ফকির আলির হাত – জয়ন্ত দে
নাচতে নাচতে ভ্যান-রিকশাটা দৌড়োচ্ছিল। পেছনে দুটো বাচ্চা ধরে জনা আটেক সওয়ার। অবশ্য এই জনা আটেকের বাইরে আছে আরও দুটো প্রাণী। একটা ছাগল, একটা মুরগি। ছাগলটা মাঝে মাঝে গলা তুলে ব্যা ব্যা করার চেষ্টা করলেই, তার মালিক খপাত করে মুখটা টেনে কোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মুরগিটাও কোঁ কোঁ করে সুর ধরবে কী ধরবে না ভাবছে। কিন্তু ভ্যান-রিকশাটা ক্রমাগত ক্যাঁচক্যাঁচ করেই চলেছে। তার কোনো মানা নেই। আর মানুষগুলো ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে বিড়ি খাচ্ছে। আর উশখুশ করছে কথা বলার জন্যে।
জায়গাটা গোসাবা। এ মানুষগুলো, সবাই যাবে জেমসপুরে।
এর মধ্যেই ছাগলটা বেশ জোরেই ডেকে উঠল, ব্যা ব্যা ব্যা…।
একটা লোক একটু নড়েচড়ে বলল, বেশি ডাক ছাড়িসনে বাপ, কর্তামশাই তো ধারে-কাছেই ঘুরছে, হালুম করে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লেই হল।
এইবার যেন কথা পেল সওয়ারিরা। একজন বলল, লাহিড়ীপুরে শুনলাম বাঘ ঢুকেছে। তা গেছে, না আছে এখনও?
প্রথম লোকটিই আবার বলল, গারাল নদী পেরিয়ে ঢুকেছে, সহজে কী যাবে? শুনলাম তো তাড়ানোর জন্যে খুব তোড়জোড় চলছে। আর সে বেটা নাকি অচিন্ত্য পাইকের ধানখেতে গিয়ে ঢুকেছে। সব্বাই এখন ধানখেত ঘিরে হল্লা করছে।
এবার অন্য একজন, সেই ছাগল কোলে-করা বুড়ো বলে, ও তো গারাল পেরিয়ে এসেছে, সুন্দরবন দত্ত রেঞ্জের বাঘ।
ভ্যান-রিকশার একদম পেছনে বসে ফকির আলি। যাবে জেমসপুর। একটা কাজের খোঁজ পেয়ে সে চলেছে। নুলো মানুষ, কাজের বড়ো অভাব। গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে সে সামনের মানুষগুলোকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে।
প্রথম লোকটা আবার বলে, বাঘটা নাকি বেশ বড়োসড়ো। সকালে একটা গোরুও মেরেছে।
আবার ফকির আলি লোকটার দিকে তাকায়। তারপর ঘড়ঘড় গলায় বলে, বাঘ কী? মদ্দা নয়, বাঘিনিই হবে। বাচ্চা বিয়োতে ঢুকেছে নির্ঘাত।
ফকির আলি জানে, বাঘিনিরা বাচ্চা হবার সময় নিরিবিলি জায়গা খোঁজে। কেন-না বাঘরা বাঘিনিদের বাচ্চা হলেই সেগুলো মেরে ফেলে। আর সেই জন্যেই, বাঘের হাত থেকে বাচ্চাদের বাঁচাতে বাঘিনিরা নিরিবিলি জায়গা খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে মাঝে-মধ্যে ভুল করে চলে আসে এখানে। না-হলে তারা জঙ্গলের প্রাণী কেন লোকালয়ে আসবে?
দ্বিতীয় লোকটা এবার ফস করে একটা বিড়ি ধরায়। লম্বা একটা টান মেরে বলে, তা সে বাঘ হোক আর বাঘিনি, ফিরে যেতে পারবে বলে তো মনে হয় না। এখানে, লাহিড়ীপুরেই খতম হয়ে যাবে।
চমকে তাকায় ফকির আলি। একমাথা বড়ো বড়ো ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল। একমুখ দাড়ি। মাঝে সুন্দরবনের অসংখ্য চরের মতো ঠোঁট-নাক-চোখ জেগে আছে। কিন্তু সেই চুল-দাড়ির ভেতর জেগে থাকা চোখটা কুঁচকে ছোটো করে সে দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাকাল। এবার দ্বিতীয় লোকটার কথা টপ করে লুফে নিয়ে কথা বলে উঠল আর একজন, এ তল্লাটে তো রেকর্ড আছে, বনের বাঘ একবার ঢুকলে আর ফেরে না। ফিনিশ!
প্রথম লোকটা বলে, তা বটে। এই তো ক-দিন আগে বাঘের পায়ের খোঁজ করে করে হন্যে হয়ে পড়েছি। এমন সময় শুনলাম একটা রান্নাঘরে নাকি ঢুকেছে ব্যাটা। ব্যস, মানুষের রোখ বলে কথা, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এক্কেবারে খতম। তারপর বনদপ্তরের লোক এল, পুলিশ এল, কম ঝামেলা তো করল না। কিন্তু তারপরেও এদিকে আবার বাঘ ঢুকল। তাকেও পিটিয়ে মেরে নিকেশ করে দিল এদিককার মানুষ। এমনকী মেরে আগুন দিল গায়ে, যাতে বাঘের সব প্রমাণ সাফ হয়ে যায়। তখনও বনদপ্তর, পুলিশ আসল। সে মামলা তো এখনও চলছে। জেমসপুর-লাক্সবাগানে রেকর্ড আছে বটে বাঘ মারার। কথাগুলো যেন মনঃপূত হল না ফকির আলির। ভ্যানের পাটা থেকে হাত তুলে চুলে ঝাপটা মারল। গম্ভীর রাগত গলায় বলল, বাঘ ঢুকেছে বলে তাকে মারতে হবে। এ কেমন ধারা বিচার। তাকে তাড়িয়ে দিলেই হল। জঙ্গলের প্রাণী আবার জঙ্গলে যাবে।
দ্বিতীয় লোকটা বলল, তবু বাঘ মারা বলে কথা। সুযোগ পেলে কে আর ছাড়ে? লোকটার কথায় যেন গর্জে ওঠে ফকির আলি, তবে জঙ্গলে যাক। দখিনরায়ের এলাকায় ঢুকে মেরে আসুক তাকে, এখানে বাগে পেয়ে, সবাই মিলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে কী বীরপুরুষের কাজ বাবু!
প্রথম লোকটা ফোঁস কাটে, তোমার তো দেখছি খুব দরদ। তা তুমি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মেরেছ নাকি? ফকির আলির মুখটা অদ্ভুত কুঁচকে যায়, হাসে কিনা বোঝা যায় না। তারপর দাড়ি-চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, সে একটা কাহিনি আছে বটে, তবে তেমন কিছু নয়।
তবু শোনা যাক, শোনা যাক, সবাই নড়েচড়ে ওঠে।
ফকির আলি বলতে শুরু করে, আমরা হলাম গিয়ে জঙ্গল হাঁসিল করে, চরজাগা অঞ্চলের মানুষ। আর আমাদের জাতব্যাবসা হল জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করা। এই মধু আনতে গিয়ে আমার বাপ, কাকা, আত্মীয়বন্ধু অনেকেই বাঘের পেটে গেছে। তবু কী করব, পেটের জ্বালা। এ কাজ ছাড়তে পারি না। আর এখন তো বাঘে খেলেও কারো কাছে নালিশ জানাতে পারব না। প্রাণ বাঁচাতে বাঘ মারা তো দূরের কথা। এবার অধৈর্য গলায় প্রথম লোকটা বলে, আসল কাহিনিটা বলো দিকি বাবু। ফকির আলি একটু দম নেয়, নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু ভ্যানের তেলহীন চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ।
ফকির আলি বলে, এখন বুঝলেন জঙ্গলে মধু কাঠ কিংবা মাছ ধরতে গেলে যদি কাউকে বাঘে খায়, গলা ছেড়ে কাঁদার জো নেই। এখন তো জঙ্গল সরকারের, আর জঙ্গলে ঢুকতে গেলে লাইসেন্স লাগে। আমাদের কারোরই লাইসেন্স নেই। চুরি করে জঙ্গলে ঢোকা। মধু, কাঠ সব চুরি করা বলতে পারেন। ছাগল কোলে করা লোকটি এবার বলে ওঠে, তুমি কি জঙ্গলে বাঘের সামনে পড়েছিলে? সামনে মানে এক্কেবারে সামনে। যখন হুঁশ হল আমার থেকে বিশ হাত দূরে তিনি। আশপাশে কেউ নেই। আমরা সঙ্গীরা বেশ দূরে দূরে, যে যার মতো কাজে ব্যস্ত। আমরা সবাই মাথার পেছনে একটা মুখোশ পরি। যাতে তিনি বোঝেন আমরাও তেনাকে দেখতে পেয়েছি। যাতে সে অন্তত একটু থমকে দাঁড়ায়। আর আমরা একটু সুযোগ পাই। আমাদের চোদ্দোজনের দলে দশজন মহুলে, আর চারজনের দায়িত্বে চারদিকের নজরদারি। কিন্তু হলে কী হবে, ‘কপালে লেখা—বাঘের দেখা।’ খন্ডাবে কে? আমার বিশ হাত দূরে বাঘ। কাউকে হাঁক পেড়ে ডাকারও সময় নেই—বনবিবির নামও স্মরণে নেই। সামানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। বলতে বলতে বিদ্যুৎচমকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমিও তখন মনস্থির করে ফেলেছি, হাতে অস্ত্র বলতে জঙ্গল কেটে পথ চলার জন্য সামান্য একটা কুঠার। আমিও কুঠার বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুজনেই পড়েছি। ও থাবা মারে। ওর দাঁত—থাবা—নখ মেলা অস্ত্র—আর আমার শুধু কুঠার আর মরিয়া সাহস। প্রথম ধাক্কাতেই আমি পড়ে গিয়েছিলাম। এই পড়ে যাওয়াতে কিছু সুবিধা পেয়েছিলাম বটে আমি। শুয়ে শুয়েই ওর হাঁ করে, জিব দাঁত বের করে নেমে আসা মুখে লাগালাম এক কোপ। কোপটা ঠিক ওর নাক আর হাঁ-মুখের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে ওর শরীর আমার ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু কুঠারটা ওর মুখের ওপর গেঁথে। একটা ঝটকা মারতেই, দেখি আমি খালাস। ওর শরীরের ভার নেই আমার ওপর। ও মাটিতে আর আমি ওর ওপর। চালালাম কুঠার, কোপের পর কোপ। ততক্ষণে আমার সঙ্গীরাও চিৎকার জুড়েছে, হল্লা লাগিয়েছে, তখন তাদের আর কিছুই করার নেই। এদিকে, কোপের পর কোপ, ওদিকে হল্লা, তিনি ঝটকা মেরে উঠলেন। উঠলেন বটে কিন্তু আর দাঁড়ালেন না, এক লাফে জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন চোখের নিমেষে।
ব্রেক কষল ভ্যান-রিকশা, এসে গেল জেমসপুর। প্রথম লোকটি বিস্মিত গলায় বলে, বাঘ তাহলে তোমায় ছেড়ে দিয়ে গেল?
এবার স্পষ্ট হাসল ফকির আলি। স্পষ্ট হয়ে হো হো শব্দে ফেটে পড়ল। ছেড়ে দিয়ে কী তিনি যান? হাসি আর ব্রেক কষার ধাক্কায় গা থেকে খসে পড়েছে চাদর। হাসির মতোই স্পষ্ট হল ফকির আলির কাঁধ। কাঁধের বাঁদিকটা শূন্য। হাতহীন জামার ফাঁকা হাতটা হাওয়ায় দুলে ওঠে, যেন ফকির আলির বিজয়ঝাণ্ডা। আর সেই বিজয়ঝাণ্ডা উড়িয়ে ফকির আলি চলে…। ভাবে নুলো মানুষ, কামের ধান্দায় নয় পরেই যাবে। আপাতত লাহিড়ীপুরেই যাওয়া যাক, ‘তেনার’ বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার আগে তাড়িয়ে দিয়ে আসতে হবে বাবা দখিনরায়ের অঞ্চলে।