ফড়িং
ফড়িং তোমাদের খুব জানাশুনা পোকা। রাত্রিতে সবুজ ফড়িংরা হঠাৎ আলোর কাছে আসিয়া কি-রকম নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকে, তোমরা দেখ নাই কি! বসিয়াই ইহারা ঘোড়ার মাথার মত লম্বা মাথাটা গম্ভীরভাবে নাড়িতে থাকে। কখনো আবার সম্মুখের পা দুখানি মুখের মধ্যে পুরিয়া আস্তে আস্তে চিবাইতে থাকে। মুখের কাছে পাতা বা অন্য কিছু রাখিলে ভয় পায় না; বেশ নিশ্চিন্ত ভাবে সেগুলিকে মুখের ভিতরে পুরিয়া দেয়। তার পরে হঠাৎ ফড়্-ফড়্ করিয়া যেখানে-ইচ্ছা উড়িয়া যায়।
আতসী কাচ দিয়া একটা ফড়িঙের মুখের আকৃতি একবার দেখিয়া লইয়ো। মুখের উপরে ও নীচে দুখানা ওষ্ঠ, খাদ্য চিবাইয়া খাইবার জন্য দুটা করাতের মত দাঁত এবং চিবাইবার জন্য দুইটি চোয়াল স্পষ্ট দেখিতে পাইবে। পতঙ্গমাত্রেরই মুখে এই ছয়টা অঙ্গ থাকে, একথা তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি। মশা মাছি প্রজাপতি ইত্যাদির মুখের এই অঙ্গগুলি কোনোটা লম্বা হইয়া, কোনোটা ছুঁচ্লো হইয়া শুঁড় ও ছুঁচ্ ইত্যাদির আকার পাইয়াছে। কিন্তু ফড়িঙের মুখের অঙ্গ বেশি বদ্লায় নাই।
এখানে ফড়িঙের একটা ছবি দিলাম। বুকের তিনটি আংটি হইতে কি-রকমে তিন জোড়া পা বাহির হইয়াছে, ছবি দেখিলেই তোমরা তাহা বুঝিতে পারিবে। ফড়িঙের সম্মুখের দুই জোড়া পা ছোট। এইগুলি দিয়া ইহারা চলিতে পারে। পিছনের দুখানা পা খুব লম্বা। ইহারা এই পায়ের উপরে জোরে ভর দিয়া লাফালাফি করে; এই লম্বা পায়ে হাঁটার সুবিধা হয় না।
ফড়িঙের মাথার দুই পাশে যে দুটা চোখ আছে, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহাদের চোখ মাছির চোখের মত বড় নয়। প্রধান চোখ ছাড়া ইহাদের মাথার উপরে আরো তিনটা ছোট চোখ আছে। সকল ফড়িঙের মাথাতেই দুটা শুঁয়ো লাগানো থাকে। স্ত্রী-ফড়িঙের লেজের শেষে হুলের মত একটা অঙ্গ দেখা যায়। ইহা ডিম পাড়িবার যন্ত্র। এই হুল মাটির তলায় প্রবেশ করাইয়া প্রত্যেক ফড়িং প্রায় এক-শত দেড়-শত ডিম পাড়ে। কিছু দিন মাটির তলায় থাকার পরে, সেগুলি হইতে ফড়িঙের ছোট বাচ্চা বাহির হয়। বাচ্চাদের প্রথমে ডানা থাকে না। কাজেই তাহারা উড়িতেও পারে না; কেবল লাফাইয়া চলা-ফেরা করে। কচি ঘাস পাতাই বাচ্চাদের প্রধান আহার। খাইয়া মোটা হইলেই ইহারা খোলস ছাড়িতে আরম্ভ করে। পাঁচ-ছয় বার খোলস ছাড়ার পরে, বাচ্চাগুলি ডানা-ওয়ালা সম্পূর্ণ পতঙ্গ হইয়া দাঁড়ায়।
ফড়িঙের কান বড় মজার জিনিস। বড় প্রাণীদের কান মাথার উপরেই লাগানো থাকে, কিন্তু ফড়িংদের কান দেহের সেখানে দেখিতে পাওয়া যায় না। সাধারণ ফড়িঙের সম্মুখের পা পরীক্ষা করিলে, তাহাতে একটু নীচু গোলাকার জায়গা দেখা যায়। ইহাই ফড়িঙের কান। কোনো ফড়িঙের কান আবার পায়ের গোড়ায় অর্থাৎ বুকের উপরেও বসানো থাকে।
সকল ফড়িঙেরই যে রঙ্ সবুজ ও পিছনের পা লম্বা তাহা নয়। মেটে লাল্চে ধোঁয়াটে প্রভৃতি নানা রঙের ফড়িং দেখা যায়। আবার সম্মুখের পা লম্বা ও পিছনের পা ছোট এ-রকম অনেক ফড়িং আছে। গাছের তাজ পাতা ও কচি ঘাস যে-সকল ফড়িঙের খাদ্য, তাহারা প্রায়ই সবুজ রঙের হয় এবং মাঠের শুক্নো ঘাস ও খড়ের মধ্যে যাহারা লুকাইয়া থাকে, তাহাদের রঙ্ মাটি ও শুক্নো ঘাসের রঙের মত হয়। পাখী ব্যাঙ্ প্রভৃতি প্রাণীরা ফড়িঙের পরম শত্রু। তাই ঘাস পাতার সঙ্গে রঙ্ মিলাইয়া ইহারা শত্রুদের ফাঁকি দেয়।
গঙ্গা ফড়িং তোমরা দেখ নাই কি? ইহাদের সম্মুখের দুখানা পা খুব লম্বা। সরু গলার উপরে ছোট মাথাটি বসানো থাকে। আমরা ঘাড় বাঁকাইয়া যেমন পাশের জিনিসপত্র দেখি, ইহারাও সেই রকমে ঘাড় বাঁকাইয়া চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া লয়। ছোট পোকা-মাকড় সম্মুখে পাইলে, তৎক্ষণাৎ তাহা ধরিয়া খাইয়া ফেলে। ইহাদের সম্মুখের পায়ে করাতের দাঁতের মত ধারালো কাঁটা লাগানো থাকে। ছোট পোকা সম্মুখে পাইলে তাহারা সেই কাঁটা-লাগানো পায়ে চাপিয়া পোকাগুলিকে পিষিয়া নষ্ট করে। জাঁতির মধ্যে সুপারি দিয়া আমরা যেমন সুপারি কাটি, ধারালো পায়ের ফাঁকে ফেলিয়া উহারা সেই রকমে পোকা-মাকড়কে মারিয়া ফেলে। এই রকমে গঙ্গা ফড়িংরা প্রতিদিন গাদা গাদা পোকা মারিয়া খায়।
গঙ্গা ফড়িংরা বড় ঝগড়াটে। দুইটা ফড়িং একত্র হইলে পরস্পর ভয়ানক লড়াই বাধিয়া যায় এবং যতক্ষণ পর্য্যন্ত দুইয়ের মধ্যে একটা না মারা পড়ে, ততক্ষণ পূরা দমে লড়াই চলে। লড়াইয়ে জিতিয়া ইহারা বিপক্ষের মৃত দেহ ফেলিয়া রাখে না। আধ-মরা অবস্থাতেই সেটিকে পায়ের ফাঁকে পিষিয়া খাইয়া ফেলে। ইহারা ছোট প্রজাপতির ভয়ানক শত্রু, প্রজাপতি ধরিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ সেগুলিকে খাইয়া ফেলে। যদি তোমরা এই ফড়িং ধরিবার চেষ্টা কর, তবে সাবধানে থাকিয়ো। সুবিধা পাইলে কামড় দিতে ছাড়িবে না। বিদেশী মানুষকে একা পাইলেই আফ্রিকার অসভ্য লোকেরা তাহাদিগকে খাইয়া ফেলিত। তোমরা হয় ত অনেক বইয়ে এই-রকম মানুষ-খেগো লোকের গল্প শুনিয়াছ। এখন আর মানুষকে মানুষ খাইতে দেখা যায় না।; কিন্তু ইতর প্রাণীদের মধ্যে এই স্বভাব আজও আছে।
এখানে আর এক-রকম ফড়িঙের ছবি দিলাম। তোমরা নিশ্চয়ই এই রকম পোকা বাগানের শুক্নো ঘাসের চিত্র ৬৮
ঘাসের মত ফড়িং মধ্যে দেখিয়াছ। দেখিলে মনে হয় যেন, ইহারা এক একটি শুক্নো ঘাস। কিন্তু ভালো করিয়া দেখিলে ইহাদিগকে ফড়িং ভিন্ন আর কিছুই মনে হইবে না। শুক্নো ঘাসের রঙের সঙ্গে নিজের গায়ের রঙ্ মিলাইয়া ঠিক ঘাসের মত চেহারায় ইহারা মাঠে পড়িয়া থাকে। এই জন্য পাখী ব্যাঙ প্রভৃতি শত্রুরা ইহাদিগকে প্রাণী বলিয়া চিনিতে পারে না। এই ফড়িংরাও ছোট পোকা-মাকড় ধরিয়া খায়।
গোবরে পোকা ও মাছির বাচ্চারা নোংরা জিনিস খাইয়া আমাদের অনেক উপকার করে। কিন্তু ফড়িদের কাছে আমরা সে-রকম কোনো উপকারই পাই না। অপকার করাই ইহাদের স্বভাব। বাগানের গাছপালা ইহাদের জ্বালায় নষ্ট হইয়া যায়। হয় ত তোমরা পঙ্গপাল দেখিয়া থাকিবে। লক্ষ লক্ষ ফড়িং লইয়া ইহাদের এক একটা দল হয়। যখন পঙ্গপাল আকাশ দিয়া উড়িয়া চলে, তখন মনে হয় যেন একখানা মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে। কোনো শস্যের ক্ষেত্রে পড়িলে সেখানকার একটি গাছও আস্ত রাখে না। সাধারণ ফড়িং ও পঙ্গপালের অত্যাচারে পৃথিবীর নানা দেশের যে কত ক্ষতি হয়, তাহার হিসাবই হয় না।
ফড়িংরা যখন সন্ধ্যার সময়ে উড়িতে আরম্ভ করে তখন একবার ফড়্-ফড়্ শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়। এই শব্দ ইহারা মুখ দিয়া করে না। উড়িবার সময়ে উহাদের পায়ের গায়ে সম্মুখের ডানা জোড়াটা ঘষা পাইয়া ঐ রকম শব্দ উৎপন্ন করে।