3 of 3

প্ৰেম

প্ৰেম

চৈত্র মাস। ফুটন্ত গরম। রোদে পুড়ে যাচ্ছে চারপাশ। সব কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া ঝাপসা। গঙ্গার জল থেকে একটা গরম ভাপ উঠছে। শানের মেঝেতে পা দিলেই লাফিয়ে উঠতে হয়। পঞ্চবটীর পক্ষিকুল পাতার ছায়ায় হিসেবকরে কখনো-সখনো একটু আধটু ডাকছে। কাকদের ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেছে। গঙ্গা থেকে যাঁরা স্নান করে চাঁদনিতে উঠছেন, তাঁরা অনবরত গামছা নিঙড়ে নিঙড়ে পায়ে জল দিচ্ছেন। দক্ষিণেশ্বর গ্রামের পথে চৈত্রের সন্ন্যাসীরা ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে গাজন গাইছে। গৃহস্থের আবাসে আবাসে মাধুকরী করছে।

কালীবাড়িতে পর পর পূজা শেষ হলো—দ্বাদশ শিবের, ভবতারিণীর, রাধাকান্তের। এইবার ভোগারতির বাজনা বাজছে মিলিত সুরে। কার্নিসের পায়রার ঝাঁক ছায়ার সন্ধানে ফটফট করে এধারে-ওধারে ওড়াওড়ি করছে। এইমাত্র জোয়ার এল গঙ্গায়। ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। এতক্ষণ বাতাস ছিল না আদৌ। জোয়ারের ঢেউ অনুসরণ করে বাতাস এল দক্ষিণ দিক থেকে। কখনো উষ্ণ কখনো শীতোষ্ণ। তরতর করে ভেসে চলেছে পালতোলা বড় বড় ভিস্তি নৌকা। আহিরীটোলা থেকে মালবোঝাই করে চলেছে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তরে আরো উত্তরে।

ছোট্ট এক খিলি পান মুখে পুরলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। বসে আছেন নিজের ঘরের তক্তপোশে নিপাট সাদা বিছানার একধারে পা-দুটি ঝুলিয়ে। আলফানসো আমের পাতলা আঁটির মতো অতি কোমল পায়ের পাতা দুটি মেঝে স্পর্শ করে আছে। পদ্মকলির মতো দশটি আঙুল। এইমাত্র মধ্যাহ্ন আহার শেষ হয়েছে। এইবার সামান্য বিশ্রাম। সোনার বরণ চওড়া পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস ঘরের মেঝেতে তিনজন ভক্ত বসে। তাঁরাও প্রসাদ পেয়েছেন। একজন সিঁদুরিয়াপট্টির ধনী ব্যবসায়ী মণিলাল মল্লিক। দ্বিতীয়জন রাখাল (পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ, ঠাকুরের মানসপুত্র)। তৃতীয়জন কথামৃতকার শ্রীম। দক্ষিণের ফুরফুরে জোয়ার-গঙ্গা-বাতাস দ্বিপ্রহরের ভরাপেট শরীরে একটা ঘুম ঘুম ভাব আনছে।

ঠাকুর মণিলালের দিকে তাকিয়ে আছেন বেশ কিছুক্ষণ। চোয়াল-দুটি নড়ছে মৃদুমৃদু। পান চিবোচ্ছেন। হঠাৎ হাসতে হাসতে বললেন, মণি, লোকে বলে তোমার অনেক টাকা! তা কথাটা তো মিথ্যে নয় বাপু। আমি বলি কি, অত টাকা নিয়ে তুমি করবেটা কি! কিছু তো মানুষের উপকারে খরচ করা যায়! যেমন ধর এই রাখাল। রাখাল বলছিল, ওদের দেশ বসিরহাটে খুব জলকষ্ট। তা তুমি বাপু ওখানে একটা পুষ্করিণী কাটিয়ে দাও না, তাহলে কত লোকের উপকার হবে বল তো!

মণিলাল নীরব। হ্যাঁ, না—কিছুই বলছেন না। ঠাকুর দেখছেন। হাসিটি লেগে আছে মুখে। প্রশ্ন করলেন—কিগো কিছুই তো বলছ না, দেবে? পুকুর একটা কাটিয়ে দেবে? তবে শুনেছি তেলিরা নাকি বড় হিসেবি! ঠাকুরের মন্তব্যে অন্য ভক্তরা হাসলেন, ঠাকুরও হাসছেন। কথা ঘুরে গেল। চৈত্রের কথা, বৈশাখের কথা। তিনি শুষ্ক, তিনি সরস, তিনি ভয়ঙ্কর, তিনি মধুর, তিনি দাতা, তিনি কৃপণ। বিপরীত গুণের অধিকারীই ভগবান। “অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্।” (কঠ-উপনিষদ্ ১।২।২০) – সূক্ষ্মর চেয়ে সূক্ষ্মতর, আবার বিশাল হতে বিশালতর। মণিলাল এতক্ষণ কি শুনছিলেন তিনিই জানেন, হঠাৎ বললেন : “মহাশয়, পুষ্করিণীর কথা বলছিলেন, তা বললেই হয়, তা আবার তেলি-ফেলি বলা কেন!”

ঘরে হাসির রোল উঠল। ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, দেখেছ! এতক্ষণ ধরে ঐটাই ভাবছিল!

বিশ্রাম আর হলো না। কলকাতা থেকে এসে গেলেন পূর্ব-পরিচিত কয়েকজন ব্রাহ্মভক্ত। ঘর ভরে গেল। ঠাকুর মহা খুশি। ছোট খাটটিতে উত্তরাস্য হয়ে বসেছেন। আনন্দময় এক বালকমূর্তি। মুখে উদ্ভাসিত হাসি। হাত-দুটি কোলের ওপর। লম্বা লম্বা আঙুলে মুদ্রা আসছে, মুদ্রা ভাঙছে। আঙুলে আঙুলে ভাবের খেলা।

ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের দিকে তাকিয়ে বললেন : “তোমরা ‘প্যাম’ ‘প্যাম’ কর, কিন্তু প্রেম কি সামান্য জিনিস গা? চৈতন্যদেবের ‘প্রেম’ হয়েছিল। প্রেমের দুটি লক্ষণ। প্রথম—জগৎ ভুল হয়ে যাবে। এত ঈশ্বরেতে ভালবাসা যে বাহ্যশূন্য! চৈতন্যদেব ‘বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে, সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।’

মহাপ্রভু গয়াধাম থেকে ফিরে এলেন। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। চোখের দৃষ্টি অন্য জগতে। সবাই ছুটে এসেছেন তীর্থপ্রত্যাগত শচীনন্দনকে দেখতে। আবেশ-জড়ানো আয়ত জলপূর্ণ উদাস দুটি চোখ। তাঁরা ব্যাখ্যা করলেন— হয়তো অনাহার, অনিদ্রা, ক্লান্তি, পথশ্রান্তি। কিন্তু অত্যন্ত নম্রসুরে তিনি বললেন :

“তোমা সবাকার আশীর্বাদে
গয়াভূমি দেখি আইলাম নির্বিরোধে।।”

উপস্থিত পণ্ডিত, ভক্ত বৈষ্ণব, সজ্জনমণ্ডলী নিমাই পণ্ডিতের ভক্তিনম্র ব্যবহারে অবশ্যই মুগ্ধ; কিন্তু তেজস্বী শাস্ত্রমুখ, অদ্বিতীয় সেই পণ্ডিতটি এমন বদলে গেলেন কেমন করে!

কয়েকজন অতি অন্তরঙ্গকে কাছে ডেকে তিনি বলতে লাগলেন : “বন্ধুসব! শুন কহি কথা।” কি কথা! সে যে কৃষ্ণকথা—”কৃষ্ণের অপূর্ব যে দেখিলা যথা তথা।” শ্রীকৃষ্ণ গয়ায় এসে যেখানে পা ধুলেন—

“সে চরণ-উদক প্রভাবে সেই স্থান।
জগতে হইল ‘পাদোদক-তীর্থ’ নাম।।”

আর বলতে পারলেন না। বারুদ্ধ। চোখে অঝোর ধারা। বুক ভেসে গেল! কোনরকমে বললেন : “বন্ধুসব! আজি ঘরে যাহ।” সকলে চলে যেতে উনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন—”কৃষ্ণ কৃষ্ণ, কোথা কৃষ্ণ কোথা কৃষ্ণ!” সে এক অসহ্য বিরহ! দেহবোধ নেই। আহারে রুচি নেই। শচীমাতা বিষ্ণুপ্রিয়াকে সামনে এগিয়ে দিলেন। মহাপ্রভু স্ত্রীকে দেখে হুঙ্কার দিয়ে বললেন : “সংহারিমু, সংহারিমু। মুঞি সেই মুঞি সেই।”

শ্রীবাসের কাছে খবর চলে গেল—

“পরম অদ্ভুত কথা, মহা অসম্ভব।
নিমাঞি পণ্ডিত হইলা পরম বৈষ্ণব।।”

শ্রীবাস বলে উঠলেন—

“গোত্রং নো বর্ধতাম্—গোত্র বাঢ়াউক কৃষ্ণ আমা সভাকার।”

শচীমাতার সংশয়—পুত্র কি উন্মাদ হলো!

অবিরত ক্রন্দন—

“কোথা কৃষ্ণ, কোথা আমার কৃষ্ণ।
আনি দেহ মোরে নন্দগোপের নন্দন।
পাইলু ঈশ্বর মোর কোনদিকে গেলা!”

সর্বত্র রটে গেল, মহাবায়ু রোগে আক্রান্ত নিমাই পণ্ডিত একবার চেতনা প্রাপ্ত হয়ে মহাপ্রভু শ্রীবাস পণ্ডিতকে বললেন :

“কি বুঝ পণ্ডিত! তুমি মোহোর বিধানে।
কেহ বলে মহাবায়ু, বান্ধিবার তরে।
পণ্ডিত! তোমার চিত্তে কি লয় আমারে।।”

শ্রীবাস হাসতে হাসতে বললেন : “ভাল বাই। তোমার যেমত বাই তাহা আমি চাই।” পণ্ডিত আরো বললেন, ভাই! শাস্ত্রে একে বলে মহাভক্তিযোগ। মানুষের জীবনে দুর্লভ। শ্রীমতীর ঠিক এমনটি হয়েছিল।

“মহা অভিযোগ দেখি তোমার শরীরে।
শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ হইল তোমারে।।”

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ হাসছেন আর বলছেন, প্যাম প্যাম! আরে প্রেম কি সামান্য জিনিস! প্রেমের দ্বিতীয় লক্ষণ কি তা জান? এই যে নিজের দেহ এত প্রিয় জিনিস, এর ওপরও মমতা থাকবে না। দেহাত্মবোধ একেবারে চলে যাবে। ঠাকুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একই অবস্থা তো তাঁরও হয়েছিল। ভালবাসার গভীরতা কতটা হলে তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে? ‘বৃন্দাবনলীলা’র দিকে তাকাও। গোপ, গোপী আর রাখালদের দেখ। তারা শ্রীকৃষ্ণকে কিভাবে ভালবেসেছিল। যখন শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেলেন, রাখালেরা তাঁর বিরহে কেঁদে কেঁদে বেড়াত। ঠাকুর গাইছেন—

“দেখে এলাম এক নবীন রাখাল,
নবীন তরুর ডাল ধরে,
নবীন বৎস কোলে করে
বলে, কোথারে ভাই কানাই!”

চৈত্রের ঝলমলে দুপুর বিকেলে হারাল। বাতাসের ঝাঁঝ ক্রমশ কমছে। ঠাকুর বসে আছেন তাঁর ঝলমলে দিব্যশরীর নিয়ে। এত কথা তবু ক্লান্তি নেই। ভক্তদের বলছেন, প্রেম মুখে নেই, জ্ঞান-বিচারে নেই। প্রেমের সুরা পান করতে হবে। এতক্ষণ পা মুড়ে বসেছিলেন, এইবার পা-দুটি মেঝেতে রাখলেন। খাটের ধারে বসেছেন। হাতদুটি কোলে জড়ো করা, বালক যেমন কোঁচড়ে মুড়ি ধরে রাখে। প্রেমের সুরা।

“আমায় দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)
আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।।
তোমার প্রেমের সুরা, পানে কর মাতোয়ারা।
ও মা ভক্তচিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে।।”

প্রেমের সুরা তৈরি হবে কিভাবে! ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ। এই আনন্দই সুরা। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, আমিই কালী। গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, আমিই কৃষ্ণ। তিনিই আমি—এই বোধ। “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে—সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়। এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়।”

ভক্তগণ স্তব্ধ। এ কি শুনছেন তাঁরা!

ঠাকুর আজ কৃপালু। ভক্তদের কৃপা করে পথের সন্ধান দিচ্ছেন—খুব ভালবাসা কেমন! যেমন ন্যাবা। চারিদিক হলদে দেখা যায়। ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসায় চারিদিক ঈশ্বরময় দেখায়। ভক্তরা আবার যেন মহাপ্রভুকেই সাক্ষাৎ দেখছেন। এবার শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রেম বোঝাচ্ছেন প্রেমের ঠাকুর—

‘পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি এই প্ৰেমা হৈতে।
এই প্রেমার বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে।।”

ঠাকুর নিজের ভাবে বিভোর হয়ে বলতে লাগলেন : “ঈশ্বরলাভের কতকগুলি লক্ষণ আছে। যার ভিতর অনুরাগের ঐশ্বর্য প্রকাশ হচ্ছে তার ঈশ্বরলাভের আর দেরি নাই। অনুরাগের ঐশ্বর্য কি কি? বিবেক, বৈরাগ্য, জীবে দয়া, সাধুসেবা, সাধুসঙ্গ, ঈশ্বরের নামগুণকীর্তন, সত্যকথা—এইসব। এইসকল অনুরাগের লক্ষণ দেখলে ঠিক বলতে পারা যায়, ঈশ্বরদর্শনের আর দেরি নাই। বাবু কোন্ খানসামার বাড়ি যাবেন—এরূপ যদি ঠিক হয়ে থাকে, খানসামার বাড়ির অবস্থা দেখে ঠিক বুঝতে পারা যায়। প্রথমে বনজঙ্গল কাটা হয়, ঝুল ঝাড়া হয়, ঝাঁটপাট দেওয়া হয়। বাবু নিজেই শতরঞ্চি, গুড়গুড়ি—এইসব পাঁচরকম জিনিস পাঠিয়ে দেন। এইসব আসতে দেখলেই লোকের বুঝতে বাকি থাকে না, বাবু এসে পড়লেন বলে।

ভক্তের ভীত প্রশ্ন : তাঁকে ভালবাসতে পারছি কই, নামে রুচি আসে কই! উঠে দাঁড়ালেন ঠাকুর। গঙ্গার পরপারে সূর্য নামছেন অস্তাচলে, জীবনের আরো একটি দিন গেল চলে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভগবান বললেন : ব্যাকুলতা! ব্যাকুল প্ৰাৰ্থনা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *