গৌড়ানন্দ কবি ভনে

প্রোফেসার পাংচু’স্ ওয়ানডার ইনক্

প্রোফেসার পাংচু’স্ ওয়ানডার ইনক্

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মন্ত্রীর (পুরোমন্ত্রী, তিনপো-মন্ত্রী এবং আধা-মন্ত্রী) বিরুদ্ধে যে একশ তিরিশটি অভিযোগ বিচারপতি ওয়াঁচুর কাছে বাছাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল সেগুলি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে মাননীয় ওয়াঁচু তার মধ্যে মাত্র দশটিকে তদন্তযোগ্য বলে গ্রহণ করেছেন।

আমাদের ইমেজ-সচেতন মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে এই সংবাদ, অভিযুক্ত মন্ত্রীদের নাম এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিবরণ পেশ করলে মন্ত্রীদের মধ্যে রীতিমতো বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। রাজ্যের কয়েকজন মন্ত্রী তো স্পষ্ট বলেই ফেলেন যে বিচারপতি ওয়াঁচু, গুরুতর অভিযোগগুলি চেপে গিয়ে’ কতকগুলো ‘বাজে’ অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের সুপারিশ করেছেন।

বিচারপতি ওয়াঁচুকে যাঁরা জানেন, তাঁরা দৃঢ়ভাবে বলছেন, মাননীয় ওয়াঁচু অত্যন্ত বিচক্ষণ বিচারক। তাঁর দ্বারা এই রকম কাজ সম্ভবই নয়। আমাদের মন্ত্রীদের যাঁরা চেনেন তাঁরা বলছেন, আমাদের কয়েকজন মন্ত্রী তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এই তালে বিপাকে ফেলবার জন্য যে সব মোক্ষম অভিযোগ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে মুসাবিদা করে ওয়াঁচু সাহেবের কাছে বেনামে পাঠিয়েছিলেন। তাহলে সেগুলো গেল কোথায়? আবার আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা জানেন তাঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কার্যকলাপ সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তিনি কারচুপি করার লোক নন।

আমরা যারা তিনপক্ষকেই জানি, তারা বিশ্বাস করি যে তিন পক্ষের কথাই ঠিক। তাহলে? এখন সকলের কাছেই ঐ এক প্রশ্ন : গুরুতর অভিযোগগুলো গেল কোথায়?

এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির সদুত্তর পাবার আশায় আমি এককভাবে তদন্ত শুরু করি। এবং এই ব্যাপারে আমাকে কয়েকবার দিললিতেও দৌড়তে হয়েছে। মাননীয় ওয়াঁচু একশ ত্রিশটি অভিযোগের মধ্যে যে একশ কুড়িটি অভিযোগ দলা পাকিয়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলেন, আমি অশেষ নৈপুণ্য সহকারে রদ্দিওয়ালাদের কাছ থেকে তা ওজন দরে কিনে নিই। তারপর সেগুলো সতর্কভাবে পাঠ করে দেখি ওগুলোর মধ্যে কোনও অভিযোগই ছিল না। সব কটিই বিশেষভাবে রচিত প্রশংসাপত্র। নিম্নে বাছাই করা তিনখানি প্রশংসাপত্রের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হল। যথা :

১নং প্রশংসাপত্র : … দফতরের পূর্ণমন্ত্রী… মহাশয় অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। অত্যন্ত সৎ স্বভাব। গরিব এবং বেকার যুবক দেখিলে তাহাদের উপকারের জন্য এমন আকুলি বিকুলি করিতে থাকেন যে গরিব এবং বেকারগণ চক্ষুলজ্জাবশত তাঁহার ত্রিসীমানায় ঘেঁষিতে চাহে না। ইঁহার আরেকটি গুণ সকলেরই অনুকরণযোগ্য। পেট্রোলের দাম যেদিন হইতে বাড়িয়া গিয়াছে সেইদিন হইতে তিনি সরকারের খরচ কমাইবার জন্য সরকারি গাড়িখানি মাত্র তাঁহার স্ত্রীর ব্যবহারের জন্য ছাড়িয়া দিয়াছেন। এবং দেশের কাজে যাতায়াতের জন্য জনৈক ধনীর গাড়ি বাজেয়াপ্ত করিয়া লইয়াছেন।। পাবলিক চাঁদা করিয়া তাঁহার পেট্রোলের দাম তুলিয়া দিতেছে…

২নং প্রশংসাপত্র : …দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী… মহাশয় অতিশয় দক্ষ, কর্মঠ এবং নির্লোভ। কালোবাজারী, মুনাফালোভী এবং সমাজবিরোধীদের নিরন্তর হিতকথা শুনাইয়া স্বপথে আনিয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার অক্লান্ত চেষ্টায় ইহারা এখন দেশের কাজে মনোনিবেশ করিয়াছে।…

৩নং প্রশংসাপত্র. : … দফতরের উপমন্ত্রী মহাশয়কে কিছুতেই প্রলোভনের বশীভূত করা সম্ভব হয় নাই। তিনি কত লোককে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করাইবার জন্য লাইসেন্স পারমিট পাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ কত লোকে কত টাকা কত দান সামগ্ৰী লইয়া তাঁহাকে প্রণামী দিতে গিয়াছে। কিন্তু তিনি কোনোদিন তাহা হাত দিয়া স্পর্শ করেন নাই…

সৎ কাজ বিচারযোগ্য নয় তাই বিচারপতি মহাশয় এই ধরনের প্রশংসাপত্রের সবগুলোই ফেলে দিয়েছেন। ওয়াঁচু সাহেবের কোনো ত্রুটিই আমি পেলাম না। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ মহল হলফ করে আমাকে জানান, তাঁদের মন্ত্রীরা যা মুসাবিদা করেছিলেন তা আদৌ প্রশংসাপত্র নয়, সেগুলো সবই সুস্পষ্ট অভিযোগ।

তাহলে সেসব অভিযোগ গেল কোথায়? তবে কি (এক) মাঝপথে কেউ হাত সাফাই করে তা বদলে দিল? (দুই) খাম থেকে অভিযোগপত্র বের করে নিয়ে তার বদলে প্রশংসাপত্রগুলো ভরে দিল?

না, তাও নয়। কারণ ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞগণ আমাকে জানান, যে কাগজ এবং যে কালিতে মূল অভিযোগ লিখিত হয়েছিল। এই প্রশংসাপত্রগুলির কাগজ এবং কালি হুবহু এক। হস্তলিপি বিশারদরা জানালেন, হাতের লেখাও জাল নয়। তবে?

ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দ্বিতীয় রিপোরটে দুটি নতুন সূত্র পাওয়া গেল।

সূত্র ১ : বিচারপতি ওয়াঁচুর কাছে যে ১৩০টি তথাকথিত অভিযোগ জমা পড়েছিল তার সব কটিই একই কালিতে লেখা এবং সে-কালি বাজারের কোনও প্রচলিত সাধারণ কালি নয়।

সূত্র ২ : বিচারপতি ওয়াঁচু যে দশটি অভিযোগ তদন্তযোগ্য বলে মনে করেছেন মাত্র সেই দশটিই লাস্ট মোমেন্টে জমা দেওয়া হয়েছে।

এই সূত্র দুটি ধরে রহস্যভেদের জন্য আমি নতুন করে তদন্তে প্রবৃত্ত হই এবং সেই সূত্রেই একদিন প্রোফেসর পাংচু’স ল্যাবরেটরির সন্ধান পাই।

প্রোফেসর পাংচু অথবা পাঁচু প্রশংসাপত্রগুলি দেখামাত্র কালি সনাক্ত করেন।

‘হ্যাঁ, প্রত্যেকটা দরখাস্তই প্রোফেসর পাংচু’স ওয়ানডার ইনকে লেখা।’

‘ওয়ানডার ইনকের সঙ্গে বাজারের অন্যান্য কালির কি তফাৎ কিছু আছে?’

‘একেবারে গুণগত তফাৎ। সাধারণ কালিতে খারাপ ভালো যে জিনিস লিখবেন সেই লেখা বদলায় না। প্রোফেসর পাংচুস ওয়ানডার ইনকে খারাপ কথা লিখলে অটোমেটিক ভাবে সেগুলো সব ভাল-ভাল কথা হয়ে ওঠে। এই কালিতে নালিশ লিখলে তা প্রশংসা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন কেউ আপনার নামে লিখিত অপবাদ দিল, লোকটা ঘুষ নেয়। সাধারণ কালিতে লিখলে ও লেখা আর বদলাবে না। কিন্তু আপনি ওয়ানডার ইনক ব্যবহার করুন। তেরাত্তির পেরুবার সঙ্গে সঙ্গে ‘লোকটা ঘুষ নেয়’ কথাটা বদলে গিয়ে দাঁড়াবে, ‘লোকটা অত্যন্ত সৎ স্বভাব।’

‘বুঝলাম। কিন্তু দশটা অভিযোগ বদলালো না কেন?’

‘তেরাত্তির পেরুবার আগেই লেখাগুলো পড়া হয়ে গেছে বলে। একবার আর বদলায় না। তবে আমার এই অত্যাশ্চর্য কালির গুণটা দেখেছেন। অভিযোগগুলোকে এমনভাবে নরমে দিয়েছে যে ভাবমূর্তি ওতে নষ্ট হয় না।’

‘দারুণ ব্যাপার মশাই। দুর্দান্ত আবিষ্কার।’

‘মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যই জান লড়িয়ে এই আবিষ্কার করেছি।’

‘তা বেশ করেছেন। কিন্তু সবাইকে দিয়ে এই এক কালিতে লেখালেন কী করে?’

‘ওটা প্রোফেসর পাংচু’স ওয়ানডার ইন্কের ট্রেড সিকরেট। মন্ত্রগুপ্তি ফাঁস করলে ব্যবসা জমবে না। বুঝলেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *