্ষণ স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে কাটল।

একসময় অশোক মৃদু কণ্ঠে প্রস্তাব করল, আমাকে কেন আপনাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন না, কাকাবাবু? হয়তো কাজে লাগতে পারতুম…’

ধীরে ধীরে কোমল হয়ে আসে হেমন্তকুমারের কঠিন মুখ। সস্মিত হাসি হেসে বলেন, ‘আজ নয়, অশোক। Strain সহ্য করতে পারবে না। রাত্তিরে বিশ্রাম করে নাও। যদি বোঝা যায় তোমার সাহায্য দরকার, তাহলে সকালেই লোক পাঠিয়ে দোব।’

আবার কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

চা—পান শেষ হতেই হেমন্তকুমার উঠে দাঁড়ালেন। মেয়েকে বললেন, ‘এবার আমায় তৈরি হতে হবে, মা। লোকজন পাহারায় রইল। তোদের ভয়ের কিছু নেই; তবু যতটা সম্ভব সাবধানেই থাকিস।’

তৈরি হতে তিনি নীচের কেবিনে নেমে গেলেন।

আগম দত্ত এতক্ষণ মুখ ভার করে বসেছিল, এইবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমি কখনো কারো কাজেই লাগি না। চিরকাল নাবালকই হয়ে রইলুম।’

রেবা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরক্ষণে হাসি থামিয়ে বলল, ‘বাঃ! কে বলে আপনি নাবালক? তাহলে কি বাবা আপনাকে আমাদের গার্জেন করে যেতেন?’

‘গার্জেন? আগম দত্ত মাথা চুলকোয়। নির্বোধের ভঙ্গিতে বলে, ‘আপনার গার্জেন তো অশোক—শুধু এক রাত্তিরের নয়, সারা জীবনেরই।’

রেবার মুখখানা আরক্ত হয়ে উঠল। অশোক ধমকের সুরে বলল, ‘নাঃ! আগম, তুই শুধু নাবালকই নয়, নীল আর লিমপুর মতো অর্ধেক বাঁদর।’

‘শুনলেন—শুনলেন, রেবাদি? কলেজ থেকেই ওরা এই রকম বলে আসছে। রাগ করতে আমি পারি কি না?’

‘উঁহু।’ রেবা কপট কণ্ঠে বলে, ‘সেই পদ্যটা জানেন তো, কে উঁচু বললে, সুবুদ্ধি উড়ায় হেসে?’

অশোক হো হো করে হেসে উঠল, আর কথার অর্থটা বুঝতে গিয়ে অগম দত্ত হাঁ করে তাকিয়ে রইল রেবার মুখের দিকে।

পুলিশবাহিনী নিয়ে হেমন্তকুমার যখন রওনা হয়ে গেলেন, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। লোক—সমাগমে যেটুকু প্রাণের সাড়া ছিল, তাও স্তব্ধ হয়ে গেল। নির্জন বালুতটে নেমে এল রাজ্যের বিভীষিকা।

একটু আগেই জোয়ার এসেছে। ফুলে উঠেছে নদীর বুক। তীব্র স্রোত রুদ্ধ আক্রোশে আঘাত করছে স্টিম লঞ্চের গায়ে—যেন নোঙর ছিঁড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় মাঝ দরিয়ায়। কাঁপছে লঞ্চ সে আঘাতে; হেলছে, দুলছে। লোহার শেকলগুলো আর্তনাদ করে উঠছে কর্কশ শব্দে।

ডেকের ওপরই বিছানা পড়েছিল অশোক আর আগম দত্তের। আপত্তি তুলেছিল রেবা। বলেছিল, ‘কাজ নেই। তুমি বরং নীচের কেবিনে গিয়েই শোওগে অশোকদা। একটা রাত তো; আমি ডেকে বসে পাহারা দিই।’

হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল অশোক, ‘পাগল! পাহারা দেবার জন্যে তো বন্দুক হাতে পুলিশই আছে। তুমি নিশ্চিন্তে নীচে চলে যাও। তাছাড়া পাশেই তো আমাদের গার্জেন রইল।’

কটাক্ষটা যে তাকেই, আগম দত্ত সেটা বুঝল। বেচারা ঘুমে ঢুলছিল; নেহাৎ লজ্জার খাতিরেই এতক্ষণ শুয়ে পড়তে পারেনি। প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে বলল, ‘তার চেয়ে গল্প করেই তোরা দুজনে রাতটা কাটিয়ে দে না, আমি ততক্ষণ একটু গড়িয়ে নিই। কথার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল সে।

হেসে উঠল রেবা আর অশোক দুজনেই; কিন্তু প্রস্তাবটা যে কারোই অমনোনীত হয়নি, সেটা তাদের দৃষ্টি বিনিময় দেখেই বোঝা গেল। দুজনে গিয়ে দুখানা চেয়ার দখল করে বসল।

পাশ ফিরতে ফিরতে আগম দত্ত জড়ানো গলায় বলল, ‘সত্যিই কিন্তু সারারাত গল্প করে কাটাসনি, অশোক। মনে সইলেও শরীরে কিন্তু ধকল সইবে না।’

রেবা মুখ টিপে হেসে, ফিস ফিস করে বলল, ‘ছেলেবেলায় এমনি গার্জেনি তুমি করতে, মনে আছে, অশোকদা?’

অশোক পরিহাস তরল কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আছে বৈকি। কিন্তু এক—এক সময় কি মনে হত জানো? সেসব যেন সত্যি নয়; তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। নিজের মনেই হেসে উঠতুম।’

রেবাও হেসে উঠল; কিন্তু পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, ‘সমস্তটা কিন্তু আজও আমাদের কাছে হেঁয়ালিই হয়ে রইল, অশোকদা। কেন যে হঠাৎ একদিন জ্যাঠামশাই তোমায় নিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হলেন…’

‘আমি নিজেই কি তা জানি?’ গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল অশোক। একটু বিরতির পর আবার বলল, ‘কত দেশ যে আমায় নিয়ে বাবা ঘুরে বেড়ালেন। কোথাও কিন্তু দু—চার দিনের বেশি টিকতে পারেননি। বয়েস তখন আমার কতই বা; তবু মনে হত ঠিক যেন গল্প—কথার ভূত তাঁকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে…’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিটা সে প্রসারিত করে দিল ডিংপুর বালুতটে কিন্তু অকস্মাৎ সেটা আটকে গেল একটা ঝোপের ওপর। মনে হল যেন একটা ছায়ামূর্তি। সন্দেহে, অনিশ্চিত আশঙ্কায় বুকটা তার কেঁপে উঠল। রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কে? কে ও?’

রেবা চমকে উঠল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘কই? কোথায় অশোকদা?’

‘ওই যে ঝোপের পাশে।’ আঙুল বাড়িয়ে দিল অশোক।

রেবা দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্নতর করে তুলল। স্পষ্ট কিছুই বোঝা যায় না; তবে মনে হল একটা বানর যেন বসে আছে।

বসেছিল নীল—প্রফেসার রায়ের সেই বানরটা। ঝকঝকে দাঁতগুলো বার করে সে যেন ব্যঙ্গের হাসি হাসল, তারপর লাফ দিয়ে কোথায় যে অদৃশ্য হল, আর দেখতে পাওয়া গেল না।

রেবা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরিহাস তরল কণ্ঠে বলল, ‘একটা বাঁদর দেখে তুমি ভয় পেলে, অশোকদা?’

‘বাঁদর!’ অশোক অন্যমনস্কের মতোই বলে।

‘ওই তো দেখলে, লাফ দিয়ে পালাল। বনের ভেতর থেকে বোধ হয় ছিটকে এসে পড়েছিল।’

অশোক তবু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। টেনে টেনে বলে ‘কিন্তু মুখ ভেংচাল, দেখলে না। ও সাধারণ বাঁদর নয়, রেবা।’ আমার মনে হচ্ছে নীল। কিন্তু কেন আসবে এখানে?’

কি সে বলতে চায়, রেবা যেন পুরোপুরি বুঝতে পারে না। ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কি তুমি বলতে চাইছ বল তো?’

অশোক কোনো জবাব দিল না; চোখও ফেরাল না।

রেবা তাকে টেনে আনতে আনতে বলল, ‘ও তোমার চোখের ভুল। আতঙ্কটা এখনও তোমার বুকে চেপে আছে তো। চল, গিয়ে শুয়ে পড়বে চল…’

নীচের কেবিনে যাবার সিঁড়ির মুখে এসে রেবা আবার বলল, ‘তুমি কেবিনে গিয়ে শোও গে। আমি রাতটা এখানেই কাটিয়ে দোবো।’

এমন প্রস্তাবে কোন পুরুষ না লজ্জা পায়। জোর করে হেসে উঠে অশোক বলল, ‘পাগল! আমি কি সত্যিই এমন কাপুরুষ যে শেষ পর্যন্ত তোমার আঁচলের তলায় আশ্রয় নোবো?’

‘না হয় খুব বীর পুরুষই হলে। কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমটা তো দরকার।’

‘সেটা হয় কিনা, আদ্ধেক রাত্তিরে এসে বরং একবার দেখে যেও।’

রেবা তবু দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে। বলে, ‘আগমবাবুকে জাগিয়ে দোবো?’

নিজের বিছানায় গিয়ে বসে পড়তে পড়তে অশোক লঘুকণ্ঠে বলল, ‘তাহলে তো রাতে ঘুমের আশা বিসর্জন দিতে হয়। তুমি যাও, নির্ভয়ে চলে যাও। লোকজন তো পাহারায় আছেই।’

তবু ইতস্তত করে রেবা বলে, ‘আবার যদি ভয়—টয় পাও?’

‘কিচ্ছু না। বরাভয় তো দিয়েইছ।’ কথা শেষে অশোক শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রেবা নেমে গেল নীচের কেবিনে।

।। এগারো।।

মেয়ের হাত ধরে ফিরে গেলেও প্রফেসার রায় কিন্তু নিশ্চিন্ত ছিলেন না। মংটুকে একান্তে ডেকে বলেছিলেন, ‘নীলকে সঙ্গে দিচ্ছি। তুমি যতজন ইচ্ছে লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়। এখনও হয়তো অশোক নাগালের বাইরে নয়। যেমন করে পারো, তাকে ধরে নিয়ে আসা চাই—ই।’

মংটু কিন্তু অন্য দিনের মতো হুকুম পালন করতে তৎপর হয়ে ওঠেনি। চোখের দৃষ্টিতে তার বিদ্রোহের ছবি ঘনিয়ে উঠেছিল।

প্রফেসার রায় সেটা লক্ষ করেছিলেন। চতুর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মনে থাকে যেন অশোককে ধরে আনতে না পারলে, তোমাদের আইনে অসীমার শাস্তি মৃত্যু। আর…’

উদ্ধত ভঙ্গিতেই মংটু বলেছিল, ‘কিংনে মালি?’

প্রফেসার রায় বুঝেছিলেন সে কি বলতে চায়। বুঝেই রেখাহীন মুখে জবাব দিয়েছিলেন, ‘যদি আনতে পারো? বেশ, কথা দিচ্ছি অসীমাকে তোমার হাতেই তুলে দোবো।’

আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল মংটু। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বারবার পদ—চুম্বন করেছিল প্রফেসার রায়ের। তারপর নীল আর দলবলকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়েছিল ডিংপুর পথে।

নীল অগ্রদূতের কর্তব্যপালন করেছিল। গাছের মাথায় চড়ে দেখে নিয়েছিল পথ পরিষ্কার আছে কিনা; লঞ্চ থেকে নেমে পুলিশ আসছে কি না। তার কাছে ইঙ্গিত পেয়ে তবে মংটুরা অগ্রসর হচ্ছিল। তাই বলে গতিবেগ তাদের কম ছিল না। বরং উল্কার সঙ্গেই তুলনা করা চলে।

অবশেষে নদীর কিনারায় এসে আত্মগোপন করেছিল তারা। নজর রেখেছিল অপরপক্ষের গতিবিধির ওপর।

সন্ধ্যার পর সশস্ত্র পুলিশবাহিনী রওনা হয়ে গেলে, অন্ধকারে প্রেতের মতোই এগিয়ে এসেছিল নীল। লঞ্চের ডেকে উপবিষ্ট অশোককে দেখতে পেয়ে আনন্দে প্রায় চিৎকার করেই ফেলেছিল আর কি। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে ছুটেছিল মংটুদের খবরটা দিতে।

তারপর শুধু প্রতীক্ষার পালা; পরমক্ষণ আসার জন্যে সজাগ দৃষ্টি মেলে রাখা।

একে একে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। ডেকে শুধু একটা বাতিই জ্বলতে লাগল। রাইফেল হাতে দুজন প্রহরী ডাঙার ওপর পায়চারি করতে করতে পাহারা দিতে লাগল। মাঝে মাঝে তারা রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করে; আর তারপরই চলে তাদের সুখ—দুঃখের আলোচনা।

ধীরে ধীরে সময় কাটতে থাকে।

কেবিনের পোর্টহোল খুলে রেবা এতক্ষণ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। এবার অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে, সেটা বন্ধ করে দিল; তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

মংটু নিঃশব্দে নদীর জলে নামল; জলের বিভীষিকা কামোটের মতই ডুবে ডুবে এগোতে লাগল লঞ্চের দিকে।

গল্পে মত্ত প্রহরীরা তার কিছুই জানতে পারল না।

মংটুর পেছনে পেছন নামল আরও জন কয়েক।

লঞ্চের পেছনে এসে অতি সন্তর্পণে নিজেকে টেনে তুলল মংটু। সতর্ক দৃষ্টিটা একবার বুলিয়ে নিল ডেকের ওপর।

না, সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। প্রহরী দুজন দূরে বসে বিড়ি ধরাতেই ব্যস্ত।

মংটুর ইসারা পেয়ে আরো ক’জন উঠে এল ডেকের ওপর।

যদিও মার্জারের মত লঘু তাদের গতি, তবু রেবার মনে হল ওপরের ডেকে কারা যেন চলে বেড়াচ্ছে। তবে কি অশোক ঘুমোয়নি? আর কে? আগম? কি করছে ওরা?

উঠে পড়ল রেবা। সিঁড়ির গোড়ায় এসে একটু উঁচু গলাতেই বলল, ‘জেগে আছো নাকি অশোকদা?’

ঠিক সেই মুহূর্তে ওপর থেকে ভেসে এল অশোকের ভয়ার্ত চীৎকার। সঙ্গে সঙ্গে ভারি জিনিস জলে পড়ার শব্দ।

রেবা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ডাকল, ‘অশোকদা! অশোকদা!’

জেগে পড়ে আগম দত্তও বিছানায় উঠে বসে চেঁচাচ্ছিল, ‘অশোক! অশোক।’

ওদিক থেকে ছুটে এল প্রহরী দু’জন।

অশোকের বিছানা শূন্য। কোথায় গেল সে? ভয় পেয়ে কোথাও লুকোল নাকি?

রেবা পাগলের মতোই ছুটোছুটি করতে লাগল। ‘অশোকদা! অশোকদা!’

‘নেই?’ আগম দত্ত আর্তকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘কোথায় যাবে?’

রেবা রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘মনে হল কেউ যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল…’

প্রহরীরা প্রতিবাদ করে, ‘তাহলে কি আমরা দেখতে পেতুম না? আর শুধু শুধু জলেই বা ঝাঁপাবেন কেন?’

কারণ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। অশোককে পাওয়া যাচ্ছে না—এটাই তো নিষ্ঠুর সত্য। কিন্তু কোথায় যেতে পারে?

একটা আশঙ্কায়, তীব্র সন্দেহে রেবার কণ্ঠনালি যেন চেপে আসছিল। বলল, ‘যদি ওরা…ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে…’

‘কারা?’ আগম দত্ত ভয়ে, বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে।

‘তা জানি না। একটা বাঁদর…হয়তো প্রফেসার রায়ের দল…’

প্রহরীরা মাথা নেড়ে বলল, ‘অসম্ভব। আমরা হলফ করে বলতে পারি, কেউ এ তল্লাটে আসেনি। এত সাহস কারও হবে না…’

লঞ্চের খালাশিরা ইত্যবসরে তৈরি হয়ে নিয়েছিল। সারেং বলল, ‘তোমরা একজন বন্দুক নিয়ে এখানে পাহারায় থাক। আর সবাই যাও, ছুটে বেরিয়ে পড়ো। দিদিমণি যা বলছেন, যদি তাই সত্যি হয় তাহলেও তারা বেশিদূর যেতে পারেনি। নদীর কিনারা ধরে ছোট সব।’

হৈ হৈ করতে করতে অন্ধকার বালুতট দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকজন।

রেলিং ধরে, পাথরের মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে রইল রেবা। আগম দত্তের চোখের জল অবিরাম পড়েই চলেছিল। এক সময় আর থাকতে না পেরে কান্না ভেজা গলায় সে বলল, ‘সময় নষ্ট না করে তার চেয়ে স্যারকে খবর দিলে হত, রেবাদি।’

কথাটা যে রেবাও না ভেবেছে তা নয়; কিন্তু সুন্দরবনের এই বিরাট এলাকার কোন দিকে গেছেন তাঁরা, এতক্ষণে কতদূরে পৌঁছেছেন, কে জানে? হয়তো ঘুরে মরাই সার হবে; দেখাই হবে না তাঁর সঙ্গে।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রেবা জবাব দিল, ‘লোকজন আগে ফিরে আসুক। দেখি কি খবর আনে…’

আর কিছু বলার আগেই কণ্ঠ তার রোধ হয়ে গেল। হায়রে! এ যে মিথ্যে মনকে প্রবোধ দেওয়া, এ সত্য রেবার চেয়ে আর বেশি কে জানে?

নিরুপায় কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল আগম দত্ত।

।। বারো।।

সকালের আলোয় ঝকঝক করছিল প্রফেসার রায়ের কাঠের বাড়িখানা। রাতের অন্ধকার গায়ে মেখে এতক্ষণ যেন অশুচি হয়েছিল, স্নান করে এখন শুচিশুদ্ধ হয়েছে।

নিজের গবেষণাগারে প্রফেসার রায় খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে শূন্য উদাস দৃষ্টি। কপালে মানসিক যাতনার রেখাগুলো বড় বেশি গভীর হয়ে ফুটে উঠেছে। একটি রাতেই মনে হচ্ছে যেন বয়েস তাঁর অনেক বেড়ে গেছে।

এককোণে গ্যাসের বাতিটা অনর্থকই জ্বলছে। পাশেই একটা কাচের পাত্রে তরল রসায়ন। হয়তো নতুন কোনো পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর শক্তিতে কুলোয়নি।

বন্ধ দরজায় এক সময় ঘা পড়ল; কিন্তু প্রফেসার রায়র কানে তা গেল না। এবার ঘা এর সঙ্গে ভৃত্য কিংলীর ডাক এল, ‘পারিয়া!’

শুনতে পেলেন প্রফেসার রায়। নিজেকে যেন টেনে আনলেন অন্য জগৎ থেকে। একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

দু’ গ্লাস দুধ হাতে কিংলী ঘরে ঢুকল। ছোট টেবলটার ওপর সেগুলো ধরে দিয়ে, আবার নীরবেই সে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণে প্রফেসার রায়ের খেয়াল হল গ্যাস বাতিটা মিছিমিছিই জ্বলছে। গিয়ে নিভিয়ে দিলেন সেটা; তারপর একটা গ্লাস ঢেকে রেখে, অন্যটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন ওপরে। সোজা দেহটা যেন সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পা দুটোকে মনে হয় ভারী পাথর; টেনে তুলতে বুকে হাঁফ ধরে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রফেসার রায় একবার জিরিয়ে নিলেন; তারপর উঠে এলেন দোতলার বারান্দায়।

নির্জন বারান্দাটা খাঁ খাঁ করছে। আজকেই যেন বিশেষ করে সেটা আঘাত করল প্রফেসার রায়কে। এমন তো আরো কতদিন শূন্য বারান্দা পার হয়েছেন; তার জন্যে ব্যথা বোধ করেননি তো। তবে কি নিছক মনের দুর্বলতা?

সচেতন হয়ে উঠলেন প্রফেসার রায়। না, এ দুর্বলতা তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সৃষ্টির তপস্যা তাঁর। সেখানে মায়া নেই, মমতা নেই। স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা সব তুচ্ছ। তবু…

বুকের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল। গ্লাস হাতে কাঠের চেয়ারখানায় বসে পড়লেন প্রফেসার রায়।

বৈজ্ঞানিক তিনি। এতকাল সৃষ্টির তাৎপর্যই খুঁজে বেড়িয়েছেন। পেয়েছেন কি? কেন তাহলে পাখিদের কাকলি শুনে আজ মনে হচ্ছে প্রভাতের বন্দনা গাইছে ওরা। এতদিন তো ভেবেছেন নিছক জৈব তাড়নার অভিব্যক্তি ছাড়া ওটা আর কিছু নয়। দিনের পর দিন দেখেছেন, গাছগুলো মাটি থেকে রস টেনে নিয়ে, মাথা খাড়া করে উঠছে। মনে মনে তারিফ করেছেন তিনি। Survival of the fittest. বাঁচতে হলে এরকম স্বার্থপরতাই চাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওরা ঊর্ধ্ববাহু তপস্বী। জগতের কল্যাণের জন্যেই তপস্যা করে চলেছে। ওরা বঞ্চিত করে না; আহরণ করে বিতরণের জন্যে।

কোণের ঘর থেকে ভেসে আসে মিষ্টি গলার গুনগুনানি। চমকে ওঠেন প্রফেসার রায়। অসীমা গান গাইছে। আশ্চর্য! এ অবস্থায় কি করে গাইছে! মনে সুরের দোলা লাগে কি করে? আজ সবই যেন ব্যতিক্রম। এতদিন যা ভেবে এসেছেন, জেনে এসেছেন, তার কোনোটার সঙ্গেই মেলে না।

দুধের গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসার রায়। কাঠের বারান্দায় যাতে শব্দ না ওঠে, সেই ভাবে সন্তর্পণে হেঁটে, কোণের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, মেঝের ওপর বসেছিল অসীমা। হাতে পায়ে তার লোহার শেকল বাঁধা। কিন্তু তার জন্যে এতটুকু ক্ষোভের বা দুঃখের চিহ্ন নেই তার মুখে। কোন যাদুমন্ত্রে যেন লোহার শেকল ফুলের মালা হয়ে গেছে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রফেসার রায়।

বাবাকে দেখে অসীমা গান থামাল। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘তোমার দুঃখ হচ্ছে, বাবা?’

প্রফেসার রায় ম্লান ভাবে হাসলেন। গ্লাস হাতে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘দুঃখ? কি জানি, আমি নিজেই তা বুঝতে পারছি না মা। ভেবেছিলুম, শোক দুঃখ জয় করেছি, মানুষের সস্তার ভাবালুতা আমার নেই; কিন্তু কতটুকুই বা বুঝি আমরা।’

তিনি থামলেন। গ্লাসটা মেয়ের সামনে নামিয়ে রেখে, গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘যে আইনের ফাঁস আমি নিজের হাতেই তৈরি করেছিলুম, তা যে কোনোদিন আমার গলাতেই চেপে বসবে…’ কথা শেষ করার আগেই কণ্ঠ তাঁর রোধ হয়ে গেল। মেয়ের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি।

অসীমা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাপের দিকে। জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত যাঁকে দেখছে, তিনি যে তাকে কতখানি ভালোবাসেন, আজ বুঝি এই প্রথম তার পরিচয় পেলো। মমতায় ভরে উঠল তার বুকখানা। মিনতিমাখা কণ্ঠে বলল, ‘একবারটি খুলে দাও না, বাবা।’

প্রফেসার রায় পিঠে যেন চাবুকের ঘা খেলেন। ফিরে দাঁড়িয়ে ব্যথাহত কণ্ঠে বললেন, ‘না মা, না, সে অধিকার আমার নেই।’

অসীমার চোখে সরল কৌতুক। বলল, ‘কেন বাবা? তুমি না পারিয়া?’

‘হ্যাঁ, আমি পারিয়া—ওরাংদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তবু ওরা আজ আমায় বিশ্বাস করে না; তাই সন্দিগ্ধ, সজাগ দৃষ্টিগুলো সব সময় আমার ওপর ফেলে রেখেছে…’

দূর থেকে ভেসে এল তিলোত্তমার চিৎকার, ‘এ…ই…ই…ল…লা…ও…ও…’ সেও যেন বিদ্রুপ করে উঠল।

প্রফেসার রায় দুধের গ্লাশটা আবার তুলে নিলেন। মেয়ের কাছে আসতে আসতে, কতকটা আপন মনেই বললেন, ‘অসভ্য হলেও, স্নেহ যে মানুষকে দুর্বল করে তুলতে পারে, এ সত্যটুকু ওদের অজানা নয়।’

অসীমা কোনো কথা বলল না; অনুরোধও করল না আর। শুধু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

তিলোত্তমার চিৎকারটা দূর থেকে আবার ভেসে আসে।

কেন আজ এত অশান্ত হয়ে উঠেছে? কি চায় ও?

প্রফেসার রায় ফিরে তাকালেন মেয়ের দিকে। মনে মনে কল্পনা করে নিলেন তিলোত্তমার ছবিটা। একজন বিধাতার সৃষ্টি; আর একজন তাঁর নিজের হাতের। তুলনা করতে গিয়ে লজ্জা পেলেন যেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এ—কাজ না করলেই পারতিস, মা। অশোককে বাঁচাতে গিয়ে নিজের মৃত্যুটা এমনি ভাবেই ডেকে না নিলে পারতিস।’

অসীমা বড় বড় দুই চোখের সরল দৃষ্টিতে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ওকে যে আমার খুব ভালো লেগেছিল, বাবা।’

নতুন করেই যেন একটা চমক খান প্রফেসার রায়। ভালো লেগেছিল? ভালো লাগা আর ভালোবাসায় কতটুকু তফাত অসীমার মত অজ্ঞ মেয়ের কাছে? অথচ এ তিনি চাননি। সভ্য জগতের কোনো লোককে যে সে ভালোবাসে, এ তিনি কোনোদিনই চান নি। আহত কণ্ঠে ডাকলেন, ‘অসীমা!’

অসীমা বাপের মনোভাবটা বোধ হয় সঠিক বুঝল না। খুশি—উচ্ছল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সত্যি বলছি, বাবা, তোমার পর এত ভালো আর কাউকে আমার লাগেনি।’

‘কেন তাহলে পালালি না?’ হতাশায় প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রফেসার রায়। ‘কেন নিজেকে এভাবে ধরা দিলি? যদি—যদি মংটু অশোককে ধরে নিয়ে আসে!’

অসীমা এমন ভাবে চমকে ওঠে যে হাতের শেকল বেজে ওঠে ঝম ঝম করে। তীক্ষ্ন কণ্ঠে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি বললে? মংটু ধরে নিয়ে আসবে অশোককে? তুমি আনতে পাঠিয়েছ? কি করবে তাকে নিয়ে? কি করেছে সে তোমার?’

কণ্ঠে তার যেন বিদ্রোহের সুর ঘনায়। প্রফেসার রায় বিচলিত ভাবে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

অকস্মাৎ কাড়া—নাকড়া বড় জোরেই বেজে ওঠে; সেই সঙ্গে ‘ওরাং’ নরনারীর উৎকট উল্লাসধ্বনি সমস্ত বনটাকে যেন কাঁপিয়ে তুলল।

প্রফেসার রায় বোঝেন এর অর্থ। সর্বাঙ্গ থর থর করে কেঁপে উঠল তাঁর। ছুটেই বারান্দায় বেরিয়ে ঝুঁ^ঁকে পড়লেন সামনের দিকে। না, অনুমান তাঁর মিথ্যে নয়। রজ্জুবদ্ধ আশোককে নিয়ে আসছে মংটু। তাদের ঘিরে ‘ওরাং’ নরনারীরা বীভৎস নৃত্য শুরু করেছে। পৈশাচিক উল্লাসের অভিব্যক্তি।

নড়তে পারেন না প্রফেসার রায়। সর্বাঙ্গ তাঁর যেন অবশ হয়ে গেছে। যে সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, সে যে এমন অভিশাপের মূর্তিতে দেখা দেবে, তা কি ভাবতে পেরেছিলেন?

এগিয়ে আসছে মংটু অশোককে নিয়ে। চোখ—মুখ তার ভাবী পুরষ্কারের লোভে যেন জ্বলজ্বল করছে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘পারিয়া! পারিয়া!’

আর অপেক্ষা করা যায় না। নিজেকে জোর করেই যেন সচেতন করে তুললেন প্রফেসার রায়। ধীর, দৃঢ় পায়ে নীচে নেমে এলেন।

অশোককে টানতে টানতে তাঁর সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল মংটু। উল্লসিত কণ্ঠে বলল, ‘নে ছিও—নে ছিও।’

প্রফেসার রায় রেখাহীন মুখে বললেন, ‘আমি জানতুম তুমি পারবে, মংটু। কী যে খুশি করেছ আমায়!’

মংটু লুটিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের গোড়ায়। বারবার চুম্বন করতে করতে বলল, ‘রাংতে না ফা…’

পুরষ্কার চাইছে মংটু। চাইতে পারে বৈকি। সে তার কথা রেখেছে। তাঁকেও রাখতে হবে তাঁর কথা।

কণ্ঠস্বরটাকে যতটা সম্ভব অকম্পিত রেখেই প্রফেসার রায় বললেন, ‘হ্যাঁ, দোব—অসীমাকে তোমার হাতেই তুলে দোব।’

দুর্ভাবনায়, ক্লান্তিতে অশোক এতক্ষণ যেন প্রাণহীন পুতুলের মতোই দাঁড়িয়েছিল। প্রফেসার রায়ের কথাটা কানে যেতেই ভীষণভাবে চমকে উঠল। নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে যিনি এমন ভাবে ছিনিমিনি খেলতে পারেন, তিনি আর যাই হন, প্রকৃতিস্থ নন। আহত জন্তুর মতোই সে গর্জন করে উঠল, ‘কক্ষনো না—আমি তা হতে দোব না। যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে…’

‘প্রাণ! বাধা দিয়ে প্রফেসার রায় শ্লেষের হাসি হেসে উঠলেন। কিন্তু সে হাসি তাঁর আচমকাই থেমে গেল, যখন অশোক সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দড়ির বাঁধনটা ছিড়ে ফেলল। শিকারি পশুর মতোই সে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল প্রফেসার রায়ের ওপর; কিন্তু তার আগেই মংটু আর তার দলবল ধরে ফেলল তাকে।

প্রফেসার রায়ের মুখে কিন্তু এতটুকু বিকৃতি ঘটল না। ইস্পাতের মতোই শান্ত কঠিন কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমার ভাগ্য ভালো, অশোক সেন, যে আমার গায়ে হাত দাওনি। দিলে…’

কথাটা অসমাপ্ত রেখে তিনি পকেট থেকে বাঘের নখের মতো সেই অস্ত্রটা বার করে নিয়ে সজোরে আঘাত করলেন অশোককে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল অশোক। মনে হল দেহের প্রত্যেকটি স্নায়ু পর্যন্ত যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঝিম ঝিম করতে লাগল মাথার ভেতর। পৈশাচিক হাসি হেসে উঠলেন প্রফেসার রায়। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘আর একবার, অশোক সেন। তাহলে শুধু দেহটাই নয়, মনও তোমার পঙ্গু হয়ে যাবে…’

সত্যি সত্যিই তিনি আবার আঘাত করলেন অশোককে। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সংজ্ঞাহারার মতই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

উল্লাসে হৈ হৈ করে উঠল ‘ওরাং’ নরনারীরা।

মংটুর দিকে তাকিয়ে প্রফেসার রায় আদেশ দিলেন, ‘নিয়ে যাও আমার ঘরে।’ তারপরই সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে গেলেন। অসীমা অভুক্ত আছে। দুধটুকু তাকে খাওয়াতেই হবে।

।। তেরো।।

অসীম সাহসেরই কাজ করে বসল রেবা। কোনো কথা শুনল না; কারও বারণ মানল না। রওনা হল সুন্দরবনের গভীরে—বাপের সন্ধানে। অশোককে যে ধরে নিয়ে গেছে, সে খবরটা তাঁকে দেওয়া চাই—ই।

লঞ্চের লোক—লস্কর নিবৃত্ত করবার অনেক চেষ্টা করল; প্রহরীরা আপত্তি জানাল, বিনা ওপরওলার হুকুমে তারা এখান থেকে এক—পাও নড়তে পারবে না। রেবার কিন্তু এক কথা—’আমি যাবই। বিপদ ঘটে ঘটুক, তবু হাত—পা গুটিয়ে বসে থাকতে আমি পারব না।’

একমাত্র এগিয়ে এল আগম দত্ত। বলল, ‘রমেশ গেছে; অশোকও এবার যাবে। তাহলে আর এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? মরতে হয়—আমিও মরব।’

ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র সঙ্গী নিয়ে রেবা লঞ্চ থেকে নেমে এল ডাঙায়। সাধারণ শাড়িখানা আঁট—সাঁট করে পরা। কাঁধে ফ্লাস্ক। চোখে সানগ্লাস।

আগম দত্ত একটু খুঁতখুঁত করে, ‘একটা বন্দুক শুধু থাকলেই আর কোনো ভাবনা থাকত না।’

সত্যিই তাদের যাত্রা করতে দেখে প্রহরীরা বা লঞ্চের লোক—লস্কর শেষ পর্যন্ত নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারল না। নিজেদের মধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলল তারা। একদল সাথী হল রেবার।

গন্তব্যস্থানের কোনো ঠিকানা নেই। কোথায়, কোনোদিকে গেলে যে হেমন্তকুমারের সন্ধান পাওয়া যাবে, তাও অজ্ঞাত। তবু বালির সমুদ্র মাড়িয়ে এগিয়ে চলল সবাই।

বালির সমুদ্র যেখানে এসে থমকে থেমেছে, সেই বনানীর সীমানায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে।

এবার কোন পথে যাবে তারা?

সবাই যেন থিতিয়ে যায়। উৎসাহ উত্তেজনার মাথায়, বাস্তব দিকটা পুরোপুরি ভাবতে পারেনি তারা।

পায়ে চলা পথের সরু রেখাটা দেখিয়ে রেবা বলল, ‘ওই পথ ধরেই আমাদের এগোতে হবে।’

‘তার চেয়ে ভাগ হয়ে গেলে হয় না?’ একজন প্রস্তাব করে।

শিউরে ওঠে আগম দত্ত। ভীত কণ্ঠে বলে, ‘পাগল! ক’জন লোকই বা আমরা। এর ওপর ভাগাভাগি হলে তো বাঘ—ভালুকেই বনভোজন করে ফেলবে।’

এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পায় রেবার। কিন্তু দ্বিধার সময় নেই। পায়ে চলা পথ ধরেই এগোতে এগোতে সে বলল, ‘কপালে যা আছে, তাই হবে। মোট কথা ও নিয়ে আর একটা মিনিটও দেরি করা উচিত নয়।’

বন্দুকধারী যে প্রহরীটি সঙ্গে ছিল, সে এগিয়ে এল। বলল, ‘আমাকে আগে যেতে দিন। কোথায় কি আছে বলা তো যায় না।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও পেছিয়ে আসে রেবা।

বেলা যত বাড়ে, বনও তত গভীরতর হয়। কেমন একটা ভ্যাপসা গরমে শরীরের ভেতর আনচান করে। কপালের ঘামে চোখের দৃষ্টি রুদ্ধ করে দেয়। ক্লান্ত বোধ করে আগম দত্তই সব চেয়ে বেশি। কিন্তু রেবার সামনে সেটা স্বীকার করতে চায় না। আর চায় না বলেই, গোপনে ফ্লাস্কটা খুলে ভেতরের পানীয়টা ঘন ঘন মুখে ঢালে।

রেবা দেখে সবই। হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘বেহিসেবি হবেন না, আগমবাবু। ফুরিয়ে গেলে, মাথা কুটলেও এখানে জল পাবেন না।’

ঠিক দুপুরের সময় প্রহরীটি দাঁড়িয়ে পড়ল। রেবাকে বলল, ‘আর এগোনো কি ঠিক হবে, মেমসাহেব?’

কারণটা বুঝতে না পেরে, রেবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে আবার বলল, ‘সাহেবের দেখা পাব কি না পাব, ঠিক নেই তো। কিন্তু সন্ধের আগে আমাদের ফিরতেই হবে।

কথাটায় যে যুক্তি আছে, এটা সকলেই মনে মনে স্বীকার করে নিল। আগম দত্ত একবার তাকাল আকাশের দিকে; বোধ করি সূর্যের পরিস্থিতি দেখে বেলার আন্দাজটা করতে চায়।

রেবা ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবছিল। একসময় প্রহরীটির দিকে ফিরে বলল, ‘থামলে চলবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তুমি বরং মাঝে মাঝে ফাঁকা আওয়াজ করো, বিন্ধ্যা সিং। বাবারা কাছাকাছি থাকলে হয়তো শুনতে পাবেন। ওঁরাও যদি সেখান থেকে উত্তর দেন, তাহলে সব গোল তো মিটেই গেল।’

এক গাল হেসে বিন্ধ্যা সিং মেম সাহেবের বুদ্ধির তারিফ জানাল এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকটার নল শূন্যে তুলে ফাঁকা আওয়াজ করল।

কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা। না, কোনো দিক থেকে কোনো জবাব এল না।

নিরাশ হল অল্পবিস্তর সকলেই। বিন্ধ্যা সিং বোধ করি আশা ছাড়েনি। আবার একবার ফাঁকা আওয়াজ করল।

সেই উৎকণ্ঠাভরা মুহূর্ত, তবে মাত্র কয়েকটিই। বহু দূর থেকে ভেসে এল গুলির আওয়াজ।

আনন্দে লাফিয়ে উঠল আগম দত্ত। ছেলেমানুষের মতোই হাততালি দিতে দিতে বলল, ‘পাওয়া গেছ—পাওয়া গেছে…গুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে, রেবাদি। স্যার কাছাকাছিই আছেন।’

রেবা ততক্ষণে আওয়াজের দিক লক্ষ্য করে, লম্বা লম্বা পা ফেলতে শুরু করেছে।

উৎসাহ, আনন্দ কারোই কম নয়। বিন্ধ্যা সিং আরো একবার ফাঁকা আওয়াজ করে ফেলল। ওপাশ থেকে তার জবাবও এল।

আর কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশবাহিনী থাক বা না থাক, হেমন্তকুমার ওখানেই আছেন।

সন্ধ্যার অন্ধকারের জন্যেই তাঁবু ফেলে, অপেক্ষা করছিলেন হেমন্তকুমার পুলিশবাহিনী নিয়ে।

গত রাত্রে পথ হারিয়েছিলেন তাঁরা। সারারাত ঘুরে ভোরের অলোয় দেখলেন প্রায় সেই জায়গাতেই পৌঁছেছেন। দিনের আলোয় এগোনোটা উচিত হবে না ভেবেই তাঁবু ফেলেছিলেন।

গুলির আওয়াজ পেয়ে প্রথমটা তাঁরা হকচকিয়ে গেছলেন। ভেবেছিলেন প্রফেসার রায়ের অনুচররাই বুঝি আক্রমণ করতে আসছে। প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিলেন সবাই; কিন্তু দ্বিতীয় বার গুলির আওয়াজ আসতেই সে ভুল তাঁদের ভেঙে গেল। পুলিশ অফিসার মিঃ বসু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘এ তো আমাদের লোক বলেই মনে হচ্ছে, মিস্টার মিত্র। হঠাৎ এখানে—এ সময়ে…’

কথা তাঁর শেষ হবার আগেই হেমন্তকুমার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো জরুরি খবর আছে। জনচারেক কনস্টেবল নিয়ে চলে আসুন আমার সঙ্গে…’

ওঁরা ওদিক থেকে রওনা হলেন আওয়াজ লক্ষ করে। সুতরাং পরস্পর মিলিত হতে দেরি হল না। কিন্তু রেবা যে কোনো কারণেই এই দুর্গম অরণ্যে আসতে পারে, হেমন্তকুমার তা কল্পনাও করতে পারেননি। দূর থেকেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘রেবা! তুই!’

ছুটতে ছুটতে রেবা এসে তার বাপের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, কাল রাত্তিরে ওরা অশোকদাকে ধরে নিয়ে গেছে…’

‘কাকে? অশোককে? কখন? কি করে?’

সবাই প্রায় একসঙ্গেই বলতে গিয়ে উত্তরগুলো আরো জটিল করে তুলল। অবশেষে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, হেমন্তকুমার মিঃ বসুকে বললেন, ‘কি করা উচিত এখন, মিস্টার বোস?’

মিঃ বসু গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আর একটা মিনিটও দেরি করা উচিত নয়। অশোকবাবুকে ধরে যখন নিয়ে গেছে, তখন মতলবটা যত তাড়াতাড়ি পারে, ওরা হাসিল করবারই চেষ্টা করবে। তার আগেই যেমন করে হোক, ওদের আস্তানা খুঁজে বার করে হানা দিতে হবে।’

সে সম্বন্ধে হেমন্তকুমারেরও দ্বিমত ছিল না। কিন্তু তার আগে রেবাকে ফেরত পাঠাতে হবে। তিনি তাগাদা দিলেন, ‘তুই আর দেরি করিসনি, মা। এই বেলা সবাই মিলে রওনা হয়ে যা; নইলে সন্ধের আগে লঞ্চে ফিরতে পারবি না।’

রেবা আপত্তি জানায়, ‘তোমাদের সঙ্গেই থাকি না, বাবা…’

হেমন্তকুমার একেবারে শিউরে উঠলেন, ‘না, না, কি বলছিস তুই পাগলের মতো! যেখানে পায়ে পায়ে বিপদ, জীবন সব সময়ে হাতের তোলোয় নিয়ে এগোতে হয়…’

বাধা দিল রেবা, ‘বিপদ বুঝি খালি আমার একলার বেলাই। তোমাদের বিপদ ঘটতে পারে না? সেটা জেনেও আমায় চোখ বুজে থাকতে বল? তাছাড়া লঞ্চে গিয়ে থাকলেই, প্রফেসার রায়ের দলবল যে নতুন করে হানা দেবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে?’

কথাটার মধ্যে যুক্তি ছিল বলেই, হেমন্তকুমার চট করে কোনো জবাব দিতে পারলেন না।

মিঃ বসু কিন্তু সায় দিয়ে বললেন, ‘মিস মিত্র ঠিকই বলেছেন। প্রতিহিংসায় মানুষ না করতে পারে, এমন কোনো কাজ নেই।’

‘তবু…’ হেমন্তকুমার মেয়েকে সঙ্গে নেবার প্রস্তাব যেন সহজ মনে গ্রহণ করতে পারেন না।

রেবা সেটা বুঝে আদরের সুরে বলে, ‘তোমাদের মধ্যেই তো সবচেয়ে নিরাপদে থাকব, বাবা। আর বিপদ যদি আসে, একসঙ্গেই মুখোমুখি দাঁড়াব। অনিশ্চিতের দুর্ভাবনাটা তো থাকবে না।’

সেটাও বড় কথা; সুতরাং হেমন্তকুমার আর কোনো ওজর—আপত্তি করলেন না।

মিঃ বসু পুলিশবাহিনীকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। শুরু হল অভিযান—নিঃশব্দ; বিপসঙ্কুল।

।। চোদ্দো।।

মন্দিরের পেছন দিকে বসে ‘ওরাং’ নারীরা অসীমাকে বিশেষ সাজে সাজাচ্ছিল। বিচিত্র সব প্রসাধনের উপকরণ। ফুল, লতা, পাতা থেকে শুরু করে ভেষজ তেল পর্যন্ত তার মধ্যে ছিল।

প্রফেসার রায় তাঁর কথা রেখেছেন। অসীমাকে আজ রাতে তুলে দেবেন মংটুর হাতে।

এ—রকম বিয়ে এর আগে হয়নি। সভ্য অসভ্যের মিলন। তার চেয়ে বড় কথা ওরাংরা জেনেছে এতে ‘পারিয়া’র পরাজয়; জয় তাদেরই। তাই নাচ—গানে উৎসব রজনীকে তারা বীভৎস করে তুলেছিল।

মাথা হেঁটে করে বসেছিল অসীমা। কি যে ঘটছে বা ঘটতে চলেছে—সে সম্বন্ধে তার কোনো বোধই যেন ছিল না। চিরদিন সুন্দরবনের বুকে এই ওরাংদের মাঝেই মানুষ হয়েছে, কিন্তু কখনো এক হতে পারেনি। একা একাই স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে; দরকার হলে হুকুম করেছে মানুষগুলাকে। পৃথক একটা সত্তা ছিল বৈকি। আজ যদি সেটা হারাতেই হয়, তার জন্যে কোনো দুঃখ নেই; শুধু অশোক যদি নিরাপদ হত, মুক্তি পেত নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে।

মশালের আলোয় চকচক করে উঠল তার চোখ দুটো।

কিন্তু ভাবালুতার কোনো দাম নেই ওরাংদের কাছে। ওদের হৃদপিণ্ড আছে; হৃদয় নেই। চোখে যদি জল দেখা দেয়, সেটা নেহাৎই দৈহিক কারণে; মানসিক যাতনায় নয়।

কেউ বুঝল না তার চোখের জলের অর্থ। প্রসাধন শেষে টেনে তুলল তাকে। চারদিক ঘিরে নিয়ে চলল মন্দিরের সামনের দিকে।

মংটুকে ঘিরেও একইভাবে নাচগান করে চলেছে ওরাং পুরুষরা। বিশেষ সাজে তাকেও সাজানো হয়েছে।

হাড়কাঠের পাশেই একটা অগ্নিকুণ্ড করা হয়েছে। তাতে লেলিহান শিখায় আগুন জ্বলছে। সামনে দাঁড়িয়ে পীতাম্বর। আজকের এ আসুরিক অনুষ্ঠানে পুরোহিতই হোতা। প্রফেসার রায় অপ্রয়োজনীয়।

অসীমাকে সেখানে এনে হাজির করানো হতেই পীতাম্বর আদেশের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘সিনাকা লে হু ওরেঙ্গা—সিনাকা লে হু…’

আগে দেবতা ওরেঙ্গার কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর সময় নেই। তাছাড়া যে কোনো মুহূর্তে বিঘ্ন আসতে পারে পুলিশের তরফ থেকে।

সকলে মংটু আর অসীমাকে নিয়ে চলল মন্দিরের ভেতর।

গবেষণাগারে বসে বসেও অশোকের কানে সে শব্দ গিয়ে পৌঁছল। অর্থটুকুও বুঝতে বাকি রইল না তার। কিন্তু নিরুপায় সে। হাত—পা তার লোহার শেকলে বাঁধা। তবু অসহ্য ক্রোধে ফেটে পড়ল একসময়, ‘আপনি মানুষ নন, পিশাচ; তাই বিয়ের নামে নিজের মেয়েকে এই নারীমেধ যজ্ঞে বলি দিচ্ছেন…’

কঠিন একটা অস্ত্রোপচারের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন প্রফেসার রায়। আরকে ভিজছিল বিচিত্র আকারের কতকগুলো অস্ত্র। ওদিকে গ্যাসের ওপর বসানো একটা পাত্রে রাসায়নিক ফুটছিল। হাতে বাঁধা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করছিলেন তিনি। মুখ ফিরিয়ে ভারী গলাতেই তিনি জবাব দিলেন, ‘ভুল করছ, অশোক সেন। যজ্ঞে আহুতি না দিলে সিদ্ধিলাভ হবে কি করে?’

ঝম ঝম করে বেজে উঠল অশোকের হাতের শেকল। আহত জন্তুর মতোই গর্জন করে উঠল সে, ‘বলতে লজ্জা হল না আপনার? মানুষের কোনো বৃত্তিই কি অবশিষ্ট রাখেননি? মায়া, মমতা, সন্তান—স্নেহ সব বিসর্জন দিয়েছেন?’

শ্লেষের হাসি হাসলেন প্রফেসার রায়। পরুষ কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের শাস্ত্রকারেরা যা বলে গেছেন, ভুলে গেছ, না পড়ইনি? সংসারের সব কিছুই তো মিথ্যে মায়া। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা যেমন বন্ধনের কারণ; মৃত্যু ঠিক তেমনি জীর্ণ—বস্ত্র ত্যাগ। তাহলে দুঃখ করব কেন? কার জন্যে? বিধাতার আসন দখল করার স্পর্ধা যে রাখে, তাকে তো নির্মম হতেই হবে, অশোক সেন।’

শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা তাঁর অতি অকস্মাৎই রুদ্ধ হয়ে এল।

অশোকের কানে যেন বেসুরো বাজল সেটা। এতো আত্মশ্লাঘা ঠিক নয়; অন্তরের বেদনা বিকৃত রূপটাই তিনি সযত্নে গোপন করতে চান। কিন্তু কেন? পরাজয়ের লজ্জাটা গোপন করতে কি?

ক্রোধের বদলে দু’চোখে বিস্ময় ভরে অশোক তাকিয়ে থাকে।

প্রফেসার রায় একবার ফুটন্ত রসায়নটা পরীক্ষা করলেন,; কাঁচের ঢাকনা খুলে আরকের পাত্রে আরও খানিকটা আরক ঢেলে দিলেন। তারপর গিয়ে দাঁড়ালেন জানলার কাছে। ওরাংদের নৃত্যগীত তখন উদ্দাম হয়ে উঠেছে। তার অর্থ অসীমাকে মন্দির থেকে নিয়ে আসা হয়েছে অগ্নিকুণ্ডের কাছে। এরপর পীতাম্বর সম্প্রদান করবে তাকে মংটুর হাতে। হাজার হাজার বছর পেছিয়ে যাবে অসীমার জীবন। যে যুগে মানুষ পাহাড়ের গুহায় বাস করত, বাস করত গভীর অরণ্যে, সেই অন্ধকার যুগ থেকেই আবার শুরু করতে হবে! আদিম, বর্বর এক ওরাংএর ঘরণী হবে সে। শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতির কোনো মূল্যই আর থাকবে না।

ভাবতে পারেন না, অসীমার এমন জান্তব—জীবন ভাবতে পারলেন না প্রফেসার রায়।

শিউরে উঠে, জানলার পাশ থেকে ছুটে এলেন তিনি। অশোকের সামনে দাঁড়িয়ে তীব্রকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কাওয়ার্ড, অশোক সেন। পালালেই যদি, কেন তাহলে অসীমাকে সঙ্গে নিলে না? তাহলে আজ আমাকে নিজের হাতেই নিজের মেয়েকে বলি দিতে হত না। না হয় আমার সাধনা ব্যর্থ হয়ে যেত—না হয় failure হওয়ার দুঃখ ভুলতে আমি আত্মহত্যাই করতুম…’

অশোক বিমূঢ়ের মতোই তাকিয়ে থাকে। মনে হয় সত্যি সত্যিই সে হয়তো অপরাধী। পুরুষ সে। অসীমার অনুরোধ কেন নির্দ্বিধায় মেনে নিল? কেন অতীত দিনের যোদ্ধার মতোই বলপ্রয়োগে হরণ করল না দুর্বল নারীকে।

প্রফেসার রায় হিংস্র শ্বাপদের মতোই তাকিয়েছিলেন তার দিকে। যে কোনো মুহূর্তে বুঝি শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। দাঁতে দাঁত ঘষে তিনি বললেন, ‘বিধাতার সৃষ্টি এই জগৎকে ভেঙে চুরে দিতে চেয়েছিলুম অশোক সেন। হাজার হাজার তিলোত্তমার মতো দানবের পক্ষে সেটা এমন কিছু ক্ষতি হত না। তোমাদের নিউক্লিয়ার বোমারও শক্তি ছিল না তাদের ধ্বংস করে। কিন্তু সে কেন? কেন আমি, প্রফেসার রায়, মানুষের সব বৃত্তি হারিয়ে পিশাচ হয়ে উঠলুম? তোমার বাপের জন্যে—আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ সেন…’ উন্মাদের মতো হা—হা করে হেসে উঠলেন তিনি।

অশোক কিন্তু ভাবছিল অসীমার কথা; তাই আচমকা অনুরোধ করল, ‘আমার শেকলটা খুলে দিন। প্লিজ! আপনি আমি চেষ্টা করলে হয়তো অসীমাকে এখনও বাঁচাতে পারি…’

প্রফেসার রায় অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন, ‘Black art ? ম্যাজিক দেখিয়ে বাঁচাবে তাকে? কিন্তু এ তোমার শহর নয়। পালাবার মতো পিচে—মোড়া রাস্তা নেই। তাছাড়া…’

থামলেন তিনি। অশোক মিনতি—করুণ কণ্ঠে আবেদন জানাল, ‘অসীমা পথ চেনে। সে ঠিক আমাদের নিয়ে যেতে পারবে। please, আর দেরি করবেন না—শেকলটা খুলে দিন…’

সে শেষ করবার আগেই প্রফেসার রায় বোমার মতোই ফেটে পড়লেন, Stop your jabbering, you skunk! তোমার শেকল খুলে দিলে অসীমার মা আমায় ক্ষমা করবেন না। না, অসীমার জন্যেও নয়।’

চোখ দুটো তাঁর আগুনের ফুলকির মতোই জ্বলতে লাগল। দু—হাতে দাড়িগুলো পাকাতে পাকাতে তিনি ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগলেন। গ্যাসের ওপর চাপানো রাসায়নিক থেকে একটা সোঁ সোঁ শব্দ উঠতে লাগল। হয়তো মিশ্রণের সময় পার হয়ে গেছে, কমে গেছে জলীয় ভাগের পরিমাণ; কিন্তু সেদিকে তাঁর খেয়ালই রইল না।

অশোক অনর্থক জেনেই আর শেকল খুলে দেবার অনুরোধ জানাল না। ভাগ্যের হাতেই নিজেকে সঁপে দিয়ে স্থাণুর মতোই বসে রইল।

প্রফেসার রায় এক সময় অশোকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সে অস্থিরতা আর তাঁর ছিল না। চোখের আগুন নিভে গিয়ে, কেমন একটা নিষ্প্রভ ঘোলাটে দৃষ্টি ঘনিয়ে উঠেছে। বহূ দূর থেকে যেন ভেসে আসছে, এমনই কণ্ঠে তিনি বলে চললেন, ‘বিধাতার প্রতিদ্বন্দ্বী সত্যিই আমি একদিন হতে চেয়েছিলুম, অশোক সেন; কিন্তু সে শুধু মানুষের কল্যাণের জন্যেই। শুভ বুদ্ধিই ছিল আমার। ছিল বৈজ্ঞানিকের সাধনা, প্রতিভা; কিন্তু তোমার বাবাই আমাকে অমানুষ করে তুলল। ভাবতে পারো কত বড় আঘাত পেলে তবে বৈজ্ঞানিক হয় পিশাচ?’

অশোক কোনো জবাব দিল না। তার বুকের ভেতর রক্তস্রোতটা যেন আচমকাই থেমে গেল।

প্রফেসার রায় মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ থেকে আবার বলে চললেন, ‘বাইরের সবাই জানে অসীমার মা রোগে ভুগে মারা গেছেন; কিন্তু সেটা সত্যি নয়, অশোক সেন। ঘৃণায়, লজ্জায় তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন…’

‘আত্মহত্যা!’

‘হ্যাঁ, আর তার কারণ তোমার বাবা। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়েছিল সে। দুষ্ট গ্রহের মতোই আমার সংসারে ঢুকে…’ ক্রোধে, অকথ্য ঘৃণায় কণ্ঠ তাঁর রোধ হয়ে গেল।

কণ্ঠ যেন অশোকেরও রুদ্ধ হয়ে আসছিল। কোনো রকমে বলে উঠল, ‘কি বলছেন আপনি? আমার বাবা…’

‘হ্যাঁ, অরুণ সেন। And I was a fool, নৃতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলুম, অথচ মানুষই চিনিনি। চিনতে পারলুম যখন, তখন অসীমার মা আত্মহত্যা করেছেন। তাঁকে বাঁচাতে যদি তোমার মায়ের জীবনটা হরণ করে থাকি, তাহলে কি অন্যায় করেছি, বলতে চাও?’

অশোক বিস্ফারিত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। লঞ্চে বসে হেমন্তকুমার যে কাহিনি শুনিয়েছিলেন, কিছু বিকৃত তথ্য থাকলেও, সেটা তাহলে মিথ্যা নয়। এই লোকটিই তার মাকে হত্যা করেছে, প্রেতের মতোই তাড়া করে নিয়ে বেড়িয়েছে তার বাপকে; আর আজ অভিশাপের মতোই দেখা দিয়েছে তার জীবনে। কিন্তু কেন, কথামালার গল্পের সেই নেকড়ে বাঘ আর মেষ শাবকের মত, বাপের অপরাধে তাকে শাস্তি পেতে হবে কেন? প্রতিহিংসা কি মানুষকে এমনই বিকৃত—বুদ্ধি, উন্মাদ করে তোলে? সেই প্রশ্নটাই অশোক করে, ‘কিন্তু আমাকে বলিদান দিতে চান কেন? সে কি ওই দানব তিলোত্তমার মস্তিষ্কে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি জাগিয়ে তুলতে?

‘কতকটা তাই, অশোক সেন; কিন্তু সবটা নয়। তুমি ছাড়াও সভ্য মানুষের অভাব নেই দেশে। তাদের কোনো একজনকে ধরে আনাও আমার পক্ষে অসাধ্য ছিল না। কিন্তু তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয় তুমি অসীমার ভাই…’

আর একবার ঝনঝন করে বেজে উঠল লোহার শেকল। অসহ্য বিস্ময়ে অশোক চিৎকার করে উঠল, ‘কি বললেন? আমি—আমি অসীমার ভাই!’

কিন্তু তার উত্তর দেবার অবসর আর মিলল না। জানলা—পথে দেখা গেল নীলের মুখ। ত্রস্ত, ভীতকণ্ঠে সে বলল, ‘পুলিশ—পুলিশ ঘিরে ফেলেছে—এগিয়ে আসছে…’

প্রফেসার রায় অবিশ্বাসের সুরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘কি করছিলে তোমরা? কেন আগে খবর দাওনি?’

নীল হাসল; সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল তার। বলল, ‘তোমার মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে মংটুর সঙ্গে দিচ্ছো কেন?’ পরক্ষণে লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

অন্ধ রোষে ফুলতে লাগলেন প্রফেসার রায়। তীরে এসে এমনি ভাবেই তরী ডুববে? এত দিনের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে? না, এত সহজেই তিনি পরাজয় মানবেন না। আর মানতেই যদি হয়, একজন পুলিশকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দেবেন না।

দূর থেকে উপর্যুপরি কয়েকটা গুলির শব্দ ভেসে এল। সেই সঙ্গে ওরাংদের বিশৃঙ্খল কোলাহল, ভয়ার্ত চিৎকার। নীল তাহলে সত্য খবরই দিয়েছে।

একরকম ছুটেই তিনি গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে গেলেন, অশোকের দিকে ফিরেও তাকালেন না।

অসহায় অশোক নীরবেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল পুলিশ যেন অসীমাকে মংটুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

তার প্রার্থনা বোধ করি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছেছিল। ঠিক সময়েই এসে পড়ল পুলিশবাহিনী। পীতাম্বর তখন অগ্নিসাক্ষ্য রেখে বিচিত্র ভাষায় মন্ত্রপাঠ করছে। পাথরের মূর্তির মতোই সামনে দাঁড়িয়েছিল অসীমা। পাশে মংটু। অভীষ্ট সিদ্ধির উল্লাসে চোখ দুটো তার জ্বলছিল। বিঘ্ন ঘটল পুলিশের অতর্কিত আবির্ভাবে। থেমে গেল নাচ—গান। আতঙ্কগ্রস্ত ওরাংরা চিৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারল, পালাতে শুরু করল। যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল, তারই সুযোগে মংটু অসীমার দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে অন্ধকার বনপথে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু রেবার নারী—চোখকে এড়াতে পারল না। সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা, পালাচ্ছে—একটা মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে। ওই বোধ হয় অসীমা।’

বজ্রকণ্ঠে হেমন্তকুমার হুঁসিয়ার করে দিলেন মংটুকে। থামতে আদেশ করলেন; কিন্তু মংটু বুঝলও না, থামলও না। সঙ্গে সঙ্গে হেমন্তকুমারের বন্দুক গর্জন করে উঠল। পায়ে আঘাত পেয়ে মংটু পড়ে গেল মাটিতে। অসীমা ছিটকে পড়ল বেশ খানিকটা দূরে। উঠে দাঁড়াবার বারকয়েক চেষ্টা করল মংটু। হয়তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতও কিন্তু তার আগেই দুজন কনস্টেবল এসে বন্দি করে ফেলল তাকে।

রেবা এসে বুকে টেনে নিল অসীমাকে। সে তখন প্রায় সংজ্ঞাহারা। অপ্রধান চরিত্র নিয়ে নাটক সৃষ্টি আগম দত্ত সহ্য করতে পারে না। সে অধীর কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘কিন্তু অশোক কোথায়? অশোক?’

অসীমা চোখ মেলে তাকাল। ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল গবেষণাগারটা। পুলিশবাহিনীর এক অংশ নিয়ে ছুটলেন হেমন্তকুমার। মিস্টার বসু তখন ওদিকে নরনারী নির্বিশেষে ওরাংদের বন্দী করে চলেছেন।

বাইরে যে একটা কিছু ঘটে চলেছে, সেটুকু বুঝেছিল অশোক; কিন্তু নিরুপায় হয়ে বসে থাকা ছাড়া তার আর করবার কিই বা আছে? অনিশ্চিত প্রতীক্ষার এক একটি মুহূর্ত, মনে হয় যেন, এক একটি যুগ। হঠাৎ বিকট শব্দে গ্যাসের ওপর বসানো কাচের পাত্রটা ফেটে গেল।

চমকে উঠল অশোক। ফিরে তাকিয়ে দেখল দীপ্ত, লেলিহান হয়ে উঠেছে আগুনের শিখা। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। হয়তো তাকেও গ্রাস করতে ছুটে আসবে। আসুক! কতটুকু ক্ষতি বৃদ্ধি তাতে? প্রফেসার রায়ের শিকার না হয়ে যদি অগ্নিদেবেরই শিকার হয়?

এগিয়ে আসছে লেলিহান শিখা। লোলুপ রসনা মেলে বড় তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছে। চোখ ফেরাতে পারে না অশোক। মনের মধ্যে কবিতার একটা ছত্রই বার বার গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘মরণ রে! তুঁহু মম শ্যাম সমান!’

দড়াম করে দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন হেমন্তকুমার। পেছনে অস্ত্রধারী পুলিশ। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘অশোক! অশোক! সত্যিই তুমি।’

অশোক নির্বোধের মতো শুধু তাকিয়ে থাকল। কিন্তু নষ্ট করবার মতো সময় নেই। আগুন তখন বেড়াজালের মতোই ঘিরে ফেলে আনন্দে যেন নৃত্য শুরু করেছে।

উন্মাদের মতোই সকলে শেকলে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলেন। একসময় খসে গেল লোহার বাঁধন। অশোককে টানতে টানতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তাঁরা। পরক্ষণে ধোঁয়ায় আর বিস্ফোরণে যেন প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়ে গেল।

নিরাপদ স্থানে এসে সকলে পৌঁছতেই, অসীমাকে নিয়ে রেবা আর আগম দত্ত এসে দাঁড়াল।

অসীমার চোখ দুটো যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অশোকের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার বাবা—বাবা কোথায়?’

তার প্রশ্নের জবাবেই যেন ঠিক এই সময়, তিলোত্তমার বিকট হুঙ্কার ভেসে এল, ‘আ—আ—ই—ই—ল—লা—ও—ও—’

সে আওয়াজে থর থর করে কেঁপে উঠল গভীর অরণ্যের বুক। ডানা ঝাপটে কলরব করে উঠল ভয়ার্ত পাখির দল। অস্ত্রধারীদের হাতের অস্ত্রও বুঝি মুহূর্তের জন্যে খসে পড়ল।

হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল মন্দিরের দেওয়াল। আরণ্যক প্রাণীদের চিৎকারে ভরে উঠল আকাশ—বাতাস। পরক্ষণে সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে এল তিলোত্তমা। কাঁধে তার প্রফেসার রায়ের নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে আছে। দক্ষযজ্ঞের পর সতীর দেহ কাঁধে যেন রুদ্র ভৈরব।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে সকলে তাকিয়ে রইলেন। মিস্টার বসু নিজেকে কোনোরকমে সচেতন করে তুলে আদেশ দিলেন, ‘ফায়ার’। একসঙ্গে গর্জন করে উঠল একাধিক রাইফেল। অব্যর্থ লক্ষ্য। আর একবার বিকট গর্জন করে উঠল তিলোত্তমা, ‘আ—আ—ই—ই—ল—লা— ও—ও—’ তারপরেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

তবু চট করে কারও কাছে যেতে সাহস হল না। ছুটে গেল অসীমাই প্রথম। বাপের নিষ্প্রাণ দেহটার ওপর লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

এগিয়ে এলেন সবাই। দূর থেকে যেটা বোঝা যায়নি, কাছে এসে সেটাই প্রত্যক্ষ করে তাঁরা শিউরে উঠলেন। প্রফেসার রায়ের দেহটা ছিন্ন ভিন্ন—যেন তীক্ষ্ন অস্ত্র দিয়ে চিরে চিরে ফেলা হয়েছে। একটা চোখ নেই; বেরিয়ে এসেছে অন্ত্র। রক্তে ভিজে জট পাকিয়ে গেছে কাঁচা—পাকা দাড়িগুলো।

অশোক কতকটা যেন আপন মনেই বলল, ‘তিলোত্তমার কীর্তি। ওকে বিজ্ঞানী দানবের শক্তি দিয়েছিলেন; কিন্তু মস্তিষ্ক দিতে পারেননি। তাই নিজের সৃষ্টির হাতেই এমন শোচনীয়ভাবে প্রাণ দিতে হল।’

হেমন্তকুমার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একটি কথাই শুধু বললেন, ‘বিজ্ঞানীরা যখন ভুল পথে চলে, তখন কল্যাণের বদলে এমনিভাবেই অকল্যাণ দেখা দেয়; সৃষ্টির বদলে লয়।’

রেবা গিয়ে ইত্যবসরে অসীমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘শোক করে তো লাভ নেই, বোন। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই।’

মিস্টার বসুর ওপর বাকি কাজটুকুর ভার দিয়ে, হেমন্তকুমার সকলকে নিয়ে ফিরে চললেন নদীর ঘাটে—যেখানে লঞ্চ বাঁধা আছে।

ভোরের আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে গাছের মাথায়। পেছনে পড়ে রইল অগ্নিদগ্ধ গবেষণাগার। হতশ্রী, করুণ, এক বিকৃত, ব্যর্থ জীবনের নীরব সাক্ষী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *