প্ল্যানচেট
একটা মস্ত সাদা কাগজের মাঝখানে বাটি রেখে বৃত্ত আঁকা পেনসিলে। বৃত্তের ধার দিয়ে গোল করে লেখা এ বি সি ডি ই এফ জি এইচ…একস ওয়াই জেড। সেই বড়ো গোলের মধ্যিখানে একটা ছোট্ট বাটি ফেলে, তাতে তর্জনী ঠেকিয়ে, চোখ বুজে আপন মনে অমল ক্রমান্বয়ে প্রশ্ন করে চলেছে, বউদি, তুমি এসেছ? এলে ইয়েস লিখে বলো তুমি এসেছ।
শীতের সকালের মিঠে রোদ খেলছে সারাছাদে। চিলেকোঠার দরজা আঁট করে টানা। চারটে জানলার তিনটেই ভেজানো। শুধু একটা জানলা দিয়ে তেরছাভাবে পাতলা, জলের মতো রোদ এসে পড়ছে ফর্সা কাগজটার ওপর। কাঁসার বাটিটার গায়ে মাঝ মাঝে ঝিলিক। দিচ্ছে রোদ। পাড়ার রোয়াকে রোয়াকে মজলিশ। অমলদের ছড়ানো-বিছোনো ছাদটা নিস্তব্ধ, খাঁ খাঁ। চিলেকোঠার পায়রাগুলোও চরতে বেরিয়েছে, দূর থেকে একবার শুধু ফটিকের চিৎকার ভেসে এল–ভোকাট্টা-আ-আ-আ-আ
অমলের কিন্তু প্ল্যানচেটে ছেদ পড়ার কথা নয়। সে একমনে ডেকে যাচ্ছে, বউদি তুমি এসেছ? এসে থাকলে একবার ওয়াই, একবার ই, আর একবার এস-এ যাও। তাহলে বুঝব এসেছ।
একতলার নিজের ঘরে দোর এঁটে বসে নির্মল ভাবছে, কুন্তলা এটা করতে গেল কেন? আগের রাতেও যে গলা জড়িয়ে বলতে পারে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই বাপী, গালে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বার বার বলে আমার নিজের থেকেও তোমাকে ভালোবাসি বাপি, সে হঠাৎ করে সকালে চা দিতে দিতে কে বলে? অমলের খেয়াল রেখো, বাপী, তারপর অমল স্নান করতে গেলে দিব্যি শাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে বসল। মরা কি এত সহজ জিনিস? জীবন, সংসার, ভালোবাসা—এসবের কোনো পিছুটান নেই? পায়ে ধরে কেউ কাউকে বাঁচিয়ে রাখে নাকি পৃথিবীতে? সবাই-ই তো নিজের টানে বাঁচে। নিজের নিজের জেদে মরে। তোমার হঠাৎ মরার জেদ হল কেন, কুন্তলা? আগের রাতের ভালোবাসাও হেরে গেল, এমন জেদ কোথায় লুকিয়ে ছিল তোমার? বিয়ের ছ-ছটা মাস পেরোল না, অথচ এভাবে লোক হাসিয়ে গেলে?
হাসপাতাল থেকে লজ্জায় মুখ ঢেকে পালিয়ে এসেছে পৃথা আর স্বাতী। পাড়ার ছেলে মেয়েরা ভিড় করে দেখতে গেছে আগুনে পোড়া সুন্দরী কুন্তলাকে। আগুনের মতো রং ছিল নতুন বউটার। এখন পুড়ে, ফোসকায় ফোসকায় মুখ ভরে, কালো কয়লা হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। পৃথা, স্বাতীকে দেখে, কী হল ব্যাপারটা? হঠাৎ এমন অ্যাক্সিডেন্ট? কী করে লাগল?—এইসব বুক জ্বালানো, অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে ছুটে এল সবাই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওরা কুন্তলার মার কান্না আর চিৎকার শুনেছে, আমার সোনার প্রতিমা এভাবে বিসর্জন হল শেষে? পই পই করে সেদিন বলেছিলাম, মামণি, ওই থামওলা বাড়ির ভেতরটা ঠন ঠন। সব গেছে দেনার দায়ে। আর কার্তিকঠাকুর চেহারা দেখে ভুললি। ও তোর নখের যোগ্য নয় মা। ছ-মাসও গেল না, জানোয়ারটা আমার মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলে!’
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বারান্দায় এই কান্না শুনে আর ওপরে ওঠার সাহস হয়নি দুই বোনের। কিছুক্ষণ থরথর করে কেঁপেছে সিঁড়ির এক কোণে, তারপর পায়ের চটি হাতে নিয়ে খালি পায়ে দুদ্দাড় করে ছুটে এসেছে বাড়ি।
কিন্তু ঠাকুরঘরে গিয়ে মাকে কিছু জানানো হয়নি। মা কালীর ফটোর সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মা। একটু আগে পুলিশ এসে জেরা করে গেছে। বউটাকে কেমন ঠেকত, মৃন্ময়ী দেবী? বরের সঙ্গে বনিবনার গরমিল দেখতেন কি? কোথায় ছিলেন ছেলে যখন আগুন আগুন করে চেঁচাল, বউ কি আপনাদের পছন্দের ছিল? নাকের হীরেটা তো আপনারই দেওয়া তাই না? সম্মান-টম্মান কি করত বউ? অসবর্ণ বিয়ে বলে, লাভ ম্যারেজ বলে খেদ ছিল না আপনার?—একটা ঘোরের মাথায় হ্যাঁ না বলে কোনোক্রমে উত্তর করে গেছেন মৃন্ময়ী। ভেতরে ভেতরে লজ্জার আগুনে দগ্ধ হচ্ছিলেন। এ বাড়ির ফরাসে বসে এমন প্রশ্ন কেউ কোনোদিন করতে পারেনি তাকে। কুন্তলার গায়ের আগুন এখন মৃন্ময়ীর সারাশরীরে মনে। কথা শেষ করে ঠাকুরঘরে ঢুকতেই পুরোনো ফিটের রোগটা ফিরে এল সাত বছর পরে।
কাছেপিঠে অমলও নেই যে নাকে ন্যাকড়া পোড়া ধরে জ্ঞান ফেরাবে। ছাদের ঘরে অমলের আঙুলের ডগায় এখন বাঁই বাঁই করে ঘুরছে পেতলের বাটি। একবার ওয়াই একবার ই একবার এস, অর্থাৎ বউদি এসেছে। অমল বলল, বউদি তুমি এসেছ? বাটি ঘুরে ঘুরে ইয়েস লিখল। অমল জিজ্ঞেস করল, তুমি গায়ে আগুন দিলে কেন? বাটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়। অমল ভাবল বউদি ভাবছে কেন? উৎকণ্ঠার সঙ্গে অমল বাটিতে ঠেকিয়ে, চোখ বুজে বসে রইল সকালের রোদে চিলেকোঠার অন্ধকারে।
মায়ের সংবিত ফিরল পৃথা যখন সলতে পাকিয়ে কাপড় পোড়ার গন্ধ দিল নাকে। মৃন্ময়ী প্রথমে কথা বললেন, হ্যাঁ রে, ওরা কি নিমুকে ধরে নিয়ে গেল? পৃথা ঝাঁঝ করে বলল, কেন? দাদা কী করেছেন? দাদা কি বউদির গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন নাকি? কথা নেই, বার্তা নেই, ধরে নিয়ে গেলেই হল? মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ওরা তো তাই করে। স্বাতী এসে শুয়ে থাকা মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না তো বাপু। যা হবার হবে, তোমার ওই শরীরে কে কী করছে, বা করল ভেবে কাজ নেই। মৃন্ময়ীর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল অমলের কথা, জিজ্ঞেস করলেন, অমুটাও নিশ্চয়ই কিছু খায়নি সকাল থেকে। ও কোথায়? স্বাতী বলল, কাল রাতেও খেয়েছে কিনা ভগবান জানে। ঝটিদা বলল, ওর কালকের রাতের থালা যেমনকে তেমন পড়ে আছে।
মৃন্ময়ীর মাথায় রক্ত চেপে গেল—আর তোরা ধেই ধেই করে হাসপাতাল চলে গেলি। দেখলি না বাচ্চাটা খেল কি খেল না?
স্বাতী পরিস্থিতি সামলে দিতে বলল, অমু তোমার বাচ্চা? ও চৌবাচ্চা। দেখোনি বউদির সঙ্গে কী গলায় গলায় পিরিত। দাদা তাও ঠিক আছে, উনি মুহ্যমান। যেন ওরই বউ গেল।
মা ধমকে উঠলেন, চুপ। যা তা বকিস না। বউমাকে তো ওকেই কেবল ভালোবাসতে দেখলাম। কষ্ট হবে না? পৃথা মার হাত ধরে বলল, তুমি ওঠো, চান করে নাও। দেখো আবার কে কখন তদন্তে আসে। উঠতে উঠতেও মৃন্ময়ী আবার ধপ করে বসে পড়লেন—সত্যি! কপালে কত দুঃখ যে আছে আমার। শেষে বউয়ের গায়ে আগুনও দেখতে হল! আমায় কেন তুলে নেন না ঠাকুর। মা ডুকরে কাঁদছে দেখে কথা ঘোরাতে পৃথা বলল, বউদির মা এক হাট। লোকের সামনে চিৎকার করে বলছিল আমরা নাকি পুড়িয়ে মেরেছি ওর সোনার প্রতিমাকে।
মৃন্ময়ী এবার কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বিয়েও আমরা দিইনি, অযত্নও করিনি কোনোদিন। জলজ্যান্ত বাড়ির বউকে পুড়িয়ে মারতে যাব কোন দুঃখে? আর কী বলল?
পৃথা বলল, বাড়ির থাম দেখে বিয়ে করে বউদি মরল। থামের আড়ালে সব নাকি ঠন ঠন।
ব্যথায় নিভে এল মৃন্ময়ীর ধবধবে সাদা মুখের রং। কপালে এও শোনার ছিল হতভাগা নিমুর দোহাইয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, পিতু এসব রুচির ব্যাপার, শিক্ষার বিষয়। যা প্রাণে চায় বলুক। তোরা কিছু বলিসনি তো উত্তরে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাতী বলে উঠল, আমরা? আমরা বলে পালিয়ে বাঁচি! বউদিকে তো একবার চোখের দেখাও দেখতে পেলাম না গতকাল থেকে।
মৃন্ময়ী একটু চুপ করে রইলেন। মেয়েরাও চুপ করে গেল। মৃন্ময়ী শাড়ির কোঁচড় থেকে একটা আধুলি বার করে পৃথার হাতে দিয়ে বললেন, বলাইয়ের দোকান থেকে চাট্টি মুড়ি কিনে দিয়ে আয় অমুকে। কিছু না খেয়ে পিত্তি পড়বে ছেলের।
পৃথা পয়সাটা নিতে নিতে বলল, কিন্তু বাবুটিকে পাব কোথায়? মৃন্ময়ী সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, ছাদে। অমনি নাকি সুরে কেঁদে উঠল স্বাতী, কেন আমাদের খিদে পায় না বুঝি? যত খিদে তোমার ওই কোলের ছেলের! মৃন্ময়ী বললেন, তা খাবি তো খাস। আমি কি না করেছি। ছেলেটা তো কালকেও কিছু মুখে দেয়নি। আর ঝটিদাকে বলিস আলু, কপি দিয়ে
একটা তরকারি বানিয়ে রাখতে। মাছ করতে বারণ করিস।
স্বাতী মুড়ি কিনতে চলে গেলে মৃন্ময়ী পৃথাকে জিজ্ঞেস করলেন, নিমু কিছু বলল, বউমা এটা করতে গেল কেন? পৃথা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দাদা তো কিছুই বুঝতে পারছে না। বলল আগের রাতেও বউদি দিব্যি আনন্দে ছিল। জানলে তো তোমার ওই ছোটোটাই জানবে, রাতদিন বউদির সঙ্গে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। কিন্তু সেই তো এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে ছাদে।
-কেন, কী করছে?
–কী আবার? চোখের জল ফেলছে নয়তো, শরৎচন্দ্র পড়ছে।
–একটু দেখে আসবি?
—স্বাতী মুড়িটা আনুক, তারপর যাব।
পৃথা আর স্বাতী চিলেকোঠার বন্ধ দরজায় কান পেতে তাজ্জব বনে গেল। আপন মনে কী বকে যাচ্ছে অমু। শেষে বিরক্ত হয়ে জোরে জোরে ছিটকিনি নাড়ল। ভেতর থেকে অমুরও বিরক্ত গলা ভেসে এল, তোমরা যাও। আমি এখন নামব না। পৃথা আওয়াজ করে মুড়ির ঠোঙা দরজার গোড়ায় রেখে বলল, এই রইল মুড়ি। খাবার হলে খেয়ো, নয়তো গোল্লায় যাও। আমরা গেলাম।
মুড়ির নামে একটু খিদে খিদে ভাব হয়েছিল অমলের, ও আরেকটু সবুর করে দরজা খুলে মুড়ির ঠোঙাটি ঢুকিয়ে নেওয়ার তাল করল। আর তক্ষুণি ফতফত ফতফত করে ডানা ঝাপটে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল গোলা পায়রা ঘণ্টা। অমল অবাক নেত্রে দেখল ঘণ্টার পায়ে সুতো দিয়ে আবার কী একটা বাঁধা। অমল ঘণ্টাকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে পায়ের কাগজটা খুলতে লাগল। তারপর একহাতে মুখে মুড়ি চুসতে চুসতে আর এক হাতে ধরে পড়তে লাগল ঘণ্টার পা থেকে খোলা কাগজটা।
কাগজটা চিঠি। দাদাকে লেখা পাশের রাস্তার সুন্দরী বৃন্দার। বৃন্দাদি মেজদি পৃথার সঙ্গে কনভেন্টে পড়ে। দারুণ স্মার্ট, পড়াশুনায় ভালো, দাদাকে ভারি পছন্দ ছিল। সবাই বলত দাদার সঙ্গে মানায় ভালো। বৃন্দাদিকে খুব মনে ধরেছিল অমলেরও। বাগড়া যা দেবার দিয়েছে। বৃন্দাদির বাবা, বলেছে, নিমুর সঙ্গে কী বিয়ে দেব মেয়ের। কিস্যু করে-টরে না। চেহারা আর বাড়ির থাম দেখে কি বিয়ে হয়। দাদা এসব শুনে রাগ করেই নাকি প্রেম করতে শুরু করে বউদির সঙ্গে। আর তারপর…
অমল পড়তে লাগল চিঠিটা—প্রিয়তম…কী যে অসুস্থ লাগছে। ভেবেছিলাম তোমাদের ওখানে যাব একবার। পরে ভাবলাম, কী দরকার অযথা কষ্ট বাড়িয়ে তোমার? অথচ কিছু একটা না লিখেও থাকতে পারছিলাম না। তুমি হয়তো গত আটমাস আমায় ভুলে গিয়ে থাকবে, কিন্তু তোমার ঘণ্টা এখনও আমায় ভোলেনি। রোজ সকালে একবার করে আসে এখানে। এখন অবিশ্যি ওর পায়ে তোমার লেখা কোনো চিঠি থাকে না। কত কতবার ইচ্ছে হয়েছে ওর পায়ে একটা চিঠি বেঁধে দিই। কিন্তু দিইনি, তোমার সুখের জীবনের আঁচড় কাটতে চাইনি, সামলে নিয়েছি নিজেকে।
কিন্তু আজ আর পারলাম না। কী হল কুন্তলার সত্যি করে বলো লক্ষ্মীটি। তোমার মতো কাউকে পেয়েও এত দুঃখ কেন? গায়ে আগুন দেওয়ার কথা তো ওর নয়। অন্য কারুর। কিন্তু সে তো দিব্যি আছে চিঠি লিখছে, বাবার দেখা পাত্রদের ফেরত পাঠাচ্ছে। পারলে চিঠি দিও, না দিলেও দোষ দেব না। ইতি তোমার…
বৃন্দাদির এই চিঠি কত চেনা অমলের। ঘণ্টার পায়ে চিঠি এলে ওই তো আগে একদফা পড়ে নিত। তারপর ঠিকঠাক করে বেঁধে রাখত যথাস্থানে। আজ কিন্তু চিঠিটা পকেটে পুরল ও। বুকে একটা দুপদুপানি শুরু হয়েছে। মাথার মধ্যে খেলছে একবার বউদির মুখ একবার বৃন্দাদির। কী যে সমস্যায় ফেলল দাদাটি।
আর প্ল্যানচেটে বসতে পারছে না অমল। ও কাগজপত্র জায়গামতো রেখে হাতে মুড়ি নিয়ে নেমে এল চিলেকোঠা থেকে। গলি দিয়ে যেতে যেতে জানলার ফাঁক দিয়ে দাদার ঘরে উঁকি মারল। দাদা-বউদির বিয়ের ছবি কোলে নিয়ে বাবার মতো বসে আছে।
নির্মল এখনও একটা সামান্য আঁচ পেল না কুন্তলা এটা করতে গেল কেন। বড়োলোক মা বাবার গঞ্জনা তো বিয়ের দিন থেকে লেগে ছিল। শ্বশুরবাড়িতে একটি কটু কথাও শুনতে হয়নি। যা শোনার সবতো নির্মলই শোনে। মা তো বউমাকে না খাইয়ে একবেলাও খায়নি কখনো। পৃথা স্বাতীর পছন্দ বৃন্দাকে, কিন্তু ওরাও তো সেটা বউদিকে জানতে দেওয়ার পাত্রী নয়। শ্বশুরের পয়সায় ব্যাবসা করব না, এই অহংকার যদি থেকেই থাকে নির্মলের তাতে কুন্তলার তো গর্ব হওয়ারই কথা। যেটুকু যা সন্দেহ ছিল বৃন্দার ব্যাপারে তাও নিতান্তই সন্দেহ। আর সন্দেহ যদি থেকেও থাকে তার সমাধান গায়ে আগুন!
ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল নির্মল। মনে পড়ল গতকাল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখা ওই দৃশ্য। অগ্নিপরীক্ষার সীতার মতো আগুনে ঘেরা কুন্তলা। কী যেন বলতে চাইল ওর কোলে আছড়ে পড়তে পড়তে। ও কী বলতে চেয়েছিল, আমি মরতে চাইনি লক্ষ্মীটি? না হলে ওভাবে বার বার মাথা দোলাল কেন? ও কি বলতে চেয়েছিল, আমি বাঁচতে চাই না লক্ষ্মীটি? তাই বা কী করে হয়। নিজেই আগুন আগুন বলে চেঁচাল কেন? কেন ঝাঁপ দিয়ে এল নির্মলের বুকে? কেন পেঁয়াজের খোসার মতো ছাড়াচ্ছিল শরীর থেকে শাড়ি? কেন পড়ে যাওয়ার আগে দু-হাতে চেপে ধরল নির্মলের হাত।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যে হতে চলেছে। সবাই গেছে হাসপাতালে। বাড়িতে শুধু মা আর অমল। অমল গুটি গুটি হাটা দিল পাশের রাস্তায় বৃন্দাদের বাড়ির দিকে। বাড়ির বাগানে দোলনায় মুখ নীচু করে বসেছিল বৃন্দা। অমল পাশে গিয়ে আস্তে করে ডাকল, বৃন্দাদি।
চমকে যেন চটকা ভাঙল বৃন্দার।—এ কী তুমি, অমু! বউদি কেমন আছে? অমলের মুখ দিয়ে কথা সরল না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াতে লাগল। বৃন্দা ঝট করে ওর মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কেঁদে উঠল, অমু এ কী হল আমাদের? আমাদের সব সুখ নষ্ট হয়ে গেল।
বৃন্দা কাঁদছে, ওর বুকের মধ্যে মাথা রেখে অমলও কাঁদছে। দু-জনেই কত কথা বলছে। কাঁদতে কাঁদতে, কিন্তু কেউ কারোরটা শুনতে পাচ্ছে না। অথচ নিয়ম করে বাগানে সন্ধ্যে নামছে।
শেষে মাথা সরিয়ে নিয়ে এসে অমল বলল, তুমি দাদাকে চিঠি লিখলে কেন, বৃন্দাদি?
কেন অমু? জানতে হবে না কেন, কী হল?
হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অমল বলল, তোমার জন্যই তো। তোমাকেই তো দাদা ভালোবাসে। তাই তো…
বৃন্দা উৎকণ্ঠার সঙ্গে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিল অমলের, ছিঃ। অমন কথা বলতে নেই অমু। কুন্তলা তোমার বউদি, দাদা তাকেই ভালোবাসে। আমার সঙ্গে দাদার তো আর কিছু নেই, কিছু নেই
কথা শেষ করতে পারল না বৃন্দা। বিকট কান্নায় ভেঙে পড়ে দোলনা থেকে খসে পড়ল মাটিতে। অমল, বৃন্দাদি কেঁদো না, বৃন্দাদি কেঁদো না, বলে জড়িয়ে ধরল ওকে। বৃন্দা ওর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুই চলে যা, অমু। তুই চলে যা—আমায় একলা থাকতে দে।
বাড়ি ফিরে ওর মনে হল শহরে বোধ হয় রায়ট বেঁধেছে। সব ঘর শুনশান, অন্ধকার। শুধু পুজোর ঘরে দোর ভেজিয়ে মা চোখ বুজে বসে। ঘরের চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে হাসপাতালে বুঝি বা খারাপ কিছু ঘটে গেছে। অমল নিঃশব্দে ফের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে প্ল্যানচেট-এ বসল। একটু পর বাটি চলতে শুরু করলে জিজ্ঞেস করল, বউদি, তুমি এসেছ?
পিছন থেকে স্পষ্ট উত্তর এল, হ্যাঁ, এই তো আমি। অমল চকিতে মাথা ঘুরিয়ে দেখল দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে এসেছে বউদি। লাল পাড়, বেগুনি রঙের শাড়ি। গায়ে অনেক গয়না। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, বউদি হাসছে।
অমল বলল, তুমি গায়ে আগুন দিলে বউদি? বউদি থামল। কোথায় দিলাম? লেগে গেল।
—ছাই লেগেছে। তুমি মরবে বলে দিয়েছ।
—কেউ কি মরতে চায়?
–কেন, তুমিই তো চাইলে?
–মোটেও নয়। তোমার দাদা আমায় ভালোবাসে না, তাই মরলাম।
–কে বলেছে তোমার দাদা ভালোবাসে না?
–তুমি জানো না।
–না, জানি না।
—তাহলে তুমি কিছুই জানো না। তোমার দাদা ভালোবাসে বৃন্দাকে।
—তোমায় বলেছে। বৃন্দাদি দাদাকে ভালোবাসে, দাদা তোমাকে।
বউদি কাঠের মেঝেতে গুছিয়ে বসে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, তোমার কি মনে। হয় আমি দাদাকে ভালোবাসতাম?
—ভালোবাসতাম কেন? এখন বাসো না?
থমথমে হয়ে গেল বউদির মুখটা। তারপর আস্তে আস্তে অমলের কাছে সরে এসে বলল, একটা কথা দাদাকে বলতে পারবে, অমু?
-কী কথা?
—যে, আমি ভীষণ ভালোবেসেছি ওকে।
—বলার দরকার নেই, দাদা জানে।
-তাহলেও বলো।
—তার আগে বলো, কেন গায়ে আগুন দিলে?
বউদি আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল, পকেটে ওটা কার চিঠি?
অমল দৃপ্ত গলায় বলল, বৃন্দাদির।
—দেখলে তো, বিয়ের এত পরেও কত টান?
—বাজে কথা। বৃন্দাদির বিয়ের পর দাদাকে কখনো চিঠি দেয়নি। এই প্রথম। তুমি পড়ো।
—তাহলে এগুলো কি?
—বলে একগুচ্ছ চিঠি অমলের সামনে ছড়িয়ে দিল বউদি। অমল বিস্ফারিত চোখে দেখল সত্যিই এক রাশ চিঠি, সব বৃন্দাদির হাতের লেখায়। বউদি বলল, অবশ্য এসব বিয়ের আগে লেখা।
অমল বলল, তাহলে?
—তাহলে এই চিঠিটা পড়ো… অমল চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল, এই ভালোবাসা তোমায় কেউ দেবে না জেনো। কেউ দিলে আমি গায়ে আগুন দিয়ে মরব। অমল আর পড়তে পারছে না। কিছু বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে বলল, এসব আজেবাজে কথা সবাই লিখতে পারে, তাতে কি কেউ বিশ্বাস করে?
বউদি বলল, তোমার বোকা বুদ্ধ দাদাটা করে। ও ভাবে যা লেখা যায় তাই করা যায়।
—আর তুমি?
—আমি আর এক বুদ্ধ। ভেবেছিলাম গায়ে একটু আগুন ছুঁইয়ে চমকে দেব দাদাকে। কিন্তু ও দেরি করল বাথরুম থেকে বেরোতে। আমি ভাবতেও পারিনি শাড়িতে আগুন এত তাড়াতাড়ি ছড়ায়। ওকে শিক্ষা দিতে আমি…।
—আর দাদা তোমায় বাঁচাতে পারল না, বউদি? বউদির মুখ যেন পাথর হয়ে এল, ও বাথরুম থেকে সমানে হাসছিল আমি যখন ‘আগুন আগুন’ করে চেঁচালাম। ভাবছিল আমি ইয়ার্কি করছি। কিংবা ভাবছিল আমি বৃন্দার ঢং ধরেছি। ও দরজা খুলে যখন প্রথমে দেখল আমায় ও তখনও বোঝেনি কী দেখছি। আর
তখনই আমার বাঁচার সব ইচ্ছে চলে গেল।
-কেন?
–বুঝলাম ও কেবল বৃন্দাকে শিক্ষা দেবে বলে আমায় বিয়ে করেছিল। ভালোবাসেনি।
—আর তুমি?
—আমি? আমি বিয়ের পর প্রতিদিন বুঝেছি ও বৃন্দার শূন্যস্থানে আমাকে বসিয়েছে। এত ভালোবাসা ও কখনোই আমাকে বাসতে পারে না। ও চিনত আমায় কতটুকু?
-তাই বলে তুমি গায়ে আগুন দেবে?
-কে বলেছে আমি আমার গায়ে আগুন দিয়েছি? আমি বৃন্দার প্রক্সির গায়ে আগুন দিয়েছি। আসল আমিটা তো এই তোমার সামনে বসে।
হঠাৎ নীচে থেকে মেজদির ডাক, অমু, অমু। এক্ষুণি নীচে আয়।
অমল বউদিকে বলল, তুমি দু-মিনিট বসো। আমি ঘুরে আসছি।
অমলকে দেখেই মেজদি ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল-বউদি নেই রে অমু। মর্গে নেবার আগে একবার দেখবি চল।
কী হল ভগবানই জানেন, অমলের কিছুতেই আর কান্না পাচ্ছে না। পকেটে হাত দিয়ে দেখল চিঠিটা ঠিকই আছে। দিতে হবে দাদাকে। দাদার বিয়ের পর বৃন্দাদির প্রথম চিঠি। বউদি কিছুই বোঝেনি।