প্ৰতিধ্বনি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দুরকমের বাতাসের কথা বারে বারে, নানা কথার ছলে ভক্তদের বলতেন। কু-বাতাস আর সু-বাতাস। প্রায়ই গাইতেন—”কু-বাতাসে দিয়ে পাড়ি হাবুডুবু খেয়ে মরি।”
পৃথিবীর এই হলো নিয়ম, এই হলো ধরম। জীবনের ওপর দুটো প্রভাবই থাকবে। আদর্শ পৃথিবী মানুষের চিন্তায়, মানুষের কল্পনায়, মানুষের স্বপ্নে। বাস্তব অন্য জিনিস। এক জটিল জলস্রোত। ভোগের পৃথিবী, লোভের পৃথিবী, বঞ্চনার পৃথিবী, খুনীর পৃথিবী জীবনকে গ্রাস করে বসে আছে। মেটিরিয়ালিজম ধর্ম ভোলাতে চাইছে, অনবরতই কানের কাছে পশুশক্তির জয়গান গাইছে। মানুষকে বলছে—তুমি বুদ্ধিমান জন্তু। আত্মশক্তি, সেলফ রিয়েলাইজেসানের কথা ভেবো না। ওসব আদ্দিকালের অচল লোক-ঠকানো কথা। ধর্ম ঈশ্বর- এসব হলো ধনীর বিলাসিতা। গরিবের ইনটক্সিকেসান। মানুষকে ভুলিয়ে রাখার ছলাকলা। নয়া মতবাদ – Produce or Perish.
যন্ত্রে যন্ত্রের মতো জুড়ে যাও! চাকা ঘোরাও। রাষ্ট্রের ভাণ্ডার পূর্ণ করে দাও সম্পদে। ধনী হও, ভোগী হও। মানুষ হলে কিনা সে প্রশ্ন পরে। ঈশ্বর নয় ওয়েলথ, গড নয় ডেমন, ভজ গৌরাঙ্গ নয়, জপ কাঞ্চন। Get rich quick. বাড়ি, গাড়ি, পঞ্চ ম-কার আধুনিক মানুষের ভগবান।
Macbeth has murdered sleep. পশ্চিমের ধনী দেশের মানুষ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। সব পেয়েও শূন্য, নিঃসঙ্গ জীবন। দেশ আছে। দেশাত্মবোধ আছে। জাতীয় অহঙ্কার আছে। বিশাল সম্পদ আছে। বাহুবল, অস্ত্রবল আছে। এক তুড়িতে অন্য দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা আছে। নেই পরিবার। কে কার? পিল ছাড়া ঘুম আসে না। মন ভেঙে টুকরো টুকরো। শত বিভক্ত ব্যক্তিত্ব। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিতে সব জেরবার।
স্বামীজী যখন বলেছিলেন, “খালি পেটে ধর্ম হয় না”, তখন ভারত ছিল পরাধীন। অতি দরিদ্র, শোষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ভেদাভেদে শতচ্ছিন্ন, ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা অপহৃত। সেই ভারতে ওই উক্তির প্রয়োজন ছিল। ধার্মিকের আলস্য পরিহার করে ফকির থেকে উজির হবার প্রয়োজন ছিল। স্বামীজী বলেছিলেন : “ভিখারির আবার ত্যাগ কি? আগে সব পাও, তারপর মায়ামুক্ত বৈদান্তিকের উদাসীনতায় সব লাথি মেরে ফেলে দাও।”
দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা স্বামীজীকে ঠিক ঠিক বুঝিনি। আজো আমাদের আত্মবিমুখতা, অধার্মিকতা, কদাচারিতাকে ঐ একটি উক্তি দিয়ে সমর্থন করে চলেছি। স্বামীজীর অজস্র উক্তি থেকে একটিকে বিচ্ছিন্ন করে এনেছি নিজেদের অপকর্মের আচ্ছাদনী হিসেবে। শয়তানের এই তো ধর্ম। অথচ স্বামীজী যা চেয়েছিলেন তা হলো—
“আমি দুনিয়া ঘুরে দেখলুম—এদেশের মতো এত অধিক তামস প্রকৃতির লোক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাহিরে সাত্ত্বিকতার ভান, ভেতরে একেবারে ইট-পাটকেলের মতো জড়ত্ব—এদের দ্বারা জগতের কি কাজ হবে? এমন অকর্ম, অলস, শিশ্নোদরপরায়ণ জাত দুনিয়ায় কতদিন আর বেঁচে থাকতে পারবে? ওদেশ (পাশ্চাত্য) বেড়িয়ে আগে দেখে আয়, পরে আমার ঐ কথার প্রতিবাদ করিস। তাদের জীবনে কত উদ্যম, কত কর্মতৎপরতা, কত উৎসাহ, কত রজোগুণের বিকাশ! তোদের দেশের লোকগুলোর রক্ত যেন হৃদয়ে রুদ্ধ হয়ে রয়েছে—ধমনীতে যেন আর রক্ত ছুটতে পারছে না—সর্বাঙ্গে প্যারালিসিস হয়ে যেন এলিয়ে পড়েছে! আমি তাই এদের ভেতর রজোগুণ বাড়িয়ে কর্মতৎপরতা দ্বারা এদেশের লোকগুলোকে আগে ঐহিক জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে চাই। শরীরে বল নেই—হৃদয়ে উৎসাহ নেই, মস্তিষ্কে প্রতিভা নেই! কি হবে রে, এই জড়পিণ্ডগুলো দ্বারা? আমি নেড়েচেড়ে ওদের ভেতর সাড়া আনতে চাই—এজন্য আমার প্রাণান্ত পণ। বেদান্তের অমোঘ মন্ত্রবলে এদের জাগাব। ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’–এই অভয়বাণী শোনাতেই আমার জন্ম। তোরা ঐ কার্যে আমার সহায় হ। যা গাঁয়ে গাঁয়ে, দেশে দেশে এই অভয়বাণী আচণ্ডাল ব্রাহ্মণকে শুনাগে। সকলকে ধরে ধরে বলগে যা—তোমরা অমিতবীর্য, অমৃতের অধিকারী। এইরূপে আগে রজঃশক্তির উদ্দীপনা কর—জীবন সংগ্রামে সকলকে উপযুক্ত কর, তারপর পরজীবনে মুক্তিলাভের কথা তাদের বল। আগে ভেতরের শক্তি জাগ্রত করে দেশের লোককে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করা, উত্তম অশন-বসন—উত্তম ভোগ আগে করতে শিখুক, তারপর সর্বপ্রকার ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্ত হতে পারবে, তা বলে দে।”
গাঁয়ের চেহারা, জেলা শহরের চেহারা পালটে গেছে। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ এসেছে। জীবনের চটক অবশ্যই খুলেছে। অর্থনীতির দুটো দিক খুলে গেছে, কালো আর সাদা। রজোগুণের বদলে বেড়েছে তমোগুণ। মানুষ আর কিছু বুঝুক না বুঝুক রাজনীতিটা বেশ ভালই বুঝেছে। আর সেই আগুনে বাতাস করছে নানা মতবাদ। আর সেই বাতাসটাই হলো কু-বাতাস। এ-যুগের একটিই মাত্র মন্ত্রদীক্ষা—ভায়োলেন্স। একটিই মাত্র মন্ত্রদীক্ষা— ‘করাপসান’। জনে জনে শুধু বলা হচ্ছে—পশু হও। মারো, মরো, হিস্সা বুঝে নাও।
“They have sacrified you to a symbol, and you carry them to power over yourself.” [ Wilhelm Reich] মতবাদের হাঁড়িকাঠে মাথা, কথার জাদু হলো খড়্গা। সম্মোহিত হয়ে সাধারণ মানুষ যাঁদের মাথায় বসিয়েছে, তাঁরা কিন্তু পাকে প্রকারে একটি কথাই বলেন-তুমি এবং তোমার জীবনের বাস্তবিকই কোন দাম নেই। তোমার পরিবার, পরিজন, পুত্রকন্যা কিছুই না। তুমি এক মহামূর্খ, দাসমাত্র। তোমাকে দিয়ে যা খুশি করানো যায়, যেমনভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ভাঁওতা মাত্র, জাতীয় স্বাধীনতা হয়তো আছে।
“This is why I am afraid of you, Little Man, deadly afraid. For on you depends the fate of humanity” [ Reich] ক্ষুদ্র মানুষ, সাধারণ মানুষ, বড় ভয় হয় তোমাদের জন্যে। তোমরাই যে তোমাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। তোমাদের জন্য ভয় হয়। তোমরা কোন কিছু থেকে পালাও না পালাও, নিজেদের কাছ থেকে আগে পালাচ্ছ। তোমরা অসুস্থ, ভীষণ অসুস্থ। তোমাদের দোষ নেই অবশ্য। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার দায়িত্ব তোমার নিজের। যারা তোমাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তাদের তোমরা যে কোন মুহূর্তে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পার। পার না কেন, একটিই মাত্র কারণ, তোমরা দলিত হতে ভালবাস। দলনকারীকে তোমরা সমর্থন কর। “No police force in the world would be powerful enough to suppress you.” সামান্যতম আত্মসম্মানবোধ থাকলে কেউ তোমাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। সেই গভীর উপলব্ধি যদি থাকত! সাধারণ মানুষ ছাড়া, পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে না! “Did your ‘liberator’ tell you that? No. He called you the ‘Proletarian’ of the world, but he did not tell you that you, and only you are responsible for your life.” [Reich] একটি কথা, আজকের সার কথা, দূরকাল থেকে ভেসে আসা স্বামীজীর সেই নির্দেশ— শিক্ষাহীন, ধর্মহীন বর্তমান অবনতিটার কথা তাদের বুঝিয়ে দিয়ে বলগে——ভাই সব’ ওঠো জাগো। কতদিন আর ঘুমুবে?’ এই কণ্ঠস্বরকে সপ্তগ্রামে তুলতে হবে, ছাপিয়ে যেতে হবে তাদের, যারা বলে—বন্ধুগণ, পশু হও, অধার্মিক ইতর হও।