প্লেগ

প্লেগ

দশ বৎসর আগেকার কথা বলিতেছি।

বম্বেতে জাহাজ হইতে নামিয়াই বাড়িতে ‘তার’ করিয়া দিলাম। কিছুই যেন ভাল লাগিতেছে না, মন ছটফট করিতেছে। বাড়ির এত কাছে আসিয়াও বাড়ি যাইতে দেরি হইতেছে। যতদিন বিলাতে ছিলাম কেমন যেন সহ্য হইয়া গিয়াছিল। এ যেন—যাহাকে ভালবাসি তাহার সহিত এক বাড়িতে থাকিয়াও দেখা করিতে পারিতেছি না।…কাল দ্বিপ্রহরে বাড়ি গিয়া পৌঁছিব, মাঝে দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টা!…

সন্ধ্যাবেলায় বম্বে হইতে যাত্রা করিলাম। সন্ধ্যা ক্রমে রাত্রিতে ঘনাইয়া আসিল—ট্রেনটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে লাগিল—মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাহাকে ভারতের পশ্চিম হইতে পূর্বে গিয়া পৌঁছিতে হইবে তাই তাহার এই প্রচণ্ড গতি!…বেহার…একটি ক্ষুদ্র সহর! অত্যন্ত ধূলিবহুল সঙ্কীর্ণগলিসঙ্কুল আমার চিরজীবনের সেই দীন সহরটি। জন্মভূমি নয় বটে, কিন্তু আজন্ম জীবনটা এইখানেই কাটিয়াছে। নাড়ীর যত টান, সমস্ত সেই সহরটাকে অজগরের মতো জড়াইয়া আছে। তারপর আমাদের বাড়ি…ঠিক রাস্তার ধারেই চুনকাম করা মস্ত বাড়িখানা—চৌমাথা হইতে দেখা যায়, পাশে গোলাপের বাগান। বাবার গোলাপের ভারি সখ!…

রাত্রি গভীর হইতেছে। ট্রেন অন্ধকার চিরিয়া নিষ্ঠুর আনন্দে চারিদিক শব্দিত করিয়া ছুটিতে লাগিল।… ঘুম আসে না… সত্যই কি বিলাত গিয়াছিলাম, না স্বপ্ন, এ জীবনের তিনটা বৎসর কি ঘুমাইয়া কাটাইয়াছি? আজ যে জীবনটা অতি অদূর অতি অপ্রাকৃত বোধ হইতেছে।… উঠিয়া বসিয়া একটা চুরুট ধরাইলাম, প্রখর বিদ্যুৎবাতির উপর কাপড়ের আবরণটা টানিয়া দিলাম।…স্টেশনে নিশ্চয়ই বাবা গাড়ি লইয়া উপস্থিত থাকিবেন। আর কে থাকিবে? সুবোধও নিশ্চয় আসিবে, সে ছাড়িবে না।…বাবা হয়তো এতদিনে একটু বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, গোঁফ বোধ হয় সব পাকিয়া গিয়াছে। বিলাত যাইবার সময় দেখিয়া গিয়াছিলাম তাঁহার গোঁফে পাক ধরিয়াছে।…আর মা! আমার মা! তিনি একটুও বদলান নাই—ঠিক তেমনি আছেন। যাইবার সময় মা কাঁদেন নাই—পাছে অমঙ্গল হয়। কিন্তু এখন! তিনি কখনই থাকিতে পারিবেন না—কাঁদিতেই হইবে। আর…আর সে…যাহাকে বার বছরেরটি রাখিয়া গিয়াছিলাম। সে এখন পনের বছরের হইয়াছে…চিঠির মধ্যে কতটুকু পাওয়া যায়! যাহাকে বুকের মধ্যে রাখিয়া তৃপ্তি হয় না, তাহার চিঠি! দূর হইতে ছুঁড়িয়া মারা এক মুঠা শুকনা ফুলের পাপড়ি!… শেষ চিঠিতে সে লিখিয়াছিল—সে কখনই আগে কথা কহিবে না…দেখা যাক কী হয়।…আমার টেলিগ্রাম এতক্ষণ পৌঁছিয়াছে—বাড়িতে একটা আনন্দ কোলাহল পড়িয়া গিয়াছে—সুবোধ নাচিতেছে, মার চক্ষুতে বারবার জল আসিতেছে, বাবা চুপ করিয়া বাহিরের ঘরে একখানা বই সামনে ধরিয়া বসিয়া আছেন, আর সে…আজ রাত্রে বোধ হয় বাড়িতে কেহই ঘুমাইতে পারিবে না।

ঘুম ভাঙিতেই দেখি আকাশ ফর্সা হইয়াছে, তখনও সূর্য ওঠে নাই। কিছুক্ষণ পরে একটি বড় স্টেশনে গাড়ি থামিল সেখানে চা খাইলাম ও খবরের কাগজ কিনিলাম। প্রায় ছয় ঘণ্টা যে ঘুমাইয়া কাটিয়া গিয়াছে ইহাতে বড় আনন্দ হইল। একেবারে যদি ঘুম ভাঙিয়া দেখিতাম বাড়ি পৌঁছিয়া গিয়াছি।

খবরের কাগজখানায় কিছু ছিল না। কলকাতার পাটের গুদামে আগুন লাগিয়াছে, একজন স্ত্রীলোক জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে; বেহার ও যুক্ত প্রদেশে খুব প্লেগ হইতেছে—পড়িতে ভাল লাগিল না; কাগজখানাকে সরাইয়া রাখিয়া দিলাম। আমার মনটা অগ্রগামী হইয়া আমার বাড়ির আমার চির পরিচিতের চারিপাশে গুঞ্জন করিয়া বেড়াইতে লাগিল!

বেলা একটার সময় নিজেদের স্টেশনে গিয়া থামিলাম। গাড়ি হইতে গলা বাড়াইয়া পরিচিত কাহাকেও দেখা গেল না—তাড়াতাড়ি নামিয়া পড়িলাম, গাড়ি চলিয়া গেল।

কেহ আমাকে লইতে আসিল না কেন? ‘তার’ কি পৌঁছায় নাই? খুব সম্ভব তাই—যাক এক রকম মন্দ নয়। হঠাৎ বাড়ি গিয়া সকলকে হতবুদ্ধি করিয়া দিব। Surprise!

কুলি জিজ্ঞাসা করিল, ‘সাবেহ, কঁহা যানা হ্যয়?’

আমি বাবার নাম করিয়া পরে বলিলাম, ‘গাড়ি মিলেগা?’

সে বলিল, ‘নহি হুজুর, গাড়ি টম্‌টম্‌ কুছ নহি।’

আমি স্টেশন মাস্টারের কাছে গেলাম। জিনিসপত্র তাহার জিম্মা করিয়া দিয়া হাঁটিয়াই বাহির হইয়া পড়িলাম। স্টেশন মাস্টার হিন্দুস্থানী—সে বলিল, মজুর একেবারে সুন্না সেই জন্য স্টেশনের গাড়ি ঘোড়ার কোনও বন্দোবস্ত নাই।

রাস্তার কোথাও একটা লোক নাই। একি? ঘর দ্বার সমস্ত বন্ধ। জোরে পা চালাইয়া বাজারের মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। সমস্ত দোকান বন্ধ, তালা লাগান। মনুষ্যহীন সহরের মতো অমন ভয়াবহ দৃশ্য বোধ হয় আর নাই। বুকের ভিতরটা কে যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত বুলাইয়া গেল। নিঃশ্বাস গলার কাছে আসিয়া এক টুকরা পাথরের মতো আটকাইয়া রহিল। একটা ধূলার ঘূর্ণি হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে উঠিয়া ধরে ধীরে আমার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। মনে হইল যেন এই ঘূর্ণিটা এই মৃত সহরের প্রেতমূর্তি। ঘূর্ণিটা যখন আমার উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে সেই সময় সম্মুখে অদূরে একটা শব্দ শুনিলাম। দেহের ভিতর এবং বাহির এক মুহূর্তে কাঁটা দিয়া উঠিল। একটা অমানুষিক আর্তনাদ, কিংবা বিকট হাসি। চক্ষু পরিষ্কার করিয়া দেখি প্রায় দশ-বারটা কুকুর এবং তাহাদের মাঝখানে কৃষ্ণবর্ণ কি একটা রহিয়াছে। নিকটে গিয়ে দেখি কৃষ্ণবর্ণ বস্তুটা একটা পাঁচ-ছয় বৎসরের শিশুর শব। তাহাকে ঘিরিয়া কুকুরগুলা কলহ করিতেছে! …যে অবস্থায় মানুষের মনে আশঙ্কার উদয় হয় আমার সে অবস্থা ছিল না—শুধু বাড়ি পৌঁছিবার জন্য একটা ঊর্ধ্বশ্বাস ত্বরা, জ্ঞানহীন চেষ্টা ছিল। দৌড়িতে আরম্ভ করিলাম, জীবনে কখনও এরূপ দৌড়াই নাই…শীতের দ্বিপ্রহর; কিন্তু সর্বাঙ্গ দিয়া ঘাম পড়িতে লাগিল, ঘামে চক্ষু ঝাপসা হইয়া গেল…কিন্তু তখন সে সব কিছুই জ্ঞান ছিল না….

বাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। দ্বার খোলা…এমন ভাবে খোলা যেন কতকাল বন্ধ হয় নাই। বাগানের দিকে দৃষ্টি পড়িল—ফুল কৈ, গোলাপ ফুল? বুকের ভিতরটা এতক্ষণে একেবারে হাহাকার করিয়া উঠিল—ফুল কৈ?

যে ঘূর্ণিটা রাস্তায় দেখিয়াছিলাম সেই ঘূর্ণি তেমনি করিয়া রাস্তার মাঝখানে উঠিয়া আবার আমার গায়ের উপর দিয়া মিলাইয়া গেল….একটা ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস…যেন অস্ফুটস্বরে আমাকে বাড়িতে প্রবেশ করিবার অনুমতি দিয়া গেল।

দ্বারপ্রান্তে ঢুকিয়া ডাকিলাম—মা! সাড়া নাই। আরো জোরে ডাকিলাম—মা! তারপর চিৎকার করিয়া উঠিলাম—বাবা! মৌন বাড়িটা সে শব্দে চমকিয়া উঠিল…কিন্তু কোনও জবাব আসিল না।…

প্রকাণ্ড বাড়িখানার ঘরে ঘরে ছুটিয়া বেড়াইলাম; কেহ নাই…মা বাবা…কেহ নাই! ঘর সাজানো, বিছানা পাতা—কিন্তু কেহ নাই! দেয়ালে চোখ পড়িল, বড় বড় অক্ষরে কাঠকয়লা দিয়া বাবার হাতে লেখা, “সকলে একসঙ্গে প্লেগে আক্রান্ত হইয়াছি—চাকর-বাকর পলাইয়াছে; সহর শূন্য।..সুবোধ ও বৌমা গেল—স্ত্রী গেল, এখনো আমি বাকি। কিন্তু আর বেশীক্ষণ নয়। সুধীরের সঙ্গে দেখা হইল না।” দেয়ালের উপর আছড়াইয়া পড়িলাম…

শীতের সূর্য তখন পশ্চিমে নামিতেছে…টলিতে টলিতে বাহিরের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। সমস্ত মৃত—ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান…নিঃসঙ্গ, উলঙ্গ, একাকী!

সম্মুখের রাস্তা হইতে রৌদ্র সরিয়া যাইতেছিল। দূরে দৃষ্টি পড়িল পথের উপর একটা রেখা পড়িয়াছে…রেখাটা আমার দিকেই অগ্রসর হইতেছে…একটা প্রকাণ্ড শীর্ণ সাপের মতো। আরও কাছে আসিল…সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছে… সাপ নয়, একের পর এক, তারপর এক, সারি সারি…এক সার ইঁদুর…

১৩৩৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *