ফটিচার
অনেক রাত হয়েছে। রাত এগারোটা হবে। শহরতলির বড় রাস্তা ফাঁকা হয়ে এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ দোকানপাট। শীতটা এখনও যায়নি। যাই যাই করছে। তবু এখনও সন্ধের পরই সবাই ঢাকা-ঢুকি দিতে আরম্ভ করে। রাতটা জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। জবুথবু হয়ে পড়েছে কম্বল মুড়ি দিয়ে। আস্তানা খুঁজছে রাস্তার কুকুরগুলি। মৌরসী আস্তানা নিয়ে একটু দাঁত খিচুনি কিংবা সামান্য আঁচড়াআঁচড়িও চলছে। হোটেলখানাগুলি বন্ধ হয়নি একেবারে। গোছগাছ, ধোয়া-মোছা চলেছে। রুটি স্যাঁকার তন্দুরগুলি হাঁপাচ্ছে। কেউ কেউ হাঁপাচ্ছে তন্দুরের উপরের জায়গাটা দখলের জন্য। শীতে ওম হবে অনায়াসে।
রাস্তাটা এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। আকাশের তারাগুলি শীতে কুঁকড়ে আড়াল হয়ে যাচ্ছে কোথায়। রাস্তার বাতিগুলি শীতে স্থবির।
সুরটা বেজে উঠল এ সময়ে। প্রায়ই বাজে। অল্প উত্তরে হাওয়া। শব্দটা ধিকিয়ে ধিকিয়ে বাইরে আসে। গলি থেকে আসে শব্দটা। পুরনো রেকর্ডের বাজনার মতো। একটু ধরা ধরা গলা। কিন্তু মিষ্টি কাঁচা গলা। গলার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতও কম নয়। পিয়ানো জাতীয় একটা কিছু আছে সঙ্গে। গিটারের কাঁপা কাঁপা গোঙানি। আর ড়ুগি-তবলা। ড়ুগিটা একটু বেশি বুং বুং করে।
গান বাজছে তেরো নম্বর গলিতে। দি নমিতা সাইকেল ওয়ার্কস-এ। টিনের চালাঘর। একটা পাকা ঘরের দেয়াল থেকে চালাটা নেমে এসেছে রাস্তার ধারে। ছিটে বেড়ার ঝাঁপ খোলা। ভেতরে -একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। বাইরে একটা কালো রঙের টিনে লেখা আছে, দি নমিতা সাইকেল ওয়ার্কস। নীচে, ‘সাইকেল, রিকশা, ও লাইট গ্রামোফোন সুলভে মেরামত করা হয়। প্রোঃ শ্রীরতনলাল পাঠক’। কথাগুলি প্রায় ছবি হয়ে গেছে। নমিতার ‘ন’ যদি ‘ছ’ ইঞ্চি হয়ে থাকে, তা হলে ‘মি’ তিন ইঞ্চির বেশি নয়। লেখক স্বয়ং প্রোঃ শ্ৰীরতনলাল পাঠক। ন্যাকড়ার তুলি দিয়ে গভীর অধ্যবসায়ের ফল ওটা। মরচে-পড়া টিনের চালার সঙ্গে মেশামেশি করে আছে। বিশেষ কারও নজরে পড়ে না। চেনা বামুনের পৈতে অপ্রয়োজনীয়। সাইনবোর্ডটা সেই রকম।
চারটে সাইকেল রিকশা চালাঘরটা জুড়ে রয়েছে। এক পাশে নড়বড়ে টেবিল, তার উপরে ময়লা খাতা, পেন্সিল, হ্যারিকেন। সামনে একটা টুল। পেছনে পাকা ঘরের দেয়াল। দুটো সিঁড়ি উঠলে বন্ধ দরজা। দরজার নীচে খানিকটা জায়গা মেরামতের জন্য ফাঁকা।
ফাঁকা জায়গাটাতে বসে গান হচ্ছে। হ্যারিকেনের আলোতেও বোঝা যাচ্ছে না কটি লোক বসে আছে। যেখানে একজোড়া ঠ্যাং ঠিক তার নীচেই একটি মাথা। মাথার পাশেই আবার একটা পিঠ কিংবা বুক! এই মানুষের পিণ্ডটা প্রদক্ষিণ করলে টের পাওয়া যায়, জনা চারেক জড়াজড়ি করে আছে। তিনজন মুখে হাত দিয়ে সঙ্গত করছে বিচিত্র স্বরে। ঠোঁট আর জিভেই তাদের যন্ত্রসঙ্গীত। বাকি একজন গান করছে। হঠাৎ শুনলে মনে হয় পুরনো রেকর্ড বাজছে।
গানটা যখন জমে উঠেছে, তখন পাকা ঘরের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এল রতনলাল। আর একটি মুখ উঁকি মারল দরজার আড়াল থেকে। মেয়ে-মুখ। একমাথা রুক্ষ চুল, খসা ঘোমটা আর ছোট ছোট চোখ। এক মুহূর্ত। তাকাতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
গান বন্ধ হল না। সুরটা স্তিমিত হল একটু। জট-পাকানো মানুষের পিণ্ডটা একটু নড়ল। আটটি চোখ রতনলালকে দেখল একবার। আবার গান হতে লাগল পুরো দমে। রীতিমতো ভাব দিয়ে দিয়ে,
সাথী ছোড় গয়ী
অব কহাঁ বাসরা আপনা–
রতনলাল ঘাড় কাত করল। চোখ বুজে মাথা নাড়ল বার কয়েক। কেঁপে কেঁপে উঠল লোমহীন ভ্রূ জোড়া। মনে হল গানের সমঝদার সে। খুঁটে খুঁটে বিচার করছে যেন। মোটা শরীরটা দুলছে। শীতে বিশেষ কাবু নয় সে, বোঝা যাচ্ছে। গায়ে একটি মাত্র শার্ট। তাও বুক খোলা। চুলগুলি উলটে পড়তে গিয়ে থমকে আছে যেন। কাপড় পরেছে মালকোঁচা দিয়ে।
গানে বাধা না দিয়ে সে এসে বসল তার টুলে। গান শেষ হল। গাইয়ে-বাজিয়ের দল বসল সারি সারি।
রতনলাল চোখ বুজেই বলল, বা, চমৎকার, পয়সা দিলে শোনা যায় না এরকম।
গলাটা চাপা আর সরু রতনের। স্বরটা চেহারার মতো নয়। কিন্তু গলার স্বরটা গম্ভীর আর মোটা করার জন্য সবসময় যে থুতনিটা প্রায় বুকে ঠেকিয়ে কথা বলে। তাতে মোটা না হোক, বিকৃত শোনায়। সে যেন কীসের ঘোরে সব সময় আচ্ছন্ন। নাক কুঁচকে, চোখ পাকিয়ে আবেগ ও উত্তেজনাপূর্ণ তার চলা-ফেরা।
হঠাৎ দাঁড়াল উঠে। তর্জনী নেড়ে বলল, পিল্লু, হ্যাঁ পিল্লু এরকম গাইত। গলার মধ্যে তার একটা মায়া ছিল। জেল ওয়ার্ডারদের পর্যন্ত ভুলিয়ে দিত গান গেয়ে। তার মানে? বলেই একবার মাথা ঝাঁকানি দিল রতন। তার মানে, বনের বাঘ পোষ মেনে যেন সেই সুরে। খেলা নয়, জেল-পাহারাদার ভুলে যেত।
সেই চারজনেই ভূতের মতো ছায়া হয়ে গেছে রতনের ছায়ার আড়ালে। একজন বলে উঠল, আচ্ছা?
হাঁ, হাঁ। রতন আরও উদ্দীপ্ত হল। বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, তা বলে ওই সব গান?
সাথী ছোড় গয়ী? আরে ছোঃ। শালা, জনানার কামা! ও-সব সাথী তো শালা বেইমান। সিনেমাতে ওরা খুব ভাল। আমরা রাজবন্দিরা পিল্লুকে নতুন গান শিখিয়ে দিলাম, বলে বুক টান করে দাঁড়াল রতন। রাজবন্দি, মানে? বিপ্লবী। এই আমি, খোদ শিখিয়ে দিলাম, বললাম, পিল্লু, তুই চোর, কিন্তু তোর জিন্দেগী বদলে যাবে, এমন গান শেখাব। গা আমার সঙ্গে।
রতন ঘাড় নামিয়ে, চোয়াল ফুলিয়ে নিজেই গান ধরে দিল,
আশমান মে ঝান্ডা উড়াকে
চল মজদুর পুকারকে।–
ঘটাং করে পাকা ঘরের দরজাটা খুলে গেল। সেই মেয়েমুখ। শোনা গেল, কী হচ্ছে কী? ছেলেপুলেরা ঘুমোবে না? রাতদুপুরে আদিখ্যেতা।
আবার দড়াম করে শব্দ। বাধাপ্রাপ্ত রতনলাল ক্রুদ্ধ কটাক্ষে একবার খালি দেখল। তার পর চুপ। হাত পা শক্ত। মুখ বিকৃত, যন্ত্রণাকাতর। যেন কী, একটা লণ্ডভণ্ড ঘটে গেল ঘরটার মধ্যে। ছায়া চারটিও কেমন কাত হয়ে রইল।
রতনলালের যন্ত্রণাটা তাদের মুখেও ছড়িয়ে পড়ল যেন।
রতনলাল ফিসফিস করে বলল, ইস্ক্রুপ ঢিলা হয়ে গেল। যত আঁটো, এরা খালি শালা ঢিলা করে দেবে। এরা বুঝবে না, সে কী জিনিস! সেই গানে জেলের দরজা কাঁপত থরথর করে। বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠত, মাইরি! মনে হত, মজদুররাজ কায়েম হতে যাচ্ছে। হাঁ, সেই গান গাইতে হবে। বিপ্লবের গান।
চারটে ছায়া গায়ে গায়ে মিশে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ধ্বক ধ্বক জ্বলতে লাগল রতনের চোখ। বলল, দুবে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের মিস্তিরি ছিলাম, আমি মজদুর। আমি জানি, মজদুর কী চায়। দ্যাখ আমি সেইজন্য জেল খেটে এলাম। নয় কি?
ছায়া চারটে প্রায় একসঙ্গে কলের পুতুলের মতো বলে উঠল, হাঁ।
রতন গলাটা যথাসম্ভব মোটা করে বলল, আমি বামুনের ছেলে। আমার বাপ কেরানি ছিল। আমি মজদুর হয়েছি। মানুষ এইরকম ধাপে ধাপে আজ নেমে যাচ্ছে। বউয়ের গয়না বেচে, ধার করে আমি একটা একটা করে রিকশা কিনেছি। কেন? না, পেট চালাতে হবে। কিন্তু এসব কিছুই থাকবে না। আমি তো জান দিয়ে দেব।
হকচকিয়ে গেল চারটে মানুষ। ধুলো মাখা উসকো-খুসকো চারটে শীতার্ত জবুথবু ভূতের মতো। রতনের ছায়ার আড়ালে চোখগুলি গোল হয়ে উঠল তাদের। মুখগুলি হাঁ হয়ে গেল।
রতনের মনে হল, সে হা হা করে হেসে উঠবে। কিন্তু উঠল না। বলল, একদিন তো দিতেই হবে জান। একলা নয়, তোরাও সেদিন যাবি আমার সঙ্গে, দুনিয়ার মানুষ যাবে। যাবিনে?
তারা ঘাড় নাড়ল। সংশয়ে, বিস্ময়ে, জানা-অজানার এক বিচিত্র দুর্বোধ্য ভাবে। ভাবখানা, তা হয় তো যেতে হবে।
হাঁ যাবি, যেতে হবে লড়ায়ের ময়দানে। তখন গাইতে হবে, ওই রকম হবে।
আরও হয়তো কিছু বলত রতন। বারোটার ঘণ্টা বেজে উঠল ঢং ঢং করে। সে তার টুলে বসল আবার। পেন্সিল নিয়ে সিসটা জিভে ঠেকাল বারকয়েক। যেন তা হলে লেখাটা ভাল হবে।
তার পর, ঝুঁকে পড়ে খাতায় বড় বড় করে লিখল, ‘আজীব দুনিয়া’, ‘এগিয়ে চল’ ‘কোন পথে’। এগুলি তার রিকশার নাম। সাইনবোর্ডটা সে নিজে লিখেছে। কিন্তু, এগুলি সে খরচা করে লিখিয়েছে রিকশার গায়ে। এ অঞ্চলে শুধু তার রিকশাতেই নাম আছে! আর কারওর নেই।
এখন তার অন্য কাজ। তবু ভাবভঙ্গি, কথার সুরে কোথাও পরিবর্তন নেই। ডাকল, আজীব দুনিয়া! রোজের এক টাকা, বকেয়া পাঁচ টাকা চার আনা।
অর্থাৎ আজীব দুনিয়ার চালকের কাছে সে পাবে রোজকার এক টাকা। আগের বাকি পাঁচ টাকা চার আনা।
আজীব দুনিয়া এগিয়ে এল মাথা চুলকোতে চুলকোতে। নড়বড়ে টেবিলটার উপর রাখল একটি টাকা।
রতন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তার দিকে কটমট করে একবার তাকাল। তারপর, এগিয়ে চল! রোজের এক, বকেয়া বারো টাকা।
এগিয়ে চল এল এগিয়ে। প্রথমে দিল এক টাকা। তার পরে আনি, দুয়ানি, সিকি, মিলিয়ে দিয়ে বলল, বকেয়া সাড়ে তিন রুপেয়া।
রতনের লোমহীন কোঁচকানো ভ্রূ একটু সটান হচ্ছিল। তার আগেই এগিয়ে চল গায়ের ন্যাকড়া জাতীয় চাদরটি ভালো করে জড়িয়ে বলল, দুটো ইস্পোক টুটে গেছে।
অর্থাৎ দুটি স্পোক খরচাটা রতনের। ভাঙাচোরা মালিকের দায়। অবশ্য ভাঙাচোরা যদি আবার ন্যায্য হয়। ভ্রূর চামড়া তেমনি বেঁকেই রইল রতনের। নাকের চামড়া কুঁচকে, পাটা দুটো ফুলল আর একটু। ডাকল, কোন্ পথে, এক। বকেয়া দেড়। কোন্ পথের পা উঠছে না। উদয়ের পথে ধাক্কা দিতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে সামনে পড়ল। বয়সটা তার একটু বেশি! গোঁফজোড়া পাঁশুটে হয়ে গেছে। চোখ পিটপিট করে ট্যাঁক হাতড়াল খানিকক্ষণ। তার পর আট আনা বার করে টেবিলে রেখে মাথা নিচু করল।
রতনের উত্তেজিত মুখে দুরন্ত ঘৃণা। বোধ হয় আধশোয়া চুলগুলিও খাড়া হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু বলল না। আটআনা জমা করে সবে উদয়ের পথেকে ডাকবার উপক্রম করেছে, কোন্ পথে বলল, চেইন থোড়া টাইট হয়ে গেছে। তেল মেরে ঢিলে করতে হবে।
সেটা অবশ্য তেমন কিছু খরচ নয়। তবু রতনের গায়ে যেন ছুঁচ বিঁধল। তার কথার মাঝেই সে ডাকল, উদয়ের পথে, এক। বকেয়া চার আনা। একটা বেল খোয়া গেছে, তার দাম দেড় টাকা। উদয়ের পথে ছেলেমানুষ বলা যায়। বছর ষোলো বয়স। সবে লোম গজিয়েছে গালে। একটা বেল তার গাড়ি থেকে চুরি হয়েছে কিছুদিন আগে। এই শীতে তার গায়ে একটা গেঞ্জি শুধু। কণ্ঠার হাড়গুলি ঠেলে উঠেছে। একটা টাকা দিয়ে সে বলল, রোজ-টাকা, বকেয়া চার আনা কাল, বেলের দাম আপোস পরশু হবে।
জিভে বারকয়েক পেন্সিল ঠেকিয়ে সে যোগ করল। তার পর ফিরল। সাংঘাতিক মুখের অবস্থা। যে রকম মুখে সে এর আগে কথা বলেছে। কিন্তু কথা বলল চাপা গলায়, দুটো গাড়ির বডি খারাপ হয়েছে। চারটে গাড়ির সবসুদ্ধ তেরোটা ইস্পোক লাগাতে হবে, কুল্যে চারটে চাকা টাল, একটার গিয়ার ক্ষয়ে গেছে, দুটোর পাডিলের পাদানি চাই। সিট খারাপ হুড খারাপ..।
বলতে বলতে গলা ধরল রতনের। এর উপর নিজের হাতে সব মেরামত করি। একটা মিস্তিরি রাখলে শালা আমার মরা বাপ ফের বেঁচে উঠত। পরমুহূর্তেই একেবারে চিৎকার করে খেঁকিয়ে উঠল, সব শালা চার নম্বর গলির ভেড়া, মোটকা সা-কারখানার পোকা, থুক। থুক থুক থুক দিই আমি তোদের। নিকাল যাও শালা। যাও। চার নম্বর গলি আর মোটকা-সা ছাড়া তোদের কেউ জ্যান্ত খেতে পারবে না। তোরা সেখানে যা।…
কিন্তু কেউ গেল না। চার নম্বর বেশ্যাপল্লী। মোটকা-সায়ের কারখানা দেশি সরাপের দোকান। যাওয়া কারও অভ্যাস থাকলেও উপায় নেই। ট্যাঁক পকেট সবাই শুন্য। যেন চারটে বলবুদ্ধিহীন বলদ। রতন একটা খ্যাপা গাড়োয়ান। রতন বিস্ময়ে রাগে আবার বলে উঠল, আমাকে দুবে ইঞ্জিনিয়ারিং ঠকিয়েছে, গরমেন্ট জেল খাটিয়েছে, আর আমাকে তোরা ঠকাচ্ছিস্? নিকাল যা। কোন্ পথে একটু বয়স্ক মানুষ। গোঁফ জোড়া কেঁপে উঠল তার। কাঁচুমাচু করে বলল, সচ বলছি, ঠকাবার মতলব একদম নেই। আপ একঠো শরীফ আদমি..
রতন তেড়ে এল, চুপ, তুই বুড়ো সবচেয়ে খচ্চর। আড়াই টাকার জায়গায় আট আনা দিয়েছি। যেতে আসতে শিবমন্দিরে মাথা ঠুকিস, ডবল শয়তান তুই। জানিনে ভেবেছিস্? যে ঠাকুর মানে, সে হয় সবচেয়ে পাজি, মজদুরের দুশমন। নইলে এ বয়সে গোঁফ চুমরে গিটার বাজাস মুখ দিয়ে?
বলে গিটারের শব্দ অনুকরণ করে ভেংচে উঠল। উত্তেজনায় সে বসল, দাঁড়াল, আবার বসল।
কোন্ পথে কাঁপতে লাগল শীতে। এতক্ষণে উত্তরে বাতাসটা আবার বইতে আরম্ভ করেছে। সকলেই কুঁকড়ে গেল একটু। হিস হিস শব্দও হল। কিন্তু রতনের সে সব নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, মনের উত্তাপে এবার সে ঘামবে। ভ্রূ কপালে ঠেকিয়ে সে বলল, আর তোদের আমি বিপ্লবের কথা বলি? আরে ছোঃ। বেইমান কখনও বিপ্লবী হয় না। ধোঁকাবাজ কোনও দিন বিপ্লব করতে পারে না। সে পারে একজন সাচ্চা মজদুর। মালিক যাকে ঠকিয়ে ঠকিয়ে হাড় মজ্জা খেয়ে ফেলেছে, সেই শোষিত মজদুর। আমি তাদের চিনি, নাড়ি নক্ষত্র চিনি। আমি নিজেকে চিনিনে? আর তোরা আমাকে ঠকাচ্ছিস। আমার শালা পাঁচটা ছেলেমেয়ে, একটা বউ, একটা বিধবা মা, তোরা আমাকে শুষিস্? শালা ঘেসো জোঁকের দল! শুঁড় ছোট হলে কী হবে, নোলা তোদের সব সময় ছোঁক ছোঁক করছে।
উদয়ের পথে ছোকরা আর সহ্য করতে পারল না। শীতের জন্য দুহাতে বুক আঁকড়ে ধরেছিল। দুহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল, মাইরি বলছি বাবু–
কিন্তু রতনের মুখের তোড়ে সে সব ভেসে গেল। নিজের কথার সুরে সে মশগুল হয়ে গেল। তার বিশাল ছায়াটা দুলতে লাগল। সে বলে গেল।
সাচ্চা মজদুর প্রহর গুনছে। দম-আটকানো অন্ধকার রাত তার টুটি টিপে মারতে আসছে। কখন, কখন ভোর হবে! অত্যাচারের অবসান হবে! আসবে সেই.. চেপে এল, কেঁপে কেঁপে উঠল রতনের গলা। যেন গোলাপী নেশায় তেজীয়ান হয়ে উঠতে লাগল সে। চারটে লোক ভড়কে গেল একেবারে। নিস্তব্ধ ঘর। রিকশা, যন্ত্রপাতি সব যেন অবাক বিস্ময়ে এইদিকেই তাকিয়ে আছে। রাত্রিটা গেছে স্তব্ধ আড়ষ্ট হয়ে। চারটে লোক যেন এক বিচিত্র ছায়াজগতে এসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল রতনের দিকে। যেন, সত্যি কোনও করাল রাত্রি থাবা মেলে আসছে চারদিক থেকে।
ঠিক এই সময়েই আবার ঘটাং দরজা খুলল। সেই মুখ, এবার আরও ক্রুদ্ধ। শোনা গেল আরও তীব্র গলা, অনেক রাত হয়েছে, এবার শুতে হবে না?
থেমে গেল সরু গলার সুতো কাটা। একটা ধাক্কা খেয়ে হেঁচকি উঠে গেল রতনের গলায়। চারজনের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল! তার পর একে একে সব বেরিয়ে গেল চালাঘর থেকে। বাইরে গিয়ে ঝাঁপটা ঠেলে দিল। রতন যন্ত্রের মতো তালাবন্ধ করে দাঁড়াল। যেন কোন নিশির মোহ ঘিরে ধরেছে তাকে। যে কথা বলছিল, যেন তার খেই খুঁজছে।
এ প্রায় প্রত্যহের ব্যাপার।
ওরা চারজন বেরিয়ে, একসঙ্গে এগুল। কারও মুখে কোনও কথা নেই। চারজন জড়াজড়ি করে, পরস্পরের গরমে ওম্ করতে করতে চলল। উত্তরের বাতাস থেকে থেকে আসছে। গাছে গাছে পাতা ঝরছে। তারাগুলি চলে গেছে আরও দূরে। মিইয়ে গেছে ঝিকিমিকি।
একজন বলল, সত্যি, শালা কী যে করি।
আর একজন বলল, মাইরি!
কোন্ পথে বুড়ো বলে উঠল, সচ বলছি, কত শোচলাম কী যে, আজ পুরা বকেয়া জরুর মেটাব। মগর, হল না। লেডি মাস্টর বারো-হানা দিল। আর দিন ভর অগল বগল ঘুরে মিলেছে বারোহানা। কতনি হইল?
আজীবদুনিয়া বলল, দেড় টাকা।
গোঁফ জোড়া ঝুলে পড়ল কোনপথের। তব, কী হবে? লেড়কা নিয়ে গেল ঘর-খরচা আট-হানা। চা-বলা পাবে দুটাকা। ছিনিয়ে নিল আট-হানা। আর আট-হানা–
দেখা গেল, মধ্য রাত্রের এই শীতে, পথের উপরেই দাঁড়িয়ে পড়েছে তারা। হিসাব দিতে আরম্ভ করেছে এরটা ওর কাছে। ওরটা এর কাছে। টাকা, আনা, পাই-পয়সা। চা-বিড়ি-খোরাক। সেই সূর্য না ওঠা থেকে নিঝুম রাত পর্যন্ত, প্রতিটি পয়সার টায়টিকে হিসাব। প্যাসেঞ্জারের আদব কায়দা, দরাদরি। কে বে-দিল আর দিলদার। কার প্যাসেঞ্জার কে নিয়েছে ছিনিয়ে। লাইনের কত পেছনে ভাজা পড়েছিল। অর্থাৎ স্টেশনের গেটের কাছ থেকে সারি সারি কতগুলি রিকশার পেছনে ছিল সে। যেন একপাশে তাগাড় করে জমিয়ে রাখা ছিল কথাগুলি। এখন হুড়মুড় পড়তে লাগল।
অথচ মালিকের কাছে স্রেফ বেইমান। সারাদিন হেঁকেছে, যাত্রীও টেনেছে। চার পয়সার দারু কিংবা দু-পয়সার কিসমতবাজি করেনি কেউ। অর্থাৎ জুয়া খেলেনি। চার গেলাস কিংবা আট গেলাস, হয়তো তারও বেশি বারো গেলাস চা খেয়ে ফেলেছে। মাইরি, কী করে যে খাওয়া হয়ে যায়। বাড়ির ভাতে পেট ভরে না। হাতে পয়সা, চোখের সামনে প্রচুর খাবার। খিদে পেলে কী করা যায়। ওই রকম গরম ফুলুরি চপ। কতক্ষণ থাকা যায়। তা ও কি আর, বল! খেয়েও বদনের রং বদলায় না মাইরি।
কেউ ঘর খরচা দিয়েছে, কেউ দেয়নি। মনিবের রোজকারটা দিতে পারলে রক্ষে। বাকি পড়লে বুক কাঁপে খালি। যেন এ-জীবনে আর শোধ হতে চায় না। আর রোজ খিঁচুনি। রোজ তো সমান নয়। একদিন ন্যাড়া নাচে, আর একদিন গোবিন্দ আছে। কপাল! প্যাসেঞ্জার তো ভগবান! কাকে যে কখন মনে ধরে যায়। আর এত রিকশা। একজন যাত্রীকে দশজন ধরে টানাটানি করে। কে কাকে ঠকাবে। ট্যাঁক তো ফাঁকি। সবাই সবার ট্যাঁক পকেট উলটে পালটে দেখায়। কাল ভোরে গাড়ি নিয়ে না বেরুলে, দাঁতে কুটো কাটা চলবে না।
সকলের সব কথা বলা হয়ে গেলে, হঠাৎ স্তব্ধ হয় জটলা। রাস্তার আলোগুলি হাঁ করে চেয়ে থাকে। যেন বলছে, হয়ে গেল? ফাঁক পেয়ে উত্তরে হাওয়াটা ছপটি হাঁকে, চল্ চল্ চল্।
প্রত্যহের জটলা। প্রত্যহের কথা। প্রত্যহের মতো কোন পথে গোঁফ-জোড়া টেনে একটু আড় ভেঙে বলে, কোই বিশওয়াস না করে। না মালিক, না দুনিয়া।
আজীব দুনিয়া বলে, ঘরের বউও করে না।
উদয়ের পথে ছোকরা একটা কটূক্তি করে বলে, বাইরের বউ-ই করে না। গলি দিয়ে গেলে ডাকবে। যদি বলি শালা পয়সা নেই, পকেটে হাত দিয়ে দেখবে।
তার পর হাসি। কিন্তু আবার, মগর আদমিটা খুব ভাল। সচ, ইনকলাবি।
অর্থাৎ রতনলাল।
উদয়ের পথে কপালের চুলগুলি তুলে দেয় মাথার ঝাঁকানি দিয়ে। বলে, আরে সে তুমি কী বলবে? আমি জানিনে? দুবে এঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশ দিয়ে গেলে শালা কারখানার লোক গন্ধ পায় রতনবাবু যাচ্ছে। দিনরাত শালা টিকটিকি ঘুরছে লোকটার পেছনে।
নিজে দেখেছি, জানিস্। পুলিশ ইস্তক ভয় পায়। এ তো আর বাবু-স্বদেশী নয়। সকলের ঘাড়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আজীব দুনিয়া ফিসফিস্ করে বলে, আর আমি তো শুনেছি রতনবাবুর অসাধ্য কাজ কিছু নেই।
জেলে নাকি খুব মার মেরেছিল। মানে, ওই যে বলে না বিপলাব; ওই বিপলাবের মধ্যে কে কে আছে নাম জানবার জন্যে খুব মেরেছিল। বাট্ শালা ইস্পকটি নটও। উঁহুঁ। খোদ রতনবাবু বলেছে।
কোন্ পথে চাপড় কষাল একটা আজব দুনিয়ার ঘাড়ে। জানতে হ্যায়, খুব জানতে যায়। তু বলবে ত জানবে? টিশনের সিপাইটা শালা কটমট করে আমাকে দেখে আর বোলে, হুঁ, নামতা সাইকিল ইস্টোর কি গাড়ি চালাচ্ছে? তুমাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হোবে। শালা তেরি…।
তবে বড় রগচটা। উদয়ের পথে ছোকরা বলে, আমাকে তো শালা একদিন রেঞ্চু ছুড়েই মারলে, মনে আছে?
আজীব দুনিয়া বললে, কেন, একবার আমার কাপড় খুলে দিল মেরে। শালা একেবারে ল্যাংটা।
কোন্ পথে করুণ স্বরে বলে, হাঁমার মোচ্ তো কেতোদিন টেনে টেনে একদম উখাড় দিয়েছে। তব হাঁ, সাচ্চা আদমির দিমাক জায়দা গরম হয়।
হাঁ, ঠিক, এক কথায় সায় দেয় সবাই। তবে? এরকম একটা সাচ্চা লোককে তারা ঠকাবে?
তার পরে হঠাৎ সকলের নজর পড়ে এগিয়ে চলার ওপর। সে আজ প্রথম থেকেই নীরব। কেবল গানের সময় তবলা বাজিয়েছিল মুখে। নজর পড়তেই মনে হল, সে আজ সাড়ে তিনটাকা বকেয়া আর রোজের এক টাকা দিয়েছে।
আজীব দুনিয়া বলে, কীরে তোর মুখে যে কথা নেই? কত কামিয়েছি আজ? এগিয়ে চল দুই উরুতের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কুঁজো হয়ে ছিল। বলল, মালিক সাড়ে চার, ঘর খরচা দেড়, ছ ইধার উধার খরচা এক, সাত। এখন পাকিট ফাঁক।
সাত টাকা। কিন্তু কেউ হেসে উঠল না, কথা বলল না। একদিনে সাত টাকা রোজগার হলে কথা বলা যায় না, তারা জানে। কেবল উদয়ের পথে বলল, চল, তোর গা হাত পা একটু বানিয়ে দিই।
ঘাড় নেড়ে বলল সে, নাঃ। একটু মাল না হলে হাত পা ছাড়বে না। শালা, সব ছোট হয়ে গেছে মাইরি। শরীলটা বিলকুল..
হঠাৎ সকলেই কেমন কুঁকড়ে যায়। সত্যি, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিদিন একটু একটু করে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তবু উদয়ের পথে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। বলল, হ্যাঁ, মালের দোকান তোর জন্যে এখন খুলে রেখেছে।
কোন্ পথে বুড়ো হেসে বলল, দোকানটা থোড়া শুঁকে যা, জাম ছাড়বে।
আজীব দুনিয়া বলল, সিরেফ বিপলাব। বিপলাব করে দিতে হবে। নইলে ছোট হতে হতে আজীব দুনিয়া একেবারে পিঁপড়ে হয়ে যাবে।
কথার শেষে কোন্ পথে বুড়ো মুখে হাত চাপা দিল। আর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে সুর করে বাজিয়ে দিল একটা চেনা গানের কলি।
.
এও প্রত্যহের। সবই প্রত্যহের। সাইকেল রিকশার তিনটে চাকার মতো। তিনটে এক সঙ্গে ঘোরে। একরকম ঘোরে।
রতন রোজই থুক থুক করে। কোনও কোনও দিন পয়সার শোকে পাগল হয়ে ওঠে। শুরু করে দেয় ধাক্কাধাক্কি চেঁচামেচি। নইলে রিকশার ব্যবসা করা চলে না বোধ হয়।
তার পরেই সে তার মুখের আর একটা ঢাকনা দেয় খুলে। পায়চারি করে, দাঁড়ায়, বুক টান করে। কখনও চিবিয়ে চিবিয়ে, কখনও কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে, হাত তুলে বলে, ওই দ্যাখ সামনে কী দিন! রক্তরাঙা দিন। খাঁটি মজদুর যেদিন লড়াইয়ে নামবে সে হাজার বছরের শোধ তুলে ছেড়ে দেবে, হাঁ। ফৌজি কায়দায়, হাঁ হাঁ মজদুর ফৌজ হয়ে যাবে।
বলেই বন্দুক বাগিয়ে ধরার কায়দায় হাত তুলে বলে, এমনি, এমনি করে করে গুড়ুম গুম সট সট খতম করে দিয়ে যাবে। যাকে বলে বুর্জুয়া, সেই তাদের একদম ফোড় করে ছেড়ে দেবে।
বলতে বলতে হাত পায়ের পেশি শক্ত হয়ে ওঠে রতনের। চোখ দুটো জ্বলে ধ্বকধ্বক করে। বলে, কেন? না, মালিক তাদের রক্ত শুষে খেয়েছে। দিনের পর দিন ঠকিয়েছে। এবার লড়াই। হাঁ, পথে পথে খুনের দরিয়া বয়ে যাবে। কী ভয়ঙ্কর সে দিন।
যেন সেই ভয়ঙ্কর চেপে বসে রতনের মুখে। চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে, সে কি এমনি হয়? একাই চাই। যাকে বলে একতা। বুর্জুয়া কী করে? না, মজদুরকে ফারাক করে দেয়। লড়িয়ে দেয় নিজেদের মধ্যে। মানে? জানোয়ার করে দেয়। তা হলে হবে না। মালিকের চালাকি ধরতে হবে, দিমাক চাই। সব জানি আমি, সব জানি। কী ভাবে ঠকাচ্ছে, ধরতে হবে। যেমন মুদি ঠকায় খদ্দেরকে, খদ্দের ঘ্যাঁচ করে ধরে, সেই রকম। যেমন ঠকায় আগরওয়ালা ওর রিকশাওয়ালাদের। একশোটা রিকশার মালিক হয়েছে ও সবাইকে ঠকিয়ে ঠকিয়ে। এ-সব বলতে হবে, বোঝাতে হবে সবাইকে। তার পর ময়দানে নামতে হবে। বিপ্লব এমনি হয় না। জেলে যেতে হবে, ফাঁসি যেতে হবে,…
তার গলা যত চড়ে, শ্রোতাদের চোখগুলি তত বড় হয়ে ওঠে। নমিতা সাইকেল ওয়ার্কসের বেড়ায় কাঁপতে থাকে তাদের ছায়াগুলি।
রতন ঝাঁপখোলা সামনের রাস্তাটা দেখিয়ে বলে, এই রাস্তাটা একদিন লড়াইয়ের ময়দান হয়ে যাবে। আর যে সাচ্চা নয়, খাঁটি নয়, সে শালা মওগার মতো পড়ে থাকবে বন্ধ ঘরে। দেখিস। এই আমরা, আমরা বিপ্লব করে মরব। মজদুর বিপ্লব চায়। বিপ্লব মানে কী? যে খেটে খায়, তার দুনিয়াদারি।
শুধু চারজন রিকশাওয়ালা নয়। সারাদিনে অনেকে আসে রতনের কাছে। তার মধ্যে কয়েকজন তার ভক্ত আছে। কারখানার লোকও দুএকজন আসে তার কাছে। সারাদিনের মধ্যে কতবার যে সে বিপ্লবের পথ দেখায়।
নিজের গলায় এই প্রত্যেকটি শব্দ ও সুর তাকে যেন মাতাল করে ফেলে। বৈষ্ণবের শ্যাম নামের মতো মর্মে মর্মে পাশে। আর বিচিত্র এক আমেজ ও উদ্দীপনায় সে কাঁপে! চোখ বোজে, হাসে, দাঁত কড়মড় করে।
পাশপাশি কিংবা দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আজীব দুনিয়া, এগিয়ে চল, কোন্ পথে আর উদয়ের। পথে। এত কথার মানেই বোঝে না তারা। কেবল বিশেষ এক একটা শব্দ নিয়ে ঠোঁট নাড়ে। আর সত্যি, তাদের বুকের মধ্যে কোথায় যেন জ্বলে ধিকি ধিকি। একটা অস্পষ্ট আবছা দৃশ্য ভাসে চোখের সামনে। দুর্বোধ্য এক হল্লা আর ভিড়ের দৃশ্য, যে ভিড়ের মধ্যে তারাও হা করে দাঁড়িয়ে আছে।
আর সারাদিনের মধ্যে যখন কেবল ঘটাং করে খোলে পাকা দরজা, উঁকি দেয় একটি মুখ, তীরের মতো এসে বেঁধে তীব্র গলার মুখ ঝামটা, তখন বড় ব্যথিত অবসাদগ্রস্ত মনে হয় রতনকে। এমনকী শ্রোতাদেরও।
আর একজন আছে। এক বুড়ো। সেও দুবে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মিস্তিরি ছিল। মালিক তাকে বের করে দিয়েছে কারখানা থেকে। সে নাকি রতনের চেয়েও খারাপ মানুষ। মজুরদের নাকি সে লড়বার পরামর্শ দেয়। কিন্তু কথা সে কম বলে। সে আসে মাঝে মাঝে, রতনের কথা শোনে। গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে বুড়ো হাসে। আর রতন তার দিকে ঘৃণা ভরে তাকিয়ে থাকে। বুড়ো যেন তার চেয়েও বড় হতে চায়।
তারপর মধ্যরাত্রে ওই চারটে ঘেসো জোঁকের দলকে রতন শোষণের অর্থ বোঝায়। বোঝায়, তাদের সঙ্গে খাঁটি মজদুরের কী তফাত, যে মজদুর ইনকিলাব করবে।
.
যেন একটা খেলা। সব যেন একটা খেলা নিয়ে মেতে আছে। এর পরে এই, তার পরে এই। শেষ রেশটা থাকে শুধু রতনের গলার। কিন্তু একদিন হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেল। গণ্ডগোল করে দিল উদয়ের পথে ছোকরা। যার কয়েকটা ভাই ছাড়া, আর ছিল মা। সেই মায়ের অসুখ। সারাদিন রিকশা চালিয়ে পয়সাটা চলে গেল ডাক্তারের হাতে। সেদিন আর সে নমিতা সাইকেল স্টোর-মুখো হল না। ভাবল, পরের দিন দিয়ে দেবে।
পরের দিনও হল না। পয়সা সব শেষ। একবার না যাওয়ার আতঙ্ক কায়েমী হয়ে বসেছে। এদিকে মায়ের অসুখ। যেন যম ছাড়ে না গোছের। রোজ রোজ এক কাঁড়ি করে পয়সা। খাটনির ওপরে আবার ধার। একদিন, দুদিন, তিনদিন। রতন তো পাগল। খবর নিয়েছে সব কিছু। অপেক্ষা করে আছে। একবার এলে হয়। তিনদিন চারদিন পাঁচদিন। মধ্য রাত্রে রতনের চিৎকার শোনা যায়, চোট্টা, তোরা চোট্টার দল। ইনকিলাব করবি তোরা? আসুক সে শালা।
এল রতনের সেই শালা, আটদিন পর। শ্মশানে মাকে পুড়িয়ে, সন্ধ্যাবেলা তিন দফা সোয়ারি টেনে হাজির। তা-ও ভয়ে ভয়ে, সকলের আগে এসেছে।
রতনের হাতের সামনে ছিল একটা পুরানো টায়ার। সেইটা দিয়েই এক ঘা কষাল সে উদয়ের পথের ঘাড়ে। খেঁকিয়ে উঠল, শালা, তোকে আবার আমি দিয়েছি উদয়ের পথে চালাতে? মানে জানিস্ শালা? গাড়ির নামের বে-ইজ্জত! উদয়ের পথে যাবি তুই? চোট্টা রিকশাওয়ালা? সব শালা চোট্টা! নিকাল যা। বলে আরও কয়েক ঘা দিয়ে বার করে দিল। বলল, পয়সা নেই, আবার গাড়িও গ্যারেজে নেই? নিকালো, বকেয়া মিটিয়ে যাবি শালা দুদিনের মধ্যে। গাড়ি আর তোকে কোন্ শালা দেয় দেখি।
উদয়ের পথে কিছু বলল না। কাঁদল না, চেঁচাল না। গালে হাত দিয়ে বসে রইল রাস্তার অন্যধারে একটা ভাঙা বাড়ির বারান্দায়।
.
ভোর হল। বেলা হল। রতন দেখল, কারও পাত্তা নেই। উঁকি দিয়ে দেখল, ভাঙা বাড়ির বারান্দায় সব বসে আছে। পাশাপাশি চারজন, কুকুরের মতো পিটপিট করে দেখছে। রতনের মাথার চুল যেন একবার খাড়া হল, আবার নামল। মনে মনে খেঁকিয়ে উঠল, কী ব্যাপার। শালারা আসবে না নাকি?
কাছে গিয়ে বলল, তোরা তিনজন গাড়ি বার করবি না?
মাথা তোলে না কেউ। আড়ে আড়ে দেখে। তার পর এগিয়ে চল বলে ফেলে, না।
কেন?
আজীব দুনিয়া বলল, ঝুটমুট তুমি মারলে ছোঁড়াটাকে।
কোন্ পথে বলল, ছোকরাটার মা মর গেল। তুম্ পিটা দিয়া।
রতনের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। বলল, তবে কী করতে হবে?
উস্কে গাড়ি চালাতে দিতে হবে। অওর..
এগিয়ে চল বলল, আর এই আট রোজ মকুব।
হ্যা শুধু শুধু মারলে। তার একটা ইয়ে আছে তো? আমাদের তো মকুব চাইছিনে? গম্ভীর গলায় থেমে থেমে বলল আজীব দুনিয়া।
রতন প্রায় একটা পাক খেয়ে নিল। অর্থাৎ ফিরে যাবে মনে করেছিল। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়ল। তার লোমহীন ভ্রূজোড়া প্রায় খোঁচা খোঁচা চুলে গিয়ে ঠেকেছে। রেগে চমকে উঠে বলল, ওরে! ওরে শালা! স্ট্রাইক! আমার বিরুদ্ধে? আমাকে বিপ্লব দেখাচ্ছিস শালারা? তোরা তোরা। খতিয়ে গেল রতনের গলা।
আজীব দুনিয়া মোটা গলায় বোকাটেভাবে বলল, এই দ্যাখো। বিপলাব আবার কী করলুম।
মানে একটা ল্যায্য বিচার করতে হবে তো। তা এইটে আমাদের মনে নিল।
রতন বলে উঠল, থুক থুক। তোরা লড়িয়ে মজুরের নকল করছিস। তোরা বেইমান, চোট্টা, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস। আমি রতনলাল পাঠক, মজদুর আমাকে চেনে। আমার বিরুদ্ধে স্ট্রাইক?
আজীব দুনিয়া আবার বলল, ইসটারেক কেন? একটা—
চোপ! ফিরে গেল রতন। আবার এল তাঁতের মাকুর মতো ফিরে, দেখবি তোরা সত্যিকারের লড়াইয়ের দিন! ইনকিলাব কাকে বলে। মর শালারা না খেয়ে।
তা আমরা কি বলছি… আজীব দুনিয়ার কথার ফাঁকেই চলে গেল রতন। চোখ পড়ল সামনে ধোপাখানার দিকে। সেখানে বসে আছে সেই বুড়ো মিস্তিরিটা। গোঁফের ফাঁকে হাসছে বসে বসে।
শালা! রতনলাল ঘরে ঢুকে দেখিয়ে দেখিয়ে চারটে রিকশার চেইন তালা দিয়ে আঁটল। তার পর ঝাঁপ বন্ধ করে দিল।
একদিন, দুদিন, চারদিন। ওরা চারজন যেন এই বারান্দাটায় মৌরসীপাট্টা গেড়েছে। কখনও সখনও এদিক ওদিক যায়। বোধ হয় দোকানে দোকানে ঘোরে কিছু ধারের খাবারের জন্য। ভোর হলে ঠিক ওইখানটিতে এসেই বসে। উপোসের ছাপ পড়ছে মুখে। শুকিয়ে চামসি হচ্ছে চেহারাগুলি।
নমিতা সাইকেল ওয়ার্কসের বেড়ার ফোকর দিয়ে তাদের কেউ দেখে কিনা তারা জানে না। কিন্তু দেখে একজন। রতন দেখে আর ফোলে। ছুটে ঘরে গিয়ে বউকে বলে, আমাকে লড়াই দেখাচ্ছে? জানো সেদিন কী হবে? যেদিন নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণী যুগযুগান্তের অত্যাচারের…
বউ হল তার পাকা ঘরের দরজার সেই মুখ। নমিতা তার নাম। পাঁচ দিনের দিন সে বলে বসল, কথা হবে পরে। সংসার চালাও আগে। এদিকে যে ফাঁক।
ফাঁক! বেরুল রতন বাইরে। এদিক সেদিক ঘুরে দেখা করল কয়েকজনের সঙ্গে। যারা বেকার বসে আছে অথচ রিকশা চালাতে পারে। সবাই এক কথা বলে, তা কী করে হয়। একই কাজ। চারটে লোককে মেরে কি খাওয়া যায়?
প্রায় হকচকিয়ে ওঠে রতন। একতা? এর নাম একতা? যারা বকেয়া মেটায় না, রোজকারটা পর্যন্ত পুরো দেয় না, উপরন্তু গাড়ি ঘায়েল করে, সেই সব নেমকহারামের একতা! আরে ছোঃ ছোঃ।
ভাবে, কী বীভৎস আর কুৎসিত এদের লড়াইয়ের কায়দা। রতনের মতো একটা মানুষকেও যারা ঠকায়।
আর এদের সামনে সে কিনা মজদুর লড়াইয়ের কথা বলে আসছে। কী বিরাট অপরূপ রূপ সেই যুদ্ধের। আকাশে বাতাসে, অস্ত্রের ঝনঝনায় দিগদিগন্ত আলোড়িত হয়ে উঠবে সে বিপ্লবের কলকল তানে।
চারদিনের পর আট দিন। তার পর বারোদিন। নমিতার কাছে কিছু বলতে গেলে থমকে যায় রতন। মনে হয় গলায় আটকে গেছে বেড়ালছানা। মিউ মিউ করে, আর আঁচড়ায়। সে বলতে চায়, এটা আসল রূপ নয়। আসল রূপ অন্যরকম। এ হচ্ছে নকল শয়তানের কারসাজি।
কিন্তু ঝিমিয়ে পড়ছে রতন। এই করে সে খায়! চারটে লোক তাকে খাওয়ায়। তার ছেলেপুলে, মা-বউ। শেষে নমিতাও বিদ্রোহ করে বসে। বলে, আজে বাজে বকে ঘরের লক্ষ্মী দূর করছ তুমি? আমার ঘরের লক্ষ্মী।…
ঘরের লক্ষ্মী! কে তার ঘরের লক্ষ্মী! যেন নমিতা সাইকেল ওয়ার্কসটা সুদ্ধ তাকে চেপে ধরতে আসছে। এমনকী, খাওয়ায়ও কম পড়ছে যেন। তার পেটে খিদে। একে একে ঘরের সকলের পেটে খিদে। খিদে, খিদে!
সন্ধ্যার ঝোঁকে রাস্তায় এসে দাঁড়াল রতন। শীত গেছে। বাতাসে ধুলো উড়ছে। সন্ধ্যার কালো আঁধারে ঝাপসা দেখাচ্ছে সবকিছু। রতন আগে দেখল ধোপাখানার দিকে। বুড়ো মিস্তিরিটা আছে। কিনা। দেখা যাচ্ছে না কাউকে।
সে ভাঙা বাড়ির বারান্দাটার দিকে তাকাল। সারা শীতকালটা ওখানে কয়েকটা কুকুর গায়ে গায়ে পড়ে থাকে। এখনও সেই রকম দেখাচ্ছে। এই অসৎ খুদে জোঁকগুলিকে মজদুর-রাজ বোঝাত সে। ছি!
তবু সে পায়ে পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল ছায়ার মতো। সে একটি ছায়া, আরও চারটি ছায়া নড়েচড়ে উঠল। ভেতরে ঢোকা চোখগুলি তাদের চক করছে।
রতন দাঁড়াল সোজা হয়ে, বুক টান করে। চাপা গলায় বলল, নিপীড়িত শ্রমিকের আন্দোলন তোরা কোনওদিন বুঝবি না। সেই ইনকিলাবের ডাক যেদিন আসবে…
গলাটা আটকে গেল। কেউ কোনও কথা বলল না। তার পর হঠাৎ রতন তীব্র ঝাঁজ দিয়ে বলে উঠল, মকুব!
বলেই সে দরজার দিকে এগুল। চারটে ছায়াও তার পেছন পেছন এল। রতন দরজা খুলে এক গোছা চাবি ছুড়ে ফেলে দিল। চার জনে মিলে চেনের তালা খুলে গাড়ি বার করতে গেল।
রতন বলল, এখুনি?
চারটে গলা শোনা গেল একসঙ্গে, তা ছাড়া? আজকে খেতে হবে তো।
বেরিয়ে গেল ‘আজীব দুনিয়া’ ধুঁকতে ধুঁকতে। তার পেছনে ধুঁকতে ধুঁকতে ‘এগিয়ে চল’ ‘কোন পথে?’ ‘উদয়ের পথে’। তবু একবার কেঁপে কেঁপে ঠোঁট-গিটারের সুর, তবলার বুংবুং। রতন বুকটা টান করে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। চমকে তাকিয়ে দেখল, সামনে সেই বুড়ো মিস্তিরি। সে সত্যি হাসে না। মুখটাই তার অমনি। গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে হাসির ভাব।
চোখাচোখি হতেই রতন বলল, বেরিয়ে যা তুই বুড়ো এখান থেকে।
বুড়ো এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এবার সত্যি হেসে ফেলল। বলল, খালি বাত্। শালা ফটিচার! দেখে লে, কারা একদিন দুনিয়া বিগড়ে দেবে। সে বেরিয়ে গেল।
সামনের রাস্তাটা হাওয়ায় যেন ছুটতে লাগল দূর দূরান্তে।