ফকির-বাবা
মনে পড়ল পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। আমি তখন মুঙ্গেরে ওকালতি করি। আমার বাবা জেলা কোর্টের বড় উকিল ছিলেন, তাঁর গুটি তিন-চার জুনিয়র। আমি ছিলাম তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
কাজকর্ম বিশেষ করতাম না; বাবার পিছন পিছন এক এজলাস থেকে অন্য এজলাসে ঘুরে বেড়াতাম, কখনো বা এজলাসে সাক্ষীর এজেহার লিখতাম, এবং বেশীর ভাগ সময় বার-লাইব্রেরিতে বসে সমবয়স্ক উকিলদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম।
বার-লাইব্রেরির আড্ডা সম্বন্ধে একটা কথা বলতে পারি। অনেক চক্রে আড্ডা দিয়েছি, কিন্তু এমন চোখা বুদ্ধি ও wit-এর সংঘর্ষ আর কোথাও পাইনি। এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস সব বার-লাইব্রেরিই সমান।
আদালতের সরজমিনে নানা জাতীয় মানুষের বিচিত্র সমাবেশ। অধিকাংশই পুরুষ; বাদী প্রতিবাদী আসামী ফরিয়াদী সাক্ষী উকিল মুন্সী তদ্বিরকারী পাটোয়ারি। কেউ ছুটোছুটি করছে, কেউ মোকদ্দমা জিতে ঢোল পিটোচ্ছে, কেউ হেরে গিয়ে গাছতলায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ক্রোধ লোভ কুটিলতা হতাশা জয়োল্লাস, কত রকম যে মনোভাব এই আদালত নামক ভূখণ্ডের মধ্যে তাল পাকাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনোটাই কিন্তু উচ্চাঙ্গের মনোবৃত্তি নয়।
এই জনাবর্তের মধ্যে একটি লোককে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম যার সঙ্গে আদালতের বাতাবরণের কোনও মিল নেই। তাকে লোকে বলত ফকির বাবা। ইয়া ষণ্ডা চেহারা, নিকষের মতো গায়ের রঙ, মাথায় এক-মাথা তৈল-চিক্কণ বাব্রি চুল, অল্প দাড়ি আছে। মাংসল মুখে সামনের দুটো দাঁত ভাঙা, কিন্তু হাসিটি প্রাণখোলা; কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, চোখ দুটিও ওই ফোঁটার মতোই রক্তবর্ণ। কি শীত কি গ্রীষ্ম— একটা কালো কম্বল তার চওড়া কাঁধে পাট করা থাকত। পরনে লুঙ্গি, কখনো সেই সঙ্গে একটা গেঞ্জি।
লোকটিকে দেখে আমার মনে হত সে আদৌ মুসলমান ছিল, তারপর তান্ত্রিক সাধনা আরম্ভ করেছিল। তার ফকির-বাবা নাম থেকেও তাই মনে হয়। কিন্তু এ আমার আন্দাজ মাত্র। তার গোটা পরিচয় কোনোদিন জানতে পারিনি। ফকির-বাবা আদালতে আসত টাকা রোজগার করতে। তার টাকা রোজগারের প্রক্রিয়া আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম। আদালতের খোলা জায়গায় ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে হঠাৎ একটা লোকের হাত ধরে বলত— ‘তুই যদি আমাকে পাঁচটা টাকা দিস তোকে মামলা জিতিয়ে দেব।’ কাউকে কখনো অস্বীকার করতে দেখিনি, বরং পরম আহ্লাদিত হয়ে টাকা দিত। আশ্চর্য এই যে, যারা টাকা দিত তারা কখনো মোকদ্দমায় হারত না। আবার দেখেছি কত লোক ফকির-বাবাকে একশো দুশো টাকা নিয়ে ঝুলোঝুলি করছে, বলছে— ‘বাবা, আমাকে মোকদ্দমা জিতিয়ে দাও।’ কিন্তু ফকির-বাবা টাকা নেয়নি। বলেছে—‘তোর টাকা নেব না।’
আমার বিশ্বাস ফকির-বাবার একটা দৈবশক্তি ছিল— খুব নিম্নস্তরের সিদ্ধাই— যার দ্বারা সে লোকের মুখ দেখে তার ভবিষ্যৎ জানতে পারত। আমাকে একবার একটা এজলাসের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে বলেছিল— ‘তুই এখানে কি করছিস? যা ভাগ্— পালা।’ তখন তার কথার মানে বুঝিনি।
দু’চার দিন আদালতে ঘুরে বেড়িয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ করে ফকির-বাবা ডুব মারত, আবার দু-চার মাস পরেই ঠিক ফিরে আসত।
যে ঘটনা আজ মনে পড়ল সেটা ঘটেছিল গ্রীষ্মকালের একটি অপরাহ্নে। তখন বোধ হয় সকালে আদালত বসছে, বিকেলবেলা বাড়িতে মক্কেল আসে। মনে আছে, বিকেল আন্দাজ চারটের সময় বাবা অফিস-ঘরে এসে বসেছেন, আমিও এসেছি, আর এসেছেন বাবার প্রধান জুনিয়র শ্রীনিরাপদ মুখোপাধ্যায়। নিরাপদদাদা পরবর্তীকালে রাজনীতির ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তখন জুনিয়র উকিল ছিলেন, আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন।
মক্কেল তখনো কেউ আসেনি; সদর দরজা ভেজানো আছে। বাবা আর নিরাপদদাদা টেবিলের দুই পাশে বসে বিশ্রম্ভালাপ করছেন। টেবিলের ওপর নথিপত্র, ভারী ভারী আইনের বই ছড়ানো রয়েছে।
হঠাৎ সদর দরজায় ঠেলা দিয়ে ঘরে ঢুকল—ফকির-বাবা। সেই শা-জোয়ান চেহারা, সেই কাঁধে কম্বল, সেই গালভরা হাসি। অনেকদিন তাকে আদালতে দেখিনি, আমাদের বাড়িতে তার পদার্পণও এই প্রথম। বাবা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
ফকির-বাবা তাঁর চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল; বলল, ‘বকিল সাহেব, দুটো টাকা দাও।’
বাবা বললেন, ‘তুমি টাকা কি করবে?’
সে ফোগলা মুখে হেসে সপ্রতিভভাবে বলল, ‘মদ খাব।’
বাবা দোনা-মনা করতে লাগলেন। টাকা দিলেন না, কিন্তু ‘দেব না’ বলে তাকে হাঁকিয়েও দিলেন না। বাবার মনে বোধ হয় সংশয় জেগেছিল, যে-ব্যক্তি মদ খাওয়ার জন্যে টাকা চায় তাকে টাকা দেওয়া উচিত কিনা।
নিরাপদদাদা এই সময় কথা বললেন। তিনি সে-সময় একটু নাস্তিক গোছের লোক ছিলেন, বললেন, ‘ফকির সাহেব, তুমি তো সাধুসজ্জন ব্যক্তি, ভুত দেখাতে পারো?’
ফকির-বাবা তৎক্ষণাৎ তাঁর দিকে ফিরে বলল, ‘হ্যাঁ, পারি।’
ক্ষণেকের জন্যে বিমুঢ় হয়ে গেলাম। বলে কি লোকটা! ভূত দেখাবে।
নিরাপদদাদা বললেন, ‘দেখাও ভূত। কিন্তু খাঁটি ভূত দেখাতে হবে, বুজরুকি চলবে না।’
ফকির-বাবা বলল, ‘এমন ভূত দেখাবো পিলে চমকে যাবে। এক তা সাদা কাগজ দাও।’
নিরাপদদাদা এক তা কাগজ টেবিল থেকে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। ফকির-বাবা কাগজ স্পর্শ করল না, কেবল কাগজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘হয়েছে। এবার কাগজটা চাপা দিয়ে রাখো।’
নিরাপদদাদা একটা ভারী বইয়ের তলায় কাগজ চাপা দিয়ে রাখলেন। ফকির-বাবা তখন চেয়ার টেনে বসল, নিতান্ত সহজভাবে এ-কথা সে-কথা বলতে লাগল। কথাগুলো এতই সাধারণ যে আজ আর তার একটি কথাও মনে নেই।
পাঁচ মিনিট পরে ফকির-বাবা গালগল্প থামিয়ে বলল, ‘এবার কাগজটা বের করে দেখ।’
নিরাপদদাদা বই-এর তলা থেকে কাগজ বের করলেন। কাগজ দেখে সত্যিই পিলে চমকে উঠল। তার ওপর আঁকা রয়েছে এক বিকট ভয়ঙ্কর চেহারা। ছেলেমানুষদের ভয়-দেখানো রাক্ষস-খোক্কসের চেহারা নয়, এমন একটা জীবন্ত হিংস্র কদর্যতা আছে ঐ চেহারায় যে, বয়স্থ মানুষেরও বুক গুরগুর করে ওঠে। আমরা মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে রইলাম।
ফকির-বাবা অট্টহাস্য করে বলল, ‘দেখলে ভূত? এবার চাপা দিয়ে রাখো।’
নিরাপদদাদা যন্ত্রচালিতের মতো কাগজখানা আবার বই-চাপা দিলেন। ফকির-বাবা পিতৃদেবের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘টাকা দাও।’
বাবা নিঃশব্দে দুটি টাকা দেরাজ থেকে বের করে তার হাতে দিলেন। ফকির-বাবা গালভরা হাসি হাসতে হাসতে চলে গেল।
আমরা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম। তারপর নিরাপদদাদা দ্বিতীয়বার চাপা দেওয়া কাগজখানা বের করলেন। দেখা গেল কাগজে ভূতের চেহারা নেই, সাদা কাগজ আবার সাদা হয়ে গেছে।
৮ জানুয়ারি ১৯৬৩