প্লিজ, কেঁচো খুঁড়বেন না
“শালাদের কী বলতে ইচ্ছা করে বলেন তো ছার।” হাবিলদার একটা সস্তা পাউরুটিতে কামড় দিতে দিতে বলল। গতকাল রাত থেকে মর্গের সামনে বসে আছে সে। মেজাজ খারাপ হওয়ারই কথা। খাইরুল ফরেনসিক লেটার নিয়ে এসেছেন সকালে। কাল লাশ সদর হাসপাতালে আনতে আনতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাই ফরেনসিক লেটার পেতে পেতে সকাল।
সুরতহালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার এখনও আসেননি। না আসলে সুরতহাল শুরু হবে না। সেই ফরেনসিক লেটার নিয়ে সুরতহালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মহা ঝামেলা। কিচ্ছু করার নেই। ঝামেলা, মহা ঝামেলা এবং মহা মহা ঝামেলাতেও পুলিশদেরকে ধৈর্য্য ধরতে হয়।
ডোম লাশটার গায়ের তারগুলো কেটে লাশটা মর্গে রেখে দিয়েছে। কাঁটাতার পেচানো লাশ দেখে মনে হল না যে সে খুব একটা অবাক হয়েছে।
গত কয়েকদিন যত জনের মিসিং ডায়েরি হয়েছে তাদের আত্মীয় স্বজনকে ফোন করে খবর দেওয়া হয়েছে। হারানো বিজ্ঞপ্তির মাইকিং করে, এমন কয়েকটা মাইকওয়ালাকে ধরেও হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আত্মীয়দের খবর দেওয়া হয়েছে। যতক্ষন এই লাশটা সনাক্ত না হচ্ছে, আর যতক্ষণ সুরতহাল না হচ্ছে ততক্ষন খাইরুল স্বস্তি বোধ করতে পারছেন না।
ঘড়িতে সকাল দশটা। ডাক্তার এখনও কেন আসছে না। খাইরুল বিরক্তি চাপা রেখে হাসপাতালের অফিসে যাবেন বলে ঠিক করলেন। হঠাৎ
দেখলেন কে যেন আসছে।
“আরে মল্লিক নাকি! খবর কি?” খাইরুল হেসে বললেন।
“আদাব দাদা। ভালোই মোটামুটি।” জয়ন্ত মল্লিক বলল। জয়ন্ত মল্লিককে সাধারণত হাসতে দেখা যায় না। তার চেহারায় সব সময়ই শ্রাবণের মেঘ ঘনিয়ে থাকে। আজও তার চেহারায় শ্রাবণের মেঘ দেখে খাইরুল অবাক হলেন না।
“তা এত সকালে হাসপাতালে। কিছু হয়েছে?”
“নাহ। এমনি। কোন খবর টবর আছে কিনা দেখতে আসলাম।”“
“আরে না না। কোন খবর নাই। কালকের সংবাদটা ভালো ছাপিয়েছ। পোস্টমর্টেমটা এখনও হয়নি বুঝছ?। কখন যে ডাক্তার আসবে। যাই হোক। থ্যাংক্স মল্লিক।”
“ওয়েলকাম স্যার। তো আমি আসি স্যার।”
“হ্যাঁ। আসো।”
জয়ন্ত যেতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। খাইরুল বললেন, “জয়ন্ত কিছু বলবা?”
জয়ন্ত থতমত খেয়ে বলল, “না না স্যার। আমি আসছি।”
খাইরুল ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়লেন। তারপর হাসপাতালের অফিসের দিকে রওনা হলেন। জয়ন্ত মল্লিক রওনা হল হাসপাতালের গেটের দিকে। যেখানে ল্যান্ডরোভারটা পার্ক করা আছে। একটা কালো টয়োটা খুব জোরে করে বাঁক নিতে গিয়ে জয়ন্তকে আর একটু হলে চাপা দিয়ে দিচ্ছিল। জয়ন্ত সামলে নিয়ে যন্ত্রের মত ল্যান্ডরোভারটার কাছে এসে দাঁড়ালো। সামনের দরজা খুলে গেল। জয়ন্ত ভেতরে গিয়ে বসল।
সানগ্লাসটা বাম হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে রঞ্জন বলল, “ওই লোকটাই থানার ওসি? যার সাথে কথা বললেন? উনিই কাল লাশ উদ্ধার করে আপনাকে খবরটা ছাপাতে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ।” জয়ন্ত বলল।
“আমি না আসা পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করবেন। কেমন? আমি গাড়ি লক করে যাচ্ছি। ভেন্টিলেশন অন করে রেখে যাচ্ছি। সমস্যা হবে না।”
জয়ন্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু টেপরেকর্ডটার কথা ভেবে আর কিছু বলতে পারল না। রঞ্জন গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেলেন। গাড়ি লক করে এগিয়ে গেল হাসপাতালের মেইন বিল্ডিং-এর দিকে। হঠাৎ কিছুদুর গিয়ে কি মনে করে রঞ্জন আবার ফিরে আসলেন। চোখে মুখে কিঞ্চিত বিরক্তি। পকেট থেকে ফিরোজ সাহেবের চাবির হ্যাঙার ব্যাগটা বের করলেন রঞ্জন। দুটো চাবি ঝোলানো আছে। মোটা ব্যাগটা পকেটে রাখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে রঞ্জনের। সে শুধু গাড়ির চাবিটা খুলে ব্যাগটা ড্যাশ বোর্ডের ভেতরে রেখে দিলেন।
দরজার সবগুলো কাঁচ তোলা। জয়স্ত বন্দী ।
রঞ্জন মেইন বিল্ডিংয়ে ঢুকে রিসিপশনে গেলেন। গিয়েই দেখলেন, জয়ন্তর দেখানো লোকটা, মানে ওসি খাইরুল ইসলাম রিসিপশনে কথা বলছে। তাকে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে। রঞ্জন পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনে মনোযোগ দেওয়ার ভান করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলেন খাইরুল কি বলছেন।
“দেখেন ম্যাডাম। আমার আরও অনেক কাজ আছে। বেলা দশটা বাজে এখনও ডাক্তার কেন আসছেন না? কি যেন নাম উনার? শফিক সাহেব? নম্বর আছে উনার?” খাইরুল বললেন।
রিসিপশনের মেয়েটা বলল, “স্যার এক্ষুনি চলে আসবে। আপনি প্লিজ একটু অপেক্ষা করেন। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন।”
খাইরুল গজগজ করতে চলে গেলেন। রঞ্জন সাহেব রিসিপশনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
“গুড মর্নিং ম্যাম।” রঞ্জন একটা ‘গুড মর্নিং’ হাসি উপহার দিল রিসিপশনে বসে থাকা মেয়েটাকে।
“গুড মর্নিং স্যার।” মেয়েটার বিরস উত্তর। গুড মর্নিং হাসিতে খুব একটা কাজ হল বলে মনে হল না।
“শফিক স্যারের চেম্বারটা কোন দিকে বলতে পারেন?”
“দোতলায় গিয়ে ডান দিকে। ২১ নাম্বার রুম।”
“উনার একটা ছবি হবে?”
“কেন বলেন তো?”
“উনাকে আমি আগে দেখিনি তো কখনও। চিনিও না।”
রিসিপশনের মহিলা একটা নাদুসনুদুস মোটাসোটা একজন লোকের পাসপোর্ট ছবি দেখালেন।
“স্যার কতক্ষনের ভেতরে আসতে পারেন।” রঞ্জন জিজ্ঞাসা করল।”আরে বাবারে, স্যার এক্ষুনি চলে আসবেন। আপনি কে? পেশেন্ট নাকি?”
“জী। রিপোর্ট দেখাতাম।”
“তাহলে ছবি দেখতে চাইলেন কেন? আর স্যার বিকালের আগে রোগী দেখেন না জানেন না? সকালে স্যারের পোস্টমর্টেমের কাজ আছে।”
“সরি ম্যাম।
রঞ্জন রিসিপশন থেকে সোজা সিঁড়ি নেয়ে সোজা দোতলায় গিয়ে উঠলেন। তারপর ২১ নাম্বার রুমের সামনে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, চেম্বারের সামনে একজন পুলিশ একটা কাঠের টুল পেতে বসে আছে। মেজর রঞ্জন পিছু হটলেন। করিডোরের গ্রিল দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে নিচের পার্কিং লটটা দেখে নিলেন। ল্যান্ডরোভারটা ঠিকই আছে। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না।
হাসপাতালের কম্পাউন্ডে আসলেন তিনি। পুলিশ ভ্যানটাকে খুঁজতে হবে দ্রুত। বেলা দশটা। তাই রোগীদের ভিড় আস্তে আস্তে বাড়ছে। এটা ভালো লক্ষণ। রঞ্জনের সুবিধা হবে। পুলিশ ভ্যানটা খুঁজে পেলেন রঞ্জন। মেইন বিল্ডিঙের পেছন দিকে, মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানে কোন পুলিশ দেখা যাচ্ছে না। পুলিশগুলো গেল কোথায়?
যেভাবেই হোক ডাঃ শফিককে পুলিশের আগে ধরতে হবে, যেভাবেই হোক। যেকোন মুহূর্তে ডাঃ শফিক চলে আসতে পারেন। মেজর রঞ্জন খুব দ্রুত চিন্তা করতে থাকলেন কি করা যায়। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। ডাঃ শফিক পুলিশ পর্যন্ত চলে গেলে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাবে। পোস্টমর্টেমটা যেভাবেই হোক আটকাতেই হবে।
হঠাৎ একজন মুখ খোলা বোরকা পরা মহিলাসহ খাইরুলকে মর্গের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল রঞ্জন। মহিলা পাগলের মত কাঁদছে। রঞ্জন কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে পুলিশ ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ডাবওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ডাবওয়ালাকে একটা ডাব দিতে বলে কান পাতলেন মহিলা কি বলছে,
“এই আমার সোয়ামী গো ভাইসাহেব। আমি আমার সোয়ামীকে চিনব না ভাই সাহেব? পচিশটা বছছর সংসার করলাম যে। ও ভাই সাব, সোয়ামীর জন্যে আমি মাইকিং পযোক্ত করলাম সোয়ামী আমার লাশ হয়ে গেল গো।” মহিলা বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল।
খাইরুল বললেন, “কাঁদবেন না আপা। আপনি নিশ্চিত যে এটা আপনার স্বামী জামিল আলীর লাশ? আপনার স্বামী অটো চালাতেন তো?”
“হ্যাঁ গো ভাইসাহেব। কারা আমার একটা মাত্র মাইয়েডারে এতিম করে দিল গো আল্লা।”
“আপনার স্বামীর কাছে কোন ব্যাগ ছিল আপা? জানেন কিছু?”
“জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। আল্লা তুমি ওই কুত্তার বিচার কইরো গো খুদা।”
“শান্ত হন প্লিজ শাস্ত হন। আপনার সাথে কেউ এসেছে?”
মহিলা আর কথা বলতে পারলেন না। পুলিশের ভ্যানে ভর দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। খাইরুল ফোন বের করে ফোন করতেই এক মোটাসোটা হাবিলদার দৌড়াতে দৌড়াতে আসল। তার বেল্ট বাঁধতে দেখে মনে হল যে সে বাথরুমে গিয়েছিল। খাইরুল হাবিলদারকে বললেন, “এই মহিলাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসো। আমি এখানে আছি। তাড়াতাড়ি আসবা। আর কালকের ঐ বিলে জাল ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। অটোর গ্যারেজ থেকে যতদূর জেনেছি এই লোকের কাছেই ব্যাগটা ছিল। মানে ঐ বিলেই ব্যাগটা থাকবে।”
রঞ্জন খালি ডাবটা আর স্ট্রটা ফেলে দিলেন ভ্যানের পাশে। ডাবওয়ালা স্ট্রটা তুলে নিয়ে পরনের ময়লা লুঙ্গিতে মুছে প্যাকেটে রেখে দিল। আরেকজন কাস্টমারকে দেওয়া যাবে।
খাইরুল যখন মহিলাকে ধরে ভ্যানে তুলতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই পার্কিং লটে একটা রেড ওয়াইন এক্সিওকে এসে দাঁড়াতে দেখল মেজর রঞ্জন। গাড়ি থেকে নামলেন ডাঃ শফিক। সেই মোটাসোটা গড়ন। একটা ক্যামবিস ব্যাগ হাতে মেইন বিল্ডিঙের দিকে যেতে শুরু করলেন।
রঞ্জন শুধু একবার ব্যস্ত খাইরুলের দিকে তাকালেন। তারপর রোগীদের স্রোত ঠেলে জোর পায়ে এগোতে লাগলেন ডাঃ শফিকের দিকে। ডাঃ শফিক ততক্ষণে মেইন বিল্ডিঙের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
রঞ্জন ভিড়ের ভেতরে ডাঃ শফিকের বাহু চেপে ধরলেন। ডাঃ শফিক চমকে বললেন, “কে কে!”
রঞ্জন ডাঃ শফিকের বাহু খামচে ধরে ল্যান্ডরোভারের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ডাঃ শফিক হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মেজর রঞ্জন তার আইডি কার্ড বের করলেন। আইডি কার্ড দেখতেই ডাঃ শফিক আর হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করলেন না। রঞ্জন নিচু গলায় বললেন, “আমার একটা উপকার করতে হবে ডক্টর। আপনার সাথে কথা আছে। জরুরী।”
রঞ্জন প্রায় টেনে ডাঃ শফিককে ল্যান্ডরোভারের কাছে নিয়ে আসলেন। তারপর প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে ডাঃ শফিককে ভেতরে ঢুকতে বললেন। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে জয়ন্ত চমকে উঠলেন। রঞ্জন ডাঃ শফিককে মাঝখানের সিটে বসিয়ে নিজে তার পাশের সিটে বসলেন।
তারপর বললেন,
“এই পোস্টমর্টেমটা করবেন না।”
“কোনটা বলেন তো।”
“তারাগাছির গতকালকের কেসেরটা।”
“আমি না করলেও পোস্টমর্টেম তো হবেই। আমিই তো সদর হসপিটালের চীফ সার্জন! আমি ছাড়া আর কে করবে?”
“কেউ করবে না। পোস্টমর্টেম হবে না। কিন্তু পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট হবে। সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি পোস্টমর্টেমটা করবেন না। এটা ধরে নিন একটা সামরিক আদেশ।”
রঞ্জন গাড়ির ড্যাশ বোর্ড খুলে একটা একটা খাম বের করলেন। হলুদ খাম। খামটা ডাঃ শফিকের হাতে ধরা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রঞ্জন বললেন, “আপনার সাথে পরে কথা হবে। এখন আপনি আসেন। পুলিশকে বলবেন, আপনি এই পোস্টমর্টেম করবেন না। অন্য…”
রঞ্জনের কথা শেষ না হতেই ডাঃ শফিক মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “সে কি বলতে হয় না হয় আমি দেখব মেজর। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। হে হে।” তাকে দেখে মনে হল, পোস্টমর্টেমটা না করতে পেরেই খুশি তিনি। হাসি মুখেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।
ডাঃ শফিক মেইন বিল্ডিং-এর দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খাইরুল তাকে দেখেছেন বলে মনে হল। তিনি জোর পায়ে ডাঃ শফিকের দিকে আসতে থাকলেন। রঞ্জন সব কিছুই দেখছে ল্যান্ডরোভারের উইন্ডশিন্ডে। তার স্ফিত বুক ওঠা নামা করছে। ঠোঁটে জয়ের হাসি। পোস্টমর্টেমটা আটকানো গিয়েছে।
জয়ন্ত বলল, “আমি তাহলে আসি স্যার?”
রঞ্জন বলল “আরে দাঁড়ান। আমি নামিয়ে দিয়ে আসি?”
“না থাক। ধন্যবাদ।”
“ভালো থাকবেন মল্লিক বাবু। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আপনার ওসি সাহেবকেও না। টেপরেকর্ডারটা থাকল। আবার দেখা হবে। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।”
জয়ন্ত নেমে গেলেন। ল্যান্ডরোভারের দরজা আটকে মেইন গেটের দিকে যেতে থাকলেন। খুব দ্রুত খাইরুলের সাথে দেখা করতে হবে। তিনি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে জিনিস দুটো স্পর্শ করলেন।
ল্যান্ডরোভারটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত মেইন গেটের বাইরেই অপেক্ষা করবেন তিনি। তারপর জিনিসটা খাইরুলকে দিতে হবে। একটা চাবি। ড্যাশবোর্ডের ভেতরে রাখা চাবির হ্যাঙার ব্যাগ থেকে হাতিয়েছেন। একটা মোক্ষম প্রতিশোধ নেওয়া গিয়েছে। কিন্তু জয়ন্তর অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ পেল না। আর টেপরেকর্ডারের ক্যাসেটটাও তিনি সরিয়েছেন। তিনি এখন মুক্ত। চাবিটা খাইরুলকে দিয়ে এই টেপরেকর্ডারের ক্যাসেটটা নষ্ট করে দিয়ে নিউজ করবে জয়ন্ত। লোকটার চৌদ্দ গুষ্টির সন্ধান বের করে ছাড়বে সে।
কিন্তু জয়ন্ত তখনও জানে না এই চাবিটার মূল্য কত!
ডাঃ শফিক তখনও মেইন বিল্ডিং পর্যন্ত পৌঁছাননি। খাইরুলও পৌঁছাননি ডাঃ শফিক পর্যন্ত। জয়ন্তও পৌঁছাননি মেইন গেট পর্যন্ত। রঞ্জন ল্যান্ডরোভারে স্টার্ট দেননি। তিনি মেজরকে ফোন করে সুখবরটা জানাবেন। তারপরে যাবেন। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। নাস্তা করতে হবে।
হঠাৎ একটা কালো টয়োটা এসে ডাঃ শফিকের সামনে থামলো। চোখের পলকে ডাঃ শফিককে তুলে নিয়ে বিদ্যুৎ বেগে মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। একজন অন্যমনস্ক লোক কালো টয়োটার ধাক্কায় ছিটকে পাশের চায়ের দোকানগুলোর ওপরে গিয়ে পড়ল। পানির ড্রাম উল্টে যাওয়ার বিকট শব্দ হল। লোকটার মাথা ঠুকে গেল প্রাচীরে। গল গল করে রক্ত বেরোতে লাগল।
রঞ্জন ল্যান্ডরোভারের ভেতরে বসে পাথরের মত সম্পূর্ণ ঘটনাটা দেখলেন। যেন দুই সেকেন্ডের একটা সিনেমা হয়ে গেল তার সামনে। তারপর গেটের কাছে ভিড়ে জমে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
খাইরুল দৌড়াতে দৌড়াতে মেইন গেটের কাছে গেলেন। ভিড় ঠেলে দেখলেন, জয়ন্ত রাস্তায় পড়ে কাঁপছে। মাথা ফেটে গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছে রক্ত। খাইরুল তাড়াতাড়ি জয়ন্তকে কোলে তুলে হাসপাতালের দিকে দৌড় দিলেন। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন লোক নিজের শার্ট খুলে জয়ন্তর মাথার ফাটা অংশে চেপে ধরল।
জয়ন্ত অস্ফুট স্বরে খাইরুলকে বলল, “পকেটে…… চাবি…… স্যার আমার পকেটে…… চাবি…… লোকটা…….”
খাইরুল জয়ন্তর চোখে চোখে রেখে বলল, “কিচ্ছু হবে না জয়ন্ত। আমি আছি। আমি আছি। কেউ একটু পানি আনো। পানি আনো তো।”
খাইরুল জয়ন্তকে ইমার্জেন্সীতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। একটা টেপরেকর্ডারের ভাঙা ক্যাসেট পাওয়া গেল। তারপর জয়ন্তর প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে যেটা পেলেন সেটা দেখে তার মাথায় বাজ পড়ল। এই চাবিটার কথাই মেরিলিনা বলেছিল। তার হারানো ব্যাগের ভেতরে এই চাবিটা থাকার কথা। কিন্তু মল্লিক চাবিটা পেল কোথা থেকে? তাহলে কি ব্যাগ বেহাতে পড়েছে? আর ব্যাগ বেহাতে পড়া মানে মেরিলিনারও বিপদে পড়তে বেশি দেরি নেই।
মুহূর্তের ভেতরে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। খাইরুল হোটেল সুকর্ণে ফোন করলেন।
হোটেলের রিসিপশনের ফোনটা ধরল এক ভদ্রলোক। তার কাছে মেরিলিনাকে চাইতেই মেরিলিনাকে পাওয়া গেল।
“হ্যালো খাইরুল সাহেব নাকি? আপনার অপেক্ষাই করছিলাম। ব্যাগটা পাওয়া গিয়েছে?”
“মেরিলিনা। হোটেলের রুম থেকে একদম বের হবেন না। একদম না। আমি আসছি।”
“কিন্তু আমি তো…”
মেরিলিনার কথা শেষ হল না। লাইনটা কেটে গেল।